তিনি তার বিছানায় এসে বসলেন। সামান্য শুয়ে থাকা। কিছু গাছপালা সম্পর্কিত বই, এবং তাঁর ভেষজ গুণাগুণ কী কী আছে, জানার খুব আগ্রহ তাঁর। এটা ইদানীং হয়েছে। পেটের নীচের দিকে একটা ব্যথা টের পান। মাঝে মাঝে ব্যথাটা তীব্র হয়ে ওঠে। মুখ ফুটে খুব একটা চিৎকার চেঁচামেচি করার স্বভাব না, তলপেটে হাত দিয়ে শুয়ে থাকেন অসার মানুষের মতো। ইদানীং কবিরাজি ওষুধে ভালো ফল পেয়েছেন। দেশীয় গাছ—গাছড়ার প্রতি এ—জন্য আকর্ষণ তার দিন দিন বাড়ছে। প্রিয়নাথের পুত্রবধূ বড় একটা পাঠাগারে কাজ নিয়েছে। সে—ই এ—সব পেলে তাকে পাঠিয়ে দেয়।
সুতরাং জানালা খুলে বসলেন তিনি। পাখা চালিয়ে খুব একটা লাভ নেই। গরম গুমোট হাওয়া। বরং গাছপালার অভ্যন্তরে যে হাওয়া বয়ে যায়, তাতে কিছুটা ঠান্ডা ভাব থাকে, পাখার হাওয়ায় শরীরে গিঁটে গিঁটে আজকাল ব্যথা ধরে যায়। সংসারের অনেক কিছুই আজকাল তার অপ্রয়োজনীয় ঠেকছে। পাখা না চালিয়ে বাইরের হাওয়ার জন্য জানালার কপাট আরও ভালো করে খুলে দিলেন।
তখন নীরজা একা রান্নাঘরে। কবে যে নীরজা এ—ভাবে ভারি একা হয়ে গেল, সব মানুষই বুঝি একদিন এ—ভাবে একা হয়ে যায়। তার সেই যৌবন, নীরজার মায়াবী মুখের কথা আর মনে পড়ে না। বাবা, মা, ছোট কাকা বড় পিসি সব মিলে যৌথ সংসারে নীরজা এসেছিল। তারপর নীরজার শহর বাস। সন্তানদের জন্যে সকাল বিকাল একদণ্ড তার বিশ্রাম ছিল না। কে স্কুল থেকে ফিরল, কার ফিরতে দেরি হচ্ছে, কেউ সময়মতো না ফিরলে বাসস্টপে ছুটে যাওয়া এবং ভুবনবাবুর তখন দুশ্চিন্তার শেষ ছিল না। সেই ছেলে মেয়েরা এখন বড় হয়ে গেছে, বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
কেউ একবার বলেও না, মা, তুমি কেমন আছ! ছুটির দিনে নীরজার আজকাল সবাইকে নিয়ে বেশ খাওয়া—দাওয়ার পর পুরানো দিনের গল্প করতে শখ জাগে কিনা একবার জিজ্ঞেস করবেন ভাবলেন। নীরজা তোমার ইচ্ছে হয় না, তক্তপোশের নিচ থেকে পানের বাটা বের করে পা ছড়িয়ে বসার। তুমি জাঁতিতে সুপুরি কাটতে কাটতে গল্প করবে, আমরা শুনব। অথচ দ্যাখ তোমার কেউ নেই। এত করে যে সবাইকে বড় করলে, ওরা কারা?
নীরজা বোধহয় খেতে বসেছে। নীরজা কী খায়, অথবা কীভাবে খায় দেখার ভারি ইচ্ছে হল। নীরজা কখনও খায় মনে হয় না। দুষ্টু বালকের মতো পা টিপে টিপে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালেন। অনেকদিন পরে স্ত্রীর সঙ্গে একটু দুষ্টুমি করার ইচ্ছে হল। তক্তপোশ থেকে নেমে সন্তর্পণে মুখ বাড়ালেন। নীরজা আলগা করে জল খাচ্ছে! সেই একটাই গ্লাস, গ্লাসটার সঙ্গে নীরজার বোধ হয় নাড়ির টান আছে। জল খাবার সময় নির্দিষ্ট গ্লাসটি তার চাই। অনেক উঁচু থেকে জল ঢেলে বেশ খাচ্ছে। বেশ অনেকক্ষণ ধরে। ভারি তৃষ্ণার্তের মতো! সংসারে এত তৃষ্ণা কীসের!
দরজায় ভুবনবাবু।
নীরজা চোখ মেলে তাকাল। ও মা তুমি! ঘুমাওনি! কী দ্যাখছ!
