তিথি এত সুন্দর কথা বলে! কে বলায় তাকে! কেমন এক আশ্চর্য প্রকৃতির মধ্যে তিথি বড় হয়ে উঠতে উঠতে বোধহয় কখনও সে কোনও স্বপ্নের দেশ আবিষ্কার করে ফেলে! সে তো সবে এসেছে, সে এখানেই থাকবে। এও বুঝতে পেরেছে, বাবা আদায়পত্রে বের হলে এই মেয়েটার সাহচর্য তার সম্বল।
পাঁচিলে শ্যাওলার গন্ধ। অরণি ভেতরে ঢোকার সময় গন্ধটা পেল। দরজা দিয়ে ঢোকার সময় তিথি বলল, তুমি আমার হাত ধরো।
কেন? তোর হাত ধরব কেন?
কিছু এখানটায় দেখা যায় না।
কেন দেখা যায় না?
দুটো চালতা গাছ আছে। নালা নর্দমা আছে বাড়িটার। পড়ে যেতে পারো।
বাস্তবিক জায়গাটায় পা বাড়াতেই ভয় করছিল অরুর। প্রায় অন্ধের মতো পার হয়ে যাচ্ছে জায়গাটা। তিথি তার হাত ধরে রেখেছে। এবং রকে তুলে দিলে বুঝল, তার আর হাঁটতে অসুবিধা হবে না। মেলা মানুষজন বারান্দায়, বৈঠকখানাও সে দেখতে পেল। সেখানে চার—পাঁচজন প্রৌঢ়মতো মানুষ পাশা খেলায় ব্যস্ত।
তিথি বলল, গিন্নিমা, অ গিন্নিমা, তুমি অরুদাকে দেখবে বলেছিলে, এই তো অরুদা দাঁড়িয়ে আছে।
মৌমাছির মতো মানুষজন যেন উড়ে আসছে। গুঞ্জন।
এই ছোড়দি—তিথি কাকে যেন ডাকল।
ছোড়দি ছোড়দি করছিস কেন? ওকে ঘরে নিয়ে বসা।
তিথি কোন ঘরে নিয়ে যাবে! বড় বউদির ঘরে, গিন্নিমার ঘরে, মেজদার ঘরে—সে ঠিক বুঝতে পারছে না বলেই রোয়াকে দাঁড়িয়ে আছে।
অরু বড়ই অসহায় বোধ করছে। বাবার সঙ্গে এলে বোধ হয় এতটা অস্বস্তি হত না।
গিন্নিমা ডাকলেন, তিথি, তুই তো আচ্ছা মেয়ে, কোথায় যাস, কোথায় থাকিস, ডেকে ডেকে সাড়া পাচ্ছি না। কখন থেকে খুঁজছি।
বারে তুমি যে বললে, অরুদাকে দেখবে!
কখন বললাম!
বললে না, জগদীশকে বলবি, অরুকে যেন নিয়ে একবার আসে।
বলেছি বুঝি। কোথায় ছেলেটা! কোথায় দাঁড়িয়ে আছে! আমি যাই কী করে—হাত জোড়া আমার। এখানে নিয়ে আয়। সব ঘরগুলোর সামনেই লম্বা রোয়াক অথবা বারান্দা বলা যায়, বারান্দা পার হয়ে তিথি বলল, দাঁড়িয়ে থাকলে কেন অরুদা, সবাইকে প্রণাম করতে হয়।
অরু রোয়াকে দাঁড়িয়েই আছে।
পাকাবাড়ি বুঝি এমনই হয়ে থাকে। একতলা বাড়িটা এতবড় ভেতরে না ঢুকলে সে বুঝতে পারত না। বাড়ির মানুষজন সবাই বড় সুপুরুষ। ঘরের ভেতর পালঙ্কে শুয়ে সুন্দরমতো মেয়েটা কে সে জানে না। বালিশে ভর করে তাকে দেখছিল। সাদা ধবধবে বিছানা, পালঙ্কের পায়ায় সিংহের থাবা। চকচকে লাল মেঝে এবং ছাদে ঝাড়বাতি ঝুলছে। হাওয়ায় রিন রিন করে বাজছিল। বয়স্ক এক মহিলা তাকে কাছে টেনে আদর করতে চাইলে সে কেমন জড়ভরত হয়ে গেল। তিথি বলল, ছোটপিসি, ভয় কি অরুদা।
