প্রিয়নাথ বউমার দিকে তাকিয়ে মনে মনে হেসেছিলেন। কষ্ট হয় না কথাটাই মিথ্যে। তবু শুনতে ভালো লেগেছিল। শরীরের কষ্ট কেউ লাঘব করতে পারে না। রুচির কথা যদি ধরা যায়, এটাও একজন প্রৌঢ় মানুষের কথা ভেবে, কারণ একমাত্র পুত্রের শোক মানুষের কাছে যে কী ভয়াবহ মন্দাকিনী সেটা বুঝতে পারে। সাধারণ রুচিতে বাধে বলেই কোনো কষ্টই কষ্ট বলে মনে করছে না মন্দাকিনী। এবং প্রিয়নাথ কখনও কখনও নিজেকে একজন সতর্ক প্রহরীর মতো দেখতে পান। যেন বাড়িটার চারপাশে হেঁটে বেড়াচ্ছেন। কখন দরজা খোলা পেয়ে চোর—ছ্যাঁচোড় ঢুকে যাবে ঠিক কি!
আর দিন যত যাচ্ছে প্রিয়নাথ বুঝতে পারছিলেন, যতই সতর্ক থাকুন, কিছু না কিছু অভ্যন্তরে ঘটেই যাচ্ছে। এবং যতই তিনি সতর্ক থাকুন না, অভ্যন্তরে যে সংকট, তা থেকে বউমার ত্রাণ নেই। ত্রাণ কথাটাই তাঁর মনে হয়েছিল। এবং নিজেকে এত সতর্ক রাখতে কেমন একটা অপরাধবোধ কাজ করছিল। যেহেতু খুব বিবেচক মানুষ হিসেবে তাঁর খ্যাতি আছে, এবং বিবেচক হতে গিয়েই টের পেয়েছিলেন, সংসারে তিনি যে গণ্ডী সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন সেটা একজন মানুষের ওপর অবিচারের শামিল! স্ত্রী গত হওয়ার পরে বুঝতে পারতেন রন্ধ্রে রন্ধ্রে তাঁর ভয়াবহ সব ইচ্ছেরা ইঁদুরের মতো কুরে কুরে খেত। এবং তিনি নীরজা নামক এক যুবতীর দরজায় কতদিন আহম্মকের মতো দাঁড়িয়ে থাকতেন। দরজা খোলা পেলে নীরজা কখনও কিছু দিয়ে বলত, আর না। ভারি লোভ। এত লোভ ভালো না। তখনই মনে হত সংসারে তিনি একটা গর্হিত কাজ করে বেড়াচ্ছেন। ভুবন সাদাসিধে মানুষ। স্ত্রীর প্রতি তার অন্ধ বিশ্বাস। বিশ্বাসের ঘরে এ—ভাবে সিঁদ কাটা ঠিক হচ্ছে না। মনে মনে অহরহ একটা অনুশোচনা ছিল, অথচ কিছুতেই তিনি অভ্যন্তরে পেরেক পুঁতে দিতে পারেননি। এই অসহায় দৃশ্যাবলি আজকাল তাঁকে খুব কাবু করছে। এবং নীরজার সন্তান ভানুর প্রতি কিঞ্চিৎ টানও অনুভব করছেন। সংসার ঠিকঠাক রাখার জন্যে এটা যে কত বড় দুর্বুদ্ধি ঠিক টের পান। তবু তিনি বুঝতে পারেন, কিছু আর করার নেই। নিয়তি এ বাড়িতে আর একটা পাপ কাজ করিয়ে নেবেই। তিনি শুধু নিমিত্ত মাত্র।
ভানু এসো। ভাত দিয়েছে!
ভানু লুঙ্গির মতো করে পরেছে কাপড়টা। চুল ব্যাকব্রাশ করা। জামাটা গায়ে গলিয়ে নিয়েছে। ভেতরে গেঞ্জি নেই। বুক খোলা। ভেজা লোম বুকে লেপ্টে আছে। এবং বুক খোলা বলে, প্রায় বুকের সবটাই দেখা যাচ্ছে। কী ঘন লোম। কাল কুচকুচে। এবং উষ্ণতা ভারি গভীর। মন্দাকিনী ডালের বাটি আলু পটলের ডিস রাখার সময় গোপনে দেখে ফেলল। এবং এই দেখে ফেলাটাই কাল। দরজায় দাঁড়িয়ে ওদের খাওয়া দেখছিল আর ভেতরে ভীষণ জ্বালা অনুভব করছিল। কিছুতেই যেন প্রলোভনের হাত থেকে সে নিজেকে রক্ষা করতে পারছিল না।
প্রিয়নাথ বললেন, তুমি তো কিছুই খাচ্ছ না। এ—বয়সে এত কম খেলে চলে!
ভানু বলল, এমনই তো খাই।
মাংসের বাটিটা বেশ ভরে দিয়েছে মন্দাকিনী। ভানু মাংসের বাটির দিকে তাকিয়ে মন্দাকিনীকে বলল, এত দিয়েছ কেন? এত আমি খাই?
