- বইয়ের নামঃ রাতের পাখি
- লেখকের নামঃ আশাপূর্ণা দেবী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১ মৃত্যুর মন্থর পদধ্বনি
রাতের পাখি – উপন্যাস – আশাপূর্ণা দেবী
বহুদিন থেকে মৃত্যুর মন্থর পদধ্বনি শোনা যাচ্ছিল দূরবর্তী বলদের গলার ঘণ্টাধ্বনির মতো। যেন নিয়ে যাবার গাড়ি আসছে প্রস্তুত হয়ে, সময় হাতে থাকার অলস মন্থরতায়।
হঠাৎ হঠাৎ কোনও এক সময় সে ধ্বনি অস্পষ্ট হয়ে গেছে, মনে হয়েছে বুঝি থেমে গেল। হয়তো ও গাড়ি আর আসবে না, ভুল রাস্তায় আসছিল ভেবে ফিরে গেছে। আবার হঠাৎ একদিন শোনা গেছে। সেই আওয়াজ, দ্রুত স্পষ্ট। যেন অনেক ক্ষণের শিথিলতার ক্রটি সামলে নিচ্ছে।
এরা তখন অনিবার্যের আশঙ্কায় সন্ত্রস্ত হয়ে উঠছে, ভয় পেয়েছে, দরজায় মুখ বাড়িয়ে দেখেছে, কিন্তু চাকার ধুলো ছাড়া আর কিছু চোখে পড়েনি।…
ক্রমশ এরা উদ্বিগ্ন হওয়ার অভ্যাসটা ছেড়েছে। রাত্রে উৎকর্ণ হয়ে থাকতে ভুলে গেছে। নিশ্চিন্ত জেনে নিয়েছে সকালে ঘুম ভেঙে উঠে চিরস্থায়ী ওই দৃশ্যটা দেখতে পাবেই। দেখতে পাবে, সামনের ওই ঘরটায় উঁচু পালঙ্কের উপর ফরসা ধবধবে বিছানায় বালিশে কনুই ঠেকিয়ে আধবসা হয়ে শুয়ে আছেন প্রিয়মাধব। দৃশ্যটা যেন অনন্তকালের পৃথিবীরই একটা অচ্ছেদ্য অংশ।
প্রিয়মাধব পালঙ্কের উপর আধবসা হয়ে শুয়ে আছেন। প্রিয়মাধবের সেই পালঙ্কের মাথার কাছের বাজুতে একখানা পাটকরা ফরসা তোয়ালে ঝোলানো আছে, আর প্রিয়মাধবের সামনে একটা নিচু গোল টেবিল আছে যার উপর থরে থরে সাজানো আছে শিশি বোতল কৌটো। প্রিয়মাধবের খাটের নীচের দিকে একটু তফাতে দেয়ালের গা ঘেঁষে একটা মাঝারি মাপের জালের আলমারি আছে, তার মাথার উপর প্রিয়মাধবের খাবারের প্লেট, গ্লাস, চামচ, ফিডিংকাপ, জল রাখবার কাঁচের জার সাজানো আছে, আর তার ভিতরে প্রিয়মাধবের মজুত করা খাদ্যবস্তু আছে। জানা কথা, ওটা হাতড়ালে আচার আমসত্ত্ব থেকে শুরু করে দেশি-বিদেশি অন্তত একশো জিনিস মিলতে পারে।
প্রিয়মাধবের পালঙ্কের ওধারে দুটো জানলার মাঝখানে একটা আলনা আছে, তার গায়ে প্রিয়মাধবের জামা কাপড় গেঞ্জি গোছানো আছে, কোণের কোনাচেগড়ন বুকসেলফটায় কয়েকখানা মোটা-সোটা ভারী বাঁধাই ইংরেজি বই আছে, যার মলাটের নামটা একসময় সোনার জলে লেখা ছিল, এখন বিবর্ণ আর অস্পষ্ট হয়ে গেছে।
এ ছাড়াও প্রিয়মাধবের ঘরে একটা ছোট্ট স্টিলের লকার’ আছে, যার চাবিটা এখনও প্রিয়মাধবের আয়ত্তে। আর একটা বেতের চেয়ার আছে, যেটায় তাঁর নার্স বসে। প্রিয়মাধব কত কত কাল যেন মাটিতে পা ঠেকাননি, তবু তাঁর খাটের পায়ের কাছে পাপোশের উপর এক জোড়া চটিজুতো সাজানো আছে।
প্রিয়মাধবের ঘরের এই দৃশ্যের পরিবর্তন নেই, ঘরের কোনও জিনিস এক ইঞ্চি এদিক-ওদিক করতে দেন না প্রিয়মাধব। শুধু খুব ভোরবেলায় এ-ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালে দেখা যায় ওঁর ওই ওষুধের টেবিলের কাছে একটা টুল পড়েছে। এবং তার উপর বড় একটা এনামেলের গামলা বসানো হয়েছে প্রিয়মাধবের মুখ ধোওয়ার জন্যে।
নার্স মুখ ধুইয়ে দিয়ে সেটা সরিয়ে নিয়ে যেতে এক মিনিট দেরি করলেই প্রিয়মাধব বিদ্রুপের গলায় বলেন, নার্স, এই দৃশ্যটা কি তোমার খুব সুন্দর বলে মনে হচ্ছে? নার্সের একটা নাম আছে, সেটা এমন কিছু দুরুচ্চাৰ্য নয়। নিজে সে অনেকবার বলেছে, আপনি আমায় নীহার বলেই ডাকবেন। প্রিয়মাধব সে অনুরোধ রাখেননি। ওই বিদ্রুপের ভঙ্গিতেই বলেছেন, চিরকাল তুমি আমার পরিচর্যা করবে এ গ্যারান্টি দাও তো নামটা মুখস্থ করার কষ্ট স্বীকার করি। ছমাস পরে আবার কে আসবে, আবার আমি তার নাম মুখস্থ করতে বসব, ঝুটমুট অত খাটতে পারব না।
নার্স অবশ্য চিরকালের গ্যারান্টি দেয়নি। অতএব নার্সই বহাল আছে। ছেলের কাছে এ গল্প করে হেসেছেন প্রিয়মাধব। বলেছেন, মেয়েমানুষ জাতটার এই এক দোষ বুঝলি, কিছুতেই কোনও একটা সম্পর্ক না পাতিয়ে স্বস্তি পায় না। যেই আমি নাম ধরে ডাকতে শুরু করব, ও-ও তক্ষুনি মেসোমশাই কি কাকাবাবু ডাকতে শুরু করবে নির্ঘাত। কী কাজ বাবা আমার অত ঝামেলায়?
প্রিয়মাধবের ছেলে অরুণমাধব অবশ্য ওই ডাকটাকে খুব একটা ঝামেলার ব্যাপার বলে ভাবেনি। নীহারের মতো একটি সভ্য-ভব্য ভদ্র মেয়ে যদি প্রিয়মাধবকে মেসোমশাই কি কাকাবাবু ডাকে, সেটা খুব একটা বিরক্তিকর বলেও মনে হয়নি তার। তবু সে বাবার কথার প্রতিবাদ করেনি, শুধু বাবার এও একটা বাতিক ভেবে মৃদু হেসেছিল।
এ ঘরে, নিজেদের দিকে তারা নীহারকে বাড়ির অতিথির মতোই স্নেহ সম্মান দেয়, তার সঙ্গে ভালভাবে কথা বলে, কিন্তু বাবার ঘরে নীহার সম্পর্কে নির্বিকার থাকতে হয়। অনেক সময় মিথ্যা ধমকের ভানও দেখাতে হয়। হয়তো বলতে হয়, এ কী? বিছানার চাদরটা কি আজ পালটানো হয়নি? ফ্রেশ দেখাচ্ছে না তো? অথবা, কী আশ্চর্য, ফলগুলো অমন খোলা ফেলে রেখেছেন কেন? এই এক গাফিলি আপনাদের!
এটা নীহারেরই শিক্ষা।
নীহারই বলে রেখেছে, বকবেন, ওঁর সামনে আমাকে খুব বকবেন। এটা ওঁর ওষুধের কাজ করবে।
অরুণমাধবের বউ উত্তরা অবাক হয়ে বলেছিল, কেন বলুন তো?
তাই হয়।নীহার হেসে বলেছিল, বেশি দিন বিছানায় পড়ে থাকতে থাকতে মানুষের মেজাজ তিক্ত হয়ে ওঠে। আর তার উপরই সব থেকে বেশি রাগ হয়, যে এই অসহায় অবস্থার সাক্ষী। অতএব সবাই মিলে তাকে বকছে গাল দিচ্ছে, এটা দেখতে ভাল লাগে।
উত্তরা নিশ্বাস ফেলে বলে, কী জানি বাবা!
নীহার হেসে বলে, আমরা জানি। দেখে দেখে অভ্যাস তো, তা ছাড়া পড়েও তো আছেন কম দিন নয়।
না, কম দিন নয়।
উত্তরার বিয়ের পর বছরখানেক মাত্র শ্বশুরকে ঘুরে বেড়াতে দেখেছে উত্তরা। আবার খুব বেশিরকমই দেখেছে। সেই বয়েসে তখনও যেন ইয়ংম্যান। ছেলের চাইতে এনার্জি বেশি, খাওয়া বেশি, কর্মক্ষমতা বেশি। শাশুড়ি ছিলেন, তাঁর সঙ্গে প্রেমের নিবিড়তাও কম দেখেনি। আদৌ কর্তা-গিন্নির মতো নয়, যেন তরুণ-তরুণী।
সহসা একদিন অকস্মাৎ ঘটে গেল বিপর্যয়। সিঁড়ি দিয়ে উঠে এলেন প্রিয়মাধব। দুটো সিঁড়ি টপকাতে টপকাতে উঠে এসেই পড়লেন অজ্ঞান হয়ে। সহজে ভাঙল না।
তোলপাড় পড়ে গেল। ডাক্তারে বাড়ি বোঝাই হল, তাঁরা রায় দিলেন, কারণটা রক্তচাপ বৃদ্ধি। তলে তলে কখন শিরায় শিরায় প্রবাহিত রক্ত মস্তিষ্কের কোষে কোষে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে, আর নামতে পারেনি। কখন হয়েছে কে জানে সে খবর। প্রিয়মাধব নিজেও তো টের পাননি।
তদবধি প্রিয়মাধবের ওই পালঙ্কশয্যা।
ওই এক দৃশ্য।
শুধু তখন নীহারের জায়গায় ছিলেন শাশুড়ি সুমিতা। স্বামীসেবার এমন গভীর বেদনাময় রূপ কদাচ দেখা যায়। প্রতিটি মুহূর্তের সতর্কতা দিয়ে ঘিরে রাখতেন তিনি স্বামীকে, প্রতিটি পলক ফেলতেন উল্কণ্ঠার দৃষ্টি নিয়ে।
নিজের নাওয়া খাওয়া ঘুম গেল ভদ্রমহিলার। একটা সেবার যন্ত্রের মতো হয়ে যেতে লাগলেন ক্রমশ।
অরুণমাধব কত অনুযোগ করেছে, মা, তুমিও কি বিছানায় পড়তে চাও?
সুমিতা বলেছেন, পড়ে যদি উঠতে না হয় এক্ষুনি পড়তে চাই বাবা!
তা হলে তো তুমি খুব স্বার্থপর মা! বাবাকে যে এত সেবা করছ সবই ভুয়ো।
তুই তো আছিস সেবা করতে, বলতেন সুমিতা। আর বলতেন, আর ভুয়ো তো সবই রে, কোনটা ভুয়ো নয়? তুই ঠিকই দেখবি বরং—
মার উক্তিতে মাঝে মাঝেই এমন দার্শনিক স্পর্শ থাকত। অরুণ আমল দিত না। বলত, তোমার কাছে আমি? যাই বলল মা, নিজেকে এমন অযত্ন করাটা খুব অন্যায় হচ্ছে তোমার। বাবার জন্যেই। নিজেকে খাড়া করে রাখতে হবে তোমায়।
এ রকম কথায় হঠাৎ হঠাৎ ভারী অদ্ভুতভাবে হাসতেন সুমিতা। বলতেন, তাই তো রেখে এলাম রে এ-যাবৎ।
অরুণ মার ওই হাসি দেখে অবাক হত।
অরুণমাধব ভেবে পেত না, এ-যাবৎ খাড়া থাকবার মানেটা কী? বাবাই তো এত বেশি খাড়া ছিলেন যে যুবকপুত্র অরুণই যেন মূল্যহীন হয়ে পড়ত।
সুমিতা তাঁর ছেলের সাবধানবাণীতে কান দেননি। সুমিতা তিল তিল করে ক্ষয় করেছিলেন নিজেকে। প্রিয়মাধবের অসুখে পড়ার তিন বছরের মাথায় মারা গিয়েছিলেন সুমিতা।
খুব একটা কিছু অসুখ করল না, বিছানাতেও পড়লেন না বেশি দিন। দিন চার-পাঁচের জ্বরে মারা গেলেন। প্রিয়মাধবের ওঠবার ক্ষমতা ছিল না। প্রিয়মাধব পাথরের মতো বিছানায় পড়ে থাকলেন। পাশের খাট থেকে তাঁর চিরদিনের সঙ্গিনীকে আলতা-সিঁদুর পরিয়ে চিরদিনের মতো নিয়ে যাওয়া হয়।
উত্তরা তখনও প্রায় নতুন বউ-ই, অত কিছুই জানত না।
নিরুপায় হয়ে নিজের মাকে আনিয়েছিল শাশুড়ির অসুখের সময় থেকেই। তিনিই আলতা আনালেন, সিঁদুর আনালেন, চওড়া লাল পাড় গরদের শাড়ি আনালেন, আর সবাইকে ডেকে ডেকে বলতে লাগলেন, দেখুন সবাই, ভাগ্যটা দেখুন। ওই অনড় স্বামীকে রেখে সতীলক্ষ্মী স্বর্গে গেলেন।
অবশ্য যাদের শোনালেন, প্রায় সকলেই তারা পাড়াপড়শি বন্ধু। আত্মীয় খুব কমই আছে প্রিয়মাধবের, সুমিতার দিকে তো আদৌ ছিলই না। মা নেই বাপ নেই। একটা যমজ বোন ছিল, তাও অল্প বয়েসে বিধবা, সেও কোনকালে মারা গিয়েছিল। সুমিতার কাছেই নাকি মারা গিয়েছিল নমিতা। যমজের হিসেবে এক ঘণ্টার ছোট বোন সুমিতার। প্রিয়মাধব তখন চা বাগানের ম্যানেজার, আসামের এক চা-বাগানে থাকেন।
সুমিতা বলেছিল, শ্বশুরবাড়িতে নমিতার কষ্টের সীমা নেই। শাশুড়ি অপয়া বলে গঞ্জনা দেয়, আর দেওররা ওর বিষয়-ভাগ ঠকিয়ে নেবার তালে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে যন্ত্রণা দেয়। তুমি যদি ওর বিষয়-সম্পত্তির ব্যাপারটা বুঝেপড়ে দেওরদের থেকে আলাদা করে নিয়ে আমাদের সঙ্গে নিয়ে চলো, বেঁচে যায় বেচারা। কিছু যদি কমও পায়, তাই পাক। আমাদের তো অভাব নেই?
প্রিয়মাধব বলেছিলেন, আমরা নিয়ে যেতে চাইলে ওর শ্বশুরবাড়ি থেকে রাজি হবে কেন?
সুমিতা রাগ করেছিল।
বলেছিল, রাজি হবে কি হবে না সে কথাও ভাবতে হবে কেন? আছে কে সেখানে? শশুর না, ভাশুর না, পাজি দুটো দেওর আর নিষ্ঠুর এক শাশুড়ি। তাদের সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়েই চলে আসবে। আমি ছাড়া আপন বলতে ওর কে আছে বলো?
বাপের বাড়ির দিকে টানের বলতে সুমিতারও তত আর কেউ ছিল না, বোন বলে খুব একটা মায়া ছিল।
নমিতার দেওররা নমিতাকে বিষয়ের ভাগ দেবার জন্যে উদগ্রীব ছিল না। সামান্য একটা থোক টাকা দিয়ে ওর ভাগটা লিখিয়ে নিয়েছিল। এবং বেপরোয়া গলায় হেসে প্রিয়মাধবকে বলেছিল, নিয়ে যান না মশাই, আমরা তো বেঁচে যাই। রাতদিন আমার বুড়ো মায়ের সঙ্গে অশান্তি করছেন।
প্রিয়মাধব রেগে বলেছিলেন, অশান্তি করছে নমিতা? অশান্তি করবার মেয়ে ও?
দেওর আরও অসভ্য হাসি হেসেছিল, দেখবেন গিয়ে কেমন মেয়ে। ঘর করে দেখবেন। ডাইনে-বাঁয়ে চিনির নৈবেদ্য নিয়ে চলেছেন যখন।
লোকটার ওই দাঁতের উপর একটা ঘুষি বসিয়ে সব কটা দাঁত ভেঙে দেবার ইচ্ছে সংবরণ করে চলে এসেছিলেন প্রিয়মাধব।
নমিতার যতদিন বিয়ে হয়নি, আর নমিতা যে কদিন সধবা ছিল, প্রিয়মাধব নিজেই এ-ঠাট্টা করতেন। হেসে হেসে বলতেন, তোমরা কদাচ দুজনে একরকম শাড়ি পোয়রা না বাপু! আমি হঠাৎ গুলিয়ে ফেলতে পারি। বলতেন, তোমাদের দুই বোনকে নিয়ে কোথাও যাওয়া আমার বিপদ, লোকে ভাববে ডাইনে-বাঁয়ে চিনির নৈবিদ্যি নিয়ে চলেছে লোকটা, বেড়ে ভাগ্যখানা তো!
কোথাও যাওয়া ব্যাপারটা সুমিতার সঙ্গেই হত নমিতার, কুমারী থাকতে, বিয়ে হয়েও। নমিতার উকিলবর বেজায় গম্ভীর গম্ভীর ছিল। তা ছাড়া এক ঘণ্টার দিদি হয়েও সুমিতা সত্যিই বড় বোনের মতো স্নেহময়ী ছিল। কোনও আমোদ-আহ্লাদ একা ভোগ করে সুখ পেত না।
সিনেমা-থিয়েটারে নিয়ে যাবে বলে নিজে গাড়ি ভাড়া করে গিয়ে নমিতার বরের অনুমতি আদায় করে নমিতাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসত। তখন প্রিয়মাধবের চা বাগানের চাকরিটা হয়নি। কলকাতাতেই কোথায় যেন কাজ করতেন।
অসম্ভব স্ফুর্তিবাজ, অসম্ভব প্রাণ-চঞ্চল, আর অসম্ভব শক্তিমান প্রিয়মাধব দুই বোনকে একসঙ্গে দুহাতে তুলে ফেলতে পারতেন কোমর ধরে।
নমিতা হাত পা ছুঁড়ে নেমে পড়ে বলত, দিদি না হয় আপনার বউ, ওকে বাঁদর-নাচ নাচাতে পারেন, আমায় কেন?
প্রিয়মাধব বলতেন, দিদি বউ, তুমি মউ! জানো না, ফাউয়ের তুল্য মিষ্ট বস্তু নেই? শালি হচ্ছে সেই ফাউ। তায় আবার যমজা।
কিন্তু নমিতা বিধবা হবার পর সেই চাপল্য সংবরণ করেছিলেন প্রিয়মাধব। দুই বোনের একরকম সাজের প্রশ্নও ওঠেনি। সেই বয়েসেই সব রং মুছেছিল নমিতা, সব বাহুল্য বর্জন করেছিল। চিরকালের বিধবার সাজে সেজেছিল।
সুমিতা কেঁদে ফেলে বলেছিল, হেমন্তকে তো তুই এত ভালবাসতিস না নমু যে, তার জন্য সর্বত্যাগিণী হবি। আমি তো জানি ওর প্রতি ভয় ছাড়া আর কিছু ছিল না তোর।
নমিতা হেসে বলেছিল, তার জন্যে সর্বত্যাগিণী হচ্ছি, এমন মিছে কথা তোমাকে কে ভাবতে বলেছে? ত্যাগ করেছি ধিক্কারে। সমাজ যদি ওই সবটা কেড়েই নিচ্ছে, তার থেকে সামান্য একটু হাতে রাখবার জন্যে আবার কাড়াকাড়ি করব কোন ঘেন্নায়? ভাল শাড়ি পরলে তো বলবে অনধিকার চর্চা!
তোর বয়েসে কে কবে কোথায় থান পরে? ওটা অসহ্য নমু!
নমিতা বলেছে, আমার আরও অসহ্য দিদি, থানের পাশে পাড়ের এক ফালি ক্যারিকেচার। সেটা আরও করুণ। আরও দৈন্যের।
হ্যাঁ, দিদিই বলত নমিতা তার একঘণ্টার বড় বোনকে। ছেলেবেলায় তাই শেখানো হয়েছিল ওকে। পিসি বলেছিল, তা হোক, একটুও ছোট বড় তো। ওতেই সম্পর্ক ঠিক করতে হয়।
মা ছিল না। শৈশবের যা-কিছু শিক্ষাদীক্ষা সবই পিসির কাছে।
কিন্তু শিক্ষাদীক্ষা কথাটার কি সত্যিই কোনও অর্থ আছে? দুটো সম্পূর্ণ একই বয়েসের মেয়েকে, একই পরিবেশে, একই শিক্ষায় শিক্ষিত করে, একই রকম কি গড়তে পেরেছিল পিসি?
পারেনি।
সুমিতার আর নমিতার আকৃতি এক ছিল। প্রকৃতি এক ছিল না। সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতি নিয়ে গড়ে উঠেছিল নমিতা, সুমিতার সঙ্গে এক থালায় খেয়ে, এক বিছানায় শুয়ে।
সুমিতা ছিল প্রত্যেকটি বিষয়ে অপটু, নমিতা সব বিষয়ে পটু।
সুমিতা মৃদু, নমিতা প্রখরা।
সুমিতা অবোধ, নমিতা তীক্ষ্ণবুদ্ধি। সুমিতা স্নেহময়ী, নমিতার শরীরে মায়ামমতার বাহুল্য নেই।
এক ঘণ্টার বড় হয়েও সুমিতা বড়দিদি, এক ঘণ্টার ছোট হয়েও নমিতা ছোট বোন।
সুমিতা শান্ত স্তিমিত, নমিতা উজ্জ্বল অস্থির। নমিতার দেওর তাই বলেছিল, নিয়ে যান না, আমরা তো তা হলে বাঁচি।
.
বিধবা হয়ে নমিতা অনেক শান্ত হয়ে গিয়েছিল। তবু ওর শাশুড়ি ওকে দেখতে দেখতে রাতদিন অশান্তিতে জ্বলেপুড়ে মরত।
বলত, এই আগুনের খারা চিরদিন বুকে বয়ে মরতে হবে আমাকে।
নমিতা শুনে হাসত। আর সুমিতা প্রিয়মাধবের কাছে চোখের জল ফেলত।
এই সময় হঠাৎ প্রিয়মাধবের চা বাগানের কাজটা হল। অভাবিত, অপ্রত্যাশিত। তবু ভাগ্যের এই দানকে সুমিতা প্রসন্নমনে নিতে পারেনি। বলেছিল, আমি অতদূরে চলে গেলে নমুকে ওরা বিষ খাইয়ে মেরে ফেলবে।
অবশেষে ওই প্রস্তাব। নমিতাকে নিয়ে যাবে সুমিতা।
ওরা রাজি হল।
নমিতার শাশুড়ি বলল, চোখের আড়ালে গিয়ে যা-খুশি করগে মা, আমার হাড়ে বাতাস লাগুক।
তা বোনকে কাছে নিয়ে গিয়ে সুমিতারও হাড়ে বাতাস লাগল। সর্বদা নমু নমু করার দুর্ভাবনাটা গেল। স্নেহের বস্তুকে একান্ত কাছে রেখে ঠাণ্ডা হল। তা ছাড়া, ওই জনবিরল চা বাগানে বাঙালি বলতে অনেক দূরের মধ্যে কেউ ছিল না। প্রিয়মাধব তো নতুন দায়িত্বের কাজে মশগুল। কথা বলতে নমিতা, সঙ্গী বলতে নমিতা। কদাচ কখনও দূর থেকে কোনও বাঙালি পরিবার বেড়াতে আসত। বলত, খুব ভাগ্যে বোনটি পেয়েছেন বাবা! সঙ্গী তো বটেই, তা ছাড়া উনিই তো দেখছি সংসার মাথায় করে রেখেছেন।
নমিতার বৈধব্যটাকে সুমিতার ভাগ্য হিসেবেই গণ্য করত ওরা। বলবার সময় সেটা সামলাতে মনে থাকত না। সুমিতা অপ্রতিভ হত, সুমিতা অন্য কথা পাড়ত।
তারা চলে গিয়ে আড়ালে বলত, বোনের প্রতি ভাবটা দেখেছ? ঠিক ঝিয়ের মতো। ওকে একটু ভাল বলাটাও সহ্য হয় না। যমজ বোন, তাকে কী সাজিয়ে রেখেছে দেখো? হলই বা বিধবা, এখানে আর কে অত দেখতে আসছে?
হয়তো বা বলত, কারণটা বুঝছ না? পাছে বরের দৃষ্টিপাত পড়ে যায়। অবশ্য তা নিয়েও হাসাহাসি করত।
বলত, দৃষ্টিতে তো নতুন কিছু পড়বে না? একই মূর্তি, আলাদা আকর্ষণ আসবার কারণ নেই।
বলত। বেরিয়ে গেলেই বলত।
অবশ্য কালেকস্মিনেই আসত তারা। সুমিতা কারও বাড়ি গেলে একাই যেত প্রিয়মাধবের সঙ্গে। নমিতা যেতে চাইত না। বলত, আমার এখন কাজ আছে।সুমিতা বেশি পীড়াপীড়ি করলে বলত, তুই তো আচ্ছা বোকা দিদি, দুজনে গেলে লোকে কী বলবে, ভুলে যাচ্ছিস?
কী আবার বলবে? নমিতা একটু বাঁকা হাসি হেসে বলত, ডাইনেবাঁয়ে চিনির নৈবিদ্যি!
যেত না নমিতা, বাড়িতে কাজ নিয়ে থাকত। আর তারপর তো কাজ বেড়েই গেল। ক্রমশই বাড়তে লাগল।
অরুণমাধব জন্মাল।
সেই এক আনন্দের দিন গেছে সুমিতার। চা-বাগানের ওই কোয়ার্টার্সের বাইরে যে আর কোনও জগৎ আছে, ভুলেই গেল যেন। দুই মা মিলে একটা শিশুকে নিয়ে রাজ্য রচনা করল একটা।
অপুট সুমিতা ছেলেকে আদর করা ছাড়া আর কিছু করতে পারে না। সুপটু নমিতা তার সব কিছু কাজ করে, শিশুর তো অতএব আঠারো আনা।
কিন্তু নমিতা?
নমিতাও কি সুখের সাগরে ভাসত? দিদির ছেলে থেকেই তার সব সম্পূর্ণতা, এই কি ভাবত সে?
নমিতার কথা বিশেষ জানার উপায় নেই।
নমিতা তো অরুণের জন্মের কিছু দিন পরেই মারা গেল। মাস আষ্টেকের ছেলে তখন অরুণ, দেশে আসবে সুমিতা ছেলের মুখে ভাত দিতে, হঠাৎ তছনছ হয়ে গেল সব। সুমিতার জীবনের সুর গেল কেটে।
সেই একই সময়ে প্রিয়মাধবের কোম্পানি আরেক বুনো জায়গায় বদলি করে দিল বড় একটা বাগান কিনে, আর অকস্মাৎ নমিতা মারা গেল একটা পোকার কামড়ের জ্বরে।
ওই বিষাক্ত পোকা থাকে বাগানের আশেপাশে। অসতর্ক কুলিকামিনদের ছেলেমেয়েরা প্রাণ হারায় মাঝে মাঝে, কিন্তু তাই বলে সুমিতার বোন প্রাণ হারাল? সুমিতা এত অসতর্ক হল?
