আমার কলেজ আছে। সময় হবে না। মাসি আমার জামা প্যান্ট কোথায়!
মিতা লম্বা ম্যাকসি পরে আছে। চুল ঘাড় পর্যন্ত বর করা। চোখে বাসি আই ল্যাস। রাতে ভালো ঘুম হয়নি। চোখের নীচে রাজ্যের অন্ধকার। দিদিমা কলতলায় কাউকে বকছে। ঠিক এই সময়ে সহসা ছোটমাসির মুখটা বুড়ি হলে কী রকম দেখাবে—এই দিদিমার বয়সে, এবং ভেবেই সে বুঝতে পারল, আগামী ২০২০ সালের ২২ এপ্রিল ছোটমাসি দেখতে হুবহু দিদিমা—যতই চামড়া টান করার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বের হক—ছোটমাসিকে কেউ আর ছোটমাসি রাখতে পারবে না। বুড়ি দিদিমা, গালে মাংস নেই, ফলস দাঁতে যখন হাঁ করবে—তখন শরীরের সবকিছু জারিজুরি ধরা পড়ে যাবে। সে বলল, মাসি তুমি হাঁ কর তো?
মাসি বলল, হাঁ করে কী হবে?
হাঁ করই না, দেখব।
কী দেখবি?
কোথাকার জল কতদূর গড়াবে ভেবে মিতা বলল, দেখে কী হবে?
কটা দাঁত আছে গুণে রাখব।
দাদু সহসা উঠে দাঁড়ালেন। না, পারা যাচ্ছে না। নানু আমার সঙ্গে এসো।
কোথায়।
চল বসার ঘরে। আমার কিছু বই আছে ওগুলো তুমি গুণবে। তখন নানু ভাবল এক সময় একটা লাইব্রেরি গড়ে তুলেছিলেন দাদু। কপালকুণ্ডলা উপন্যাস মা প্রথম দাদুর লাইব্রেরি থেকে পায়। দাদুর চিন্তাশক্তি, কিংবা বলা যায় বুদ্ধিমত্তা অত্যন্ত প্রখর। দাঁত না গুণে বই গুণতে বলছে। বুড়োটা বড় বেশি চালাক। সে বলল, দাঁত গোনা আর বই গোনা এক কাজ দাদু? তুমি বল, এক কাজ কী না?
রাসবিহারীর কপাল ঘামছিল। ছটি জীবিত কন্যার জনক তিনি। মরে গেলে জামাতারাই তার এই সম্পত্তির মালিক হবে। তিনি এখন তা চান না। কারণ নানু কেন জানি বুকের মধ্যে একটা জায়গা নিয়ে বসে যাচ্ছে। সেই জামাইয়ের মৃত্যু দিন থেকেই—তখন নানুর বয়স আর কত। একটা জাবদা খাতায় তাঁর সব কিছু লিখে রাখার অভ্যাস। তিনি লিখেও রেখেছিলেন। ওটা খুলে আর একবার দেখা দরকার। বেঁচে থাকতে থাকতে আর দুটি কাজ তাঁকে সম্পূর্ণ করে যেতে হবে। এক নম্বর মিতার বিয়ে, দুই নম্বর নানুর জন্য ভালো একটা কাজ এবং সুন্দর টুকটুকে নাত—বউ। তাহলে মোটামুটি লাইফ—সারকল সম্পূর্ণ। একজন মানুষের পৃথিবীতে আর কী লাগে!
মিতার বিয়ের জন্য ভালো একটা ছেলে পেয়েছেন। খোঁজখবর নিতে হবে পাত্রপক্ষ যা চায় মিতার সে—সব গুণ ষোলো আনা আছে। দাবি দাওয়া যথেষ্ট। পাত্র দেখা হয়নি। সেজ—জামাইয়ের অফিসের ক্যালকাটা ব্রাঞ্চে ছেলেটা কাজ করে। এই সব কথাগুলিও রাসবিহারীর মাথায় টরে টক্কা বাজিয়ে গেল। তবু কপাল খুবই ঘামছে। এক বয়সে ভাবতেন, দুটো ডাল ভাতের সংস্থান করতে পারলেই জীবন ধন্য। তারপরের কালে ভাবতেন, সন্তানগুলি বড় হলেই সব কষ্ট দূর হয়ে যাবে। এবং মেয়েরা বড় হতে থাকলে ভাবলেন, বিয়ে দিতে পারলেই লেটা চুকে গেল। কিন্তু এখন দেখছেন, নানুর কিছু একটা না হলে তিনি মরেও স্বস্তি পাবেন না। অথচ এই নানু দিনকে কী হয়ে যাচ্ছে! তিনি বললেন, কাল রাতে এত দেরি হল কেন তোমার ফিরতে?
