—অশ্বিনীনগর স্টেশনে নেমে যেতে হয়।
—এত দূরে চলে গেলে কেন?
—খুব দূর না তো। শিয়ালদা থেকে বিশ মিনিট লাগে।
—তবে তো খুব কাছে।
—খুব কাছে। শুয়ে শুয়ে তোমার কথা বলতে ভালো লাগে টুকুন?
—না।
—তবে উঠে বসছ না কেন? এই দ্যাখো বলে সে বলল, তুমি রেডিয়োটা চালিয়ে দাও না।
—কী হবে?
—কারফিউ দিলে বলে দেবে।
—কারফিউ হলে যাবে কী করে?
—কিন্তু যাওয়া দরকার। আমি না গেলে বুড়ো মানুষটা ভয়ানক ভাববে।
—বুড়ো মানুষটা তোমাকে বুঝি খুব ভালোবাসে?
—ভালোবাসে না ছাই! কেবল কাজ। কাজ করো। কাজ করলে লোকটা সবাইকে ভালোবাসে। কাল আমাদের বনে যাবার কথা আছে।
—কী করবে গিয়ে?
—সব শুকনো পাতা জড়ো করব। তারপর যখন সন্ধ্যা হবে, সেইসব শুকনো পাতায় আগুন দেব।
—কী মজা।
—খুব মজা! শীতের সময় আগুন দিলে বুড়ো লোকটা বলেছে জীবজন্তুরা পর্যন্ত সব চলে আসে।
—ওরা আসে কেন?
—আগুন পোহাতে। একটু থেমে সুবল বলল, তুমি রেডিয়োটা খুলে দাও, আচ্ছা টুকুন, কেউ আবার চলে আসবে না তো? কত বড় ঘর তোমার। কেউ চলে এলে কী হবে?
—কেউ এলে কী হবে সুবল?
—আমাকে আসতে দেবে না। তোমার মা আমাকে যদি পুলিশে দেয়!
টুকুনের মুখটা সত্যি শুকিয়ে গেল। সে এটা ভাবেনি। না বলে না কয়ে পাঁচিল টপকে সে চলে এসেছে, পুলিশে দিয়ে দিলে যা হোক ওদের একটা কাজ মিলে যাবে।
সুবল বলল, আমি আর আসব না। আমি এতটা ভাবিনি।
টুকুন বলল, আমার পাশের ঘরটায় গীতামাসি থাকে। বিকেলের খাবার দিয়ে সে নীচে নেমে যায়। উঠে এলে টের পাব সুবল। কাঠের সিঁড়িতে শব্দ হবে।
—গীতামাসি তোমার দেখাশোনা করে?
—হ্যাঁ। ওকে, দ্যাখো, ঠিক হাত করে নিতে পারব।
—কিন্তু তোমার মাকে টুকুন?
টুকুন উঠে বসল। যেন একটা পরামর্শ না করলেই নয়। সে বলল, এদিকে এসো। সুবলকে নিয়ে ওর বাথরুমের দিকে চলে গেল। ওর দু—পাশে দুটো জলের কল। বড় বড় দুটো থাম। এবং কিছু জালালি কবুতর একসময় কার্নিশে ছাদের অলিন্দে বসবাস করত, তারা এখন কেউ নেই। টুকুনের অসুখ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওরা নাকি উড়ে গেছে। সুবলকে এসব দেখাল টুকুন, বলল সুবল, মা এলে আমরা টের পাব। তোমার কোনও ভয় নেই। পায়ের শব্দ আমি টের পাই। কোনটা গীতামাসির, কোনটা ডাক্তারবাবুর। সব আমি জানি। ওরা এলে তোমাকে আমি ঠিক লুকিয়ে ফেলব। সে দোতলার অলিন্দে নিয়ে গেল। