দিদির আগের সুনাম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বোঝাই যাচ্ছিল। সে তো নিজেও কম হাঁটাহাটি করছে না, সে যদি কোথাও চাকরি পেয়ে যেত, তবে, তবেই বা কী, দিদি কী এমন একটা রঙিন জগৎ থেকে নেমে এসে বলবে, খোকা, আমি ফের ভালো হয়ে গেছিরে।
মানু তখন শুনতে পাচ্ছে বড়দা শিস দিচ্ছে ঘরে। বড়দা ফিরবে প্রায় একটায়। বাড়ি থেকে সকালে বের হবার সময় শিস দিয়ে গান গায় দাদা। মানু দাদার এত উচ্ছ্বাস কেন টের পায়! ছুটির দিনে প্রিয়নাথ কাকার বাড়িতে সকালটা কাটিয়ে আসবে। মন্দাকিনী বউদি আজকাল খুব যত্ন করছে। প্রিয়নাথ কাকার বিধবা পুত্রবধূ মন্দাকিনী বউদি। গত অক্টোবরে রাঁচির কাছে কার অ্যাকসিডেন্টে দাদা মারা গেলেন। বাবা কি টের পায় সব। বাবা কি টের পেলেই কাশতে থাকে খক খক করে।
মানু সেন্টারটা কিছুতেই পেল না। জয়ার কাছে একবার যাবে। জয়া তো এখন পার্লারে বসে কবিতা লিখছে। কোথায় একটা কাগজে জয়ার কবিতা বের হয়। আজকাল গিয়ে কাছে বসে থাকলেও জয়া টের পায় না, একজন তরুণ যুবক ওর সামনে বসে আছে। সে কবিতা—টবিতা পড়তে ভালোবাসে না। বোঝেও না। বরং খেলার খবর যত আছে—কে কোন সালে কার কাছে কত পয়েন্ট ছিনিয়ে নিয়েছে গড় গড় করে বলে দিতে পারে। উঠতি খেলোয়াড় টমসনের ফাস্ট বলের গতি কত, অমৃতরাজ ভ্রাতৃদ্বয় শেষ পর্যন্ত ডেভিস কাপের ফাইনালে উঠতে পারবে কী না, না উঠতে পারলে ওর রাতের ঘুমটাই মাটি হবে। বরং তাকে বললে, সে সহজেই খেলা বিষয়ক রচনা লিখে দিতে পারে। কবিতার মাথামুণ্ড সে কিছুই বোঝে না। জয়া তাকে একদিন বলেছিল, মানু তোমার এমন সুন্দর চোখ, তুমি কবিতা লিখতে পারো না কেন? তোমার চোখে যদি চুমো খাই রাগ করবে?
মানু বলেছিল, যাঃ তুমি তো মেয়ে। চোখে চুমো খাবে কী।
চোখে চুমো খেলে আমি সুন্দর কবিতা লিখতে পারব। এসো না খাই।
কী হবে কবিতা লিখে?
তুমি বুঝবে না মানু। মানুষ কী সুন্দর হয়ে যায় কবিতা লিখতে পারলে।
চোখে চুমু না খেলে কষ্ট হবে তোমার?
খুব।
তবে খাও। সে চোখ বুজে দাঁড়িয়েছিল।
জয়া তখন উঠে চারপাশে কী দেখে নিল। বাঘা পায়ের কাছে লেজ নাড়ছে। সে উঠে পড়তেই বাঘা উঠে পড়েছিল। সুন্দর জি আর মিনি স্কার্ট পরা মেয়েটার শরীরে কী যে আশ্চর্য গন্ধ! সে চোখ বুজেছিল—কারণ, বুঝতে পারছিল দুহাত বাড়িয়ে তাকে জড়িয়ে নিয়েছে জয়া। কুকুরটা ঘেউ ঘেউ করে উঠছিল তখন। জয়ার বাবা ওপর থেকে বলেছিল, ‘বাঘা অসময়ে ডাকছে কেন রে!’