হল।
সুমিতার ভাগ্য সুমিতাকে নিঃস্ব করল। সুমিতার শৈশব কৈশোর বাল্যের একমাত্র সাথী, সুমিতার যৌবনসুখের একমাত্র দর্শক, সুমিতার সংসার-জীবনের একমাত্র অবলম্বন ঝরে পড়ল মুহূর্তের মধ্যে।
দেশে এসে ছেলের ভাত দেওয়া আর হল না সুমিতার, চলে গেল সেই বুনো বাগানে। দীর্ঘকাল পড়ে থেকেছে সেখানে, ছেলেকে বোর্ডিং-এ রেখে মানুষ করেছে, তারপর প্রিয়মাধব যখন আরও কিছুদিন এ বাগান সে বাগান করে অবশেষে অবসর নিয়ে দেশে ফিরেছেন, সুমিতা কলকাতায় এসে গুছিয়ে বসেছেন, ছেলের বিয়ে দিয়েছেন।
কিন্তু সেই বিয়ের পরই আবার ঝপ করে ভেঙে পড়ল তাসের প্রাসাদ।
প্রিয়মাধব অসুখে পড়লেন।
নমিতার মৃত্যুর মতোই আচমকা এল এই মৃত্যু।
তা, মৃত্যু ছাড়া আর কী?
জীবন থেকে তো নির্বাসন ঘটল প্রিয়মাধবের। যে-জীবনকে আঁকড়ে থেকেছেন প্রিয়মাধব চিরটা দিন।
চিরদিনই বিষাদকে ভয় প্রিয়মাধবের, শোককে বরদাস্ত করতে পারেন না। নমিতার মৃত্যুর পর তাই প্রিয়মাধব ইচ্ছে করে হইচই করেছেন। ইচ্ছে করে স্ফুর্তি করেছেন, সুমিতাকে কিছুতেই বিষাদে ডুবে থাকতে দেননি। বলেছেন, মৃত্যুর সাধনা করে লাভ কী? জীবনের সাধনা করো।
.
সেই প্রিয়মাধব জীবনকে হারালেন। চিরতরে হারালেন।
সুমিতা যদি নমিতার শাশুড়ির মতো হতেন, নিশ্চয় বউকে অপয়া বলতেন।
কিন্তু তেমন নন সুমিতা।
তাই ভাগ্যের এই দুঃসহ নিষ্ঠুরতা মেনে নিয়েছেন। আর কাউকে দায়ী করেননি। জীবনপাত করে সেবা করেছেন স্বামীর। তারপর একদিন আস্তে বিদায় নিয়েছেন।
তদবধি নার্স।
নার্স ছাড়া আর কে করবে?
অরুণমাধবের সাধ্য কী?
প্রিয়মাধবের খুঁতখুঁতুনির বোঝা পাহাড়ের বোঝাঁ।
নার্স এল।
কতজন এল গেল।
কাউকে বরদাস্ত করতে পারেন না প্রিয়মাধব। প্রতিটি বিষয়ে খুঁত কাটেন, ব্যঙ্গ করেন বিদ্রূপ করেন, আর অরুণমাধব যখন বাবাকে দেখতে এ ঘরে আসে, বলেন, পয়সা কি তোমার এত বেশি হয়েছে অরুণ যে, এই চিড়িয়াখানার মালটিকে মোটা পয়সা দিয়ে পুষছ। ফেলে দেওয়ার মতো পয়সা থাকে, অনাথ-আশ্রমে দান করো না।
অরুণ লজ্জায় অধোবদন হত, লাল হয়ে বলত, কী বলছেন বাবা?
প্রিয়মাধব বলতেন, ঠিকই বলছি। এর থেকে একটা বনমানুষ এনে বাপের সেবায় লাগিয়ে দিও, কাজ যেমন চলছে চলে যাবে।
বনমানুষ!
এর পর আর কোন মানুষটি থাকবে? পাগলের সেবা করবে বলে তো আসেনি তারা?
অনেক জনকে বিদায় করে এখন নীহার। নীহার একটু বেশি বুদ্ধিমতী আর বেশি সহিষ্ণু বলে অনেকদিন টিকে আছে। প্রিয়মাধবের কোনও কথাই গায়ে মাখে না সে। এ ঘরে এসে উত্তরাকে বলে, উঁহু, ভয় পাবেন না, আমি নড়ছি না। আপনার শ্বশুরের শ্রাদ্ধের ভোজ খেয়ে তবে যাব।
আশ্বাস!
এই আশ্বাসের জোরে অরুণ আর উত্তরা ক্রমশই বাবার জন্যে উৎকণ্ঠিত হওয়া কমিয়ে দিয়েছে। জানে, মিস ঘোষ আছেন।
নীহারের বয়েস কম, কিন্তু দৃঢ়তা আছে।
যখন অরুণমাধব রাত্রে একটু সাড়াশব্দ উঠলেই ভয় পেত, মৃত্যুর পদধ্বনি শুনতে পেলে ফ্যাকাসে হয়ে যেত, তখন নীহারই বলত, যান তো, শুতে যান তো! মাথা খারাপ করতে হবে না। আপনারাই যদি জেগে বসে থাকবেন, আমি তবে আছি কী করতে?
কোনও সময় বা বলত, এত ভয়ই বা কীসের? মা বাপ কি মানুষের চিরদিনের? এই তো মা গেছেন, বেঁচে নেই আপনি?
শুনে উত্তরা নার্সের ওপর কৃতজ্ঞ হত। যে কথাগুলো নিজে সে বরকে বলতে পারে না, সেটা অপর কেউ বলে দিচ্ছে–এতে অবাক বিস্ময়ে মুগ্ধ হত।
নীহারের এই অসীম বিবেচনায় উত্তরা ওকে নার্স বলে দূরে রাখেনি, আত্মীয়ের মতো ভাবে।
.
সুমিতা মারা যেতে উত্তরার মা বেয়াইকে ডেকেও বলেছিলেন, দেখুন বেয়াই মশাই, ভাল করে তাকিয়ে দেখুন, আর তো দেখতে পাবেন না। একদিন নিজে হাতে করে মাথায় সিঁদুর ঢেলে দিয়ে আঁচলে আঁচলে বেঁধে এই ঘরে নিয়ে এসেছিলেন, আজ সেই গাঁটছড়া খুলে দিয়ে নতুন সাজে সেজে চলে যাচ্ছেন বেয়ান।
ভদ্রমহিলার বুকের পাটা যে বিলক্ষণ তা বোঝা গেল। অরুণ চমকে উঠল–এই একটা ঝড় ওঠে বুঝি। এই গ্রাম্যতায় না জানি কী তীব্র ব্যঙ্গ করে উঠবেন বাবা!
প্রিয়মাধব কিন্তু ঝড় ওঠালেন না, নিঃসাড় হয়ে তাকিয়ে রইলেন। বোধ-চৈতন্য কিছু আছে, তা বোধ হল না।
অরুণমাধবের শাশুড়ি তাঁর বেয়াইয়ের বোধ-চৈতন্য উদ্রেকের উদ্দেশ্যে আরও বেশ কিছু হৃদয় মোচড়ানো কথা বললেন, কাজে লাগল না। প্রিয়মাধব পাথরের মতো শুয়ে রইলেন, সুমিতার দিকে না তাকিয়ে।
ভদ্রমহিলা এ-ঘরে এসে বললেন, তোর শ্বশুরের ব্রেনটা একেবারে গেছে উত্তরা, নইলে এতকালের সঙ্গী চিরকালের মতো চলে যাচ্ছে, চোখে এক ফোঁটা জল নেই? এক বিন্দু আকুলতা নেই? পাগলেও এমন শোক বুঝতে পারে।
উত্তরাও অবাক হচ্ছিল বইকী!
ও তো ভেবেছিল শ্বশুরকে ধরে রাখা যাবে না, হুড়মুড়িয়ে উঠতে চেষ্টা করে পড়ে প্রাণটা হারাবেন। কিন্তু সে-দৃশ্য দেখল না। প্রিয়মাধব পাথর হয়ে রইলেন। একদণ্ড চোখের আড়াল হলে সুমিতা সুমিতা করে ডাক পাড়তেন। সুমিতা চলে গেলেন, একবারের জন্যে ডাকলেন না প্রিয়মাধব সুমিতা বলে। একবিন্দু জল গড়াল না।
ব্রেনটা কি তবে হঠাৎ শ পেয়ে অকেজো হয়ে গেল?
তাই মনে হয়েছিল কদিন।
যে কদিন অরুণমাধব, উত্তরা আর বাড়ির চাকরটা মিলে এলোমেলো করে সেবা করেছিল, পাথরের মতো পড়ে ছিলেন প্রিয়মাধব।
কিন্তু নার্স ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে যেন ছিটকে উঠলেন, বদলে গেলেন। নাওয়া খাওয়া প্রত্যেকটি ব্যাপারে রসাতল করতে লাগলেন। চামচখানা রাখা, কি তোয়ালেখানা পাট করার অপরিপাট্য নিয়ে অভিযোগের ঝড় তুলতে লাগলেন। আর শুরু করলেন তীব্র তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গবচন।
একদিন তো উত্তরা বলেই ফেলেছিল, তা ঠিক, মার মতন আর কে হবে বাবা? আপনি যদি তেমন আশা করেন ।
প্রিয়মাধব বলেছিলেন, কথা বলতেও শিখতে হয় বউমা! ওটা শিখতে তোমার বাকি আছে।
কিন্তু মাঝে মাঝে অবস্থার বদল হয়। অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকেন প্রিয়মাধব। মৃত্যুর পদধ্বনি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ঘণ্টা মিনিট মাপা হয়। উত্তরা মুক্তির স্বপ্ন দেখে, অরুণ দিশেহারা হয়।
বাবা থাকবেন না, এখনও যেন এ কথা ভাবতে পারে না অরুণমাধব। তেরো বছর ধরে প্রায় শিলীভূত হয়ে পড়ে আছেন প্রিয়মাধব–তবুও। অরুণমাধবের চেতনার কাল থেকেই বাবাই তার
জীবনের হিরো। চা বাগানের সেই প্রাণহীন পরিবেশের মধ্যে বাবাকে মনে হত প্রাণের বন্যা।
মা ছিলেন একটু মৃদু, একটু চুপচাপ।
বাবা উত্তাল, অস্থির, দুরন্ত।
সেই বাবার এই পরিণতি বড় বিচলিত করে রেখেছে অরুণমাধবকে।
তবু ইদানীং অনিবার্যের নৈবেদ্য হাতে করেই বসে থাকতে হচ্ছে।
প্রায়ই সেই অনিবার্য জানান দিচ্ছে। প্রায়ই আজকাল সকালে এ ঘরে এদের সঙ্গে চা খেতে বসে নীহার বলে, আজ সকালে আবার এ দৃশ্য দেখাতে পারব আপনাদের, এ আশা করিনিকাল রাত্রে যা অবস্থা!
অরুণমাধব শিউরে উঠে বলে, সে কী, ডাকেননি কেন আমাদের?
নীহার বলে, উঁহু! আরও না দেখে
অরুণ বলে, শেষকালে বাবার যদি কিছু বলতে ইচ্ছে করে!
এত অগাধ সময় পেয়েও যদি সে ইচ্ছে মিটিয়ে নিতে না পারেন, না-ই পারলেন।
কথা আর কি! কোন কথা বলবার থাকতে পারে? তবে
উত্তরা ভাবত ওই লকারটায় না জানি কী আছে! এখনও শ্বশুর যার চাবি আগলাচ্ছেন। ওইটার কথাই হয়তো কিছু বলবেন। হয়তো কোনও দলিলপত্র আছে। হয়তো শাশুড়ির গয়নাগাঁটি আছে। সেইগুলো হাতে তুলে দেবেন আনুষ্ঠানিক ভাবে। কিন্তু সে অনুষ্ঠানে দরকার কী?…ভাবত উত্তরা, মারা গেলে তো আর চাবি সামলাতে আসবেন না প্রিয়মাধব?…আর সে চাবির ভাগীদারও কেউ নেই একা অরুণ ছাড়া।
প্রিয়মাধবের মাথার কাছের বাজুতে একখানা পাটকরা তোয়ালে, প্রিয়মাধবের সামনে একটা নিচু গোল টেবিল, যাতে থরে থরে সাজানো আছে শিশি, বোতল, কৌটো।…
যেন এই দৃশ্যটাই অনিবার্য!
উত্তরা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকত ওই দৃশ্যটার উপর। উত্তরা যে তার বরের সঙ্গে একদিনের জন্যে কোথাও বেড়াতে যেতে পারেনি, এ আক্ষেপ করতেও ভুলে যাচ্ছিল ক্রমশ।
ও জানে ওকে সকালবেলা উঠেই এ ঘরে এসে বলতে হবে, বাবা কেমন আছেন?
প্রিয়মাধব এক টুকরো বিদ্রুপের হাসি হেসে বলবেন, চমৎকার!
একটুক্ষণ অপ্রতিভের মতো দাঁড়িয়ে থেকে সরে আসতে হবে উত্তরাকে! বেশিক্ষণ কাউকে সহ্য করেন না প্রিয়মাধব। বাড়ির লোক কি অন্য আত্মীয় কেউ এসে একটু বেশিক্ষণ দাঁড়ালেই প্রিয়মাধব বলে ওঠেন, আর কেন? হয়ে গেছে তো চারপেয়ে গোরু দেখা।! টিকিট উসুল হয়ে গেছে। এবার যেতে পারো।
উত্তরা বলত, আর আমি যাব না ও ঘরে।
অরুণমাধব বলত, বাবাকে কি এখন পুরো মানুষ ভাবা উচিত উত্তরা?
উত্তরা রেগে উঠত। বলত, পুরো মানুষের মানমর্যাদা, প্রাপ্য পাওনাটা তো পুরোর উপর আরও বেশি নিচ্ছেন। তাতে তো একতিল ঔদাসীন্য দেখি না!
তবু আবার দুপুরবেলা উত্তরাকে এ ঘরের দরজায় এসে বলতে হয়, বাবা, তরকারি মুখে ভাল লাগল?
প্রিয়মাধব বলেন, অপূর্ব! তুমি নিজে বেঁধেছ বুঝি?
নীহার বলত, আমার কিন্তু ভারী ইন্টারেস্টিং লাগে। এত রোগী দেখেছি, এমন মজার রোগী দেখিনি কখনও।
আপনার আর মজা লাগবে না কেন?উত্তরা ভারী গলায় বলত, আপনার তো জীবন ফসিলহয়ে যাচ্ছে না আমার মতো? বিয়ে হয়ে পর্যন্ত এই দৃশ্য ২৪৬
অরুণমাধব ক্ষুব্ধ হত, অরুণমাধব লজ্জিত হত। ক্ষুব্ধ হত স্ত্রীর মনোভাবে, লজ্জিত হত বাবার ব্যবহারে।
উত্তরার কাছে অরুণমাধবের মুখরক্ষা করতেও যদি বাবা। শুনেছিল মৃত্যু অনিবার্য, প্রিয়মাধবের ব্যাপারে কি তার ব্যতিক্রম হবে?
.
আশা ফুরিয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু এল একদিন সেই অনিবার্য!
এল, কিন্তু ঢাকঢোল বাজিয়ে সমারোহ করে নয়, নিঃশব্দে।
হয়তো অনেক ঢাকঢোল বাজিয়ে নিয়েছে বলেই এখন স্তব্ধতা পছন্দ করল।
অনেক রাত্রে নীহার এসে এ ঘরের দরজায় টোকা দিল। বলল, আসুন?
এ কী সুর!
এ কী ভঙ্গি।
অরুণমাধব শুকনো গলায় বলল, কী হয়েছে?
ঘামছেন!
উত্তরা মৃতের মতো বলল, পাখা খুলে দেননি?
নীহার একটু হেসে বলল, দিয়েছি।
অরুণমাধব ত্রস্ত হয়ে জামা গায়ে দিতে গেল। নীহার বলল, ও কী করছেন?
ডাক্তারকে বলিগে—
আর নয়, থাক। ডাক্তার এসে পৌঁছবে না।
তা হলে?
আসুন এ-ঘরে।
অরুণ গেল, উত্তরাও গেল।
নিঃসন্তান দম্পতি, পিছনের দিকে তাকাতে হয় না।
প্রিয়মাধব ঘামছিলেন।
কবিরাজরা নাকি একেই বলেন কালঘাম। তবু প্রিয়মাধবের জ্ঞান চলে যায়নি। প্রিয়মাধব স্পষ্ট করে তাকাতে পারছিলেন না, কিন্তু স্পষ্ট গলায় কথা বলেছিলেন, কোথায় ছিলে তোমরা? সারারাত একলা পড়ে আছি আমি।
অরুণমাধব ঝুঁকে পড়ে ডেকে বলে ওঠে, বাবা, কী কষ্ট হচ্ছে?
প্রিয়মাধব বললেন, মরতে পারছি না, এই কষ্ট।
বাবা, ডাক্তারবাবুকে ডাকব?
আঃ।
ধমক দিয়ে উঠলেন প্রিয়মাধব।
তারপর বলে উঠলেন, অরুণ, আমাকে সে কথা বলতেই হবে। নইলে মরা হবে না।
উত্তরা এগিয়ে এসে বলল, কোন কথা বাবা?
প্রিয়মাধব এই মরণকালেও চেঁচিয়ে উঠলেন। বললেন, আঃ, তুমি কে বাঁচাল মেয়ে? যাও, যাও এ ঘর থেকে।
উত্তরা ঠিকরে বেরিয়ে গেল।
নীহার ওদিক থেকে একটু অনুকম্পার হাসি হাসল।
প্রিয়মাধব আরও ঘামছিলেন, নীহার মুছিয়ে দিচ্ছিল তোয়ালে দিয়ে। নীহার জানতে পারছিল, এই ফরসা তোয়ালেটা কাল সকালে আর পালঙ্কের বাজুতে পাট করে রাখতে হবে না।
প্রিয়মাধব বললেন, নার্স, তুমি যাও।
না, আমি যাব না।
প্রিয়মাধব তেড়ে উঠলেন, তুমি আমার গোপন কথা শুনবে?
শুনতেই হবে।
অরুণ, একে তাড়িয়ে দাও।
অরুণ মিনতির চোখে তাকাল। নীহার নিচু গলায় বলল, অনেকক্ষণ থেকে ডিলিরিয়াম শুরু হয়ে গেছে। অনেক গোপন কথা বলেছেন আমায়।
অরুণ স্তিমিত হয়ে গেল।
প্রিয়মাধবও স্তিমিত হয়ে যাচ্ছেন, তবু শেষ চেষ্টা করলেন প্রিয়মাধব, এই চাবিটা নাও। ওটা খোলো।
সেই চাবি, যা এতদিন আগলে রেখেছিলেন প্রিয়মাধব।
অরুণের হাত-পা শিথিল হয়ে যাচ্ছিল, তবু অরুণ খুলল গডরেজের ছোট্ট আলমারিটা। কিছু নেই, শুধু কিছু কাগজ আর একটা মোটা খাতা!
মূঢ়ের মতো তাকাল।
প্রিয়মাধব বিছানা হাতড়াচ্ছিলেন, যেন কিছু একটা খুঁজছিলেন।
অরুণমাধব শুকনো গলায় বলে, বাবা, কী দেব?
প্রিয়মাধব শুনতে পেলেন না। নিজের মনে বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, তোমার চোখ সরাও। দেয়ালে, ছাতে, জানলায়, দরজায় সব জায়গায় চোখ পেতে রাখবে কেন তুমি? বুঝতে পারো না আমার ভয় করে? কত মায়া ছিল তোমার, এত নিষ্ঠুর হলে কী করে?
মুমূর্ষ রোগীর প্রলাপের মধ্যে কি কোনও অর্থ থাকে? বাক্যন্ত্রের আর চিন্তার যন্ত্রের মধ্যেকার যোগসূত্র তো ছিন্ন হয়ে গেছে, ভেঙে পড়ে গেছে চলাচলের সেতু। এখন তো শুধু চির-অভ্যস্ত বাকযন্ত্র এলোমেলো করে ছড়িয়ে দিচ্ছে তার শেষ শক্তিটুকু।
অরুণ তবে কেন সেই অর্থহীন প্রলাপের মধ্যে থেকে অর্থ খুঁজতে চাইছে? ও কেন উৎকর্ণ হয়ে ওই কথাগুলোই শুনছে?…প্রিয়মাধবের নখের ডগাগুলো যে অসম্ভব ঠাণ্ডা হয়ে গেছে, নীহার যে যেখানে যত ভোয়ালে ছিল সব দিয়েও প্রিয়মাধবের ঘাম মুছিয়ে শেষ করতে পারছে না, এ কি প্রিয়মাধবের ছেলের চোখে পড়ছে না?
তাই অজানিত এক রহস্যলোকের বন্ধ দরজায় কান পেতে দাঁড়িয়ে থাকার মতো দাঁড়িয়ে আছে সে ওই প্রলাপোক্তির সামনে।
হয়তো এমনিই হয়।
একা অরুণমাধবই নয়, মানুষ মাত্রেই রোগীর প্রলাপোক্তির মধ্যে থেকে, মুমূর্যর শেষোক্তির মধ্যে থেকে কোনও এক অজানা রহস্যলোকের চাবি খুঁজতে বসে।
চিরদিন দরজায় দরজায় পাহারাদার ছিল মোতায়েন, আগলে রাখত রহস্যের কোষাগার, আজ পরিত্যাগ করে চলে গেল তারা ভগ্নদুর্গ। খোলা পড়ে রইল দরজা। কৌতূহলী মানুষেরা তবে উঁকি মেরে দেখতে আসবে না কেন, কী ছিল ওখানে? ঝড়তি-পড়তি যদি কিছু পড়ে থাকে, কুড়িয়ে নিতে পারলে তো বোঝা যাবে, কোন রহস্যপুরীর দরজা আগলে থাকত মজবুত পাহারাদার! অরুণও সব মানুষের মতোই করল।
কান পাতল ওই স্তিমিত কণ্ঠের অর্থহীন প্রলাপোক্তিতে।
স্তিমিত হয়ে যাচ্ছে..ক্রমশ স্তিমিত হয়ে যাচ্ছে সেই অর্থহীন বিড়বিড় করা বকুনি। যেন সরু তারের উপর দিয়ে হাঁটছে, আর বারেবারে পা ফসকে যাচ্ছে। তবু চোখ রাঙাচ্ছ? কতবার বলছি, তোমার ছেলে ভয় পাবে। হ্যাঁ হ্যাঁ–ছেলে।…আঃ, কী নাম তোমার? জানো না? থাক থাক্, বলতে হবে না। শুধু শুনে রাখো, সুমিতা তোমার মা নয়!… না-না, ভুল বলছি ছেলে, সুমিতা তোমার মা। বুঝলে? শুনতে পাচ্ছ, সুমিতা তোমার মা, কিন্তু সে তো হারিয়ে গেছে। সেই যখন তুমি একটা খোকা ছিলে, তখন
আচ্ছা ও তবে কে? যে তোমায় ভাত খাইয়ে দেয়? তোমায় জামা পরিয়ে দেয়? ও কেউ নয়? সুমিতা, ওর বুঝি চোখ নেই? জলভরা, ছলছলে! অরুণের কানটা প্রিয়মাধবের ওষ্ঠ স্পর্শ করছে। অরুণও ঘামছে প্রায় বাবার মতোই। অরুণের বাহ্যজ্ঞান লোপ পেল না কি?
তাই অরুণ লোকলজ্জা মানছে না। নীহার যে বসে রয়েছে সে কি দেখতে পাচ্ছে না অরুণ? অরুণ শুধু শুনবে বিলীন হয়ে যাওয়া কণ্ঠের শেষ কথা। অস্ফুট শব্দ ফুটতর করতে নাকি যন্ত্র আছে, সে যন্ত্র যদি আগে থেকে এনে রাখত অরুণ?
এনে রাখেনি।
তাই অরুণ শুধু একটা স্বরের খসখসানি শুনতে পাচ্ছে। ওর থেকে কি ধরতে পারবে অরুণ প্রিয়মাধব বলছেন, ছেলে, তুমি বুঝতে পারছ না অত চোখ কার? সুমিতার না নমিতার? তবু পারছ না, বোকা, বোকা, ঠকে যাচ্ছে। চিরদিন ধরে শুধু ঠকছে। খুব ঠকিয়েছি তোমায়, দুয়ো, দুয়ো!
আর শোনা যাচ্ছে না।
খসখসানিটুকুও থেমে যাচ্ছে যেন। নীহার ধমকে উঠল, আর কী শুনতে চাইছেন অরুণবাবু? কথা তো থেমে গেছে, দেখছেন না রেকর্ডের গায়ে শুধু পিনটা ঘষছে।
হ্যাঁ, কথা বন্ধ হয়ে যাওয়া রেকর্ডটা এখনও ঘুরছে, পিনটা উঠিয়ে নেবার ওয়াস্তা।
কিন্তু হঠাৎ কী করে তবে উত্তেজিত গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন প্রিয়মাধব? পিনটা উঠিয়ে নেবার সময় শেষবারের মতো কি আর্তনাদ করে উঠল রেকর্ডখানা? না কি ভেঙে গেল? নার্স! নার্স! খাতাটা পোড়াচ্ছ না যে? ভেবেছ কী তুমি? মাইনে পাও না?…জানো না আমার ছেলে ভয় পায়..পুড়িয়ে ফেলো নার্স, বলছি পুড়িয়ে ফেলল।
বাবা! বাবা! ঝাঁপিয়ে পড়ল অরুণমাধব।
থেমে গেল ভাঙা রেকর্ডের আর্তনাদ।
ক্রমশ দুরের ঘণ্টা নিকটবর্তী হচ্ছে, গাড়ির চাকার আওয়াজ স্পষ্ট হচ্ছে, মনে হচ্ছে সে গাড়ি এবার দরজায় এসে থামবে। আর অন্য পথে ফিরে যাবে না।
ও কি প্রিয়মাধবের ওই স্বীকৃতিটুকুর জন্যে অপেক্ষা করছিল? অপরাধ কবুল করেছেন প্রিয়মাধব, এইবার নিয়ে যাবে ও?
.
মিস ঘোষ! অরুণমাধব গলার স্বরেই যেন হাত চেপে ধরল নীহার ঘোষের, কখন থেকে শুরু হয়েছিল ভুল কথা?
নীহার সন্তর্পণে হাত ছাড়িয়ে নেবার সুরে বলল, ওই এক ঘুম থেকে ওঠার পর আর কি।
ঘুমিয়েছিলেন?
চমৎকার!
অরুণ রুদ্ধশ্বাসে বলে, তারপর কী হল?
নীহার হঠাৎ প্রায় হেসে উঠল। কথার সুরে তার আভাস ধরা পড়ল, কিছু মনে করবেন না অরুণবাবু, আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে এই পিতৃশোকটা যেন আপনার কাছে বিনা নোটিসে অকস্মাৎ বজ্রপাতের মতো এসেছে।
কী বলছেন?
ঘুম ভাঙার মতো বলে অরুণ।
বলছি, আপনার এই ভেঙে পড়াটা হাস্যকর। আপনার বাবার যা অবস্থা চলছিল, সুসন্তান হিসেবে ঈশ্বরের কাছে আপনার ওঁর মুক্তির জন্যে প্রার্থনা করা উচিত ছিল।
মিস ঘোষ, বাবা আমার কাছে কী ছিলেন আপনি জানেন না।
দেখুন, মা-বাবাকে কে না ভালবাসে? সেই ভালবাসার বশেই যথা সময়ে ওঁদের মৃত্যু কাম্য! অনড় অশক্ত হয়ে বেঁচে থাকুন তাঁরা আমার দৃষ্টিসুখের জন্যে, এ তো রীতিমত স্বার্থপরতা!
আপনার কথা মানছি মিস ঘোষ অরুণ অন্যমনা হয়ে বলে, কিন্তু সেই প্রথম ঘুম ভেঙে কী বলছিলেন উনি শুনতে পেয়েছেন আপনি?
নীহার উড়িয়ে দেবার ভঙ্গিতে বলে, শুনতে হয়তো পেয়েছিলাম, কান দিইনি—
কান দেননি? উনি কী বললেন কান দেননি?