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাল। সুবলের কাছে এটা প্রায় রাজার দেশ। টুকুন এক রাজকন্যার মতো। সে যেন এক রাখাল বালক। তার কাছে আছে মৃতসঞ্জীবনী সুধা। সুধা রসে মেয়েটা এখন নির্ভাবনায় হাঁটছে। সুবলের আছে এক ভালোবাসার জাদুমন্ত্র, অথবা সুবলকে নিয়ে হেঁটে এই যে ঘরের পর ঘর, নানাবর্ণের ছবি, এবং সব বিচিত্রবর্ণের কারুকাজ করা খাট—পালঙ্ক পার হয়ে যাচ্ছে—এ যেন তার কাছে ভারী মজার। যেন হাজার হাজার দৈত্য আসবে সুবলকে তুলে নিতে। টুকুনের কাছে আছে দৈত্যের প্রাণ। কোথায় ওরা দাঁড়িয়ে পাখিটার পাখা পা এবং গলা ছিঁড়বে তার যেন একটা পরামর্শ চলেছে।
এসব হলেই মেয়ের মনে হয় না তার কোনও অসুখ আছে। এসব হলেই মনে হয় পৃথিবীতে বেঁচে অনেক সুখ। এক অপার অভাববোধ এই বালকের জন্য। সংসারে ছেলেটি যত অপাঙক্তেয়, তত টুকুনের কাছে সে মহার্ঘ। টুকুন আনন্দে, কারণ যখন প্রায় সব ঠিক হয়ে গেল তখন আনন্দে প্রায় ছুটে ছুটে যাচ্ছিল। বলল সুবল তোমাকে এখানে আসার একটা সুন্দর রাস্তা দেখিয়ে দেব। তুমি ফুল বিক্রি করে রোজ এখানে আসবে। আমি কী সুন্দর ছোট্ট রাজপুত্রের গল্প পড়ে রেখেছি। তুমি আসবে বলে বসেছিলাম। তুমি না এলে কাকে আর আমার গল্প শোনাব।
কাঠের সিঁড়ির মুখের দরজাটা টুকুন বন্ধ করে দিল। কী বড় বড় শার্সির নীল রংয়ের দরজা। টুকুন অনায়াসে টেনে টেনে বন্ধ করে দিচ্ছে। সুবল ওকে দরজাটা বন্ধ করে দিতে সাহায্য করলে সে বলল, আমি পারব সুবল। বলে হাসল।
সুবল যেতে যেতে বলল, এটা কী?
—এটা পিয়ানো। বলেই টুকুন দুহাতে ঝম ঝম করে বাজাতে থাকল। কতদিন থেকে পিয়ানোটা কেউ বাজায় না। না, ইন্দ্র মাঝে দু’একদিন বাজিয়েছে। যখন টুকুন শুয়ে থাকে মা কখনও বাজান। লম্বা একটা খাতা পিয়ানোর ওপর। সুবল দেখল কেমন গোটা ঘরটা ঝম ঝম করে উঠছে। এবং ক’টা চড়াইপাখি ঝাড়—লণ্ঠনে বসেছিল, পিয়ানো বাজালে পাখিগুলো উড়ে উড়ে বাগানের ভিতর চলে গেল।
সুবল দেখছে—কী সুন্দর বাজাচ্ছে টুকুন। এমন একটা সুন্দর বাজনা পৃথিবীতে আছে তার যেন জানা ছিল না। চুলগুলো বব করা টুকুনের। বিনুনি বাঁধা নয়। হাতের আঙুলগুলো চাঁপা ফুলের মতো। পায়ে আলতা আছে বলে খুব সুন্দর লাগছে। এবং সে পাজামার মতো কোমল পোশাক পরে আছে, আর লম্বা, টুকুন প্রায় তার মতো লম্বা। সে বয়সানুপাতে লম্বা হয়ে যাচ্ছে। সে আয়নায় নিজের মুখ দেখতে পেল। কারণ বড় বড় দুটো আয়না, পৃথিবীতে এতবড় আয়না দিয়ে কী হয় সে জানে না। গোটা ঘরের প্রতিবিম্ব এখন এই আয়নার ভিতর। সে তন্ময় হয়ে টুকুনদিদিমণির পিয়ানো বাজনা শুনছে।
আর তখন কাঠের সিঁড়ির মুখে কারা উঠে আসছে যেন। ওরা দুজনে এত বেশি গভীরে ডুবে আছে যে কেউ টের পায়নি, অথবা শুনতে পাচ্ছে না সিঁড়ি দিয়ে বাড়ির সবাই ছুটে আসছে এদিকে। কারণ অসময়ে পিয়ানো বাজাচ্ছে কেউ, সে কে।