সে একটা জামা গায়ে দিল। সকালটাতে কিছু করার থাকে না। অন্যদিন দাদার অফিস, দিদির অফিস থাকে বলে বাজারটা সে করতে যায়। সকালের কাগজটা দেখা হয়ে গেলেই যেন সারাদিনের কাজ তার শেষ। গল্পের বই সে দু—একবার পড়ার চেষ্টা করছে, কোনো মজা নেই কোথাও। বরং এ পাড়ায় সে অনেকের ফুট—ফরমাস খেটে দেয়। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, কেউ মরে গেলে কাঁধ দেওয়া, দত্তবাড়ির বউ যাবে রামগড়ে, কে যাবে সঙ্গে, ভুবনবাবুর ছেলে মানুর কথা তখন সবার মনে পড়ে যায়। মানু পাড়ায় এভাবে বেশ ইজ্জত নিয়ে বেঁচেছিল। দিদিটা রুমাল উড়িয়ে বউভাত খেতে যাচ্ছে। বাবার এত সুখ সয় না বোধহয়। কেমন সব সময় শঙ্কিত মুখ। একটা জ্যান্ত উটের ছবির মতো বাবা গলা বাড়িয়েই আছে।
সেও নেমে গেল সিঁড়ি ধরে। কোথায় যাবে জানে না। বের হতে ইচ্ছে ছিল না। এই সময়টাই বোধহয় সবার ভালো না লাগার সময়। বিকেলে দো—আসমান দেখা যাবে। জয়া তাকে দিয়ে টিকিট কাটিয়ে রেখেছে। সকালটাই বড় বেশি একঘেয়ে। হাবুল পালের রোয়াকটাই সর্বোৎকৃষ্ট জায়গা। ওরা পাঁচ—সাতজন নানা রকম খবরে মেতে থাকতে পারে তখন। কিন্তু হেরে গেছে দল। সে মানত পর্যন্ত করেছিল। কালীবাড়িতে লাল জবা দেবে। গেলেই ছেঁকে ধরবে পিছনে লাগবে। তবু আড্ডা ছাড়া হাতের কাছে এখন তার করার কিছু নেই। এবং যেতেই রুমন বলে ফেলল, কত টেম্পারেচার?
কোনো টেম্পারেচার ওঠেনি।
আয় না দেখি।
মন ভালো নেই রুমন। ঝামেলা করবি না।
কী ঝামেলা করলাম মাইরি। বুককি শালা মাইরি তোকে কী বলবে বলে কখন থেকে বসে আছে।
কিছু বলতে হবে না। কে শুনছে ওর কথা।
বুককি বলল, খাঁ খাঁ করছে গুরু।
সবারই খাঁ খাঁ করছে। কেউ ভালো নেই। চুপচাপ বসে থাক। অথবা গান গাও, শুনি!
বুককি বলল, অসময়ে গান গাইতে বলছ?
গা না। যা মনে আসে।
চাঁদবদনী ধনি নাচ তো দেখি গাইব?
গা না। কে বারণ করেছে। যেটা ভালো লাগে গা।
রুমন বলল, আমি নাচব তবে।
মানু বলল, না তোমায় নাচতে হবে না।
বুককি চোখ বুজে ফেলেছে। ওর গানের গলা ভালো। হুবহু নকল করে ফেলতে পারে একবার শুনে। অথচ কোনো প্রচেষ্টা নেই। কে জানে চেষ্টা থাকলে হয়তো সেও একটা কিশোরকুমার হয়ে যেতে পারত। আসলে বুককি যতটা আড্ডাবাজ হুল্লোড়ে ততটা সিরিয়াস নয় জীবনে। অথচ সব সংগীত সম্মেলনে বুককিকে দেখা যাবে বাইরে গাছের নীচে বসে আছে। নিবিষ্ট মনে গান শুনতে সে ভালোবাসে। মানু বলেছিল, তুই তো গান শিখতে পারিস। চর্চা করিস না কেন?