উত্তেজিত শোনাল অরুণের গলা। নীহার অনুত্তেজিত, প্রলাপের রোগী কী বলছে না বলছে তাতে কান দিতে গেলে আমাদের চলে না অরুণবাবু!
আপনার মনে হল সবই প্রলাপ?
তা ছাড়া আবার কী? সারা দেয়াল উনি চোখ দেখতে পাচ্ছিলেন, দেয়াল ছাত দরজা জানলা, সমস্ত ভরে যাচ্ছিল জোড়া জোড়া চোখে, এ সবেরও তবে মানে আবিষ্কার করুন।
হয়তো মানে আছে মিস ঘোষ!
হতাশ গলায় বলে অরুণমাধব।
.
সেই ঘরটাতে বসেই কথা বলছে ওরা, যে ঘরে একখানা শূন্য পালঙ্ক পড়ে আছে অদ্ভুত নতুন একটা দৃশ্যের মতো। ওই পালঙ্কে যে তেরো বছর ধরে একটা যন্ত্রণাজর্জর আত্মা খানিকটা জড়মাংসপিণ্ডের মধ্যে আশ্রয় নিয়ে ঈর্ষার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেছে জীবন্ত পৃথিবীর দিকে, এ কথা কি এখন আর মনে পড়ছে? ওটা যেন শুধু একটা শূন্যতার প্রতীকের মতো পড়ে আছে।
উত্তরা এ ঘরে আর আসেনি।
উত্তরা ছত্রিশ ঘন্টা আগের সেই অপমানটায় জ্বলছে, যখন প্রিয়মাধবের সেই অচল দেহটা তার সমস্ত আক্ষেপ আর উত্তেজনা থামিয়ে স্থির হয়ে গেল, যখন সেই তাঁর জর্জরিত আত্মখানি দরজায় এসে থামা গাড়িটায় চড়ে বসে এগিয়ে গেল মেঠোপথ ধরে, তখনও উত্তরা এল না। উত্তরা শুধু দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকল।
অরুণমাধব বলেছে, উত্তরা, তুমি কি পাগল?
তিলে তিলে পাগল হয়ে উঠেছি হয়তো। প্রতি মুহূর্তে অপমান সহ্য করা শক্ত বইকী! জিনিসটা গুরুপাক।
কিন্তু এতদিন সহ্য করে এসে, এখন এই শেষকালে যখন অসহ্য হওয়াটা অর্থহীন হয়ে গেল
উত্তরা গম্ভীরভাবে বলেছে, কার কাছে কোন জিনিসটা কোন অর্থ নিয়ে আসে, সবাই কি বুঝতে পারে? অনেক ভার সইতে সইতে কোনও এক সময় সুতোটা ছিঁড়ে পড়ে।
অরুণমাধব ভাবল, হয়তো ছিঁড়ে পড়ে ভালই হয়েছে, হয়তো রোগীর প্রলাপের ওই শেষ কথাগুলো উত্তরা বুঝে ফেলত, হয়তো তার মানে আবিষ্কার করতে বসত।
কিন্তু অরুণ?
অরুণ কি স্মৃতির সমুদ্রে তলিয়ে গিয়ে দেখতে চেষ্টা করবে প্রিয়মাধব ওকে কখন ঠকালেন? তার সমস্তটা জীবন ঠকিয়ে এসেছেন প্রিয়মাধব? না কি মৃত্যুকালে ঠকিয়ে গেলেন? দুয়ো দিয়ে গেলেন?
সুমিতা যখন মারা গিয়েছিলেন, তখন কি সুমিতা প্রলাপ বকেছিলেন!
না, সুমিতার প্রলাপ বকার কোনও কারণ ঘটেনি, সুমিতা সামান্য একটু ইনফ্লুয়েঞ্জায় মারা গিয়েছিলেন।
সুমিতা মারা যাবার দিন সকালেও অরুণকে ডেকে বলেছিলেন, অরুণ, ওঁর ওষুধটা খাবার সময় হল বোধ হয়।
বলেছিলেন, বউমাকে বলিস অরুণ, ওঁর স্টুটা নিজে করে দিতে। ব্ৰজেন ঠিকমতো পারবে না। হয়তো ঝাল দিয়ে বসবে।
প্রতিদিন মাংস খেতেন প্রিয়মাধব, সেই রান্নাটা ছিল সুমিতার হাতে।
সেই দুপুরেই মারা গেলেন সুমিতা, যেন আস্তে ঘুমিয়ে পড়লেন। একটি কথাও বলে গেলেন না কাউকে। আশ্চর্য, কোনও বক্তব্যই কি ছিল না সুমিতার? একমাত্র বক্তব্য, প্রিয়মাধবের ঝোলে যেন ঝাল না পড়ে?
তবে?
বক্তব্য কি শুধু নমিতার?
সুমিতার সেই যমজ বোন নমিতা।
বিষপোকার কামড় খেয়ে মারা গিয়েছিল যে নমিতা অনেকদিন আগে। অরুণ নামক একটা বোকা শিশু যখন দোলায় শুয়ে চেঁচাত, আর চুষি খেয়ে ভাবত মার স্পর্শ পাচ্ছি, তখন।
.
কিন্তু মৃত নমিতা কি উঠে এসেছিল চিতা থেকে? সেই আসামের উপকণ্ঠের কোনও একটা জঙ্গুলে শ্মশানে যে চিতা সাজানো হয়েছিল, সেখান থেকে এখানে চলে এসেছিল নমিতা? প্রিয়মাধবের ঘরে ঢুকে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে বালিশের তলা থেকে চাবি বার করে নিয়ে খুলে ফেলেছিল প্রিয়মাধবের মাথার কাছের সেই ছোট্ট আলমারিটা? আর তার মধ্যে রেখে দিয়ে গিয়েছিল তার বক্তব্য! কখন ওই বক্তব্যের খাতাটা ভরাল নমিতা? কখন লিখল পাতার পর পাতা? আশ্চর্য!
অথচ খাতাটা তো নমিতারই।
মলাটের পরের পৃষ্ঠাতেই তো পরিষ্কার করে লেখা রয়েছে–নমিতা দেবী।
কিন্তু নমিতা দেবী কি তাঁর বক্তব্য লিপিবদ্ধ করে রেখে গেছেন নীহার ঘোষ নামের একটা মাইনে করা নার্সের জন্যে? তাই কি সম্ভব?
অথচ সে খাতা নীহার ঘোষই পড়ছে রাত জেগে, উপন্যাস পড়ার কৌতূহল নিয়ে।
তার মানে নীহার ঘোষ চুরি করেছে এ খাতা।
গোলমালের সময়, যখন ভোলা পড়ে ছিল আলমারিটা। অথচ নীহার এমন খারাপ মেয়ে ছিল না। খাতাটা যদি চুরি করেছে নীহার, ওর মধ্যে থেকে প্রিয়মাধবের স্ত্রীর গয়নাগুলো ও তো চুরি করতে পারত। ওর মধ্যেই তো ছিল একটা খোপে। হয়তো নীহার দেখতে পায়নি সেই গয়না। তাই নিতে পারেনি। তাই শুধু ওই কালো বাঁধাই মোটা খাতাটা টেনে নিয়েছিল খস করে।
যে খাতা নমিতা দেবীর অনেক রাত্রিজাগরণের ফসল, সে খাতা নীহার ঘোষ পড়ছে রাত জেগে, এর থেকে ভাগ্যের কৌতুক আর কী আছে?
কিন্তু ভাল মেয়ে নীহার কেন চুরি করল? প্রিয়মাধবের আদেশ পালন করতে ও কি তবে ওটা পুড়িয়ে ফেলতেই নিয়ে রেখেছে? শুধু কৌতূহল সামলাতে পারেনি, ভিতরে কী লেখা আছে ভেবে?
এই কৌতূহলই নীহারকে যুক্তি দিয়েছে, আমি পড়লে কী? আমার কাছে তো শুধু উপন্যাস? আমার জন্যে তো প্রিয়মাধব নামের ওই নাটকীয় চরিত্রটি নাটকের মতো করে বলে ওঠেনি, খাতাটা পুড়িয়ে ফেলো নার্স। খাতাটা পুড়িয়ে ফেলল।
.
দিদি আমার থেকে এক ঘণ্টার বড়—
নমিতার জীবনের নায়িকা কি দিদি?
তাই নমিতা দিদি দিয়েই শুরু করেছে তার ডায়েরি:
দিদি আমার থেকে এক ঘণ্টার বড়, তবু পিসি আমায় দিদি বলতে শিখিয়েছিল।
আমাদের সেই সিকদার বাগান লেনের বাড়িটার ধারেকাছে যারা থাকত, তারা শুনে হাসত। বলত যমজ ভাইবোনকে দাদা, দিদি বলা শুনিনি কখনও। কে বড় কে ছোট হিসেব থাকে নাকি? ওদের হিসেবে যাই হোক, আমি কিন্তু দিদিকে দিদিই ভেবে এসেছি ছোট থেকে। দিদিও তো ছোট বোন ছাড়া আর কিছু ভাবত না আমায়। দিদি বড়র স্নেহ দিয়ে আগলে রাখত আমায়। বড়র মর্যাদা নিয়ে শান্ত থাকত।
দিদির সঙ্গে ছেলেবেলায় কখনও ঝগড়া হয়নি আমার। একটা খেলনা একটা পুতুল থাকলে দিদি আমার হাতে তুলে দিত।
অবিশ্যি খেলনা পুতুল, এইসব রাজকীয় বস্তু ভাগ্যে কবারই বা জুটেছে আমাদের?
কে আদর করতে এসেছে আমাদের? জন্মকালে মা মরেছে, বাল্যকালে বাপ।
যমজ দুটো বোন পিসির হাতে মানুষ হয়েছি, নেহাতই ভগবানের জীব এই পরিচয়ে। তবে বাড়িটা ছিল আমাদের নিজেদের, আর বাবার টাকাও ছিল কিছু, তাই পিসেমশাই তাঁর ভাইদের সঙ্গে পৃথক হয়ে শালার বাড়িতে এসে উঠেছিলেন।
অবশ্য তাঁর এই আসার পিছনে যুক্তি ছিল বইকী! পিসিমা যদি তাঁর ভাইঝি যুগলের তদারকির অজুহাতে ভাইয়ের বাড়িতেই স্থায়ী বসতি স্থাপন করেন, পিসেমশাই কি বানের জলে ভেসে যাবেন?
আসল কথা, আমাদের দুর্ভাগ্য পিসিমার সৌভাগ্য ডেকে এনেছিল। শ্বশুর বাড়িতে একখানি মাত্র ঘরে, পাঁচ বউয়ের এক বউ হয়ে শাশুড়ির আওতায় দিন কাটছিল, সে জায়গায় সংসার, স্বাধীনতা, বাপের বাড়ির বাড়িখানা। তার বদলে দুটো পুষ্যি, এই যা। কিন্তু পিসির নিজের তো ছেলেপুলে ছিল না।
তবু পিসি আমাদের সামনে সক্কলকে বলে বেড়াত, এই-যে, আমার গলায় গেঁথে দিয়ে চলে গেছে। ভাই-ভাজ দুজনে। নিজের সর্বস্ব ভাসিয়ে দিয়ে এসে ওদের নিয়ে পড়ে আছি।
আমরা বড় হবার পরও বলত।
পিসির সর্বস্বটা কতটা, সে কথা আমরা বুঝে ফেলার পরও বলতে লজ্জা পেত না।
অথচ পিসি যদি এত কষ্ট না করত, কত উপকারই করা হত নমিতা সুমিতা নামের দুটো মেয়ের।
নামকরণের সঙ্গে সঙ্গে, যদি বিলোপ হয়ে যেত নাম দুটো, বেঁচে যেত তারা।
কিন্তু বাঁচতে পেল না বেচারারা।
পিসি মরে মরে তাদের মানুষ করতে লাগল।
তবে পিসিকে আমি দোষ দিতে পারি না।
পিসি করেছিল বইকী! অনেক কিছুই করেছিল। পিসেমশাই গাফিলি করে বসে থেকেছে বলে পিসি তার সঙ্গে ঝগড়া করে পাড়ার লোককে দিয়ে সুমিতা নমিতাকে স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে। পাড়ার লোককে দিয়েই মাস্টার ঠিক করিয়ে দিয়েছে। আর নিজে লেখাপড়া না জানলেও, দুবেলা তদারকি করে পড়তে বসিয়েছে ওদের ছেলেবেলায়। স্কুলের ভাত রাঁধত পিসি, স্কুলে যাবার সময় জবজবে করে তেল দিয়ে চুল আঁচড়ে দিত। আবার স্কুল থেকে ফিরলে একগোছা পরোটা আর তরকারি নিয়ে বসে থাকত, আসামাত্রই যাতে তাদের পেটের মধ্যে চালান করে দিতে পারে।
শুধু যাযা করত, সব বড় বিশদ করে বলত পিসি। বলে বেড়াত। ওই দোষ! ওই দোষেই পিসিকে দেখতে পারত না ওরা।
অথচ পিসি তার বরের সঙ্গে ঝগড়া করত মেয়ে দুটোকে নিয়ে।
পিসেমশাই ওদের সুবাদেই ওদের বাড়িতে থাকত, ওদের পয়সাতেই সংসার চালাত, তবু ওদের আপদবালাই ভাবত। ভাবখানা যেন আমাদের যুগল জীবনের মাঝখানে ও দুটো অবান্তর সুখের বিঘ্ন।
তবু যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছিল পিসি।
টেনে তুলেছিল মেয়ে দুটোকে স্কুলের গণ্ডি থেকে, আর দুজনকে দুটো বর জোগাড় করে দেবার জন্যেও উঠেপড়ে লেগেছিল সেই স্কুলের সময় থেকেই।
তবু ভাইঝিদের ভালবাসা জোটেনি তার কপালে।
সুমিতা নামের মেয়েটা পিসিকে ভালবাসুক না বাসুক গুরুজন বলে মানত। বড় হয়ে ইস্তক পিসির কাজের সাহায্য করে দিতে আসত, পিসি খেয়েছে না খেয়েছে দেখত, পিসি তোমার কষ্ট হচ্ছে–এ কথা বলে মন জোগাত।
নমিতা ছিল বিপরীত।
হ্যাঁ, আমি! আমি আদৌ ওসবের মধ্যে যেতাম না। ঝি না এলে পিসি যদি বাসন মাজতে যেত, দিদি হয়তো ঘরগুলো মুছতে বসত, আমি সে সময় দিদিকে আর পিসিকে দেখিয়ে দেখিয়ে চটের ফুল তুলতাম, শুনিয়ে শুনিয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কবিতার বই খুলে কবিতা পড়তাম।
আমাদের বাবার অনেক বই ছিল। তার মধ্যে কবিতার বইও অনেক ছিল।
কান্ত কবির, সত্যেন দত্ত, করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়ের, কুমুদরঞ্জন মল্লিকের, যতীন্দ্রমোহন বাগচীর, আর সর্বোপরি রবীন্দ্রনাথের। রবীন্দ্রনাথের অনেক বই ছিল বাবার।
দিদি কদাচ সে সব বইতে হাত দিত, দিদি স্কুলের পড়ায় প্রাণ ঢালত। যদিও কখনও ছুটির দিনেটিনে একখানা বই টেনে বসত তো সে হয়তো গ্রন্থাবলী। অনেক গ্রন্থাবলী ছিল বাবার আলমারিতে।
বাবাকে আমার অস্পষ্ট মনে পড়ে।
যেন একটু বিষণ্ণ বিষণ্ণ, একটু বা গম্ভীর। আমাদের কদাচ কাছে ডাকতেন। এর বেশি নয়। কিন্তু ওই বইগুলির মধ্যে থেকে যেন বাবাকে আবিষ্কার করতে চেষ্টা করতাম আমি।
সে আবিষ্কার সত্যের কাছাকাছি পৌঁছত কিনা জানি না, তবে পিসির সঙ্গে যে পিসির ভাইয়ের আকৃতি বা প্রকৃতির মিল ঘটায়নি এটা নিশ্চিত। আকৃতিও কল্পনা করে নিতে হত। কারণ বাবার কোনও ফটো ছিল না। পিসির মুখের আক্ষেপের মধ্যে থেকে শুনেছি, আমাদের মায়ের নাকি খুব ফটো তোলার সাধ ছিল। ভাল একটি ফটো তোলার।
বিয়ের সময় নাকি ফটো তোলা হয়নি মার।
কিন্তু হচ্ছে হবে করে সেই ফটো আর ভোলা হয়নি, মরেই গেলেন ভদ্রমহিলা। দু-দুটো মোটাসোটা মেয়ের ভার যদিবা সয়ে ছিলেন, তাদের ধারটা আর সইতে পারলেন না। তাদের পৃথিবীতে নামিয়ে দিয়েই বিদায় নিলেন।
এরপর যে আর বাবার নিজের ছবি তোলবার বাসনা হবে না, এটা খুবই স্বাভাবিক।
একবার একজোড়া ন্যাড়া মেয়ের ফটো তুলিয়ে দেয়ালে ঝুলিয়ে রেখেছিলেন, সেটা মাকড়সার ঝুল চাপা হয়ে ঝুলেই থাকত, সাতজন্মে চুনকাম না করা দেয়ালে। তার আশেপাশে পিসির অবদান কালী, দুর্গা, সত্যনারায়ণ, কমলে কামিনী, আর বস্ত্রহরণ লীলার পট। পিসির ছবির সংগ্রহশালা দেখলে বোঝবার উপায় ছিল না, পিসি শাক্ত কি বৈষ্ণব। কেন জানি না, মা সম্পর্কে কোনও কৌতূহল পোষণ করিনি কখনও। পিসি যদি কখনও একখানা পুরনো চেলি কি রং-জ্বলা সাটিনের জ্যাকেট সামনে এনে বলত, এই দেখ তোদের মার স্মৃতিচিহ্ন, উদাসীন দৃষ্টিতে দেখতাম, নয়তো বা সেকালের জামার কাটছাঁট নিয়ে ঠাট্টা করতাম। কিন্তু বাবার সম্পর্কে কৌতূহল ছিল, জল্পনা কল্পনা ছিল, আর জ্ঞান হয়ে দেখতে পেলাম না বলে আক্ষেপ ছিল।
ওই আলমারি ভর্তি পুরনো বইয়ের মধ্যে কি বাবার উপস্থিতির সৌরভ ছিল? না কি প্রত্যেকটি বইয়ের গায়ে পরিষ্কার অক্ষরে যে নামটি লেখা ছিল, তাতেই সেই নামীর স্পর্শ ছিল?
কারণ যাই হোক, বাবাকে নিয়ে আমরা আলোচনা করতাম। দিদি আর আমি।
আমিই বলতাম, বাবাকে দেখতে কীরকম ছিল বল তো দিদি?
দিদি ভেবে বলত, পিসির দাদা তো৷ পিসির মতোই হবে।
ওটা আমার পছন্দ হত না।
বলতাম, দূর, পিসির মতো হলে তো বিচ্ছিরি।
এই নমু, ও রকম বলতে নেই রে, বলিস না।
আমি হেসে ফেলে বলতাম, তবে কি পিসিকে খুব সুন্দরী বলা উচিত?
দিদি হেসে বলত, অতটা বলছি না তা বলে।
কিন্তু কতটা যে বলতে চাইত তা দিদিও জানত না। নিজস্ব কোনও ধারণা ছিল না দিদির।
দিদি শুধু দেখতে চেষ্টা করত কাউকে না আঘাত করা হয়, কাউকে না অসম্মান করা হয়ে যায়। কোথাও না ঔদ্ধত্য প্রকাশ হয়।
আমি যদি বিশেষ কোনও ইচ্ছে, অভিমত বা ধারণার উপর জোর দিতাম, দিদি ক্ষীণ প্রতিবাদ তুলতে না তুলতেই তাতে সায় দিত।
তাই দিদি পরক্ষণেই বলত, যা বলেছিস, পিসির মতো ছিল না কখনও। ভাইবোন বলেই যে একরকম দেখতে হবে তার মানে নেই। আমাদের মতো যমজ তো আর নয়!
এ সব বই, সমস্ত বই বাবা পড়েছিলেন মনে হয় তোর? বলতাম আমি।
দু-তিনটে আলমারি বই পড়ে ফেলা দিদির কাছে সত্যি সমুদ্র-জল পান করার মতোই, তাই দিদি হেসে ফেলে বলত, ধ্যেৎ।
আমি বলতাম, আমার কিন্তু স্থির বিশ্বাস, সব পড়েছেন বাবা। নতুন বই কিনে কেউ তুলে রাখতে পারে? একটা করে কিনেছেন, পড়ে তবে আলমারিতে সাজিয়েছেন। এই হচ্ছে ঠিক।
দিদি বলত, এমনি কিনে রেখে দেওয়া যায় না বুঝি?
আমি বলতাম, যায়। যাবে না কেন? ভাত বেড়ে নিয়ে বসে না খেয়েও কি থাকা যায় না? তবে থাকে কি কেউ?
তা পদ্যর বইগুলো কি কেউ পড়ে?
পড়ে না? আমি হি হি করে হাসতাম।
পড়ে না তো লেখা হয় কেন?
আহা, সে তো স্কুলে রেসিটেস্যান করতে কিংবা
আমার হাসির ঝাপটায় দিদির হাসি বন্ধ হয়ে যেত।
অপ্রস্তুত হয়ে গিয়ে নিজেও হাসত দিদি।
কিন্তু এসব কথা আমরা খুব ছেলেবেলাতেই কইতাম। বছর আট কি নয় বড়জোর।
বড় হয়ে তা বলে দিদি অত বোকা ছিল না।
নিজস্ব একটা স্বাভাবিক বুদ্ধি দিদির মধ্যে গড়ে উঠেছিল। দিদি বুঝতে পারত কোন কথার কী পরিণাম হতে পারে, কোন মনোভাবটা শুভ, আর কোনটা শুভ নয়। পিসেমশাইকে পর্যন্ত বলতে শুনেছি, সুমিতার মতন মেয়ে হয় না। লক্ষ্মী মেয়ে।
সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য নমিতা নামের মেয়েটার সমালোচনা হয়েছে। বলা বাহুল্য, সে সমালোচনা নমিতার অনুকূল নয়।
কিন্তু তাতে কিছু এসে যেত না নমিতার।
নমিতা ওই বোকা সুমিতার মতো কেয়ার করত না, কে কী ভাবছে। পিসের মতো একটা গাঁইয়া লোকের, বা পিসির মতো একটা নির্বোধ মেয়েমানুষের নিন্দে সুখ্যাতিতে কিছুই এসে যেত না তার।
বাবার ওই বইয়ের রাজ্যে ছিল নমিতার আশ্রয়।
সুমিতা আশ্রয় খুঁজত সংসারের মাপা গণ্ডির মধ্যে।
আশ্চর্য! মানুষ কত বদলায়!
কত ওলটপালট হয়ে যায় তার চিন্তাধারা! কী অদ্ভুত সিদ্ধান্তেই না পৌঁছতে পারে সে হঠাৎ। আর কত সহজেই ভেঙে পড়ে তার আশ্রয়!
২. দিদি ডাকের মর্যাদা
সুমিতা তার ছোট বোনকে ভালবাসত, ঘোটর মতোই মায়া করত, দিদি ডাকের মর্যাদা রাখত।
নমিতা সেই ভালবাসা সেই মমতা অগ্রাহ্য করতে পারত না, ছোটর মতোই খাকত, কিন্তু ভিতরে ভিতরে দিদির থেকে নিজেকে অনেক বড় ভাবত। বুদ্ধিতে বড়, বিদ্যেতে বড়। সুক্ষ্ম রসবোধে আর শিল্প
সৌন্দর্য-সংস্কৃতির রুচিবোধে দিদিকে নিজের থেকে নেহাতই ক্ষুদ্র মনে হত তার।
নমিতা যে বিশিষ্ট একজন, আর সুমিতা যে শুধুই একটা জন মাত্র, এ ধারণা জন্মে গিয়েছিল নমিতার অস্থি-মজ্জায়।
পিতৃপক্ষের এবং পিসির পক্ষের আত্মীয়রা যখন দুই যমজ বোনের মধ্যে একজনকে ল্যাংড়া এবং অপর জনকে আমড়ার সঙ্গে তুলনা করত, নমিতা অবজ্ঞাভরে তাকিয়ে দেখত, যারা করছে তারা কোন দরের লোক।
.
এমনি করতে করতেই ম্যাট্রিক পাস করল তারা।
বোকা সুমিতা প্রথম বিভাগে পাস করল, চালাক নমিতা দ্বিতীয় বিভাগে।
এটা যে নমিতার সম্পূর্ণ অবহেলার ফল তাতে আর সন্দেহ ছিল না। তবু সুমিতা যেন ওর ওই বিভাগটা নিয়ে মরমে মরে গেল। আর নমিতা সগর্বে বলে বেড়াতে লাগল, পরীক্ষায় গোটাকতক মার্ক বেশি পাওয়াই যাদের কাছে পরমার্থ, আমি তাদের দলে নই বাবা! বিবেকের দংশনে কিছুমাত্র কাতর হসনি দিদি, তুই মনের আনন্দে তোর ফার্স্ট ডিভিশনটা সোনার আলমারিতে তুলে রাখগে যা। ২৫৪
মেয়ে দুটো কলেজে পড়বে কি না পড়বে, এ কথা একবার উঠেছিল। মাস্টারমশাই নামক যে জীবটি আমাদের শৈশববাল্যের কর্ণধার ছিলেন, তিনি পিসিকে মা বলতেন। আর সেই সূত্রেই তাঁর যাতায়াত অব্যাহত ছিল। বলা বাহুল্য আমরা বড় হয়ে ওঠার পর অবধি পড়িয়ে চলবেন এত বিদ্যে ছিল না মাস্টারমশাইয়ের। কিন্তু হিতৈষীর পোস্টটা আঁকড়ে ছিলেন তিনি বরাবর।
যদিও পিসির মতো বুদ্ধিহীন মেয়েমানুষকে যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় মা ডেকে সম্পর্ক পাতায়, তার বুদ্ধি বিবেচনার উপর আমার অন্তত কিছুমাত্র আস্থা ছিল না।
তথাপি মাস্টারমশাই বলেছিলেন, ভর্তি করতে হলে এখনই অ্যাপ্লাই করতে হবে, দেরি করাটা ঠিক নয়। কিন্তু পিসি কলেজের নামে নাক তুলেছিল। বলেছিল, কলেজে পড়বে কী? তুমি বলছ কি বাবা! ছিঃ!
মাস্টারমশাই আমাদের জন্যে অনেক জল ঢেলেছিলেন, কিন্তু মাটি ভিজল না। কঠিন থাকল পিসি, আর জীবনে এই দেখলাম, একটা ব্যাপারে পিসি আর পিসে একমত হল।
পিসেও বলল, তুমি বলো কী মাস্টার? কলেজে ভর্তি হবে কি? চাকরি করবে নাকি?
মাস্টারমশাই নগলায় বললেন, কলেজে পড়লেই যে চাকরি করতে হবে তার কী মানে? পড়ার জন্যেই পড়া। আজকাল কত মেয়ে কলেজে পড়ছে।
পিসে বলল, তা সে ফ্যাশানের জন্যে তো টাকা চাই, কলসির জল গড়াতে গড়াতে তো তলায় ঠেকেছে।
মাস্টারমশাই সবিনয়ে বলেছিলেন, ফ্রি-তে পড়ার ব্যবস্থা যদি করতে পারেন তিনি, তা হলে কি
.
পিসেমসাই ছিটকে উঠলেন।
বললেন, ছি ছি, বলো কী মাস্টার? বংশের একটা প্রেসটিজ নেই? দেবেশ মুখুজ্যের মেয়েরা পড়তে যাবে দয়ার ভিখিরি হয়ে?
