বাসা বাড়িতে সে বড় হয়েছে। সে শুনেছে বাড়ি বদলের স্বভাব তার বাবার যেমন বাতিক ছিল, জ্যাঠামণিরও। এক বাড়িতে দু—তিন বছরও কাটত না, সে তার দশ—বারো বছরের জীবনে এটাই দেখে এসেছে। বাবা মরে যাবার পর মার সঙ্গে সে তার দাদুর বাড়িতে চলে এসেছিল। একতলার একটা ঘরে তখন সে তার মায়ের সঙ্গে থাকত। তারপর মেসো খবর পেয়ে পাটনা থেকে চলে এলেন—মাকে বললেন, তুমি আমার ওখানে চল, কিছুদিন বেড়িয়ে আসবে। ওরা চলে গেল সেখানে—তখন অন্য একটা বড় শহরে মেসোর বদলি হবার কথা। বড় মাসি ওদের নিয়ে গাড়ি করে কখনও রাঁচি, কখনও হাজারিবাগ গেছে। কেবল ঘুরে বেড়িয়েছে। সে বোঝে এত বড় একটা শোক সামলে উঠতে মার সময় লেগেছিল। তারপর সংসারে যে কী হয়, সে বুঝতে পারত না। মা একদিন বলল, আমরা একটা বড় শহরে চলে যাব নানু তোমার মেসো আমার জন্য একটা চাকরি ঠিক করেছে। তুমি ওখানেই পড়বে।
বাবার মৃত্যুর জন্য তার এক বছর পড়া হয়নি। পৃথিবীটা ছিল তখন হাহাকারে ভরা। সর্বত্র সে দেখত, তার পাশে পাশে কেউ হেঁটে যাচ্ছে। আর যেন বলছে, নানু ভয় পাবি না। আমি আছি। মানুষ মরে শেষ হয়ে যায় না। সে তার মাকে বলত, মা বাবা এমন কেন বলে? তখন যা হয়ে থাকে, দাদু এবং মা তাকে গয়াতে নিয়ে গিয়ে পিণ্ডদান করাল। প্রয়াগে সে এবং দাদু ত্রিবেণীর জলে ডুব দিল। পৃথিবী থেকে তার বাবার স্মৃতি মুছে দেবার জন্য সংসারে তখন আপ্রাণ চেষ্টা। কেউ ভুলেও বাবার কথা তার সামনে উচ্চারণ করত না। মাও না। কিছুদিন মা পাথর হয়েছিল—তারপর মেসো সেই যে ‘বেড়াতে চল’ বলে নিয়ে গেল সেই শেষ, শোকের শেষ। মার মুখে হাসি ফুটে উঠল। গাড়িতে মা জানালায় মুখ বাড়িয়ে বলেছিল, মনীষদা ওই দেখো চা—ওলা যাচ্ছে। ডাকো, চা খাব।
মেসো বলেছিলেন, গাড়িটা এখানে অনেকক্ষণ থামবে। চলো নীচে নেমে খাই। নানু নামক বালকের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, তুমি বসো। আমরা এক্ষুণি আসছি।
কত আগেকার কথা অথচ মনে হচ্ছে তার, এই সেদিন যেন সব ঘটে গেল। মা নেমে গেল মেসোর সঙ্গে। মেসো কী একটা ঠাট্টা করল মাকে। মা মেসোকে সামান্য ঠেলা দিয়ে কী একটা রসিকতা করল এবং যেন জীবনে কিছুই থেমে থাকে না—সে দেখল তার মা যখন উঠে আসছে, তখন জোর হাসছে মেসোর কথায়।
নানু মাথা নীচু করে বসেছিল তখন। মার এমন হাসি তার একদম ভালো লাগেনি। সে তখনও মাথা নীচু করে চা খাচ্ছে। সে যখন কথা বলে কারও সঙ্গে, মাথা নীচু করে কথা বলে—কীভাবে যেন তার মাথাটা কারা ষড়যন্ত্র করে হেঁট করে দিচ্ছে। প্রথম ষড়যন্ত্রকারী কে? এই প্রশ্নটা অনেকদিন থেকে তার মাথায় ঘুরছে। বিশেষ করে এখানে আসার পরই মনে হয়েছে সব ষড়যন্ত্রকারীদের সে খুঁজে বার করবে। সব আত্মীয়দের বাসায় যাবে—এবং খোলাখুলি সবার সঙ্গে সে বাবার মৃত্যু সম্পর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করবে।