এই যে করছি। বলেই সে গান জুড়ে দেয়। চর্চা তো তোমরা এলেই শুরু হয়ে যায়। তোমাদের ভালো লাগলে আর কার ভালো লাগল না লাগল গ্রাহ্য করি না। যেন এ কটি বন্ধুর জন্যেই সে অতি যত্নে গলায় গান তুলে ফেলে। এবং ওদের যতক্ষণ না শোনাবে বুককি কেমন অস্বস্তিতে থাকে।
বুককি বেশ মজার গান জুড়ে দিয়েছে। চাঁদবদনী ধনি নাচ তো দেখি। ওরা রেলিঙে ভর করে দাঁড়িয়ে আছে। পাশেই একটা পার্ক, সেখানে সকালে টেনিস খেলে কেউ কেউ। হকার্স কর্নারে দোকানপাট খুলছে। পাড়ায় কে কোন বাড়িতে থাকে সবই তারা জানে। তরুণী মেয়েরা অথবা যারা কৈশোর পার হয়ে যাচ্ছে সবার একটা করে তাদের নিজস্ব নাম আছে। ধবলী যাচ্ছে, যদি চাঁদবদনী ধনি নাচ তো দেখি বুককি না গাইত, তবে ঠিক চেঁচিয়ে বলত, ধবলী যায়, কী হবে হায় এই সব পঙ্গপালের।
যেন সত্যি আর একটা গান। অথচ বুককি সত্যি গানটা মন দিয়ে গাইছে। গান শুনে যে নিস্তেজ পর্বটা ছিল মানুর, নিমেষে কেমন উবে গেল। বলল, বুককি তুই কী বলবি বলেছিলি রে?
গুরু দোষ নেবে না বল।
দোষ নেব কেন!
দোষ হলে ক্ষমা করে দেবে বল।
এই হচ্ছে বুককি। আসল কথাটা বলার আগে এত বেশি ভনিতা করবে যে শোনার সব আকর্ষণ নষ্ট হয়ে যায়।
বুককি! কেমন চেঁচিয়ে উঠল মানু!
রুমন বলল, তোর কি মেজাজটা আজ ঠিক নেই রে!
মানু কিছু বলল না।
হার জিত তো খেলায় আছেই।
রুমন! খুব স্থির গলা মানুর।
কেমন হতচকিত রুমন। বুককি বলল, দোস্ত তুমি যা দেখাচ্ছ তারপর আর দেখছি কিছু বলাই যাবে না।
মানু হাতে বালা পরেছে বছর খানেক হয়ে গেল। সে ডান হাতের বালা বেশ টেনে ওপরে তুলছে। মানু ভেতরে ভেতরে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লে এমন করে থাকে। ওর কেন যে মনে হয় ঠিক এই সময়ে দিদি কিছু করছে। দিদিকে জোর করে কেউ কিছু করছে। সে রোয়াকে বসে পড়ল। পিন্টিদের বাড়ির তিনতলার জানালার দাঁড়িয়ে পিন্টির কাকা সিগারেট খাচ্ছে। পিন্টি একবার পুজোর মণ্ডপে রাত জেগেছিল। পিন্টির শরীরে এক রকমের সুন্দর গন্ধ আছে। সে মেয়েদের আলাদা গন্ধ টের পায়। জয়া পিন্টি বুলার শরীরে এক এক রকমের গন্ধ।
মানু মনে মনে হেসে ফেলল। যত সব বাজে ভাবনা তাকে সব সময় বিপর্যস্ত করছে। যেমন, দিদি যখন কলেজে পড়ত, একটু দেরি হলেই তার মনে হত, এই বুঝি কেউ এসে খবর দিয়ে যাবে অ্যাকসিডেন্ট। দিদির খাতায় রোল নাম্বার, ইয়ার এবং কলেজের নাম যদি না থাকে, কোনো ঠিকানায় তাকে খুঁজে পাবে না। এবং দিদি ফিরে এলেই বলেছিল, তোর খাতায় রোল নাম্বার, কলেজের নাম লিখে রাখিস তো?
রমা কিছুই বুঝতে পারত না। মানু এ—ধরনের কথা কেন বলছে, রমা একবার দেখেছিল, ওর ব্যাগে একটা চিরকুট। কী খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করেছিল। নাম, ঠিকানা লেখা। এবং ঠিক মানুর হাতের লেখা।