নানু আজ সকাল সকাল স্নান করল। চা, জলখাবার খেল দাদুর সঙ্গে। মাসি সকালবেলায় সহসা দুটো মেহেদি হাসানের গজল গেয়ে ফেলল। এবং মনেই হয় না কোথাও এ—বাড়িতে কারও কোনো গোপন দুঃখ আছে।
নানু আজ পড়ার বইগুলিও উলটে পালটে দেখল। তার মনে হচ্ছে এ—সব পড়ে মানুষের আখেরে কিছু হয় না। শুধু পণ্ডশ্রম। ফলে তার জোরে জোরে গান গাইতে ইচ্ছে করছে। বইগুলি সরিয়ে আয়নায় নিজের মুখ দেখল। নরম দাড়ি গালে। ভালো করে আজ আবার দাড়ি কামাল। গালে হাত রেখে বুঝল বেশ মসৃণ। চশমার ভেতর চোখ দুটো ভারি স্নিগ্ধ। কোনো জ্বালা নেই। তারপর খুব ধীরে সুস্থে দাদুর ঘরে এসে বসল। ফোন তুলে ভাবল নবনীতাকে ফোন করবে। তখনই মনে হল, নম্বর তার জানা নেই। বিকেলে আবার একবার যাওয়া দরকার। এবং সে ভাবল, গেলেই ত হবে না, একটা অজুহাতের দরকার। তখনই মনে হল, নবনীতাকে নিয়ে সেই বাড়িটায় একবার যাবে। যেখানে সে তার বাবা মা এবং ঠাকুমার সঙ্গে বছরের পর বছর ছিল।
তখন অবশ্য জেঠু তাদের সঙ্গে ছিল না। কোথায় সংসারে একটা কাঁটা বিধে যায়, জেঠু এক সকালে, সেই ধুমসো মোটা মতো মেয়েছেলেটাকে সঙ্গে নিয়ে এসে বলেছিল, এই হাসি। এম এ পাশ। মাস্টারি করে। আমি বিয়ে করব মা। অবনীশ শেষ পর্যন্ত এমন একটা রাক্ষুসে ডাইনির পাল্লায় পড়ে যাবে ঠাকুমা স্বপ্নেও ভাবেনি। রাক্ষুসীটা আসার পর থেকেই এমন একটা সুখী সংসার দুদিনে কেমন হতশ্রী হয়ে উঠল।
তখন সংসারে এটা থাকে না, ওটা থাকে না। খরচ কেন এত বেশি হয়। সে শুতে পায় না জেঠুর সঙ্গে। মা নিত্যদিন বাবাকে গালমন্দ করে। বাবার ভীষণ খরচের হাত। সংসারে জেঠুর টাকা পয়সা দেওয়া ক্রমে কমে যেতে থাকল। এবং এক সকালে সেই রাক্ষুসীটাকে নিয়ে অন্য বাসায় উঠে গেল। বাবা সেদিন এত বেশি আঘাত পেয়েছিলেন যে দু’দিন কিছুই খাননি। এসব মনে হলেই তার চোখ জ্বালা করতে থাকে এবং আক্রোশ জমে ওঠে। অথচ আজ সকালে সে ভেবেছিল—সব রকমের আক্রোশ মন থেকে সরিয়ে দেবে। সে তো সবাইকে ক্ষমা করে দিয়েছে।
রাসবিহারী সকালে নানুর এই পরিবর্তনে কিছুটা বিস্মিত হলেন। তিনি নানুকে বললেন, কাল তোমার ফিরতে এত দেরি হল কেন?
নানু কাগজ ওলটাচ্ছিল। সে দাদুর দিকে না তাকিয়েই বলল, এক জায়গায় গেছিলাম।
সে তো বুঝতে পারছি। সেটা কোথায়?
বেশি দূর না।
দিনকাল ভালো না। তোমার জন্য আমরা চিন্তা করি, সেটা একবার মনে রেখো।
আর হবে না।
রাসবিহারী নাতির এমন কথায় আরও অবাক হয়ে গেলেন। ভালো মানুষের যে স্বভাব, প্রায় সে রকম কথাবার্তা নানুর। তিনি বললেন, তোমার জেঠু কাল ফোন করেছিলেন।
কোত্থেকে?
অফিস থেকে।
কিছু বলল।
বলেছে মন দিয়ে পড়াশোনা করতে।
তাই বুঝি। তারপর কাগজটা রেখে হাত পা সটান করে বলল, তুমি কী বললে?
