মানুর এই ধরনের অশুভ চিন্তা করার একটা বাতিক আছে। বাবা যখন অফিস থেকে রিটায়ার করে তখন বয়স তার খুব একটা বেশি না। বাবা একটু রাত করে ফেললেই জানালায় দাঁড়িয়ে ছটফট করত মানু। আর মনে হত, কেউ বলছে—এটা কি ২৩/১০ এর বাড়ি? এখানে ভুবনবাবু বলে কেউ থাকেন? আপনি ভুবনবাবুর কে! তিনি হাসপাতালে।
মানু বলল, বুককি নির্ভাবনায় বলতে পারিস।
গুরু তোমার জয়া কিন্তু প্রেম করছে।
কার সঙ্গে?
সে তো গুরু জানি না।
ওর অনেক কবি বন্ধু আছে। জয়া বলেছে, কবি বন্ধুদের নিয়ে জয়া মাঝে মাঝে বেড়ায়।
বুককির মুখটা মানুর কথায় কেমন ফ্যাকাশে দেখাল। সে ভেবেছিল জোর একটা খবর দেবে আজ মানুকে। কিন্তু মানু কোনো উত্তর দিল না। কলেজ স্ট্রিটের পিছনের দিকটার একটা রেস্টুরেন্টে সে জয়াকে দুদিন দেখেছে। পর্দা ঘেরা সব কেবিনে নানা রকমের নষ্টামি করার জায়গা। বদনাম আছে জায়গাটার। উঠতি কলেজ পালানো সব ছেলেমেয়েদের খুব ভিড় হয়। সহজে কেবিন পাওয়া ভার। একবার ঢুকে গেলে কেউই বের হতে চায় না। এমন জায়গায় সে জয়াকে দেখেছিল। সঙ্গে সুন্দর মতো তার বয়সি একটা ছেলে।
বুককি বলল, কবি বন্ধুরা বুঝি খুব ভালো ছেলে হয়?
অন্তত তোমাদের মতো না।
রুমন বলল, মাইরি, আমিও কবিতা লিখতে আরম্ভ করব ভাবছি।
ভেবে দ্যাখ না। চাট্টিখানি কথা না। কবি হতে চাইলেই কবি হওয়া যায় না। জয়ার নাম আছে।
বুককি বলল, ছেলেটার যদি ফ্যাচাং করার ইচ্ছে হয়ে যায়।
মানু বলল, ফ্যাচাং করার ইচ্ছে হবেই না। কবিতা ভারি মধুর ব্যাপার। কবিরা কবিতা ছাড়া কিছু বোঝে না, জানে না।
রুমন বলল, বিকেলে তোর খেলা আছে?
বিকেলে আমি আর জয়া দো—আসমান দেখতে যাচ্ছি।
আর সেই আশায় সেদিন ম্যাটিনিতে সে হলের নীচে দাঁড়িয়েছিল জয়া আসবে—সে আর জয়া হলে ঢুকবে। টিকিট জয়ার কাছে। জয়ার জন্যে চারপাশের ভিড়ের ভেতর যখন উন্মুখ ছিল তখনই মনে হল দূরে জয়া কারও সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে। সে কাছে গিয়ে বলল, এসো। শো আরম্ভ হয়ে যাবে।
জয়া বলল, তুমি যাও মানু। বলে একটা টিকিট দিয়ে দিল। আমার যাওয়া হবে না। তোমার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলাম।
তার মানে?
আমার আজ কবিতা পাঠ আছে। এর নাম কালিদাস! ও আমাকে নিয়ে যাবার জন্যে বাড়ি গেছিল।
মানুর মাথাটা ঝিম ঝিম লাগছিল। ভেতরে একটা ক্রুদ্ধ বাঘ হাই তুলছিল। সে কিছু বলতে পারল না। কবিরা খুব সুন্দর কথা বলে! জয়া কত সুন্দরভাবে কথাটা বলল। সে কোনো রকমে বলল, আপনিও বুঝি কবিতা লেখেন?
