- বইয়ের নামঃ ভালোবাসা চিরকালীন
- লেখকের নামঃ আশাপূর্ণা দেবী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. ভালোবাসার থেকে বড় আর কিছু নেই
আমার কাছে মানুষের ভালোবাসার থেকে বড় আর কিছু নেই। জীবনে এর থেকে বড় কোন সম্পদ আছে কিনা আমার জানা নেই। আমি মনে করি না শুধু, বিশ্বাস করি মানব সভ্যতাই গড়ে উঠেছে মানুষের ভালবাসার মধ্য দিয়ে, তার মধ্যে আবার নর-নারীর ভালবাসার থেকে মহৎ আর কিছু নেই।
ধূসর বিকালের গোধূলি লাল আভায় বিস্তারিত সবুজ মাঠের উপরে তার আলোকছুটা এক মায়াবী কল্পনায় আমাকে নিয়ে যায় সেই অতীত বেলা ভূমে যেখানে আমার সঙ্গে নিত্য পথ চলতো আমার ভালবাসা, আমার স্বপ্ন, আমার কল্পনা, আমার ঘৃণা, আমার দ্বন্দ্ব, আমার দুর্বলতা, আমার ভীরুতা, আমার প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তি।
হিসাবের খাতা উল্টিয়ে দেখি কোন হিসাবই মেলেনি। হিসাব মেলেনি তাদেরও যারা স্বপ্ন ও বাস্তবকে নিয়ে হিসাব মিলাতে চেয়েছিল। কেন তাদের হিসাব মেলেনি? জীবনের চোবাবালিতে কেন তাদের পথ হারাতে হল? সে দুর্গম রহস্যের সমাধান হয়তো কোনদিনই হবে না। আর এটাই তো জীবন। তাই বলে হিসাব যে একেবারেই মেলেনি কথাটা কি এত জোর দিয়ে বলা যাবে? তারা তো বেঁচে আছে–কখনো সমুদ্রে, কখনো পাহাড়ে, আবার কখনো বা এই সমতলের ধানের শিষে ভোরের শিশিরের সুরভিতে।
ভোরের শিউলিতে খুঁজে ফিরি তার পরশ, শিশিরে পেতে চাই তার স্পর্শ, ভোরের বাতাস কখনোবা নিয়ে এসেছে তার ঘ্রাণ, সন্ধ্যার কুহেলিতে দেখেছি তার অবয়ব, অথচ তাকে পাইনি, যে আমার অধরা আর অনাঘ্রাতা, আমার স্বপ্নকে ভেঙে করেছে চুরমার। কেন এমন হল, কেন জোর করে ছিনিয়ে নিতে পারলাম না তাকে?
কে আমি কোন অধিকারে তার নাগাল পেতে চাই? জীবনে যে জল রঙের ছবিই আঁকতে পারল না তার সাধ হয় কি করে অমুর্তকে মুর্ত করার। ধরতে পারে কেবল মাত্র সেই যার সে অধিকার আছে। আমার তো সে অধিকার নেই। তবু না মেলা অংককে বার বার মিলাবার ব্যর্থ প্রয়াসে ভাবি জীবনের সব কিছুই কি মিথ্যে? হিসাব যে মিলাতে চেয়েছিলাম, তার কি কোন মূল্য নেই? নিজের জীবনের হিসাব মিলানোটাই কি সব? যাদের অংক মিলে গেছে তাদের জন্য কি থাকবেনা আমার কোন অভিনন্দন?
আবার ভাবি, যে স্মৃতির মেখলা পরে এই ধূসর বিকাল আমার চোখে মায়াঞ্জন হয়ে এঁকে চলেছে, পথ চলা শেষে তাদের অস্বীকার করব কি করে! আমার পৃথিবীর শব্দ ভান্ডার হলেই বা স্বল্প, অন্য পৃথিবী থেকে ধার করে নেব না হয় কিছু নতুন শব্দ। সেই শব্দেই লিখে যাব পৃথিবীর আর এক ইতিহাস।
স্বপ্নকে যদি কোন মায়াবী আলোয় বাস্তবের কাছাকাছি নিয়ে আসা যায়, হয়তো যন্ত্রণা বাড়তে পারে, আঘাতে বিবর্ণ হতে পারে মানবিক অনুভূতিগুলো। তাতে কি? যে খুঁজে পেতে চায় অপ্রাপণীয়াকে তাকে তো যে কোন ভাবে জয় করতেই হবে বাধাগুলো।
আমি পারিনি বলে আর কেউ যে পারবেনা, তাতো নয়। প্রান্তিক রায় জীবনের প্রতিক্ষেত্রে হেরে গেছে বলে রেহানাকেও হারতে হবে, সে দিব্যি তো কেউ দেয়নি।
রেহানা দূরের তারা হয়ে বাঁচতে চায়, সাধ্য কি তাকে মর্তের মাটিতে ফিরিয়ে আনার। অথচ একদিন, এই রেহানাই শুধু নয় তার সঙ্গে অশ্রুকণা, তপতী ও আরো কেউ কেউ হারতে চেয়েছিল। কিন্তু কি হল জীবন ইতিহাসের দৃশ্যগুলিতে? জনমানসে আলোড়ন তুলে তারা শুধু আমার দুঃখের বোঝা বাড়িয়ে গেল। আজ বুঝতে পারি, তাদের সে জোরটুকু ছিল না, যে জোরে দূরকে করা যায় নিকট। যার সে জোর থাকে, জীবন-তো তাকেই নিয়ে আবর্তিত হয়। আর সে জন্যই তাদের প্রতীকী উপস্থিতি, দুয়ারে যতই আঘাত হানুক, ভীরু মন তাতে সাড়া দেবে কেন?
ব্যর্থ বাঁশির সুর দুয়ারে আঘাত হেনে ফিরে যায়, প্রতিধ্বনিত হয় সেই ব্যাকুলতা, স্মৃতির পাতায় তাকেই অক্ষয় করে রাখার যে অনুভূতি, আজো এই গোধূলি আকাশ কোনে খুঁজে ফিরি শেষ হয়েও শেষ না হওয়া সেই সূরের মুৰ্ছনা।
প্রান্তিক রায় বেদনার মধ্যে তাদের অস্তিত্ব খুঁজে পায়। ভালবাসা নামক রূপক পৃথিবীতে তাদের বিচরণ অবাধ। মায়াবী আলোয় ফিরে পায় হারানো সুরের রেশ। সমুদ্র তাদের টানে জীবনের এক ঘেয়েমীকে মুক্তি দিতে, পাহাড় জাগায় উদ্যমতা। আবার এই সমতলের বিষণ্ণতায় নতুনের স্বপ্ন দেখে জীবনের পাতায় পাতায়। তাইতো শেষ কথা বলার সময় আসেনি এখনো।
অশ্রুকণার জন্য একটা আলাদা অনুভূতি জাগে মনের মধ্যে। জানিনা এই অনুভূতির কোন আলাদা নাম আছে কিনা। যদি থাকেও তবু সে নামের সাথে আমার কোন পরিচয় নেই। অশ্রুকণাকে ভাল লাগে কারণ, অনেক অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে সে তার সাবলীল উপস্থিতি আর সমবেদনা দিয়ে আমাকে উদ্দীপ্ত করেছে অনেকবার। কিন্তু অশ্রুকণার এই যে নিতান্ত অসহায় এক গাঁয়ের ছেলেকে উপযাচক হয়ে সমবেদনা জানানো, পছন্দ নয় কলেজের অনেকের। ছেলেরা কতটা প্রতিক্রিয়াশীল জানা না গেলেও মেয়েরা যে সুযোগ পেলেই আমাকে অপদস্ত করতে পিছপা নয় সে অভিজ্ঞতা এই সামান্য দিনে বেশ কয়েকবার হয়ে গেছে। তাই তাদের এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি।
কিন্তু আমি প্রান্তিক দূর থেকে এতদিন দেখে এসেছি অকাকে। ভীরুতা আমাকে বাধা দিয়েছে কাছে যেতে, তাইতো এড়িয়ে চলছি প্রতিমুহূর্তে। এই কো-এডুকেশান কলেজে পড়তে এসে, গ্রামের লাজুকতা যে তখনো ছাড়তে পারেনি তার পক্ষে কেমন করে সম্ভব ঐ সব দূর আকাশের তারাদের মুখোমুখি দাঁড়াবার। তবু এরই ফাঁকে অশ্রুকণার উপযাচক হয়ে কাছে আসার নৈকট্য আমাকে ভাল লাগার এক মরুদ্যানে পৌঁছে দেয়। কিন্তু তাতে কি? মরুদ্যানের সিগ্ধতা যারা কেড়ে নিতে চায় তারাতো সক্রিয়। তাদের অবাধ বিচরণকে ঠেকাবে কে? তাইতো আবারও একদিন মুখোমুখি হয়ে যেতে হয় তমালীর, নিতান্ত নিরুপায় হয়ে। এই যে গাঁয়ের ছেলে কোথায় চললে একা একা? তমালীর সঙ্গে ঝাক বেধে আসা অনুতপা, মুক্তি, শিরা খিল খিল করে হেসে ওঠে। ওদের ঐ প্রাণোচ্ছলতা আমাকে যেন মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে চায়। পারিনা চোখ তুলে তাকাতে। কিন্তু যাদের প্রাণে আনন্দের উচ্ছ্বসিত জোয়ার, তারা তা মানবে কেন? যেকোন ভাবেই হোক আনন্দকে তো জয় করতে হবে। তাই আমার অসহায়তা, ভীরুতা, লাজুকতাকে তারা মূল্য দেবে কেন? এরপর অপমানের শুল আরো তীব্রভাবে হেনে শিপ্রা বলে, কিগো ভাই কানাই কোন রাধিকার খোঁজে চলেছে এই পথে একলা একলা? মুক্তি বলে, আমরা রাধিকা না হতে পারি, কিন্তু তার সহচরীতো বটে। ভালবাসার ঐ চোখ দুটি তুলে তাকাও না একবার, বলতে বলতে খিলখিল করে হেসে ওঠে সবাই এক সাথে। তাতেই ক্ষান্ত না হয়ে কেউ কেউ আমার হাতে একটা চিমটি কাটে, কেউ জামা ধরে টানে, কেউবা আমার বই খাতার সস্তাদামের ব্যাগটা টেনে ছুঁড়ে ফেলে দেয় দূরে। আমার রাগ হয় খুব, কিন্তু কোন ভাবেই তা প্রকাশ করতে পারিনা। গাঁয়ের ছেলে সত্যি। তাই বলে তার কথা উল্লেখ করে অপমান করতে হবে? এটাই বুঝি শহরের ভদ্রতা। ওদের ওই অরুচিকর কথার উত্তরে শুধু আস্তে আস্তে বললাম, কেন এই ভাবে আপনারা আমায় বিরক্ত করছেন, আমার তাড়া আছে পথ ছাড়ন।
তমালী বলে ওঠে দেখ দেখ, আমাদের কিছুতেই ও বন্ধু বলে মানবেনা। ক্লাশের বন্ধুদের কেমন আপনি করে বলছে দেখ। মুক্তি বললো, ওকে ঐ পুকুরের জলে ডোবানো দরকার, যদি তাতে ওর নতুন জন্ম হয়। তমালী বলে নারে, তাতে আবার শ্রীরাধিকার মান হতে পারে। ওকে নিয়ে ডোবার অধিকারতো তার। তার চেয়ে ছেড়ে দে, আমরা শ্রীরাধিকাকে বলি। এই যে ভাই অশ্রুকণা তোমার কানু অপেক্ষা করছে ঐ পুকুর পাড়ে কৃষ্ণচূড়ার নীচে। আবারও খিল খিল করে হেসে ওঠে একসাথে। তারপর হাসতে হাসতে দল বেঁধে চলে যায় ওরা। মনে মনে ভাবি কি রকম ফাজিল মেয়ে সব। লজ্জা সরমও নেই।
কিন্তু আমি এখন কি করব। ওটুকু সময়ের মধ্যে যা যা করার সবই করেছে ওরা। টানাটানিতে জামার একটা অংশ ছিঁড়ে গেছে। সেলাই না করে ওটা পরে আর কলেজে আসা যাবেনা। বইগুলো যে কোথায় কোথায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কে জানে? খুঁজে দেখতে হবে। টানা হ্যাঁচড়ায় হাতের কবজিতে ব্যাথা এখনো টনটন করছে। যে ভাবে চুল ধরে টানাটানি করেছে, তাতে মাথা নাড়াতেই কষ্ট হচ্ছে। কি অপরাধ আমার? কলেজে আসি, আবার ফিরে যাই আপন মনে। অন্যান্য ছেলে মেয়েরা যখন আড্ডা মারে, আমি তাতে যোগ দিইনা। ডালে লাগেনা তাই। কিন্তু এটাও তো সত্য, ওরাতো কোনদিন ডাকেনি আমাকে। হা একদিন বলেছিল বটে, কলেজের প্রায় ১০/১২টি ছেলেমেয়ে একসঙ্গে কলেজ ক্যান্টিনে বসে চা খাচ্ছিল, আমার ভীষণ খিদে পেয়েছিল তাই পকেটের পয়সা গুনে নিয়ে সামান্য কিছু খাওয়ার জন্য ক্যান্টিনে ঢুকেছিলাম। ক্যান্টিনের বিশুদা, পুরো নাম জানিনা ঐ নামে সবাই ডাকে–আমাকে বলল কি খাবে প্রান্তিক?–আমি বললাম, ৫০ পয়সা আছে তাতে যা হয় দাও। আমি বিশুদাকে দিতে বলে, পিছনের একটা ফাঁকা সিট দেখে এগিয়ে চলেছি। কলেজ বন্ধুদের
মধ্যে একজন, নাম মনে হয় বিমল, আমাকে বলল, আরে প্রান্তিকবাবু যে এসো এসো, আজ তোমার ঘাড় ভেঙে আমাদের চা খাওয়া হবে। বলেই তমালী শিপ্রাদের বলল, একটু সরে বসতো তোরা, প্রান্তিকবাবুকে বসতে দে। আমি বললাম, না ভাই আপনারা আরাম করে বসুন। আমি পিছনের সিটে বসব। তমালী ফোড়ন কেটে ওঠে কেন ভাই আমাদের সঙ্গে বসলে কি আপনার জাত যাবে? শিপ্রা বলল, না ভাই আপনাকে খাওয়াতে হবে না, আমরাই খাওয়াব। বসুন না, আমাদের সঙ্গে বসে এক কাপ চা না হয় খেলেনই। আমি বললাম, আমি চা খাইনা। একথা বলেই ওদের কথার আর কোন উত্তর না দিয়ে পিছনে গিয়ে বসলাম। বিশুদা একটু পরেই ২ খানা হাতে করা রুটি এবং খানিকটা ছোলার ডাল দিয়ে গেল। আমি কোন ভাবে খেয়ে উঠে পড়লাম। শুনতে পাচ্ছি তখনো আমাকে নিয়ে ওরা হাসাহাসি করছে। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু উপায়ই বা কি।
তখনো সন্ধ্যে হয়নি। একটা খাতা খুঁজেই পাওয়া গেলনা। ওতে আমার বেশ কিছু জরুরী নোটস্ ছিল। এত খারাপ লাগছে যে, বাড়ী ফিরতেও আর ইচ্ছে করছেনা। চুপচাপ বসে আছি শান বাধানো পুকুর ঘাটের বেদীতে। ভাবছি সন্ধ্যার আঁধার নেমে এলে আস্তে আস্তে চলে যাব।
এরইমধ্যে কেটে গেছে বেশ কয়েকটা দিন। একা একা পথ চলতে ভয় হয়। গ্রামের স্কুলে যখন পড়তাম হেডমাষ্টাব, মশাই ভীষণ ভালবাসতেন। আমি মোটামুটি লেখা পড়ায় খুব একটা খারাপ ছিলাম না বলে গ্রামের সকলে আমাকে ভালবাসতেন।
তখন ১১ ক্লাসে উচ্চমাধ্যমিক ছিল। টেষ্টে ভাল নম্বর পেয়ে প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হওয়ার পরে হেডস্যার বললেন; তাঁর এক ছাত্রী থাকে কলকাতায়। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই চাকরি করে। ওদের কোন সন্তান নেই। তোমার কথা বলেছি ওদের। তুমি কলকাতার কলেজে গিয়ে ভর্তি হও। ওরাই সব ব্যবস্থা করে দেবে, তোমার কোন আপত্তি নেই তো। হেডস্যারের ছাত্রী মানে গ্রামের সম্পর্কে আমাদের নীলাঞ্জনা পিসি, মাঝে মাঝে গ্রামের উৎসবে আসেন গ্রামের বাড়ীতে। মাঝে মাঝে ডেকে কথাও বলেন। কিন্তু তবু যেন মনে হয় কত দূরের মানুষ। কেন্দ্রীয় সরকারের একজন জুনিয়ার একাউন্টস অফিসার নীলাঞ্জনা পিসি, পিসির বর পরিমলদাও ভাল চাকরি করেন। তবে প্রাইভেট ফার্ম। ওদের একটাই দুঃখ, কোন সন্তান। হয়নি। আমার বয়সটা ঠিক ওদের সন্তানের বয়সের মতো নয়।
কলকাতায় হেডস্যারই আমাকে নিয়ে এসেছিলেন নীলাঞ্জনা পিসির কাছে। আসার কথা ব্যক্ত করে নীলাঞ্জনা পিসিকে বললেন যে, তোমার যদি কোন অসুবিধা হয়, তাহলে বল। পিসি বললেন, আমাদেরতো কোন অসুবিধা নেই, বরং ও থাকলে আমাদের কিছু সুরাহাই হবে।
সারাদিনের ক্লান্তির পরে আমরা যখন ফিরি, জীবনের সবকিছু একঘেয়েমি বলে মনে হয়। ও থাকলে অন্তত কিছুটা হলেও একঘেয়েমির ছন্দপতন হতে পারে। উত্তরে হেডস্যার বললেন একটা কথা বলব নীলু?–বলুন। আজকাল তো চিকিৎসা বিজ্ঞান অনেক উন্নত, তোমরা চেষ্টা করছনা কেন? চেষ্টা করা হয়েছে স্যার, কিন্তু ঈশ্বর যা চায়নি তা কি জোর করে পাওয়া যায়? তারপর বললেন তা হলে অরফ্যান হোম থেকে তো দত্তক নিতে পার? না স্যার, দত্তকের কথা ভাবিনি কখনো। আরো দু-এক জন যে বলেনি তা নয়, কিন্তু বিষয়টি আমাদের বিবেচনার মধ্যে নেই স্যার। আর তাছাড়া দোষ যখন আমার, তখন পরিমলকে আমি কেন আমার ভাগ্যের সঙ্গে জড়াব। বুঝতে পারলাম না তুমি কি বলতে চাইছো? নীলাঞ্জনা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, তারপর ধীরে ধীরে বলে যে, আমি ওকে আবার বিয়ে করতে বলেছি। অবাক হয়ে হেডস্যার বলেন, সেকি কথা নীলু! তুমি এর পরিনাম জানো? জানি স্যার। একদিন হয়তো ওর ঘরে আমার আর জায়গা হবে না। কিন্তু ওতো সুখী হবে, পূর্ণ হবে ওর পিতৃত্ব।
হেডস্যার নিশীথরঞ্জন সরকার এর আর কি উত্তর দেবেন। তবু তার মনে হয় নীলাঞ্জনার এ এক হঠকারি সিদ্ধান্ত। ও কোন ভাবেই ঠিক করছেনা। তাই আর ও প্রসঙ্গ না বাড়িয়ে আমার প্রসঙ্গে বললেন, তা হলে তোমাদের এখানে প্রান্তিককে রাখা বোধহয় ঠিক হবে না! কেন স্যার? তোমাদের মানসিক এই অবস্থার মধ্যে ও একটা বোঝা হয়ে উঠবে। নীলাঞ্জনা পিসি বলল, আপনি ঠিক বলছেন না স্যার। প্রান্তিক আপনার স্কুলের কৃতী ছাত্র এটা যেমন ঠিক, তেমনি ওতো আমারও গ্রামের ছেলে, সম্পর্কে আমার ভাইপো। হয় তো এই কলকাতা শহরে এ সম্পর্কের কোন মূল্য নেই। কিন্তু এতদিনেও গ্রামের বন্ধন যখন কাটাতে পারিনি তখন এ সত্যকে অস্বীকার করব কি করে? না স্যার ওর কোন অসুবিধাই হবেনা। আমি পরিমলকে বলেছি ও হাসি মুখে মেনে নিয়েছে। ওর আসার সময় হয়ে গেছে, আপনি আরেকটু অপেক্ষা করুন। হেডস্যার বললেন, কিন্তু নীলু। আমার যে সময় নেই একদমও। আমাকে উঠতেই হবে। নীলাঞ্জনা আর কি করবে? হেডস্যার যাওয়ার আগে বললেন, তোমরা আমাকে নিশ্চিন্ত করলে। আশীর্বাদ করে হেডস্যার চলে গেলেন। আমি রয়ে গেলাম। তা আমিও এখানে আছি বেশ কিছুদিন হয়ে গেছে পিসি ও পিশেমশাইর মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিংএর কোন অভাব আছে বলে আমার কখনো মনে হয়নি। বলতে গেলে ওনারা আমাকে ওদের পরিবারের একজন হিসাবে হাসিমুখে মেনে নিয়েছেন। ওবাড়ীতে আমাকে কোন কড়া অনুশাসনেও রাখা হয়নি বরং বাস ভাড়া এবং সামান্য টিফিনের পয়সা আমাকে নিয়মিত দিতে কোনদিন ভুল করেন না। আমার সারাদিন যা ব্যয় হয় তারপর বাকী পয়সা ওনাদের ফিরিয়ে দিই। ওরা ফিরিয়ে নিতে চান না। তবু আমি তা ফিরিয়ে দিই। সুতরাং আমার কাছে অতিরিক্ত ব্যয় করার মত পয়সা থাকে না।
আজ ওরা ব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে গেছেন। আমায় পয়সা দিতে সম্ভবত ভুলে গেছেন। সুতরাং কোন টিফিনই খাওয়া হয়নি। তারপর আসার সময় যেমন হেঁটে এসেছি, যেতেও হবে হেঁটে, পথ অনেকটা। তাই একটু তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে চলছিলাম। অসম্ভব ক্লান্তি নিয়ে পুকুরের ঘাটে বেদীর ওপরে বসে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মনে নেই।
অন্ধকার নেমে এসেছে। বাইরের পৃথিবীকে, তা আরো ঘন কালো যবনিকায় ঢেকে দিয়েছে, উপরন্তু সন্ধার অন্ধকারে ২/১টি মশার কামড়ও টের পাচ্ছি। ঘুম ভেঙে যায়। এ পথ নির্জন। পুকুরের জলে ভাল করে চোখমুখ ধুয়ে, হাঁটতে আরম্ভ করি। কিন্তু পা চলতে চাইছেনা। অথচ এতটা পথতে হাঁটতেই হবে। সামনের ঐ বাড়ীতে হয়তো রেহানা থাকে। রেহানা রহমান। সারা কলেজের সহপাঠীদের মধ্যে ওর সঙ্গেই আমার ২/১টি কথা হয়। আসলে কলেজে আমরা একই ক্লাসে পড়ি। আমাকে কিছু নোট দিয়ে ও সাহায্য করেছিল, দূর্ভাগ্য সে খাতাটিই আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
ওর সঙ্গে কলেজ করিডোরে যেদিন প্রথম দেখা হয়েছিল, আমি ক্লাসরুম খুঁজছিলাম। ইতস্ততঃ করছি দেখে ও আমায় জিজ্ঞাসা করেছিল আপনি তো প্রান্তিক রায়? আমি হ্যাঁ বলাতে, ও বলেছিল, আমাকে চিনতে পারছেন না তাইনা? তারপর নিজেই নিজের পরিচয় দিয়ে বলেছিল, আমি রেহানা রহমান। যেদিন কলেজে ভর্তি হন সেদিন আপনাকে দেখেছিলাম। ভর্তির ফর্ম থেকে আপনার নামটাও জেনে নিই, সেই সময়। কিছু মনে করবেন না, সহপাঠীদের সঙ্গে আমি কিন্তু বেশীক্ষণ আপনি করে কথা বলতে পারিনা। তুমি বললে আপত্তি করবেন না তো! সরল আর সহজ স্বীকারোক্তি, ভীষণ ভালই লেগেছিল কারণ তাতে কোন অহংকার নেই। তাই আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম ওর দিকে। আমাদের গ্রামের স্কুলেও গুটি কয়েক ছাত্র-ছাত্রী ওদের সম্প্রদায় ভুক্ত ছিল। ছেলেরা আমাদের সঙ্গে অবাধে মেলামেশা করলেও মেয়েরা একটু দূরত্ব বজায় রেখে চলতো। হয়তো কোন ধর্মীয় সঙ্কোচ তাদের এভাবে চলতে বাধ্য করতো। কিন্তু রেহানার সাবলীলতায় সে ভুল যেন ভেঙে গেল আমার। বললাম না আপত্তি কিছু নেই। ও বলল, কিন্তু একটা শর্ত আছে, আমাকেও কিন্তু আপনি বলা চলবেনা। বললাম, চেষ্টা করব। ও প্রতি উত্তরে মৃদু হাসল শুধু। একেবারে প্রথমেই যে তাকে তুমি বলতে পেরেছিলাম তা কিন্তু নয়। তবে ধীরে ধীরে একদিন সেই জড়তা ভেঙে গিয়েছিল এবং রেহানাকে তুমি বলতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি। তবে তার সঙ্গে কথাবার্তা হতো কালে ভদ্রে এবং খুব সামান্য। মনে মনে ভাবতাম রেহানাও তো শহরের মেয়ে, তবুও ওদের সঙ্গে কত পার্থক্য। মনে পড়ে সপ্তাহ দুয়েক আগে এই পথেই ফিরছিলাম। রেহানা একটা বাড়ীর বারান্দা থেকে আমাকে ডাকলো। এই যে প্রান্তিক! আমি তাকিয়ে দেখি একটা বাড়ীর বারান্দা থেকে রেহানা ডাকছে। খুব হাসিখুশী, গোধূলির রক্তিমাভায় ভীষণ সুন্দর লাগছিল ওকে। আমি থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম, ও বারান্দা থেকে নেমে এসে আমার পাশে দাঁড়িয়ে বলল, এটা আমাদের বাড়ী, চলনা! কিন্তু! কিন্তু কি? তারপর কি মনে হতে হেসে ফেলল, ও আমি তোমাদের স্বধর্মের লোক নই বলে তোমার সঙ্কোচ হচ্ছে? না ঠিক তা নয়। তবে অত ইতস্তত করছ কেন? চলনা ভিতরে। বলে হাত ধরে প্রায় জোর করে টেনে নিয়ে গেল। আমার কোন প্রতিবাদই সে শুনল না।
বাড়ীতে ওর একটা আলাদা পড়ার ঘর আছে। বাইরে থেকে ঠিক বোঝা যায় না। কিন্তু ঘরগুলো ভীষণ ছিমছাম এবং সুন্দর ভাবে সাজানো। ও আমাকে ওর পড়ার ঘরে বসিয়ে রেখে ভিতরে চলে গেল। একটু পরে এক ভদ্রমহিলা এসে দাঁড়ালেন আমার সামনে। বললেন আমি রেহানার! ও বলছিল তুমি নাকি ভিতরে আসতে চাও নি। কিন্তু কেন? কিসের সঙ্কোচ? আমি আর কি বলব। আমি উঠে ওঁনাকে প্রণাম করলাম, কোন বাধা দিলেন না। ওনার প্রশ্নের উত্তরে বললাম ঠিক তা নয়, আসলে আমার খুব তাড়া আছে। কেন? জানতে চাইলেন ভদ্রমহিলা। আমি বললাম আপনি হয়তো জানেন না। আমি গ্রামের সম্পর্কে এক পিসিমার কাছে থাকি, বলেছিলেন একটু তাড়াতাড়ি ফিরতে তাই আর কি? ভদ্রমহিলা পাশের একটা চেয়ারে বসে বললেন, দাঁড়িয়ে আছ কেন বোসনা। আমি বসলাম। ভদ্রমহিলা বলে চললেন, তোমার কথা শুনেছি রেহানার কাছে। তুমি তোমার এক আত্মীয়ার বাড়ীতে থাক তাও বলেছে আমায়। প্রায় দিনই তোমার কথা বলে। আমার কথা? অবাক হয়ে বলি, কিন্তু ওর সঙ্গেতো কলেজে আমার কোন কথাই হয় না বলতে গেলে। আমার কথা বোজ কি করে বলবে? ভদ্রমহিলা বললেন ও সেই কথাই বলে, যে তোমার সঙ্গে রোজ দেখা হয় অথচ তুমি ওকে এড়িয়ে চল, কোন কথাই বলতে চাওনা। আমি ওকে বলেছিলাম, একদিন ছেলেটাকে নিয়ে আয়না আমাদের বাড়ীতে। ভদ্রমহিলার কথা শুনতে শুনতে আমার বিস্ময় যেন আর কাটেনা। আমাদের কথা বলার মাঝে রেহানা একটা প্লেটে কিছু খাবার এবং চা নিয়ে ঘরে ঢুকলো। কিন্তু আমি যে কেন ওর দিকে সোজাসুজি তাকাতে পারছি না কে জানে? ভদ্রমহিলা বললেন, তোমরা কথা বল, আমি দেখি সেলিনা এখনো আসছেনা কেন? সেলিনা, রেহানার ছোট বোন, আগামীবার উচ্চমাধ্যমিক দেবে।
আমি চুপচাপ বসে আছি দেখে রেহানা বলল, তুমি কি কথা বলবেনা বলে ঠিক করেছ নাকি? চমকে উঠে তাকালাম ওর দিকে। না ঠিক তা নয় আসলে আমি একটা কথা ভাবছিলাম। কি? আমি জানতে চাইলাম তুমি কি রোজ কলেজে যা যা ঘটে সব বাড়ীতে এসে বল?–কেন? না, এমনিই জিজ্ঞেসা করছি। –তবু? মানে মাসিমার তো আমাকে চেনার কথা নয়। তাই ভাবলাম, তুমি না বললে জানবেন কি করে।
ও তাই বল, খিল খিল করে হেসে উঠলো রেহানা আর আমি স্পষ্ট সোজাসুজি তাকলাম ওর দিকে। ওকি লজ্জা পেল? কি জানি। বলল অমন করে তাকিয়ে আছো কেন? নারীর স্বাভাবিক লজ্জায় খানিকটা যেন নুয়ে আসে রেহানা।
লাল রোদ্দুর ফিকে হয়ে ধূসর আঁধার নামার অপেক্ষায়। রেহানার আফরোজ বেগম, তাঁর ঘর থেকে চিৎকার করে বলেছন সেলিনাতো এখনো ফিরলনা, একবার দেখবি রাস্তার মোড়ে গিয়ে? রেহানা বলল কি যে তুমি ব্যস্ত হও রোজ রোজ, ও কবে আর এত সকালে ফেরে? না ফিরলে চিন্তা হয় না। এত চিন্তা করার কি আছে? তোমার মেয়েতো একাই কেবল ফেরেনা তা নয়, ওদের ক্লাসের অনেকেই ফেরেনা।–কেন ফেরেনা কেন? আফরোজ বেগমের কণ্ঠে উদবিগ্নতার ছোঁয়া।–ফিরবে কি করে মা। ওরা ক্লাস শেষ হলে এক জায়গায় পড়তে যায় তাইতো দেরি হয়। ৭টার মধ্যে না ফিরলে আমি যাব যেখানে ওরা পড়ে। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল–কই কি যেন বলছিলে? না কিছু না, বলে চায়ের কাপটা মুখে তুলে নিলাম। আলদা প্লেটের খাবারগুলোও একটু একটু করে খেয়ে নিলাম। তারপর বললাম, আজ তাহলে উঠি রেহানা। আচ্ছা বলে উঠে দাঁড়ায় রেহানা। তারপর বলে, তুমি তো এই পথেই হেঁটে গিয়ে বাস ধর তাইনা?–হ্যাঁ? তাহলে তো যে কোনদিন আসতে পারো? হ্যাঁ তা পারি। তাহলে কাল আসবে বল? চেষ্টা করব। ও আর কিছু বললনা। আমিও বেরিয়ে আসি ওদের বাড়ী থেকে।
অনেক কথাই ওকে জিজ্ঞাসা করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পারলামনা কোন কথাই বলতে। পরের দিন থেকে পারত পক্ষে, ওই রাস্তাটি এড়িয়ে চলেছি। এটা কি ভিতরের কোন ভয়, না আশঙ্কা। তা না হলে ওদের বাড়ীর পাশ দিয়ে কম দূরত্বের সোজা পথ ছেড়ে বেশী দূরত্বের ঘুরপথে বাস স্টজে যাবো কেন? রেহানা বুঝতে পারলেও আমাকে কোন প্রশ্ন করে অস্বস্তিতে ফেলতে চায়নি হয়তো। আজ আবার অন্যমনস্ক ভাবে এই রাস্তায় এসে পড়েছি। সব বাড়ীর আলো জ্বলে উঠেছে। একটু আগে সন্ধ্যার অন্ধকার গম্ভীর হয়ে নেমে এসেছে পৃথিবীতে।
রেহানার ঘরে আলো জ্বলছে। রাস্তার দিকে পিছন ফিরে সামনের মেয়েটির দিকে তাকিয়ে কি যেন বলছে আর হাসছে। এ সময় ওদের বাড়ী গেলে কিছু মনে করবে নাতো! তবু বেল দিলাম। আমাকে বোধ হয় সামনে বসা মেয়েটি আগেই দেখেছে কারণ তা না হলে বেল দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দরজা খুলতো না। মেয়েটি কোন কথা না বলে আমার দিকে তাকিয়ে আছে! নীরবে বোধহয় জানতে চাইছে আমি কে। বললাম, আমি প্রান্তিক, রেহানা আছে? রেহানাও কখন যেন ওর পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। বলল, কি ব্যাপার প্রান্তিক, তোমার শরীর খারাপ? এমন শুকনো শুকনো লাগছে কেন? কলেজতো অনেকক্ষণ ছুটি হয়ে গেছে, এতক্ষণ কোথায় ছিলে? এসো এসো ভিতরে এসো। এক নাগাড়ে এতগুলো প্রশ্ন করায় আমি খানিকটা বিভ্রান্ত। আমার অবচেতন মনে হয়তো রেহানার কথা বারবার মনে হয়েছে। আবার একথাও ঠিক যে সচেতন ভাবে আমি রেহানার কথা ভেবে ওদের বাড়ী আসিনি। তাই খানিকটা ইতস্তত করে বললাম, না আজ থাক রেহানা, আজ আমি একটা বিশেষ প্রয়োজনে এসেছিলাম তোমার কাছে। বেশতো বলনা কি প্রয়োজন? এত লজ্জা করছ কেন? বলল রেহানা। আমি ইতস্তত করছি দেখে সঙ্গের মেয়েটি বলল,–আপা, আমি থাকলে বোধহয় উনি কিছু বলবেন না। আমি বরং চলে যাচ্ছি। ও হাসতে হাসতে চলে গেল ভিতরের দিকে। রেহানা নিজেই বলল, আমার বোন সেলিনা। তুমি ওর কথায় কিছু মনে করোনা। ও ঐ রকমই। অফুরন্ত প্রাণশক্তিতে সারদিনই হৈ হুল্লোড় আর আনন্দে মেতে আছে। তারপর বলল বলনা কি বলবে? আসলে আমি আমার ম্যানিব্যাগটা ফেলে এসেছি, তারপর কলেজ থেকে বেরিয়ে এমন একটা ঝামেলায় জড়িয়ে পড়লাম যে, অনেক দেরি হয়ে গেল। পিসিমা হয়তো ভাবছেন। ও আর কোন প্রশ্ন করল না। জানতেও চাইলনা কিসের ঝামেলা। শুধু বলল, তুমি ভিতরে এসো। আমি সঙ্কোচের সঙ্গে বললাম, এমনিতে অনেক দেরি হয়ে গেছে, ভিতরে গেলে আরো দেরি হয়ে যাবে। আমি বরং এখানে অপেক্ষা করছি। রেহানা ভিতরে গিয়ে আবার ফিরে এলো, তারপর পাঁচটি টাকা আমার হাতে দিয়ে বলল, আশাকরি এতে হয়ে যাবে। আমি ওকে ধন্যবাদ দিয়ে বেরিয়ে এলাম। শুনতে পেলাম সেলিনার কথা রেহানাকে বলছে, বেচারা! তারপর বলল তুইকি জানিস আপা, কড়ি দিয়ে কিনলাম এর সতী, দীপুকে কি বলেছিল? কি? তাও জানিসনা। তবে শোন, সতী বলেছিল, আমি জানি তুমি আমার কাছে কিছু চাইবে কিন্তু সে যে টাকা …। রেহানা ধমক দিয়ে বলে ইয়ার্কি করিসনা সেলিনা ওর কানে গেলে ও কি ভাববে বলতো। সেলিনা উত্তরে কি বলেছিল ভাল করে শোনা গেলনা, তাছাড়া ওদের কথা শুনবার সময়ও আমার নেই। এরপর বাড়ীতে যখন পৌঁছালাম, তার অনেক আগেই পিসি এবং পিসেমশাই অফিস থেকে ফিরে এসেছেন। পিসি বললেন, এত দেরি হল যে, কোথায় গিয়েছিলে? আমি আর কি বলব। খিদেতে পেট জ্বলছে তার সঙ্গে যোগ হয়েছে অপমানের জ্বালা। কোন কথাই বলতে ভাল লাগছেনা, শুনতে তো নয়ই। তবু অন্যের বাড়ী। উত্তরতো একটা দিতেই হবে। বললাম কলেজে ছুটির পরে এক বন্ধুর বাড়ী গিয়েছিলাম, দেরি হয়ে গেছে। পিসি বললেন এতদেরি করবেনা। চিন্তা হয় না? যা তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুয়ে খেতে এস।
ডাইনিং টেবিলে পিসেমশাই পরিমল বাবু আসেননি। পিসি আর আমি অনেকক্ষণ তার জন্য অপেক্ষা করে করে শেষ পর্যন্ত নিজেরা টিফিন খেয়ে উঠে পড়েছি। একবার মনে হয়েছিল আজকের সব ঘটনা খুলে বলি পিসিকে। কিন্তু কেন যেন বলতে পারলামনা। হয়তো লজ্জায় বা ভয়েও হতে পারে।
নিজের টেবিলে পড়তে বসেছি। শুনতে পাচ্ছি পিসেমশাই বলছেন, শেষ পর্যন্ত তুমি কি ঠিক করলে? কিসের? বা সব ভুলে গেলে? তোমাকে তো কয়েকদিন ধরে বলছি। বেশী দেরি করলে সব ভুল হয়ে যাবে। বুঝলাম দেরি করলে ভুল হয়ে যাবে। কিন্তু ব্যপারটি কি? পিসেমশাই বললেন একটা বাচ্চাকে দত্তক নেওয়ার। কিছুক্ষণ চুপচাপ উভয়ে, তারপর ধীরে ধীরে পিসি বললেন, আমার মত নেই। দত্তক যাকেই নাওনা কেন তাতে তোমার রক্তের অধিকার থাকবেনা, আর যেখানে তোমার রক্তের অধিকার থাকছেনা, তাকে আমার পক্ষে মেনে নেওয়া কষ্টকর। তাহলে তুমি কি চাও? আমি যা চাইব তাই তুমি করবে? চেষ্টা করব। তাহলে তুমি আরেকবার বিয়ে কর। নীলু, তোমাকে বার বার বলেছি এ অসম্ভব। কেন তুমি বোঝনা কেন? বুঝি যে না, তা নয়। কিন্তু আমি তোমায় ভালবাসি পরিমল। আমি যে তোমায় পিতৃত্বের স্বাদ থেকে বঞ্চিত করছি, তারজন্য আমার মনের যে অবস্থা তা তুমি বোঝনা। তুমি কি আমায় একটুও বিশ্বাস করতে পারছনা? এটা বিশ্বাসের প্রশ্ন নয় নীলু। বাস্তবতার প্রশ্ন। তারপর বললেন আমি না হয় মেনেই নিলাম, তুমি সব কিছু মেনে নেবে। কোন প্রতিবাদ করবে না। কিন্তু যে আসবে সে যদি তোমাকে মেনে না নেয়? তাতেও আমার দুঃখ থাকবেনা, যদি সে তোমাকে অন্তত ভালবাসে। কিন্তু তার ভালবাসার খেসারত দিতে গিয়ে যদি তোমাকে হারাতে হয়? তাতেও আমার কোন দুঃখ থাকবে না। আমি হাসিমুখে তোমার জীবন থেকে সরে যাবো। পরিমল বাবু বললেন জীবনটাকি এত সহজ ভাবে চলে নীলু? আর তা ছাড়া তুমি তোমার নিজের কথা ভাবছো। আমার কথা এক দম : ভাবছো না। আমার মন যদি তোমাকে হারানো সহ্য করতে না পারে। আগে আগে এসব কথা ভাবছ কেন? আমি যদি তাকে আমার ছোট বোনের মত ভালবাসি, সে কেন আমাকে অস্বীকার করবে? আর যদি করেও সেদিনকার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন ভাবে চিন্তা ভাবনা করব। তুমি না করোনা লক্ষ্মীটি। এ যেন এক নতুন আবিস্কার আমার কাছে। মনে হয় পিসি যেন আত্মত্যাগে এক মহীয়সী নারী।
কেটে যায় আরো বেশ কিছু দিন। একদিন পরিমলবাবু তাঁর এক অফিস সহকর্মীকে নিয়ে বাড়ীতে আসেন। সেদিন আমার কলেজ যাওয়া হয়নি। শরীরটা ভালো ছিল না। পিসি অফিস থেকে ফেরেননি। পরিমলবাবু বললেন, তুমি আজ কলেজে যাওনি প্রান্তিক। না, শরীরটা ভালো নেই। ও ঠিক আছে। তারপর সঙ্গের ভদ্রমহিলার সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, আমার অফিস সহকর্মী, মিনতি সেন, আর এর নাম প্রান্তিক, নীলাঞ্জনার ভাইপো, আমাদের এখানে থেকে পড়াশুনা করে, খুব ভালো ছেলে। মিনতি সেন তাকালেন আমার দিকে। কি ভাবলেন, তা তিনিই জানেন। পরিমলবাবু বললেন, চল ভিতরের ঘরে গিয়ে বসি। মিনতি সেন মৃদু আপত্তি জানিয়ে বলেন, এখানেই বসিনা। তারপর জানতে চাইলেন তা তোমার গিন্নি কখন আসবেন? সাতটা নাগাদ। সাতটা নাগাদ! সে তো অনেক দেরি। না, এতক্ষণ দেরি করা সম্ভব হবে না। আমি বরং আরেক দিন আসব। আমি বুঝতে পারছি না এসময় পরিমলবাবু মিনতি সেনকে নিয়ে বাড়ীতে এলেন কেন? এসময় তো কারো বাড়ীতে থাকার কথা নয়। পরিমলবাবু বললেন, আমার যে তোমার সাথে কিছু কথা আছে মিনতি? প্রান্তিক এখানে বসে পড়াশোনা করছে। ওর পড়াশোনার ডিস্টার্ব হবে, তার থেকে চল ভিতরে গিয়ে বসা যাক। প্রান্তিক এখানে পড়াশোনা করছে এ ব্যপারটা বুঝতে পেরে মিনতি আর কোন রকম দ্বিধা না করে পরিমলবাবুর পিছু পিছু ভিতরের ঘরের দিকে পা বাড়ান।
আমার মনে হলো আমার কলেজে না যাওয়াটা বোধ হয় পিসেমশাই ভাবতে পারেননি। সুতরাং যে কোন অজুহাতে বেরিয়ে পড়াই উচিৎ। কিন্তু কোথায় যাওয়া যায়? সকালে পিসি, কলেজে যাওয়ার খরচ দিয়ে গেছেন। সিনেমায় যাওয়া যেতে পারে। যদিও বলে কোথাও যাওয়াটা পিসির পছন্দ নয়। তবু বেরিয়ে পড়ি আমি। যাওয়ার আগে পিসেমশাইকে বলে যাই, আমি একটু বেরুচ্ছি। কোথায়? আমার এক বন্ধু কিছু কলেজ নোট দেবে বলেছিলো, ওখানেই যাব। কখন ফিরবে? তাড়াতাড়ি ফিরে আসব। ভিতর থেকে মিনতি সেন বেরিয়ে এসে বললেন, আপনি কোনদিকে যাবেন? বললাম, কলেজ স্ট্রীটের দিকে। একটু দাঁড়ান আমিও যাব। তারপর পরিমলবাবুকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আজ আমি আসি পরিমল। তোমার বাড়ীতে চিনেই গেলাম, এরপর একদিন একলাই চলে আসব।
বুঝতে পারছি এই ফাঁকা ঘরে অস্বস্থি বোধ করছেন মিনতি সেন। তবু বললাম, আপনি একটু অপেক্ষা করে যাননা। পিসির সঙ্গে দেখা করে যান। উনি বললেন, সে আরেকদিন হবে ভাই। আপনি একটু দাঁড়ান, উনি ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন আমার সাথে, পরিমলবাবুর কোন অনুরোধকে গুরুত্ব না দিয়েই।
রাস্তায় এসে বললেন, আপনি কলেজ স্ট্রীট কোথায় যাবেন? আমি তাঁকে বাধা দিয়ে বললাম। আমাকে তুমিই বলবেন। বেশ তাই হবে। ওখানে তুমি কোথায় যাবে? হিন্দু হোষ্টেলে যাব। বেশ যেও, আপাতত চলল না সামনের ওই রেস্টুরেন্টটায়, বেশ খিদে পেয়েছে। আমি ইতস্তত করছি দেখে উনি বললেন লজ্জা করছে? না ঠিক তা নয়? তাহলে? বেশ চলুন।
সামনের জলযোগ রেস্টুরেন্টে ঢুকে একটা কেবিনে আমরা আমাদের জায়গা করে নিলাম। উনি বললেন কি খাবে? আমার একদম খিদে পায়নি। আপনি যা খাবেন খান, আমি আপনাকে সঙ্গ দিচ্ছি।
উনি দুটো মোগলাই পরটা এবং দু কাপ কফির অর্ডার দিলেন। কাটা চামচ দিয়ে মোগলাই টুকরো করতে করতে জিজ্ঞাসা করলেন, নীলাঞ্জনা তোমার কেমন পিসি? সত্যি কথাই বললাম, আমাদের একই গ্রামে বাড়ী সেই সম্পর্কে পিসি,–তাহলে নিজের নয়? না। এখানে তোমার আর কোথাও থাকবার জায়গা নেই? ঠিক জানি না, তবে প্রথম থেকেই তো এখানে আছি, অসুবিধাতো কিছু নেই।
উনি বোধ হয় বুঝতে পারছেন, এত কৌতূহল বোধ হয় ঠিক হচ্ছেনা। তাই বললেন, তুমি কিছু মনে করো না ভাই, আসলে চুপচাপ বসেতো খাওয়া যায় না, তাই কিছু বলা দরকার বলেই বলা। আমি বললাম, না আমি কিছু মনে করছিনা, আপনি যা কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারেন।
উনি বললেন, আমার সম্পর্কে তোমার জানতে ইচ্ছে করেনা কে আমি? কেন এসেছিলাম আর কেনই বা তোমার সঙ্গে চলে এলাম।
হঠাৎ বাইরের দিকে চোখ পড়তে দেখি অশ্রুকণা ও অনুতপা। একটাও কেবিন খালি নেই তাই ওরা দাঁড়িয়ে আছে। আমি ওদের ডাকতে গিয়েও চুপ করে গেলাম। মিনতি সেন বললেন ওরা কারা? আমার কলেজ বন্ধু। ডাকনা ওদের। এই কেবিনেতো চারজনের সিট, আমরা তো দুজন। কেন ওরা দাঁড়িয়ে থাকবে?
কিন্তু ডাকতে আর ওদের হল না। আমাকে দেখতে পেয়ে হাসতে হাসতে আমাদের কেবিনের সামনে এসে দাঁড়ালো। আমি বললাম ভিতরে এসো। তারপর মিনতি সেনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললাম, আমার পিসি মিনতি সেন। আর ওরা অশ্রুকণা এবং অনুতপা। মিনতি সেন বললেন বা সুন্দর নাম তো তোমাদের অশ্রুকণা, আর অনুতপা। ওরাও হাসতে হাসতে বলে, আপনার বিচারটা বড্ড এক পেশে পিসি ওর নামটাও কি রোমান্টিক তাইনা? কি সুন্দর নাম প্রান্তিক রায়। আর সঙ্গে সঙ্গে সকলে একসঙ্গে হেসে উঠলো এবং ভিতরে এসে বসল। মিনতি সেন বেল বাজিয়ে আরো ২টো মোগলাই এবং কফির অর্ডার দিলেন।
আস্তে আস্তে জানা গেল অনুতপা এবং মিনতি সেন দক্ষিণ কলকাতার ঢাকুরিয়ার দিকে থাকেন। তারা এক সময় উঠে পড়লো। আমি কাছেই থাকি, অশ্রুকণাকে ওখানে থেকে বাসে বরানগরের দিকে যেতে হবে। তখনো সন্ধ্যে হতে ঢের বাকি। অশ্রুকণা জিজ্ঞাস করলো, আজ কলেজ যাওনি কেন? তুমি কি করে জানলে আমি কলেজ যাইনি? বা এতে জানাজানির কি আছে? তুমি যাওনি এতো আর মিথ্যে নয়। না ঠিক তা বলছিনা, তোমার খোঁজ করছিলাম, তাই জানতে পারলাম। আমার খোঁজ করছিলে? কেন? এমনি। যা এমনি এমনি কেউ কাউকে খোঁজ করে নাকি? বলে হাসতে থাকি আমি।
হঠাৎ কথা ঘুরিয়ে অশ্রুকণা বলল, তোমার পিসি কিন্তু সুন্দর। সুন্দর না সুন্দরী? দুটোই।–তার মানে? সুন্দর তার মন, আর সুন্দরী তিনি রূপে? বিয়ে করেননি কেন? বলছিলেন, কোথায় যেন চাকরি করেন, কোথায় চাকরি করেন?–এক মার্চেন্ট ফার্মে। তারপর বললাম আচ্ছা অশ্রু…ও আমাকে বাধা দিয়ে বলল না না অশ্রু নয়, আমায় তুমি কণা বলেই ডেকো! তারপর বলল চল বেরিয়ে পড়ি। উত্তরে বললাম বেশ চল। তারপর লাজুক হেসে বললাম, কণা তুমিও কিন্তু খুব সুন্দর। ও শুধু বলল ধ্যাৎ, বাসস্টান্ডে এসে ওকে বাসে তুলে দিলাম। বাসটা ফাঁকাই ছিল। উঠেই বসতে পেরেছিলো। বলল, কাল কলেজে আসছে তো! হ্যাঁ যাবে। বাসটা ছেড়ে দিল।
কে এই মিনতি সেন? কেন এসেছিলেন তিনি? আর এলেন যখন, তখন আবার আমার সঙ্গে চলে এলেন কেন? তবে একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে মিনতি সেন সত্যি সুন্দরী। আর তার সৌন্দর্যে আছে অন্যকে আপন করে নেওয়ার এক মাদক আকর্ষণ। পরিমলবাবু বলেছেন, তিনি তার সহকর্মী। তাই-কি? কি জানি। পরিমলবাবুকে যেন এখন আর ততটা বিশ্বস্ত মনে হয় না।
আমাকে একা পেয়ে নীলাঞ্জনা পিসি বললেন, কাল তোমার পিসেমশাইয়ের এক অফিস কলিগ এসেছিলেন। আর এসেই তোমার সঙ্গে বেরিয়ে গেলেন। উনি কে? আমি অবাক হয়ে তাকাই পিসির দিকে। বললাম, বললেন তো একই অফিসে কাজ করেন। তা তোমার সঙ্গে বেরিয়ে গেলেন যে বড়! তুমি নিশ্চয়ই আগে চিনতে! সন্দেহ তার কণ্ঠে। একে? এই কি সেই নীলাঞ্জনা পিসি যিনি তার স্বামীকে দ্বিতীয়বার বিয়ে দিতে উঠে পড়ে লেগেছেন, শুধু একটা নতুন শিশুর জন্য। আমি বললাম, আমার সঙ্গে আগে কোন পরিচয় ছিল না। তবে আমার কলেজ স্ট্রীটের দিকে যাওয়ার কথা শুনে বললেন, উনিও যাবেন। আমি অবশ্য দেরি করে তোমার সঙ্গে দেখা করে যেতে বলেছিলাম। কিন্তু তিনি বললেন, পরে একদিন আসবেন।
পিসি আর বেশী কথা বাড়ালেন না। শুধু বললেন এলেনই যদি একটু দেরি করতে পারলেন না।
অনুমান করতে পারি মিনতি সেনকে নিয়ে স্বামী-স্ত্রীতে একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। এতে আমার পিসিকে খুব একটা দোষী মনে হয় না। কারণ পরিমলবাবুর যদি মনে কোন ইচ্ছে থেকেও থাকে তা স্পষ্ট করে বলতে পারতেন। তা না করে তিনি যেমন গোপনে তাকে নিয়ে এলেন এবং মিনতি সেনও আসতে রাজী হয়ে গেলেন তা ঠিক স্বাভাবিক পর্যায়ে পড়ে না।
দিনকয়েক পরে নীলাঞ্জনা পিসি একদিন মিনতি সেনকে অফিসে ফোন করেন। মিনতি সেন সেদিন অফিসে আসেননি। এবং কবে আসবেন তা জানাতে পারেননি। সন্দেহ ঘনীভূত হয়। কারণ গতকালই পরিমলবাবু ৭ দিনের জন্য অফিসের কাজে বাইরে গেছেন।
রাতে পিসি জানতে চাইলেন আমি মিনতি সেনের বাড়ী চিনি কিনা বা তার ঠিকানা জানি কি না? বললাম বাড়ী চিনিনা, তবে ঠিকানা জোগাড় করে দিতে পারি। কিভাবে? আমাদের এক সহপাঠি ওদের ওদিকে থাকে আর মিনতি সেনকেও চেনে। কি নাম? অনুতপা। একদিন নিয়ে আসবে ওকে? পিসি যেন একটা ফয়সালা চান এ ঘটনার।
পরের দিন কলেজে গিয়ে জানলাম, অনুতপা কলেজে আসেনি। কিন্তু অনুতপাকে আমি খুঁজছি এই সামান্য ব্যাপার নিয়ে অনেক আজে বাজে আলোচনা আরম্ভ হয়ে গেল। এরই মাঝে অশ্রুকণা এগিয়ে এসে বলল তুমি ওকে খুঁজছিলে কেন?
আলোচনা এমন একটা বিশ্রী আর কদৰ্য্যরূপ নিয়েছে যে, আমার কারো কথা শুনতে ভালো লাগছিল না। বললাম, প্রয়োজন আছে তাই। আমার কণ্ঠে উম্মা প্রকট হয়ে ওঠে। অশ্রুকণা কিন্তু রাগল না। বলল তোমার এই গেঁয়ো গোঁয়ারতুমি আমার একদম ভালো লাগে না প্রান্তিক। আমি বিশ্বাস করি অনুতপাকে তোমার সত্যি কোন দরকার আছে। আমাকে বলা যায় না কি দরকার। সত্যিকারের সহমর্মীর মতো জানতে চায় অশ্রুকণা।
না, এর মধ্যে তো কোন কৌতূহল নেই, নেই কোন কুটিলতা। বললাম, ওকে একবার আমার পিসির প্রয়োজন তাই। এবার অবাক চোখে তাকালো অশ্রুকণা। বলল, কে? মিনতি সেন? আমি বেফাঁস বলে ফেললাম, তুমি ওকে চেন নাকি? বা তুমিই তো সেদিন পরিচয় করিয়ে দিলে উনি তোমার পিসিমা, অনুতপাদের ওদিকেই তো থাকে না। অনুতপা কয়েকদিন ধরেই কলেজে আসছে না। জ্বর হয়েছে। যাবে নাকি? আমি যাচ্ছি ওকে দেখতে।
কি যেন ছিল অশ্রুকণার এই আবেদনে। আমি না করতে পারলাম না।
ওদের ওখানে যখন পৌঁছালাম তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। অনুতপা বোধ হয় ভাবতেই পারেনি আমরা ওদের ওখানে যেতে পারি। ওর জ্বর কমেছে। কাল স্নান করেছে। শরীর বেশ কাহিল, খুবই ক্লান্ত লাগছিল ওকে দেখে। ওর বাবা অফিস থেকে ফেরেননি। দাদা কেন্দ্রীয় সরকারে চাকরি নিয়ে বাইরে থাকেন। বাড়ীতে শুধু ওর মা আছেন। আমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় অনুতপা। বলে আমার যে কি ভাল লাগছে তোমরা এসেছো বলে। কদিন বাড়ীতে থেকে একেবারে হাঁফিয়ে উঠেছি। মনে মনে শুধু ভেবেছি তোমরা কেউ এলে ভাল লাগতো। তোমাদের কাউকে যে সংবাদ দেব সে উপায়ও নেই। তা তোমরা জানলে কি করে? অশ্রুকণা বলে আজই সংবাদ পেলাম। প্রশান্ত বলেছে। প্রশান্ত? নামটা অশ্রুকণার মুখে শুনে অবাক হয় অনুতপা। প্রশান্তকে তো চেনার কথা নয় অশ্রুকণার। তবু সেটা আচরণে প্রকাশ না করে বললো, ওর সঙ্গে তোমার দেখা হল কোথায়? কি একটা কাজে আজ কলেজে গিয়েছিলো। হঠাৎ মনে হল তোর সংবাদ ও জানতে পারে। তাই জিজ্ঞাসা করাতে বললো, তোর বেশ কয়েকদিন ধরে জ্বর।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অনুতপা বলে, অথচ দেখ, আমার বেশ কয়েকদিন ধরে জ্বর এ সংবাদ রাখে অথচ একবার আসতে পারেনা। এরা সব এই রকমই। অনুতপার মা আমাদের জন্য মিষ্টি নিয়ে আসেন। বলেন, তোমরা কলেজ থেকে আসছ এই মিষ্টিটা খেয়ে নাও। আমি তোমাদের জন্য খাবার করছি। আমরা না না করে উঠলাম। কিন্তু উনি তখন আর ওখানে নেই।
অশ্রুকণা বলল, আমরা যদি আগে জানতে পারতাম অবশ্যিই আসতাম। যাকগে সে কথা। এ কদিনে কি কেউ আসেনি? অনুতপা বলে, একবোরে কেউ আসেনি বলা ঠিক হবে না, প্রান্তিকের পিসি মিনতি সেন এসেছেন একদিন অন্তর একদিন। অফিস থেকে ফেরার পথে যেদিনই এসেছেন, ফল ইত্যাদি নিয়ে এসেছেন। বসতেন বেশ কিছুক্ষণ। অনেক গল্প করে আবার ফিরে যেতেন। আমি অবাক হয়ে তাকাই অনুতপার দিকে। অশ্রুকণা বলে, কি এত গল্প করেন উনি? তার কলেজ জীবনের কথা। সেদিন ছেলেরা কি ভাবে ওনাদের পিছনে লাগতেন এইসব আর কি? তোদের বাড়ীর কাছে থাকেন বুঝি! এইতো মোড়টা ঘুরলে ২৫/২ নং বাড়ীতে। মিনতি পিসি যে এত ভালো, পরিচয় না হলে বুঝতেই পারতাম না। তারপর আমার দিকে ফিরে বললেন, সত্যি প্রান্তিক তোমার প্রতি আমার কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ তোমার পিসির সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য। উনি শেষ কবে এসেছিলেন, জিজ্ঞাসা করে অশ্রুকণা। এই তো কালকেই এসেছিলেন। তার মানে আজ আর আসবেনা। তারপর আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, চল না প্রান্তিক আমরা তোমার পিসির ওখান থেকে ঘুরে আসি। আমি বললাম আজ থাক কশা, বাড়ীতে চিন্তা করবে। মনে মনে হিসাব মিলিয়ে নিয়েছি পরিমলবাবুর সঙ্গে মিনতি সেন যাননি। অনুতপা বলল, সে কি কথা প্রান্তিক, আমাদের এখানে এসে না গেলে উনি জানতে পারলে দুঃখ পাবেন। হয়তো মনে মনে আমাকেই দায়ী করবেন যে আমিই তোমাকে যেতে দিইনি।
অগত্যা যেতে হয়। সত্যি খুব কাছেই মিনতি সেনদের বাড়ী। ছোট্ট বাড়ী। কিন্তু বেশ সাজানো গুছানো। আমরা বেল দিতেই এক বুড়ো মতো ভদ্রলোক বেরিয়ে আসেন। জানিনা ভদ্রলোক মিনতি সেনের কে হন। কিন্তু ঠিক পিছনে পিছনে মিনতি সেন আমাকে দেখতে পেয়েই ভদ্রলোককে বললেন, বাবা, তুমি আবার উঠে এলে কেন? আমি তো আছি, যাও তুমি ভিতরে যাও। তারপরে আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন–প্রান্তিক ভালো আছো। তো? পাশে অশ্রুকণাকে দেখে বললেন, তুমিও ভালো আছো তো অশ্রু? ও এগিয়ে গিয়ে মিনতি সেনকে প্রণাম করতে গেলে মিনতি সেন বাধা দিয়ে বললেন, এসব কি করছ? বা গুরুজনদের প্রণাম করব না?
আমরা ভিতরে গিয়ে বসলাম। মিনতি সেনকে জিজ্ঞাসা করলাম কাল অফিসে যাননি? না কেন বলো তো। এমনি? এমনি এমনি তো কিছু হয় না প্রান্তিক? তারপর বললেন কাল কি আমাকে খুঁজতে আমার অফিসে গিয়েছিলে? না তবে নীলাঞ্জনা পিসি আপনাকে কাল অফিসে ফোন করেছিলেন। কেন? তাতো জানিনা। খুব দরকার বুঝি? তারপর অবশ্য বললেন, আমাকে তো আগে কখনো ফোন করেনি। ঠিক আছে আমি কাল অফিসে যাব। যদি খুব দরকার থাকে আমাকে ফোন করতে বলল। তারপর অশ্রুকণার দিকে ফিরে জানতে চাইলেন তোমরা আমার কাছে এসেছে না অন্য কোথাও গিয়েছিলে? অশ্রুকণা বলল, আসলে কদিন ধরে অনুতপা কলেজে যাচ্ছেনা তো, তাই প্রান্তিককে বললাম, তোমার পিসি তো ঐ দিকেই থাকেন, চলনা, অনুতপাকেও দেখা হবে, আবার তোমার পিসির বাড়ী থেকেও ঘুরে আসা যাবে।
আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠতে দেখলাম মিনতি সেনের ভাসাভাসা দুটি চোখকে। বললেন খুব ভালো করেছে। আমি একদিন অন্তর একদিন ওদের বাড়ীতে গেছি। কথায় কথায় জিজ্ঞাসা করেছি তোমার কলেজ বন্ধুরা কেমন? এতদিন কলেজ যাচ্ছনা, অথচ কেউ তো তোমাকে দেখতে এলনা। আমাদের সময়ে আমরা এত অবাধ মেলামেশা করতে পারতাম না ঠিকই কিন্তু কেউ আমরা হঠাৎ অনুপস্থিতি হয়ে গেলে কেউ না কেউ ঠিকানা খুঁজে খুঁজে উপস্থিত হয়ে যেতাম। তারপর ওকে জিজ্ঞাসা করলাম প্রান্তিককে সংবাদ দেব?
অনুতপা বারণ করেছিল, তাই আর তোমাদের সংবাদ দেওয়া হয়নি। এবার তো আমার বাড়ী চেনা হয়ে গেছে মাঝে মাঝে এস কিন্তু। এটা ওটা কথা বলতে বলতে মিনতি সেন আমাদের জন্য খাবার তৈরি করলেন, কফি দিলেন, অনেক অনুরোধে মিষ্টিও খেতে হল। যতক্ষণ ওবাড়ীতে ছিলাম মিনতি সেন বেশীক্ষণ অশ্রুকণার সঙ্গেই কথা বললেন আমার সঙ্গে সামান্য ২/১ টি কথা ছাড়া প্রায় এড়িয়েই চললেন। জানিনা কেন মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল, তবে পরে ভেবেছি, মিনতি সেনের এই ব্যবহারের পিছনে একটা কারণ ছিল, এবং তা যথেষ্ট যুক্তি গ্রাহ্য।
পথে বেরিয়ে এসে অশ্রুকণা বলল, তোমার পিসি এত সুন্দর যে আমার কি মনে হয় জান?–কি? আমি উৎসুক দৃষ্টিতে তাকাই ওর দিকে। ও বলে, আমি যদি ছেলে হতাম, নির্ঘাৎ ওর প্রেমে পড়ে যেতাম। আমি হাসতে হাসতে বললাম, ভাগ্যিস মিনতি সেন আমার পিসি, কিন্তু তা না হয়ে যদি মিনতি সেন আমার কাকু হতেন তবে নির্ঘাৎ কপালে দুঃখ ছিল। ধ্যাৎ বলে চোখে যে কটাক্ষ হেনে তাকালো আমার দিকে, তাতেই আমার অবস্থা কাহিল। আমি আর কোন কথা বলতে পারলামনা। বাস স্টান্ডে দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের নর্থের বাস আর আসছে না। আস্তে আস্তে রাত বাড়ছে। বাড়ীর লোকেরা নিশ্চয়ই চিন্তা করছে। অশ্রুকণা বলল, না বাস আর আজ আসবে না, চল বরং ট্রেনেই ফিরে যাই। অগত্যা আমরা আবার হাঁটতে হাঁটতে রেল স্টেশনের দিকে এগিয়ে চললাম। অশ্রুকণা বলল, আমার কি মনে হচ্ছে যান?–কি? যদি আমাদের এই পথ চলা আর শেষ না হতো। আমি হেসে উঠলাম। হাসলে যে! না ভাবছি তোমার এই স্বপ্নের খেয়া কোথায় গিয়ে শেষ হবে। ওকে দেখে খুব চিন্তিত মনে হল, তাই জানতে চাইলাম, তোমার কি হয়েছে বলতো কণা? ও আমার কথার কোন উত্তর না দিয়ে গুন গুন করে গেয়ে উঠলো আমার এই পথ চলাতেই আনন্দ, গানটা ভারি সুন্দর, বাধা দিতে পারলামনা। অবাক হয়ে ভাবছিলাম, এমন জনারণ্যের মাঝে যে এমন গাইতে পারে, না জানি সুর তার হৃদয়ের কোন উৎস থেকে উৎসারিত হয়। কিন্তু পথ যে সামান্য। আর সামান্য পথ বলেই হয়তো পথ শেষ না হওয়ার এই আকুলতা। প্লাটফরমে ঢুকতেই শিয়ালদহ গামী ট্রেন এসে দাঁড়ালো। টিকিট কাটার কোন অবকাশই হয় না। বিনা টিকেটেই ট্রেনে উঠে পড়ি।
বাড়ীতে যখন ফিরেছি তখন রাত ১০টা বাজে। নীলাঞ্জনা পিসি এঘর ওঘর করছেন। আমাকে দেখে আশ্বস্ত হলেন ঠিকই, কিন্তু ক্ষেপে গেলেন তার থেকে বেশী। বললেন এমন ইচ্ছেমত যদি চলতে চাও তাহলে যেখানে খুশী যেতে পারো। প্রান্তিক আমার এখানে তোমার থাকার দরকার নেই। ভেবে দেখেছে কিছু একটা হয়ে গেলে গ্রামের বাড়ীতে কি জবাব দেব?
অত্যন্ত কঠিন আঘাত সন্দেহ নেই, তবু কিছু বলতে পারলামনা। কারণ আমার বার বার মনে হয়েছে আমাকে আঘাত দেওয়া তার উদ্দেশ্য নয়। আমার জন্য যে তার সীমাহীন দুশ্চিন্তা তাই ফুটে উঠেছে তার দেওয়া আঘাতের মধ্য দিয়ে। আমি চুপ করে তার বকুনিকে মেনে নিলাম।
খাওয়ার টেবিলে জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায় গিয়েছিলে? আমি বললাম তোমাকে জানতেই হবে? বা আমাকে জানতে হবে না, এত রাত পর্যন্ত তুমি কোথায় কি করে বেড়াচ্ছ? একটা কিছু হয়ে গেলে তো আমাকেই কৈফিয়ত দিতে হবে। আমি সত্যি কথা বলব কিনা ভাবছি, উনি আবার বললেন কি হল, জবাব দিচ্ছনা কেন? আমি বললাম তোমাকে বলব কিনা তাই ভাবছি। এমনকি গোপন কথা যা আমাকে বলা যাবে না। আমি পিসিকে রাগিয়ে দেওয়ার জন্য বললাম, আমি তো বড় হয়েছি পিসি। কিছু গোপনতা তো আমার থাকতেই পারে। পিসি কি বুঝলেন কে জানে। বললেন, লুকিয়ে লুকিয়ে জল খাওয়া হচ্ছে? ওসব চলবেনা আমি স্পষ্ট বলে দিচ্ছি।
নারী মনের কৌতূহল, সব বয়সেই তা একই রকম। ঈশ্বর বোধ হয় এই সীমাহীন কৌতূহল দিয়েই তাদের পাঠিয়েছেন। আস্তে আস্তে আমার বিছানায় এসে বসলেন উনি। আমি নিবিষ্ট মনে বইয়ের পাতায় ডুবে গেলাম। যদিও জানি একটা লাইনও আমার মাথায় ঢুকছেনা। আড়চোখে একবার তাকালাম পিসির দিকে। পিসি সুন্দরী। প্রায় ১০ বছরের বিবাহিত জীবনে শরীরের কোথাও এতটুকু টোল খায়নি। পাশাপাশি মিনতি সেন। কে বেশী সুন্দরী। অশ্রুকণার কথায়, যদি সে ছেলে হতো তাহলে সে মিনতি সেনের প্রেমে পড়ে যেতো। আসলে এই কথা বলে সে কি বোঝাতে চাইছে, সেকি চাইছে আমি যেন মিনতি সেনের সঙ্গে আর না মিশি? কেন যে ছাই মিনতি সেন আমার পিসি এই পরিচয় দিতে গেলাম ওদের কাছে। আমি তো বলতেই পারতাম আমার পিসির বন্ধু বা অন্য কিছু। কিন্তু এখন যা হয়েছে তাতে আর ফিরিয়ে নেওয়া যাবে না।
পিসি বললেন, বই পড়ছ না পাতার পর পাতা উল্টিয়ে যাচ্ছো? বললাম পড়ছি তো। ছাই পড়ছে। তার চেয়ে শুয়ে পড়। বললাম ঘুম আসছেনা। কথা লুফে নিয়ে পিসি বললেন সারাদিন এই রকম টোটো করে ঘুরলে কি আর ঘুম আসবে? না আসলে কি করব? শুয়ে শুয়ে ভেড়া গোন দেখবে এক সময় ঠিক ঘুম এসে যাবে। আমি বললাম, তুমি ঘুমাচ্ছনা কেন? আমারও ঘুম আসছেনা।–কেন তোমার ঘুম আসছেনা কেন? তুমিতো আর সারাদিন আমার মতো টোটো করে ঘোরনি। পিসি বললেন আমার যে কেন ঘুম আসছেনা
সে তুমি বুঝবে না প্রান্তিক। আমার মত অবস্থায় পড়লে হয়তো বুঝতে পারতে। বড় অসহায় মনে হয় পিসির কণ্ঠস্বর। উত্তরে বললাম না তা হয়তো ঠিক বুঝব না, পিসি, তবে খানিকটা অনুমান করতে পারি। কি অনুমান করতে পারো? বললাম, তোমার অসহায়তা, তোমার নিঃসঙ্গতা, তোমার আশা ও কামনার দোদুল্যমানতা। কিন্তু পিসি মিথ্যে দুশ্চিন্তা করে কিছু লাভ হয়কি? তুমি যা ভাবছ তা হয়তো সত্যি নয়, অথচ মিথ্যে ভেবেই তুমি হয়তো তোমারই ক্ষতি করছ। সব কিছুকে স্বাভাবিক ভাবে গ্রহণ কর, দেখবে কোথাও কোন অসুবিধা নেই। মনেও শান্তি পাবে।
অবাক হয়ে তাকান নীলাঞ্জনা পিসি আমার দিকে। আমি যে এমন কথা বলতে পারি তা উনি ভাবতেই পারেননি। উনি কাত হয়ে আমার বিছানায় শুয়ে পড়েছিলেন এবার উঠে বসলেন। বললেন, তুমি কাউকে ভালোবাস প্রান্তিক। বললাম হ্যাঁ? কাকে? আমার পরিচিত যারা, সকলকে। আমি তা জানতে চাইনি প্রান্তিক, আমি শুধু জানতে চাইছি এই সকলের মধ্যে আলাদা করে কাউকে ভীষণ আপন করে ভালবাস কি না। হঠাৎ পিসির এ ধরনের প্রশ্নে অবাক হয়ে যাই।
কি বলব। আমার জীবনে তখনো আসেনি ভালোবাসার কোন আলাদা আকাঙ্খ। স্পষ্ট করে ছুঁয়ে যায়নি হৃদয়কে কেউ। বুঝতে পারি অশ্রুকণা বা রেহানা একটু আলাদা দৃষ্টিতে দেখে আমাকে। আলাদা করে কথা বলতে আনন্দ পায়। কিন্তু তাকে ভালোবাসা বলে কিনা জানিনা। অন্তত আমি নিজে ওদের কাউকে আলাদা করে ভাবিনি এখনো। তাই পিসিকে ভড়কে দিতে বললাম, আমার এই ছোট্ট জীবনে একজনকে আমি ভীষণ ভাবে ভালোবাসি পিসি, যদি তাকে ভালোবাসা বলে। কাকে জানতে চান নীলাঞ্জনা। আমি বলে চললাম যেন আমাকে বলার নেশায় পেয়েছে এমনি ভাবে। তার কথা আমি প্রতি মুহূর্তে ভাবি, তার হাসি আমাকে হাসায়, তার কান্না আমাকে কাঁদায়। তার দুশ্চিন্তা আমার কাছে বোঝার মত মনে হয়। তার নিঃসঙ্গতাকে পারলে কানায় কানায় ভরে দিতে ইচ্ছে হয়। তার চপলতায় আমি চঞ্চল হই। তাকে বুঝতে চাই, কিন্তু বুঝতে পারিনা। তাকে ধরতে চাই, যদিও ধরা ছোঁয়ার বাইরে তার অবস্থান। কখনো তাকে মনে হয় বন্ধু, কখনো বা শুভাকাঙ্খী, কখনো বা আপন মনে কথা বলি তার সাথে, সান্ত্বনা দিতে চাই তার সব হারানো ব্যথার জায়গায়, তবু তাকে দূরের বলে মনে হয়। কখনো মনে হয়না, নিজেকে তার যোগ্য বলে। নীলাঞ্জনা পিসি অবাক আর বিস্ময় ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকান আমার দিকে। মনে হয় তার মনে কিসের যেন এক ঢেউ খেলে যাচ্ছে। আমার এমন গুছিয়ে কথা বলাতে অবাক হন ভীষণ। জানতে চাইলেন কে সেই ভাগ্যবতী যে তোমার এতটা সময় চুরি করে নিয়েছে। তোমার জীবন থেকে। কণ্ঠে কি হতাশা না কৌতূহল? আমার ভীষণ মজা লাগছে পিসির এই অসম কৌতূহলের জন্যে। তাকিয়ে দেখি তার বুকের ওঠা নামা। চোখের পরে চোখ রেখে বললাম, সত্যি তোমাকে জানতে হবে পিসি? অভিমানী কণ্ঠে বললেন, যদি বিশ্বাস করতে না পার নাইবা বললে। আমি চুপ করে আছি দেখে বললেন, তার মানে আমাকে তোমার বিশ্বাস হয় না। তা তুমি আমায় বিশ্বাস না করলেও আমি জানি কে তোমার শুধু মনটাই নয় জীবনটাই ধরে নাড়া দিয়েছে। আমার কৌতূহল আরো বেড়ে যায়। বলি বলতো কে? পিসি হাসতে হাসতে বলল রেহানা। এবার আমার অবাক হওয়ার পালা। রেহানা বা অশ্রুকণার নাম পিসি শুনে থাকতে পারেন, তাই বলে তাদের মধ্যে রেহানা আমার জীবনে জড়িয়ে আছে, এমন কোন ঘটনা ঘটেছে বলেতো মনে করতে পারছি না। আমি বললাম এ তোমার অলীক কল্পনা পিসি। তাছাড়া রেহানা নামের মেয়েটিকে তুমি দেখওনি। তার কোন কথা তোমার সাথে কোন দিন বলেছি বলেও তো মনে হয়না। আমার মুখের কথা লুফে নিয়ে পিসি বললেন, সেই জন্যইতো আমার মনে হয়–রেহানা আছে তোমার জীবনব্যাপী। আর এমন নিবিড় তোমাদের সম্পর্ক যে, গোপনতার সেই মধুরতা তুমি কাউকে প্রকাশ করতে চাওনা। না হলে তুমি তোমার কলেজের কত ছেলে বন্ধু মেয়ে বন্ধুর কথা বল, কিন্তু কোনদিনই রেহানার নাম ভুলেও উচ্চারণ করো না, কিন্তু কেন? সেকি তোমার একান্ত একার বলে? হাসতে থাকেন নীলাঞ্জনা পিসি ভাসা ভাসা চোখ দুটি কৌতূকে উজ্জ্বল।
আমি হাতড়িয়ে দেখি কথাটা হয়তো সত্যি। আসলে রেহানার সাথে আমার সম্পর্ক কেমন জানিনে। কথাও বেশী হয় না নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া। বললাম, বেশ তোমার কথাই সত্যি, আমি তার কথা তোমাকে বলিনা, অবশ্যি বলার কিছু নেই বলেই বলিনা, কিন্তু তুমি তার নাম জানলে কি করে। হাসছেন পিসি। এই সঘন রাতের আলো আধারিতে পিসি যেন মায়া লোকের অঙ্গরির মত। হাসলে এত সুন্দর দেখায় পিসিকে। নিকষকালো ঘণ এলায়িত চুল, দুই ভূর মাঝে সবুজ টিপ, দেহের কোন অংশেই নেই বাহুল্য মেদ, সঙ্গে সুউন্নত পীন পয়োধর, এক নেশা জাগানো আকর্ষণ যেন, অথচ কেবল ভালোলাগা ছাড়া সে আকর্ষণের অন্য কোন ভূমিকা নেই।
হঠাৎ মনে পড়ে যায় মিনতি সেনের কথা, মিনতি সেন সম্পর্কে নীলাঞ্জনা পিসি যা ভাবেন তা সত্যি কিনা জানিনা। অন্তত আজ পর্যন্ত মিনতি সেনের কোন আচরণে এমন কিছু ধরা পড়েনি, যাতে অন্য কিছু ভাবা যায়, শুধু এক অপরাহ্নে পরিমল বাবুর সাথে তার অকারণ আগমন ছাড়া। যদিও প্রশ্নটা থেকেই যায়, শূন্য বাড়ী জেনেও তিনি কেন এসেছিলেন পরিমলবাবুর সাথে?
অকারণ কৌতূক যেন উপছে পড়ছে নীলাঞ্জনা পিসির চোখ দিয়ে। বললেন, কি দেখছ ওমন করে আমার দিকে তাকিয়ে। ভেবে দেখলাম চোখ যদি হঠাৎ নামিয়ে নিই, ভুল মানে হতে পারে। বললাম তেমনি চোখের পর চোখ রেখে, পিসি তুমি এত সুন্দর না, আগে কোন দিন ভাল করে দেখিনি তোমায়।
নীলাঞ্জনা পিসি নারী। নারীর স্বাভাবিক ধর্ম তার লজ্জা,তাকে তিনি অস্বীকার করবেন কি করে? তাছাড়া কোন নারীকে যদি কোন পুরুষ, সে যে বয়সেরই হোকনা কেন, সুন্দর বলে, তাহলে একটা গোপন অনুভূতি তার হবেই। কিন্তু আমার এ স্তুতিতে মনে হয় তার চিন্তা অন্য খাতে বইতে আরম্ভ করে। বললেন প্রান্তিক, আমার সুন্দরের বয়স আমি পেরিয়ে এসেছি অনেক আগে। হয়তো তুমি আমার মাঝে অন্য কাউকে খুঁজে বেড়াচ্ছো, তাই এত ভালো লেগে গেছে। কি ঠিক কিনা? আমি তাকে বাধা দিয়ে বললাম, না পিসি না। কি না? তুমি যা ভাবছো তা মোটেই নয়। তবে কি সত্যিই তুমি রেহানাকে ভালোবাসনা? না পিসি না। তাহলে তুমি কাকে ভালবাস? আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, তোমাকে পিসি–তোমাকে, শুধু তোমাকে আর কাউকে নয়।
উনি তাকালেন আমার দিকে। আমি মাথা নীচু করলাম, পিসি বোধ হয় এমন একটা উত্তরের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। উঠে পড়লেন। আমার সঙ্গে আর কোন কথা না বলে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়লেন। তার এই বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় আমি ভীষণ অবাক হয়ে যাই। আমার উত্তরে তিনি আঘাত পেয়েছেন কিনা জানিনা। কিন্তু পিসির ঐ ভাবে চলে যাওয়া আমার একদম ভালো লাগেনি। চেয়ারে সেই ভাবে বসে আছিতো বসেই আছি। চোখে ঘুম নেই। আবোল তাবোল অনেক কথা ভাবতে ভাবতে রাত শেষ হয় এক সময়।
সকালে উঠে পিসি দেখেন যে আমি সেই ভাবে বসে আছি একই জায়গায়। ঘুম জড়ানো চোখে আমার পিছনে এসে দাঁড়ান তিনি। তার পর আমার মাথার চুলে অঙ্গুলি সঞ্চালন করতে করতে বললেন, তুমি কাল রাত থেকে সেই একই ভাবে বসে আছো? ঘুমাও নি কেন? না কোন রাগ নয়, কোন বিদ্বেষও নয়। কোন এক সহমর্মীর আপন করার অনুভূতি যেন। আর তাতেই আমার ভিতরেব ক্ষোভ যেন গলে যেতে লাগলো। কিন্তু আমি নড়ার কোন লক্ষণ দেখালামনা। এবার তিনি আমার মাথাটা ঘুরিয়ে আমার মুখটা তার কবোষ্ণ বুকের পরে রেখে বললেন, আমার উপর রাগ করেছো প্রান্তিক! ছি, এতবড় ছেলের চোখে জল।
আর সত্যি সত্যি আমার দুচোখের জলে তার বুকের আঁচল ভিজে যেতে থাকে। কিন্তু তিনি আমার চোখের জল মোছাবার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করলেন না। তারপর এক সময় বললেন, তুমিতো আমায় ভালোবাস প্রান্তিক, তাই না!–কিন্তু তুমিতো আমায় ভালবাসনা। কে বলেছে?–তাহলে ওভাবে তুমি পালিয়ে গেলে কেন?
