ছোটটা আর কিছু বলছে না। অবোধ বালিকার মতো তাকে দেখছে। বোধ হয় দয়া হল। বলল, বলে লাভ নেই কেন!
ফিরে গেছে হয়তো!
সময়মতো আসেন না কেন?
দেরি হয়ে গেল। বাস ট্রামের যা অবস্থা।
বাড়ি থেকে আগে বের হতে হয়।
আপনারা বাড়ি থেকে আগে বের হয়েছেন?
অনেক আগে। আগে এলে তো দোষের হয় না!
তা হয় না।
বড় মেয়েটার চুল কোঁকড়ানো। চোখ টানা নাক একটু চাপা। বেশ উঁচু লম্বা। প্রায় দিদির মতো হবে। শাড়ি পেটের নীচেও খানিকটা নেমে গেছে। শাড়ির ফাঁকে নাভির নীচেও বেশ কিছু অংশ দেখা যাচ্ছে। সে বলল, আপনাদের ওরা কখন আসবে?
এসে পড়বে। দশ মিনিট অ্যালাউন্স দেওয়া আছে।
মাত্র দশ মিনিট!
দশ মিনিট কতটা সময় আপনি জানেন না! ছোটটা খুক খুক করে হাসতে থাকল।
ওরা আসবে তো ঠিক?
এখনও সময় যায়নি।
একবার দেখুন না! বলে সে সেই ইঁটের টুকরোটা আবার কুড়িয়ে আনল।
ক্যাচ ধরতে পারেন?
মীনা তো প্রাকটিস করছে।
তবে আর কি। ওপরে ছুঁড়ে দিচ্ছি ক্যাচ লুফতে পারলে ওরা ঠিক আসবে।
কথাটা কতটা বিশ্বাসের বোঝা না গেলেও সময় কাটানোর পক্ষে মন্দ না। মীনা বলল, দিন দেখি।
সে বেশ উঁচু করে ছুঁড়ে দিল। মীনা খপ করে ধরতে গেলে সে দেখল তার বুক লাফিয়ে উঠল। শরীর ওর কাঁটা দিয়ে উঠল। সে ইচ্ছে করলে পাগলের মতো এখন সত্যি কিছু করে ফেলতে পারে। জাপটে ধরতে পারে। যে—কোনো যুবক এখন লম্পট হয়ে গেলেও দোষের না। ওর মাথা ঝিমঝিম করছিল। দিবালোকে একটা হত্যাকাণ্ডের জন্যে সে ক্রমে কেমন মরিয়া হয়ে উঠেছিল।
নয়
রাসবিহারী বাগানে কিছু নতুন গাছগাছালি লাগান এ—সময়টাতে। বীজ পুঁতে দেন। কলম লাগান। গাছে ফুল না ফুটলে ফল না ধরলে এ—সময় সব সাফসোফ করে নতুন গাছপালা পুঁতে যান। এই একটাই হবি এখন রাসবিহারীর। বয়স হয়ে গেছে, শরীরের সামর্থ্য কমে আসছে—তবু এই বাড়িটার প্রতি তাঁর ভারি মমতা। এবং গাছপালার মধ্যে যতক্ষণ ডুবে থাকেন ততক্ষণই তাঁর স্বস্তি। কত রকমের খবর বুড়ো বয়সের জন্য অপেক্ষা করে থাকে। মেয়েদের এক একজন এক এক রকমের খবর পাঠায়—কারও বরের বদলি, কেউ পেটের আলসারে ভুগছে, কারও ছেলে বদমেজাজি—যেন বুড়ো বয়সে কোনো ভালো খবর পেতে নেই। চিঠি এলেই অদ্ভুত শঙ্কায় ভোগেন রাসবিহারী। আর ক’মাস থেকেই মিতার ঠিক পিঠের দিদি অমলা রবিবারে এখানে চলে আসে। অরুণের রবিবারে প্রায় কাজ থাকে। সপ্তাহে একটা ছুটির দিন তাও কাজ। এবং অমলা বাড়িতে এসেই হইচই শুরু করে দেয়। সকালে মিতাকে নিয়ে বের হয়ে যায়। দুপুরে ঘুমোয়, তারপর, কাকার বাসায় যাবে বলে চলে যায়। ঢাকুরিয়ায়। সেখান থেকে বেশ রাত করে ফেরে। একদিন রাসবিহারী ছোট ভাই বঙ্কুবিহারীকে প্রশ্ন করেছিলেন, অমলার দেখছি তোমার প্রতি খুব টান। বঙ্কুবিহারী জানে অমলা ওর বাড়িতে মাসে দু—মাসে এক আধবার যায় কিছুক্ষণ থাকে, কাকিমা এবং ছোটদের বলে যায়, যাচ্ছিরে। একটু মার্কেটিং করতে যাব। কখনও বলে টিকিট কাটা আছে, কলামন্দিরে যাব। একা একা ঘুরতে মেয়েটা খুব ভালোবাসে।