ভুবনবাবু বললেন, তোমাকে।
নীরজা খুব শান্ত গলায় বলল, আমার আর কিছু দেখার নেই।
ভুবনবাবু দরজার ওপর উবু হয়ে বসলেন।
শোও না গিয়ে।
ভুবনবাবু বললেন, তুমি খাও। আমি একটু বসি।
আর জায়গা পেলে না বসার?
নীরজা!
অসময়ে মানুষটার চোখ—মুখ খুব ভালো ঠেকছে না। নীরজা সামান্য মাছের ঝোল দিয়ে ভাত নেড়ে চেড়ে নিচ্ছিল। মানুষটা ঠায় বসে আছে। তার খাওয়া দেখছে।
নীরজা বলল, ঘুম আসছে না?
তুমি আর এক হাতা ভাত নাও। মনে হয় তোমার পেট ভরেনি।
নীরজা খেতে খেতে বলল, তবে এক হাতা ভাত দাও।
অনেকদিন আগের কথা মনে পড়ে গেল ভুবনবাবুর। তখন নীরজা আর সে। রাতের বেলা নীরজা খেতে বসে প্রায়ই ডাকত, ভাত দাও। ভাত লাগবে।
যেন নীরজা মানুষটাকে সব সময় কাছে কাছে রাখতে ভালোবাসত। এবং শরীরে তখন কী যে মোহ। শরীরে সব সময় আশ্চর্য সৌরভ মেখে ঘুমোত নীরজা। কাজে গেলে নীরজার জন্যে মনটা পড়ে থাকত বাসায়। কতক্ষণে ছুটি হবে, কতক্ষণে আবার দরজা খোলার সঙ্গে নীরজার মুখ দেখবে। এবং কত রকমের কূট চিন্তা যে মাথায় এসে ভিড় করত তার।
রান্নাঘরের দরজা বন্ধ করবার সময় ভুবনবাবু বললেন, নীরজা একটা কথা আছে?
নীরজা তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছছিল। —কী কথা।
লুডো খেলতে ইচ্ছে করছে।
বুড়ো বয়সে ও—সব শখ ভালো না!
খুব বুড়ো হয়েছি?
নীরজা কিছু বলল না। মানুষটা কিছুদিন থেকেই কেমন অন্যমনস্ক। রমার চাকরিটা হবার পর কিছুদিন ভারি খুশি ছিলেন, তারপর আবার আগের মতো। অরুণ এলে যতটা কথা বলা দরকার, ততটাই। এবং যেহেতু মানুর একটা চাকরি দরকার, অরুণের সঙ্গে বরং একটু বেশিই কথা বলেন। মাঝে মাঝে কথা বলতে গিয়ে হেসেও দেন।
দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর নীরজা বেশ পা ছড়িয়ে বসবে একটুক্ষণের জন্য। বেশ সুন্দর করে আপন মনে সুপুরি কাটবে। পান খাবে। তারপর একটু গড়িয়ে নেওয়া স্বভাব। তখন মানুষটা তক্তপোশে শুয়ে থাকে। ঘুমিয়ে থাকে কী জেগে থাকে বোঝা যায় না। খুব দরকারি কথা মনে পড়ে গেলেও জিজ্ঞেস করে না নীরজা। কারণ মানুষটার আজকাল ঘুম এমনিতেই কম হয়। সব সময় কেমন সন্ত্রস্ত থাকেন। নীরজা মাঝে মাঝে না বলে পারে না, এখন তো তুমি সুখের নাগাল পেয়েছ। এত ভাবার কী আছে বুঝি না।
সুখের নাগাল পেয়েছেন ঠিক। সংসারে হা—অন্ন বলতে আর কিছু নেই। বরং বেশ উঁচু মধ্যবিত্তের যা যা লাগে সবই একে একে ছেলে মেয়ে দুজনে মিলে করে ফেলেছে। বেশি ভাড়ার বাড়ি, বসার ঘর, সোফা সেট, এবং কদিন পর বাড়িতে একটা ফ্রিজ—টিজ হয়তো চলে আসবে। মানুর চাকরিটা হয়ে গেলেই বোধহয় ওটা হয়ে যাবে। এবং তিনি বুঝতে পারেন, তখন তিনি আরও একাকী। অরুণের পিছনে মেয়েটা ছুটছে। রমার এ—বয়সে এত স্বাধীনতা সহ্য হবে কিনা বুঝতে পারছেন না। যদিও তিনি এ—কালের বাবা, অথচ এ—কালের সন্তানদের ঠিক বুঝতে পারেন না যেন—কেমন দুঃখী মুখে একটা আশঙ্কা লেগে থাকে সব সময়।