পিসি আস্তে আস্তে বললেন, আমার কথা শুনতে তোমার ভালোলাগবে?–তোমার সব কথা আমার ভালোলাগে, মনে হয় সর্বক্ষণ কেবল তুমি আমার সাথেই কথা বল। সঙ্গে সঙ্গে পিসি আমার কথা শেষ না হতেই বললেন, তাই ভয় হয় প্রান্তিক, আর আজ কেন পালিয়ে গেছি এখনি হয়তো তা বুঝতে পারবেনা, কিন্তু জীবনেব অভিজ্ঞতা যখন আর একটু বাড়বে তখন বুঝতে পারবে, আমার পালিয়ে না গিয়ে উপায় ছিল না। এত বিষণ্ণ আর অবসন্ন লাগছে পিসিকে যে তার জন্য ভীষণ দুঃখ হয় আমার।
উত্তরে বললাম, সে আমি জানি পিসি। জান?–হ্যাঁ জানি। এরপরেও জানতে চাও তোমাকে ভালবাসি কিনা। হ্যাঁ আমি তোমার মুখ থেকেই শুনতে চাই। পিসি তার বুক থেকে আমার মাথাটি তুলে দিয়ে বললেন, ছেলে মানুষি করো না। সব প্রশ্নের উত্তর সোজাসুজি দেওয়া যায় না। তার চেয়ে আজ কলেজে গিয়ে রেহানাকে বলবে, আমি তাকে একবার দেখতে চাই।–কেন? বাঃ তোমার বন্ধুরা কেমন আমি দেখব না, দেখতে ইচ্ছে হতে পারে না?–রেহানাতো আমার একমাত্র বন্ধু নয়। জানি। –তাহলে? তাহলেও ওর যদি আমাদের এখানে আসতে কোন অসুবিধা না হয় তাহলে একবার আসতে বলবে। একথা বলে আমাকে ছেড়ে দিয়ে ফিরে যাচ্ছেন দেখে আমি আবারও ডাকলাম, পিসি। কি? আমি কিন্তু আমার উত্তর পাইনি। পিসি এগিয়ে এলেন। আমার পাশে। তারপর আস্তে আস্তে আমার মুখটা তুলে নিলেন ধীরে ধীরে তার মুখের কাছে। তারপর কাঁপা কাঁপা ওষ্ঠাধরে একটা চুম্বন একে দিয়ে দ্রুত পালিয়ে গেলেন। কিন্তু কই আমার মধ্যে তো কোন শিহরণ জাগল না। বুঝতে পারিনি আমি, পিসির কাছে আমি এটাই চেয়েছিলাম কিনা। আমার চাওয়ার বিনিময়ে তিনি যা দিলেন তা আমার ভালবাসার প্রতিদান না তার স্নেহ উপহার তাও বুঝতে পারলাম না। বিনিময়ের জন্য অপেক্ষা করেননি তিনি, পালিয়ে গেছেন। অপেক্ষা করলে, আমি কি করতাম তা আমি নিজেই জানিনা। আমার শিরায় শিরায় যে কম্পন শিহরণ জাগার কথা –কোথায় সেই শিহরণ! আমার বিশ বছরের যৌবনে নারীর প্রথম যৌবন স্পর্শ। হোকনা সে যৌবন আমার ধরা ছোঁয়ার বাইরে। হোকনা পিসি আমার গুরুজন। তবু নারীতো। যে নারীর যৌবন আজো তার দেহের কানায় কানায় জোয়ারের জলে উচ্ছলিত। এক অলস মধ্যাহ্নে তাই আমার মনে হয়, এমনি করেই হারিয়ে যাই আমরা–আমাদের যৌবন . বিক্রি হয়ে যায় ফেরি ঘাটে। তাই কি? পিসির ভালবাসাকে কি আমি ফেরিঘাটের সঙ্গে তুলনা করতে পারি? না পারিনা। অপ্রাপ্তি যে প্রাপ্তির থেকেও অনেক মূল্যবান।
০২. পিতৃত্বের দাবী
পরিমলবাবু তার কাছে পিতৃত্বের দাবী করেন, কিন্তু তা দেওয়ার ক্ষমতা নেই পিসির। তাই বলে কোন দত্তক নিয়ে তিনি যেমন তার মাতৃত্বের স্বাদ মেটাতে চাননা তেমনি ঐ একই উপায়ে তিনি পরিমলবাবুকে পিতৃত্ব দেওয়ারও ঘোর বিরোধী। তিনি চান, পরিমল বাবু আবার বিয়ে করুক। আর সেই নবাগতার সন্তান মেটাক তার পিতৃত্বের আকাঙ্খা।
জানি আমি, কিন্তু বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। নীলাঞ্জনা পিসিকে যতটুকু বুঝেছি বা জেনেছি তাতে মনে হয় তিনি এখন কি চান তা বোধ হয় তিনি নিজেও জানেন না। আর একথা শুধু পিসি কেন, আমরা কেউ কি জানি, আমরা কি চাই? অথচ নীলাঞ্জনা পিসি একদিন ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন পরিমলবাবুকে। সবে কলেজে ঢুকেছেন নীলাঞ্জনা পিসি। আর সেই সময় উঁচু ক্লাসের পরিমলবাবুর নজরে পড়ে যান তিনি। শুনেছি নীলাঞ্জনা পিসির রূপে মুগ্ধ হয়ে আরো অনেক ছেলে তার প্রেমে পড়ার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু পিসি কারো দিকে ফিরেও তাকাননি। বলা চলে পরিমলবাবুই তার জীবনের প্রথম পুরুষ এবং একমাত্র পুরুষ হিসাবে প্রথম দিন থেকে মেনে নিয়ে তার ঘরে এসেছিলেন। সম্ভবতঃ পরিমলবাবু তা জানতেন। তাই নীলাঞ্জনাকে লাভ করা যেমন তার জয়ের একটা অঙ্গ, তেমনি কৃতজ্ঞতাবশত অন্য কোন নারীর কথা এতদিন তিনি মনেও আনেন নি। অবশ্য এসব আমার শোনা কথা, কিছু অনুমান মাত্র।
মিনতি সেনই বোধ হয় তার প্রথম ছন্দপতন। অবশ্য তাও ঠিক আমি ভালো করে জানিনা। পিসিকে নিয়ে তার একাকী আর নিঃসঙ্গ জীবনের কথা ভাবিনি কখনো। সেদিন যা কিছু বলেছিলাম, কথার পর কথা সাজিয়ে তার একটা কাব্যিক রূপ দিয়েছিলাম মাত্র। কিন্তু পিসি যে এমন একটা কিছু করবেন তা কখনো ভাবিনি। হয়তো এটা ভাবার কোন বিষয় নয় বলেই।
আমার উথাল পাতাল চিন্তাকে প্রতিহত করে কে যেন বলল, তুমি এখানে বসে আছো প্রান্তিক আর আমি তোমাকে সব জায়গায় খুঁজে বেড়াচ্ছি। তাকিয়ে দেখি রেহানা। বিস্ময় ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকাই ওর দিকে। বেশ কয়েকদিন পরে দেখা রেহানার সাথে। ও কয়েকদিন কলেজে আসেনি। যদিও ওদের বাড়ীতে যাওয়া যেতো কিন্তু ইচ্ছে করেনি। সহজ ভাবে বললাম, খুব দরকার আমাকে? কেন খুঁজছিলে? আমার উত্তরটা ছিল স্বাভাবিক, কিন্তু কোথায় যেন রেহানার অভিমানে আঘাত লাগে। বলে, দরকার না হলে বুঝি তোমাকে খোঁজা যায় না। তারপর বলল, না প্রান্তিক তোমার সাথে আমার কোন দরকার নেই। একথা বলেই ও সামনের দিকে পা বাড়ায়।
আর, ও চলে যাচ্ছে দেখে, আমি ওকে পিছু ডেকে বললাম একি রেহানা, তুমি চলে যাচ্ছ যে! বিশ্বাস কর আমি কোন কিছু মনে করে একথা বলিনি। তবু চলে যাচ্ছে। দেখে বললাম, আরে শোন শোন! কিন্তু কে কার কথা শোনে, ও দ্রুত পা ফেলে এগিয়ে . চলেছে। একবার মনে হল দৌড়ে গিয়ে ধরি ওকে। তারপর কি ভেবে যেন থেমে গেলাম। রেহানা যেমন এসেছিল, তেমনি ভাবেই চলে গেল। আমি শুধু তাকিয়ে রইলাম ওর চলে যাওয়ার পথের দিকে।
যে জটিলতার জালে আমি ক্রমান্বয়ে জড়িয়ে পড়ছি নিজেরই ভুলে, তা থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজে পাচ্ছিনা। অথচ আমার একথা যে কাউকে বলার নয়। আর এদিকে সাতদিন কেন ১০ দিন হয়ে গেছে পরিমলবাবু ফেরেননি। আজ তার চিঠি এসেছে, তার আরো মাস খানেক দেরি হবে। কোম্পানীর একটা বিরাট প্রজেক্ট-এ তাকে আটকে পড়তে হয়েছে, তাই নীলাঞ্জনা যেন সাবধানে থাকে। আমার পড়াশোনার যাতে কোন বিঘ্ন না ঘটে সেদিকে অবশ্য বিশেষ নজর দিতে বলেছেন। চিঠিটা পোষ্টকার্ডের। ডাক বাক্সে দেখে পিসিকে না জানিয়ে পড়ে ফেলেছি। অথচ অন্যের চিঠি যে পড়া উচিৎ নয় বুঝেও কৌতূহল দমন করতে না পেরে পড়ে ফেলি চিঠিটা। পিসিকে না জানিয়ে। কিন্তু আমার যা অবাক আর বিস্ময়ের ব্যাপার তা হচ্ছে পরিমলবাবুর এ কেমন চিঠি? প্রথম কথা স্বামী লিখছেন স্ত্রীকে চিঠি, তাও পোষ্টকার্ডে, দ্বিতীয়ত স্বামী স্ত্রীর চিঠির মধ্যে থাকবেনা এমন কিছু যা মনকে ছুঁয়ে যায়। এ আবার হয় নাকি, তৃতীয়ত ব্যক্তিগত চিঠিতে আর ব্যবসায়িক চিঠি নয় যে তাতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটা শব্দও ব্যয় করা যাবে না। চতুর্থত একবারও জানতে চাইবেন না স্বামী যে তার স্ত্রী কেমন আছেন? বা তিনি নিজেইবা কেমন আছেন? এ চিঠিতেও পরিমলবাবু একবারের জন্যও পিসি কেমন আছে জানতে চাননি। শুধুমাত্র একটা সংবাদ যে তার ফিরতে আরো মাস খানেক দেরি হবে। তা হতেই পারে। কিন্তু তাই বলে স্বামীর চিঠিতে ধরা পড়বেনা স্ত্রীর জন্য কোন উদ্বিগ্নতা। চিঠিটা পড়ার পর ডাক বাক্সে আবারও তেমনি ভাবে রেখে এসেছি আমি। রাতে বাড়ী ফেরার পরে হয়তো সে চিঠি দেখবেন পিসি। পড়ে তিনি কি ভাববেন? কি ভাবে নেবেন জানিনা। হঠাৎই মনটা খারাপ হয়ে যায়। মনে হয় পিসির সঙ্গে পরিমল বাবুর দুরত্বটা অনেকটাই বেড়ে গেছে।
কয়েকদিন ধরে আমার কিছুই ভালো লাগছেনা। পিসির কাছে কেন যেন স্বাভাবিক হতে পারছি না। খারাপ জেনেও অকারণ এড়িয়ে চলছিলাম। কেন এড়িয়ে চলছি তারও কোন উত্তর জানা নেই।
পরের দিন আবারও পিসি জিজ্ঞেসা করেছিলেন, রেহানাকে বলেছিলে আমার কথা? দায় সারা উত্তর দিয়েছিলাম, কলেজে আসেনি। পিসি আর কথা বাড়াননি।
এদিকে রেহানা ঐ ভাবে চলে যাওয়ার পরে অনেক ভেবেছি, কেন তার এই অভিমান। পরের ক্লাসটা অফ। তিনটে থেকে ক্লাস আছে ডি এন বি এর। একবার মনে হল যাব না ক্লাসে, তারপর অবশ্য ভেবে দেখলাম ক্লাসটা ফাঁকি দেওয়া ঠিক হবে না। রেহানার সাথে দেখা হওয়াটাও ভীষণ দরকার। এভাবে সবাই আমাকে ভুল বুঝবে তা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না।
কলেজ থেকে ফেরার পথে, লাল কৃষ্ণচূড়ার নীচে একাকী পেয়ে গেলাম রেহানাকে। জানি ও আমাকে এড়িয়ে যাবে। তাই দ্রুত তার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললাম, ও ভাবে চলে এলে কেন? এমন ভাবে ওর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছি যে ওর চলে যাওয়ার বা পাশ কাটিয়ে যাওয়ার কোন উপায়ই নেই। বলল, পথ ছাড় প্রান্তিক, আমার কাজ আছে। কাজ আমারও আছে, কিন্তু তোমাকে বলতেই হবে কেন আমাকে ওভাবে অপমান করলে? অপমান আমি করলাম না তুমি করলে? তারপর বলল যাকগে, আমি কথা বাড়াতে চাইনে, তুমি পথ ছাড়, অনেকে এদিকে তাকিয়ে আছে। থাকুক। আমাকে উত্তরটা জানতেই হবে। কোন উত্তরই আমার কাছে পাবেনা, তুমি পথ ছাড়, না হলে সত্যিই কিন্তু তুমি অপমানিত হবে। তখন। কিন্তু আমাকে দোষ দিতে পারবেনা। তার কণ্ঠের দৃঢ়তায় আমি অবাক হয়ে যাই।
এ কোন রেহানা? এতো আমার পরিচিত রেহানা নয়? আমি পথ ছেড়ে দিলাম। দিনটা আমার একদম খারাপ যাচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে কালুদার চায়ের দোকানে গিয়ে বসলাম, এটা কলেজ থেকে একটু দূরে। বললাম কালুদা পকেটে পয়সা নেই, কিন্তু ভীষণ খিদে পেয়েছে। কালুদা বললেন, কি খাবে বল।–যা হয় দাও, তার সঙ্গে এক কাপ চা, কাল। দাম দিয়ে দেব।
চায়ের দোকানে আর কোন খরিদ্দার নেই। কাগজটা পড়েই আছে। কাগজটার প্রতিটি লাইন পড়ে শেষ করলাম। তারপর উঠে পড়লাম। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম শিয়ালদা, সেখান থেকে ঢাকুরিয়া ট্রেনে। তখন প্রায় সন্ধ্যা হয় হয়। কেন এখানে এলাম জানিনা। অনুতপাদের বাড়ী যাওয়া যায়। কিন্তু ওর সঙ্গেতো আজ কলেজে দেখা হয়েছে। তাহলে কি অজুহাতে ওদের বাড়ী যাব। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে আবার ফিরে এলাম শিয়ালদায় তারপর হাঁটতে হাঁটতে বাড়ী।
পিসি আজ অফিস থেকে আগেই ফিরেছেন। ডাক বাক্সে চিঠিটা নেই। তার মানে পিসি চিঠিটা নিয়ে নিয়েছেন। উনি বসে আছেন বারান্দায়। আমি যে এসেছি সেদিকে কোন ভূক্ষেপ নেই। আমি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে পিসির পিছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমার উপস্থিতি টের পেয়ে বললেন কি চাই? তোমার শরীর খারাপ এভাবে বসে আছ? আর কিছু বলার আছে? না। তাহলে যাও এখন। দেখ ডাইনিং টেবিলে খাবার ঢাকা আছে। আজকাল কোথায় যাও কলেজ তো শেষ হয়েছে সেই ৪টেয়। আর এখন ৭টা, এত সময় কোথায় ছিলে? এভাবে যদি নিজের ইচ্ছেমত চলো, তা হলে মাষ্টার মশাইকে বলতে হবে, তোমাকে রাখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। মনে পড়ে যায় আগেও একদিন ঠিক এরকম কথাই বলেছিলেন পিসি। ফিরতে দেরি হওয়ার জন্য বুঝতে পারছি অন্য কোন রাগ আমার পরে ঝাড়ছেন। উত্তর দেওয়া ঠিক হবে না বলে আস্তে আস্তে চলে এলাম।
রাতে খাবার টেবিলে বললাম পিসি, মাষ্টারমশাইকে কিছুই বলতে হবে না, আমি নিজেই চলে যাবো। আমাকে নিয়ে তোমার অসুবিধা হচ্ছে একথা তুমি আমাকে বলতেই পারতে। কেন যে না বলে এই কষ্ট পাচ্ছ? কোথায় যাবে? মিনতি সেনের বাড়ীতে? আমি চমকে উঠে বললাম এতুমি কি বলছ পিসি? অবাক হচ্ছ যে বড়। তারপর বললেন তুমি যাওনি মিনতি সেনের বাড়ীতে? বুঝতে পারছি যে ভাবেই হোক মিনতি সেনের বাড়ী যাওয়ার সংবাদ পিসি পেয়েছেন। আস্তে আস্তে বললাম হ্যাঁ গিয়েছিলাম। অথচ আমাকে বলনি কেন? আমি তোমাকে না করতাম? কোন বিশ্বাস নেই আমার উপর?
আমি আরো ধীরে এবং মৃদুস্বরে বললাম, বলতে চেয়েছিলাম পিসি, কিন্তু তুমি যে আমার সব কেমন এলোমেলো করে দিলে। তুমি আমাকে এমন সব উল্টো পাল্টা কথা বলতে আরম্ভ করলে যে মিনতি সেনের কথা আর বলাই হল না। যাতে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় তেমন ভাবেই বললাম কথাগুলো।
পিসি চুপ করে শুনলেন সব। তারপর বললেন, থাক আর বলতে হবে না, তোমাদের পুরুষ জাতটাকে চিনতে আর বাকী নেই আমার। একথার আমি আর কি উত্তর দেব? বুঝতে পারছি মনের মধ্যে ঝড় বইছে নীলাঞ্জনা পিসির। খাওয়া শেষ করে উঠে পড়লাম। তারপর আলো নিভিয়ে নিজের বিছানায় শুয়ে আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কপালে কার কোমল স্পর্শে চোখ মেলে দেখি পিসি। বললাম, একি পিসি তোমার চোখে জল? তুমি ঘুমাওনি?
সামনের চেয়াটায় বসে পড়ে বললেন, আমার কথায় খুব আঘাত পেয়েছ না? কিন্তু বিশ্বাস কর, প্রান্তিক আমি তোমায় আঘাত দেওয়ার জন্য কিছুই বলিনি। আসলে নিজেই বিভিন্ন ব্যাপারে এমন ক্ষতবিক্ষত যে তোমাকে কি বলতে কি বলেছি, তার জন্য তুমি কিছু মনে করোনা। আমি উঠে বসলাম। তারপর বললাম, আমি জানি পিসি, আমি কিছুই মনে করিনি। তুমি জান? কি জান তুমি? থাক না। না তোমাকে বলতেই হবে। আমি বললাম, তুমি সব ব্যাপারে এত জোর কর কেন বলত। তারপর বললাম দেখ পিসি আমি যা জানি, মানে যা আমি মনে করি, তা কি সব সময় বলা যায়? যায় না বুঝি? ম্লান হেসে নীলাঞ্জনা পিসি বললেন তা হলে সেদিন কেন বললে আমায় তুমি ভালোবাস? আর আমি তোমায় ভালোবাসি কি না তা আমার মুখ দিয়ে শোনার জন্য জেদাজেদিই বা করলে কেন বল? তবুও তো তুমি বলোনি আমায় তুমি ভালোবাস কিনা। আর কি ভাবে বলব প্রান্তিক ওতেও যদি তুমি তোমার উত্তর না পেয়ে থাক, তবে থাক না তা চির অন্ধকারে, কিছুই তোমাকে জানতে হবে না। উঠে পড়লেন, পিসি। আমি অবাক হয়ে ভাবি কি বলতে চান পিসি? তিনি কি আমার মধ্যে অন্য কিছু আশা করেন? না আমার কোন আচরণ তাকে এমন ভাবে ভাবতে বাধ্য করেছে? নিজের আচরণের জন্য নিজের কাছে নিজেকে খুব ছোট মনে হয়।
রোজকার মত আজও পিসি বেরিয়ে যান অফিসে। আমিও কলেজে যাব বলে প্রস্তুত হচ্ছি। কিছুই ভালো লাগছেনা। মিনতি সেনের কথা ঠিক ঠিক মত বলতে হবে পিসিকে। কিন্তু মিনতি সেনের আমি কতটুকু জানি? যা সামান্য জানি তাতে তাকে অন্যরকম ভাববার কোন কারণ নেই। মিনতি সেন বলেছিলেন, আমি যেন পরের দিন পিসিকে বলি। তাকে ফোন করতে। কিন্তু সুযোগের অভাবে বলা হয়নি। সত্যি সত্যিই এতবার এত কথা হয়েছে তারমধ্যে কি এই সামান্য কথাটা বলা যেতনা? আসলে পিসি যদি অন্য কিছু ভাবেন, তাই বলিনি তাকে। বুঝতে পারি এটা অন্যায়। সত্যকে গোপন করার একটা যন্ত্রণা আমকে কুরে কুরে খায়।
গত দিনে রেহানার সঙ্গে ব্যবহারটা কেমন বেসুরো হয়ে গেছে। অথচ কিছুতেই বুঝতে পারছি না রেহানার সঙ্গে আমি খারাপ ব্যবহার কি করেছি। ওর সঙ্গে আমার মুখোমুখি হতে হবে। এই আশঙ্কায় কলেজে যেতে ইচ্ছে করছেনা। কিন্তু যাব কোথায়? এই কলকাতায় আমার পরিচিতির সংখ্যা এত কম যে, কোথাও গিয়ে সময় কাটাবার মত জায়গা নেই। এক মিনতি সেনের সঙ্গে দেখা করা যেতে পারে তার অফিসে গিয়ে। যদিও কোন দিন সেখানে যাইনি।
বেরিয়ে পড়লাম, কলেজে যাবনা মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছি। তাই আর বাস নয়, কলকাতার এগলি ওগলি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কখন যেন এন্টালী মার্কেটের কাছে এসে উপস্থিত হয়েছি হঠাৎ কে যেন পিছন থেকে ডাকে প্রান্তিক ভাই। কিন্তু পিছনের দিকে তাকিয়ে কাউকে তো দেখতে পাচ্ছি না। আবারও যখন এক পা দুপা করে এগিয়ে চলেছি শুনতে পাই সেই কণ্ঠস্বর, প্রান্তিক ভাই।
আমি পিছনে সামনে ডাইনে বায়ে সব দিকে তাকিয়েও পরিচিত কোন মুখ দেখতে পাচ্ছিনা। আর তাছাড়া প্রান্তিক ভাই এই ভাবে আমাকে কেউ ডাকে কিনা তাও তো জানিনা। তাইতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। যদি সত্যি সত্যি আমাকে কেউ ডেকে থাকে তাহলে সে নিজেই কাছে আসবে।
বাব্বাঃ, কোন দিকে হুস নেই? কাকে খুঁজছেন প্রান্তিক ভাই? হাফাতে হাফাতে আর উজ্জ্বল হাসিতে মুখ ভরিয়ে কাছে এসে দাঁড়ালো সেলিনা। রেহানার বোন, আমি অবাক হয়ে বললাম তুমি এখানে? কোত্থেকে? অবাক হচ্ছেন তো। জানি আমাকে আপনি খুঁজছেন না, কিন্তু খুঁজছেন কাকে? আবার সেই অমলিন হাসি, সীমাহীন কৌতুক দুটি চোখে। আমি ঠাট্টা করতে ছাড়লাম না। বললাম, তুমি যখন সিওর জান তোমায় আমি খুঁজছিনা, তাহলে একথাও তোমার জানার কথা, কাকে আমি খুঁজছি। ঠোঁট উলটে সেলিনা বলল, ইস বয়ে গেছে আমার সে কথা জানতে। তারপর বলল আসলে প্রান্তিক ভাই ভীষণ খিদে পেয়েছে। কিছু খাওয়াবেন না?
আমি অবাক হয়ে তাকাই ওর দিকে। নিজের খিদে পেলে দোকানে বলেছি, না হলে এই কলকাতায় শুধু পিসিকে। পরিচিত কাউকে নিজে খিদের কথা বলা যায় কিনা ভাবিনি কখনো। আর এই সেলিনা ওর সঙ্গে বুঝি আমার একদিন বা দুদিন দেখা হয়েছে। আর কথাও হয়েছে অতি সামান্য। সঙ্গে ধর্মীয় ব্যবধানতো আছে? আর এই সব কিছুকে উপেক্ষা করে এই যে আবদার তা আমাকে অবাক না করে পারেনা, মনে মনে ভাবি আহারে যদি আমার অনেক টাকা থাকতো, তাহলে ও যা যা খেতে চাইতো দাতা কর্ণের মতো সর্বস্ব উজাড় করে দিতাম। কিন্তু আমার পকেটে যে মাত্র ৫ টাকা সম্বল। ভীষণ খিদে তে রুটি তরকারি আর বড় জোর দুকাপ চা খাওয়া যেতে পারে।
ও আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল, কি ভাবছেন প্রান্তিক ভাই, মেয়েটাতো আচ্ছা, বিধর্মী হয়ে লাজ লজ্জা বিসর্জন দিয়ে আমায় লজ্জায় ফেলতে চাইছে, তাইতো? আমি বললাম, তোমার কথা ঠিক নয় সেলিনা। আমি ধর্ম দিয়ে কাউকে বিচার করি না। ধর্ম মানুষের নিজস্ব আচরণ মাত্র। তাহলে কি দিয়ে বিচার করেন? সে কথা বলতে তো সময় লাগবে। তার চেয়ে চলনা সামনের ঐ রেস্টুরেন্টটায়। ওখানে খেতে খেতে বলব। সেলিনা বলল না প্রান্তিক ভাই ওখানে যাব না। ওই রেস্টুরেন্টটা ভালো না। তার চেয়ে বরং হাঁটতে হাঁটতে শিয়ালদার দিকে চলুন। ওখানে প্রাচীর কাছে একটা ভালো রেস্টুরেন্ট আছে। মানুষের ভিড়ও বেশী থাকে না আবার আলাদা কেবিনেরও ব্যবস্থা আছে। খেতে খেতে আপনার কথা শুনব চলুন। আমি ইতস্তত করছি দেখে বলল, কি হল ভয় পাচ্ছেন? না না ভয় পাব কেন? তাহলে? না কিছুনা চল। অবশ্য একথা বলা ছাড়া আমার উপায়ও ছিল না।
নির্দিষ্ট কেবিনে ঢুকে আমরা মুখোমুখি বসেছি। সত্যি রেস্টুরেন্টটা বেশ ফাঁকা। যে ২/৪ জন আসছেন তারা তাদের নিজেদের মতো করে খেয়ে দেয়ে চলে যাচ্ছেন। ঔৎসুক্য বা কৌতূহল কোনটাই যেন তাদের থাকতে নেই। আমি বললাম কি খাবে বল? আপনার যা ইচ্ছে। আমি দেখলাম লজ্জা করে লাভ নেই। তাই বললাম দেখ সেলিনা, একটা কথা তোমাকে আগে বলে নেওয়া ভাল। আমার পকেটে কিন্তু মাত্র ৫ টাকা আছে। ওটাই আমাকে পথ খরচা দেওয়া হয়। যা কিছু খেতে হবে ওতেই। ও হাসতে হাসতে বলল, তাহলে ফিরবেন কি করে? কেন হাঁটতে হাঁটতে। তোমার যদি তাতে আপত্তি হয় তাহলে ৪ টাকার মধ্যে খেতে হবে। ও বলল, বেশ আমরা হাঁটতে হাঁটতেই ফিরব।
এরপর আর কথা চলে না। আমি ৫ টাকার মধ্যে যে রকম হয় সে রকম অর্ডার দিলাম। তার সঙ্গে ২ কাপ চা। কিছুক্ষণ চুপচাপ আছি। এরই মধ্যে সেলিনাকে একটু একটু করে বেশ ভালোই লেগে গেল। কত সাবলীল আড়ষ্টতাহীন। ভীষণ প্রণোচ্ছল। ও বলল কি ভাবছেন প্রান্তিক ভাই? না কিছুনা। তা তোমার স্কুল কি ছুটি হয়ে গেছে? না স্কুল এখন বন্ধ। তাহলে? স্কুলেই এসে ছিলাম, একটু কাজ ছিল। হঠাৎ দেখি আপনি আমাদের স্কুলের পাশ দিয়ে যাচ্ছেন। তখন ডাকলে না কেন? আপনাকে আইডেন্টিফাই করতে একটু সময় লেগেছিল। যখন বুঝতে পারলাম আপনিই তখন আপনি বেশ খানিকটা পথ এগিয়ে গেছেন। দ্রুত পায়ে আপনাকে ধরবার চেষ্টা করছি, আর প্রান্তিক ভাই, প্রান্তিক ভাই, বলে চিৎকার করে চলেছি। কি করে বুঝবো আপনি কারো ধ্যানে এমন নিবিষ্ট যে, চার পাশের কাউকে ভূক্ষেপই করতে চাননা। আবার সেই হাসি, উজ্জ্বল হাসির চমকে তার সারা শরীরে যেন সমুদ্রের ঢেউ ভেঙে পড়ছে।
মুগ্ধ চোখে ওর দিকে তাকিয়ে ভাবি এমন করে কি রেহানা হাসতে পারে? পারেকি এমন করে ভালোলাগার রক্তে দোলা দিতে। আমি বললাম, তোমার মতো অবস্থা হলে আমিও তাই ভাবতাম। কিন্তু আসল কথা তা নয় সেলিনা। তবে আসল কথাটা কি? আমি বললাম থাক ওসব কথা, তোমার পড়াশুনা কেমন হচ্ছে বলো? ও অধৈৰ্য্য হয়ে বলল, দূর প্রান্তিক ভাই, এই পড়াশুনা ছাড়া কি আমরা আর কোন কথা বলতে পারিনা। আমি বললাম, আচ্ছা তুমিই বল আমি শুনি। আমি বলব? শুনতে ভালো লাগবে আপনার। এমন কি বলবে যা আমার ভালো লাগবে না? তারপর অবশ্য বললাম তুমিই বল তোমার কথা শুনতে আমার ভালোই লাগবে। বললাম আমি।
ও বড় বড় চোখ তুলে তাকালো আমার দিকে। তারপর নীচু হয়ে খেতে খেতে বলল, জানেন, কাল মা কতকিছু রান্না করেছিলো, আমার জন্মদিন উপলক্ষে। এক সময় মা জানতে চাইলেন, কাউকে বলবি। আমি মাকে বললাম, কোনদিনতো কাউকে বলা হয়, আজ আবার কাকে বলব। জানেন প্রান্তিক ভাই, আমাদের তো কোনভাই নেই, আর সেই যে একদিন আপনি গিয়ে মাকে কি মায়ায় বেঁধেছেন। তাই হয়তো বললেন, রেহানা, ছেলেটা শুনেছি পিসিব কাছে থাকে, মা তো নেই। অবশ্য আমি ওর মা নই, তবু একবার কলেজ থেকে ফেরার পথে ধরে নিয়ে আসিস তো। কেন যে এই পোড়া মনটা তার কথা ভাবে কে জানে। আমরা অবাক হয়ে দেখলাম মার দুটো চোখ ছলছল করছে। রেহানা মাকে বলল, এই তোমার দোষ মা। সবাইকে আপন করে নেওয়া। তারপর বলল তুমি আসতে বলছো, কিন্তু যদি ও না আসে। যদি আমাদের বিধর্মী ভেবে যে কোন অজুহাতে এড়িয়ে চলে। আমার কিন্তু রেহানার এই অজুহাতটা একদমই ভাল লাগেনি। বলল সেলিনা।
মা আর কোন কথা বলেন না। কিন্তু মায়ের জন্য আমার মনটা এমন করে উঠলো যে, মনে হল মা শুধু একা কাঁদছেন না আমিও কাঁদছি। আমি রেহানাকে বললাম, আপা, তোমার সাথে কি দেখা হবে না প্রান্তিক ভাইয়ের। ও চিরদিনই একটু কম কথা বলে। মেপে কথা বলে। আমার মতো উচ্ছল নয়। আমার মতো আনন্দ বা দুঃখ অবলীলায় প্রকাশ করতে পারে না। তাই অনেকে ওকে দাম্ভিক বলে, আবার উন্নাসিক বলে। আসলে ওর মনটা শিশুর মত এল। বাবা ওকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখতেন, কিন্তু বছর খানেক আগে এক বাস দুর্ঘটনায় বাবার মৃত্যু হয়। আমরা হঠাৎ বড় অসহায় হয়ে পড়ি। ডালিম নামে একটি ছেলে, প্রেসিডেন্সিতে আপার থেকে সিনিয়র ক্লাসে পড়তেন। তিনিই সংবাদটি নিয়ে আসেন। তারপর, ধীরে ধীরে একদিন সব শোকের যেমন অবসান হয়, আমাদের ও হয়েছিল! ডালিম ভাইয়ের সঙ্গে আমাদের পরিবারের সম্পর্ক ধীরে ধীরে গাঢ়তর হয়েছিল, রেহানা মনে হয় আস্তে আস্তে ওকে ভালবেসেও ফেলে। কিন্তু বড় চাপাতো। তাই তার ভালোবাসার কোন প্রকাশ ছিল না। আমাদের দুই বোনের সামনে একদিন মা বলেছিলেন, রেহানা ওকে কি তোর পছন্দ? আমরা অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকালাম। রেহানা অন্য ঘরে পালিয়ে বাঁচতে চাইল। আমি বললাম, তুমি কি ডালিম ভাইয়ের সাথে রেহানার বিয়ে দিতে চাও? জানতে চাইলাম তাহলে ওর পড়াশুনার কি হবে? তাছাড়া রেহানা বা তোমার পছন্দেতো সব হবে না। ডালিম ভাইয়েরও একটা নিজস্ব পছন্দ আছে। আছেন তার অভিভাবকেরা। আর তারা যদি রাজি না হন, কেন অপমানিত হতে যাবে। মা বললেন আমি ডালিমের সাথে কথা বলেছি ও রেহানার মত জানতে চেয়েছে তা ছাড়া ও আরো একটা কথা বলেছে যে রেহানা রাজী থাকলে ও অপেক্ষা করবে যতদিন না ও প্রতিষ্ঠিত হয়, ওর শিক্ষা শেষ না হয়।
আমি বললাম, এ তোমার ঠিক হচ্ছে না মা। কি দরকার এই ভাবে জড়িয়ে পড়ার। আমাদের পড়াশুনা করতে দাও। আমরা নিজেরা দাঁড়াতে পারলে তোমার আর কোন চিন্তা থাকবে না। মা বলেছিলেন না থাকবে না ঠিক। কিন্তু আমাদের সমাজে কটা মেয়েকে দাঁড়াতে দেওয়া হয়? আমি মা কে বললাম, সবটাই সমাজের ঘাড়ে চাপিয়ে লাভ নেই মা! আমাদের দাঁড়াবার ইচ্ছেটাও জোরদার নয়। তারপর জোর দিয়ে বললাম না মা, ও চিন্তা তুমি ছেড়ে দাও। মা বললেন ডালিম আসলে কি বলব? বলবে ও এখনো ছেলে মানুষ। ও সময় চাইছে। এত কথা বলার পরে আমার একটা কথা মনে হল, না, আমার মনে হয় এটা বলা ঠিক হয়নি। কারণ মা তো আমার জন্য ডালিমকে পছন্দ করেননি। তিনি পছন্দ করেছেন রেহানার জন্য। আর ওর মনে যদি অন্য কোন ভাবনা থাকে। তাই বলার পরে বেশ অনুশোচনা হয় আমার।
কিন্তু প্রান্তিক ভাই! সেই ডালিম ভাই কি করলেন জানেন? বললাম কি? যে ডালিম ভাই রোজ একবার আসতেন তার দেখা নেই ৩/৪ দিন। পরে একদিন খুঁজে খুঁজে আমার স্কুলে এসে উপস্থিত। গেটে দাঁড়িয়ে আছেন ছুটির অপেক্ষায়। আমি বেরিয়েই দেখি ডালিম ভাই দাঁড়িয়ে আছেন। বললাম ডালিম ভাই আপনি? কোথাও গিয়েছিলেন বুঝি? উনি বললেন না। তাহলে আমাদের ওখানে যান না কেন? কোন কথা না বলে উনি হাঁটতে লাগলেন। আমিও হাঁটতে লাগলাম ওঁর পিছন পিছন। বললাম জানেন, এ কদিন আমরা। সব সময় আপনার কথা ভেবেছি। ও তাই বুঝি। একেবারে নিরাসক্ত উত্তর। বললাম, কেন বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি? হঠাৎ ও পিছন ফিরে আমার মুখোমুখি দাঁড়ালো। আমি চমকে উঠে বললাম কিছু বলবেন? ও বলল তুমি ভাবতে আমার কথা? বাঃ আমরা কি আমাকে বাদ দিয়ে। ও তেমনি ভাবে বলল আমি স্পষ্ট কবে জানতে চাইছি তোমার কথা। তুমি ভাবতে কিনা? আমি সরল মনে বললাম হ্যাঁ, আমিও ভাবতাম ডালিম ভাই। কতদিন আপনি আসেননা। সত্যি, বলে ও আমার হাতটা চেপে ধরল। আমি অবাক হয়ে বললাম, ছিঃ ডালিম ভাই এসব কি করছেন, হাত ছাড়ন। কণ্ঠে যেন কি ছিল, ও আমার হাত ছেড়ে দিল কিন্তু তার পকেট থেকে একটা ভাজ করা কাগজ আমার হাতে জোর করে গুঁজে দিয়ে দ্রুত অদৃশ্য হয়ে গেল।
চিঠিটা যে রেহানার নয়, সেটুকু বুদ্ধি তখন আমার হয়েছে প্রান্তিক ভাই। একবার ভেবেছিলাম ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে দিই চিঠিটা। কিন্তু ঐ যে কৌতূহল, নারী মনের যা স্বাভাবিক স্বভাব আর কেবল নারীমনই বা বলি কেন যৌবনের এতো স্বাভাবিক কৌতূহল। চিঠিটাকে লুকিয়ে ফেললাম আমার ব্লাউজের মধ্যে। একবার ভেবেছিলাম রাস্তায় কোথাও বসে পড়ি। তারপর ভাবলাম না থাক। বাড়ী গিয়েই পড়ব।
আমি অবাক হয়ে শুনছিলাম ওর কথা, যেন নিরাপদ আশ্রয় স্থল ভেবে সব কথা বলা যায় আমাকে। তারপর সেলিনা বলল শুনবেন ও কি লিখেছিল? আমি বেশী কৌতূহল দেখিয়ে বললাম, তোমার যদি মনে হয় এরপরের কথাও বলা যায় তাহলে বল। কেন আপনার কি কোন কৌতূহল নেই? বললাম, দেখ সেলিনা, কৌতূহল থাকা ভালো, কিন্তু অকারণ কৌতূহল ভালো না। আমি বিশ্বাস করি, যেটুকু বলার প্রয়োজন বলে তুমি মনে করবে তা তুমি বলবে। আসলে কারো মনের কথা জানার অধিকার কি জোর করে কিছু শোনা যায়? হঠাৎ সেলিনা বলল, এখানে ভালো চিকেন পকোড়া হয়, অর্ডার দিননা প্রান্তিক ভাই! শুধু বসে বসে গল্প করলে ওরা কিছু ভাবতে পারে। বাধ্য হয়ে আমাকে অর্ডার দিতে হয়।
সেলিনা বলে চলে, বাড়ী ফিরে বাথরুমে গিয়ে ডালিম ভাইয়ের চিঠিটা পড়ি। তাজ্জব ব্যাপার প্রান্তিক ভাই ও লিখেছে ও আমাকেই চায় রেহানাকে নয়। কিন্তু সে কথা বলতে গিয়ে ও আমাদের দুজনের দেহের বিভিন্ন অঙ্গের যে বর্ণনা দিয়েছে তা শুনলে লজ্জায় কানে আঙুল দিতে হবে। আরো যে সব কথা লিখছে তা আমি বলতে পারব না। একবার ভেবে ছিলাম রেহানাকে দেখাব চিঠিটা ও বুঝুক কেমন পুরুষকে ও ওর মনের মানুষ করতে চেয়েছে, ঘৃণায় রাগে আমার সমস্ত শরীরটা যেন রিরি করতে থাকে। ভাবলাম ওকে একটা শিক্ষা দেওয়া দরকার। তারপর মনে হল দূর এ সব করে কী হবে। আসলে তো ও কোন মেয়ের রাগ প্রকাশেরও যোগ্য নয়। তাইতো কাউকে কিছু বলা হল না। না রেহানা না মা। কিন্তু কাউকে কিছু না বললেনও ওর বিরুদ্ধে তীব্র বিদ্বেষ আমার মনের মধ্যে পুঞ্জিভূত হতে থাকে বিস্ফোরণের অপেক্ষায়।
তারপর একদিন আসে ডালিম। রেহানাকে ওর সামনে একলা রেখে জানালায় চোখ রাখি। কিন্তু অনুভব করতে পারি, ওর দুটি উৎসুক চোখ সেলিনাকে খুঁজে ফিরছে। রেহানা চা করতে ভিতরে গেলে আমি তার চিঠিটা নিয়ে এসে দাঁড়াই তার সামনে। আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ওর দুটি চোখ। আস্তে আস্তে ও বলে, আমার চিঠির উত্তর দিলে না কেন। সেলিনা বলল আপনি আর আসেন কই। আমি তো উত্তর লিখে বসে আছি আপনার জন্য। ও বলে, এইতো আমি এসেছি, এবার দাও। আর তার সঙ্গে সেই জিনিষটা। আমি কৌতূহলী হয়ে জানতে চাই কি? ওই তো যা আমি চেয়েছি। আমি বললাম এই দিনের বেলায়? তাহলে রাত্রে আসব? আমি একটু ভেবে নিয়ে বললাম না তার আর দরকার নেই, আপনি আসুন আমি এখনি দেব। কিভাবে? তা তো আপনার জেনে দরকার নেই। আমি দেব আপনি নেবেন এইতো।
ওর শরীরে এক অদম্য দোদুল্যমনতা দেখে আমার হাসি পেল। বললাম, আগে থেকে এমন কাঁপতে আরম্ভ করলে নেবেন কি করে? সব যে ঝরে পড়ে যাবে। ও বলল, কিছুই ঝরে পরবেনা তোমার দেওয়া দান আমি দু হাত পেতে নেবো। তাই বুঝি, আমি হাসতে লাগলাম। ও তখন আমার বুকের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে।
রেহানা এসে দাঁড়ালো পাশে। আমি ওকে জোরে এক ধাক্কা দিলাম। আর তাতে তাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেল ও। তারপর বললাম, ডালিম ভাই আমি রেহানা নই। আমি সেলিনা। নিয়মিত বক্সিং করি।
রেহানা এই হঠাৎ আক্রমণে দিশেহারা হয়ে ডালিমকে ধরতে গেলে আমি চিৎকার করে বলি, একদম ছুবিনা ওকে। ও একটা নরকের কীট। ও ভেবেছে কি? তারপর ডালিম ভাই-এর কাছে গিয়ে তুলে দিয়ে বললাম, যান এক্ষুনি এখান থেকে চলে যান। আর কোন দিন আসবেন না এখানে। আর মনে রাখবেন, আমি সেলিনা রহমান। এবারের ক্লাব প্রতিযোগিতায় বক্সিংএ প্রথম হয়েছি। আমি একাই যথেষ্ট আমাদের দু বোনকে রক্ষা করার জন্য। হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রেহানা তখনো। আর ডালিম তখন উঠে দাঁড়িয়ে মাথা নীচু করে আস্তে আস্তে বেরিয়ে গেছে। ও চলে গেলে আমি রেহানাকে আমার বুকের উপর টেনে নিয়ে বললাম আমাকে ক্ষমা করিস আপা। আসলে ও একটা শয়তান, বলে ডালিমের লেখা চিঠিটা তার হাতে তুলে দিলাম। রেহানা এক নিমেষে চিঠিটা পড়ে ফেলে কান্নায় ভেঙে পড়লো আমার বুকের পরে। আমি জানি প্রান্তিক ভাই সেদিন ও কত বড় আঘাত পেয়েছিল। যার জন্য থরে থরে সাজিয়ে ছিল ভালবাসার ডালি তার যে এমন পরিণতি হবে, তা স্বপ্নেও ভাবেনি। তাছাড়া সহ্য করবার শক্তিতে সবার এক নয়। সেলিনার কথা শুনে আমার মনের মধ্যে যে কী হচ্ছিল সে শুধু আমিই জানি। মানুষের মনের মধ্যে এমন শয়তানও বাস করে, ভাবতেও অবাক লাগে। প্রেসিডেন্সির ব্রিলিয়ান্ট ছেলে ডালিম, তার মনটা এমন কুৎসিৎ! ভালবাসা, শ্রদ্ধা, মায়া, মমতা এসব কিছুই নয়? সত্যি শুধু শারীরিক ঐশ্বৰ্য্য।
সেলিনা বলে চলে, তারপর থেকে নিজেকে ও আরো গুটিয়ে নিয়েছে নিজের মধ্যে। তবু বলেছিলাম, মাকে আঘাত দিবি? যা না একবার কলেজে, প্রান্তিক ভাইকে বলনা একবার আসতে।
ফিরে এলে মা জানতে চাইলেন, এলো না ছেলেটা? সংক্ষিপ্ত উত্তরে রেহানা বলেছিল, দেখা হয়নি। আমার কিন্তু মনে হয়েছিল এমন কিছু ঘটেছে যা সে বলতে চায়না। তারপর বলল বলবেন প্রান্তিক ভাই, কি হয়েছিল এমন, কেন এলেন না আপনি?
আমার সব কিছু তালগোল পাকিয়ে যেতে লাগল। রেহানা যে এত অভিমানী তা জানব কি করে? অথচ সত্যি কথাটাও বলতে পারছি না, তাতে হয়তো রেহানাকে ছোট্ট করা হবে। সেলিনা বলল, এত কি ভাবছেন প্রান্তিক ভাই? রেহানার সাথে ভুল বোঝাবুঝি কিছু হয়েছে?
আমি সেলিনাকে যতই দেখছি ততই অবাক হয়ে যাচ্ছি। ও যে ডালিমকে বলেছে, আমি রেহানা নই আমি সেলিনা। আমাদের দু বোনকে রক্ষা করার জন্য আমি একাই যথেষ্ট। সেলিনার উপর বিশ্বাস যেন আমার বাড়তে থাকে। আমি সেলিনাকে বললাম, তুমিতো যথেষ্ট বুদ্ধিমতি, রেহানাকে তুমি ভালভাবেই জান। তাহলে তার কথায় তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না কেন? হচ্ছেনা কারণ ওটা বিশ্বাস যোগ্য কথা নয় তাই। তাছাড়া আমি ওকে এত জানি যে ওর মুখ দিয়ে আর কোন কথা বের হওয়া সম্ভব নয়। তা ওর চোখ দেখে বুঝতে পারি। কিন্তু আমারই ভুল হয়েছে প্রান্তিক ভাই আপনি যে রেহানার থেকেও এক কাঠি উপরে এ সত্য আমার জানা ছিল না।
তারপর হঠাৎ চেয়ার থেকে উঠে পড়ে বলল চলুন যাওয়া যাক। আমি বললাম, হ্যাঁ তাই চল। আমিও উঠে পড়লাম। ও আমাকে কোন দাম দিতে দিল না। বেশি জোরও করতে পারলামনা। মনটা খারাপ হয়ে গেল। কাল ওর জন্মদিন ছিল। কিন্তু কালকের দিনটা তো আর ফিরে আসবেনা। তাই বললাম, তোমার জন্মদিনটা আমার মনে থাকবে সেলিনা। আগামী জন্মদিনে আমি নিশ্চয়ই যাব। ও হাসতে হাসতে বলল, সত্যি আপনি পাগল আছেন প্রান্তিক ভাই! আগামী জন্মদিন মানেতো আরো এক বছর পরে। ততদিনে দেখবেন সব গোলমাল হয়ে গেছে। তার থেকে চুপি চুপি একটা কথা বলি, কাউকে বলবেন না কিন্তু। কৌতুক ছড়িয়ে পড়েছে তার উজ্জ্বল দুটি চোখে। আমি তখনো কিছু না বলে চুপ করে আছি দেখে ও বলল, আসছে রবিবারের পরের রবিবার রেহানার জন্মদিন। ও কিন্তু ওর জন্মদিনের জন্য কোন আয়োজন মাকে করতে দেবেনা। মা কত সাধ্য সাধনা করেও একটা জন্মদিনের পোষাকও পরাতে পারবেনা তাকে। সেদিন সে উপোস করবে। খাবে তার পরের দিন, যাতে জন্মদিনে কিছু না খেতে হয়। আমি অবাক হয়ে বললাম, এমন কথা তো শুনিনি কখনো। সত্যি অবাক হচ্ছি তোমার কথা শুনে। তুমি সত্যি বলছ তো। সেলিনা বলল, এতক্ষণ কি তবে সব আমি মিথ্যে কথা বলেছি। যাকগে গোপন কথাটি বলে দিলাম। এবার যা ভালো বুঝবেন করবেন। আর একটা কথা, রেহানা খায়না বলে, ও দিন কিন্তু আমাদেরও উপোষ করতে হয়। না হলে দোকান থেকে খাবার কিনে এনে খেতে হয়। তবে বাবা যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন কিন্তু রেহানার জন্ম দিন ঘরোয়া ভাবে হলেও ভালো ভাবেই পালন করা হতো। জানতে চাই তবে এখন হয়না কেন? সেলিনা বলল আসলে ওর জন্মদিনেই বাবার এক্সিডেন্টটা হয়, আর তা ওকে এমন ভাবে আঘাত দেয় যে, ঐ দিনটাকে ও প্রানপণে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করে। তারপর আমাকে চমকে দিয়ে বললেন একি আপনি আবারও বসে পড়লেন যে। এরপরও বসতে গেলে আমার ক্ষমতায় কুলোবেনা। চলুন বলে হাসতে থাকে সেলিনা। সেলিনার যৌবন যেন উপছে পড়ছে।
রাস্তায় এসে সেলিনাকে বললাম, আমার একটা কাজ আছে। একটু দেরি হবে, তুমি বরং চলে যাও। সামান্য হেসে বললাম, তোমার গোপন কথাটা আমার মনে থাকবে, আর তোমার কথাও মনে থাকবে। আসি বাই বাই।
ও চলে গেল। আসলে আজতো আমার কোন কাজ নেই। কিন্তু এমন একটা সুন্দর আর জোরালো মনের সঙ্গে পথ চলতে বড়ই তৃপ্তি লাগছিল। ও চলে গেলে আমি তাই আরো খানিকটা এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে কখন যে কি কারনে শিয়ালদা স্টেশনে চলে এসেছি বুঝতে পারছি না।
আবারও সেই মিনতি সেন। বুঝতে পারিনা, কেন মিনতি সেনের মুখটা বার বার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আর কেনইবা মিনতি সেন বার বার টানে আমায়, কি যে দুর্নিবার আকর্ষণ মিনতি সেন আমার কাছে তার কোন ব্যাখ্যা আমার জানা নেই। তাইতো নিজের অজান্তেই সাউথ গামী ট্রেনে উঠে পড়ি আর নেমেও পড়ি ঢাকুরিয়া স্টেশনে। আর সেখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে মিনতি সেনের বাড়ী।
স্ট্রীট লাইটের আলোয় দেখা যাচ্ছে বাইরে একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন মিনতি সেন। আটপৌরে পোক। চুল এলায়িত। তার মানে হয় অফিসে যাননি, না হলে অফিস থেকে ফিরে এসেছেন অনেক আগে। বেল দিতেই, উপর থেকে বললেন খোলা অছে। চলে এস, তার মানে আমাকে এর মাঝে কখন যেন দেখে নিয়েছেন এক ফাঁকে।
সিঁড়ির দরজাটা ভেজানো ছিল। আবার তেমনি ভেজিয়ে দিয়ে আমি উপরে চলে এলাম। আমাকে দেখে যে উনি অখুশী হন নি তা তার চোখমুখ দেখে বুঝতে পারি। বললেন, কোথায় এসেছিলে অনুতপাদের বাড়ীতে? ওকে নিয়ে এলেনা কেন? বললাম, না পিসি আমি সোজাসুজি আপনার এখানে চলে এসেছি। ভীষণ আনন্দিত হলেন মিনতি সেন। মুখে বললেন, শুধু আমার কথা মনে করে আমার কাছে এসেছে, কি যে ভালো লাগছে, বল কি খাবে?
আমি বললাম, বাড়ীতে যা আছে, আপনি কিন্তু দোকানে যেতে পারবেন না। তাই হবে। উনি উঠে গিয়ে ফ্রিজ থেকে মিষ্টি এবং টুকি টাকি আরো কিছু নিয়ে এলেন।
মিনতি সেনদের এই রাস্তা মুখী বারান্দাটা বেশ বড়। কয়েকটা চেয়ার পাতা আছে এবং একটি টি টেবিল। উনি আমার হাতে খাবরের প্লেটটা তুলে দিয়ে বললেন, আচ্ছা প্রান্তিক তুমি আমায় পিসি বলে ডাক কেন বলত। আমি বললাম, ঠিক কোন কিছু ভেবে বলিনা, তবে আপনার যদি আপত্তি থাকে, তবে যা বলে ডাকতে বলবেন, তাই বলেই ডাকব। উনি হেসে ফেললেন, বললেন, তোমার মনটা এত সরল। তোমাদের মতন ছেলে মেয়েরা আছে বলেই এখনো পৃথিবীটাকে ভাললাগে। তারপর প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বললেন, ওই যে সেদিন তোমার সঙ্গে যে মেয়েটা এসেছিল, কি যেন নাম .. হ্যাঁ মনে পড়েছে অশ্রুকণা। তোমরা এক সাথে পড়? বললাম হ্যাঁ। মেয়েটি খুব ভালো তাইনা? আমি সন্দেহতুর হয়ে বললাম কেন বলুন তো। না এমনি, ওকে আমার ভীষণ আপনার মনে হয়েছিল। সেদিন জলযোগে তো ওর সঙ্গেই দেখা হয়ে ছিল তাই না প্রান্তিক? আমি সম্মতি সুচক ঘাড় নাড়ি।
তারপর খাওয়া শেষ করে বললাম এবার তা হলে উঠি। এই তো এলে। বেশী রাত হলে পিসি চিন্তা করবেন। তুমি যে বলেছিলে তোমার পিসি আমায় খুঁজছিলেন, কই তিনি তো ফোন করলেন না। হয়তো সময় পাননি, হয়তো বা যে জন্য খুঁজে ছিলেন তা মিটে গেছে। হবে হয়তো। তারপর একটু থেমে বললেন নীলাঞ্জনা তোমার কেমন পিসি। আমারই মত কি? হঠাৎ এ প্রশ্নের কারণ কি, আমার মন সন্দিগ্ধ হয়ে ওঠে।
কঠিন, অত্যন্ত কঠিন প্রশ্ন। এর উত্তর আমি কিভাবে দেব। তিনি যদি সহজ ভাবে জানতে চাইতেন নীলাঞ্জনা আমার কেমন পিসি, উত্তর দেওয়া সহজ হতো। হয়তো সত্যি কথাই বলতাম, গ্রাম সম্পর্কে পিসি। কিন্তু ঐ যে আমার মতো কি। প্রশ্নটা জুড়ে দিয়ে আমার সবকিছু কেমন এলো মেলো করে দিলেন। কোন উত্তরই দেওয়া হয়না। চুপ করে আছি দেখে বললেন, বললে নাতো। আর এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই বললাম আমাদের গ্রামের মেয়ে। গ্রাম সম্পর্কে আমার পিসি হয়। তবে আমি বিশ্বাস করি, সত্যি কারে দায়িত্ব নেওয়ার যার অধিকার আছে, রক্ত দিয়ে তার বিচার করা যায় না। এই যে বলতে গেলে আপনি তো আমার কেউ নন। অথচ কেন যে আপনার কথা মনে হয় সব সময় বুঝতে পারিনা। সম্পর্ক দিয়ে কি এর বিচার করা যায়? তবে যদি আপনি আমায় অস্বীকার করতেন এড়িয়ে চলতেন, তখন হয়তো মনে হতো আপনিতো আমার কেউ না।
ওঘর থেকে কে যেন বললেন, কার সঙ্গে কথা বলছিস মিনতি? পিসির বাবার কণ্ঠস্বর। বললেন, প্রান্তিক এসেছে। ওই যে কয়েক দিন আগে এসেছিল, তুমি উঠোনা আমি ওকে তোমার কাছে নিয়ে আসছি। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, বাবা চোখে কম দেখেন, আর সব সময় ভাবেন আমার কি হবে?
মিনতি পিসি কেন এসব কথা বললেন জানিনা, আমি গিয়ে ওনাকে প্রণাম করে বললাম কেমন আছেন? অবাক হলেন যেন বৃদ্ধ ভদ্রলোক। কিন্তু কোন রকম প্রতিক্রিয়া প্রকাশ না করে বললেন, মিনতি ওকে খেতে দিয়েছিস? তারপর আমার দিকে ফিরে বললেন, তোমার নামতো প্রান্তিক? মিনতি বলছিল। তা তুমি কি করছ? আমি বিজ্ঞান নিয়ে অর্নাসে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছি। খুব ভালো খুব ভালো, বৃদ্ধ তারিফ করলেন আমাকে। তারপর বললেন, যাও মিনতির সঙ্গে কথা বল, আমার মতো বুড়োর সঙ্গে তোমার আর কতক্ষণ ভালোলাগবে। বললাম, আমার কিন্তু আপনাকে ভালোই লাগছে। তারপর ওনার বিছানার একেবারে কাছে এসে বললাম, আপনার মাথাটা একটু উঁচু করুনতো দাদু, আমি বালিশটা দেওয়ালের সঙ্গে ঠেশ দিয়ে দিচ্ছি, আপনি বসুন। কি সব সময় শুয়ে থাকেন।
তারপর আমি ওনার মতামতের অপেক্ষা না করে ওনার মাথাটা নিজের হাতে একটু উঁচু করে বালিশটাকে ঝেড়ে দেওয়ালে ঠেশ দিয়ে ওনাকে সাহায্য করে বসিয়ে দিলাম। তারপর নিজেই বিছানার অগোছালো চাদরটা তুলে নিয়ে, মাথার জট পাকানো চুল গুলোকে আঁচড়িয়ে দিলাম। খোঁচা খোঁচা দাড়ি তা আর চিরুনি দিয়ে ঠিক করা সম্ভব হয়না। গায়ের কোচকানো জামাটা খুলে ফেলে পাউডারের কৌটো থেকে কিছু পাউডার নিয়ে তার সারা গায়ে ছড়িয়ে দিলাম, পাশের আলনা থেকে একটা পরিস্কার জামা তুলে নিয়ে তার গায়ে গলিয়ে দিয়ে বললাম, এমন নোংরা হয়ে থাকেন কেন? দাঁড়িও কাটেননি। দেখবেন কয়েকদিন পরে ওখানে পোকা কিল বিল করছে। কালই নাপিত ডেকে জঙ্গল পরিস্কার করে ফেলবেন। আর রোজ না হলেও আমি পিসিকে বলে যাব, যেন একদিন অন্তর একদিন বিছানার চাদর বদলিয়ে দেন। এমন নোংরা ভাবে কি বাঁচার স্বপ্ন দেখা যায়? পিসি যে কি করে! বৃদ্ধ মন্মথনাথ। সেন। অবাক হয়ে আমার কাজ দেখছিলেন আর মনে মনে কি যেন ভাবছিলেন। কেন যে এই কাজগুলো উপযাচক হয়ে করলাম জানিনা। হয়তো মিনতি সেনের জন্য, উনি আমার বাবা, উনি আমার একমাত্র আপনজন কথাটা আমায় প্রভাবিত করে থাকবে। আপনজনের সিঁড়ি বেয়েই তো আরো আপন জনের কাছে পৌঁছানো সম্ভব। সে যাই হোক এই কাজগুলো করতে আমাকে যেমন কোন জেদ করতে হয়নি। তেমনি বৃদ্ধ মন্মথ সেনও কোনরকম বাধা দেননি। মিনতি সেন অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কে করল তুমি? আমি নীরবে মাথা নাড়লাম এবং মিনতি সেনের হাত থেকে চায়ের প্লেটটা নিয়ে তার হাতে দিয়ে বললাম, দাদু চা খান, কিন্তু আপনার চশমা কোথায়? মিনতি সেন দেরাজ থেকে চশমা জোড়া বের করে আমার হাতে দিলেন। আমি চশমাটা তার চোখে পরিয়ে দিয়ে বললাম দেখুন তো আগে আমাকে কখনো দেখেছেন কী না। কিন্তু আমার এত আগ্রহের কোন জবাব দিলেন না উনি। আমি এরপর দিনের কাগজটা খুঁজে পেতে তার হাতে দিয়ে বললাম, সারাদিন শুয়ে থাকেন কেন? কাগজ, বই, ম্যাগাজিন যা পাবেন তাই পড়বেন। এইবার চা খেতে খেতে কাগজটা পড়ে ফেলুন তো। আমি একটু পরে এসে জিজ্ঞাস করব কি পড়লেন। বলতে হবে কিন্তু। এতক্ষণে হেসে ফেললেন বৃদ্ধ। বললেন পড়া ধরবে তো! বেশ তাই হবে। কিন্তু দাদুভাই পাশ না ফেল তা কিন্তু বলতে হবে তোমায়। এই যে মুহূর্তে আপন জনের একটা সম্পর্ক গড়ে উঠলো, তাতে মনটা ভীষণ ভাল হয়ে গেল। তাকিয়ে দেখি মিনতি সেনের দৃষ্টি হতে বিস্ময় যেন আর কাটতে চায় না। তার বিস্ময় আমার এই কাজের জন্য না, তার বাবার এই সহজ হয়ে ওটা। বুঝতে পারি না।
এরপর মিনতি সেনের সঙ্গে আবার সেই বাইরে এসে বসলাম আমি। চা খেতে খেতে বললাম, আপনার চা যে ঠান্ডা হয়ে গেল পিসি। এই খাই, বলে চায়ের কাপটা তুলে নিয়ে এক চুমুক খেয়ে আবার রেখে দিলেন।
বললাম, কি এত ভাবছেন। উনি ধীরে ধীরে বললেন, কি যে ভাবছি তা তোমাকে বোঝাবো কি করে প্রান্তিক? এই যে দেখছ আমার বাবা, ব্যাঙ্কের একজন সিনিয়র রিটায়ার্ড অফিসার। আজ ১০ বছর হয়ে গেল চাকরী থেকে অবসর নিয়েছেন। আমার বাবা যে কি আমুদে মানুষ ছিলেন তা তোমাকে বোঝাতে পারবনা। একদিন তিনি একটি ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ের কথা প্রায় পাকা করে এসে আমার মাকে বললেন, বুঝলে গিন্নী, আমি মিনতির বিয়ের ব্যাপারটা পাকা করে এলাম। মা জিজ্ঞাস করলেন একেবারে পাকা? ছেলেটি কে? বাবা কৌতুক করে বললেন, সে তোমাকে একেবারে আশীবাদের দিনই বলব। মা বললেন। তা হলে ওটুকুই বা আমার জন্য বাকী রাখলে কেন? সেকি হয় তুমি যে মা, আমার যে দাবী, তোমারও তো সেই একই দাবী। মা আর কথা বাড়াননি। ছেলের বাড়ী থেকে আশীর্বাদ করতে এলেন, সঙ্গে ছেলেও এলেন। আমার কোন মতামত নেন নি বাবা। আর তার ব্যক্তিত্ব এমন ছিল যে তার সামনে গিয়ে তার বিরুদ্ধাচারণ করতে আমাদের বুক দূর দূর করে কাঁপতো। কিন্তু ছেলেকে দেখে মা বেঁকে বসলেন। বাবাকে ভিতরের ঘরে ডেকে নিয়ে বললেন এ বিয়ে হবে না। বাবা বললেন কেন? মা বললেন, আমার সাফ কথা, আমি যখন বলেছি এ বিয়ে হবে না তখন হবে না।
আমার তখন মনের অবস্থা বুঝতে পারছ প্রান্তিক। বাবা মা ঝগড়া করে চলেছেন, অথচ আমার কথা কেউ ভাবছেন না। বাবা তখনো বলে চলেছেন, আমি মেয়ের বাবা, তোমার স্বামী, এ বাড়ীর অভিভাবক, আমি বলছি এ বিয়ে হবে। তোমার ওঘরে যাওয়ার দরকার নেই। বাবা চলে যেতে উদ্যত হয়েই মা বললেন শোন, তোমার জেদের কাছে আমি বারবার হার স্বীকার করেছি। তার একমাত্র কারণ তুমি বাড়ীর অভিভাবক। একমাত্র অর্থ উপার্জনকারী। আমি মা হয়েও কোন কথা বলার অধিকার নেই, কারণ আমার কোন আর্থিক ক্ষমতা নেই। আমিও তোমার উপর নির্ভরশীল। তাইতো তোমার মতের বিরুদ্ধে আমিই মিনতিকে চাকরি করতে পাঠিয়েছি, যাতে সে স্বাবলম্বী হতে পারে আমার মত অসহায়তার শিকার না হতে হয়। আজও আবার সেই অর্থ ক্ষমতার দম্ভে নিজের ইচ্ছেটাই চাপিয়ে দিতে চাইছে। কিন্তু ভাল করে শোন, আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে যদি তুমি ওর বিয়ে দাও, তা হলে আমার মৃতদেহ মাড়িয়েই তোমাকে তা করতে হবে। আমি বেঁচে থাকতে তা হবে না। মিনতি সেন বললেন, আমিতো শিউরে উঠি, মায়ের হল কি! কিন্তু মায়ের এই জেদে বাবার জেদও আরো বেড়ে গেলো। তার মুখের উপর এই পরিবারের যে কেউ কথা বলতে পারে, তা ছিল তার কল্পনার অতীত। তার পৌরষত্ত্বে আঘাত। তিনি তা মেনে নেবেন কেন? দম্ভভরে বললেন প্রয়োজনে তোমার মৃতদেহ মাড়িয়েই ওর বিয়ে হবে। আমি যাচ্ছি। যাওয়ার আগে তাই বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে দিয়ে গেলাম বেরিয়ে নাটক করবার চেষ্টা করোনা। বাড়ীতে অতিথি তাদের কোন অমর্যাদা হতে আমি দেব না।
তারপর জেদী পুরুষ আমার বাবা বাড়ীর কাজের লোকদের দ্বারা এমন নিখুত ভাবে অনুষ্ঠানটি শেষ করলেন যে, কারো কিছু বোঝার কোন উপায় রইল না।
দিনের শেষে অতিথিদের বিদায় দিয়ে ফিরে আসতে আসতে যে ৪/৫ ঘন্টা সময় কেটে গেছে তাতে যা হওয়ার তাই হয়ে গেছে। মা কি ভাবে অতগুলো ঘুমের ওষুধ জোগাড় করেছিলেন তা উনিই জানেন। যখন দরজা খুলে বাবা ভিতরে ঢুকলেন তখন সব শেষ, তবুও হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো মাকে, কিন্তু যিনি সব কিছুর উর্ধ্বে চলে গেছেন, তার জন্য কেইবা কি করবে। মিনতি সেনের গলাটা বুঝি সামান্য কেঁপে যায়। বলে চলেন বাবার মতো পুরুষের এই বোধ হয় প্রথম পরাজয়। মা কোথাও কিছু লিখে যাননি। সুতরাং বাবাকে গ্রেপ্তার হতে হল। কিন্তু বাবার এক কথা আমি কিছুই জানিনা। বিচারক আমাদের কোন কথা শুনলেন না। বাবাকে তিন বছর সশ্রম কারাদন্ড দিল। ছেলেদের বাড়ীর থেকে ওরা অবশ্য এসেছিলেন। ছেলেটির নাম ছিল প্রতীম। শিবপুর কলেজ থেকে বি, ই, পাশ। ভালো কোম্পানিতে গজ করেন। বাবার ভেল হওয়া সত্বেও তারা আমাকে তাদের ঘরের বৌ করে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন কিন্তু আমিই রাজী হতে পারিনি।
এতক্ষনে থামলেন মিনতি সেন। মনে মনে ভাবছিলাম, কোন মানুষকে উপর থেকে দেখে বোঝা যায় না কার জীবনে কি ঝড় বয়ে চলেছে। মিনতি সেনেরও যেন আর কিছু বলার নই।
আমি ডাকলাম পিসি? চমকে উঠলেন মিনতি সেন। বললেন কিছু বলছ? জানতে চাইলাম কেন আপনার মা এই বিয়েতে একদম রাজী না হয়ে মৃত্যুকে বেছে নিলেন। জানতে পেরেছিলেন কোন দিন, কিসের জন্য তার এই জেদ? একটা দীর্ঘশ্বাস টেনে নিয়ে বললেন, না প্রান্তিক জানতে পারিনি। জানবার চেষ্টা করেছিলেন? যিনি কিছুই বলে যাননি সে চেষ্টা করব কি করে? আপনার বাবাও কিছু অনুমান করেননি? জানিনা ঠিক। যদি কিছু অনুমান করেও থাকেন আমাকে বলেননি কিছুই।
জেল থেকে ফিরে এসে ঐ যে বিছানা নিয়েছেন, ওখানেই তার দিন রাত কাটে। নিতান্ত প্রয়োজন না হলে আমার সঙ্গেও কথা বলেন না। কোন কিছু করতে গেলে, তিনি সজোরে প্রত্যাখ্যান করেন। নিজের কাজ তিনি নিজেই করেন। আজই প্রথম দেখলাম তোমাকে উনি কোন বাধা দেননি।
আমি বললাম, প্রতীমবাবু আপনার সঙ্গে কোন যোগাযোগ করেননি? হ্যাঁ করেছিলেন। আমি যখন তার বাবা মাকে না করে দিয়েছিলাম। তখন তার একটা চিঠি পেয়ে ছিলাম আমার অফিস ঠিকানায়, লিখেছিলেন, সুচরিতাসু,
আমাকে আপনারা ভুল বুঝবেন না। বাবা মাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। জানি আমাকেও ফিরিয়ে দেবেন তবু যদি জানতে পারতাম, আমার অপরাধ কোথায়? হয়তো বলবেন এ মিলন ঈশ্বর চাননি। ঘটনার গতি হয়তো তাতে বিশ্বাসের আলপনা আঁকতেও পারে। কিন্তু এক্সিডেন্টতো এক্সিডেন্টই। এটাও জানিনা তিনি কেন এমন চরম সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। আমি কোন অজুহাত খাড়া করছিনা, যদি সব কিছুকে সরিয়ে দিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করতে পারেন, আমাকে জানাবেন। আমি অপেক্ষা করব, ইশ্বর আপনাকে শান্তি দিন। কল্যাণাকাঙ্খী প্রতীম।
মনে মনে ভাবলাম, এতবড় মনের মানুষকে আমি খারাপ ভাববো কি করে? বললাম, আপনি উত্তর দিয়ে ছিলেন? না দেওয়া হয়নি। কেন দিলেন না? মায়ের কথা মনে করে। হয়তো ঠিক কথাই বলেছেন মিনতি সেন। যার জন্য তার মা মৃত্যু বরণ করলেন, তাকে কি করে জীবনসাথ হিসাবে বেছে নেবেন তিনি? তবু জিজ্ঞাসা করতাম প্রতীমবাবু কি পরে কোথাও বিয়ে করেছেন? জানিনা। তিনি এখন কোথায় আছেন? তাও জানিনা। বললাম, ওনার কোন অফিস ঠিকানাই আপনি জানেননা? কি করবে? কিছুই করব না পিসি, শুধু চোখের দেখা দেখে আসব। একটা জীবন তো ধ্বংস হয়ে গেল, আরেকটা জীবনও ধ্বংস হয়ে গেল কি না।
মিনতি সেন মৃদু হেসে বললেন কি দরকার প্রান্তিক? আমার পক্ষে যা মেনে নেওয়া সম্ভব হবে না, সেখানে আরেকজনের দুঃখ বাড়িয়ে লাভ কি? লাভ কিছু নয় পিসি, কিন্তু একথা তো সত্য, জীবনে কোনদিন আপনি তাকে ভুলতে পারবেন না। আমি আপনাকে জোর করব না, শুধু ঠিকানাটা দিন। মিনতি সেন বেশ কয়েক বছর আগের অফিস ঠিকানাটা আমার হাতে এনে দিলেন। আমি উঠে পড়লাম। জানতে চাইলেন, আমি আবার কবে আসব। খুব তাড়াতাড়ি আসব, জানিনা কেন সব সময় আপনার কথা মনে পড়ে! আমি বেরিয়ে এলাম।
রেহানার সঙ্গে কলেজে কয়েকবারই দেখা হয়েছে, কিন্তু আমাকে এড়িয়ে গেছে প্রতি মুহূর্তে। আজ রবিবার। পিসিকে বললাম আমি একটু বেরোব পিসি। কোথায়? আমাদের এক কলেজ বন্ধুর জন্মদিন ওদের বাড়ী যাব। তোমাকে লো; না বলে নি, তাইতো জেদ হয়েছে আমি যাব। পিসী আর কথা না বাড়িয়ে আমাকে ২০ টাকা দিয়ে বললেন, জন্মদিনের গ্রীটিং কার্ড আর একটি ফুলের তোড়া নিয়ে যেও।
তোমার জন্মদিনে আমার শুভেচ্ছা লেখা গ্রীটিং কার্ড আর বিভিন্ন রংয়ের ফুলের সমাহারে সাজানো ফুলের তোড়া নিয়ে আমি যখন ওদের বাড়ী উপস্থিত হয়েছি তখনো দুপুর হয়নি। সেলিনা আমাকে ঘরে ডেকে নিল। তার ওর মায়ের কাছে নিয়ে গিয়ে বলল, সেদিন উনি আসেননি মা আজ কিন্তু এসেছেন। রেহানার জন্মদিনে, কিছু খাওয়াবেনা? ওর মাকে পা ছুঁয়ে প্রণাম করলাম আমি।
একটু পরে সেলিনা রেহানাকে ডেকে নিয়ে আসে এ ঘরে। আমি আমার ঝোলা থেকে প্রথমে ফুলের তোড়াটা তার হাতে দিতেই ও প্রায় ছিটকে গিয়ে বলে এটাকি? আমি বললাম, আগে গ্রহণ কর তারপর বলছি। ও আমার হাত থেকে ফুলের তোড়াটি নেওয়ার পর আমি গ্রীটিংস কার্ডটা মেলে দিলাম ফুলের তোড়ার উপরে। তাতে এক পলক চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, কে তোমাকে বলল আজ আমার জন্মদিন? আমি হাসতে হাসতে বললাম অত অধৈর্য হয়ো না রেহানা? কে আবার বলবে? তোমার চোখ বলছে, তোমার চেহারা বলছে, সর্বোপরি তোমার এ্যাডমিশান রেজিষ্টার তাকে তুমি অস্বীকার করবে কি করে?
রেহানা আমার কথার কোন প্রতি উত্তর না দিয়ে নিয়ে চলে গেল। আমি ওকে বাধা দিতে গেলে সেলিনা ইশারায় না করল। তারপর বলল, আপনি আমাকে বাঁচিয়েছেন প্রান্তিক ভাই। তারপর তার মাকে বলল, তোমরা না হয় উপোস করবে, কিন্তু প্রান্তিক ভাইকে কিছু খাওয়াবে না। আফরোজ বেগম বললেন এই যাই।
উনি চলে গেলে, সেলিনা বলল আপনি রেহানার ঘরে যান। আজ আপনার অগ্নি পরীক্ষা। মানে? মানে আবার কি, যার জন্মদিনে শুভেচ্ছার উপহার নিয়ে এসেছেন, সেকি উপোষ করে থাকবে নাকি! কিন্তু সেলিনা, কোন অধিকারে আমি তার ব্রত ভাঙব? যদি পারবেন না, তবে দম্ভ করে এলেন কেন? তারপর আরো কাছে এসে চুপিচুপি বলল, ভালোবাসার অধিকারে সব করা যায় প্রান্তিক ভাই! সেই অধিকারে আপনি তার ব্রত ভাঙবেন। কিন্তু একজনের ভালোবাসার অধিকারই কি সব। আরেক জনের দরকার নেই? সেলিনা বলল এইটুকু যদি না বুঝতে পারেন ভালোবাসার কথা বলবেন না জীবনে কখনো। বড় অদ্ভুত মেয়ে এই সেলিনা। বয়সে ছোট হলে হবে কি। জ্ঞানে বুদ্ধিতে আর অনুভূতিতে সবাইকে যেন টেক্কা দেয়। সেলিনা ওর মায়ের কাছে চলে গেলে, আমার পক্ষে আর কতক্ষণ একা একা এ ঘরে বসে থাকা সম্ভব? আমি আস্তে আস্তে যে ঘরে রেহানা আছে সে ঘরে গিয়ে উপস্থিত হলাম। একটা আকাশী রং-এর পর্দা ঝুলছে দরজায়। আমার উপস্থিতি টের পেয়ে রেহানা বলল, চলে এস। আমি ভিতরে গিয়ে দেখি, একাকী বসে আছে, পাশে ফুলের তোড়া এবং তার উপর গ্রীটিংস কার্ড আমি নিজেই ওটা তুলে নিয়ে সামনের ড্রেসিং টেবিলের একপাশে যে টিপয় আছে তাতে সাজিয়ে রাখলাম। আর নীচে গ্রীটিংস কার্ডটা খুলে রাখলাম। খাট থেকে তাকালেই দেখা যায়। ও আমার দিকে তাকিয়ে অকারণ একটু হাসল। বললাম হাসলে যে। না, ভাবছিলাম, তুমি এত ভীরু কেন? বুঝলামনা। বুঝে কাজ নেই। ঐ গ্রীটিংস কার্ডটা নিয়ে এস। কেন? আরে আনইনা। আমি নিয়ে এলাম। তারপর খাটের লাগোয়া পড়ার টেবিলের দেরাজ থেকে সবুজ কালির কলমটা বের করে বললো, লেখ। আমি অবাক হয়ে বললাম কি লিখব? বারে! কাকে তুমি জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাচ্ছ তার নাম লিখবে? আর কে দিচ্ছে? সে জায়গাটাও কি ফাঁকা থাকবে নাকি? আমি পেনটা নিলাম ওর হাত থেকে তারপর সুন্দর করে লিখলাম রেহানাকে আর শেষে লিখলাম প্রান্তিক। কেন। যেন মনে হল আনন্দে ওর চোখ দুটি চক করছে। তারপর নিজেই উঠে গিয়ে এমন সুন্দর করে ফুলের তোড়াটার নীচে রাখল যেন তা আরো সুন্দর ভাবে প্রতিভাত হয়। তারপর আবার নিজের বিছানায় এসে বসল।
আমি বললাম, জন্মদিনে এমন একটা ময়লা শাড়ী পরে আছো কেন? ও বলল, তুমি হয়তো জানো প্রান্তিক, আমার জীবনে জন্মদিন কোন নুতন বার্তা বয়ে নিয়ে আসেনা, তাই ভালো লাগেনা। বললাম, তোমার ভালো লাগাটাই কি সব, আমাদের ভালো লাগতে নেই? হয়তো আছে, কিন্তু তুমি আমাকে কতটুকু জান? একটু হাসলাম। তারপরে বললাম, যতটুকু জানলে তোমাকে চেনা যায় ঠিক ততটুকুই জানি। চমকে উঠলো ও, বলল, মানে?
এমন সময় সেলিনা পর্দার বাইরে থেকে বলল, প্রান্তিক ভাই, মা চা দিতে বললেন, এ ঘরে নিয়ে আসব না ডাইনিংএ দেব। বললাম, আমি আসছি, এ ঘরে আনতে হবে না। সেলিনা চলে গেলে রেহানাকে বললাম, চল। ও বলল তুমি যাও। আমি বললাম সেকি করে হবে? আমি যাচ্ছি তুমি কিন্তু ৫ মিনিটের মধ্যে চলে আসবে। তারপর ওর দিকে এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। বলল কি দেখছ? কিছুনা। আমি যাচ্ছি। পর্দার কাছে গিয়েও আবার ফিরে এসে বললাম, ঠিক এই ভাবে এসোনা, অন্তত আমার কথা মেনে একটা নতুন শাড়ী পরে এস। আর অপেক্ষা না করে বেরিয়ে এলাম।
পাঁচ মিনিট নয়, অন্তত ১০ মিনিট পরে রেহানা এলো। রেখেছে আমার কথা। নতুন লাল শাড়ী, কপালে লাল টীপ, চোখে কাজল, সুন্দর করে এক বেনীতে বাঁধা চুল। ফুলের তোড়া থেকে তুলে নেওয়া একটা লাল গোলাপ বেনীর গোড়ায় গোজা। মুখ নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে টেবিলের পাশে। সেলিনা একবার তাকিয়ে রান্নাঘরে চলে গিয়ে ওর মাকে ডেকে নিয়ে এলো। মা ওকে দেখে শুধু বলল রেহানা! আর কোন কথা বলতে পারলেন না। দু চোখ দিয়ে শুধু টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়লো আফরোজ বেগমের।
বললাম রেহানা বস। রেহানা বলল তুমিই বস আমি আসছি। ভিতরে গিয়ে সেলিনার হাত থেকে খাবারের রেকাবী আর চায়ের কাপ নিয়ে বলল, তুইও বোসগে সেলিনা। আমি এসব নিয়ে যাচ্ছি। সেলিনা কোন প্রতিবাদ না করে তার হাতে দিয়ে দিল সব। তারপর আমার মুখোমুখি বসে পড়ল। রেহানা এরপর সেলিনা এবং তার মায়ের জন্য মিষ্টি এবং চা নিয়ে এসে মাকে বলল, তুমিও বোস মা। আফরোজ বেগম অবাক হয়ে দেখছিলেন রেহানাকে।
আমি বললাম, তুমি কেন বাকী থাকবে রেহানা তুমিও বোসনা। রেহানা বলল, আগে তো তোমরা খেয়ে নাও, তারপর দেখছি। লক্ষ করে দেখলাম, সেলিনা কোন কথা বলছেনা, শুধু আড় চোখে বার বার দেখছে রেহানাকে। রেহানা এত সুন্দর। কোন দিন ভালো করে তাকিয়েও দেখেনি ও। সেলিনা বলল, বোস না আপা তুই কেন পরিবেশন করবি, আজতো আমার পরিবেশন করার দিন।
মানুষের মন কেমন করে যে আপন নিয়মে তার পথ করে নেয় তা বোধ হয় সে নিজেও জানে না। রেহানার ভালোলাগা, মন্দ লাগা, তার রাগ মান অভিমান ভালবাসা ঘৃণা দ্বন্দ্ব কোন কিছুর পরে যেন তার স্থায়ী কোন অধিকার নেই। ঘাসের ডগায় ভোরের শিশিরের মত তা যেন বড় ক্ষণিকের কিন্তু ভারি সুন্দর। রাগলে যেমন কাউকে সুন্দর লাগে তেমনি ভালবাসা যখন চিকচিক্ করে ওঠে তার চোখের মনিতে তখন তা এক অপূর্ব পায় কাছের মানুষের সম্মোহনী দৃষ্টিতে।
ঐ লাল শাড়ী, যেন নব বধূর লাল বেনারসী। সব কিছু লাল আর লাল, তার শাড়ী, ব্লাউজ, কপালের টিপ, হাতের পলা, লাল তার বেনীতে গোজা উপহারী গোলাপ, ভাবতে অবাক লাগছে, অথচ বুঝতে পারছি না কেন সে আজ এমনি লাল রঙে সেজেছে। আর ঐ যে এক টুকরো হাসি ও-তে যেন লজ্জায় লাল।
আমার সামনে বসে আছে শুধু সেলিনা। আফরোজ বেগম একটু খানি বসে নিজের চায়ের কাপ নিয়ে উঠে চলে যাচ্ছেন দেখে আমি বললাম একি আপনি কেন চলে যাচ্ছেন, বসুন না। উনি বললেন, তোমরা বস। আমি রেহানাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
সেলিনা বলল, কি প্রান্তিক ভাই, আপনি যে যুদ্ধ জিতে গেছেন, তবে আর আমি থাকি কেন? আমি বললাম, জিতিনি ভাই, তবে জেতার আশা আছে। এখনো আশা করছেন? কোন সেনাপতি কি হারতে ভালবাসে? দেখবেন কিন্তু যুদ্ধ জয় হয়ে গেলৈ সৈনিকদের আবার ভুলে যাবেন না। মনে রাখবেন আসল যুদ্ধ কিন্তু তারাই করে, আর কৃতিত্ব নেয় সেনাপতি নিজে। হাসতে হাসতে বললাম যুদ্ধজয়ের পরে ভাববো, এই যুদ্ধে তোমার কোন ফল্ট ছিল কি না। তারপর নির্ভর করবে তোমাকে সৈনিক হিসাবে বহাল করা যাবে কি না। ও বলল, এত দন্ত কিন্তু ভালো নয় প্রান্তিক ভাই। আমিও চললাম। এবার না হয় বসে বসে ঠিক করুন সেলিনাকে বহাল রাখা যাবে কি না। হাসতে হাসতে সমস্ত শরীরে হিন্দোল ছড়িয়ে উঠে পড়লো সেলিনা। রেহানা এসে বলল, একি তুই চলে যাচ্ছিস যে, সেলিনা শুধু একটু হাসল, তারপর চলে গেল। আমি বললাম, তোমার চা কোথায়? আমি কিছু খাবোনা। কেন? এ আমার ব্রত। আমি জানি। জা? হ্যাঁ জানি। কে বলেছে সেলিনা? সেলিনা ছাড়া কি জানবার আর কোন উপায় নেই? হয়তো আছে। তবে আমার বিশ্বাস সেলিনাই তোমাকে বলেছে এসব। কিন্তু তুমি আমাকে এ অনুরোধ করোনা প্রান্তিক। না করবো না। ঠিক আছে।
আমি সামনে খাবার নিয়ে চুপ চাপ বসে আছি। ও বলল চুপ করে থাকবে? কিছু খাবে না? বললাম তুমিই বল, এভাবে খাওয়া যায়? তোমার জন্মদিনে তুমি কিছু খাবেনা। আমার খেতে ভালো লাগবে? তার চেয়ে একটা কথা বলব? ও তাকায় আমার দিকে। তারপর আস্তে আস্তে বলল বল। বললাম আমি জানি রেহানা তোমার আঘাতটা কোথায়? আজতো আনন্দের দিন শুধু নয়, আজতো স্মৃতি তর্পনেরও দিন। নিজের জন্ম দিনের মুহূর্তটা তুমি ভুলে যেতে পারে। কিন্তু কি করে ভুলবে এদিন যে তোমার একান্ত প্রিয় জনের বিদায়ের দিনও। কিন্তু আজ যদি তুমি এমনি ভাবে চিরদিনের নিয়মটাকে উল্টিয়ে দিয়ে নতুন নিয়মের সৃষ্টি করো, তোমার বাবার সেটা ভালো লাগবে? তিনি কি দুঃখ পাবেননা? তার এই অকালে চলে যাওয়ার জন্য তো তুমি দায়ী নও। তবে কেন তাকে এই আঘাত দেবে? তিনি যদি আজ বেঁচে থাকতেন তাহলে কি এমনি ব্রত গ্রহণ করতে?
