ওরা!
ওরা এসে দেখবে আমরা নেই।
মীনা, জবা এবং মানু মাঠ পার হয়ে চলে যাচ্ছে। এবং যদি কোনো গ্রহান্তরে টেলিপ্যাথি থাকে, ধরা যাবে, সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে এক যুবক দুজন যুবতীর পিছু পিছু খাবার লোভে হেঁটে যাচ্ছে।
জবা মীনা গান গাইছে। হাত ধরাধরি করে ওরা দুজনে গান গাইতে গাইতে হেঁটে যাচ্ছে। শরীরে ভারি আনন্দ হিল্লোল। কোষে কোষে রন্ধ্রে রন্ধ্রে ওরা বিহ্বল হয়ে পড়ছে। গানের ভেতর কেবল কিছু পাওয়ার জন্য পাগল।
এগারো
জয়া বলল, আর কতদূর?
আয় না। বলে একটা সরু গলিতে কালিদাস ঢুকে গেল। তারপর পানের দোকান থেকে দুটো সিগারেট কিনে জয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, পান খাবি?
মিষ্টি পান খাব।
এই তিনটে মিঠে পাতা লাগাও।
কালিদাস পকেটে খুচরো খুঁজছিল।
জয়া বলল, আর কে কে আসছে?
বিনয় বলল, অনেকের তো আসার কথা। না এলে বোঝা যাবে না।
জয়া এলিভেটেড সু পরেছে। মাঝারি ধরনের লম্বা শরীর, মনে হয় জয়া সবার থেকে লম্বা থাকতে চায়। সু পরায় মোটামুটি লম্বাই হয়ে গেছে। কালিদাস বেঁটে মতো মানুষ—ওর মাথা ছাড়িয়ে উঠে গেছে জয়া এবং সারাক্ষণ তার দেহ থেকে ক্রিমের একটা সুন্দর গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। কালিদাস বিনয় পিছনে পিছনে এসেছে গন্ধটা শুকতে শুকতে। প্রায় দুটো কুকুরের শামিল—এবং জয়ার পিছনটা এত মনোরম যে সারা রাস্তায় ওরা আর কোনো দৃশ্য দেখেনি। শাড়ি সিল্কের হলে যা হয়, পিছনে লেপ্টে থাকে। ফলে চলার সময় শরীরের সঙ্গে শাড়িটার বেশ একটা ছন্দ থাকে। এই ছন্দ যে কত আনন্দের বেদনার এবং দুঃখের তারা এখনও জানে না।
বিনয় বলল, জয়া, ওই ছেলেটি কে রে?
ও মানু। খুব ভালো ছেলে। জয়া বলল, তোদের মতো না। তোরা তো কবিতা লিখিস। মানুর ওসব বাই নেই। ভালো ছেলে। ওর চাকরি হলে আমাকে বিয়ে করবে বলেছে।
কালিদাস বলল, আমরা কী দোষ করলাম?
তোরা তো বলিসনি বিয়ে করবি।
আজই বলে রাখলাম।
বিনয় বলল, জয়া তোর পান।
সে পানটা হাতে নিয়ে খুলে দেখল। চুন বেশি হলে গাল পুড়ে যায়। দেখল ঠিকই আছে। আরও দু’কুচি ভাজা সুপারি চেয়ে নিল হাত পেতে।
বিনয় বলল, আমি পান খাচ্ছি না। রেখে দিচ্ছি।
বললেই পারতিস কিনতাম না। কালিদাস দু’টো পান এবং সিগারেটের পয়সা দিয়ে দিল।
জয়া দেখেছে বিনয়ের একটা অদ্ভুত স্বভাব আছে। আরও দুবার তাকে নিয়ে দু—জায়গায় কবিতা পাঠের জন্যে গেছে। পান কিনে খেয়েছে। বিনয় খায়নি। বিনয় হাত পেতে বলেছে, জয়া দে। প্রথম দিন সে বুঝতে পারেনি, সে বলেছিল, কী দেব! বিনয় পানের ছিবড়ে চাইছে। এবং জয়া বলেছিল, কী কাঙাল রে তুই!
কাঙাল কী। তোর এঁটো খেতে আমার ভালো লাগে। তারপর এক সময় অবসর বুঝে বলে ফেলেছিল, জয়া, তুই আমার একটা কথা রাখবি?
