গেরু চাল থেকে নামার আগেই ঝড় উঠেছে। উত্তর—পশ্চিম কোণের মেঘটা সারা আকাশে ছড়িয়ে পড়ল। গঙ্গার বালিয়াড়ি থেকে অজস্র বালির ঝড় উপরে উঠে আসছে। নেলি এই ঝড়ের ভেতরেই কয়েকটা পোড়া কাঠ ঘরে নিয়ে তুলল। শুয়োরের বাচ্চা দুটো এখন বড় হয়েছে। ওদের ডেকে সাড়া পেল না সে। কবুতরগুলো ঝড়ের ভিতর কোথায় হারিয়ে গেছে যেন। সে গঙ্গা—যমুনাকে ডাকল—কিন্তু কেউ সাড়া দিল না। বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি নামছে। বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটায় চটানের কঠিন মাটি ভিজতে থাকে। তারপর এক দুই করে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি পড়ে। বৃষ্টির ধারা নেমেছে। বৃষ্টির জলে মা—বসুন্ধরা ঠান্ডা হচ্ছে।
শরীরের গুমোট ভাবটা কাটাবার জন্য নেলি উঠোনের বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে ভিজল। মা—বসুন্ধরার মতো বৃষ্টির জলে সেও ঠান্ডা হচ্ছে। নেলি দেখল, বৃষ্টির ভিতর দু—একটা কাক উড়ে যাচ্ছে। দুটো শালিক বৃষ্টির জলে স্নান করছে। বিচিত্র শব্দ উঠছে আশেপাশে। ব্যাঙ ডাকছে। কচুর ঝোপে বৃষ্টি পড়ার টুপটাপ শব্দ। এই সব দেখে নেলিও ব্যাঙের মতো বৃষ্টির জলে লাফাল, নাচল। আনন্দে ছুটে ছুটে বেড়াল। পোড়া মাটিতে প্রথম বৃষ্টি পড়ার গন্ধ নেলিকে সব রাগ অভিমান ভুলিয়ে দিল। সে চিৎকার করে উঠোন থেকে বলছে, শনিয়া গতরে পানি ঢেলে লে। পানিতে ভিজে পোড়া শরীর ঠান্ডা করে লে!
মংলি নিজের দাওয়ায় বসে বলল, মাগির ঢং দেখ।
দুখিয়া এখনও ফেরেনি। কাটোয়ার লোকটা ঘরে বসে তখন মংলিকে ডাকছে। ভিতরে যেতে বলছে। মংলি যেন নেলির জন্যেই ঘরের ভিতর গিয়ে বসতে পারছে না। উঠোনে দাঁড়িয়ে জলে ভিজছে আর মংলির ইতর ইচ্ছার সাক্ষী থাকার চেষ্টা করছে।—ওলো মাগি তু মরবি—তু মরবি। তু ফুলে ফেঁপে মরবি। মংলি দাওয়ায় বসে যেন শাপ—শাপান্তর করল নেলিকে।
হরীতকী ঘর থেকে ডাকছে, নেলি তু আচ্ছা কাজ করে লিচ্ছিস না। দিনকাল বহুত খারাপ যাচ্ছে। জলে ভিজে তবিয়ত খারাপ হবে। ঘরে যা, ঘরে যা।
নেলির তখন মনে পড়ল বাপের কথা। ওর ভগবানের কথা—ভগবান যে ওর পেটে। সে তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে গেল। কাপড় ছাড়ল। শুয়োরের বাচ্চা দুটো জলে ভিজে ঘরে ঢুকছে। কবুতরের বাচ্চাগুলো টঙ—এর ভিতর এসে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। বৃষ্টি তেমনি জোর হচ্ছে। বেলা থাকতে চটানে রাত নেমে গেল। উঠোনের জল নালা—নর্দমায় নামছে। ঘাটোয়ারিবাবুর জানালা বন্ধ। দুঃখবাবু চটানে নেই। নেলি কুপিটা ধরাল। কুপির আলো দেখে শুয়োরের বাচ্চা দুটো ওর পাশে এসে বসল। নেলি আদর করল ওদের। গঙ্গা—যমুনা পাশে না থাকায় যে নিঃসঙ্গতা বোধ ছিল, ওরা পাশে এসে বসায় সে অভাব বোধটুকু কেটে গেল নেলির। বাইরে জল পড়ার শব্দ হচ্ছে—টিপটাপ—টুপটাপ।
ভোর রাতের দিকেই আজকাল যা একটু ঘুম হয় ঘাটোয়ারিবাবুর। সারা রাত তিনি গরমে ছটফট করেন। শেষরাতের দিকে ঠান্ডা পড়লে শতরঞ্জটা পেতে শুয়ে পড়েন। এবং সঙ্গে সঙ্গে ঘুমটা চলে আসে তখন। তারপর ভোরে ঘুমটা ভেঙে গেলে তুড়ি দেন এবং হাই তোলেন। বলেন পরম ব্রহ্ম নারায়ণ। তোমারই ইচ্ছা ঠাকুর। এই সব বলে শরীরের সব জড়তা ভেঙে উঠে পড়েন।
কাউন্টারে একটা মুখ ভেসে উঠল। মুখটা উঁকি দিয়ে বলছে, একটু এদিকে আসবেন?