ঠিক এ—সব ভাববার সময়ই মনে হল অমলা আসছে। হাতে মীনা করা বড় বটুয়া। কাঁধে ব্যাগ। ওতে ওর রাতে পরার জন্য শাড়ি সায়া ব্লাউজ থাকে। এক সময় সান্টু আসত খুব এ—বাড়িতে। সান্টু তার ছোট বোনের দেওর। অমলার বিয়ের পর সান্টুর এ—বাড়ি আসা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ইন্ডিয়ান অকসিজেনে সান্টুর ভালো মাইনের চাকরি অথচ তখন কেন যে অমলার পছন্দ না সান্টুকে তিনি এখনও তা বুঝে উঠতে পারেন না। অথচ একটা প্রবল টান রয়েছে দু’জনের মধ্যে, এবং এটা তিনি নিজে ঠিক চোখে না দেখলেও কোনো এক গোপন খবর থেকে তা টের পান।
ইদানীং এখানে আসা অমলার বেড়ে যাচ্ছে কোন টানে বুঝতে কষ্ট হয় না। অমলা এসেই যেমন বাবাকে প্রণাম করে তেমনি প্রণাম করে সোজা ভিতরে ঢুকে গেলেই আবার একটা প্রবল শঙ্কা সেই বুকের মধ্যে গুড় গুড় করে উঠল।
সেদিক থেকে স্ত্রী হেম খুব সুখে আছেন। তার এখনও একটাই কাজ—বাড়ির রান্নাবান্না এবং ঠাকুর চাকরের প্রতি সজাগ সতর্ক চোখ। হেমের বিশ্বাস, এরা সবাই দুর্বৃত্ত। সংসারের সব জিনিস গোপনে চুরি করে নিয়ে যায় ফলে সারাদিন এ—ঘর ও—ঘর। এটা ওটা সামলাচ্ছে। মাঝে মাঝে মিতার সঙ্গে ধর্মমূলক ছবি এলে দেখতে যায়। নানুর জন্য তার দুর্বলতা কম। মেয়েটার জন্য একটাই সমস্যা—বড় হয়ে গেছে, বিয়ে দিয়ে দাও—ধিঙ্গি করে আর কতদিন রাখবে। সংসারে এই বয়সে সাধারণ একজন নারীর যে স্থান হেমের তাই হয়েছে। কালেভদ্রে রাসবিহারীর মনে হয়, হেম তার স্ত্রী। বরং হেমকে বাড়ির পাহারাদার ভাবতেই এখন বেশি ভালো লাগে। সব সময় সন্তর্পণে সব কিছুর প্রতি নজর রাখছে। কোনো কিছু অপচয় হবার উপায় নেই।
রাসবিহারীর মনে আছে, হেম যৌবনে বিকেল হলেই গা ধোয়া, পাট ভাঙা শাড়ি পরা, গলায়, কাঁধে, মুখে পাউডার এবং সুঘ্রাণ ছড়িয়ে বসে থাকত। পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা—এটা হেমকে না দেখলে বোঝা যেত না। তবে শেষ পর্যন্ত একের পর এক কন্যাদের জন্ম দিয়ে বোধ হয় হাঁপিয়ে উঠেছিল। একদিন শুতে গিয়ে দেখে রাসবিহারী, বিছানা আলাদা—হেম আলাদা ঘর নিয়েছে। এবং সেই থেকে ক্রমে যে দূরত্ব বাড়ছিল তা এখন চরমে। প্রায় সারাদিন দুটো চারটে কথা ছাড়া ওদের আর কোনো সম্পর্ক আছে অথবা ছিল তা বোঝাই যায় না। রাসবিহারী দুটো বীজ পুঁতে দেবার সময় ভাবলেন, সংসারের বুঝি এই নিয়ম।