এই উজ্জ্বল আলোর উৎস অরু জীবনেও প্রত্যক্ষ করেনি। সার্চলাইটের আলোতে নদীর পাড়, গাছপালার সব যেন ভেসে যাচ্ছে। অজস্র পাখি ওড়াউড়ি করছিল এবং কোথাও কোনও গাছের ডাল থেকে একঝাঁক বাদুড় উড়ে গিয়ে ঘুরে ঘুরে গাছটা প্রদক্ষিণ করছে। ইঞ্জিন বন্ধ করে দেওয়ায় বাদুড়ের কিচমিচ শব্দ পর্যন্ত শোনা যাচ্ছিল। ঘাটে মানুষের ভিড়। আলোতে সব কিছু এত বেশি উদ্ভাসিত হয়ে আছে যে অরু নড়তে পারছিল না।
এই অরু!
হুঁ।
চল, আমাদের নামতে হবে।
অরু যেন কিছুটা ঘোরে পড়ে গেছে। সে দাঁড়িয়েই আছে।
জগদীশ বোঝেন, জীবনের এই সব নতুন অভিজ্ঞতায় অরু কিছুটা বোধহয় ধন্দে পড়ে গেছে। সে ভাবতে পারে এমন আশ্চর্য এক গ্রহের খোঁজ স্টিমারে না এলে পেত না।
জগদীশ টের পেল গেরাফি নেমে যাচ্ছে। গড় গড় করে অতিকায় গেরাফিটা জলের অতলে নেমে যাচ্ছে। মোটা রশি দিয়ে পাটাতনের থামের সঙ্গে বেঁধে ফেলা হচ্ছে স্টিমারটিকে। যাত্রীদের ছোটাছুটি শুরু হয়ে গেছে। অরুর কিছুতেই হুঁশ ফিরে আসছে না যেন!
সবাই নেমে যাচ্ছে। অরু বলল।
আমরা নামব! হ্যাঁ। এতক্ষণ কী বলছি তোমাকে।
অরুর মধ্যে আবার সেই বিষণ্ণতা, সে যেন কিছুতেই উৎসাহ পাচ্ছে না। প্রায় জোর করেই ধরে নিয়ে যাচ্ছেন জগদীশ, আশরাফকে এই সময় খোঁজা অর্থহীন—কোনওরকমে নেমে যাওয়া দরকার। টিনের স্যুটকেস, মিষ্টির হাঁড়ি এক হাতে, অন্য হাতে অরুকে ধরে রেখেছেন। পাড়ে লেগে গেলে স্টিমারটা দুলে উঠল। জগদীশ নিজেকে সামলে, অরুকে সামলে নেমে যাচ্ছেন, তখনই দেখলেন আশরাফ ছুটে আসছে। অরুকে বলল, সাবধানে নামবেন। বাবার কথা শোনবেন। বাড়ি ছেড়ে বিদেশ—বিভুঁইয়ে পড়াশোনা করতে চলে এলেন—তারপর বড় হয়ে দূরদেশে যখন যাবেন, আমারে সঙ্গে নিবেন, মন খারাপ করলে চলে! কেউ তো এক জায়গায় থাকে না।
অরু কিছু না বলে শুধু হাত তুলে দিল।
তিন
নদীর ঘাটে নেমে জগদীশ বললেন, পা চালিয়ে এসো। আর বেশি দূর না। সামনেই আমবাগান, সেখানে আমি থাকি। ঐ যে দেখছ, টিনে কাঠের ঘর। দেখতে পাচ্ছ, অন্ধকার হয়ে আছে বলে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। আর একটু এগুলেই দেখতে পাবে। বাবুদের সবাইকে মান্য করবে। আমি ওদের কাছারি বাড়িতে থাকি। মেলা দাদা দিদি আছে তোমার। তারা যেন তোমার ব্যবহারে কোনও কারণেই ক্ষুণ্ণ না হয়। কাল দশটায় স্কুলে যাবে। গুরুপদবাবু তোমাকে নিয়ে যেতে বলেছেন। গুরুপদবাবু স্কুলের হেডমাস্টারই শুধু নন, তিনি একটি আস্ত বিদ্যার জাহাজ।
