রাসবিহারী বুঝতে পারেন মেয়েরা তাদের মায়ের মতই। নানুর মা এখন কী করে দিন কাটায় তিনি তা বুঝতে পারেন। সংসারে সব কথা খুলে বলা যায় না। একবার নানু তার মাকে জিজ্ঞেস করেছিল—
খুব দরকার ছিল চাকরি করার!
নানুর মা বলেছিল, বারে আমার ভবিষ্যৎ আছে না।
সত্যি তো ভবিষ্যৎ বলে কথা। তিনি বোঝেন, ভবিষ্যৎ বস্তুটি কী। তিনি নিজেকে দিয়েই এটা বুঝতে পেরেছেন। ভবিষ্যৎ মানে শেষ পর্যন্ত একটা বড় ফাঁকা মাঠে দাঁড়িয়ে যাওয়া। সবাই অবলম্বন পেয়ে তাকে নিরালম্ব করে রেখে গেছে একটা পত্র—পুষ্পহীন বৃক্ষের মতো। রাসবিহারী নিজেকে এখন কোনো পত্র—পুষ্পহীন বৃক্ষের মতোই ভাবতে ভালোবাসেন। আর এ—সব কথা বেশি করে মনে হয়—যখন বুঝতে পারেন নাতিটার ভার না নিলেই ভালো হত। কিন্তু ওই যে বলে ফাঁনদে পড়িয়া বগা কান্দে। …..আর তখনই তিনি দেখলেন, নানু এদিকে আসছে। সকালের হাওয়ায় নানু বাগানে পায়চারি করতে বের হয়েছে। মুখে ব্রাস, দাঁত মাজছে—ফস ফস করে কথা বলার চেষ্টা করছে। রাসবিহারী সেই কথার এক বর্ণ বুঝতে পারছেন না।
নানু বলল, দাদু এই গরমে তোমার গাছ বাঁচবে?
বাঁচবে না কেন ভাই, বাঁচাতে জানলেই বাঁচে!
এখনও বৃষ্টি শুরু হয়নি ভালো করে।
জল দিতে হবে।
এ—সব কথা একেবারেই অকারণ। আসলে রাসবিহারী এখন নানুকে যে—কথাটা বললে খুশি হতেন সেটা হচ্ছে, তুমি রোজ রাত করে বাড়ি ফিরলে আমি খুব উদ্বিগ্ন থাকি। আরও কিছুদিন বাঁচতাম, তুমি আর তোমার মা মিলে সময়টা খুবই সংক্ষিপ্ত করে দিলে।
নানু বলল, আজ জেঠুর বাড়ি যাব ভাবছি।
তোমার জেঠু অবনীশ কাল দুপুরে ফোন করেছিল।
কী বলল?
বলল তুমি রোববারে যাবে।
আজ গেলে কী হবে?
তোমার জেঠিমার শরীর ভালো নেই।
তবে রোববারেই যাব।
তাই যেও। মানুষের সুবিধা অসুবিধা বুঝতে হয়।
সবাই কি বোঝে?
না বুঝলে চলবে কেন?
না সবাই বোঝে না দাদু। বলে মুখ থেকে সে থু থু ফেলল। তাহলে আমাকে এখানে চলে আসতে হয় কেন?
এ—সব কথায় রাসবিহারী ভীত হয়ে পড়েন। তিনি বুঝতে পারেন সংসারের সেই মৃত ছবিটা আবার নানু তুলে দেখাতে চায়। একটা জোড়াতালি দিয়ে যা তিনি ভুলতে চেয়েছেন, এবং যা কিছু তিনি মেনে নিয়েছেন, অর্থাৎ সায় না থাকলেও ইজ্জতের খাতিরে মুখ বুজে আছেন, সেই নানু আবার তা ছিন্নভিন্ন করে দিতে চায়। তিনি অন্য কথায় চলে এলেন, তোমার মুখ ধোওয়া হলে বল। একসঙ্গে চা খাব।
নানু বলল, এখন তো দেখছি মার সঙ্গে জেঠুরও খুব ভাব। প্রায়ই নাকি চিঠি দেয়। আমার খবরাখবর নেবার কথা বলে। আগে ও সব কোথায় ছিল! ভিন্ন বাড়ি দেখে জেঠু উঠে গেল কেন! আমার বাবা কি সত্যি খুব খারাপ মানুষ ছিলেন?
