নিশ্চয় আনব। নিশ্চয়।
আপনার স্ত্রী আছে, বাবা মা আছেন, ভাবতে বড় ভালো লাগে। স্ত্রী স্বামীকে কত ভালোবাসে তা জানার সৌভাগ্য আমার হয়নি। তবু বুড়ো বয়সে—বলতে লজ্জা কি—রসকলিকে দিয়ে সে স্বাদ এককালে মেটাবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু কথা কী জানেন, দুধের স্বাদ ঘোলে মেটে না মশাই, মেটে না। কোনো স্বাদ নেই। কোনো স্বাদ নেই। তিনি চোখ খুলেও খুলতে পারছেন না। সামান্য সুখটা আর একটু থাক—এই তাঁর ইচ্ছা।
এক নতুন ইচ্ছায় ঘাটোয়ারিবাবু ডুবে যাচ্ছেন। জীবনের অনেকগুলো ক্ষুদ্র অনুভূতি অন্য এক মনোরম ধরিত্রীর অনুসন্ধানে ওঁকে উদগ্র করে তুলল। চোখ বুজেই তিনি সেই সুখকে ধরতে পারলেন। দুঃখবাবু যেন ছোট ফুল দিয়ে সংসার সাজাচ্ছেন। হরীতকীর বাচ্চা হয়েছে। নেলিরও বাচ্চা হবে। ওরা ওদের ঘর নিয়ে বাঁচল। ওরা ওদের সুখ নিয়ে বাঁচল। শুধু এই ঘাটবাবু কড়ির হিসাবের মতো মৃত্যুর হিসাব রাখছেন। এই সব ভেবে ভেবে গভীর জলধিতে ডুবে গেলেন তিনি। শুধু আঁধার—আঁধার। জীবনের কোনো চিহ্ন দেখতে পাচ্ছেন না। তিনি চোখ বুজেই চেয়ারের হাতল দুটো জোরে চেপে ধরলেন। তিনি মৃত্যুর বীভৎসতায় শিউরে উঠলেন।
সহসা চোখ খুলে চেয়ারের হাতল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। ইতস্তত কিছুক্ষণ পায়চারি করে দুঃখবাবুর মুখের ওপর ঝুঁকে পড়লেন। বললেন, ভোরে যখন আসেন গিন্নি কিছু বলে না? বলে না, ঘাটের চাকরি ছেড়ে দাও? বলে না, অন্য চাকরি দেখ?
ওসব বলে না, তবে বলে, তাড়াতাড়ি ফিরে এসো। আমি ফিরে গেলে তবে ওর সব কাজ শেষ হবে। ফিরে গেলে নাইবার জল দেবে। সে জলে আমি স্নান করব। আমি খেতে বসব। ছেলেমেয়ে দুটো কোত্থেকে এসে জুটবে। যতই খাক, আমার সঙ্গে না খেলে ওদের পেট ভরবে না। ও আমাকে খাইয়ে দিয়ে দিবা নিদ্রার ব্যবস্থা করে তবে নিজে স্নান করবে। খাবে।
খুব ভালো মেয়ে।
হ্যাঁ, তুলনা হয় না।
স্ত্রী, পুত্র, পরিবার নিয়ে তবে সুখেই আছেন।
তা মোটামুটি আছি। সুখে—দুঃখে চলে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে টাকা—পয়সার জন্য খুব বিব্রত বোধ করি। অভাব অনটনের সংসার। বুঝতেই ত পাচ্ছেন।
তা হলে বলছেন দুঃখও আছে।
তা আছে।
তিনি বুঝলেন নিরবচ্ছিন্ন সুখ অথবা নিরবচ্ছিন্ন দুঃখ মানুষের থাকতে নেই। তিনি বুঝলেন এই সুখ দুঃখের জন্যই দুঃখবাবুর সংসার—সংসার হয়েছে। একটু সুখ দুঃখের জন্যই দুঃখবাবু এমন সুখের কথা বলতে পারছেন। এই সুখ—দুঃখ না থাকলে তিনিও যেন বলতেন, আর ভালো লাগে না মশাই, সংসারের ওপর বীতরাগ হয়ে পড়েছি।
