নবনীতার মা বলল, তুমি দেখনি ঘরটা?
আমাদের সময়ে ছিল না।
সহসা নবনীতা বলল, এত ঘামছেন কেন নানুদা?
নানু সত্যি ঘামছিল। নবনীতা উঠে পাখা ফুল স্পিডে চালিয়ে দিয়ে আবার বসল। তার কথাবার্তায় কোনো সংকোচ ছিল না। নানু যেন কিছুই লক্ষ্য করছে না, এমনকি নবনীতাকেও দেখছে না,—কেউ বসে আছে সামনে তাও তার যেন খেয়াল নেই—এমন চোখমুখ করে রেখেছে। অধিকাংশ সময় সে মুখ না তুলেই কথা বলছিল। সে একটি ভালো ছেলের মুখোশ পরে আছে এখন। এই যে কাকিমা, মারই বয়সি—শরীরে যৌবন ধরে রাখার কী প্রাণান্তকর চেষ্টা তার। কথাবার্তায় মনে হচ্ছিল মা আর মেয়ে যেন দু বোন। একবার বলতে ইচ্ছে হয়েছিল, আচ্ছা কাকিমা, আপনার আর কেউ আছে? কাকা মরে গেলে কারও সঙ্গে প্রেম করতে পারেন। তারপরই তার মনে হল প্রীতিশ নামক যুবক পাশের গলিটা পার হয়ে বড় একতলা বাড়ির নীচে আজ থেকে আট বছর আগে আত্মহত্যা করেছিল। সে এখানে জানতে এসেছে তার বাবা কেন আত্মহত্যা করলেন।
তখন কাকিমা বলল, তোমার বাবা বড় ভালোমানুষ ছিলেন।
সে বলল, ভালোমানুষ ছিলেন বুঝি! তারপর বলার ইচ্ছে হয়েছিল, আপনি জানলেন কী করে! বাবা ভালোমানুষ কী খারাপ মানুষ সেটা তো আমার মা—ই একমাত্র বলতে পারে। আপনি কি…।
তখনই কাকিমা বলল, তোমার বাবাকে মনে পড়ে? তখন তো তুমি খুবই ছোট ছিলে।
সে কী ভেবে বলল, না। তারপর কেমন অতলে ডুবে যাচ্ছিল। কীভাবে যে বলবে, আমার বাবা আত্মহত্যা করেছিল কেন জানেন—কিন্তু বলতে পারল না।
নবনীতার মনে হল মার যে কী স্বভাব! নানুদাকে এ—সময় তার বাবার কথা মনে করিয়ে দিয়ে কী লাভ। কেমন দুঃখী মুখ এবং কাতর দেখাচ্ছে। সে বলল, নানুদা শোলে দেখেছ?
নানু যেন শুনতেই পায়নি। সে দুজনের দিকে তাকিয়েই যেন প্রশ্ন করল, বাবার ছবি আছে এ বাড়িতে?
ছবি। দাঁড়াও। হ্যাঁরে নবি, প্রীতিশকাকার কোনো ছবি আছে? অ্যালবাম খুলে দেখবি।
নবনীতা বলল, না নেই।
নানু কেমন শক্ত গলায় বলল, থাকতেও তো পারে। খুঁজে দেখ না।
তখন সুনীলকাকা বেশ সাফসোফ হয়ে বসার ঘরে ঢুকে গেল। লম্বা পাজামা পাঞ্জাবি পরেছে। স্নান করায় শরীরে দামি সাবানের গন্ধ। মুখে পাইপ। বেশ কম বয়সে সুনীলকাকা খুব উঁচুতে উঠে গেছে। প্রায় আত্মস্থ এক মানুষ, সুখী এবং জীবনে যা যা দরকার সবই হাতের নাগালে। অনেকদিন পর তার বসের ছেলে এই বাড়িতে—সে কেমন আছে এটা দেখুক—এমনই স্মিত হাসিতে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল, তোমাদের ডিস্টার্ব করলাম না তো।
নানু এখন কিছুই শুনতে চায় না। সে আরও শক্ত হয়ে গেল। বলল, সুনীলকাকা, তোমার কাছে বাবার ফোটো আছে?
সুনীল কথাটার খুব গুরুত্ব দিতে চাইল না।—আছে বোধ হয় দেখতে হবে।
নানু বলল, এখন একবার দেখবে। বাবার একটা ফোটো আমার খুব দরকার।
কেন বাড়িতে নেই?
