নানু এখন চায় চুপচাপ শুয়ে পড়তে। তার খেতে পর্যন্ত ভালো লাগছে না। বাবার মুখটা কেমন, বাবার মুখ, সেই হিজিবিজি আঁকা মানুষের ছবির মতো, কোনো একটা ছবি—সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে যেন ভেসে যায়। সে কেমন অসহায় বোধ করতে থাকল। মনে হয় তার শেষ অবলম্বনও চলে যাচ্ছে। পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য তার দরকার বাবার পাশাপাশি থাকা। তিনিও কেমন স্মৃতি থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছেন।
এইসব ইচ্ছের কথা মাঝে মাঝে আর কাউকে বলতে পারলে ভালো লাগত। অথচ সে দাদুর বাড়ি চলে আসার পর এমন কাউকে পেল না যাকে বলতে পারে, জানো আমার বাবা কুড়িটা ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে মারা গেছেন। জানো আমার মা আর আমাকে আগের মতো ভালোবাসে না। তার কোনো টান নেই—সংসারে আমি বড় একা। মাঝে মাঝে এও মনে হয় সে তার একমাত্র কাছের মানুষ মানুকে বলতে পারে। সে তার আগের জীবনের অনেক কথাই মানুকে বলেছে। ক্লাসের অফ পিরিয়ডে ওরা লাইব্রেরির মাঠে চলে গেছে এবং কত কথা—কিন্তু মানুষের সংগোপনে এমন কিছু কথা থাকে যা বুঝি কাউকে বলা যায় না। এই যে সে হত্যাকারীর খোঁজে বের হয়েছিল, মানুর সঙ্গে দেখা হলে হয়তো তার সে ইচ্ছাটা এত প্রবল হত না আজ।
দাদু ঘরে এসে বলল, চল খাবি।
নানু বলল, চল।
নীচের তলায় সে ভেবেছিল সবাই শুয়ে পড়েছে। এখন দেখছে সবাই জেগে! দাদু, দিদিমা, মাসি এবং সে। টেবিলে বসে সবাই একসঙ্গে খাবে। রান্নার মেয়েটা টেবিলে খাবার সাজিয়ে রেখেছিল আগেই—ওরা বসলে ঢাকনা খুলে দিল, প্লেট সাজিয়ে গেল। হাতে মুখে জল দেওয়ায় নানুর চোখ মুখ স্নিগ্ধ দেখাচ্ছিল।
দাদুর দিকে তাকিয়ে নানু বলল, তোমরা খেয়ে নিলেই পারতে।
দিদিমা বলল, তুমি না এলে খাই কী করে?
ছোট মাসি বলল, তুই কোথায় গেছিলি? এত কী কাজ! দিদিকে চিঠি লিখে জানিয়ে দেব। তুই আমাদের খুব জ্বালাচ্ছিস।
নানু খুব স্পষ্ট গলায় বলল, বাবার ফোটোর খোঁজে গেছিলাম।
কোথায়? দাদু উঠে দাঁড়ালেন।
তুমি অত উত্তেজিত হচ্ছ কেন দাদু?
না, মানে তুই ফোটো খুঁজতে কোথায় গেছিলি? ফোটো তো বাড়িতেই অনেক আছে। কত লাগবে?
কোথায়? তোমরা তো এতদিন বলেছ, ফোটো নেই।
তখন তুমি ছোট ছিলে, বাবার কথা মনে হলেই কষ্ট পাবে ভেবে তুলে রাখা হয়েছিল।
নানু বলল, অঃ। তারপর আর কিছু বলল না। তার মনে পড়ল, সেই অনেক আগে একবার বাবার ফোটো চেয়ে পায়নি। কোথাও পায়নি। তার মনে হয়েছিল, কোথাও নেই—বাবার ছবিটা বাড়িতে ভারি বিপজ্জনক। নানু এখন বড় হয়ে গেছে। নানু এখন বাবার সেই স্মৃতি বুকে বয়ে বেড়ায় না। সহজেই দেওয়া যেতে পারে ভেবেই হয়তো দাদু সেই স্মৃতি স্বীকার করলেন, আছে। তিনি দেবেন।
নানু খেয়ে উঠে ওপরে চলে গেল। সে এখন আর মনে করতে পারছে না, কেন সে সুনীল কাকার বাড়ি গিয়েছিল। ফোটোর জন্য না অন্য কিছু জানতে—আসলে কী সে মনের মধ্যে একটা তুমুল প্রতিহিংসার ঝড় নিয়ে বড় হচ্ছে। যার জন্য মাঝে মাঝেই মনে হয়, সে একটা কিছু ঠিক করবে। সেটা কী। সেটা কী কোনো শূন্যতা, জীবনে বিশ্বাসের অভাব। না অন্য কিছু!