রোদের তাপ বাড়ছে। বেলা বাড়ছে। শ্মশানের আগুনটা দাউ—দাউ করে জ্বলছে। ওরা দুজনেই আগুনটা দেখে চুপ করে থাকলেন কিছুক্ষণ। রোদের উত্তাপে আগুনটা খুব নিষ্প্রভ মনে হচ্ছে। ঘাট থেকে উঠে আসছে নেলি। ওর কাজ হয়ে গেল বলে উঠে এল। কিন্তু ওরা দেখল একটি ডোমের মেয়ে ওকে উঠে আসতে সাহায্য করছে। হরীতকী ছুটে চটান থেকে নামল। শনিয়া সকলকে বলছে চটানের—নেলির বাচ্চা হবে।
দুঃখবাবু জানালায় দাঁড়ালেন। তিনি জানালা থেকে শনিয়ার কথা শুনতে পাচ্ছেন। তিনি আড়াল থেকে নেলিকে উঠে আসতে দেখছেন। নেলির দীর্ঘ শরীরটা ব্যথায়, বেদনায় নুয়ে পড়েছে। চুলগুলো কপালে, মুখে ছড়িয়ে আছে। হরীতকী নেলিকে দাঁড় করিয়ে খোঁপা বেঁধে দিল। হরীতকী কপাল থেকে চুলগুলোকে সরিয়ে দিল, নেলির কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। চোখ দুটো কোমল, সাদা—সাদা, ধীর। ওর চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। শরীরের অসহ্য যন্ত্রণা ওকে সুখ এবং দুঃখ দুই—ই দিচ্ছে যেন। জানালার কাছে এসে নেলি চোখ তুলে দুঃখবাবুকে দেখল। চোখ নামাল। নেলি যেন বলছে, হামার ভগমান আসছে বাবু। হামি হামার মাচানে ভগমানকে নামাতে যাচ্ছি।
বড় করুণ! বড় করুণ! দুঃখবাবু জানালায় মুখ রেখে ফের উচ্চারণ করলেন। জানালা থেকেই দেখতে পাচ্ছেন—অরুণবাবু এই রোদের উত্তাপে বসে নিজের বাচ্চাটাকে ভস্ম হতে দেখছেন। তিনি তাঁর একমাত্র পুত্রকে আগুনের জঠরে ঠেলে দিলেন। শ্মশানের শেষ ধোঁয়ার সিঁড়ি উপরে উঠে যাচ্ছে। ওর একমাত্র আত্মা স্বর্গের সিঁড়ি তৈরি করছে। নেলি এই পথ ধরে উঠে গেল। সে তার ভগবানকে মাচানে নামাতে যাচ্ছে। দুটো মোষ নেমে গেল গঙ্গায়। ওরা লড়াই করতে নেমে গেল। একটা লোক নানারকমের খেলনা শরীরে ঝুলিয়ে বিক্রির আশায় উঠে যাচ্ছে। সে শিবমন্দিরের পথ থেকেই নাচতে আরম্ভ করল, বলতে আরম্ভ করল, লে যানা বাবু। সাড়ে ছ আনা। দেখে শুনে মন দেওয়ানা। আহা মন দেওয়ানা। দেওয়ানা।
চটানে নেলির গোঙানি। গোঙানি থামছে, না। অহরহ সেই আওয়াজ দুঃখবাবুকে বিব্রত করছে। নেলির বুঝি খুব কষ্ট। জানালায় দাঁড়িয়ে নেলির কষ্ট তিনি বুঝি ধরতে পারছেন। এখন এই জানালায় দাঁড়াতে ইচ্ছা হচ্ছে না। চটানে নামার ইচ্ছা। নেলির মাচানে বসার ইচ্ছা। একটু আদর করার ইচ্ছা। কিংবা তিনি যেন ওকে সাহস দিতে চাইছেন। কিন্তু দুঃখবাবু নড়তে পারছেন না। নেলি মাচানে পড়ে পড়ে কাঁদছে—আর তিনি নড়তে পারছেন না।
হরীতকী জল গরম করছে ঘরে।
মংলি নিজের ঘরে বসে শাপ—শাপান্ত করছে। চটানে এত বিটির পেটে বাচ্চা আসছে, ওর পেট কেবল খালিই যাচ্ছে। দুখিয়ার সঙ্গে ঘর করতে এসে কত বছর ঘুরে গেল। চটানে কত লোক এল গেল। অথচ ওর পেটে একটা বাচ্চা এল না। চোখখাগী ডাকঠাকুর। নিজের গতরটা দেখল—নিজেকে, দুখিয়াকে শেষে চটানের সকল মেয়ে—মরদকে শাপ—শাপান্ত করল।