দাঁড়াও না। ঠিক কোথাও যাব। ভালো করে ধরে রাখো।
রমা মুখটা অরুণের পিঠে লাগিয়ে বলল, খুব ভালো লাগছে! না!
অরুণ যতটা সম্ভব স্পিড তুলে প্রায় হাওয়ায় গা ভাসিয়ে দিল যেন। দু—পাশের বাড়িঘর মাঠ দ্রুত সরে যাচ্ছে। ভি—আই—পির এই রাস্তাটা অরুণের ভারি প্রিয়। নিশ্চিন্তে সোজা সিটে বসে থাকতে পারে। মনে হয় কখনও নিজে ঘোড়সওয়ার, কখনও মনে হয় সে পৃথ্বিরাজের মতো ঘোড়ায় ছুটে যাচ্ছে। পিছনে জয়রাজ দুহিতা সংযুক্তা। রাজার মেয়ে চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে।
অরুণ বলল, তোমার বাবার নাম ভুবন না হয়ে জয়রাজ হলে ভালো হত।
রমা চেঁচিয়ে বলল, বুঝতে পারছি না, কী বলছ!
আসলে হাওয়ায় পিছলে যাচ্ছে সব শব্দ। জোরে না বললে কিছুই স্পষ্ট হচ্ছে না। অরুণ বলল, বলছি, তুমি রাজার মেয়ে।
রাজার মেয়ে হতে যাব কোন দুঃখে?
তোমাকে কী যে করতে ইচ্ছে হচ্ছে না।
কী করতে ইচ্ছে হচ্ছে?
রাজার মেয়েকে কী করতে ইচ্ছে হয়?
যাও জানি না। তুমি ভারি অসভ্য কথা বলতে পার।
অরুণ জোরে হেসে উঠল।
এই কী হচ্ছে। একটা কিছু না ঘটিয়ে ছাড়বে না!
ভালোই তো! হলে মন্দ কী!
এই বুঝি ইচ্ছে।
আরও দু—চারটে গাড়ি অতিক্রম করে অরুণ হাওয়ার পিঠে ভর করে যেন চলে যাচ্ছে। ক্রমে উল্টোডাঙ্গা, লেকটাউন, এয়ারপোর্ট পার হতেই রাস্তাটা ফের সরু হয়ে গেল। তেমন নিশ্চিন্তে আর বাতাসে ভেসে যাওয়া যাবে না। সে স্পিড সামান্য কমিয়ে দিতেই একটা ঝাঁকুনি খেল রমা। তারপর স্পিড একেবারে কমিয়ে দিয়ে অরুণ বলল,—এসো, এখানে সুন্দর নিরিবিলি একটা চায়ের দোকান আছে। চা খাব।
রমা বলল, কোথায় যাবে বলতো?
একটা কথা যে কতবার বললে তুমি রমা! এখন একটু ঘুরব। সন্ধ্যায় চাঙোয়াতে খাব। বিকেলে একটা কিছু আজ হবে।
হতে দিচ্ছেটা কে!
রমার মুখের দিকে তাকাল অরুণ। হতে দিচ্ছেটা কে—বলে চোখ নামিয়ে নিয়েছে। কেমন চাপা লজ্জা চোখে মুখে ফুটে উঠেছে। এমন সব কথাবার্তা অরুণ আজকাল প্রায়ই বলে। আসলে শেষ পর্যন্ত কিছুই হয় না। রমার ভীতু মুখ দেখলে সেও শেষ পর্যন্ত কেমন হয়ে যায়। কাপুরুষের মতো মুখ করে রাখে। ছেলেমানুষের মতো শুধু বলা, আর পারছি না।
রমা তখন মজা পায়। বলে, কেন, ঘরে তো বউ আছে। দুঃখটা সেখানেই সারিয়ে নেবে।
অরুণ আর বেশি কিছু বলতে সাহস পায় না। ঘরে সত্যি অমলা রয়েছে। সবই জানা। কোনো রোমহর্ষক ঘটনা আর ঘটে না। ডাল ভাতের মতো অমলা ওকে শুধু খেতে দেয়। বললেই মাদুর পেতে দেবার মতো। অথবা মনে হয় ওটা পাতাই আছে যে—কোনো সময় গড়িয়ে নিলেই হল। আর এ—ভাবেই বুঝি অমলা দিন দিন শরীরের সব রহস্য নষ্ট করে ফেলেছে। কোনো আকর্ষণ বোধ করে না। এই যে ছুটির দিনে সে বের হয়ে পড়েছে দশটা কাজের অজুহাত দেখিয়ে অমলার তাতেও কোনো রাগ নেই। ক্ষুণ্ণ হয় না, বরং ছুটির দিনটা সে বাপের বাড়ি যেতে পারবে বলে খুশিই হয়।
চা দাও তো। দু—কাপ।
রমা বলল, গরম জলে ভালো করে ধুয়ে দেবে। ভাঙা ফাটা কাপে দেবে না।
রমার এটা বাতিক। কোথাও বাইরে গেলে, চা—টা খেলে এ কথাগুলো নির্ঘাত একবার বলবেই। এবং সে জানে রমা দু—এক চুমুক চা খেয়েই বলবে, কী বিশ্রী চা। খাওয়া যায়!
