মাসিমার মুখ ভীষণ ভার। জ্যামে তিনিও আটকে গিয়ে অসময়ে বাড়ি ফিরে এসেছেন। হাতের এতটা সময় কী কে করেন! মিঃ তরফদারের সঙ্গে তাঁর দেখা না হওয়ায় তাঁর খুব খারাপ লাগছে। এবং তখন যেন হাসতে হাসতে বলা—শুনছ, টুকুন ইন্দ্রকে গাছতলায় বসিয়ে গাড়ি নিয়ে হাওয়া খেতে গেছে।
—ভালো করেছে।
মেজাজ ভালো না থাকার ব্যাপারটা মজুমদার সাব বেশ ধরতে পেরে মনে মনে হাসছিলেন।
এবং ঠিক পরে পরেই ইন্দ্র এসে যখন বলল—মাসিমা টুকুন ফেরেনি! কেমন হুঁশ ফেরার মতো তিনি ঘড়ি দেখলেন—মেয়েটার জন্য কেমন প্রাণ কেঁদে উঠল। আর সঙ্গে সঙ্গে হুঙ্কার—তুমি কী। মজুমদার সাবকে ভীষণ গালাগাল—তুমি এতবড় নিষ্ঠুর। আমার একটা মাত্র মেয়ে তাও তুমি এমনভাবে চুপচাপ আছো।
—আরে ঠিক চলে আসবে। মনে হয় সুবলের কাছে গেছে।
—সেই পাখিয়ালাটা! ছিঃ ছিঃ। তুমি এখনও চুপচাপ বসে আছ? ইন্দ্র, তুমি পরিমলকে ধরো তো।
—আরে করছ কী! পুলিশ কমিশনার—টমিশনার আবার ডাকছ কেন? আমি তো আন্দাজে বললাম।
টুকুনের মা ঘড়ি দেখছে কেবল। নটা বেজে গেছে। সুবলের কাছে গেছে কী, যায়নি, কেউ তো ঠিক জানে না, হয়তো মীনাদের বাড়ি গেছে, মীনার কথা মনে হতেই জোনার কথাও মনে হল। যা খামখেয়ালি মেয়ে। টুকুনের মা সব ওর বান্ধবীদের এক এক করে যখন ফোন শেষ করে উঠবে তখন সবার চোখে অন্ধকার। এবার বোধ হয় পুলিশ কমিশনার—টমিশনার দরকার আছে। কিন্তু এতবড় বাড়ির একটা ব্যাপার, স্ক্যান্ডাল হতে কতক্ষণ—আরও কিছু সময় দেখা দরকার। হয়তো কিছুই হয়নি। পুলিশে ছুঁলেই আঠারো ঘা। সুতরাং ইন্দ্র, মজুমদার সাব, টুকুনের মা এবং মজুমদার সাবের পার্সোনেল সেক্রেটারি চুপচাপ কী করা যায় ভাবছিলেন—তখন মনে হল কেউ বলতে বলতে আসছে—টুকুনদিদিমণি আসছে।
ওরাও দেখল টুকুনদিদিমণি আসছে। ভীষণ সজীব। পেছনে ধীর পায়ে আসছে সুবল। কত লম্বা দেখাচ্ছে ওকে। খুব হাসিখুশি। বাড়ির ভিতর যে একটা ব্যাপার ঘটবে সুবল যেন বুঝতে পেরেছে। তবু সে এতটুকু আমল না দিয়ে বলল—টুকুনদিদিমণি একাই ফিরতে চেয়েছিল, এতটা রাস্তা একা আসবে—ঠিক সাহস পেলাম না।
মজুমদার সাব খুব সংযত গলায় বললেন—এভাবে টুকুন তোমার যাওয়া উচিত হয়নি। আমরা খুব ভাবছিলাম।
ইন্দ্র বলল—আর একটু হলেই পরিমল মামাকে ফোন করব ভেবেছিলাম।
টুকুনের মা বলল—তুমি আর বাড়ি থেকে কোথাও বের হবে না।
সুবল বলল—আমি যাচ্ছি টুকুনদিদিমণি।
মজুমদার সাব বললেন—না, বোস।
টুকুনের মা বলল—না, তুমি যাও সুবল। অনেক রাত হয়েছে।
সুবল বলল—সেই ভালো।
টুকুন বলল—একটু দেরি করে গেলে কিছু হবে না। এগারোটার লাস্ট ট্রেন পেয়ে যাবে। একটু কফি করে দাও মা।
মা যে কী জবাব দেবে ভেবে পেল না। মেয়েটা এত বেহায়া। ইন্দ্র বলল—এটাও একটা অসুখ।
টুকুন বলল—কী অসুখ!
