হাঁড়িটা বেশ বড়। গঙ্গা থেকে কৈলাসের বৌ হাঁড়িটা ধুয়ে এনেছে। ওরা কয়েকজন মিলে শুয়োরটাকে এখন পাতার ওপর রেখেছে। শুয়োরটার শরীরে পোড়া ঘায়ের মতো রঙ। কৈলাসের বৌ হাঁড়িটা শুয়োরের পাশে রাখল। গোমানি শুয়োরের পেট চিরল। লাশকাটা ঘরে ছুরি চালিয়ে হাত ওর পাকা। ছুরির প্যাঁচে পেটটাকে দু ভাগ করল। অদ্ভুত কায়দায় ভিতর থেকে সব ময়লাগুলো তুলে নিল গোমানি। তারপর হাত ঢুকিয়ে পেটের ভিতর থেকে কাদার মতো জমাটবাঁধা রক্ত মালসা মালসা তুলে আনল এবং হাঁড়িতে রাখল। কৈলাসের বৌর দুটো লোভী চোখ, হাঁড়ির ঢাকনা খুলে দেখছে। দুখিয়া মংলি পরস্পর তাকিয়ে চোখ টান করল। হরীতকী দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে। বাচ্চাটা এখন কাঁদছে না, নীল হচ্ছে না। সে এ—শরীর নিয়ে জিয়াগঞ্জ যেতে পারবে না ভেবে দুঃখ পাচ্ছে। এমন একটা খানাপিনা থেকে বাদ গেল সে। এমন একটা মাইফেলে সে থাকতে পারল না। ওর চোখে সে আপশোশ ধরা পড়েছে।
চর্বিগুলো গোমানি ভাগ করে রাখল। মাংসগুলো কেটে কেটে কলাপাতার স্তূপ করল। শুয়োরটার গায়ে মাংসের চর্বি বেশি। শুয়োরটা বড় জবরদস্ত, শুয়োরের মতো শুয়োর বটে। কৈলাস দাওয়ায় বসে এমন সব কথা বলছে। এখন কৈলাসের মুখে ও মনে বেশ একটা আমিরী চাল। রাজা—বাদশার মতো বসে ওজর বানাচ্ছে। আদেশ দিচ্ছে চটানের সকলের কাছে। সে হুজুর বনে গেছে। সকলে এসে ওর পাশে দাঁড়িয়েছে—কী করতে হবে, কোথায় যেতে হবে হুকুম নিচ্ছে। সে গেরুকে বাজারে পাঠাল। লখি, টুনুয়াকে নদীর ওপারে। ঝাড়োকে জিয়াগঞ্জ থেকে কাটোয়া পর্যন্ত গঙ্গার ধারে ধারে যত চটান আছে—সেখানে। ঢুঁড়ে ঢুঁড়ে বেড়াচ্ছে। বলছে সকলকে, তুমরা যাবেক কিন্তুক বাপুরা। কৈলাসের পুষে বড় করা বাচ্চাটার শাদি। মেয়েরবানি করে তুমরা সব চলোগে। লয়তো কৈলাসের খুব দুঃখ হবে। তুমরা যাবেক সকলে। ঝাড়ো সকলকে দাওয়াত দেবার জন্য চটান ছেড়ে দুদিন আগে চলে গেছে।
আজ এই ভোরে, এই আমিরী ভাবটুকু কৈলাসকে খুব সুখ দিচ্ছে। সকলের সঙ্গে সে কথা বলল। আজ বৌটারও খুব সুখ। এত বড় একটা শুয়োর এ চটানে কোতল হল, সে ত ওরই বেটার জন্য। চটানের মানুষেরা এত বড় শুয়োর কোতল হতে দেখেছে চটানে—না আর দেখবে! সে ঘরে গেল তখন। কৈলাসের কানে কানে বলল, একটা মাইক লাগা না! বাবুদের বাড়ি গমগম করে উঠুক। বলুক, কৈলাস ডোমের বেটার শাদি। শহরের লোক যদি না জানল তবে শাদিতে কী সুখ!
কৈলাস ভাবল, তা বটে তা বটে। এক বেটার শাদি।
সে ডাকল দুখিয়াকে—দুখিয়ারে, অঃ দুখিয়া!