অরণি বাবার পেছনে পেছনে সেই টিনকাঠের ঘরটার সামনে উঠে যেতেই বুঝল, জায়গাটা যেন কিছুটা পরিত্যক্ত এলাকা। নিশুতি রাতের মতো নিঝুম হয়ে আছে। সিমেন্ট বাঁধানো উঁচু ভিটি, ঘরে ঢোকার সিঁড়িটিও পাকা—বাবা তখন তালা খুলছেন এবং কথা বলেই যাচ্ছেন, স্কুলে ভর্তি হয়ে যাও। এখানেও তোমার মেলা বন্ধুবান্ধব জুটে যাবে। আর বড়বাবু, ছোটবাবুর মতো মানুষ হয় না। দুই শরিকের মধ্যে রেষারেষি আছে ঠিকই তবে তুমি রেষারেষি যতটা পারো এড়িয়ে চলবে। আপাতত বড়বাবুর পালিতে আছি, সেখানেই আমাদের দু—বেলা আহারের ব্যবস্থা। মাসে মাসে পালি বদল হবে। সে থাকতে থাকতে বুঝে যাবে। আপাতত জামাপ্যান্ট ছেড়ে হাতমুখ ধুয়ে নাও। বলে তিনি দরজা ঠেলে দিলেন। অন্ধকারেই হাতড়ে বের করলেন একটা হারিকেন। আলো জ্বেলে একটা থামের তারকাঁটায় ঝুলিয়ে দিলেন।
ঘরটা যে পার্টিশান করা তাও টের পেল অরু। পাশের দরজা ঠেলে দিতেই চোখে পড়ল, মেলা কাঠের র্যাক, তাতে পুরনো লাল মলাটের সব খাতাপত্র—কেমন একটা অচেনা গন্ধ বের হয়ে আসছে ঘরটা থেকে। একটা বালতি এবং কাঁসার ঘটি ঘর থেকে বের করে দরজা ফের বন্ধ করে বললেন, দু’মিনিট বিশ্রাম করে হাতমুখ ধুয়ে নাও। পাশেই টিউকল। আমার সঙ্গে এসো, বলে হারিকেন তুলে দূরে টিউকলটি দেখালেন। আমি এখুনি আসছি। ভয়ের কিছু নেই। বউঠানকে খবরটা দিয়ে আসি, আমরা এসে গেছি, রাতে খাব। বড়বাবু হয়তো বৈঠকখানায় অপেক্ষা করছেন, তাঁকেও খবরটা দেওয়া দরকার।
তারপর অরণি দেখল, বাবা অন্ধকারে কোথায় হারিয়ে গেলেন।
সে কিছুটা সন্ত্রস্ত হয়ে যে পড়েছে—তার মুখচোখ দেখেই বোঝা যায়। কোথায় কতদূরে সেই বৈঠকখানা—সে ঘর থেকে যে বের হয়ে যাবে তাও পারছে না। বাবা তাকে সঙ্গে নিয়ে গেলে কতটা কি ক্ষতি হত!
সারাদিনের পথশ্রমে সে যে খুবই কাহিল! দরজা খোলা। বাবা সামনের জানালাও খুলে দিয়ে গেছেন। নদী থেকে ঠান্ডা হাওয়া উঠে আসছে। সে তক্তপোশে বসে আছে। তার আর নড়তে ইচ্ছা করছে না। রাতের বেলা একা থাকতে তার এমনিতেই অস্বস্তি হয়। ভয় ভয় করে। অশুভ আত্মাদের ভয়ও আছে তার। সে বেজায় সাহসীও নয়। চারপাশের গাছপালার মধ্যে একটা মাত্র টিনের ঘর, মানুষের কোনও সাড়াশব্দই পাওয়া যাচ্ছে না। দূরে, বহুদূরে স্টিমারটা যে দুকূল জলে ভাসিয়ে চলে যাচ্ছে, তার গুমগুম আওয়াজ কান পাতলে এখনও শোনা যায়। তক্তপোশের নিচে কী আছে সে জানে না, সে দু—পা উঠিয়ে বসল। উঠে গিয়ে যে তারকাঁটার আংটা থেকে হারিকেনটা তুলে এনে তক্তপোশের নিচটা দেখবে তারও যেন সাহস নেই। কীটপতঙ্গের আওয়াজ উঠছে। গাছপালা থেকে পাতা পড়ছে টুপটাপ, এবং অন্ধকার ভেদ করে সেই শব্দমালার মধ্যে কোনও ভূতুড়ে আওয়াজের মতো টিনের চালে অনবরত কেউ যেন করাত চালিয়ে যাচ্ছে।