—এই অসুখ!
মজুমদার সাব খুব বিব্রত বোধ করছেন। তিনি বললেন—তুমি আর এসো না সুবল। তোমাকে নিয়ে সংসারে খুব অশান্তি।
টুকুন ভাবল, সবাই তবে তোমরা শান্তিতে আছো! সুবল এলেই যত অশান্তি। ঠিক আছে। সে বলল—সুবল, আমি কাল যাব।
টুকুনের মা থ, মেয়ের এত সাহস! ছেলেটা তুকতাক করে একেবারে মাথাটা খেয়েছে। এবং সুবল যখন চলে গেল, তখন টুকুনের মা—র ভীষণ মাথা ধরেছে। কী যে হবে!
কবে একবার ওর বাবা একটা বেয়াড়া চাকরকে গুলি করে হত্যা করেছিলেন, এবং কুয়োতে ফেলে দিয়ে মাটি বুজিয়ে দিয়েছিলেন, কেন যে বাবা এমন করেছিলেন, সে জানত না। কেবল সে দেখেছে ঐ চাকরটার মৃত্যুর পর মা কেমন বিষণ্ণ হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি সব সময় জানলার ধারে দাঁড়িয়ে থাকতেন। এবং চোখ উদাস। এখন সে ব্যাপারটা বুঝতে পারে।
বুঝতে পারে বাবা বেশি বয়সে দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন। সে শেষ পক্ষের মেয়ে। বাবার সঙ্গে মা—র বয়সের তফাত কত যে বেশি ছিল, সে যেন সেটা এখনও অনুমান করতে পারে না। মা—র চোখ মুখ কী পবিত্র ছিল, মা বড় করে সিঁদুরের টিপ কপালে দিতেন। খুব মোটা করে আলতা পরতে ভালোবাসতেন, মা—র চোখে মুখে ছিল অসীম লাবণ্য। মা কখনও কঠিন কথা বলতে জানতেন না। ঝি—চাকরদের কাছে মা ছিলেন দেবীর মতো, অথচ বাবার সংশয় ভীষণ এবং এই সংশয় থেকে সংসারে ঝড় উঠেছিল।
এসব কথা মনে হলে মাথা ধরাটাও আরও বেড়ে যায়। টুকুনের জন্য তার এমন একটা কিছু মনে হয়েছে। এবং সে যেতে যেতে দেখল বড় বড় আয়নায় ওর প্রতিবিম্ব পড়ছে। সে নিজের মুখের দিকে নিজেই তাকাতে পারছে না। ভীষণ কুৎসিত দেখাচ্ছে মুখ। সমাজে সে মুখ দেখাবে কী করে! মিঃ তরফদার এ—নিয়ে বেশ রসিকতা করবেন। কান গরম হয়ে যাবে। পায়ের রক্ত মাথায় উঠে আসবে। সে তার শোবার ঘরের দিকে যেতে যেতে দেখতে পেল—দেয়ালের সব বড় বড় ছবি ওর দিকে তাকিয়ে যেন হাসছে। অথবা সব ছবিগুলো জীবন্ত হয়ে যাচ্ছে। এবং ওর পিছনে ছুটে আসছে। আর ঘড়িতে তখন সাড়ে দশ। রেল স্টেশনে গাড়ি ছাড়ার শব্দ। কেমন বেহুঁশের মতো সে তার ঘরের দিকে ছুটে গিয়ে আলোটা নিভিয়ে দিল। আর একটু বাদে এ—ঘরে সেই কাপুরুষ মানুষটা ঢুকবে। মুখে লাগানো তার নকল দাঁত। ওকে চেটেপুটে খাবার জন্য আসবে। সে এসে যাতে চেটেপুটে না খেতে পারে সেজন্য দরজা বন্ধ করে দিল।
দরজা বন্ধ দেখলে মানুষটা ফিরে যাবে এবং সারা রাত ছটফট করবে বিছানায়। ওর ঘুম আসবে না। সকাল হলে সে মানুষটার কাছে যা চাইবে ঠিক পেয়ে যাবে। সে জানে সারা দিন পর শরীর চেটেপুটে খেতে না দিলে মানুষটার কামনা—বাসনা মরে না। সে তার মেয়ে টুকুনকে সুস্থ করে তোলার জন্য আবার কী করা যায় ভেবে যা স্থির করল সে বড় নৃশংস। ভাবতেও ভয় হয়।
কুড়ি
আর তখন টুকুন দরজা—টরজা পার হয়ে নিজের ঘরে ঢুকে গেল।