আমাদের বংশের মর্যাদা সম্পর্কে পিসেমশাইকে কখনও মাথা ঘামাতে দেখিনি। অবাক হলাম।
তবে পিসির ব্যাপারে অবাক হবার কিছু ছিল না। পিসি তাঁর বাপের বংশের মান-মর্যাদা সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। অহরহই ভাইঝিদের শিক্ষা দিতেন, মনে রাখিস কত বড় বংশের মেয়ে আমরা।
কাজেই পিসি যখন বলল, বলল কী প্রফুল্ল, মেয়েরা ধেই ধেই করে কলেজে পড়তে যাবে? বংশের একটা মান-মর্যাদা নেই?তখন আমরা অবাক হলাম না।
শুধু কলেজে পড়ব এমন একটা রোমাঞ্চময় আশা, কেবলমাত্র ছলনা করে গেল, এইটাই বুকে বাজল। পিসি যখন ও পথ দিয়ে গেছে তখন আর আশা বৃথা।
তবুনমিতা নামের দুঃসাহসী মেয়েটা বলে ফেলেছিল, কী হয় পড়লে? কত বড় বড় ঘরের মেয়েরা তো পড়ছে—
প্রফুল্ল মাস্টারও তাড়াতাড়ি বলেছিলেন, হ্যাঁ, আমিও তো তাই বলছিলাম, কত বড় বড় ঘরে আজকাল
পিসি দৃঢ় গলায় বলেছিল, তা হোক। তুমি ও বুদ্ধি ছাড়ো বাবা! বরং বলে রাখি, দুটি সুপাত্রের সন্ধান এনে দাও আমায়! এইবার বিয়ে দিয়ে ফেলে আজন্মের দায় থেকে মুক্ত হই।
প্রফুল্ল মাস্টারের মুখটা অবশ্য আর প্রফুল্ল থাকেনি। কারণ, দিদির উপর বিশেষ একটা উচ্চ ধারণা ছিল তাঁর, হয়তো বা (ডবল বয়েস হওয়া সত্ত্বেও) একটু দুর্বলতা।
পড়লে দিদি যে একটা ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট হবে এ ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন তিনি রেজাল্ট বেরোনোর দিন থেকে বহুবার।
তাই সুপাত্র খোঁজার কথায় মুখটা বেচারার মলিন হল। যদিও সেই দুবুকে পকেট লাগানো খাকি শার্টের সঙ্গে বঙ্গলক্ষ্মী মিলের বেয়াল্লিশ ইঞ্চি ধুতি পরা নিরেটমুখো সেই লোকটার মুখের মলিনতা খুব বেশি রেখাপাত করল না আমার মনে। আমি শুধু অপেক্ষায় রইলাম, কখন একা হব, সুপাত্র খোঁজার ভার পেয়ে মাস্টারমশাইয়ের মুখের রং পরিবর্তন নিয়ে কখন দিদিকে খ্যাপাব।
মাস্টারমশাইকে নিয়ে খ্যাপাতাম আমি দিদিকে।
দিদি অস্বস্তি পেত।
বলত, মাস্টারমশাই না গুরু! গুরুকে নিয়ে ওসব কী ঠাট্টা রে নমু? ছিঃ। ডবল বয়সী উনি আমাদের। আমি হি হি করে হেসে বলতাম, তাতে কী? মাস্টারমশাই তো তোকে দেখতে দেখতে গলে যান।
তা হলে তোকে দেখতেও দিদি ধমক দিতে চেষ্টা করত, দুজনে তো একই রকম দেখতে।
শোনো কথা! দেখতে হলেই হল? তুই হলি প্রথম বিভাগ, আমি তাই?
পিসি আর একবার জোর দিল, হ্যাঁ বাবা, ওই কথাই রইল। অনেক জায়গায় যাওয়া-আসা আছে তোমার, বিদ্যে বুদ্ধি কুলশীল আকার-প্রকার সব দিকে একরকম দুটি পাত্র তুমি দেখবে।
পিসির কথা শুনে মাস্টারমশাইয়ের হয়ে উত্তর দিতে ইচ্ছে হচ্ছিল আমার, তা হলে খুঁজে বার করো তোমার ভাইঝিদের শুভ-জন্মগ্রহণের পাঁচ-সাত বছর আগে তোমাদের সঙ্গে জাতিগোত্র কুলশীল মিলোনো আর কোথায় কোন ভদ্রমহিলা যমজ পুত্র প্রসব করেছিলেন এবং তারা সুস্থ শরীরে জীবিত আছে।
কিন্তু বলা গেল না।
পিসি সেই বাঁচালতা দেখে মূৰ্ছা যেত তা হলে।
প্রফুল্ল মাস্টার তাঁর পাতানো মাতৃদেবীর নির্দেশ অনুযায়ী পাত্র খুঁজতে শুরু করলেন, আর আমরা দুটি যুগলকমল প্রেম-ভালবাসা মিলন-বিরহের স্বপ্ন-সরোবরে ভাসতে লাগলাম।
কিন্তু সুমিতা কি সত্যি ভাসত?
সুমিতার মধ্যে কি সেই আকাঙ্ক্ষার জন্ম হয়েছিল?
বুঝতে পারতাম না।
এক থালায় ভাত খেয়ে, আর এক বিছানায় শুয়েও দিদির হৃদয়-রহস্য ঠিক ধরতে পারতাম না আমি। বুঝতে পারতাম না দিদির মধ্যে যৌবন নামক বস্তুটা উদ্বেল হয়ে উঠেছে কিনা। হঠাৎ এক ঝলক ফাগুনে-হাওয়ায় উতলা হয়ে ওঠে কিনা দিদি, আবেগে আবেশে কারও মুখের পানে চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করে কিনা দিদির, আর রাত্রে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে একখানা চওড়া বুকের মধ্যে আশ্রয় নিতে, তার গলা জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে কিনা তার।
সন্ধ্যাবেলা পিসি যখন রান্নাবান্না সেরে ঠাকুরতলায় পাঠ শুনতে যেত, আর পিসে বৈঠকখানায় দাবায় বসত প্রফুল্ল মাস্টারের সঙ্গে, তখন আমি চয়নিকাখানা খুলে ভোলা গলায় পাঠ করতাম–
হে আমার চির ভক্ত একি সত্য? সবই সত্য?
চির-মন্দার ফুটেছে আমার মাঝে কি?
চরণে আমার বীণা ঝঙ্কার বাজে কি?
নিশির শিশির ঝরে কি আমায় হেরিয়া?
প্রভাত আলোর পুলক আমাকে ঘেরিয়া?
অথবা পাঠ করতাম—
আমার যৌবন স্বপ্নে যেন ছেয়ে গেছে বিশ্বের আকাশ
দিদি তথন দিব্যি ছুঁচ সুতো নিয়ে পিসির ফরমায়েশি সেলাইগুলো পেড়ে বসত। সেলাই না থাকলে সন্ধ্যার আগেই দিদি বলত, পিসি, রোজ হাঁফাহাঁফি করে কষ্ট পাও কেন? যাও না তুমি, রুটিগুলো না হয় আমি সেঁকে রাখব।
এক-আধদিন রেগে বলতাম, এই সুমি মুখপুড়ি, পোড়ারমুখি, ওইসব হতচ্ছাড়া কাজ ভাল লাগে তোর এ সময়?
সুমিতা হেসে বলত, কাজের আবার সময় অসময়। সেরে ফেললেই হয়ে গেল।
বলত।
কিন্তু সেরে ফেলতে দিদি পারত না। দুঘণ্টা লাগত ওর খানকয়েক রুটি সেঁকতে। পিসি পাঠ শুনে এসে দেখত তখনও দিদি রুটি ওলটাচ্ছে। কিছু বা ছিঁড়েছে, কিছু বা পুড়িয়েছে। পিসি দেখে গালে হাত দিত।
নয়তো বলত, পারিস না, করতে আসিস কেন বাছা? যে পারে, সে তো উপর বারান্দা থেকে নামে না।
সেলাইয়েও তথৈবচ।
একটা বালিশের ওয়াড় সেলাই করতে দিদি দিনের পর দিন পাড়ত তুলত।
কোনও কোনও দিন আমি কেড়ে নিয়ে চটপট সেরে দিয়ে তুলে রেখে বলতাম, পড়, পড় একটু প্রেমের কবিতা, এরপর নইলে বরের কাছে ঠকে যাবি
দিদি হাসত। দিদির হাসিটা বড় মিষ্টি ছিল।
বলত, তুই পড়ছিস, শুনছি তো৷।
আমি পড়লেই তোর হবে? আমি খেলে তোর খাওয়া হয়?
দিদি আরও হাসত, যমজের শুনেছি তাও হয়।
তবে শোন,বলে হয়তো আরম্ভ করতাম আমি
তোমারেই যেন ভালবাসিয়াছি শতরূপে শতবার।
যুগে যুগে অনিবার।
দিদি খপ করে বলে বসত–তোর যেন সেই রাম না হতেই রামায়ণ।
রেগে বই মুড়ে বইয়ের কোনাটা ওর মাথায় ঠুকে দিয়ে বলতাম, ওরে মুখ, রাম না হতেই তো রামায়ণ। ঠাকুর এলে বসিয়ে রেখে তবে কি কোথায় চাল কোথায় কলা করে খুঁজে বেড়াতে হয়? আগে থেকে নৈবিদ্যি প্রস্তুত রাখতে হয়।
দিদি মিষ্টি করে হাসত।
দিদির মুখটা তখন একটু বুদ্ধি বুদ্ধি দেখাত। ওই মুখটাই যে আরশিতে দেখি আমি, তা মনে হত না।
দিদি বলত, রাখ প্রস্তুত করে। তারপর অসাবধানে কোন ফাঁকে কুকুর-শেয়ালে মুখ দিয়ে যাক।
ওরে সর্বনাশ! আমি লাফিয়ে উঠে বলতাম, এই ভয়ে তুই মনের দরজায় তালা-চাবি লাগিয়ে বসে আছিস? যৌবনকে রুপোর কাঠি ছুঁইয়ে রেখে দিয়েছিস?
দিদি বলত, ভারী অসভ্য হয়ে যাচ্ছিস তুই।
তা হয়তো সত্যি।
আমাদের আমলের সভ্যতা ভব্যতার মাপকাঠিতে আমি হয়তো একটু অসভ্যই ছিলাম। শান্ত মিনমিনে ভাল মেয়ে জীবটা আমার অসহ্য ছিল বলেই হয়তো এই অসভ্যতা।
তা ছাড়া পিসির সংসারের ওই ছকে বাঁধা স্তিমিত ছন্দে আমাকে যেন আর আঁটছিল না। আমার জীবন-তরণী সাগরে ভাসাবার উদ্দাম আকাঙ্ক্ষায় ছটফট করছিল।…
কিন্তু আমি পিছিয়ে পড়লাম।
সাগরের টিকিট আমার জুটল না চট করে। এক ঘণ্টার সিনিয়রিটির দাবিতে দিদি সে টিকিট পেয়ে গেল, বিনা তদ্বিরে, বিনা আকুলতায়।
দিদিকে অবজ্ঞাই করে এসেছি চিরকাল, এই প্রথম হিংসে করলাম।
কিন্তু শুধুই করলাম?
না, করতে শুরু করলাম?
প্রফুল্ল মাস্টারই এনেছিলেন সুপাত্রের সন্ধান। কিন্তু একজোড়া নয়, একটা।
পিসি বলল, আমি তো দুটোকেই এক রাত্তিরে পার করতে চাই বাবা প্রফুল্ল।
মাস্টারমশাই বললেন, চাই বললেই কি সব সময় পাওয়া যায় মা? এটিকে বসিয়ে রেখে অন্য পাত্র খুঁজতে গেলে, এরা কি বসে থাকবে? অন্যত্র বিয়ে দিয়ে ফেলবে ছেলের।… একজনেরই লাগিয়ে দিন। একই দিনে জন্মেছে বলে যে একই রাত্রে বিয়ে হতে হবে তার কী মানে? দুদিনের নেমন্তন্নটা বা ছাড়ব কেন আমরা?
তারপর একটু দুষ্টুমি বুদ্ধি খেলেছিলেন মাস্টারমশাই। বলেছিলেন, ওদের তো আর ছোট বড় বলে
কিছু নেই? যাকে হোক লাগিয়ে দেবেন।
সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় নেড়েছিল পিসি, উঁহু, ছোট-বড় আছে বইকী! এক ঘণ্টার বড়ও বড়। নমুকে আমি সুমিকে দিদি বলতে শিখিয়েছি, দেখনি? দিদির বিয়েই আগে হবে।
.
পিসি বলেছিল, মেয়েদুটোর মা নেই, বাপ নেই। মা বাপওলা ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেব।
তা পিসির প্রতিজ্ঞাপূরণ হলেও সাধ মিটল না।
পাত্রের মা বাপ আছে, কিন্তু থেকেও নেই।
বৃন্দাবনে গুরু-আশ্রমে থাকেন তাঁরা। অবিশ্যি ছেলেটাকে মানুষ করে রেখে গেছেন। চাকরি-বাকরি করে, কাকার বাড়ি থাকে। বিদেশে বদলি হবার আশা আছে।
শুনে পিসির পছন্দ হয়নি।
বলেছিল, ও আর কী-ভাল পাত্তর আনলে তুমি প্রফুল্ল?
আমি আড়ালে হেসে বললাম, এই খুঁত বর নিয়ে আসার পিছনে মাস্টারমশাইয়ের কোন মনস্তত্ত্ব কাজ করছে বুঝতে পারছিস দিদি?
দিদি সব দিনের মতোই বলল, দূর অসভ্য!
কিন্তু মাস্টারমশাইয়ের প্যাঁচ কাজে লাগল না। পাত্র সম্পর্কে আগে যতই নাক উঁচু করুক পিসি, দেখে একেবারে বিমোহিত হয়ে গেল।
দেখতে আসবে বলেছিল, না করলে মাস্টারমশাই অপদস্থ হবেন ভেবে রাজি হয়েছিল পিসি। বলেছিল, পরে ঠিকুজি কুষ্টির অমিল তুলে ভেঙে দেব। মা বাপ বৃন্দাবনবাসী, ও আবার কী সংসার।
কিন্তু দেখে ওই যা বললাম–মোহিত।
কনে দেখতে পাত্র নিজেই এসেছিল কিনা! পাত্র, আর তার বন্ধু।
দীর্ঘসুন্দর দেহ স্বাস্থ্যে উজ্জ্বল, আর চুল থেকে নখ পর্যন্ত যেন প্রাণের দীপ্তিতে ঝকমক করছে। কথা ধারালো, হাসি সুন্দর। কে বলবে বৃন্দাবনবাসী মা বাপের ছেলে। হয়তো বা এ একরকম প্রতিক্রিয়া।
যাই হোক, পাত্র দেখেই পিসি জামাই বলতে শুরু করল। আর রূপ-গুণের কথা বলতে বলতে গলে গেল।…
বয়েস থাকলে নিজেই বোধ করি প্রেমে পড়ে যেত পিসি।
চালাকি কাজে লাগেনি, তবু শেষ চালাকি করেছিলেন মাস্টারমশাই। বলেছিলেন, একটা মজা করুন না মা! দুজনকে একরকম সাজিয়ে রেখে দিন। পরে নমিতাকে দিয়ে চা দেয়াবেন, খুব ধাঁধায় পড়ে যাবে।
পিসি এ মজাটায় মজা পেয়েছিল।
বলেছিল, তা মন্দ বলোনি বাবা! তা ছাড়া বড় জামাইকে দেখিয়ে বলেও রাখি যদি ওর বন্ধু বা আত্মীয়ের মধ্যে কোনও পাত্তর থাকে। দুটি বোন জোড়ের পাখি, কাছাকাছি থাকতে পেলে বাঁচবে।
এ প্রস্তাব আমার কাছে অপমানকর। আমি এ প্রস্তাবে রাজি হব না ভেবেছিলাম।
এক ঘণ্টার দাবিতে দিদি টিকিট পেয়ে গিয়েছিল বলে রাগে হাড় জ্বলে যাচ্ছিল আমার। তবু রাজি হয়ে গেলাম। একটা বিবাহযোগ্য পুরুষের সামনে বেরোবার সুযোগ পেয়ে, সে লোভ ছাড়তে পারলাম না।
দুজনের এক সাজের অভাব ছিল না।
প্রত্যেক সময় একই সাজপোশাক হত আমাদের। আশৈশব।
সেই বছরেই পুজোর সময় দুজনেরই টুকটুকে লাল ভয়েলের শাড়ি হয়েছিল, বড় বড় সাদা রেশমের ফুল দেওয়া। দিদিকে তাই পরিয়ে কনে দেখানো হল।
মাথা নিচু করে বসে থাকল দিদি। কথার উত্তর না ই দিয়ে সারল। চা, জলখাবার দেবার সময় আমিও এলাম সেই সাজে, দিব্য সপ্রতিভ ভঙ্গিতে। ২৫৮
বলা বাহুল্য, ওরা প্রায় হোঁচট খেল। কনের একটি যমজ বোন আছে, এ কথা তাদের বলা হয়নি। কাজেই বিভ্রান্ত না হয়ে করবে কী? পিসেমশাই কনে দেখানোরূপ গুরুতর কর্তব্য সেরে দিয়েই কেটে পড়েছিলেন। মাস্টারমশাইয়ের উপর ছিল বাকি ভার।
মাস্টারমশাই জলখাবার প্লেট নিয়ে এলেন, আমি চা।
ওরা অবশ্যই এমন দেখেনি।
কেই বা দেখেছে, ঘাড় হেঁট করে কনে দেখা দেখিয়ে, সে মেয়ে তক্ষুনি বীরদর্পে আবার এসে ঘরে ঢোকে আতিথ্য করতে!
অতএব ওরা প্রায় হোঁচট খেল।
বন্ধুটি বলল, আঃ, আপনি আবার কেন কষ্ট করে—
আমি তো প্রস্তুত হয়েই গেছি।
চটপট উত্তর দিলাম, তাতে কী? আপনারা এত কষ্ট করে সেই কতদূর থেকে এসেছেন।
বর চমকে তাকাল।
তারপর মৃদু হেসে বলল, আপনার পিসেমশাইকে খুব ভয় করেন, তাই না?
মাস্টারমশাই একটু তাড়াতাড়ি বললেন, তা করে।
বোঝাই যাচ্ছে, ঠকেছে। তবু সেটা আরও দৃঢ় করলেন মাস্টারমশাই। পিসের উপস্থিতির জন্যেই যে তখন এগজামিনে কোন সাবজেক্ট ছিল তাই বলতেই গলা বসে যাচ্ছিল, এবং তাঁর অনুপস্থিতিতেই গলা খুলল, সেটা ধরে নিয়ে বরই বলে বসল, পিসেমশাইকে খুব ভয় করেন বুঝি?
মাস্টারমশাই বললেন, তা করে।
বর আবার বলল, আমি তো তখন সত্যি বলতে মুহ্যমান হয়ে পড়েছিলাম। ফার্স্ট ডিভিশনে পাস করা মেয়ে, অথচ নাম জিজ্ঞেস করলে ঘাম ছোটে–
আমি খোলা গলায় বললাম, কে বললে ফাস্ট ডিভিশন? মোটেই না। ওটা মাস্টারমশাইয়ের চালাকি। আমি মোটেই ফার্স্ট ডিভিশন নই।
ওরা অবশ্য ঠাট্টা ভাবল।
আবার বলল, যাক ওটা না হলেও ক্ষতি নেই, আপাতত তো লেটার পেয়ে পাস।
আমিও আবার বললাম, পাস-ফেলের ব্যাপার তো মিটে গেছে আগে। এখন আর এটা পরীক্ষার হল নয়, আর আমিও পরীক্ষার্থী নই, এসেছি আতিথ্য করতে। খাবারগুলো গরম আছে, ঠাণ্ডা করবেন না।
বন্ধুটি বলে উঠল, এখন আর ওঁর ঠাণ্ডা-গরমে কোনও প্রভেদ নেই।
বাচালতা করব স্থির করেই গেছি, বিয়েটা পণ্ড হলেই যেন মঙ্গল, এই মনোভাব, মাস্টারমশাইও তার সমর্থক। কাজেই বলে উঠলাম, হঠাৎ অবস্থা এমন শোচনীয় হল যে? শীত-গ্রীষ্ম, শীতল-উষ্ণে প্রভেদ নেই।
অবস্থা শোচনীয় হবার জন্যে আপনিই দায়ী,বললে বর, তখন যেন উৎসাহে বরফ জল ঢাললেন, আর এখন
এখন গরম জল, চা। বললাম হেসে হেসে, তা ছাড়া পিসিমা আরও এক থালা পুলি গড়ে নিয়ে ভাজছেন, আপনাদের গরম খাওয়াবেন বলে।
বন্ধুটি বলে উঠল, ইস। বিয়ে কাজটা আগেই ঘটিয়ে বসে আছি বলে আফশোস হচ্ছে। এ বাড়ির জামাই হলে, অন্তত গরম গরম পিঠে-পুলিটা জুটত ভাল৷
আমি বললাম, তা আফশোস জিনিসটা কি ফুরিয়ে যাবার? হয়তো ওটা আপনার বন্ধুর ভাগ্যে তোলা থাকল। বাকি জীবনটা উনিই করতে পারবেন ওটা।
ঠাট্টা জিনিসটাও নাকি ভয়ংকর।
প্রতিকূল গ্রহনক্ষত্ররা নাকি অদৃশ্যলোকে বসে মানুষের উচ্চারিত শব্দের উপর তথাস্তু করে। বলে, ঠিক আছে, যা বলেছিস তাই হবে। তথাস্তু।
হয়তো আমার সেই ঠাট্টার সময় ওই তথাস্তু গ্রহ বসেছিল।
কিন্তু তখন তাকে দেখা গেল না।
তখন মনে হল সমস্ত গ্রহই অনুকূল।
.
পিসি আহ্লাদের সাগরে ভাসছিল। পিসে আসতেই বলে উঠল, কথা দিয়ে গেল।
পিসেমশাই বললেন, যাবে না মানে? শালার মেয়েরা কি ফেলনা? বলি খাঁই-টাই কী রকম বুঝলে?
পিসি বলল, শোনো কথা। খাঁইয়ের তো নামগন্ধ নেই। মা বাপ দেখবে না, ছেলে কি নিজে খাঁই করতে বসবে? কিছু নেবে না।
পিসে বলল, নেবে মানে? কত বড় কুলিনের ঘরে বিয়ে করতে ঢুকবে, তা জানো?
পিসি বলল, জানব না কেন? তুমি যত বড় ঘরে ঢুকেছিলে!
রেগে বলল না, হেসে।
বাড়িতে হালকা-হাসির হাওয়া উঠছে। মাস্টারমশাইও চলে গেছেন হাসি দেখিয়েই। দেখিয়েছেন পিসিকে।
আমিও দেখাচ্ছি হাসি। হি হি করে হেসে হেসে বলছি, কীরে দিদি, লাগল কেমন?
দিদি বলল, আমার থেকে তুই বেশিক্ষণ দেখেছিস, তুই-ই বল।
আমার বলায় লাভ? বেল পাকলে কাকের কী?
দিদি হঠাৎ একটা খাঁটি কথা বলল। হঠাৎ এই রকম এক-একটা খাঁটি কথা বলে ফেলত দিদি। অবাক লাগত। মনে হত দিদি কি সত্যি বোকা? না ওটা ওর ছলনা?
দিদি বলল, তা বটে, তবে কাক বেচারিই বেলটা পাকাল এই যা দুঃখ।
তার মানে?
মানে, তুই গিয়ে খই না ফোঁটালে, পাত্র পত্রপাঠ প্রস্থান করত।
যে কথা আমি ভাবছিলাম, সেই কথা দিদি বলল।
আমাকে অতএব বিনয় করতে হল।
বললাম, তোর বুঝি বিশ্বাস ওরা ধরতে পারেনি? মাথা খারাপ! মাস্টারমশাই বলেননি ভেবেছিস? ও বাবা ফাস্ট ডিভিশনেই মোহিত।
দিদি শুধু একটু হাসল। অবিশ্বাসের হাসি।
বললাম, বাজি ফেল। বল ও ধরতে পেরেছে, না আমাকেই তুই ভেবেছে?
দিদি বলল, বাজিটার হারজিত প্রমাণ হবে কী করে?
জিজ্ঞেস করে জেনে নেব।
জিজ্ঞেস করে জেনে নিবি? কাকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিবি তুই? বিমূঢ়ের মতো বলল দিদি।
কেন, তোর ভাবী বরকে? আমি একটা চিঠি লিখলে রাগ হবে তোর? দিদি আমার হাত চেপে ধরল। বলল, বাজে বাজে পাগলামি করিসনে নমু! কোথায় কী তার ঠিক নেই, রাস্তার একটা লোককে তুই চিঠি লিখতে যাবি? বাজিতে আমিই হারছি বাবা! হল তো?
এই স্বভাব দিদির।
যুদ্ধের আগেই হার মানা।
তখন ভাবতাম দিদিটা ভীরু।
এখন অন্য কথা ভাবি। ভাবি, জেতার জন্যে লড়ালড়ি না করে হার মানার খাতায় নাম লেখানো শক্তিহীনতার চিহ্ন, না শক্তির চিহ্ন?
দিদির মধ্যে যে শক্তি ছিল, সেটা এতই সহজভাবে সংহত ছিল যে, দেখতে পাওয়া যেত না। সেটা যেন সমুদ্রের মতো গভীর। আমি যে শক্তির বড়াই করেছি, সেটা সমুদ্রের উপরের ঢেউ।
দিদি বাজিতে হার মানার খাতায় স্বাক্ষর দিয়েছিল, কিন্তু দিদিই জিতল।
বাসরে বসে বর স্বীকার করল, সে আমাকেই দিদি ভেবেছিল, এবং দুবার দুরকম প্রকৃতি দেখে গোলকধাঁধায় ঘুরে মরেছিল, তবু ভাবতে পারেনি একজোড়া শাড়ির মতো অবিকল একজোড়া মেয়ে আছে এদের বাড়িতে।
দিদি বাসরে কথা বলেনি, আমিই চালিয়ে গেছি আলাপ।
বললাম, গোলকধাঁধায় পড়েও তো ভয় খেয়ে পালালেন না, সম্মতি দিয়ে গেলেন।
বর বলল, ভয় বস্তুটা নেই আমার। বরং ভয়ের প্রতিই আকর্ষণ।
তবু ঠকেছেন, এটা মানছেন তো?
বর হেসে বলল, উঁহু, মানছিনা। রীতিমত লাভবানই হয়েছি। একটির বদলে দুটি পেলাম, স্ত্রীর সঙ্গে শালি! ফাউ জিনিসটা লোভনীয়। তা ছাড়া শাস্ত্রে বলেছে, শান্ত স্ত্রী আর মুখরা শালি এটাই পরম সুখের।
এ শাস্ত্র কে আপনাকে শেখাল শুনি?
সব শাস্ত্র শিক্ষা করতে হয় না, কিছু শাস্ত্র বাতাসে ফেরে। ধরো প্রেমশাস্ত্র।
রাগ দেখিয়ে বললাম, ও শাস্ত্রটা বেশ ভালমতো শিখে ফেলেছেন বুঝি আগে থেকেই?
দিদি আমায় চিমটি কেটে থামাল।
এইভাবে দিদির বাসর কাটল।
বিয়ের কদিন পর দিদিকে নিয়ে জামাইবাবু তার মা বাপকে দেখাতে বৃন্দাবন যাবার ঠিক করল।
আমার মনে হল দিব্যি একখানা হনিমুন বাগাল দিদি! আর একবার ঈর্ষা অনুভব করলাম। অথচ জীবনে এই প্রথম দিদির সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হবার মুহূর্তে ভয়ানক একটা মন-কেমনের যন্ত্রণা বোধ করতে লাগলাম। দিদি তো কেঁদে কেঁদে মুখ ফুলিয়েই ফেলল। একবার পিসির কাছে আবেদন করেছিল দিদি আমায় নিয়ে যাবার জন্যে, কিন্তু পিসি মারতে এল। বলল, এমন কথা বাবার কালে শুনিনি। তুই যাচ্ছিস তোর বরের সঙ্গে শ্বশুরবাড়ি, ও অত বড় মেয়ে তোর সঙ্গে যাবে কোন সুবাদে?
