নানু আজ যথার্থই সুন্দর এবং সতেজ। সে উঁচু লম্বা, তার ওপর উঁচু হিলের জুতো পরেছে। হাত—পা লম্বা, একজন তরুণের ঠিক যা যা থাকলে সুপুরুষ মনে হতে পারে নানুর সব আছে। এবং ওর দিকে সব সময় নবনীতা সোজা তাকাতে পারছে না। মাঝে মাঝে নানুদা ভারি সরল মানুষ হয়ে যায়—এটাই বড় বিপদ। সবাই তো আর একরকমের নয়। কে কোন কথার কী মানে করে বসবে কে জানে!
নানুদা তোমার লাল বলটা আছে?
লাল বলটা মানে?
ওই যে সকালেই দেখতাম তুমি একটা লাল বল নিয়ে পার্কের দিকে তোমার জেঠুর হাত ধরে চলে যাচ্ছ।
তুমি দেখতে।
বা, মা যে বলত, ওই দ্যাখ মিঃ চক্রবর্তীর ছেলে, কী সুন্দর। কাঁদে না।
তুমি বুঝি কাঁদতে খুব।
কে জানে!
জানো নবনীতা অনেকদিন থেকে সেই লাল বলটাই খুঁজছি। কীভাবে যে বলটা আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেল। বলেই নানু কেমন দুঃখী মুখ করে ফেলল। পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছল। যেন কোনো সুদূরে সেই লাল বলটা গড়িয়ে চলে যাচ্ছে—সে ছুটে কিছুতেই আর তার নাগাল পাচ্ছে না। মার মনীষদাই প্রথম টের পাইয়ে দিল তাকে, বলটা চুরি গেছে। কোথাও তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
এবং সঙ্গে সঙ্গে মগজে সেই আগুনের আংরা ধিকি ধিকি জ্বলে উঠলে সে বলল, ঈশ্বর আমি তো সবাইকে ক্ষমা করে দিয়েছি, তবে আর আমার মাথায় ধক ধক রেলগাড়ি চালাচ্ছ কেন। সে তাঁর ঈশ্বরের কথা এ—সময় শুনতে পেল। তিনি বলছেন, সামনে দ্যাখ। —কী দেখছ?
নবনীতা।
সে কেমন?
তুলনা হয় না।
মাথার মধ্যে রেলগাড়ি আর চলছে?
না।
নবনীতা বলল, কার সঙ্গে কথা বলছ?
ও না না। নবনীতা আমি তোমার সঙ্গে কথা বলছি।
তবে শুনতে পাচ্ছি না কেন?
শুনতে পাচ্ছ না। তবে জোরে বলি।
সে তখন খুব ধীরে ধীরে বলল, লাল বলটা খুঁজে পেয়েছি। নবনীতা আমার লাল বলটা এখন বুঝতে পারছি কার কাছে আছে।
কার কাছে? নবনীতা খুব হতচকিত গলায় বলল।
বলটা তোমার কাছে আছে। তুমিই আবার লাল বলটা আমাকে ফিরিয়ে দিতে পারো।
আমার কাছে? কী বাজে বকছ নানুদা! আমি লাল বলটা দিয়ে কী করব!
তোমার কাছেই আছে। কাল সহসা জানলায় তোমার মুখ দেখে টের পাই। আশ্চর্য এক জ্যোৎস্না দেখতে পাই বনভূমিতে খেলা করে বেড়াচ্ছে।
নানুদা তোমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে না তো!
না, আমি ঠিক আছি। সত্যি বলছি আমার মাথার কোনো গণ্ডগোল নেই। আগে ছিল। হুঁসহাস রেলগাড়ি মাথার মধ্যে ঢুকে যেত। তোমাকে দেখার পর সব আমার নিরাময় হয়ে গেছে নবনীতা।
নবনীতা এবার উঠে দাঁড়াল। নানুর দিকে আর তাকাতে পারছে না সে। একজন অসহায় যুবক মাথা নীচু করে এ—ভাবে পায়ের কাছে বসে থাকলে বড়ই অস্বস্তি। সে অন্য প্রসঙ্গে যেতে চাইল। এখন আপাতত চা জলখাবার সামনে রাখার ইচ্ছে। সে ভিতরে ঢুকে কাজের মেয়েটিকে বলল, চা দাও! দেখ ফ্রিজে মিষ্টি আছে। বের করে দাও।
ছয়
ভুবনবাবু খেতে বসার সময় দেখছিলেন, মানু খুব তাড়াতাড়ি খেয়ে উঠতে যাচ্ছে। সাধারণত ভুবনবাবু এবং মানু আজকাল এক সঙ্গেই খায়। তাড়াতাড়ি খেতে দেখে বলেছিলেন, আস্তে খা। বিষম খাবি। গলায় আটকে যাবে।
ভুবনবাবুর কথাতেই যেন মানু জল চেয়েছিল। গলায় সত্যি আটকে যেতে পারে। বড় বড় ড্যালা, খাদ্যনালির পক্ষে বা কষ্টকর এবং বেশি জোরে ঢোক না গিললে সবটা ভেতরে যায় না, যে—কোনো সময় কিছু একটা অঘটন ঘটে যেতে পারে—বাবা তাকে সব সময় এত বেশি সাবধানে রাখতে চায় যে মাঝে মাঝে করুণা হয়। তবু সে যতটা পারে বাবাকে সমীহ করে চলে।
বোধ হয় ভুবনবাবু আরও কিছু বলতেন। নীরজা ভাতের থালা এগিয়ে দিয়েছিল। সামান্য ঘি, তিন—চার টুকরো পটল ভাজা, বড় স্টিলের থালার মাঝখানে নৈবেদ্যর মতো ভাত চুড়ো করা। এবং ছোট বাটির একবাটি মুগের ডাল। এমন সুন্দর খাবার দেখে ভুবনবাবু বোধহয় বাকিটুকু বলতে ভুলে গেছিলেন।
ঠিক ওঠার সময় তিনি মানুকে বললেন, যতীন সেনের কাছে একবার বিকেলে যা দেখি। বলবি, বাবা আপনাকে যেতে বলেছে। আর একটা ঠিকুজি এসেছে। ভানুর কুষ্ঠির সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে হবে।
মানু খুবই বিরক্ত। কুষ্টি ফুষ্টি তার ধাতে সয় না। সে বুজরুকি ভাবে। তোয়ালে দিয়ে মুখ মোছার সময় সে বলল, কাল যাব।
আজ না গেলে ওর সঙ্গে দেখা হবে না।
মানু সাড়া না দিলে অগত্যা ভুবনবাবু বললেন, যাবে কোথায়!