কী কথা!
তোর জিভের ডগা থেকে আমি একটু পান নেব।
ঠিক আছে, নিস।
এবং এক বিকেলে কলেজস্ট্রিট থেকে একটা দামি পান কিনে সত্যি সে সোজা চলে গিয়েছিল জয়াদের বাড়িতে। জয়ার বাবা অফিসে। জয়ার পিসি স্কুলে। মা রুগণ। দিনরাত শুয়ে থাকে। এবং জয়ার একমাত্র সঙ্গী বাঘা পায়ের নিচে শুয়ে ঘুমোচ্ছিল। তখন শহরের রাস্তায় সবে মাত্র আলো জ্বলে উঠছে। বিনয় বেল টিপে ধরতেই দরজা খুলে গেল। জয়ার পরনে মখমলের পোশাক। একেবারে লম্বা গাউনের মতো পায়ের পাতা অবধি। হাতে রুপোর বালা। চুল ঘোড়ার লেজের মতো টান করে বাঁধা। বিনয় ঢুকেই খুব ফিস ফিস গলায় বলেছিল, এনেছি।
কোনো নিষিদ্ধ বস্তু নিয়ে যেন সে ঢুকেছে। চোখে মুখে খুব একটা থমথমে ভাব। —তুই, একা আছিস তো?
কী হবে একা থাকলে।
বিনয় কলাপাতার ভাঁজ থেকে একটা পানের খিলি বের করে বলেছিল, নে খা।
পান খেলে ঠোঁট টুকটুকে লাল হয় না জয়ার। জয়া কতদিন ঠোঁট উলটে দেখেছে। মোটেই লাল হয়নি। সে বলল, ঠোঁট লাল হবে তো?
হবে। খা না। কে আবার এসে পড়বে তখন আর হবে না। তাড়াতাড়ি খা তো—
জয়া খেতে খেতে প্রায় সবটাই খেয়ে ফেলেছিল। বিনয় দেখছে। —এই রে সবটা খেয়ে ফেলেছিস! কী কথা ছিল?
ও! বলেই জয়া উঠে দাঁড়িয়েছিল। নে—জিভের ডগা সামান্য বের করে দিল। আর বিনয় কাছে আসতেই আবার জিভটা ভেতরে পুরে ফেলল। বিনয় হতাশ গলায় বলেছিল, এই জয়া এমন করিস না। মাইরি, মরে যাব। জয়া খুব কুঁচকে বলেছিল, তুই দাঁত মাজিস না।
আজকাল রোজ দাঁত মাজি। বিনয় দাঁত বের করে দেখিয়েছিল।
আচ্ছা নে।
জয়া মা কালীর মতো অনেকটা জিভ বের করে রেখেছিল। এবং মিষ্টি পানের অতীব সুমধুর গন্ধ। বিনয় জিভ থেকে সবটা চেটে খেয়ে বলেছিল, কী আরাম! জয়া তোরা যে কী না! তোরা আমাদের দেখছি মেরে ফেলবি।
কালিদাস তখন বলল, এসে গেছি।
দরজায় নীরদ দাঁড়িয়ে। সতরঞ্চি পাতা। দু—একজন ইতিমধ্যে এসে গেছে। জয়া চেনে না এদের। নীরদ বলল, জয়া, ভিতরে বস গিয়ে। নীরদ ওদের তুলনায় সামান্য বেশি বয়সের মানুষ। এবং গলায় একটা গম্ভীর স্বর রেখে দেয় সব সময়। কবিতার ক্ষেত্রে সে কিছুটা অভিভাবকের মতো। ওরা সবাই নীরদদা বলে ডাকে। সব কবিতার আসরেই মানুষটিকে দেখা যায়। নিজে খুব ভালো কবিতা লিখতে পারে না। তবে কবিতা—অন্ত প্রাণ। ভালো কবিতা কী, মানুষটা বোঝে। এবং এই কবি অন্তপ্রাণ মানুষটিকে জয়া শ্রদ্ধা করে। মান্য করে। সে ভেতরে ঢুকে ভালো মেয়ের মতো বসে পড়ল। খাতাটা এক পাশে।