জায়গাটা তোমার খুব পছন্দ হবে রমা।
অরুণ এবার স্কুটারে চেপে হ্যান্ডেলটা সামান্য ঘুরিয়ে দিল। রমা বসল। আঁচল গুঁজে দিল কোমরে। ঘাম হচ্ছে খুব। রুমালে মুখ মুছল। চুল খোঁপা থেকে কিছু আলগা হয়ে গেছে। সেগুলো ফের খোঁপায় গুঁজে দিল। তারপর অরুণের পিঠের ওপর নিজেকে চেপে ধরল। প্রায় দুরন্ত বেগে স্কুটারটা সব মানুষজন, জ্যাম ভিড় কাটিয়ে দু—পাশে মাঠ ফেলে চলে যেতে থাকল। তারপর। এবং ক্রমে বিন্দুবৎ হয়ে ভেসে থাকল একটা আশ্চর্য সুখ। প্রকৃতির কূট খেলা তখন আরম্ভ হয়ে গেছে শরীরে।
মানু তখন হাঁটছিল। মানুষজন, গাড়ি বাড়ি, ট্রামের তার ফেলে সে একটা নির্জন জায়গার খোঁজে চলে এসেছে। চুপচাপ কোথাও বসে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে। মুখের ভেতর টিকিটের কাগজ দলা পাকানো। চুইংগামের মতো সে চিবিয়ে খাচ্ছে কেবল। জয়া সুন্দর শাড়ি পরেছিল আজ। পাশে বসে শো দেখার আরামটুকুও তাকে ওরা দিল না। সব ইচ্ছে কোথাকার দুটো কবি এসে গুঁড়িয়ে দিয়ে গেল। কিছুই ভালো লাগছিল না। কিছু ভিখিরি বসে আছে রেলিঙের ধারে। শুকনো রুটি রোদে আরও শুকিয়ে নিচ্ছে। একটা ওর বয়সি ছেলে কাক শালিক তাড়াচ্ছে। এবং বড় নিবিষ্ট চোখে পাহারা দিচ্ছে। খাওয়ার সুখ কত আরামের ওদের চোখ মুখ দেখলে টের পাওয়া যায়। মানুর বলতে ইচ্ছে হল তোমাদের মতো আমিও ভিখিরি। কাঙাল বলতে পারো। সে রেলিঙের ধারে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল। শহরে কত কিছু ঘটে যাচ্ছে। ওই যে বুড়োটা, হাতে রেশন ব্যাগ নিয়ে ট্রামে উঠবে বলে দৌড়াচ্ছে, সে জানে না পাশেই আছে তার হাজার কিশিমের হতাশার ছবি।
এমন কী অহংকার, মেয়ে তোমার, অনায়াসে দুজন কবি আমার থেকে ছিনিয়ে নিতে পারে তোমাকে। মানুর ভেতরে ভেতরে জেদ বাড়ছিল। সে একটা ঢিল তুলে ছুঁড়ে দিল। এবং কত দূরে গিয়ে পড়ছে, আর এভাবে কত দূরে সে ঢিল ছুঁড়তে পারে তা দেখে নিচ্ছে। মানুষের মাথায়, গাড়ির জানলায় লাগলে কেলেঙ্কারি হবে সে জানত। তবু কেমন ভেতরের একগুঁয়ে একটা স্বভাব আছে তার। সে যা আশা করেছিল, যা সকাল থেকে তাকে স্বপ্নের ভেতর জমিয়ে রেখেছিল, কবি ছোঁড়া দুটো তছনছ করে দিয়ে গেল। সে কিছুই বলল না। এখন মনে হচ্ছে তার কিছু বলা উচিত ছিল। নিজের সঙ্গে কিছু কথাবার্তা আরম্ভ করে দিল এ—ভাবে।
তুমি একটা আহম্মক।
কী করব। জয়া এমনভাবে বলল,—
আরে মেয়েমানুষ তো, ধরে রাখতে হয়। সবই তোমাকে বলে দিতে হবে। বলতে পারলে না, রাখো কবিতা। বাড়াবাড়ি করলে চেঁচামেচি শুরু করে দেব।
কী ফল হত তাতে?
অনেক কিছু হত। ভয় পেত।
জয়া দুঃখ পাক আমি এটা চাই না?