তারপরই সে দরজা বন্ধ করে দিল। সে চিৎকার করে বলল, আমার কোনো পরিচয় নেই—আমি বাস্টার্ড। আমার মাকেই আমি পৃথিবীতে একমাত্র চিনি, চিনতে পারি, বলতে পারি তিনি আমার মা, তিনিও আমার প্রতি বিরূপ। কাছে রাখতে ভয় পেয়েছেন। ‘জননী আমার ধাত্রী আমার’—কবিতার লাইন সে বলে গেল, জননীগো—তুমি আমায় এক আশ্চর্য শূন্যতায় ভাসিয়ে দিলে? নানু শেষে কী ভেবে হেসে দিল, বলল, ধেড়ে খোকা, ধাতস্থ হও। সংসারে কেউ কারও নয়। ভেউ ভেউ করে এত কাঁদছ কেন? সে জানালা খুলে বুক ভরে নিঃশ্বাস নেবার চেষ্টা করল।
তখনই নানু দেখল বনভূমিতে জ্যোৎস্না। অপার্থিব এক ঈশ্বরের পৃথিবী সামনে। জ্যোৎস্নায় যেন কেউ দাঁড়িয়ে আছে। সহসা তার নবনীতার কথা মনে পড়ে গেল। ন—ব—নী—তা বলে সে টেনে টেনে দেখল কতটা লম্বা করে কথাটা বলা যায়।
নবনীতা বলেছিল, শোলে দেখেছেন? কতদিন সে কোনো সিনেমা দেখেনি। সেই বিতকিচ্ছিরি ঘটনাটা দেখার পর থেকেই সে গুম মেরে গিয়েছিল। মা অর্থাৎ শ্রীমতী রানু মানে রানুবালা, তার সঙ্গে কথা বলতে সাহস পায় না। নানুর মনে হয়েছিল শ্রীমতী রানুবালার এটা কলঙ্ক। কলঙ্ক মাথায় করে শেষ পর্যন্ত রানুবালা কতদিন বাঁচবে, না মরে যাবে। একদিন রানুবালাকে কাঁদতে দেখে তার মুখ কুঁচকে গেছিল। সে বলেছিল, লোকটা এ—বাড়িতে এলে অনর্থ ঘটবে।
রানু চিৎকার করে উঠেছিল, তুই কী বলতে চাস?
সেই উল্লুকের বাচ্চা এখানে আসবে না। এলেই খুন করব।
কী বলতে চাস তুই!
খুন করব বললাম। দরকার হলে তোমাকেও।
রানুবালার মুখ ভীষণ শুকিয়ে গেছিল। ক’দিন থেকে গুম মেরে আছে নানু। মনীশদার সঙ্গে সেদিন খারাপ ব্যবহার করেছে। নানু কী সব টের পেয়ে গেছে….
রানুবালা তারপর ঘরের সেই জায়গাটা বাইরের কোনো ফুটো দিয়ে দেখা যায় কিনা, তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে। খুঁজতে গিয়েই মনে হয়েছে, ছেলে তার বড় হয়ে গেছে। আর একসঙ্গে থাকা যায় না। বাবাকে লিখেছে নানুকে পাঠিয়ে দেব। এখানে পড়াশোনা একদম করে না। দিনকে দিন হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে।
কতক্ষণ নানু জানালায় দাঁড়িয়ে আছে, টের পায়নি। মানুষের যে কী হয়! আজ সকালে এক রকম, বিকেলে এক রকম। সন্ধ্যায় সে যা ছিল, এখন আর তা নেই। আকাশ এবং এই পরিব্যাপ্ত জীবনে কী আছে কী নেই সে এখনও জানে না। তবু এক সুদূর থেকে মাঝে মাঝে এই পৃথিবীতে কেউ টরেটক্কা শব্দ পাঠায়। নানু আজ প্রথমে বুঝতে পারছে, সে তার বাবার জন্য কিছুই করতে পারে না। কারণ বনভূমিতে আজ সন্ধ্যায় জীবনে প্রথম জ্যোৎস্না দেখেছে।