আমার যাওয়া হল না।
জীবনে এই প্রথম দিদির সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হল আমার। বিয়ের পর এ কদিন দিদি তো প্রায় আমাদের বাড়িতেই ছিল, সঙ্গে জামাইবাবুও। কারণ ওর কাকার বাড়িতে আলাদা ঘর নেই।
মাস্টারমশাইকে একখানা বাসা খুঁজে রাখবার অনুরোধ জানিয়ে জামাইবাবুরা গাড়িতে উঠল।
দিদি জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে আমায় দেখছিল, আর কাঁদছিল, আমারও চোখ শুকনো ছিল না। তবু যেই ওদের গাড়ি বেরিয়ে গেল, আমার মনে হল, দিদির ওটা লোক-দেখানো ন্যাকামি। যাচ্ছেন বরের সঙ্গে নাচতে নাচতে রেলগাড়ি চড়ে বেড়াতে, শুনছি নাকি ফেরার সময় দিল্লি-আগ্রা দেখে আসবে, এর মাঝখানে কিনা বোনের জন্যে অশ্রু বিসর্জন করছেন! সব বাজে। দেখানো- দেখো দেখো, আমি কত মহৎ, কত ভাল! দিদির প্রতি এই এক অদ্ভুত ভাব ছিল আমার। প্রবল ভালবাসা, অথচ তীব্র ঈর্ষা। আমার এই মনস্তত্ত্বের তত্ত্ব বুঝতে পারিনি আমি কোনও দিন।
একাধারে দিদি আমায় টেনেছে আর ঠেলেছে।
এ কি আমরা যমজ বলে?
কিন্তু দিদির ক্ষেত্রেও তো তা হলে একই হবে।
অথচ তা হয় না।
দিদি আমার প্রতি স্নেহে বিগলিত। দিদিও যদি আমাকে হিংসে করত, হয়তো ভাল হত আমার। সর্বদা দিদিকে উচ্চস্তরের আর নিজেকে নিম্নস্তরের ভাবার গ্লানি এমন রূঢ় যন্ত্রণা দিত না আমায়।
.
দিদি হিংসের কথা ভাবতেই পারে না।
আর কেনই বা করবে?
দিদি তো অবিরত জিতেই চলেছে। আমার সব কর্মে পটুত্ব এবং দিদির সব বিষয়ে অপটুত্ব থাকা সত্ত্বেও চিরদিন পিসি থেকে শুরু করে আত্মীয়স্বজন, পাড়াপড়শি সবাই দিদিকে প্রশংসা করেছে, দিদিকে বেশি ভালবেসেছে।
কারণ?
কারণ দিদি শান্ত, দিদি নম্র, দিদি সকলের মনজোগানী।
ওইগুলো যে দিদির সহজাত, এটা যেন সব সময় বিশ্বাস হত না আমার, মনে হত সুখ্যাতির আশায় ও রকম নরম হয়ে থাকে দিদি। কিন্তু ভাবলে আর কি, জিতে তো যেত দিদি।
পরীক্ষাতেও দিদিই জিতল।
রাতদিন বই নিয়ে বসে থেকে থেকে সিদ্ধিলাভ করল। ওটা আমার অসহ্য। তা ছাড়া আমি ভেবেছিলাম দু-পাঁচদিন পড়েই মেরে নেব আমি, দিদির সারা বছরের খাটুনির ফসলের থেকে, ওই পাঁচদিনের খাটুনিতেই ভাল ফসল ঘরে তুলব। হল না।
মাস্টারমশাইয়ের মতো নির্বোধ একটা বুড়োর বিহ্বল দৃষ্টি আমার কাছে হাস্যকর, তবু দিদির প্রতি ওঁর ওই দৃষ্টি আমাকে বেজার করত।
তারপর তো বিয়ে হয়ে জিতে গেল দিদি।
ওর মনের মধ্যে বিয়ের জন্যে চাহিদার সৃষ্টি হয়নি, তবু দিব্যি একখানা বর পেয়ে গেল ও। এক ঘণ্টার বড়র দাবিতে এই পাওয়া যেন নির্লজ্জতার মতো মনে হল আমার।
তাও বরটা কেন বোকা-হাঁদা বুদ্ধ হল না? কেন কালোকোলো মোটা বেঁটে হল না?
না, দিদির প্রতি শত্রুতার মনোভাব নিয়ে এ কথা বলছিনা আমি। শুধু বলছিলাম দিদি যা মেয়ে, যে কোনও রকম বরকেই মেনে নিত ও। ওর লোকসান হত না কিছু।
তাই ভেবেছি তখন।
ভেবেছি দিদিকে আমি পুরোপুরি পাঠ করে ফেলেছি, এবং বুঝে নিয়েছি, সব রকম অবস্থাকে মেনে নিতে পারত ও
কত ভুলই ভাবি আমরা মানুষের সম্পর্কে!
দিদির বিয়েটা আমার কাছে কিঞ্চিৎ জ্বালাস্বরূপ হলেও, উন্মাদনা-আমোদও ছিল বইকী! বিয়ের বারো-চোদ্দ দিন তো এখানেই প্রায় থেকেছে ওরা। পিসির সংসারের এই স্তিমিত ছন্দের উপর এ যেন একটা উত্তাল ঝড়, অন্ধকার অন্তঃপুরে আলোর বন্যা।
সর্বদা এক স্ফুর্তিবাজ এবং প্রায় বেপরোয়া যুবকপুরুষের সান্নিধ্য আমাকে যেন নেশাচ্ছন্ন করে রেখেছিল।
জামাইবাবুর ওই বেপরোয়া ভঙ্গি অবশ্য পিসি ততটা দেখতে পেত না; পিসি জামাই-আদরের রসদ গোছাতেই ব্যস্ত থাকত।
আর পিসিরও মেয়েলি মনের জামাই বুভুক্ষা পরিতৃপ্ত হচ্ছিল। তা ছাড়া লোকের কাছে তো গল্প করতে হবে পিসিকে। পিসির এক মাসতুতো বোন আসত প্রায়ই, পিসির প্রাণের পুতুল। তাকে সব বলা চাই। আর বেশি করেই বলা চাই।
জামাইকে যে পিসি যথার্থ জামাই-আদর করছে সে গল্প করার জন্যেও আরও এত যত্ন পিসির।
পিসি নীচের তলায় সারাক্ষণ, আমরা দোতলায়। জামাইবাবু বিয়ে বাবদ যে ছুটি নিয়েছিল তার জের চলছিল, তাই সর্বদাই আছে বাড়িতে।
জামাইবাবু বলত, যদি সেকাল হত, এবং আমি একজন রাজা হতাম, তোমাদের দুজনকেই রানি করে ফেলতাম।
দিদি ইতিমধ্যেই ওর বরে একেবারে নিমগ্ন হয়ে গিয়েছিল। বরকে দেখতে দেখতে বিভোর হয়ে যেত, কিন্তু কথা বেশি বলতে পারত না। ও রকম কথায় বড়জোর বলত, তা হলে অবশ্যই একজন দুয়োরানি হত, আর আমারই দুয়োরানি হবার চান্স থাকত বেশি।
জামাইবাবু হেসে উঠে বলত, কেন? হঠাৎ এহেন সন্দেহের হেতু?
বাঃ, আমি যে বড়। বড়রানিরাই তো দুয়োরানি হয়।
দিদি কি তার অসতর্ক উক্তিকে ওইভাবে আবার ঢেকে নিত? না দিদির সরল বিশ্বাসী মন ওই ভাবেই ভাবত?
জামাইবাবু ও কথা হেসে ওড়াত। আচমকা আমাদের দুজনকে দুহাতে জাপটে ধরে বলে উঠত, আমার কাছে দুয়োর পাট নেই। দুজনেই সুয়ো৷ ২৬২
কৌতুকছলে হলেও ওই নিবিড় পুরুষ-স্পর্শ নিথর করে দিত আমাকে। মনে হত এই মুহূর্তটুকু চিরকালের মতো স্তব্ধ হয়ে থাক, ডুবে যাক বিশ্ব চরাচর। কিন্তু সেই মনে হওয়াটাকে সবলে বিসর্জন দিয়ে হাত পা ছুঁড়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলতাম, দিদি না হয় আপনার বউ, যা ইচ্ছে করতে পারেন। আমায় কেন?
জামাইবাবু বলত, দিদি বউ, তুমি মৌ। আরও মিষ্টি।
আমি অবাক হয়ে ভেবেছি, দিদি কেন রাগ করত না। আমি হলে নির্ঘাত রেগে-জ্বলে কুরুক্ষেত্র করতাম। দিদি কি এত বেশি পেয়ে গিয়েছিল যে, ওই উপচে পড়া ফেনাটুকুতে দৃকপাত করত না? না কি এ ওর সেই ছেলেবেলার মনোভাব। একটা খেলনা কি একটা পুতুল পেলে যেমন বিনা দ্বিধায় আমাকেই সেটা দিয়ে দিত দিদি, এও তাই?
তা সত্যি বলতে, রাতটুকু বাদ দিলে দিনের সময়ের অধিকাংশ আমিই দখল করে রাখতাম জামাইবাবুকে। গল্পে তর্কে গানে আবৃত্তিতে আমাদের দুজনের জমজমাটি আসরে দিদি যেন দর্শকমাত্র, শ্রোতামাত্র। অথচ দিদির মুখ আহ্লাদে জ্বলজ্বল করত, দিদির চোখ খুশিতে উদ্ভাসিত থাকত।
এটাও আমার কাছে অপমানকর ছিল বইকী!
এতে যেন দিদি আমার স্তর থেকে অনেকটা উচ্চস্তরে উঠে যেত। মনে হত দিদি তার অগাধ ঐশ্বর্যের এক কণা আমায় উপহার দিয়ে আত্মতৃপ্তির সুখ উপভোগ করছে।
আর রাত্রে যখন দিদি আস্তে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে নিঃশব্দে খিলটা লাগিয়ে দিত, আমি ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে সেই দিকে তাকিয়ে থেকে ভাবতাম, কাল থেকে আর দিদির ওই কৃপার উপহারটুকু নিয়ে কৃতার্থ হব না আমি। জামাইবাবুকে অবজ্ঞা করব অগ্রাহ্য করব, কথার উত্তরে উছলে উঠব না। নিজের আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত থাকব। বহুক্ষণ ঘুম আসত না, ওই প্রতিজ্ঞাটাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতাম, দেখতে চেষ্টা করতাম তার প্রতিক্রিয়া।
কিন্তু সকাল হতেই যেই জামাইবাবু তার দীর্ঘ বলিষ্ঠ অপরূপ আকর্ষণীয় চেহারাটি নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেই বলে উঠত, শালির নিদ্রাভঙ্গ হয়েছে? তখন চুপ করে থাকতে পারতাম না। উছলে উঠেই বলে উঠতাম, হবে না কেন? আমার তোে অর্ধরাত অবধি জাগরণের পালা ছিল না।
জামাইবাবু হেসে উঠে বলত, নাঃ, একটা ভায়রাভাই জোগাড় করে না ফেলা পর্যন্ত শান্তি নেই।
তীক্ষ্ণ হতাম আমি, আপনার অশান্তিটা কী?
বাঃ, নেই? একজন তৃষিতের সামনে বসে শীতল পানীয় পান করায় বিবেকের একটা দংশন নেই? আবার কথায় কথা বাড়ত, তর্ক জমত, ঝগড়া রাগারাগি সব কিছুর পালা চলত। সকালবেলাটা একছত্র অধিকার থাকত আমার। কারণ, দিদি সে সময়টা কিছুতেই দোতলায় বসে থাকত না, পিসির সাহায্যার্থে নীচে নেমে যেত, রান্নাঘরে বসে থাকত।
রেগে বলতাম, দিদি, পিসি তো একাই একশো! তুই আর সমুদ্রে শিশির বিন্দু ঢালতে যাস কী জন্যে?
দিদি বলত, তা হোক, শিশির বিন্দুরও একটা কর্তব্য আছে।
সে কর্তব্য এ ভদ্রলোকের উপরও থাকা উচিত। পিসির কাছে দু ঘণ্টা বসে থেকে তুই হয়তো পিসির দুটি শাক বেছে দিবি, কি চারটি কড়াইশুটি ছাড়িয়ে দিবি, কী বা লাভ হবে তাতে পিসির? অথচ এখানে তুই থাকা মানেই জামাইবাবুকে শীতলতার সাগরে ডুবিয়ে রাখা!
এখানে তো তুই আছিস, দিদি হেসে উঠত। বলত, তুইও একাই একশো!
রেগে বলতাম, অত বিশ্বাস করিসনি দিদি, ইচ্ছে করলে তোর বরকে কেড়ে নিতে পারি তা জানিস?
দিদি সেই অদ্ভুত মিষ্টি হাসিটা হাসত তখন। বলত, যে জিনিস কেউ ইচ্ছে করলে কেড়ে নিতে পারে, সে জিনিস থাকা না থাকায় তফাত?
চমৎকার! তোর গায়ের গয়নাগুলো রাস্তায় ফেলে রাখ তা হলে?
তা কেন? ওগুলো তো জড়বস্তু। ওর কি নিজস্ব সত্তা আছে?
ওসব পণ্ডিতি কথা রাখ। কখন কী হয় কে বলতে পারে?
তা না হয় পারে না,–দিদি হাসত, তোরই বা হঠাৎ অন্যের বর কেড়ে নেবার ইচ্ছে হবে কেন? তুই কি যে-সে?
আমি সামলে নিতাম নিজেকে।
ব্যাপারটাকে স্রেফ তরল ঠাট্টার খাতে গড়িয়ে দিতাম। বলতাম, তা হাতের কাছে নিজের বর পাচ্ছি না যখন।
ওরা দুজনেই হেসে উঠত।
রাতারাতি ওর একটা বর জোগাড় করো দিকি, বলে দিদি বরের দিকে চেয়ে হাসতে হাসতে চলে যেত।
আমি চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতাম, সেই যাচ্ছিস তো শাক বাছতে? মরগে যা! আমরা এখন রবীন্দ্রকাব্য-পাঠ সভা বসাচ্ছি।
দিদি অনুচ্চ পরিষ্কার গলায় উত্তর দিয়ে যেত, বসাস ক্ষতি নেই, বেশি গলা খুলিসনে। পিসেমশাইয়ের কানে না পৌঁছলেই ভাল।
আমি অতঃপর বাবার বইয়ের আলমারির চাবি খুলতাম।
এ ছাড়া অনেকক্ষণ ধরে নিজেকে এখানে বসিয়ে রাখবার যুক্তিই বা কী? শুধু দুজনে গল্প?
বেশিক্ষণ জমে না।
কথা খুঁজে পাওয়া যায় না।
অথচ দিদি যতক্ষণ থাকে দুজনেরই মুখে খই ফোটে।
জামাইবাবু বলত, তোমার বাবার এই বইয়ের আলমারিগুলো দেখলে মন খারাপ হয়ে যায়। ভদ্রলোক হয়তো সব পড়েও যেতে পারেননি।
আমি আবহাওয়া গম্ভীর করতে রাজি হতাম না। বলতাম, তা পৃথিবীর নিয়মই এই, ধনবানে কেনে বই, জ্ঞানবানে পড়ে।
তবে পড়ুন জ্ঞানবতী মহিলা!
আমি দু-একখানা বই নিয়ে পাতা ওলটাবার ভান করতাম। অথচ আমি জানতাম কী পড়ব আমি। প্রেমের কবিতাই বেছে বেছে পড়তাম।
একদিন নারীর উক্তি পড়ছিলাম চয়নিকা থেকে। লজ্জার বালাই রাখিনি আমি, বেশ খোলা গলায় পড়েছিলাম–
আমি কি চেয়েছি পায়ে ধরে,
ওই তব আঁখি তুলে চাওয়া,
ওই কথা, ওই হাসি, ওই কাছে।
আসা-আসি।
অলক দুলায়ে দিয়ে হেসে চলে
যাওয়া?
কেন আন বসন্তনিশীথে আঁখিভরা আবেশ বিহ্বল—
হঠাৎ দিদি দোতলায় এল। এমন আসে না কোনওদিন।
আমার সহসা মনে হল দিদি আমাদের উপর আচমকা ইনস্পেকশন চালাতে এসেছে। কেঁপে উঠলাম যেন। নিজেকে অপরাধী অপরাধী মনে হল। তাড়াতাড়ি বললাম, এই দেখ দিদি, তোর হয়ে নারীর উক্তি শুনিয়ে দিচ্ছি জামাইবাবুকে।
দিদি একটা ড্রয়ার খুলছিল। অবাক হয়ে বলল, কী বলছিস?
বলছি তোর কথাটা আমিই শোনাচ্ছি
দিদি হেসে বলল, আমার আবার কথা কি?
তোর কোনও কথা নেই?
কই, মনে পড়ছে না তো!
আমি সামলে উঠলাম। বললাম, তবে এসেছিলি কী করতে মরতে রসভঙ্গ করতে?
দিদি হেসে বলল, তোদের রসভঙ্গ করি, এ উদ্দেশ্য নিয়ে আসিনি বাপু। পিসিমা নিমকি কাটবার জন্যে একটা পাতলা ছুরি চাইলেন–
ড্রয়ার থেকে পাতলা ছুরিখানা নিয়ে চলে গেল দিদি তাড়াতাড়ি।
জামাইবাবু চেঁচিয়ে বললেন, ওহে মহিলা, ছুরিখানি এই হতভাগ্যের বক্ষে বিদ্ধ করে গেলেই ভাল হত না?
দিদি একটু দাঁড়িয়ে মুখ ফিরিয়ে হেসে বলে গেল, তোমাদের জমজমাটি আসরের উপর তো ছুরিকাঘাত করেই গেলাম!
আমি বই মুড়ে ফেললাম।
দিদি চলে যাবার পর সত্যিই আর পাঠ জমল না।
আমি বইটা ঠেলে রেখে বলে ফেললাম, ছুরিটা ছুতো।
জামাইবাবু চমকে বললেন, কী বললে?
বলছি, দিদি ছুরির ছলে আমাদের উপর চোখ ফেলতে এসেছিল।
এরকম কথা আমি কোনওদিন বলিনি।
সেদিন ইচ্ছে করে বললাম।
আমি যেন কিছু একটা উদঘাটিত করতে চাইছিলাম। এই ধরনের প্রসঙ্গ এনে ফেলে ভয়ংকর খাদের পথে পা বাড়াতে চাইছিলাম।
কিন্তু জামাইবাবু যেন আমার গালে একটা চড় মারল।
জামাইবাবু বলল, তোমার দিদি স্বর্গের দেবী নমিতা! ও জিনিস ও ভাবতেই পারে না।
ঘরে এসে সত্যিই নিজের গালে নিজে চড় মারলাম আমি। আর ভাবলাম আর নয়, আর নয়।
কিন্তু ওর সঙ্গে কথা না কয়ে থাকতে পারি না কেন?
.
সর্বদা ওর আশেপাশেই ঘুরতে ইচ্ছে করে কেন?
একদিন পিসি বলেছিল, হ্যাঁ রে নমি, তুই সর্বদা প্রিয়মাধবের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরিস কেন বল তো? বড় হয়েছিস!
আমি কড়া গলায় বললাম, কেন, সন্দেহ হচ্ছে খারাপ হয়ে যাব?
পিসি থতমত খেল।
বলল, বাবাঃ, যেন ফণাধরা কেউটে! তোর সঙ্গে কথায় কে পারবে!
পিসে বলল, আর এ-ও বলি, নতুন জামাই এতদিন শ্বশুরবাড়িতে কেন?
পিসি আবার তৎক্ষণাৎ ফণাধরা কেউটের মতো ফোঁস করে উঠল।
বলল, আছে, বাড়িটা ওর শ্বশুরের বলে। পিসেশ্বশুরের বাড়ি হলে থাকতে আসত না। ও ভদ্দর ছেলে, তাই আলাদা বাসা খুঁজছে, নইলে ইচ্ছে করলেই তো এখানে থাকতে পারত।
থাকতে পারত? পিসে ভ্যাবলার মতো বলল, চমৎকার।
পিসি বলল, অবাক হচ্ছ কেন? পারতই তো, সুমির আর নমিরই বাড়ি, মনে রেখো সেটা।
পিসের কাছে কোনও সময় হারবে না পিসি, তা নিজের স্বার্থে ঘা পড়লেও। অথচ একদিনের জন্যে ছাড়াছাড়ি থাকতে পারে না দুজনে।
পিসি একটু গঙ্গা নাইতে গেলে, যতক্ষণ না ফেরে, ছটফট করে পিসে।
.
তা এইসবের পরের দিনই বৃন্দাবনে গেল ওরা।
দেদার কাঁদল দিদি।
আর আমার মনে হল, কান্নাটা দিদির ছল।
ও যেন আমাকে দুয়ো দিয়ে সেজেগুজে বরের সঙ্গে গাড়িতে উঠল।
জামাইবাবুর মুখে কী প্রসন্নতা!
তার মানে, আমাকে নিয়ে ওর শুধু মজা। আমি ওর খুশির খেলনা, ওর কৌতুকপ্রিয় প্রকৃতির কৌতুকের একটা উপকরণ। দিদিই প্রাণপুতুল। হ্যাঁ, এ কথা আমায় বলেছিল জামাইবাবু, বলেছিল দিদিকে দেখতে এসে দিদির শান্তশিষ্টনমূর্তি ওর মনে কোনও দাগ বসাতে পারেনি। পরে আমার চপলতাতেই আকৃষ্ট হয়েছিল, এবং এক কথায় কথা দিয়ে গিয়েছিল। তবে এও বলেছিল, কিন্তু পরে দেখলাম, ঘটনাটা ওভাবে না ঘটলে ঠকতুম। তোমার দিদি একটুকরো খাঁটি সোনা।
সেই খাঁটি সোনাটি নিয়ে খাঁটি বোষ্টম মা বাপের কাছে দর্শন দিতে গেলেন প্রিয়মাধববাবু, মাস্টারমশাই ছলছল চোখে ওদের মোটঘাট গাড়িতে তুলিয়ে দিল।
হয়তো মাস্টারটিকে নিয়ে খেলতে পারতাম। দিদিকে মুছে ফেলতে পারতাম ওর মন থেকে, কিন্তু সেটা বড়ই অরুচির।
এই প্রথম নিঃসঙ্গতা অনুভব করলাম জীবনে। আর দিদির স্নেহ, দিদির একান্ত ভালবাসা মনে পড়ে হৃদয় দীর্ণ-বিদীর্ণ হতে লাগল, নিজের প্রতি ধিক্কার এল। পিসির কাজের সাহায্য করতে শুরু করলাম।
.
কিন্তু সেই শ্মশান-বৈরাগ্য আর কদিন?
দিদিরা ফিরল।
ওদের তখন বাসা ঠিক হয়ে গেছে। মাস্টারমশাই জোগাড় করে রেখেছে। আর পিসি মাস্টারের সঙ্গে গিয়ে উনুন পেতে, ভাঁড়ার গুছিয়ে রেখে এসেছে। দিদির যে বাবার বাড়ির ভাগের কথা মনে পড়েনি, এই কৃতজ্ঞতায় অনেকটা করছে পিসি।
.
দিদিরা বাসার খবর জেনেছিল।
দিদিরা স্টেশন থেকে সেই বাসায় এসে উঠল।
প্রথম দিন পিসিই রান্না করে দিতে এসেছিল।
আমিও সঙ্গে গিয়েছিলাম।
আমিই দিদিকে আগে দেখলাম জানলা থেকে।
দেখলাম, দিদি বেশ একটু বদলে গেছে। দিদি আর সেই পাতলা গড়নের রূপসী তরুণী নেই, যেন বেশ একখানি ভরাট-দেহ যুবতীতে পরিণত হয়েছে।
এই কদিনেই এত চেঞ্জ? ছিঃ!
হিংসে করব না অবজ্ঞা করব? দেহের এই ভরাটত্ব কি মনের পূর্ণতার ছায়া নয়?
সম্পূর্ণ একা একা যুগল ভ্রমণে ওরা যে পরিপূর্ণতার স্বাদ পেয়েছে, তা তো ওদের মসৃণ মুখে, গভীর চোখে, আর কথার মধ্যেকার নিবিড় ব্যঞ্জনায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
এই জন্যেই বোধ করি বুদ্ধিমানের দেশে হনিমুনের প্রথা। অনেকজনের মধ্যে, সমাজ-সংসারের আওতার মধ্যে দৃষ্টি থাকে অস্বচ্ছ, চিত্ত থাকে বন্ধনগ্রস্ত, ভালবাসা নিজেকে বিকশিত করবার জায়গা পায় না।
দিদিরা বৃন্দাবনের ছুতো করে হনিমুন ঘুরে এল, পরস্পরের মধ্যে ডুবল।
তবে আর আমি ওদের অবজ্ঞা ছাড়া কী করব?
অবজ্ঞা করে বললাম, ওরে বাস, দিদি কী সাংঘাতিক মুটিয়েছিস? যাই বলিস, বড় হ্যাংলা বাপু তুই। এই কদিনের মধ্যেই এত আদর খেলি যে, ডবল হয়ে গেলি?
ডবল অবশ্য হয়নি দিদি, তবু সেটাই বললাম ঘেন্না দিতে।
দিদি হাসল।
প্রতিবাদ করল না।
প্রতিবাদ করল দিদির বর।
বলে উঠল, এটা বড় বেশি অতিশয়োক্তি হচ্ছে না নমু?
আমি বললাম, মোটেই না। আপনি অন্ধ–চোখে দেখতে পাচ্ছেন না।
দিদি বলল, যা বলেছিস! শীতের মুখে নতুন দেশে বেড়াতে গিয়ে বেজায় চেঞ্জ লেগে গেছে।
পিসি যদি সহবত শিক্ষার পরাকাষ্ঠা দেখাতে নমিতাকে তার এক ঘণ্টার বড় বোন সুমিতাকে দিদি বলতে না শেখাত, যদি ওদের তো আর ছোট বড় নেই ভেবে বাঁচাল ছটফটে নমিতাটাকেই বর পাইয়ে দিত, আর সুমিতা যদি না আজীবন দিদিগিরির মাসুল জোগাত, হয়তো ওদের দুজনেরই জীবন-ইতিহাস আলাদা হত।
হয়তো ওরা আর পাঁচজনের মতোই সুখী সন্তুষ্ট গৃহিণী হত। কিন্তু তা হল না।
পিসি ওদের জীবনের প্রারম্ভে পরম শত্রুতা সেধে রেখেছিল।
কিন্তু শুধুই কি পিসি?
ভাগ্যদেবতা নয়?
ক্রুর নিষ্ঠুর দেবতা নামের কলঙ্ক ভাগ্য-বিধাতা!
নমিতার তো সুমিতার থেকে দামি পাত্রের সঙ্গে বিয়ে হল কমাস পরেই। তবু কেন?
নমিতা পিসিকে যতই অবজ্ঞা করে আসুক আজীবন, পিসি তার কর্তব্যে ত্রুটি করেনি একতিলও। শুধু পিসি সুমিতার আগে নমিতার বিয়ে দেয়নি। কিন্তু সেই তো কাল হল, নমিতা তাই সুমিতার বরকে আগে দেখল। তাদের এই মরুভূমির সংসারে এক পশলা বৃষ্টি, এই হারেমের জীবনে একটি যুবক পুরুষ।
পিসি নির্বোধ হলে কী হবে, সাধারণ সংসার-পরিবেশের নীতি-দুর্নীতি, সভ্যতা-ভব্যতা, এসব তার চোখ এড়াত না। জামাইবাবুকে নিয়ে নমিতার মাতামাতি তার চোখ এড়ায়নি, আর জামাইকে ভালবাসলেও তার বেপরোয়া হুল্লোড় তার চোখে ভাল ঠেকত না।
তাই ওরা যখন বৃন্দাবনে গেছে, উঠেপড়ে লেগে পাত্র খুঁজেছে পিসি।
তা বাড়ি আর বর, এটা তখন অত দুর্লভ ছিল না। চেষ্টার মতো চেষ্টা করলে পাওয়া যেত।
অবস্থাপন্ন ঘরের এক উকিল পাত্র জোগাড় করে ফেলল পিসি। বছর দুই হল ল পাশ করে কোর্টে বেরোচ্ছে, সংসারে মা আছে, আরও দুটো ভাই আছে, কলকাতায় দুখানা বাড়ি আছে, দেশে জমিজমা আছে।
আর কী চাই?
