সে বলল, বাবা তুমি যাবে না?
কোথায়?
এই যে আমাকে নিয়ে যেতে বলল।
ও হ্যাঁ। যাব। তোমাকে দেখার আগ্রহ সবার। বউঠান দু—বার খবরও নিয়েছেন। স্টিমার এত লেট করবে কে জানত!
অরু ফের বলল, তুমি কি আহ্নিকে বসবে!
কেন?
দেরি হয়ে যাবে না।
তিথির সঙ্গে যা না। বলবি, আহ্নিক সেরে আমি যাচ্ছি।
তিথি বলল, হল তো! চলো না অরুদা!
তিথি তার হাত কিছুতেই ছাড়ছে না।
চলো বলছি।
আগে তুই আমার হাত ছাড়।
আমার হাতে কী আগুন আছে? ছুঁলে হাতে কি তোমার ফোসকা পড়বে!
এত আস্পর্ধা হয় কি করে! বাবা কেন যে ধমক দিচ্ছেন না। বাবা তো বলতে পারেন, ঠিক আছে যাবে, হাত ধরা যখন পছন্দ করে না। না ধরলেই পারিস।
জগদীশ খড়ম পায়ে কোথায় আবার বের হয়ে যাচ্ছেন।
অরুর দিকে তাকিয়ে বললেন, আহ্নিক সেরে আসছি ঘাট থেকে। বেশি দেরি হবে না।
বাবা আর কোনও কথা না বলেই বের হয়ে গেলেন।
তিথির এখন যেন ভারী মজা।
বাবার উপর অরণির ক্ষোভ বাড়ছে। এই অচেনা জায়গায় তার জন্য বাবার যেন কোনও ভাবনা নেই। তার কোনও বিন্দুমাত্র বিপদের আশঙ্কা আছে বলেও বোধ হয় তিনি মনে করেন না।
তিথি এবার গম্ভীর গলায় বলল, কী যাবে? না বসে থাকবে। আমি অত সাধাসাধি করতে পারব না বাপু। একা বসে থাকলে জানো ভূতে ধরে।
কত সহজে তিথি কথাটা বলে ফেলল। তাকে যে ভূতে ধরেছিল তিথি বোধ হয় টের পেয়ে গেছে। সে ঘামছিল, চোখ গোল গোল করে তিথিকে দেখছিল, সে কোনও সাড়া দিতে পারেনি, তিথি জানলায় উঁকি দিয়ে সব টের পেয়েছে।
বাবার খড়মের শব্দও মিলিয়ে গেল।
সে কী করবে বুঝতে পারছে না। যদি তিথি এখন এক লাফে বের হয়ে চলে যায়, যদি বলে ঠিক আছে, ভুইঞা কাকা এলেই যেয়ো, আমি যাচ্ছি। আমার মেলা কাজ। তা হলেই হয়েছে।
তিথি তাকে নিয়ে এখন যে কতরকমের মজা করতে পারে।
তিথির সঙ্গে চলে যাওয়াই ভালো। সে আর এই ঘরটায় একা বসে থাকতে পারবে না। কিছুতেই না। একা থাকলে সত্যি ভূতে ধরে। ভূতের যত ধান্দা রাতে। বিধুখুড়োর কথা। রাতেই তারা ঘুরে বেড়ায়—যত অন্ধকার তত তাদের মজা। সিঙ্গিদের সেই বটগাছটায় যে জোড়া ভূত থাকে, কিংবা খালের পাড়ে সাঁকোর নিচে ভেতো ভূত থাকে, কেবল ভাত চুরি করে খেতে ভালোবাসে বিধু খুড়ো ছাড়া সে খবর কেউ রাখে না। নানাপ্রকারের ভূতের গল্প বিধুখুড়োর পেটে গোলমাল পাকায়। রাতে গোরু—বাছুর গোয়ালে তুলে, বৈঠকখানায় এসে টুলে চিত হয়ে শুয়ে পড়বে, আর গামছা ঘুরিয়ে মশা তাড়ানোর সঙ্গে রাজ্যের যত ভূত এসে তার কাছে হাজির হয়। অরু আর তার ভাইবোন মিলে জপতপ করার মতো বিধুখুড়োর শিয়রে বসে থাকে—তারপর কী হল খুড়ো।
হয়েছে তোদের মাথা। রান্নাঘরে দেখে আয় পাত পাড়তে কত দেরি! তোদের মা কাকিরা সারাদিন কী করে! কখন খাব, কখন ঘুমাব। কত রাত হল টের পাস না।
অরুর তখন এক কথা, তুমি খাও না খাও—আমি একা যেতে পারব না।
রান্নাঘরটা যে তাদের ভেতরের উঠোন পার হয়ে অন্দরের উঠোনের শেষ দিকটায়। ঠিক বাঁশঝাড়ের পাশে। এতটা রাস্তা রাতে জ্যোৎস্না থাকুক, অন্ধকার থাকুক—হারিকেন হাতে থাকুক, টর্চ থাকলেও সে একা যেতে সাহস পায় না। তবু বাড়িতে একরকম, কিন্তু এই অচেনা জায়গায় সে যে কী করে!
