সে হেরে গেলে প্রিয়নাথকাকা খুশি হয় খুব। আর এই নিয়ে মন্দাকিনী বউদি হাসি ঠাট্টা করতে ভালোবাসে। —মন কোথায় থাকে?
প্রিয়নাথ শেষ চালে এসে দেখলেন, কিস্তি দেবার মতো গুটির বল নেই। সারাদিনই ছকের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে হবে। সুতরাং বললেন, তুমি বসো। স্নানটা সেরে নিচ্ছি। এবং কাকলিকে ডেকে বললেন, ভানুকে একটা কাপড় বের করে দে।
প্রিয়নাথ চানের ঘরে চলে গেলেই কাকলি ছুটে ঘরে ঢুকে পড়ল। বলল, তুমি ভারি মিথ্যুক।
ভানু বুঝতে না পেরে বলল, মিছে কথা কখন বললাম?
তোমাকে মারব। বলেই চুল খামচে ওর পিঠে ঝুলে পড়ল।
সান—ফ্লাওয়ার চলে গেছে বললে কেন?
আছে নাকি?
আমার বন্ধুরা তো দেখে এল।
তোকে সাউন্ড অফ মিউজিক দেখাব।
না দেখব না।
ক্রেজি বয়। খুব ভালো বই।
মেয়েটি ওর ঘাড়ে ঝুলে এভাবে অজস্র কথা আর আদর খাবার ছলনাতে বেশ জড়িয়ে যাচ্ছে। ভানুর এত ভালো লাগে কেন এটা। ইচ্ছে হয় কোলে নিয়ে ফাঁপানো চুলে বিলি কেটে দেয়। মেয়েটা বুঝতে পারে মা এখন কোথায়। তার ঘিলুতে সব সময় এই বাড়ির একটা প্রতিবিম্ব ভাসে, প্রৌঢ় মানুষটি সব সময় সতর্ক নজর রাখছেন। অথচ এই প্রৌঢ় মানুষটি না থাকলে সে যখন তখন হুট হাট এ বাড়িতে আসতে পারত না।
যেমন এখন রান্নাঘরে মন্দাকিনী বউদি, এ ঘরে সে আর কাকলি। স্নানের ঘরে প্রিয়নাথ কাকা বেশ সময় নিয়ে চান করতে ভালোবাসেন। মন্দাকিনীর চটির শব্দ পাওয়া যাবে, এ—দিকে এলেই টের পায় কাকলি মা আসছে। তখন সামনে বসে মেয়েটা পা দোলাবে। মন্দাকিনী হলুদ ছোপের হাত আঁচলে সামান্য মুছে বলবে, তোমাকে জ্বালাচ্ছে?
ভানু হেসে বলবে, খুব।
সে বলল, কাকলি রোমান—হলিডে দেখবে নাকি?
মাকে বল না!
মন্দাকিনীকে বললে, সেও বায়না ধরবে, আমাকে নিয়ে চল! এবং প্রিয়নাথকাকা মনে করেন সঙ্গে কাকলি থাকলে যে—কোনো জায়গায় ভানুর সঙ্গে মন্দাকিনী যেতে পারে। আজ রান্নার লোকটা কামাই করেছে। কামাই না করলেও ছুটির দিনে শ্বশুরকে নিজের হাতে রান্না করে খাওয়ায় বউদি। এবং ভানু এলে বুঝতে পারে, এত বড় একটা শোক, সহজেই মন্দাকিনী বউদির উবে যায়। কাকলি পর্যন্ত সে—দিনের সেই শোককে আর মনে করতে পারে না। ভানুকে দেখলে ওরা দুজনেই ভারি খুশি হয়ে ওঠে।
ভানু এখন বুঝতে পারে না আকর্ষণটা কার প্রতি তার প্রবল! কাকলি, না মন্দাকিনী। কাকলিকে ফ্রকে আর মানায়ও না। তবু মন্দাকিনী আরও কিছুদিন হয়তো কাকলিকে বালিকা সাজিয়ে রাখবে। এবং সে টের পায়, এই বালিকা সাজিয়ে রাখার ভেতর মন্দাকিনীর যে খুব একটা বয়স না, এখনও দীর্ঘ সময় ধরে সে যুবতীর মতো বেঁচে থাকতে পারে, কারণে অকারণে ইচ্ছেটা প্রবল হয়ে উঠলে, সদ্য পাশ করা যুবতীর চেয়ে কম যাবে না, এ—সব বোধহয় বলতে চায়। এবং বিয়ের সময় কত বয়স, কবে কাকলি হয়েছে, এই হওয়ার ভেতর জন্মের তারিখ বলে—টলে আজকাল মন্দাকিনী খুব একটা সুখ পায়। এবং ওর যে কী হয় তখন! নির্দোষ কথাবার্তা। অথচ ব্যাপারটার ভেতর এমন সব ঘটনা বা দৃশ্য থেকে যায়, যা তাকে ভীষণ প্রলুব্ধ করে। আর এ—সব কথাবার্তা যে খুব গোপনে হয় তাও না। প্রিয়নাথকাকার সামনেই যে—কোনো অছিলায় একবার মনে করিয়ে দেওয়া, বাবা তো আমাকে বালিকা বয়সেই নিয়ে এল। বালিকা বয়েস! বয়েসটা তরুণীর হলে ক্ষতি ছিল কী! এবং গত চোদ্দই জুন সকালবেলায় বউদি বলেছিল, বুঝলে ভানুবাবু, বালিকাবধূতে আলাদা সুখ আছে। আসলে কী বালিকা বয়সে বিয়ে হলে খুব একনিষ্ঠ থাকা যায় এমন কিছু বলতে চায় মন্দাকিনী! না অন্য কিছু? না পবিত্র আধারে প্রবিষ্ট হবার মতো রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা শুধু বালিকাবধূতেই! কোনটা?