এখানে আসার পর বছর পার হয়ে গেল। দাদু সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকে। কোথাও বের হতে দেয় না। যেখানে সে যাবে সঙ্গে দাদু যেতে চাইবেন। মানুষটাকে এক এক সময় তার দারুণ ভালো লাগে, এক এক সময় মনে হয় এই মানুষটার প্রতি তার করুণা হবারই কথা। আবার কখনও কী যে ঘৃণা! সে তখন চিৎকার করে ওঠে, ‘তুমি যাও, দাদু আমার সামনে তুমি এসো না। তুমি তো পি ডবল্যু ডির হেড ক্লার্ক ছিলে। একজন কেরানি কত আয় করে। এই আয়ে এত পয়সা কখনও হয়, মেয়েদের তুমিই নষ্ট করেছ—তোমার মেয়েরা কে কী আমার জানতে বাকি নেই। তখন মনে হয়, ছিঃ ছিঃ দাদুর সম্পর্কে এত সব খারাপ চিন্তা তার মাথায় আসে কী করে!
সকালে উঠে ঘুম ঘুম চোখে চা ভাবা যায় না! চা খেলেই যেন শরীরের সব জড়তা নষ্ট হয়ে যায়। সে টান টান হয়ে ওঠে। রক্ত মাংসে মজ্জায় অস্থিরতা জাগে। সে দাঁড়ায়। জানালা খুলে দিয়ে মুক্ত হাওয়া নেয় বুক ভরে। তারপর নীচে ছোটমাসির দরজায় গিয়ে দেখল, মাসি ঘরে নেই। তার জামা প্যান্ট মাসি জোর করে ঘর থেকে তুলে আনে। ধুয়ে ইস্ত্রি করে আবার রেখে দেয় তার ঘরে। তা রাখেনি। কোথায় রাখল তার জামা প্যান্ট! দাদুর ঘরে ঢুকেই অবাক। মাসি আজ সকাল সকাল দাদুর ঘরে ঢুকে গেছে। দাদু পঞ্জিকার পাতা ওলটাচ্ছে। ওকে দেখেই বলল, বোসো। সে বসল না। মাসির দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার কি কিছু হয়েছে ছোটমাসি?
মিতা সামান্য চোখ কুঁচকে বলল, আমার আবার কী হবে?
না এই বলছিলাম, কেমন দেখাচ্ছে তোমাকে, এত সকাল সকাল এখানে।
দাদু তখন বলল, পাঁচটা আঠারো গতে একাদশী।
নানু বলল, দাদু ছোটমাসি আজ একাদশী করবে!
দাদু জানে, নানুর মাথার মধ্যে কেউ গুণ টেনে নিয়ে যায়। একদিন নানু বলেও ছিল কথাটা। আমার মাথার মধ্যে কেউ গুণ টানে—’গুণ টানে’ এইরকম কথা নানুই বলতে পারে। বরং বলতে পারত, ধুনুরি তুলো ধোনে। তার বন বন ডবকা শব্দ মাথার মধ্যে বাজে। কিন্তু তা না বলে গুণ টানে—ভারি আজগুবি কথাবার্তা নানুর। সুতরাং বুড়ো রাসবিহারী সামান্য তামাকের পাতা মুখে ফেলে দিয়ে বললেন, তোমাকে আজ ছোটমাসির সঙ্গে একটু বেলঘরে যেতে হবে।
নানু বলল, আমার কাজ আছে। বুড়ো রাসবিহারী আবার চোখ তুলে দেখলেন নাতিকে তারপর কিঞ্চিৎ অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বললেন, তোমার এত কী কাজ!