তিনি বললেন, রমাকে নিয়ে অরুণ কোথায় গেল?
অফিসের কোন বাবুর যেন বউভাত।
আসলে সবই বলে গেছে রমা। কিন্তু কেউ কোনো গুরুত্ব দেয়নি। ভবিতব্য ভেবে ছেড়ে দেওয়া। বিয়ের জন্যে খুব পীড়াপীড়ি করতেও আজকাল ভরসা পাচ্ছেন না। ফের সংসারে আবার কিছুটা হা—অন্ন ঢুকে যেতে পারে। এত বড় সমস্যায় মানুষ কখনও পড়ে যায় ভুবনবাবুর জানা ছিল না।
নীরজা বলল, ওষুধ খেয়েছ?
না।
নীরজা জল ও ওষুধ দিলে ভুবনবাবু বললেন, ওরা কখন ফিরবে বলে গেছে?
মানু বলেছে শো দেখতে যাচ্ছে। ফিরতে সন্ধে হবে।
রমা?
ও কখন ফিরবে ঠিক নেই?
কেন ঠিক থাকে না, তুমি একবার ওটা ভেবে দেখেছ?
কিছু ভাবি না। অত ভাবলে সংসার চলে না।
রমার বিয়ে দেওয়া উচিত।
উচিত, করলেই হয়। কে বারণ করেছে। নীরজা ক্ষুণ্ণ গলায় কথাটা বলল।
মেয়ে তোমার রাজি হবে কিনা একবার জিজ্ঞেস কর তো?
রাজি হবে না কেন?
ভুবনবাবু আর কিছু বলতে সাহস পেলেন না। কেবল মুখ ফিরিয়ে বললেন, ওদের কোনো টান নেই।
নীরজা দু’কুচি সুপুরি আলগা করে মুখে ফেলে দিল। বলল, টান না থাকলে এত কেউ করে না।
ছুটির দিনে দেখেছ কেউ বাসায় থাকতে চায় না।
নীরজা ভুবনবাবুর দুঃখটা কোথায় বুঝতে পারছে। মানুষটা সব সময় সবাইকে কাছে পিঠে নিয়ে থাকতে চায়। কাজের দিনে এমনিতেই কেউ বাড়ি থাকতে পারে না। কথাও বিশেষ হয় না। বড় ছেলে আজকাল অফিস থেকে সোজা বাড়ি ফেরে না, প্রিয়নাথের বাড়িতে দাবা খেলে রাত করে ফেরে! তিনি সবাই না আসা পর্যন্ত বারান্দায় পায়চারি করেন, দোতলার বারান্দায় বসলে রাস্তার অনেকটা দেখা যায়। কে কতদূর আছে কে কখন ঢুকছে সবই তিনি টের পান। এবং সবাই এলে তিনি আর কোনো কথা বলেন না। ঘরের আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়েন। এ—বাড়িতে ভুবনবাবু বলে কেউ আছে তখন বোঝা যায় না। কেবল রমা এলে বলবে, বাবার খাওয়া হয়ে গেছে? বাবা শুয়ে পড়েছে? শুয়ে থেকে মেয়ের এমন দু—চারটে কথা শুনতে পান। রাতে আজকাল রমা প্রায়ই বাড়িতে খায় না। কোথাও না কোথাও সে খেয়ে আসে। বাইরের হাবিজাবি খাওয়া আজকাল এত বেড়েছে যে তিনি যথার্থই শঙ্কা বোধ করেন।
ভুবনবাবু বললেন, খুব দুঃসময় আমাদের।
নীরজা এ কথার কোনো তাৎপর্য খুঁজে পেল না। বলল, এ—কথা বলছ কেন?
এখন রাহুগ্রাসের সময়। সাবধানে থাকা ভালো। বৃষ রাশির পক্ষে সময়টা খুব শুভ নয়। মানুকে বললাম যতীন সেনের কাছে যেতে। ও আমাদের কুষ্ঠি বিচার করে রাখবে। শান্তি স্বস্ত্যয়নের দরকার হতে পারে। ছেলেরা কেউ কথা শোনে না। এত কী কাজ, আসার সময় যতীনের কাছে হয়ে এলে কী যে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে বুঝি না। তা—ছাড়া রাসবিহারীবাবুও তাঁর মেয়ের ঠিকুজী পাঠিয়েছেন। সেটাও দেখা দরকার।
মিলে গেলে আমি আর দেরি করব না নীরজা। বিয়েটা ভানুর দিয়ে দেওয়া দরকার।
বয়স বাড়লে মানুষ বাতিকগ্রস্ত হয়ে যায়। আজকাল মানুষটার খুব করকোষ্ঠীর প্রতি বিশ্বাস জন্মে গেছে। যাত্রা শুভ কী অশুভ, এসব বাছবিচার করে চলার স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছে। নীরজার এতে খুব একটা অবিশ্বাস নেই, কিন্তু তার জন্যে সব সময় আতঙ্কিত হয়ে থাকা কেমন হাস্যকর লাগে। সে বলল, তুমি দিন দিন বড় ভীতু হয়ে পড়ছ।
নীরজা জানে মানুষটা এবার অনেক কথা বলবে। সে মেঝেতে ফল—ফুল আঁকা দামি সতরঞ্চি পেতে নিল! শুয়ে শুয়ে বাকিটুকু শোনা যাবে।
ভুবনবাবু বললেন, নীরজা তোমার ভয় করে না?
