সে দূর থেকেই নবনীতাদের জানলা দেখতে পেল। বুকের ধুকপুকানি বাড়ছে। সহসা নবনীতা এত প্রিয়জন হল কী করে। চারপাশে সব লুণ্ঠনকারীরা। সে গোপনে বলল, নবনীতা আমি এসে গেছি।
তারপরই নানুর খেয়াল হল বাড়িটার দরজা জানালা বন্ধ!
সে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। প্রথমত কেমন সংকোচ, সে যে—এত দূর আবার চলে এসেছে কাকিমা যদি টের পায়, আসলে নবনীতাই তার আকর্ষণ। এ—সব মনে হতেই যতটা দ্রুত ভেবেছিল, দরজায় দাঁড়িয়ে বেল টিপবে, ঠিক ততটা দ্রুত সে কিছু করতে পারল না। এবং মনে হল, সে গতকালই এখানে এসেছিল—একটা দিন মাঝে পার হয়নি, নবনীতাও লজ্জায় পড়ে যেতে পারে, বেহায়া ভাবতে পারে তাকে। এত সহজে উতলা হওয়া ঠিক না। সে বেল টিপল না। সারাদিন একবারও মনে হয়নি কথাটা। সে নীচে নেমে কী করা উচিত ভেবে দেখবার জন্য পার্কটায় গিয়ে বসবে ভাবল।
তখনই মনে হল কেউ ডাকছে, এই নানুদা চলে যাচ্ছ কেন?
সে ওপরে তাকিয়ে দেখল, জানালার ফাঁকে ভারি মিষ্টি মুখ। আধভেজানো জানালায় রোদ এসে পড়েছে, রোদে ওর চোখ মুখ চিক চিক করছিল।
তারপরই কেমন গম গম করে বেজে উঠল বাজনা—শরীরের রক্তে সেই নিবিড় ধ্বনিমাধুর্য নানুকে কেমন ভালোমানুষ করে তোলে।
দরজা খুলে দিলে নানু বলল, সব বন্ধ। ভাবলাম কোথাও চলে গেছ।
কোথায় যাব?
এই কোথাও। তারপর মাথা নীচু করে সেই আগের মতো নানু বলল, তোমার কাছে একটা বিশেষ কাজে এলাম নবনীতা।
আগে বোস। তারপর না হয় কাজের কথা বলবে।
কতদিন নানুর কোনো প্রিয়জন ছিল না। সে সবাইকে ঘৃণা করে এসেছে। মানুষের কিছুই তার ভালো ঠেকেনি। সবাইকে মনে হয়েছে ফেরেব্বাজ, ধান্দাবাজ। যা খুশি সে বলে ফেলতে পারত। কিন্তু এখন সে কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছে না। সে লাজুক বালকের মতো শুধু বসে থাকল। নবনীতা তাকে বসতে বলেছে। তাকে দোতলার ঘর থেকে ডেকে ফিরিয়েছে—এতসব মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটার ওপর কৃতজ্ঞতায় চোখ কেমন ঝাপসা হয়ে গেল।
নবনীতা বলল, তুমি বসো। আমি আসছি।
কিন্তু আশ্চর্য। বাড়িতে যেন আর কেউ নেই। নবনীতার ভাইবোনেরও কোনো সাড়া পাচ্ছে না। কাকিমা কোথাও যেতে পারে, নবনীতা একা বাড়িতে। ওর শরীরটা ভীষণ দুলে উঠল। সে বলল, ঈশ্বর আমাকে ক্ষমা করবেন—আমি পারব না।
নানুর এই স্বভাব, অর্থাৎ শরীরের মধ্যে কোনো অশুভ ইচ্ছের প্রভাব বাড়তে থাকলে সব সময় এমন বলে সংযম রক্ষা করতে চায়।
তখনই নবনীতা ফিরে এল। সে খুব তাড়াতাড়ি শাড়ি পরে এসেছে। শাড়ি পরলে নবনীতাকে যুবতীর চেয়েও বেশি নারী মনে হয়! একজন নারী জীবনে কত দরকার, নবনীতাকে দেখার আগে নানু টের পায়নি।
নবনীতা আঁচলে গা ঢেকে বসল। বলল, আপনাকে একটা সারপ্রাইজ দেব নানুদা।
নানু এবং নবনীতার মাঝখানে শুধু একটা সেন্টার টেবিল। মাঝখানে এক গজ রাস্তা পার হতে হয়। অথচ এই এক গজ রাস্তা কত যোজন দূরে মনে হচ্ছে। আহা এই নারী সুধা পারাবার। অস্থিমজ্জায় রক্তে মাংসে বড় বেশি পটু নবনীতা।
সে বলল, নবনীতা কাকিমা কোথায়?
