মানে পাঁচটি ভাইবোন নিয়ে তিথি বিমাতার সংসারে থাকে।
তিথির কথা ভেবে অরুর খারাপই লাগল।
আসলে সে যে চালাকি করে তিথির বাবা—মার কথা বলে আটকে রেখেছে বুঝতেই দিল না। কথা বললে মেয়েটা নড়তেই চায় না। শিকারের সেই মৃত হাঁসটা দেখানোর আগ্রহ যেন আর তিথির মধ্যে নেই। তাঁকে সামান্য ভালোবেসে কথা বললে, এমন চোখে তাকিয়ে থাকে যে কিছুতেই আর অবহেলা করা যাবে না।
তিথি ঠিক অরুর পাশের চকিতে বসে পা দোলাচ্ছে। রোগা এবং কিছুটা লম্বা, অরুর মতোই লম্বা হবে, সংকোচ সংশয় কোনওকিছুই যেন তার মধ্যে নেই। চোখ দুটো বড় তাজা। খুবই ফর্সা, মুখের গড়নটা সরল সুন্দর এবং কিছুটা গম্ভীর। মেয়েটা চুপচাপ থাকলে দেবী বিসর্জনের বাজনা বেজে ওঠে। চুল কোঁকড়ানো, কপাল বেশ চওড়া এবং ঘন চুলে নারকেল তেলের গন্ধ।
অরু দেখল, সামান্য কথাবার্তা বলায় তিথি খুব খুশি। তারপরই কেন যে বলল, তুমি ওঠো তো। বিছানাটা একেবারে করে দিয়ে যাই। খেয়ে এসে শুয়ে পড়বে। বালিশ চাদর ওয়াড় সব কেচে রেখেছি। কাকার মশারিটা ছোট। দু’জনের হয় না। বলে কয়ে কাকাকে দিয়ে তোমার আলাদা মশারি আনিয়েছি। কাকার শুতে শুতে অনেক রাত হবে।
এখন বিছানা করতে হবে না। বাবা আসুক।
তিথি বলল, তা হলে আমি যাই। বলেই সিঁড়ি ধরে লাফিয়ে নেমে গেলে অরু দৌড়ে দরজার কাছে চলে গেল।
এই যাস না। আমি তোর সঙ্গে যাব।
এসো না। আমি তো দাঁড়িয়েই আছি।
কোথায় দাঁড়িয়ে আছিস! দেখতে পাচ্ছি না!
নেমে এসো, দেখতে পাবে।
দরজা বন্ধ করে দেব।
শিকল তুলে দাও না!
অরু শিকল তুলে দিতেই তার চারপাশ রাতের অন্ধকার ঘিরে ধরল। কিছুই চেনে না। বড় বড় আমগাছের ছায়ায় জায়গাটা কীভাবে কতটা ছড়িয়ে আছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। জানালা দিয়ে সামান্য আলো এসে বাইরে পড়েছে। সেদিকে তাকিয়েও কিছু বুঝতে পারল না। একবার ভাবল দরকার নেই তিথির সঙ্গে গিয়ে, কোথায় দাঁড়িয়ে আছে বুঝতেই পারছে না, সে ঘাবড়ে গেলে তিথি আরও মজা পেয়ে যাবে।
সে সিঁড়িতে উঠে শিকল খুলতে গেলেই, তিথি কোথা থেকে ডাকল, এই তো আমি। তুমি আমাকে দেখতে পাচ্ছ না!—ঠিক যেখানে জানালার আলো এসে পড়েছে, তিথি সেখানে দু—হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছে।
সে ফের ঘরে শেকল লাগিয়ে জানালার আলোর দিকে এগিয়ে গেল।
না, তিথি নেই।
পাশেই সাড়া পাওয়া গেল, এসো।
অরু অন্ধকারে খুঁজছে তিথিকে। কোনও গাছের আড়াল থেকে যেন কথা বলছে। যতই অন্ধকার হোক, আবছামতো কিছু তো দেখা যাবেই। একটা কুকুর দৌড়ে গেল। ঘেউ ঘেউ করছে।
অরুর মহা মুশকিল। এখন ইচ্ছে করলেই সে যেন আর ঘরে ফিরতে পারবে না। আমবাগানের এলাকাটা যে অনেকটা জায়গা জুড়ে তিথিকে খুঁজতে গিয়ে টের পেল। কোনও আলো পর্যন্ত চোখে পড়ছে না। শুধু তিথির এক কথা, আমি তো তোমার সঙ্গেই আছি। এসো না।