ও আমাকে বাধা দিয়ে বলল, না না তুমি এমনি ভাবে বলল না। বললাম, আমি তো বলতে চাইনি রেহানা। তুমি যা করছ এটা নিয়ম নয়। এ তোমার আঘাতের বহিঃপ্রকাশ মাত্র। জীবনে অনেক আঘাত আসবে, আসতে পারে আরো কঠিন আঘাত। সেদিন কি তুমি আরেক ব্রত গ্রহণ করে জীবনটাকে আরো দুর্বিসহ করে তুলবে? তার দ্বারা তুমি কাকে শাস্তি দেবে? আর তা ছাড়া যেকোন আচরণ পালনের অধিকার যেমন তোমার আছে, তেমনি এটা দেখাও তোমার দায়িত্ব, তোমার সেই আচরণে অন্য কেউ যেন আঘাত না পায়? এখানে তোমার বোন আছে। তারও নিশ্চয় জন্মদিন পালন হয়। আমি জানি না তার জন্মদিনে কোন উৎসব হয় কি না। যদি না হয়, তবে তার জন্য কি তোমার নিজেকে দায়ী মনে হবেনা?
রেহানা চুপচাপ শুনছিল আমার কথা। কোন উত্তর দিচ্ছেনা দেখে আমি আবারও বললাম, অবশ্য এ আমারই ভুল, আমার আসাই ঠিক হয়নি। তুমি জান না রেহানা তোমার জন্মদিনে আসার জন্য আমি পিসিকে মিথ্যে কথা বলেছি?
আঁতকে উঠলো রেহানা মিথ্যে কথা বলেছে? মানে পিসি কি তোমাকে আসতে দিতে চাননি। না ঠিক তা নয়। আসলে আমার মনে হয়েছিল তোমার জন্মদিনে হয়তো আমাকে তুমি বলতে পার। কিন্তু আমার তো জানা ছিলনা, না বলার পিছনে আছে আরেক ইতিহাস। যা তোমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। তাই পিসি যখন বললেন, তোমাকে কি নিমন্ত্রণ করেছে। বললাম না, তাই আরো জেদ বেড়ে গেছে এজন্যই আমাকে যেতেই হবে।
রেহানা বলল, তুমি এ ভাবে বলছ কেন? তুমিতো দেখতেই পাচ্ছ, জন্মদিন আমার জীবনে আরেক অন্ধকার স্মৃতি বয়ে নিয়ে আসে। আমার বাবা, তিনি আমাকে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখতেন, কিন্তু কি যে হল, কিছুতেই নিজেকে ক্ষমা করতে পারছি না।
আমি বললাম, তুমি যা করছ সে শুধু তোমার বাবাকে অসম্মান নয়, অসম্মান করছ তুমি তোমার মা ও বোনকেও। তাহলে আমি কি করব। আমি আস্তে আস্তে বললাম মৃত্যু বেঁচে থাকে স্মৃতির মধ্যে, আর স্মৃতিকে জাগরিত করাই মৃত্যুকে শ্রদ্ধা জানান। তারপর খানিক থেমে প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বললাম, আচ্ছা রেহানা তোমার বাবার কোন ছবি নেই? ও বলল কেন বলত! না তোমার ঘরে বা এ ঘরে তোমাদের দুই বোনের ছবি দেখছি, অথচ তোমার বাবা বা মায়ের কোন ছবি দেখছিনা। তাই আর কি। ও বলল, ছিল কিন্তু ছবিটা দেখলে কি যে হতো, কি যে যন্ত্রণায় আমি ছটফট করতাম, তাই তাকে সরিয়ে ফেলেছি।
০৩. হাসলাম আমি
হাসলাম আমি বললাম, ছবি সরিয়ে কি যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যায়? তার চেয়ে ছবিটা এমন একটা জায়গায় টাঙিয়ে দাও যে বাড়ীর সকলের তা নজরে পড়ে। তারপর তোমার বাবার জন্মদিন, তোমার মা বাবার বিয়ের দিন, তোমার ও সেলিনার জন্মদিন ছাড়াও আরো যে সমস্ত দিন গুলো তোমাদের জীবনে স্মরণীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ বলে তোমরা মনে করো, সেই সব দিনে তাজা ফুলের মালা পরিয়ে দাও ছবিতে। আর মনে মনে বলল, বাবা তুমি যেখানেই থাক চিন্তা করোনা, তোমার স্বপ্ন আমি পূরণ করবই। দেখবে আস্তে আস্তে মনে এক অন্য ধরনের জোর পাবে। আর সেই ভয়ংকর স্মৃতির দিনটা মলিন হয়ে ভাস্বর হয়ে উঠবে সেই সব স্মৃতি গুলো যা তোমাদের আনন্দে ভরিয়ে রাখতো। তিনি বেঁচে থাকতে বিভিন্ন দিনে যা যা করতেন তোমরাও তাই করো, আর সেটাই হবে তাকে সর্ব শ্রেষ্ট শ্রদ্ধা অর্পণ। এই ভাবে তার সমস্ত আনন্দকে এড়িয়ে গিয়ে তুমি কি তাকে অপমান করছো না?
রেহানা নীরবে আমার সব কথা শুনলো কোন রকম প্রতিবাদ না করে। তারপর আস্তে আস্তে বলল, কিন্তু প্রান্তিক তুমি জানো, আমার জন্মদিনে প্রথম মিষ্টিটা তিনি নিজে হাতে আমার মুখে তুলে দিতেন। আমি তা ভুলব কি করে। বললাম তোমার তো মা আছেন, তার হাত থেকে নিয়ে নাও তোমার প্রথম মিষ্টিটা। এই পৃথিবীতে কোন সন্তানের কাছে বাবাই সব নয়, মাকে তার অর্ধেক অংশতো ছেড়ে দিতেই হবে। তোমার মাযের আঘাতটা তুমি দেখবেনা?
তাহলে আমি কি করব তুমি বলে দাও প্রান্তিক? বলল রেহানা, আমি বললাম, আমি বলে দেওয়ার কে? কখন যেন সেলিনা এসে দাঁড়িয়েছে পাশে বুঝতেও পারিনি। বলল, চা একেবারে জল হয়ে গেছে প্রান্তিক ভাই, মিষ্টিটাও সেই ভাবে পড়ে রয়েছে। দিন না সব বদলিয়ে নিয়ে আসি।
রেহানা বলল, তুই বোস সেলিনা। আমি নিয়ে আসছি এসব। ও হাসতে হাসতে বলল সেই ভাল। রেহানা ও সব নিয়ে চলে গেলে, চাপা হাসিতে মুখ ভরিয়ে ফেলল সেলিনা। বললাম কিছু বলবে? বা একজনকে এত কথা বললেন আর আমার বেলায় ফাঁকি? তা। হবেনা প্রান্তিক ভাই? আপনাকে আজ শাস্তি পেতেই হবে! হেসে বললাম কি শাস্তি। ও তেমনি চাপা কৌতুকে বলল, এ নাটকের শেষ দৃশ্যে আপনি কেমন অভিনয় কবেন, তা দেখতে হবে। মানে?
আমার দিকে কৌতূহলী চোখ তুলে বলল, ওই তো রেহানা আসছে ওর কাছে মানেটা বুঝবেন, আমি আসছি। আমি বললাম, না তুমি বস। আমি যখন অভিনয়ই করছি তখন সে অভিনয় ঠিকঠিক হচ্ছে কিনা তার জন্যতো দর্শক চাই, তুমিই না হয় আজকের দর্শক হও। আমার বয়ে গেছে, বলে চাপা কৌতুক ছড়িয়ে দিয়ে চলে গেলো ও।
রেহানা বলল, ও চলে গেল যে। বললাম, কি করে বলব কেন চলে গেল। তুমি ওকে ডাকনা। থাক না, ও এমনিই আসবে, এবার খেয়ে নাও। আগে তুমি খাও। তারপর কি ভাবে ভেবে বললাম, আরে দাঁড়াও দাঁড়াও, একটু অপেক্ষা করো আমি আসছি। ও চোখ তুলে তাকালো আমার দিকে বলল কোথায় যাচ্ছ। এই আসছি বলে রান্না ঘরের কাছে গিয়ে সেলিনাকে বললাম, মাসীমাকে নিয়ে একবার এ ঘবে এসোতো সেলিনা।
একটু পরে ওরা ঘরে এলে, আমি আফরোজ বেগমকে বললাম মাসীমা আজতো রেহানার জন্মদিন তাই না? উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, হ্যাঁ। আমি বললাম তা এই রকম নিরামিষ জন্মদিন হবে? মিষ্টি মুখ খাওয়া দাওয়া কিছু হবে না? সেলিনা বলল, আপনি যে এরকম পেটুক তাতো জানা ছিল না। আমি হাসতে হাসতে বললাম আসলে পিসির বাড়ী থাকি কিনা। সব সময়তে ইচ্ছে মতো খাওয়া হয় না, তাই কোন আনন্দ উৎসবের বাড়ী গেলে পুষিয়ে নিই। সেলিনা তেমনি হাসতে হাসতে বলল, তাই বুঝি। তা সামনেই তো এক গাদা খাবার রয়েছে, ওখান থেকে তো ইচ্ছে মতো খেয়ে নিতে পারেন প্রান্তিক ভাই! পারি কিন্তু অসুবিধা হচ্ছে, নিয়ম! যার জন্মদিন তার বাবা বা মা, নাহলে সব থেকে বয়োজ্যেষ্ট যিনি তিনি যার জন্য এই উৎসব তার মুখে প্রথম খাবার তুলে না দিলে খাই কি করে? অথচ সামনের এই ভাল ভাল খাবার দেখে জিভের জলও ধরে রাখা যাচ্ছে না। সেলিনা চোখ টিপে হাসছে।
আমি আফরোজ বেগমের দিকে তাকিয়ে বললাম, নিন মাসীমা, ওখান থেকে মিষ্টি তুলে নিয়ে আগে রেহানা, তারপর সেলিনাকে দিন। সেলিনা বলল, আর আপনাকে! আরে আমি তো আজকের অভিনেতা, মানে তোমার ভাষায় যদিও আমার মর্যাদা পাওয়া উচিৎ ছিল আজকের একমাত্র অতিথির। তা তোমার ভাষায় আমি যখন অভিনেতাই, তখন না হয় অভিনয় করতে করতেই খেয়ে নেব। কিন্তু সেলিনা, শুধু মিষ্টিতে অতিথি আপ্যায়ন এ আমার একদম পছন্দ নয়।
রেহানা অবাক হয়ে তাকালো আমার দিকে। তার যেন কেমন সন্দেহ হল। বলল, কি ব্যাপার প্রান্তিক এ সব অভিনয় টভিনয় কি সব বলছ? আমি বুঝতে পারছি আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে যাওয়া কথাটা রেহানার মনে সন্দেহের জন্ম দিয়েছে। কিন্তু এর থেকে বেরোবো কি করে? বললাম, সেলিনা তখন কি বলল জান? কি? আমাকে নাকি দেখতে ঠিক অভিনেতার মতো।
হেসে উঠলো সেলিনা। আর সেই সঙ্গে আমরা সবাই। আফরোজ বেগম প্লেট থেকে একটা সন্দেশ তুলে দিলেন রেহানার মুখে, আর সঙ্গে সঙ্গে ও মাথা নীচু করে ওর মায়ের কাছ থেকে আর্শীবাদ নিলো। সেলিনাও মিষ্টি তুলে ওর মুখে দিল। রেহানা আমার দিকে তাকিয়ে বলল তুমি দেবেনা? আমি ইতস্তত করে বললাম, দিতেতো ইচ্ছে করছে, কিন্তু দিই কোন অধিকারে বলতো?
সেলিনা আবার তার কৌতুক ছড়িয়ে দিয়ে বলল, এত কি ভাবছেন প্রান্তিক ভাই। আপনিতো অভিনেতা, সেই অভিনেতার অধিকারেই না হয় রেহানার ইচ্ছেটা পূরণ করুন। এক সঙ্গে আমরা আবার হেসে উঠলাম সবাই।
দিন যায় মাস যায় জীবন এগিয়ে চলে তার নিজস্ব গতিতে। কেমন যেন মনে হয় আরো জটিল শৃঙ্খলে বাধা পড়ে যাচ্ছি প্রায় সব জায়গায়।
আকাশ সেদিন গোধুলি আবিরে রাঙা, হয়তো তখনি সন্ধ্যা নামবে পৃথিবীর অঙ্গনে, পাখীর কলকাকলিতে মুখর আকাশ। উঠতে হবে। অশ্রুকণা আপন মনে পরপর ঢিল ছুঁড়ে চলেছে সামনের বয়ে যাওয়া নদীর জলে। নদীর এ পাশটা নির্জন। সাধারণের যাতায়াত প্রায় নেই বললেই চলে। এক ঘন্টা বেশী অতিবাহিত হয়ে গেছে নীরবে বসে আছি পাশাপাশি।
অথচ আজ যখন পরীক্ষার হলে ঢুকতে যাচ্ছি, ও পাশ থেকে ডেকে বলল, প্রান্তিক তোমার বইটা পড়া হয়ে গেছে, এ কয়দিন দেওয়া হয়ে ওঠেনি। ভীষণ ভালো লাগলো বইটা। ওনি আরেকবার পড়বে, তারপর না হয় একদিন আলোচনা করা যাবে। বইটা দিয়ে এত দ্রুত ভিতরে ঢুকে গেল যে আমার কোন কথা শোনার অপেক্ষায় থাকলনা ও।
আমি বইটা আমার ঝোলা ব্যাগে, না দেখেই ঢুকিয়ে রাখলাম। মনে করতে পারছি না কবে ওকে বইটা দিয়েছিলাম। আর বইটাই বা কি। হলে ঢোকার আগে বাথরুমে যেতে যেতে একবার খুলে দেখি ওর মধ্যে ভাজ করা একটা কাগজ। আমি সঙ্গে সঙ্গে সেটা বুক পকেটে ভরে নিয়ে বইটা আবার আমার ঝোলা ব্যাগে ঢুকিয়ে দিলাম। বাথরুমে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে বুক পকেট থেকে কাগজটা বের করে এক পলকে চোখ বুলিয়ে নিলাম। প্রান্তিক, আজ কি পরীক্ষা শেষে তোমার সঙ্গে দেখা হতে পারে? আমি অপেক্ষা করব নদীর পারে সেই নির্জন বটগাছটার নীচে। আসতে ভুলোনা কিন্তু কণা।
যৌবনের যে প্রান্তে উপনীত হয়েছি তাতে ইচ্ছে করে, ভীষণ ইচ্ছে করে, কারো চিঠি পেতে বা কাউকে দিতে। দেওয়ার সাহস অর্জন করতে পারছি না, ভীরু মন বার বার বাধা দিচ্ছে। যদি কেউ ভুল ভাবে। পেতে ইচ্ছে করে রেহানার চিঠি। কিন্তু কেন? আমি কি ওকে ভালোবাসি? জানিনা। সেরকম কোন গভীর শূণ্যতা তো মনের মাঝে উঁকি মারে না। প্রায়ই দেখা হয় ওর সাথে, মাঝে মাঝে ফেরার পথে জোর করে ধরে নিয়ে যায়। কোন দিন সেলিনা থাকে কোন দিন থাকে না। যে দিন থাকে না সেদিন অস্বস্তি হয়। বুঝি আমি গেলে আফরোজ বেগম খুশী হন। তবু রোজ যেতে মন চায় না। মাঝে মাঝে মনে হয়, অনেক দিন যদি দেখা না হয় ওর সাথে, তা হলে ও নিশ্চয় চিঠি লিখে জানতে চাইতো আমি কি রাগ করেছি? কেন যাইনা ওদের বাড়ি? পারলে তাড়াতাড়ি একরার অবশ্যই যেন যাই। আর কি কিছু লিখতো? জানিনা, সেরকম কোন ছবিতো কল্পনায়ও দেখছিনা, অথচ তার চিঠি পেতে ইচ্ছে করে কিন্তু কেন? কেন? কে দেবে এ উত্তর আমায়?
পরীক্ষা শেষের একটু আগে বেরিয়ে গেছে অশ্রুকণা। ও হল থেকে ঝেরয়ে যেতে তাকালাম ওর দিকে, ও তাকালো, তারপর নীরবে এবং দ্রুত বেরিয়ে গেল।
পরীক্ষা শেষ হলে অনেকের সাথে আমিও বেরোলাম। আমার ঠিক পিছনে রেহানা। তারপর একা পেয়ে বলল, অনেকদিন আসছেনা কিন্তু। আজ মা ভীষণ ভাবে তোমার কথা বলছিলেন। আসছো তো।
কি অদ্ভুত, ঠিক এমনি ভাষায় তার লেখা কাল্পনিক চিঠির কথা মনে পড়ে গেল। বললাম যাব, কিন্তু একটু দেরি হবে। কেন কোথাও যাবে? না একটু কাজ আছে। কোথায়? অসুবিধা না হলে আমিও যেতে পারি। কি যে বলি ওকে। বললাম, ওটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে রেহানা। তুমি যাও, একটু দেরি হবে। তবে আমি যাব। হঠাৎ ও বলে উঠলো। কোন অভিসারিকা অপেক্ষা করছে বুঝি? বলে ভীষণ কৌতুকে হেসে উঠলো ও। আমিও হেসে উঠে, বললাম, তোমার একথা যদি সত্যি হতো রেহানা তবে, নিজেকে ভীষণ দামী বলে মনে হতো। ও তেমনি চোখের তারা নাচিয়ে বলল তাই বুঝি। চেষ্টা করে দেখব তোমার সাধ মেটে কিনা। বলে হাসতে হাসতে চলে গেল
নিছক কৌতুক। কিন্তু সবটাই কি কৌতুক। অশ্রুকণার বই দেওয়া দেখেছে, আগে আগে চলে যাওয়াও দেখেছে। কিছু সন্দেহ উঁকি দেয় নিতো? আর তাছাড়া এত দিনের মেলামেশায় রেহানাকে এমন চপল মনে হয়নি কখনো।
অবশ্য বেশীক্ষণ ওর কথা ভাবার সময় পাইনি। এক সময় সেই পরিচিত বটগাছটার নীচে এসে উপস্থিত হলাম। কিছু আগেই ওখানে এসে অপেক্ষা করছে অশ্রুকণা। আমি চুপিচুপি ওর পাশে গিয়ে বসলাম। ও যেন জানতই আমি ছাড়া আর কেউ নয়। তাই কোন হেলদোল নয়, নীরবে এক দিকে সরে বসল মাত্র। কিন্তু কোন কথা বললনা। আমি পকেট থেকে ওর লেখা চিঠিটা ওকে ফেরৎ দিয়ে বললাম, তুমি আসতে বলেছিলে। ও চিঠিটাতে একবার চোখ বুলিয়ে কুটি কুটি করে ছিঁড়ে নদীর জলে ভাসিয়ে দিল। বললাম, একি করলে কণা? ওটার ওপরতো তোমার কোন অধিকার নেই, বলল ভেবেছিলাম নেই, কিন্তু এখন দেখছি অধিকার জিনিষটা বড় কঠিন, তা হেলায় অর্জন করা যায় না।
বুঝতে পারলাম না অশ্রুকণার এই অভিমানের কারণ কি? ও নীরবে একের পর এক ঢিল ছুঁড়ে চলেছে নদীর জলে। বললাম কণা, ভীষণ খিদে পেয়েছে। চলো ওঠা যাক। ক্যান্টিনে খেতে খেতে তোমার কথা শুনব। ও বলল দরকার নেই আমার কথা শুনে। তোমার তো খিদে পেয়েছে, কি খাবে বল? মানে, আমি যা খেতে চাইব তাই তুমি খেতে দেবে? না তা হয়তো পারব না, তবে আমার কাছে যা আছে তা তোমাকে দিতে পারি।
বুঝতে পারছি না অশ্রুকণা কোন দৃষ্টিভঙ্গীতে কথা বলছে। এত কাটাকাটা কথাতো ও কোন দিন বলেনা। যাই হোক আমি অন্যরকম ব্যাখা না করে বললাম, তোমার সঙ্গে যা আছে তা খেতে আমার কোন আপত্তি নেই। আসলে খাওয়ার ব্যাপারে আমার কোন বাছ বিচারই নেই। খিদের সময় পেট ভরার মতো যে কোন রকম খাবার পেলেই আমার চলে যায়। ও চুপ করে আছে। কোন কথা বলছেনা। বললাম, কি এত চুপ করে আছো যে? না। ভাবছি? কি ভাবছো? ভাবছি তোমার জীবনের এই সহজাত সৌন্দর্য যদি আমি পেতাম! তোমার কোন কথাই বুঝতে পারছি না আমি। ও বলল বুঝে তোমার কাজ নেই প্রান্তিক। তারপর নিজের ব্যাগ থেকে বের করলো টিফিনের কৌটো। পরোটা আলুভাজা এবং সন্দেশ। কৌটো খুলে আমার হাতে দিয়ে দিল সবটাই। বললাম। তোমার টা? আমি খেয়েছি। মিথ্যে কথা। আমি মিথ্যে কথা বলিনা। এটাও মিথ্যে কথা। তুমি কি আমার সঙ্গে ঝগড়া করবে নাকি?
আমি অবাক হয়ে গেলাম ওর কথা শুনে। বললাম তোমার সঙ্গে ঝগড়া করবো? কেন বলতো? কি করেছো তুমি যে তোমার সাথে ঝগড়া করব। ও বলল, তাহলে আমার সঙ্গে তুমি ঝগড়াও করতে চাওনা। তারপর ধীর গলায় বলল জানতাম প্রান্তিক, আমার কোন মূল্যই নেই তোমার কাছে। অথচ এ কদিন আমি প্রতি মুহূর্ত তোমাকে এড়িয়ে চলেছি কেন, জান? আমি আবারও অবাক হয়ে তাকালাম ওর দিকে। ও বলে চলল, কি জানি তুমি হয়তো আমাকে এড়িয়ে চলবে তাই। না হলে যে কথা মুখে বলতে পারতাম, তা চিঠিতে বলার দরকার হতো না। কণ্ঠভারি, দৃষ্টি উদাস, মন যেন বিষণ্ণ। বললম সত্যি আমি কিছু জানি না কণা, কি হয়েছে তোমার? কি এমন করেছে যাতে তোমাকে এড়িয়ে চলার প্রয়োজন হবে আমার? না কিছুনা। তার মানে আমাকে তুমি বলতে চাওনা। থাক ওসব কথা, বল কেমন আছো?
আমি রেগে গিয়ে বললাম, এবার কিন্তু সত্যি এড়িয়ে চলার মতো কথা বলছ। কি হয়েছে তোমার? কি করেছে এমন? না কিছুনা। ও আস্তে বলল। কিছুনা বললে হবে কেন?
আমাকে তুমি বলতে চাওনা? ও বলল জানিনা, এবার খেয়ে নাও তো। আমারই বোঝ উচিৎ ছিল। তুমিতো টিফিন আনো না খিদেতো তোমার লাগতেই পারে। না আমি খাবনা। যতক্ষণ তুমি না বলবে ততক্ষণ আমি কিছুই খাবনা। ও বলল, মাথা গরম করোনা প্রান্তিক, আজ খেয়ে নাও। তোমাকে নিশ্চয়ই বলব, তবে আজ নয় আরেক দিন।
আমার যে কি হল জানিনা, ওর সমস্ত খাবারটা নদীর জলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললাম, তবে আমিও আরেক দিন খাব। ও অস্পষ্ট ভাবে উচ্চরণ করলো কি নিষ্ঠুর তুমি। কিন্তু আমি তা শুনেও শুনলাম না। ও আর কোন কথা বলল না। আমারও যেন কিছু বলার নেই। মনের মধ্যে একটা শুধু প্রশ্ন, আমি কি সত্যিই এত অভিমানী? দীর্ঘক্ষণ কেটে গেছে একই ভাবে। এখুনি আঁধার নামবে। বললাম, আজ তা হলে ওঠা যাক কণা। ও হ্যাঁ–না কিছুনা বলে তেমনি মাথা নীচু করে রইল। আমি এবার ওর মাথাটা নিজ হাতে ঘুরিয়ে দিয়ে বললাম কি হল? কিন্তু একি! চোখের জলে ওর বুকের আঁচল পর্যন্ত ভিজে গেছে।
অঝোরে কাঁদছে ও। কী হয়েছে ওর?
জানিনা একে ভালোবাসা বলে কী না। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে শুধু ওর কথা ভেবেছি। কি হয়েছে ওর? ওকে কি কেউ ঠকিয়েছে? না ও ঠকিয়েছে কাউকে। জানিনা, কিছুই জানিনা। মনটা এক অজানা দুশ্চিন্তায় ভারি হয়ে ওঠে।
তখন সন্ধ্যা অতিক্রান্ত। বাস স্ট্যান্ডে ওকে বললাম, আমি কি এগিয়ে দিয়ে আসব। তোমাকে? না। আমার কিন্তু কোন অসুবিধা নেই। আমার আছে। ও ঠিক আছে।
রুটের বাস এসে দাঁড়াতেই, আমি ওকে তুলে দিয়ে নিজের বাস ধরব বলে দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎ মনে হলো আমি তো রেহানাকে কথা দিয়েছিলাম। কি করে তা ভুলে গেলাম। একবার মনে হল থাক আজ আর যাবনা। সঙ্গে সঙ্গে মনে হল, তা কি করে হবে? আমিতো কথা দিয়েছি রেহানাকে। একটু দেরি হবে। কিন্তু আমি যাবই। ওর মা আফরোজ বেগম আমাকে সন্তানের মত ভালোবাসেন তাকে অপেক্ষায় রাখা কি ঠিক হবে? আর রেহানাই বা কী ভাববে? কিন্তু ওখানে যে এতটা দেরি হয়ে যাবে, বুঝতে পারিনি।
যখন পিসির ওখানে ফিরেছি তখন রাত ১০টা। সারাটা পথ ভাবতে ভাবতে এসেছি। পিসি না জানি কী না কী বলবেন। এমনিতেই দেরি হলে হাজারো কথা শুনিয়ে দেন। আর আজতো একেবারে রাত দশটা। কিন্তু এমন ভাবে ঘটনাগুলো একের পর এক ঘটে গেল যে, আমার কোন উপায় ছিল না, ভয়ে ভয়ে বাড়ীতে ফিরে দেখি পরিমলবাবু ফিরে এসেছেন। উনি জানতে চাইলেন কেমন আছো প্রান্তিক? পরীক্ষা কেমন হয়েছে? বললাম ভালো। আপনার শরীর কেমন? উনি বললেন ভালো, তারপর আমাকে জিজ্ঞাস করলেন তোমার কন্তু এ বাড়ীতে ফিরে মেন হয়েছে? বলল তোমার
পিসি কি কোথাও গেছেন? বলে গেছেন কি কিছু তোমাকে? আমি অবাক হয়ে বললাম, কেন উনি ফেরেন নি? না ফেরেননি, তাইতো তোমাকে জিজ্ঞাসা করছি। তাছাড়া ওনার অফিস থেকে বেরুবার আগেই আমি বেরিয়ে এসেছি। বললাম আপনি আসবেন উনি জানেন? তাতো ঠিক জানিনা, তবে চিঠি একটা দিয়েছিলাম। পেয়েছে কীনা তাও জানিনা। বললাম তার মানে আপনার চা বা কফি কিছুই খাওয়া হয় নি। আমি দেখছি বলে তাড়াতাড়ি গ্যাস জ্বালিয়ে ওনার জন্য এক কাপ কফি বানালাম। একাজ গুলো অবশ্য সব এখানে এসে শিখে নিয়েছি। কলকাতা আর যাই হোক মানুষকে স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করে।
উনি কফির কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, কোথায় যেতে পারেন বলে মনে হয়। বললাম, তাতো ঠিক জানিনা পিসেমশাই। আপনি বরং ওনার অফিসে একবার যোগযোগ করে দেখুননা। নিস্পৃহ গলায় বললেন, এখন কি আর কাউকে পাওয়া যাবে? আমি চিন্তিত ভাবে বললাম, তাও ঠিক। কিন্তু কোথাও তো খোঁজ নিতে হবে। একবার থানায় খোঁজ নেবো? থানায় কেন? কোথাও কোন দুর্ঘটনা তো হতে পারে। হ্যাঁ তা পারে। তারপর বললেন দরকার নেই। তুমি একটা কাজ করতে পারবে? বলুন! মনে হয় হোটেল এখনো খোলা আছে। আমি টাকা দিচ্ছি, তুমি বরং রাতের খাবারটা কিনে নিয়ে এসো।
মাঝে মাঝে যে রাতের খাবার হোটেল থেকে আনা হয় না তা নয়। তবে, সেটার পরিবেশ এবং পরিস্থিতি আলাদা রকম। কিন্তু মনে মনে ভাবলাম, পিসেমশাইয়ের দিকটাও দেখতে হবে। সারাদিন উনি কিছু খাননি, কষ্ট হচ্ছে বুঝতে পারছি। বললাম, হোটেলে যেতে আসতে সময় লাগবে, তার চেয়ে আমি বরং আলু, ডিম সিদ্ধ ভাত করছি। ঘরে মাখন এবং দূধ আছে বেশী সময় লাগবেনা। উনি বললেন তা হয়তো লাগবেনা। কিন্তু কালতো তোমার পরীক্ষা আছে। পড়বে কখন? বললাম, না আমার পরীক্ষা আজই শেষ হয়ে গেছে। উনি আর কথা বাড়ালেন না, শুধু বললেন, তাহলে যা ভাল হয় কর। তার এই নিস্পৃহ। কণ্ঠস্বরে বোঝা যায় যে ভীষণ ক্লান্ত, মায়া হয় মানুষটার জন্য।
ভাত বসিয়ে দিয়ে ভাবতে বসলাম পিসি কোথায় যেতে পারেন। পরিমল বাবু বলছেন, তিনি আজ আসবেন তা তিনি আগেই জানিয়েছেন, তা হলে? হঠাৎ মনে হল দীনেন্দ্র স্ত্রীটে পিসিদের এক অফিস সহকর্মী থাকেন, একবার খোঁজ নিয়ে দেখা যেতে পারে আদৌ তিনি অপিসে গিয়েছিলেন কিনা। সঙ্গে সঙ্গে গ্যাসের আঁচ কমিয়ে আমি বেরিয়ে পড়লাম, দীপংকর বাবু বাড়ীতেই ছিলেন। অত রাতে আমাকে দেখে অবাকই হয়েছেন বুঝতে পারছি, আগেও ২/১ দিন আমি এ বাড়ীতে এসেছি বললেন কি ব্যপার প্রান্তিক, এত রাতে? আমি বললাম, পিসি এখনো বাড়ী ফেরেননি। আজ কি উনি অফিসে গিয়েছিলেন? উনি অবাক হয়ে বললেন, সেকি উনিতো অফিস থেকে আজ অনেক আগেই বেরিয়েছেন। জিজ্ঞাসা করলাম এত আগে যে? উত্তরে বললেন, পরিমলের আজ আসার কথা, অথচ একটু বরানগর যেতে হবে। আমি অবাক হয়ে বললাম বরানগর? সেখানে কোথায় যাবেন কিছু জানেন? না ঠিক জানিনা, আমি জিজ্ঞাসা করিনি। তারপর নিজেই জানতে চাইলেন ওখানেকি তোমাদের কোন আত্মীয় স্বজন নেই?
মনে মনে ভাবলাম এর কি উত্তর দেব? আমি যতদিন আছি ততদিন বরানগরের কারো কথা শুনিনি। অবশ্য কয়েকদিন ধরে অশ্রুকণাদের বাড়ী কোথায়? ওদের বাড়ীতে কে কে আছে? আমি ওদের বাড়ী গেছি কিনা এসব কথা প্রায়ই জিজ্ঞাসা করেছেন, কিন্তু সেখানে যাবেনই বা কেন। অশ্রুকণাদের ফোন আছে, ফোন করা যেতে পারে। কিন্তু ফোনটা কোথা থেকে করা যাবে? দীপঙ্করবাবু বললেন কি ভাবছ? বললাম না কিছুনা। কিন্তু ওখানে তো যাওয়ার কোন কারণ নেই, মানে আমাদের বাড়ীর সঙ্গে বিশেষ যোগাযোগও নেই। তবে কোন বিশেষ কারণে যেতে পারেন, কিন্তু এখনতো বাস ট্রাম সব বন্ধ হয়ে গেছে, অথচ পিসেমশাই খুব চিন্তা করছেন। কি যে করি। আমি কি তোমায় কোন সাহায্য করতে পারি? আমি বললাম, এখানে কি কোন ফোন পাওয়া যাবে? যেখানে যেতে পারেন বলে মনে হয়, সেখানে ফোন আছে, একবার ফোন করে দেখা যেতে পাবে। উনি বললেন, এসো আমার সঙ্গে আমাদের বাড়ীতেই ফোন আছে। তুমি ফোন নাম্বার জানতো? আমি বললাম হা জানি। ডায়াল করলে ও পাশ থেকে মেয়েলি কণ্ঠে কে যেন বললেন হ্যালো? আমি প্রান্তিক বলছি। ও তুমি? কি ব্যাপার এতরাতে কোথা থেকে ফোন করছ? আমি কথা বলছি। অশ্রুকণার সঙ্গে কথা বলার মানসিকতা এই মুহূর্তে একদম নেই। তাই উচ্ছলতা প্রকাশ না করে সরাসরি বললাম, পিসি এখনও ফেরেনি, খুব চিন্তায় আছি। চিন্তা করোনা উনি এক্ষুনি পৌঁছে যাবেন। কাল কলেজে এসো–বাই। অশ্রুকণা ফোন ছেড়ে দিল। অশ্রুকণাও বাহুল্য কথা না বাড়িয়ে যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু বলে লাইনটা কেটে দিল। আমার মনে এক জটিল প্রশ্ন। পিসি কণাদের ওখানে কেন? কিন্তু এটা ঠিক, পিসির একটা নিদিষ্ট সংবাদ পেয়ে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। মানে শেন দুর্ঘটনা ঘটেনি। দীপঙ্করবাবু বললেন, খোঁজ পাওয়া গেল? হ্যাঁ, পিসি অশ্রুকণাদের বাড়ী গিয়েছিলেন, তবে একটু আগে বেরিয়ে এসেছেন। যাক নিশ্চিন্ত।
বাড়ীতে পৌঁছানোর কিছুক্ষণ পর দেখি একটি ট্যাক্সি থেকে নামছেন পিসি? আমাকে উদ্বিগ্ন দেখে বললেন, কি ব্যাপার? আমার তখন কথা বলতে একদম ভালো লাগছেনা। বললাম, এত রাত পর্যন্ত তুমি বাড়ীর বাইরে, চিন্তা হয় না? চিন্তা কেন? আমি তো জানিয়ে গেছি, যে আমার আসতে রাত হবে, চিন্তা করোনা। কাকে বলে গেছো? কেন তোমার পড়ার টেবিলে আমি চিঠি লিখে চাপা দিয়ে গেছি তুমি পাওনি? হয়তো হবে। কিন্তু পড়ার টেবিলে যাওয়ার সময় পেলাম কোথায়।
কিন্তু আমি এই প্রসঙ্গে না গিয়ে বললাম, পিসেমশাই তোমাকে জানিয়েছিলেন যে তিনি আজই আসছেন, তাহলে কি তোমার আজ কোথাও না গেলে হতো না? উনি ভীষণ রেগে মেগে বললেন, কি সব আজে বাজে কথা বলছ। আমাকে কেউ কিছু জানায়নি। যাও ঘরে যাও। উনি এতটা রেগে আছেন কেন জানি না। কিন্তু এত কঠিন কথারও কোন প্রতিবাদ না করে আমি রান্না ঘরে এসে ঢুকলাম আর উনি আমার পিছন পিছন এসে ঢুকলেন সেখানে। গ্যাসে তখন ভাত প্রায় ফুটে এসেছে আঁচটা বাড়িয়ে দিয়ে খানিক পরে ভাতটা নামিয়ে নিলাম।
পিসি কোন প্রতিক্রিয়া না জানিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে ভুকে গেলেন। আমি টেবিলে পেপার ওয়েটে চাপা দেওয়া পিসির লেখা কাগজটা তুলে নিলাম। প্রান্তিক, আমার একটু কাজ আছে। ফিরতে দেরি হবে। চিন্তা করো না। তোমার পিসেমশাইয়ের আসার কথা। আসবে কী না জানি না। ফ্রীজে মাছের ঝোল করা আছে। পারলে ভাতটা করে নিও–পিসি।
নিজেকেই নিজের ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করলো। একবারতো টেবিলটা দেখা উচিৎ ছিল। না, দেখছি আমার সাধারণ বুদ্ধিটুকুও লোপ পেয়ে গেছে। বাইরে বেরিয়ে আসতে গিয়ে শুনতে পাচ্ছি, পরিমলবাবু এবং পিসি কথা কাটাকাটি করছেন। একসময় মনে হলো, আমার ইনটারফেয়ার করা উচিৎ, কিন্তু তারপর মনে হলো না দরকার নেই। একসময় নিশ্চয়ই বন্ধ হবে। স্বামী স্ত্রীর ঝগড়া একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। তা ঘটতেও যেমন সময় লাগে না মিটতেও তাই।
খানিক পরে আমি পিসেমশাইকে ডাকলাম। বললাম পিসেমশাই আসুন। খাবার দিয়েছি।
ছোট্ট সংসার, এসব কাজ গুলো শিখে নিতে হয়েছে। অবশ্য তার জন্য আমি পিসির কাছে কৃতজ্ঞ। পিসিও এলেন। বলতে গেলে নীরবেই রাতের খাওয়া শেষ হল।
রাতে কিছুতেই ঘুম আসছেনা। চিঠিতে লিখেছেন, পরিমলবাবুর আসার কথা, আবার আমাকে বললেন, উনিতো জানেন না। এসবের মানে কি? আবার আজই অশ্রুকণাদের বাড়ী যাওয়ার দরকার কি ছিল?
পরের দিন অশ্রুকণার সঙ্গে দেখা হয়েছিল, খুব হাসিখুশী। ম্যাচিং করা শাড়ী ব্লাউজ চটি পরেছে কণা। তার সঙ্গে ম্যাচিং করা সবুজ টিপ। শ্যাম্পু করা চুলে এলো বেণী। ভীষণ ভালো আর সুন্দব দেখাচ্ছে অশ্রুকণাকে। ঠাট্টা করতে ছাড়লাম না, বললাম, আজকি তুমি ছেলেদের মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য এই অপরূপ সাজে সেজেছো কণা? ও ঠাট্টা করেই জবাব দিলো, মনে হচ্ছে তোমার মাথাটাই শুধু ঘোরেনি এখনো, ওটা যদি ঘুরতো তাহলে না হয় বুঝতাম তোমার কথার একটা মূল্য আছে। বললাম, তাই বুঝি? ও কিছু বললনা, শুধু হাসল, আমি বললাম, আজ কি তোমার কলেজে কোন কাজ আছে? কেন বলত। না এমনি বলছিলাম।
আমরা কলেজ থেকে একটু দূরে চায়ের দোকানে এসে বসলাম। ও বলল এখানে বসলে যে। বা! তুমিতো বলনি কোথায় যাবে? আমি না বললে বুঝি তোমার কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না? বললাম সে কথা ঠিক নয় কণা। আসলে তোমাকে একটু বুঝতে সময় দেবেতো? তোমাকে ঠিক বুঝতে পারছি না।
ও আমোক বলল আচ্ছা তুমি কি কাউকে বোঝ? আমি অবাক হয়ে বললাম তার মানে? ও উত্তরে হঠাৎ বলল আচ্ছা, দেবযানীর ওই কথাটা তোমার মনে আছে? কোন কথাটা। ওই যে দেবযানী যেখানে বলছে, কখনো কি এ হয় নাই মনে, তৃপ্ত চোখে আজি এরে দেখায় সুন্দর। আমি হাসতে হাসতে বললাম, আগে চা খাই তারপর ভেবে দেখা যাবে।
ও যেন চুপসে গেল। বললাম কি হলো? না কিছুনা। চাটা খেয়ে আমরা হাঁটতে হাঁটতে শিয়ালদায় এলাম। বললাম, এবার বল কোথায় যাবে? কোথাও না। মানে? তারপর অবশ্য জানতে চাইলাম ছবি দেখবে? না। তাহলে চলনা মিনতি সেনদের বাড়ী থেকে ঘুরে আসি। অনেক দিন যাওয়া হয় না। আমার ভালো লাগছেনা প্রান্তিক। তাহলে চলো আমরা ফিরেই যাই। হ্যাঁ তাই চলো। আমরা আবার ফিরলাম। চলতি বাসে উঠে পড়লো ও আমাকে কোন কিছু বোঝর অবকাশ না দিয়েই। হতভম্বের মত শুধু বললাম, আমার যে অনেক কথা জানার ছিল কণা। সেই ক্ষণিকের অবসরে ও শুধু বলল, আমার কিছু জানাবার নেই। হু হু করে আমার সামনে দিয়ে বাসটা বেরিয়ে গেল।
এই ক্ষণিকের আনন্দ ও বিদায় দৃশ্যে বিষণ্ণতায় ভরে গেল আমার মন। মাঝে মাঝে মনে হয় একে যেন চিনি, আবার কেন যেন মনে হয় ও অনেক দূর-দূরান্তের। আর একথা মনে হতেই কখনো যা হয়নি, তাই যেন হতে লাগলো আমার ভিতরটায়, যেন বুকের মাঝ খানটাতে হু হু করে এক নিঃসঙ্গতার সুর বেজে চলেছে অবিরাম। কেন বুঝতে পারছি না ওকে আর ওই বা কেন এই আধো ধরা আধো ছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে বার বার। আমিই বা কি চাই? আমিই বা নিজেকে এমন করে অপ্রকাশ্যতার ঘেরাটোপে নিজেকে আবদ্ধ করে রাখছি কেন?
হাঁটতে হাঁটতে আবার সেই শিয়ালদা স্টেশন। প্লাটফরমে ঢুকে পড়লাম। শুনতে পাচ্ছি ডানকুনির ট্রেন ছাড়বে এখনি। কে যেন জোর করে আমাকে ওই ট্রেনে তুলে দিলো। কিন্তু কোথায় যাব? বরানগরে ঢুকতেই নিজের খেয়ালে নেমে পড়লাম ট্রেন থেকে। পথ চিনিনা। রিক্সায় উঠে পড়লাম এবং মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম অশ্রুকণাদের বাড়ী। ভাবতে আশ্চর্য লাগে এখানে কি আমি আমার নিজের ইচ্ছেয় এসেছি, না কেউ আমায় জোর করে নিয়ে এসেছে?
মনে মনে ভাবলাম, তবে কি এতক্ষণেও আমি অশ্রুকণাকে ভুলতে পারিনি। না ওর ওই ভাবে চলে আসাটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারিনি বলেই মুখোমুখি বোঝ পড়ার তাগিদটাই আমাকে এখানে পৌঁছে দিল। জানিনা, কিছুই জানিনা আমি।
কলিং বেল টিপতেই বেরিয়ে এলেন শ্রীময়ীদেবী। অশ্রুকণার মা। আমাকে একা দেখে বললেন, তোমার সঙ্গে অশ্রুর দেখা হয়নি? বিস্ময় আর অবাক দৃষ্টিতে আমার উত্তরের জন্য প্রতীক্ষা করতে থাকেন তিনি। বললাম–হা হয়েছে। ও কোথায়? এখনও তো আসেনি। উনি আমাকে ভিতরে এসে বসতে বললেন। তারপর বললেন, ও যে বলে গেল তোমার সঙ্গে ব্যান্ডেল যাবে। যাওনি বুঝি?
কি যে উত্তর দেব বুঝতে পারছি না। ও ব্যালে যাওয়ার কথা একবারও বলেনি আমাকে। তবুতো উত্তর একটা দিতে হবে, বললাম ওকে জিজ্ঞাস করাতে ও বলল, না আজ আর কোথাও যাবে না, বাড়ীতেই ফিরে যাবো। ভাল লাগছেনা। মায়ের উদ্বিগ্নতা নিয়ে শ্রীময়ীদেবী বললেন শরীরটা খারাপ হয়নিতো? বললাম, মনে হয় না। উনি বললেন তুমি একটু বোস, আমি এখনি আসছি।
বাইরে আবার কলিং বেলটা বেজে উঠলো। আমি দরজা খুলতেই ও অবাক হয়ে তাকালো আমার দিকে। আমি আস্তে বললাম, ব্যান্ডেলে যেতে চেয়েছিলে আমাকে বললে
কেন? আমি কিন্তু মাসীমাকে বলেছি, ভাল লাগছে না বলে ও আজ আর যেতে চায়নি। দেখ তুমি আবার অন্য রকম কিছু বলোনা। ও, আচ্ছা, বলে দাঁড়িয়ে রইল। বললাম ভিতরে আসবেনা? ও ঢুকতে ঢুকতে বলল, আমার মন বলছিল তুমি আসবে। তারপর বলল আমার ও রকম ব্যবহারের জন্য আমি সত্যিই দুঃখিত প্রান্তিক।
শ্রীময়ীদেবী ওকে দেখে বললেন, কি হল শরীর খারাপ? না। তাহলে ব্যান্ডেলে যাবি বলেও গেলিনা কেন? উত্তরে বলল হঠাৎ মনে হল, যাবো না। বিরক্তি মিশিয়ে শ্রীময়ীদেবী বললেন তোর এই হঠাৎ হঠাৎ খেয়াল কবে বন্ধ করবি অশ্রু? আর তাছাড়া ওকে একলা ছেড়ে দিয়ে কোথায় গিয়েছিলি? একটু দরকার ছিল মা। শ্রীময়ীদেবী রাগত ভাবে বললেন সে তো বুঝলাম, কিন্তু তা কি পরে করলেও চলতো না। ছেলেটা কতক্ষণ বসে আছে বলতো? তারপর বললেন চা খাবি? অশ্রুকণা বলল চা করেছে নাকি? উনি তেমনি ভাবে বলে চলেন, না করিনি, কি করে জানব কখন আসবি? যা শাড়ীটা ছেড়ে ফেল, আমি তোর চা টা করে নিয়ে আসছি।
আমি বললাম, দরকার নেই মাসিমা। আপনি বরং একটা খালি কাপ নিয়ে আসুন। আমারটা ভাগ করে নিচ্ছি। অশ্রুকণা বলল, সেই ভাল। শ্রীময়ীদেবী আর কথা বাড়ালেন না। একটা খালি কাপ এনে রাখলেন টেবিলের উপরে।
আমাকে একা পেয়ে এক সময় অশ্রুকণা বলল, জান প্রান্তিক আমার না ভীষণ ভালো লাগছে, ভীষণ, ভীষণ। হঠাৎ তোমার কি হলো এত ভালো লাগার। ও বলল, সে তুমি বুঝবে না প্রান্তিক। তারপর বলল একটু বোস আমি শাড়ীটা ছেড়ে আসছি।
পিসি ও পরিমলবাবুর মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। গতদিন থেকে পিসি অন্য ঘরে নিজের বিছানা আলাদা করে নিয়েছেন। ঘরটা আমার পাশের ঘর।
আমার আর একমুহূর্তও এবাড়ীতে ভালো লাগছেনা। পরিমলবাবু অফিসে চলে গেছেন। পিসির তখনো কোন তাড়া নেই। বললাম, অফিসে যাবে না? না। কেন? ছুটি নিয়েছো? না, যেতে ইচ্ছে করছেনা তাই। তুমিতো এমন হঠাৎ করে অফিস কামাই কর না। তা তোমাকে কি সব কথাই জানতে হবে? আমি বললাম, তুমি কিন্তু অকারণে রেগে যাচ্ছ। তারপর বললাম একটা কথা বলব? বল। বললাম, মনে হচ্ছে পিসি তুমি ঠিক করছ না। হঠাৎ উনি রেগে গিয়ে বললেন, আমার পক্ষে কোনটা ঠিক, কোনটা বেঠিক তা কি তোমার কাছ থেকে জেনে নিতে হবে? এও তোমার রাগের কথা পিসি। কিন্তু একটু স্বাভাবিক ভাবে চিন্তা করে দেখো, তুমি যা করছ তা ঠিক কীনা। কি ঠিক নয়। এই যে আলাদা ভাবে থাকা, এটাকি তুমি ঠিক করছ? পিসি বললেন এটা আমাদের স্বামী স্ত্রীর ব্যক্তিগত ব্যাপার, এখানে তোমার নাক গলানো একেবারে অন্যায়। আমিও দমবার পাত্র নই। বললাম, হয়তো একদিন এটা তোমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার ছিল, কিন্তু আজ আর তা নেই, মানে? মানে কি আমাকে বুঝিয়ে বলতে হবে? মনে হচ্ছে তুমি অনেক বড় হয়ে গেছে। বড় যে হয়ে গেছি তা কি তুমি অস্বীকার করতে পার? পিসি বললেন, তুমি যতই বড় হও না কেন আমার কাছে তুমি সেই ছোট্ট আছ। আমি জোরের সঙ্গে বললাম। তোমার একথা মানিনা পিসি। তুমি কিছুতেই আমাকে আর আগের মত ছোট্টটি ভাব না। তা হলে কি ভাবি। কি ভাব সেটাতো তোমারই ভালো করে জানার কথা, আমি কি করে বলব। আমি শুধু তোমাকে বলতে চাই, একই বাড়ীতে এভাবে আলাদা থাকাটা আমার ভাল লাগছেনা। নিজেকে অপরাধী বলে মনে হচ্ছে। এভাবে যদি তোমবা থাকতে চাও তা হলে আমাকেও এখান থেকে চলে যেতে হবে।
পিসির কণ্ঠে উম্মা। বললেন, তাতো যাবেই। পিসির প্রয়োজন তো ফুরিয়ে গেছে। তোমার কাছে। আর থাকার প্রয়োজনটা কিসের। আমি বললাম এও তোমার ভুল পিসি। পিসি বললেন, কোন দিনই তোমাকে আর আমার দরকার হবে কীনা জানিনা। ভবিষ্যতই তা বলতে পারবে। আজ কিন্তু অন্তত নিজের স্বার্থের জন্য তোমাকে আমার প্রয়োজন। তাই যখন তখন ছেড়ে যাওয়ার কথা বলনা প্রান্তিক, তাতে আমার কষ্ট হয়। কিন্তু আমাকে নিয়ে তোমাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি হোক তা আমি কি করে চাইব? তোমাকে নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে এ তোমাকে কে বলল? আমরা বলেছি কখনো? না বলনি, তবে তুমি যা করছ তাতে আমাকে একটা পক্ষ হতে বেশী সময় লাগবেনা। তাছাড়া পিসেমশাইয়ের দোষটা কি? পিসি বললেন, তুমিওতো পুরুষ ছেলে তাই আরেকটা পুরুষের দোষ দেখতে পাওনা, পাবেও না কোনদিন। তোমাদের কাছে তো মেয়েরাই সব অশান্তির মূলে। তারা মানিয়ে নিতে পারেনা, তারা অবুঝ, তারা স্বার্থপর। তারা নিজেরটা যেমন বোঝে, অন্যেরটা সে ভাবে বোঝেনা। এসব তো প্রবাদ বাক্য হয়ে গেছে। আর তাকে সযত্নে লালন করে চলেছে। তোমাদের মত পুরুষেরাই। তাই তুমি বুঝবেনা। পিসি যে মানসিক ভাবে যন্ত্রনা বিদ্ধ তা বুঝতে অসুবিধা হয় না।
আমি আস্তে বললাম, আমার মনে হয় তোমার এ অনুমান ভুল। পিসি বললেন দেখ আমি মেয়ে। পুরুষের যে কোন পদক্ষেপ মেয়েদের চোখে যে ভাবে প্রতিভাত হয়, তা আর কাবো চোখে হয় না। তাই তোমার কথা মানতে পারছি না। আমি আরো জোরের সঙ্গে বললাম, এটাও তোমার সম্ভবত ভুল ধারণা পিসি, বরং তুমি যদি বলতে মেয়ে হিসাবে তুমি আরেকটা মেয়ের তাকানো, চাওয়া, তার প্রতিটি পদক্ষেপ, তার মন কি চায়, একটা মেয়ে হিসাবে তোমার তা অজানা নয়, তাহলে তারমধ্যে হয়তো খানিকটা সত্য থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু তুমি মেয়ে বলে কোন পুরুষের পদক্ষেপ তোমার নখদর্পনে তা আমি বিশ্বাস করিনা। তারপর হঠাৎ ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে জানতে চাইলাম বলতো আমি কি চাই? আমিও তো একজন পুরুষ।
পিসি চমকে উঠে বলল তার মানে? কি বলতে চাও তুমি? আমাকে তুমি এত কাছ থেকে দেখছ, আমার প্রতিটি গতিবিধি তোমার নখদর্পণে শুধু নয়, তুমি তা নিজ অভিজ্ঞতায় তীক্ষ্ণভাবে বিচার করতে চাইছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও কি তুমি বলতে পারবে আমি কি চাই? আমার ভেতরটায় কিসের যন্ত্রণা?
পিসি বোধ হয় আমার কাছ থেকে এমন অদ্ভুত প্রশ্ন আশা করেনি। কিন্তু তাই বলে দমবার পাত্রীও তিনি নন। বললেন তা আমি কি করে জানবো তুমি কি চাও? হয়তো চাও, আমি যা চাই তার বিপরীত কিছু। তারপর একটু থেমে বললেন, আর আমাকে বিরক্ত করো না। আমি ভীষণ ক্লান্ত প্রান্তিক।
আমি দমে গেলাম। এরপর কি ভাবে কি বলা যায় বুঝতে পারছি না, তবু বললাম, পিসি তা নয়, তুমি যা চাও হয়তো আমিও তাই চাই, শুধু আমরা কেউই জানিনা, সত্যি করে কি চাই আমরা। ঐ সব চাওয়া পাওয়া থাক পিসি। অনেকদিন গ্রামের বাড়ীতে যাইনা। ভাবছি একবার যাব, তুমি যাবে নাকি। তুমিও তো যাওনা অনেক দিন।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পিসি বললেন, যেতে তো ইচ্ছে করে প্রান্তিক, তবু যেন মন থেকে সাড়া পাইনা। কোথায় যেন আমার সব কিছু গোলমাল হয়ে গেছে। কাউকে আর আগের মতো বিশ্বাস করতে পারিনা। তুমি যখন এত কাছে থেকেও আমাকে বুঝতে পারছনা। বুঝতে পারছি কেউ আমাকে বুঝতে পারবেনা। অনেক ছোট তুমি। তবু পারবে কি বলতে, কি হলে আবার আমি নিজের মনে সেই হারানো বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে পারব?
বুঝতে পারছি পিসির দুটি চোখ ছলছল করে উঠছে। এখন ওনার সত্যি একা থাকা দরকার। আর দরকার অন্তত একবার মিনতি সেনের সঙ্গে তাকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া। আর আমাকেও এখানে বেশীক্ষণ অপেক্ষা করা ঠিক নয়। তাই আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসতে চাইলে পিসি বললেন তুমি কোথায় যাচ্ছ প্রান্তিক? বললাম একবার মিনতি সেনদের বাড়ী যাব ওনার বাবা খুব অসুস্থ। আমাকে একবার যেতে বলেছেন। ভীষণ অবাক হয়ে তাকালেন আমার দিকে। তোমাকে যেতে বলেছেন? তোমার সঙ্গে তার প্রায়ই দেখা হয় বুঝি? বললাম না পিসি প্রায়ই দেখা হয় না, তবে মাঝে মাঝে হয়। কিভাবে? ওর অসুস্থ বাবা বলেছিলেন তুমি মাঝে মাঝে এসো দাদুভাই, তাই মাঝে মাঝে আমি নিজেই যাই। দাদুভাই কথাটা কানে যেতে কেমন যেন চমকে উঠলেন পিসি। খানিকক্ষণ এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে কিছু একটা বুঝবার চেষ্টা করেন পিসি। তারপর সহজ ভাবে জানতে চাইলেন, সম্পকটা সুন্দর, কিন্তু বুঝতে পারছি না প্রান্তিক মিনতি সেনের বাবা তোমার দাদুভাই হলেন কি করে? বললাম সে অনেক কথা পিসি। এক কথায়তো তার উত্তর দেওয়া যাবে না। তার চেয়ে একদিন আসতে বলব মিনতি সেনকে। দেখবে তোমার মন কত হাল্কা হয়ে গেছে।
আমি উসুক হয়ে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে, যদি কিছু বলেন? কিন্তু না, আমার মনের আশা ব্যঞ্জক কিছুই বললেন না, পিসি। শুধু বললেন, বুঝতে পারছি প্রান্তিক আমি তোমার কাছে মূল্যহীন। আমার কোন দাম নেই তোমার কাছে। এখন ওই মিনতি সেন, ওঁর বাবা, এঁরাই তোমার সব, এরাই তোমার আপনজন। তাহলে আর দেরি করে কী লাভ? যাওনা তুমি মিনতি সেনদের ওখানে। হয়তো একদিন জানতে পারবো, তুমি এখন পাকাঁপাকি ভাবে ওখানেই আস্তানা গেড়েছে। আমাকে হয়তো চিনতেও পারবেনা। সেই চিরন্তন নারী, ভিতরটা যার ঈর্ষার আগুনে জ্বলছে। বুঝতে পারছি নিজেকে শোধরাবার কোন চেষ্টাই নেই নীলাঞ্জনা পিসির। কিন্তু আর কথা বাড়ানো ঠিক হবে না। আস্তে আস্তে ওর ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরের পড়ার চেয়ারটায় এসে বসলাম। আমার ভিতরটাও বড্ড অশান্ত। কি যে বলতে চেয়ে ছিলাম, আর কি যে বললাম, সব যেন কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। সুস্থ হয়ে বসে থাকতে পারছি না। আবার উঠলাম। তারপর পিসিকে কিছু না বলে বেরিয়ে পড়লাম।
আবার সেই পথ ভ্রান্ত পথিকের মতো পথ খুঁজে বেড়ানো আর পথে পথে ঘোরা। মিনতি সেনকে এক রকম বুঝেছি। আমার বোঝাটা ঠিক না বেঠিক সেটা পরের কথা। আর নীলাঞ্জনা পিসি, কিছুতেই বুঝতে পারছি না তাকে। অথচ আমি তো কত কাছে তার। কিছুতেই তার তল পাওয়া যায়না।
কিন্তু একি, আমি রেহানাদের বাড়ীতে এলাম কি করে? এখানে তো আমার আসার কথা নয়। কখনই বা ঘর থেকে নেমেছি পথে, আর সেই পথইবা কী ভাবে নিয়ে এসেছে। আমাকে এখানে, একি কোন ভোজবাজী? দিশাহারার মতো ভাবছি কলিং বেলটা বাজাবো কিনা, হঠাৎ জানালা থেকে মুখ বাড়িয়ে সেলিনা বলল প্রান্তিক ভাইনা? অমন চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন কেন? শরীর খারাপ? তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিল সেলিনা।
ও যেন বিষণ্ণ হৃদয়ে এক ঝলক আনন্দ, প্রচন্ড গরমে যেন এক পশলা বৃষ্টি, সরোবরে ফুটন্ত পদ্ম, বাগানেব রক্ত গোলাপ, যেন বসন্তের দখিনা বাতাস। যা শুধু দেহের ক্লান্তি দূর করে না, মনের ক্লান্তিও শুষে নেয় আপন ক্ষমতায়।
আজ যদি না আসতেন, আর কোনদিন কথা বলতাম না আপনার সাথে। অবাক হয়ে বললাম কেন বলত? বা বলব কেন? দিদিই এখন আপনার সব। তারপর বলল পরপর ২ দিন এসেছেন একদিনও আমার সঙ্গে দেখা করেননি। কেন একটু দেরি করলে কি আপনার মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেতো? ভিতর থেকে আফরোজ বেগম বললেন, কার সঙ্গে কথা বলছিসরে সেলিনা। ও জোরে জোরে বলল, প্রান্তিক ভাই। জান মা, ও বোধ হয় জেনে গেছে রেহানা বাড়ী নেই, তাই ঢুকতেই চাইছিলেন না, আমরা যেন কেউ নই। রেহানাই সব। মা, এর বিচার তোমাকে করতেই হবে। সেলিনাকি এতই হেলা ফেলার? প্রান্তিক ভাইকে একথা বুঝিয়ে দেওয়ার দরকার আছে যে সেলিনা ছাড়া রেহানার কোন মূল্য নেই। অভিযোগ করতে করতে ও যে মুখ টিপে হাসছিল তা আমার দৃষ্টি এড়িয়ে যায়।
এক নিঃশ্বাসে এতগুলো অভিযোগ। এক সঙ্গে শুনতে বেশ খারাপ লাগলেও এক ধরনের মজাও পাচ্ছিলাম। ভীষণ মজা। সত্যি সেলিনা যেন প্রচণ্ড দাবদাহে এক হঠাৎ ঝটিকা। মুহূর্তে সব ক্লান্তি দূর করে দেয়। আফরোজ বেগম বললেন, কি কথার ছিরি তুই কি, সাধারণ ভদ্র ভাবেও কথা বলতে পারিসনা। তারপর আমার দিকে ফিরে বললেন, তুমি কিছু মনে করোনা বাবা। ও এইরকমই, মায়ের সস্নেহ প্রশ্রয়।
আমি নিজেও জানি, সেলিনা ঐ রকম, আর মনটা যেন শ্বেতশুভ্র গোলাপ পাপড়ি। ভাল না লেগে উপায় নেই। বললাম, না মাসিমা আমি কিছু মনে করিনি। তাছাড়া সেলিনা তো অভিযোগ করতেই পারে। এ বাড়ীতে আসব অথচ ওর সঙ্গে দেখা করব না এ অবিচার ও মানবে কেন? তবে? এইবার পথে এসেছেন প্রান্তিক ভাই, বলল সেলিনা। কিন্তু তারপর হেসেই বলল, তাই বলে মন খারাপ করবেন না কিন্তু। আমি বললাম, কেন মন খারাপ করব কেন? রেহানার সঙ্গে দেখা হবে না তাই। এটা ওর দুষ্টমি না সত্যি সত্যি দেখা হবে না, কোনটা সে বলতে চায় সেই ধন্ধে পড়ে যাই আমি। মনের মধ্যে যেমনই হোক, মুখে বললাম, আমি কি শুধু রেহানার সঙ্গে দেখা করতেই আসি? ওর সঙ্গে তো কলেজেই দেখা হয়। তবে আসেন কেন? হেসে বললাম সেলিনাকে, মাসীমাকে দেখতে। ও বড় বড় চোখ তুলে বলল এ কিন্তু ভালো কথা নয় প্রান্তিক ভাই। আমি কিন্তু বক্সিং-এর মেয়ে। ডালিমের কথা মনে আছেতো? আমি চুপসে গেলাম। সেলিনার মনে কি অন্য কোন ছায়া পড়ছে। তারপর খিল খিল করে হেসে উঠে বলল, না প্রান্তিক ভাই, আপনি যাদু জানেন দেখছি। কোথায় রেহানার অবর্তমানে ভাবছি একটু মনের কথা বলব তার আর উপায় নেই জানালার দিকে তাকিয়ে বলল, ঐ দেখুন না রেহানা ফিরে আসছে। অথচ যাওয়ার সময় বলে গেছে। সন্ধ্যার আগে ফিরবেনা। আর দেখুন মাত্র আধঘন্টার মধ্যেই ফিরে এলো৷ ইনটুইশান না পূর্ব পরিকল্পনা কে জানে। বলতে বলতে আরো খিল খিল করে হাসতে হাসতে মরাল গ্রীবা দুলিয়ে এমন ভাবে হেঁটে চলে গেল যেন সরোবরে রাজহংসী সাঁতার কেটে এগিয়ে চলেছে জল ভেঙ্গে ভেঙ্গে। সত্যি অবাক হয়ে ভাবছি কি অফুরন্ত প্রানশক্তি থাকলে জীবনটাকে এমন সহজ ভাবে ভাসিয়ে দেওয়া যায়।
পাশে দাঁড়িয়ে রেহানা বলল, কখন এলে? কাল তো দেখা হলো বলনিতো আসবে। কি আর বলার অছে। তবু বললাম কোথায় গিয়েছিলে? আর বলল না। খিদিরপুরে ছোট মাসীর ওখানে যাব বলে বেরিয়ে ছিলাম, শিয়ালদায় কি এক গণ্ডগোল হয়েছে, বাস-ট্রাম সব বন্ধ। বললাম ভালই হয়েছে। ও বলল কেন ভালো হয়েছে কেন? তুমি তো বলনি। তুমি খিদিরপুরে যাবে। কেন বললে যেতে নাকি? আপত্তি না থাকলে আমার তরফ থেকে অসুবিধা ছিল না। তারপর বললাম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলবে বোস না, ও বলল, একটু অপেক্ষা করো শাড়ীটা ছেড়েই আসছি।
সেলিনা চা নিয়ে এলো। বলল, কই রেহানা কই? পরামর্শটা করে নিয়েছেন? অবাক হয়ে বললাম কিসের পরামর্শ? বা কি কি বলতে ভুলে গিয়েছিলেন আর কি কি বললে ঠিক মতো ম্যানেজ হয়ে যাবে বলতে বলতে আর হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল ও। শাড়ী বদলে চোখে মুখে জল দিয়ে একে বারে আটপৌরে পোষাকে রেহানা এসে বসল মুখোমুখি। কি জানি কেন এত ভাল লাগছিল ওকে, যেন ভোরের শিউলি। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ওর দিকে। বলল অমন করে কি দেখছ? তোমাকে। লজ্জায় রাঙা হয়ে রেহানা বলল ধ্যাৎ। অকারণ শাড়ীর আঁচলটা টেনে নিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিলো ও আমার দিকে না তাকিয়ে। বললাম কি অপূর্ব সহবস্থান। মানে? একজন যেন শান্ত সরোবর। আরেক জন, সেই সরোবরেই ঢেউ তুলে আনোচ্ছলতায় ডানা ঝাঁপটিয়ে সাঁতার কেটে চলেছে। ও চোখ তুলে বলল, তুমি সেলিনার কথা বলছ? জান ও ভীষণ ভাল মেয়ে। মনটা কাঁচের মত স্বচ্ছ। ওকে ভালবেসে কেউ কখনো ঠকবেনা। আমি বললাম তার থেকে বলো ঠকাতে দেবেনা। মানে? ঠকাতে গেলেই তাকে নিয়ে যাবে বস্কিংয়ের নেটে এবং সেখান থেকে ফেরার কোন উপায় থাকবেনা। কিন্তু ওর কথা থাক। তুমি কি তা হলে বলতে চাইছো, তোমাকে ভালবাসলে ঠকার ভয় আছে।
কি জানি কেন অকারণ কেঁপে উঠলো রেহানা। বলল, আমার মধ্যে এমন কিছু নেই যাতে করে কেউ আমাকে ভালবাসতে পারে। আসলে জানকি প্রান্তিক, এক অতি সাধারণ মেয়েকে কেউ ভালবাসে না। ২/১ দিন তাকে কারো ভাল লাগলেও লাগতে পারে। মানতে পারলাম না তোমার কথা। কেন? ভালবাসা মানুষের সহজ এবং স্বভাবজাত। তাই তো বিশ্বের কোটি কোটি সাধারণ মানুষ একে অপরকে ভালবেসে তাদের প্রতি ন্যস্ত দায়িত্ব পালন করে পৃথিবীটাকে আজো সুন্দর করে রেখেছে। বরং অসাধারণরা সেখানে ব্যতিক্রম। সাধারণের ভালবাসা তার স্বাভাবিক ভালবাসা, অযত্নেও তা বিকশিত, আর ঐ যে টবের গোলাপ, হয়তো অসাধারণ, কিন্তু পরিচর্যার ব্যাঘাত ঘটলে শুধু ফুল নয় তার উৎসেও মৃত্যু ঘটে মুহূর্তে। তুমি সাধারণ বলেইতো এত অসাধারণ আমার কাছে।
এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে মন হয়তো এখনই ভেঙে পড়বে এক চবম দুর্বলতায়। কিন্তু কে বুঝবে আমাকে, এ আকাশ কুসুম, এ অসম্ভব। বেহানাতো অসম্ভবকে পেতে চায় না তার পরশ শুধু অনুভব করতে চায়? সে কাঁদতে চায়। কাঁদতে চায় ভালবেসে। কাঁদতে চায় না পাওয়ার আনন্দে। বৈশাখী দুপুরের প্রখর সূর্যতাপে, এক খন্ড কালো মেঘ হয়ে থাকুক এই ভালবাসার বেশটুকু। বেহানা চায় না ঐ মেঘ জল হয়ে নামুক পৃথিবীতে, সিক্ত করুক তার তপ্ত হৃদয়। সেতো শেষ হওয়াব সঙ্কেত। না রেহানা তা চায় না। ওকে যতটা বুঝেছি তাতে বুঝতে পারি বাস্তবে নয় ও ধরা দিতে চায় অনুভুতিতে। রেহানা ডুবে আছে তাব আপন চিন্তার গভীবে, অতল সমুদ্রে ডুব দিয়ে সে যে কী কুড়াতে চাইছে, তা সেই জানে। ওর দিকে তাকাতেই দেখি হাসি হাসি মুখে কখন যেন পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে সেলিনা। ওর চোখে বিদ্যুৎ ঝলক। ইঙ্গিতে কিসের যেন ঈশারা। জানতে চাই কিছু বলবে? আবারও সেই মুক্ত ঝলক, সেই উচ্ছলতা, সেই আনন্দ প্রবাহ, নিথর সরবরে যেন হাজারো বুদ্বুদ–উত্তরে বলল থাক প্রান্তিক ভাই, নিঃশব্দতার মানেই যদি না বোঝেন, কেন যে এলেন এ পথে কে জানে।
রেহান। যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে। মনে হল গুমোট গরম থেকে মুক্তির বাতাস বয়ে নিয়ে এসেছে সেলিনার উপস্থিতি। রেহানা উঠে দাঁড়ালো। সেলিনা বলল, কিরে উঠলি যে। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি কি প্রান্তিক ভাই আপনাদের ছন্দপতন ঘটালাম। রেহানা আস্তে আস্তে ভিতরের ঘরে ঢুকে গেল, আমি বললাম, ভীষণ ভাবে তোমাকে চাইছিলাম সেলিনা। হেসে বলল কেন বৃন্দা হতে। আমি তা পারবনা। বললাম, বৃন্দা না হতে পার চন্দ্রাবলীতে আপত্তি আছে? ও বলল দাঁড়ান দাঁড়ান আপনাদের ঐ রাধাকৃষ্ণ লীলার সব চরিত্রের নামও ভালো করে মনে থাকে না ছাই। ওই যে চন্দ্রাবলীর কথা বললেন না, ওর রোলটা কি? আমি হাসতে হাসতে বললাম রাধার প্রেমের পূর্ণতা দেওয়া। মানে? প্রেমের আরেক সত্য অভিমান ঈর্ষা থেকে যার জন্ম জানতো। সেই অভিমানকে তীব্রতা দেওয়াই চন্দ্রাবলীর কাজ। বুঝলাম না। থাক তোমার বুঝেও কাজ নেই। আসলে তোমার বক্সিংএর মাঠে চন্দ্রাবলী একেবারে বাজে খেলোয়াড়। তা তুমি বেরোবে কখন? কোথায়? যেথা মন চায়। আপনিও যাবেন নাকি। যদি প্রথমে নক আউট না কর যেতে পারি। রেহানা জানে? যাব তোমার সাথে তাতে রেহানার জানার দরকার কি? তাছাড়া আমিতো রেহানার সঙ্গে যাচ্ছিনা। সাহস আছে আমার সঙ্গে বেরোবার? আগে না বেরিয়ে বলি কি করে? তাহলে দরকার নেই। আপনি বরং আরেক দিন যাবেন। কেন আজ নয় কেন? ও কি ভেবে যেন বলল, বেশ চলুন, কিন্তু সারা পথে আমার সঙ্গে আমার কথাই বলবেন। রেহানার কোন কথা কিন্তু জিজ্ঞাস করতে পারবেন না। কেন রেহানাকে তুমি ঈর্ষা কর নাকি? না মশাই না, রেহানাতো সাধারণ বাগানের সহস্র গোলাপের একটি গোলাপ মাত্র। আর তুমি? কেন? ঐ যে বড়লোকের সখের টবের পরিচতি গোলাপ। যত্ন না পেলে মুহূর্তে উৎস সহ শুকিয়ে যেতে পারে। তাইতো চলার পথে যত্ন থেকে বিচ্যুত হতে চাইনে। মিষ্টি মিষ্টি হাসছেও। বুঝলাম সব কথা শুনেছে ও। তাই বললাম, কিন্তু এমন টবও তো আছে সেলিনা যেখানে বাগানের গোলাপ ঝরে গেলেও টবের গোলাপ কিন্তু ঝরেনা। সেলিনা বলল, ও আপনি প্লাস্টিক গোলাপের কথা বলছেন তো? হবে হয়তো। তাই হয়তো ডালিমরা ছিঁড়তে পারে না। আঘাতে পর্যুদস্ত হয় মাত্র। যাকগে সে কথা, আমার সাথে পথ চলবেন বলেছেন, তাহলে আর দেরি কেন?
এতো পরিচিত সেলিনা নয়। কোথায় যেন ছন্দপতন হয়ে গেছে। এ কোন সেলিনা? আমি কি ভুল করেছি? রেহানা কি ভুল করেছে? কিন্তু মুহূর্তে মাত্র। আবার সেই সেলিনা। মুখে অমায়িক হাসি নিয়ে বললে কৈ চলুন। তারপর হেসে উঠলো খিল খিল করে। সেই পরিচিত সেলিনা। মনের মধ্যে যেন কিছু লুকিয়ে থাকতে নেই। বলল খুব ভয় পেয়ে গেছেন, তাই না? বললাম, সত্যি বেরোবে? কেন? আমার সঙ্গে যেতে সাহস হচ্ছে না বুঝি। না ঠিক তা নয়। তাহলে? আসলে! থাক থাক আর বলতে হবে না। আমারই ভুল প্রান্তিক ভাই। রেহানা একা আর আপনি রেরুবেন আমার সঙ্গে এ হয় নাকি? তারপর দ্রুত বেরিয়ে গেল ও ঘর থেকে বাইরে, তার পরে পথে।
আমি জোরে জোরে ডাকলাম দাঁড়াও সেলিনা আমিও আসছি। রান্না ঘর থেকে বৈরিয়ে এসে আফরোজ বেগম বললেন, কোথায় যাবে তুমি? উত্তরে বললাম উঠতে হবে মাসীমা। উনি বললেন, সেলিনা এক্ষুনি আসবে। ও কোথায় গেল। এই একটু দোকানে গেছে। যাবে আর আসবে। তবু আমাকে উঠতে হবে মাসীমা। ভাবছি একবার গ্রামের বাড়ীতে যাব। পরীক্ষা হয়ে গেছে অনেক দিন যাওয়া হয় না। রেহানা পাশে এসে বলল, আমরা যদি যাই, তোমরা যাও মানে? এই আমি, সেলিনা আর মা, তারপর বলল জান গ্রাম দেখতে আমার ভীষণ ইচ্ছে করে। কি যে বলব ওকে বুঝতে পারছি না। মনের মধ্যে কি যে দ্বিধা না দ্বন্দ্ব। দ্বন্দ অবশ্য একটা আছে। আমাদের একান্নবর্তী পরিবার। আমার বাবা মাকে জানি। তাদের সব কিছু মেনে নিতে অসুবিধা নেই। কিন্তু অন্যরা যদি না মেনে নেন। তারা যদি অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেন এদের। কি উত্তর দেব আমি? রেহানা বলল, কি ভাবছো? না কিছু না। আমি জানি কি ভাবছো? কি ভাবছি? আমাদের কি পরিচয় দেবে তাই না? না মানে? যা সত্যি তাই পরিচয় দেবে। বললাম তোমার তো গ্রাম্যসমাজ সম্পর্কে কোন অভিজ্ঞতাই নেই? না তা নেই। তবে তোমার অসুবিধা যে দ্বিবিধ তা বুঝতে পারছি। যেমন? একটাতো সাধারণ। আর দ্বিতীয়টা হচ্ছে আমার এবং আমাদের ধর্মমত।
বললাম, হয়তো তোমার কথাই সত্য। আর তাছাড়া আমাদের যেখানে বাড়ী তার কাছাকাছি তোমাদের ধর্মাবলম্বী কেউ নেই। রেহানা বলল, ধর্মই কি আমাদের সাধারণ ভাবে মেলামেশায় বাধা? উত্তরে বললাম, আমি জানিনা রেহানা। আমার কাছে ধর্ম মানুষের কোন আসল পরিচয় নয়। এবং এ শিক্ষা আমি আমার বাবা মায়ের কাছ থেকেই পেয়েছি। তাহলে? বললাম সত্যি কি তোমরা যেতে চাও?
সেলিনা যেমন দ্রুত বেরিয়ে গিয়েছিল, তেমনি দ্রুত আবার ফিরেও এল। আমি বললাম বক্সিং কি হয়ে গেল। ও বলল, না হয়নি। আজ ভাবছি আমার বিপরীতে আপনাকে চাইব। হঠাৎ আমার উপরে রাগের কারণ। কেন এতক্ষণ ধরে যে যুক্তির জাল বিছিয়ে নিজেকে মুক্ত করতে চাইছেন। সেও তো বক্সিংএর নেট। রেহানা যেতে চাইছে আপনার সাথে, তাইনা।
না এ মেয়েটাকে কিছুই লুকোবার উপায় নেই। তারপর রেহানার দিকে তাকিয়ে বললাম, ঠিক আছে যাবে তোমরা। কিন্তু শেষ মুহূর্তে পিছিয়ে যাবে না তো। রেহানা বলল হঠাৎ তোমার একথা মনে হচ্ছে কেন? না এমনি।
আফরোজ বেগম রান্না ঘর থেকে সব কথা শুনে বললেন, তুমি এবার একলা ঘুরে এসো বাবা, ওরা যখন যেতে চাইছে, পরেই যাবে। এত তাড়া কিসের। বললাম, না মাসীমা, আমি যখন যাব, আপনাদেরও নিয়েই যাব। কোন অসুবিধা হবে না। পরশু আপনাদের নিয়ে যাব, প্রস্তুত থাকবেন। এরপর আর দেরি না করে বেরিয়ে পড়লাম।
সারাটা দিন এক বিচিত্রতায় কেটে গেল আমার প্রতিটি মুহূর্ত। অশ্রুকণা, পিসি, রেহানা, সেলিনা, মিনতি সেন, তার বাবা, পরিমল বাবু, সকলেই যেন কত স্বতন্ত্র, কত আলাদা। আবার কোন কোন বিষয়ে তারা কত এক।
রাতে পিসিকে বললাম, পরশু বাড়ী যাব। বেশতো। কিন্তু একটা সমস্যা হয়েছে পিসি, কি করা যাবে বলতো। কি? রেহানারা যেতে চায় আমার সাথে? কোথায়? তারা কখনো গ্রাম দেখেনি, তাই আমাদের গ্রামে তারা যেতে চায়। ভালো কথা, তুমি ওদের নিয়ে যাও। তুমিতো বলেই খালাস। কিন্তু পরিণতি কি হবে ভেবে দেখেছো? কিসের পরিণতি। বা গ্রামের লোকের হাজার প্রশ্নের কি উত্তর দেবো? কারো কোন উত্তর দিতে হবে এমন কি কোন কথা আছে নাকি? আছে পিসি আছে? তুমি বুঝতে পারছনা। পিসি বললেন তুমি কি বলতে চাইছো বলত। আমি ধীরে ধীরে বললাম, আমি কিন্তু তোমার উপর গভীর বিশ্বাস রেখে ওদের কথা দিয়েছি? আমার উপর বিশ্বাস রেখে? কি এমন বিশ্বাস। তোমাকেও যেতে হবে আমাদের সাথে।
পিসি কি যেন ভাবলেন, তারপর বললেন, কবে যাবে বলে ঠিক করেছে। পরশু দিন। আর কে কে যাবে? রেহানা, সেলিনা ও ওর মা আফরোজ বেগম। ও আচ্ছা। তা হলে তুমি যাচ্ছতো। পিসি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, আমি নিজেও হাফিয়ে উঠেছি। সারাদিন তোমার কথা নিয়ে ভেবেছি। দেখি এবার গ্রামের মুক্ত হাওয়া থেকে ঘুরে আসি, যদি কোন পরিবর্তন হয়।
নির্দিষ্ট দিনের রাতে ট্রেন। সকালে রেহানাদের ওখানে গেলাম। গোটা বাড়ীটা একটা থমথমে ভাব। কলিং বেল বাজিয়ে চলেছি। কেউ খুলে দেওয়ার জন্য আসছেনা। এমনতো হওয়ার কথা নয়। অনেক বারতে এসেছি এ বাড়িতে। তবে কি আমার কলিং বেল বাজানোর শব্দ ওরা শুনতে পাচ্ছেনা। আবার বেল দিলাম। সেলিনা বেরিয়ে এল। কোথায় সেই চঞ্চলা হরিণী। আমাকে দেখে বলল, প্রান্তিক ভাই অনেকক্ষণ বুঝি? কিন্তু সেই আগ্রহ, সেই দাবী, সেই অধিকার, সেই চপলতা সবই যেন অনুপস্থিত। বললে ভিতরে আসবেন? এতে আহ্বান নয়। এযে বিতাড়ন। তবু বললাম, আজ আমার গ্রামের বাড়ীতে যাওয়ার কথা। সেদিন কথা হয়েছিল তোমরাও যাবে। রাতে ট্রেন। তাই বলতে এসেছিলাম। কিন্তু কোন কথা বলতে আমার ভয় হচ্ছে। আসলে আমি বুঝতে পারছি না এই দু দিনের মধ্যে কি এমন হয়েছে যা আমি বুঝতে পারছি না। সেলিনা বলল প্রান্তিক ভাই, হয় আপনি ভিতরে এসে বসুন, না হয় পরে আসুন।
এযে কি দুর্বিষহ অবস্থা, তা কাউকে বোঝাতে পারছি না। রাস্তার দিকের সমস্ত জানালাগুলো বন্ধ। বাইরে থেকে বোঝারও কোন উপায় নেই ভিতরে কেউ আছে কি না। মন ভীষণ ভাবে চাইছিল রেহানার সঙ্গে একবার দেখা হোক। কিন্তু মুখে তা বলতে পারছি না। আমার জানা ও দেখা সেলিনা সম্পূর্ণ বিপরীত আচরণ করে আমার সামনেই গেটের দরজা বন্ধ করে ভিতরে চলে গেল। এই কি সেই সেলিনা নিজেকে যে বক্সার হিসাবে জাহির করে। যার এক আঘাতে ডালিম নামের ছেলেটি আর কোনদিন এদিকে পা বাড়ায়নি।
আস্তে আস্তে ফিরে এলাম। পিসিকেই বা কি বলব। তিনি রাজী হয়েছেন। টিকিট কাটতে বলা হয়েছে। ফেরার পথে টিকিট কেটে নিয়ে যাব। পিসি কাল রাত থেকে গোছানো আরম্ভ করেছেন। কয়েকটা টুকিটাকি জিনিষ কিনতে হবে। তাই আমাকে তাড়াতাড়ি ফিরতে বলেছেন, আমাকে নিয়ে বেরোবেন। কিন্তু এখন যে ফিরে গিয়ে কি বলব। কিছুই ভালো লাগছে না। কেন যে রেহানারা এমন ব্যবহার করল কে জানে? আমাকে নিয়ে কোন সমস্যা হয়নি তো। অবশ্য এতদিন ওদের বাড়ী আমার যাতায়াত, ওদের কোন আত্মীয় স্বজন আছেন কি না জানিনা। সেদিন কেবল মাত্র শুনেছিলাম রেহানার কোন এক মাসী নাকি খিদিরপুর থাকেন। হঠাৎ মনে হল তাদের কেউ আসেনিতো। কিছুক্ষণ এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করে বাড়ীতে ফিরে এলাম। পিসি বললেন, অনেক তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছে। টিকিট পেয়েছে তো। বললাম না পিসি। কোন টিকিট নেই। পিসি অবাক হয়ে বললেন, সেকি কথা, কোন টিকিট নেই মানে? প্রথম শ্রেণী এসি বা সাধারণ কোন টিকিটই নেই। আমি সম্পূর্ণ মিথ্যে করে বললাম, অন্য কোন শ্রেণীর খোঁজ নিইনি। তুমি যদি বল, তা হলে আমি এখনি গিয়ে খোঁজ নিয়ে আসছি। বুঝতে পারছি পিসি আশাহত হয়েছেন। বললেন, মনকে ভীষন ভাবে প্রস্তুত করেছিলাম। গ্রামের সেই ছেলেবেলার দিনগুলি নিয়ে কতকিছুই না ভাবছিলাম, কিন্তু আমি চাইলেই হবে কেন? সবার অলক্ষ্যে যিনি আমাদের নিয়ে দিনরাত খেলা করে চলেছেন, তিনি না চাইলে যে কিছুই হবার নয়। একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন নীলাঞ্জনা পিসি।
আমি বললাম, এতো আশাহত হওয়ার কি আছে পিসি? আজকে যাওয়া হলোনা বলে কয়েকদিন পরেও যাওয়া যাবে না, তাতো নয় পিসি বললেন, হয়তো যাবে, কিন্তু সেদিন আর আজকের ইচ্ছেটা থাকবে কিনা কে জানে? বললাম, সব কিছুতেই তোমার এই হতাশা আমার ভালো লাগেনা, মনের ইচ্ছে বলেতো একটা জিনিষ আছে। তা আছে, তাই বলে হতাশায় ভুগতে আমি রাজি নই। পিসি বললেন, তোমাদের বয়স অল্প, স্বপ্ন বা উদ্যম তোমাদের যে ভাবে এগিয়ে নিয়ে যায়, আমাদের কি সেই ভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে? যাকগে সেকথা, কিন্তু তোমার সঙ্গে যারা যাবে বলেছিলেন, তাদের জানিয়েছো না জানাওনি। দেখি এক সময় গিয়ে জানিয়ে আসব। তারা যদি প্রস্তুত হয়ে থাকেন? কি আর করা যাবে। সত্যি কথাটাই তো বলতে হবে। তারপর বললাম আচ্ছা পিসি চলনা কোথাও থেকে বেড়িয়ে আসি। অবাক হয়ে নীলাঞ্জনা বললেন কোথায়? যে কোন জায়গায়। পিসি, এই যে আজকে যাওয়া হচ্ছে না, এ আমারও ভাল লাগছেনা। কিন্তু কোথায় যেতে চাও? যেকোন জায়গায়। যেখানে তুমি নিয়ে যাবে। আমার সঙ্গে যাবে? ভাল লাগবে? তোমার সঙ্গে যাবো, ভালো লাগবেনা কেন? কি করে ভাল লাগবে, ভাল লাগার জন্য যে স্বপ্ন দেখতে হয়। আর সেই স্বপ্ন দেখার বয়সটাই যে নেই আমার। কি এক গম্ভীর হতাশা নেমে আসে নিলাঞ্জনা পিসির কণ্ঠে। আমি বললাম তোমার এই হতাশা আমায় ভীষণ যন্ত্রণা দেয় পিসি। পার না নিজেকে সব সময় উদ্যমী রাখতে। পিসি কি ভাবলেন, তা তিনিই জানেন। জানতে চাইলেন বল কোথায় যাবে? আরো বললেন, যদি আমার সঙ্গে যেতে তোমার খারাপ না লাগে তা হলে যে কোন জায়গায় যেতে চাও চল। বললাম তা হলে চলল তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়া যাক। কোথায়? ডায়মন্ড হারবার। ডায়মন্ডহারবার? আর কেউ যাবে? না শুধু তুমি আর আমি। হঠাৎ পিসি বললেন, বুঝতে পারছি যেকোন কারণে হোক তোমার মন আজ ঠিক নেই। কি হয়েছে বলত প্রান্তিক। না কিছু হয়নি। তাহলে আজই তোমার ডায়মন্ডহারবার যাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছে কেন? কারো সঙ্গে ঝগড়া করেছো, না ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। ঝগড়া করব কেন? আর ভুল বোঝাবুঝিইবা হবে কেন? তা আমি কি করে বলব। তারপর ১৮০ ডিগ্রী ঘুরে গিয়ে বললেন, রেহানারা কি যেতে রাজী হয়নি?
