বেলা পড়ে আসছে। শীতের বেলা। ঝাউগাছের ও পাশে সূর্য ক্রমশ বাঁশবনের অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে। ঘাটে আগুন উঠছে না। চিতার আগুন যত নিভে আসছে দুখিয়া তত বেশি উত্তেজনা অনুভব করছে। মংলি ঘাট থেকে ফিরছে—ওর মাথায় নতুন তোশক চাদর। হরীতকীর ঘরের পাশ দিয়ে একটু ঘুরেই সে গেল। যেন সকলকে দেখিয়ে যেতে চায়। নেলি ইচ্ছা করেই কাঁথার নিচে মুখ লুকিয়ে ফেলল। কাঁথা কাপড়ের ভিতর থেকে উঁকি মেরে তোশক চাদর দেখল না। ঝিম মেরে কাঁথা—কাপড়ের নিচে পড়ে থাকল।
আর এ—অসময় লাফাতে লাফাতে এল গেরু। গলায় কালো কারে তাবিজ। পুরুষ্টু মরদের মতো গজাতে আরম্ভ করেছে গোঁফ। কালো গেঞ্জি গায়ে—হাতে বল্লম—ওকে দুর্ধর্ষ মনে হচ্ছিল। বল্লমটা কাঁথা—কাপড়ের উপরেই যেন ছুঁড়ে দেবে। নেলির চুল মাচানের পাশে ঝুলছে। গেরু বুঝতে পারছে নেলি মাচানে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। নেলিকে সে ডাকল—এই নেলি,—নে—লি, নেলি—বা তু ত আচ্ছা আছে। অবেলায় এক ঘুম দিয়ে লিচ্ছিস।
নেলি কাঁথা—কাপড় ছেড়ে উঠল না অথবা ওঠার ইচ্ছা প্রকাশ করল না, কিংবা ইচ্ছা থাকলেও উঠতে পারল না, শুয়ে থাকার ইচ্ছা কেবল—ঘুম ঘুম ভাব শরীরে। অথচ ঘুম আসছে না। রাজ্যের চিন্তা এসে নেলিকে জড়িয়ে ধরেছে—গেরু কবে চটানে সত্যি মরদ হয়ে উঠবে, গেরু কবে বুলবে আ যা নেলি, কাঁহা ভি চল যাই, কবে অন্য চটানে উঠে গিয়ে ওরা ঘর বাঁধতে পারবে। দু হাতের ওপর চিবুক রেখে গেরুর দিকে নেলি শুধু চেয়ে থাকল। কাঁথা—কাপড় ছেড়ে কিছুতেই উঠছে না কিংবা কথার জবাব দিচ্ছে না।
গেরু নেলিকে বলল, হামি ফরাসডাঙায় যাচ্ছি! বাপ হামাকে আজ থেকে লিয়ে লিল।
তুর বাপ হামাকে লিবে? তবে হামিও সঙ্গে যাই।
গেরু প্রচণ্ডভাবে হেসে উঠল। বল্লমটা শক্ত করে ধরল। কোমর থেকে গামছা খুলে মুখ মুছে বলল, কী যে বুলছিস তু নেলি। তু যাবি ফরাসডাঙায়। তু যাবি মুর্দার কঙ্কাল তুলতে! তু যে ডরে মরে ভূত হো যাবিরে নেলি, ভূত হো যাবি!
নেলির গলার স্বরটা সহজ এবং সুরেলা হল—হামি বুঝি পারে না ভাবছিস!