তাহলে তুমি দুঃখ পাও এটা সে চায় কেন?
তা তো বলতে পারব না।
তুমি কাপুরুষ। কেউ এভাবে মুখের গ্রাস ছেড়ে দেয় না।
মানু কিছুক্ষণ তারপর অন্যমনস্কভাবে ফের হেঁটে গেল। আইসক্রিমের বাক্স টেনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে একটা লোক। দুজন হাফ—যুবতী বালিকার মতো আইসক্রিম মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ওকে দেখে ওরা হাসছিল। এবং সে তখনই বুঝতে পারল ওর হাতে একটা বড় ঢিল। এমন সুন্দর ছেলেটা ইঁটের টুকরো হাতে নিয়ে কোথায় যাচ্ছে! কার মাথা ফাটাতে যাচ্ছে! ওর মাথার গোলমাল আছে ভেবে হয়তো তারা হাসছে। সে গোপনে ঢিলটা হাত থেকে ফেলে দিল। হাত ঝাড়ল। একবার বলবে নাকি—এই মেয়েরা, তোমরা এখানে কেন! ঘরে ভালো লাগে না কেন! তোমাদের কেউ আসবে? আচ্ছা, তোমরা সেজেগুজে বের হয়েছ বেড়াতে, সত্যি বেড়াতে চাও তো না অন্যকিছু? চারপাশে সবুজ মাঠ, গাছপালা, এবং মনের ভেতরে কেবল দুষ্টুমি—সব বুঝি! জয়াটা যে কী করল আজ! গন্ধে গন্ধে ওর কবি বন্ধুরা ঠিক পিছনে হেঁটে যাচ্ছে। মেয়েদের গন্ধ পুরুষেরা এত পায়, পুরুষের গন্ধ মেয়েরা পায় কিনা একবার জিজ্ঞাসা করবে নাকি! পুরুষের গন্ধ পাও না! আমি যে হেঁটে যাচ্ছি, তোমাদের ভালো লাগছে না!
এবং সে দেখল সত্যি হাঁ করে ওদের দিকে সে তাকিয়ে আছে। আর ওরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে।
সে বলল, না আপনাদের আমি কিছু বলছি না।
বড় মেয়েটার চুল দু’বেণীর। ছোট মেয়েটার কোমর খুব সরু। গেঞ্জি পরেছে। বুক উঠছে নামছে নিশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে। বড়টা সামান্য লাজুক প্রকৃতির। মানুর দিকে সামান্য চোখ তুলেই নামিয়ে নিয়েছে। ছোটটা সাহসী। সে এগিয়ে এসে বলল, কিছু বলছেন?
আপনারা এখানে কতক্ষণ?
ঘড়ি দেখে বলল, বিশ মিনিটের ওপর।
তাহলে বলে লাভ নেই।
মানুর প্রতি যে—কোনো কারণেই ছোটটার কৌতূহল বেড়ে গেল। বোধহয় ওরা দুবোন। কিংবা বোধহয় দুজনেই কলেজের বান্ধবী। অথবা প্রতিবেশী। ঘরে ভালো লাগে না। হেঁটে হেঁটে চলে এসেছে ময়দানের এদিকটায়। এবং গাছপালায় ছায়ায় বসে আইসক্রিম খাচ্ছে। শহরের ঘরে ঘরে এই এখন ক’টা যুবতী আছে, ক’শো, ক’হাজার অথবা ক’লক্ষ, যেমন সে জানে তার দিদি, এবং জয়া, মন্দাকিনী বউদি সবাই কোথাও যেতে চায়। কোথাও যাওয়ার সুখ অথবা অসুখের ভিতর পড়ে গিয়ে নিদারুণ হয়ে উঠেছে। জয়াটা শুধু দু’জন কবির সঙ্গে চলে গেল। কবিতা পাঠ এত কী মধুর, অথচ অসুখের মতো ওটাও একটা সুখ কিনা কে জানে! তাকে ফেলে তো চলে গেল। কত বড় অসুখ হলে জয়া তাকে ফেলে যেতে পারে এতক্ষণে সে এটা টের পাচ্ছে। এবং টের পেলেই মনে হল মাথাটা দু’ফাঁক করে দিলে কী ক্ষতি ছিল! কবিতা বের হয়ে যেত সব ফাঁক করা খুলি দিয়ে।