বুঝতে পারছি, পিসি কিছু একটা সন্দেহ করেছেন, বললাম, ওদের বাড়ীতেতো যাওয়াই হয়নি, সুতরাং ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ কোথায়? নিলাঞ্জনা পিসি বললেন, প্রান্তিক আমি শুধু তোমার পিসি নই, আমি তোমার বন্ধুও বটে। আমার মন বলছে কি যেন তুমি আমাকে লুকাচ্ছে। তার থেকে চল বিকালে আমরা রেহানাদের বাড়ী থেকে ঘুরে আসি। মেয়েটিকে আজো আমি দেখিনি। চল না ওর মায়ের সঙ্গেও আলাপ করা যাবে।
আমি না করতে পারছি না, আবার যেতেও মন সায় দিচ্ছেনা। বিশদ ভাবে না বললেও টুকরো টুকরো ভাবে তাদের কথা আমি বলেছি পিসিকে। ওদের সম্পর্কে পিসির একটা ধারণা হয়েছে, তা ভেঙে যাক, আমি তা চাইতে পারিনা। বললাম তুমি যেতে চাইছে তোমাকে আমার নিয়ে যাওয়া উচিৎ। তবুও পিসি এভাবে যাওয়া কি ঠিক হবে। ওরা অপ্রস্তুত হতে পারে। তা ছাড়া ওরা মানে আফরোজ বেগমেরা কবে ফ্রি থাকতে পারেন তাওতো জানা দরকার। আমার মনে হয় বরং ওদের সঙ্গে কথা বলে একদিন সময় করে যাওয়া যেতে পরে।
নীলাঞ্জনা পিসি আর কথা বাড়ালেন না। বললেন বেশ, তোমার কথাই থাক। তাহলে ডায়মন্ডহারবার যাওয়াই ঠিক। চল বেরিয়েতো পড়া যাক। তারপর যেতে যেতে যদি মনে হয় অন্য কোথাও গেলে হয় তখন না হয় সে কথা ভাবা যাবে।
০৪. দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে
দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। শিয়ালদা স্টেশানে এসে শুনলাম ডায়মন্ডহারবার লাইনে তার কাটা গেছে। বিকালের আগে লাইন ঠিক হওয়ার সম্ভাবনা নেই। পিসি বললেন না, আজকের দিনটা একেবারে খারাপ। শুধু ব্যর্থতা আর ব্যর্থতা। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কি করবে? তুমি যা বলবে। আমি আর কি বলব। আজকে আমি তোমার উপরে নিজেকে ছেড়ে দিলাম। যেখানে নিয়ে যাবে, সেখানেই যাবো। বললাম আমার সাধ্য কোথায় পিসি। তবু কোথাও চল। এভাবে স্টেশানে বসে থাকা যায় না কি? তোমার কোন বন্ধুদের বাড়ী নেই কাছাকাছি? আছে কিন্তু আমার হঠাৎ হঠাৎ যাওয়া আর তোমাকে নিয়ে যাওয়া কি এক। বরং চল দক্ষিণেশ্বর যাই। ওখান থেকে নৌকোয় বেলুড় তারপর ফিরে আসা। সন্ধ্যার দিকে না হয় একবার মন্দিরে ঢুকে আরতি দেখা। হা সেই ভালো।
দুপুরের দিকে একটা ডানকুনি লোকালে উঠে দক্ষিণেশ্বর এলাম আমরা। পঞ্চবটী বনে অনেকক্ষণ বসে থেকে গঙ্গাকে দেখলাম। পিসি বললেন, এখানে এলে আমার ছোট বেলার কথা মনে পড়ে যায়। আমাদের বাড়ীর পাশে যে নদী, প্রায়ই সেখানে এসে নদীর পাড়ে বসতাম। নদী যে কেন আমাকে এত টানে কে জানে? বাবা মায়ের কাছে এই নিয়ে কত বকুনি খেয়েছি, তবু আসতাম। তুমি একা? প্রায়ই একা আসতাম। মাঝে মাঝে বন্ধুদের কেউ কেউ থাকতত। কিন্তু আমার মতো তারা কেউ নদীপাগল ছিল না। মাঝে মাঝে মনে হতো আমি বুঝি নদীর প্রেমে পড়ে গেছি। এত যে তোমার নদী ভাললাগে, তাহলে, বাসার কাছেও তো গঙ্গা আছে, যেতে পারোতো। পিসি বললেন না ঐ বাবুঘাট, আউটট্রাম ঘাট, এ গঙ্গা আমার একদম ভালো লাগেনা। আর এই দক্ষিণেশ্বর? না, এটা খুব একটা খারাপ লাগেনা। কিন্তু আমার ভীষণ ভাল লাগে, গঙ্গার নির্জন ঘাট। হয় শুধু আমি একা, অথবা আমাকে যে বুঝতে পারে এমন কেউ সঙ্গে থাকবে।
জানি, পিসির ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আলোচনা করা ধৃষ্টতা। তবু এমন কতকগুলো মুহূর্ত আসে জীবনে, তখন একাকার হয়ে যায় এই সব আপাত ব্যবধানের সম্পর্ক। তাই হয়তো কবিগুরুরও অসুবিধা হয় না সুরের তান তুলতে হৃদয় তন্ত্রীতে। তবু চুপ করে আছি দেখে পিসি বললেন, কিভাবছে প্রান্তিক। তোমার কথা। আমার কথা? হ্যাঁ তোমার কথা পিসি। তুমি যখন গ্রামে ছিলে আমি তখন কত ছোট। দূর থেকে দেখতাম তোমাকে। মাঝে মাঝে গাল টিপে দিতে। তারপর হাসতে হাসতে চলে যেতে। আমার খুব অভিমান হতো তোমার পরে। কেন? আমার কেন যেন মনে হতো আমি ছোট বলেই তুমি আমার সাথে কথা বলনা। মনে মনে শুধু ভাবতাম আমি কবে বড় হবো। বড় হলেতো তুমি আর কথা বলে পারবেনা।
পিসি একটু হাসলেন শুধু। আমি বললাম হাসছো যে। না হাসিনি, আসলে জানকি প্রান্তিক, সব শিশুরাই তাই ভাবে। তারা কবে বড় হবে? বড় হলে তার সাধগুলো, স্বপ্নগুলো তারা নিজেরাই পূর্ণ করতে পারবে। কিন্তু তা আর পারেনা। বড় হওয়ার সাথে সাথে ছোট বেলার সেই স্বপ্নগুলো মরে গিয়ে অথবা দূরে সরে গিয়ে আরো নতুন নতুন স্বপ্ন নতুন নতুন ইচ্ছে মনের উপর আছড়ে পড়ে। অবহেলায় পড়ে থাকে ছোট বেলার সাধ ও আকাঙ্খ। এটাই জগতের নিয়ম। আসলে বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে অনেক কিছু পরিবর্তন হয়ে যায় প্রান্তিক। আমি বললাম, মানিনা তোমার কথা। কি মানো? এই যে তুমি বললে বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শৈশবের স্বপ্নগুলো মরে যায়। মরেনা বুঝি? এক চিলতে রহস্যময়ী হাসি মিলিয়ে যায় পিসির ওষ্ঠ প্রান্তে।
আমাদের থেকে একটু খানি দূরে, একটি ছেলে আর একটি মেয়ে এসে বসল। হয়তো তারা কলেজেই পড়ে। ছেলেটি বলল কেন যে তোমার সাধ হলো এখানে আসার? মেয়েটি বলল কেন জায়গাটা কি খারাপ? জান এখানে একদিন স্বয়ং রামকৃষ্ণ সিদ্ধি লাভ করেছিলেন। আমার জেনে কাজ নেই। ঠিক আছে কিন্তু তোমার এই গঙ্গা ভালো লাগেনা। আমার এত ভীড় ভালো লাগেনা। তাহলে চল, নৌকায় আমরা বেলুড় মঠে যাই। আবার সেই বেলুড় মঠ। তাহলে কোথায় যাবে? যেখানে শুধু তুমি আর আমি, পাশে কেউ থাকবে না। মাথার উপরে নীল আকাশ, আমি তাকিয়ে থাকবো তোমার দিকে। একটুখানি স্মিত হেসে মেয়েটি বলল শুধু তাকিয়ে থাকবে? হ্যাঁ শুধু তাকিয়ে থাকবো। তোমার চোখের তারায় খুঁজে পেতে চেষ্টা করব নিজেকে। তেপান্তর থেকে ছুটে আসবে এলোমেলো দুরন্ত বাতাস, যা তোমার শক্ত করে বাঁধা বেণী থেকে জোর করে ছিনিয়ে নিতে চাইবে। ২/১ টি কুঞ্চিত কেশ আর ঐ দুরন্ত বাতাসের দুরন্তপনায় তোমার আঁচল উড়বে দূর আকাশে বলাকাব পাখার মত। সোনাঝরা সন্ধ্যার সেই মূহুর্তে তুমি শুধু আমার হয়ে থাকবে। হাসতে হাসতে মেয়েটি বলল, তোমার ক্ষেপামী যাবে না দেখছি। কতদিন ধরেই তো দেখছ, তবু আশ মিটলনা। মিটল কই? আর সত্যি সত্যি যেদিন মিটবে সেদিন তুমি আর রহস্যময়ী থাকবেনা। মনও কাদবেনা তোমার জন্য। তারপর বলল, চল ওঠা যাক। ওরা উঠে চলে গেল।
এতক্ষণে পিসি একটিও কথা বলেনি। আমিও বলি নি। আমি নিশ্চয়ই জানি আমারই মতো পিসিও ওদের কথা শুনেছেন নিবিষ্ট মনে। সত্যি ছেলেটির মনের জোর আছে বলতে হবে। নিজের কথা স্পষ্ট করে বলার অধিকার আছে তার। আর তাই মেয়েটিও তাকে অস্বীকার করতে পারে না। পিসি হঠাৎ আমাকে চমকে দিয়ে বলল, ওরা কিন্তু একটা কথা ঠিক বলেছে প্রান্তিক, আমি চকিতে পিসির দিকে তাকিয়ে বললাম কি? ঐ যে ছেলেটি বলল, যেদিন আশ মিটবে সেদিন তুমি আর রহস্যময়ী থাকবেনা। মনও কাঁদবেনা তোমার জন্য।
কথাটা গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যঞ্জনাময়। বললাম, ওরাতো আরো অনেক কথা বলেছে, তার একটাও তোমার ভাল লাগলনা। ভাল লাগেনি বলছিনা। ছেলেটি তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন। ফালতু অজুহাতে জীবনের অমূল্য মুহূর্ত সে হারাতে চায়না। সে ভীরু নয়। তার মনের কথা স্পষ্ট করে বলতে পারার জন্য এক প্রকারের শ্রদ্ধা আদায় করে নিতে পারে। কিন্তু খুব যে একটা দাগ কেটেছে আমার মনে তা নয় কিন্তু। কিন্তু আশ মিটলে তুমি আর রহস্যময়ী থাকবেনা, এযেন আমার জীবন দর্শনের নতুন দরজা খুলে দিয়েছে। অতি সাধারণ কথা, কিন্তু কি অসাধারণ ব্যঞ্জনাময়।
একটা হাত তার কাঁধে রেখে আস্তে বললাম, পিসি তোমার মনে যে এত দুঃখ লুকিয়ে আছে আগে কোন দিন বুঝতে পারিনি। বললেন আজও কি বুঝতে পারছ? বোঝ যায় না প্রান্তিক, জীবনের রহস্যময়তাই তার বেঁচে থাকার রসদ। একদিন যা মনে হতো শুধু সত্য নয় একমাত্র সত্য আর একদিন তাই কেমন এক নিমেষেই মিথ্যে হয়ে যায়। আমি বললাম, জীবনের সব সত্যই কি মিথ্যে হয পিসি? ঠিক বুঝতে পারছি না তুমি কি বলছ? জীবনের সত্য বলে কিছু আছে কীনা আমি জানিনা। তবে আজ বুঝতে পারছি, দামিনী কেন বেঁচে আছে? আমি বোকার মত প্রশ্ন করলাম কোন দামিনী? পিসি বলল, দামিনীকে চেননা? আমার তো মনে হয় না, রবীন্দ্রনাথ দামিনীর থেকে বড় করে আর কোন নারী চরিত্র এঁকেছেন কীনা। চতুরঙ্গ পড়েছে। দামিনীর মুখ দিয়ে রবীন্দ্রনাথের সেই অবিস্মরণীয় উক্তি, সাধ মিটিল না। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ঐ ছেলেটি কি বলেছে? আশ যে দিন মিটবে সেদিন আর তুমি রহস্যময়ী থাকবেনা। মনও কাদবেনা। দামিনীরও মন কাঁদতোনা যদি তার সাধমিটে যেতো। তারপর একটু খানি চুপ করে থেকে, একেবারে অতর্কিত ভাবে আমার একটা হাত তুলে নিলেন নিজের হাতের মধ্যে। কিন্তু একটি কথা বললেন না। বললাম তোমার শরীর খারাপ করছে? না। তাহলে চুপ করে আছো কেন?
হঠাৎ প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে তিনি জানতে চাইলেন কে তোমাকে বেশী করে টানে প্রান্তিক অশ্রুকণা না রেহানা? আমি অবাক হয়ে পিসির এই প্রসঙ্গ থেকে অন্য প্রসঙ্গেনিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছি। বললাম, না পিসি কেউ নয়। ঐ ছেলেটি যেমন করে তার অধিকারের দৃপ্ত ঘোষণা জানিয়েছে আমার জীবনে তেমনি করে কেউ আসেনি আজো। আসেনি, না আসতে দাওনি? আমি বললাম তোমার কি হয়েছে বলতো আজ? এমন এমন প্রশ্ন করছ যা কোন দিন করনি? বললেন থাক ও কথা। একটু আগে তুমি বলেছনা, যখন তুমি ছোট ছিলে, তোমার সঙ্গে কথা না বলে শুধু গাল টিপে দিতাম বলে তোমার ভীষণ অভিমান হতো, আর ভাবতে কবে তুমি বড় হবে। বড় হলে আমার সঙ্গে তুমি কথা বলতে পারবে। আমি লজ্জায় মাথা নীচু করে রইলাম। পিসি বলে চলেছেন। এখনতো তুমি বড় হয়েছে। অন্তত গালটিপে দেওয়ার বয়স তোমার নেই। অনেকদিন ধরে আছো আমার সাথে। কই তোমার কোন কথাই তো বলনা আমাকে। তার মানে শৈশরের সেই স্বপ্নগুলো তোমার মরে গেছে অথবা হারিয়ে গেছে নতুন স্বপ্নের ভিড়ে তাই না? আমি চমকে উঠে বললাম, না পিসি কিছুই মরেনি। আজো তোমার সাথে আমার ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলতে ভালো লাগে। কিন্তু তোমার সময় কোথায়? আর তাই বলে কিন্তু তোমার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগও আমার নেই। কেন? অভিযোগ নেই কেন? বললাম স্বপ্ন হয়তো মরেনা পিসি কিন্তু বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাস্তবের বালুতটে অনেক কিছুই চাপা পড়ে যায়। যেমন এইখানে না আসলে, আমার জানা হতোনা তোমার নিঃসঙ্গ অতীত। তোমার একাকিত্ব, হতাশা, ব্যথা ও বেদনা। উনি বললেন, এটা জেনেই তোমার কি লাভ হবে? না পিসি, লাভ লোকসান দিয়ে সব অঙ্ক মিলানো যায় না। এই যে কতক্ষণ আমরা বসে আছি এখানে। সূর্য হেলতে হেলতে গঙ্গার বুকে লাল আবির ছড়িয়েছে অথচ সময়কে আমরা জয় করেছি, কেন? এই অঙ্কের কি হিসাব মিলাতে পারবে? পারবেনা। তার থেকে চল সন্ধ্যা হয়ে এলো। মন্দিরের আরতি দেখবে বলেছিলে না? একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পিসি বললেন, হ্যাঁ চলো।
প্রায় আধ ঘন্টা পরে আমরা মন্দির থেকে বেরিয়ে এলাম। মন্দিরে যাওয়ার আগে যতটা বিষণ্ণ মনে হচ্ছিল, এখন আর অতটা নেই। পিসি বললেন, সেই দুপুরে খেয়েছে, খিদে পায়নি? হা পেয়েছে। তাহলে চল, কিছু খেয়ে নেওয়া যাক।
দুজনার জন্য যা যা অর্ডার দিয়েছিলাম তা থেকে পিসি তার ভাগের অর্ধেক আমাকে তুলে দিলেন। আমি বাঁধা দিলামনা। আসলে আমি পিসিকে শুধু দেখেই চলেছি। কত কাছে আছি আমি এই মানুষটির। অথচ আশ্চর্যের বিষয়, কিছুই জানিনা তাকে। তিনিও কি জানেন আমাকে? না, হয়তো জানেন না, কাউকে পরিপূর্ণভাবে জানা হয়তো সম্ভবও নয়।
পরিমলবাবুকে ভালবেসে বিয়ে করেছিলেন পিসি। অনেক স্মৃতি হয়তো জড়িয়ে আছে তার সাথে। কিন্তু কি আশ্চর্যের বিষয় কোনদিন ভুলেও সেই স্মৃতির পাতা ওল্টননি একমুহূর্তের জন্যও। অনেক বার মুখে এলেও ঐ স্মৃতির কথা উচ্চারণ করতে পারিনি আমিও। যদি অন্য রকম কিছু ভাবেন। পিসি বললেন, আর কিছু খাবে? আমি অন্যমনস্কের মত বললাম, তুমি যদি দাও তাহলে খাব। কি খাবে? তোমার যা ইচ্ছে? পিসি আবার কিছু অর্ডার দিলেন তার ইচ্ছে মত। খেয়ে দেয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
বাড়ীতে যখন ফিরলাম, তখন রাত ৮ টা। গোটা বাড়ীটা অন্ধকার। গেটে এসে দেখলাম, বাইরে থেকে তালা বন্ধ। তার মানে পরিমলবাবু এখনো ফেরেননি। পিসিকে জিজ্ঞাস করলাম, ওনার দেরি হবে এমন কথা উনি কিছু বলেছেন? পিসি বললেন উনি জানেন আমরা সন্ধ্যার ট্রেনে বেরিয়ে যাবো। তাই হয়তো দেরি করে ফিরবেন। ও নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। গেট খুলে চলো ভিতরে।
গ্রামের বাড়ীতে যাওয়া হবে বলে, গোছাতে গোছাতে সেগুলো আবার তেমনি এলোমেলো রেখে বেরিয়ে পড়া হয়েছিল। পিসি সেগুলো আবার ঠিক ঠাক করে গুছিয়ে রাখলেন। তারপর ক্রমে ক্রমে রাত বাড়তে লাগলো। কিন্তু পরিমলবাবু তখনো এলেন না। কি করা যায় বলতে প্রান্তিক। তারপর নিজেই বললেন, তুমি কি একবার দীপঙ্করবাবুর ওখানে যাবে? ওখান থেকে যদি ফোন করা যায়? বললাম কোথায় ফোন করতে হবে?
পিসি কয়েকটা ফোন নাম্বার দিলেন। একটা পরিমলবাবুর সিনিয়র বসের। আর দুটোর একটা তার স্টেনোর এবং অন্যটি পরিমলবাবুর অধিনস্ত সহকারী ম্যানেজারের। দীপঙ্করবাবুকে বলবে, একটু খোঁজ নিয়ে যেন তোমাকে সত্যি সংবাদটি জানান।
আমি বেরিয়ে পড়লাম। অত রাতে দীপঙ্করবাবু তখন শুয়ে পড়েছেন। কিন্তু আমার যাওয়াতে উনি উঠে পড়লেন। পিসি যা বলেছেন আমি ওনাকে বললাম। উনি বললেন, তুমি নিজেই ফোন কর। এস আমার সঙ্গে। সিনিয়র বস এবং সহকারী ম্যানেজারের ফোন এনেছো? ফোন করাতে মেয়েলি কণ্ঠে কে যেন বললেন স্পিকিং কাকলী মিত্র। আমি নমস্কার জানিয়ে বললাম আমি পরিমলবাবুর বাড়ী থেকে বলছি। উনিতো এখনো ফেরেননি। আজ কি উনি অফিসে গিয়েছিলেন? আপনার পরিচয়? ফোনের অপর প্রান্ত থেকে সেই মেয়েলি কণ্ঠ। আমি ওনার আত্মীয়, আই মীন উনি আমার পিসেমশাই হন। প্লীজ ওয়েট বলে উনি ফোন রেখে দিলেন। এবং খানিক পরে বললেন, হ্যাঁ এসেছিলেন, কিন্তু আপনার পিসি কি জানেন না, উনি ট্যুরে ৭ দিনের জন্য বাইরে গেছেন। আমি বললাম, আসলে আমাদের আজ গ্রামের বাড়ীতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু টিকিট না পাওয়ার জন্য যাওয়া হয়নি। হয়তো পিসিকে বলেছিলেন, কিন্তু ব্যস্ততার জন্য তিনি তা ভুলে গেছেন। আপনার সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ। উনি গুডনাইট জানিয়ে ফোন ছেড়ে দিতে চাইলে আমি বললাম, আচ্ছা ম্যাডাম আপনি ওনার ট্যুরের জায়গার ফোন নাম্বার দিতে পারবেন? নো সরি। আরেকটা কথা ওনার সঙ্গে আর কে গেছেন? ইট ইজ এ ভেরি ভেরি কনফিডেনসিয়াল, নো মোর প্লিজ। ওকে। গুডনাইট! গুড নাইট। ফোনটা ছেড়ে দিলেন কালী মিত্র।
দীপঙ্করবাবু বললেন খোঁজ পাওয়া গেল? হ্যাঁ, উনি ট্যুরে গেছেন। তোমাদের বলে যায়নি? হয়তো বলেছেন। আসলে আমার আর পিসির গ্রামের বাড়ীতে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু যাওয়া হয়নি। পিসিকে যদি বলেও থাকেন উনি তা মনে করতে পারছেন না। ও আই সি? ঠিক আছে। সাবধানে যেও।
পিসিকে সব বলতে, তিনি থ মেরে গেলেন। আমি বললাম কি হল পিসি? তুমি চুপ করে আছো কেন? না চুপ করে আর থাকব না। আমি আর পারছি না প্রান্তিক। ওর যদি আমাকে আর ভালো না লাগে বলে দিলেই পারে। এই ছল চাতুরীর দরকার কি? সকালে ওকে কত করে বললাম, তুমিও চল না। কতদিনতো যাওয়া হয় না। না আমার সময় নেই। কেন এত কি কাজ? দিল্লী থেকে চেয়ারম্যান আসবেন। অফিসের ফাঁইল পত্রগুলো প্রস্তুত করতে হবে। বললাম তুমি একা একা থাকবে? মাত্র কটাদিনতত, তারপর বললাম বেশ তুমি আমাদের সঙ্গে না যাও একটা দিন টুর নিয়ে ঘুরে এসো। বললেন কোন উপায় নেই। অফিস থেকে এখন বেরোবার কোন উপায় নেই। আর তার ষ্টেনো বলল তিনি ৭ দিনের ট্যুরে চলে গেছেন। এ অসহ্য।
মিথ্যে কথা আমারও অসহ্য। প্রয়োজনে অনেক সময় মিথ্যে কথা বলতে হয় তা অস্বীকার করিনা। কিন্তু পরিমলবাবুর ব্যাপারটা এখন বুঝতে পারছি না। পিসির দুঃখ যন্ত্রণা যেমন বুঝি তেমনি পরিমলবাবুর পক্ষেও যে কিছু বলার আছে, সেটাকে অস্বীকার করতে পারিনা। কিন্তু কাকলী মিত্রর শেষের কথাটি আমাকে পিসির সঙ্গে সহমত হতে সাহায্য করছে। তিনি একটা অফিস থেকে অফিসিয়াল ট্যুরে গেছেন, তিনি তো আর ভারত সরকারের কেন গোপন শাখায় কাজ করেন না, যে তার ট্যুর ভেরি ভেরি কনফিডেনসিয়াল হবে। যাই হোক পিসিকে বললাম, তোমার হয়তো পিসেমশাইয়কে বুঝতে কোন অসুবিধা হচ্ছে পিসি। আর তা ছাড়া তুমি নিজেইতো বলেছে, এ কয়দিন না হয় যেন কোন ট্যুর থেকে ঘুরে আসে। তোমার সঙ্গে যখন কথা বলেছিলেন, তখন হয়তো উনি যা বলেছিলেন সেটা সত্যি ছিল। পরে হয়তো অফিসে গিয়ে জানলেন, তার থেকে, জরুরী তার ট্যুরে যাওয়ার তাই। তিনি চলেও গেছেন, এতে তোমার অসহ্যের কি আছে? পিসির রাগ পড়েনি। ভিতরে ভিতরে তিনি যে গজরাচ্ছেন বুঝতে পারছি। বললেন, দেখ প্রান্তিক এই ভাবে কারো দোষ ঢাকতে যেওনা। তাতে একূল ওকূল দুকূলই যাওয়ার সম্ভবনা।
বললাম তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে পিসি? যদি সত্যি সত্যি তোমার বিশ্বাস হয়ে থাকে, তিনি তোমার মন থেকে দূরে সরে গেছেন। সন্দেহকে বাড়িয়ে দিয়ে কি তাকে কাছে টানা যায়? তুমি যদি তাকে আগের মত পেতে চাও, তোমাকেও ভালবাসতে হবে আগের মত। তার মন থেকে মুছে দিতে হবে অন্য কোন ছায়াপাত।
পিসি বললেন আজ আর তা সম্ভব নয় প্রান্তিক। কেন? জানিনা কেন? তবু পরিমলকে আমার আর আগের মত ভালবাসা সম্ভব নয়। প্রথম কথা ছল-চাতুরী আমি একদম সহ্য করতে পারিনা। বললাম পিসি, শুধু নিজের ভাবনা থেকে ও ভাবে বিচার করছ কেন? উনিওতো কিছু ভাবতে পারেন তোমার সম্পর্কে, যা তার মনকে তোমার কাছ থেকে আগে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছে। রেগে গিয়ে পিসি বললেন কি বলতে চাও তুমি? আমাকে উনি বিনা কারণে সন্দেহ করবে কেন? কি প্রমাণ আছে আমাকে সন্দেহ করার? বললাম তোমরা হাতেও কি কোন প্রমাণ আছে তাকে সন্দেহ করার? এবার উল্টো পাল্টা ভাবে পিসি বললেন প্রমাণটাই কি সব। নিত্যদিনের আচার আচরণ আমার অনুভূতি এর কি কোন মূল্য নেই? বুঝতে পারছি পিসির এসব যুক্তিহীনের যুক্তি। আসলে পরিমলবাবুকে উনি এত ভালবাসেন যে একটুখানি বিচ্যুতিই তার কাছে বিরাট হয়ে দেখা দেয়। বললাম, তোমার অনুভূতির নিশ্চয়ই মূল্য আছে পিসি। তবু সব কিছুর জন্য অপেক্ষার মূল্যও কম নয়। উনি আসুক। দেখবে সময় একদিন তোমার মনের এই গ্লানি মুছে দেবে। উনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন তাই যেন হয়।
পরের দিন সকাল যেন এক নতুন বার্তা নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। ভোরের আকাশ সুৰ্য্যের অপেক্ষায় মৌন। ছাদের টবে ফুটেছে অজস্র গোলাপ ও চন্দ্রমল্লিকা। কি তার রংএর বাহার। একটি চন্দ্রমল্লিকা ফুটেছে অজস্র রঙের সমহারে। দেখতে অপূর্ব। ভীষণ লোভ হচ্ছে ওই ফুলটি তুলে কোন প্রিয়জনের হাতে তুলে দিতে। কিন্তু কে আমার প্রিয়জন, কার হাতে তুলে দেবো আমার আকাঙ্খার চন্দ্রমল্লিকা। পিসিকে শ্রদ্ধার অঞ্জলি দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু যে আকাঙ্খায় মন উন্মুক্ত, সেখানেতো নীলাঞ্জনা পিসি নেই।
ভোরের আকাশকে সাক্ষী রেখে কোন দিন এই ছাদে উঠিনি আমি। আকাশের পূর্ব প্রান্ত লাল, কিন্তু অন্ধকারের মায়াবী আলো যেন এখনো মুছে যায় নি।
হঠাৎ ছাদের দরজা খুলে যায়। একি পিসি তুমি? হ্যাঁ, কিন্তু তুমি এত ভোরে ছাদে কি করছ? দেখ কি অপরূপ অজস্র গোলাপ আর চন্দ্রমল্লিকার সমাহারে রাতের আকাশ যেন নতুন প্রভাতকে বরণ করে নেওয়ার অপেক্ষায়। রাতে তুমি ঘুমাওনি? না পিসী একদম ঘুম হয়নি। তাইতো সকাল না হতেই উঠে এসেছি ছাদে। কেন? যদি আজকের আকাশ কোন নতুন বার্তা বয়ে নিয়ে আসে। পিসি বললেন, সাররাত না ঘুমিয়েও তুমি এই সতেজ মনটা কোথা থেকে পাও প্রান্তিক? বললাম, জীবনের সব কিছুকে হাসিমুখে গ্রহণ করার একটা জেদ আমাকে চির সতেজ করে তোলে। ভুল প্রান্তিক ভুল। তাই যদি হতো, তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারতে। কিন্তু তাতো পারনি, অথচ নিজেকে মিথ্যে মায়ায় আচ্ছন্ন করে–যা সত্য নয় তাকেই সত্য বলে প্রকাশ করতে চাইছো। তারপর চোখের পর চোখ রেখে বললেন এখনো কুয়াশা কাটে নি দেখেছ? হ্যাঁ, কিন্তু আমি যখন এসেছিলাম তখন কিন্তু কুয়াশা ছিল না। পূর্ব প্রান্ত লাল হয়ে উঠেছিল সূর্য ওঠার অপেক্ষায়। যদিও অন্ধকার ছিল, তবু আলোর নিশানা আমি টের পেয়েছিলাম। ঐ দেখ সেদিন যে বিচিত্র বর্ণের চন্দ্রমল্লিকার টবটা কিনেছিলাম আজ তা পূর্ণতায় বিকশিত একটি ফুটন্ত চন্দ্রমল্লিকা। ওর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কি ভাবছিলাম জান? কি? কোন এক প্রিয়জনকে উপহার দেব তা। তাই বুঝি? কে তোমাকে না করছে? না কেউ না করেনি। আসলে বুঝতে পারছি না, কোথায় ওর সত্যিকারের জায়গা। মানে? এই ভোরের বাতাস তোমার কাছে নতুন মনে হচ্ছে না পিসি? মনে হচ্ছে না আঃ কি আরাম! তুমিকি সারারাত জেগে জেগে স্বপ্ন দেখেছো? হয়তো দেখেছি, হয়তো দেখিনি, তুমি কিন্তু তাই বলে কথার অক্টোপাশে এই মুগ্ধ আর মোহময়ী সকালকে ভুল বুঝনা। ঠিক আছে তাই হবে। তোমার চিন্তার সঙ্গে চেতনাকে মিশিয়ে দেখি সকালটা তোমার মতো আমার জীবনেও কোন নতুন সুরের তান তোলে কীনা। হ্যাঁ সেই ভাল। কিন্তু পিসি আমার কথার তো উত্তর দিলে না। কি? ঐ অপূর্ব রঙের চন্দ্রমল্লিকার আসল জায়গাটা কোথায়? এ উত্তর দাতাব ইচ্ছের উপর নির্ভর করে না প্রান্তিক। তুমি যখন তোমার কোন প্রিয়জনকে দেবে বলে ঠিক করেছো, তখন তোমার মনকেই জিজ্ঞাস করো, কোথায় ওর সত্যিকারের জায়গা।
হঠাৎ চমকে উঠলাম পিসির দিকে তাকিয়ে। একি পিসি? নতুন শাড়ী পরেছো, চুল বেঁধেছে নতুন করে, কোথাও যাবে নাকি? যাবো বলেইতো তোমার ঘরে গিয়েছিলাম প্রান্তিক। কিন্তু গিয়ে দেখলাম, তুমি ঘরে নেই। অথচ বাইরে যাওয়ার গেট বন্ধ। তাইতো ছাদে এলাম। খুব ভাল করেছে পিসি। একটু দাঁড়াও, নড়বেনা কিন্তু। কেন? যা বলছি তাই করনা।
নীলাঞ্জনা দাঁড়িয়ে স্থির হয়ে রইলেন। আমি চন্দ্রমল্লিকাটি নিজের হাতে তুলে নিয়ে এলাম। মনে মনে ঠিক করে নিলাম, পিসি যেখানে গুরুজন সেখানে তার চরণতলে অর্পণ করব এই ফুলটি। হঠাৎ মনে হল দূর ওতো ভক্তের নৈবেদ্য। না আমি তা পারবনা। তাহলে কর কমলে? দূর। তাই হয় নাকি কখনো। প্রথম প্রেমের লাজ নম্রতায় প্রেমিকের হয়তো তা মানিয়ে যায়। কিন্তু আমার জীবনে পিসির অবস্থান কোথায়। তিনি কি আমার পূজার বেদী না বন্ধু না আর কিছু। আস্তে আস্তে এগিয়ে এলাম, পিসির কাছে। একেবারে বুকের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে পিসিকে বললাম, চোখ বন্ধ কর পিসি। কেন? আরে করইনা। পিসি কোন রকম দ্বিরুক্তি না করে চোখ বন্ধ করলেন। আর আমি, চন্দ্রমল্লিকাটি গুঁজে দিলাম পিসির শিথিল বেণীতে। তারপর মন যা চাইল, হেরে গেলাম যুক্তির কাছে। পিসি কিন্তু বিজয়িনী যেন। আমার দ্বিধান্বিতাকে দূরে সরিয়ে রেখে তার রক্ত গোলাপ ঠোঁট দুটি নিমেষে নামিয়ে নিয়ে এলেন আমার ভীরু ওষ্ঠা ধরে। তারপর দ্রুত পালিয়ে গেলেন যেন। না বললেন আমার সঙ্গে কোন কথা, না চাইলেন প্রতিদান হিসাবে কিছু।
আর এই নিয়ে পিসি দুই বার তার ব্যগ্রতাকে নিয়ে এসেছেন আমার স্পর্শতার মধ্যে। তবু যেন কত ব্যবধান। সেদিন কিন্তু দেহের তন্ত্রীতে এ শিহরণ ছিল না। তবে আজ কোথা থেকে এলো, ভীরু বুকে এই কম্পিত শিহরণ! সেদিন পিসিকে চোখের পর চোখ রেখে বলতে পেরেছিলাম, আমি তোমায় ভালবাসি পিসি। আজ ভালবাসা কথাটি উচ্চারণ করতে আড়ষ্টতা কেন? কেন পারলাম না বলতে এ আমার ভালবাসার প্রথম উপহার। ধীরে ধীরে নেমে এলাম ছাদ থেকে। ঘরের অন্ধকার এখনো যায়নি। ভেজানো দরজার ঘরে আলো জ্বেলে পিসি হয়তো দেখছেন নিজেকে। আমি টোকা দিতে বললেন, ভিতরে এস। এতক্ষণ যে শাড়ীটা পরে ছিলেন, বদলে ফেলেছেন তা। অঙ্গে জড়িয়েছেন বাসন্তী রঙের বালুচরী। সিঁথিতে সিঁদুর, দুই ভুর মাঝখানে সোনা ঝরা টিপ, আঁচলটা সবে বুকের পরে তুলে নেবেন, আমি ঢুকতে গিয়েই বেরিয়ে এলাম। উনি আর আমাকে পিছু ডাকলেন না। আমি নিজের ঘরে এসে নিজে কেন এমন ব্যবহার করলাম তাই নিয়ে ভাবছি। উনি আমার ঘরে এসে বললেন, এখনো জামা প্যান্ট পরনি? আমি অবাক হয়ে তাকালাম ওনার দিকে? বললেন, তাড়াতাড়ি কর প্রান্তিক। এযেন সকাল বেলাকার ছাদের সেই দ্বিধান্বিতা নীলাঞ্জনা নন। এ যেন এক দীপ্তিময়ী নতুন নীলাঞ্জনা। স্পষ্টতা আর অধিকার যেন তাকে এক নতুন মহিমা দান করেছে।
অপূর্ব লাগছে নীলাঞ্জনা পিসিকে। অঙ্গের পোষাকের সঙ্গে বেণীতে গোঁজা ঐ সাত রঙা চন্দ্রমল্লিকা যেন আপন গরবে গরবিনী। আর সৌন্দর্যের কাছে মাথা নত করে না এমন কে আছে? বয়স কি সব সময় সৌন্দর্যের প্রতিবন্ধক? আমার মনে হয় না তা নয়। পিসির বয়স যেন তার সৌন্দর্যকে এক অপূর্ব লাবণ্যময় মর্যাদা দিয়েছে। বললাম কোথায় যাবে? পিসি বললেন কোথাও না। তবু …। ভোরের রাজপথ আমাদের চলমানতার সাক্ষী হয়ে থাকুক। ঠিক পাঁচ মিনিট। আর একটুও দেরি করোনা কিন্তু প্রান্তিক। যদিও অনুরোধ, কিন্তু তাকে উপেক্ষা করতে পারি এমন সাধ্য নেই।
কেটে গেছে বেশ কয়েকটি দিন। পরিমলবাবু ফিরে এসেছেন ট্যুর থেকে। পিসি এব্যাপারে একটিও কথা বলেননি তার সাথে। পরিমলবাবু শুধু বলেছেন, তোমাদের তা হলে যাওয়া হলো না? তার কোন প্রতি উত্তর পিসি দেননি। পরিমলবাবুও এনিয়ে কোন জোর জবরদস্তি করেননি।
অনেকদিন ধরে দেখা হয়না অশ্রুকণা, অনুতপা, রেহানা বা অন্যান্য কলেজ বন্ধুদে সাথে। আজ সবেবরাত। সৌভাগ্য রজনী। ভাবছি একবার যাব রেহানাদের ওখানে। হয়তে আর আগের মতো ওরা আমাকে গ্রহণ করতে পারবেনা, তবু অন্তত নিজের কাছে নিজে কৈফিয়ৎ দিতে পারব, আমি তোমাদের ভুল বুঝিনি, তোমারাই আমাকে ভুল বুঝে দূর সরিয়ে দিয়েছে।
সন্ধ্যের পর, ওদের বাড়ীতে যখন গেছি, এক নিঃশব্দ পুরীর মতো মনে হচ্ছে ওদে বাড়ী। আজ কি তবে সৌভাগ্যরজনী নয়? তাইবা কি করে হবে। অনেক বাড়ীতে আলো মালায় সেজেছে। আমি মনের মধ্যে অনেক দ্বিধা নিয়ে বেল দিলাম। বেল দিতেই সতে সঙ্গে দরজা খুলে গেল। রেহানা। কিন্তু একি চেহারা। মাথার চুল উস্কোখুস্কো পরনের শাড় অবিন্যস্ত। উদাস চোখ। ওকে দেখে ভীষণ ভয় হল। বললাম, কি হয়েছে তোমার রেহানা তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? বলল, এস ভিতরে এস কি যেন ছিল সে কণ্ঠে। হতাশা ন বিষাদ, বুঝতে পারছি না। আস্তে আস্তে ওর পিছনে পিছনে এসে বসলাম ওদের বসার ঘরে বলল, এত দিন পরে এলে? গিয়েছিলে গ্রামের বাড়ীতে? মনে হল যেন কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে ওর। বললাম, না যাওয়া আর হল কই? কেন? গেলে না কেন? সে অনেক কথা থাক। কিন্তু তোমার এই অবস্থা কেন? সেলিনা কোথায়? হাসপাতালে। হাসপাতালে। চমকে উঠলাম আমি জানতে চাইলাম কি হয়েছে ওর? বলব! আজ সবেবরাত। সৌভাগ রজনী। আমাদের সৌভাগ্যতো দেখতে পারছ। আমার এই অবস্থা। সেলিনা হাসপাতালে মা জুরে বেহুশ। নিজেদের রান্না পৰ্য্যন্ত ঠিক মতো হয় না। তা তুমি কেমন আছো? ভালো না এতো ভালো থাকার কথা নয় প্রান্তিক? আমি বাঁধা দিয়ে বললাম আমার কথা পরে শুনো। জেনে রাখো আমি ভাল আছি। তা তোমাদের এই অবস্থা। আমাকে সংবাদ দাওনি কেন? রেহানা তার উত্তর না দিয়ে বলল তুমি চা খাবে? একটু বসো। আমি চা নিয়ে আসছি পাশের ঘর থেকে আফরোজ বেগম বললেন, কে কথা বলছেরে রেহানা? উত্তরে রেহান বলল প্রান্তিক। ওকে একবার আমার কাছে আসতে বলতো। রেহানা বলল, তোমার কাছে গেলেই তো তুমি কান্নাকাটি করবে। কি দরকার আমাদের দুঃখের বোঝ ওকে জানিয়ে বুঝতে পারছি কি যেন অভিমান জমে আছে রেহানার বুকে। আমি বললাম, আমি ও ঘরে আছি তুমি চা নিয়ে ও ঘরেই এসো। আমি আফরোজ বেগমের ঘরে গিয়ে বসলাম। উনি শুয়ে আছেন। হাতে এবং পায়ে ব্যান্ডেজ। কপালে হাত দিলাম, জ্বর খুব। বললাম, মাসিমা, আমাকে শুধু মিথ্যেই আপন আপন করেন। কি হয়েছে আপনাদের জানতে চাইনে, কিন্তু আমাকে একবার জানাবারও প্রয়োজন মনে করলেন না।
আফরোজ বেগমের দুই চোখ বেয়ে জল নেমে এলো। আমি রুমাল বের করে মুছিয়ে দিয়ে বললাম, ভেঙে পড়বেন না মাসিমা। মন শক্ত করুন। দেখবেন একদিন সব ঠিক হয়ে গেছে।
রেহানা চা নিয়ে এলো। সঙ্গে ২টো নিমকি, আর দুটো সন্দেশ। আমি বললাম মাসিমা আর তোমার চা। মা এই সময় চা খাননা, আর আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।
বেশ গরম। তবু রেহানা শাড়ীর আঁচল আরো শক্ত করে জড়িয়ে নিচ্ছে নিজের শরীরের সঙ্গে, বললাম অমন করছ কেন? শরীর খারাপ লাগছে? ও বলল না, এমনি। তুমি খাও আমি আসছি। একটু পরেই ফিরে এল আবার। একটা ভিজিটিং কার্ড আমার হাতে দিয়ে বলল আজ দুদিন হাসপাতালে যেতে পারছি না। কি জানি কেমন আছে সেলিনা। কোনদিন কোন কথাই তোমাকে বলিনি। আজ অনুরোধ করছি, যদি এর মধ্যে গ্রামের বাড়ীতে না যাও রোজ অন্তত একবার যেও হাসপাতালে? কি জানি কেমন আছে ও? বললাম, কি হয়েছে। সে তুমি গেলেই দেখতে পাবে। তারপর আমার কাছে এগিয়ে এসে আমার হাতটা ধরে বলল, আমার অনুরোধটুকু রাখছতো প্রান্তিক? কিন্তু একি? আফরোজ বেগমেব মতো ওরও যে প্রচণ্ড জ্বর। বললাম, কদিন এই জ্বর চলছে? বেশ কয়েকদিন হল। ডাক্তার দেখিয়েছো? হ্যাঁ। কি বলছেন? কমে যাবে বলেছেন। আমি আর থাকতে পারলাম না। বললাম রেহানা তুমি এত নিষ্ঠুর? থাক ওসব কথা। তুমি কাল যাচ্ছতো হাসপাতালে? বললাম, আমি এখনি যাচ্ছি। কিন্তু এখনতো তোমায় ঢুকতে দেবে না। না তা হয়তো দেবেনা, কিন্তু সংবাদটাতে পাব। কিছু প্রয়োজন হলে অন্তত দিয়ে আসতে পারব। কাল সকালে ওর সাথে দেখা করব। দুপুরে তোমাদের সংবাদ দেবো। তারপর ওর দিকে চোখ রেখে বললাম, নিশ্চয়ই সকাল থেকে খাওয়া হয় নি, দোকান থেকে খাবার এনে দিয়ে যাবো? দরকার নেই প্রান্তিক। সকালে একটু সুস্থ ছিলাম, রান্না করেছিলাম, বিকালটাও চলে যাবে। তুমি আজ যাবে বললেনা? যদি কোন সংবাদ পাও একটু দিয়ে যাবে? দুদিন সংবাদ না পেয়ে মায়েব মনের অবস্থা আরো খাবাপ হয়ে গেছে। আমি আর কি বলব। শুধু বললাম, আমার উপর তোমার কোন দাবী নেই তাইনা? ও কিছু বললনা। শুধু মাথা নিচু কবে রইল। আমি বেরিয়ে এলাম।
হাসপাতালে এসে দেখি যে ওয়ার্ডে সেলিনা ভৰ্ত্তি আছে সেখানে আমার পরিচিত একটি মেয়ে কাজ করে। ওর নাম তপতী। আমাকে দেখে ও বলল, আরে প্রান্তিক না? এখানে তোমার কে আছে? আমার এক বন্ধুর বোন তোমাদের এখানে ভর্তি আছে, ওর নাম্বার বললাম। তপতী বলল, ও সেলিনা রহমান, এবারের ক্লাব বক্সিং এ প্রথম পুরস্কার বিজয়িনী। কিন্তু ওর কোন দাদা আছে বলেতো জানিনা। ওর এক দিদি না বোন সেই আসতো, কি যেন নাম–হ্যাঁ মনে পড়ছে রেহানা রহমান। ভীষণ মিষ্টি মেয়েটি। তা ওতো দুদিন আসছে না। আমি বললাম, রেহানা আমার সহপাঠী। ওর কথাই বলছিলাম, ও এবং ওর মা দুজনই খুব অসুস্থ। আজ হঠাৎ গিয়েছিলাম ওদের বাড়ীতে। তপতী ইঙ্গিতপূর্ণ চোখ তুলে তাকালো আমার দিকে তারপর বলল–ও তাই বল।
তপতী আমার স্কুল জীবনের বন্ধু সম্পর্কটি এক সময় ছিল অম্ল মধুর। কিন্তু সে সব পুরনো কথা। দেখা না হলে হয়তো কোন কথাই মনে পড়তনা। স্কুল ফাঁইনাল পাশ করে ও নার্সিং ট্রেনিং নিয়ে চলে এসেছে। ওর সঙ্গে যে হঠাৎ এখানে দেখা হবে ভাবিনি। তপতী বলল, আমার দিকে তাকিয়ে কি ভাবছ। না কিছু ভাবছিনা। তারপর বললাম, জগৎটা কি বিচিত্র তাই না? এই দেখনা, কতদিন হয়ে গেছে, সেই যে তুমি নার্সিং ট্রেনিংএ চলে গেলে, তোমার সঙ্গে যে আবার আমার দেখা হতে পারে তাই কি কখনো ভেবেছি? তা ঠিক। আমিও ভাবিনি। তারপর কণ্ঠটা একটু নীচু করে বলল, আমাকে বোধ হয় তুমি চিনতে পারনি। না সত্যি পারিনি, আর তা ছাড়া তুমি এখানে আছে জানলে হয়তো চিনবার চেষ্টা করতাম। আরো অসুবিধা, নাসিং ড্রেসে আসল চেহারা অনেকটা চাপা পড়ে যায়। ও বলল, চা খাবে? আতঁকে উঠে বললাম এত রাতে? ও বলল, তুমিতো নীলাঞ্জনা পিসিদের ওখানে আছো তাই না? হ্যাঁ। উনি কেমন আছেন? ভাল। আমাকে কি চিনতে পারবেন? হয়তো হঠাৎ দেখলে নাও চিনতে পারেন, তবে পরিচয় দিলে নিশ্চয়ই চিনতে পারবেন বলেই মনে হয়। দেখেছি তো গ্রামের কথা প্রায়ই ভাবেন। তপতী বলল, আমাদের গ্রামের সব চেয়ে প্রতিভাময়ী মেয়ে। দেখতে ভীষণ ইচ্ছে করে। বললাম একবার এসোনা পিসীর বাড়ীতে। যাব একদিন। তুমি ওর ঠিকানাটা দাও। তুমি থাক কোথায়? এখানে হোষ্টেলেই থাকি। তারপর বলল, তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে প্রান্তিক। তুমি কি সেলিনার সঙ্গে দেখা করতে চাও? এখনকি তোমরা দেখা করতে দেবে? দুষ্টু হাসি ঠোঁটের কোনে মিলিয়ে দিয়ে তপতী বলল, না অসময়ে দেখা করার নিয়ম নেই। তবে তোমার যখন ভীষণ ইচ্ছে এস আমার সঙ্গে। আমি অন্যান্য পেসেন্টের সঙ্গে কথা বলার মাঝে তোমার কথা, দেখা এবং অন্যান্য প্রয়োজন শেষ করে নেবে। হাতে সময় দশ মিনিট। ডাক্তার বাবু রাউন্ডে আসবেন, বললাম আচ্ছা চল।
অবাক হয়ে দেখলাম, সেলিনাব পায়ে এবং মাথায় ব্যান্ডেজ। তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। আমাকে দেখে ও অবাক হয়ে তাকায় আমার দিকে আছে। তপতী বলল, সেলিনা, তোমাব দিদি ও মা অসুস্থ, তাই আসতে পারেননি। ওকে তোমার খোঁজ নিতে পাঠিয়েছেন। তোমাদের প্রয়োজন দশ মিনিটের মধ্যে শেষ করে নাও। ডাক্তার বাবু এসে গেলে কিন্তু আমার অসুবিধা হবে। ধন্যবাদ বলে সেলিনা আমাকে পাশের টুলে বসতে বলল। তারপর দেখতে পাচ্ছি ওর চোখ দুটো ছল ছল করছে। এখনি বোধ হয় কান্না ঝরে পড়বে। আমি বললাম, কাল দুবেলায়ই আসব আমি, তখন সব কথা শুনবো। এখন বলত, তোমার কিছুর প্রয়োজন আছে কীনা? ও সকলেব সামনে আমার একটি হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলল, প্রান্তিক ভাই আমার সেদিনের ব্যবহার কি ক্ষমা করতে পেরেছেন? ওকে বাঁধা দিয়ে বললাম, থাক ওসবকথা। তুমি এখন আগের থেকে ভালোতো? হ্যাঁ অনেকটা ভালো। ঘাও প্রায় শুকিয়ে এসেছে। শুধু সে দিনের কথা চিন্তা করলে মাথার মধ্যে ভো ভো করে। তারপর বলল, রেহানার জ্বর কমেনি? না এখনো কমেনি। তবে তার জন্য তুমি চিন্তা করোনা। তোমার কিছু দরকার কি না সেটা আগে বল। দুদিন জামা কাপড় চেঞ্জ করতে পারছি না। আমি বললাম এখানে খেতে পারছতো। চলে যাচ্ছে প্রান্তিক ভাই, ও নিয়ে আপনি ভাববেন না। জানি কষ্ট হবে তবু মা ও রেহানাকে একটু দেখবেন। তাবপর অন্য দিকে পাশ ফিরে শুলো সেলিনা। আমি উঠে পড়ে বললাম, আজ তাহলে আসি, কাল আসব। তুমি বাড়ীর জন্য চিন্তা করোনা।
বেরিয়ে আসার সময় তপতী এলো কাছে। বললাম আমি তা হলে আসি তপতী। ও বলল, ঠিক আছে এসো। চিন্তার কিছু নেই, খুব তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেওয়া হবে। আমি বললাম তাই যেন হয়। ও আমার আরো কাছে এসে বলল, ওর জন্য আলাদা করে কিছু করতে চাইলে তোমার আপত্তি হবে না প্রান্তিক? মানে? ও বলল রেহানা এলেও দেখেছি তো ও যেন কাকে খুঁজতো। তারপর ভিজিটিং আওয়ার শেষ হয়ে গেলে, ওর বুকে যেন কিসের হতাশা নেমে আসতো। পেশেন্টের পরিচর্যা করতে করতে আমি তোমাদের লক্ষ করছিলাম। তুমি জেনো প্রান্তিক ও আজ নিশ্চিন্তে ঘুমাবে। চিন্তা করো না। আমিতো এই হোস্টেলেই থাকি, ওর কোন অসুবিধা হবে না। শাড়ি ব্লাউজ যা যা প্রয়োজন আমিই কাল সকালে দিয়ে যাবো। তপতীর ভুল ভাঙাতে ইচ্ছে করল না। শুধু বললাম সে তুমি যা ভালো বোঝ করবে। আমি বেরিয়ে এলাম। রাত প্রায় দশটা আবার রেহানাদের বাড়ী। রেহানা জানালা খুলে দেখল যে আমি। বললাম দরজা খুলবার দরকার নেই। সেলিনা ভালো আছে। ওর যা প্রয়োজন মোটমুটি একটা এরেঞ্জমেন্ট করা হয়েছে। অসুবিধা হবে না। হয়তো তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেওয়া হবে। কাল সকালে ওর সঙ্গে দেখা করে দুপুরে আসব। চিন্তা করোনা।
আর দেরি না করে বেরিয়ে পড়লাম। বাড়ীতে যখন ফিরেছি তখন দশটা তিরিশ বেজে গেছে। পরিমলবাবু আজও হঠাৎ না বলে বাড়ী ফেরেননি। পিসি শুধু ঘর আর বার করছেন। আমাকে দেখে খুশী হয়েছেন বুঝতে পারছি। কিন্তু বাইরে তা কিছুতেই প্রকাশ না করে গেটের তালা খুলে দিলেন। বললাম, আমি খুব দুঃখিত পিসি। তোমাকে সংবাদ দিতে পারিনি। পিসি কোন কথাই বললেন না। আমি বললাম কোথায় গিয়েছিলাম কেন দেরি হল কিছুই জিজ্ঞাসা করবে না? কি প্রয়োজন। দরকার মনে করোনি সংবাদ দাওনি। রাত হয়েছে খাওয়ার প্রয়োজন হলে খেতে এসো। আমি বললাম, পিসেমশাইয়ের সংবাদ নেবো না। কোন প্রয়োজন নেই। আমার জন্য যখন কেউ ভাবেনা, তখন আমিই বা ভাবতে যাব কেন?
আমি আর কথা বাড়ালাম না। খাওয়ার টেবিলে এসে খেতে বসলাম। পিসি বললেন, তোমার কলেজ খুলতে আর কদিন বাকী আছে? দিন দশেক। তাহলে কি ঠিক করলে গ্রামের বাড়ীতে যাবেনা বলে মনস্থির করেছো? না ঠিক কিছুই করিনি। আর তাছাড়া তুমিও আর কিছুই বলনি। এবার তাহলে বল কবে যেতে চাও? পিসি বললেন, কালই চল। কাল? কেন তোমার অসুবিধা আছে নাকি। হ্যাঁ তা একটু আছে পিসি। তবে পরশু চল। আমি বললাম, আর কয়েকটি দিন দেরি করলে হয় না। কেন? তোমার এখানে এত কি কাজ যে কয়েকদিন দেরি করতে চাইছো? কণ্ঠে অসম্ভব উম্মা। আমি ধীরে ধীরে বললাম। তুমি জানতে না চাইলেও আমি বলতাম পিসি। আসলে তোমাকে না বলে আমি শান্তি পাচ্ছিলাম না। কি এমন কথা যে আমাকে না বলে তুমি শান্তি পাচ্ছ না। বললাম, শোনার আগে তোমার একটু শান্ত হওয়া দরকার পিসি। আমি কি অশান্ত? তুমি আমার থেকে নিজেই ভালো জানো তুমি শান্ত না অশান্ত। আমার কণ্ঠে যেন কি ছিল হয়তো উদ্বিগ্নতা আর দুশ্চিন্তার ছাপ। পিসি বললেন, একি প্রান্তিক তোমার চোখে জল, ছি এতবড় ছেলের চোখে জল আসতে নেই। তোমার এমন কি হয়েছে যে এত দুশ্চিন্তা করছ? আমি তো আছি। হ্যাঁ আমি জানি তুমি আছো, তাইতো নিজেকে এখনো ঠিক রাখতে পেরেছি। তারপর ধীরে ধীরে সব কথা খুলে বললাম। সেই ডালিমের কথা, সেলিনার কথা, রেহানার কথা, আফরোজ বেগমের কথা, এক এক করে সব বললাম পিসিকে। যে দিন গ্রামে যাওয়ার কথা ছিল, সে দিন কেন যাওয়া হলো না, কেন মিথ্যে কথা বলতে হলো। আবার আজ সবেবরাতের রাতে ওদের ওখানে গিয়ে যা যা ঘটেছে, এবং হাসপাতালে তপতী, সেলিনা আবার সেখান থেকে রেহানাদের বাড়ী, কোনটাই বাদ না দিয়ে সব কিছু পিসিকে বলে, জিজ্ঞাসা করলাম এবার বল আমার কি করণীয়।
খাওয়া বন্ধ করে পিসি সব শুনলেন। তারপর বললেন অনুমান কিছু করেছিলাম প্রান্তিক। কিন্তু বাস্তব আর অনুমানতো সব সময় এক হয় না। যাই হোক, সেলিনা হয়তো তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে, কিন্তু তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে রেহানা ভোগাবে। ওকে ডাক্তার দেখানো হয়েছে? জানিনা। সেকি কথা, ওর ঐ অবস্থা ওকে ডাক্তার দেখানো হয়েছে। কী না এটাই জান না? তারপর বললেন ঠিক আছে সকালে ডাঃ মিত্রকে নিয়ে ওদের বাড়ী যাবে। যাবতীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা অবশ্যই উনি যা যা বলেন সবই করবে। যা ওষুধ বলেন সব কিনে দেবে। আর হোটেলে এরেঞ্জমেন্ট করবে যেন দুবেলা ওদের বাড়ীতে তারা খাবার পাঠায়। আমি বললাম কিন্তু। আবার কিন্তু কি। আমি আমতা আমতা করে বললাম, কিন্তু এতসব করার জন্যেতো অর্থের দরকার। হ্যাঁ দরকারই তো, এ সবলতা আর বিনা পয়সায় হবে না। কিন্তু ওরা যদি অত অর্থের সংস্থান করতে না পারে। তুমি দেবে। আমি? কি বলছ তুমি পিসি? আমি নিজের শরীরে যতক্ষন কুলাবে, পরিশ্রম করতে পারব, কিন্তু অর্থ কোথায় পাব? পেতে হবে প্রান্তিক। না পেলে চলবে কেন? কিন্তু কোথায় পাব? পিসি বললেন প্রিয়জনের জন্য প্রয়োজনে চুরি, রাহাজানি, ডাকাতি যা হয় কিছু একটা করবে। আমি আঁতকে উঠে বললাম কি বলছ তুমি পিসি, চুরি রাহাজানি, ডাকাতি করব? না করলে তুমি এতটাকা পাবে কোথায়? দরকার নেই আমার কোন প্রিয়জনের ভালো হওয়ার। রাহাজানির টাকায় তাদের ভালো হওয়ার থেকে ধীরে ধীরে তাদের মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়াই উচিত। তাই বুঝি। তা তোমার চোখের সামনে সামান্য চিকিৎসার অভাবে তারা যখন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে, পারবে সেই দৃশ্য দেখতে? বললাম জানিনে পারব কিনা। তবে এসব আমি পারবনা। না যদি পারবে তা হলে ভালবাসতে গেলে কেন? ভালবাসা কি ছেলে খেলা? তারপর একটু থেমে বললেন, ঠিক আছে সারারাত না হয় ভেবে দেখ, এসব করা সম্ভব কীনা। আপাতত খেয়ে নাও। না আর খেতে ইচ্ছে করছে না। বেশ, তা হলে উঠে পড়।
সকাল বেলা, আমায় ধাক্কা দিয়ে তুলে দিলেন পিসি, বললেন বাবাঃ কি ঘুম ঘুমাতে পারো। ডাঃ মিত্রের ওখানে যাবে না? বললাম না থাক পিসি। ডাঃ নিয়ে গিয়ে ওদের অপ্রস্তুত করতে চাইনা। আমি জানি, তা তুমি পারবেনা। আসলে তুমি একটা ভীরু কাপুরুষ মাত্র। তারপর নিজের মানি ব্যাগ থেকে ৫০০ টাকা দিয়ে বললেন, আশা করি আপাতত মিটে যাবে। পরে লাগলে আমাকে বলতে পারবে, না তাও পারবে না। কিন্তু পিসি? ও তুমি ভাবছো আমার কাছ থেকে এটাকা নেওয়া কি তোমার ঠিক হবে? ওটা না হয় পরেই ভেবো প্রান্তিক। আপতত, এ টাকাটা দরকার। আর দেরি করোনা, এর পরতো আবার সেলিনাকে দেখতে যাবে। আমি অবাক বিস্ময়ে তাকালাম পিসির দিকে। সৌন্দর্যের সঙ্গে মিশেছে যেন অপরূপ দেবীমাধুর্য। হাত পেতে নিলাম পিসির দেওয়া ভালোবাসার দান, প্রিয়জনের কাছ থেকে দান হিসাবে টাকা নেওয়া যায় কি না জানিনা। কিন্তু পিসির এ দানের সঙ্গে ঝরে পড়ছে অজস্র ভালোবাসা। আমি জামা কাপড় পরে বেরিয়ে পড়লাম। একটা টিফিন ক্যারিয়ারের কৌটা এগিয়ে দিয়ে বললেন এটা নিয়ে যাও। কি ওটা? সকালে কিছু খেতে হবে তো।
অবাধ্য চোখর জল কিছুতেই বাধা মানতে চাইছেনা। বহু কষ্টে সামলে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ডাঃ মিত্রকে নিয়ে যখন রেহানাদের ওখানে পৌঁছালাম, তখন নটা বাজে। উনি অনেকক্ষণ ধরে পরীক্ষা করলেন রেহানাকে। ওষুধ লিখলেন ও কয়েকটা জটিল পরীক্ষা করতে বললেন, তারপর বললেন ভয়ের কিছু নেই। কয়েকদিন ভোগাবে, তবে সুস্থ হয়ে যাবে। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, পরীক্ষাগুলো আজকেই করে ফেলতে পারলে ভালো হয়। যত দেরি হবে সঠিক চিকিৎসা তত বিলম্বিত হবে। আরেকটা কথা, এখন পরিপূর্ণ বেডরেষ্ট। টেনশন আর অমানবিক পরিশ্রম, তারপর দিনের পর দিন পরিমাণ মত খাদ্যের অভাব ওকে আজ এই জায়গায় নিয়ে এসেছে। মনে রাখবে প্রান্তিক বিশ্রামের যেন কোন ব্যাঘাত না হয়।
ডাঃ বাবুকে বিদায় দিয়ে আবার ফিরে এলাম। রেহানা বলল এসব তুমি করতে যাচ্ছ কেন? কি লাভ তোমার? জীবনের সবকিছু কি লাভ লোকসান দিয়ে বিচার হয়? শুনেছতো ডাঃ বাবুর কথা। শুধু বিশ্রাম আর বিশ্রাম। কিন্তু কিভাবে বিশ্রাম নেবো প্রান্তিক। মায়ের ঐ অবস্থা, সেলিনা হাসপাতালে, আমার কি বিশ্রাম সাজে? তাহলে মর, আমার কি? রাগ করছ কেন? না রাগ করব না, কিন্তু আমার কথা না শুনলে আর কোন দিন আসব না। আর শোন, সেলিনাকে দেখে আমি বারোটা নাগাদ আসবো, এই টিফিন ক্যারিয়ারে খাবার আছে খেয়ে নিও। তারপর দেখি কোন হোটেল বা রেস্টুরেন্টের সঙ্গে এরেঞ্জমেন্ট করা যায় কি না। পাগলামি করোনা প্রান্তিক। তোমাকে কিছু করতে হবে না। দেখবে আস্তে আস্তে এবার আমি ভাল হয়ে গেছি। কোন পরীক্ষা না করে, কোন ওষুধ না খেয়ে? রেহানা অর্থপূর্ণ হেসে বলল, কাল থেকেতো ওষুধ খাচ্ছি প্রান্তিক। তোমাকে কষ্ট করতে হবে না। কাল যদি আমাকে অনেকটা সুস্থ না দেখ তোমার কথা শুনবো, কিন্তু আজ আর আমাকে নিয়ে টানাটানি করোনা। বেশ এই খাবারটা খেয়ে নিও। কি আছে ওতে? আমি জানি না। বা তুমি হাতে করে বয়ে নিয়ে এলে আর তুমি জানো ওতে কি আছে? বললাম তুমি বড্ড তর্ক করো রেহানা। আমার সময় নেই চললাম।
সকালে মাত্র পঁয়তাল্লিশ মিনিট থাকতে দেওয়া হয় রোগীর কাছে। তাও পনেরো মিনিট লেট। তপতী দাঁড়িয়ে আছে তখনো। ওর ডিউটি ইভিনিং এ। আমাকে দেখে বললো এতে দেরি করলে প্রান্তিক? হ্যাঁ, একটু দেরি হয়ে গেছে। সেলিনা কেমন আছে? ভালো আছে। তোমাকে খুঁজছে। আচ্ছা চল। তুমিই যাওনা। আমি অপেক্ষা করছি তোমার জন্য। কেন মিথ্যে অজুহাত খুঁজছে। চল। আমাকে যেতেই হবে? বা তুমিতো আচ্ছা মেয়ে তপতী। তুমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে অথচ আমার সঙ্গে যাবে না। একটু হেসে তপতী বলল, অনেক দিন পরে ওর সঙ্গে কথা বলবে। এমন কথা তো কিছু থাকতে পারে যা আমার উপস্থিতিতে বলা যাবে না। যদি না যায়, এখান থেকে বেরিয়ে গিয়ে বলবো। ওকেও তো মনে রাখতে হবে ও পেশেন্ট। ও হাসপাতালে আছে। তপতী কি যেন ভাবল তারপর বলল চল।
তপতী নিশ্চয়ই সকালে এসে ওর পোষাক বদলিয়ে দিয়ে গেছে। একটা আনকোরা নতুন ছাপার শাড়ী পরেছে সেলিনা। মাথার চুল বিন্যস্ত। কে যেন সুন্দর করে আঁচড়িয়ে দিয়ে গেছে। কাল যেমন লেগেছিল আজ আর তেমন লাগছে না। তপতী বলল, তুমি এগোতে থাক, আমি একটু এখনকার ডিউটি দিদির সঙ্গে কথা বলে আসি। আমি এগিয়ে যেতে সেলিনা বলল, কুড়ি মিনিট দেরিতে এলেন প্রান্তিক ভাই। হ্যাঁ একটু দেরি হয়ে গেছে। আমি তো ঝগড়া করার জন্য অপেক্ষা করছি। কেন ঝগড়া করবে কেন? বা ঝগড়া কররোনা। তপতীদিকে দিয়ে আমাকে এত অপমান করলেন কেন? আমি বললাম, তপতী তোমাকে স্নেহ করে সেলিনা। মনে করোনা ও রেহানার মত তোমার আর একটা দিদি। আচ্ছা না হয় তাই ভাববো। ওকে আপনি চিনলেন কি করে? সে পরে হবে। এখন কেমন আছো? ভাল। আপনি তপতী দিকে জিজ্ঞাসা করুননা আমাকে কবে ছেড়ে দেবেন। বললাম এত ব্যস্ত হচ্ছো কেন? এটাতো হাসপাতাল, তোমাকে ছেড়ে দেওয়ার মতো অবস্থা হলে আর একদিনও এরা তোমাকে রাখবেন না। হসতে হাসতে কাছে এসে দাঁড়ালো তপতী। বলল, ভাই সেলিনা, প্রান্তিককে যে তুমি চেন তা আগে বলনি কেন? সেলিনা বলল আপনি যে ওকে চেনেন তা জানব কি করে? তাছাড়া আপনার বিরুদ্ধেও আমার একটা অভিযোগ আছে। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ? দেখ প্রান্তিক ও বলেকি? তোমার কথায় ওর জন্য আমি যা নয় তাই করলাম, তারপরও আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ? তা ভাই অভিযোগটা কিসের? হঠাৎ হাসতে হাসতে সেলিনা বলল, থাক বলবনা।
কেটে যায় আরো কয়েকটা দিন। সেলিনাকে এখনো ছেড়ে দেয়নি হাসপাতাল কতৃপক্ষ। একটি গুলি কানের পাশ দিয়ে মাথার একটি অংশ দিয়ে গেছে। আরেকটা পায়ে। পায়ের ক্ষত শুকিয়ে গেছে প্রায় কিন্তু মাথার ক্ষত শুকাতে আরো কয়েকটা দিন লাগবে। কিন্তু সেলিনা কিছুতেই আর হাসপাতালে থাকতে চাইছেনা। অনেকদিন তো হয়ে গেছে হাসপাতালে আছে। হাসপাতালের অনেকের সঙ্গে এই দীর্ঘদিনের সহাবস্থানের ফলে একটা সখ্যতা গড়ে উঠেছে। তপতী হোস্টেলে থাকে। হোস্টেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে, সেলিনার দুই বেলার খাবার ওই নিয়ে আসে। এ নিয়ে সেলিনা একদিন বলে যে, আপনি আমার জন্য এত কষ্ট করেন কেন তপতীদি। তপতী ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন, প্রান্তিক বলেনি রেহানার মত আমিও তোমার একজন দিদি। রেহানা যদি আমার পরিবর্তে এই হোস্টেলে থাকতো, তাহলে কি তোমাকে সে হাসপাতালের খাবার খেতে দিতো। কিন্তু আপনি কেন ভুলে যান। আমি আপনাদের ভালোবাসা বা স্নেহের যোগ্য নই। কে বলেছে? আমি বলছি। তোমার বলা বা জানাটাইকি সব? হা হা সব। তারপর বলল আমার জন্য হ্যাঁ, কেবল আমার জন্যই, আমার গোঁয়ারতুমির জন্য, শুধু আমার নিজের জীবনে নয়, আমার গোটা পরিবার তথা, প্রান্তিক ভাই এবং আপনাকেও এই কষ্ট ভুগতে হচ্ছে। তপতী ওকে বাধা দিয়ে বলে এত কথা বলোনা সেলিনা। ভুলে যেওনা তুমি এখনো সুস্থ হওনি। ও তাকালো তপতীর দিকে। তারপর ফঁকা হাসপাতালের দেওয়ালের দিকে মুখ করে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তপতী বলল, আমার উপর তোমার খুব রাগ হচ্ছে তাই না সেলিনা? সেলিনা আবার ফিরলো তপতীর দিকে। তারপর বলল, আপনারা আমাকে কেন এত ভালবাসেন বলুনতো? তপতী শুধু একটু হাসলো। তারপর বলল, তুমি ভালবাসার মতো যে, তাই তোমাকে ভালো না বেসে থাকতে পারি না। সেলিনার এই সব সহানুভূতির কথা শুনলে চোখ দুটো জ্বালা করে ওঠে, তারপর ঝাঁপসা হতে হতে এক সময় জলে ভরে যায়। নিজেকে সে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারে না। অতিকষ্টে চোখের জলকে সংবরণ করে ও বলল, আচ্ছা তপতীদি আপনার বাড়ীতে আর কে কে আছেন? কেন যাবে নাকি আমাদের বাড়ীতে? যেতেতো ইচ্ছে করে দিদি। কিন্তু ভয় হয়। কেন ভয় হয়? সেলিনা বলল, একবার যাব বলে ঠিক করার পরিণতি তো এই, আবার যদি যেতে চাই, জানিনা, এই পৃথিবীর আলো আর দেখতে পারব কি না। গম্ভীর হতাশা করে পড়ে তার কণ্ঠে। তপতী সেলিনার এই অবস্থার অতীত ইতিহাস জানে না, তবে ভেবে নেয়, নিশ্চয়ই কোন গোপন ইতিহাস আছে এর পিছনে। খুঁচিয়ে তা বের করে সেলিনাকে অস্বস্তিতে ফেলতে চায় না। বলে, থাক ও সব কথা। বরং পরে একদিন তোমার কাছ থেকে ভাল করে জেনে নেবো। এবার তাহলে আসি। ভিজিটিং আওয়ার শেষ হয়ে গেছে ডাক্তারবাবুরা আসবেন রাউন্ডে। আমার কাজ আছে। সেলিনা বলল, আজ আর কেউ এলোনা তাই না? বুঝতে পারে তপতী। এই কেউ বলতে সেলিনা কার কথা বলছে। চারটে বাজার আগে থেকে তার মন কার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে তাতো অজানা নয় তপতীর। রেহানাও আসেনা বহুদিন। প্রান্তিক সেদিন বলেছিল সেলিনাকে রেহানা এখনো পরিপূর্ণ সুস্থ নয়। আর মা। না তিনি অনেকটা ভাল আছেন। ব্যান্ডেজ খুলে দিয়েছেন? হ্যাঁ দিয়েছেন। রেহানার জ্বর কি এখনো কমেনি? কমেছে কিন্তু খুব দুর্বল। রোজই বায়না ধরে তোমার কাছে আসবে বলে। কিন্তু নর্থ থেকে সাউথে আসার ধল্ল সইতে পারবে কি না সেই ভয়ে আমি বলেছি, আরেকটু সুস্থ হও, তারপর নিয়ে যাবে। তাছাড়া আমিতো রোজই যাচ্ছি। রোজই তোমাদের সংবাদ দিয়ে যাচ্ছি। তপতী আছে ওখানে। ও ওর যথাসাধ্য করছে। সেলিনা জানতে চায় রেহানার চেহারা কি খুব খারাপ হয়ে গেছে? তুমি এই সব ভাব বুঝি। তোমাকে না বলেছি সেলিনা, এখন আর কারও কথা ভাববে না।
সেলিনার স্বগতোক্তির উত্তরে তপতী জানায় তোমাকে বলে যেতে ভুলে গেছে প্রান্তিক, তাই যাওয়ার পরে মাঝ রাস্তা থেকে ফিরে এসে আমাকে বলে গেছে কাল ওর আসা হবে না। খুব জরুরি একটা কাজ আছে। তাই আমাকে বিশেষ ভাবে বলে গেছে, ভিজিটিং আওয়ারের সময়টুকু যেন আমি তোমার কাছে থাকি। তোমার কোন প্রয়োজন থাকলে যেন জেনে নিই। তা তুমিতো কিছুই বলছে না। প্রান্তিক জানতে চাইলে কি বলব। ও জানতো না যে আমি যাবো না, জানা থাকলে হয়তো এতটা উতলা হতোনা। বলল, আমার তো সব প্রয়োজনই আপনি মিটাচ্ছেন নতুন করে আর কি প্রয়োজন হবে?
এতদিনে তপতীও জেনে গেছে, প্রান্তিকের সমস্ত মন জুড়ে আছে সেলিনা এবং তাদের পরিবারের সকলে, কিন্তু সম্পর্কটা কোন স্তরের তার কোন হদিস পায়নি। না সেলিনা না প্রান্তিক কেউ তাদের আচরণে এমন কোন কিছুর প্রকাশ হতে দেয় নি যে, তাদের সম্পর্ক নিয়ে অন্য কিছু ভাবা যায়। এই সম্পর্ক ভাই-বোনের স্নেহ ছাড়া অন্য কিছু নয়। তপতী প্রথম প্রথম একটু আধটু ঠাট্টা করতে গিয়েছিল ঠিকই কিন্তু এমন কিছু দৃষ্টিকটু ব্যবহার তাদের মধ্যে নেই যে সেই ঠাট্টাকে দীর্ঘস্থায়ী করা যেতে পারে। জানতে চাইলো প্রান্তিকের কাছে.আমি কি সেলিনাকে জানিয়ে দেব যে তুমি কাল আসতে পারবে না। কি দরকার আগে আগে জানিয়ে। ববং তাতে ওর মনটা অকারণ খারাপ হয়ে যেতে পারে। অন্তত পুরোটা সময় তো সে ভাবতে থাকবে, আমি আসতেও পারি। কিন্তু সত্যি করে যখন সময় শেষ হয়ে যাবে, তখন জানিয়ে দিও। আচ্ছা তাই হবে। কিন্তু তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করব প্রান্তিক? বল। ওদের জন্য তুমি এত করছ কেন? আমি একটু হাসলাম, তারপর চুপ করে থেকে বললাম, ভগবান না করুন, এরকম অবস্থায় পড়লে, আমাকে তোমার পাশে পাবে ঠিক এখনকারই মতন। তবু যেন তপতীর কোথায় অতৃপ্তি থেকে যায়। ঠিক উত্তর যেন পাওয়া হল না। বলল, তুমি যে এদের জন্য এত করছ নীলাঞ্জনা পিসি জানেন?
আমি বুঝতে পারছি। আমার ভিতর থেকে উল্টো পাল্টা প্রশ্ন করে আসল সত্যটা বের করে নিতে চাইছে তপতী। বললাম হয়তো জানেন। তোমার একথার মানে? কি করে এর মানে তোমাকে বলি, বলততপতী। পিসিতো কোনদিন জিজ্ঞাসা করেন নি, আমি কোথায় যাই, কি করি। তার মানে তোমার বাঁধন বলতে কোথাও কিছু নেই। তোমার নিজের ইচ্ছেয় যা কিছু করতে পারো। বললাম, এ তোমার রাগের কথা তপতী। কোন বাঁধন নেই এটাই তুমি বুঝলে? তারপর বললাম যদি কোন বাঁধন না থাকবে, তাহলে আমি রোজ আসি কেন এখানে, আর তুমিই বা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে এত করছ কেন? আমার কথা ছাড়, আমি তোমার কথা জিজ্ঞাসা করছি। আমি তপতীর কৌতূহলকে থামিয়ে দেওয়ার জন্য বললাম, রাত অনেক হয়েছে। আর নয় তপতী। তারপর প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে নিয়ে বললাম, তুমি পিসির ঠিকানা নিয়েছিলে একবার যাবেও বলেছিলে। যাবে না কি? কবে? যে কোনদিন। আচ্ছা ভেবে দেখব। আমি যখন উঠে পড়ছি, আবার পিছু ডাকলো তপতী। বললাম বল। রেহানা ওর বোন না দিদি? দিদি। ও কি এখানে আসার মত সুস্থ হয় নি? কেন বলত। না ও বলছিল, কতদিন রেহানাকে দেখেনা। আমার মনে হয়েছে রেহানাকেও ভীষণ ভালবাসে। যদি সম্ভব হয় কালকে পারবেনা বলছ, পরও ওকে নিয়ে এসোনা। আচ্ছা দেখি।
পিসিকে যে মিনতি সেন ফোন করতে পারেন তা ছিল আমার ধারণার বাইরে। এটা ঠিক, মিনতি সেনদের ওখানে যাওয়া হয় না অনেক দিন। যাব যাব করেও যাওয়া হয় নি। আসলে সময় করে উঠতে পারিনি। কিন্তু মিনতি সেনের বাবা যে অসুস্থ। একবার আমি যাব কথা দিয়েও যাওয়া হয়নি। এটা খুব অন্যায় হয়েছে জানি। তাই বলে পিসিকে ফোন করে আমার কথা জানতে চাইবেন, না একথা কখনো ভাবিনি। তাই পিসি যখন বললেন, আজ মিনতি সেন ফোন করেছিলেন। আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। বললাম, মিনতি সেন তোমাকে ফোন করেছিলেন? হ্যাঁ করেছিলেন তো, কিন্তু তুমি যে ভীষণ অবাক হচ্ছো। উনি কি কোন কারণে আমাকে ফোন করতে পারেন না। পারেন না সে কথা আমি বলিনি, কিন্তু কেন ফোন করলেন সেটাই আমার জানার বিষয়। আমি ভীষণ উৎকণ্ঠা নিয়ে আছি কি জানি কি কথা না বলেছেন মিনতি সেন। পিসি বললেন তুমি বলেছিলে, ওর বাবা খুব অসুস্থ। তুমি যাবে একবার। হ্যাঁ বলেছিলাম, তবে যাওনি কেন? নানা ঝামেলায় যাওয়া হয়ে ওঠেনি। এত কি ঝামেলা যে একজন ভদ্রমহিলাকে কথা দিয়েও তা রাখা গেলনা। আমি বললাম, না পিসি ঠিক তা নয়, আমি কথা দিলে তা রাখবার আপ্রাণ চেষ্টা করি। পিসি উম্মা নিয়ে বললেন এইতো তার নমুনা। যাকগে সে কথা তুমি কি পরশুদিন যেতে পারবে? কেন তুমি যাবে আমার সাথে? আমি যাব কেন? আমাকে কি যেতে বলেছেন নাকি? আমি বললাম জানি না উনি কি বলেছেন, তবে শুধু আমার যাওয়ার কথা বললে তো পিসেমশাইকে বলে দিতে পারতেন। তোমাকে নিশ্চয়ই ফোন করতেন না। তারপব কাতর অনুরোধ করে বললাম চল না পিসি আমার সাথে। পিসি যে আমার এই অনুবোধে রেগে যেতে পারেন, ভাবতে পাবিনি। বললেন, দেখ প্রান্তিক ছেলেমানুষীর একটা সীমা আছে। আমি আর কথা বাড়ালাম না। প্রায় রাত ১১টা পর্যন্ত অপেক্ষা করে খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়লাম। আলোটা নিভানো হয়নি বলে পিসি এলেন আমার ঘরে। বললেন, আলোটাতো নিভিয়ে শুতে পারতে তা হলে আমার আর কষ্ট করে আসতে হতোনা৷ কি যে কর। তারপর যেমন ভাবে এসেছিলেন, আলোটা বন্ধ করে তেমনি ভাবে চলে যেতে উদ্যত হতেই আমি বললাম, শোন পিসি। কি বল? তোমার ঘুম পাচ্ছে? পিসি আববা রেগে গিয়ে বললেন, এই সব বাজে কথা শোনবার আমার সময় নেই। বুঝতে পারি কোথাও কিছু একটা হয়েছে। কিন্তু ধরতে পারছি না। তবু কোন রকম রাগ বা উত্মা প্রকাশ না করে বললাম, যে কোন কারণে তোমার আজ মন ভালো নেই পিসি। তোমার বুঝি তাই মনে হচ্ছে? কিন্তু সেসব ভুল। আমি ভীষণ ভালো আছি। আজ আমি ভীষণ আনন্দে আছি। কি। সব প্রলাপ বকছ পিসি? পিসি আরো রেগে গিয়ে বললেন। আমি প্রলাপ বকছি? মানে আমি পাগল? পাগল তোমার পিসেমশাই। পাগল তোমার মিনতি সেন। পাগল তুমি তোমরা সবাই।
আমি যে কি করব বুঝতে পারছি না। আলো নিভাতে সমস্ত ঘরটা ঘুরঘুঁটে অন্ধকার। আমি বিছানায় বসে নাইট বাটা জ্বেলে দিলাম। দেখলাম পিসি দুই হাতের পর মাথা রেখে চেয়ারে বসে আছেন। হঠাৎ খুব দুশ্চিন্তা হল আমার, তবে কি পিসেমশাইয়ের না আসা, এবং মিনতি সেনের আমাকে ফোন করে খোঁজ নেওয়ার মধ্যে কোন গভীর যোগসূত্র আছে?