কীসের ভয়?
মেয়ে তোমার কিছু একটা করে ফেলতে পারে!
বড় হয়েছে। ছোট নেই। হলে ফলভোগ করবে। নীরজা কেমন উত্তপ্ত হয়ে উঠল। তোমার যখন এত সংশয়, মেয়েকে না ছাড়লেই পারতে। বাইরে বের হলে একটু স্বাধীনতা দিতেই হয়।
আগে বুঝতে পারিনি এতটা হবে।
যখন বুঝলে এতটা হচ্ছে তখন আর চুপ থাকা কেন। বলে দাও না, এ বাড়িতে থাকতে হলে চাকরি করা চলবে না। চাকরির জন্যে আগে তুমিও তো কম লোককে ধরাধরি করনি। ভাগ্যিস অরুণের সঙ্গে পরিচয় ছিল। এখন দুঃখ করে আর লাভ নেই।
তোমার বড় ছেলে দুপুরে কোথায় কী করছে তাও তুমি জান না।
সব জানি। বুঝি। কিন্তু এখন ওদের হাতে। কিছু বলতে পারি না।
আস্কারা দিয়েছ! বুঝবে।
আমার আর বোঝার কী আছে। সব বুঝে ফেলেছি। তুমি এখন বোঝো। সারাজীবন তো নিজের গোঁ নিয়ে থাকলে। কারও অধীন হয়ে থাকতে পারলে না। এখন নিজের কাছে নিজেই হেরে যাচ্ছ। মজা মন্দ না।
সাত
ভারি দুরন্ত হয়েছে কাকলি। চুল বব করা। দৌড়াতে গেলে গোটা শরীর যেন নেচে বেড়ায়। শাদা শাটিনের ফ্রক পরতে পছন্দ করে মেয়েটা। কাকাবাবুকে দেখলে ওর দুষ্টুমি আরও বেড়ে যায়। দাদু কাকাবাবু সকাল থেকে সেই যে উবু হয়ে বসেছে ওঠার নাম নেই। কাকলি দৌড়ে এসেছে দরজায়। মুখ বাড়িয়ে বলছে, তোমরা চান করে নাও। মা চান করতে বলছে।
প্রিয়নাথ বললেন, এই হয়ে গেল।
ভানু প্রিয়নাথের মুখ দেখল। সংসারে মন্দাকিনী বউদি, কাকলি এবং বুড়ো মানুষটা। ঠিক বুড়ো নয়, প্রৌঢ় বলা চলে প্রিয়নাথকাকাকে। বয়স বাবার চেয়ে কিছু বেশিই হবে। তবু কী করে যে কাকা হয়ে গেলেন! প্রিয়নাথকাকা, একসময় বাবার খুব বন্ধু ছিলেন। প্রিয়নাথ কাকা একসময় মা’র ভীষণ খোঁজখবর করতেন। এবং এখনও মা, একবার পুরীতে প্রিয়নাথকাকা কত অবহেলা ভরে সমুদ্রের ঢেউ থেকে তাকে তুলে এনেছিল তার গল্প করতে ভালোবাসে। সেবারে প্রিয়নাথকাকা সঙ্গে না থাকলে জলে ডুবেই মরতে হত। মা ঠেস দিয়ে বলত, তোমার বাবা যা একখানা পুরুষ! বয়সকালে প্রিয়নাথকাকা খুবই সুপুরুষ ছিলেন। আধ পাকা চুল। বাবার চেয়ে কম বয়সি মনে হয়। নিজে সুন্দর, বউমাকে বাড়ির মতো মানিয়ে এনেছিলেন। ভয় ছিল বাড়ির নীল রক্ত যেন কলুষিত না হয়। কাকলির উরু দেখা যাচ্ছিল ফ্রকের নীচে। বয়স তো খুব বেশি না। তার চাল ভুল হয়ে যাচ্ছে।