এই যে দাদু। সে লাফিয়ে দাদুর কাছে চলে যায়।
লেকের ধারে যাবি নাকি?
আমার ভাল্লাগে না। অতসী আসবে বিকেলে।
আমার সঙ্গে তোর কোথাও যেতে ইচ্ছে হয় না, না রে?
কেন, যাইতো। তোমার সঙ্গে সেদিন রেখা পিসিদের বাড়ি গেলাম তো।
আগে তো পা উঠিয়েই থাকতিস!
কাকলি বলবে, এখনও থাকি।
দাদু আর তারপর কিছু হয়তো বলবেন না। পত্রিকার কিছু কিছু কাটিং রাখার একটা স্বভাব আছে দাদুর। সবদিন রাখেন না। কখনও কোনোদিন রাখলে কাগজটা আলাদাভাবে তুলে নিয়ে বিছানার নিচে রেখে দেবেন। বিকেলে কাকলি এলে তাকে নিয়ে বসবেন। গঁদ এবং শাদা ফুলস্কেপ কাগজে এঁটে দেবেন দাদু কাটা কাগজগুলি। সে তা রোদে বিছিয়ে সামান্য শুকনো করে ফাইলে সাজিয়ে রাখবে। এবং কখনও দাদু ওর বই অথবা চশমা হাতে দিয়ে বলবেন, রেখে দে এবং নানারকমের সব হজমি ওষুধ খাবার পর আদর করে হাতে দেবেন! বলবেন, খা।
সুতরাং এ—বাড়িতে কাকলির বাবা নেই বলে সে হতাশায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ার কথা ছিল, দাদু, ভানুকাকা এবং মা মিলে সেটা পুষিয়ে দিচ্ছে। বরং সে এখন তার বান্ধবীদের সঙ্গে একটু রাত করে ফিরলেও দাদু কিছু বলেন না। বাবা থাকতে একটা সুন্দর রেকর্ড প্লেয়ার কিনে দিয়েছিল তাকে। তার প্রিয় গানের রেকর্ড আলমারিতে সাজানো। বাবার মৃত্যুর পর মাস দুই ভীষণভাবে মুহ্যমান ছিল। তখন দাদু যে সব গান সে শুনতে ভালোবাসত, তার কোনো একটা রেকর্ড—প্লেয়ারে বাজাতেন। যেন বাড়িটাকে আবার স্বাভাবিক করে তোলার জন্যে দাদুর শেষ চেষ্টা। শোকে বাড়িঘর অন্ধকার হয়ে থাকবে মনে হতেই বুঝি দাদু ডেকে এনেছিলেন ভানুকাকাকে। এই বাড়ির ব্যালকনিতে একজন মানুষ অফিস থেকে ফিরেই রাতের আকাশ দেখতে ভালোবাসত। এখন আর তা যেন কারও মনেই নেই। সবাই কেমন সহজেই সব কিছু মেনে নিয়েছে।
প্রিয়নাথ আজকাল নিরামিষ খেতে ভালোবাসেন। মাছ—টাছ খেতেই চান না। মন্দাকিনী তবু জোরজার করে খাওয়ায়। বাইরে প্রিয়নাথের আধুনিক মানুষের মতো ব্যবহার। ভেতরে তার এখনও একজন প্রাচীন মানুষ আছে। যে চায়—মন্দাকিনী আচার—বিচার মেনে চলুক। একজন সদ্যবিধবার পক্ষে আচার—বিচার কথাটা খুব জোর গলায় বলা ঠিক না। মাছটা মাংসটা মন্দাকিনী এখনও খাচ্ছে না। খেলে তিনি খুব একটা বাধাও দেবেন না। তবু যতদিন না খায় ততদিনই যেন একটা স্বস্তি আছে। মাছ মাংসের সঙ্গে শরীরের লোভ—লালসা বাড়ে বই কমে না। তিনি সেটা বোঝেন। এবং এ—জন্য নিরামিষ খাওয়ার ঝোঁকটা ইদানীং বেড়েছে। কাকলির অন্য রকমের স্বভাব। নিরামিষ খেতেই পারে না। তাছাড়া প্রোটিন জাতীয় খাবার বালিকা বয়সে