ওঃ তবে তো কথাই নেই, বরং আপনার দায়-দায়িত্ব দেখতে পারবে।
সুনন্দা আর একটু হাসল, আমার দায়-দায়িত্ব দেখতে তো আপনিই আছেন, সে জন্যে না। এ শুধু আমার নিজের জন্যেই।
হ্যাঁ, শুধু নিতান্ত টিকতে না পারার কষ্টটা লাঘব করতে চায় সুনন্দা। কিন্তু ব্রজনাথকে না জানিয়ে তো কোনও কাজই করে নি সুনন্দা শোভনলালের মৃত্যুর পর থেকে। তাই এই প্রশ্ন।
ভাইপো!
ভাইয়ের ছেলে!
সুনন্দার দাদা বৌদিকে তো দেখেছেন ব্রজনাথ। সেই যে শোভনলালের আকস্মিক মৃত্যুর খবর পেয়ে ছুটে এসেছিলেন প্লেনে করে।
পুনায় থাকেন। মিলিটারিতে চাকরি করেন। ছুটি কদাচ মেলে।
এসেছিলেন ভগ্নীপতির মৃত্যু সংবাদে, শ্রাদ্ধ শান্তি না ঢুকতেই চলে যেতে হয়েছিল। ছেলে মেয়ে অনেকগুলি, তাদের কাউকে নিয়ে আসেন নি, তাই কাউকে ব্রজনাথ দেখেন নি। যে ছেলেটির কথা বলছে সুনন্দা, সেটি সুনন্দার দাদা অলকেন্দ্রর মেজ ছেলে। তখন সে স্কুলের শেষ পরীক্ষা দিচ্ছে। এখন ছেলেটি যাদবপুর এঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়তে এসেছে, হোস্টেলে ভর্তি হয়েছে, তাই সুনন্দার ইচ্ছে হোস্টেলে না থেকে পিসির কাছে থাকুক।
খুবই স্বাভাবিক ইচ্ছে, বলেছিলেন ব্রজনাথ, আপনার ঘর সন্তান সন্ততিতে পূর্ণ থাকলেও এ ইচ্ছে হতে বাধা ছিল না। এই তো নিয়ম সংসারের। নিকট আত্মীয় কলকাতায় থাকতে ছেলে হোস্টেলে থেকেই বা পড়বে কেন? কিন্তু কথা হচ্ছে–ব্রজনাথ বলেছিলেন, আপনার ভাইপো, বলাটা আমার সমীচীন হচ্ছে না, তবুও না বলে পারছি না মিসেস রায়, যা দেখছি আপনার ভাইপোর বয়েসটি বড় খারাপ, আর এই শহরটি ততোধিক খারাপ, এ ঝুঁকি নেওয়া সোজা নয়। হোস্টেলে থাকে চাপে থাকে, আপনার কাছে থাকা মানে বুভুক্ষু মাতৃহৃদয়ের উজাড় করা স্নেহের কাছে
সুনন্দা মৃদু হেসেছিল। বলেছিল, স্নেহাস্পদের অকল্যাণ ডেকে আনবে, এমন অসঙ্গত স্নেহ আমি দেব না ব্রজনাথবাবু, আর বয়সের কথা বলছেন? সে বিষয়ে আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। সে ছেলে একটি হীরের টুকরো।
আর তবে কোন যুক্তি থাকতে পারে ব্রজনাথের?
–আপনার দাদার মত আছে তো?
–রাজী করিয়েছি।
অতঃপর সেই হীরের টুকরোটিকে বাড়িতে এনে প্রতিষ্ঠা করল সুনন্দা।
তা লেখায় পড়ায় আচারে আচরণে স্বভাব মাধুর্যে হৃদয়ের ঔদার্যে ছেলেটি হীরের টুকরোই বটে! সে এসে থাকার সঙ্গে সঙ্গে চাকর বাকরগুলো যেন তার চরণে হৃদয় সমর্পণ করে বসল।
মাঝে মাঝে রায় কোম্পানি, অর্থাৎ ফার্নিচারের ওই দোকানটাতেও যায় উদ্দালক। তারাও ওর কমনীয় মুখ আর কোমল কথায় মুগ্ধ।
আর সুনন্দা?