জামাইয়ের চেহারা?
তাও ভাল।
বরং প্রিয়মাধবের থেকে আরও একটু ফরসা।
ওরা সংসার পাতাতে না পাতাতেই পিসি এই পাত্রের কথা বলল ওদের কাছে।
আহ্লাদে উছলে উঠল ওরা।
নমিতাও উছলোবেই প্রতিজ্ঞা করে ঝলসে বেড়াতে লাগল।
প্রিয়মাধব বলেছিল তখন, দুদিকে দুই চিনির নৈবিদ্যি নিয়ে বেড়াতে যাওয়া, বায়োস্কোপ যাওয়া, সবই বুঝি ঘুচল এবার, ফাউটা লুঠে নিতে ডাকাত পড়েছে।
নমিতা বলেছিল, দুদিক সামলাবার দায় থেকে অব্যাহতি পাচ্ছেন তেমনি।
ওটা কি দায়?
তা একরকম।
প্রিয়মাধব বলেছিল, তা হোক, বুকের আধখানা খালি হয়ে যাচ্ছে। সুমিতার সামনেই বলেছিল।
সুমিতা বলেছিল, তোমার ইয়ার্কির ধরনটা এবার বদলাও বাপু! কে কী ধরনের লোক জানা তো নেই। ওর বর যদি এসব পছন্দ না করে?
না করে, উকিলের চিঠি দেবে।বলে হেসে উঠেছিল প্রিয়মাধব।
প্রিয়মাধব নামের ওই লোকটাকে নমিতা তখন কিছুতেই ঠিক বুঝতে পারত না। কখনও মনে হত, সুমিতা নামের ওই নিস্তেজ শান্ত মাতৃপ্রকৃতির মেয়েটার মধ্যে সে তার চঞ্চল রক্তের পরিতৃপ্তি পায় না। তাই নমিতার আগুনের দিকে আকৃষ্ট হয়, তার মধ্যে মনের চাহিদা মেটায়।
কখনও মনে হত, ওই সুমিতা-সাগরের অগাধ গভীরতাতেই সে নিমজ্জিত, এই চপলতা তার আমোদ মাত্র।
অতএব নমিতা অপমানিতা।
এই দুই টানাপোড়েনের মধ্যে বিয়ে হয়ে গেল নমিতার।
নমিতা মনে করল ওদের একবার দেখিয়ে দিতে হবে।
দেখিয়ে দিতে হবে প্রেম কাকে বলে, প্রেমের উচ্ছ্বাস কাকে বলে।
মনে করল।
যদি সেই ওর মনে করাটা কাজে করতে পেত, তা হলেও হয়তো সবই ঠিক থাকত, কিন্তু নমিতা অনেক পেয়েও কিছু পেল না।
হেমন্ত উকিলের বহুবিধ গুণের মধ্যে একটা বিশেষ গুণ ছিল। চপলতা সে আদৌ পছন্দ করত না।
থিয়েটার বায়োস্কোপ দেখাকে সে অসার-আমোদ বলে মনে করত, নাটক নভেল পড়াকে প্রায় দুর্নীতি বলে মনে করত, এবং কবিতা বস্তুটা যে মানুষ ইচ্ছে করে পড়তে পারে, এটা সে ভাবতেই পারত না। তবে স্ত্রীকে সে ভালবাসতে দেরি করেনি। এবং স্ত্রীর এক ঘণ্টার দিদিকে দিদি বলে সমীহ করতেও ত্রুটি করেনি।
এই সুযোগটা নিত তার স্ত্রীর দিদি। প্রায়ই গাড়ি ভাড়া করে শহরের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে ছুটত, আর গিয়ে বলত, ভাই হেমন্ত, আজ একটু বউকে ছাড়তে হবে।
হেমন্তর মন ভিজোতে আরও বলত, যমজ বোন বুঝতেই তো পারছ। ও না ভোগ করলে আমার ভোগ হয় না। রাগ কোরো না ভাই।
যেন অনুমতি না নিয়ে উঠবে না। অথচ রাগ করত না হেমন্ত। এক কথাতেই অনুমতি দিত। পরে হেমন্ত নমিতাকে বলত, আশ্চর্য! তোমার যমজ বোন উনি, এ যেন বিশ্বাসই হয় না। দেবী আর উর্বশী।
নমিতা রেগে রেগে বলত, বিধাতার কারসাজি। নইলে আর কটাদিন আগে তোমা হেন দেবতা যদি আমাদের গার্জেনের চোখে পড়ত গো, ইতিহাস বদলে যেত।
হেমন্ত বলত, আমার পূর্বজন্মের পুণ্য ছিল না, তাই চোখে পড়েনি!
৩. দাহ অনুভব
নমিতা দাহ অনুভব করত।
কিন্তু সে দাহ বেশিদিন রইল না।
নমিতার ভাগ্য নমিতাকে একটা কাঁটাবনে নিয়ে গিয়ে আছড়ে ফেলল।
হেমন্ত নামের ওই বিরক্তি উৎপাদনকারী সম্পূর্ণ অপছন্দের বরটাও ভাগ্যে বেশিদিন টিকল না তার, মারা গেল।
হঠাৎই মারা গেল।
ডাক্তার বলল কলেরা। হেমন্তর মা বলল, হারামজাদী বউ বিষ খাইয়েছে।
ছবির মতো চেহারার তরুণী বউ। ঔদ্ধত্য আর বাঁচালতা ছাড়া আর কোনও দোষ যার খুঁজে পাওয়া যায় না, বিনা দ্বিধায় তার নামে এই বদনাম রটিয়ে দিল শাশুড়ি।
.
কিন্তু নমিতা কি মরমে মরে গিয়েছিল?
অনেকদিন পরে কলম হাতে নিয়ে সেই নমিতাকে দেখতে দেখতে ভাবছি, কই? এত বড় অপবাদেও তো মরমে মরে যায়নি সে! মনের ঘেন্নায় নিজেই বিষ খেয়ে শোধ নিতে পারেনি তো?
তাই তো উচিত ছিল।
সাধারণ বাঙালির ঘরের মেয়ে তো তাই করত।
আর কোনও মেয়ে এত বড় অপবাদের পরও মুখ দেখাত কি? বিশেষ করে স্বামী মদ্যপ ছিল না, অসচ্চরিত্র ছিল না, স্ত্রীর প্রতি অবহেলা বা অত্যাচারকারীও ছিল না, শুধু একটু বেশি সিরিয়স ছিল।
জীবনকে সে রঙিন চশমা দিয়ে দেখত না তার বড় ভায়রা-ভাইয়ের মতো।
নমিতার প্রতি আকর্ষণের অভাব ছিল না তার। এবং নমিতার চপলতাটুকু অন্তর্হিত হলে হয়তো গলেই থাকত। সেই স্বামীর এই আকস্মিক মৃত্যুই তো যথেষ্ট মর্মান্তিক ছিল, তার উপর এই বিষের অপবাদ!
নমিতার নিজেরই বিষ খাওয়া উচিত ছিল।
কিন্তু নমিতা বিষ খেল না।
বরং অভিযোগকারিণীর গায়ে বিষের ঝাপটা মারল।
বলল, খাইয়েছি যদি তো জেনেশুনে বসে আছেন কেন? পুলিশ-কেস করুন?
শাশুড়ি চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে অন্য ছেলে দুটোকে ডেকে বউয়ের এই ভয়ংকর বাণী গোচরে আনল। নমিতা তাদেরও ওই এককথা বলল, জেনেশুনে পুলিশ-কেস করছ না কেন বলো তো? জেলে দাও ফাঁসি দাও, একটা কিছু করো।
তোমার মতন মেয়েমানুষকে তাই করাই উচিত, বলেছিল মেজ দেওর। আর সদ্য বিধবা নমিতা হেসে উঠে বলেছিল, তবু সেই উচিত কাজটা করছ না। তার মানে, ভাবছ ভালই হয়েছে, ষাঁড়ের শত্রু বাঘে মেরেছে, কেমন? দুখানা বাড়ি তিনটে ভাগীদার অসুবিধে হচ্ছিল তো!
হ্যাঁ, ওই ভাবেই ওদের বিষের ঝাঁপট মেরেছে নমিতা, অপবাদের শোধ নিয়েছে।
হয়তো ওই ভাবেই চালিয়ে যেত সে।
তার রুচিবোধ, কাব্যবোধ, শিল্প-সুষমা সব কিছুর বোধ জলাঞ্জলি দিয়ে শাশুড়ি আর দেওরদের সঙ্গে বিষের লড়াইয়ে জেতবার জন্যে মরণ পণ করত। ভাগ্য নামক পৈশাচিক বিধাতার উপর নিষ্ঠুর প্রতিশোধ নিতে নিজেকে কুৎসিত কদাকার করে তুলত। তবু তাও হয়তো ভাল হত। কিন্তু তার জীবনের শনি দিদি তা করতে দিল না। দিদি তার বরকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে কেঁদে পড়ল। বলল, এখানে থাকলে তুই বাঁচবি না নমু, আমার কাছে চল তুই।
তোমার কাছে, কী বল?
নমিতা হেসে উঠেছিল, তোমার সুখের সংসারে কালসাপ হয়ে ঢুকতে যাব আমি? তুমি পাগল না আমি পাগল?
সুমিতা বলল, তুই তো চিরকেলে পাগল! তোর কথা শুনব না। এই জিজ্ঞেস কর তোর জামাইবাবুকে, ও কী বলে শোন।
নমিতার তখনও অশৌচ চলছিল।
তখনও নমিতা বৈধব্যের বেশ গায়ে চড়ায়নি, শুধু চুলগুলো রুক্ষু হয়ে চেহারাতেও একটু রুক্ষতা এনেছিল।
তবু সুন্দরী দেখাচ্ছিল বইকী!
ঘরের মধ্যেকার বড় আরশিদার আলমারির পাল্লায় নিজের ছায়া দেখতে পাচ্ছিল নমিতা। নমিতা তাই মুচকি হাসি হেসেছিল, জামাইবাবু কি আমার গুরুদেব যে, যা বলবেন শুনতে হবে?
তা গুরুদেব না হোক, গুরুজন তো বটে। চিরদিন ভালবাসিস, ভক্তি করিস।
নমিতা হেসে উঠেছিল। সদ্য বিধবার মুখে সেই বাঁচালের হাসি মানায় কিনা খেয়াল করেনি।
নমিতা বলেছিল, ভালবাসার সঙ্গে ভক্তিটা জুড়ে বুঝি একটু মোলায়েম করছিস দিদি?
দিদি তবুও থতমত খায়নি।
আশ্চর্য মনোবল দিদির!
দিদি বলেছিল, তা ভালবাসা থাকলেই ভক্তি আসতে বাধ্য। ভক্তিশ্রদ্ধাহীন ভালবাসা আবার ভালবাসা নাকি?তারপর বলেছিল, তর্ক রাখ নমু, আমি বুঝতে পারছি এখানে থাকলে তুই বাঁচবি না।
তা বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মেয়ের মধ্যে একটা মেয়ে না-হয় নাই বাঁচল।
দিদি কেঁদে ফেলল।
চাঁদের শুক্ল অংশের মতো যমজ দুই বোনর পবিত্র অংশটুকুর চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়তে লাগল। বললে, তুই ছাড়া আমার আর কে আছে নমু?
যেন ওই নমু ওর থেকে বছর পাঁচ-দশের ছোট বোন।
.
ওই নমিতাটাকে আমি বলতে ইচ্ছে হয় না, তাই নমিতা বলে চলেছি।
যদিও জানি না কেন লিখছি এসব। হয়তো ভয়ংকর যে যন্ত্রণাটা কোনওদিন ফেটে পড়তে পায়নি, সে-ই আমাকে এই প্ররোচনা দিয়েছে।
জানি না কার জন্যে লিখছি আমি এসব।
প্রিয়মাধবের জন্যে?
তার ছেলের জন্যে?
না কি যে হারিয়ে গিয়েও না হেরে জিতে গেল, তার জন্যে?
হয়তো কারও জন্যেই লিখছি না।
শুধু প্রিয়মাধব যখন জিজ্ঞেস করে, রোজ কী লেখো? তখন বলি, আমি মরে গেলে দেখতে পাবে।
কিন্তু লিখছি তো এখন।
তখন তো লিখিনি।
যখন নমিতা নামের একটা ভয়ংকরী মেয়ে ছিলাম আমি।
কিন্তু তখনই কি লিখতাম না?
প্রেমের কবিতায় খাতা ভরাতাম না?
অজস্র সেই প্রেমের কবিতায় ভরা খাতাখানা একদিন আমার উকিল বরের হাতে পড়েনি?
উলটেপালটে দেখে বলেছিল সে, তোমার সংগ্রহশালাটি প্রশংসার যোগ্য নয়, যত রাজ্যের ওঁচা, অসভ্য কবিতাগুলো বেছে বেছে খাতায় তুলেছ?.
তাই ভেবেছিল ওপরের কবিতা নকল করে খাতায় তুলেছি।
তার বেশি দৌড় ছিল না ওর কল্পনার।
ওর মার যেমন একখানা খাতায় রাজ্যের স্তব-স্তোত্র বন্দনা-মহিমা ইত্যাদি ভোলা আছে, আমার খাতাটাকেও ও তাই ভেবেছিল।
আমি যখন সগর্বে বলেছিলাম, তোলা মানে? এ তো আমার নিজের লেখা–, একটু অনুকম্পা মিশ্রিত অবিশ্বাসের হাসি হেসেছিল উকিল।
তারপর বলেছিল, তা তোমার এরকম টেস্ট হওয়াই স্বাভাবিক। দেখেছি তো তোমার বাবার বইয়ের কালেকশান! একখানা ভাল বই নেই। ওই সব পড়েই তো মানুষ!
কিন্তু স্বর্গের দেবী সুমিতা দেবীও ওই বাড়িতেই মানুষ! তীব্র হাসি হেসে বলেছিলাম আমি।
হেমন্ত উকিল বলেছিল, ব্যতিক্রম! পৃথিবীতে ব্যতিক্রম থাকেই।
কবিতা লিখেছি আমি ছেলেবেলায় দু-চারটে, বেশির ভাগ দিদির বিয়ের পর।
আগেরগুলো লিখেই তৎক্ষণাৎ দিদিকে দেখাতাম। পরে কদাচিৎ!
মনে হত অরসিকেযু রসস্য নিবেদন-এ কাজ কী?
তবে জামাইবাবুর আসবার কথা থাকলে ইচ্ছে করে টেবিলে কি খাটে ফেলে রেখেছি।
জামাইবাবুর চোখে পড়ে গেলে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পড়ত, আর দিদিকে ডাকত, দেখো গো দেখো, তোমার বোনের কাব্য। হৃদয় একেবারে রসভারে টলটল করছে।
দিদি বলত, তুই নিজে লিখেছিস? সত্যি? আশ্চর্য!
আশ্চর্যই হয়েছে দিদি, সন্দেহ করেনি কখনও।
অথচ দিদি
কী বলেছিল তখন দিদি
হ্যাঁ, তখন দিদি বলেছিল, তুই ছাড়া আমার আর কে আছে নমু?
বললাম, দিদি, এদের কাছ থেকে চলে যাওয়া মানে তো লড়াইয়ে হেরে পালিয়ে যাওয়া।
দিদি বলল, তা হোক! ঝগড়ায় হারা ভাল। মনে নেই ছেলেবেলায় পিসি বলত, কিছুতে হেরো না, ঝগড়ায় হেরো।
পিসি!
দিদির এই পিসি সেন্টিমেন্টে বরাবর হেসে উঠতাম আমি, কিন্তু সম্প্রতি পিসি মারা গেছে, তাই হাসলাম না।
বললাম, কিন্তু তোর বাড়িতে নিয়ে যাবার পিছনে যুক্তি কী? আমি ছাড়া তোর কেউ নেই বলে? লোকে শুনলে হাসবে।
লোকের হাসিতে কী আসছে যাচ্ছে?
দিদি বলেছিল, দুঃখের সময় সুখবর বলতে পারিনি। তোর জামাইবাবুর অন্য একটা কাজ হয়েছে। চা বাগানের ম্যানেজারি।
চা বাগানের ম্যানেজারি!
কাজটাকে খুব একটা ভাল এবং খবরটাকে বেশ একটা সুখবর বলে ভাবিনি আমি। কিন্তু দিদির ওই আহ্লাদে জ্বলজ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে মায়া হয়েছিল সে কথা বলতে।
দিদি তারপর অনেক কথা বলেছিল। বলেছিল
কখনও তো কোথাও যাইনি আমরা, বিদেশ কেমন তা চক্ষে দেখিনি। আমি তবু জন্মের মধ্যে কর্ম একবার দিল্লি আগ্রা বৃন্দাবন, তুই তাও না।
এই সব কূটকচালে আত্মীয়-স্বজনদের আওতা থেকে সরে গিয়ে ভালই থাকব আমরা। একেবারে প্রকৃতির কোলে শান্ত পরিবেশে থাকব, কেউ আমাদের জীবনের জানলায় উঁকি দিতে আসবে না।
এমনি সব অনেক কথা অগোছালো করে বলেছিল দিদি।
আর তার মধ্যেই দিদির ভালবাসার মনের ইচ্ছে বারবার উঁকি দিয়েছিল।
দিদি নিজে না বুঝলেও, আমি বুঝেছিলাম দিদির সেই বড় স্নেহের বড় ভালবাসার ছোট্ট বোনটা যে এই বয়েসে সর্বত্যাগিনী হয়ে বসে থাকবে, এ দিদির সহ্য হচ্ছিল না, তাই দিদির ইচ্ছে উঁকি দিচ্ছিল সমাজ-সংসারের চোখের আড়ালে নিয়ে গিয়ে তাকে নিয়মবন্ধন থেকে মুক্ত করে দেবে।
ওর সেই ভালবাসার মনের ইচ্ছেটি কথার ফুল হয়ে ফুটে উঠছিল, এখানে থাকলে তোর ওই শাশুড়িবুড়ি নির্ঘাত তোকে নিয়ে যা তা করবে। কিন্তু তুই তো বলতে গেলে কুমারীই আছিস। বরের সঙ্গে কদিনই বা ঘর করেছিস, আর কতই বা মিশেছিস? তুই খাবি পরবি সবই করবি।
.
খাওয়া-পরা, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের মাধ্যমে দিদি আমার বৈধব্যযন্ত্রণার লাঘব চেয়েছিল। হয়তো ভেবেছিল তবু সেটাই লাভ।
আর সেই লাভটুকু পেতে আসামের জঙ্গলও আকর্ষণীয় মনে হয়েছিল দিদির।
কিন্তু দিদির সেই ছেলেমানুষীকে প্রশ্রয় দিইনি আমি। আমি অশৌচান্তেই সাদা থান সার করেছিলাম, হাত শুধু করেছিলাম, কোমর ছড়ানো চুলগুলোর অর্ধেক নির্মূল করে ফেলেছিলাম।
দিদি সেই মূর্তি দেখে বসে পড়েছিল। বলেছিল, হেমন্তকে তো তুই এত ভালবাসতিস না নমু যে, তার জন্যে সর্বত্যাগিনী হবি?
দিদির দুঃখ দেখে মন কেমন করেনি তা নয়, কিন্তু দিদির ভালবাসার পুতুল হয়ে থাকতে মন ক্রমশ বিদ্রোহী হয়ে উঠছিল আমার।
ওর ওই স্নেহের ভার ক্রমশই ভার হয়ে উঠছিল আমার কাছে।
দিদি আমায় ভালবাসবে, মমতা করবে, করুণা করবে, আহাকরবে, আর আমি দিদিকে ঈর্ষা করব, এ অসহ্য!
দিদি যদি আমায় এত ভালবাসতে না আসত, এত আহা না করত, বাঁচতাম আমি।
.
ভেবেছিলাম ওদের সঙ্গে কিছুতেই যাব না। চলে যাক দিদি অনেক দূরে।
তার সুখ, সমৃদ্ধ, ভালবাসার বর, আর বরের ভালবাসা নিয়ে। আমি এখানে লড়াই করে বেঁচে থাকব। কিন্তু আশ্চর্য! তবু গেলাম আমি দিদির সঙ্গে। আমার অহংকারকে পরাস্ত করে লোভ জয়ী হল। থান কাপড় আর শুধু হাত আমাকে রক্ষা করতে পারল না।
যেখান থেকে আগ্রহের অনুরোধ এল, স্থির থাকা শক্ত হল আমার। রক্তের মধ্যে এল চাঞ্চল্যের জোয়ার।
তখন কি জানতাম ছাই, ওই আগ্রহের অনুরোধ এসেছিল দিদির নির্দেশে? দিদির কৌশল ওটা?
জানতাম না।
ভেবেছিলাম এ ওরই গোপন আগ্রহ। আমার সাজবদলে দিদি বসে পড়েছিল। আর জামাইবাবু আড়ালে শুকনো মুখে বলেছিল, একটু ঠাট্টা-আহ্লাদ করে বাঁচতাম শালি, সে পথও ঘোচালে! দেখে ভয় ভয় করছে।
বললাম, সবই তো এহ বাহ্য।
তবু মনে হচ্ছে তুমি যেন দূর আকাশের তারা হয়ে গেলে?
ভালই তো, ঊর্ধ্বমুখে চেয়ে থাকবেন, আর অর্ঘ্য দেবেন।
জামাইবাবু বলেছিল, দূর এ যেন অসহ্য।
তারপর ও আমায় ঠকাল।
ওর ভালবাসার বউয়ের নির্দেশে আমায় ভালবাসা জানাতে এল।
অনেকদিন পরে জেনেছি আমি, দিদির অনুরোধেই আমায় অনুরোধ করেছিল ও। দিদি বলেছিল, জানো তো ও তোমায় কত ভালবাসে, তোমার কথা এড়াতে পারবে না।
সেই কথার জাল ফেলতে এল ও।
বলল, নমু, চল-না আমাদের সঙ্গে।
নমু ডাক ও কবে ডেকেছে?
চমকে গেলাম।
বললাম, কেন? খাল কেটে কুমির নিয়ে যাবার ইচ্ছে কেন?
ও বলল, তা কেন? খাল কেটে গঙ্গা নিয়ে যেতে চাইছি।
হেসে ফেলে বললাম, ওটা তো সাজানো কথা। ডাইনে বাঁয়ে চিনির নৈবিদ্যি, সেটাই বলুন। সেটা বলতে পারলে তো বেঁচে যেতাম! প্রিয়মাধব তার নামের অর্থ বহন করে চোখে চোখে তাকাল। বললে, কদিনই বা বলতে পেলাম? সুখের দিনগুলো বড় তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে গেল।
ওই দৃষ্টিতে সম্মোহিত হয়েছিলাম আমি।
তাই ওদের সঙ্গে যেতে রাজি হয়ে গেলাম। পরে ভেবেছি, ওই দৃষ্টি কি অভিনয়? না কি সত্যি?
সত্যি যদি তো স্ত্রীর অনুরোধে অনুরোধ করতে এসেছিল কেন ও? অভিনয় তবে কার সঙ্গে করেছিল? আজ পর্যন্ত বুঝতে পারলাম না ওর কোনটা সত্যি, কোনটা অভিনয়। না কি নিজেই জানে না ও? হয়তো তাই! ওর অগাধ প্রাণপ্রাচুর্য ওকে হয়তো সীমারেখার মধ্যে স্থির থাকতে দিত না।
আমি রাজি হয়েছি দেখে দিদি যেন কৃতার্থ হল।
দিদি এসে আমার শাশুড়ির কাছে আবেদন করল।
শাশুড়ি বলল, নিয়ে যাবে তো যাও মা, বাঁচি আমি। ওই আগুনের খাপরাকে বুকে নিয়ে সারাজীবন বইতে হবে আমায়, ভেবে ভয়ে মরে যাচ্ছি।
আমি বললাম, আপনার কি ধারণা চিরদিনের জন্যে বোনের বাড়ি থাকতে যাচ্ছি আমি?…যখন ইচ্ছে হবে চলে আসব।
শাশুড়ি নিশ্বাস ফেলল। বোধহয় নিজের ভবিষ্যৎ ভেবে।
কিন্তু জামাইবাবু সে পথ ঘোচাল আমার। আমার দেওরদের সঙ্গে ভাগ-ভিন্ন করে, অধিকারচ্যুত করল আমায়। বলেছিলাম, দিদির সঙ্গে যে আমার চিরকাল বনবে তার গ্যারান্টি কে দিচ্ছে? যদি তেজ করে চলে আসি?
দিদি হেসে বলেছিল, তা বেশ তো, চলে আসিস। সিকদার বাগানের বাড়ির চাবি খুলে নিয়ে দিব্যি থাকবি। বাবার বাড়িটা তো বেচে খাইনি আমরা?
পিসি মরার পর পিসে অতএব তার ত্যাগ করে-আসা ভাইদের বাড়ি চলে গিয়েছিল, বাড়িটার নীচের তলায় ভাড়াটে বসিয়ে। দোতলাটা চাবি দেওয়া ছিল।
.
দেওররা বলল, হাড়ে বাতাস লাগল আমাদের।
শাশুড়ি বলল, বাঁচলাম।
এই পাথেয় নিয়ে ভগ্নিপতির আশ্রয়ে বসবাস করতে চললাম আমি।
এই জীবন আমার। অথচ দিদির সঙ্গে ওই এক ঘণ্টার তফাত ছাড়া আর কোনও বিষয়ে তফাত ছিল না আমার।
দিদির জন্মলগ্নটা কি এমনই এক শুভগ্রহের গতিপথের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছিল যে, দিদির জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই পিছলে পড়ে গিয়েছিল সে গ্রহ?
পর মুহূর্ত থেকে শুরু হয়েছিল কোনও এক কুটিল গ্রহের শাসনকাল?
.
গাড়িতে এমন আদর করে ওরা দুজনে নিয়ে গেল আমায়, যেন আমি এক মস্ত কুটুম যাচ্ছি, কি একটা রুণ শিশু যাচ্ছি। সেই অবস্থা সহ্য করতে হয়েছিল আমাকে।
ট্রেন থেকে লাফিয়ে পড়তে ইচ্ছে হচ্ছিল। আর আমার মুখে সেই ইচ্ছের ছাপ পড়ছিল খুব সম্ভব। অতএব ওরা আরও যত্ন করতে এগিয়ে আসছিল। ভাবছিল আহা বেচারা।
আমার তাপিত প্রাণে প্রলেপ লাগাতে ওরা প্রাণ ঢালছিল।
কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল, আমি যে দুঃখী, আমি যে ভাগ্যবঞ্চিত, এ যেন ওরা ভুলতে দিতে রাজি নয়। ওরা ওদের মিলিত হাত বাড়িয়ে আমার সেবা করে করে অহরহ জাগরূক রাখবে সেটা।
হয়তো ওদের দোষ নয়, দোষী আমার বৈধব্যের বেশ।
আমার কাটা চুল, আমার খালি হাত, আমার থান কাপড়, ওদের ও কথা ভুলতে দিচ্ছিল না। ওরা বুঝতে পারছিল না, এই সাজ আমার ওদের প্রতি বিদ্রোহ। ভাবছিল বৈরাগ্য।
.
আমার বিদ্রোহ ছিল, ঔদ্ধত্য ছিল, ঈর্ষা ছিল, অহংকার ছিল, ছিল না শুধু লোভ জয় করবার শক্তি।
আমি নিজেকে ধিক্কার দিয়েছি, তবু অনিমেষ নয়নে সেই প্রিয় মুখের দিকে তাকিয়ে থেকেছি। যে মুখের অধিকারীর নাম সত্যিই প্রিয়।
প্রিয়মাধব।
অবশ্য এক-আধ সময় মমতার কাছেও হার মানিনি তা নয়।
দিদি যখন আমায় মমতা করতে হৃদয় বাড়াত, সে হৃদয়কে দুহাত দিয়ে ঠেলে ফেলে দেবার দুর্দমনীয় ইচ্ছে দমন করেছি তো শুধু মমতারই বশে।
.
