তখন ঘরে ঢুকে অমলা বলেছিল, কার সঙ্গে কথা বলছিসরে এত?
কেন তোমার কি ফোনের দেরি হয়ে যাচ্ছে?
অমলা বলল, খুব ফাজিল হয়েছ।
অরুণ মেসোমশাইকে বল একদিন যাব ওদের অফিসে।
কী দরকার।
চাকরি টাকরি যদি হয়।
তোমার চাকরি হলেই হয়েছে।
বোঝাই যায় নানু দুপুরে ফোনে কার সঙ্গে কথা বলছিল। খুব সংযত কথাবার্তা। কিছুক্ষণ কথা বলার পর শিস দিতে দিতে ওপরে উঠে গিয়েছিল। সে তার অমলা মাসিকে আর ফিরে তাকিয়েও দেখল না। সে জানে এখন অমলা মাসি ফোনটার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়বে।
তারপর নানু সুন্দর পোশাক পরে করিডরে পায়চারি করতে করতে মাঝে মাঝে ঘড়ি দেখছিল। তারপর একটা সিগারেট খেয়েছিল গোপনে। এবং এক সময় কী সংকেত পেয়ে নীচে নেমে বাস রাস্তার দিকে হেঁটে গেল।
তারপর নানু সিনেমা হাউসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকল। এখন সে জটিল চিন্তাভাবনা মাথায় রাখতে ভালোবাসছে না। কারণ এমন একটা আনন্দের দিন তার আসবে সে কখনও কল্পনা করেনি। বনভূমিতে ‘জ্যোৎস্না’ আসছে। ফোনের সেই সংকেত থেকে এতক্ষণ পর্যন্ত সে বড়ই অধীর। তাকে স্পষ্ট বলেছে, ঠিক আছে যাব।
তুমি একা আসবে কিন্তু!
সে কি। একা কী করে আসব। বাড়ি থেকে ছাড়বে কেন। বাবা ফিরে এসে শুনলে কী ভাববে। বকবে না? জানো, মা বলছিল নানু যেন কেমন হয়ে গেছে!
তুমি কী বলেছ?
আমি কী বলব আবার!
না, এই যদি বলে দাও লাল বলটা তোমার কাছে আছে, বলেছি। তুমি বলেছ, না নেই। আমি বলেছি, হ্যাঁ আছে—এইসব আর কি।
আমার বয়ে গেছে বলতে।
নানুর মাথার মধ্যে কথাগুলি বিজ বিজ করছিল। রাস্তা, মানুষজন, ভিড় এবং হকারদের চিৎকারের মধ্যে সে একটা লম্বা মতো মানুষ হয়ে যেতে চাইছে। সে অনেকদূর থেকে নবনীতাকে আবিষ্কার করতে চায়। কিন্তু ক্রমে সময় যাচ্ছে। এখানে সে আধ ঘণ্টার মতো দাঁড়িয়ে নবনীতাকে আবিষ্কার করতে পারল না। তবে কী নবনীতা তাকে ধোঁকা দিল।
নিজের সঙ্গে নিজের এই কথা নানুর আজন্মকালের। নানু সব সময় পৃথিবীতে একটা বাতিঘরে সুখ খুঁজে বেড়াচ্ছে। নবনীতা তার বাতিঘর। যেন নবনীতা ইচ্ছা করলেই তাকে এখন নিরাময় করে তুলতে পারে। এবং তখনই দেখল নবনীতা আসছে। বড় মহিমময়ী। শাড়ি পরেছে। কানে গোল ইয়াররিং। মনটা মুহূর্তে বিশাল সাম্রাজ্য হয়ে গেল তার। সে ছুটে গিয়ে বলল, ও এলে তবে!
কী করব, এত করে বললে না এসে পারা যায়!
কী যে ভালো করেছ না। এসো কোথাও বসে একটু খাই কিছু।
শুধু আইসক্রিম খাব।
আর কিছু খাবে না?
না। আমাকে কিন্তু ছটার মধ্যে বাড়ি ফিরতে হবে।
কী হবে না ফিরলে?
মা বাবা ফেরার আগেই যেতে হবে।
সে যেও। নবনীতা…ন…ব …নীতা।
এই কী হচ্ছে! গান করছ কেন?