বললাম পিসি ওভাবে বসে আছে যে। যাও ঘুমিয়ে পড়ো গে। আবারো সেই রাগী জবাব তুমি ঘুমাও। আমার জন্য ভাবতে হবে না। আমার সময় হলে আমি ঘুমাতে যাব। আমি উঠে পড়লাম বিছানা থেকে। আস্তে আস্তে দাঁড়ালাম পিসির পাশে এসে। পিঠে হাত রেখে ডাকলাম পিসি। আমার গায়ে হাত দেবে না। তোমরা সব শত্রু। কেউ তোমরা আমাকে চাও না। আমার ভালমন্দ নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় নেই তোমাদের। আমি শুধু অবাক আর অবাক হয়ে চলেছি। বললাম কি যা তা বলছ পিসি? কে তোমার শত্রু? এ তোমার মনের ভুল। মনকে ঠিক কর, দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে। এবার পিসি আর কোন কথা বললেন না। আমি আবারও ডাকলাম পিসি। কিন্তু কোন সাড়া নেই। এবার জোর করে মুখটা তুলে ধরতেই দেখলাম, দুচোখের জলে তার বুকের আঁচল ভিজে একাকার। বললাম ছিঃ পিসি ছিঃ! কি হয়েছে না বলে নিজের মধ্যে চেপে রেখে দিলে কি সমাধান হবে? এবার উনি আমাকে আস্তে আস্তে ওর বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে বললেন, আমি খুব খারাপ তাই না প্রান্তিক? এসব তুমি কি বলছ পিসি, কে বলেছে তুমি খারাপ। তাহলে তুমি এখান থেকে চলে যেতে চাইছো কেন? আমি পিসির বাহুপাশ থেকে আস্তে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে, সামনের চেয়ারটায় পিসিকে বসিয়ে দিয়ে, বিছানার এক পাশে মুখোমুখি বসে মৃদু কণ্ঠে বললাম, কে তোমাকে এই বাজে কথা বলেছে জানিনা। যেই বলুক সে মিথ্যে কথা বলেছে? আমি কোথায় যাব পিসি? কে আছে আমার এখানে? আর কেনই বা যাবো? তুমিতো আমার সঙ্গে এমন কোন ব্যবহার করনি যাতে রাগ করে চলে যাব। পিসি বলনে, তার মানে, আমি খারাপ ব্যবহার করলে তুমি চলে যেতে পার। আর এখন না গেলেও ভবিষ্যতে যেতে পারো নিশ্চিত, তাই না? আমি কি তাই বলেছি? না স্পষ্ট করে বলোনি, তবে তুমি যা বলেছে, তার তো মানে একটাই। কিন্তু প্রান্তিক তুমিতো নিজেই বলেছো আমাকে তুমি ভালবাসি। আমার সঙ্গে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলতে তোমার ভাল লাগে। তাইনা? পিসিব প্রশ্নের উত্তরে বললাম সত্যি কথাইতো বলেছি পিসি। সত্যি আমি তোমাকে ভালবাসি। নীলাঞ্জনা বললেন, ভালবাসা বুঝি খুব পলকা জিনিষ, যে সামান্য আঘাতে তা ভেঙে যাবে। বললাম বুঝতে পারছি না তুমি কী বলতে চাইছে পিসি। নীলাঞ্জনা বলেলেন, কথা দাও প্রান্তিক আমি যদি খারাপ ব্যবহারও করি কোন দিন, তাহলেও তুমি কোনদিন চলে যাবেনা। তাহলে তো বুঝবো তুমি আমাকে ভালবাস।
পিসির এই এলো মেলো ব্যবহারে আমার কান্না পেয়ে যাচ্ছে। তবু বললাম জানিনে আমার মুখ দিয়ে তুমি কি শুনতে চাও। বল তুমি আমি কি বললে তুমি খুশী হবে? আমার খুশী হওয়াটা কি তোমরা চাও? তোমরা বলতে কি বলতে চাইছো জানিনা, কিন্তু আমার কথা বলতে পারি, তুমি চাওনা, তুমি খুশী হতে পার না এমন কিছু আমি করবনা, কোন দিনই আমি তোমাকে ছেড়ে যাবো না পিসি। নীলাঞ্জনা চোখ তুলে তাকালে আমার দিকে। বললেন, একথার মানে কি জান? জানি কি জান? বললাম আমি আমার কথা বলেছি পিসি, আর তুমিও বধির নও যে শোননি। তাই নতুন করে এককথা বার বার বলতে পারবনা। পিসি মৃদু হেসে বললেন, কিন্তু আমাকে সুখী দেখতে বা করতে গিয়ে যদি তোমাকে কোন কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়? তাই নেবো পিসি। সহজ কণ্ঠে নীলাঞ্জনা বললেন, এখনো সময় আছে প্রান্তিক এমন কঠিন সিদ্ধান্ত তুমি নিওনা। আমি ধীরে ধীরে বললাম, এ কোন কঠিন সিদ্ধান্ত নয় পিসি। আমার জীবনে তোমার অবদানকে আমি অস্বীকার করব কি করে? নীলাঞ্জনা বললেন যদি আমার হঠকারিতার জন্য জেদের জন্য একে একে সবাই আমাকে ছেড়ে যায়? আমি যাব না। কেন? আমি তোমাকে ভালবাসি বলে। আর একথা তো তোমাকে বহুবার বলেছি। আমার কথা শুনে পিসি আবারও রেগে উঠলেন। বললেন, ভালবাসার মানে জান? না জানিনা, কিন্তু তোমাকে বাদ দিয়ে আমি কোন সুখ কিনতে চাইনে। কিন্তু ভেবে দেখোছো কি এসব করতে গিয়ে যদি তোমার জীবন জ্বলতে জ্বলতে শেষ হয়ে যায়? কোন দিনই তুমি জ্বালাতে পারবে না পিসি কারণ আমার জীবনে আগুন জ্বালিয়ে তোমার সুখ কেনা হবে না। সুতরাং ওতে আমি ভয় পাইনা পিসি, মিছিমিছি ভয় দেখিওনা আমাকে। আমিও খানিকটা একরোখা হয়ে কথাগুলো বললাম পিসিকে। কি যেন ভাবলেন পিসি। তারপর একবার পিছনের দবজার দিকে তাকালেন অকারণে। এগিয়ে এলেন আমার দিকে আস্তে আস্তে। আমি তখন মাথা নীচু করে আছি। দু হাতে আমার মুখটা তুলে নিলেন। ভয় যে পেলাম না তা নয়। আগেও দুই দুইবার তার দুর্বলতার আঁচ পেয়েছি আমি। আমার চোখ দিয়ে অবিরাম জল গড়িয়ে পড়ছে। নিজের আঁচলে তা মুছে দিয়ে বললেন, চোখের জল যে মাঝে মাঝে জীবনের কত কঠিনতাকে উর্বর করে তুলতে পাবে নিজের জীবন অভিজ্ঞতায় তা আমি বুঝেছি। মুছে ফেল চোখের জল প্রান্তিক। তারপর বললেন যাতে তোমাকে সুখী দেখতে পারবনা, তেমন সুখ আমি কি চাইতে পারি। আমার ভিতরের কান্না গলা পৰ্য্যন্ত উঠে এলো, বললাম পিসি! পিসি আমাকে আস্তে আস্তে শুইয়ে দিলেন। তারপর মশারি খাঁটিয়ে, ঘরের সব গুলো আলো নিভিয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন।
রাত কাটলো এক গভীর প্রত্যাশা নিয়ে। কি যে হল আর কি যে হল না, কোনটাই যেন ঠিক মনে করতে পারছি না। পিসি কি চাইলেন আর আমি কি দিলাম তার চেয়েও বড় হয়ে উঠলো পিসি কি দিলেন, আর আমি কি পেলাম। পিসি কি নিজেকে সরিয়ে নিলেন আমার কাছ থেকে? না তিনি আমার মনের মধ্যে জাগাতে চেয়েছেন সেই অপূর্ণতা, যার জন্য পিসি নয়, আমাকেই যেতে হবে তার কাছে। জানিনে কিছুই জানিনে। সকালের বিছানা থেকে উঠতে ইচ্ছে করছেনা। ভাবছিলাম পরিমলবাবুর কথা। কে দায়ী পিসি না পরিমলবাবু? আপাত দৃষ্টিতে পরিমলবাবুর বিশেষ কোন দোষ আমি দেখতে পাচ্ছিনা। কিন্তু কিছু একটা আছে যা পিসি এবং পরিমলবাবুকে সন্দেহের দোলায় ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে। সকালের চা নিয়ে এসে পিসি বললেন, রাতে নিশ্চয়ই ঘুম হয়নি। না হয়নি। আমি জানতাম তুমিতো সবই জান। হা জানিতো। কালকের সেই বিষণ্ণতা একে বারে অনুপস্থিত। সকালে স্নান করেছেন পিসি। পরেছেন গরদের লাল পেড়ে শাড়ী। একটু আগের প্রভাত পূজার শঙ্খধ্বনি এসেছে কানে। আগে করতেন না। কিন্তু ইদানিং সকাল সন্ধ্যা দু বেলাই মঙ্গলদীপ জ্বালান তিনি তার দেবতার মন্দিরে। নটরাজের পূজারি নীলাঞ্জনা পিসি। বললাম এত সকালে তোমার পূজা শেষ? তারপর জানতে চাইলাম আজ কি প্রার্থনা করলে তোমার দেবতার কাছে। পিসি বললেন আমার দেবতা নটরাজ। তিনি সব কিছুর উর্ধে। তার কাছে তো চাইবার কিছু নেই আমার, তবু মৃদু হেসে পিসি বললেন বলেছি আমার অপূর্ণতাকে পূর্ণ করে দাও হে নটরাজ তোমার আপন খেয়ালে। ব্যস তোমার প্রার্থনা শেষ? কেন তুমি কি অন্য কিছু চাইতে নাকি? না পিসি কোন দেবতার কাছে প্রার্থনা করা আমার পোষাবে না, আমি বরং তোমার কাছে প্রার্থনা করতে পারি। আমার কাছে বল কি চাও তুমি। হেসে বললাম কিছুই চাইনা। শুধু তোমাকে চাই পিসি শুধু তোমাকে। পিসি চায়ের পেয়ালা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, এই ধর চা। অফিসের সময় হয়ে গেছে। আর বলছিলাম কি বেশী মন খারাপ না করে একবার মিনতি সেনের কাছে যাও।
০৫. মিনতি সেনের বাড়ী
মিনতি সেন সাধারণত ৫/৩০টার আগে বাড়ীতে ফেরেন না। হাসপাতাল থেকে মিনতি সেনের বাড়ীতে যেতে গেলে এক ঘন্টার উপর সময় লাগে। তাই তপতীকে বলে এসেছি আজ আমার আসা হবে না, তুমি ওকে সময় দিও। কিন্তু কে জানতত, শিয়ালদা স্টেশনে হঠাৎ করে এমনি ভাবে দেখা হয়ে যাবে পরিমলবাবুর সঙ্গে। রেল ক্যান্টিন থেকে রেকচ্ছেন পরিমল বাবু, সঙ্গে এক সুন্দরী মহিলা। তা হলে পিসির অনুমান ঠিক। কিন্তু এ মহিলার যে সিঁথিতে সিঁদুর। তা হলে কে এই মহিলা? মিনতি সেন যে নন, তাতে দেখতেই পারছি। তবে কি কাকলী মিত্র? কিন্তু যতদূর জানি কাকলী মিত্র অবিবাহিতা। অবশ্য পরিমলবাবু যদি গোপনে তাকে বিয়ে করে থাকেন তা হলে অন্য কথা। কিন্তু তাইবা কি করে সম্ভ। পিসির অনুমতি ছাড়া বিয়ে হবে কি করে? আমি একটু আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালম। শুনতে পেলাম ভদ্রমহিলা বলছেন, রোজ রোজ ব্যারাকপুর থেকে আমি আসতে পারবনা। তাহলে কি করবে? কি আর করব। তোমার পরেতো আমারও অধিকার আছে? আমিতো অস্বীকার করছিনা। তা হলে তোমার যেতে আপত্তি কোথায়? তুমি বুঝতে পারছ না, যুঁথি। আমি সবই বুঝতে পারছি। তারপর বললেন তোমারই অনুরোধে আমি চুপ করে ছিলাম এতদিন। আর সম্ভব না। তাহলে কি করতে চাও? আমি আর আসতে পারবনা। বেশ তাই হবে, কাল আমিই যাব।
আনন্দে চিক্ চিক্ করে উঠলো ভদ্রমহিলার চোখ। পরিমলবাবু বললেন, সেই প্রথম দিনের মতো ফিরিয়ে দেবে নাতো। তোমার মনে আছে সেদিনের কথা। মনে থাকবেনা কেন? আজো সেদিনের কথা মনে পড়লে অপমানের জ্বালায় আমি কেঁপে উঠি। তাই বুঝি। হ্যাঁ যুঁথি তাই। তবুও তো ভুলতে পারলেনা। না পারলামনা। তারপর বললেন, হয়তো পারতাম তবে পারলে না কেন? ওরা ক্যান্টিনের বাইরে একটা ফাঁকা জায়গা বেঁছে নিয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন। আমার যে কি হল আমি কিছুতেই পা নাড়াতে পারছি না। পরিমলবাবু বললেন পারলাম না তোমার জন্য? আমার জন্য? হ্যাঁ তোমারই জন্য। আরো বললেন, কারণ আমি কথা দিয়েছিলাম, আমার সন্তানের মা তুমি ছাড়া আর কেউ হবে না। বিজয়িনীর হাসি দেখা গেল যুঁথির মুখে। বললেন, কিন্তু আমি যে শুনেছি সন্তান দেওয়ার মতো ক্ষমতাই তোমার নেই। তাই বুঝি। বেশ কালতে যাচ্ছি। পরীক্ষা দেবে? হ্যাঁ পরীক্ষাই দেব, কিন্তু পাশ করলে কি দেবে বল? তার আগেতে প্রবেশাধিকার চাই। সেটা পাও আগে। তার মানে এখনো তোমার সেই হেঁয়ালি। আমার জন্য কি তোমার কোন মায়া হয় না? যুঁথি বললেন কালতে যাচ্ছ? কাল বলব। কাল কেন আজ বলা যায় না। হয়তো যায়, কিন্তু এখনো আমার নিজেকে জানা হয়নি। যাকগে চলি। চল তোমাকে গাড়ীতে তুলে দিয়ে আসি। কোন দরকার নেই। তুমি চলে যাও। আমি একাই যেতে পারব। বেশ জোর করবনা।
পরিমলবাবু সিঁড়ি ভেঙে নেমে গেলেন। আর যুঁথি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আস্তে আস্তে নেমে এলেন। টিকিট কাউন্টারে এসে টিকিট কাটলেন। হ্যাঁ ব্যারাকপুর এর টিকিট। আমি নিজে তার পিছনে দাঁড়িয়ে ব্যারাকপুরের টিকিট কাটলাম।
চায়ের তৃষ্ণা পেয়েছে খুব কিন্তু চায়ের ফেরিওয়ালা, অন্যদিকে থাকায় আমি জোবে ডাকলাম, এই চা। কিন্তু ও বোধ হয় শুনতে পায়নি। ও অন্য কম্পার্টমেন্টে চলে গেল। আমি আপন মনে বললাম, ভীষণ চা তেষ্টা পেয়েছিল কিন্তু চাওয়ালা শুমতেই পেলনা। হাসলেন যুঁথি। হাসলে ভীষণ সুন্দর লাগে ভদ্রমহিলাকে। ভদ্রমহিলার চেহারার মধ্যে এমন একটা আলাদা জৌলুস আছে যা যেকোন পুরুষকে তার দিকে তাকাতে বাধ্য কববে। উনি নিজের ফ্লাস্ক থেকে চা ঢেলে আমার দিকে বাড়িয়ে দিলে আমি বললাম, না থাক আপনি খান। অবারও হাসলেন যুঁথি। লজ্জা করছে? ছেলেদের লজ্জা আমার কাছে কেমন বোকা বোকা মনে হয়। আমি বললাম আমারও তাই মনে হয়। কি? ঐ যে আপনি বললেন না লাজুক ছেলেদের আপনার কেমন বোকা বোকা মনে হয়।
ট্রেনের যাত্রীরা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত, সুতরাং আমাদের দিকে তাকাবার তাদের সময় কোথায়? তবু যে ২/১ জন আড়চোখে তাকাচ্ছেনা তা হলপ করে বলা যায় না। যুঁথি বললেন, তাই বুঝি। বুঝতে পারছি যতটা বোকা তিনি আমাকে মনে করেছিলেন আমি যে তা নই এটা বুঝতে পেবেই একটা সমীহের দৃষ্টিতে তাকালেন আমার দিকে। বললেন আপনি তো ভারি সুন্দর কথা বলতে পারেন। আপনি কি ব্যারাকপুরেই থাকেন? এত জায়গা থাকতে হঠাৎ আপনার ব্যারাকপুরের কথা মনে হলো কেন? আস্তে আস্তে বললেন, আপনাকে আমি টিকিট কাউন্টার থেকে লক্ষ কবছি। আপনি ব্যারাকপুরের টিকিট কেটেছেন তাও দেখেছি। আমি হেসে ফেললাম। হাসলেন যে। না এতলোক থাকতে আপনি আমার গতিবিধি লক্ষ কবেছেন কীনা তাই। তারপর বললাম না আমি ব্যারাকপুর থাকি না। তবে আমার এক বন্ধুর ওখানে অপেক্ষা করার কথা, কি জানি অপেক্ষা করে আছেন না চলে গেছেন। চলে গেলে তো খুব দুঃখের কথা। কেন দুঃখ হবে কেন? বা দুঃখ হবে না, আপনি এত কষ্ট করে গিয়ে দেখলেন যে যার থাকার কথা তিনি নেই। এতো দুঃখেরই কথা। আমি খুব গম্ভীর ভাবে বললাম। আমি কোন কিছুকে মূল্যহীন মনে করিনা কারণ উনি না থাকলেও আমার সঙ্গে তো একজন নতুন বন্ধু রয়েছেন। কে? কেন আপনি? অবাক হয় যুঁথি? এ ছেলেটি বলে কি? মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে যে অধিকাংশ ছেলের লেজেগোবরে অবস্থা হয়, এ ছেলেটির মধ্যেতে তার বিন্দুমাত্র লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। কত সহজ এবং স্বাচ্ছন্দ্য। কোন আড়ষ্টতা নেই, নেই কোন অস্পষ্টতাও। নিজের মতামত দৃঢ়ভাবে জানাতে পারে। এমন ছেলেদেরইতো মেয়েদের সাধারণত ভাললাগার কথা। যুঁথির তাই ভাল না লেগে উপায় নেই। এমন একজন সহজ সাবলীল এবং সোজাসুজি কথা বলতে পারে এমন যুবকের সঙ্গে কথা বলতে পারা যে অনেক মেয়ের কাছে ঈর্ষণীয় তাকে অস্বীকার করবে কি করে যুঁথি। বললেন, আমাকে আপনি বন্ধু বলে মনে করেন? অবশই যতক্ষণ ট্রেনে চলছি ততক্ষণ তাতে আপত্তি কি? সময়টাতে অন্তত ভালো কাটবে। যুঁথির যেন আর কোন কথা জোগায় না।
কিছুক্ষণ চুপচাপ। কোন তরফের থেকেই কোন কথা নেই। সামনে একজন রহস্যময়ী সুন্দরী মহিলা বসে আছেন। হোকনা তিনি আমার থেকে বেশী বয়সী তাতে কি? সৌন্দর্যের পরিমাপ কি বয়স দিয়ে মাপা যায়? সিঁথিতে সিঁদুর, হাতে শাখা না থাকলে অনেক পুরুষের বুকে যে আগুন জ্বালাবার সৌন্দর্য আকর্ষণ তার আছে তাকে অস্বীকার করা যায় না। আর তা ছাড়া ট্রেনে চলতে চলতে হয় উদাস দৃষ্টিতে বাইরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে হয় না হয় চোখ দুটিকে নিবদ্ধ রাখতে হয় ঠিক আমার সামনে যিনি বসে আছেন তার দিকে। দুটোই সমস্যার। অনেক সময় কথা না বলেও এত কথা বলা যায় যে নিজেকে ক্লান্ত মনে হয়। ঠিক কিনা বলুন? শেষের কথাটায় একটু জোর বেশী দিলাম যাতে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়। কিন্তু আমার কথা শুনে হেসে ফেললেন উনি, বললেন না আপনার সঙ্গে সত্যি পেরে ওঠা যাবে না, বললাম আপনি যে বেশীক্ষণ পারবেন না তা আমি জানি। যাক গে সে সব কথা। এবার বলুনতো আপনি কি করেন? যুঁথি সহজ ভাবে বললেন, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে এত খোঁজ নিচ্ছেন কেন বলুনতো? আপনার সঙ্গে হয়তো ভবিষ্যতে আমার আর কোন দিন আর দেখা নাও হতে পারে। হতেও তো পারে। আবার সেই কথার মারপ্যাঁচ। হয়তো যুঁথি মনে মনে ভেবে চলেছেন, ছেলেটার বয়স বেশী নয়, কিন্তু যেকোন বয়সের মেয়েদের সঙ্গে যে তার সাবলীল মেলা মেশার অধিকার আছে তাকে অস্বীকার করা যায় না। হয়তো মনে মনে ভেবে নিয়েছেন যুঁথি যে যতক্ষণ একসঙ্গে পথ চলা হচ্ছে, ততক্ষণ চুকরে না থাকাই ভাল। বললেন আপনার এই আত্মবিশ্বাস কোথা থেকে পেলেন বলুনতো? ঠিক বুঝলামনা আপনার কথা, উনি বললেন এই যে আমার কথার প্রতি উত্তরে অমন করে বললেন, আপনি যে বেশীক্ষণ পারবেন না তা আমি জানি। এই আত্মবিশ্বাস। আমি হো হো করে হেসে উঠলাম। পাশের যাত্রীরাও চমকে উঠে তাকালেন আমার দিকে ঠিক যুঁথির মতো।
ততক্ষণে ট্রেনটি ব্যারাকপুর স্টেশনে ঢুকে পড়েছে। সবাই নামার জন্য ব্যস্ত। আমি বললাম, কি হলো নামবেন না। হ্যাঁ নামব। এ ট্রেনের শেষতো এখানেই, অত তাড়াহুড়োর কি আছে? সত্যিইতো তাড়াহুড়োর কিছু নেই। এই জন্যই আমার আপনাকে ভীষন ভালো লেগেছে। মানে? এতক্ষনে বুঝেছি, আপনি ধৈর্য্য ধরতে জানেন। জানেন এটা মেয়েদের একটা বিশেষ গুন। আপনি বুঝি মেয়েদের খুব ভালো ভাবে চেনেন। এই দেখুন আপনি কেমন অবাস্তব কথা বল্লেন। মেয়েদের চেনে না এমন কেউ আছে নাকি? মা, বোন, বৌদি, পিসি, মাসি এমন কি স্ত্রী পর্যন্ত সবাইতো মেয়ে। আপনি কি বলতে চান এদের আমি চিনিনা? তারপর বললাম, না এবার নামতে হবে, ট্রেনে আর কেউ নেই দেখছি।
আমরা প্লাটফরম থেকে বেরিয়ে এলাম। যুঁথি বললেন, কই আপনার বন্ধু নেই? না দেখছিনা। তা হলে কি করবেন? হঠাৎ প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বললাম, চলুননা ওইতো চায়ের দোকান, ওই দোকানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাড়ে চা খাওয়া যাক। আপনার বোধহয় মাঝে মাঝেই চা তেষ্টা পায়। মাঝে মাঝে নয়, তবে সঙ্গে কেউ থাকলে চা খাওয়ার একটা বিশেষ জেদ চেপে যায়। শুধু চা আর কিছু খেতে ইচ্ছে করেনা? না করেনা, কারণ পকেট ওর বেশী পারমিট করে না। আবারও হেসে উঠলেন যুঁথি, তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এই ট্রেন প্রায় ৪০ মিনিট পরে ছাড়বে, আমার বাড়ী কাছেই, যদি আপত্তি না হয় তা হলে চলুন না, বাড়ীতে চা করে খাওয়া যাবে। আবারও সেই মুখচোরা হাসি। বুঝতে পারছি আমার কথাবার্তা তার কাছে যেন হঠাৎ পাওয়া মজার সামগ্রী। খুব গম্ভীর কিন্তু হতাশ কণ্ঠে বললাম। যেতে তো ইচ্ছে করে কিন্তু বাড়ীতে কেউ যদি কিছু ভাবেন। ভাবলোই বা। মানে? মানে আবার কি, যদি কেউ কিছু ভাবতে চান, ভাববেন, তাতে আপনার কি। আমিতো আপনার বন্ধু কি তাই না? কিন্তু ওরা যদি বিশ্বাস করতে না চান। ওদের বিশ্বাসে কি যায় আসে, আমিতো বিশ্বাস করছি। আমি অবাক হয়ে বললাম সত্যি? কেন আমাকে আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না। না ঠিক তা নয় আসলে। কি আসলে? আসলে আপনি সত্যিই বলছেন তো যে, আমি আপনার বন্ধু। কেন আমার বন্ধু হতে আপত্তি আছে আপনার না ঠিক তা নয়। তারপর বললাম আপনি আমাকে কতটুকু চেনেন? যতটুকু চিনি তাতেই চলবে। চলুন এবার।
সত্যি কাছেই বাড়ী। একতলা, ছিমছাম, সত্যিই সুন্দর বাড়ীটা। ছোট বাড়ী, উনি নিজের চাবি দিয়ে তালা খুলে ভিতরে এলেন। ছোট্ট বসার ঘর। এক দেওয়ালে দেওয়াল ঘড়ি, আর এক দেওয়ালে একটা বড় ফটো সুন্দর করে বাঁধানো। এগিয়ে ভাল করে দেখি পরিমলবাবুর ছবি। আমি বললাম, আপনি এখানে একাই থাকেন? হ্যাঁ। দেওয়ালের ছবিটির দিকে তাকিয়ে বললাম ওটা কার ছবি? আমার বন্ধুর। আপনার বন্ধু? হ্যাঁ। আমাকে তো আপনি বন্ধু বললেন তাইনা? হ্যাঁ। তাহলে এবার আমার একটি ছবি বাঁধিয়ে আপনাকে দিয়ে যাব। কেন? বা এক বন্ধুর ছবি রাখবেন, আরেক বন্ধুর রাখবেন না।
আবার সেই মন পাগল করা হাসি। বললেন, আচ্ছা দেবেন, রাখব? সতি? হ্যাঁ সত্যি? যাঃ তাই হয় নাকি? কি হয়না। উনি আপনার সত্যি কারের বন্ধু হতে পারেন। কিন্তু আমিতো চলতি পথের সাথী হারা বন্ধু মাত্র। যুঁথি বললেন, কেউ সাথী হারা নয়। চলতি পথে কোন সাথী হারিয়ে গেলে নুতন সাথী জুটে যায়। যেমন আপনি। ওর কথা শেষ হতেই হো হো করে হেসে উঠলাম, আর আমার সঙ্গে হেসে উঠলেন যুঁথিও।
মিনিট পাঁচেক পরে কফি, কিছু মিষ্টি এবং নিমকি নিয়ে এলেন যুঁথি। আমি অবাক হয়ে বললাম কফি? হ্যাঁ, আপনি পছন্দ করেন না। ভীষণ ভীষণ পছন্দ করি, কি করে যে আমার মনের কথাটি বুঝতে পারলেন। আবার সেই কৌতুক হাসির রেখা ওষ্টা ধরে বিলিয়ে দিতে দিতে বললেন, মেয়েদের একটা সিক্সথ সেন্স আছে জানেন? হা জানি। তা হলে? আমিতো সেই জন্যই ভাবি যারা মেয়ে চায়না বলে …। থাক, বলে থেমে গেলাম।
কফির কাপটা তুলে নিলাম। বললাম, কই আপনি নিলেন না? এই নিই। কফি খাওয়া শেষ হলো। বললাম তা হলে উঠি। আচ্ছা। কিন্তু একটা কথা জানা হল না? কি? আবার কি আমাদের দেখা হতে পারে। আপনিতো বাড়ী চিনে গেলেন, আসবেন সময় করে। আপনি বুঝি একা থাকেন? আপাতত। আচ্ছা আপনাকে চিনবো কি করে? আই মীন কি পরিচয়ে। আমার নাম যুঁথি। এই নামেই এ পাড়ার সকলেই চেনেন আমাকে। আবাল বৃদ্ধ বনিতা যাকেই বলবেন, তারাই চিনিয়ে দেবেন আমার বাড়ী। তা তো না হয় হলো, কিন্তু তারা যদি জানতে চান, আপনি আমার কে হন? তা হলে? আপনার যেমন ইচ্ছে আমার পরিচয় দেবেন। যদি বলি আমার বন্ধু। তাই দেবেন। আচ্ছা যাওয়ার আগে একটি কথা জিজ্ঞাস কবি, ঐ ছবির মানুষটি আপনার স্বামী তাই না? চুপ করে থাকেন যুঁথি। আমি বললাম, আমি জানতাম, তাই বলেছিলাম, ওই ছবির পাশে কিছুতেই আপনি আমার ছবি টাঙাতে পারবেন না। তা উনি কি এখানে থাকনে না? না। কেন? আমাকে না জানিয়ে উনি আবার একজনকে বিয়ে করেছেন তাই। আমি অবাক হয়ে বললাম, সেকি সাংঘাতিক কথা, আপনার মতো একজন সুন্দরী স্ত্রী থাকতেও আবার বিয়ে করেছেন? আপনিতো ওর বিরুদ্ধে কোর্টে যেতে পারতেন। আজ থাক বলে কি যেন একটা সম্বোধন করতে চাইছিলেন আমাকে। বললাম, আমার নাম প্রান্তিক, আপনি প্রান্তিক নামেই ডাকবেন আমাকে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললাম, ইস? অনেক দেরি হয়ে গেল। আবেক দিন আসব হাতে সময় নিয়ে। সেদিন শুনবো আপনার কথা। তারপর বললাম না ভদ্রলোক যথেষ্ট অন্যায় করেছেন। দেখতে পাচ্ছি যুঁথির মনটা মেন যেন শুকিয়ে যাচ্ছে। আমি কিন্তু বলেই চলেছি আপনাকে এব; স্থির সিদ্ধান্তে আসতে হবে। যুঁথি উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, কিসের স্থির সিদ্ধান্ত। আমি বললাম, বাঃ আপনিতো কোন অশিক্ষিত গ্রাম্য বধু নন, যে স্বামীর অন্যায় অবিচার মুখ বুজে মেনে নেবেন, কোন উপায় নেই বলে। আপনি শিক্ষিত নারী। প্রচলিত আইন যে জানেন না তাও নয়। তাই আপনার নিজের সম্পর্কে সিদ্ধান্ততো আপনাকেই নিতে হবে, অন্যায়কে মেনে নেবেন না প্রতিবাদ করবেন। তারপর হেসে বললাম, যাই হোক, এটা আমার ব্যক্তিগত অনুযোগ মাত্র। আজ তাহলে চলি আবার দেখা হবে। শুভরাত্রি। যুঁথিও বললেন শুভরাত্রি। কিন্তু তাকে খুব বিষণ্ণ দেখায়।
বাসায় যখন ফিরলাম, তখন রাত ১১টা বেজে গেছে। ভয়ে ভয়ে বাড়ী ঢুলাম। কোথায় ভাবলাম পিসিকে আজ নতুন কথা শুনিয়ে অবাক করে দেবো, তা নয়। এযে দেখছি আষাঢ়ের মেঘ। আমি বেল দিতেই তিনি গেট খুলে দিলেন ঠিকই, কিন্তু কোন কথা না বলে ভিতরে ঢুকে গেলেন। আমি পিছনে পিছনে এসে দাঁড়ালাম পিসির পাশে। পিসি বললেন, কোথায় গিয়েছিলে? সে অনেক কথা তোমাকে পরে বলব। আর বলার দরকার হবে না। আমার সব জানা শেষ হয়ে গেছে। আমি কিছুই বুঝতে না পেরে বললাম, তোমার কি হয়েছে পিসি। তুমি এমন করে কথা বলছ কেন? পিসি আমার কথার কোন উত্তর না দিয়ে ড্রয়ার থেকে একটা সাদা খাম, যার উপরে সুন্দর পুরুষালী হাতে নীলাঞ্জনা নাম লেখা। আমার হাতে দিয়ে বললেন আমার ছাড়পত্র। তুমি পড়, তারপর বল আমার কী করণীয়। পিসি খামটা দিয়ে নিজের ঘর থেকে চলে গেলেন যে ঘরে আমি থাকি। আর তারপরে সে ঘরের বিছানায় নিজের দেহটা এলিয়ে দিলেন হয়তো কোন এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে। আমি খামটা খুলে পড়তে লাগলাম।
নীলাঞ্জনা,
তোমাকে আগের মতো হে আমার সন্ধ্যাকাশের তারা এই নামে ডাকতে পারলাম। জীবনের অনেক গুলো বছর তোমার সঙ্গে কাটিয়ে গেলাম নিখুঁত অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে। অভিনয়ও তো কখনো কখনো ভালবাসায় পর্যবেশিত হয়। একদিন তাই তোমাকে সত্যিই ভালোবেসেও ছিলাম। পেয়েও ছিলাম তোমার কাছ থেকে ভালোবাসার প্রতিদান। কিন্তু যে বন্ধন এতদিন আমাদের এক সূত্রে গেঁথে দিয়েছিল আজ আর তা নেই। কেন নেই তারজন্য কাউকে অভিযোগ জানাব না। অপরাধের বোঝা সব নিজের ঘাড়ে নিয়ে তোমার জীবন থেকে সরে যাচ্ছি। ইচ্ছে করলে আমার বিরুদ্ধে তুমি কোর্টে যেতে পার। আমি আত্মপক্ষ সমর্থন করব না। যে মিথ্যে অভিনয় এতদিন তোমার সাথে নিখুঁত ভাবে করেছি, আমি মনে প্রানে বিশ্বাস করি তার শাস্তি হওয়া উচিৎ। তোমাকে ভুল বোঝাবার জন্য আমি দুঃখিত। হয়তো আর কোনদিনই তোমার সাথে দেখা হবে না আমার। যদি কোন নতুন জীবন বেছে নাও, আমি ঈশ্বরের কাছে তোমার ও তোমাদের মঙ্গল কামনা করবো পরিমল।
একবার নয়, বার বার পড়লাম পরিমলবাবুর চিঠি। তার মানে কাল তিনি যাবেন যুঁথির কাছে। যদি এই জীবনটুকু না জানতাম, ভালো হতো। নীলাঞ্জনা পিসির যেমন অনেক কথা বলার আছে, তেমনি যুথির যে অনেক কথা বল।অহ ৩ ব ক করে। এতদিনে, এত অবিচারের পরেও যুঁথি কি ভুলতে পেরেছেন পরিমলবাবুকে? না। পারেননি, তাহলে নীলাঞ্জনা পিসি বা ভুলবেন কি কবে? যৌবনের উষালগ্ন থেকে যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছেন, স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করেছেন। আজ যদি হঠাৎ তা বালির বাধের মত ভেঙে নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায় তাতেই কি মুছে যায় তার স্মৃতি রেখা। কি বলব পিসিকে সব মেনে নাও। একথাটা বলা যত সহজ, মেনে নেওয়াটা কি ততই সোজা? ভেবে দেখলাম সত্যিকারের অপরাধ যদি কেউ করে থাকেন তিনি পরিমলবাবু। আবার একথাও সত্য ভালবাসাতে কোন আইন মানেনা যে নিক্তিতে ওজন করে ভালবাসতে হবে। তবুও আমার মনে হয় পরিমলবাবু যদি বলতেন আমি তোমাকে সত্যি ভালবাসি নীলাঞ্জনা, কিন্তু সব ভালবাসাই যেমন মিলনে শেষ হয় না, তোমার আমার ভালোবাসাও মিলনে শেষ হবে না কারণ আমি বিবাহিত আর এদেশের আইন দ্বিতীয় বিয়েকে সমর্থন করবেনা। তাই আমাদের ভালবাসা শুধু ভালবাসাতেই তার পূর্ণতা পাক নীলাঞ্জনা। তাহলে পিসি হয়তো তার নিজের সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন।
আমি এখন বিশ্বাস করি যে পিসির এই দূরে সরে যাওয়াটা সত্যি না হলেও পরিমলবাবুকে একদিন পিসিকে ছাড়তেই হতো। কিন্তু কেন পরিমলবাবু এটা করলেন যুঁথি যথেষ্ট সুন্দরী বলে। আমারতো মনে হয় পিসির চেয়েও সুন্দরী। তাহলে? কেন যুঁথিকে দূরে সরিয়ে রেখে সেদিন পরিমলবাবুকে নীলাঞ্জনার কাছে আসতে হল? কেন মিথ্যা অভিনয়ে নীলাঞ্জনার বুকের মধ্যে পরিমলবাবু তার স্থায়ী আসন অধিকার করে নিলেন? যদি না জানতাম, মিথ্যে সন্দেহ করতাম হয়তো পিসিকে। বলতাম, এ দাম্পত্যকলহ একদিন মিটে যাবে পিসি এটাই নিয়ম, কিন্তু আমি যে জানি সব। আমার জানা কথাটি কি ভাবে যে বলব পিসিকে বুঝতে পারিনা। তবু আস্তে আস্তে ধীর পায়ে আসি একসময় আমার ঘরে যেখানে পিসি আছেন। বসি তার মাথার কাছে। আলতোভাবে আমার ডান হাতটা রাখি পিসির মাথায়। আর তাতেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে আমাকে তার বুকের পরে টেনে নিয়ে বলেন, আমি কি করব প্রান্তিক, আমাকে বলে দাও কি আমার করণীয়। পিসির কান্নার অশ্রুবিন্দু ছোঁয়াচের মতন আমাকেও সংক্রামিত করতে থাকে। আমিও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। তারপর বললাম, আমি জানি না পিসি, আমি কিছু জানি না, এখন কি তোমার করণীয়। তারপর একসময় নিজের চোখের জল মুছে নিয়ে, পিসির আঁচলে পিসির চোখের জল মুছে দিয়ে বললাম, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে মেনে নিতে হবে পিসি। জানি আমি যা বলছি, এই মুহূর্তে তোমার ৩. পক্ষে তা মেনে নিতে কষ্ট হবে, কিন্তু এ ছাড়া পথ কি? পিসি কোন কথা না বলে, উঠে বসলেন, তারপর বললেন, জানতাম একদিন এমন কিছু ঘটবে, কিন্তু এত তাড়াতাড়ি যে ঘটবে তা ভাবিনি। আমি বললাম, তুমি যদি জানতে, তা হলে শুধু সময়ের হেরফেরের জন্য অভিযোগ করে কি লাভ? আমি শুধু বলব, পরিমলবাবু যতই নিখুঁত অভিনয় করুন না কেন তুমিতো করনি। তোমার ভালবাসা, তোমার একনিষ্ঠতা তাকে তোমার কাছে আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসবে কীনা জানিনা। কিন্তু কেউ ছোট হয়ে গেল বলে তুমি নে ছোট হবে। পিসি বলেন, তোমার কথা ভাববে প্রান্তিক। একদিন মনে করতাম এত কাজ না করে ও একটা স্থির সিদ্ধান্তে আসুক, তাতে ও-ও বাঁচবে আমিও বাঁচব। কিন্তু শেষের সে দিন যখন সত্যিই এল তখন আমার বুকের মধ্যে এত ধড়ফড় করছে কেন? বলে তিনি আমার একটা হাত টেনে নিয়ে রাখলেন তার বুকের ওপর।
অসম্ভব ওঠানামা করছে তার হৃদপিন্ড। নাড়ীর গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলেছে তার বুকের ওঠা নামা। তামি হাতটা সরিয়ে নিলাম। বললাম পিসি থেকে গিয়ে ভালো করে স্নান করো, আমি গীজারে জল গরম করে দিচ্ছি। যাব তার আগে আমাকে বলতো, তুমিও কি আমার সঙ্গে নিখুঁত অভিনয় করছো? একদিন তুমিও কি এমনি করে ছেড়ে যাবে আমাকে। আবার ডুকরে কেঁদে উঠলেন পিসি। আমি পিসিকে আমার বুকের পরে টেনে নিয়ে বললাম না পিসি কোনদিন তোমাকে ছেড়ে যাব না। আগেও বলেছি, আজ আবারও বলছি, তুমি তাড়িয়ে না দিলে আমি কোথাও যাব না। সত্যি? বলে তিনি আমার ওষ্ঠাধরে এক জ্বালাহীন চুম্বন এঁকে দিলেন। আর আমি? প্রতিদান দিলাম তার কপালে প্রতি চুম্বন এঁকে।
গতদিন কলেজ খুলেছে। ২/৩ দিন যেতে পারিনি, না রেহানার কাছে, না সেলিনার কাছে। তাই প্রথম কলেজ খোলার দিনটা কামাই করতে হল। সকালে চলে গেলাম হাসপাতালে। ডিউটিতে আছে তপতী। আমাকে দেখেই প্রচন্ড রেগে গিয়ে বলল, তুমি কি প্রান্তিক? আজ তিন দিন তুমি আসনা। রেহানাও আসে না। প্রথম ২ দিন যদিও বা কিছু খাইয়েছি, কাল যে সারাদিন কিছুই খায়নি। সারাদিন সে এক কথা বলেছে না দিদি, হয় প্রান্তিক ভাইয়ের কিছু হয়েছে, না হয় রেহানার অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে। আমি কিছুই খাবনা। ডাঃ সরকার অনেক করে বোঝালেন কিন্তু তার সেই এক কথা, তোমাদের সংবাদ না পাওয়া পর্যন্ত সে কিছুই খাবে না। তারপর তপতী জানতে চাইল কি হয়েছিল তোমার? শরীর খারাপ, না রেহানার বাড়াবাড়ি কিছু হয়েছে? ওর মা-ই বা কেমন আছেন? কি করে বলি আমার নিজের অবস্থার কথা। রেহানার সংবাদ তো জানিনে ২/৩ দিন। ওতো অন্তত আসতে পারতো। তিন দিন আগে ওর সঙ্গে যখন দেখা হয়েছিল, তখনতো ওর শরীর অনেক ভাললছিল। যাকগে, ওসব কথা ভেবে লাভ নেই। আমি তপতীকে বললাম, পিসির শরীরটা কয়েকদিন ধরে ভালো যাচ্ছেনা। আমার তাই, রেহানাদের ওখানে বা এখানে কোথাও আসা হয়ে ওঠেনি। সেলিনা যে এতটা পাগলামি করবে তা ভাবতে পারিনি। যাকগে আমি এখন কি করব বলতো তপতী। ও অবাক হয়ে বলল আমি বলে দেব তোমাকে যে তুমি কি করবে? বললাম, দেখ আমার মনের অবস্থা মোটেই ভাল নয়, এটা ঠাট্টা করার সময় নয়। তুমি সেবিকা সেবাই তোমার ধর্ম রোগীর ভাল মন্দ তুমি যেমন বুঝবে আমি কি তা বুঝব। তাছাড়া আমিতো বুঝতেই পারছি না সেলিনা আমাকে দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে যাবে না শান্ত হবে। তপতী কি যেন ভাবলো খানিকক্ষণ। তারপর বলল। তুমি দেখা করে যাও প্রান্তিক। না হলে এ বেলাও খাবেনা। বেশ তাই হবে।
আমি যখন সেলিনার কাছে এলাম দেখলাম দেওয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে আছে ও। আমার উপস্থিতি টের পায়নি মনে হয় আমিও ডাকিনি তাকে ইচ্ছে করে। একটু পরে এল তপতী। আমি ওকে ঈশারায় না ডাকবার জন্য বললাম। ও একটু হেসে বেরিয়ে গেল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, দেখা করার সময় প্রায় আধ ঘন্টা অতিবাহিত হয়ে গেছে, আর দেরি করলে হয়তো কথাই বলা যাবে না। ওর মাথায় আলতো হাত রাখতে আমার দিকে ফিরেই কেঁদে ফেলল। আমি তো ভীষণ অপ্রস্তুত। বললাম, ছিঃ সেলিনা কাঁদেনা। তুমি কাল সারাদিন খাওনি কেন? ও বলল, আমি কিছু খাবনা, আর আপনার সঙ্গে কথাও বলবনা। কেন এত রাগ করছ কেন? এ কয়দিন আসেননি কেন? আপনি আমাকে একটুও ভালবাসেন না, আমি আর এখানে থাকবোনা, আমি আজই বাড়ী চলে যাবো। আমি বললাম পাগলামি করেনা সেলিনা। আমি আজই ডাক্তারবাবুর সঙ্গে কথা বলে যাবো। তারপর ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললাম তুমি যে খেলে না কিছু, কাল সারদিন পোকও বদলালে না এতে তপতীদির দুঃখ হয় না? না হয় না। আমার জন্য কারও কোন দুঃখ হয় না। আমি বললাম, তুমিতো এমন ছিলে না। এমন হয়ে যাচ্ছ কেন? তপতীদি যা যা বলেন অবশ্যই করবে। তিনি তোমাকে ভালবাসেন। আমি বিকালে আবার আসবো। রেহানাকেও সঙ্গে নিয়ে আসবো। জানতে চাইল ও কেমন আছে? আগের থেকে ভালো। তারপর উঠে আসার আগে ওর একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বললাম, তপতীদির কথা শুনবে না? ও মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো, হ্যাঁ শুনবো। আঃ কি শান্তি।
আমি বেরিয়ে এলাম। আর ও, আমি যতক্ষণ না অদৃশ্য হয়ে যাই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আমার দিকে, কি যে চায় ও, কে জানে? মনটা ডুকরে কেঁদে উঠলো। নিজের চোখের জলকে চাপতে গিয়ে আর এক বার তাকিয়ে দেখি, এক দৃষ্টিতে ও আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। বললাম, আমি বিকালে আবার আসব। তপতী পাশেই ছিল বলল, অভিমান ভেঙেছে? বাবা। পারও বটে তুমি। কথাটা কেমন যেন বেসুরো লাগে আমার কানে। বললাম, তোমাকে সত্যি অসুবিধায় ফেলেছি তপতী। কিন্তু এ দায়িত্ব তো তুমি নিজেই গ্রহণ করেছিলে। আমি কি তা অস্বীকার করছি? না বরং তুমি তোমার দায়িত্ব ষোল আনার জায়গায় ১৮ আনা পালন করেছে আর তাতেই ওর ধারণা হয়েছে, আমাদের উপর অভিমান করার ওর সত্যি সত্যি অধিকার আছে। তারপর বললাম আর কয়েকটা দিন একটু দেখ তপতী। তপতী বলল, আমার কথায় রাগ করলে প্রান্তিক? কেন রাগ করবো কেন? তোমার উপর কি রাগ করা সাজে? কিন্তু যাকগে সেকথা, তুমি জানকি, ওকে আর কয়দিন হাসপাতালে থাকতে হবে? কাল ওর ব্যান্ডেজ খোলা হবে। সব ঠিক থাকলে কালই ছেড়ে দেওয়া হবে। সত্যি বলছ? নীরব আনন্দে দুচোখ আমার যেন উছলে উঠছে। তারপর বললাম, একেতো ডানপিটে মেয়ে, তারপর মা ও দিদিকে ছাড়া। এই হাসপাতালের বন্ধ ঘরে ওর নিঃশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসছে। তা ছাড়া এখানে ও আর একদম থাকতে চাইছেনা। ঠিক আছে তুমি আর চিন্তা করোনা, ওকে যাতে ছেড়ে দেয় তার জন্য ডাক্তারবাবুকে যা বলার আমি বলবো। তারপর সম্পূর্ণ প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে বললো এরপরতো তুমি আর আসবে না তাইনা প্রান্তিক। তপতীর একথার মানে হয়তো খানিকটা অনুমান করতে পারছি। বললাম, আসব না একথা তুমি ভাবলে কি করে? কেন আসবে? কার জন্য আসবে? গলাটা কেমন যেন ভারি মনে হয় তপতীর। বললাম কে যে কার জন্য কোথায় যায় আর কার জন্য কত কি ভাবে কেউ বলতে পারে? আমিতো তোমার জন্যও আসতে পারি তপতী? আমার জন্য ঠাট্টা করছ?
আমি ওকে বললাম, ঠাট্টা কিনা জানিনা, তবে এখানে যদি আসি তবে তোমার জন্যই আসবো। তপতী। আর কোন কথা না বলে ওর কাছ থেকে কোন প্রতি উত্তর না শুনেই, আস্তে আস্তে বেরিয়ে এলাম। না, রেহানা ততটা সুস্থ হয় নি। আমাকেই তাই আসতে হল সেলিনাকে নেওয়ার জন্য। হাসপাতালের সমস্ত কিছু মিটিয়ে দিয়ে আমি যখন ওকে নিয়ে আসব, সেই সময়ের মধ্যে একবারও আসেনি তপতী। আমি আয়াকে দিয়ে ওকে সংবাদ পাঠালাম। তবুও এলোনা। সেলিনা বলল, প্রান্তিক ভাই তপতীদি আসবেনা। আমি কি কোন অন্যায় করেছি ওর কাছে? নানা তুমি কেন অন্যায় করবে। তুমি একটু বোস, আমি আসছি।
ডিউটি ঘরে গিয়ে দেখি, তপতী তার দু হাতের মধ্যে মাথা গুঁজে বসে আছে। আমি ডাকলাম, তপতী। ও তাকালো আমার দিকে। কেঁদে কেঁদে চোখ দুটো লাল। আমি কিছুই বলতে পারলাম না। ও শুধু বলল, আমি যাব না প্রান্তিক। আমি কিছুতেই সেলিনার কাছে যাবো না। কেন? কেন জানতে চাইছো? আজ কতদিন হয়ে গেল। এই মান অভিমানের অতীত হয়ে গেছি আমি। নিজেকে শুধু যন্ত্রের মত মনে হয়েছে এই দীর্ঘ বছরগুলো। আর আজ এতগুলো বছর পরে মেয়েটা আমার সবকিছু কেড়ে নিয়েছে প্রান্তিক। সবকিছু। বললাম, এ তোমার ভুল তপতী। বল জীবন তোমার কানায় কানায় ভরে দিয়েছে। তোমার স্বজাতি নয়, তোমার ধর্মেরও নয়, অথচ কি তীব্র অভিমানে ওর সামনে যেতে পারছনা, এর কি কোন মূল্য নেই তপতী? আমি তো দেখেছি অনেক দিন, কি ছটফটে আর অফুরন্ত জীবনশক্তির একটা মেয়ে, এই আঘাতে মিইয়ে গেছে। ওকে তুমি ভুল বুঝো না তপতী। তপতী বলল আমি ওকে ভুল বুঝেছি, এই কি তোমার মনে হলো? তারপর বলল তুমি জানো প্রান্তিক আমার বুকের মধ্যে যে কি হচ্ছে? এখানে তো সম্ভব নয়, অন্য কোথাও হলে তোমাকে বলতাম, আমার বুকে হাত দিয়ে বলতে প্রান্তিক সেলিনা কি আমার কেউ নয়? ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল তপতী। অদ্ভুত এই মানব চরিত্র, কার জন্য যে কোথায় কে অপেক্ষা করে আছে কেউ জানে না। কিন্তু না, পারলামনা, ওর চোখের জল মুছিয়ে দিতে। শুধু বললাম, চোখের জল মুছে ফেল তপতী। আঘাত তোমার যতই তীব্র হোক তুমি বড়। সেলিনা চাইছে তুমি একবার অন্তত এস ওর কাছে। নিজের আঁচলে চোখের জল মুছে নিয়ে ও বলল, তুমি এগোও প্রান্তিক, আমি আসছি।
আসামাত্র সেলিনা ওকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমার কথা তোমার মনে থাকবে তপতীদি? ওরে পাগলি মেয়ে তোকে কি আমি ভুলতে পারব। তুই যে আমাকে কি দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছিস তুই নিজেও তা জানিসনে। তোকে শুধু একটা অনুরোধ জীবনে অনেক ঝড় ঝপটা আসবে, কেটেও যাবে, কিন্তু প্রান্তিককে কখনো কোন দিন ভুল বুঝিসনি ভাই। ঈশ্বর ওর মত মানুষকে মাঝে মাঝে পৃথিবীতে পাঠিয়ে প্রমান করতে চান যে পৃথিবী এখনো, বাসের অযোগ্য হয়নি। সেলিনা তাকালো আমার দিকে, তারপর কি মনে হতেই, হঠাৎ পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো তপতীকে। আর তপতী ওকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিয়ে ওর কপালে পরপর কয়েকটা চুমু খেল। সেলিনা বলল, তা হলে তুমি কবে যাচ্ছ আমাদের ওখানে। যাবরে পাগলি যাব! বোধ হয় কান্না চাপতে পালিয়ে গেল তপতী। ট্যাক্সিটা ছাড়বার সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতেও পারলনা।
সারাটা পথ উদাস দৃষ্টিতে, গাড়ীর জানালা খুলে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকলো সেলিনা। একটি কথাও বললোনা আমার সাথে। আমি বললাম, মন খুব খাবাপ লাগছে তাই না? অথচ দেখ সেলিনা, হাসপাতাল থেকে চলে আসার জন্য কি আকুলতা তোমার। আর এখন সেই হাসপাতাল, ওখানকার প্রতিটি মুহূর্ত বার বার তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সেখানে। এই হয় সেলিনা। এই ভালবাসা, এই মমতা, এই মুগ্ধ স্মৃতি এটুকু বয়ে নিয়ে চলি বলেই আমবা মানুষ। কিন্তু আমার কথার কোন উত্তর দিল না সেলিনা। একবারও বাইরের দৃষ্টিকে ভিতরে এনে আমার দিকে তাকালোনা।
তারপর বেহানাদের ওখানে যখন পৌঁছালাম তখন রাত প্রায় ৯টা হয়ে গেছে। রেহানা তার দুর্বল শরীর নিয়ে এগিয়ে এলো। কানের পাশের কপালের ঘাটা প্রায় শুকিয়ে এসেছে, তবে দাগ যে কোনদিন মুছে যাবে না এটা নিশ্চিত। ট্যাক্সি থেকে নামতেই সেলিনাকে জড়িয়ে ধরল রেহানা। কিন্তু তার সাথেও কোন রকম কথা না বলে ভিতরে চলে গেলো সেলিনা। আফরোজ বেগমের অবস্থা এখন অনেক ভালো। সংসারের কাজও একটু একটু করে করা আরম্ভ করেছেন। সেলিনাকে কাছে টেনে নিয়ে কপালে একটা চুম্বন এঁকে দিয়ে ওকে ভিতরের ঘরে নিয়ে গেলেন। আমি বসার ঘরে বসলাম। রেহানা বলল, চা খাবে? না। সেলিনার কি হয়েছে বলত। কোন খারাপ সংবাদ কিছু আছে? আমি আঁতকে উঠে বললাম, কি খারাপ সংবাদ থাকবে বলতো। না হলে এতদিন পরে দেখা হলো, অথচ কোন কথাই বলল না আমার সাথে। সেতো আমার সাথেও বলেনি সারাটা পথ। গাড়ীর কাঁচ খুলে বাইরের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কাটিয়ে দিল। রেহানা বলল কেন ও এসব করছে? আমাদের কি এসব ভাল লাগবে? আমি বললাম রেহানা, হাসপাতালে মানুষ অনেক আশা নিয়ে যায়, ফিরে আসে স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনা নিয়ে। ও কিন্তু ফিরে এসেছে অনেক স্মৃতি নিয়ে। হাসপাতালের মায়ায় পড়ে গিয়েছে, কাটিয়ে উঠতে তো সময় লাগবে। তারপর জানতে চাই তুমি এখন কেমন আছো? ভালো। ছোট উত্তর। আমি বললাম যখনি জানতে চাই তখনি বল ভাল। কিন্তু তোমার চেহারা যে দিন দিন কত খারাপ হয়ে যাচ্ছে দেখ কি? ও তোমার মনের ভুল, না হলে আমি সত্যিই ভালো আছি। ভালো আছো না ছাই। আসলে তুমি আমার কাছে নিজেকে লুকাচ্ছো। আমাকে কি তুমি একটুও বিশ্বাস করতে পারনা। থাক ও সব কথা, ওই দেখ, তুমি চা খাবে না বলেছো, অথচ মা তোমার জন্য চা নিয়ে এসেছেন, চাটা খাও। আমি আসছি। আফরোজ বেগম বললেন, তোমার ঋণ কি ভাবে শোধ করব জানিনা। আমি বললাম, ছিঃ মাসীমা। ছেলের কাছে কি মায়ের কোন ঋণ থাকে নাকি? এ কথা শোনাও যে পাপ। আফরোজ বেগম আর কোন কথাই বলতে পারলেন না। রেহানা আসতে, উনি আবারও ফিরে গেলেন নিজের কাজে।
রেহানা, একটা মোটা খাম আমার হাতে দিয়ে বললো, এটা নাও। কি এটা। আগে ধর তারপর বলছি। আমি নিলাম ওর হাত থেকে। তারপর খুলতে যেতেই রেহানা বাধা দিয়ে বলল এখন নয়, পরে এক সময় খুলো। কেন? কি আছে এতে। আমার কৃতজ্ঞতা। তুচ্ছ করোনা প্রান্তিক। ও আর সামনে দাঁড়ালো না। আমি ডাকলাম, রেহানা শোন ও আবার এসে দাঁড়ালো আমার কাছে। বললাম বস। ও বসল। আমি বললাম, ওতে কি আছে আমি হয়তো অনুমান করতে পারছি। কিন্তু রেহানা, আমিও তো মানুষ। পশু বা দেবতা নই। ভুল যদি করে থাকি, তার শাস্তি এ ভাবেই দিতে হবে। তোমরা কি ভাবো বলতো আমাকে।
রেহানা আমার কথার কোন উত্তর না দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। আমি বললাম তোমার কিছুই বলার নেই? ও বলল, আছে। তবে বল। ওতেই যা বলার বলেছি। আমি বড্ড ক্লান্ত। ও প্রায় পড়ে যাচ্ছিল। আমি কোন ভাবে ওকে ধরে ফেললাম। কতক্ষণ ওকে ওই ভাবে ধরে ছিলাম মনে নেই। সম্বিৎ ফিরে পেলাম, ও যখন বলল, ছাড়, মা আসছেন। আফরোজ বেগম গরম গরম লুচি, বেগুন ভাজা আর মিষ্টি নিয়ে এলেন। বললেন, রাত অনেকটা হয়েছে, খেয়ে নাও বাবা। আপনি আবার এসব করতে গেলেন কেন? কই আর করলাম। আমাদেরও তো খেতে হবে। আমি দ্বিরুক্তি না করে খেয়ে নিলাম। আফরোজ বেগম বললেন, খাওয়া শেষ হলে একবার সেলিনার সঙ্গে দেখা করে যেও। ও কারো সঙ্গে কোন কথা বলছেনা। বলছে খাবেনা। আমি বললাম কেন? কি জানি বাবা, ওকেতো কোনদিনও বুঝিনি। আজই বা বুঝবো কি করে। আফরোজ বেগম চলে গেলে রেহানা তাকালে আমার দিকে। ওর চোখে কি যেন মায়া আছে। বেশীক্ষণ তাকাতে পারিনা, আপনিই চোখ নামিয়ে নিতে হয়। বললাম, কি হয়েছে বলত, কি করে বলি প্রান্তিক। সত্যিই মাঝে মাঝে নিজের উপর ঘৃণা হয়, ধিক্কার হয়। বললাম তুমিও চল, ও আবার তাকালো আমার দিকে তার সেই মায়াবী চোখ তুলে। বলল না তুমি যাও প্রান্তিক। আমি আর দাঁড়াতে পারছি না।
সেলিনা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। ডাকলাম, সেলিনা। কোন উত্তর নেই। আবারও ডাকলাম, তেমনি নিরুত্তর। এবার ওর কপালে হাত ছোঁয়াতে চোখ মেলে তাকালো। বলল, আপনি এখনো যাননি প্রান্তিক ভাই? আমি ওর কথার কোন উত্তর না দিয়ে বললাম তোমার কি হয়েছে বলত। হাসপাতালে কি কিছু হয়েছে? কেন বলুনতো। না মাসীমা বললেন তুমি কারো সঙ্গে কথা বলছনা। এমন কি খাওনি পর্যন্ত। আমার খেতে ইচ্ছে করছেনা। তা কি হয়। সেই কখন খেয়েছে। খাবেনা কেন? খেয়ে নাও। বোঝনা কেন, তুমি না খেলে এরা খায় কি করে? আজ দুদিন ধরে তুমি রেহানার কথা একবারও জিজ্ঞাসা করনি। এখানে এসেও তুমি ওকে এড়িয়ে গেলে, কেন? ও সে সবের দিকে না গিয়ে বলল, কাল থেকে তো আর আপনি আসবেন না, তাই না? কে বলেছে? আমি জানি, আর আপনি আসবেন না। তারপর নিজেই বলল, আসতে হবে না। কেন আসবেন? আমরা আপনাকে দুঃখ ছাড়া কি দিয়েছি? আমি অবাক হয়ে বললাম, এসব তোমাব মাথায় কে ঢুকিয়েছে? তারপর তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বললাম, যতদিন না তুমি সুস্থ হয়ে আবার বক্সিংএর রিংএ ফিরে না যাচ্ছ ততদিন রোজই আসব। ম্লান হেসে সেলিনা বলল, কেন মিথ্যে সান্ত্বনা দেন প্রান্তিক ভাই। আমিতো আর বক্সিংএর রিংএ ফিরতে পারবনা সেতো আপনি ভাল ভাবেই জানেন। তারপর যেন আপন মনে বলল, দরকার নেই রোজ আসার কিন্তু মাঝে মাঝে আসবেন বলন। বলে একটা হাত আমার ওর নিজের হাতের মধ্যে তুলে নিয়ে বলল, কেন যে প্রান্তিক ভাই বেঁচে ফিরলাম। এতদিনে আপনার পরিচিত সেলিনার যে মৃত্যু হয়েছে। দুটিচোখ দিয়ে ওর জল গড়িয়ে পড়ল। একবার ভাবলাম মুছে দিই। পরে মনে হল, না, ওর কান্নার প্রয়োজন। ভীষণ প্রয়োজন। বললাম ছাড় আমাকে যেতে হবে। রাত হয়েছে অনেক। ও আমাকে ছেড়ে দিল। তারপর বললাম, শোন যদি আগের মত হওয়ার চেষ্টা না করো তাহলে আর কোনদিন আসবোনা। আরেকটা কথা, নিয়মিত খেয়ে নেবে। মাকে কষ্ট দেবেনা। আপনি কষ্ট পাবেন না? জানিনা বলে ওর কাছ থেকে বেরিয়ে দেখি রেহানা দাঁড়িয়ে আছে। আমি আর ওর সঙ্গে কোন রকম কথা না বলে বেরিয়ে এলাম।
বহুদিন পরে অশ্রুকণার সঙ্গে দেখা হল কলেজ ক্যান্টিনে, অথচ কি অদ্ভুত আমাকে দেখেও না দেখার ভান করে চলে যেতে উদ্যত হতেই আমি বললাম, কি ব্যাপার চিনতে পারছনা? কেমন যেন হঠাৎ দেখা হয়েছে, তারই আনন্দের রেশ টেনে বলল, আরে প্রান্তিক। তুমি কি গ্রামের বাড়ীতে গিয়েছিলেন নাকি? বহুদিন কোন খোঁজ টোজ নেই। খোঁজ কি রাখার চেষ্টা করেছে? কেন বলত। না তা হলে জানতে পারতে আমি কোথায় আছি। ও তাই বল। তবে এর মাঝে তোমার পিসির সঙ্গে দেখা হয়েছিল জান? আমার পিসি? কই বলেননি তো। তোমার সঙ্গে দেখা হলেতো বলবে। আমি আসলে তোমার মিনতি পিসির কথা বলছি। মনে মনে বললাম মিনতি সেন। তারপর ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, তোমার কি এখন ক্লাস আছে? না। তাহলে এস না চা খাওয়া যাক। আচ্ছা চল। চা ও টোস্টের অর্ডার দিলাম। তারপর ওকে বললাম, হ্যাঁ অনেকদিন যাওয়া হয় না মিনতি পিসির ওখানে। কেন যাওনি কেন? তোমার কথা অনেক করে বলেছিলেন। তোমার দাদুর অবস্থাও খুব ভাল না। প্রায়ই তোমার নাম করে বলে, প্রান্তিক এসেছে? পিসি যখন বলেন, যে না আসেনি, তখন আবার চুপ করে যান, তুমি একবার যেও প্রান্তিক। তোমার পিসি ও দাদু তোমার কথা খুব ভাবেন। আমি বললাম, হ্যাঁ এবার একদিন যাব। মনে মনে ভাবছিলাম তার আগে একদিন প্রতীম বাবুর সঙ্গে দেখা করতে হবে। ও বলল, কিছু বলছ? না, কিন্তু কণা, তুমি আমাকে জানাওনি কেন? আমিতো জানাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তোমার পিসি এমন করে না করলেন যে, আমি তোমার সঙ্গে দেখা পর্যন্ত করিনি এতদিন, যদি দেখা হলেই বলে ফেলি। তাহলে আজ কেন বললে? কি করে জানব এত দিনেও তোমার যাওয়া হয়নি। চা খেয়ে উঠে পড়লাম। ও বলল, চললে? হ্যাঁ, আমার ক্লাস আছে। ও আমি উঠতেই বলল, রেহানাকে দেখছিনা, ওকি কলেজে আসেনি? আমার সঙ্গে দেখা হয়নি। বলে আর কোন কথার অপেক্ষা করে বেরিয়ে এলাম।
দুর্গাপুরে একটি ফার্মে ম্যানেজারের পোস্টে চাকরি করতেন প্রতীমবাবু। কিন্তু ট্রান্সফার হয়ে এসেছেন লিলুয়াতে। ওখানে গিয়েই জানতে পারলাম। পরের দিন আবার তাই লিলুয়া। বেশ বড় ফার্ম। এখানকার সিনিয়র ম্যানেজার প্রতীম চৌধুরি। বড় বড় অক্ষরে নামের ফলক। আমি একজন স্বাক্ষাৎ প্রার্থী। স্লিপ দিয়ে অপেক্ষা করছি। প্রায় ১৫ মিনিট পরে, অনুমতি এল। আমি ঘরে ঢুকতেই উনি একবার চোখ তুলে তাকালেন আমার দিকে। সুন্দর সৌম্য চেহারা। প্রায় ৬ ফুট লম্বা গৌরবর্ণ ছিপছিপে মানুষটি। কানের কাছে জুলপির ২/১টা চুলে পাক ধরেছে। কিন্তু তা সযত্নে রক্ষা করা হয়েছে। গোফ কামানো। দামী ফ্রেমের চশমার মধ্যে দিয়ে চোখের ঈশারায় বসতে বললেন।
বেল দিতেই এক ভদ্রমহিলা ঢুকলেন। বললেন দু কাপ কফি। আমি অবাক হয়ে ভাবছি উনিকি তবে সব সাক্ষাৎ প্রার্থীকে কফি খাওয়ান? কি জানি? পরিমলবাবুও কলকাতার একটা মার্চেন্ট ফার্মে কাজ করেন। কোন দিনতো যাইনি, তাই জানিনে নিয়ম কানুন। কফি আসতেই, উনি এক পেয়ালা তুলে নিয়ে বললেন, কফিটা নিন, তারপর বলুন আমি আপনার জন্য কি করতে পারি? আমার জন্য? আমার ঘরেতো আর কেউ নেই। হাসলেন উনি, তারপর বললেন, ও আপনি ভাবছেন আপনার জন্য কফি কেন? না, আপনার জন্য আলাদা করে কফির অর্ডার দেওয়া হয়নি। আসলে আপনি আপনার সাক্ষাৎ প্রার্থনায় লিখেছেন, প্রয়োজন ব্যক্তিগত। তাই আপনাকে ইচ্ছে করে দেরি করে ডাকা হয়েছে। আমার সাক্ষাতের নির্দিষ্ট সময় শেষ। অবশ্য এর মাঝে কয়েকবার আপনার নামটায় চোখ বুলিয়ে নিয়েছি, আগে কখনো আপনার নাম শুনেছি কিনা! নিশ্চয়ই শোনেননি। আপনি কি মনে করেন শোনা উচিৎ? হাসতে হাসতে বললাম, কি যে বলেন। না না আমি সে সব কথা বলিনি। কথার পরে কথা বলতে হয় তাই বলা। উনি বললেন, তাহলে বলুন আপনার ব্যক্তিগত প্রয়োজনের কথা। আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, আমার নাম প্রান্তিক। হ্যাঁ, মিপে তাই লিখেছেন। কি করেন আপনি? আমি ওনাকে বাধা দিয়ে বললাম, আপনি একজন কর্মব্যস্ত মানুষ। হয়তো অনেক অমূল্য সময় আমি নষ্ট করে দিচ্ছি। তবু এসে যখন পড়েছি, তখন কি আরেকটু সময় আমায় দিতে পারবেন? যদি বলেন, সম্ভব নয় তাহলে কবে সম্ভব হবে জানালে আমি সেদিন আসতে পারি। কতক্ষণ লাগবে? যদি আপনি কিছুই না বলতে চান তাহলে ১০ মিনিট আর যদি শুনে কিছু বলতে চান তাহলে অন্তত আধঘন্টা। বা আপনিতো বেশ মজার মানুষ। কি করেন? কিছুই করিনা। তবু। আমি এবার ফাঁইনাল ইয়ারের ছাত্র। ও তাহলে তো তুমি বলা যেতে পারে। নিশ্চিন্তে। আর তা হলে আমার পক্ষেও ভাল হয়। কেন ভাল হয় কেন? আসলে আপনি বললে অনেকটা দূরের বলে মনে হয়। তুমি বললে অনেকটা কাছের মনে হয় তাই আরকি। বেশ বল তাহলে।
আমি একটা গলা খাঁকানি দিয়ে বললাম, আপনার বাড়ীতে কে কে আছেন? কেউ। কিন্তু কেন? তাহলে বাড়ীতে গিয়ে বললে ভাল হয়। খুব কি গোপন কথা। মোটেই, কিন্তু অফিসে কথা বলতে বলতে দেখা গেল, আপনার কাজের ফাঁইল এসে গেছে, আমাকে থেমে যেতে হবে। তারপর আবার যখন আরম্ভ করব তখন হয়তো দেখব, যা বলছিলাম তা ভুলে গেছি, উনি একটু হাসলেন শুধু। তারপর বললেন, তুমি নিশ্চিন্তে বলতে পার। আপাতত এখানে কোন ফাঁইল আসবেনা। আমি কি বলব ভাবছি। উনি বললেন কই কিছু বললে না। বললাম, আপনার এখানে কেউ নেই, তার মানে বাড়ীর সব কি দেশের বাড়ীতে? তুমি চেন আমার দেশের বাড়ী? না চিনি না, তবে জানি। তারপর জানতে চাই আচ্ছা আপনার মা বাবা বেঁছে আছেন এখনো? না ওরা কেউ আর নেই এখন। আপনিতো বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান তাইনা? হ্যাঁ, কিন্তু এত কথা তুমি জানলে কি করে? সে তো পরের কথা, আপনি একা থাকেন মানে …। উনি বললেন তুমি জানতে চাইছো আমি বিয়ে করেছি কিনা তাইতো। হ্যাঁ। না করিনি। এরপরে তুমি জানতে চাইবে কেন করিনি। ঠিক তাই। কেন তোমার এসব কথা জেনে কি হবে। আমি বললাম আসলে আমি একটা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের উপর সমীক্ষা চালাচ্ছি। যারা বিভিন্ন প্রাইভেট কনসার্নে এক্সিকিউটিভ আছেন, তাদের ব্যক্তিগত জীবন কাজকে কি ভাবে প্রভাবিত করে। উনি বললেন ভেরি ইনটারেস্টিং। এমন কোন সমীক্ষা হয়েছে বলেতো জানা নেই। তা কতদিন তুমি এটা করছ। তা বেশ কিছু দিন হল। কতজনের কাজের ধারা, তাদের ব্যক্তিগত জীবনের প্রভাব ইত্যাদি সমীক্ষা শেষ করেছে। তা কয়েকজনের হয়েছে। আসলে আমার কাছে আপনার যে ঠিকানা ছিল, তা দুর্গপুরের। আমি সেখানেই গিয়েছিলাম। কিন্তু শুনলাম আপনি আর ওখানে নেই। হ্যাঁ, সেতো অনেক দিন আগের কথা, পরে আমি জার্মানি যাই, এবং সেখান থেকে ফিরে বছর তিনেক হলো আমি এখানে জয়েন করেছি। বললাম খুব ভালকথা, আপনি কি মনে করেন একাকী জীবনে কাজ করা সহজ না সংঘবদ্ধ পারিবারিক জীবন থেকে তা সহজ। দেখ। তোমার এই ব্যাপারটা নিয়ে আমি কখনো ভাবিনি। তাহলে আপনি ভাবুন, আমি বরং পরে একদিন আসব। কোন প্রয়োজন নেই, আমার যা মনে হয় তাই তোমাকে বলতে পারি। তাইতো বলবেন, আমিতো আপনি যা মনে করেন তাই জানতে চাই। কি মনে হয় আপনার?
দেখ আমি একাকী থাকি। তাই সময়ও আমার অফুরন্ত ইচ্ছে করলে অনেক কাজ করতে পারি। তবে করেন না কেন? মাঝে মাঝে একঘেয়েমি মনে হয় তাই। এই একঘেয়েমি থেকে মুক্তি পেতে আপনি কি চান? কি আর চাইব। আমি বললাম পরিবার, সঙ্গ এসবতো জীবনে প্রয়োজন। উনি বললেন মাঝে মাঝে হতাশ মনে হয় নিজেকে। কেন কাজ করব? কার জন্য করবো? তাহলে অবকাশ সময় কাটান কি করে? কাটাবার তো বিভিন্ন উপায় আছে তবে আমার ভালো লাগেনা। কেন? একটা বিস্মৃত অধ্যায় মাঝে মাঝে আমাকে তাড়া করে ফেরে। আমি একটু চুপ করে থেকে বললাম, একটা কথা জিজ্ঞাসা করব? বল। আপনি কি কাউকে ভালবাসতেন? কেন বলতো? ঐ যে আপনি বললেন না একটা বিস্মৃত অধ্যায় তাই আর কি। কি হবে সে সব কথা শুনে। না আমি জোর করবনা। তবে যে সমীক্ষা আমি চালাচ্ছি, তাতে ঐ বিস্মৃত অধ্যায় সম্পর্কে জানতে পারলে আমার ভাল হতো। আমার কাজের সুবিধা হতো। নাম ধাম গোপন করে ঘটনা বলতে কি আপনার আপত্তি আছে। না তা নেই তবে সে সব অতীত অতীতই থাকুক না। ঠিকই বলেছেন, অতীতের তো অতীতেই থাকা উচিৎ বর্তমানে তাকে টেনে এনে যন্ত্রণা বাড়ানো কেন? কিন্তু অতীতকে ভুলে থাকাকি অতই সহজ? না, স্যার তা মোটেই সহজ নয়। এই যেমন ধরুন, প্রানপনে আপনি আপনার অতীতকে ভুলতে চাইছেন, কিন্তু পারছেন কি? যদি পারতেন তাহলে তো আপনাকে এই নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতে হতো না। তারপর বললাম আপনার কাছে তা অতীত নয় বলেই তো এখনো অপেক্ষায় আছেন আপনি তাইনা? চমকে উঠলেন প্রতীম চৌধুরী। তিনি কি সামান্য সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখছেন আমাকে?
একটা দীর্ঘশ্বাস টেনে নিলেন প্রতীম চৌধুরী। তাকালেন আমার দিকে। তারপর বলেলেন ভাবছি কি হবে তোমাকে সে সব কথা বলে? না আমাকে বলে হয়তো আপনার প্রতীক্ষার অবসান হবে না, তবু আমার এই ছোট্ট জীবন দিয়ে বুঝেছি নিজের দুঃখের বোঝ কাউকে না কাউকে ভাগ করে দিতে হয় এবং তা বললে মনটা হয়তো একটু হাল্কা হতে পারে। উনি বললেন বেশ আমি বলছি, কিন্তু তোমাকে কথা দিতে হবে প্রান্তিক, একথা আর কেউ জানবেনা। তোমার গবেষণা পত্রেও এ ঘটনার কোন ছায়াপাত ঘটাবে না তুমি। কথা দিলাম। উনি ধীরে ধীরে বললেন, না জীবনে কোন মেয়েকে কোনদিন ভালবাসিনি। আসলে ক্যারিয়ার এবং পড়াশোনার বাইরে যে একটা জগৎ আছে তাই আমার জানা ছিল না। তারপর একদিন একটি মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ের কথা হয়। পছন্দও হয়। মনে মনে স্বপ্নও দেখি ওকে নিয়ে। একটু থামলেন প্রতীম চৌধুরী। বললেন কফি খাবে? যদি আপনি খান তাহলে আপত্তি নেই। বেয়ারা এলে উনি কফির অর্ডার দিলেন এবং বললেন, আধ ঘন্টা পরে দুই প্লেট লাঞ্চ। উনি তারপর বলে চললেন, পাকা দেখার দিন, কি হয়েছিল জানিনা, সব কিছু ঠিক ঠাক হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও এ বিয়ে হল না। মেয়েটির মা আত্মহত্যা করলেন। ওর বাবাকে পুলিশ এ্যারেষ্ট করলেন। জেল হল তার পরে একদিন জেল থেকে ফিরেও এলেন, চরম ট্রাজেডির মুখোমুখি দাঁড়িয়েও আমরা কিন্তু রাজী হয়েছিলাম। কিন্তু মেয়েটি রাজী হলেন না। স্বপ্ন ভেঙে গেল প্রান্তিক। তবু আজো আমি সেই স্বপ্নই দেখি। বললাম মেয়েটির সঙ্গে আপনার আর দেখা হয়নি কোন দিন? না। কেন দেখা করেননি কেন? ভয়ে। কিসের ভয়? যদি মুখের পরে দরজা বন্ধ করে দেয়। আমি বললাম চিঠি লিখেও তো জানতে চাইতে পারতেন তার মনের কথা! তুমি ঠিকই বলেছো। আমি আমার মনের কথা তাকে জানিয়েছিলাম। কিন্তু ভালোবাসার চিঠিতে কোন দিন লিখিনি হয়তো তা লেখার জন্য আলাদা মুন্সিয়ানার দরকার। যা হৃদয়কে ছুঁয়ে যেতে পারে। আমার চিঠিটা ছিল খুবই সোজাসুজি। জানিয়েছিলাম, আমি অপেক্ষা করতে রাজী। মৃদু হেসে বললাম, তিনি কি উত্তরে কিছু বলে ছিলেন? না প্রান্তিক। তাই এখন যদি জানতে চাও তার ঠিকানা আমি জানি কীনা। কিন্তু জানলেও সে ঠিকানা তো আমি তোমায় দিতে পারব না প্রান্তিক।
অনেকক্ষণ চুপচাপ। এর মাঝে কফি এল। নীরবে দুজনেই কফি খেলাম। তারপর আমি বললাম। আজো কি আপনি তার অপেক্ষায় আছেন। ঠিক জানিনা। তবে নতুন কাউকে জীবনের সঙ্গে মেনে নিতে পারিনি। সেতো দেখতে পারছ। আমি বললাম, আপনার এই নীরব পূজার মানে কি? এতো অর্থহীন। আর সত্যি সত্যিই যদি মন থেকে তাকে চান, খুঁজে বের করুন তাকে। দাঁড়ান তার মুখোমুখি, বলুন আপনার কথা নিজের অধিকারকে দাবী করুন তার কাছে। ভয় হয় প্রান্তিক ভীষণ ভয় হয়, যদি আবার ফিরিয়ে দেয়। দিলেনই বা। পৃথিবীর সব দাবী কি কারো মেটে? তাই বলে দাবী করার অধিকার যার আছে, সে কি দাবী করতে ভুলে যাবে? কি করে বুঝবো আমার দাবীর অধিকার আছে? এক নিঃসঙ্গ বিষণ্ণতা ধরা পড়ে তার কণ্ঠে।
আমি আস্তে আস্তে বললাম, তা অবশ্য ঠিক, কিন্তু তবু আপনাকে অনুরোধ করব, আপনি তার কাছে যান, বুঝুন তাকে। হয়তো এমনও হতে পারে, আপনারই অপেক্ষায় আজো বসে আছেন তিনি পথ চেয়ে। এরপর জোর দিয়ে বললাম কেন দুটো জীবন এমন ভাবে ব্যর্থ হয়ে যাবে? কোথায় খুঁজবো তাকে? কেন যেখানে তারা থাকতেন, সে ঠিকানাতো আপনার জানা। সেখানে কি তারা নেই? জানি না প্রান্তিক কিছুই জানিনা আমি, আমার ভয় হয় কি জান? কি? তুমি ওয়ার্ডসওয়ার্থের সেই বিখ্যাত কবিতা পড়েছো? কোন কবিতা। ঐ যে ইয়াররা আনভিসিঢেউ এবং ইয়াররা ভিসিঢেউ। এখনো সে বেঁচে আছে আমার স্বপ্নে। কিন্তু গিয়ে যদি সে স্বপ্ন মায়ামরীচিৎকার মতো মিলিয়ে যায়। বললাম হয়তো বাস্তবের মুখো মুখি দাঁড়িয়ে একথা মনে হতে পারে আপনার। তাতে কি? স্বপ্ন আর বাস্তব যে এক নয় এটাও তো আপনার জানা দরকার। তারপর বললাম বলবেন কি তার ঠিকানা যদি কোন উপকারে আসে। না থাক প্রান্তিক। আমার সত্য আমার কাছেই থাক। তাকে গবেষণাগারে ফেলে লাভ নেই। তবে যদি কোন দিন চলতি পথে তার সাথে দেখা হয় নিশ্চয়ই জিজ্ঞাসা করবো, আমার সেদিনের চিঠির উত্তর তিনি দিলেন না কেন? আর যদি এমন হয় আপনার চিঠির উত্তর তিনি দেননি ঠিকই, কিন্তু তিনিও তার জীবন বয়ে নিয়ে চলেছেন একাকিনী নিঃসঙ্গ তপস্বিনীর মতো আপনারই প্রতীক্ষায়। দিন গুনে গুনে, কি করবেন আপনি? আবেগে। আপ্লুত কণ্ঠ। বললেন জানিনা কি করব। সত্যি আমি জানিনা আমার কী করা উচিৎ।
আমার জানার যা তা জানা হয়ে গেছে। এবার আমাকে উঠতে হবে। অথচ উনি লাঞ্চের অর্ডার দিয়েছেন, তাই বসতে হয়। বললাম, জীবনে যদি এমন শুভ মুহূর্ত কোন দিন আসে। আমাকে জানাবেন তো? উনি বললেন তোমার ঠিকানাটা দাও। আমি ঠিকানাটা লিখে তার দিকে এগিয়ে দিলাম। লাঞ্চ এলো। খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
রেহানার চিঠিটা পড়েছি বেশ কয়েকবার। কি যে ও বলতে চায়, বার বার পড়েও উদ্ধার করতে পারিনি। কেন যে এত চাপা আর এত অস্পষ্টতা নিয়ে ও এগিয়ে চলেছে কে জানে। একবার বলেছে তোমাকে ছাড়া আর কাকে বলব? আবার বলছে আমায় ক্ষমা করো তোমাকে এসব কথা বলছি বলে। চিঠিটা আরেকবার পড়ি আমি। লিখেছে রেহানা।
প্রান্তিক।
আমি জীবনে কাউকে কোনদিন কোন চিঠি লিখিনি। লেখার প্রয়োজনও হয়নি। আজ তোমাকে লিখছি, মুখে সব কথা বলতে পারবনা বলে। তোমার ঈশ্বর আর আমার আল্লাহ কেউ বোধ হয় চায়নি, আমরা এক সাথে পথ চলি। মানুষ যে কেন, এমন করে প্রতিরোধ খাড়া করে বুঝতে পারিনা। তোমাকে বোধ হয় ডালিমের কথা বলিনি কোনদিন। ওকে একদিন ভাল লেগেছিল। আস্তে আস্তে বোধ হয় ভালও বেসে ছিলাম, কিন্তু কি যে হলো জানিনা, ও সেলিনাকে যে ভাষায় চিঠি লিখলো ঘৃণায় তা উচ্চারণও করা যায় না। ভুলে গিয়েছিলাম সব। ডালিম নামের কোন ছেলে যে এই পৃথিবীতে বাস করে তাও মনে হয়নি পরে কোনদিন।
এর মাঝে পরিচয় হলো তোমার সাথে। আস্তে আস্তে কেমন যেন দুর্বল হয়ে যেতে লাগলাম, সেলিনা আমার থেকে ২ বছরের ছোট। কিন্তু ও আমার সব থেকে কাছের বন্ধু। আমার দুর্বলতাকে আরো দুর্বল করে দিয়ে আমাকে পৌঁছিয়ে দিতে চাইল তোমার কাছে। জানিনে কতটুকু পৌঁছাতে পেরেছিলাম। কিন্তু চেষ্টার ত্রুটি করিনি প্রান্তিক। তোমার আর ডালিমের মধ্যে আছে এক দুস্তর ব্যবধান। তুমি তোমাকে বুঝতে দাওনা, আর ডালিম, সে তার অধিকার জোর করে ছিনিয়ে নিতে চায়, আর তার জন্য কোন নিষ্ঠুরতাই যেন তার কাছ কোন বাধা নয়।
নিজেকে প্রস্তুত করেছিলাম যাব তোমার সাথে, জানি অনেক বাধা আছে, তবু আমি চেয়েছিলাম তোমার সঙ্গে একাকী কাটিয়ে দেব কয়েকটি দিন। আগের দিন রাতেই বলছিল সেলিনা যে সে যাবে না। ওকে অনেক করে বলেছিলাম, কিন্তু ওর ওই এক কথা, না রেহানা তোরা যা। আমি এ কয়দিন খিদিরপুর মাসির ওখানে গিয়ে থাকবো। মাও যাবেন আমার সাথে ঠিক হয়েছিল। কিন্তু পরদিন সব গোলমাল হয়ে গেল।
ডালিম এলো আরো কয়েকটি ছেলেকে নিয়ে। ওতো আসেনা বহুদিন। সেলিনা প্রথমে ওদের ঢুকতে দিতে চায়নি, কিন্তু মা বললেন আসতে দে ওদের। শোন ওরা কি বলতে চায়। সেলিনা ওদের বসবার ঘরে বসতে বললে মা বললেন না ওদের ভিতরের ঘরে নিয়ে আয়। ওরা ভিতরের ঘরে গেলে আমিও গেলাম ও ঘরে। আমার চোখের পরে চোখ রেখেডালিম বলল, তোমরা নাকি একটা কাফের ছেলের সাথে তাদের গ্রামে যেতে চাইছে। সেলিনা বললো, এ ভাবে কথা বলছেন কেন? কাফের বলে আমাদের কাছে কিছু নেই। হ্যাঁ, ওর সাথেই ওদের গ্রামের বাড়ীতে যাব আমরা। না যেতে পারবেনা এটা আমার আদেশ। আদেশ? আপনার বোধ হয় সেদিনের কথা মনে নেই সেলিনা বলল। ডালিম তার উত্তরে বলে আছে। আর আছে বলেই আমরা সেই ভাবে প্রস্তুত হয়ে এসেছি। কি বলতে চান আপনি? ডালিম বলল, আমি মৌলবীকে বলে এসেছি, আজই রেহানার সাথে আমার বিয়ে হবে?