মা রবীন্দ্রসদনে গেছে আদিপাউস দেখতে।
তুমি গেলে না। ওরা কোথায়! তোমার ভাইবোন।
বাবার সঙ্গে গেছে! তুমি আদিপাউস দেখনি।
না।
দেখলে না কেন?
কী হবে দেখে?
কী হবে আবার! মানুষ নাটক দেখে কেন? সিনেমা দেখে কেন! আমি তো আজকাল কবিতার সকাল শুনতে যাই। কেমন একটা নতুন জগৎ মনে হয়।
কতদিন কিছুই দেখিনি।
এয়ারপোর্ট দেখেছ?
না।
একদিন দেখে এসো।
তুমি সঙ্গে গেলে যাব।
বারে আমি যাব কী করে! মা আমাকে তোমার সঙ্গে যেতে দেবে কেন?
দিলে কী হবে?
নবনীতা হেসেছিল। —তুমি সত্যি বড় সরল নানুদা। তোমার মতো মানুষ এখনও তবে পৃথিবীতে দু—একজন আছে।
জানো আমার খুব ইচ্ছে করে….তারপরই নানুর মনে হল, একদিনের আলাপে নবনীতাকে তার ইচ্ছের কথা বলতে পারে কিনা। সে সামান্য থেমে নবনীতার দিকে তাকাল। নবনীতা ছাপা হলুদ কলকা পাড়ের সিল্ক পরেছে। গায়ে সবুজ ব্লাউজ। গলায় সাদা পাথরের মালা। চোখে কাজল কিংবা ভ্রূ—প্লাক করা হতে পারে—কিংবা নবনীতার ভ্রূ এতই সুন্দর যে দেখলে মনে হয় আলগা হয়ে বসে আছে ভ্রূজোড়া। তখনই নবনীতা বলল, নানুদা তুমি কিছু খাবে?
কী খাব?
যা বলবে?
কত কিছু খেতে ইচ্ছে করছে নবনীতা—কিন্তু কে দেয়।
খুব ফাজিল।
নানু নিজের দিকে তাকাল। সে খুবই চঞ্চল হয়ে পড়ছে। নবনীতা এই বয়সে সবই কি বুঝতে পারে। সে ভেতরে ভেতরে কতটা অস্থির হয়ে পড়েছে এটাও কি চোখ মুখে ধরা দেয়। এমন কেন হচ্ছে। না কী এমনই স্বভাব তার, সহজেই সব জয় করে নেবার স্বভাব। কেউ যদি চলে আসে—কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী তার। সে বলল, নবনীতা তোমার আর কোনো প্রেমিক নেই তো?
ও মা, কী সব বিতিকিচ্ছিরি কথা বলছ নানুদা।
না এমনি বললাম। আচ্ছা তুমি কখনও পাহাড়ে গেছ?
যাব না কেন। ওইতো সেদিন আমরা রাঁচি থেকে ঘুরে এলাম। পাহাড়ে গেলে মন ভারি উদাস হয়ে যায়, না নানুদা?
যাও না। জেঠিমাকে নিয়ে তো যেতেই পার। কেদারবদরি যাওয়া তো খুব সহজ। সোজা ট্রেনে হরিদ্বার…..
নানু বলল, মা আর আমাকে নিয়ে কোথাও যাবে না।
নবনীতা উঠে জানালার পর্দাটা আরও বেশি ঠিকঠাক করে দিল। তারপর রেকর্ড প্লেয়ার থেকে সুন্দর একটা ভেনচারের মিউজিক তুলে নিল। এবং নানুর দিকে তাকিয়ে বলল, কেমন লাগে ভেনচারের মিউজিক। আর শুনবে?