ঘাটোয়ারিবাবু শতরঞ্জতে বসে দুটো স্তোত্র পাঠ করলেন। কাউন্টারের কথা তিনি ইচ্ছা করেই শুনলেন না। এখন তিনি স্তোত্র পাঠ করবেন। হাতমুখ ধোবেন। গঙ্গায় স্নান করবেন। এখন অনেক কাজ। তিনি জোরে জোরে মন্ত্র উচ্চারণ করতে থাকলেন।
কাউন্টার থেকে আবার গলাটা ভেসে এল।
তিনি যথারীতি দাঁড়ালেন—যথারীতি দড়ি থেকে গামছা টেনে দরজা খোলার সময় বললেন—একটু বসতে হবে। স্নানটা সেরে আসি। মড়া নিয়ে যখন তখন এলেই ত চলবে না! ঘাটে গিয়ে বসুন। হনহন করে তিনি শিবমন্দিরের পথ ধরে গঙ্গায় নেমে গেলেন।
কাউন্টারে লোকটা পায়চারি করতে থাকল। রাগে—দুঃখে তার ইচ্ছা হল ঘাটোয়ারিবাবুর গলা টিপে ধরতে। মৃত্যুর জন্য মানুষটার এতটুকু দুঃখ নেই। এতটুকু সহানুভূতি নেই। চামার যেন। লোকটা মৃত্যুর খবর শুনে একবার চমকাল না। একবার আহা পর্যন্ত করল না। মৃত্যুর জন্য কোনো কষ্ট নেই, মৃত্যুর জন্য যেন লোকটা হাঁ করে বসে থাকে। যেন এই মৃত্যুই স্বাভাবিক, বেঁচে থাকা অস্বাভাবিক। বেঁচে থাকার কোনো দাম নেই, শুধু দাম আছে জন্ম এবং মৃত্যুর। ভিতরের এই এত কাণ্ড সব যেন ওর কাছে জন্ম—মৃত্যুর বিকার। ওর মুখটা দেখে লোকটা পায়চারি করতে করতে এই সব ভাবল।
ঘাটোয়ারিবাবু নদীতে নামার সময় দেখলেন দশ—বারো বছরের একটি হৃষ্টপুষ্ট ছেলেকে দুজন লোক কাঁধে করে ঘাটে নামাচ্ছে। বাপ পিছনে। তিনি বুক চাপড়ে কাঁদছেন। কাউন্টারে তবে এই মড়ার লোকটাই ওকে এতক্ষণ জ্বালাচ্ছিল। ঘাটোয়ারিবাবু একবার দেখে আর দেখলেন না। ঘাটের অন্য লোকগুলো স্নান সেরে দূরে দাঁড়াল। তারা বলল—আহা কী সর্বনাশ! এই ধরনের সব শোক প্রকাশ করল। ঘাটবাবু দাঁড়ালেন না। তিনি নেমে যাচ্ছেন। তিনি এই ধরনের কোনো শোকই প্রকাশ করলেন না। তিনি শুধু বললেন, হরিবোল। হরিবোল। যারা শোক প্রকাশ করছিল তারা উপরে উঠেই বচসা আরম্ভ করে দিল। কে ছুঁয়ে কাকে অস্পৃশ্য করল সেই নিয়ে বচসা।
ঘাটোয়ারিবাবু ডুব দেবার আগে কানে আঙুল দিলেন। গঙ্গার জলে শান্তি আছে কোথাও। সহস্র ডুব দিয়ে তিনি যেন তাই প্রত্যক্ষ করতে চাইছেন।