সে বারবারই মুখ তুলে বাবাকে দেখছে।
জগদীশ বললেন, নারাণগঞ্জ থেকে স্টিমারটা ছাড়ে। উদ্ধবগঞ্জ, বৈদ্যেরবাজার হয়ে বারদীর ঘাটে এসে ভিড়বে। বেলা দেখে সময়ের আন্দাজ করতে হয়। তবে জগদীশ জানে, দশটার মধ্যেই স্টিমার ঘাটে ভিড়বে।
এখানটায় নদী খুব চওড়া, এবং বাঁক আছে বলে, ঠিক বেলতলির মুখে না এলে স্টিমার দেখা যায় না। সবাই উদগ্রীব হয়ে আছে, ঐ বুঝি আসছে, ঐ বুঝি দেখা যায়। জগদীশ বুঝতে পারছেন না—ঠিক কতটা আর দেরি। তার পকেট ঘড়িটা সময় ঠিক দিচ্ছিল না, নারায়ণগঞ্জে সুধাকরের ঘড়ি মেরামতের দোকানে দিয়ে এসেছিল, ফেরত আনা হয়ে ওঠেনি। সেখানে যেতে হলেও যে স্টিমারে যেতে হয়—যেতে আসতে একটা দিন কাবার হয়ে যায়। মামলা মোকদ্দমা উপলক্ষেই যাওয়া এতদূর, তবে যে হেঁটে যাওয়া যায় না তাও নয়, শীত কিংবা গ্রীষ্মে হেঁটেই যেতে হয়। প্রায় পনেরো ক্রোশের মতো রাস্তা হেঁটে শুধু ঘড়ি মেরামতের খবর নেওয়াও কঠিন।
অগত্যা পাশের ভদ্রলোকটিকে বলতেই হল, বাবুমশায়, কটা বাজে?
লোকটি পকেট থেকে ঘড়ি বের না করেই বলল, দশটা বেজে গেছে। মনে হয় লেট আছে।
ইঞ্জিন বিকল হয়ে পড়তে পারে, চড়ায় আটকে যেতে পারে। কতরকমের দুর্দৈবই যে যাত্রাপথের অপেক্ষায় থাকে। জগদীশ অগত্যা অশ্বত্থ গাছের গুঁড়িতে বসে পড়লেন। পাশে অরু দাঁড়িয়ে আছে। সে নদীর দিকে তাকিয়ে আছে। হাওয়ায় নদীতে বড় বড় ঢেউ—পাখিরা উড়ছে, ফিঙে পাখির ঝাঁক উড়ে যাচ্ছে নদীর উপর দিয়ে। কাক চিলও উড়ছে। ঢেউ—এর মাথায় ভেসে বেড়াচ্ছে বালিহাঁস—বাজপাখিরাও উড়ে উড়ে নদীর জলে শিকারের খোঁজে আছে। পাটাতনটা লম্বা হয়ে চলে গেছে বেশ দূরে—পাটাতনের নিচে বেদেদের নৌকাগুলি বাঁধা। ঢেউএ খুবই দুলছিল।
গাদাবোটও কম নেই। জেলে ডিঙ্গি সব মাছ নদীতে জাল ফেলে বসে আসে। অদূরে নদীর ঘাটে দুটো কেরায়া নৌকা লগি পুঁতে অপেক্ষা করছে। যাত্রী পেলেই বোধ হয় ঘাট থেকে নৌকা ছেড়ে দেবে। আর যতদূর চোখ যায় শুধু জল, আর কাশের জঙ্গল নদীর বুকে জেগে ওঠা চরগুলিতে। আশ্চর্য এক রূপকথার দেশে যেন অরু ঢুকে যাচ্ছে।
তখনই জগদীশ ডাকলেন, অরু আয়। স্টিমার আসছে।
অরু বেলতলির ঘাটের দিকে তাকাল—না কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সে শুনেছে, সাদারঙের স্টিমারটা অনেক দূর থেকেই দেখা যায়। কিন্তু চারপাশে তাকিয়ে স্টিমারের বিন্দুমাত্র চিহ্ন দেখতে পেল না।
সে বলল, কোথায়?
আসছে। চলো এগিয়ে থাকি।
এগিয়ে থাকি বলতে জগদীশ অরুকে কোথায় যেতে বলছেন বুঝতে পারল না।
সে দেখল বাবা তার আর কোনও কথা না বলে পাটাতনের দিকে হেঁটে যাচ্ছেন।
সে এবার যেন কিছুটা বিরক্ত হয়েই বলল, কোথায় স্টিমার?
