- বইয়ের নামঃ ভালোবাসা চিরকালীন
- লেখকের নামঃ আশাপূর্ণা দেবী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. ভালোবাসার থেকে বড় আর কিছু নেই
আমার কাছে মানুষের ভালোবাসার থেকে বড় আর কিছু নেই। জীবনে এর থেকে বড় কোন সম্পদ আছে কিনা আমার জানা নেই। আমি মনে করি না শুধু, বিশ্বাস করি মানব সভ্যতাই গড়ে উঠেছে মানুষের ভালবাসার মধ্য দিয়ে, তার মধ্যে আবার নর-নারীর ভালবাসার থেকে মহৎ আর কিছু নেই।
ধূসর বিকালের গোধূলি লাল আভায় বিস্তারিত সবুজ মাঠের উপরে তার আলোকছুটা এক মায়াবী কল্পনায় আমাকে নিয়ে যায় সেই অতীত বেলা ভূমে যেখানে আমার সঙ্গে নিত্য পথ চলতো আমার ভালবাসা, আমার স্বপ্ন, আমার কল্পনা, আমার ঘৃণা, আমার দ্বন্দ্ব, আমার দুর্বলতা, আমার ভীরুতা, আমার প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তি।
হিসাবের খাতা উল্টিয়ে দেখি কোন হিসাবই মেলেনি। হিসাব মেলেনি তাদেরও যারা স্বপ্ন ও বাস্তবকে নিয়ে হিসাব মিলাতে চেয়েছিল। কেন তাদের হিসাব মেলেনি? জীবনের চোবাবালিতে কেন তাদের পথ হারাতে হল? সে দুর্গম রহস্যের সমাধান হয়তো কোনদিনই হবে না। আর এটাই তো জীবন। তাই বলে হিসাব যে একেবারেই মেলেনি কথাটা কি এত জোর দিয়ে বলা যাবে? তারা তো বেঁচে আছে–কখনো সমুদ্রে, কখনো পাহাড়ে, আবার কখনো বা এই সমতলের ধানের শিষে ভোরের শিশিরের সুরভিতে।
ভোরের শিউলিতে খুঁজে ফিরি তার পরশ, শিশিরে পেতে চাই তার স্পর্শ, ভোরের বাতাস কখনোবা নিয়ে এসেছে তার ঘ্রাণ, সন্ধ্যার কুহেলিতে দেখেছি তার অবয়ব, অথচ তাকে পাইনি, যে আমার অধরা আর অনাঘ্রাতা, আমার স্বপ্নকে ভেঙে করেছে চুরমার। কেন এমন হল, কেন জোর করে ছিনিয়ে নিতে পারলাম না তাকে?
কে আমি কোন অধিকারে তার নাগাল পেতে চাই? জীবনে যে জল রঙের ছবিই আঁকতে পারল না তার সাধ হয় কি করে অমুর্তকে মুর্ত করার। ধরতে পারে কেবল মাত্র সেই যার সে অধিকার আছে। আমার তো সে অধিকার নেই। তবু না মেলা অংককে বার বার মিলাবার ব্যর্থ প্রয়াসে ভাবি জীবনের সব কিছুই কি মিথ্যে? হিসাব যে মিলাতে চেয়েছিলাম, তার কি কোন মূল্য নেই? নিজের জীবনের হিসাব মিলানোটাই কি সব? যাদের অংক মিলে গেছে তাদের জন্য কি থাকবেনা আমার কোন অভিনন্দন?
আবার ভাবি, যে স্মৃতির মেখলা পরে এই ধূসর বিকাল আমার চোখে মায়াঞ্জন হয়ে এঁকে চলেছে, পথ চলা শেষে তাদের অস্বীকার করব কি করে! আমার পৃথিবীর শব্দ ভান্ডার হলেই বা স্বল্প, অন্য পৃথিবী থেকে ধার করে নেব না হয় কিছু নতুন শব্দ। সেই শব্দেই লিখে যাব পৃথিবীর আর এক ইতিহাস।
স্বপ্নকে যদি কোন মায়াবী আলোয় বাস্তবের কাছাকাছি নিয়ে আসা যায়, হয়তো যন্ত্রণা বাড়তে পারে, আঘাতে বিবর্ণ হতে পারে মানবিক অনুভূতিগুলো। তাতে কি? যে খুঁজে পেতে চায় অপ্রাপণীয়াকে তাকে তো যে কোন ভাবে জয় করতেই হবে বাধাগুলো।
আমি পারিনি বলে আর কেউ যে পারবেনা, তাতো নয়। প্রান্তিক রায় জীবনের প্রতিক্ষেত্রে হেরে গেছে বলে রেহানাকেও হারতে হবে, সে দিব্যি তো কেউ দেয়নি।
রেহানা দূরের তারা হয়ে বাঁচতে চায়, সাধ্য কি তাকে মর্তের মাটিতে ফিরিয়ে আনার। অথচ একদিন, এই রেহানাই শুধু নয় তার সঙ্গে অশ্রুকণা, তপতী ও আরো কেউ কেউ হারতে চেয়েছিল। কিন্তু কি হল জীবন ইতিহাসের দৃশ্যগুলিতে? জনমানসে আলোড়ন তুলে তারা শুধু আমার দুঃখের বোঝা বাড়িয়ে গেল। আজ বুঝতে পারি, তাদের সে জোরটুকু ছিল না, যে জোরে দূরকে করা যায় নিকট। যার সে জোর থাকে, জীবন-তো তাকেই নিয়ে আবর্তিত হয়। আর সে জন্যই তাদের প্রতীকী উপস্থিতি, দুয়ারে যতই আঘাত হানুক, ভীরু মন তাতে সাড়া দেবে কেন?