তুই পড়াশোনা একদম করছিস না বললাম।
নানু আর কথা বলল না। সে ভাবল আজই দুপুরে একবার ফোন করবে জেঠুকে। অফিসে এলেই তার ফোন পাবে জেঠু। সে বলবে, কাল তোমার ওখানে যাব জেঠু। কতদিন তোমাকে দেখি না। সংসারে আমার বড়ই প্রিয়জনের দরকার।
তারপর আর কেন জানি তার সময় কাটে না। কলেজ যাবে কী যাবে না ভাবছিল। একবার মনে হল কলেজে গেলে, সময়টা দ্রুত কেটে যাবে। মানু ক’দিন ধরে কলেজ কামাই করছে। ইস্টবেঙ্গল আর মোহনবাগানের খেলা এলেই সে কলেজে আসে না। আজ হয়তো আসতে পারে। এলে নবনীতার সঙ্গে তার যে আলাপ হয়েছে সে—কথা বলবে। জানতে চাইবে, নবনীতার এমন কথাবার্তায় কী মনে হয়। মনে হয় কী নবনীতা তাকে গোপনে কিছু দিতে চায়। তারপরই ভাবল—যা, সে এ—সব মানুকে বললে, নবনীতাকে ছোট করা হবে। বরং কোনো ক্রাইসিস দেখা দিলে সে মানুর পরামর্শ নেবে।
কলেজে আজ তিনটে ক্লাস—জে এমের ক্লাসে সে খুব মনোযোগ দিয়ে কনসাইনমেন্ট কাকে বলে, তার বিল ভাউচার কেমন হয় শুনল। এবং ব্যাংকিং—এর ক্লাসে সে আজ কিছু নোটও নিল। অনেকদিন পর মনে হয়ে ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য জীবনে এ—সব দরকার। কৃতী মানুষ না হতে পারলে নবনীতার মান সম্মান রাখতে পারবে না।
কলেজ ছুটির পর সে একটা রেস্টুরেন্টে বসে দুপিস পাউরুটি, ডিম এবং এক কাপ চা খেল। এবং তখনই মনে হল এ সময় রওনা হলে ঠিক পাঁচটার মধ্যে নবনীতার বাড়িতে পৌঁছতে পারবে।
যখন পার্কটায় এল, তখন মনে হল রোদের আঁচ এতটুকু কমেনি। গ্রীষ্মের দুপুর সহজে শেষ হতে চায় না যেন। নবনীতা এখন কী করছে! ওর পরীক্ষা আসছে বছরে। তারপরই মনে হল গ্রীষ্মের ছুটি, নবনীতাদের ছুটি হয়ে যেতে পারে। কাল বাদে পরশু তার কলেজও বন্ধ হয়ে যাবে। নবনীতা বাড়িতেই থাকবে—না কী নবনীতার অন্য কোনো প্রেমিক আছে—যদি থাকে তবে! এই প্রশ্নটা তাকে অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দিল।
নানু তাদের পুরানো বাসাবাড়িটা পার হয়ে যাচ্ছে। তার মনেই নেই এ সেই বাড়ি, যেখানে বসে সে বাপের আদ্যশ্রাদ্ধ করেছিল। মাথা নেড়া, গায়ে নতুন মার্কিন কাপড়, প্রায় সন্ন্যাসী বালকের মতো তাকে দেখাচ্ছিল।
এ—বাড়িতেই তার শৈশব কেটেছে বলা চলে—বাবা জেঠু ঠাকুমা মা এবং সে! মা তখন বাড়ির বধূ। বড় করে কপালে সিঁদুরের ফোঁটা, সিঁথিতে লম্বা সিঁদুর এবং খুব সকালে প্রাতঃস্নান, তারপরই রান্নাঘরে ঢুকে বাড়ির মানুষদের জলখাবার থেকে অফিস স্কুলের সময়মতো ঝাল—ঝোল ভাতের ব্যবস্থা এক হাতে। জেঠু তাকে একটা মিশনারি স্কুলে দিয়ে আসত। তখন সব কিছুই ছিল মায়া মাখানো, এমনকি বাড়ির বেড়ালটাও খেল কী না লক্ষ্য থাকত সবার। অথচ আজ নানু বাড়িটা পার হয়ে গেল, লক্ষ্যই করল না বাড়িটার দরজায় কেউ দাঁড়িয়ে আছে। বাবা গ্রীষ্মের দিনে রোজ সকালে বাড়িটার রোয়াকে এসে বসত। কোথা থেকে বয়ে আসত ঠান্ডা হাওয়া। বাবার চুল উড়ত। সে পেছনে এসে কখনও ঝাঁপিয়ে পড়ত। বাবা তখন বলত, নানু পাশে বোস। ওই দেখ কে আসছে। ধরে নিয়ে যাবে। ওর ছোট বুকটা কেঁপে উঠত—যেন কেউ নিয়ে যাবার জন্য সত্যি আসছে। সে ভয় পেয়ে বলত, বাবা আমি দুষ্টুমি করব না। তোমার পাশে চুপচাপ বসে থাকব। বাবা বলত ঠিক আছে, বলে দেব, নানু খুব ভালো ছেলে। এত ভালো থেকেও শেষ পর্যন্ত কারা তার সর্বস্ব লুণ্ঠন করে নিয়ে গেল। এক অদৃশ্য অশুভ ভয়ংকর হাত তাকে উদাসীন মাঠে রেখে চলে গেছে। এখন সেই উদাসীন মাঠ থেকে সে দু—হাত তুলে ছুটছে—আর কিছুদূর গেলেই সে জলছত্র পেয়ে যাবে। নবনীতা সেখানে গাছের নীচে একজন দুঃখী মানুষকে কতদিন পরে জলদান করবে।