তুই আমার সঙ্গে নেই? গাছের আড়াল থেকে কথা বলছিস! কতদূর! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। আমাকে তুই ভয় দেখাবি না বলে দিচ্ছি।
সামনে একটা সুপারি বাগান পড়বে। বাগানটা নদীর পাড়ে চলে গেছে। রাস্তা হারিয়ো না অরুদা। আমার পিছু পিছু চলে এসো। আমি ভূত নই, আমাকে ভয় পাবার কিছু নেই।
মেয়েটি ভারী বজ্জাত। তাকে বেকুব বানাবার তালে আছে। জমিদারবাড়ি বিশাল এলাকা নিয়েই হয়ে থাকে সে জানে। যেমন এই আমবাগান কিংবা সুপারিবাগানের ভেতর দিয়ে যেতে যেতেই হয়তো কোনও সাদারঙের বাড়ি আবিষ্কার করে ফেলবে। কারণ স্টিমারের আলোতে সুপারিবাগানের ভেতর দিয়ে সে যেন সত্যি একটা সাদারঙের বাড়ি দেখে ফেলেছিল।
বাবা তাকে কোথায় এনে তুললেন! সে কার পাল্লায় পড়ে গেল! মা নদীর জলে ভেসে গেছে, বাপ বাজারে জিলিপি ভাজে—তিথির ভাইবোনও আছে, কোন দিকটায় তিথি তার বাবার সঙ্গে থাকে তাও সে বুঝতে পারছে না। চারপাশে গাছ, কোথাও জঙ্গল, সুপারির গাছগুলো সোজা দাঁড়িয়ে আছে। সামান্য ঝড়বৃষ্টি হয়ে যাওয়ায় টুপটাপ পাতাও ঝরছে না, দু—একটা মরা ডাল পায়ে লাগতেই সে উবু হয়ে বসে পড়ল। তিথি তাকে যেন কোনও অশরীরী আত্মার পাল্লায় ফেলে দিচ্ছে।
এই অরুদা, বসে পড়লে কেন।
যেন একেবারে পাশ থেকে বলছে।
বিশাল একটা গাছের কাণ্ড তার সামনে রাস্তা রুখে দাঁড়িয়ে আছে। সে এগোতে পারছে না।
এত পাঁচিল। ঐ তো দরজা।
অরু বলল, তুই কোথায়?
এই তো আমি।
তিথি একেবারে সামনে এসে তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
এই ছাড়। কী হচ্ছে।
কিছু হচ্ছে না। তুমি এত ভীতু। নদীর জল কল কল শব্দ—শুনতে পাচ্ছ না। সুপারিগাছের ফাঁক দিয়ে দেখ না, ঘাটে নৌকায় কত লণ্ঠন জ্বলছে।
তুই আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস?
নদীর পাড়ে।
কেন?
এমনি এমনি।
আমি যাব না। তোর ইচ্ছে হয় তুই যা। বাবা আসুক, সব না বলছি তো। তুই না আমাকে অন্দরে নিয়ে যাবি বললি। গিন্নি মা আমাকে দেখতে চেয়েছেন, পাখি শিকার, মেজদা, রান্নাবাড়ি কত কিছু না বললি!
আমি তো তোমাকে সেখানেই নিয়ে যাচ্ছি।
এত দূর!
দূর, কী বলছ! ঐ তো দেখা যাচ্ছে। সাদামতো বাড়ি দেখতে পাচ্ছ না আবছামতো। বৈঠকখানায় সেজবাতি জ্বলছে। রকে হারিকেন জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে। দেখতে পাচ্ছ না! নদীর পাড় ধরে গেলে তুমি খুব খুশি হতে অরুদা। সেখানে কত বড় আকাশ, কত নক্ষত্র আকাশে, কত সব জেলে ডিঙ্গি নদীর ঢেউ—এ ভাসছে, আমার যে কেবল মনে হয় খুব বর্ষায় কোনও ডিঙ্গিতে নদীর ঢেউয়ে ভেসে যাই। ঝড়বৃষ্টি নদীর ঢেউ ফুলেফেঁপে উঠবে, লম্বা ছিপনৌকায় আমি বসে থাকব। চারপাশে ঘন আঁধার, ঝিরঝির করে কুয়াশার মতো বৃষ্টি ঘিরে থাকবে আমাকে, কেউ দেখতে পাবে না, কেউ না, তুমি ছাড়া।