ঘুমোবার আগে সে বিছানায় চুপচাপ বসে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, আমি সবাইকে ক্ষমা করে দিলাম। সে আলো নিভিয়ে দিল তারপর। শুয়ে কপালে হাত রাখল। এবং চোখে সেই লাবণ্যভরা মুখ। নবনীতা ভারি বিস্ময়ে ওর দিকে তাকিয়েছিল। ক্রমে সেই চোখ নরম হতে হতে এক সময় ভারি অন্তরঙ্গ হয়ে গেলে, নবনীতা চোখ নামিয়ে নেয়। পৃথিবীতে সে এমন সুন্দর লজ্জার চোখ কেউ নামিয়ে নিয়েছে, জীবনে দেখেনি। সিনেমায় দেখেছে, বন্ধুদের কাছে সে গল্প শুনেছে, কিন্তু জীবন দিয়ে প্রত্যক্ষ করেনি। সে বলল, নবনীতা। সে বলল, ন….ব…নী….তা। সে বলল, ন…ব…নী…তা।
চার
আজও আবার রমাকে নিয়ে অরুণ বের হয়ে গেল। ভুবনবাবু কান পেতে শুনলেন স্কুটারের শব্দ। দূরে আরও মিলিয়ে যাচ্ছে। তাঁর এমন সুন্দর মেয়েটাকে নিয়ে একটা লোক মাঝে মাঝে উধাও হয়ে যায়। বুকের ভেতর কষ্টটা টের পান। অসহায় চোখ মুখ দেখলে মায়া হবার কথা। ভুবনবাবু কত কিছু আশা করেছিলেন। তাঁর সংসার খুব বড় নয়। ভানু যেবারে হল, তিনি চাকরি খোয়ালেন। রমা যেবারে হল, তিনি প্রমোশান পেলেন আর মানু যখন নীরজার পেটে, চাকরিতে জটিল অবস্থা। সংসারে মেয়েটাকেই বার বার মনে হয়েছে পয়া। মেয়েটার কপালে খুব সুখ থাকার কথা। এবং মনে মনে যা কিছু স্বস্তি সবই রমাকে কেন্দ্র করে। সেই মেয়েটা ক’মাসের মধ্যে কেমন হয়ে গেল। একটা লোকের সঙ্গে ঘুরে বেড়ালে খারাপ দেখায়, এখন আর তেমন বলতেই সাহস পান না।
এবং সারাটা দিন অস্বস্তিতে কাটে। এই যে রমা বের হলে গেল, এবং কোথায় যাবে, যাবার সময় তো বলে গেল কোন এক অমলবাবুর বউভাত। কখন ফিরবে রমা? একবার খুব সংকোচের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। যা হোক রমা খুব একটা মুখ করেনি। ভালো মতই বলেছে, ফিরতে সন্ধ্যা হবে।
ফিরতে সন্ধ্যা হওয়ার ব্যাপারটা খুব ভয়ের নয়। কতদিন তো রমার ফিরতে বেশ রাত হয়ে যায়। তিনি বারান্দায় পায়চারি করেন। রাস্তায় স্কুটারের শব্দ পেলেই বুঝতে পারেন, রমা এল। অরুণের স্কুটার অন্য দশটা স্কুটার থেকে যেন আলাদা। শব্দটা তাঁর ভারি চেনা। দশটা স্কুটারের ভেতর কোনটা অরুণের তিনি আজকাল ঠিক টের পান। ঘরের ভেতর বসে বুঝতে পারেন, মানু সদর খুলছে। ওরা এল।
অথবা স্ত্রীকে বলবেন, এত রাত করে যে ফিরছে, কিছু বল না কেন?
তুমিও তো বলতে পারো।
আমার কি শোভা পায়। তুমি মা। স্ত্রীজাতির কলঙ্কটা কী তা বোঝো। তুমি বললেই ভালো হয়। আমার পক্ষে বলা শোভা পায় না।
নীরজা যে কিছু বলেনি এমন নয়। কিন্তু রমা এমন গম্ভীর মুখে তখন চেয়ে থাকে যে তিনি সাহস পান না। রমা মাঝে মাঝে মাকে ভীতু দেখলে হেসে ফেলে।—আচ্ছা মা, আমি তো তোমার মেয়ে, তবে ভয় পাও কেন?
