জবা বলল, এই!
মীনা বলল, এই কী ভাবছেন?
মানু বলল, গন্ধ পান না?
জবা বলল, হ্যাঁ, পাই?
কীসের গন্ধ পান?
মুচকি হাসল জবা। বলল, আপনি কোথাকার কী লোক, বলব কেন?
খুব খারাপ লোক না। ভুবনেশ্বরে আমার একটা সেলস এম্পোরিয়ামে কাজের কথা চলছে। কাজটা হয়ে গেলেই সুন্দর মতো কোনো মেয়েকে আমি ভালোবেসে ফেলব ভেবেছি।
এ রাম! এখনও বাসেননি!
এখন তো সবাইকে ভালো লাগে। সুন্দর দেখলেই ইচ্ছে করে হাত ধরতে।
আমাদেরও ইচ্ছে করে।
সে বোকার মতো তাকিয়ে বলল, কী ইচ্ছে করে?
জবা বলল, কী পাজি, সব জানতে চায়। আপনাকে বলব কেন?
মানু বলল, বলুন না, এখানে তো আর কেউ শুনতে আসছে না।
মীনা বলল, কিছু বলিস না রে পেয়ে বসবে।
জবা বলল, ন্যাকা।
মানু মীনার দিকে তাকিয়ে বলল, আচ্ছা আমাকে ন্যাকা মনে হয়। তারপর কিছুই না ভেবে বলল, বসুন না। দাঁড়িয়ে আছেন কেন।
জবার বসতে অসুবিধা নেই। সে জিনস পরেছে। হাফ—হাতা টপ পরেছে। গলায় সরু সোনার হার। পুষ্ট শরীরে সব কিছু বাড়বাড়ন্ত। প্রতিটি নখে সুন্দর রূপালি পালিশ। আঙুল সরু সরু আর লম্বা। হালকা একটা রুপোর আংটি কড়ে আঙুলে। চুল শ্যাম্পু করা, কিছুটা বাদামি রঙের। সে সহজেই বসে পড়তে পারল।
মীনার লাল শাড়িতে রুপোলি চুমকি বসানো। হাতের বটুয়া লাল রঙের। বগলকাটা ব্লাউজ লাল রঙের। গলায় লাল পাথরের মালা। সে বসার সময় প্রথমে হাঁটু মুড়ে বসল। তারপর শাড়ি টেনে পায়ের পাতা ঢেকে দিল।
মানুর মনে হল সহসা চারপাশে একটা স্বপ্নের পৃথিবী তৈরি হয়ে যাচ্ছে। কথা বললে সে ওদের জিভ দেখতে পাচ্ছে। টকটকে লাল! এদের দুজনের কেউ কনস্টিপেসনের রুগি নয়। যেমন তার বাবা মা এবং আজকাল দাদাও আয়নায় জিভ দেখে। পাকস্থলী পরিষ্কার রাখার জন্যে ঘুম থেকে উঠেই ত্রিফলার জল খায়। আসলে জবা মীনাদের শরীরের সব কোষগুলোই দারুণ তাজা! রক্তকণিকারা মাথা কুটে মরছে হাওয়া খাওয়ার জন্য।
বিকেলের মাঝামাঝি সময়। বেশ হাওয়া দিচ্ছে। গাছটা মাথার ওপর ছায়া দিচ্ছে নিরন্তর। দুটো একটা পাখি ডাকছিল। মানু পা গুটিয়ে বসেছিল। জবা মীনা মাঝে মাঝেই দূরে কিছু দেখছে। ওদের আসার কথা, ওরা আসছে না কেন! অথচ অন্যদিন ওরা এসে দেখেছে, গোপাল পিন্টু বসে আছে অথবা পায়চারি করছে। ট্রাম অথবা বাস থেকে নামতে না নামতেই ওরা দৌড়ে এসেছে। অবশ্য সব সময়ই এটা হয় না। আবার কোনোদিন ওরা আগে চলে এসেছে। আসলে কত আগে বের হওয়া যায়, বাড়িতে সময় কাটে না, রাস্তায় বের হতে পারলেই, কী যেন হিল্লোল বয়ে যায় শরীরে।
মানু মাঝে মাঝে চোখ তুলে দেখছে। মানুষের জীবন ভারি মায়াবী। জবা মীনাকে আর মনেই হয় না অপরিচিত। যেন সে তাদের কতবার দেখেছে, কত কালের চেনা। দূরে ভিক্টোরিয়া স্মৃতিসৌধ, সামনে সমান উঁচু ম্যাচ বাক্সের মতো বাড়িগুলো। ট্রামের ট্রাকশানে কখনও বিদ্যুতের ঝিলিক। পিছনে ফোর্ট উইলিয়াম। এবং কত প্রাচীন অথবা নবীনা এই শহর।
মানু বলল, হাফ—হাতা টপে আপনাকে দারুণ মানিয়েছে।
জবা নিজের বুকের দিকে তাকাল। বুকটা ধুকপুক করছে।
মীনার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনাকে শাড়িতেই বেশি সুন্দর দেখায়। এটা আপনি বোঝেন কী করে!