বিশ্বাস কর প্রান্তিক, আমি মাটির সাথে মিশে যেতে লাগলাম। বলে কি এবা? এটা কি মধ্যযুগ নাকি? আধুনিকতার শিক্ষা কি এরা পায়নি? বললাম, এ তুমি কি বলছ ডালিম। তুমিতো শিক্ষিত ছেলে। প্রেসিডেন্সিতে পড়াশোনা করেছো। জোর করে কাউকে বিয়ে করা যায় নাকি? ওদের মধ্যে একজন ছিলেন নুরুজ্জমান, সেও ভালো ছেলে, বলল এক হিন্দু কাফের তোমাকে শয্যাসঙ্গিনী করবে সেটা বুঝি ভাল হবে? আজকেই তোমাদের দুই বোনের সঙ্গে আমাদের বিয়ে হবে। সেলিনা বলল, আবদার নাকি?
এই সময় বেল দিলে তুমি। কয়েকবারই দিলে। সেলিনার ঐ অবস্থায় তোমাকে ফিরিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। আমি জানালা দিয়ে বিমর্ষ ভাবে তোমার ফিরে যাওয়া দেখলাম। কিন্তু তোমাকে ডাকতে পারলাম না। পারলাম না আমাদের চরম লজ্জার মধ্যে তোমাকে নিয়ে আসতে।
এতক্ষণে মা বলল, তোমরা কি বলতে চাইছো ডালিম। তোমাদের কারো সঙ্গে আমি আমার কোন মেয়েরই বিয়ে দেবোনা। তোমরা বেরিয়ে যাও। সেলিনা বলল ডালিম ভাই, ভাল ভাবেই বলছি আপনারা বেরিয়ে যান, তা না হলে কিন্তু অপমানিত হতে হবে। ডালিম উদ্যত হয়ে বলল অপমানিত হতে হবে? একজন কাফেরের রক্ত কি আমার রক্তের থেকে দামী। তাহলে আজই সেই রক্তের দাম আমাকে মিটাতেই হবে? বলতে বলতে এগিয়ে গিয়ে সেলিনাকে টেনে নিল ওর বুকের মধ্যে তারপর বীভৎস ভাবে জোর করে তার কোমাৰ্য্য লুষ্ঠিত করতে চাইলে দরজার ডাঁসা দিয়ে ডালিমের মাথায় আঘাত হানেন মা। আমি ভয়ে লুটিয়ে পড়ি মেঝেতে। তবু ওর মধ্যে থেকে দেখি, ডালিম পড়ে গিয়েও মায়ের হাত থেকে কেড়ে নেয় সেই ডাশা, এবং তাই দিয়ে আঘাত হানে মায়ের ডান হাতে, মা পড়ে যান। কিন্তু তাতেও লম্পটটা ছাড়ে না, ঐ উঁশা দিয়ে মায়ের পায়ে আঘাত করলে, সেলিনা কোন ভাবে নিজেকে ছাড়িয়ে রান্না ঘরে গিয়ে বড় আঁস বটিটা নিয়ে এসে আক্রমণ করে ওদের। নুরুজ্জমান সহ তিনজন পালিয়ে যায়। কিন্তু ডালিম শেষ বারের মত চেষ্টা করে আমাকে তুলে নিয়ে যেতে। কোন ভাবে সেলিনার বটির একটা কোপ বাঁচিয়ে, নিজের পকেট থেকে পিস্তল বের করে গুলি করে সে সেলিনার মাথা লক্ষ করে। গুলিটা কানের পাশ দিয়ে মাথার একটা অংশ ক্ষত করে বেরিয়ে যায়। সেই অবস্থাতেই আমি শরীরের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে ওর কাছ থেকে নিজেকে ছিনিয়ে নিয়ে সেন্নিকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরি। ডালিম ততক্ষণে আবার গুলি করে, কিন্তু তা সেলিনার পায়ে লাগে, এবার আমি ভয়ংকর মুর্তিতে সেই আঁস বটি নিয়ে এগিয়ে যাই ডালিমের দিকে। সম্ভবত ওর পিস্তলে আর গুলি ছিল নাওকোন ভাবে পালিয়ে যায়। আমি তখন ভয়ংকরী।
আমার শাড়ী কোথায় জানিনা, ব্লাউজ ছিন্ন বিচ্ছিন্ন। ডালিমের নিষ্ঠুরতায় ঠোঁট দিয়ে রক্ত ঝরছে, মা জ্ঞানহীন। আর সেলিনা নারীর শেষ কৌমাৰ্যটুকু যদিও রক্ষা করেছে, কিন্তু হায়েনার দাঁতের আঘাতে সমস্ত দেহ ক্ষতবিক্ষত। সে কি দুর্বিসহ অবস্থা। তোমাকে বলে বোঝাবার নয়।
কি করব আমি, শরীরে এক বিন্দু শক্তি নেই। অথচ ডাক্তার ডাকতে হবে। মনে মনে চাইছিলাম আর প্রার্থনা করছিলাম হে করুণাময় আল্লাহ প্রান্তিককে এই সময় একবার আমার কাছে পাঠিয়ে দাও। আমার এই আকুল আহ্বান বধির আল্লাহর কানে পৌঁছালনা। কোন ভাবে শাড়িটা খুঁজে পেয়ে তা দেহের সঙ্গে পেঁচিয়ে নিয়ে আমাদের মোড়ে যে ডাঃ সরকার আছেন, তার কাছে গিয়ে কেঁদে পড়লাম। তিনি বললেন কি হয়েছে মা। সব সংক্ষেপে খুলে বললাম তাকে। তিনি এলেন দেখলেন, তারপর সেলিনাকে হাসপাতলে পাঠাবার ব্যবস্থা করে মাকে বাড়ীতেই যা করার করলেন। পুলিশে সংবাদ দিলেন ঐ ৪ জনকেই এ্যরেষ্ট করা হল। তারপর কি হয়েছে জানিনা।
আজ ভয় হয় প্রান্তিক, কি হবে সেলিনার ও মায়ের। আমার কথা ভাবিনা। নিজের মৃত্যুর পরওয়ানা নিজেই লিখে দিয়ে যাব একদিন। কিন্তু ওরা? ওদের কি হবে?
জানি, একদিন আমার কাছে জানতে চাইবে সব। পারবনা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এসব কথা বলতে। তাই তো আগে থেকে লিখে জানিয়ে দিলাম সব। আমার আর কিছুই বলার নেই প্রান্তিক। তোমার জীবনে আমার দুঃখের বোঝা নামিয়ে দিতে চাইনে। যদি কোন মুহূর্তে কোন দুর্বলতা তোমাকে স্পর্শ করে থাকে তার জন্য আমায় ক্ষমা করো। ভেবেছিলাম কোন কথাই বলব না তোমাকে কিন্তু কেন যে জানালাম তার উত্তর জানিনা। তুমিও জানতে চেয়োনা–রেহানা।
সেলিনাদের গোটা পরিবারের ঘটনায় এমন যে কিছু একটা থাকতে পারে অনুমান করেছিলাম। কিন্তু ডালিম যে সেই ঘৃণ্য ঘটনার নেতৃত্ব দিয়েছে ভাবতে পারিনি। সেলিনার কাছে ডালিমের কথা শুনেছি, মানে সেলিনা যতটুকু বলেছে, তাতে ডালিমের ঐ ব্যাপারটি যৌবনের এক হঠাৎ খেয়াল বলে মনে হয়েছিল। তাকে অত হিংস্র বলে কখনো মনে হয়নি। প্রেসিডেন্সির শিক্ষিত ছেলে কেন এত হিংস্র হবে। আর মধ্যযুগীয় বর্বরতা? এতো অসহনীয়। কিন্তু তাই বলে ঘটনার গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না। একদিনতো ফিরে আসবে ডালিমরা, সেদিন যে আবার প্রতিশোধের নেশায় মেতে উঠবে না কে বলতে পারে। কিন্তু আমিই বা কি করতে পারি। কতটুকু ক্ষমতা আমার। আমি আমার জীবন দিয়ে এদের পাশে দাঁড়াতে পারি, আমার ক্ষুদ্র সামর্থ দিয়ে এদের সাহয্য করতে পারি, তার বেশি ক্ষমতা কোথায়? আর ডালিমদের মোটেই ছোট করে দেখা উচিৎ নয়। ওরা ভয়ংকর বিষধর সাপ। ছোবল মারার প্রতিক্ষায় থাকবেই। কি করব। কি করা উচিৎ কোনটাই বুঝতে পারছি না। রেহানাদের সংবাদও জানিনা ২/৩ দিন। কোন দিনই আমি আইন-আদালতের পাতা দেখিনা। কিন্তু আজ নিজের অজান্তেই চলে আসি এই পাতায়। হঠাৎ দেখি আগামী সোমবার একটি বিশেষ কেসের শুনানী হবে। আসামি ডালিম নুরুজ্জমান সহ চারজনকে সেদিন কোর্ট প্রাঙ্গণে আনবার জন্য পুলিশকে মহামান্য বিচারক আদেশ জারী করেছেন, চোখটা আটকে গেল ওখানে। কয়েকবারই পড়লাম লাইনগুলো। না কোথাও রেহানা, সেলিনা বা আফরোজ বেগমের কথা নেই।
চিন্তায় আছি ভীষণ। রেহানাদের যা অপমান ওদের হাতে হতে হয়েছে, ওতেই যেন শেষ হয় সব আর যেন কোন অপমান আদালত প্রাঙ্গণে না হয়। কারণ যদি ওদের সাক্ষী হিসেবে এই আদালতে আনতে হয়, তা হলে উকিলের উল্টো পাল্টা প্রশ্নে বেআব্রু হওয়া ছাড়া কোন উপায় থাকবে না।
কলেজ থেকে সোজা বাড়ী না ফিরে শিয়ালদা স্টেশান এবং সেখান থেকে ট্রেনে ঢাকুরিয়া, কে আমাকে নিয়ে এল আমি জানিনে। আমার এখানে আসার কোন পূর্বপরিকল্পনা ছিল না অথচ এলাম। কতদিন পরে। ঘড়িতে দেখলাম প্রায় ৪/৩০, তার মানে মিনতি সেনের ফিরে আসার সময় হয়েছে, আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলাম বাড়ীর দিকে।
বেল দিতেই এক ভদ্রমহিলা দরজা খুলে দিলেন। কাকে চাই? আমি বললাম, পিসি, মানে মিনতি সেন আছেন? আপনি ভিতরে আসুন। ভিতরে গিয়ে দেখি, মিনতি সেনের বাবার অবস্থা বেশ খারাপ। মিনতি সেন তাই কয়েকদিন অফিস থেকে ছুটি নিয়েছেন। আমাকে দেখে বললেন, প্রান্তিক তুমি এসেছো? তোমার কথাই ভাবছিলাম। কয়েকদিন ধরে বাবা শুধু তোমার নাম করছে। তুমি একটু বোস বাবার পাশে। আমি বসলাম তারপর আস্তে ডাকলাম দাদু। বৃদ্ধ চোখ মেলে তাকালেন। দৃষ্টি ঘোলাটে। তবু আমাকে চিনতে পারলেন, আমার একটা হাত তার দুর্বল হাতের মধ্যে তুলে নিয়ে বললেন, এতদিন আসনি কেন দাদু। আমি আর কি বলব, উনি আমার হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে আবার চোখ বন্ধ করলেন। মিনতি সেন মিনিট দশেকের মধ্যে ফিরে এলেন। বললেন, কলেজ থেকে আসছ? হ্যাঁ। তারপর যে ভদ্রমহিলা আমাকে দরজা খুলে দিয়েছিলেন তাকে বললেন, জবার মা, তুমি প্রান্তিক কে কিছু খেতে দাও। আমি বললাম দরকার নেই পিসি। উনি বললেন, দরকার তোমার নেই, কিন্তু আমার আছে। তুমি তাড়াতাড়ি খেয়ে এসো তোমাকে একটা কাজ করতে হবে। আমি আর অন্যথা না করে তাড়াতাড়ি খেয়ে এলাম। উনি বললেন স্টেশান পেরিয়ে গেলে দেখবে ডাঃ অমল মজুমদারের চেম্বার। তোমাকে একবার তাকে নিয়ে আসতে হবে। যাবে আর আসবে। একদম দেরি করবে না।
০৬. বেরিয়ে পড়লাম
আমি আর কোন কথা না বলে বেরিয়ে পড়লাম। চেম্বারে তখন রোগী ভর্তি, এদের সবাইকে এড়িয়ে ডাক্তারবাবুর কাছে যাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু আমাকে যে যেতেই হবে তার কাছে। তাই একজন রোগী ভিতর থেকে বেরোতে জোর করে ঢুকে পড়ি ভিতরে ডাঃ বাবু খুব রেগে গেলেন কি ব্যাপার এ ভাবে না বলে ভিতরে ঢুকে পড়ছো যে। আমার উপায় নেই, আপনাকে একবার আমার সঙ্গে যেতেই হবে। কোথায়? এই কাছেই। অসম্ভব। আমি কাকুতি মিনতি করে বললাম, অসম্ভব হলে চলবেনা ডাঃ বাবু আমার দাদুর অবস্থা খুব খারাপ। সেতো বুঝলাম, কিন্তু চেম্বারের এত রোগী এদের ফেলে যাই কি করে? আমি বুঝতে পারছি আপনার অবস্থা। কিন্তু ডাক্তার বাবু এদের অবস্থা তো খুব খারাপ নয়, ১০ মিনিট অপেক্ষা করতে পারবে। কিন্তু আমার দাদু যে সে সময়টুকও পাবেন কীনা জানিনা। কে তোমার দাদু? আমি বললাম, আপনি নিশ্চয়ই মিনতি সেনকে চেনেন? ওনার বাবা। আমার কথা শুনে যে ভাবে ডাঃ বাবু উঠে পড়লেন, তাতে বুঝতে পারছি রোগী বা মিনতি সেনদের ডাঃ বাবু ভালভাবেই চেনেন। বললেন চল, আমি একটা রিক্সা ডাকতে চাইলে উনি বললেন, তুমি আমার গাড়ীতে এসো। ডাঃ বাবু এলেন। রোগী দেখলেন। মিনতি সেন বললেন কাকাবাবু কি হবে? উনি বললেন, ভয় নেই মা। আমি একটা ইনজেকসান দিচ্ছি ঘুমাবে। তবে তোমরা কেউ না কেউ কাছে থাকবে। জাগলে যেন কাউকে না কাউকে দেখতে পায়। মিনতি সেন বললেন, কোন হাসপাতাল বা নাসিংহোমে ভর্তি করার প্রয়োজন আছে? কোন প্রয়োজন নেই মা। তুমি সর্বক্ষণের জন্য একজন কাজের লোক রাখ। যিনি প্রয়োজনে সব সময় ওনার কাছে থাকতে পারে। আপনার কথা মতো রেখেছিতো কাকাবাবু। রেখেছো? খুব ভাল করেছো। আচ্ছা বলত মা, উনি কি চান? মানে? কাউকে দেখতে চান কিনা, হা কাকাবাবু, প্রায়ই প্রান্তিকের নাম বলে। ও কেন আসেনা? লাস্ট কবে এসেছিল? কে সে? আমার ভাইপো। সেকি এসেছে? আমি এগিয়ে এসে বললাম আমার নাম প্রান্তিক? ও তুমি। ভেরি গুড ইয়ংম্যান। তুমি এখানে থাক কোথায়? নর্থ ক্যালকাটায়? তা তুমি মাঝে মাঝে আসতে পারতো? তারপর বললেন মাঝে মাঝে আসবে বুঝেছ? মিনতি সেনকে বললেন উঠি মা। চেম্বারভর্তি রোগী। উনি উঠে পড়লেন। যাওয়ার সময় আমায় ইশারায় ডাকলেন। আমি গাড়ীর কাছে গিয়ে দাঁড়ালে উনি গাড়ীতে উঠতে উঠতে বললেন, এমনিতে ভাল আছেন, ভাল হয়ে যাবেন, তুমি কিন্তু মাঝে মাঝে এস, আচ্ছা চলি।
কি জানি একথা বলবার জন্য আমাকে ডাকবার দরকার হল কেন? আমি আবার ফিরে এলাম। মিনতি সেন বললেন, বাবা ঘুমাচ্ছেন, তারপর জবার মাকে ডেকে বললেন, জবার মা তুমি এখানে থেকে। বাবা উঠে পড়লে আমাদের ডেকো। আমরা উপরের ঘরে আছি।
আমি বললাম, আমাকে সংবাদ দেননি কেন? কি ভাবে সংবাদ দেবো? কেন পরিমল বাবুকে দিয়ে। পরিমলবাবু? কি বলছ তুমি প্রান্তিক। পরিমলবাবু কোথায় কাজ করেন তাও কি তোমরা জানো? কাকাবাবুকে যে বললে তোমরা নর্থ ক্যালকাটায় আছ, তাহলে কি তোমরা যাওনি পরিমলবাবুর সঙ্গে? আমি অবাক আর অবাক হচ্ছি। উনি আমার অস্বস্তি না বাড়িয়ে বললেন, হয়তো তোমাকে জানাবার দরকার মনে করেন নি। তারপর বললেন আমাদের কোম্পানীর একটা নতুন অফিস খুলেছে রানাঘাট, সেখানে তিনি চলে গেছেন। তার সঙ্গেতো আমার দেখা হয় না। তবে কোম্পানী তাকে কোয়াটার দিয়েছে। উনিতো বলেছিলেন, ওখানেই উঠবেন। হয়তো এখনো যাওয়া হয়ে ওঠেনি। যাকগে সে কথা, কেমন আছো তুমি? ভালো খুব ভালো। আমি আর কি বলব, একটু হাসলাম শুধু। একটা কথা জিজ্ঞাসার জন্য আমার মন উশখুশ করছে। উনি বললেন, মনে হচ্ছে কি যেন বলবে? আমি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম আচ্ছা পিসি আপনি এর মাঝে বলেছিলেন না কলকাতায় কে একজন বড় পুলিশ অফিসার আপনার কাকা। হা তো, কলকাতার পুলিশ কমিশনার আমার কাকা। আপন কাকা? না আপন নয়। তবে তোমার প্রয়োজন কি? কিছু বলতে হবে? আমি উচ্ছ্বসিত হয়ে বললাম, আপনি কিছু বললে তিনি শুনবেন? মিনতি সেন কি যেন ভাবলেন কিছুক্ষণ। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো। মিনতি সেন বললেন, সম্ভবত পুলিশ কমিশনার। এই সময় উনি প্রায়ই ফোন করে বাবার খোঁজ নেন। তুমি বোস। মিনতি। সেন ফোন ছেড়ে এসে বললেন, তোমার কথা বলেছি। আমার একটা চিঠি নিয়ে যাবে। তোমার প্রয়োজনের কথা বলবে। আশা করি তোমার কোন অসুবিধা হবে না।
মিনতি সেন কয়েক লাইনের একটা ছোট্ট চিঠি লিখে দিলেন আমাকে, বললেন কবে যাবে? কাল ঠিক আছে। কিন্তু কি ব্যাপারে আমাকে বলা যায় না? যায়, তবে ওনার সঙ্গে কথা বলে আসি। এরপর উনি হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলেন। আচ্ছা অশ্রুকণার সঙ্গে আরেকটি মেয়ে, কি যেন নাম বলে কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, ও মনে পড়েছে, রেহানা। ভারি মিষ্টি মেয়েটি, ওর সঙ্গে তোমার আর দেখা হয় না? হ্যাঁ, হয়তো, কিন্তু কেন বলুনতো? না কি একটা বিশ্রী ঘটনা নিয়ে ওদের নাম দেখছিলাম কাগজে। আমি ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে বললাম, কি লিখেছে কাগজে? কবেকার কাগজে? আমার চোখে মুখে উৎকন্টা। উনি বললেন, তুমি অমন করছ কেন? তুমি কি জান ওদের ব্যাপারটি। আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম। উনি বললেন, কি হয়েছিল আমাকে বলা যাবে? আমি এক গ্লাস জল চাইলাম। পিসি ফ্রীজ থেকে জল বের করে দিলেন। জল খাওয়া হলে বললেন কফি খাবে? হলে ভাল হয়। মিনতি সেন এরপর জবার মাকে ডেকে ২ কাপ কফি পাঠাতে বললেন। তারপর বললেন, এবার বল প্রান্তিক ওদের নিয়ে আসল ব্যাপারটি কি? আমি যা যা জানি কোন কিছু এক বর্ণ বাদ না দিয়ে এমনকি রেহানার চিঠিটা পর্যন্ত, সব কিছু ওনাকে খুলে বললাম, উনি সব শুনে একটিও কথা বললেন না। উঠে গেলেন আমার পাশ থেকে। কাকে যেন ফোন করলেন, কার সঙ্গে কথা হচ্ছে বুঝতে পারছি না। শুধু শুনতে পেলাম। উনি বলছেন ভট্টাচার্য সাহেবকে বলবেন। আমি মিনতি সেন ফোন করছি। আগামী সোমবার শিয়ালদা কোর্টে কে আছে। এ কেসের দায়ীত্ব তাকেই নিতে হবে। ওপাশের উত্তরে আবার বললেন ঠিক আছে ওনাকে দাও। মিনতি সেন বলে চলেছেন। আমি মিনতি বলছি। অসম্ভব বললে হবে না। এটা আমার মান মর্যাদার প্রশ্ন। কি চাই? আমি চাই ওরা যেন আর কোনদিনই জেল থেকে বেরোতে না পারে। না ওটা হবে না। কি ভাবে হবে সেটা আপনি জানেন। সম্পূর্ন নিজের ভাবে এ কেসের দায়ীত্ব আপনাকেই নিতে হবে। ও অধিকার? সেতো আপনি বলছেন। হ্যাঁ সোমবার বিকাল। আপনি খাবেন? আপনার তো খাওয়ার কোন ক্ষমতাই নেই। ও বেশ মিষ্টি খাওয়াবো। আপনিতো আচ্ছা পেটুক আছেন? আচ্ছা তাই হবে। না ওরা আদালতে যাবে না। ও বাড়ী হা হা আমিই নিয়ে যাবো কথা দিচ্ছি।
সবটা বুঝতে পারলাম না। মিনতি সেন কার ব্যাপার নিয়ে কথা বলছেন। ফিরে এসে বললেন, রাত তো অনেক হয়েছে তোমাকে তো বাড়ী ফিরতে হবে তাইনা? হ্যাঁ, পিসি খুব ভাববেন। আচ্ছা প্রান্তিক বলল তো তুমি কি রেহানাকে ভালেবাস? আমি চুপ করে আছি দেখে বললেন, তোমার পিসি জানে? আমার মুখে কোন উত্তর নেই। উনি তারপরও বললেন তোমার মা-বাবা মেনে নেবেন? আরো এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বললেন, অশ্রুকণা কি আন্দাজ করেছে রেহানাই তোমার ভালবাসার পাত্রী?
কি বলব আমি, মিনতি সেন একের পর এক বলে যাচ্ছেন, যেন রেহানাই আমার ধ্যান জ্ঞান। উনি আবারও বললেন, ওর মা তোমাকে ভালবাসেন ঠিকই কিন্তু রেহানাকে বিয়ে করতে চাইলে তিনি কি রাজী হবেন? না আর নয়। এবার পিসিকে থামাতেই হবে। বললাম, পিসি এসব আপনি কি বলছেন, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। নীলাঞ্জনা পিসি জানেন, আমি মাঝে মাঝে ওদের বাড়ীতে যাই। ওদের ওই বিপদে পিসি ও আমি সাধ্যমত সাহায্য করেছি মাত্র। আর অশ্রুকণা? ও এবং রেহানা উভয়ে আমার সহপাঠী। এখানে কোন আন্দাজের প্রশ্ন নেই পিসি। আর তুমি? ভেবে দেখিনি। প্রান্তিক, হঠাৎ কি একটা প্রশ্ন চট করে মনে পড়েছে এমনি ভাবে বললেন, চাকরি করবে প্রান্তিক? চাকরি হ্যাঁ চাকরি। কে দেবে আমাকে চাকরি। আমিই দেব করবে কী না বল?
একের পর এক ঘটনা এমন ভাবে ঘটে যাচ্ছে মনে হচ্ছে যেন মিনতি সেন কোন রক্ত মাংসের মানুষ নন, তিনি যেন আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ। যা মন চাইবে তাই পাবেন। ডাঃ তার নাম শুনে চেম্বার ফেলে উঠে আসেন। পুলিশ কমিশনার তার কথা ফেলতে পারবেন না, উকিল সাহবেকে তো রীতিমত অর্ডার করছেন। কেসের রায় যেন তার মনের মত হয়। আর এখন, আমাকে বলছেন, চাকরী করব কী না। উনি চাকরী দেবেন। অথচ নিজের জীবনে বয়ে নিয়ে চলেছেন এক চরম নিঃসঙ্গতা। মনে মনে ভাবছি নিজের জীবনের অঙ্ক যিনি মেলাতে পারছেন না, তিনি মেলাবেন অন্যের জীবনের অঙ্ক? বললেন, কি ভাবছ? কিছু নয়।
হঠাৎ জবার মা ডেকে পাঠালেন পিসিকে। পিসির সঙ্গে আমিও নীচে নামলাম। রাতের রান্না করতে হবে জবার মাকে তাই ডেকে পাঠানো। দাদুর ঘুম তখনো ভাঙেনি। আমি বললাম আসি পিসি। আচ্ছা এসো। আমি গেট খুলে বেরোতে যাব, উনি বললেন শোন। বলুন। সোমবার একবার আসতে পারবে? আসব। কিন্তু কখন? বিকাল ৪টেয়। আচ্ছা। আরেকটা কথা ঐ সময়ে অবশ্যই রেহানাকে নিয়ে আসবে। দেখব।
আবার সেই রেহানা। কয়েকদিন যাওয়া হয়নি। কি জানি কি ভাবছে। বেল দিতেই দরজা খুলে দিল রেহানা। আমার সঙ্গে কোন কথা না বলে ভিতরে চলে গেল। খারাপ, ভীষন খারাপ লাগছিল। বসার ঘরে একাকী বসে আছি। ভেবেছিলাম আসবে বুঝি রেহানা আবার। কিন্তু এলো না। আফরোজ বেগম তার ঘর থেকে বললেন, কে এলোরে রেহানা। আমার সামনে দিয়ে রেহানা বেরিয়ে গিয়ে যে ঘরে আফরোজ বেগম আছেন সে ঘরে গেল। আমি কান পেতে আছি ওদের কথা শুনবার জন্য। রেহানা বলল যে প্রান্তিক এসেছে। প্রান্তিক, আর ওকে তুই একা বসিয়ে রেখেছিস? বলিহারি তোদের ব্যবহার। ওর শরীর ভাল আছে তো? শুনতে পাচ্ছি রেহানা বলছে, জিজ্ঞাসা করিনি। বা জিজ্ঞাসা করিসনি। ছেলেটা তাদের জন্য এত করল, আর তোরা সব কি বলত। ওর তো শরীর খারাপ করতে পারে? রেহানা। আস্তে বলল কি এত জোরে জোরে কথা বলছ মা? আমিতো কানে কালা নই। না তা নোস। তবে ধীরে ধীরে যে বোবা হয়ে যাচ্ছিস তা বুঝতে পারছি। তুমিতে সবই বুঝতে পারছ। আমার আর কি বলার আছে? না তোর কিছু বলার নেই যা ওকে এক কাপ চা করে দিয়ে আয়। আমার শরীরটা একদম ভাল লাগছেনা। ভাল লাগছেনা, কই আগেতো বলিসনি। সব কথা কি তোমাকে বলতে হবে? না তা বলবি কেন? আমি মা, আমার কষ্টতে বুঝবিনা। তুমি যদি মিছিমিছি কষ্ট পাও আমি কি করতে পারি মা। হ্যাঁ আমি মিছিমিছি কষ্ট পাই। তোরা আমাকে কোন কষ্ট দিসনা এই তো। ঠিক আছে তুই যা, বরং পারলে ওকে বলে দিয়ে যা, ও যেন এই ঘরে আসে।
ভাবছি উঠে যাব কীনা। কিন্তু উঠতেও পারছি না। বার বার মনে হচ্ছে রেহানার অনেক কথা ছিল আমার সাথে। তীব্র অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে আমি কিছু বলিনি বলে। জানি, ও আমাকে কিছুই বলবেনা, তাই ওর বলার অপেক্ষা না করে আস্তে আস্তে আফরোজ বেগমের কাছে গিয়ে বসলাম। আমার যাওয়া মাত্র রেহানা বেরিয়ে যেতে চাইলে আমি বললাম, তুমিও বোস না রেহানা। শরীর কি এখনো ঠিক হয়নি? কলেজে ক্লাশ পুরোদমে আরম্ভ হয়ে গেছে অথচ তুমি যাচ্ছ না? বেহানা কোন উত্তব না দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আমি বললাম, বলছ শরীর খারাপ অথচ দাঁড়িয়ে আছ ব্যপার কি? আর তা ছাড়া, আমি কি কোন অন্যায় করেছি যে আমার সঙ্গে কোন কথা বলা যাবে না আমার এই আক্রমণেও ও কোন কথা বলল না। আফরোজ বেগম বললেন, যা যা তোকে আর সঙের মত দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। আমার ভাল লাগেনা এসব। আমার হয়েছে যতসব জ্বালা।
এই পরিবেশে আমার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে, কিন্তু কি করব চলে আসার একটা অজুহাতও খুঁজে পাচ্ছি না। রেহানা আমার সঙ্গে কোন কথা না বলে নিজের ঘরে চলে গেল। আমি আফরোজ বেগমকে বললাম, কেন ওকে বকাবকি করছেন মাসিমা! ওর হয়তো সত্যিই শবীর খারাপই। শরীরতো খারপ, নতুন করে আর কি খারাপ হবে? আজ সকালেও তোমার কথা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তোমার নিশ্চয়ই শরীর খারাপ হয়েছে তাই। আমি রেহানাকে বললাম, তুই একবার দেখনা ওর কোন খোঁজ নিতে পারিস কিনা, না হলেও অন্তত কলেজে যা। দেখা হবে, না হলে জানতে পারবি কি হয়েছে। তাতে বলে কিনা মেয়ে আমি আর কলেজে যাব না। আমি আঁতকে উঠে বললাম সেকি। কলেজে যাবে না। শুধু কি তাই বাবা। বলে এ মুখ সে আর কাউকে দেখাবেনা। চমকে উঠে বললাম, বলে কি? ও কি অন্যায় করেছে যে মুখ দেখাতে পারবেনা। তুমি একবার বুঝাওতো বাবা! আমি আর পারছি না এদের নিয়ে। বললাম আচ্ছা। যাওয়ার সময়ে দেখা করে যাব ওর সঙ্গে। আজ সেলিনা কেমন আছে? ভাল আছে অনেকটা। একটু একটু হাঁটাচলা করছে। তবে বেশীক্ষণ পারছেনা মাথা ঘুরে যাচ্ছে। খাওয়া দাওয়া। ওটাই তো এক সমস্যা। কিছুতেই খেতে চায়না। তুমি কি একটু বুঝিয়ে যাবে? আমি বললাম, চিন্তা করবেন না মাসিমা। একদিন দেখবেন সব ঠিক হয়ে গেছে। মানসিক আঘাতটাতো কম নয়। আমি বরং সেলিনার কাছে যাচ্ছি। তাই যাও বাবা। আমি ওই ঘরেই চা পাঠিয়ে দিচ্ছি।
সেলিনা খাটের রেলিংএ হেলান দিয়ে, কি একটা ম্যাগাজিন পড়ছে। আমাকে দেখে একটু সোজা হয়ে বসে বলল, আরে প্রান্তিক ভাই যে। কতক্ষণ। অনেকক্ষণ, সকলের সঙ্গে দেখা করেই আমার সঙ্গে বুঝি? বলতে পার। তার মানে কর্তব্য পালন তাইতো? তাও বলতে পার। সবই যদি আমি বলব, তা হলে আপনি কি বলবেন। আমার কথা শোনার কি তোমাদের সময় আছে? আমার কণ্ঠ অভিমানী। চমকে উঠে সেলিনা বলল, এ ভাবেতো আপনি কথা বলেন না প্রান্তিক ভাই, কি হয়েছে? শরীর খারাপ? বললাম না শরীর আমার ঠিক আছে। আমার কথা থাক, তুমি কেমন আছ? ভালো। শুধু ভালো বললে তো আর কোন কথা বলার থাকে না, অথচ মাসিমা বললেন, তোমার ঘরে চা পাঠিয়ে দেবেন, অন্তত চা খাওয়ার সময়টুকু যাতে তোমার কাছে থাকা যায় তার জন্য এমন কিছু বল, যাতে সময়টা কাটানো যায়। ও উৎসুক হয়ে বলল, কি জানতে চান? বললাম বক্সিংএর দুনিয়ায় ফিরতে হবে তো, এ ভাবে মিইয়ে গেলে চলবে কেন? মনে সাহস আনতে হবে। সব সময় শুয়ে থাকলে চলবে কেন? তাহলে কি করব। রাস্তায় বেরুবে? কি হয়ে ছিল ভুলে গিয়ে জীবনের স্বাভাবিকতায় ফিরে আসতে হবে।
কি যেন ভাবলো সেলিনা, তারপর বলল, এসব কথা যে ভাবিনা তা নয়। কিন্তু ভয় হয়। কিসের ভয়? ঐ শয়তান গুলোতে হারিয়ে যায়নি। যদি আবার আসে? কোন শয়তানগুলো? কেন রেহানা আপনাকে কিছুই বলেনি? আরো আশ্চর্য হয়ে বললাম, ওতো আমার সঙ্গে কোন কথাই বলছেনা। কেন কথা বলছেনা কেন? কি করে বলব সেলিনা। তুমিও মাঝে মাঝে আড়ি করে দাও, আমার সঙ্গে আর কথা বলবেনা বলে।
অনেক অনেকদিন পর খিল খিল করে হেসে উঠলো সেলিনা। যেন দমবন্ধকরা গুমোট ঘরে দখিনা হাওয়া লুটোপুটি খেলছে। বললাম এমন হাসলে, কি যে ভাল লাগে। হা বহুদিন হাসতে ভুলে গিয়েছিলাম। কেমন যেন হতাশ লাগছিল সব কিছুতেই। আজ মনে হচ্ছে দূর হতাশার কি আছে? জীবনের সব ঘটনাকে কি মনে রাখতে হবে না কি? তারপর জোরে জোরে চিৎকার করে মাকে ডেকে বলল, মা রেহানাকে বলতো আমি ডাকছি। আফরোজ বেগমের চা ততক্ষণে হয়ে গেছে। উনি আমার আর সেলিনার জন্য নিমকি আর চা নিয়ে এলেন।
হাসি হাসি মুখ সেলিনার। মায়ের মনতো। সন্তানের মনের সংবাদ তার থেকে বেশী কে জানবে। তিনি বললেন, তোমরা চা খাও, দেখি রেহানাকে বলে দেখি।
আমরা চায়ের কাপ নিয়ে অপেক্ষা করলাম কিছুক্ষণ যদি রেহানা আসে। কিন্তু আফরোজ বেগম জানালেন, না ও আসবেনা ওর অসম্ভব মাথা ধরেছে, বলছে আসতে পারবেনা। আমি সেলিনার দিকে তাকিয়ে দেখি মিটিমিটি হাসছে। আমি ওদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে বললাম আমি যতক্ষণ থাকবো, ও সুস্থ হবে না, আসলে ও আমাকে সহ্য করতে পারছেনা কেন যেন? সেলিনা বলল তাই বুঝি? তা নাহলে আর কি ভাববো বল? হঠাৎ প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে সেলিনা বলল, ওকে নিয়ে একদিন ঘুরে আসুন। দেখবেন, ভিতরের মেঘ কেটে গেছে। তারপর বললো,
আপনার এক বন্ধু আছে না, কি যেন নাম? হ্যাঁ মনে পড়ছে অশ্রুকণা। হ্যাঁ আছে। কিন্তু ওকে তুমি চেনো নাকি? না চিনতাম না তবে ২/৩ দিন আগে এসেছিল আমাদের বাড়ী? তোমাদের বাড়ী? আমি চমকে উঠলাম। আমার চমকে ওঠাটা সেলিনার দৃষ্টি এড়ালনা বলল, এতে চমকে উঠছেন কেন? ও যেমন আপনার বন্ধু, তেমনি রেহনারও তত বন্ধু। তা ঠিক। কি জন্য এসেছিল ও? এটাতো আপনার ঠিক হচ্ছে না প্রান্তিক ভাই? আপনি ছাড়া রেহানার কাছে আর কেউ আসবে না, এ হয় নাকি? সেলিনার কথায় কি যে হচ্ছিল আমার বুঝাতে পারব না, কাউকে। সেলিনা বলে চলে এ কিন্তু আপনার ভীষণ বাড়াবাড়ি। আমি কি তাই বলেছি? না বলেননি, কিন্তু বলতে চেয়েছেন। আমি অবাক হয়ে বললাম আমি বলতে চেয়েছি? না সেলিনা না আমি শুধু বলতে চেয়েছি এ ঘরের বদ্ধতা তোমার জন্য নয়। তোমার চাই মুক্ত বাতাস উন্মুক্ত প্রান্তর। তেপান্তরে মাঠ। আর বক্সিং এর রিং সেটা বলবেন না। না বলব না। কারণ ঐ রিং এ যাওয়ার কোন ইচ্ছেই তোমার নেই। তার থেকে তুমি প্রস্তুত থেকো, আমি আসব কাল বিকালে, বেরোবে আমার সঙ্গে। আপনার সঙ্গে। কেন আপত্তি আছে? আছে বৈকি। তারপর হেসে বলল প্রান্তিক ভাই, আপনার সঙ্গে নয়, বরং কাল আপনি আমার সঙ্গে চলুন। কোথায়? একবার তপতিদিকে দেখতে ভীষণ ইচ্ছে করছে। যাবেন? আচ্ছা যাব। কখন যাবে? আপনি আপনার বাড়ী থেকে রাস্তার মোড়ে দাঁড়াবেন, বিকেল ৩টে নাগাদ, আমি যাব ঐ সময়। তুমি আমার বাড়ী চেন? না চিনিনা, তবে জানি আপনি কোথায় থাকেন?
আচ্ছা বলে বেরিয়ে এলাম ওখান থেকে। অভিমানের প্রত্যাঘাতে চেয়েছিলাম, যাব না রেহানার সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু পা যে ঐ দিকেই এগিয়ে চলল, একটা পাতলা চাদর গায়ে দিয়ে, ফুলফোর্সে পাখা চালিয়ে শুয়ে আছে রেহানা। কৃষ্ণবর্ণ আর পান্ডুরতায় আচ্ছন্ন তার মুখচ্ছবি। চোখ বন্ধ করে আছে। কি যে গভীর ব্যথা লুকিয়ে আছে ওর বুকের মধ্যে কে জানে? মনে মনে ভেবে নিয়েছি কদিন আগে অশ্রুকণা এসেছিল, নিশ্চয়ই এমন কিছু বলেছে, যা রেহানার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি। কিন্তু কি তা। আমি আস্তে হাত রাখলাম ওর কপালে। চোখ মেলে দেখে আমি সামনে। ও বলল, তুমি আর এসোনা প্রান্তিক। কেউ ব্যথা পাক আমি চাইনা। বুঝতে পারছি আমার অনুমান ঠিক। অশ্রুকণা নিশ্চয়ই কিছু বলেছে। কিন্তু কি বলতে পারে ও। হয়তো কাগজে যে সমস্ত ঘটনা বেরিয়েছে বলে মিনতি সেন বলেছিলেন, তেমনি কোন খবর অশ্রুকণার নজরে এসেছে আর তাকেই হয়তো রূপে রংএ ব্যাখ্যা করেছে রেহানাকে। যা রেহানার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি। আর চিরদিনের চাপা স্বভাবের মেয়ে রেহানা, সব বেদনার বোঝা নিজে গ্রহণ করে আমাকে মুক্তি দিতে চাইছে। বললাম কেউ ব্যথা পাক এটা তুমি চাও না। কিন্তু আমি ব্যথা পাই তাইকি তুমি চাও? কি অপরাধ করেছি তোমার কাছে যে এই ভাবে অপমান করছ? বেশ তবে থাক তুমি তোমার মত, কয়েকদিন আসতে পারিনি, মনে করোনা তোমার চিঠি এর জন্য দায়ী, আমি আসতে পারিনি তার কারণ, আরো এমন কতকগুলো ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েছিলাম যে একদম সময় করে উঠতে পারিনি। অশ্রুকণা কি বলেছে জানিনে, ওর সঙ্গে আমার একটি মাত্র কথা হয়েছে, জিজ্ঞাসা করেছিল, রেহানা আসেনি? বলেছিলাম আমার সঙ্গে দেখা হয়নি। হ্যাঁ এটা মিথ্যে কথা, জেনে শুনেই বলেছিলাম, এর বাইরে যদি কিছু বলে থাকে তার দায়িত্ব তার আমার নয়। ও তেমনি চোখ বন্ধ করে রয়েছে। জানিনা আমার কথা শুনতে পাচ্ছে কী না,তবু বলৈ চললাম, রেহানা আমিও মানুষ। রক্ত মাংসের মানুষ। মান-অপমান, ভালবাসা-ঘৃণা, বিশ্বাস-অবিশ্বাস অন্য সকলের মত আমারও আছে। যাকগে। এসব কথা বলে তোমাকে আর আঘাত দেবো না। সোমবার ঠিক ৩/৩০ টায় শিয়ালদা সাউথ প্লাটফর্মে অপেক্ষা করব। আসা না আসা তোমার ব্যাপার। চলি।
না ফিরে তাকাইনি ওর দিকে। নিজেই দরজা এবং গেট খুলে বেরিয়ে এলাম বড় বাস্তায়। হঠাৎ কি খেয়াল হল তাকালাম পিছন ফিরে। দেখলাম রাস্তার দিকের জানালা খুলে তাকিয়ে আছে রেহানা।
সোমবার ৩-২৮। না রেহানা আসেনি, ধরে নিয়েছি আসবেনা। ও হারিয়ে যেতে চায় আমার জীবন থেকে, এটা মেনে নিতে পারছি না। কিন্তু ওযে আমার জীবনের সঙ্গে নিজেকে জড়াতে চায় না। এ উপলব্ধির প্রায় কাছাকাছি এসে গেছি। কিন্তু একি। আস্তে আস্তে আমার কাঁধে পিছন থেকে হাত রাখল কে? তাকিয়ে দেখি রেহানা। আমি অবাক চোখে তাকাতে বলল, ভেবেছিলে আমি আসবনা তাইনা? তাছাড়া কি অন্য কিছু ভাবা যেতো? কেন আমার উপর তোমার কোন বিশ্বাসই নেই? নেই কোন অধিকার? আমি বললাম, গাড়ী স্টার্ট দিচ্ছে তাড়াতাড়ি এসো। ওকে আগে তুলে দিয়ে চলন্ত ট্রেনে লাফিয়ে উঠলাম। দেখলাম ও হাফাচ্ছে। তবুও জানতে চাইল, কোথায় যাব আমরা। জাহান্নামে। খুব সুন্দর জায়গা তাই না। বলেকি মেয়েটি। বললাম, জাহান্নাম সুন্দর কীনা জানিনা, তবে সুন্দর যে তুমি, তাতে কোন ভুল নেই। ধ্যাৎ।
ট্রেন থেকে নেমে বললাম, হেঁটে যেতে পারবে না রিক্সা ডাকব। কাছে? হ্যাঁ কাছেই। কোথায়? তোমার মিনতি সেনের কথা মনে আছে? জলযোগে একবার দেখা হয়েছিল। বলেছিলাম আমার পিসি। লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠলো রেহানা। বলল, ওখানে কেন? খানিকটা জড়সড় যেন। বললাম, আমাকে বিশ্বাস করতো রেহানা? জানিনা। না জানলে চলবে কেন? একটু আগে তুমি জাহান্নামকেও একটা সুন্দর জায়গা বলে বর্ণনা করেছে কেন বলত। সামান্য হেসে বলল, সেতো তোমার জন্য। আমার জন্য? হা তোমার জন্য। তোমার সঙ্গে আমার নরকে যেতেও আপত্তি নেই। আমি বললাম। আমাকে তুমি এত ভালবাস রেহানা? জানিনা, বলে চুপ করে গেল। আমারও যেন কিছু বলার নেই।
এই মেয়েই পরশুদিন বলেছে তুমি আর এসো না প্রান্তিক। এই হয়। জীবনের চলমানতা কেমন করে কাকে কোন পথে নিয়ে যাবে, কেউ তা জানেনা। মুহূর্ত আগেও মনে হচ্ছিল, রেহানা সত্যিই হারিয়ে যেতে চায় আমার জীবন থেকে। আর এখন, রেহানার স্বপ্নগুলো আবর্তিত হয়, সাধারণ অতি সাধারণ প্রান্তিক কে নিয়ে।
মাত্র কয়েক মিনিটের রাস্তা। মিনতি সেনের বাড়ীতে বেল দিতেই তিনি নিজেই দরজা খুলে দিলেন। আমার পাশে রেহানাকে দেখে বললেন, তুমি রেহানা না? একি চেহারা করেছ? তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, প্রান্তিক এ তোমার খুব অন্যায় এত কষ্ট দিলে কেন ওকে? আমি রেহানাকে বললাম, আমার পিসি মিনতি সেন। ভীষন লজ্জা পেয়েও রেহা মিনতি সেনকে প্রনাম করে বলল, আমার কথা আপনার মনে আছে? মনে থাকবে না কেন পাগলি? তবে একি চেহারা বানিয়েছিস। কেন এমন চেহারা করেছিস? মাঝে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন। উপরে যাও প্রান্তিক।
আমি উপরে এসে দেখলাম সেখানে এক ভদ্রলোক বসে আছেন। সামনে কোর্টের কিছু ব্রিফ। মানে ভদ্রলোক হয় এ্যডভোকেট না হলে এ্যডভোকেটের কোন নিয়োজিত ব্যক্তি। আমি সামনা সামনি একটা চেয়ারে বসলাম। উনি জিজ্ঞাস করলেন, আপনি মিস সেনের কিছু হন? ভাইপো। আপনার নাম? প্রান্তিক। ও আপনাকেই দরকার। বাস্তবিকই আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করছি। মিস সেন কোথায়? বললাম আসছেন। আচ্ছা আপনার সঙ্গে রেহানা নামে একজনার আসর কথা ছিল না? হ্যাঁ ছিল, এবং এসেছেনও। উনি কোথায়? পিসি ওকে নিয়ে আসছেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কিছু মনে করবেন না, আপনি? আমি সুরেশ ভট্টাচাৰ্য্য। লিগাল প্রাকটিস্ করি। তারপর নিজেই বললেন, এদের সঙ্গে আপনার পরিচয় কি ভাবে? বেহানা আমার সঙ্গে পড়ে। ও তার মানে আপনি ছাত্র? আমি হ্যাঁ বলে বললাম, আমাকে আপনি তুমি করেই বলবেন। কেন ইয়ং ম্যান, আপনিতে আপত্তি আছে? হ্যাঁ আছে, বড়রা কেউ আপনি করে বলুক, আমার ভাল লাগেনা, আচ্ছা তাই হবে?
সামনের দিকে তাকিয়ে দেখি মিনতি সেন, পিছনে রেহানা। কিন্তু একি, এ পোষাকে তো রেহানা আসেনি। সুন্দর লাল হলুদের মহীশূর সিল্ক পরেছে রেহানা। বেণীটি সুন্দর কবে বাঁধা। তার গোড়ায় গোঁজা লাল গোলাপ। ব্লাউজটা ঠিক আছে, যতদূর মনে পড়ে হাত খালি ছিল। কিন্তু এখন দেখছি দু হাতে দুটো বালা, গলায় লকেট সহ সরু চেন বুকের খাদে লেপটে আছে, খানিকটা স্নো পাউডারের প্রলেপ দেওয়া হয়েছে মুখশ্রীতে, আই ভু পেন্সিল ইউজ করা হয়েছে চোখের পাতায় এবং ভূতে। সবুজ টিপ দেওয়া হয়েছে দুই ভূর মাঝে। আর এতেই অনেকটা ঢাকা পড়েছে তার কৃশতা। আই ভূর পেন্সিলের স্বাভাবিকতায় উজ্জ্বলতর হয়েছে দুটো চোখের দৃষ্টি। হাতে মিষ্টির প্লেট। নিমকি। সিঙ্গারা এবং ৩/৪ বকমেব মিষ্টি। আমি একবার চোখ তুলে আবার নামিয়ে নিলাম। রেহানার স্বাভাবিক সৌন্দৰ্য্য সামান্য প্রসাধনে এত অসামান্য হতে পারে তা আমার ভাবনার বাইরে। মিনতি সেন বললেন, মিঃ ভট্টাচার্য। কথা দিয়ে ছিলাম, ওকে দেখাব একবার আপনাকে। এই সেই রেহানা যার কেসটা আপনাকে নিতে বলেছিলাম। আপনি আমার কথা রেখেছেন বলে আমি কৃতজ্ঞ। এর নাম রেহানা। আর ও প্রান্তিক। এদের কথাতো আপনাকে বলেছি। আপনি নিশ্চয়ই এতক্ষনে প্রান্তিক কে জানিয়ে দিয়েছেন আজকের শুনানিতে কি হয়েছে। ভট্টাচার্য সাহেব বললেন, না এখনো। জানানো হয়নি। বরং আপনিই জানিয়ে দিন। মিনতি সেন বললেন এডভোকেট আপনি আর জানিয়ে দেব আমি? উনি বললেন, আমিতো বলছি। তারপর মিষ্টির প্লেটের দিকে তাকিয়ে বললেন, এত খেতে পারবনা মিস সেন। বরং আরেকটা প্লেট নিয়ে আসুন। মিনতি সেন বললেন ঐ সামান্য মিষ্টি, আবার কি প্লেট নিয়ে আসব। আপনি খেয়ে নিন। তারপর রেহানাকে বললেন, চল মেয়ে, এদের জন্য কফি নিয়ে আসবি। ভট্টাচার্য সাহেব বললেন তোমার নাম রেহানা? রেহানা একটু হাসলেন। মিনতি সেন তাকালেন রেহানার দিকে। রেহানা নীচু হয়ে প্রণাম করতে উনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন একি করছ মা। আজকাল আবার এসব কেউ করে নাকি? মিনতি সেন বললেন। বা করবে না কেন? বাঙালী কৃষ্টিকে কি অস্বীকার করা যায়? ভট্টাচার্য সাহেব বললেন, তা ঠিক জানিনা মিস সেন। আমারও যে এসব ভালো লাগে না তা নয়, তবে সমস্যা কোথায় জানেন? আমার মেয়ে, সেতো মা তোমারই মত বয়স, এবার প্রথম বর্ষ এম এ করছে। তাকে গুরুজনদের প্রনাম করতে বললে, সে বলে তার নাকি লজ্জা করে। আমারও ধীরে ধীরে বিশ্বাস হচ্ছিল, সত্যি হয়তো আজকের দিনের ছেলেমেয়েদের এসব বুঝি ভালো লাগেনা। তোমাকে দেখে আমাকে আবার নতুন করে ভাবতে হবে।
উনি মিষ্টির প্লেট তুলে নিয়ে খেতে আরম্ভ করলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, দেখ প্রান্তিক, জীবনে অনেক আঘাত আসবে, সমস্যা আসবে, আসবে দুঃখ-ঝড়, তাই বলে নিজের বিশ্বাসকে হারিয়ে ফেল না। তোমার পিসিকে আমি ভীষণ শ্রদ্ধা করি, তার কারণ ভিন্ন। তাই তার আবেদনকে অস্বীকার করতে পারলামনা। স্বতঃ প্রনোদিত হয়ে এ কেস আমি গ্রহণ করেছি। ওদেব যাতে আদালতে উঠতে না হয় তার জন্য আমি আপ্রান চেষ্টা করব। কিন্তু মিস সেন আপনাকেও আপনার কাকাবাবুকে বলতে হবে, পুলিশ যাতে কেসটি ঠিক ঠিক মত প্লেস করে সেটা দেখতে। এক মাস পরে ওদের আবার আদালতে হাজির করা হবে। আমি দেখব যাতে ওদের শাস্তি কঠোর হয়। আর মা রেহানা কয়েকটা সই-টই লাগতে পারে। প্রান্তিকই যেন যোগাযোগ রাখে, আমি দেখব। আমার মেয়ের নাম শান্তা, এসোনা একদিন আমাদের বাড়ীতে। তোমাদের দেখে যদি ওর চিন্তার কোন পরিবর্তন হয়। মিনতি সেন বললেন, আপনার কি খুব দুঃখ ভট্টাচার্য সাহেব। এতদিন বিলাতে ছিলেন, তাতেও মানসিকতার পরিবর্তন হল না। কে বলেছে হয়নি মিস সেন? তবু বাঙালীর এই ভদ্রতা, এই নম্রতা, গুরুজনদের প্রতি এই শিষ্টাচার আজো নষ্টালজিয়াতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। আমার মেয়ে এক খ্রিস্টান যুবককে ভালবাসে। আমার কোন আপত্তি নেই, শুধু চাই ওর ভিতর যেন দেখতে পাই এই বাঙালী কৃষ্টিকে।
তারপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, না অনেক দেরি হয়ে গেল, উঠতে হবে। রেহানা বলল, একটু বসুন কাকাবাবু, আপনার কফিটা নিয়ে আসি। রেহানা বেরিয়ে গেলে ভট্টাচার্জ সাহেব বললেন, ইয়ু আর আ ভেরি লাকি ইয়ংম্যান। তোমাদের শুভ কামনা জানাই। আমি আর কি বলব। লজ্জায় শুধু চুপ করে রইলাম। রেহানা কফি নিয়ে এলে, তার হাত থেকেই কফির পেয়ালা তুলে নিলেন ভট্টাচার্জ সাহেব। মিনতি সেন বললেন, ঐ বোধহয় বাবা উঠেছেন, তুমি যাওনা প্রান্তিক একটু ওঁর কাছে, আমি এগিয়ে গেলে, রেহানাকে বললেন তুইও যা মেয়ে।
পিসি ভট্টাচার্জ সাহেবকে বললেন, আপনার তো বহু জায়গায় যোগযোগ আছে। প্রান্তিককে একটা চাকরি করে দিন না। হাসলেন ভট্টাচার্জ সাহেব, বললেন, এই আইন আদালতের চাকরি ভাল লাগবে ওর। আইন আদালতের চাকরি দেবেন কেন? আপনিতো সুর এ্যাণ্ড সুর মার্চেন্ট অফিসেরও অ্যাডভোকেট তাইনা? হ্যাঁ, তাহলে ওদেমু ওখানেই দিন না। ওরাতো কয়েক জন সহকারী ম্যানেজার নেবেন বলেছেন। ভট্টাচার্জ সাহেব তাকালেন মিনতি সেনর দিকে। তারপর বললেন, কিন্তু ওরা যে মিনিমাম কোয়ালিফিকেশান স্নাতক চায়। কদিনই পরে ওতো স্নাতক হবে। পারবেন না ম্যানেজ করতে? দেখব। তারপর তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যেতে যেতে বললেন, ও যাবেতো? মিনতি সেন বললেন, আমার ওপর বিশ্বাস রাখতে পারেন।
এবার ফিরতে হবে। মিনতি সেনের বাবা বললেন, দিদি ভাই তোমার মতো মিষ্টি মেয়ে খুব কম দেখিছি। মাত্র কয়দিন হলো মিনতির কাছে তোমার নাম শুনেছি, একদিন মিনতিও হয়তো তোমার মত মিষ্টি মেযেব মা হতে পারতো। কিন্তু কি যে হয়ে গেল, ও বোধহয় তোমাদের মাধ্যমে, সেই মাতৃত্বের সাধ মিটাতে চায়। কদিন আয় বাঁচব, রেহানার একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বললেন, কি আর বলব, ও যদি তোমাদের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পায়! একটু দেখো। হাতটা ছেড়ে দিয়ে অন্য দিকে পাশ ফিরে শুলেন বৃদ্ধ আমি ডাকল্লাম, দাদু এবার যে উঠতে হবে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আচ্ছা, বলে চুপ করে গেলেন বৃদ্ধ।
মিনতি সেন বললেন, একি করছিস মেয়ে। ওসব তোর। রেহানা বুঝতে না পেরে তাকিয়ে রইল। মিনতি সেন বললেন, এসব খুলে রেখে যাবি বলে কি পরতে দিয়েছি? কিন্তু, কোন কিন্তু নয় মেয়ে। শুনলি তো বাবার কাছে আমিও তোর মত মেয়ের মা হতে পারতাম।
জানি অসুবিধা কোথায়। কোথায় সঙ্কোচ রেহানার। আবার মিনতি সেনের মনের অবস্থাটাও বিচার করতে হবে। যে গভীর ভালোবাসা আর স্নেহের উপর ভিত্তি করে রেহানাকে এই সাজে সাজিয়েছেন, তার অধিকারটাকে বুঝতে হবে। বললাম, থাক না রেহানা, মাসিমাকে যা বলবার আমি বলব।
বেরিয়ে এলাম, আমবা। আসার সময় রেহানার হাতে একটা প্যাকেট তুলে দিয়ে বললেন, না করিসনে মেয়ে এটা সেলিনাকে দিয়ে দিবি। বলবি আমি দিয়েছি। এতক্ষণে যদিও বা সম্ভব ছিল, রেহানা আর পারলনা, টপটপ করে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। মিনতি সেন বললেন একি পাগলি কী করছিস? রেহানা বলল, আপনার এই ভালবাসার যোগ্যতা যে আমার নেই। মিনতি সেন ওকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে বললেন যোগ্যতার মানদন্ডের হিসাব কি সব জেনে বসে আছিস পাগলি। তারপর তাকে ছেড়ে দিয়ে নিজের আচলে চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বললেন একদম কাঁদবি না পাগলি। একটা কথা সব সময় মনে রাখবি যারা তোর কাছে চাইবেনা কিছুই, পারিস তো তাদের মনের ঠিকানা খোঁজবার চেষ্টা করিস।
বেরিয়ে এলাম আমরা। সারাটা পথ একসঙ্গে হেঁটেছি। কিন্তু কিছু চাওয়াতো দূরের কথা, কোন কথা বলতেই পারলাম না। তাই একটা কথা হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছি যে, মন যেখানে কানায় কানায় পূর্ণ সেখানে চাইবার কিছু নেই। একটাও কথা না বলে, আমরা এলাম প্লাটফর্মে। ওঁকে বসিয়ে রেখে টিকিটটা কেটে নিয়ে এলাম। এসে দেখি চুপ করে বসে আছে রেহানা। আমি যে এসেছি সে বুঝি বুঝতেই পারেনি। শিয়ালদাগামী ট্রেন এসে দাঁড়ালো প্লাটফর্মে। আমি বললাম কই ওঠ। ও বলল, এ ট্রেনটা ছেড়ে দাও প্রান্তিক। পরের ট্রেনে যাব। ট্রেনটা বেরিয়ে গেল।
বললাম চা খাবে? বলল না। তাহলে ট্রেনটা ছেড়ে দিলে কেন? জানিনা। আমার একদম বাড়ী যেতে ইচ্ছে করছেনা। কেন? বলতে পারবো না কেন? প্রান্তিক আমার বোধ হয় না আসলেই ভাল হতো। কেন? তোমাকে সত্যি কথাই বলছি, এত ভালবাসা পাওয়ার যোগ্যতা আমার নেই। মিনতি পিসি কি চান আমি জানিনা। তার বাবার কথায় আমার মত তারও একটা মেয়ে থাকতে পারতো? কিন্তু হয়নি, কি কারণ, আর দুঃখটাইবা কি কোনটাইতো আমি জানিনে, অথচ যে ভাবে তিনি তার সর্বগ্রাসী ভালবাসার প্রবল জলোচ্ছ্বাসে আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছেন, জানিনা এর কি প্রতিদান আমি দিতে পারবো। বারবার মনে হচ্ছে কি জান প্রাত্ত্বিক, আমাকে যদি তিনি সাধারণ একেবারে সাধারণ কোন করুণা প্রার্থীর মতন ভাবতেন, আমার বোধ হয় এত কষ্ট হতো না।
বললাম, কেন এত ভাবছো রেহানা, মিনতি সেনবা আছেন বলেইতো, আজো দুঃখ বেদনা আর শত আঘাতেও বাঁচবার সাধ জাগে, স্বপ্ন দেখবার ইচ্ছে হয়। যদি সে স্বপ্ন। পূরণ না হয়। নাইবা হলো, তাতে স্বপ্ন দেখাটাতো মিথ্যে হয়ে যাবে না। তুমি হয়তো পারবে প্রান্তিক, কিন্তু আমার কথা ভেবেছো? যে মেয়ে স্বপ্ন দেখতে ভুলে গেছে তাকে যদি নতুন স্বপ্নের ফেরি করতে হয়, সে পারবে কেন? আর এই যে, যে সাজে সাজিয়ে দিয়েছেন আমাকে মিনতি পিসি, এযে আমার আনন্দ না দুঃখ সে তোমাকে বোঝাতে পারবো না। হয়তো বেশী দাবী হয়ে যাবে, তবু যদি এই সাজে তুমি আমায় সাজিয়ে দিতে এত বোধহয় কষ্ট হতো না। জানতাম, তুমি না চাইলেও হয়তো কিছু দাবি আছে তোমার পরে। স্মৃতির সাঝিতে ভরে নিতাম সেই দাবির অলংকার যা একদিন ফুল হয়ে ফুটতো, তার পর হয়তো বা ঝরে যেতো, তবু মনকে সান্ত্বনা দিতাম, এর মধ্যে করুণা আছে কীনা জানিনা, কিন্তু পথ চলার অধিকার তো ছিল একদিন। তা হলে কেন তুমি আমাকে এমনি চরম অবহেলা আর তাচ্ছিল্যে একাকী পথের বাকে এসে দাঁড় করিয়ে দিলে?
আমি অবাক আর বিস্ময় ভরা চোখ তুলে তাকালাম ওর দিকে। হয়তো বিষাদ আছে আনন্দের বেলাভূমে, কিন্তু গোধুলি আকাশের সন্ধ্যা আভায় ধুসর হয়ে আসা প্রান্তরে এ কোন মেয়ের চরণধ্বনি। একে কি চিনি আমি? সৌন্দর্য আর মহিমাত্বের মাখামাখিতে রেহানা যেন নতুন স্বপ্নের সাগরভূমি। চোখ কি পারবে ওই সৌন্দৰ্য্যকে সয়ে নিতে!
আমি নিজেও কম অবাক হইনি, মিনতি পিসির আচরণে। হ্যাঁ, বুঝতে পারি উপলব্ধির গভীরতায় যে, মিনতি পিসির নিঃসঙ্গ জীবন, এমনি একটা স্বপ্ন দেখার অপেক্ষায়। কিন্তু নিজের ক্ষমতাকে কি আমি.যাচাই করে দেখেছি, এই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করা যাবে কী না। কে আমি? কতটুকু আমার ক্ষমতা? অথচ অবাক হয়ে ভাবি যাদের ভালবাসা আমাকে ধন্য করেছে, তারা কি তাদের ভালবাসা বিলিয়ে দিয়ে নিজেদের প্রকাশ করতে চেয়েছে, না তাদের ভালবাসায় আমাকে দিয়েছে পথ চলার অনুপ্রেরণা।
বললাম, অবহেলা যদি করেও থাকি তোমাকে, দুঃখকি রেহানা, তোমার চলার পথকে কর দিগন্ত বিস্তৃত। সরু এক ফালি পথ থেকে বেরিয়ে এসে তুমি দাঁড়াও রাজপথে। যারা অর্ঘ্য সাজিয়ে তোমার অপেক্ষায় আছে বরণ করে নেওয়ার জন্য, ধন্য কর তাদের, তুলে নাও তাদের ভালাবাসা তোমার হৃদয় মাঝে। অবহেলার মধ্যে নিজের মুক্তি চেওনা রেহানা আবার তাচ্ছিল্য ভাবে তাকে পেতেও চেওনা। তাতে জিতবেনা তুমি। জীবনে যা পেয়েছো তাকে গ্রহণ কর সহজ ভাবে। আঘাত দুঃখ বেদনা সব কিছুকে ভাগ করে নাও আনন্দের সাথে। জীবনের জয়কে যেমন সাদরে বরণ করে নাও, তেমনি হারকেও গ্রহণ করেনও সমান মর্যদায়। মনে রেখ জীবনে যা কিছু আসে কখনো তা কুসুমাস্তীর্ন পথে আসে না। সে হারই হোক আর জিতই হোক। অবহেলাকে অবহেলা দিয়ে জয় করো। তাচ্ছিল্যকে করো আরো তাচ্ছিল্য। তাই বলে যে তোমাকে তার হৃদয়ের ভালবাসা আর আবেগ দিযে সাজিয়েছেন, তার দেওয়া এ স্নেহের দান, ছোটই হোক আর বড়ই হোক গ্রহণ করো পরম পাওনা বলে। এই পৃথিবীতে কজন পায় এই অযাচিত দান। ঈশ্বরের আর্শীবাদ না থাকলে তা পাওয়া যায় না রেহানা।
এরপর যে কি বলব বুঝতে না পেরে চুপ করে গেলাম। বুঝতে পারছি আমার বলাটাও কেমন তালগোল পাকিয়ে গেছে। কি যে বলতে চেয়েছি, তাইতো ছাই বুঝতে পারছি না। তবু মনের সেই দিহীন নিশানায় আর একবার তাকালাম রেহানার দিকে। অপলক তাকিয়ে আছে ও আমার দিকে। বললাম, অমন করে তাকিয়ে তাকিয়ে কি দেখছ? কোন কথা না বলে, মিনতি সেনের ভালবাসায় গুঁজে দেওয়া ফুলটা বেনী থেকে খুলে নিল রেহানা। এখনো সতেজ গাঢ় লাল, তারপর তা আমার হাতে দিয়ে আস্তে আস্তে বলল, ফিরিয়ে দিওনা প্রান্তিক, এ আমার অহংকার। যার জন্য দিয়েছেন তাকেই দিলাম নিঃস্ব করে।
পরের গাড়ীটা এসে গেল। ওর হাত থেকে ফুলটা নিয়ে দ্রুত সেই তাড়াহুড়োর মধ্যে আবার সেটা ওর বেনীতে গুঁজে দিয়ে বললাম, তোমার অহংকারটুকুই আমার পাথেয় হয়ে থাকুক।
যখন ওদের বাড়ীতে ফিরেছি, অনেকটা রাত হয়ে গেছে। উদ্বিগ্নতায় প্রহর গুনছেন ওরা। বেল বাজাতে দরজা খুলে দিল সেলিনা। আমার পিছনে ওকে দেখে আশ্বস্ত হল ঠিকই, কিন্তু পোষাকের দিকে চোখ আটকে গেল সেলিনার। রেহানা ওর সঙ্গে কোন কথা না বলে মাথা নীচু করে নিজের ঘরে চলে গেলো। পিছনে পিছনে সেলিনাও ঢুকল ওর ঘরে। অবাক হয়ে তাকালো ওর দিকে। তারপর বলল, একটু বলে গেলে পারতিস রেহানা। বলতো, তোর এই চরম আনন্দের দিনে আমাদের কি উদ্বিগ্নতায় রাখলি। প্রান্তিক ভাইয়ের সঙ্গে কোথাও যেতে তো আমাদের কোন আপত্তি ছিল না। তারপর একটু থেমে বলল, খুশীতে রেহানা? রেহানা ওর ইঙ্গিত বুঝতে পেরে বলল, তুই থামবি তো সেলিনা। ও বলল, দেখ রেহানা যদি এক চিলতে সিঁদুর দিতিস সিঁথিতে অপূর্ব লাগতো তোকে? তারপর কানের কাছে মুখ এনে বলল, প্রান্তিক ভাই খুশীতো লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠেও বকুনি লাগাল সেলিনাকে, সব সময় ইয়ারকি ভাল লাগে না সেলিনা। কোথায় উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইবি কেন এত রাত হলো। কোন বিপদ টিপদ হয় নিতো? তা নয় যত সব আজেবাজে কথা। সেলিনা মৃদু হেসে বলল, বিপদে যে সত্যি সত্যি পড়েছিলি, তাতে তোকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
প্রথমে বেনীতে গোঁজা রক্ত গোলাপ, তারপর গলার চেন এবং শাড়ী খুলতে খুলতে বলল, তোর মুখে কিছুই বাঁধেনা তাইনা সেলিনা? বাঃ তোদের আনন্দটাকি ভাগ করেও নিতে দিবিনা? কি বড় মাপের মনটাকে তুই জয় করে নিলি, অথচ একটুও আনন্দ উৎসব হবে না এও কি তুই ঠিক করলি? রেহানা বলল, কি বলতে চাস তুই? সেলিনা বলল, তাহলে ডাকি প্রান্তিক ভাইকে! না দরকার নেই। তারপর মিনতি সেনের দেওয়া প্যাকেটটা ওর হাতে তুলে দিয়ে বলল, তোর। আমার? কি আছে ওতে? কি করে বলব, খুলে দেখ।
সেলিনা খুলে অবাক। একি? ওসব কি প্রান্তিক ভাই দিয়েছে। রেহানা একটু উত্তেজিত হয়ে বলল প্রান্তিক প্রান্তিক-প্রান্তিক। কোথায় পাবে প্রান্তিক এসব? ওকি চাকরি করে? সেলিনা হাসতে হাসতে বলে, তুই অতো রেগে যাচ্ছিস কেন বলতো রেহানা। এখন থেকেই নিজের মানুষটাকে এমন লুকিয়ে রাখতে চাইছিস যেন কেউ ছিনিয়ে নিয়ে না যায়? বিষণ্ণ কণ্ঠে রেহানা বলল, বুঝতেই যাকে পারলামনা আজো তাকে আবার লুকিয়ে রাখা। তারপর বলল দেখ প্রান্তিক একা বসে আছে। ও ঘরে যা, আমি চা করে নিয়ে আসছি।
সেলিনা আসে আমার কাছে। প্যাকেটটা আমার সামনে টেবিলের পরে রেখে বলে, আড়ি আপনার সঙ্গে প্রান্তিক ভাই। কেন? বাঃ, কাল সারাটা বিকাল আপনার সঙ্গে ঘুরলাম, একেবারে ঘুণাক্ষরেও জানতে দিলেন না, যে আজই রেহানা আপনার সঙ্গে বেরোবে। ওই প্যাকেটটা আমর সামনে মেলে ধরে তুমি কি জানতে চাইছো? ও হাসতে হাসতে বল, রেহানাকে আপনি অল্পে ভুলাতে পারেন, কিন্তু আমাকে পারবেন না। বললাম একশো ভাগ ঠিক কথা সেলিনা। রেহানা তোমার তুলনায় এত সামান্য যে, আমি কিছু না দিলেও ওকে ভোলানো অসম্ভব হবে না, কিন্তু তোমাকে যে ভোলানো যাবে না, এতে আমার কোন দ্বিমত নেই। আজতো আপনাদের আনন্দের দিন, এমন আনন্দের দিনে একটু বলে গেলেন না কেন? আমিতো অবাক, তবু বললাম বুঝতে পারিনি এতদেরি হবে তাই। কোথায় গিয়েছিলেন? আমি গম্ভীর হয়ে বললাম, আজ তোমাদের কেসটা ছিল জান? কি কেস? বাঃ যার জন্য এত ভুলে সেটাই ভুলে গেলে? আজ ডালিমদের কোর্টে তোলা হয়েছিল। বলার সঙ্গে সঙ্গে সেলিনার মুখটা যেন কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেল। বোধ হয় সেদিনের সব ঘটনা একে একে মনে পড়তে লাগল। আমি বললাম, ওই কেসটার ব্যাপারে কয়েকদিন আগে আমার এক পিসি, তুমি চেনো, রেহানা চেনে, মিনতি সেনের সঙ্গে কথা বলেছিলাম, যাতে একজন ভালো উকিল দেওয়া যায়। আজ সেই উকিলবাবুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম, আর মিনতি সেন মানে আমার পিসি, যা নিয়ে এতক্ষণ তুমি রেহানা কে ঠাট্টা, করলে এসব দিয়েছেন, আর তুমিতো যাওনি তাই অন্য প্যাকেটটাও তোমার জন্য পাঠিয়েছেন। ওর মধ্যে কোন লুকোচুরি নেই সেলিনা। আছে এক মমতাময়ী মায়ের স্নেহসিক্ত ভালবাসা।
সেলিনা চুপ করে রইল। কোন উত্তর বুঝি জানা নেই। আমি বললাম যাও সেলিনা, প্যাকেটটা খুলে দেখ ওটা তোমার পছন্দ কী না। পিসি দিয়েছেন, আমি কেন রেহানাও জানে না ওতে কি আছে? রেহানা চা নিয়ে আসতেই সেলিনা প্যাকেটটা নিয়ে চলে গেল। আমি চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললাম এবার উঠতে হবে রেহানা। কাল কি কলেজে যাচ্ছ? ও বলল, তুমি বল কি করব? হেসে বললাম আমি বলার কে? কেউ নও? এ কথার বুঝি কোন উত্তর হয় না। বললাম, কারো প্রতি মিথ্যে অভিমানে নিজের স্বপ্নকে মরে যেতে দিওনা। এর বেশী আমার কিছু বলার নেই। তারপর বললাম তাহলে কাল দেখা হবে কলেজে। আচ্ছা বলতে, আমি উঠে দাঁড়ালাম। বেবরাতে যাবো। মিনতি সেনের দেওয়া উপহার সম্ভার নিজের অঙ্গে ধারণ করে সামনে এসে দাঁড়ালো সেলিনা। অপরূপ মানিয়েছে তাকে চোখ ফেরানো যায় না। বলল, চললেন যে প্রান্তিক ভাই। আমাকে যে যেতে হবে, অনেক রাত হয়েছে। আর তো দেরি করা যাবে না। পিসি চিন্তা করবেন। সেলিনা বলল আমাকে কেমন মানিয়েছে বললেন না। আমাকে বলতে হবে? বা বলবেন না কেন? সুন্দর না কুৎসিৎ এটা বলার অধিকারতো আপনার আছে। আমি বললাম যিনি তোমাকে এই সব জিনিষ দিয়েছেন, বলার অধিকাবতো তার। তাকে পাব কোথায়? তার হয়ে বরং আপনিই বলুননা। বললাম সুন্দর বললে সৌন্দর্যের অপমান হবে। তাই বলছি অপূর্ব। লজ্জায় রাঙা হয়ে বলল ঠাট্টা করছেন? তোমার কি তাই মনে হল। বলুন না আমি কি কোন অন্যায় করেছি, ওর গলাটা অকারণ ভারি হয়ে ওঠে। আমি বললাম। আজ আর তোমার অভিমানের উত্তর দেওয়ার সময় নেই সেলিনা। তাই ওটা বাকি থাক। আরেকদিন বলব, সত্যি সত্যি আমি কোন ঠাট্টা করেছি কিনা।
নীলাঞ্জনা পিসির সঙ্গে আজকাল সম্পর্কটা কেমন যেন শিথিল হয়ে এসেছে। আগের মত অতটা ভালমন্দ নিয়ে বিচার করেন না। অফিস, বাড়ী, রান্না-বান্না, ছুটির দিনে একটু এখানে ওখানে বেড়াতে যাওয়া ছাড়া সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। আমি যে এই বাড়ীতে আছি, মনে হয় তাও অনেকটা ভুলে গেছেন। তাড়াতাড়ি আসলেও বলেন না, আজ এত তাড়াতাড়ি কেন। দেরি করলেও বলেননা এত দেরি কেন? কি এক চিন্তায় যেন আচ্ছন্ন থাকেন সর্বক্ষণ। রেহানাদের কথা আগে মাঝে মাঝে জিজ্ঞাসা করতেন। আজকাল তাও করেননা। এর মাঝে কবে নাকি অশ্রুকণার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। আমাকে বললেন, তুমি কি আজকাল কলেজ যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছ নাকি? তা হলে আর এখানে থেকে লাভ কি? আমি অবাক হয়ে বললাম, তোমাকে কে বলেছে এসব কথা? পিসি বললেন আমাকে কেউ না বললে আমি জানব কি করে? সেতো ঠিকই, কিন্তু কে বলেছে আমিতো জানতে চাইতে পারি? কেন তুমি কি তার সঙ্গে ঝগড়া করবে নাকি? না ঝগড়া করবনা পিসি, কিন্তু জানা দরকার কে আমার এই উপকারটুকু করল। পিসি বললেন কাল অশ্রুকণার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। কোথায়? ও আমার অফিসে গিয়েছিল। আমি অবাক হয়ে বললাম তোমার অফিসে? হঠাৎ? কেন তুমি কি কিছু সন্দেহ করছ নাকি? না পিসি সন্দেহ নয়। কাল ৩টে পর্যন্ত ও কলেজে ছিল। আমাকে বলল, একটু বিবাদী বাগ যাব যাবে নাকি?
আমি জানতে চাইলাম ওখানে কি কোন কাজ আছে? উত্তরে বলল, হ্যাঁ একজনের সঙ্গে দেখা করতে হবে। বিশেষ প্রয়োজন। উত্তরে বললাম তাহলে তুমি যাও। আমার পরের ক্লাশটা খুব ইমপর্টেন্ট। এ কথার পরে ও চলে গেল। তারপর আজ ওর সঙ্গে দেখা হয়েছে। কিন্তু কই কিছুই তো বললো না। পিসি জানতে চাইলেন তোমার সঙ্গে ওর ঝগড়া হয়েছে কি? আমি আরো অবাক হয়ে বললাম, ঝগড়া? আমার সঙ্গে? তুমি এসব কি বলছ পিসি? নীলাঞ্জনা বললেন আমি কিছু বলতে চাইনে প্রান্তিক। যা কানে আসে তাই বললাম। আরো বললেন তুমি নাকি রেহানাকে নিয়ে কোথায় গিয়েছিলে? ফিরেছে অনেক রাতে। তারপর তাকে কি সব উপহার টুপহার দিয়েছ? আমি যে এর কি উত্তর দেব বুঝতে পারছি না? বললাম অশ্রুকণা তোমাকে এই সব কথা বলেছে? আরো অনেক কথা বলেছে, আমি সে সব কথা বলতে চাইনে। তোমাদের নাকি রেজিস্ট্রেশান হয়ে গেছে, এই সব আর কি। মুহূর্ত মাথায় রাগ চড়ে গেল। অশ্রুকণা বলেছে এইসব? এত মিথ্যে? আজ রেহানাদের জন্য যা করছি অশ্রুকণাদের জীবনেও ভগবান না করুন কিছু হলে আমি আমার সাধ্যমত এই কাজই করতাম। এতটুকু বিশ্বাস নেই ওর আমার প্রতি। এত মিথ্যে বলতে ওর জিভটা আটকে গেলনা। আর রেজিস্ট্রেশান যদি করতেই হয় তবে তা গোপনে করব কেন? ভিতরটা জ্বলতে লাগল তীব্র ঘৃণায়। আর মন? চরম বিদ্বেষে পরিপূর্ণ হয়ে উঠলো অশ্রুকণার উপর। মনে মনে ভাবলাম ছিঃ, এরাই আবার সভ্যতার বড়াই করে, ভালবাসার অহঙ্কার করে। আমাকে চিন্তিত দেখে পিসি বললেন, কি ভাবছ? আমি হতাশ কণ্ঠে বললাম কিছু ভাবছিনা পিসি। শুধু মনে হচ্ছে এদের, আমি একদিন বন্ধু বলে পরিচয় দিয়েছিলাম। এতবড় ভুল আমার হলে কী করে?