বাবা বললেন, শব্দ শুনতে পাচ্ছ না। গুমগুম আওয়াজ। কান পাতলেই শোনা যায়। তোমার স্টিমার আসছে।
দুই
বাবার হাতে ফুল—তোলা টিনের স্যুটকেস, বগলে পুঁটুলি—তিনি পাটাতনের শেষ মাথায় প্রায় চলে গেছেন—সেও দৌড়তে পারত, কিন্তু কোথায় স্টিমার, গুমগুম আওয়াজও শুনতে পাচ্ছে না, সে দাঁড়িয়েই আছে। সারাটা রাস্তা বাবা কিছুতেই স্যুটকেসটা তার হাতে দেননি—এমনকি বোঁচকাটিও নয়, সে কি এতই ছেলেমানুষ! এই সব ভেবেই তার এত রাগ হচ্ছিল যে, স্টিমার না দেখে যেন এক পা—ও নড়বে না সে। আর বাবা কেন যে এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন, তাও সে বুঝতে পারছে না। স্টিমারটা কি তাদের ফেলে চলে যেতে পারে!
বাবা ডাকছেন, অরু আয়, দাঁড়িয়ে থাকিস না। আগে উঠতে না পারলে বসার ভালো জায়গা পাবি না। কতদূর আমাদের যেতে হবে!
তখনই সাদা রঙের স্টিমার নদীর বাঁকে ঢুকে গেছে। ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। ক্রমে স্টিমারটা এগিয়ে আসছে। কী বিশাল, যেন নদীর জল তোলপাড় করে সিটি বাজাতে বাজাতে সবাইকে সতর্ক করে দিচ্ছে—নদীর পাড়ে এসে বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ছিল। নৌকাগুলি দুলছিল—নদীর দু’পাড় জলময় হয়ে যেতে যেতে কখন যে স্টিমার থেকে সিঁড়ি নেমে গেল, তাও যেন অরুণ খেয়াল নেই। কেমন এক বিস্ময় তার মধ্যে নিয়ত খেলা করে বেড়াচ্ছিল।
হঠাৎ সে দেখল বাবা তার কাছে ছুটে এসেছেন।
কী হল! আয়।
অরু বুঝল তাকে যে স্টিমারে উঠে আরও অনেক দূরে চলে যেতে হবে—যেন মনেই নেই। যেন নদীর পাড়ে সে বেড়াতে এসেছিল, কোথাও যাবার কথা ছিল না তার, স্টিমার দেখে সে বাড়ি ফিরে যাবে—বাবা এসে তার হাত ধরে টানতেই তার খেয়াল হল সে পাটাতনের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। যাত্রীরা সব উঠে যাচ্ছে সিঁড়ি ধরে, সে তাড়াতাড়ি বাবার হাত ছাড়িয়ে দৌড়তে থাকল। আর স্টিমারে উঠে যাত্রীদের ভিড় ঠেলে সিঁড়ি ধরে আপার—ডেকে উঠে গেল। রেলিং—এ ঝোলানো সাদা রঙের গোল গোল লাইফবয়া পরম কৌতূহলে সে দেখছে।
বাবাকে দেখেই প্রশ্ন, এগুলো কী!
পরে সব জানতে পারবে। আগে আমার সঙ্গে এসো। জাহাজের সারেঙসাবের সঙ্গে দেখা করে আসি। তিনি তোমাকে দেখতে চেয়েছেন। সুলতানসাদির বাজারের কাছে এককালে তাঁর বাড়ি ছিল। তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি শুনেই বললেন, কর্তারে নিয়া আসেন, দেখি। আশরাফ মিঞার নাম নিশ্চয়ই শুনেছ।
আশরাফ মিঞার নাম সে কখনোই শোনেনি। সে জানে বাবার এই স্বভাব, যে—মানুষ এতবড় স্টিমারটা চালিয়ে নিয়ে যায়, তার নাম না জানলে হবে কেন! ঝড়জলে কিংবা প্লাবনে, অথবা জলের ঘূর্ণি যার এত চেনা, সে মানুষটার নাম না জানা খুবই অন্যায়, এমনও মনে হল বাবার মুখ দেখে। তা ছাড়া মানুষটা যখন তাদের এলাকার মানুষ।