মীনা হাঁটুর ওপর হাত রেখেছে আড়াআড়িভাবে। চিবুক রেখেছে হাতের ওপর। মীনা সোজা তাকিয়েই বলল, আমাদের খুব ভাগ্য ভালো!
মানু বলল, এ বয়সে মেয়েদের ভাগ্যটা ভালোই থাকে।
সে কথা বলছি না মশাই। বলছি, ভাগ্যিস তার সঙ্গে আপনার দেখা হয়নি।
দেখা হলে কী হত?
স্বার্থপর হয়ে যেতেন না। আমরা যে আছি একবারও চোখ তুলে দেখতেন।
মানুর কী রকম যেন একটা বড় রকমের ব্যথা বুকের গভীরে বেজে উঠল। একটা ভারি দীর্ঘনিশ্বাস বয়ে গেল সত্যি। জয়ার কবিতা পাঠ বোধহয় জীবনেও শেষ হবে না। সে সত্যি কথা বলে ফেলল, আসলে মানুষ বোধহয় পবিত্র হয়ে গেলে কিছু আর গোপন রাখতে পছন্দ করে না। —জয়ার সঙ্গে শো দেখব বলে এসেছিলাম। হাউসে দেখা হতেই জয়া বলল, বাড়িতে দুজন কবি হাজির। কবিতা পাঠ আছে। আমাকে ফেলে ওদের সঙ্গে জয়া চলে গেল।
আর সেই থেকে একা ঘুরছেন? জবা বলল, আমরা হলে মারামারি করতাম।
মানু বলল, পারতেন।
খুব পারতাম।
মানু নীচের দিকে তাকাতে পারছে না। সেই জঙ্ঘার সন্ধিস্থলে দামি টেরিকটনের ভাঁজটা ওকে মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক করে দিচ্ছিল। এবং সে চুরি করে যতবার সেদিকে তাকাতে গেছে, জবার চোখে চোখ পড়ে গেছে। তার মুখ অতর্কিতে জ্বলে উঠেই আবার নিভে গেছে।
আপনার লাভার বুঝি পদ্য লেখে?
লাভার! তা লাভারই বলতে পারেন। খুব লঘুস্বরে লাভার বললে, ছোটই করা হয় জয়াকে। সে মনে মনে বলল, আমি ঠিক কিছুই জানতাম না। জয়া চোখে চুমু খাবার পরই আমার মাথা গোলমাল হয়ে গেছে। আগে তো রোয়াকে বসে আড্ডা মারতুম, মেয়েদের দেখলে আমার বন্ধুরা টপ্পা গাইত, শিস দিত, কিন্তু জয়াটা আমার চোখে চুমো খেয়ে যে কী করল এটা! জয়ার কথা ভাবলেই মাথা এখন ঝিম ঝিম করে। চোখ বুজলে জয়াকে দেখতে পাই। দু’জনে আমরা একটা কিছু করে ফেলব এবার।
মীনা বলল, এই আবার আপনি ভাবতে শুরু করেছেন।
আমাকে বলছেন!
তবে কাকে? চলুন উঠুন। কোথাও বসে একটু খাওয়া যাক।
আমাকে আপনারা খাওয়াবেন!
আসুন না। দেখি কতটা কী খাওয়াতে পারি।