হা জী বলেহ।
তু একবার লখনবাবুর কাছে যা। ওয়াকে বলবি একটা মাইক লিতে হবে। একটা কলের গান ভি লিতে হবে। দশ রুপায়া কাল দে লিব। তু যা।
দুপুরে একটা চাঁদোয়া টাঙানো হল উঠোনে। একটা ঘট বসানো হল। চটানের সকল মেয়ে—মরদ মিলে নদী থেকে জল তুলে ঘটে একটু একটু জল ঢালল। মাইক বাজল উঠোনে। বাবুদের বাড়িমুখো মাইকটা বসানো হয়েছে। খাটালের গলিতে দুটো বড় কড়াইয়ে শুয়োরের গোস্ত জ্বাল হচ্ছে। বড় মাছের ঝোল হচ্ছে। বড় কড়াইয়ে দু কড়াই মিষ্টি আনিয়েছে কৈলাস। দুখিয়া রান্নার তদারক করছে। মাঝে মাঝে ঘাটোয়ারিবাবু অফিস থেকে নেমে আসছেন। হেঁটে হেঁটে সব দেখাশোনা করছেন এবং সকলকে তাড়া দিচ্ছেন—এবার রওনা হতে হয়।
নেলি উনুনটার পাশে বসে সব দেখল। বাপ ছুটোছুটি করে মরছে একবার রামকান্তের কাছে, একবার কলের গানের কাছে। লাশ—কাটা ঘরের দুজন লোক এসেছিল, বাপ এক ঘণ্টার ভিতর সে—কাজগুলো সেরে চলে এল। বাপের মুখের ঘাম জমেছে। এতদিন পর বাপ যেন একটা কাজের মতো কাজ পেল। কৈলাস ওকে দিয়ে পয়লা নম্বর কাজগুলো করাচ্ছে বলে—সে কৃতার্থ হচ্ছে। বড় অনুগত আজ গোমানি ডোম। বড় ভালোমানুষ আজ সে।
লখি—টুনুয়া নদীর পার থেকে ফিরছে। ওদের সঙ্গে আরও চারজন মরদ। ওদের কাঁধে বড় বড় ভাঁড়। ওরা পচাই নিয়ে ফিরছে।
ঘাটোয়ারিবাবু ফের অফিস থেকে নেমে এলেন। বললেন, কিরে তোদের এখনও হল না। জিয়াগঞ্জ পৌঁছতে দেখছি তোরা খুব রাত করবি।
ঘাটোয়ারিবাবুকে চটানে দেখে সকলে এসে জড়ো হল। ওরা খুব ভালো মানুষের মতো বাবুর কথা শুনল। তারপর সকলে সকলকে তাড়া দিল। বলল, জলদি, জলদি করো। আর দেরি চলবে না।
ঘরে ঘরে সকলে সাজল। মংলি দাওয়ার নিচে পানের পিক ফেলে আকাশি রঙের শাড়ি পরল এবং ভাবল যদি কাটোয়া থেকে লোকটা আসে, যদি মংলির সঙ্গে জিয়াগঞ্জে যায়! কাঠের বাক্স থেকে সে ভাঙা আরশি নিল। নিজের মুখ দেখল এবং পাশাপাশি অন্য মুখটা দেখারও ইচ্ছা। কপালে টিপ দিল কাগজের। চোখে কাজল, পায়ে রুপোর খাড়ু, হাতে রুপোর চুড়ি, নাকে পিতলের নথ পরল, চোখ টানটান করে সকলের সঙ্গে কথা বলছে। দুখিয়াকে ধমক দিচ্ছে। মংলির ধমক খেয়ে দুখিয়া ফেটি বাঁধল মাথায়, কাঁধে গামছা, গায়ে হাফশার্ট, হাতে লাঠি নিল। হাতে লাঠি নিয়ে দুখিয়া এ—ঘর সে—ঘর করতে থাকল। দুটো গোরুর গাড়ি ভাড়া করা হয়েছে। দুখিয়া গোস্ত, পচাই, মিষ্টি, মাছ—গোরুর গাড়িতে বোঝাই করছে। অন্য গোরুর গাড়িতে গেরু বসেছে টোপর মাথায় দিয়ে। চারপাশে বসেছে চটানের সব বাচ্চাকাচ্চার দল।
বেড়ার ফাঁকে নেলি দেখছে। হরীতকী তবু বাচ্চাটা কোলে নিয়ে বাইরে এসে দাঁড়াতে পারল। নেলি সেটুকু পর্যন্ত পারল না। লজ্জায়, দুঃখে সে চালাঘরটার একপাশে চুপচাপ বসে থাকল এবং বেড়ার ফাঁক দিয়ে গোরুর গাড়ির ওপর গেরুকে দেখে তার চোখ ফেটে জল বেরোতে লাগল। গেরু শাদি করতে যাচ্ছে। সে আজ থেকে শনিয়ার মরদ হবে। অন্য চটানে উঠে যাওয়ার জন্য অন্য কোনো মরদ থাকল না নেলির। সে এ চটানে বড় একা, বড় নিঃসঙ্গ। বাপ গোমানি পর্যন্ত চুল পাট করেছে, তেল মেখে গোঁফ মোটা করেছে। শক্ত করেছে। বাপ গোমানিকে বড় খুবসুরত লাগছে। গেরুকে আজ বাবুমানুষের মতো লাগছে। লতুন কাপড় পরনে, লতুন জামা গায়ে। মাথায় টোপর পরছে গেরু। সেও কেমন চুপচাপ, কেমন ভেঙে পড়েছে যেন। গেরুকে দেখে নেলির কষ্ট হতে থাকল। যেন ওর কিছু বলবার নেই। সে বাপ কৈলাসের হাতে বাঁধা। যেন তার নালিশ—নেলি তু না কাঁদিস। হামাকে তু ভুলে যা। আজ থেকে তুর গেরু মর গিল।