তিথির কথারও গুরুত্ব আছে।
ঘরে একা থাকলে ভূতে ধরে।
সে বলল, তিথি একটু বসবি। বাবা আসুক। তারপর আমরা যাব।
হয়ে গেল। ভূতের ভয়ে এত কাবু। কাকার ফিরতে দেরি আছে।
কেন, দেরি কেন?
বারে মঠে শিবলিঙ্গ আছে জানো?
তা থাকতেই পারে।
থাকতেই পারে না, আছে। খুবই জাগ্রত। কাল সকালে আমার সঙ্গে যাবে। সব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাব। আটআনা জমিদারবাবুর কত বড় প্রাসাদ দেখতে পাবে। নদীর পাড়ে কাকা ঘাটের স্টেশন মাস্টারের ঘরে বসে খবরের কাগজ না পড়ে ফিরবেন না। আহ্নিক সারা হলেই ফিরে আসবেন, তা হলেই হয়েছে।
মঠে শিবলিঙ্গ আছে জানো না? কেন যে বলল তিথি! জাগ্রত ঠাকুর, সেই না হয় হল। জাগ্রত বলেই বাবার দেরি হবে ফিরতে তাই বা কেমন আবদার। তা হলে কি রাতে তাকে এই ঘরে পাঠ্যবই নিয়ে একাই পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হবে!
বাবা তার আহ্নিকের নামে মঠে যাবেন, জাগ্রত ঠাকুর বলে পরিবারের সবার মঙ্গলের জন্য ধ্যানে বসবেন, তারপর স্টেশন মাস্টারের ঘরে ঢুকে সেজবাতির আলোয় অর্ধসাপ্তাহিক আনন্দবাজার কাগজখানা পড়বেন। পড়া শেষ না হলে আবার পড়বেন—এই অজুহাতে যে বাবা রাতে ঘরে ফিরতে বেশ দেরি করবেন তাও অরু বুঝে গেল। তিথির সঙ্গে তার বরং ভাব করেই চলা দরকার।
অরু কিছুটা চালাকি করে বলল, তোর বাবা কী করে রে?
বাবা জিলিপি ভাজে। কতবার বলব!
কোথায়?
কেন বাজারে।
তোদের বাড়িটা কোন দিকে।
আঙুল তুলে দেখাল, চলো না আমাদের বাড়ি হয়ে যাবে। জানো আমার মা না কোথায় চলে গেছে?
তোর মা বাড়ি থাকে না?
লোকে যে বলে মা আমার জলে ভেসে গেছে।
এইরে, এ যে আর এক ভূতের দোসর।
কী করে জলে ভেসে গেল?
আমি তার কী জানি? ছোট ছিলাম তো। মা’র কথা আমার মনেই নেই।
তোর মা নেই তবে?
তিথি জিভ কেটে বলল, অমন কথা বলো না অরুদা। আমার মা সাক্ষাৎ লক্ষ্মীঠাকরুণ। মা না থাকলে বাবা নাকি বিবাগি হয়ে যেত। ভুইঞাকাকাই জোরজার করে ফের বাবাকে বিয়ে দিয়ে সংসারী করে তুললেন।
তোর ভাইবোন আছে?
হাতের পাঁচ আঙুল তুলে দেখাল।