দরজা—জানালা খুলে দিলেও ভিতরের কষ্টটা যাচ্ছে না। তিনি টেবিল থেকে একটা গেলাস তুলে জল খেলেন। তারপর কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলেন। লম্বা সিল্কের শ্লিপিং গাউনের ফাঁকে শরীরের সবকিছু দেখা যাচ্ছে। পেটে তিনি এই বয়সেও চর্বি জমতে দেননি। খুব মিতাহারি। এবং শরীরের প্রতি অধিক যত্নের দরুন নকল দাঁত থাকলেও তাঁকে এখনও যুবা লাগে। খুব যুবা। তিনি অনায়াসে নিজেকে কমবয়সি বলে চালিয়ে যেতে পারেন। যৌবন ধরে রাখার কী প্রাণাক্তকর ইচ্ছা। এবার তিনি প্রথম কেমন নিরালম্ব মানুষের মতো শুয়ে পড়লেন। তিনি ছোট বয়সের কথা ভাবলেন। তাঁর ছোট বয়সে মা তাঁকে তাঁর আত্মীয়ের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি থাকবেন। পড়াশোনা করবেন। এবং বড় দুঃখের দিন—অনেক দূরে ছিল স্কুল। গ্রাম, মাঠ, কিছু ফলের বাগান পার হয়ে যেতে হত। টিফিনের পয়সা থাকত না। রাস্তায় শীতে অথবা বসন্তে পড়ত খিরাইর জমি, তিনি এবং অন্য সব ছেলেরা মিলে খিরাই চুরি করে স্কুলের টিফিন, অথবা বর্ষার দিনে ছিল শালুক আর শাপলা, গ্রীষ্মে নানারকম ফলপাকুড়—যেমন আম, জাম, জামরুল—এভাবে একটা সময় কেটে গেছে তাঁর। এখন কেন জানি মনে হয় বড় আরামের দিন ছিল সেগুলো। আত্মীয়াটি খুব নিগ্রহ করত তাঁকে। সে—সব এখন তাঁর মনেই হয় না। বরং কী যেন একটা জাঁতাকলে পড়ে সব সময় ভীতু মানুষের মতো মুখ করে রাখার স্বভাব এখন। ভালোভাবে হাসতে পর্যন্ত ভুলে গেছেন। মাঝে মাঝে ইচ্ছা হয় এ—থেকে নিষ্কৃতি পেতে। নিজেই একটা নিজের গোলকধাঁধা বানিয়ে এখন যে কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। সেই অভিমন্যুর মতো ভিতরে ঢোকার পথটা বুঝি কেবল জানা আছে। বাইরে বের হবার রাস্তা তাঁর জানা নেই।
তারপর গভীর রাতে ঘুম এলে তিনি একটা ভীষণ জড়বৎ মানুষের পৃথিবীতে কিছু অস্থির ছবি একের পর এক দেখে গেলেন। ছবিগুলো তাঁর চোখের ওপর লম্বা হাত—পা—ওয়ালা কঙ্কাল সদৃশ চেহারায় নাচছে। কেউ হয়তো হাত—পা বাড়িয়ে কোমর দুলিয়ে নাচছে। এবং সুন্দর এক মেয়ের চেহারা, সে এসেছে তাদের ভিতর নাচবে বলে। কেমন বায়ুহীন, অন্নহীন জগতে সে এসেছে দেবীর মতো। তারপর কী যে মোহে সেই সব লম্বা হাত—পা—ওয়ালা মানুষের ভিতর সে মিশে গেলে দেখতে পেল, ওরও হাত—পা ক্রমে লম্বা হয়ে যাচ্ছে। কেমন আগুনের ঝড়ো হাওয়ায় ওর সব মাংস খসে পড়ছে। এখানে এলে বুঝি কেউ সঠিক চেহারায় ফিরে যেতে পারবে না। সেও নাচছে কোমর দুলিয়ে, মাঝে মাঝে হাত এত বেশি লম্বা করে দিচ্ছে যে সে ইচ্ছা করলে আকাশের সব গ্রহ—নক্ষত্র পেড়ে আনতে পারে। এবং আকাশের সবকটা নক্ষত্র হেলেদুলে যেন একটা খেলা, ওরা বেশ সুন্দর মেয়ে হয়ে যাচ্ছে কখনও। এবং অন্নহীন, বায়ুহীন পৃথিবীতে ওরা আকাশের সব গ্রহ—নক্ষত্র ফুলের মতো পেড়ে পৃথিবীকে শ্রীহীন করে দিচ্ছে। তিনি তাঁর স্ত্রীর মুখও সহসা এদের ভিতর দেখে ফেললেন।