চা বাগানের বহুবিঘ্নিত রাস্তার বহুবিধ দোলা এবং হৃদয় দ্বন্দ্বের দোলা, এই দুই দোলায় দুলতে দুলতে প্রিয়মাধব মুখার্জির কর্মস্থলে পৌঁছনো গেল।
সারি দিয়ে লোক এসেছিল সাহেব আর মেমসাহেবকে স্বাগত জানাতে। কলকাতার টি বোর্ডের একজন মাঝারি অফিসার কোন পাতাচাপা কপালের জোরে একেবারে একখানা বাগানের ম্যানেজার হয়ে আসে, তাই ছিল তখন বোধ করি এদের জল্পনার বিষয়।
তবে তটস্থ হবার ব্যাপারে এতটুকু ত্রুটি দেখাল না। আমাকেও ত্রুটি করল না। অবশ্য আমার মনে হল আমাকে নিশ্চয় মেমসাহেবের আয়া ভাবছে ওরা।
ম্যানেজারের বাংলোর দিকে চললাম আমরা, আস্তে গাড়ি চালিয়ে। এই পথ দিয়ে যেতে সমস্ত উপত্যকাভূমি দেখা যাচ্ছে, নীচে গভীর খাদ অবধি চা বাগান। চা বাগান! চির পরিচিত শব্দ। অথচ চির অপরিচিত দৃশ্য। দিগন্ত বিস্তৃত সেই সিঁড়িকাটা বাগানের হরিৎ আর গাঢ় সবুজের শ্যামল শোভা যেন চিত্তের সমস্ত গ্লানি মুছে দিতে চেয়ে মেহদৃষ্টিতে তাকাচ্ছে।
চা বাগানের এই সুবজ শোভা নাকি হতভাগ্য মানুষদের রক্তের লালের পরিবর্ত।
কিন্তু সে কথা এখন বোঝা যাচ্ছে না। ওর থেকে চোখ তুললেই তো থাকের পর থাক পড়ে রয়েছে হিমালয়ের ছোট ছোট গিরিচূড়া, তারও উপরে একেবারে আকাশের কোণে তুষারমৌলী গিরিরাজ চিরসুন্দর, চিরপবিত্র।
হঠাৎ দেখলে সেই পবিত্রতা আর শুভ্রতাটুকুই মনে ছাপ দেয়।
মনে হল দিদি ঠিকই বলেছে।
প্রকৃতির কোলই বটে।
সেই প্রকৃতির কোলে
বেশ রাজকীয় সম্মানেই ম্যানেজার সাহেবের বাংলোয় প্রবেশ করলাম আমরা। সাহেব মেমসাহেব, আর তাঁদের স্নেহপাত্রী দুঃখিনী আশ্রিতা। না, সেই পরিবেশে তখন ও ছাড়া নিজেকে আর কিছুই ভাবতে পারিনি আমি।
কিন্তু বাংলোর মধ্যে এসে জিনিসপত্র ছড়িয়ে দিদি যখন এলিয়ে পড়ল, এবং কোম্পানি নিয়োজিত অসমিয়া দুটো চাকরানীর বহুবিধ কথার কোনও উত্তরই দিয়ে উঠতে পারল না, তখন আমাকেই হাল ধরতে হল।
আর তখন ধীরে ধীরে দিদিই যেন আমার আশ্রয়ে এসে পড়া বেচারিতে পরিণত হয়ে উঠল।
.
কাজের মধ্যে সহজ হয়ে গেলাম আমি।
ডাক-হাঁক শুরু করলাম। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে সামান্য কাজে হইচই, সামান্য কথায় তোলপাড় হাসি, এটা যেন আপনি এসে গেল। গোছগাছ নিয়ে দিদির শিথিলতা, জামাইবাবুর হইচই এবং আমার ম্যানেজমেন্ট, বাংলোকে বেশ সরগরম করে তুলল।
জামাইবাবু বলল, শালিকে আবার যেন শালি শালি মনে হচ্ছে।
হঠাৎ যেন আমিও আমার সাজটা ভুলে গেলাম। ভুলে গেলাম অবস্থা। মনে হল দিদির বিয়ের ঠিক পরের সেই নমিতা আমি। যে নমিতা ছিল অকারণেই চঞ্চল। যে কথায় কথায় হাসত, কথায় কথায় গান গেয়ে উঠত, কবিতা পড়ত আর কবিতা লিখত।
মনে হল, আবার হয়তো কবিতা লিখতে পারব আমি।
দিদি আমার এই কিশোরী মূর্তি দেখে কি অবাক হল? না শুধুই খুশি হল?
জানি না কী হল আর না হল, তবে দিদির একটি কীর্তি দেখে আমি অবাক হলাম শুধু। দিদি যে ভিতরে ভিতরে এই মতলব করছে, তা কে জানত।
.
আমি যখন রান্নায় ব্যস্ত, দিদি তখন কোম্পানির ওই চাকরানী দুটোকে দিয়ে বেডিং খুলিয়ে বিছানা পাতিয়েছে। একটা ঘরে জোড়াচৌকিতে দিদির আর আমার, পাশের ঘরে একা জামাইবাবুর।
শুতে এসে আমি তো থ!
হইচই করে উঠতেই হল।
বললাম, ম্যানেজার সাহেব, এটা কী?
জামাইবাবু এই নতুন সম্বোধনে হেসে উঠে বলল, এটা মোেটই আমার ম্যানেজমেন্টের অবদান নয়। এ সম্পূর্ণ মেমসাহেবের ব্যাপার।
তা আপনি তো ছিলেন এখানে?
ছিলাম। দর্শক হিসেবে।
অথবা বলির ছাগ হিসেবে হেসে উঠলাম আমি। দিদিকে ডাক দিলাম। ধীরে সুস্থিরে দিদি আস্তে আসছিল খাবার ঘর থেকে, বারান্দা পার হয়ে।
তীব্র তীক্ষ্ণ প্রশ্ন করলাম, দিদি, এটা কী?
দিদি মিষ্টি হেসে বলল, সুমিতা দেবী এবং নমিতা দেবীর সুখশয্যা।
ওঃ! তাই বুঝি? তা শ্রীমতী সুমিতা দেবী, চা-বাগানের ম্যানেজার সাহেব রাতারাতি আমাকে ধরে তুলে খাদে ফেলে দিয়ে আসুন, এই তা হলে চান আপনি?
দিদি অপ্রতিভ হাসি হেসে বলল, বাঃ, তুই তা হলে এই নতুন দেশে একলা শুবি না কি?
আমি গম্ভীরভাবে বললাম, অবিশ্বাস হয়, দোরে চাবি লাগিয়ে চাবিটা নিয়ে শুয়ো। সকালে খুলে দিলেই হবে। রাতে আমার ঘুম ভাঙে না।
দিদি অবাক হয়ে বলল, অবিশ্বাস মানে? শুনছ গো, নমির কথা?
জামাইবাবু বলল, শুনছি বইকী! যত শুছি, তত মোহিত হচ্ছি।
দিদি বলল, অবিশ্বাসের জন্যে একা শুতে দেব না, এমন অনাসৃষ্টি কথা তোর মাথাতেই আসা সম্ভব। তুই এই অজানা অচেনা জায়গায় একা একটা ঘরে থাকবি, এতে আমার স্বস্তি আসবে?
বললাম, দিদি, স্বস্তি জিনিসটা একা তোরই প্রাপ্য সর্বদা এটা ভাবিস না! তা ছাড়া বিধাতার উপর হাত চালাবি তুই? সে যাকে একা থাকার বিধান দিয়েছে, তুই যাবি তার শয়নসঙ্গী হতে? পাগলামি করিস না, যা। যা-না, তোর বালিশ-বিছানা উঠিয়ে দিচ্ছি চল।
প্রিয়মাধব এতক্ষণ সকৌতুকে এ দৃশ্য উপভোগ করছিলেন। হেসে বললেন, থাক থাক, শালি, আজ যখন সুখশয্যা রচনা করা হয়েছে, ওটাই চলুক।
না, চলবে না। আমি দৃঢ় হলাম, যা অচল, তা একদিনই বা চলবে কেন? দিদি আরও অপ্রতিভ গলায় বলল, রাত্তিরে তোর ভয় করবে দেখিস।
দেখব! ভয়টাও তো একটা দ্রষ্টব্য। হেসে বললাম আমি, ভয়ানক একটা কিছু দান করে বসতে নেই রে দিদি, শেষে হাত কামড়াতে ইচ্ছে করবে।
দিদি তবু অনুরোধ করে। তবু ছেলেমানুষের মতো করতে থাকে।
আমি যেন নতুন কনেকে বরের ঘরে শুতে যেতে সাধছি। দিদি বলে, আহা, ভারী একেবারে ভয়ানক! পাঁচ বছর বিয়ে হয়ে গেছে।
আমি বলি, তোর কথাটা কেমন হল জানিস? আহা, বড্ড একেবারে তেষ্টা। জন্মাবধি জল খাচ্ছি।
দিদি হেসে ফেলে বলে, আমার অত নেই, যাঃ।
তা না হয় নেই, তুই না হয় মহামানবী। কিন্তু যে বেচারি বলির ছাগের ভূমিকা নিয়ে বসে আছে?
দিদি আবার হেসে ফেলে।
বাবাঃ, এতও জানিস তুই। দিদি তবু পাতা বিছানাটাতেই বসে গড়ানে ভঙ্গিতে বলে, বেশ ঠিকঠাক আছে, শুয়ে পড়-না বাবা!
আমাকে অতএব রাগ দেখাতে হয়। বলতেই হয়, ম্যানেজার সাহেব, আমাকে এই দণ্ডে স্টেশনে পাঠাবার ব্যবস্থা করে দিন। নচেৎ গিয়ে খাদে পড়তে হবে।
বাবাঃ। বাবাঃ। দিদি উঠে পড়ে বোকা বোকা অপ্রতিভ হাসি হেসে বলে, একদিন এদিক-ওদিকে কী হয় শুনি?
কী হয়?আমি প্রিয়মাধবের দিকে চোরা কটাক্ষ হেনে বলি, হয়–অভিসম্পাত। কী দরকার বাবা সে অভিশাপ কুড়িয়ে? একে তো পূর্বজন্মে না জানি কোন ক্রৌঞ্চহত্যার পাপে এ জন্মে এই দুর্গতি! আবার এই পাপে
দিদি বালিশটা হাতে ধরে উঠে পড়ে।
শুধু বালিশ নিচ্ছিস? চৌকি বিছানা?
দিদির মুখে নবোঢ়ার রক্তিম ছাপ পড়ে। লজ্জা লজ্জা হেসে বলে, একদিন যা হোক করে হয়ে যাবে, কে আবার এখন অত টানাটানি করে?
দিদির সেই যা হোক করে কাটানোর উপকরণের দিকে তাকালুম। ফুট তিনেকের বেশি চওড়া নয় প্রিয়মাধবের চৌকিটা।
আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে প্রিয়মাধব বললেন, তার মানে আমাকে চৌকি থেকে ফেলে দেবেন আর কি!
ওদের এই লীলা রঙ্গে ভারী রাগ হল। বললাম, দিদি, দয়া করে শুয়ে পড়বি? ঘুমে মরে যাচ্ছি যে আমি!
দিদি এবার তাড়াতাড়ি উঠল। তবু
ভাব দেখাচ্ছে কতই যেন কষ্ট হচ্ছে আমার জন্যে। অন্য ঘরে বিছানা করে ফেলে মুখ তো শুকিয়ে গিয়েছিল। বুঝি না আমি? সব ছল। সব সাজানো। এক্ষুনি গিয়ে ও ওই প্রিয়মাধবের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে
বলবে, বাঁচলাম।
তুই আগে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ কর। তবে যাব আমি, বলল দিদি।
আমি বললাম, আমার দেরি আছে।
ওমা এখন আবার কী করবি তুই?
বাড়ির বিধবা গিন্নির ধরনে বললাম, আমি সকালের জলখাবারের ব্যবস্থা করে রাখব।
অ্যাঁ! বলিস কী? ও কাল সকালেই হবে। এই যে বললি ঘুমে মরে যাচ্ছিস?
যাচ্ছিলাম, এখন আর যাচ্ছি না। তা তুই বুঝি আমার দরজায় তালা লাগাবার জন্যে শুতে পারছিস না?
ধ্যেৎ, বলে দিদি যেন অগত্যাই ঘরে ঢুকে পড়ল।
বরের ঘরে।
আস্তে দরজাটা ভেজিয়ে দিল।
সন্তর্পণে খিলটা লাগাল। তবু খুট করে একটু শব্দ হল। শব্দটা বিষের মতো লাগল।
আমি অনেকক্ষণ ওই বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে রইলাম ঈর্ষাতুর দৃষ্টিতে।
তারপর শব্দ করে খিল লাগালাম আমার ঘরে।
.
পরদিন ইচ্ছে করেই একেবারে অন্ধকার ভোরে উঠে পড়ে কাজে লেগে গেলাম। নতুন পত্তন সংসারে কাজের অভাব ছিল না, তা ছাড়া কাজ তো আর টাকা নয় যে, অভাব থাকলে অভাবই।
কাজের অভাব থাকলে কাজ সৃষ্টি করে নিতে কতক্ষণ? আমি যদি সকালের চায়ের উপকরণ হিসেবে কোনও একটা শৌখিন খাবার করতে বসি, বেশ কেটে যাবে সময়।
কাটল সময়।
আকাশের আবছা অন্ধকারও কাটল।
আলোয় ঝকমক করে উঠল বাড়িটা।
তখনও ওদের ঘরের দরজা বন্ধ। একটা দাসী এসে ঝটপাট শুরু করল, এবং আশ্বাস দিল আর একজন এক্ষুনি এসে পড়বে।
কী যে কাজ করবে দু দুটো দস্যি মেয়ে, কে জানে! কথাটা কাউকে বলতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু কে শুনছে? বাড়ির যাঁরা মালিক, কর্তগিন্নি তো এখনও সুখনিদ্রায় অভিভূত।
বেহায়া!
নির্লজ্জ।
ঢং করে আবার অন্যঘরে বিছানা পাতা হয়েছিল।
ইচ্ছে হচ্ছিল ওই বন্ধ দরজার উপর গুম গুম করে কিল মেরে চেঁচিয়ে বলি, কী গো লজ্জাবতী লতা! বর ছেড়ে অন্যত্র শুচ্ছিলে না তুমি? লজ্জার বালাই তো খেয়ে বসে আছ! লজ্জা করছে না এই অজানা অচেনা জায়গায় হঠাৎ এসে পড়ে সব ভার একটা মানুষের উপর ছেড়ে দিয়ে বাসরের বিছানায় শুয়ে শুয়ে দুপুরের রোদ দেখতে!
ইচ্ছে হচ্ছিল।
অথচ তা করিনি আমি। যা করেছিলাম তা যে-কেউ শুনলে গালে হাত দিত। আমিও জানি না ওই দুরন্ত রাগের সময় কী করে আমি সকালের রোদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে গুগুন্ করে গান গাইছিলাম। অথচ গাইছিলাম।
একটু পরে দিদি উঠে এল।
সত্যিই নতুন কনের মতো লজ্জা লজ্জা মুখে এসে দাঁড়িয়ে কুণ্ঠিত হাসি হেসে কৈফিয়তের সুরে বলল,ইস কী বেলাই হয়ে গেল! তুই তো কখন উঠেছিস, আমায় একটু ডেকে দিসনি কেন?
আমি ভুরু তুলে বললাম, আমি যে কোন উঠেছি, সেটা কী করে জানলে?
দিদি বলল, ওমা শোনো কথা! কাজই পরিচয়। অনেক আগে না উঠলে কখনও কচুরি ভাজা যায়?
খুব কড়া একটা কিছু বলতে ইচ্ছে করছিল, তবু সামলে নিয়ে বললাম, আমি মন্ত্রবলে এক নিমেষে সব করে ফেলতে পারি।
ইস তাই বইকী! বলে ছেলেমানুষের মতো হাসল দিদি।
দাঁড়িয়ে থাকল একটু বোকার মতো, তারপর স্নানের ঘরের দিকে চলে গেল।
পাহাড়ি দেশের বাড়ি, দেয়াল জোড়া, শার্সির জানলা, বারান্দার এক দিকটা তো পুরো কাঁচের। বারান্দার রেলিংগুলো হালকা কাঠের, মেঝেগুলো মসৃণ সবুজ। কিন্তু মেঝের রং কতটুকুই বা দেখা যাচ্ছে, প্রায় সর্বত্রই তো কার্পেট বিছানো।
রান্নাঘর ভাঁড়ারঘর?
সেও কাঠ পাতা।
দিদি চলে গেল বোকার মতো, ছেলেমানুষের মতো। তবু ওই কাঁচের মধ্যে থেকে এসে পড়া আলোয় ওকে যেন সম্রাজ্ঞীর মতো মনে হল। আমার নিজের হেঁটে যাওয়ার ভঙ্গিটা কেমন আমি জানি না। তবু কোনওদিনই আমি দিদির মতো কুণ্ঠিত অপ্রতিভ কি ন নম্র ভঙ্গিতে হাঁটি না। শ্বশুরবাড়িতে থাকতে পর্যন্ত হাঁটাচলায় ইচ্ছে করে আনতাম দৃপ্তভঙ্গি।
তবু দিদির ওই হেঁটে যাওয়াটা দেখে মনে হল, আমার ঠিক এরকমটা যেন না হয়।…
এই ভঙ্গি কি ভিতরের পূর্ণতার রূপ?
ওর সবটা ভরাট, ও আত্মস্থ, তাই ওর চলনে বলনে নম্রতার মধ্যেও অহংকারের ছায়া?
না কি সবটাই আমার মনের ভ্রম?
.
দিদি স্নানের ঘরে থাকতে থাকতেই জামাইবাবু বেরিয়ে এল ঘর থেকে।
এসেই যে আমার সন্ধান করবে তা জানতাম। করলও তাই। রান্নাঘরের দরজায় উঁকি মেরে বলে উঠল, আরে ব্যস, উষাকালেই অন্নপূর্ণা মূর্তি! কচুরি, হালুয়া, আলুর দম, বাঃ বাঃ বেড়ে।…রাত্তিরে ঘুমিয়েছ, না কি বিনিদ্র রজনী কেটেছে কচুরির ডাল বেটে?
রাগ দেখিয়ে বললাম, কেন, আমি কি এমনি কুঁড়ে যে ওই সামান্য কাজটুকুর জন্যে রজনী বিনিদ্র করতে হবে?
প্রিয়মাধব হেসে বললেন, তা নও বটে। তবে তোমার দিদির নিশ্চিত এই এতগুলি ব্যাপার ঘটিয়ে তুলতে দুরাত জাগতে হত।
আমি আবার রাগ দেখালাম, ভাল হবে না জামাইবাবু, দিদিকে বলে দেব।
ওদিক থেকে দিদির গলা শোনা গেল। বলে দিতে হবে না, সব শুনতে পাচ্ছি।
প্রিয়মাধব হা হা করে হেসে উঠে বললেন, তার মানে পাহারা দিচ্ছ?
দিদি তেমনি গলায় বলে উঠল, তা দেওয়াই তো উচিত, তোমাকে বিশ্বাস কী? যে লোভী তুমি! হয়তো মুখ না ধুয়েই বলে বসবে, দেখি দুখানা গরম গরম!
ঈশ্বর জানেন, কেন হঠাৎ চড়াৎ করে ভয়ানক একটা অপমানের অনুভূতিতে আমার পা থেকে মাথা অবধি জ্বলে উঠল। মনে হল দিদির এই সরল সাজাটা সম্পূর্ণ ছল। ও আমাদের দুজনকেই ব্যঙ্গ করল।
ওই অপমানের অনুভূতি কি শুধু একদিন? একবার?
প্রতিদিন, যে কোনও মূহুর্তে নয়?
দিদি যে আমাদের উপর পাহারা দিত না, আমাদের সন্দেহ করত না, এইটাই আমায় খেপিয়ে তুলত। আমি জোর করে করে বলেছি, দেখ দিদি, অত বিশ্বাস ভাল নয়।
দিদি ঠাট্টা ভেবে হেসেছে।
প্রিয়মাধবও বলত ঠাট্টা। তবে বেশিরভাগ আড়ালেই বলত, তোমার ঠাট্টাগুলো বড় কড়া শালি, আমি কড়া চোখে তাকিয়ে বলতাম, কে বললে ঠাট্টা?
সত্যি হলে তো আরও বিপজ্জনক কড়া, বলে পালাত। সত্যি শোনবার সাহস ছিল না।
.
তবু আমি ওই চা বাগানের কোয়ার্টার্সে প্রথম প্রথম ভালই ছিলাম। আমি যেন সহসাই আমার অতীত কৈশোরকে ফিরে পেয়েছিলাম।
আমি কবিতা লিখেছি তখন, গান গেয়েছি, আবৃত্তি করেছি। আমি তখন অকারণে চঞ্চল হয়েছি।
দিদি আমার এই স্ফুর্তির মূর্তি দেখে আনন্দে বিগলিত হয়েছে। বলেছে–মনে হচ্ছে কি জানিসনমু, আমরা যেন সেই আমাদের ছেলেবেলায় ফিরে গেছি। কী ভালই যে লাগছে!
আমি ভাবতাম, তোর ওই প্রিয়মাধবটি না থাকলে কেমন ভাল লাগত দেখতাম! তোর ভরাট মনের উপর আমি হচ্ছি ফাউ। চাঁদের উপর চুড়ো, নৈবিদ্যির উপর মণ্ডা। ছেলেবেলা। ছেলেবেলায় ও ছিল তোর প্রাণ জুড়িয়ে?
কিন্তু আমার সব কথাই তো মনের মধ্যে। তাই দিদি অবোধ থাকে। দিদি আমাকে আমার কৈশোর কালের স্বাদ দিতে চায়। তাই
.
দিদি আমার হাতে ধরে মিনতি করেছে ওদের সঙ্গে মাছ-মাংস খেতে, ওর শাড়ি থেকে রঙিন শাড়ি পরতে। বলেছে, মনে কর না ভাই, তুই কুমারীই আছিস। তোর সেই অতীতটা কিছু নয়। শুধু একটা বিরাট স্বপ্ন মায়া।
বলত, তার কারণ দিদি খেয়ে-পরে সুখ পেত না।
কিন্তু আমি খেয়ে-পরে দিদিকে খাওয়া-পরার সুখ দিতে যাব কেন?
সেই সুখ দেওয়া মানেই তো দিদির হাতের মুঠোয় চলে যাওয়া। দিদির প্রজা হয়ে যাওয়া। সেই সস্তা হতে আমি রাজি হইনি। আমি আমার আলাদা খাওয়া-পরার বর্মের মধ্যে একটা আলাদা সত্তা হয়ে বিরাজিত থাকব দিদির প্রিয়মাধবের সামনে।
.
প্রিয়মাধবকে আমি বুঝতে পারতাম না। মস্ত বড় একটি অভিনেতা ও, তাতে আর সন্দেহ কি? কিন্তু সেই অভিনয়টা কার সঙ্গে করত ও? বারে বারে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি আমি, বারে বারে বিভ্রান্ত হয়েছি।
কখনও ওর চোখে গভীর আবেগের গোপন ছায়া, কখনও সহজ কৌতুকের সহজ আলো, কখনও মনে হত ও ওই স্তিমিত-চিত্ত সুমিতা দেবীতে ক্লান্ত। কখনও মনে হত, ওখানেই ও নিমগ্ন।
অবিরত এই আলোছায়ার মধ্যে থেকেছি আমি।
কিন্তু আমি নিজে কী চাইতাম?
সে কথা আমি জানি না। আমার চাওয়া চিরদিনই আমার সঙ্গে নিষ্ঠুর ব্যঙ্গের খেলা খেলেছে।
আমি যখন সেই গভীর ছায়ার আভাস দেখতাম, কৌতুকের ছুরি বিধিয়ে দীর্ণ করতাম তাকে। যখন সেখানে স্বচ্ছ দীপ্তির আলো দেখতাম, আমি বাঁচাল হতাম, বেহায়া হতাম, এগিয়ে যাবার ভান করতাম।
.
আবার দিদির মনস্তত্ত্বও মাঝে মাঝে অবোধ হত। দিদি যেন ইচ্ছে করে এগিয়ে দিত আমায়, বলত, ওই রে সাহেব চেঁচামেচি লাগাচ্ছে, দেখ না ভাই কী বলছে! আমি আর পারি না উঠতে।
বলত, তুই বাবা বলে কয়ে বেশি খাওয়াতে পারিস, তুই-ই খাওয়া।
এটা কেন?
এটার মানে কী?
দিদি কি আমার উপবাসী চিত্তকে এক মুঠি খুদের খোরাক দিতে চায়?
না, ওর বরের মনোরঞ্জন করতে চায়?
সুমিতা দেবীর ওই স্তিমিত আর সীমিত সত্তা দিয়ে প্রচুর প্রাণ প্রিয়মাধবের দেহ মন দুইয়ের চাহিদা মিটছে না সন্দেহে এই প্রয়াস ওর?
.
এক এক সময় সন্দেহ হত, এই উদ্দেশ্যেই হয়তো দিদি আমাকে আমার কেন্দ্রচ্যুত করে নিয়ে এসেছে। এই বন্ধু-সমাজহীন অরণ্যে, প্রিয়মাধবের মতো প্রবল-প্রাণের মানুষকে ও নিজে একা ভরে রাখতে পারবে না, বেঁধে রাখতে পারবে না, তাই বলতে পেরেছিল, তোমাকে নমি ভালবাসে, তুমি বললেই যাবে।
যার অনেক ঐশ্বর্য তার আবার খানিকটা দিতে কী? ফেলে ছড়িয়েও তো ষোলো আনা থাকে তার।
এ সন্দেহ প্রবল হলেই আমি সোজা বলে দিতাম, আমার বয়ে গেছে। তোর বরের যত্ন তুই করগে যা।
দিদি হেসে হেসে বলত, সাহেব, শুনছ তোমার শালি কী বলছে?
সাহেব বলত, ঠিক শালিজনোচিত কথাই বলছে।
এখানে আসার পর থেকে ঠাট্টা করে আমি যেমন ম্যানেজার সাহেব বলতাম, দিদিও তেমনি ওগো হ্যাঁগো ছেড়ে সাহেবটাই রপ্ত করে ফেলেছিল। এও একটা লীলা।
আমি, দিদি আর প্রিয়মাধব।
এই তিনটি মুখ সংসারে।
তা ছাড়া চাকরানি, গোয়ালিনি, জমাদারনি, ধোপানি। এখানে মেয়েরাই বেশি কাজ করে। এদের মুখ ছাড়া ভদ্রলোকের মুখ দুর্লভ।
তবু অন্য বাগানের থেকে কোনও কোনও বাঙালি পরিবার কদাচ বেড়াতে আসতেন। এবং যথারীতি দিদির গৃহে আমার এই উপস্থিতিকে দিদির পরম ভাগ্য বলে ঘোষণা করে, আমাকে আহা করে যেতেন।
সে রকম দিনে ওরা চলে গেলে দিদি বড় বেশি মনমরা হয়ে থাকত। বলত, এখন মনে হচ্ছে হয়তো আমার ভালবাসাটা ছল, হয়তো নিজের স্বার্থের জন্যেই তোকে এখানে টেনে এনেছি আমি। নিজের মন তো বোঝা যায় না। আমি অপারগ তুই পারগ, তাই হয়তো তোর উপর আমার লোভ হয়েছিল। তাই ই তো করছি আমি। সব ভার তোর ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে নিজে আরাম খাচ্ছি।
দিদির সেই ক্ষুব্ধ ক্ষুণ্ণ মুখ দেখে মায়া হত বইকী! তখন হয়তো আমিই ওর মন ভাল করতে বেশি হইচই করতাম, ম্যানেজার সাহেব ম্যানেজার সাহেব করে হাঁক পেড়ে দিদির এই বৃথা দুঃখের বার্তা জানিয়ে হাসতাম। এবং যারা এসে দিদির মন খারাপ করে দিয়ে যাচ্ছে তাদের মুণ্ডপাত করতাম।
এই ভাবেই ঘুরে এল বছরখানেক। আসাম উপত্যকার প্রকৃতিতে ষড়ঋতুর খেলা দেখা হয়ে গেল।
আর এর মধ্যেই বিধাতার সেই চিরন্তন খেলার সূচনা দেখা দিল।
এটা যত অপ্রত্যাশিত, তত আনন্দের।
ম্যানেজার সাহেব আহ্লাদে দিশেহারা হলেন, দিদি বিগলিত হল।
এতদিন বিয়ে হয়েছে দিদির, ছেলেমেয়ে সম্পর্কে ওরা তো প্রায় আশা ছেড়েই দিয়েছিল।
সেই আশার আলোক দেখা দিয়েছে।
দিদির এই নতুন সৌভাগ্য ম্যানেজার সাহেবের বাংলোয় উচ্ছ্বাসের জোয়ার বহালো। সত্যি বলতে, আমি যেন দিদির এই নতুন ঘটনায় নির্মল হয়ে গেলাম, পবিত্র হয়ে গেলাম। দিদির এই মাতৃত্বের সূচনা ওকে এমন অসহায় অসহায় আর ছেলেমানুষ ছেলেমানুষ মতো করে তুলল যে, ওর উপর থেকে চিরকালের সেই ঈর্ষাটা সরে গেল আমার, মমতায় মন ভরে উঠল। প্রিয়মাধব আর আমি দুজনে আমরা যেন একটা নাবালিকার অভিভাবক। ওই বালিকা নাবালিকাটি হঠাৎ একটা মস্ত সম্পত্তির অধিকারিণী হয়ে বসেছে, অথচ বেচারা কিছুই জানে না, কিছুই সামলাতে পারে না, এমনি একটা ভাব আমাদের। অতএব–উঠতে বসতে দিদিকে সাবধান করি আমরা, যখন তখন ডাক্তার আনা হয়। এ অবস্থায় কী করা উচিত আর না উচিত, তার একটা বিরাট তালিকা প্রস্তুত হয়।
সৌভাগ্যবতীর সৌভাগ্য নতুন করে ঝলসে ওঠে।
বিয়ের ছ বছর পরে
আসামের চা-বাগানে দিদির প্রথম সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়।
.