ঘোরার ফলে কিছু নির্দিষ্ট দোকানি রমারও চেনা হয়ে গেছে। এ—জায়গাটা নতুন। রমাকে নিয়ে সে এ—জায়গাটায় নতুন এসেছে। সে মাঝে মাঝে বারাসাত এরিয়াতে কাজ থাকলে স্কুটার থামিয়ে একবার না একবার যাবার আসবার পথে এখানে নেমেছে। দোকানির ছোকরা চাকরটা অরুণকে খুব ভালো না চিনলেও কিছুটা মুখ চেনার মতো! সে গরম জলে পরিপাটি করে কাপ প্লেট ধুলো। চা দেবার সময় বলল, আর কিছু দেব?
রমা বলল, না কিছু না।
অরুণের এখন সময় কাটানো দরকার। দুপুরের রোদ খুব একটা তেজি না যেন। হাওয়া দিচ্ছে। ওর ইচ্ছে ছিল, ফ্লাস্কে করে সামান্য চা আর চিপস সঙ্গে নেবে। অমলাকে বললেই সব করে দিত। কিন্তু রমাকে তোলার সময় কাঁধে চায়ের ফ্লাস্ক দেখলে সংশয় দেখা দিতে পারত ভুবনবাবুর। সবাই তার সঙ্গে যদিও আচরণে খুব মেহেরবান হয়ে যায়, তবু সে বুঝতে পারে তলে তলে রমাদের বাড়িতে খুব একটা সুনজরে কেউ তাকে দেখে না। কেবল মাসিমা খুব সরল মুখ করে রাখে। যেন স্কুটারে চড়ে হাওয়া খেতে যাচ্ছে। খুবই পবিত্র ঘটনা।
রমা বলল, দুপুরের রোদে এ—ভাবে ঘুরে বেড়ালে লোকে পাগল বলবে।
অরুণ চারপাশটা দেখল। খদ্দের খুবই কম। অন্য অনেকদিন সে দেখেছে, খদ্দের গিজগিজ করছে। একটা বড় অশ্বত্থ গাছের নিচে দোকানটা। বেশ একটা নিরিবিলি ছায়া আছে। টুল পাতা বাইরে। দুজন চাষী মতো মানুষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে।
রমা সব চা—টাই খেল। বাড়ি থেকে সামান্য খেয়ে বের হয়েছে। এখানে চা, আরও দু—একবার চা হবে, তারপর অরুণ কোথায় যাবে সে জানে না। ঠা ঠা রোদ্দুরে ঘুরে বেড়াতে এত সুখ রমা আগে টের পেত না। কী শীতে কী বসন্তে এবং এই দাবদাহের ভেতরও যেন এক শান্ত সলিলা ভাব। কোনো কষ্টই কষ্ট মনে হয় না।
রমা এবারে ফিস ফিস গলায় বলল, খালি বাসাটা কি বারাসতে?
অরুণ পিছনে ফিরে দেখল। দুষ্টুমি হচ্ছে বোঝা যায়। রমা বিশ্বাসই করছে না বোধহয়, খালি বাসায় হাত পা ছড়িয়ে বসার সুযোগ কলকাতায় কোথাও থাকতে পারে! বড় হোটেলের ঘর পাওয়া যায়। রমা অবশ্য জানে এত সাহস অরুণের কোনোদিন হবে না। একটা পরিচয় তো দিতে হবে। আর তা ছাড়া কোথায় কোন ছলনা ওৎ পেতে আছে কে জানে! কাগজে কত সব কেলেঙ্কারির খবর থাকে। কেলেঙ্কারির ঠিক আগে বোধহয় ওরা এভাবেই একটা নীল স্কুটারে চড়ে বেড়ায়। বড় কোনো হোটেল ঘরের কথা এলেই সঙ্গে সঙ্গে পারিপার্শ্বিক দূষিত আবহাওয়ার কথা মনে হয়। অরুণ আর যাই করুক এতটা সাহস হবে না তার। সে বলল, কী কিছু বলছ না যে।