জয়া চুমো খেতে খেতে বলেছিল, বাঘা খুব অসভ্য হয়েছে বাবা। সময় অসময় বোঝে না।
মানু একদণ্ড দেরি করেনি। ধাঁই করে লাথি মেরেছিল বাঘার পেটে। বাঘা আর একটুও চিৎকার করেনি। জয়ার ঠোঁটে মিষ্টি গন্ধ। সে বাড়ি ঢুকে বাথরুমে সাবানে ঘষে ঘষে গন্ধটা তুলে ফেলেছিল। পালিয়ে সিগারেট খাওয়ার মতো কোনো গন্ধ যদি দিদি টের পেয়ে যায়—মানুটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
সংসারে নষ্ট হয়ে গেলে কেউ আর তখন ভালোবাসতে চায় না। সে এ জন্যে সব সময় ভালো থাকতে চেয়েছে। উঠতি বয়সে যা সব ইচ্ছে থাকে, তারও আছে। সে একদিন সিগারেট খেতে পারল না পালিয়ে। কতদিন ভাবত নানুকে নিয়ে সে বাবুঘাটে চলে যাবে, অথবা গড়ের মাঠের ঠিক মাঝখানটায়। দু’জনে দুটো সিগারেট কিনে নেবে মেট্রোর নিচ থেকে। তারপর সন্তর্পণে হাঁটতে হাঁটতে একেবারে যখন বুঝবে কেউ নেই, পরিচিতি কোনো মুখই তাকে আর দেখছে না, তখন সিগারেট জ্বালিয়ে বেশ বড়দের মতো টানবে। ইচ্ছেটা সেই কবে থেকে। পরীক্ষায় সে ভালো করতে পারে না কেন বোঝে না। কেবল খেলা সম্পর্কে ভারি উৎসাহ তার। আসলে সে খেলা পাগল বলে, অন্য দশটা কুকর্ম করার সময় একেবারেই পায়নি। তার বয়সের ছেলেরা কত সব অভিজ্ঞতার কথা বলে। সে একটাও বলতে পারে না। তবু যা হোক জয়াকে মাস দুই আগে ভাগ্যিস হাতের কাছে পেয়ে গেল। জয়া তাকে মাঝে মাঝে আজকাল সাহসী হতে বলছে।
দিদির এই সকালে বের হয়ে যাওয়াটা ভালো লাগছিল না। বাবা কিছু বলে না। দাদাও বের হয়ে যাচ্ছে। কেমন সবাই আলগা হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। ছ’মাস আগেও এটা ছিল না। কেমন সবাই মিলে সুন্দর একটা সংসারের ছবি ছিল বাড়িতে। দিদির চাকরিটা দাদাকেও কেমন স্বার্থপর করে ফেলেছে। সে বুঝি ভাবছে, এবার চলে যাবে। এতদিন তো টানা গেল, এবার ছুটি।
মা তখন ডাকল, মানু খেয়ে যা।
ওর খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। এবং কেমন বিরক্ত গলায় বলল, রেখে দাও।
রেখে দেবটা কোথায় শুনি! তোমাদের সবার খাবার নিয়ে কতক্ষণ বসে থাকব?
কে বলেছে বসে থাকতে?
নীরজা আজকাল দেখেছে মানু প্রায়ই মুখে মুখে উত্তর করে। স্বভাবটা কেমন চোয়াড়ে হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। বড়টাকে কিছু বলতে পারে না। মেজটা তো স্বাধীন হয়ে গেল চাকরি পাবার পর। ছোটটা পর্যন্ত মুখ করছে। নীরজা অগত্যা মানুর সকালের জলখাবার প্লেট দিয়ে তার ঘরে ঢেকে রেখে দিল। যখন খুশি খাবে। মুখে কিছু বলল না।
আজকাল বাড়ির খাবারের মেনু পালটে গেছে। আগে ছিল দুখানা রুটি, সামান্য আলুর তরকারি। দিদির চাকরিটা সংসারে প্রাচুর্য এনে দিয়েছে, ডিমের পোচ, মাখন, স্লাইস পাউরুটি, এক গ্লাস হরলিক্স। এত খাবার দেখে, তার বমি পাচ্ছিল। দিদি রুমাল উড়িয়ে কোথায় যায়, কী করে, সব বুঝতে পারে। একদিন ভেবেছিল বলবে, দিদি তুই আর যাস না। আমি কাঁচামালের ব্যবসা করব। আমাদের ঠিক চলে যাবে। তারপর মনে হয়েছিল ইস, কে শুনবে তার কথা। আর বাবা যদি জানতে পারে বাজারে আনাজপাতি বিক্রি করার কথা ভাবছে সে, তবে আর রক্ষে থাকবে না। মানসম্মান এভাবে খোয়াতে রাজি নই।