নীরজা ভিতরে আরও গুটিয়ে যায় তখন। রমা তো জানে না, ওর বয়সে তিনি খুব ভালো ছিলেন না। অথচ সব মায়েরাই তো এমন মুখ করে রাখে যে মনেই হয় না, যৌবনে কী একটা যেন হলে ভালো হয়, সব থেকেও কিছু একটা নেই, সব মায়েরাই যে সব বাচ্চাদের অজ্ঞাতে গোপনে কিছু করে ফেলতে পারে, রমা বুঝি তা জানে না। নীরজার চুলে পাক ধরেছে। বয়সানুযায়ী একটু বেশি পেকেছে। কপালে বড় সিঁদুরের ফোটা সতী—সাধ্বী করে রেখেছে। নীরজা বলতে পারত, আমাদের কালটা একটু অন্যরকমের ছিল। অতটা খোলামেলা ছিল না। তোমরা বড় খোলামেলা। ভয়টা সেজন্যই বেশি।
রমা মাকে জড়িয়ে বলত, আমাকে তুমি কী ভাবো মা?
নীরজা কিছু তখন বলতে পারত না। কারণ সংসারটা সত্যি আর আগের মতো নেই। জীবনধারণের জন্য কত কিছু আজকাল দরকার হয়। সাধাসিধে ভাবে বেঁচে থাকার কোনো অর্থ নেই আজকালের ছেলেমেয়েদের কাছে। যা আছে চারপাশে দেখে নাও, জীবন ফুরিয়ে যাচ্ছে। নীরজা আজকাল নিজের কাঙালপনাও মাঝে মাঝে টের পায়। মেয়েকে খুব বেশি একটা কিছু বলতে পারে না।
ভানু বাজারের থলে রেখেই বলল, মানদাকে বল চা করে দিতে। আমি বের হব।
কোথায় বের হবে সবাই জানে। নীরজা বলল, মানদা বাজারটা সাজিয়ে রাখ। দাদাবাবুকে চা করে দাও। ডিম ভেজে দাও টোস্টের সঙ্গে।
মানু গুনগুন করে তখন গান গাইছিল। মানু উবু হয়ে রেডিয়োর নব ঘোরাচ্ছে। ছুটির দিনে সকালেই বাড়িটা একে একে খালি হয়ে যায়। মানুবাবু এখনও ঘরে আছে দেখে ভানু বিস্মিত হল। গতকাল হেরে এসেছে। হেরে গেলে বাড়িতেই ঘাপটি মেরে বসে থাকে। কেউ ডাকলেও সাড়া দেয় না। মন ভালো নেই মানুর তবু একবার জিজ্ঞেস করল, অরুণ চলে গেছে?
দিদিকে নিয়ে চলে গেছে।
তোর কাজের কথা কিছু বলল?
না।
একবার জিজ্ঞেসা করলে পারতিস।
মানু কিছুতেই সেন্টারটা পাচ্ছে না। দাদার কথা খুব অবহেলা ভরে যেন শুনছে। বাড়ির ভেতর একটা জঘন্য ঘটনা ঘটছে দিনের পর দিন। অথচ সবাই চোখ বুজে আছে। কিছু বলতে সাহস পাচ্ছে না। কেমন ব্যক্তিত্বহীন বাবা। দাদা স্বার্থপর হয়ে উঠছে। মানু একটা চাকরি পেলেই পড়াশোনা ছেড়ে দেবে। দাদাও নিজেরটা বুঝে নেবার জন্য আজকাল বড় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে—সে কঠিন এবং রুক্ষ গলায় জবাব দেবে ভাবছিল আর তখনই বাবার কাশির শব্দটা বেয়াড়া রকমের। সে আর সাহসই পেল না কিছু বলতে। কেবল দাদার দিকে একবার মুখ তুলে তাকাল।
তখন বোঝাই যায় দিদির এমন অসামাজিক আচরণে সবারই সায় আছে। অরুণ এলে তাদের সবাইকে খুব ভদ্র হয়ে যেতে হয়। যতটা নয় তার চেয়ে বেশি। যেমন বাবা দাদা মা সবাই তখন একটা সুন্দর মুখোশ পরে ফেলে। পবিত্র সব কথাবার্তা। যেন কোনো দেবদূত অরুণদা। দেবদূতরা তো শরীরের কিছু বোঝে না। মানু বন্ধুদের কাছে খুব গর্বের সঙ্গে বুকে টোকা মেরে আর কথা বলতেও পারে না। বিশেষ করে কলেজে নানুর সঙ্গে দেখা হলে মাথাটা তার নুয়ে আসে। নানু গম্ভীর প্রকৃতির ছেলে। খুব সিরিয়াস জীবন সম্পর্কে। রাজনীতি নিয়ে কথা উঠলে নেতাদের সে চোর বাটপাড় ছাড়া ভাবে না। কী হয়ে গেল দিদিটা! আমরা কী হয়ে গেলাম!