কী খায় না খায় মন্দাকিনী তা কি জানে! প্রিয়নাথ সহসা অন্যমনস্কতার দরুণ বিষম খেলেন।
জল খান বাবা।
তাড়াতাড়ি প্রিয়নাথ জল খেলেন। এবং নাকে মুখে ভাতের কণিকা সব সুড়সুড়ি দিচ্ছিল। নিজের ব্রহ্মতালুতে হাত চেপে দিলেন দুবার। তারপর গলা খাকারি দিয়ে যেন অস্বস্তিটা লাঘব করার চেষ্টা করলেন।
এত আয়োজন! বলে ভানু আবার মন্দাকিনী বউদিকে দেখল। কাকলির খাওয়া হয়ে গেছে বলে সে বসে ছিল একটা মোড়ায়। কাকলি মার দিকে তাকিয়ে বলল, কী যে বল না কাকু! আয়োজন কোথায়। এটুকু দই খেতে পার না?
খেতে সবই পারি। তবে একটা তো পেট! কত খাব।
প্রিয়নাথ বললেন, যা—ই বল, বাঙালিদের খাবার খুব স্বাস্থ্যসম্মত। তেতো দিয়ে আরম্ভ। টক দিয়ে শেষ।
সহসা তিনি এমন কথা কেন বললেন ভানু বুঝতে পারল না। সে কথায় সায় দিল শুধু, তা ঠিক।
আমরা জানি না বলে, আমাদের যত হজমের গোলমাল।
ভানুর স্বাস্থ্য প্রবল। উঁচু লম্বা মানুষ। কোনো অসুখ—বিসুখ ইদানীং তার হয়নি। বাড়িতে মা খাবার সবসময় বেশ রিচ করে রাঁধে। বাবার জন্যে আলাদা রান্না হয়। ঝাল—টাল মা বেশি খায়। মশলা তেল বেশি দিতে ভালোবাসে। খুব একটা শরীর খারাপ হয় না তার। কিন্তু এ বাড়ির রান্না কম মশলায়। তেল ঝাল মশলা পরিমাণ মতো। তবু বুঝতে পারে মন্দাকিনীর অসুখটা ভেতরে রয়েই যাচ্ছে। কিছুতেই নিরাময় হচ্ছে না।
আসলে এটা অসুখ না স্বাভাবিক জীবন! যুবতী নারী বলতে যা বোঝায়, তার স্বাধীনতা থাকলে যা যা থাকে হাতের মুঠোয়, সবই করতে ভালোবাসে মন্দাকিনী। কিন্তু কখনও কোনো চপলতা দেখেনি। কাছে কাছে রাখতেই পছন্দ করে। অথচ প্রশ্রয় দেয় না। কেবল একটা আকর্ষণ রেখে দিয়েছে শরীরে। এমন পোশাক পরে থাকে যেন মায়াবী সব কিছুকে দূরে সরিয়ে রাখার ইচ্ছে। সাধাসিধে। এতেই আরও গন্ধটি প্রবল হয়ে যায়। পৃথিবীর যেখানেই সে থাকুক নাকের ডগায় বিধবা যুবতীর গন্ধটা লেগে থাকে।
মন্দাকিনী তখন বলল, কাকলি, তোর কাকার বিছানা করে দে।
একটু একা থাকলেই মন্দাকিনী কাজের ফাঁকে ঘরে ঢুকতে পারে। দুটো একটা কথা। কখনও চিৎ হয়ে শুয়ে থাকলে মন্দাকিনী জানলার কাছে এসে দাঁড়ায়। কপাট ভেজিয়ে দেয়। কাকলি দুষ্টুমি করতে ভালোবাসে। তখন প্রৌঢ় মানুষটা টের পায় একজন যুবক কত সহজে বাড়িটাকে স্বাভাবিক করে রেখেছে। ভানু এলেই যেন বাড়িটা প্রাণ পেয়ে যায়। তিনি তখন চোখ বুজে যৌবন বয়সের কিছু দৃশ্য দেখতে পান। নীরজা ঠিক এভাবে তাকে দেখলে চঞ্চল হয়ে উঠত। পৃথিবীতে এটা যে কী, শরীরে অথবা রক্তে এটা যে মানুষের কী এক আশ্চর্য অনুভূতি—কোনো বাধা নিষেধই কেন যে গ্রাহ্য করে না—এমন এক রহস্যময়তা টের পেয়ে পুত্রের ছবিটা দেখলেন। মুখে ভালোমানুষ, মৃত্যুটার সঙ্গে একটা ছোট কেলেঙ্কারি জড়িত। যদিও টের পায়নি কেউ। মন্দাকিনীর কী ছিল না! তিনি অঙ্ক কষে বের করতে বসে যান। তারপর বুঝতে পারেন, সবারই সব থাকে। ব্যবহারে পুরানো হয়ে গেলে আকর্ষণ কমে যায়। আর সংসারে চুরি করে খাবার স্বভাব, মানুষের বোধহয় সহজাত ব্যাপার। ঠেকানো যায় না। ছেলেটা গোপনে আর একটা প্রেম করছিল, বোধহয়। না হলে রাধা এবং সে একই গাড়িতে থাকবে কেন! রাধা আর সে একই সঙ্গে খাদে পড়ে শেষ হবে কেন!
আট
আমরা কোথায় যাব বলতো?