তুমি রেহানাকে ভালবাসনা? জানতে চাইলেন পিসি। হ্যাঁ বাসি। তাহলে? তাহলেই কি রেজিষ্ট্রি করতে হবে? আর তুমি তা জানবেনা? তুমি আমাকে কি ভাব বলতে। পিসি আমি তোমাকে কিছুই ভাবিনা। আর তুমিতো ভালভাবে জান, যার নিজের জীবনের কোন স্থিরতা নেই তার ভাবনার কি মূল্য আছে? তারপর হঠাৎ প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বললেন, তুমি কি অশ্রুকণাকে ভালবাস না। বললাম সব ভালবাসাতো একই মানদণ্ডে বিচার হয়না পিসি। আমি যেমন রেহানাকে ভালবাসি, তেমনি অশ্রুকণাকেও ভালবাসি। আবার তোমাকেও ভালবাসি। যদি তা পাল্লায় ওজন করা হয় তাহলে নিশ্চয়ই সব ভালবাসার ওজন একই রকম হবে না। পিসি বললেন, তা হলে তো বিশ্বাস করতে হয় রেহানাকে তুমি একটু বেশী ভালবাস। তা হয়তো হবে। কিন্তু পিসি সেটা উপলব্ধির বিষয়। যুক্তিতর্ক দিয়ে তা বোঝানো যাবে না। তোমার কথাই মনে কর না পিসি, একদিন যে বিশ্বাস তুমি আমার ওপর রাখতে আজ আর তা রাখনা। কি করে বুঝলে? আমার উপলব্ধি দিয়ে। তোমার উপলব্ধি বুঝি সব। আমার যন্ত্রনার কোন মূল্য নেই তাইনা? আমি বললাম পিসি, এভাবে কোন কিছুর বিচার করা যায় না। অশ্রুকণা তোমাকে কি বলেছে জানি না। কেন বলেছে তাও বলতে পারবো না। কিন্তু তোমার যন্ত্রণা আমি বুঝি না এ তোমার ভুল। ভুল? হ্যাঁ ভুল। আর একটা কথা পিসি, আমি চিৎকার করে বলতে পারি আমার থেকে তোমাকে কেউ বেশী বোঝেনা, কেউ না। বরং তুমি আমার যন্ত্রণা কিছুই বোঝনা। বোঝবার চেষ্টাও করো না। হয়তো তোমার নিজের জীবনের কোন স্থিরতা নেই তাই। তবু যতদিন পরিমলবাবু ছিলেন, খানিকটা হয়তো বোঝার চেষ্টা করতে, আর বুঝতেও। কিন্তু এখন একদম বোঝনা। আমাকে বোঝার মতো সময়ই নেই তোমার। তবু তোমার বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নেই পিসি। যন্ত্রণায় যন্ত্রণায় যে জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে, তার কাছে কী অভিযোগ জানাবো। আমিতো জানি তোমাকে। বেশ খানিকটা উত্তেজিত হয়ে নীলাঞ্জনা বললেন কি বলতে চাও তুমি। পিসি সব জেনেও একটা মানুষ যখন সব কিছু গোপন করে চলেছেন, বার বার বলতে চেয়েও বলতে পারছেন না, তার মনের সেই অবস্থার কোন খোঁজ রাখ? বুঝতে পার সে যে কী কষ্ট? কি যেন ভাবলেন নীলাঞ্জনা। হয়তো ভাবলেন যে আমি আমার কথা বলছি। তাইতো বললেন, জানিনা তুমি কি বলতে চাইছো প্রান্তিক। আমি কি তোমার জীবনে কোন বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছি? কোন কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছি? ছিঃ, এসব কি কথা বলছ তুমি পিসি। তুমি আমায় ভালবাস। আমার জীবনের পূর্ণতা তোমার কাম্য, তুমি কেন বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে? নীলাঞ্জনা বললেন, তাহলে কি এমন গোপন কথা যা তুমি একাকী বয়ে নিয়ে চলেছে, যা প্রকাশ করতে না পারার যন্ত্রণায় তুমি গুমরে মরছো? বললাম শুনতে চাও? নীলাঞ্জনা বললেন সে তো আমি বলতে পারবো না তুমি আমাকে শুনাতে চাও কী না। তবে সেই গোপন কথা শুনিয়ে যদি তোমার যন্ত্রনা থেকে মুক্তি পাও আমার শুনতে আপত্তি হবে কেন? বুঝতে পারছি পিসি তার নিজের ভুলের জাল থেকে বেরোতে পারেননি। তার ধারণা যন্ত্রণাটা আমার নিজের আর তার জন্য দায়ী পিসি। কিন্তু এ ভুল তার ভেঙে দিতে হবে, না হলে এ ভুল বাড়তে বাড়তে এমন একটা জায়গায় পৌঁছাবে যে সেখান থেকে আর ফিরে আসা সম্ভব হবে না। বললাম, পিসি এক গ্লাস জল খাওয়াবে? এই আনি।
পিসির আনা সেই জল এক চুমুকে খেয়ে নিয়ে একটু থেমে বললাম, পিসি, নতুন করে কি জীবন আরম্ভ করা যায় না? মানে? কি হবে অতীতকে আঁকড়ে থেকে। নদীর জল কোথাও তো দাঁড়িয়ে থাকে না। তবে তুমি কেন দাঁড়িয়ে থাকবে? কেন নতুন করে স্বপ্ন দেখবেনা। বাঁচার স্বপ্ন। বেঁচে ওঠার স্বপ্ন। আমি কি মরে গেছি? না তুমি মরে যাওনি। কিন্তু স্বপ্নগুলো তোমার মরে গেছে। পিসি বললেন যা মরে গেছে কি করে আর তাকে বাঁচিয়ে তুলবো। উত্তরে বললাম যে স্বপ্নগুলো মরে গেছে আমিতো তাকে বাঁচাতে বলিনি। আমি বলেছি নতুন করে স্বপ্ন দেখতে। জীবনকে নতুন ভাবে আরম্ভ করতে। নীলাঞ্জনা বললেন, আজ আর তা সম্ভব নয় প্রান্তিক। কেন নয়? যে মন মরে গেছে তাকে কি বাঁচিয়ে তোলা যায়? আমি বললাম, মনতো তোমার মরেনি পিসি। আচ্ছাদনে ঢাকা পড়েছে মাত্র কতক গুলো বস্তা পচা আদর্শে। সত্যি কিনা বল? না সত্যি নয়। সত্যি যদি নয়, তাহলে কিসের আশায় আজো তুমি সিঁথিতে সিঁদুর দাও? কেন উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে তোমার হাতের শাখা আর এয়োতির চিহ্ন লোহা, কেন আজো একলা ঘরে ডুকরে কেঁদে ওঠো গভীর রাতে? এসব কি ভুল? তিনি যে ধরা পড়ে গেছেন একথা বুঝতে পেরে বলে ওঠেন জানিনা, কিছু জানিনা আমি বলে চলে যেতে উদ্দত হতে, আমি তার হাতটা ধরে বলি যেওনা পিসি একটু অপেক্ষা কর। আমার সব কথা শুনে যাও। উনি বললেন আমি আর শুনতে চাইনা। আমি জোর দিয়ে বললাম কেন শুনবেনা। শুনতে তোমাকে হবেই পিসি? তারপর বললাম জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অধিকার কারো নেই। তা সে যত বড়ই হোক বা অতি সাধারণ হোক। আমার বলায় এত তেজছিল যে তাকে অবজ্ঞা করতে না পেরে সামনের চেয়ারটায় বসে পড়েন নীলাঞ্জনা পিসি। আমি বলতে থাকি, পরিমলবাবুতো তোমাকে স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, তোমার সঙ্গে তিনি নিখুঁত অভিনয় করে-তোমাকে ঠকিয়েছেন। প্রয়োজনে তুমি আদালতে যেতে পার বলে জানিয়েছেন। তিনিতো ছাড়পত্র দিতে কোথাও কোন ফাঁক রাখেননি। তাহলে তুমি কেন এত ফঁক রাখছ? পিসি বললেন, ও যদি ভুল করে, তবে আমিও কি সেই একই ভুল করব? না করবেনা। কিন্তু কতদিন? যতদিন তোমার সেই মানুষটাকে ফিরে পাওয়ার আশা থাকবে ততদিন। পিসি বললেন তুমিকি বলতে চাও যে আর কোনদিন সে তার ভুল বুঝে ফিরে আসবে না? আমি দৃঢ় ভাবে বললাম না আসবে না। কি করে বুঝলে? আমি যে সব জানি পিসি। তুমি জান! কি জান তুমি? যা তুমি জানো তাই আমি জানি। তারপর বললাম পরিমলবাবু চলে যাওয়ার পরে কোন খোঁজ নিয়েছে তার? না নিইনি। কেন? দরকার মনে করিনি তাই? এও তোমার ভুল পিসি। আসলে আজো তুমি পরিমলবাবুকে ভালবাস ধ্রুব তাবাব মত। তাইতো ভয়, যদি আবার তোমার দেখা স্বপ্নগুলো বালির বাঁধের মতো ভেঙে তছনছ হয়ে যায়। তাইনা।
নীলাঞ্জনা পিসি কোন কথা বললেন না। চুপ করে রইলেন অনেকক্ষণ। আমি জানতে চাইলাম, তুমি কি জান পরিমলবাবু কোথায় গেছেন? না খোঁজ নিইনি। খোঁজ নাও। কি হবে খোঁজ নিয়ে? সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে পারবে। কাজ নেই সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। তার থেকে ও যেখানে থাকুক সুখে থাকুক। বললাম পিসি এ তোমার মহতী কথা। তোমার অন্তরের কথা নয়। তবে কি আমার অন্তরের কথা? থাক পিসি, দরকার নেই। তার থেকে কাল যাবে আমার সাথে। কোথায়? যে নারী বেঁধেছে তাকে আপন বাঁধনে, আর ভ্রান্ত পথিক খুঁজে পেয়েছে তার আপন পথ। যাবে সেখানে। তুমি চেন নাকি তাকে? না চিনতামনা। তবে যে দিন পরিমলবাবুর ছাড়পত্র এলো তোমার কাছে সেদিনই তাকে জেনেছি। তুমি হেরে গেছে তার কাছে, সব দিক দিয়ে হেরে গেছে পিসি। তুমি হারিয়েছে তার স্ত্রীর অধিকার, তার ভালবাসার অধিকার, এমনকি তার প্রেমিকার অধিকারও। কোন দিনই আর তিনি ফিরে আসবেন না তোমার কাছে। তাহলে কেন এই পথ চাওয়া? তাই বলছিলাম পিসি জীবন থেকে যে হারিয়ে গেছে, তাকে হারিয়ে যেতে দাও। খ্যাপার মতো পরশ পাথর খুঁজে ফিরো না।
এতগুলো কথা একসঙ্গে বলে আমি থামলাম। পিসি চুপ করে বসে আছেন। আকাশ পাতাল ভাবছেন হয়তো। তাকে বিরক্ত না করে আমি উঠে গেলাম। গ্যাস জ্বালিয়ে কফি বানালাম, তারপর তার দিকে এক পেয়ালা এগিয়ে দিয়ে বললাম, দুঃখ করোনা পিসি। সে দিনের দক্ষিণেশ্বরের সেই ঘটনা মনে আছে তো? আশ মিটলে তো ফুরিয়ে গেল। আর দামিনীর সেই অবিস্মরণীয় উক্তি। সাধ মিটিল না। আর এই খানেইতো রয়েছে বার বার ফিরে আসার অঙ্গীকার। একটু থেমে বললাম যুঁথি কেন তার দাবি ছেড়ে দেবে তোমাকে? তার দাবিতে তোমারও আগে। বরং বলতে গেলে, তোমার সঙ্গে সম্পর্কের কোন আইন গত স্বীকৃতি নেই। বড় জোর একসঙ্গে কিছুদিন কাটাবার স্মৃতি ছাড়া তোমার দাবি করাব মততে কিছু নেই পিসি। যুঁথি তাব বিবাহিতা স্ত্রী। সব জেনে বুঝে তবেই তো পরিমলবাবু আনতে চাননি তোমার মাধ্যমে তাব কোন উত্তবাধিকার। তোমার যে সে ক্ষমতা নেই, এও এক নিখুঁত অভিনয় মাত্র। আব তুমি এমন এক বোকা মেয়ে যে ভালবাসার নেশায় সুব বিশ্বাস করে বসে আছে। তীব্রভাবে প্রতিবাদ করে পিসি বললেন, তুমি চুপ কর তুমি কি বলছ তুমি নিজেই জানো। আমি কোন রকম প্রতিবাদ না কবে বললাম, তোমার কথা যদি সত্যি হতো আমার থেকে খুশী কেউ হতো না পিসি। কিন্তু তা যে হওয়ার নয়। কাবণ, একদিন নিজের পরিচয় গোপন করে গিয়েছিলাম যুঁথিব কাছে, কিন্তু সে সব কথা বলাব সময় পেলামনা পিসি, সেদিনইতো তুমি পেয়ে গেছে তোমাব ছাড়পত্র।
এসব নতুন, একেবাবে নতুন নীলাঞ্জনার কাছে। ভাবতেও পাবেননি কখনো, পবিমল এমন বেইমান হতে পারে। আমি তো তাকে নতুন কাউকে ঘরে আনতে বলেছিলাম, তবে এ মিথ্যার আশ্রয় নিল কেন সে বুঝতে পাবছি পিসির গলা কাঁপছে। তবু তিনি বললেন, তুমি এসব সত্যি কথা বলছতো প্রান্তিক? না আমাকে পরীক্ষা করছ? এখনো সন্দেহ। আমি মরমে মরে গিয়ে বললাম, বহুবার বলব বলব করেও বলতে পারিনি পিসি। আজ বলতে পেরে নিজেকে ভারমুক্ত মনে হচ্ছে। নীলাঞ্জনা পিসি এরপর উঠে গেলেন। আমি আর তাকে বাধা দিলাম না। ওর এখন একা থাক ভীষণ দরকার। একেবারে একা। নিজেকে নিয়ে ভাবার জন্য এই একাকীত্ব তার খুবই প্রয়োজন।
কয়েকদিন পরে কলেজ গেটে একটা জটলা দেখে এগিয়ে যাই। কে যেন বলল, কলেজের একটা মেয়ে বাসে চাপা পড়েছে। তাকেই নিয়ে আসা হয়েছে কলেজ গেটে। ভাবলাম, মেয়েটাকে তো হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল। কলেজ গেটে কেন? গিয়ে। দেখি রক্তে মাথামাখি। কে মেয়েটি? আসার পথেই শুনতে পেলাম, অশ্রুকণা। ওকে নিয়ে এত জটলা, কিন্তু কারও একে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা মনে পড়ছেনা। আমি একটা ট্যাক্সি ডেকে ওকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। আমার সঙ্গে আরো দুটি ছেলে এবং রেহানা। ওর শরীর এখনো ঠিক হয়নি, বললাম, তুমিতো না গেলেও পারতে। কি দরকাব। এ টেনশন তুমি সহ্য করতে পারবেনা। রেহানা আমার কথা শুনলো, কিন্তু যাওয়া বন্ধ করল না।
হাসপাতালের এমারজেন্সীতে সেই সময় কোন ডাক্তার নেই। কয়েকজন স্টুডেন্ট তখন আউটডোরের দায়িত্বে আছেন। অশ্রুকণাকে নিয়ে গেলে, তারা এক বার দেখেই মেঝেতে ফেলে রাখলেন। বললাম, ওকে ওই ভাবে ফেলে রাখলে চলবে কেন? ওরতো চিকিৎসা দরকার। ছেলেরা বললেন স্যার আসুক। তারপর চিকিৎসা হবে। বললাম অপূর্ব। রোগী মারা গেলে কি আপনাদের স্যার আসবেন। এখনি ডাকুন তাকে। আগে ওর চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন। ওরা নির্বিকার ভাবে বললেন স্যারের একটু দেরি হবে। মাথা ঠিক রাখতে পারলামনা, বললাম, কেন দেরি হবে? সে কৈফিয়ৎ কি আপনাকে দিতে হবে? অবশ্যই দিতে হবে। আপনারা পেয়েছেন কি? এই জন্যই হাসপাতালে রোগীর বাড়ীর লোকেরা হঠাৎ হঠাৎ ডাক্তারদের আক্রমণ করে বসেন। ছেলেরা বললেন, আপনাদের তাড়া থাকলে আপনারা অন্য কোথাও নিয়ে যান। কেন অন্য কোথাও নিয়ে যাব কেন? আপনাদের স্যার। সরকারের কাছ থেকে মাইনে নেন না? কৈফিয়তের উত্তর আমরা দিতে পারব না। দিতে পারবেন না মানে, দিতে হবে। মনে রাখবেন আপনারা যারা ছাত্র, আপনাদের পিছনে সরকার যে অর্থ ব্যয় করেন সে অর্থ আমরা দিই। আমাদের টাকায় আপনাদের ডাক্তার হওয়া। আর আমাদের অবহেলা? পাঁচ মিনিট সময় দিচ্ছি, এর মধ্যেই আপনাদের স্যারকে যেখান থেকে পারেন ধরে নিয়ে আসুন। ওরা নির্বিকার ভাবে বললেন ওর সময় হলেই আসবেন। সেই একই রেকর্ড বাজানো। আমি আর পারলামনা। যে ছেলেটি তর্ক করছিলেন তার হাতটা ধরে ঝাঁকানি দিয়ে বললাম পেয়েছেন কি? হাত ছাড়ুন। ছাড়ব তার আগে চলুন আমার সঙ্গে দেখিয়ে দিন কোথায় আপনার স্যার, আমিই তাকে ডাকবো। আমার ওই চেঁচামেচিতে অনেকে জড়ো হয়ে গেছেন সেখানে। রেহানা বোধ হয় ভয় পেয়েছে সে আমার একটা হাত ধরে বলল, ওকে ছেড়ে দাও প্রান্তিক। কি ছেলেমানুষী করছ। না আমি ছাড়বনা, আগে ওকে ওর স্যারকে ডেকে নিয়ে আসতে হবে তবে ছাড়া পাবেন। পেয়েছেন কি এরা? রোগী। মরবে বিনা চিকিৎসায়, আর এরা গুলতানি করবে, এরাই কি আমাদের ভবিষ্যৎ? ছেলেটি জোর করে আমার হাত থেকে তার হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন, আপনি কোথাকার নবাব মশাই, জানেন আপনার এই অভব্য আচরণের জন্য আপনাকে পুলিশে দিতে পারি। বললাম তাই নাকি। বেশ ডাকুন আপনার পুলিশকে। আমিও আপনাকে বলছি, প্রয়োজনে আপনার ডাক্তারী পড়া আমি চিরতরে ঘুচিয়ে দিতে পারি, একথাটাও সেই সঙ্গে মনে রাখবেন। আমার মাথায় যেন তখন আগুন জ্বলছে।
এতক্ষণে ঐ দিনের কর্তব্যরত ডাক্তার ডাঃ বল এলেন। এসেই বললেন, কি হয়েছে এত জটলা কেন? আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম, আপনিই তাহলে ডাক্তার? আউটডোর ছেড়ে কোথায় ছিলেন এতক্ষণ? সে কৈফিয়ৎ কি তোমাকে দিতে হবে ছোঁকরা? বললেন ডাঃ বল। হ্যাঁ, আমাকেই দিতে হবে, কারণ রোগী নিয়ে এসেছি আমি। ডাঃ বল ছেলেদের কাছ থেকে কি শুনলেন তা উনিই জানেন। বললেন ঐ রোগী পরে দেখা হবে। আর ইমার্জেন্সীতে কর্তব্যরত গ্রুপ ডি স্টাফদের বললেন, এদের এখান থেকে চলে যেতে বল। কেউ যেন এখানে কোন ঝামেলা না করে। আর যে রক্ষীবাহিনী থাকে তাদের নির্দেশ দিলেন, বাড়াবাড়ি করলে লাঠি চালাতে পিছপা হবেন না। অপমানের জ্বালায় জ্বলতে লাগলাম আমি। রেহানাকে বললাম, সুমিত ও স্নেহাংশু আছে, তোমরা এখানে থাক, আমি আসছি। সুমিত বলল, কেন যে মাথা গরম করলি প্রান্তিক। এখনতো এদের দয়ার অপেক্ষা করতে হবে। আমি বললাম ঠিক আছে। তোরা এখানে থাক। রেহানাকে বললাম তোমার কাছে টাকা আছে? ও আমাকে ব্যাগ থেকে বের করে ১০ টাকা দিল। আমি বললাম, আমি আসছি। বেশী দেরি হবে না।
বাইরে গিয়ে মিনতি সেনকে ফোন করে সব জানালাম। বললেন সেকি! ওরা কি মানুষ? ঠিক আছে তুমি কলেজের বাইরের গেটে দাঁড়াও। আমি পুলিশ কমিশনারকে নিয়ে এখনি আসছি। কত সময় লাগবে? না সময় লাগবেনা। ওঁর সঙ্গে আমার একটা এপয়েন্টমেন্ট আছে। মিনিট পাঁচেকেব মধ্যেই উনি আসবেন। এলেই আমি নিয়ে আসছি। তুমি অপেক্ষা কর। এরপর অশ্রুকণাদের বাড়ীতে একটা ফোন করলাম।
সত্যি ১০ মিনিটের মধ্যে মিনতি পিসি এলেন। সঙ্গে একজন পুলিশ অফিসার, নিশ্চয়ই পুলিশ কমিশনার। মিনতি সেন পরিচয় করিয়ে দিলেন কাকাবাবু এই সেই প্রান্তিক। আমি প্রণাম করলাম কমিশনার সাহেবকে। তিনি সংক্ষেপে আমার কাছ থেকে জেনে নিলেন ব্যপারটি। পুলিশ কমিশনাব সোজা সুপারিনটেনডেন্টের ঘরে গিয়ে আজকের ঘটনা তাকে অবহিত করে সুবিচাব দাবি করলেন। উনি নিজে উঠে এসে ডাঃ বলকে বললেন, আপনি ডিউটি আওয়ারে কোথায় গিয়েছিলেন? সঙ্গে পুলিশ কমিশনার পাশে আমি, ডাঃ বল একটু ঘাবড়ে গেলেন। তিনি আমতা আমতা করে যা বললেন, তাতে সুপারিনটেনডেন্ট মোটের উপর সন্তুষ্ট হলেন না। বললেন, ঐ রোগীকে বাদ দিয়ে আপনি অন্য রোগী দেখছেন কেন? মানুষের জীবন নিয়ে এই ছেলেখেলা করার অধিকার আপনাকে কে দিয়েছেন? মনে রাখবেন আপনি ডাক্তার, মানুষের সেবাই আপনার ধর্ম। যদি তা পালন করতে না পারেন কি দরকার এই লাইনে আসা। আর ছেলেদের উদ্দেশ্যে বললেন তোমরা ছাত্র। জান কি তোমাদের এক একজনকে ডাক্তার বানাতে সরকারের কত ব্যয় হয়? এবং সরকাবকে সেই টাকা দেন সাধারণ মানুষ। তোমরা প্রত্যেকে সাধারণ মানুষের কাছে দায়বদ্ধ, ভবিষ্যতে তোমাদের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ শুনলে, তোমাদের কলেজ থেকে বের করে দিতে বাধ্য হব। তাবপর ডাঃ বলকে বললেন, রোগীর যা যা করণীয় তাই করুণ। আলাদা কেবিন অ্যারেঞ্জমেন্ট করে নিয়মিত আমাকে সংবাদ দিয়ে যাবেন। দেখবেন রোগীর যেন কোন অযত্ন না হয়। তারপর পুলিশ কমিশনারকে বললেন, আমি দুঃখিত। আপনাকে কষ্ট করে ছুটে না আসলেও চলত। একটা ফোনই যথেষ্ট। পুলিশ কমিশনার সে কথায় কোন ভ্রুক্ষেপ না করে বললেন ধন্যবাদ। চলি, আশা রাখব আর কোন অসুবিধা হবে না।
০৭. রেহানা এসে দাঁড়ালো
রেহানা এসে দাঁড়ালো মিনতি সেনের পাশে। বলল, আপনি ভাল আছেন তো? হারে মেয়ে হ্যাঁ। কবে আসছিস? আপনি কবে আসবেন? আমাকে ডেকে মিনতি সেন বললেন, তুমি কাল একবার আসতে পারবে? যাব। তারপর পুলিশ কমিশনারকে বললেন, এই মেয়েটিই রেহানা। আপনাকে এর কথাও বেশ কয়েকবার বলেছি। কোন ব্যাপারে যেন? আপনি সব ভুলে যান। কমিশনার সাহেব প্রান খুলে হেসে বললেন তোর এই বকুনিটুকু আমার এত ভাল লাগে যে, বার বার তোর বকুনি খেতে ইচ্ছে করে। তারপর নিজেই বললেন, ঐ ডালিমের কেসটা নিয়েতো। তারপর রেহানার চিবুকটা একটুখানি নাড়িয়ে দিয়ে বললেন, তুমি ভেব না মামনি। মিনতি যখন তোমাদের সহায় ভগবানেরও সাধ্য নেই তোমাদের হারায়। তারপর মিনতি সেনকে তাড়া লাগিয়ে বললেন চল চল দেরি হয়ে যাবে। আর একটা কথা, বলে আমাকে ডেকে নিলেন কাছে, বললেন হয়তো কোন অযত্ন হবে না, তবু তুমি আমাকে নিয়মিত সংবাদ জানাবে। আমার ফোন নাম্বার জানতো। বললাম জানি। ওরা বেরিয়ে গেলেন।
না অশ্রুকণার চিকিৎসার কোন অসুবিধা হয় নি। আলাদা কেবিন। বিশেষ খাতির করে দুবেলা দেখা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের যা যা করণীয় সবই করছেন ঘড়ির কাটার সঙ্গে সময় মিলিয়ে। আমি বোজ আসতে পারিনি, কিন্তু রেহানা এসেছে রোজ। ওর কাছ থেকে সংবাদ নিয়েছি। যেদিন ওকে ছেড়ে দেবে রেহানা বললো আজো তুমি যাবে না? না রেহানা তুমি যাও। এ তোমার ঠিক হচ্ছে না প্রান্তিক। আর এসবের মানে আমি যদি ভুল করি তা হলে তুমি এই রকমই করবে তাইতো। তুমি জানো রেহানা অশ্রুকণা যা করেছে তা ক্ষমার অযোগ্য। জানি আমি। না জানো? রেজিষ্ট্রি করে আমায় বিয়ে করেছে এইতো। হাসতে হাসতে বলল রেহানা। আমি রেগে গিয়ে বললাম এটাকে তুমি সামান্য অপরাধ বলে মনে কর? না করিনা। এটাকে আমি অসামান্য অপরাধ বলেই মনে করি, যদি বলে থেমে গেল রেহানা। থামলে কেন? বল না যদি কি? ও বলল থাক না, যা মিথ্যা, তাতো সত্যি হবে না কোন দিন, কি দরকার ও নিয়ে মাথা ঘামাবার। তাছাড়া অশ্রুকণা এজন্য খুব অনুতপ্ত। এই এ্যাক্সিডেন্ট নিয়ে ওরও একটা নতুন অভিজ্ঞতা হয়েছে, তাছাড়া সত্যি কথা কি জান? কি? আমি তাকালাম ওর দিকে। ও বলল, ও তোমাকে ভালবাসে প্রান্তিক ভীষণ ভালবাসে। আসলে ঘটনা চক্রে যাই ঘটুকনা কেন, এবং যে ভাবেই তার প্রচার হোক না কেন, আমি যে তোমার সঙ্গে বেরিয়েছিলাম, এবং অনেক রাতে ফিরেছিলাম, এটাকে ও কোন ভাবে মেনে নিতে পারেনি। তাই রাগের মাথায় ও সব কথা ও বলে ফেলেছে। আমি বললাম কাকে বলেছে জান? জানি। কাকে? তোমার পিসিকে তো। তুমি কি করে জানলে? বা, হাসতে হাসতে রেহানা বলল, রেজিস্ট্রি করে বিয়ের কথা যখন বললাম তখনতো জিজ্ঞাসা করলেনা কার কাছে শুনেছি। আর অনেক রাতে ফেরার কথা শুনে জানতে চাইছ কার কাছে শুনেছি?
আমি বললাম ঐ ভাবে ব্যাখা করছ কেন রেহানা। আসলে পিসির কাছে যে দিন শুনলাম অশ্রুকণা এইসব কথা বলেছে, রাগে আমি জ্বলতে লাগলাম। প্রতিজ্ঞা করলাম ওর সঙ্গে জীবনেও আর কথা বলবনা। হাসতে হাসতে রেহানা বলল, অথচ দেখ, ওকে নিয়ে সবাই যখন জটলা করছে, তখন কেবল তুমিই বুঝতে পারলে ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া দরকার। তারপর সেই হাসপাতাল কাণ্ড, এতো আমাদের জীবনের অক্ষয় সম্পদ। নাতি নাতনিদের সঙ্গে গল্প করার বিষয় কি বল? আমি ভীষণ চেষ্টায় হাসি দমন করতে গিয়েও পারলাম না। বললো হাসলে যে বাঃ হাসবনা, তোমার স্বপ্ন কত দিগন্ত বিস্তৃত। আগেতো ছেলে মেয়ে তার পরতো নাতি নাতনি। কিন্তু তার আগে দরকার বিয়ে। সে সামাজিক হোক বা রেজিস্ট্রি তাই না? যা অসভ্য কোথাকার। বলে দ্রুত পালিয়ে গেল।
অশ্রুকণার বাবা, বাইরে আছেন, ওর মা বলেছেন, বাবা প্রান্তিক, ভর্তিতে তুমিই করে ছিলে, ওকে রিলিজ করেও তুমিই বাড়ীতে পৌঁছিয়ে দিও। এই দায়িত্ব তোমাকেই দিয়ে যাচ্ছি। আচ্ছা মাসিমা ঠিক আছে।
ভেবেছিলাম রেহানাকে পাঠাবো। আমি যাব না। কিন্তু রেহানার এতগুলো কথার পর যদি না যাই, রেহানা বলবে অশ্রুকণার প্রতি তোমার ভালবাসা এত গভীর যে, অভিমানের উর্ধে উঠতে পারলে না। কিন্তু একি। ওযে আসছেই না। কে জানে কখন আসবে?
হঠাৎ দেখি সেলিনা আসছে। আবদার করে বলল চলুন না প্রান্তিক ভাই এটুকুতো মাত্র পথ হেঁটেই যাইনা। মন্দ হয় না বললাম আমি। আরো বললাম তোমার শরীর কিন্তু এখনো ঠিক হয়নি সেলিনা, কষ্ট হবে। তুমি নিশ্চয়ই জান অশ্রুকণাকে নিয়ে আসতে হবে। ওরা হয়তো অপেক্ষা করে থাকবে আমার জন্য। হঠাৎ সেলিনা বলল, আচ্ছা প্রান্তিক ভাই, অশ্রুকণাদি যদি জিজ্ঞাসা কবেন, এ কে? আপনি কি পরিচয় দেবেন? তোমার যা পরিচয়? কি আমার পরিচয়? মৃদু হেসে বললাম সে যখন কেউ জিজ্ঞাসা করবে উত্তরটা তাকে দেব। অশ্রুকণাকি চেনেনা তোমাকে? না জানেনা তুমি কে? হঠাৎ ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, আমার সঙ্গে কথা বলতে আপনার খুব কষ্ট হয় তাইনা? ভাবতে পারছি না ওকি বলতে চায়। কেন যে ও এল আমার সাথে, আর এলই যদি তবে ওর যা সাধারণ পোষাক তাই পরে এলোনা কেন? কি দরকার ছিল মিনতি সেনের দেওয়া এই রাজকীয় পোষাক পরার। এটাকি ছেলে মানুষী না শুধুই খেয়াল, অথবা অন্য কিছু। হল না বাসে বা ট্রামে ওঠা বাধ্য হয়ে হাঁটতে হাঁটতে আসতে হল এ পথটুকু ওর সাথে। যে কারণেই হোক ওর ইচ্ছে যে পূর্ণ হয়েছে এতে যে ও আনন্দিত তা ওর শারীরিক ভাষায় বোঝা গেলেও মুখে কিছু বললনা। তারপর হাসপাতালের যাবতীয় দেনা পাওনা মিটিয়ে দিয়ে আমি যখন অশ্রুকণার কাছে এসে দাঁড়িয়েছি ও আমার দিকে তাকিয়ে ঝবঝর করে কেঁদে ফেলল। এতটা বোধ হয় সেলিনাও ভাবেনি। ও তাই অশ্রুকণার কাছে গিয়ে বলল, একি অশ্রুদি, এখনকি ভেঙে পড়ার সময়? মনকে দৃঢ় করুন। আঘাতকে গ্রহণ করুন সহজ ভাবে। আমি অবাক হয়ে তাকাই সেলিনার দিকে। এত দিনে বুঝেছি যে সেলিনাব ভিতর আছে এক কৌতুক প্রিয় আর সংবেদনশীল মন। তাই তো ওর পক্ষেই বলা সম্ভব ছিঃ অশ্ৰুদি এটাকি কান্নার সময়? জীবনে কত পথ পাড়ি দিতে হবে দুর্গম না সহজ আমরা কি জানি? তাই আর কান্না নয়। দাঁড়ান সোজা হয়ে। এবং তারপর, নিজের দামী শাড়ীর আঁচল দিয়ে মুছিয়ে দিল ওর চোখের জল। আমার দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় জানতে চাইল ওর পরিচয়। বললাম একেতো তোমার না চেনার কথা নয়, এ সেলিনা রেহানার বোন। সেলিনা। নামটাকে ও মনে করতে পারছে কীনা বোঝ গেলনা। সেলিনা হেসে বলল চিনতে পারছেন নাতো একটু মনে করার চেষ্টা করুন ঠিক চিনতে পারবেন। অশ্রুকণা তবুও মনে হয় চিনতে পারলনা। তারপর বললাম ওকে যে চিনতেই হবে তার কি কোন মানে আছে? সবাই কে কি আমরা চিনি? অশ্রুকণা মনে মনে ভাবে, প্রান্তিক যাই ভাবুক। যে ভাবেই আমার না চেনাটাকে ব্যাখ্যা করুক একথাটা মানতে হবে যে, সেলিনা নামের এই মেয়েটিকে যদি আমি না চিনতাম, তাহলে কিছুতেই ও নিয়ে আসতোনা। তাছাড়া ও যে রেহানার বোন সে পরিচয়ও তো দিয়েছে প্রাভিক। এরপরে তার অবশ্যই চেনা উচিৎ ছিল। কিন্তু কেন যে কিছুতেই মনে করতে পারছেনা। নিজের স্মৃতি শক্তির উপর খুব রাগ হয় অশ্রুকণার। সেলিনা বলল, বেশ গরম আইসক্রিম খাবেন? আমি হেসে বললাম গরম কোথায়? এখনতো ঠান্ডা পড়ে গেছে বলা যায়। তুমি খেতে পার আমি খাব না। আর আপনি অদি। অনেক আশা করে তাকালো ওর দিকে। অশ্রুকণা বলল, প্রান্তিক তিনটে আইসক্রিম নিয়ে এসো না। তিনটে কেন? বা আমরা তো তিনজন না? আমিতো খাব না বলছি। সেলিনা বলল এ আপনার ভীষণ বাড়াবাড়ি প্রান্তিক ভাই। আপনি খাবেন না। বেশ তো। কিন্তু খাবেন না একথাটার পরে এত জোর দিচ্ছেন যে, আমাদের খাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও তা বন্ধ করে রাখার আপ্রাণ প্রয়াস। মেয়েটির চতুরতাকে প্রশংসা না করে উপায় নেই। বললাম, ঠিক আছে তোমরা একটু অপেক্ষা কর, আমি যাব আর আসব। আমি যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছি হঠাৎ দেখি অশ্রুকণা সেলিনাকে তার নিজের বুকের পরে টেনে নিয়ে বলছে। আমাকে ক্ষমা করো সেলিনা তোমাকে চিনতে না পাবার জন্য। এবার কি তবে চিনতে পেবেছেন? হাসি মুখে বলল সেলিনা। অকশা বলল, তোমাকে চেনা যে অতি কঠিন কাজ একথা বহুবার শুনেছি প্রান্তিকের কাছে, মন তোমার চির সবুজ, হৃদয় যেন এক স্রোতস্বিনী নদী। হেলায় জয় করতে চাও দুনিয়াকে, নিজেকে নিঃস্ব করে বিলিয়ে দেওয়াতেই তোমার আনন্দ। আরো যেন কি সব বলতে যাচ্ছিল অশ্রুকণা–। তাকে বাঁধা দিয়ে সেলিনা বলল, দাঁড়ান অশ্ৰুদি, এভাবে প্রশংসা বা নিন্দা যাইই করুন না কেন, তা দিয়ে আমাকে চিনবেন কি করে? তারপর বলল প্রান্তিক ভাই কি জানি কি বলেছেন তার ব্যাখা উনি দিতে পারবেনা। কিন্তু আমি যে, এতদিন পথ চললাম ওর সাথে, আজো চিনতে পারিনি ওকে একটুও, তা সে সত্য বা মিথ্যে যাই হোকনা কেন। তারপর হেসে বলল, এই দেখুন না, এই গোলাপটি আজইতো তার নিজের হাতে পরিয়ে দিয়েছেন আমার বেনীতে, হয়তো আপন খেয়ালে, অথবা অনুরোধ এড়াতে পারেননি তাই, কিন্তু কৃতজ্ঞতা স্বরূপ বিধর্মী হয়েও ওর পায়ে যে মাথা নোয়ালাম অথচ একবারও বললেন না, সেলিনা তোমাকে আমি ভালবাসি, তাই তো এই সুন্দর গোলাপটিকে তার যোগ্য স্থানে রাখতে পেরে নিজেকে ধন্যমনে করছি। কি নিষ্ঠুবতা। কি অপমান! এবার আপনিই বলুননা অশ্রুদি, একি অপমান নয়? সুন্দরকে যদি যোগ্য মর্যাদাই না দিতে পারবেন তবে আর তার আরাধনা কেন?
অবাক হয়ে শোনে অশ্রুকণা আর নিবিষ্ট মনে ভাবে সেলিনার কথা, কি অকপটতা। যেন কোন গ্লানি নেই। যেন কোন মন্দ তাকে স্পর্শ করতে পারে না। ওর কথায় একটু খানি হেসে অশ্রু আমাকে বলল, যাও প্রান্তিক তাড়াতাড়ি নিয়ে এসো। তারপর সেলিনাকে বললো, এসো ভাই একবার আমার কাছে, আমি রেহানা নই, আমি তোমার মত অসামান্যও কেউ নই। অকুশার চোখ দুটি ছলছল করে উঠলো। এই দুই নারীর নিজস্ব আদান প্রদানে আমি আর কেন স্বাক্ষী হয়ে থাকি। বেরোতে হবে। ট্যাক্সির মিটার উঠছে। যদিও মাসীমা, মানে অশ্রুকণার মা, টাকা দিয়ে দিয়েছেন। আমি ওদের আবেগ ধারায় কোন ছন্দ পতন না ঘটিয়ে আইসক্রিমের জন্য বেরিয়ে পড়লাম।
সেলিনা বলল, দিদি আমি পৃথিবীকে সোজাসুজি দেখতে ভালবাসি। কারো করুণার প্রত্যাশা আমি কোন দিনই করিনা। তবু আমার জীবনে আলোড়ন তুলে এলেন এই প্রান্তিক ভাই। তারপর অশ্রুকণার দিকে তাকিয়ে বলল, না না ভুল বুঝবেন না, আমি আপনাদের মত করে কোন দিনই চাইনি ওকে। এরপর বলল আপনিতো স্পষ্ট করে বলছেন আপনার কথা, আর রেহানা? নিজের কথা কোন দিনই সে বলতে পারবেনা কাউকে। আপনি ওকে ঠিক বুঝেছেন, অন্যের জন্য ও সরে দাঁড়াবে, তবু নিজের দাবি পেশ করবেনা কোন দিন। কান্নতেই বোধ হয় ওর আনন্দ। আর দেখুননা প্রান্তিক ভাইয়ের ব্যাপার, ও কি বোঝেনা রেহানা ওর কাছে কি চায়? কে পারে নিজেকে এমন নিঃস্ব করে তুলে ধরতে। তবু কি কঠিন হৃদয়? একবারও বলতে পারলেন না। না হয় মিথ্যে করেই বলতেন, রেহানা আমি তোমায় ভালবাসি। একটু থেমে বলল, রেহানার বুকে ঈর্ষার আগুন জ্বালতে আমিও কম চেষ্টা করিনি, যাতে অন্তত ও যা চায় তার উপর অধিকার দাবি করতে পারে। কিন্তু সবই নিষ্ফল অশ্ৰুদি, আজ তাই আর একবার চেষ্টা করছি, দেখি যদি ওর মনের দরজা খোলে তাতে। তারপর কি ভাবতেই সেলিনা বলল, আমার পরে রাগ করলেন অদি? কেন বলত। আমার স্বার্থপরতায়। তোমার স্বার্থপরতায? হ্যাঁ, আমার স্বার্থপরতায়, কারণ আমি জানি রেহানার থেকে আপনিও কম ভালবাসেন না প্রান্তিক ভাইকে। অথচ সেই আমি রেহানার হয়ে ওকালতি করে যাচ্ছি, একি আমার স্বার্থপরতা নয়? অশ্রুকণা আবারও ওকে তার বুকের পরে টেনে নিয়ে বলল, তোমার মতন স্বার্থপর একটা বোন যদি আমার থাকতো। সেলিনা বলল আমাকে কি আপনি তাই ভাবতে পারেন না, না পারিনা। কেন? কোন বোনকি তার দিদিকে আপনি বলে? সেলিনা বলল, আমার অন্যায় হয়েছে, এই কান ধরছি, আব হবে না। তারপর দুজনেই খিল খিল করে হেসে উঠলো। দু জনের চোখেই জল দেখতে পেলাম।
আমরা যখন অশ্রুদের বাড়ী পৌঁছালাম তখন প্রায় ৯টা বেজে গেছে। সেলিনাকে নিয়ে আবার এতটা পথ পাড়ি দিতে হবে। স্নেহময়ী দেবী সেলিনাকে বললেন, তুমি মা আসবে একটু আমার ঘরে? সেলিনা ওই ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেলে, অশ্রুকণা বলল, আমায় কি তুমি ক্ষমা করতে পারবেনা প্রান্তিক? কেন বলত। বা আমি যা করেছি তাতে তোমার অজানা নয়, এবার তুমিই বল সেটা অন্যায় নয়? কিসের অন্যায়? আর তাছাড়া তুমিতো অন্যায় জেনে কিছু করনি? কিন্তু আমি যে মিথ্যে কথা বলেছি। জেনে তো মিথ্যে কথা বলনি আর না জেনে যদি কিছু করে থাক, তাতে অন্যায়টা কোথায়? প্রান্তিক তুমি মানুষ না দেবতা? এভাবে কথা বলছ কেন? দেখ আমি এক অতি তুচ্ছ মানুষ মাত্র। আমার রাগ আছে, অভিমান আছে আছে হিংসা দ্বেষ বিদ্বেষ ঈর্ষা। আছে চাওয়া পাওয়া রক্ত মাংসের কামনা বাসনা সবই, শুধু পার্থক্য কি জান? কি? বলে তাকালো আমার দিকে আমি বললাম, আমার কথা আমি প্রকাশ করতে পারি না। কেন পারনা? কেন তুমি তোমার দাবিকে জোর করে ছিনিয়ে নিতে পারনা? কেন পারনা বলতে তোমার একান্ত প্রিয়জনকে যে আমি তোমায় ভালবাসি। তোমাকে আমি চাই। তোমার জন্যই আমার বেঁচে থাকা, তোমার জন্যই আমার স্বপ্ন দেখা। বললাম, দেখ কণা, যত সহজে তুমি একথা বলতে পারছ, আমি তা পারিনা। কেন পার না? কেন এত ভীরু তুমি? সে তুমি বুঝবেনা কণা। তারপর বললাম আচ্ছা আজ যদি আমি তোমায় বলি, কলা চল আমরা হারিয়ে যাই, পারবে হারিয়ে যেতে? ও আমার একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে তুলে নিয়ে বলল, না আজ আর তা পারবো না। এরপর একটা দীর্ঘশ্বাস টেনে নিয়ে বলল, কিন্তু একদিন এই আমিই তোমার সাথে হারিয়ে যেতে চেয়েছিলাম যেখানে খুশী। সেদিন যদি তুমি বলতে, চল নরকে যাই, আমার হাসিমুখে তোমার সাথে নরকে যেতেও কোন আপত্তি হতো না। ওর কথা মনোযোগ সহকারে শুনে বললাম, তবে আজ অসুবিধা কোথায়? অসুবিধা যে কোথায় সেকি তুমি জানো? না আমাকে তুমি পরীক্ষা করতে চাইছো? পরীক্ষা? আমি কি তত বড় মানুষ যে তোমাকে পরীক্ষা করার অধিকার আমার আছে? যাক ও সব কথা। একটা কথা জিজ্ঞাস করব? সত্যি কথা বলবে? মৃদু হেসে বললাম, নিশ্চয়ই বলব, বল কি জানতে চাও। কে তোমার মন জুড়ে। বসে আছে রেহানা না সেলিনা? আমি রেগে গিয়ে বললাম, কণা? ও বলল, রাগ করছ কেন প্রান্তিক। আমি জানি, আমিতো মেয়ে, একজন মেয়ে হিসাবে পুরুষের চোখের ভাষা যেটুকু বুঝি, তাতে রেহানা আছে তোমার সমস্ত অন্তর জুড়ে, আর, আর কি? আর সেলিনা আছে তোমার স্বপ্ন হয়ে–এক পলকে যে আমার মত মেয়েকে জয় করে নিতে পারে, তোমার পৌষ তাকে অস্বীকার করবে কি করে প্রান্তিক? জানি, তোমার জীবন আজ এক কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন, ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি তুমি যেন পথ খুঁজে পাও, তুমি যেন জয়ী হও।
কি যে হল আমার কে জানে? সেলিনাকে তো কখনো এ ভাবে ভাবিনি আমি। অনেক দুর্বল মুহূর্ত যে আসেনি জীবনে তা নয়। তবু এমন করে কেউতো আমাকে এই পরীক্ষার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় নি, যেমন করে দিয়েছে অশ্রুকণা। তবু মনেব দ্বিধাকে অস্বীকার করার জন্য বললাম, জানিনা কণা, কে আমাকে বেশী টানে, তুমি না রেহানা? সেলিনা না নীলাঞ্জনা, জানিনা আমি কিছু জানিনা। আমি এক দিকভ্রান্ত পথিক। কোথায় যে যাব তাইতো জানিনা, আমি যে কেমন করে কখন আমার ঠিকানা হারিয়ে ফেলেছি তাইতো জানি না। আর এও জানিনা কে আমাকে পৌঁছে দেবে সেই হারানো ঠিকানায়। অবাক আর বিস্ময় ভরা দুটি চোখ তুলে তাকালো অশ্রুকণা আমার দৃষ্টি কে অনুসরণ করে। পারলাম না। ওর মত অপলক তাকিয়ে থাকতে। তখন আমার হাতখানা নিশিন্ত আশ্রয় নিয়ে আছে তার হাতের মধ্যে। ঠিক সেই সময় খাবার, আর কফির পেয়ালা নিয়ে পাশে এসে দাঁড়ালো সেলিনা আর তার পিছনে ওর মা। হাতখানা ছিনিয়ে নিলাম ওর হাত থেকে। সেলিনার দিকে তাকিয়ে বললাম রাত হয়েছে অনেক, এবার যেতে হবে সেলিনা। হাসি হাসি মুখে সেলিনা বলল, কফিটা না খেয়েই যাবেন প্রান্তিক ভাই। চোখ তুলে তাকালাম ওর দিকে, সোজাসুজি রাখলাম আমার দুটি চোখ ওর চোখের পরে। কি অপূর্ব আর সুন্দর লাগছে সেলিনাকে।
সেলিনা নারী। পুরুষের চোখের ভাষা তার অজানা নয়। এতো মেয়েদের সহজাত ধর্ম। চোখ দুটি সেলিনা নামিয়ে নিল। নিজেকে সহজ আর স্বাভাবিক করতে রাখল কফির পেয়ালা আর খাবারের প্লেট সামনের টেবিলে। তারপর দ্রুত পালিয়ে যাওয়ার আগে বলল, আপনি তাড়াতাড়ি খেয়ে নিন প্রান্তিক ভাই, আমার দেরী হবে না। কারো কোন কিছু বলার সময় না দিয়ে নিজেকে অদৃশ্য করে নিয়ে গেল পর্দার আড়ালে।
স্নেহময়ী দেবী বললেন, হ্যাঁ বাবা তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও। অনেক রাত হয়েছে। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন আবার কবে আসবে? বললাম আসব মাসিমা, চিন্তা করবেন না। খাওয়া শেষে উঠে পড়লাম। স্নেহময়ী দেবী বললেন, তুমি আমার অশ্রুকে নতুন জন্ম দিয়েছে বাবা। তোমার কথা ভুলতে পারবো না কোনদিন। ওব বাবা নেই এখানে, তুমি না থাকলে কি যে হতো। বললাম, এ আপনার ভুল ধারণা মাসিমা। কারো জন্য কোন কাজ পড়ে থাকে না এ বিশ্বাস আমার আছে। তারপর স্বাভাবিকের থেকে একটু জোরে সেলিনাকে ডেকে বললাম, সেলিনা তাড়াতাড়ি এসো।
অশ্রুকণা আমার সঙ্গে আর কোন কথা না বলে সেলিনাকে বলল, রেহানাকে বলল আমি ভালো আছি। কিন্তু আবার কবে আসবে তুমি? নিজের স্বাভাবিকতায় ফিরে যেতে যেতে সেলিনা বলল, যত তাড়াতাড়ি তুমি আমাদের বাড়ীতে যাবে। তারপর আমাকে তাড়া দিয়ে বলল, চলুন না, প্রান্তিক ভাই। এর পরতো দেখছি বাস ট্রাম কিছুই পাওয়া যাবে না।
রেহানাদের বাড়ীর রাস্তায় ঢুকতে ঢুকতে দেখি, জানালা খুলে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রেহানা। সেলিনা বেল দিতেই রেহানা দরজা খুলে দিলো। আমি বললাম অনেক বাত হয়ে গেছে আর ভিতরে যাব না। ও বলল আচ্ছা। সেলিনাও ভিতরে যাওযার জন্য কোন অনুরোধ জানায় না। ফিরেই এলাম, পিছনে তাকিয়ে দেখি জানালায় তখনো এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রেহানা। ওর মনে কি কোন ঝড় উঠেছে। কে জানে। ওঠাটা যে অস্বাভাবিক নয়, এতদিনে তা বুঝতে পারছি।
সেদিন তপতীকে কথা দিয়েছিলাম, আসব একদিন। নিশ্চয়ই শুনবো তোমার কথা। ও বলেছিল সেদিন একা আসবে তো। বলেছিলাম তাই হবে। সত্যি সত্যি একদিন তাই রেহানাদের কেসের সংবাদ নিতে এসে ভট্টাচাৰ্য্য সাহেবের বাড়ী থেকে ওকে ফোন করে জানালাম, ফ্রি আছো তো? আধ ঘন্টার মধ্যে আসছি আমি। উত্তরে বলেছিল, গেটের বাইবে ঝাউবনের পাশে অপেক্ষা করব।
এসে দেখি সত্যি সত্যি অপেক্ষা করছে ও। এতদিন হাসপাতালে ওকে সেবিকার পোষাকেই দেখেছি। মনের মধ্যে সেই ছবিটি গেঁথে আছে। তাই নীল শাড়ী আর লাল ব্লাউজে একটু বুঝি চিনতে অসুবিধা হয়েছিল। কিন্তু তা কোন অস্বস্তিতে ফেলতে পারে নি, কারণ, ওই-ই দুর থেকে বলল, ১০ মিনিট লেট প্রান্তিক। বললাম হবে বা। ও বলল চল আমরা হাঁটতে হাঁটতে ভিক্টোরিয়া যাই। মনে মনে ভাবলাম হয়তো যা ও বলতে চায় তা হাঁটতে হাঁটতেই বলাটা সহজ হবে। আমার তাতে আপত্তি নেই। এক অজ গ্রাম থেকে শহরে এসে এ কয় বছরেতো কম অভিজ্ঞতা হয়নি। কার মনে যে কোথায় কোন ছবি লুকিয়ে আছে কে জানে। স্যোৎসাহে বললাম, খুব সুন্দর প্রস্তাব, সহজ মনে তোমার কথা শোনা যাবে।
ভিতরে ঢুকে দেখি কোন জায়গাই প্রায় ফাঁকা নেই। খানিকটা হাঁটতে হাঁটতে একটা জায়গা ফাঁকা পাওয়া গেল। আমরা বসলাম। তপতী জিজ্ঞাসা করল তুমি কি এর আগে কখনো এসেছে এখানে? না। তাহলে এত কথা জানলে কি করে? আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম তার আগে তুমি বলত এত জায়গা থাকতে তুমি এখানে এলে কেন? তাহলে কোথায় যেতাম। তারপর বলল তুমিতো জান, আমি হোস্টেলে থাকি, সেখানে তোমাকে নিয়ে যাই কি করে? আমি বললাম যাকগে সে কথা, তুমি আমাকে কি জন্যে আসতে বলেছিলে? তুমি কি রাগ করেছ তোমাকে আসতে বলার জন্য, না সেলিনার সঙ্গে ঝগড়া করে এসেছো? আমি বললাম, তপতী তোমার একটা কথা জানা ভীষণ দরকার যে তুমি সেলিনাকে জড়িয়ে যে সব ইঙ্গিত করছে এসব ভুল। ভুল? সেলিনাকে তুমি ভালবাস না? সেলিনা তোমাকে ভালবাসেনা? হ্যাঁ বাসে। তা হলে? তাহলে কি? এরপরও বলছ আমার ভুল?হা ভুল তপতী, ভীষণ ভুল। আমি ভাবছিলাম, তোমার এ ভুল ভাঙিয়ে দেওয়া দরকার। ও বলল, আমি একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের মনের ভাষা বুঝিনা এইকি তুমি বলতে চাও? আমি কিছুই বলতে চাইনে, শুধু বলতে চাই এ তোমার ভুল। তপতী বলল, আমি তোমাকে বুঝতে পারছি না প্রান্তিক তুমি কি বলতে চাইছো? আর এই যদি তোমার মনের কথা হয় তাহলে বলব, সেলিনা বড় দুঃখিনী। আমি একটু হাসলাম বললাম, সেলিনাকে তুমি আজো চিনতে পারনি। তপতী প্রতিবাদ করে বলল, আমি বলব প্রান্তিক তুমি সেলিনাকে বুঝতে পারনি। হাসপাতালে ওকে আমি কাছ থেকে দেখেছি, ওর মনকে বুঝেছি। তুমি একদিন না এলে ওব অভিমান যে কত তীব্র হতে পারে, আমিতো তার সাক্ষী। তবু তুমি বলবে ওকে আমি বুঝতে পারিনি? না পারনি তপতী, থাক সে কথা, আর কেন বুঝতে পারনি তা তোমাকে আরেকদিন বুঝিয়ে বলব। এবার তোমার কথা বল। আমার কথা! তারপর বলল আমার কথা কি তোমার শুনতে ভাল লাগবে? কেন লাগবেনা। তোমার যদি কিছু বলার থাকে তা আমর শুনতে খারাপ লাগবে কেন? ও বলল, তোমার সৌমেন্দ্রর কথা মনে আছে? আমি একটু চিন্তা করে বললাম, কোন সৌমেন্দ্র। ও বলল আমাদের বাড়ীর কারো কথা কি মনে আছে তোমার? কেন থাকবেনা। তোমার বাবা মা তারপর তোমার এক ভাই প্রতুল। ও এখন কি করছে? এবার স্কুল ফাঁইনাল পরীক্ষা দেবে? আমাদের বাড়ীর আর কারো কথা তোমার মনে পড়ে না? তোমাদের বিরাট পরিবার। মাঝখানে বাধা দিয়ে বলল, আগে ছিল এখন আর নেই। যাই হোক সবাইকে মনে রাখাতো আমার পক্ষে সম্ভব নয় তপতী। হ্যাঁ, এবার বল সৌমেন্দ্রর কথা। তার মানে সৌমেন্দ্রকে তুমি মনে করতে পারছনা। তারপরে বলল, আমাদের বাড়ীতে এক ভদ্রমহিলা ছিলেন আমরা সবাই তাকে পিসিমা বলে ডাকতাম, মনে আছে? আমি মনে করতে পেরে বললাম হ্যাঁ মনে পড়ছে। কি একটা ব্যাপারে যেন তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। হ্যাঁ ওনারই ছেলে সৌমেন্দ্র। আমাদের থেকে এক ক্লাশ উপরে পড়তো। তা হয়তো হবে, তখন তো অনেক ছোট ছিলাম। ও এখন ফাঁইনাল ইয়ার ডাক্তারী পড়ে। আমি আনন্দ প্রকাশ করে বললাম খুব ভাল কথা। তোমাকে ডেকেছি, সেই কারনে। একটা উপকার করে দেবে প্রান্তিক? আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম কি ব্যাপার বলত। তপতী বলল, কাল চিঠি এসেছে ওর মা অসুস্থ, কিন্তু ওর পরীক্ষা চলছে, এখন বাড়ীতে গেলে এ বছরটা নষ্ট হয়ে যাবে। তুমি একটু বুঝিয়ে বলবে? আমি বোঝাব? আমার কথা উনি শুনবেন কেন? তপতী বলল আমার বিশ্বাস, ও শুনবে তোমার কথা। তুমি আমাকে ফোন না করলে আমিই যেতাম নীলাঞ্জনা পিসির বাড়ীতে, এবং আজই। বললাম, সে না হয় বুঝলাম, কিন্তু তুমি যখন আমায় আসতে বলেছিলে, তখনতো এই ঘটনা ছিল না, তা হলে কেন আসতে বলেছিলে? ওর জন্যই আসতে বলেছিলাম। ওর জন্য? আমি অবাক হয়ে বললাম হাসপাতালে অনেক বার তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছে একবারও তো ওর কথা বলনি? না বলিনি। কারণ বুঝতে পারিনি, তার সঙ্গে কথা বলেও তাকে তুমি চিনতে পারবে না। অদ্ভুত! হ্যাঁ অদ্ভুত। তারপর বললো একদিন কৈশোরের চপলতা বশত তোমাকে একটা চিঠি লিখে শুধু মাস্টার মশাইয়ের কাছে নয় বাড়ীতেও পর্যন্ত মার খেয়েছিলাম। মনে আছে? হ্যাঁ মনে আছে। কিন্তু তুমি ওই রকম একটা চিঠি লিখতে গিয়েছিলে কেন? কেন লিখতে গিয়েছিলাম সে উত্তর তো দিতে পারবো না প্রান্তিক, কিন্তু লিখেছিলাম। ওতে কি লিখেছিলাম তোমার কি মনে আছে? আমি খানিকক্ষন চিন্তা করে বললাম, কিছু কিছু মনে পড়ছে। তুমি যা লিখেছিলে, তার কয়েকটা লাইন এই রকমই ছিল, তুমি আকাশ, আমি চাঁদ, কখনো তোমার ভালবাসায় বিকশিত হই শুক্লপক্ষের পূর্ণ চন্দ্রে। আরো বোধহয় লিখেছিলে, তোমার নিষ্ঠুরতায় পাষাণকেও হার মানাতে হয়, তবু আমি নিজেকে সঁপে দিতে চাই সেই পাষণের বেদীতলে। হেসে উঠলাম আমি। কি ছেলেমানুষী ছিল সেদিন তোমার। তপতীর কণ্ঠ বুঝি আবেগে বুজে আসতে চাইলো। হ্যাঁ ছেলেমানুষি। কিন্তু তোমার উত্তরটা সেটা মনে আছে তোমাব? আমি বললাম, আজ আর সেই অতীতকে নিয়ে এত ঘাটাঘাটি করছ কেন? তাপর বললাম, হয়তো তোমাকে অনেক আঘাত দিয়ে যা লিখেছিলাম, তা আমার লেখা উচিত হয় নি, কিন্তু আমার ঐ চিঠির জন্য যে তোমাকে এত মার খেতে হবে, তা কিন্তু ভাবিনি। আসলে তোমার চিঠিটাকে মনে করেছিলাম একটা খেলা, তাই খেলাচ্ছলে আমিও খেলা করেছিলাম। হ্যাঁ, সত্যি খেলা করেছিলে। তাইতো লিখতে পেরেছিলে, কিসের এত দম্ভ তোমার আমার আকাশে চাঁদ হয়ে ফুটতে চাও, চাও আমার ভালোবাসার অধিকার দাবী করতে? ভিখিরিকে করুণা করা যায় ভালবাসা যায়না। আজো আমি কেঁপে উঠি তোমার সেই হুল ফোঁটানো লেখা গুলো মনে পড়লে। আজো অনেক রাতে ঝরে আমার চোখের জল। দুঃখের ভারি বোঝায় একাকী ভাবি, একবার কি আসতে পারতেনা, শুধু একবার। পারতেনা বলতে, তপতী চিঠিতে যা লিখেছি সেটা আমার মনের কথা নয়। কিন্তু আসনি। কেন আসনি জানিনা, কিন্তু আমার মনের পর্দায় যে ছবি এঁকে গেলে তাকে তো মুছে ফেলতে পারলামনা আজো। সেদিনের সে সব কথা অনেক বার ভেবেছি হাসপাতালের সেই মুহূর্তগুলোতে, একবার মনেও হয়েছিল তোমাকে জিজ্ঞাস করবো, সত্যি কি আমাকে আঘাত দেওয়ার জন্য ঐ হুল ফুটিয়েছিলে না নিজেকে গোপন করতে চেয়েছিলে কঠিন পাষাণে।
দেখলাম ওর চোখদুটি ছল ছল করে উঠছে। আমি তার একটা হাত আমার হাতের মধ্য নিয়ে বললাম, তপতী অতীত অতীতই, কেন হৃদয় খুঁড়ে সেই বেদনা জাগাতে চাইছো। আজ তোমার আমার পথ এক নয়। এ কথাতো মানবে আমাদের দুটি পথ দুটি দিকে গেছে চলে। তবে আর পিছন ফিরে তাকানো কেন? তপতী বলল, তাকাতাম না প্রান্তিক, সৌমেন্দ্রর মধ্যে নিজেকে খুঁজে পেতে চেয়েছি। ওর মাকে যদিও পিসি বলেই জানতাম, বড় হয়ে জানতে পেরেছি উনি ছিলেন আমাদের বাড়ীর কাজের মেয়ে। দীর্ঘদিন থাকতে থাকতে তিনি আমাদের পরিবারের একজন হয়ে উঠেছিলেন। যেদিন জানতে পারলাম অকারণে অপমান করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তাকে, সেদিন থেকে তোমার প্রত্যাঘাতকে ভালবাসায় রূপান্তর করে ভরে দিতে চাইলাম তাকে। আর তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে দেখতে সেদিন দেখলাম তোমাকে, অনেক অনেক বছর পরে। দেখলাম সেলিনার প্রতি তোমার গভীর ভালবাসা, ঈর্ষার আগুনে জ্বলতে লাগলাম আমি। মুহূর্তে ভুলে গেলাম সৌমেন্দ্রকে দেওয়া আমার আশ্বাস আমার প্রতিশ্রুতি। তোমাকে বলতে লজ্জা নেই প্রান্তিক, কয়েকটা দিন পাগলের মত শুধু তোমার কথাই ভেবেছি। কিন্তু তার মধ্যেই দেখলাম, তোমার প্রতি সেলিনার আকর্ষণ। তার গভীর ভালবাসা। তার জেদ, তার অভিমান, আর অন্যদিকে, তোমার স্নেহের পরশে ও যেন এক নতুন মানুষ। ধীরে ধীরে ভালবেসে ফেললাম ওকে। যা আমি পাইনি তাই পাওয়ার সাধ জাগলো ওর মাধ্যমে। নিজেকে গুটিয়ে নিলাম, যে হিংসার অনলে একদিন তোমার ধ্বংস কামনা করেছিলাম, সেলিনা সেখানে নিয়ে এল এক নতুন জীবন। তারপর বলল, শুনেছি তোমার সমস্ত জীবন ব্যাপী আছে রেহানা, সেলিনার সেখানে কোন অধিকার নেই, জানিনা এটাও সেলিনার অভিমান কি না। তোমাকে বলতে চেয়ে ছিলাম নিজের কথা, জানাতে চেয়েছিলাম, সেই তপতীর মৃত্যু হয়েছে প্রান্তিক। যাকে তুমি আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করেছিলে।
তারপর কিছুক্ষণের জন্যে থামল তপতী। তাকালে আমার দিকে। বলল আমার বদলির আদেশ হয়েছে, সৌমেন্দ্রর পরীক্ষা শেষ হলে নতুন জায়গায় চলে যাবো। ওর মাকে নিয়ে আসব কাছে এই স্বপ্ন যখন দেখে চলেছি, তখনি এলো এই দুঃসংবাদ। জানিনা আজো তুমি আঘাত দেবে কি না, সেদিন যাকে ভিখারিনি বলে তাড়িয়ে দিয়েছিলে তোমার অহংকারে ঘা লেগেছিল বলে আজ কিন্তু সে সত্যিই ভিখিরিনির মত তোমার কাছে এসেছে, ফিরিয়ে দেবেনা তো? ওর চোখে জল।
তপতী তার নিজের কথা বলতে গিয়ে বার বার অতীতকে কেন মনে করিয়ে দিচ্ছে জানিনা। সত্যি কথা বলতে কি, সেদিনের সেই ঘটনাগুলোকে কৈশোরের চপলতা ছাড়া আমার অন্য কিছু মনে হয়নি। তা যে এতদিন কোন মেয়ে তার মনের নিভৃত কোনে এতগুলো বছর অভিমানে বাঁচিয়ে রাখতে পারে আমার ধারণারও অতীত। মাঝে মাঝে মনে হয় কতটুকু জানি আমরা মানুষকে। এই হাসপাতালে ওকে না দেখলে হয়তো মনেই পড়তোনা তপতী নামের একটা মেয়ের সঙ্গে আমার একটি অতীত স্মৃতি আছে, আর সৌমেন্দ্র, ও আমাদের থেকে সিনিয়র ছিল। ওর বাবা মারা গেছেন ও যখন একেবারে হোট। ভাল করে মনে নেই। তপতীর ভালবাসা তাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। মনে হয়, তাকে ডাক্তার করার পিছনেও আছে তপতীর পরিশ্রম আর স্বপ্ন। মুহূর্তে ভাল লেগে গেল তপতীকে। ভীষণ ভালো। জীবনতো এই রকমই, তার বাঁকে বাঁকে কত যে মণিমুক্তো ছড়িয়ে আছে কে তার খোঁজ রাখে? মনে মনে ভাবি কি ভুলই না আমরা করি। একটা ছোট্ট ঘটনা, কৈশোরের চপলতা, হয়তো বা মনের নিভৃতে ভালবাসার রঙে রঙ্গীন হয়ে পাখা মেলতে চেয়েছিল। ঐ চিঠিটা, সে প্রান্তিক কে না লিখে যে কোন কিশোরকেই লিখতে পারতো। যদি আমি কোন উত্তর না দিতাম, তা হলে হয়তো হারিয়ে যেতো তার চপলতা। কিন্তু আমার ঘৃণা আর আঘাত, ওর মনের চপলতাকে দিল এক দৃঢ় প্রত্যয়। মার খেয়েও কোন প্রতিবাদ করে সে খুঁজে নিতে চাইল তার ভালবাসার একনিষ্ঠতা অন্যত্র, অন্যখানে। সবই ঠিক।
আমার অতীত জীবনকে ছিন্ন ভিন্ন করে তপতী বলল, কি ভাবছ প্রান্তিক। কিছু না। তাকালাম দূর আকাশ পানে, কখন যেন সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনীভূত হয়ে এসেছে। আকাশে মুহূর্তে বিদ্যুৎ ঝলক আর ঘন কালো মেঘের ঘনঘটা দেখে বললাম, দেখেছো এখনি মনে হচ্ছে প্রবল বর্ষা নামবে। ভিক্টোরিয়ার রক্ষীরা গাছের গুঁড়িতে এখনো কেউ বসে আছে কীনা তাই খুঁজতে বেরিয়েছেন। বলতে এসেছেন, তারা যেন আর দেরি না করে চলে যান, ঝড় ও জল এক সঙ্গে নামতে পারে। বললাম চল তপতী, আর দেরি করা ঠিক হবে না। কি এক গভীর আকুলতা নিয়ে ও তখনো তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি যেন দেখেও দেখতে চাইলামনা এই আকুল ব্যগ্রতা।
দুই একটা জলের ফোঁটা গায়ে এসে লাগে। মুহূর্তে সারা আকাশ কালো হয়ে চারিদিক গভীর অন্ধকারে ঢেকে গেল। ঝড় উঠলো, প্রথমে ধুলিঝড়, তারপর প্রবল বৃষ্টি। গাছের ছায়ায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে দেখতে পেলাম, রাস্তার উপর দিয়ে জল বয়ে চলেছে, সামনের কিছুই দেখা যাচ্ছেনা। ভিজে একাকার হয়ে গেছি আমরা। কোন দিকে যাব বুঝতে পর্যন্ত পারছি না।
সর্বাঙ্গ ভেজা তপতীকে আমি কি ভাবে এগিয়ে নিয়ে যাব? কিভাবে পৌঁছিয়ে দেব তাকে তার বাসায়। রাস্তায় কোথাও হাটু জল কোথাও বা তার থেকেও বেশী। বৃষ্টির অন্ধকারেও যেটুকু আবছা আলো আছে তাতেই তাকাতে পারছি না ওর দিকে। হঠাৎ চলতে চলতে পা পিছলে পড়ে গেল তপতী। ওকে কোন ভাবে তুলে নিলাম দুহাতে। বললাম মনে হচ্ছে আর হাটা যাবে না। এবার কোথাও দাঁড়ানো যাক। ও বলল তা হয় না প্রান্তিক বেশী রাত হলে হোস্টেলে ফেরাই কষ্ট হবে। তার চেয়ে আমার হাতটা ধর তারপর এগিয়ে চল। যে কোন ভাবেই হোক রাত ৮টার আগে হোস্টেলে আমাকে ফিরতেই হবে। আমি আর দ্বিরুক্তি না করে ওর হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে আগে আগে পথ চলছি। ও কি ভাবছে জানিনা। আমি কিন্তু মনে মনে ভাবছি, ও একটু আগে ভিখারিনির মত কিছু চেয়েছিল, কি দিতে পারতাম জানিনা, কিন্তু দুর্বার প্রকৃতি বুঝি, সব চাহিদা মিটিয়ে দিয়েছে ওর। জানি এই মুহূর্তটুকু ও ভুলতে পারবেনা কোনদিন। তাই জীবনে যা দিতে পারিনি, স্মৃতি হয়ে তাই অন্তত বেঁচে থাকুক, ওর মনের মণিকোঠায়।
সাড়ে সাতটা নাগাদ অনেক দুর্যোগ আর জল পেরিয়ে ওর হোস্টেলের কাছে সম্পূর্ণ স্নান করে এসে দাঁড়ালাম। ও তাকাল আমার দিকে। বললাম, একেবারে স্নান করে উঠেছে তপতী। ঠান্ডা লেগে যেতে পারে। ও বলল, তুমি কিভাবে যাবে? আমার জন্য ভেবোনা। ঠিক পৌঁছে যাব। আবার কি দেখা হবে? কেন হবে না? অবশ্যই হবে। এই পৃথিবী যতবড়ই হোকনা কেন তাকে ছোট করে নিতে কোন অসুবিধা হবে না। তোমাকে খুব কষ্ট দিলাম তাইনা? বললাম কোন কোন কষ্ট আনন্দের দ্যোতনা হয়ে বেঁচে থাকে জীবনে। আজকের কষ্টটাও না হয় সেই ভাবে বেঁচে থাক। কি জানি, বলল তপতী। আমি বললাম, কি যেন চেয়েছিলে আমার কাছে, বললে না তো। ও বলল, পেয়ে গেছি প্রান্তিক। যে ঠিকানা হারিয়ে ফেলেছিলাম এই দুর্যোগের দুরন্তপণা তা যেন নতুন করে ফিরিয়ে দিয়ে গেল আমাকে। তারপরে বলল সাবধানে যেও। আচ্ছা। আর একটা কথা। বল। যাওয়ার আগে একবার রেহানাকে দেখার ভীষণ ইচ্ছে, দেখাবে? ওকে কি তোমার প্রয়োজন? প্রয়োজন? হ্যাঁ, ভীষণ ভীষণ প্রয়োজন। আচ্ছা মনে রাখব তোমার কথা। আর সৌমেন্দ্রকে বল, পরীক্ষা যেন ড্রপ না করে। ওকে চিনতে না পারার জন্য ভীষণ খারাপ লাগছে। তাকে বলো যতটা অমানবিক আমাকে তিনি মনে করেছেন। আমি কিন্তু তা নই। বেশ বলব। তুমি কিন্তু আর দেরি করো প্রান্তিক। তারপর বলল সারাটা রাস্তা তোমাকে হয়তো হেঁটেই যেতে হবে।
বাড়ীতে গিয়ে দেখি পিসি ফেরেনি তখনো। রাত হয়েছে অনেক। সারা রাস্তায় কোন বাসট্রাম নেই। সারা কলকাতা যেন এক সীমাহীন সমুদ্র। শুধু জল আর জল। কোথায় খুঁজবো তাকে। অগত্যা দীনেন্দ্রস্ট্রীটে গিয়ে ওর অফিসে ফোন করলাম। এক চান্সে ফোনটা পেয়েও গেলাম। নীলাঞ্জনার কথা জিজ্ঞেস করতেই একজন ডেকে দিলেন। হ্যালো। আমি প্রান্তিক বলছি। পিসি বললেন তুমি বাড়ীতে পৌঁছে গেছ? হ্যাঁ, কিন্তু তুমি কিভাবে আসবে? আমার জন্য চিন্তা করোনা। অফিসে প্রায় সবাই আটকা পড়ে গেছি। এরা একটা গাড়ীর ব্যবস্থা করছে, চলে আসব, ফোন ছেড়ে দিলেন।
গভীর রাতে ফিরলেন পিসি। সমস্ত শরীর ভিজে একাকার। বললেন, এত জল যে গাড়ী আসতে পারছেনা, তাই হাঁটতে হল। আঁতকে উঠে বললাম ইস্ একেবারে স্নান করে ফেলেছে। আমি গীজারে জল গরম করে দিচ্ছি, স্নানটা করে নাও। না থাক। এত রাতে আর স্নান করবনা। বললাম সেটা ঠিক হবে না। স্নান না করলে শরীর আরো খারাপ লাগবে। যাই হোক আমার কথা শুনে পুরো স্নান না করলেও অর্ধেক চান করলেন তিনি। কিন্তু অতরাতে আর কিছু খেতে রাজী হলেন না। বললাম, এক গ্লাস গরম দুধ অন্তত মুড়ি দিয়ে খেয়ে নাও। তিনি আর কথা বাড়ালেন না।
পরের দিন সকালে, অনেক রাস্তা থেকে জল সরে গেছে, তবে অনেক নীচু রাস্তা এখনো জলের নীচে। একবার রেহানাদের ওখানে যাওয়া দরকার। কাল যা জল হয়েছে, তাতে তাদের একতলা বাড়ীতে কোমর জল হওয়ার কথা। কলেজে যাওয়ার আগে ওদের বাড়ীতে গিয়ে উপস্থিত হলাম। তখনো ঘরের মেঝে থেকে জল সরেনি। বেল দিতেই দরজা খুলে দিল সেলিনা। বলল, কাল জলের সময় কোথায় ছিলেন প্রান্তিক ভাই? কোথায় আর থাকব। একবার উকিলের কাছে গিয়েছিলাম। ও! বলে থেমে গেল সেলিনা। বলল চা খাবেন? না, তা কাল কি তোমরা এখানেই ছিলে? কোথায় আর যাব বলুন। দেখতে পারছি বিছানাপত্র সব ভেজা। অন্য কোথাও চলে যেতে পারতেন? কোথায় আর যাব। সর্বত্রই তো জল, সবারই তো একই অবস্থা। আপনি বরং বসুন, আমি চা নিয়ে আসছি। ভিজে কাপড়ে রেহানা এসে দাঁড়ালো। বললাম, ভিজে কাপড়ে আছ, ঠান্ডা লাগবে যে। কি আর করব। কাল রাতে সব ভিজে গেছে। জল আলমারিতে পর্যন্ত ঢুকে সব ভিজিয়ে দিয়েছে। একটু সরিয়ে নিতে পারলেনা? হয়তো পারতাম, কিন্তু যখন সরাতে গেছি তার অগেই সব কিছু ভিজে একাকার। তারপর বলল, তুমি কাল ভেজোনি তো। যা সামান্য ভিজেছি তাতে অসুবিধা হয়নি। ও বলল একবার মনে হয়েছিল তুমি আসতে পার, কিন্তু না আসতে ভাবলাম হয়তো কোথাও আটকে পড়েছে। কি হয়েছিল। কাল পিসি প্রায় রাত ২টোয় ফিরেছে। আঁতকে উঠে বলল কেন? প্রায় ১২টা পর্যন্ত অফিসে আটকে ছিল, তারপর যদিওবা অফিস থেকে গাড়ীর এ্যবেঞ্জমেন্ট করেছিলো কিন্তু এতজলে গাড়ী কোথা দিয়েও আসতেই পারলনা। অগত্যা হাঁটা, এবং তারপর সাঁতরিয়ে এবং স্নান করে যখন বাড়ীতে পৌঁছালেন, তখন ২টো বাজে। কালকের ধকলে শরীরটা সকাল থেকেই খারাপ। রেহানাকে খুব চিন্তাম্বিত মনে হল।
সেলিনা চা নিয়ে এল। ওর হাত থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম মাসিমা কোথায়? রান্নাঘরে। ও চাটা দিয়ে চলে গেল। রেহানা বলল, তোমার শরীরটা যে একদম ভাল লাগছে না, কি হয়েছে? কৈ কিছু নাতো। কিছুনা কি? তুমি লুকোচ্ছ। দেখতে পাচ্ছি চোখ দুটো তোমার লাল সারা মুখে চিন্তার ছাপ, আবার জ্বর আসবেনা তো? বলেই আমার কপালে হাত রেখে পরীক্ষা করে রেহানা। তার পরে বলে তুমি কিগো? গায়ে তো জ্বর। কেন মিথ্যে কথা বল? তারপর আমার হাত ধরে বলল, ওঠো এবার? কোথায়? সেলিনার ঘরের বিছানা জলে ভেজেনি। চল শুয়ে পড়বে। আমি বললাম, এত ব্যস্ত হচ্ছো কেন রেহানা। আমি ঠিক আছি, তোমায় এত ব্যস্ত হতে হবে না। ও আস্তে আস্তে বলল, কেন এত কষ্ট দাও বলত? তোমার শরীর খারাপ, আমার ভাল লাগবে? ওঠ লক্ষ্মীটি। চল ও ঘরে। লজ্জা ভীষণ লজ্জা আমাকে আড়ষ্ট করে দেয়। বললাম, চিন্তা করোনা রেহানা। আমার কিছু হবে না দেখো, জানি তোমার কিছু হবে না আর কিছু হলে যে তোমার মহত্ত্ব ব্যর্থ হয়ে যাবে। তুমি অনেক বড় প্রান্তিক, তাই হয়তো আমার মত সাধারণ মেয়ের উদ্বিগ্নতা তোমাকে ভাবায় না। তারপর বলে বেশ, তোমাকে ও ঘরে যেতে হবে না, কিন্তু কলেজেও তুমি যেতে পারবেনা। কেন? কেন আবার কি? তুমি কি বাড়াবাড়ি রকমের একটা কিছু বাধাতে চাও না কি?
এ এক নতুন রেহানা। এমন করেতো কোনদিন ও আমার সাথে কথা বলেনি। চিরদিনই নিজেকে নিজের কাছে লুকিয়ে রেখেছে, মেপে মেপে কথা বলেছে দুশ্চিন্তা বা উদ্বিগ্নতা যদি কিছু থাকেও তাকে কখনো বাইরে প্রকাশ হতে দেয়নি, বুঝতেও দেয়নি তার ভাবনা চিন্তা গুলোকে।
আর আজ? আমার চা খাওয়া হয়ে গেছে। সেলিনা চায়ের কাপ নিতে এসে দেখে, রেহানা ঠিক আমার মাথার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে, আর তার আঙুল বিলি কেটে চলেছে আমার মাথার চুলে। ওর বোধ হয় খেয়ালই নেই, বাড়ীতে আর কেউ আছে কি না। ওর বুকের সিক্ত কবোষ্ণতা আমাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে বারবার। এমন করে ওতো কাছে আসেনি কোনদিন। মন হয়তো কখনো বা চেয়েছিল, ওর আবেগ ছুঁয়ে যাক আমার হৃদয়কে। এই যে উদ্বেগ আর দুশ্চিন্তা, এরতো একটা মূল্য আছে। তাকে উপেক্ষা করি কি ভাবে?
