চটানে আবার ভোর হল। আবার রাত্রি হল। দিন রাত্রি যেতে মাস গেল। শীত এল, শীত গেল। গ্রীষ্ম এল। ঘাটোয়ারিবাবু চেয়ারটায় বসে রামায়ণ পড়তে পড়তে গরমে ছটফট করেন।
ঘন বৃষ্টি হয়েছিল যেমন দুদিন, আবার ঘন রোদ তেমনি দু—সপ্তাহ। দুপুরের দিকে আবার সেই গরম হাওয়াটাই উঠেছে। শিমুল গাছের নতুন পাতাগুলো পুরনো হচ্ছে। এখন একটা পাখি পর্যন্ত চোখে পড়ছে না। এই ঘন রোদে কিছু লোক বাবলার বনে কাঠ কাটছে। নদী থেকে শেষ লোকটা স্নান করে উঠে গেল। দুজন লোক একটা লোককে আমকাঠে পুড়িয়ে শেষ বারের মতো ‘হরিবোল’ দিল। ঘাটোয়ারিবাবু জানালায় বসে সব দেখেন। জানালার একটা কপাট খোলা। ভিতর দিকের দরজা বন্ধ। অন্য জানালাটাও বন্ধ। গরম হাওয়াটা ঘরের ভিতর বেশি ঢুকতে পারছে না। গরম হাওয়াটা দরজায় কিংবা জানালায় আছড়ে পড়ে থমকে থাকছে। বাতাসের শব্দটা বিরক্ত করে মারে বাবুকে। তখন চটানের মেয়ে—মরদদের বলতে শোনেন, গেরুর ছেলে হল।
গেরুর ছেলে হওয়ার কথা শুনেই কেন জানি ঘাটোয়ারিবাবুর একটা পাখি দেখার শখ হল। এই ঘন রোদে পাখিরা উড়ছে না। ওরা কোথায় গেল জানার শখ হল। তিনি দরজা খুলে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। দরজা বন্ধ করে শেকল তুলে দেন। তারপর ধীরে ধীরে পাখি দেখার জন্য চটান পার হয়ে অশ্বত্থ গাছটার নিচে এসে দাঁড়ান। এখানে শুধু কাক। ওরা অধিকাংশ ডালে ডালে বসে আছে। মাত্র একটি কাক উড়ে উড়ে চিৎকার করছে।
তিনি অন্য পাখি দেখার ইচ্ছায় ক্রমশ অশ্বত্থ গাছ পেরিয়ে সরু একটা পথে নামলেন। রোদটা ঠিক কপালে এসে নামছে। সেই পথ ধরে যাওয়ায় কয়েকটা বুলবুল পাখি একটা ইষ্টিকুটুম পাখি ও গোটাদুই শালিক দেখতে পেলেন। তিনি এখানেও থামলেন না। পথটা ধরে ক্রমশ দক্ষিণ দিকে আন্দাজ এক ক্রোশ পথ হবে, হেঁটে একটা আমকাঁঠালের বাগানে এসে বসেন। এখানে সব রকমের পাখিরা যেন বাস করে, এমন একটা ধারণা হল ঘাটোয়ারিবাবুর।
তিনি স্মৃতির ঘরে অনেকক্ষণ হেঁটে মনে করতে পারছেন না—একটা চালাঘর, কিছু কাঠ, কিছু মেয়ে—মরদ ভিন্ন তাঁর অন্য অস্তিত্ব আছে। তিনি ঘাসের ওপর বসে সেই স্মৃতিকে বারবার ঠেলে দিয়ে এই পৃথিবীকে দেখার জন্য চোখ খুললেন। আর সঙ্গে সঙ্গে মনে হল এটা যেন দুঃখবাবুর সংসার। কিছু ছেলে, কিছু মেয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটছে। কিছু পাখি দোল খাচ্ছে। খঞ্জনা পাখিরা ঘাসের ওপর শুয়ে শরীরের উত্তাপ কচি ঘাসে মিশিয়ে দিচ্ছে। ছেলেমেয়েরা কোঁচড়ে ভরে বাতাসে—ঝরা আম তুলে নিচ্ছে। হাওয়া, পাখি, ফুল, ফল ফুটফুটে ছেলের দল ঘাটোয়ারিবাবুকে বসতে দিল না। তিনি নিজেও কেমন যেন ওদের মতো ছোট হয়ে গেছেন। ধরণির এইসব বিচিত্র কচি কচি উপাদানগুলো যেন বলছে, তুমি আনন্দ কর, আনন্দ কর। তুমি ফুল ফোটাও। তুমি কঠিন হয়ে থেক না। তুমি পাষাণ হয়ে বেঁচ না। তিনি সেজন্য আজ ছুটতে চাইলেন। ছেলেমেয়েদের কোঁচড়ে কোঁচড়ে আম তুলে দিলেন। আর সকল পাখিদের ডেকে বলেন আমি আসব, আবার চলে আসব।
শেষে ঘাটোয়ারিবাবু দেখেন সন্ধ্যা হচ্ছে। সূর্য পাটে বসেছে। গাছে গাছে তার শেষ আলো। নিজেকে বিলিয়ে নিজেকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। ছেলের দল, মেয়ের দল, এক দুই করে চলে যেতে থাকে। এক দুই করে পাখিরা কোনো আঁধারের আশ্রয়ে যেন হারিয়ে যেতে থাকে। নদীর পার ধরে ঘরে ফেরে এই ধরণির সব সুখী লোকেরা। দুঃখবাবুও হয়তো চটান ছেড়ে ঘরে চলেছেন। দুঃখবাবুর সাজানো সংসারের কথা জেনে আজ কেন জানি মনে হচ্ছে যদি তিনি গাছ, অথবা ফুল কী পাখি হয়ে বাঁচতে পারতেন। আর মনে হল ফুলের ভিতর সৌরভ আছে। সেই সৌরভ তার কানে কানে বলে গেল, ঘাটোয়ারিবাবু ফুল ফোটাও—ফুল ফোটাও। ঘাটোয়ারিবাবু, সুখ মেয়েতে—মদে নয়, রামায়ণ—মহাভারতেও নয়, সুখ সৌরভ ফুলের ভিতরে। ফুল ফোটার ভিতরে। তিনি এই প্রথম উপলব্ধি করলেন জীবন মৃত্যুর চেয়ে বড়। মৃত্যুকে উপেক্ষা করার জন্য তিনি শেষবারের মতো জীবনে ফুল ফোটাতে চাইলেন। তিনি গাছ—ফুল—পাখি হতে চাইলেন। কিন্তু হায় তখন তাঁর পারের কড়ি জমা পড়ে গেছে। তিনি গাছ, ফুল অথবা পাখি হতে পারলেন না। তিনি শুধু বসে বসে নিঃশেষে কাঁদলেন।