প্রিয়নাথকাকা স্নান সেরে যাবার সময় উঁকি মেরে বললেন, যাও ভানু, আমার হয়ে গেছে।
মন্দাকিনী বউদি সকালেই বোধহয় আজ স্নান সেরে নিয়েছে। রবিবার ভানুর ছুটির দিন। এ—দিনটাতে মন্দাকিনীও ছুটি করে নিয়েছে। এবং ভানু আজকাল কখনও কোনো হলের নীচে প্রতীক্ষা করে থাকে। মন্দাকিনী বউদিকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ারও একটা কাজ আছে তার।
প্রিয়নাথ নানাভাবেই ভানুকে এ বাড়ির জন্যে ভারি দরকারি ভেবে থাকেন। সুতরাং প্রিয়নাথ বললেন, বউমা ওকে একটা কাপড় দাও!
মন্দাকিনী বাথরুমের দরজায় এসে দাঁড়াল। বলল, কী কিছু পরতে হবে না।
ভেতরে জল পড়ার শব্দ হচ্ছে। বোধহয় শুনতে পায়নি। সে বলল, ও ও মশাই কাপড় নেবেন না!
কাকলিও এসে গেছে। কেমন একটা মজা পায় এই মানুষটির কথাবার্তায়। ভেতরে মানুষটা চান করছে। শরীরে কী থাকে, স্নানের সময়ের কিছু কিছু দৃশ্য এ—সময় ওদের দুজনই ভেবে ফেলে। দুজন দু—রকম ভাবে। মন্দাকিনী খুব সরল বালিকার মতো মুখ করে আছে। কাকলি ভারি গম্ভীর। এবং দরজা সামান্য ফাঁক করে কাপড়টা নেবার সময় বোধহয় কেউ খুব একটা ভালো থাকছে না ভেতরে। লম্বা লোমশ ভেজা হাত, মন্দাকিনীর শরীর কেমন কাঁটা দিয়ে ওঠে। এবং কাকলির দৃশ্যটা বেশ মধুর লাগছিল। অথবা বলা যায় মানুষটার গায়ের গন্ধ কেমন স্নানে আর সাবানে মিশে গেছে। পরিচ্ছন্ন সুগন্ধযুক্ত সুশ্রী মানুষ, বয়স তিরিশের কোঠায়, এবং মুখে খুব বিনীত বাধ্যের ছাপ, এ মানুষকে পছন্দ না করে উপায় থাকে না।
কাকলির বায়না কত। আজকাল যে—কোনো বায়না, গোপনে অথবা সবার সমক্ষে এই মানুষটাই তামিল করে থাকে। রোমান—হলিডে দেখে কী হবে! সাউন্ড—অফ মিউজিক, একান্ত না হলে লাভ স্টোরি, সে ভেবেছিল ফিসফিস গলায় বলবে, লাভ স্টোরি বইটা দেখাবে ভানুকাকা? আমাদের ক্লাসের মাধুরী অনীতা দেখেছে। আমাকে দেখাবে? পালিয়ে তোমার সঙ্গে একদিন দেখে আসব। কেউ টের পাবে না? ফন্দি ফিকির ভাবতে সময় লাগে না কাকলির। ভানুকাকার ফোন নাম্বার জানা। বারোটা তিনটে, এবং তিনটের সময় বই দেখে ফিরলে দাদু ঠিক ভাববেন, কাকলি স্কুল থেকে ফিরছে। কোনো কিছুর জন্যে এমনিতেই আর দাদু তাকে তিরস্কার করেন না। কেবল মাঝে মাঝে দাদুর মুখ কেন জানি গম্ভীর হয়ে যায়। তখন সে বুঝতে পারে দাদু ভীষণ রাগ করেছেন। আর সে তখন এমন বিমর্ষ হয়ে যায় যে দাদু কিছুতেই আর গম্ভীর থাকতে পারেন না। —কাকলি কোথায় রে!