কালিদাস বলল, জয়ার জন্য লিখি। জয়ার খুব ভালো লাগে আমার কবিতা। মানুর ইচ্ছে হয়েছিল জানার, তার জন্যে কেউ কিছু লেখে কিনা। কিন্তু সে দেখল, ওদের যাবার এত তাড়া যে আর একটা কথাও বলার সময় নেই। সে ভ্যাবলাকান্তর মতো দাঁড়িয়ে থাকল। সামনের বাসটায় দৌড়ে উঠে গেল জয়া আর তার কবিবন্ধু। সে দুঃখী মানুষের মতো দাঁড়িয়ে থেকে টিকিটটা মুখে পুরে দিল। তারপর শক্ত দাঁতে কট কট করে কাটতে থাকল।
পাঁচ
সকাল সকাল নানুর আজ ঘুম ভেঙে গেল। সে উঠেই জানালা খুলে দিল! বাইরে এসে দাঁড়াল। রাস্তাটার ওপারে একটা ছোট্ট মতো লাল বাড়ি। বারান্দা থেকে বাড়িটার সব কিছুই স্পষ্ট। এই প্রথম সে লক্ষ্য করল, একটা বাচ্চা মেয়ে সাদা ফ্রক গায়ে দিয়ে লনে দাঁড়িয়ে আছে। তারপর মনে হল, বাড়িটায় রয়েছে বড় একটা ছাতিম গাছ। ছাতিম ফুলের গন্ধ—আহা, একবার সে মেসোমশাই মা—
এই পর্যন্ত মনে হতেই তার চারপাশ অন্ধকারে ডুবে যেতে থাকল। এক কুৎসিত জগৎ থেকে সে পরিত্রাণের কথা ভাবছিল। সবাইকে সে ক্ষমা করে দিয়েছে। কারণ তার এখন বনভূমিতে জ্যোৎস্না। নবনীতা, ভারি সুন্দর নাম। নবনীতা তার হাত কামড়ে দিয়েছিল। এবং সেই দাঁত আর তার নেই। নবনীতা এখন নতুন এক পৃথিবী তার কাছে।
অন্তত এমন সুন্দর পবিত্র ইচ্ছের কথা সে মানুষকে বলতে পারে। একদিন ওদিকে সে গিয়েছিল। মানুদের বাসাটা সে দেখে এসেছে। সুন্দর মতো এক যুবা গলা বাড়িয়ে বলেছে মানু নেই। মানু বাড়ির গল্প করতে খুব ভালোবাসে। দিদির গল্প, বাবার গল্প, মার গল্প—কিছুই বাদ রাখেনি। খুব খোলামেলা এবং সরল সাদাসিদে ছেলে। কিন্তু কী আশ্চর্য কিছুদিন থেকে সেই মানুও কেমন গম্ভীর। সংসারে মানুর তো তার মতো হারাবার কিছু নেই। মানু সবার ছোট। তার বাবা রিটায়ার করেছেন সাত আট বছর। এবং এ—সময়ে মনে হল বাবা যদি আরও কিছু বেশি দিন বেঁচে যেতে চেষ্টা করতেন। অন্তত মার চুলে পাক ধরা পর্যন্তও যদি তিনি অপেক্ষা করতেন।
তারপরই ফের নবনীতার কথা মনে হতেই শিস দিতে দিতে সে নীচে নেমে গেল।—ও দাদু তোমার ঘুম ভাঙল না। দিদিমা, মাসি তোমরা কোথায়—চা কই। এখনও তোমরা ঘুমাচ্ছ। মিতা দরজা খুলে দেখল নানু নীচের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁত মাজছে। মিতা কাছে গিয়ে বলল, কী রে দিলি সকালের ঘুমটা মাটি করে।
—কেমন ঠান্ডা বাতাস। চল না সামনের রাস্তাটা পার হয়ে বড় মাঠটায় নেমে যাই।
এখনও এখানে একটা বড় মাঠ রয়েছে। এ—অঞ্চলে এখনও অনেক ফাঁকা জায়গা, গাছপালা আছে। হেঁটে গেলে অনেকটা দূর হেঁটে যেতে ইচ্ছে করে। দক্ষিণের মৃদুমন্দ হাওয়া গাছপালার মধ্যে বয়ে যায়। আশ্চর্য এক প্রশান্তি তখন বাড়ি—ঘরে। মনেই হয় না মানুষের কোনো দুঃখ আছে।