না।
সে কী! নবনীতা প্রায় চিৎকার করে উঠল।—বাড়িতে বাবার ছবি থাকে না সে কী করে হয়!
কখন যে একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে এদিকটায়। সামান্য ঝড়ও। নানুর ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেছে। রাস্তাটা এদিকের কতদিন মেরামত হয়নি। হবে কী না কেউ বলতেও পারে না। উঁচু নিচু খানাখন্দ—কোথাও বসে গেছে অনেকটা। ইঁট বের হয়ে পড়েছে—ফলে নানু যতটা দ্রুত হেঁটে রাস্তা অতিক্রম করবে ভেবেছিল, ঠিক ততটা জোরে হাঁটতে পারছে না। পা উঁচু নিচুতে পড়ে যে—কোনো সময় মচকাতে পারে। সে ঘড়িতে দেখল এগারোটা বেজে গেছে।
সুনীলকাকার বাড়ি থেকে বের হয়ে—সোজা রাস্তায় দাঁড়িয়ে জানালায় কারও মুখ দেখার চেষ্টা করছিল নানু। তাদের বাড়িটাতে অন্য কেউ থাকে এখন। বাবার মতো সেই মানুষটা সকাল সন্ধ্যায় এসে জানালায় হয়তো দাঁড়ায়। সে খুব বায়না করলে—বাবা কখনও ওকেও তুলে দাঁড় করিয়ে দিতেন জানালায়। তার মনে হয়েছিল, কেউ তেমন এখনও এসে এই জানালাটায় দাঁড়িয়ে আছে। বাড়িতে তার মতো কেউ হয়তো জেদ ধরলে জানালাটায় তুলে দেওয়া হয়। সেই ঘরটা এবং জানালাটা তাকে ভীষণভাবে কেমন এক আকর্ষণে ফেলে দিয়েছিল। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকলে কুজনে মন্দ কথা ভাবতে পারে—সেজন্য নানু, কিছুক্ষণ পার্কের বেঞ্চিতে বসে থেকে আবার রাস্তাটায় গেছে—জানালাটার কাছে গেছে। ঘণ্টাখানেক এরকম টানাপোড়েনের মধ্যে সহসা মনে হয়েছিল রেলিং—এ কেউ ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে—তার যাওয়া আসা লক্ষ্য করছে। ফলে সে স্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল। এসব কারণে ফিরতে তার এত রাত। কাল একবার নবনীতাকে গিয়ে সে বলবে, আমাদের আগের বাসাটায় এখন কে থাকে? ওখানে যাব। তুমি আমাকে নিয়ে চল।
তারপরই মনে হয়েছে নবনীতাদের সঙ্গে আলাপ নাও থাকতে পারে। নবনীতা নাও যেতে পারে। নবনীতা না গেলে, বাড়িটায় তার যাওয়া মুশকিল। সোজাসুজি যদি চলে যায়, গিয়ে বলে এ—ঘরটাতেই আমার বাবা মা থাকতেন, এ—ঘরটাতেই আমি অনেকদিন থেকেছি—ওই রেলিংটা দেখছেন, সেখানে থাকত আমার কাঠের ঘোড়া। ঘোড়ার পিঠে বসে আমি দোল খেতাম। আমার বারবারই এখানে চলে আসতে ইচ্ছে করে।
রাস্তার অন্ধকারে নানু ফিরছে। পাশাপাশি বাড়িগুলোতেও কেউ জেগে নেই, কেবল দোতলায় রেলিং—এ দাদু এক অতিকায় জড়দগবের মতো। সে একটা ক্যালভার্ট পার হয়ে বাড়িটার গেটের কাছে ঢুকে গেল। দাদু ঝুঁকে অন্ধকারে কিছু আঁচ করলেন, তারপর নিঃশব্দে নেমে আসতে থাকলেন। নীচের একটা আলো জ্বেলে দিলেন তিনি। নিঃশব্দে লোহার গেট খুলে দিলেন। নানুর কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। সে সোজা সিঁড়ি ধরে উঠে গেল। ছোট মাসি এবং দিদিমা শুয়ে পড়েছে। এদিকের ঘরবাড়ি মাঠ গাছপালা এখন কেমন নিশুতি রাতের মতো।