গেরুর এখন কথায় ঢিলেঢালা চাল—কেইসে তু পারে? এ তো কাঠ বইয়ে দেয়ার কাজ না আছে। এ বহুত তন্তর—মন্তরের কাজ আছে, বহুত তন্তর—মন্তর লাগে।
নেলি গেরুর মুখের কাছে হাতটা ঘুরিয়ে আনল। হে রে, রাখ তোর তন্তর—মন্তর। হামি ভি বহুত তন্তর—মন্তর জানে।
লেকিন তাবিজ—ওবিজ লাগে নেলি। বাপ মেরে তিন তিনটা তাবিজ দিল। পুনঃপদের মাদুলি, মহাশক্তি কবচ বাণ, আউর মহাশক্তি কোমর বাণ। এ ঝাড়ফুক লয়, জাদুমন্তর লয়—এ আছে জড়িবুটির কারবার। দ্রব্যগুণ। ডান পুকুসে টান মেরে তোষক করে, পির পরিতে নজর দেয়, বাণ মোর এ—মাদুলি দেহে লিলে আসন পাবে দেহ। এ—তু কাঁহাসে লিবি আর কাঁহাসে দিবি।
গেরু কথাগুলো নেচে নেচে বলল—অনেকটা বাপ কৈলাসের মতো। কৈলাস যেমন করে কোর্ট—কাছারির ময়দানে একদা হেকিমি দানরির ব্যবসার সময় সকল মক্কেলদের তাবিজের গুণাগুণ ব্যাখ্যা করত, তেমনি গেরু আজ নেলিকে তাবিজের দ্রব্যগুণ ব্যাখ্যা করল।
নেলি এবার কাঁথা—কাপড় ছেড়ে উঠে বসল মাচানে। দু হাতের ওপর ভর করে বসল। চুলগুলো মুখের ওপর এসে পড়েছে। শরীরটা যেন ঝুঁকছে মাচারে বাইরে। যেন এখুনি টলে পড়বে শরীরটা। নেলি তবু বলল, হামারা কোনো জড়িবুটি লাগে না গেরু। লেকিন হামি মেয়েমানুষ লয় ত হাম ভি যেতরে মুর্দার কঙ্কাল তুলতে। চটানে ভুখা থেকে হামি নেহি মরগে। নেলি এ—সময় মুখটা ক্রমশ নিচের দিকে নুইয়ে দিচ্ছে।
তু ভুখা আছে নেলি! গেরু বল্লামটা নিচে রাখল। পাশাপাশি বসল সে। কিছুক্ষণ সে চুপ করে বসে থাকল। নেলিকে সে এ—চটানে আরও অনেকদিন ভুখা থাকতে দেখেছে, কিন্তু আজ যেন অন্যভাবে নেলির উপোসি শরীরটা দেখল। নেলি ভুখা আছে চটানে, এই ভেবে ওর খুব কষ্ট হতে থাকল। অথচ নেলিকে কিছু বলতে পারছে না এ—সময়ে। অন্য দিনের মতো নেলিকে জড়িয়ে ধরে কথা বলতে পারল না। কিংবা জড়িয়ে ধরতে ভয় হচ্ছে। সে সংশয়ের চোখে চারিদিকে একবার চেয়ে সহসা নেলির মুখটা তুলে ধরতেই দেখল, নেলি কাঁদছে! ভুখা থেকে নেলি আজ চটানে গেরুর সামনে কেঁদে দিল। —নেলি তু ভুখা আছে! পুনরাবৃত্তি করল গেরু। তারপর বল্লামটা তুলে চলে যাওয়ার সময় বলল হামার কাছে একটা পয়সা ভি নেই। থাকলে তুকে দিয়ে দিতাম। সাত সতের খেলে লখির কাছে সব পয়সা কটা হেরে গেছি।
গেরুর এসব কথা শুনে নেলি বিরক্তিতে ফেটে পড়ল। মনে মনে বলল, হেরে গেরু তু হামার বুঝি বাপ। তু পয়সা দিবি, সে পয়সায় হামি খেয়ে লিব! এই সব ভেবে নেলির নিজের মনেই সরম এল। গেরু ওর কে! গেরু ওর পাশে একটু বসতে পারল না! গেরু এ—সময় পয়সা নেই বলে, অথবা নেলি আরও কষ্টের কথা শুনাবে বলে চলে গেল! ছিঃ মরণ হামার? তু হামার কে! তু হামার বাপ আছে না বেটা আছে। তু হামার কোন আছে, তুর কাছে কেন্দে ভিখ লিব!
নেলি ফের শুয়ে পড়ল। এই ঘরে শুয়ে পুরোনো অশ্বত্থ ডালে কাকের শব্দ পেল। সে বুঝতে পারছে চোখ বুজে—সন্ধ্যা হতে দেরি নেই। এই সময়ে সব কাকেরা এই পুরোনো অশ্বত্থে ফিরে আসে। সে চোখ না খুলে বসুন্ধরার সব সুখ দুঃখকে বোঝবার চেষ্টা করল। তখন এল গেরু। সন্তর্পণে ফিরে এল। মরদের মতো সে ওর পাশে দাঁড়াল। বলল, দু—চারমাস তু সবুর কর। ফরাসডাঙার কায়দা—কানুন শিখেলি, তারপর তু আর হামি অন্য চটানে উঠে যাব। হয় কাটোয়ায় লয়তো নবাবগঞ্জে। তু আর তখন ভুখা থাকবিনে।