সে তো ব্রজনাথের ভাষায় তার বুভুক্ষু মাতৃহৃদয়ের উজাড় করা স্নেহ দিয়ে ডুবিয়ে রেখেছে উদ্দালককে, ডুবে বসে আছে নিজে।
শুধু ব্রজনাথই তেমন সুচক্ষে দেখেন না ছেলেটাকে। তার মনে হয় তার দিকে চোখ পড়লেই ও যেন ব্যঙ্গ হাসি হাসে।
হয়তো তাঁর সেই ধারণাটা নেহাৎ ভুলও নয়। ব্যঙ্গ না হোক, কৌতুকের হাসি হাসে উদ্দালক, ব্রজনাথের ওই সাজানো সাধু ভাষায় গড়া কথা শুনে। বলে, উনি যেন সর্বদা ওঁর মাই লর্ডের সামনে কথা বলছেন। যেন ওঁর দুদিকে দুপক্ষের মক্কেল দাঁড়িয়ে আছে।
এই কৌতুকটাকেই ব্যঙ্গ ভাবেন ব্রজনাথ, আর অপ্রসন্ন হন। কিন্তু অপ্রসন্ন হয়ে আর কি হবে। যতদূর দেখা যাচ্ছে, পাকাপাকি দত্তক না নিলেও, প্রায় পুষ্যিপুতুরই করে নিচ্ছে সুনন্দা উদ্দালককে। দেখা যাচ্ছে তার প্রথম সোপান।
ব্রজনাথ অবশ্য বলেছিলেন একদিন, আপনার তো অনেকগুলি ভাইপো ভাইঝি, তা সবাইকে বঞ্চিত করে একজনকে দিলে, একটু অবিচার করা হবে না কি?
সুনন্দা হেসে উঠেছিল বঞ্চিত করা বলছেন কেন ব্রজনাথ বাবু? তারা তো আর আমার এই সম্পত্তির ওপর দৃষ্টি দিয়ে বসে নেই? আমার দাদার অবস্থাও এমন কিছু খারাপ নয়, যথেষ্ট ভালই বরং। চারটি ছেলে তার, তাদের মধ্যে একজনকে যদি আমি একটু মেহদৃষ্টিতে দেখি, যদি তাকে কিছু দিই, আর সকলের ওপর অবিচার করা হবে কেন সেটা? তাছাড়া আর একটু হেসে কথার উপসংহারে এসেছিল সুনন্দা–তাছাড়া একেবারে বিনা স্বার্থেও তে দেব না আমি। আমার তো জীবনের শেষ পরিণতি আছে? ও আমাকে দেখবে। সম্পত্তিটা পেলে তো আমায় ফেলতে পারবে না?
এ কথা শুনে অবশ্য ব্যঙ্গ হাসি হেসেছিলেন ব্রজনাথ। বলেছিলেন, ফেলতে পারবে না সেটা লিখিয়ে নেবেন?
নাঃ, লিখিয়ে নেব না। শুধু অলিখিত একটা চুক্তি থাকবে দুজনের মধ্যে।
আমাকে মাপ করবেন মিসেস রায়, বলেছিলেন ব্রজনাথ, আপনার সরলতা আমার শ্রদ্ধা উদ্রেকের চাইতে হাস্যোদ্রেকই করছে। আমরা ল-ইআররা যেখানে বাস করি, সেটা হচ্ছে মনুষ্য
জগতের ভিতর পিঠ। যেখানে পালিশ নেই, মলাট নেই, একেবারে উগ্র নগ্নতা। তাই আপনার এই সরলতাকে প্রশংসা করতে পারছি না। নিজের গর্ভজাত সন্তানই মাকে কত ঠকায়, সে খবর রাখেন আপনি?
সুনন্দার মুখটা একটু লাল হল। বলল–তেমন দুর্ভাগ্য হলেও তো করবার কিছু থাকে না ব্রজনাথ বাবু! তবু বলব এ সন্দেহ করলে, আমার পিতৃবংশের সম্ৰান্ততার প্রতি অবিচার করা হবে।
ক্ষমা চাইছি আমার ধৃষ্টতার জন্যে, মিসেস রায়, তবু আপনার কাছে হাতজোড় করছি, এখুনি একেবারে যথাসর্বস্ব দান করে বসবেন না, এখনো আপনার জীবনের অনেক বাকী।
তা সুনন্দাও অবশ্য তখুনি সর্বস্ব ত্যাগ করতে বসে নি, শুধু ওই অলিখিত চুক্তি রচিত হচ্ছিল, উদ্দালকের সঙ্গে যতটা না হোক, তার মায়ের সঙ্গে।