ভুবনবাবু তখন ভাত মেখে খাচ্ছিলেন। নীরজা তাকিয়ে আছে। চৌকাঠের কাছে মানু। সে বাবার বাকি কথাটা শোনার জন্যে দাঁড়িয়ে!
তোর বুঝি অনেক কাজ? রাসবিহারীবাবু কালও ভানুর অফিসে লোক পাঠিয়ে খোঁজ নিয়েছেন।
আমার আবার কাজ! ম্যাটিনিতে টিকিট কাটা আছে।
তাহলে ফেরার পথে দেখা করে আসিস।
কী বলব?
ওইতো রাসবিহারীবাবু মেয়ের ঠিকুজী পাঠিয়েছেন।
মানু আর দেরি করেনি। রাসবিহারীবাবু, কেন লোক পাঠায় সে—সব জানার ইচ্ছে তার বিন্দুমাত্র নেই। বাবা ছক মিলিয়ে যাচ্ছেন। ছক ছাড়া কোনো কাজ হয় না। এবং এই নিয়ে কত যে ছক এ বাড়িতে এল। এবারে এসেছেন রাসবিহারীবাবু। সে মনে মনে হেসে ফেলল। তারপর সে ঘরে ঢুকে জামা গলিয়ে বের হয়ে পড়েছিল।
এবং ভুবনবাবু খেয়ে উঠে যখন করিডরে হেঁটে যাচ্ছিলেন—মনে হয় কেমন নিস্তব্ধ এই আবাস। কারও কোনো শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। ছুটির দিন, সবারই থাকার কথা, বড়টার তো একটায় বাড়ি ফিরে আসার কথা, আসেনি, বোধহয় প্রিয়নাথের বাড়িতে যাবে। প্রিয়নাথ দাবা খেলতে পছন্দ করে—খেলাটি প্রিয়নাথই ভানুকে শিখিয়ে নিয়েছে। প্রিয়নাথ ছেলের মৃত্যুর পর বাড়ি থেকে একেবারে বের হয় না। কেবল সন্ধ্যার দিকে পাশের আশ্রমে যায়। গীতাপাঠ, কীর্তন প্রভৃতির ভেতর কিছুক্ষণ ডুবে থাকতে ভালোবাসে। প্রিয়নাথ যৌবনে ঘোর নাস্তিক ছিল। সেই প্রিয়নাথ ধর্মে এমন মজে গেছে দেখে তার সামান্য হাসি পাচ্ছিল। প্রিয়নাথের নাতনি কাকলি মাঝে মাঝেই ভানুকে ডেকে নিয়ে যায়। কী যে জরুরি কাজ এত, তিনি বোঝেন না। ভানুকে আজকাল এ বাড়ির বড় ছেলে ভাবতে কষ্ট হয়। দায়—দায়িত্ব সবই ঠিকঠাক বহন করছে, কিন্তু তবু মনে হয় সংসার—বিচ্ছিন্ন মানুষ। দু—একবার মেয়ে পছন্দ করেছিলেন, কিন্তু ছেলের ভারি অমত। যা রোজগার তাতে বিয়ে করা বিলাস—ভুবনবাবু নিজের অক্ষমতাকেই যেন তখন বেশি করে দায়ী করেন। মা—বাবা ভাই বোনের দায় যার এত, বিয়ে করা তার পক্ষে শোভা পায় না। সে—জন্য একটা অপরাধবোধে মাঝে মাঝে ভীষণ কাবু হয়ে যান ভুবনবাবু। সংসারে ঠিক যেভাবে রাশ টেনে রাখা দরকার পারেন না। আলগা রশিতে সবই ঢিলেঢালা হয়ে যায়। তার গাম্ভীর্যকে কেউ আর বেশি আমল দেয় না।