রাসবিহারী প্রমাদ গুণলেন। সাতসকালে নানু আবার কী ঝামেলা না বাধায়। তিনি তাড়াতাড়ি বাগান থেকে ঘরের দিকে হাঁটা দিলেন। নানু পাশে পাশে যাচ্ছে। এবং মনে হচ্ছে রাসবিহারীকে কেউ এখন তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এমন অবস্থা দেখে নানু হেসে ফেলল। বলল, অত ছুটবে না, পড়ে যাবে।
রাসবিহারী ঘাড় ফিরিয়ে বললেন, আমি দৌড়লাম কোথায় আবার।
নানু ফের খুব অমায়িক গলায় বলল, আচ্ছা দাদু তোমরা সব সময় বাবার সম্পর্কে এত চুপ থাক কেন? আমি সবই জানি। বাবার মৃত্যুর জন্য কে কে দায়ী তাও জানি যেমন ধর, এক নম্বর খুনি আসামি সেই ধুমসো ভদ্রমহিলাটি, দু নম্বর আমার মা, তিন নম্বর জেঠু। ওরা তিনজন বাবার সংসারে তিনটে ফ্রন্ট খুলেছিল। বাবা ভেবেছিলেন—একটা ফ্রন্ট খোলা আছে, সেখান দিয়ে অন্তত পালানো যাবে—কিন্তু দেখা গেল সেখানেও একজন দাঁড়িয়ে আছে।
রাসবিহারী বললেন, সেটা আবার কে?
নানু মাথা নীচু করে বলল, আমি। আমাকে দেখে বাবা নিজেকে খুব অসহায় বুঝতে পেরেছিলেন। বেশি টাকা রোজগার করবেন বলে কাজ ছেড়ে দিলেন—কারণ সংসারে তখন টাকার দরকার খুব। সংসারে বেশি সুখের জন্য বেশি টাকার জন্য বাবা ব্যাবসা করতে গেলেন এবং ফেল মারলেন। তখন বাবার চারপাশ ফাঁকা। দাদা বউদি ফ্ল্যাট নিয়ে উঠে গেছে। বাবা তবু ভয় পেতেন না। মার গঞ্জনা শুরু হল। একদিন মনে আছে, মা আমার সামনে বাবাকে বলেছিল, পুরুষের রোজগার না থাকলে বেঁচে থেকেও লাভ নেই। পাশে আমি দাঁড়িয়ে। বাবা মাথা নীচু করে ঘর থেকে বের হয়ে গেছিলেন।
রাসবিহারী বারান্দায় দাঁড়িয়ে। নানু মুখোমুখি। এমন একটা নাটকের সময় মিতা বাথরুমে শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দেখছে। হেম চা চিনি মাখন ডিম বের করে ডাকছেন, ও কালোর মা, সব নিয়ে যা।
নানু দেখল দাদু তাকে অপলক দেখছে। কেমন বিমূঢ়। শূন্য দৃষ্টি। আবার না হেসে পারল না। —দাদু, ও দাদু, খুব মিথ্যে বলেছি! তুমি অত ভয় পাও কেন। আমি তো এখন সবাইকে ক্ষমা করে দিয়েছি।
রাসবিহারীর এবার বাহ্যজ্ঞান ফিরে আসছে। নানুর মাথায় আবার রেলগাড়ি চলছে। রেলগাড়ি চলতে থাকলেই নানু অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলে। রাসবিহারী ভাবে, নানু যা স্বভাবের তাই হয়ে গেছে। তখন নানুকে আর অত খারাপ লাগে না।
রাসবিহারী খুরপিটা রাখার জন্য বাইরের দিকে আউট—হাউসে হেঁটে গেলেন। এখন হাত মুখ ধুয়ে সামান্য জলযোগ। তারপর পত্রিকা এসে যাবে এবং চা। পত্রিকা পড়তে পড়তে বেলা দশটা। তারপর চান, এবং আহার। আহারের পর দিবানিদ্রা, শেষে আবার চা এবং বিস্কুট। বেলা পড়ে এলে হাতে লাঠি এবং সান্ধ্য—ভ্রমণ। মোটামুটি জীবনের এই রুটিন দাঁড়িয়েছে রাসবিহারীর।