স্ত্রীর মুখ দেখতে পেয়েই মনে হল স্বপ্নটা কুৎসিত। তিনি আরও সুন্দর স্বপ্ন পছন্দ করেন। তবে কীভাবে যে সেই সুন্দর স্বপ্ন দেখা যায়! তাঁর ইচ্ছা হচ্ছিল—এই বাড়িটা আরও বড় হয়ে যাক। গেটে টুপি পরা দারোয়ান থাকুক। অনেক দাসদাসী, কর্মচারী। পঁচিশ—ত্রিশটা কারখানার মালিক তিনি হতে চান। আজ কলকাতা, কাল সান—ফ্রান্সিসকো এভাবে বিদেশিনীদের নিয়ে স্ট্যাচু অব লিবার্টির নীচে বসে থাকা। অথবা চোখের ওপর কেন যে সেই একশো আটতলা বাড়িটা ভেসে উঠছে না। অথচ স্বপ্নের ভিতর তিনি দেখলেন একটা কাচের বোয়েম। বোয়েমটা এক দুই করে অনেক তলা। এত ছোট বোয়েমে এক তলা থাকে কী করে! স্বপ্নের ভিতর গুনতে সময় লাগে না। সেই বোয়েমে তিনি বুঝতে পারলেন একশো আটতলাই আছে। এবং হাজার, দু’হাজার তারও বেশি হবে ফ্ল্যাট। লক্ষের ওপর মানুষের চিড়িয়াখানা। বোয়েমটা একটা দণ্ডের ওপর বসানো। কেমন কেবল চোখের ওপর ঘুরে ঘুরে যাচ্ছে। আর যা দেখা গেল আশ্চর্য! পৃথিবীটা এই একটা বোয়েমের ভেতর আশ্রয় নিয়েছে। এবং তিনি দেখতে পেলেন সেখানে পঞ্চানন দাসের স্ত্রী সুমতির গলায় দড়ি। এটা বোধহয় আত্মহত্যা। তিনি যেহেতু পঞ্চাননকে ডেকে চাকরি দিয়েছিলেন, যদিও এখন পঞ্চানন ইউনিয়ন করে লিডার বনে গেছে, তবু চাকরির সুবাদে তাকে তুই—তুকারি করতে বাঁধে না।
—এটা তোর বউ?
—আজ্ঞে স্যার।
—আত্মহত্যা?
—আজ্ঞে…!
—কেন?
—ঠিক জানি না স্যার। দুপুরের শিফটে খেয়ে কারখানায় গেছি—বউ সুন্দর করে রেঁধেবেড়ে খাইছে। কারখানায় খবর পেলাম যে গলায় দড়ি দিয়েছে।
—নিশ্চয়ই বকেছিলি।
—না স্যার। ইদানীং আমি ওকে কিছু বলতাম না।
—আগে বলতিস।
—আগে কথায় কথায় মারধোর করেছি। অভাব—অনটনে মাথা ঠিক থাকত না। তবে আমাদের খুব মিল ছিল।
—এখন।
—এখন তো আপনার দয়ায় সে—সবের কিছু নেই।
—তবে স্টে—ইন—স্ট্রাইক করেছিস কেন?
—হুকুম স্যার।
—কার হুকুম?
—ইউনিয়নের।
—কত মাইনেতে ঢুকেছিলি?
—ত্রিশ টাকা।
—এখন কত?
—তিনশ’ টাকা।
—ক’ বছরে?
—ছ’ বছরে?
—প্রডাকসান কত বেড়েছে?
—কিছু না।
—কতটা করতে পারিস ইচ্ছা করলে?
—তা দ্বিগুণ। মন দিয়ে কাজ করলে আমরা স্যার কী না করতে পারি?
—মন দিতে কুণ্ঠা কেন?
—যখন হয়ে যাচ্ছে, চলে যাচ্ছে।
—এভাবে বেশিদিন চলে না! আমি ক্লোজার করব।