জনার্দন ধীরে ধীরে আরও নীচে নেমে এল। সে একনাগাড়ে হাঁটতে পারছিল না বলে কোথাও সামান্য সময় বসে বিশ্রাম নিচ্ছিল। জলের জন্য সে নেমে যাচ্ছে। খাদ্য অন্বেষণের জন্য সে নেমে যাচ্ছে। যেখানেই সে বসত—চারপাশে শুধু মৃত গাছের ডাল। হাওয়া দিলে মরমর শব্দ করে কিছু গাছপালা ভেঙে পড়ত। জনার্দনের ইচ্ছে যায় তখন, মৃত ডালে, গাছে গাছে এবং সর্বত্র আগুন ধরিয়ে দিলে কেমন হয়। মা সুবচনিকে পুড়িয়ে মারলে কেমন হয়। ভাবতে ভাবতে জনার্দন হা হা করে হেসে উঠল।
আবার জনার্দনের হাঁটা। দক্ষিণের মণি পাহাড়ে উঠে গেলে হয়তো এখন কিছু কাঁটাজাতীয় গাছ মিলতে পারে। কম জল হলে ওরা বেশি গজায়। পাথরের ফাটল থেকে রস চুষে ওরা বড় হয়। কিন্তু শরীর দুর্বল, মণি পাহাড়ে উঠে যাবার সাধ্য যেন একেবারেই নিঃশেষ হয়ে গেছে জনার্দনের। সে হেঁটে হেঁটে শেষ যে পাহাড়ের মাথায় রোজ উঠে পাথর নিক্ষেপ করত তার নীচে কিছুক্ষণ দাঁড়াল। জ্যোৎস্না রাত বলে পাহাড়ের শেষ দিকের অংশটুকু একেবারেই দেখা যাচ্ছে না। সে এবার সেই যোজকের নীচের অংশটুকুতে এসে দাঁড়াল। পাথরে পাথরে জায়গাটা খুব উঁচু হয়ে গেছে। এবার নদীতে জল এলে প্রায় হ্রদের মতো জায়গাটা ঘিরে জল ধরে রাখবে। সে জলের আশায় বৃষ্টির আশায় আকুল হতে থাকল। বৈশাখ চলে গেছে, জ্যৈষ্ঠ যাব যাব করছে। অথচ একবিন্দু বৃষ্টি নেই। এবারেও মা সুবচনি এ—অঞ্চলে আগুন জ্বালিয়ে রাখবে। রাগে দুঃখে জনার্দন পাথরের ওপরই খামচাতে থাকল।
দুঃস্থ মানুষ জনার্দন অহোরাত্র খাদ্য অন্বেষণের পর ক্লান্ত হয়ে নদীর স্রোতের উঁচু অংশটাতে চুপচাপ বসেছিল। ভোর হতে আর দেরি নেই। হরিণী তার দুই শিশু সন্তান নিয়ে এবার নেমে আসবে। ওদের জলপান করানো হলে জনার্দন পেট পুরে জলপান করবে। তারপর, মন্দিরের ভিতর সারাদিন পড়ে থাকা ক্ষুধার ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা সহ্য করতে করতে মাঝে মাঝে দৃষ্টিহীন হয়ে যাওয়া—হায় জনার্দন প্রায় এখন কিছুই ভাবতে পারছিল না। সামনে যেসব গঞ্জ ছিল সেও সুনসান। কোনও কোলাহল নেই, ক্রমশ এক অন্ধকার এই পাহাড়ঘেরা মাঠে নেমে এসে সব অঞ্চলটাকে ভূতপ্রেতের রাজত্ব করে দিল।
জনার্দন মনে মনে খেঁকিয়ে উঠল, না হয় না। তার ইচ্ছে হচ্ছিল যে কোনও মই বেয়ে এবার প্রায় আকাশের কাছাকাছি উঠে যাবে, এবং আকাশটাকে মা সুবচনির খাঁড়া দিয়ে দুভাগ করে দেবে। দু ভাগ করে দিলেই ঝর ঝর করে জল নামবে। সে এই ক্লান্ত শরীরেও মই বেয়ে ওঠার মতো দু হাত তুলে দিল আকাশের দিকে। তারপর চিৎকার করে বলতে চাইল, জল দে। আমি যদি তোর কাছে পাপ করে থাকি, আমার প্রাণের বিনিময়ে জল দে। বলে সে বালিয়াড়ির ওপর সটান শুয়ে পড়ল এবং হাত দুটো পিঠের উপর যেন দুটো হাত বাঁধা অবস্থায় ওকে বলি দেওয়া হচ্ছে এমন ভঙ্গি নিয়ে বালির উপর শুয়ে পড়ল।—এবার দে এক কোপ। ভ্যাঁ। জনার্দন বালির ওপর কাটা পাঁঠার মতো ছটফট করতে থাকল এবং ব্যা ব্যা করে ডাকতে থাকল। যথার্থই যেন ওকে সুবচনি দেবীর মন্দিরে পাঁঠার মতো বলি দেওয়া হচ্ছে এখন।