খুবই দরকার। কাকলির জন্যে মাছ, কখনও মাংস অথবা ডিম বাড়িতে করতেই হয়। খেতে বসে মন্দাকিনী আজকাল জোরজার করে সামান্য মাছ—মাংস প্রিয়নাথকে খেতে দেয়। প্রিয়নাথও যেন কিছুটা বিরক্ত মুখে কোনোরকমে শুধু গলাধঃকরণ করা আর কিছু না, না হলেই ভালো ছিল, তবু শরীর বলে কথা, মন্দাকিনী সব সময়েই শরীরের কথা মনে করিয়ে দেয় প্রিয়নাথকে। —খান বাবা। না খেলে শরীর টিকবে কী করে। তার যেন বলার ইচ্ছে, শরীর যে সব বাবা। তার যে ইচ্ছের শেষ নেই। প্রিয়নাথের মুখোশ পরে থাকার স্বভাব সব সময়। ভেতরের লোভ তিনি সামলাতে পারেন না। খুব সহজেই খেয়ে নেন। খুব স্বার্থপরতার মতো দেখায়, এ—জন্য একদিন খাবার পর হজমি খাবার সময় ডেকেছিলেন, বউমা।
মন্দাকিনী হাত মুছতে মুছতে প্রিয়নাথের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। বউমার দিকে তিনি চোখ তুলে তাকাতে পারেননি। বড়ই পুষ্ট শরীর এবং নিরামিষ আহারে লাবণ্য বোধহয় শরীরে আরও বেড়ে গেছে। ভেতরে ভেতরে ভয় পেয়ে যান তিনি। বলেন, বউমা একটা কথা ছিল।
মন্দাকিনী শুধু তাকিয়ে ছিল শ্বশুরের দিকে, কিছু বলেনি। কোনো গুরুত্বপূর্ণ কথায় এলে শ্বশুরমশাই এ—ভাবেই কথা আরম্ভ করেন।
আমি বলছিলাম কি……
আবার প্রিয়নাথ কথা শেষ না করেই অন্যদিকে তাকিয়ে কী যেন দেখছিলেন। মন্দাকিনী তখনও কিছু বলেনি।
বলছিলাম, আজকাল কেউ আর অত মেনে—টেনে চলে না।
তুমি ইচ্ছে করলে…..’, আবার কথা শেষ না করেই সিগারেটের প্যাকেটটা খুঁজছিলেন।
মন্দাকিনী তখন বলেছিল, আমার বাবা কোনো কিছু অসুবিধা হচ্ছে না। আপনি এ নিয়ে ভাববেন না।
প্রিয়নাথ খুব খুশি হয়েছিলেন। বউমা এমনিতে খুবই বুদ্ধিমতী। কে কী পছন্দ করে বউমা ঠিক বুঝতে পারে। তিনি তখন আরও উদার হয়ে যান। বলেছিলেন, বউমা বাকি জীবনটা তোমার পড়ে থাকল। আমার দুর্ভাগ্য। চোখের ওপর দেখতে হবে সব।
এই চোখের ওপর দেখতে হবে সব, সেটা কী দেখতে হবে। দেখতে হবে, একজন সদ্য বিধবা যুবতী কীভাবে শরীরের সব ইচ্ছে নষ্ট করে দেয়। সব প্রলোভন জয় করে ফেলেছে, আসলে এটাকে কি প্রলোভন বলা চলে! একজন মানুষের স্মৃতি কতদিন বয়ে নিয়ে যাওয়া চলে! একজন মানুষের স্মৃতি তাকে কতদিন সুস্থ রাখতে পারবে—এটা কী তিনি কেবল দেখতে চান, খাদ্যবস্তুতে ভেজাল না থাকুক। এমনভাবে সব চলুক, সংসার ভেঙে না যায়, সব ঠিকঠাক চলছে, আহারে কিছু মাছ মাংস থাকুক, অথচ কেউ টের পাবে না, গোপনে সবাই সব কিছু খেতে পছন্দ করে থাকে।
মন্দাকিনী বলেছিল, বাবা, আজকাল আপনি বড্ড বেশি ভাবেন। আমার কপালে এমনই লেখা ছিল। আর আমার তো কোনো কষ্ট হয় না।