ব্যর্থ বাঁশির সুর দুয়ারে আঘাত হেনে ফিরে যায়, প্রতিধ্বনিত হয় সেই ব্যাকুলতা, স্মৃতির পাতায় তাকেই অক্ষয় করে রাখার যে অনুভূতি, আজো এই গোধূলি আকাশ কোনে খুঁজে ফিরি শেষ হয়েও শেষ না হওয়া সেই সূরের মুৰ্ছনা।
প্রান্তিক রায় বেদনার মধ্যে তাদের অস্তিত্ব খুঁজে পায়। ভালবাসা নামক রূপক পৃথিবীতে তাদের বিচরণ অবাধ। মায়াবী আলোয় ফিরে পায় হারানো সুরের রেশ। সমুদ্র তাদের টানে জীবনের এক ঘেয়েমীকে মুক্তি দিতে, পাহাড় জাগায় উদ্যমতা। আবার এই সমতলের বিষণ্ণতায় নতুনের স্বপ্ন দেখে জীবনের পাতায় পাতায়। তাইতো শেষ কথা বলার সময় আসেনি এখনো।
অশ্রুকণার জন্য একটা আলাদা অনুভূতি জাগে মনের মধ্যে। জানিনা এই অনুভূতির কোন আলাদা নাম আছে কিনা। যদি থাকেও তবু সে নামের সাথে আমার কোন পরিচয় নেই। অশ্রুকণাকে ভাল লাগে কারণ, অনেক অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে সে তার সাবলীল উপস্থিতি আর সমবেদনা দিয়ে আমাকে উদ্দীপ্ত করেছে অনেকবার। কিন্তু অশ্রুকণার এই যে নিতান্ত অসহায় এক গাঁয়ের ছেলেকে উপযাচক হয়ে সমবেদনা জানানো, পছন্দ নয় কলেজের অনেকের। ছেলেরা কতটা প্রতিক্রিয়াশীল জানা না গেলেও মেয়েরা যে সুযোগ পেলেই আমাকে অপদস্ত করতে পিছপা নয় সে অভিজ্ঞতা এই সামান্য দিনে বেশ কয়েকবার হয়ে গেছে। তাই তাদের এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি।
কিন্তু আমি প্রান্তিক দূর থেকে এতদিন দেখে এসেছি অকাকে। ভীরুতা আমাকে বাধা দিয়েছে কাছে যেতে, তাইতো এড়িয়ে চলছি প্রতিমুহূর্তে। এই কো-এডুকেশান কলেজে পড়তে এসে, গ্রামের লাজুকতা যে তখনো ছাড়তে পারেনি তার পক্ষে কেমন করে সম্ভব ঐ সব দূর আকাশের তারাদের মুখোমুখি দাঁড়াবার। তবু এরই ফাঁকে অশ্রুকণার উপযাচক হয়ে কাছে আসার নৈকট্য আমাকে ভাল লাগার এক মরুদ্যানে পৌঁছে দেয়। কিন্তু তাতে কি? মরুদ্যানের সিগ্ধতা যারা কেড়ে নিতে চায় তারাতো সক্রিয়। তাদের অবাধ বিচরণকে ঠেকাবে কে? তাইতো আবারও একদিন মুখোমুখি হয়ে যেতে হয় তমালীর, নিতান্ত নিরুপায় হয়ে। এই যে গাঁয়ের ছেলে কোথায় চললে একা একা? তমালীর সঙ্গে ঝাক বেধে আসা অনুতপা, মুক্তি, শিরা খিল খিল করে হেসে ওঠে। ওদের ঐ প্রাণোচ্ছলতা আমাকে যেন মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে চায়। পারিনা চোখ তুলে তাকাতে। কিন্তু যাদের প্রাণে আনন্দের উচ্ছ্বসিত জোয়ার, তারা তা মানবে কেন? যেকোন ভাবেই হোক আনন্দকে তো জয় করতে হবে। তাই আমার অসহায়তা, ভীরুতা, লাজুকতাকে তারা মূল্য দেবে কেন? এরপর অপমানের শুল আরো তীব্রভাবে হেনে শিপ্রা বলে, কিগো ভাই কানাই কোন রাধিকার খোঁজে চলেছে এই পথে একলা একলা? মুক্তি বলে, আমরা রাধিকা না হতে পারি, কিন্তু তার সহচরীতো বটে। ভালবাসার ঐ চোখ দুটি তুলে তাকাও না একবার, বলতে বলতে খিলখিল করে হেসে ওঠে সবাই এক সাথে। তাতেই ক্ষান্ত না হয়ে কেউ কেউ আমার হাতে একটা চিমটি কাটে, কেউ জামা ধরে টানে, কেউবা আমার বই খাতার সস্তাদামের ব্যাগটা টেনে ছুঁড়ে ফেলে দেয় দূরে। আমার রাগ হয় খুব, কিন্তু কোন ভাবেই তা প্রকাশ করতে পারিনা। গাঁয়ের ছেলে সত্যি। তাই বলে তার কথা উল্লেখ করে অপমান করতে হবে? এটাই বুঝি শহরের ভদ্রতা। ওদের ওই অরুচিকর কথার উত্তরে শুধু আস্তে আস্তে বললাম, কেন এই ভাবে আপনারা আমায় বিরক্ত করছেন, আমার তাড়া আছে পথ ছাড়ন।