কী গান করলাম।
এই যে ন—ব—নী—তা।
জানি না নবনীতা, যখনই একটু সময় পাই, তখনই জানালা খুলে আকাশ দেখি, তখনই সব আনন্দের প্রকাশ, আজকাল আমার একটি শব্দে শুধু আনন্দের প্রকাশ—
ন—ব—নী—তা!
নবনীতা ঠোঁট টিপে চোখ বাঁকিয়ে বলল, আহা কী কথা! নবনীতা না ছাই।
নানু বলল, নবনীতা, কী যে ভালো লাগছে। এমন সরল প্রকাশ, নানুর নবনীতাকে কেমন একটা টানের মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। নবনীতা পাশাপাশি হাঁটছিল। শাড়ি পরায় তাকে আর কিশোরী ভাবা যাচ্ছে না। যেমন নানুকে দেখেও বোঝার উপায় নেই সে কৈশোর পার হয়ে সবে যৌবনে পা দিয়েছে। বরং দুজনকেই পৃথিবীর আদিম নরনারীর মতো মনে হচ্ছিল। সে আর নবনীতা বুনো ফুলের গন্ধ নিতে ছুটছে। এই বয়সে মানুষের আর কিছুরই দরকার নেই—কেবল ছুটে যাওয়া হাত ধরে, কোথাও হ্রদের ধারে বসে থাকা, কখনও নদীর জলে প্রতিবিম্ব দেখা অথবা কোনো এক সবুজ পাহাড়ের মাথায় ছোট্ট ডাকবাংলোয় রাত্রি যাপন। যদি শীতের সময় হয় সামান্য উষ্ণতা চাই, গ্রীষ্মের সময়ে অজস্র বৃষ্টিপাত—নানু কত কিছু নবনীতাকে নিয়ে ভেবে ফেলে।
কিন্তু নবনীতা এখনও এতটা ভেবে দেখেনি। তার কাছে শহরটা শহরই থাকলে ভালো হয়। মাঝে মাঝে বাড়ি থেকে কিছু মিছে কথা বলে, এই একটু ঘুরে যাওয়া, আইসক্রিম খাওয়া, খুব সাহসী হলে সে ভাবতে পারে সন্ধের অন্ধকারে একটু মাঠে বসে নিরিবিলি নানুদাকে ডেকে নেওয়া। বাবা আসেন সাতটার পর, মা দিবানিদ্রা যান। তারপর ক্লাবে যান। দুপুরে কিংবা সকালে সে মাকে শুধু বলে রাখে বিকালে একটু বের হব মা। অগ্নির কাছ থেকে কিছু ক্লাস—নোটস নিতে হবে।
বাবা মাঝে মাঝে বসার ঘরে তাকে ডাকেন। এবং কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলেন, তুমি সত্যি বড় হয়ে গেছ। বিয়ে দিয়ে দেব।
আর তখনই সে বাপের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, বল, একথা আর বলবে!
সুনীল তখন তার স্ত্রীর শরণাপন্ন হয়ে বলে, দেখে যাও তোমার মেয়ে আমাকে মেরে ফেলল। বড় হয়েছে বললে কেউ এভাবে রেগে যায়।
এই বড় হওয়া যে কী মজার। যখন একা থাকে, কিংবা গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে বুঝতে পারে, তাকে কেউ কোথাও নিয়ে যাবে বলেছে। এবং সব সময়ই সে যেন তাকে বলে যাচ্ছে, আমার ভয় করে।
নানু তখন দুটো আইসক্রিম নিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে ফিরছে। একটা নবনীতার হাতে দিয়ে বলছে, নাও। নবনীতা ঠিক পদ্মকলির মতো আইসক্রিমটা ধরে আছে।
যদি কেউ দেখে বুঝবে এই নর এবং নারীর মধ্যে এখনও আশ্চর্য পবিত্রতা বিরাজ করছে। এখনও কোনো দ্বিতীয় ভূখণ্ডে ওরা পা রাখেনি। বড় সুসময় এদের এখন। এই সুসময়ে প্রীতিশ আর রাণু কুড়ি বছর আগে ঠিক এই হল ঘরটায় আইসক্রিম খেয়েছিল। কেউ না জানলেও চারপাশের ইট পাথর দালান কোঠা তার সাক্ষী। অথচ মানুষ তার পবিত্র সময় বেশিদিন ধরে রাখতে পারে না।