সেলিনাও বুঝি কম অবাক হয়না। এমন করে ও যে আমার কাছে আসতে পারে সে বুঝি সেলিনারও স্বপ্নের অতীত। কিন্তু ও এমন এক জাতের মেযে, সব কিছুকে নিতে পারে অতি সহজ ভাবে। অন্য কেউ হলে হয়তো একটি হাঁচি দিয়ে তার উপস্থিতি জানাতে, অথবা নীরবে সরে যেতো। কিন্তু সেলিনা অন্য ধাতুতে গড়া। রেহানাকে এ অবস্থায় দেখে সেলিনা বলল, যে ভাবে ভিজে কাপড়ে দুই প্রান্তিক ভাইয়ের কাছে এসে দাঁড়িয়েছিস তাতে তোর সংক্রামক ব্যধি ওকে না সংক্রামিত করে। যা, শাড়ীটা শুকিয়ে গেছে। সারারাত যে ভাবে ভিজে ছিস্ তাতে প্রান্তিক ভাইকে না আবার তোকে নার্সিং করতে হয়। ত্বরিতে সরে দাঁড়ায় রেহানা। মাথার চুলে বিলি কাটুনি বন্ধ করে হাতটাও সরিয়ে নেয় দ্রুত রেহানা। আমিও লজ্জা কম পেলাম না। মন বুঝি প্রস্তুত ছিল রেহানার ভালবাসার আঙুলের স্পর্শ পাওয়ার জন্য। সেলিনা বলল এতে এত লজ্জাবতী হয়ে গেলি কেনরে রেহানা। নিজের জিনিষের প্রতি মমতা কার না হয়। যেন লজ্জায় মরে যেতে যেতে অস্পষ্ট ভাবে বলতে বলতে গেল, শুধু বাঁদরামি। সেলিনা বলল, কি হয়েছে প্রান্তিক ভাই, শরীর খারাপ? না না ঠিক আছে। তা হলে অমন বিপরীত মুখী সেবা নিচ্ছিলেন কেন? এতো আপনাদেব ক্ষেত্রে একেবারে বেমানান? রেহানাকে বলল ওভাবে আঁতকে উঠলি কেন, যা স্নান করে শাড়ীটা বদলিয়ে আয়, ততক্ষণে দেখছি প্রান্তিক ভাইয়ের কি হয়েছে। রেহানা আস্তে আস্তে চলে গেলে সেলিনা আমার কপালে হাত দিয়ে আঁতকে উঠে বলল, একি প্রান্তিক ভাই এযে অনেক জ্বর। চলুন। কোথায়? এ বাড়ীতে তো আর কোন শুকনো বিছানা নেই, তাই বাধ্য হয়ে মন না চাইলেও আমার বিছানায় যেতে হবে। ভয় নেই। রেহানা স্নান করে এলেই, তাকে পাঠিয়ে দেবো। মুখ টিপে হাসতে লাগল সেলিনা। আমি বললাম, সেলিনা এই রকম ভয়ংকর ঠাট্টা করে কি আনন্দ পাও তুমি? অন্তত দুঃখ যে পাইনে এটাতো ঠিক। আর তা ছাড়া আপনি একে ঠাট্টা বলছেন কেন? আপনি জ্বরে ভুগবেন, আর ও দূরে দূরে থাকবে, এ হয় নাকি? কেন তুমিতো আছ? আমি? হাসল সেলিনা। হাসলে যে। না, প্রান্তিক ভাই হাসছিনা, শুধু জানিয়ে যাচ্ছি, কোন রকম উচ্ছলতা, চপলতা বা প্রগলভতা প্রকাশ না করেও ও যেখানে আপনার অন্তর ছুঁয়ে যাবে হাজার সেলিনার সাধ্য নেই সেখানে পৌঁছাবার। যদি এই ঠাট্টাটুকু আপনার ভাল না লাগে করব না প্রান্তিক ভাই। তাই বলে মনে করবেন না, ঠাট্টা করছি বলে আপনাদের আমি বুঝিনা। একটু চুপ করে থেকে বলল, চলুন এবার। একটু বিশ্রাম নিন প্রান্তিক ভাই তারপর ভাল না লাগলে চলে যাবেন। কথা দিচ্ছি রেহানা আপনাকে আটকাবেনা।
উঠতেই হল। আসলে বুঝতে পারছি, ভিতরে ভিতরে কি যেন চাইছে মন। জ্বরটাও বেশ চাগিয়ে আসছে, বললাম চল। সুন্দর করে বিছানা করা হয়েছে। নতুন একটা চাদর পাতা হয়েছে সদ্য ভাঁজ খুলে। বালিসে দেওয়া হয়েছে নতুন ওয়াড়। আর কোনায় সুন্দর সেলাইয়ের কাজ। সেই কবে মাকে দেখেছি, নতুন কেউ এলে এমনি করে সাজিয়ে দিতেন বিছানা। দ্বিরুক্তি না করে শুয়ে পড়লাম। শরীর যে পারছেনা, তা অস্বীকার করি কি করে। আফরোজ বেগম আমার মাথায় জল পট্টি দিয়ে চলেছেন। কতক্ষণ জানিনা চোখ বুঝে দেখছি, যেন তপতী পাশে এসে বলছে, এ আমারই দোষ। তোমাকে যদি সেদিন ভিক্টোরিয়ায় নিয়ে না যেতাম, যদি এ ভাবে তুমি জলে না ভিজতে, কিছুতেই তুমি জুরে পড়তেনা। চল
প্রান্তিক আমাদের হাসপাতালে। যে ওয়ার্ডে তুমি ভৰ্ত্তি হবে মেট্রনকে বলে সেই ওয়ার্ডেই আমি ডিউটি নেব। অন্তত ঐ কটাদিন আমার সেবার মাধ্যমে তুমি সুস্থ হয়ে ওঠো। যাবে প্রান্তিক? বললাম না। কেন বার বার না করছ? আমার থেকে কি এরা তোমার বেশী সেবা করবে? বললাম তবুও না। আবারও সেই না। তুমি কি একটুও আমাকে বুঝতে চাইছনা? একবার তাকাও আমার দিকে। দেখ সেদিনের মত আজো জড়িয়েছি বেনীতে যুঁই ফুলের মালা। তোমার প্রিয় আকাশী রংএর শাড়ী পরেছি, কপালে লাগিয়েছি সবুজ টীপ একদিন বলেছিলে, এ পোষাকে তোমাকে ভীষণ মানায় তপতী। একবার পরীক্ষা করে দেখনা,রেহানার থেকে আমি তোমাকে বেশী ভালবাসি কী না। বলছি তো না-না-না। তুমি যাও এখন? কিসের এত অহংকার তোমার? আমাকে এই ভাবে তাড়িয়ে দিচ্ছ? তারপর যেন অভিসম্পাত দিয়ে বলছে, যাকে তুমি চাইছ সে কোনদিন আসবেনা তোমার জীবনে। দুটো জীবন তোমাদের ব্যর্থ হয়ে যাবে প্রান্তিক। অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিওনা। চল আমার সাথে। চিৎকার করে উঠলাম তুমি যাবে কি না।
চোখ মেলে দেখি ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলছে রেহানা। বলল, আমায় তুমি চলে যেতে বলছ? এত নিষ্ঠুর তুমি? আমি কি এতই অস্পৃশ্য তোমার কাছে। ও উঠে যেতে চাইলে, ওর শাড়ীর আঁচলটা ধরে টান দিতেই তা বুক থেকে খসে পড়ে গেল। আমি লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে নিলাম অন্য দিকে। এতক্ষণ কি তবে স্বপ্ন দেখছিলাম। চকিতে শাড়ীর আচলটা বুকে তুলে নিয়ে ও পালিয়ে গেল।
এ আমি কি করলাম। গায়ে অসহ্য যন্ত্রনা। মাথা যন্ত্রণায় ফেটে যাচ্ছে। চোখ দুটো দপ দপ করছে। এত নিঃসঙ্গ লাগছে যে, সে এক অসহনীয় অবস্থা। আমার চিৎকারে ছুটে এলো সেলিনা। আমার বুকে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, কি হয়েছে প্রান্তিক ভাই, এমন করছেন কেন? বললাম, একটা ট্যাক্সি ডাকতে পারবে সেলিনা, আমি বাড়ী যাব। ও ওমনি তার করাঙ্গুলি স্পর্শে আমার বুকের যন্ত্রণা লাঘব করতে করতে বলল যাবেন, কিন্তু জ্বর নিয়ে তো আপনি যেতে পারবেন না। আমাকে যে যেতেই হবে। কেন? কার প্রতি এ অভিমান আনার? রেহানা এসে বলল, একটা ট্যাক্সি ডাক সেলিনা। আমরাতো ওর কেউ নই। কেন থাকবে এখানে? কারো শুশ্রূষা নিতে ওর বিবেকে বাঁধে। তাতে বুঝি ওর মহত্বে আঘাত লাগবে। সেলিনা রেহানার কথার কোন প্রতিবাদ না করে বলল, তুই এখানে একটু বোস আমি আসছি। কোথায় যাবি? যা যা বলছি তাই কর। বলিহারি তোর অহংকার? কেন ওকে বুঝতে চাইছিস না বলতো। এই অবস্থায় ওকে ফিরিয়ে দিলে একলা ঘরে কে তোকে সান্ত্বনা দেবে? তার থেকে বোসনা ওর কাছে। শুধু তোর ব্যথা দেখবি। ওরটা বুঝবিনা? ছিঃ রেহানা ছিঃ। কেন যে ভালবাসতে গিয়েছিলি? শুধু কাঁদতেই শিখেছিস। একটু হাসতে শেখ রেহানা।
রেহানা বসল আমার পাশে। সেলিনা চলে গেলে ওর একটা হাত নিজের হাতে তুলে নিতে গেলে ও জোর করে হাতটা ছাড়িয়ে নিল। আমি আবারও তা জোর করে নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বললাম, কি চাও তুমি রেহানা? আমি কষ্ট পাই তাইতো? ও বলল চুপ করো প্রান্তিক। বেশী কথা বলোনা। আমি চুপ করে গেলাম। আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে এক সময় বললাম আমার জন্য তোমার খুব কষ্ট হয় তাইনা? না হয় না। হয় না? কেন হবে? কে তুমি আমার নিজের মন থেকে বলছ তো আমি তোমার কে? তুমি চুপ করবে? হা করব। তবে আগে বল, আমার সাহচার্য কি তোমার কাছে অসহ্য? তুমি কি আঘাত দিয়ে ছাড়া কথা বলতে পার না প্রান্তিক? আমি আঘাত দিয়েছি না তুমি আমায় আঘাত দিয়েছ? বেশ আমিই তোমায় আঘাত দিয়েছি। এক দিনতো বলেছিলে, কোন আঘাতই নাকি তোমার বুকে বাজেনা। তা হলে? তাই বলে তোমার দেওয়া আঘাতও আমার বুকে বাজবেনা আমি কি এতই নিষ্ঠুর? তুমি তো পাষাণ। প্রাণহীন একখন্ড পাথর মাত্র। মমতা কি আছে তোমার?
মাথার যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে বললাম মাথাটা একটু টিপে দেবে? বড্ড যন্ত্রণা। ছল ছল চোখে বলল কোথায়? আমার সমস্ত শরীরে। কেন এমন হল প্রান্তিক, কেউ কি তোমায় কঠিন আঘাত দিয়েছে? তুমি ছাড়া কারো সাধ্য নেই আমাকে কঠিন আঘাতে ঘায়েল করতে পারে। ও বলল, হাত ছাড়, মাথা টিপে দিচ্ছি।
নীরবে আমার মাথা টিপে দিতে লাগল রেহানা। এক সময় বলল, যন্ত্রণা একটু কম লাগছে? আমি কোন উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইলাম। ডাক্তার সরকারকে নিয়ে ঘরে এসে ঢুকলো সেলিনা। রেহানা উঠে দাঁড়ালো। ডাক্তার সরকার বললেন কি হয়েছে মা? খুব জ্বর, হাত পা কামড়াচ্ছে শরীরে ভীষণ ব্যথা আর মাথার যন্ত্রণায় ছটফট করছে।
ডাক্তার সরকার দেখলেন। তারপর বললেন, ভোগাবে কয়েকদিন, তবে ভয়ের কিছু নেই। বিশ্রাম দরকার। আফরোজ বেগম বললেন, ডাক্তার বাবু ছেলেটি ওর পিসির কাছে থাকে। বাবা মা কেউ কাছে নেই। কি যে হবে। ডাক্তার সরকার খুব উদার প্রকৃতির মানুষ। বললেন বাবা মা কাছে নেই, তাতে কি আপনারা তো আছেন? আপনি দেখবেন? আফরোজ বেগম বললেন আপনি বোধ হয় কিছু জানেন না ডাক্তার বাবু। কি? ওকে আমি আমার কাছে রাখব কি করে? কেন ও হিন্দুর ছেলে বলে? আমি কিন্তু একথা আপনাদের কাছে আশা করিনি। ও যা করেছে আপনাদের জন্য এবং এখনো যা করে, আপনার স্বজাতি, এমন কি আপনার ছেলেও তা করতনা। জানি ডাক্তারবাবু, কিন্তু ওর পিসি তা মানবে কেন? ও আই সি। তাহতে পারে। তবে যদি সত্যি সত্যি দায়ীত্ব পালন করতে চান, তাতে কোন অসুবিধা হবে না। তারপর রেহানাকে বললেন, ওর কিন্তু তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠা দরকার মা। বিখ্যাত ব্যরিস্টার মিঃ ভট্টাচার্য বিনা পয়সায় যে তোমাদের কেসটি গ্রহন করেছেন, সে কিন্তু ওর জন্য, ডাক্তারবাবু চলে গেলেন। তার সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে গেলেন আফরোজ বেগম এবং সেলিনা।
রেহানা আমার কপালে হাত রেখে বললো, ডাক্তারবাবু কি বলে গেছেন শুনেছ? আমি চুপ করে রইলাম। এর আমি কি উত্তর দেব। রেহানা আবার বলল, কি কথা বলছেনা যে। কি বলি বলত। কি করবে? তুমি বল কি করবো? আমার কথা তোমার ভাল লাগবে? বলেই দেখনা। পিসির কাছে ফিরে যাও। তুমি যাবে তো আমার সাথে? যাব, থাকবে আমার কাছে? হাসল রেহানা, ভীষণ মিষ্টি সে হাসি। বলল, থাকব। সত্যি? তুমি বোঝ না? আমি তো সব সময় তোমার কাছে আছি। তবে আমি তোমায় দেখতে পাইনা কেন? কেন হৃদয় আমার এত খালি মনে হয় বলতে পার? পারি। তবে বল। তুমি আমায় একটুও ভালবাসনা তাই। তাই বুঝি? তবে আমি কাকে ভালবাসি? আমাকে ছাড়া সব্বাইকে? ওর একটা হাত টেনে নিয়ে পাশ ফিরে শুলাম।
সেলিনা বলল, যা রেহানা খেয়ে আয়, আমার খেতে ইচ্ছে করছেনা। ইচ্ছে না। করলেও খেতে যে হবে। যা তাড়াতাড়ি খেয়ে আয়। ওষুধটা খাইয়েছিস? ডাঃ কাকু বলেছেন ওষুধটা খেলে জ্বরটা কমে যাবে। খাইয়েছি। যা তবে। বিকাল হয়ে এল। প্রান্তিক ভাইকে তো ওর পিসির কাছে পৌঁছে দিতে হবে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে গেল রেহানা। ঘাম দিয়ে জ্বরটা নেমে যেতে শরীরটা একটু হালকা লাগল। সেলিনাকে বললাম ভীষণ খিদে পেয়েছে। কি খাবেন? যা হোক।
গরম পরটা, আলুভাজা, মিষ্টি আর কফি নিয়ে এল রেহানা, বলল খেয়ে নাও। তারপর যেতে হবেতো। কোথায়? বা তোমার পিসি চিন্তা করবেন না।
আমি আর কোন কথা না বলে খেয়ে নিলাম। সেলিনা ট্যাক্সি ডেকে নিয়ে এল। মনে মনে ভেবেছিলাম রেহানা হয়তো যাবে আমার সাথে। কিন্তু শেষ বেলায় ও বলল, তুই যা সেলিনা। আমারও বোধহয় জ্বর আসবে। সেলিনা শুধু একটু হাসল। তারপর ট্যাক্সিতে আমার পাশে এসে বসল। কয়েক মিনিটের পথ। পৌঁছে গেলাম। সেলিনা বেল দিতে গেলে বললাম, দরকার নেই সেলিনা, আমার কাছে চাবি আছে। ওকে চাবিটা দিতে, গেটটা খুলে আমাকে নিয়ে ভিতরে এল। পিসি শুয়ে আছেন। আমার সঙ্গে ওকে দেখে উঠে এলেন। সেলিনা বলল, আপনি পিসিতো। বলে মাথা নীচু করে প্রনাম করতেই নীলাঞ্জনা বললেন তুমি মানে …। তার কথা শেষ না হতেই সেলিনা বলল। না না আমি রেহানা নই, আমি সেলিনা। কিন্তু আপনাকে ওরকম লাগছে কেন? বলে আমাকে ছেড়েই পিসির কপালে হাত দিতেই চমকে উঠে বলল একি আপনারও জ্বর? নীলাঞ্জনা বললেন, ওরও কি জ্বর হয়েছে? হ্যাঁ ভীষণ জ্বর। কলেজে যাওয়ার পথে আমাদের ওখানে গিয়েছিলেন। আসলে, কালকের ঝড়জলের পরে সংবাদ নিতে আর কি। কিন্তু তখনও ওর গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। মা তাই ওকে আটকে দিলেন। বললেন আজ আর কলেজে গিয়ে কাজ নেই বাবা। এখন একটু বিশ্রাম নাও। তারপর বিকেলে একটু সুস্থ হলে না হয় চলে যেও। কিন্তু জ্বর আর কমে না। বাধ্যহয়ে ডাঃ কাকু মানে ডাক্তার সরকারকে ডাকা হলে উনি দেখেশুনে বললেন, ভোগাবে তবে ভয় নেই, ওর বিশ্রাম আর নার্সিং-এর দরকার। সেটাতো তোমাদের ওখানেও হতে পারতো বললেন নীলাঞ্জনা। এই দেখুন আপনি এখনো রেগে আছেন। আপনি মা, আপনার নাসিং আর আমার মায়ের নাসিং কি এক হবে? কেন তোমরাতো আছে, তোমরা পারতেনা নাসিং করতে? পারতাম পিসি কিন্তু তাতে যা বাড়তে ছাড়া কমোনা। একি আপনার শরীর যে কাঁপছে, চলুন চলুন আপনাকে শুইয়ে দিই। নীলাঞ্জনা বাধা দিয়ে বললেন দরকার হবে না, তুমি ওকে দেখ।
সেলিনা নীলাঞ্জনাকে ধরে নিয়ে বিছানার দিকে যেতে যেতে বলল, মায়েদের এই জেদটা আমার ভীষণ ভাল লাগে জানেন পিসি। কেমন একটা অহংকারী ভাব। সন্তানের সব ভালো-মন্দের মা-ই যেন একমাত্র জিম্মাদার। আমার মাকেও দেখেছি তো, ওঁর ধারণা উনি ছাড়া, ওর সন্তানের আর কেউ যেন কোন নাসিং-ই জানেনা। একমাত্র ওঁর নাসিং হলে ওর ছেলে মেয়েরা সব সুস্থ হয়ে যাবে। মাথার দু পাশের দুটো রগ চেপে ধরে শুয়ে পড়লেন নীলাঞ্জনা। সেলিনা তার হাতটাকে সরিয়ে দিয়ে বলল, আমি টিপে দিচ্ছি, নিজে কি নিজের সেবা করা যায় নাকি? সেলিনা খুব যত্ন সহকারে, তার মাথা টিপে দিতে লাগলো। আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল। লজ্জা করবেন না প্রান্তিক ভাই দরকার হলে আমাকে ডাকবেন। তারপর নীলাঞ্জনাকে বললেন, চা খাবেন পিসি? চা কে করবে? কেন আমি? তুমি? কেন আমাকে আপনার রান্না ঘরে ঢুকতে দেবেন না? যদি না দিই। আমি জোর করে ঢুকবো, দেখি মা হয়ে কেমন করে আপনি আটকান। নীলাঞ্জনা বললেন, তুমি বার বার আমাকে মা বলছ কেন? আমিতো ওর মা নই। জানি, কিন্তু আমিতো আপনাকে প্রান্তিক ভাইয়ের মা বলিনি। তবে কার কথা বলছ? আমার মায়ের কথা বলছি। আমার মা হতেও আপত্তি আপনার?
নীলাঞ্জনা ভাবেন, এ মেয়ে বলে কি? সেলিনা তার চিন্তাকে ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়ে বলে, তা হলে চা করে নিয়ে আসি, গরম গরম খেয়ে দেখুন ভাল লাগবে। নীলাঞ্জনা নীরবে সম্মতি জানালে সেলিনা বলে প্রান্তিক ভাই আপনি খাবেন তো। কিন্তু আমার মতামতের অপেক্ষা না করে ও তিন কাপ চা করে নিয়ে এলো। এক কাপ আমাকে আমার ঘরে দিয়ে বাকী দুকাপ নিয়ে নীলাঞ্জনার ঘরে ঢুকলো সেলিনা। নীলাঞ্জনা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, বা বেশ সুন্দর চা বানিয়েছে তো তুমি? তাহলে সার্টিফিকেট দিচ্ছেন তো? তারপর বলল নিশ্চয়ই খাওয়া হয় নি। আপনি চাটা খান। আমি আপনার জন্য গরম গরম কিছু খাবার আর কফি করে নিয়ে আসছি।
কি জানি নীলাঞ্জনা সেলিনাকে এবারেও কেন বাধা দিলেন না। সেলিনা অতি অল্প সময়ের মধ্যে গরম লুচি ও ঝাল ঝাল তরকারী করে নিয়ে এলো। আগে এটা খেয়ে নিন। কফি পরে আনছি? থাক পরে খাব। কেন পরে খাবেন কেন? এখনি খান। তারপর বলল আমি খাইয়ে দেব? কিন্তু প্রশ্নটা করে ও তারজন্য কোন অপেক্ষা না করে সত্যি সত্যি সেলিনা লুচিতে তরকারী দিয়ে নীলাঞ্জনাকে বলল হা করুন। নীলাঞ্জনা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন ওর দিকে। সেলিনা বলল, আমার দিকে তাকালে কি খাওয়া হবে পিসি, আর কোন কথা নয় এবার হা করুন। নীলাঞ্জনাকে বাধ্য হয়ে হা করতে হয়। আর সেলিনার দেওয়া লুচিটাও খেয়ে নেন নীলাঞ্জনা। তারপর বলেন, আমি নিজেই খাচ্ছি। সেলিনা বলে, কেন আমার হাতে খাওয়া যাবে না, না আমি খাওয়াতে পারব না?
হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছেন নীলাঞ্জনা, এমন অদ্ভুত মেয়ের পাল্লায়, এর আগে পড়েনি কখনো। নিজেকে পরিচয় দিয়েছে রেহানার বোন হিসাবে। প্রান্তিকের কাছে ওদের সবার কথা শুনেছেন নীলাঞ্জনা। কিন্তু কোন দিনই মুসলিম সমাজের রক্ষণশীলতার বাইরে এদের কথা ভাবতে পারেননি। তাই তার অবাক হওয়াটা অনেক বেশী। লুচি তরকারী খাওয়া হয়ে গেলে, সেলিনা কফি করে নিয়ে এল। এবারে আমাকেও এক কাপ দিয়ে নীলাঞ্জনার ঘরে ঢুকে গেল সেলিনা। বলল, তাড়াতাড়ি খেয়ে নিন পিসি, সন্ধ্যা হয়ে এলো, আমাকে তো যেতে হবে। যেতে হবে? কথাটা শুনে এমন ভাবে তাকালেন নীলাঞ্জনা পিসি, যেন একথাটা ভীষণ নতুন তার কাছে? বললেন, না গেলে মা রাগ করবেন, না? তাতো করতেই পারেন। যেমন প্রান্তিক ভাই যদি আপনার কাছে ফিরে না আসতেন আপনি রাগ করতেন না? না করতাম না। তাই হয় না কি? আপনি আমাকে ছেলে ভুলাতে চাইছেন? নীলাঞ্জনা বললেন, আচ্ছা তোমাকে যদি আমি ধরে রাখি তা হলেও যাবে? ধরে রাখবেন? কেমন করে ধরে রাখবেন? আমার স্নেহ দিয়ে, আমার ভালবাসা দিয়ে। ও সব বাজে সেন্টিমেন্ট পিসি, ও সব দিয়ে কাউকে ধরে রাখা যায় না। তবে কেমন করে ধরে রাখা যায়। তার উত্তরতো আপনাকেই খুঁজে নিতে হবে পিসি, কারণ আপনি তো মা।
সেলিনার সঙ্গে কথা বলতে বলতে নিজেকে খুব হালকা লাগছিল নীলাঞ্জনার। সত্যি শরীরটা তার ভীষণ খারাপ লাগছিল। একলা ঘরে তা আরো দ্বিগুন হয়ে উঠেছিল। তারপরে যখন প্রান্তিক এই মেয়েটিকে নিয়ে ঢুকল, মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে গ্রীষ্মের দাবদাহে এ যেন এক পশলা মিষ্টি বৃষ্টি। সেলিনা বলল, মনের জোর দিয়ে ধরতে হয়। এই দেখুন না, মা, রেহানা, চাইছিল প্রান্তিক ভাই থাকুক। তবে থাকল না কেন? জানতে চাইলেন নীলাঞ্জনা। সেলিনা পুরনো আলোচনা জের টেনে বলল ঐ যে বললাম, তাদের চাওয়ার মধ্যে সেই জোরটাই যে ছিলনা। নীলাঞ্জনা বললো ওদের না হয় জোর ছিল না, কিন্তু তোমার তো ছিল, তুমি চাইলেনা কেন? সেলিনা হাসতে হাসতে বলল এইতো আপনি ভুল করলেন পিসি, জোর যদি কারো থাকে সে ওই রেহানার আছে, কিন্তু বেচারা চাইতেই পারল না।
নীলাঞ্জনা বললেন, তা হলে আমি বলছি তুমি থাক। সেলিনা উত্তরে বলল ওটাকি জোরের কথা পিসি? ওটাতো কথার কথা। যে দিন সত্যি জোর দিয়ে বলবেন, দেখবেন হাজার প্রতিকূলতায়ও আমাকে নড়াতে পারবেন না।
কেটে গেল বেশ কয়েকটা দিন। জ্বরে ভুগতে হল পিসি ও আমাকে সেলিনা আসতো মাঝে মাঝে। এবং এই আসার মধ্য দিয়ে পিসির মন ও হৃদয় ছুঁয়ে গেল সেলিনার চপল সাহচর্য। সেলিনাকে অনেক বার বলতে চেয়েছি, একবার যেন রেহানা আসে, কিন্তু পারিনি, কেন পারিনি জানিনে। সেলিনাও তার উপস্থিতির মধ্যে একবারও রেহানার নাম পৰ্য্যন্ত উচ্চারণ করে নি। একদিন শুধু বলেছিল না প্রান্তিক ভাই, ও যা ভয় করেছিল, তা হয়নি জুরে পড়তে হয় নি ওকে। ভালো আছে। ব্যাস্ আর কোন কথা নয়। আফরোজ বেগম একদিন এসে পিসিকে দেখে গেছেন। সেলিনা ও আফরোজ বেগমের মধ্য দিয়ে পিসির অনেক ভুলের অবসান হয়েছে মুসলিম রক্ষণশীলতা সম্পর্কে। একদিন নীলাঞ্জনা সেলিমাকে রেহানার কথা জিজ্ঞাস করেছিলেন, তাতে সেলিনা বলেছিল, আমাকে বুঝি আপনার আর ভাল লাগছে না ঠিক আছে ওকেই পাঠিয়ে দেব। আমি আর আসব না। অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়েছিল সেলিনা। নীলাঞ্জনা বললেন, পাগলি মেয়ের কাণ্ড দেখ। আমি কি তাই বলেছি।
রেহানার আসা হয়নি। সেলিনাই এসেছে। বেশীর ভাগ সময় সে পিসির সঙ্গে কাটিয়ে গেছে। আমার কাছেও এসেছে, তবে খুব কম।
শরীরটা যথেষ্ট দুর্বল তবে সুস্থ হয়ে উঠছি তাড়াতাড়ি। পিসি, গতদিন কাজে জয়েন করেছেন। অনেকদিন পরে ঘর থেকে বেরিয়ে তার মনটাও অনেকটা ভাল। অবশ্য সেলিনার সাহচার্যে তার চপলতা ও চঞ্চলতার মধ্য দিয়ে অতীতকে যেন খুঁজে পেয়েছেন নীলাঞ্জনা। আজ অফিস থেকে ফিরে বললেন, সেলিনা আসেনি? আমি বললাম তোমাকে তো বলে গেল ও আজ আসবে না। বলেছিল বুঝি, তা তুমি আজ কেমন আছ? ভাল ও আচ্ছা শোন, মিনতি সেন আজ আমার অফিসে ফোন করেছিলেন তোমাকে। কেন? এর আগেও নাকি ২/১ বার করেছেন। খুব দরকার বুঝি? হ্যাঁ উনি বললেন, তোমাকে ওঁর ভীষণ দরকার। কবে নাগাদ তুমি যেতে পারবে। তুমি জিজ্ঞাসা করনি কি দরকার? করেছি, তবে বলেননি। কিন্তু মনে হল, সত্যি তোমাকে তার প্রয়োজন। পারবে নাকি একবার যেতে? আমি বললাম, প্রয়োজন নিশ্চয়ই আছে, তবে কিসের প্রয়োজন সেটাইতো বুঝতে পারছি না। পিসি বললেন, উনি কাল আবার ফোন করবেন। আমি বললাম, তুমি একটা কাজ করবে পিসি? কি? ফোন করলে বল না যে উনি যদি পারেন তবে যেন একবার আসেন। বলেছিলাম। উনি কি বললেন? বললেন যে একদম সময় করতে পারছেন না। তাই তুমি যেতে পারলে ভাল হয়। তুমি বলেছ কি, আমি কয়দিন ধরে অসুস্থ তাই যেতে পারিনি। না আমি কিছু বলিনি। কাল ফোন করলে কি বলব, তাই বল। যা ভাল বোঝ তাই বলল। আমার একা একা অতদূর যাওয়ার ক্ষমতা নেই, এইটুকু তোমাকে বলতে পারি। আচ্ছা তাই হবে।
প্রায় ২ মাস হয়ে এল, রেহানার সঙ্গে আমার দেখা সাক্ষাৎ নেই। এত দীর্ঘদিন ওকে না দেখে থাকিনি কখনো। কত কথা যেন জমা হয়ে আছে মনের মধ্যে। এমন করে ওর অভাবতো জীবনে কখনো অনুভব করিনি। কোন দিনই বেশী কথা বলেনা রেহানা। ওর উৎকণ্ঠা এবং নৈকট্য তাও চিরদিন দূরে দূরে থেকেছে। এক সঙ্গে পথ চলতেও দেখেছি সামান্য ২/১টা কথা চাপা ভাবে বলেছে ও। আমিও যে ওর সঙ্গে খুব বেশী কথা বলি তা নয়। তবে আকাশ ভরা জোছনা রাতে তার সঙ্গে পথ চলতে চেয়েছি কতবার, কিন্তু বলতে পারিনি। ভোরের শিশির বিন্দুতে রাজপথের পিছল পথে হাটার বাসনাও দুর্নিবার প্রচেষ্টায় দমন করেছি। জীবনের শুন্যতা কেমন ভাবে তার সাহচার্যে পূর্ণতা পেতে পারে ভাবার চেষ্টা করেছি এই দীর্ঘ মাস। ও আমাকে নিষ্ঠুর বলে, প্রাণহীন প্রস্তর খণ্ডের সঙ্গে তুলনা করে, কিন্তু ওকি। ওতো জানে, আমি শুয়ে আছি, এখন আমি কোথাও যেতে পারবো না। পারত না একবার আসতে?
কি হতে এলে? নীলাঞ্জনা পিসি কিছু মনে করতেন? নিশ্চয়ই না। সেলিনার নৈকট্য তার জীবনেও এনেছে এক গভীর পরিবর্তন, কিন্তু সেই নীলাঞ্জনা এক বার, মাত্র একবারই সেলিনাকে বলেছিলেন, রেহানা কি আসতে পারে না একবার? আফরোজ বেগম এলেন অথচ সে এলো না। ও কি বোঝে না, আমার কান উৎকীর্ণ হয়ে কার পদধ্বনি শুনতে চায়। চোখ দুটি দেখতে চায় কার চকিত আবির্ভাব। মন চায় কার নীরবতার বিষণ্ণতায় মগ্ন হতে। আর সেলিনা? তারও যেন কত পরিবর্তন হয়ে গেছে। একি তার অভিনয়? না এমনি ভাবে পরিবর্তনের মাধ্যমে সে কোন নতুন বারতা বয়ে আনতে চায়।
একটু আগে পিসি অফিসে চলে গেছেন। বলে গেছেন, সেলিনা এলে বল ও যেন তোমার খাবার গরম করে দেয়। আর আমার সঙ্গে যেন দেখা করে যায়। আমি অপেক্ষা করে আছি ওর আসার আশায়। আর ভাবছি ও যদি আসে, তবে অনেক দিন পরে, একলা আমাকে পেয়ে সেকি ফিরে যেতে পারবে তার অতীতে? পারবে কি তেমনি হাসিঠাট্টা আর চকিত চঞ্চলতায় আমার মনকে ছুঁয়ে যেতে যেখানে আমি একটি পরশ পাওয়ার অপেক্ষায় থাকি। কিন্তু কোথায় সেলিনা? দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা আসন্ন, সেলিনার দেখা নেই।
ঝপ করে সন্ধ্যা নেমে এলো এক সময়। পায়ে পায়ে এগিয়ে এলাম ঘরে। সুইচ টিপে জ্বালালাম বিদ্যুতের আলো। এলিয়ে দিলাম ক্লান্ত দেহকে নিজের বিছানায়। সেলিনা বলল, এখন শশাবেন না, প্রান্তিক ভাই, আমি কফি নিয়ে আসছি।
খানিক পরে এলো পিসি। সেলিনাকে যেন কতদিন পরে দেখছেন, এমনি এক আনন্দের সুরে ভরে উঠলো মন। বললেন, ভীষণ ক্লান্তি লাগছে, আমার জন্য এক কাপ কফি হবে সেলিনা? সেলিনা বলল, আপনি, হাতে মুখে জল দিয়ে আসুন, আমি এক্ষুনি কফি দিচ্ছি। আপনার জন্যতো কফি করাই আছে।
০৮. নীলাঞ্জনা পিসি
নীলাঞ্জনা পিসি হাতে মুখে জল দিয়ে শাড়ীটা বদলে এসে ডাক দিলেন, সেলিনা। সাড়া দিয়ে সেলিনা বলল, আপনি কি প্রান্তিক ভাইযের ঘরে আসবেন না আপনার ঘরে দেব? বললেন, এ ঘরে নিয়ে এস। আমি তাকালাম সেলিনার দিকে। আমি ইঙ্গিতে ওকে কি যেন বলতে চাইছিলাম, সেলিনা বলল থাক না, ওকে কেন অপমান করতে চাইছেন। ওতো আছে ওর নিজের জায়গায়। হায় বোকা মেয়ে, তুমি বুঝবেনা যে, ভয়টা তোমাকে ন্য ভয় নীলাঞ্জনা পিসিকে। কি জানি, যদি প্রশ্ন করে জানতে চান, কে পরিয়ে দিল, প্রান্তিক?
সেলিনা কফি আর বিস্কুট নিয়ে নীলাঞ্জনার ঘরে গেল, পর্দাটা খোলা। দুটো ঘরের অবস্থান এমন যে পর্দা বা দরজা বন্ধ না করলে একটা ঘরেরই দুটো অংশ বলে মনে হয়।
দেখতে পাচ্ছি সেলিনা ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে, অপলক তাকিয়ে আছেন পিসি ওর দিকে, আর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কি যেন দেখছেন। সেলিনা বলল, অমন করে কি দেখছেন পিসি। চিন্তায় যেন ব্যাঘাত ঘটল এমন ভাবে নীলাঞ্জনা বললেন, না কিছুনা। তারপর জানতে চাইলেন কখন এসেছো? সন্ধ্যার একটু আগে। কাল এলেনা কেন? বা আপনাকে তো বলে গেলাম, আমার একটু কাজ আছে আসতে পারবো না।
নীলাঞ্জনা এতক্ষণে কফি খাওয়া শেষ করে বললেন, খোঁপায় ফুলগুলো কে পরিয়ে দিয়েছে? যা ভয় পেয়েছিলাম তাই হল। সেলিনা কি একটু লজ্জা পেল? এই কি প্রথম মনে হতে লাগল, সত্যি কথা বলবে কীনা। কিন্তু সেলিনাতো সেলিনা, বলল, খারাপ লাগছে? তা হলে খুলে ফেলি? এই দেখ মেয়ের অভিমান, আমি কি তাই বলেছি। তারপর বললেন আমার কাছে এস। সেলিনা কাছে এলে, ওর কপালে একটি চুম্বন একে দিয়ে বললেন, ভারি সুন্দর লাগছে। তারপর নিজের ব্যাগ থেকে আলমারীর চাবি বের করে সেলিনাকে দিয়ে বললেন, ঐ আলমারিটা খোল। সেলিনা ইতস্তত করে বলল, আমি খুলব? কেন তুমি কি খুলতে জানো? পিসি। আমি দেখতে পাচ্ছি, সেলিনার চোখ ছল ছল করে উঠছে। কিন্তু নীলাঞ্জনার সে দিকে কোন ভূক্ষেপ নেই। বললেন, কি হলো তোমাকে খুলতে বলছিনা? ও বলল কোন চাবি দিয়ে খুলব বলে নীলাঞ্জনার দিকে চাবির রিং এগিয়ে দিল। নীলাঞ্জনা বললেন, এই চাবি দিয়ে খুলবে। সেলিনা একটু দ্বিধান্বিত হয়েও আলমারীটা খুলে ফেলল। নীলাঞ্জনা বললেন, ওই উপরেব তাকের থার্ড প্যাকেটটা নিয়ে এস। সেলিনা নিয়ে এলে নীলাঞ্জনা বললেন, খোল প্যাকেটটা। খুললে বেরিয়ে এল ময়ুর রং-এর একেবারে আনকোরা একটা শাড়ী, অপূর্ব রঙের বাহাব। নীলাঞ্জনা বলেলেন, ওটা দাও আমাকে। তারপর শাড়ীটা হাতে নিয়ে সেলিনাকে বললেন, গত নববর্ষে হঠাৎ খেয়ালে কিনেছিলাম এটা, ঠিক নিজে পরব বলে কিনিনি, তবু প্রান্তিক বলেছিল, পিসি এ শাড়ীটায় তোমাকে ভীষন মানাবে। বলেছিলাম ধ্যাৎ ঐ শাড়ী পড়ার বয়স আছে নাকি? উত্তরে ও কি বলেছিল জান? উৎসুক হয়ে তাকায় সেলিনা শোনার অপেক্ষায়। নীলাঞ্জনা বললেন ও সেদিন বলেছিল, আসলে তোমার মনটা মরে গেছে পিসি তা না হলে বয়স তোমার এমন কিছু নয় যে এই শাড়ী পরতে তোমার অরুচি হবে। সেলিনা বলল ঠিকইতে পিসি। প্রান্তিক ভাইতো কোন অন্যায় কথা বলেননি, আপনার মত সুন্দরী আমি খুব কমই দেখেছি। নীলাঞ্জনা সেলিনার কথাটাকে ঠাট্টার ছলে উড়িয়ে না দিয়ে বললেন, সব সন্তানের কাছে তার মা সুন্দর। তোমারও তাই মনে হয়েছে সেলিনা। যাক গে সে কথা। প্রান্তিকের সে দিনের সে কথায় খুব একটা গুরুত্ব দিইনি যে আমার মন মরে গেছে। আপন খেয়ালে যে শাড়ীটা কিনেছিলাম, পরা আর তা হয়নি। প্যাকেট সমেত ওটাকে যেখান থেকে তুমি নিয়ে এলে, ওখানেই ওটা আছে সেই প্রথম দিন থেকে। কেন? পরলেন না কেন? জানতে চাইলো সেলিনা। নীলাঞ্জনা বললেন সে তো ঠিক জানিনা সেলিনা, আসলে পরে ধীরে ধীরে বুঝতে পেরেছিলাম প্রান্তিকই ঠিক, জোর করে মনটাকে যতই সতেজ রাখার চেষ্টা করিনা কেন, জলের অভাবে তা যে কখন শুকিয়ে যায় বুঝতেও পারিনা আমরা। একটা হতাশা ফুটে ওঠে নীলাঞ্জনার কণ্ঠে।
শুয়ে শুয়ে ভাবছি, কি বলতে চাইছেন পিসি? হ্যাঁ আমি জোর করে ঐ শাড়ীটা কিনিয়েছিলাম, কারণ কথাচ্ছলে একটা শাড়ীর দোকানে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন আমার ভীষণ পছন্দের শাড়ী, রঙটাও অপূর্ব। আমার ভীষণ মনে রাখবার মত রঙ। বলেছিলাম, তা হলে শাড়ীটা কিনে নাও। বলেছিলেন, আজ টাকা নেই, আর এক দিন কিনব। তাইতো জোর করেছিলাম।
সেলিনা বলল, বুঝতে পারছি প্রান্তিক ভাইয়ের প্রতি অভিমানে আপনি ও শাড়ীটা পরেননি। আজ তা হলে আমার অনুরোধে এই শাড়ীটা পরুন। সত্যি অপূর্ব লাগবে আপনাকে। ভাবছি পরবো, তারপর বললেন, এবার এই চাবিটা নিয়ে লকারটা খুলে ফেলতো। ওর ভিতর আমার গয়নার বাক্স আছে নিয়ে এস। সেলিনা বুঝতে পারছেনা এসব তাকে দিয়ে করানো হচ্ছে কেন? উনি নিজেও তো একাজটা করতে পারতেন। কিন্তু এটা তার মনের ভাবনা। বাইরে সে নীলাঞ্জনার আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলল।
আমার কেমন যেন সন্দেহ হতে থাকে, পিসীর আজকের আচরণ মোটই স্বাভাবিক নয়। গয়নার বাক্সটা নিয়ে এলে, নীলাঞ্জনা বললেন, এই আমার যাবতীয় গয়না। বলত সেলিনা এই শাড়ীর সাথে কোন গয়না গুলো আমাকে মানাবে। সেলিনা বলল, আমিতো ঠিক অতশত বলতে পারবো না পিসি। কারণ গয়না পরার অভ্যেস খুব একটা নেই। আর তা ছাড়া আত্মীয় স্বজনের বাড়ীতে বেড়াতে গেলে, বা ছোট খাট উৎসবে যে গয়না মানাবে, কোন পার্টিতে নিশ্চয়ই তা মানাবেনা। নীলাঞ্জনা বললেন আমি কোথাও যাব না, তোমার সামনেই বসে থাকবো। তুমি শুধু দেখবে আমাকে, দেখবে আর বলবে, আমি কি আগের মত আছি তোমার চোখে আমাকে মানাবে, শুধু সেই গয়না গুলো বের কর। সেলিনা বলল, প্রান্তিক ভাইকে ডাকি। কেন ওকে কেন? শুধু আমি দেখব উনি দেখবেন না? তা ছাড়া যে সাজ আমার ভাল লাগবে ওনারতো তা নাও লাগতে পারে। নীলাঞ্জনা হঠাৎ বললেন প্রান্তিককে তুমি খুব ভালবাস তাইনা? আমি লজ্জায় অন্য দিকে ফিরে শুলাম। সেলিনা বলল, শুধু প্রান্তিক ভাই কেন, আমিতো আপনাকেও ভীষণ ভালবাসি? আমি বিশ্বাস করি সেলিনা, সত্যিই তুমি আমায় ভালবাস, তা না হলে তোমার জন্য এত অভাব বোধ করি কেন? কেন একদিন না এলে এমন শূণ্য শূণ্য লাগে। কিন্তু কি মনে হয় জান আমার? কি? প্রান্তিককে তুমি এত ভালবাস বলেই, আমাকে তুমি এত ভালবাস। তারপর কি যেন বলতে গিয়ে সেলিনাকে বশ্লেন দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এস। সেলিনা বলে থাকনা। কেন আমাকে বিশ্বাস করতে পারছনা? সেলিনা আর কোন কথা না বলে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে ফিরে আসে। নীলাঞ্জনা বললেন, প্রান্তিককে আর একজন ভালবাসে তার মন প্রান দিয়ে, তাই তুমি তোমার চঞ্চলতা, চপলতা, হাসি ঠাট্টার মাঝে নিজের বেদনাকে লুকিয়ে রেখে প্রান্তিকের ভালবাসার পাত্রীর জন্য পথ প্রশস্ত করে চলেছে এই তো।
তীব্র প্রতিবাদ করে বলে উঠলো সেলিনা না না পিসি এ মিথ্যা, আমি রেহানার মত ওকে ভালবাসি না। ওমন করে জীবনের সর্বস্ব দিয়ে, শুধু প্রান্তিক ভাইকে কেন কাউকে ভালবাসিনা। তারপর বলল আমি অনেক তুচ্ছ পিসি, রেহানার ভালবাসার কাছে, আমি একেবারে খেলার সামগ্রী মাত্র। কেঁদে ফেলল সেলিনা। ওকে নিজের বুকের পরে টেনে নিয়ে, চোখের জল নিজের আঁচলে মুছিয়ে দিতে দিতে নীলাঞ্জনা বল্লেন, আমি জানতাম সেলিনা কান্না ছাড়া তোমার কোন পথ নেই। যতই তুমি বক্সিং-এর মেয়ে হিসাবে নিজের পরিচয় দিতে ভালবাসনা কেন, আসলে তোমার মন রেহানার থেকেও নরম। আর নরম বলেই মুখে তুমি এত জোর দেখাও। রেহানাকে দেখিনি, হয়তো সে তোমার থেকেও সুন্দরী, হয়তো প্রান্তিককে ভালবেসে সে পৃথিবীকে ভুলে থাকতে পেরেছে। অবশ্য এ শুধু আমার অনুমান মাত্র। আর তুমি, সবাইকে ভালবেসে, প্রান্তিকের প্রতি তোমার ভালবাসাকে ভুলে থাকতে চেয়েছে। রেহানার কান্না হয়তো একদিন শুকিয়ে যাবে, কিন্তু সেলিনা এই ব্যঙ্গ বিদ্রূপ হাসি ঠাট্টার মাঝে যে চোখের জল তুমি অহর্নিশি ফেলে চলেছে তা শুকাবে কি করে?
এমন তীব্র আক্রমণ, মনের অষ্ঠমহলেব সত্যকে এমন করে তুলে নিয়ে আসার স্পষ্ট ঘোষণায় বিব্রত হয়ে পড়ে সেলিনা। তার তো বয়স এমন নয়, তাই আজ যা সে হেলায় হারিয়ে ফেলতে পারে, জীবন অভিজ্ঞতার আলোকে অভিজ্ঞ নীলাঞ্জনারা তা পারে না। তারা জীবনকে বুঝতে শিখেছেন অভিজ্ঞতার কষ্টি পাথরে যাচাই কবে। কিন্তু তবু সেলিনা একমত হতে পারে না নীলাঞ্জনার সাথে, বলে না পিসি এ আপনার ভুল। আমার কোন দুর্বলতাই প্রান্তিক ভাইকে স্পর্শ করেনি। আমিতো জানি তাকে। হয়তো আপনি আমার থেকেও অনেক বেশি জানেন, তবু বলব, আপনিও প্রান্তিক ভাইকেভাল চেনেননি। ক্ষণিকের দুর্বলতা, ক্ষণিকের ভাললাগা দিয়ে কোন মানুষের বিচার করা যায় না পিসি। তারপর বলল আমি যখন হাসপাতালে ছিলাম, তখনতো রোজ প্রান্তিক ভাই যেতেন আমাকে দেখতে। মান, অভিমান, অবুঝ জেদে মন যে একেবারে কখনো দুর্বল হয়নি–তা কিন্তু নয় পিসি। কিন্তু সে দিন আমি আর একজনকেও দেখেছি, দেখেছি তার নিবেদিত আত্ম সমর্পণকে, তবুতো রেহানার উপর থেকে এক বিন্দু টলানো যায় নি প্রান্তিক ভাইকে। আসলে আমার মনে হয়, ও কারো কাছে ধরা দিতে চায় না। ও যেন দূর আকাশের তারকা মাত্র। এরপর খিল খিল করে হেসে উঠে সেলিনা বলল, কি পাগল না আমি পিসি? যা নয় তাই ভেবে দুঃখ পাই। তারপর বলল এবার এই শাড়ীটা পরুনতো। নীলাঞ্জনা বললেন, হ্যাঁ এই পরি, তার আগে গয়না গুলো পছন্দ কর। সেলিনা, সত্যি নীলাঞ্জনাকে যা মানাতে পারে এমন বেশ কয়েকটি গয়না পছন্দ করে নীলাঞ্জনার হাতে দিল। নীলাঞ্জনা একটু হেসে তা গ্রহণ করল। তাবপর সেলিনাকে বল, এই ঘরের লাগোয়া একটা বাথরুম আছে। যাও ভাল করে চোখে মুখে জল দিয়ে এসো তো। কেন? তারপরে বলল একেবারে বাড়ী গিয়েই চোখে মুখে জল দেব তা ছাড়া রাতও তত বাড়ছে। নীলাঞ্জনা বললেন, আমি তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আসব। আনন্দে হাততালি দিয়ে সেলিনা বলল আপনি যাবেন? হ্যাঁ যাবে, তবে একটা সত্ত্বে। কি? কোন সন্তানকি তার মাকে তোমার মত করে কথা বলে। না বুঝতে পেরে তাকিয়ে থাকে সেলিনা। নীলাঞ্জনা বললেন, প্রথম দিনই তুমি বলেছিলে প্রান্তিকের মা আমি নাইবা হলাম, কিন্তু তোমার মা হতে আপত্তি নেইতো।
না আগে বুঝতে পারেনি সেলিনা, কোন হৃদয়ের নিঃসঙ্গতা এমন করে কোন পূর্ণতার দিকে এগিয়ে যায় কি না। সেদিন ছিল নীলাঞ্জনাকে বোঝার স্পৃহা। আর আজ নিজেকে বোঝার তাগিদ। কি চাই আমি? আমার পথ কি ঠিক পথ? বলল, কিন্তু পিসি, আমি কি পারব তোমার যোগ্য মেয়ে হতে। আবারও নীলাঞ্জনা তাকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে বললেন, একবার আমার বুকে কান পেতে শোনতো মেয়ে এ কিসের হাহাকার। আর তোকে বুঝতে পারব না? যে তুই, কি ভাবে আমার সমস্ত হৃদয়টাকে চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল। তারপর প্রায় ভগ্ন কণ্ঠে বলেন তোকে যদি আরো কিছুদিন আগে পেতাম সেলিনা। নিজেকে তাহলে কিছুতেই এমন করে শেষ হতে দিতাম না। সেলিনা অবাক। মুগ্ধ বিস্ময়ে একেবারে নিশ্চল। দুটি পা যেন নিথর। কোনদিকে এগোবার শক্তি নেই। নীলাঞ্জনা তা বুঝতে পেরে নিজেই সেলিনাকে নিয়ে গেলেন বাথরুমে। তারপর চোখে মুখে জল দিয়ে, আবার তাকে ফিরিয়ে নিয়ে এলেন। এবং ময়ুব রঙের শাড়ীটি তার হাতে দিয়ে বললেন আমি ও ঘরে যাচ্ছি, ততক্ষণে, শাড়ীটা পরে ফেলতো। আমি? হারে মেয়ে, তুই না পরলে কি আমি পরবো? পিসি। ঠিক আছে আর কথা বাড়াতে হবে না, তাড়াতাড়ি পরে ফেল।
অগত্যা সেলিনাকে শাড়ীটা পরতে হয়। মিনিট দশেক পরে শাড়ীটা পরে ফিরে এলো, নীলাঞ্জনাতে চোখ ফেরাতে পারেন না দেখে। অপূর্ব মানিয়েছে সেলিনাকে। কিন্তু বড্ড বেখাপ্পা লাগছে খোঁপা। ও টাকে সুন্দর করে বেনী করে দিলে ভাল লাগতো, কিন্তু কোথায় যেন বাধা, পারলেন না বলতে নীলাঞ্জনা। হয়তো ওর ভিতর আছে অনেক স্মৃতি। তাই ওদিকে না গিয়ে, তার জন্য যে গয়না পছন্দ করেছিল সেলিনা, এক এক করে সব গয়না নিজের হাতে পরিয়ে দিলেন তাকে। তারপর আয়নার কাছে নিয়ে গিয়ে বললেন, দেখতো ঠিক আছে কি না। আমি কি করে বলব, তুমিই দেখনা। নীলাঞ্জনা ওর খোঁপার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন, ওটা থাকবে না খুলে নুতন করে বেঁধে দেব? তোমার যা ভাল লাগে। না থাক। তারপর, সন্ধ্যায় যে সাজে সাজতে হয় সেই সাজে সাজিয়ে দেওয়া হল সেলিনাকে। সাজানো শেষ হলে বললেন, চলতো প্রান্তিকের কাছে? কেন আবার ওর কাছে কেন? বাঃ তোর সাজে কোথাও কোন ত্রুটি আছে কি না ও দেখুক।
এই বোধ হয় প্রথম লজ্জায় ভেঙে পড়তে চাইল সেলিনা। বলল না পিসি, আমি যাব না। কেনরে? এই অল্প সময়ে এমন কি হল, যাতে ওর কাছে যাওয়া যাবে না। না ঠিক তা নয় পিসি। আসলে, প্রান্তিক ভাইয়ের ইচ্ছেয় একদিন যে শাড়ী তোমার জন্য কেনা হয়েছিল, সেই শাড়ী পরে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারব না আমি। বেশ, নীলাঞ্জনা বললেন, তা হলে ওকেই ডাকছি। বলে আর অপেক্ষা না কবে ওখান থেকেই চিৎকার করে বললেন, প্রান্তিক একবার এদিকে এসতো।
এতক্ষণে ওদের সব কথাই আমি কান পেতে শোনার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু সব কথা শোনা যায় নি। যা শুনেছি, তাতে মনে হয় না, সেলিনার সামনে আমি স্বাভাবিক হতে পারবো, সেলিনাও পারবে কী না আগের মত স্বাভাবিক হতে জানিনা। তবু পিসির ডাকে সাড়া দিয়ে এলাম। সত্যি অপরূপা যেন। এরই মধ্যে উধাও বেমানান খোঁপাটি। নীলাঞ্জনা বললেন, তোমরা কথা বলতে থাক, আমি আরেক কাপ চা খাব। তোমরা খাবে? আমি বললাম, আমি খাব, কিন্তু তোমার মেয়ে খাবে কি না জানি না।
অর্থাৎ প্রান্তিক সবই শুনেছে, ধরে নেয় সেলিনা। বলে আমিও খাব পিসি। নীলাঞ্জনা চলে গেলে, সেলিনা বলে, পিসি জোর করে পরিয়ে দিলেন। যেন আত্মপক্ষ সমর্থনের কৈফিয়ৎ দিচ্ছে সেলিনা। বললাম, মা তার মেয়েকে পরিয়ে দিয়েছেন, এটাই তো স্বাভাবিক নিয়ম। সেলিনা প্রতিবাদ করে বলল, হয়তো স্বাভাবিক নিয়ম, কিন্তু আমার কাছে এটা অস্বাভাবিক। কেন? এর কোনটার প্রতি আমার কোন অধিকার নেই। কেন? নেই কেন? কে আমি নীলাঞ্জনা পিসির? তুমি তার মেয়ে সেলিনা। পিসির সম্পর্কে তুমি কিছুই জানো তাই এসব বলছ। যদি তুমি জানতে, তার জীবনের কোন শূণ্যতাতুমি ভরে দিয়েছে, তা হলে একথা বলতে না।
তারপর হঠাৎ তার দিকে তাকিয়ে বললাম, পিসিকে বলনা মেকআপটাকে একটু খানি মডার্ন করে দিতে। কথাটা শুনতে ভুল হয় না নীলাঞ্জনার।
তিন কাপ চা নিয়ে এসে বললেন, যদি ওল্ড বলে কিছু মনে হয়, নিজেই তো তাকে মডার্ন করে দিতে পারো। পিসির উপর দোষারোপ করে কি লাভ? উত্তরে বললাম, লাভ লোকসানের কথা নয় পিসি, আসলে অধিকার। মা মেয়ের অধিকারে আমি বাইরের লোক, আমার প্রবেশাধিকার কি ঠিক হবে।
সবটা হয়তো ঠাট্টা, কিন্তু সেলিনার কেন যে সর্বাঙ্গ জ্বলে যেতে লাগল বুঝতে পারছেনা। তবে কি প্রান্তিক ভাই এসব চান নি? ক্ষণিকের জন্যও কি মনে হয় নি, সেলিনা অপূর্ব তুমি, সুন্দর তুমি, তোমাকেও ভালবাসা যায়।
সেলিনা বলল, আপনার যদি হিংসা হয়ে থাকে, পিসিকে আপনার কাছ থেকে কেড়ে নিচ্ছি বলে, আপনি আসুন না, আমার বক্সিংএর রিং-এ। যদি পারেন আমাকে হারিয়ে দিয়ে ছিনিয়ে নিন না পিসিকে। পিরবো না। আমার না উত্তরে বলল পারবেন কি করে, আপনার তো সামান্য পছন্দটুকুর পর পর্যন্ত কোন অধিকার নেই, আপনি দাবি করবেন পূর্ণাঙ্গ মানুষটির অধিকার?
মনে যা আসছে তাই বলে যাচ্ছে সাবলীল ভাবে। মনে মনে ভাবি, এমন করে বলতে পারে কী করে? কোন লজ্জা বা সঙ্কোচ কি তার পথরোধ করে দাঁড়ায় না? তারপর যেন কত ব্যস্ত, এমনি দ্রুততায় বলল, কি হল, খুলুন না তাড়াতাড়ি, সময় যে বয়ে যাচ্ছে।
এ সেলিনাকে অস্বীকার করা যায় না। তার দাবি, তার জেদ, তার অভিমান, না মেটা পর্যন্ত যেন রেহাই নেই। আজ সেলিনার উপর কোন দাবি নয়। ও আজ পিসির হয়েই থাকুক। তার শূন্য হৃদয় ভরে উঠুক সেলিনার দুরন্তপনার স্পর্শে, ভালবাসায়, আর শ্রদ্ধায়। বেরিয়ে যাওয়ার মিনিট দশেক পরে, আবার আমার ঘরে এসে বলল, কই চলুন। কোথায়?
এখনো রাত বেশী হয় নি। একটা খালি ট্যাক্সি পাওয়া দরকার। ওকে ওদের বাড়ীতে পৌঁছিয়ে দিয়ে আবার ফিরে আসতে হবে। উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করছে পিসি এবং কিছুক্ষণের মধ্যে সত্যি সত্যি পাওয়া গেল একটা ট্যাক্সি। কিছুতেই যাবে না। তারপর অবশ্য রাজী হয়েছে, তবে যাতায়াতে যা হবে তার থেকে ৫ টাকা বেশী দিতে হবে। পিসি তাতেই রাজী। আমার আর যাওয়া হয়না।
সেলিনা বাড়ীতে বেল দিতেই রেহানা দরজা খুলে দিলো। আর সামনে নীলাঞ্জনাকে দেখে অবাক হয়ে বলল, আপনি? আমাকে চেন কি? না মানে। সরাসরিই বল না আমাকে চেন কি না। ওর অবস্থা তো তথৈবচ। কিছু বলতেই যেন ভয় পাচ্ছে। সেলিনা পাশে এসে বলল। রেহানা আমার দিদি। সেতো বুঝতেই পারছি। কিন্তু ও আমাকে চেনে কী না, এ প্রশ্নের উত্তর দিতে এত দ্বিধা কিসের? তবুও কোন উত্তর না দিয়ে এক পাশে সরে দাঁড়িয়ে বলল ভিতরে আসুন। নীলাঞ্জনা ভিতরে ঢুকতেই তাকে পা ছুঁয়ে প্রণাম করল রেহানা। বলল, চলুন, ভিতরের ঘরে মা আছেন। রেহানা নীলাঞ্জনাকে ভিতরের ঘরে, যেখানে আফরোজ বেগম আছেন সেখানে নিয়ে এসে বলল, আমার মা। সেলিন্না সম্ভবত আগেই কিছু বলে থাকবে। নীলাঞ্জনা নমস্কার করতে আফরোজ বেগম বললেন,কি সৌভাগ্য আমার আপনি এসেছেন আমার ঘরে। কেন, আমি কি আসতে পারি না। আপনি এবং আপনার মেয়েরা এত করবেন। আর আমি সামান্য আসতে পারবো না। তা হয় নাকি? রেহানা তখনো দাঁড়িয়ে আছে দেখে আফরোজ বেগম বললেন, যা তো মা, ওনার জন্য এক কাপ কফি বা চা যা হোক নিয়ে আয়। রেহানা, রান্না ঘরে গিয়ে চায়ের জল বসিয়ে চলে এল নিজের ঘরে, সেলিনাও আছে ও ঘরে। ভীষণ ভাল লাগছে সেলিনাকে। সত্যি সাজলে ওকে এত ভাল লাগে, যা কল্পনাও করা যায় না। রেহানা অকারণ ওকে জড়িয়ে ধরল। সেলিনা একটু হাসল তারপর বলল, আচ্ছা রেহানা, আমি ওখান থেকে আসলে দেখি রোজ আমাকে জড়িয়ে ধরিস, কি পাস এতে। আর কেন যে তুই এত ভীরু, কেন যে তুই তোর দাবি প্রকাশ করতে পারিসনে, কেন যে মিছিমিছি কষ্ট পাস আমি বুঝি না। তারপর বলল, না রেহানা, আমি তোর হয়ে আর এত প্রক্সি দিতে পারবো না। এবার থেকে তোর নিজের জিনিষের দায়িত্ব নিজে বুঝে নিবি। আমার দ্বারা আর কিচ্ছুটি হবে না। আর তাছাড়া আজ প্রান্তিক ভাই যা অপমান করেছেন তাতে আমি আর কোনদিন যাবো না ওর কাছে।
ব্যাথা পায় রেহানা, বলে প্রান্তিক তোকে অপমান করেছে? সত্যি বলছিসতো। সেলিনা বলল তোকে মিথ্যে কথা বলে আমার লাভ? রেহানা বলল, দাঁড়া খুলিসনা কিছুই, আমি আসছি।
রেহানা চা মিষ্টি, নিমকি বিস্কুট সবকিছু একসঙ্গে সাজিয়ে নিয়ে আসে যে ঘরে নীলাঞ্জনা আছেন সে ঘরে। ওগুলো সব এক জায়গায় নামিয়ে রেখে পাশে সরে দাঁড়ায়। নীলাঞ্জনা অপলক তাকিয়ে আছেন ওর দিকে। এত কী দেখছেন কে জানে? লজ্জা পায় রেহানা। নীলাঞ্জনা বলেন বোস এখানে। রেহানা একটু দুরে বসে। নীলাঞ্জনা জানতে চায় তুমি তো প্রান্তিকের সঙ্গে এবার পরীক্ষা দেবে তাই না। রেহানা মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। কলেজে যাচ্ছ তো নিয়মিত? হ্যাঁ। শুনেছিলাম তোমার শরীরও বেশ খারাপ ছিল। তা এখন ভাল আছো। ভাল আছি। নীলাঞ্জনা বললেন ওতো প্রায় দেড় মাস হতে চলল কলেজে যেতে পারছেনা। তুমি এর মধ্যে একদিনও গেলে না কেন আমাদের ওখানে? কোন উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকে রেহানা। অবশ্য তার উত্তর দেওয়ার মতো কিছু ছিলও না। চা খেতে খেতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ভাল করে দেখে নেন নীলাঞ্জনা রেহানাকে। রেহানা বলল আপনি মায়ের সঙ্গে কথা বলন, আমি আসছি। তাকে বাধা দিয়ে নীলাঞ্জনা বললেন না শান। ও দাঁড়ায়। তারপর নিজের ব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট এবং একটা গয়নার বাক্স তার হাতে দিয়ে বলেন শুধু ছোট মেয়েকে দেব, বড় মেয়েকে দেব না তা তো হয় না মা, এটা নাও। না করো না। আফরোজ বেগম বাধা দিয়ে বললেন এসব আপনি কি করছেন দিদি। এমন ভাবে ঋণে জড়াচ্ছেন কেন আমাদের। নীলাঞ্জনা খানিকটা আপন মনে বললেন ঈশ্বর আমাকে মা হওয়ার অধিকার দেন নি, ভালই করেছেন, তার যা ইচ্ছে। শুধু তার বিরুদ্ধে একটা মাত্র অভিযোগ, কেন তিনি আমার মাতৃ হৃদয়টাকে বাঁচিয়ে রাখলেন? একটা দীর্ঘশ্বাস টেনে নিয়ে এরপর রেহানাকে বললেন, ও মা না করোনা। রেহানা আবার এগিয়ে এসে তাকে প্রণাম করল এবং ওগুলো নিয়ে আস্তে আস্তে বেরিয়ে গেলো। নীলাঞ্জনা বললেন, এবার যে আমাকে উঠতে হবে দিদি। রাত হয়েছে, প্রান্তিক একা আছে। আফরোজ বেগম জানতে চাইলেন ও কেমন আছে? উত্তরে নীলাঞ্জনা বললেন এখন অনেকটা ভাল। তবে পুরো সুস্থ হতে হয়তো আরো কিছু সময় নেবে। আফরোজ বেগম আপন মনে বললেন আল্লাহ তুমি পরম করুণাময়। না আর দেরি নয়। উঠে পড়লেন নীলাঞ্জনা। ওখান থেকে এলেন ওরা দুবোন যে ঘরে আছে সে ঘরে। নীলাঞ্জনা শুনতে পাচ্ছেন, রেহানা বলছে ছিঃ সেলিনা, এই সামান্য ব্যাপারে কাউকে ভুল বুঝতে নেই। ও মোটেই তোকে অপমান করেনি। গোধুলি সন্ধ্যায় যা ছিল সত্য এবং সুন্দর, অস্ত সন্ধ্যায় তাকে হয়তো তত ভাল বলে মনে হয়নি, বাসি ফুলের মত তাই তাকে ফেলে দিয়েছে। এতে তুই অপমানিত বোধ করছিস কেন? নীলাঞ্জনা বাইরে থেকে ওকে বললেন, সেলিনা আমাকে যে উঠতে হবে মা, তারপর রেহানাকে বললেন, ডাঃ সরকারের চেম্বার তো কাছেই তাই না? চল না রেহানা আমাকে একটু ওই চেম্বার পর্যন্ত পৌঁছে দেবে।
পথে আসতে আসতে রেহানাকে বললেন, মিনতি সেন ফোন করেছিলেন। তোমাকে ও প্রান্তিককে ভীষণ ভাবে যেতে বলেছেন, বিশেষ দরকার। কাল দুপুরে তুমি প্রান্তিককে নিয়ে একবার যেও। আমাকে বলেন নি, কি দরকার, তবে প্রয়োজন এটা বুঝতে পারছি। যাচ্ছ তো? আস্তে রেহানা বলল নিশ্চয়ই যাব। চেন তো আমাদের বাড়ী। অসুবিধা হবে না। আচ্ছা এরপর আর কোন কথা না বাড়িয়ে একটা চলতি ট্যাক্সিতে উঠে পড়লেন নীলাঞ্জনা পিসি।
রেহানা বলল, আপনি ডাক্তার সরকারের চেম্বারে যাবেন বললেন যে। না আজ আর হবে না। ট্যাক্সিতে উঠতে উঠতে বললেন, কাল যেও কিন্তু। নিশ্চয়ই যাব। ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিল।
দুপুর বেলা, বাড়ীতে এসে বেল দিল রেহানা, আমি শুয়ে আছি, আবারও ডোর বেলটা বাজছে। পিসি নেই। আস্তে আস্তে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিয়ে আমিতো অবাক। কয়েকটা মুহূৰ্ত্ত মুখে কোন কথা নেই। তারপর বললাম রেহানা তুমি! মৃদু হেসে রেহানা বলল, তুমি বুঝি আমাকে চাওনি না? আমি অভিমান করে বললাম জানিনা। ভিতরে আসব? আসবে না কেন? যদি আমাকে দেখে তোমার ভাল না লাগে, যদি অসুস্থ হয়ে পড়। আমি ওর কথার প্রতিবাদ না করে বললাম, বাজে কথা না বলে ভিতরে এস।
বিছানার চাদরটা এলোমেলো। বালিশের ওয়াড় এবং ঢাকনা ঠিক জায়গায় নেই। পড়ার টেবিলটা কবে থেকে জঞ্জাল হয়ে আছে। আমি বিছানায় বসতে গেলে ও বলল, এই চেয়ারটায় বোস না। কেন? আরে বোস না? আমি চেয়ারটায় বসলে, ও তার অভ্যস্ত হাতে সুন্দর করে বিছানাটা গুছিয়ে দিল। পড়ার টেবিলটাও গুছিয়ে ফেলল এর মধ্যে। বালিশ ওয়াড় ঢাকনা যেমনটা হওয়ার কথা তেমনি করে দিয়ে বলল, এখন শোবে? না থাক বসেই কথা বলছি। রেহানা বলল না, তুমি শুয়েই পড়। আমি বলছি তোমার মাথার কাছে। তুমি শুয়ে শুয়েই কথা বল আমার সঙ্গে। আমি কোন কথা না বলে চুপ করে রইলাম। ও বলল আমার সঙ্গে কথা বলবেনা? তার পরে বলল এটা রাগ না আমার উপস্থিত্তি তোমার কাছে বিরক্তি কর লাগছে?
কি যে বলব ওকে। আমি ওর একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বললাম, আমি নিষ্ঠুর তাই না? আমি পাষাণ এইতো? হ্যাঁ তাইতো। আর তুমি? কি আমি? এই দেড় মাস কি আমাকে ভুলে যাওয়ার সাধনা করছিলে? তুমি চুপ করবে? কেন চুপ করব? আমার প্রাণ নেই? মন নেই আমার? দেহ কি রক্ত মাংসের নয়? এই সব বুঝি ভাব সব সময়? সত্যি কি ছেলেমানুষ তুমি? হ্যাঁ হ্যাঁ আমি ছেলেমানুষ।
রেহানা বলল, থাক ও সব কথা প্রান্তিক। তুমি যেতে পারবে আমার সাথে? কোথায়? আমার সঙ্গে যাবে তাও প্রশ্ন? না প্রশ্ন নয়। শরীর পারমিট কববে কিনা তাই শুধু ভাবছি। ভাবছ, কিন্তু কেন? আমি তো সঙ্গে রয়েছি। বললাম, হ্যাঁ তাতো আছই। ও বলল আমার প্রশ্নের কিন্তু কোন উত্তর দাও নি এখনো। সব উত্তর দেওয়া যায় না রেহানা। তাছাড়া তুমিতো এই সবে এলে। এখন বলছ, তুমি আমার সঙ্গে আছো, অথচ এই দেড় মাস? তুমিতো একবারও আমার কথা ভাববার সময় পাওনি। ও বলল, কেন বোঝ না? তাছাড়া আমার আসাটাই কি সব? আমি তোমার মন জুড়ে আছি কিনা সেটাই তো আসল কথা? উত্তরে বললাম যদি বলি না নেই। রেহানা বলল, তোমার বলার অপেক্ষায় থাকবনা সেদিন। যেদিন জানতে পারবো, রেহানা নয়, আর কেউ তোমার মন জুড়ে আছে। কোন অনুযোগ বা অভিযোগ জানাব না। এমনিই চলে যাবো। তোমাকে বুঝতেও দেবনা। আমি বললাম, তুমি এমন করে দূরে দূরে থাক কেন? এ তোমার ভুল। আসলে এখনো তুমি আমায় আলাদা করে ভাবো। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, তোমার বুঝি তাই মনে হয়। না বলে একটু হেসে উঠে গিয়ে সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে বলল, কই ওঠ। তুমি আমাকে হাত ধরে তোল। তুমি নিজেই ওঠ প্রান্তিক। তবু তুমি কাছে আসবেনা। আসতাম, কিন্তু এই মুহূর্তে মন তোমার ভীষণ দুর্বল, তোমাকে আমি কোন ভাবেই ছোট হতে দিতে পারি না প্রান্তিক। তুমি যে আমার অহঙ্কার, একি তুমি বোঝনা? কিসে যে কার অহঙ্কার হয় এক দম বুঝিনা। কিন্তু একথা ঠিক, সত্যি বুঝি দুর্বল হয়ে যাচ্ছিলাম। সত্যি বুঝি চরম ভাবে পেতে চেয়েছিলাম এমন কিছু, যা ভালবাসার ঐশ্বর্য নয় লুণ্ঠনের সম্পদ মাত্র। বললাম, না রেহানা তোমার অহঙ্কারের কোন অপমান হোক, তা আমি হতে দেবনা। এস, আমার কাছে, ভয় নেই।
রেহানা আস্তে আস্তে এল আমার কাছে। আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম, ও নীচু হতেই আমি ওর গলাটা জড়িয়ে ধরে উঠে পড়লাম। ও বলল, জামা কাপড়টা পরে নাও। আমি পরে নিয়ে ওর সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম। জানতেও চাইলাম না কোথায় যাবে। রাস্তায় এসে জানতে চাইলাম, তুমি সঙ্গে আছে, তাইতো কোন ভয় নেই। তোমার সঙ্গে যাচ্ছি তাই আমি নিশ্চিন্ত। তবু রেহানা, কোথায় আমরা যাব তা কি আগে থেকে একবারও বলা যাবেনা? রেহানা বলল, তুমি মুখে যাই-ই বলনা কেন, আসলে তোমার মনের মধ্যে এখনো দ্বিধা। তারপর হেসে বলল, কিন্তু আমি চাইনা প্রান্তিক এ দ্বিধাটুকু মুছে যাক। তাই তুমি তোমার মতো ভাবতে থাক, দেখবে আমরা ঠিক জায়গায় পৌঁছে গেছি যেখানে তুমিও যেতে চেয়েছিলে। মিনতি সেনের বাড়ী বেল দিতেই মিনতি সেন বেরিয়ে এলেন। আমাকে দেখে বললেন একি চেহারা বানিয়েছ প্রান্তিক। মিনতি সেনকে সব কথা খুলে বললাম। তারপর বললাম দাদু কই। ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললেন মিনতি সেন। আমি বুঝতে পারছি কি হয়েছে। বললাম, একটা সংবাদ দিতে পারলেন না পিসি। কি করে দেব? আমি তো তোমার বাড়ীর ঠিকানা জানিনা। অফিসে তোমার পিসিকে বেশ কয়েক বার চেষ্টা করেছি, কিন্তু উনিও আসেননি। তারপর বললেন, তোমরা যেদিন গেলে, তার পরের দিন অসুস্থ হয়ে পড়েন। শ্বাস কষ্ট আরম্ভ হয়। ডাঃ বাবুকে কল দেওয়া হয়। আসেনও, কিন্তু তার আগেই সব শেষ। ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলেন মিনতি সেন। আমিও কেঁদে ফেললাম। রেহানার চোখেও জল। মিনতি সেন নিজের চোখের জল নিজে মুছে নিয়ে আমাদের বললেন কেঁদোনা। একটা বন্ধ খাম দিয়ে গেছেন তোমাকে। যখন তার প্রায় শেষ মুহূর্ত আমি তার মুখের পরে ঝুঁকে বললাম, কিছু বলবে বাবা। এই বন্ধ খামটা কাঁপা কাঁপা হাতে বালিশের নীচ থেকে বের করে আমার হাতে দিয়েই এলিয়ে পড়লেন, আর কোন সাড়া শব্দ নেই। সব শেষ। খামটা হাতে নিয়ে দেখি তোমার নাম। তুলে দিলেন বন্ধ খামটা আমার হাতে।
আমি বললাম কি আছে ওতে? মিনতি সেন বললেন জানিনা, আমি খুলিনি। তবে বাবা কি বলে গেছেন তোমাকে তা জানবার একটা ভীষণ ইচ্ছে থেকেই তোমাকে বার বার ফোন করেছি, তুমিও আসনা অনেকদিন। পরে জানতে পারি যে তুমি খুব অসুস্থ ছিলে। তোমার পিসিও খুব অসুস্থ ছিলেন।
রেহানা বলল, হ্যাঁ, পিসি, ওনার শরীর এখনো ঠিক নেই। নীলাঞ্জনা পিসিই আমাকে বললেন, আপনার মনে হয় খুব প্রয়োজন তাই যেন, আমি একবার অবশ্যই করে ওকে নিয়ে আসি আপনার এখানে। কিন্তু দাদু নেই, একদম ভাল লাগছেনা। মাত্র কয়েক দিনের পরিচয়, তাতেই যেন কত আপনার ছিলেন আমার। একবার শেষ দেখাও দেখতে পেলাম না। অভিমান বেজে ওঠে ওর কণ্ঠস্বরে।
আমি চিঠিটা খুলে ফেলি। কাঁপা কাঁপা হাতের অক্ষর। দাদু ভাই, আমার বোধহয় দিন ঘনিয়ে এসেছে, হয়তো তোমার সাথে আর কোন দিন দেখা হবে না। দিদি ভাইয়ের সঙ্গেও তাই। তোমাদের দুজনের জন্য আমার হৃদয় নিংড়ানো আশীর্বাদ রইল। অনেক বাধা আসবে তোমাদের জীবনে। সমাজ এখন তোমাদের মত মানুষদের গ্রহণ করবার জন্য প্রস্তুত নয়। তবু আমি সে যুগের ধ্যান ধারণা নিয়েও তোমাদের জন্য কল্যাণ কামনা করছি। একদিন তোমরাই এই হতভাগ্য সমাজকে নতুন পথের সন্ধান দিতে পারবে বলে আশা করি। যেখানে ধর্ম নয়, ভালবাসা আর মানবতাই মানুষের শেষ পরিচয়। আর একটা কথা, আমার মেয়ে মিনতি। জানি না তোমরা তার কথা জান কি না? যদি জান তা হলে আমার কথাও জান, আমি তোমাদের সেই সব ভয়ংকর কথাগুলো মনে করিয়ে দিতে চাইনা। তোমরা যেখানেই থাক, ওকে একটু দেখ। এই আমার শেষ অনুরোধ। তোমাকে এবং দিদি ভাইকে যেটুকু বুঝেছি, তাতে আমার মনে হয়েছে তোমাদের পেয়ে ও অনেক কিছু ভুলে থাকতে পারবে। যদি প্রতীমের সঙ্গে তোমাদের কখনো দেখা হয়, তাহলে বলল, সে যেন সব কিছু মেনে নিয়ে মিনতিকে গ্রহণ কবে, জানিনা সে এখন কোথায় আছে, জীবনে তার কেউ এসেছে কি না তাও জানিনা। তোমরা মিনতির ছেলে মেয়ের মতন, তবু কেন মোদের এই দায়িত্ব দিয়ে যাচ্ছি, সে উত্তর জানতে চেও না। শুধু এই বিশ্বাস রেখে যাচ্ছি, মিনতির মায়ের ভুলেব জন্য কিছুতেই তার জীবনটাকে তোমরা নষ্ট হতে দেবে না। তোমরা থাকবে ওর পাশে। যদি কোনদিনও প্রতীমের খোঁজ না পাও। ওর জীবনটা তোমবাই ভরে দিও। হাসি আর আনন্দে কোন দিনও যেন ও না ভাবে, ও বড় একা। দেখেছি তোমাদের পেয়ে ও কত বদলে গেছে। বাবা হয়ে সব সময়ই তো তার এই আনন্দময় জীবন আমি চেয়েছি। দিতে না পাবার জন্য আমার দায়িত্বকে আমি অস্বীকার করি না। আর একটা কথা, মিনতি আমার কোন কিছুই স্পর্শ করে না সেই ঘটনার পরে, তবু আমি তার বাবা। তাকেই দিয়ে গেলাম সর্বস্ব। তোমরা ওকে গ্রহণ করতে বল হতভাগ্য পিতার এই স্নেহের দানকে। সারাজীবনে যা পারলাম না, আজ প্রাক-বিদায় মুহূর্তেও তা পারবো না সাবা জীবন নিজের ভুলের প্রায়শ্চিত করতে চেয়েছি, পারিনি। মিনতি আমায় তার মায়ের ওই ট্যাজিক মৃত্যুর জন্য সমস্ত দোষ আমাব পরে চাপিয়ে দিতে চেয়েছে। আমি তা মেনে নিয়েছি। তবু যে সে আমায় ক্ষমা করেনি, তা বুঝি। যদি তোমাদের কথাও সে না শোনে তবে আমার রেখে যাওয়া যাবতীয় সম্পদকে তোমরা মানবিকতার প্রচারে ব্যয় করো এই আমার শেষ দাবি। মিনতিকে বলে যেতে পারলাম না। নিজের অহঙ্কারের কাছে হার মেনেও জীবনের শেষ দিনেও জিততে চেয়েছি। আশা করবো, তোমরা আমাকে বুঝবে। সময় যে ফুরিয়ে আসছে তাও বুঝতে পারছি। হাত কাঁপছে। কাল চলে যাওয়ার পরে জবার মাকে বললাম, কালি আর কাগজ দাও। ওর কাছ থেকে কাগজ আর কালি নিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতের অক্ষরে আমার যা কিছু বলার তোমাকে বলে গেলাম দাদুভাই। তোমাকে হয়তো মুখোমুখি কোন কথাই বলতে পারতাম না। প্রতীম, সব ভুলে ওকে গ্রহণ করতে চেয়েছিল। কিন্তু তার মায়ের মৃত্যু যে জন্য দায়ী তাকে সে কেমন ভাবে গ্রহন করবে? তাইতো তাকে গ্রহণ করতে পারলনা মিনতি। তোমাকে বলে যাচ্ছি, মিনতির মা, একটা ভুলের পিছনে ছুটে নিজের জীবন যেমন শেষ করেছে, তেমনি অভিশপ্ত করে দিয়েছে মিনতির সমস্ত জীবনটাই। আর আজ এই মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তোমাকে বলছি। মিনতির মা সম্পূর্ণ ভুল আশঙ্কায় আমাদের পরিবারটাকে তছনছ করে দিয়ে গেছে। আমার এই কথাটা তুমি বিশ্বাস কর দাদুভাই। এত কথায় হয়তো ভাবছ, এত লোক থাকতে তোমাদের বললাম কেন। বললাম এই জন্য, যে মানবিকতা তোমদের ভিতরে আমি দেখেছি তাতে কেবল তোমাদের কাছে রেখে যাওয়া যায় আমার জবান বন্দী।
হয়তো মনে তোমার প্রশ্ন, প্রতীমকে কেন সহ্য করতে পারেনি মিনতির মা। এটা ওর মায়ের ভুল। আবারও বলছি আমার এই কথা তুমি নিশ্চিন্ত মনে বিশ্বাস করতে পার।
আলাদা একটা কাগজে আমি আমার যাবতীয় হিসেব দিয়ে গেলাম। মিনতিকেই দিলাম। বেঁচে থাকতে সে আমার কিছুই ছোঁয়নি। মৃত্যুর পরে ছোঁবে কিনা জানিনা, ভয় হয় যদি নিতে না চায়, ও যেন তোমাদেরই সব দিয়ে যায়, তার প্রতি এই আমার শেষ আদেশ। তোমাদে মঙ্গল কামনা করি। হতভাগ্য–দাদু।
আমি,যতক্ষণ চিঠি পড়েছি রেহানা ও মিনতি সেন তাকিয়ে ছিলেন আমার দিকে। আমার পড়া শেষ হলে দু চোখ ভরে জল নেমে এল। এতে এমন কোন আবেগ মাখা কথা নেই, আছে পিতা ও মেয়ের চরম মান–অভিমানের কথা। যা কখনো বুঝতে পারিনি। চিঠিটা পড়া হলে, ওটা আমি রেহানাকে দিই। রেহানা বলল আমাকে কেন? বললাম আগে তুমি পড়। তারপর পিসিকে দাও। উনি পড়বেন সবশেষে। কারণ শেষ সিদ্ধান্ত নেবেন উনি। আমার কথা কিছু লিখেছেন? বললাম, সব কথাই আপনাকে নিয়ে, তবু ও আগে পড়ুক। তারপর আপনি যা ভাল বুঝবেন করবেন। কিন্তু পিসি, এত ব্যথা কেমন করে গোপন করে এত দীর্ঘ দিন পথ চলেছেন আপনি। ভুলতো মানুষেই করে, তাই বলে, তাকে এমন শাস্তি দিতে হবে? আপনিতো মা। পারবেন এমন অন্যায় করলে আমাদেরও শাস্তি দিতে? পারবেন আমাদের দেওয়া কঠিন শাস্তি আপনার বাবার মতন গ্রহণ করতে? কেন এমন করলেন পিসি।
মিনতি সেন কোন কথা না বলে, রেহানার পড়া শেষ হলে চিঠিটা এক নিমেষে পড়ে নিলেন। তারপর কান্নায় ভেঙে পড়লেন। তাকে বুকের পরে তুলে নিয়ে ওনার বিছানায় শুইয়ে দিলাম। রেহানাকে বললাম, চল আমরা নীচের ঘরে যাই, ওনার এখন একা থাকা দরকার। দরকার ভীষণ ভাবে দরকার কান্নার, তবেই যদি হাল্কা হতে পারেন। রেহানা বলল, কি অদ্ভুত তাইনা। অথচ এত ব্যথা যে দুজনেই বয়ে বেড়াচ্ছেন দেখে বোঝার উপায় নেই। আমি বললাম ঠিক তোমার মত। যা!
অনেকক্ষণ পরে, জবার মা আমাদের ডেকে পাঠালেন উপরে। মিনতি সেন কাঁদতে কাঁদতে একটু শান্ত হয়েছেন, চোখ দুটো লাল। চুল এলোমেলো। শাড়ী অবিনস্ত। তবু যেন কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। রেহানা ওকে নিয়ে ভিতরের ঘরে গিয়ে একটু বিন্যস্ত করে নিয়ে এলো। উনি বসলেন খাটের রেলিংএ হেলান দিয়ে। তারপর বললেন, তোমরা দুজনেই বাবার চিঠি পড়ছে? এখন তোমরাই বল আমার কি করণীয়।
আমরা সবাই চুপ করে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে। কারো মুখে কোন কথা নেই। উনি বললেন, কি হলো প্রান্তিক কিছু বল। আমি বললাম পিসি। আজই কিছু করতে হবে, তারতো কোন প্রয়োজন নেই। থাক না কয়েকদিন পর করলেও হবে। আরো কয়েকবার পড়ন চিঠিটা। তারপর নিজেই বুঝতে পারবেন কি করা সম্ভব, বা কি করা উচিত। মিনতি সেন বললেন, বাবার বুকে যে এত ব্যাথা জমা ছিল আমি বুঝতে পারিনি। সব সময় মনে হয়েছে মায়ের মৃত্যুর জন্য বাবাই দায়ী। তাই তার অহঙ্কার আমি মেনে নিতে পারিনি। আর তাই তার সবকিছুকেই প্রাণপনে এড়িয়ে চলেছি। মায়ের যে কোন ভুল থাকতে পারে মনেই হয়নি কখনো। এখনতো আবার নতুন করে সব কিছু ভাবতে হবে। বললাম, তাই ভাববেন, তার আগে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসুন। মিনতি সেন বললেন, সময়ই সব ঠিক করে দেবে জানি, হয়তো এমনও হতে পারে তোম