না এভাবে পড়ে থেকে লাভ নেই—জনার্দন উঠে পড়ল। নিশুতি রাত শেষ হয়ে যাচ্ছে। চারিদিকে মাঠ, গাছ, পাহাড় যেন দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে আছে তাকে হত্যা করবে বলে। জনার্দন উলঙ্গ ছিল বলে উপবীত ডানদিকের কোমরের কাছে ঢলঢল করছিল। মনে হচ্ছিল উপবীত ওর শরীরে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। সে উপবীতে হাত রেখে হাঁকল, কে আসবি আয়, কার কত হিম্মত আছে আয়, কত লড়বি এই ঠাকুরের সঙ্গে আয়—কারণ জনার্দনের মনে হচ্ছিল শুধু সুবচনি নয়, শুধু এই অঞ্চলের মানুষজন নয়, সকলেই যেন, যেন গাছ, ফুল, পাখি, পাহাড় সকলে মিলে ওর সঙ্গে তঞ্চকতা করছে। অথবা রসিকতা করছে—হায় জনার্দন তোদের ফসলের অহঙ্কার ভালোবাসার অহঙ্কার এবারে সব মুছে যাবে।
ঠিক তক্ষনি লাফিয়ে লাফিয়ে নীচে নেমে আসছে হরিণী আর তার দুই শিশু। সোনার হরিণের মতো দেখাচ্ছিল প্রায়। ভোর রাতের জ্যোৎস্নায় ওদের চোখগুলো বড় উজ্জ্বল ছিল। বালিতে পায়ের দাগ পড়েছে। ওদের শরীর এত নরম এবং উজ্জ্বল যে জ্যোৎস্নায় মনে হচ্ছিল শরীর থেকে পিছলে যাচ্ছে। ওরা নেমে আসছিল এবং পিছনের দিকে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছিল। জনার্দনের এখন আর মৃত্যুভয় থাকছে না। মাঠ এবং পাহাড়কে এখন দৈত্যের মতো মনে হচ্ছে না। এখন যেন জনার্দন আর একা নয়। সে এবং এই তিন বন্যপ্রাণী মিলে চারজন। সে প্রায় সুবচনি দেবীর মন্দিরে যেমন একা একা কথা বলে দিন কাটায় অর্থাৎ সেই সুবচনির সঙ্গে কথা বলে, এবং সুবচনির হয়ে কথার উত্তর দেয় তেমনি এই নদীর খাতে হরিণদের সঙ্গে প্রায় একা একা কথা বলার স্বভাব।—তা হলে তোরা এলি। তোদের জন্য আমি কখন থেকে বসে রয়েছি। তোরা তো বাপু দ্রুত ছুটতে পারিস, কোথায় কোনও বনে দ্রুত ছুটে যাস কে জানে। আহারের কোনও অসুবিধা হচ্ছে নাত! জনার্দন ওদের সঙ্গে প্রায় সাধু ভাষায় কথা বলতে আরম্ভ করে দিল।
সে ওদের নাম রেখে দিয়েছে এতদিনে।
সে সবচেয়ে ছোটটাকে ডাকল—পলা এই পলা তুইত বাপু ভারী দুষ্টু। শিঙে মুখ ঘসে সুখ খাচ্ছিস। পলা পা দুটো হঠাৎ এবার পিঠের উপর রেখে প্রায় মাথার কাছে মুখ নিয়ে এল। ওর মাথার নীচে এবং গা চেটে দিচ্ছে। বোধহয় ঘাম ছিল শরীরে, এবং ঘাম শুকিয়ে নুনের গন্ধ ছিল শরীরে, পলা মনের সুখে জিভ দিয়ে পিঠ ঘাড় গলা চেটে দিতেই জনার্দন এক ধরনের সুখ পেল—অতীব সুখ, লোভের বশবর্তী সে সুখ আহারের সুখ, এমন সুখ বুঝি কতদিন সে পায়নি—সে ভিতরে আহারের এক সুখ আছে ভাবতেই মনে হল কোথায় যেন আগুন জ্বলছে, কাঠের আগুন, বন্য মানুষেরা সেই কাঠে মাংস পুড়িয়ে চিবুচ্ছে। ওর জিভ স্বাদে গন্ধে অতুলনীয়, জিভে জল এসে গেল। সঙ্গে সঙ্গে সে খপ করে পলাকে ধরে বুকের কাছে টেনে আনল, এবং ওদের জলপান করানোর কথা মনে থাকল না। আহারের লোভে, দীর্ঘদিনের অনাহার জনার্দনকে প্রায় পাগলের মতো করে ফেলছে। সে পলাকে নিয়ে এবার মন্দিরের দিকে দ্রুত ছোটার জন্য মাঠের দিকে উঠে যেতে থাকল।