আচ্ছা দাদু তুমি সত্যি করে বলত, তোমার ছোট মেয়ের দাঁত কটা?
আমি কী করে জানব?
বাবা হবে, অথচ খবর রাখবে না কটা দাঁত মেয়ের?
তুই যখন বাবা হবি, তখন খবর রাখিস সব কিছুর।
কী বললে!
রাসবিহারী প্রমাদ গুনলেন। নানুর চোখ ভীষণ টকটকে লাল। নানুর মাথায় রক্ত উঠে যাচ্ছে। তিনি বললেন, নানু দাদুভাই, আমার শরীর কেমন করছে।
নানু বলল, ডাক্তার ডাকব! ও ছোট মাসি!
না, না, তুই ওপরে যা! আমার শরীর এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে। তারপর মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি হাঁ করে ওকে দেখাতে পার না। তোমার এত গুমর।
নানু দাদুর দুরবস্থা দেখলে খুব স্বাভাবিক হয়ে যায়। তার চোখ দুটো আর লাল থাকল না এবং সে পাশে বসে বলল, দাদু তোমার বয়স হয়েছে। এখনও এত ভাব কেন বল তো। এ—বয়সে মানুষের ঠাকুর দেবতা ছাড়া আর কী থাকে!
নানু মাঝে মাঝে কত ভালো কথা বলে। মনেই হয় না তখন, এই শেষ বয়সের নাতিটা আত্মঘাতী হতে পারে। বরং বিবেচক, বুদ্ধিমান—নানু বড় কর্তব্যপরায়ণ। তিনি বললেন, নানু তোমার জ্যাঠামণি আজ বিকেলে আসবে। বাড়ি থেকো।
সে বলল, বাবার বড় ভাইয়ের কথা বলছ?
এই মুশকিল। কোনো কথা নানু কী ভাবে নেবে বুঝতে পারেন না রাসবিহারী। এখন যা কথাবার্তা নানুর,—তাতে মনে হয় জ্যেঠুর সম্পর্কে তার আর তিলমাত্র শ্রদ্ধা নেই। তিনি নানুর দিকে একবার ভালো করে তাকালেন। মিতা ঘরে নেই। সে কোন ফাঁকে ঘর থেকে বের হয়ে গেছে। কখন আবার নানুর মনে পড়ে যাবে ছোট মাসি দাঁত না দেখিয়েই চলে গেল! সুতরাং রাসবিহারী নানুকে কিছুটা অন্যমনস্ক করে রাখতে চাইছেন। নানুর জ্যাঠামণি অবনীশ এবং তার বউ দুজনেই আসবে। নানুর খোঁজখবর নিতে আসে। কারণ আফটার অল নানু অবনীশের ছোট ভাইয়ের ছেলে। আত্মীয়—স্বজন এমনিতেই প্রীতিশের মৃত্যু নিয়ে নানারকম কথাবার্তা বলে থাকে। আড়ালে এও শোনা যায় অবনীশের বউর স্বার্থপরতা প্রীতিশকে ভীষণভাবে মর্মাহত করেছিল। অবনীশ বিয়ে করেছিল বেশি বয়সে। ওদের এখন একটি মেয়ে। মেয়েটির বয়স আট। বউ শিক্ষকতা করে। ভালো ইস্কুলে মাস্টারি এবং কোচিং—এর আয় থেকে বেশ বাড়িঘর বানিয়ে আদর্শ স্বামী—স্ত্রী এখন তারা। অবনীশ একটা অফিসে আছে।
নানুর দিকে তাকিয়ে এতগুলি কথা রাসবিহারী মনে মনে ভেবে ফেললেন। অবনীশের কথাবার্তায় সব সময়ে খুব বিপ্লবী মেজাজ। রাজনীতি থেকে হাল আমলের সাহিত্য সম্পর্কে অগাধ পাণ্ডিত্য এবং পৃথিবীতে কোথাও কিছু হচ্ছে না, একমাত্র চীন দেশটি সম্পর্কে তার এখনও আস্থা আছে—না হলে যেন সে আর বেঁচে থাকতেও রাজি ছিল না। অবনীশ কথাবার্তা হাফ বাংলা হাফ ইংরেজি ঢং—এ বলতে অভ্যস্ত।