ছোটপিসিকে সে কেন যে বয়স্ক ভাবল বুঝতে পারছে না। সাদা ধবধবে থান পরনে। হারিকেনের আলোতে আবছামতো মুখ। ভালো করে নজর করতেই বুঝল, সাদা থান পরলেই বয়স্ক হয়ে যায় না। তার চেয়ে কিছু বড় হতে পারে। কাকিমার বয়সিই হবে। ছোটকাকার বিয়ের কথা তার মনে আছে। সে বরযাত্রী গিয়েছিল। বালিকা বয়সে ছোট কাকিমা যদি তাদের বাড়িতে আসে, তবে এখন তার কতই বা বয়স হতে পারে।
ছোটপিসি থুতনি ধরে বলল, আয় আমার ঘরে।
অরু কিছুতেই যেতে চাইল না।
আর আশ্চর্য তিথির হাতে সেই হাঁসটা। ছালচামড়া ছাড়ানো হয়নি। হাঁসটা মৃতও নয়। তবে ভালোমতো জখম হয়েছে। তিথি হাঁসটাকে প্রায় বুকে করে ধরে রেখেছে।
পাকা ঝাপটাচ্ছিল হাঁসটা।
কিন্তু উড়তে পারছে না। জোরজার করে তিথি চেপে রেখেছে কোলে।
হাঁসটা যে আদৌ মরে যায়নি, শিকারের পাখি এমনই হয়ে থাকে, খোঁড়া হতে পারে, কিংবা পাখায় ছররার গুলি লাগতে পারে, বোধহয় হাঁসটার ডানা ভেঙে গেছে, বড়ই কাতর চোখে হাঁসটা মাথা তুলে হারিকেনের আলোতে উড়ে যাবার চেষ্টা করছে, পারছে না, বৃথাই চেষ্টা—তখনই ছোটপিসি বলল, তোর কি তিথি ঘেন্নাপেত্তা নেই। বুকে তুলে রেখেছিস। নিয়ে যা। আমি সহ্য করতে পারছি না।
অরুও কেমন দমে গেল।
এই জখমি হাঁসটা যেন না দেখলেই ভালো হত।
অরু বলল, আমি যাই।
তিথি বলল, একা যেতে পারবে, কাছারিবাড়িতে! রাস্তা হারিয়ে ফেলতে পারো।
অরুর মনে হল, সে সত্যি একা যেতে পারবে না। তিথি রাস্তা চিনিয়ে না নিয়ে গেলে, রাতের অন্ধকারে গাছপালার ছায়ায় কাছারিবাড়িটা যেন কখনোই আর খুঁজে পাবে না।
।চার
জগদীশ পাঁচটা না বাজতেই ঘুম থেকে উঠে পড়েন। খড়ম পায়ে বাইরে বের হয়ে সূর্য প্রণাম, তারপর নুয়ে এই বসুন্ধরা এবং যাকে তিনি জগজ্জননী ভাবেন তাঁর উদ্দেশ্যে চোখ বুজে কিছুক্ষণ ধ্যান, ফের ঘরে ঢুকে পেতলের গাড়ুটি হাতে নিয়ে হাঁটা দেন—সামনের সুপারিবাগানে ঢুকে যান, কিছুদূর হেঁটে গেলেই ঝোপের মতো জায়গায় তিনি অদৃশ্য হন। তারপর নদীর জলে অবগাহন, স্তোত্রপাঠ এবং ফেরার পথে মঠের শিবলিঙ্গের মাথায় একটি ধুতুরা ফুল এবং নদীর জল ঢেলে শিবস্তোত্র পাঠ করেন।
এত সকালে তার পুত্র অরণির ওঠার অভ্যাস নেই। দেশের বাড়িতে মাইনর পাশ করে বসেছিল, গতকাল তাকে নিয়ে তিনি তাঁর কর্মস্থলে চলে এসেছেন। স্থানীয় স্কুলে ভর্তি করে দেবার ব্যবস্থাও হয়ে গেছে। রাতে পথশ্রমে অরণির বোধ হয় ভালো ঘুম হয়নি। সারারাতই ছটফট করেছে। বাড়ি ছেড়ে থাকারও কষ্ট কম না। ভোররাতের দিকে ঘুমিয়ে পড়ায় তিনি তাকে এখনও ডেকে তোলেনি। মনে মনে স্তোত্রপাঠ করছেন, এবং খড়ম পায়ে হাঁটাহাঁটি করলে অরণির ঘুমের ব্যাঘাত ঘটতে পারে—যতক্ষণ না হরমোহন নাজিরখানার দরজা খুলে দেবে, তিনি ঘর ছেড়ে যেতেও পারেন না।