আমি আর প্রিয়মাধব দিদির দুই অভিভাবক অনভিজ্ঞ দিদিকে দিদির ওই সদ্যোজাত শিশুটির মতোই উৎকণ্ঠিত দৃষ্টিতে দেখতে থাকি, উদ্বিগ্নমনে তদ্বির করি ওর।
আর সেই সূত্রে যেন প্রিয়মাধব আর আমি অন্য এক ঘনিষ্ঠতার সূত্রে আবদ্ধ হয়ে যাই। আগে দিদি বড় ছিল, আমাকে নিতান্তই বালিকা হিসেবে দেখত দিদি। এখন পট পরিবর্তন হল, দিদি ছেলেমানুষ হয়ে গেল। এই পরিবর্তনটা তারিয়ে তারিয়ে ভোগ করতাম আমি।
ছেলেকে দিদির কাছে দিতেই চাইতাম না আমরা।
দিদি যে কিছুই পারে না এটা যেন পাথরের গায়ে খোদাই করে লেখা হয়ে থাকা দরকার।
দিদি শুধু সেবার পাত্রী, আমি বাদবাকি সব। আমার ইচ্ছেয় সব।
দিদি নরম গদির বিছানায় বসে অপ্রতিভ অপ্রতিভ কুণ্ঠিত মুখে আবেদন করত, খোকাকে আমার কাছে দে না একটু?
আমি শাসনের সুরে বলতাম, উঁহু! এখন টাইম নয়। তোমার কাছে দিলেই তুমি এক্ষুনি বক্ষদুগ্ধ পান করাতে বসাবে, সেটা ক্ষতিকর।
দিদি বলত, দেব না সত্যি বলছি, দেখিস।
কাতরতায় গলতাম না আমি।
কারণ দেব না বলেও দিয়েছে লুকিয়ে লুকিয়ে, এ দৃষ্টান্ত আছে।
প্রিয়মাধবেরও প্রিয়ার স্বাস্থ্য এবং প্রিয়পুত্রের সর্ববিধ কল্যাণের চিন্তায় মনের চেহারা বদলে গিয়েছিল নমিতার। সুমিতার সব কিছুই ছেলেমানুষি বলে উড়িয়ে দেবার পরম সুখটার আস্বাদ তাকে নিষ্ঠুর করে তুলেছিল। সূচনা কালের সেই মমতাটা ক্রমশ ঝরে যাচ্ছিল, দিদির ওই আকুলতা আর আবেদনের যন্ত্রণা দেখে নিষ্ঠুর একটা আমোদ পেতাম আমি। অতএব ছেলেকে ঘড়ি ধরে আদর করতে পাওয়া ছাড়া আর পাবার হুকুম ছিল না সুমিতার!
সুমিতা যদি একদিন শখ করে ছেলেকে নাওয়াতে আসত, নমিতা বলত, ম্যানেজার সাহেব, ক্যামেরা আনুন! আর অনেক হাসির পর ছেলে এবং সরঞ্জাম কেড়ে নিয়ে বলত, রক্ষে কর দিদি, ঠিক তুই ওকে হাত ফসকে ফেলে দিয়ে মাথা ফাটিয়ে দিবি।
দিদি ছেড়ে দিত।
দিদি অপ্রতিভ হাসি হেসে বলত, বাঃ আমি যেন ওর মা নই?
মা তাতে কী? মহারানিরাও তো মা হয়, তারা কি ছেলে নাওয়াতে বসে?
আহারে, আমি যেন মহারানি?
ওরে বাবা, তা আবার বলতে? মহারানির ছেলেরা ধাইমার কাছেই মানুষ হয়।
দিদি এক একসময় কুণ্ঠিত গলায় বলত, তা একেবারেই শিখব না? ধর একদিন তোর শরীর খারাপই হল
নার্স আনবেন ম্যানেজার সাহেব।
তা বলে আমি শিখব না?
শিখিস। আরও দু-চারটে হোক, তখন শিখিস। এটার উপর দিয়ে আর হাত পাকাতে চাসনি।
বলে সেই চাঁদের টুকরো আর পাথরের কুচির মতো ছেলেটাকে নাচিয়ে নাচিয়ে স্নান করাতাম আমি।
দিদি ঘরে চলে যেত।
গল্পের বই নিয়ে শুয়ে পড়ত।
এতকাল গল্পের বইয়ে ঝোঁক দেখিনি দিদির। ইদানীং সে ঝোঁক দেখছি।
.
এটা কি আমার বড় বেশি নিষ্ঠুরতা হত?
সুযোগ পেয়ে আমি আমার আজন্মের জ্বালার শোধ নিতাম কি এই অভিনব উপায়ে?
হয়তো তা নয়।
এই দুরকালের পটভূমিতে দাঁড়িয়ে সেই থানপরা নমিতাকে দেখতে পাচ্ছি আমি, শুধু নিষ্ঠুরতার উল্লাসেই নয়, অনেকটা লোভের বশেও এই নিষ্ঠুরতা করেছে সে। তার বুভুক্ষু চিত্ত একটা শিশুর অধিকার পেয়ে তার তিলার্ধ ছাড়তে রাজি হত না। সবটা দখল করে থাকতে চাইত। কেবলমাত্র মাতৃদুগ্ধের জোগানে হেরে যেতে হচ্ছে দেখে, ছেলেটাকে অবিরত বাইরের খাদ্যে ভরিয়ে রাখত। সুমিতা যখন তার মাপা এক-আধবারের ভূমিকা নিয়ে বুকের দুধ খাওয়াতে যেত, শিশু স্বভাবতই মুখ ফেরাত, আর নমিতা যেন বিজয়িনীর উল্লাস অনুভব করত।
অথচ সভ্য মার্জিতবুদ্ধি সুমিতা আপন সন্তানকে নিয়ে কাড়াকাড়ির কথা ভাবতে পারত না।
নমিতার কি সুমিতার ওই বঞ্চিত মুখের দিকে তাকিয়ে একবারও মমতা আসত না?
মনে কি হত না, আহা নিক ও ওর ছেলেকে!
হত
কিন্তু এও যে জানত সে, মা যতই অপটু হোক, ছেলে তার হাতে পড়লে ঠিকই চালিয়ে নেবে, আর ঠিকই মায়ে-ছেলেয় আপস হয়ে যাবে।
অতএব আবার নমিতার ভাগ্যে সেই মুষ্টি ভিক্ষা!
.
তা ছাড়া প্রিয়মাধব।
প্রিয়মাধব তো ধারণা করে নিয়েছে, সুমিতা অচল! সুমিতার হাতে পড়লে খোকা বেশিদিন নয়। নমিতা না থাকলে খোকাকে বাঁচানো যেত না। প্রিয়মাধবের ওই ধারণাটা তো আলগা হয়ে যাবে। প্রিয়মাধব ত বুঝে ফেলবে সুমিতার ছেলেকে সুমিতা ঠিকই সামলাতে পারে।
এই জেনে ফেলতে দেওয়া যে নমিতার পরম লোকসান। নমিতা শুধু আদরের পুতুল হয়ে থাকতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছিল, শুধু করুণার পাত্রী হয়ে থাকতে অস্থির হয়ে যাচ্ছিল। সংসার পরিচালনার ভূমিকাটা ধর্তব্য করছিল না নমিতা, সেটা তো মাইনে করা লোকও পারে। খোকার সূত্রে নমিতা দরকারি হয়ে উঠেছে। অবশ্য-প্রয়োজনীয়ের পরম ভূমিকায় অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছে। অতএব মার ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাক খোকা, যাতে মার থেকে মাসিকেই বেশি ভজে সে।
আর সেই ভজনার সূত্রে তার বাবাও সেই মাসিকে ভজতে থাকুক মন-প্রাণ দিয়ে।
তা সেটা হত বইকী!
প্রায়ই তার প্রমাণ পাওয়া যেত।
যেমন খোকা রয়েছে মাসির কোলে, প্রিয়মাধব দুহাত বাড়িয়ে ডাকত, আয়, আমার কাছে আয়। দুষ্টু মাসিটার কাছে থাকবি না। সঙ্গদোষে উচ্ছন্ন যাবি। বাবার বোলচালে মুগ্ধ খোকা দু হাত বাড়িয়ে ঝাঁপিয়ে এসে পড়ত বাবার বুকে।
নমিতা বলত, নেমকহারাম ভূত! দেখব কে তোকে আর কোলে নেয়।
ততক্ষণে কিন্তু খোকা আবার মাসির দিকে দু বাহু প্রসারিত করে বাবার কোল থেকে ঝুলে পড়েছে।
পঞ্চাশবার এই একই খেলার পুনরাবৃত্তি হয়েছে, আর প্রতিবারই একটি সপ্রেম কটাক্ষ, একটু মিঠে কড়া রসিকতা, একটু বা চকিত স্পর্শ লাভ হয়েছে নমিতার ভাগ্যে।
সময়ের জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে নমিতা এবং খেলাটাকে যথেষ্ট পরিমাণে সরব সহাস্য করে তুলে নার্ভগুলোকে ঠিক রাখবার চেষ্টা করেছে। খোকা, খোকার বাবা, খোকার মাসি, তিনজনের মিলিত কলহাস্যে বাসাটা মুখর হয়ে উঠেছে।
খোকার মা কি এ সভায় থাকত না?
থাকত! কখনও থাকত কখনও থাকত না। তবে তার ভূমিকা তো সর্বদাই দর্শকের।
মুখটা হাসি হাসি করে হাতে একটা উলের গোলা আর দুটো বোনার কাঠি নিয়ে বসে থাকত হয়তো।
প্রিয়মাধব তাকে উদ্দেশ করে বলত, দেখো তোমার ছেলে কী সাংঘাতিক বেইমান। বাবাকে গ্রাহ্য মাত্র করছে না।
সুমিতা হেসে বলত, সে তো হবেই। ছেলেটা যে আবার তোমারও।
প্রিয়মাধব রাগের ভান দেখিয়ে বলে উঠত, তার মানে? এটা যেন আমার প্রতি কটাক্ষপাত মনে হচ্ছে।
কটাক্ষপাত নয়, আলোকপাত।বলে মৃদু হেসে মুখ নামিয়ে হাতের কাজে মন দিত দিদি।
মাঝে মাঝে নমিতা আবার ছেলেটাকে এগিয়ে নিয়ে দিদির কাছে দাঁড়িয়ে বলত, যা বুদ্ধ যা, মার কাছে যা। মার থেকে মাসির দরদ হাসির কথা, বুঝলি হাবা? যা!
বলা বাহুল্য ছেলেটা স্বভাবতই বসে থাকা মায়ের থেকে দাঁড়িয়ে থাকা মাসিকেই বেশি পছন্দ করত। অতএব মাসির গলাটা প্রাণপণে জড়িয়ে ধরে মুখ ফিরিয়ে নিত।
নমিতা হেসে হেসে বলত, বটে বটে! বাবা তো তবে ঠিকই নামকরণ করেছে। বেইমান!
বোকা সুমিতা এসব রঙ্গরসে যোগ দেওয়ার থেকে অনেক বেশি দরকারি মনে করত পশমের প্যাটার্নটা নির্ভুল হচ্ছে কিনা লক্ষ রাখতে।
কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ এক সময় নমিতার মনে হত, দিদি প্যাটার্নফ্যাটার্ন কিছুতে খেয়াল রাখছে না, শুধু ঘর বুনে যাচ্ছে। আর দিদির মুখটা সেই অর্থহীন ঘরগুলোর দিকে আরও ঝুঁকে পড়ছে।
ওই মুখটার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখতে দেখতে হঠাৎ একসময় হয়তো নমিতার এই কলরব কলহাস্য নেহাত খেলোমি মনে হত। আর রাগ এসে যেত নিজের উপর।
বলত, হয়েছে, খুব নাচানো হয়েছে। কাজ নেই যেন আর! নে দিদি তোর ছেলে ধর! অনেক কাজ পড়ে আছে আমার
ছেলেটাকে ফেলে দিতে আসত সুমিতার কোলে। কিন্তু সুমিতার হাতে যে দুদুটো উঁচলো কাঁটা। সুমিতা তাই, আরে আরে কাঁটা কাঁটাবলে শিউরে দাঁড়িয়ে পড়ত। তারপর কাঁটা-পশম গুছিয়ে নিতে নিতে বলত, ছেলেধরা তো সামনেই রয়েছে। ওকে দে না।
ছেলেকে কোলে করবার জন্যে এত আকুলতা দেখাত মাঝে মাঝে, কিন্তু ওই হুড়োহুড়ি খেলার মধ্যে কিছুতেই ভূমিকা নিতে চাইত না সুমিতা।
সুমিতা কেবল নিভৃতে একান্ত করে পেতে চায় তার ছেলেকে।
সুমিতা লোকলোচনের অন্তরালে তার মাতৃস্নেহ উজাড় করে দিতে চায় মাতৃসুধাঁধারার মাধ্যমে। যেটা নাকি প্রিয়মাধব আর নমিতা দুজনের কাছেই বিশ্রি রকমের গাঁইয়া ঠেকে।
সেই ঠেকাটাকে অবশ্য ওরা চাপতেও চেষ্টা করে না।
যদি হঠাৎ আবিষ্কৃত হয়ে পড়ে সুমিতা আয়ার কাছ থেকে লুকিয়ে ছেলেকে হাত করে ঘরে পুরেছে, প্রিয়মাধব হাঁ হাঁ করে ওঠে, আরে বেশ তো বাগানে বেড়াচ্ছিল, হঠাৎ আবার বন্ধ ঘরের মধ্যে পুরলে কেন? এদিকে তো এত বিদ্যে বুদ্ধি, এটার ব্যাপারে এমন বুদ্ধিভ্রংশ কেন?
সুমিতা ক্ষুব্ধকণ্ঠে জবাব দেয়, বুদ্ধিভ্রংশ ছাড়া বুঝি কেউ ছেলেকে কোলে নেয় না?
প্রিয়মাধব বলে, ওই অসময়ে কোলে নেওয়া, দুধ খাওয়ানো সবই গ্রাম্যতাদুষ্ট।
সুমিতা বলে, বেশ তো, মনে করো গ্রাম্যই। খোকার ঝি বলেই চালিও।
নমিতা অন্য সুর ধরত।
নমিতা ব্যঙ্গ হাসি হেসে বলত, এই যে গণেশ-জননী! আহা এই দেবীরূপ চোখে দেখলেও পুণ্যি!
সুমিতা বলত, এক্ষুনি নামিয়ে দেব।
আহা নামিয়ে দিবি কেন, থাক না, থাক। শুধু হাতজোড় করছি দয়া করে এখন আর খাওয়াতে বসিস না।
সুমিত্রা অপ্রতিভ গলায় বলত, না না, খাওয়াব কেন?
কেন তা তুইই জানিস! নমিতা মুখ টিপে হেসে বলত, বোধহয় বক্ষভার লাঘব করতে! আমি কী করে বুঝব বল ওই পরমতম রহস্য?
সুমিতা উঠে গিয়ে ছেলেকে আয়ার কাছে দিয়ে আসত। হ্যাঁ, উঠে গিয়েই দিয়ে আসত, চেঁচিয়ে ডাকত না কখনও কোনও ঝি-চাকরকে।
৪. পড়ন্ত বিকেল
আবার কতদিন এমন হয়েছে বাগানে গেছে সবাই ছুটির সকালে কি পড়ন্ত বিকেলে। খোকার সঙ্গে সঙ্গে আয়া আছে এবং বাগানে খুশির ঝড় বইছে। হঠাৎ একসময় দেখা গেল সুমিতা নেই। সুমিতা কখন যেন উঠে গেছে, ভিতরে চলে গেছে।
নমিতা অনেকক্ষণ লক্ষ না করার ভান করত, গাছপালাকে ঘিরে ছুটোছুটি করত, এবং নেহাত একসময় না বললে নয় বলেই বলে উঠত, ওমা দিদিটা কখন পালাল! বাবাঃ একটু যদি বসতে পারে। নির্ঘাত ওর উলের গোলা ওকে টানছিল।
প্রিয়মাধব বলত, আচ্ছা এই উলবোনাটা তো ছিল না তোমার দিদির!
নমিতা বলত, না মোটেই না। খাসিয়া মেয়েগুলোর দেখে দেখে শখ লেগেছে। এখানে দুধওয়ালি সবজিওয়ালিগুলো পর্যন্ত কী ফার্স্টক্লাস বোনে দেখেছেন তো?
প্রিয়মাধব বলত, তা কই, বুনছেন কী? সেটা তো দেখি না।নমিতা হেসে ফেলত।
সত্যি সেটা দেখা যেত না বটে। খোকার একটা পুলওভার ধরেছে এইটুকু দেখা যায়, ছাড়তে দেখা যায় না।
অথচ–বোধ করি টেক্কা দেবার মনোবাসনা নিয়েই নমিতা কেবলমাত্র রাত্রে ঘুমের সময় বুনে বুনে খোকার এবং খোকার বাবার দু দুটো সোয়েটার বানিয়ে ফেলে চকিত করে দিয়েছিল দুজনকে। তবে বলল না রাত্রে বুনেছি। ওরা অবাক হল। সুমিত্রা, আর তার বর। অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, বুনলে কখন?
নমিতা অবহেলায় বলল, এই কাজের ফাঁকে ফাঁকে এক আধ সময়।
উল কিনে দিল কে?
ওমা সেটা আবার একটা চিন্তার কথা নাকি। কিনিয়েছি দাইকে দিয়ে।
খোকার গায়ে সেই সোয়েটারই শোভা পেতে লাগল, তার মায়ের হাতের পুলওভারটা অসমাপ্তই পড়ে রইল ড্রয়ারের এক কোণে।
প্রিয়মাধবও সহর্ষে শালির অবদান অঙ্গে জড়িয়ে বেড়াতে লাগল।
তারপর থেকেই সুমিতা যেন আবার গল্পের বইয়ে বেশি মজল।
প্রিয়মাধব বলত, এটা আবার তোমার কী হল? এত বই বই বাতিক তো ছিল না কখনও? এখানে এই পাণ্ডববর্জিত দেশে এত বাংলা বই কোথায় পাই?
দিদি আর কিছু বলত না, চিঠি লিখে টাকা পাঠিয়ে কতকগুলো পত্র পত্রিকার গ্রাহিকা হয়ে পড়ল।
প্রিয়মাধব বলত, একেই বলে রক্তধারা। মনে হচ্ছে তোমাদের বাবার বাতিক আস্তে আস্তে এসে ধরবে তোমাদের।
.
আড়ালে দিদি আর প্রিয়মাধব কোন কথা বলত তা আমি জানি না, কিন্তু দিদির হাসিটা তো ঠিকই বজায় ছিল। যেটা আমাকে অবাক করত। দিদি যদি সর্বদা বিষণ্ণ থাকত, একটা যেন মানে পেতাম। তা থাকত না সে।
হয়তো কোনওদিন আমাদের কলহাস্যের মাঝখান থেকে উঠে গেছে দিদি, প্রিয়মাধব একটু পরে কাছে গিয়ে বলত, কী হল? তুমি কি কুপিতা হয়ে চলে এলে?
দিদি অবাক হয়ে যেত যেন।
বলত, কেন? একথা বলছ কেন হঠাৎ?
যে রকম নিঃশব্দে উঠে এলে সভা থেকে!
দিদি হেসে ফেলত।
সাজানো দাঁতের পাটি ঝকঝকিয়ে উঠত। যেটা হয়তো আমারও হয়, তবে নিজে দেখতে পাই না এই যা।
দিদি হেসে ফেলে বলত, তা উঠে আসাটা সশব্দ করতে হবে নাকি? সেটা কেমন, জানা তো নেই।
ওই হাসিটাই ওর ছদ্মবেশ ছিল।
পরে বুঝতে পেরেছি, ওকে যখন আমরা বোকা, বেচারি, অবোধ ভেবে করুণা করেছি, ও তখন ওর এই ছদ্মবেশটি এঁটে আমাদের বোকা বুঝিয়েছে, আমাদের ঠকিয়েছে।
হ্যাঁ, ঠকিয়েছে।
প্রিয়মাধব আর নমিতা ধরতে পারত না।
খোকার অসুখ করলে সুমিতাকে ঘুমোতে পাঠিয়ে রাত জেগে খাড়া বসে থাকত নমিতা আর প্রিয়মাধব। খোকাকে দেখতে এসে ডাক্তার যদি সুমিতাকে কোনও প্রশ্ন করত, প্রিয়মাধব বলত, তুমি কি ঠিক বলতে পারবে? নমিতা এসে বুঝিয়ে বলুক।
এতে সুমিতা আহত হতে পারে, অপমানিত হতে পারে, এ কথা মাথায় আসত না প্রিয়মাধবের। সুমিতা সম্পর্কে চিরনিশ্চিন্ত ছিল সে।
তারপর সেই একচক্ষু হরিণের গল্পের হরিণের মতো অবস্থা ঘটল প্রিয়মাধবের।
এল সেই ভয়ংকর দিন।
.
খোকার অন্নপ্রাশনের কথা উঠল।
আট মাস বয়েস হয়ে গেল খোকার, আর দেরি করা চলে না।
প্রিয়মাধব বলল, এই ছুতোয় কটা দিন ছুটি নিয়ে কলকাতায় যাওয়া যাক।
আর এই প্রস্তাবে হঠাৎ যেন সুমিতার হৃদয়-নদীতে বান ডাকল।
সুমিতা সেই অনেকদিন আগের মতো উল্লাসে আর উদ্ভাবনীশক্তিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।
ও জামাপত্র গোছাতে গোছাতে বলে, হ্যাঁ গো, খোকনের খাটটা নিয়ে যাওয়া হবে? দোলা খাটটা?
প্রিয়মাধব অবাক হয়ে বলল, খাটটা? খাটটা নিয়ে যাওয়া হবে?
বাঃ খোকা দোল খাবে না? অপ্রতিভ হাসি হাসে সুমিতা।
খোকা মা-মাসির কোলে দোল খাবে বলেই হাঁক পেড়েছে প্রিয়মাধব, এই নমিতা শুনছ, তোমার দিদি খোকার দোল খাবার জন্যে দোলনা খাটটা নিয়ে যেতে চাইছে।
নমিতা বলে উঠেছে, বেশ করেছে চেয়েছে। কেন চাইবে না? কোম্পানি তো মালের দাম দেবে।
কোম্পানি দেবে?
হা হা করে হেসে উঠেছে প্রিয়মাধব।
কেন, কোম্পানি দেবে কেন? এ কি আমি ট্রান্সফার হয়ে যাচ্ছি? বেড়াতে যাব ছেলের মুখে ভাত দিতে, কোম্পানি নেবে তার ভার? ছুটি দিচ্ছে এই ঢের!
তা বটে। সেই ঢের।
চা-বাগানের কাজে ছুটিটা বড় দুর্লভ।
সেই দুর্লভ বস্তু সংগ্রহ করে ফেলেছিল প্রিয়মাধব কলকাতায় গিয়ে ছেলের অন্নপ্রাশন দেবে বলে। কিন্তু সেই দুর্লভ বস্তু কি ভোগ হয়েছিল প্রিয়মাধবের? হয়নি।
ছেলের গয়না ও চেলির ফর্দ লেখা প্রস্তুত, ছেলের ভাতের যজ্ঞির ফর্দ প্রস্তুত, কাকে কাকে নেমন্তন্ন করা হবে তার ফর্দ প্রস্তুত, শুধু রাত পোহালেই রওনা।
হঠাৎ রাত্রে ছেলের গায়ে হাত দিয়ে শিউরে উঠল সুমিত্রা!
জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।
.
আচ্ছা, সুমিতার কাছেই কি শুত খোকন?
না, শুত না।
তিনমাস বয়েস থেকেই নমিতা ওকে নিজের কাছে নিয়ে শুতে আরম্ভ করেছিল। শুধু তখন কয়েকটা দিন শুচ্ছিল খোকা সুমিতার কাছে–সেই যে নমিতার কদিন আগে সর্দিজ্বর হয়েছিল, সেদিন থেকে নমিতা নিজেই এ ব্যবস্থা করেছিল। বলেছিল, সর্দি জিনিসটা বড় ছোঁয়াচে, বিশেষ করে বাচ্চাদের খুব তাড়াতাড়ি আক্রমণ করে।সুমিতা নিশ্চয়ই নমিতার ওই সামান্য অসুস্থতাটাকে ঈশ্বরের আশীর্বাদ বলে মনে করেছিল। খোকাকে কাছে নিয়ে শুতে পাওয়া সুমিতার কাছে তো কম পাওয়া নয়।
প্রথম সকালে নমিতা বলেছিল, কী রে, রাতে ঘুমিয়েছিলি তো? না কি সারারাত অপলক নেত্রে বৎসমুখপানে তাকিয়ে বসে রাত কাবার করেছিলি?
সুমিতা বলেছিল, কেন? আমি কি পাগল?
নমিতা হেসে দিদিকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, তা পাগল ছাড়া আবার কী? জানিসই তো আপনার ধন পরকে দিয়ে, পাগলা বেড়ায় মাথায় হাত দিয়ে! তুই তো প্রায় তাই!
সুমিতা বলেছিল, পর আবার কে আছে বাপু আমার? এক আছে বর, আর আছিস তুই, নিজেরই অর্ধাংশ। ওই অর্ধাংশ শব্দটার উপর কি একটু বেশি জোর দিয়েছিল সুমিতা? তাই নমিতা চমকে উঠেছিল। ভেবেছিল নমিতাকে তাদের দুজনের মধ্যেকার সম্পর্কের নিবিড়তা বুঝিয়ে দেবার জন্যেই, সুমিতার এই জোর নাকি?
চমকে ওঠা নমিতা নিজেকে সামলে নিয়ে হঠাৎ খুব হেসে উঠেছিল। দিদিকে আরও জোরে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, উঃ, তুই যে আজকাল বেজায় কথা শিখেছিস দেখছি। বরের সঙ্গগুণে, কেমন?
সুমিতা হেসে বলেছিল, কেন, বরের সঙ্গগুণে কেন? তোর সঙ্গগুণটা কিছু নয় নাকি?
আমার সঙ্গ তো মাতৃগর্ভের সূচনা থেকেই। সে গুণ ধরেছিল কই? চিরদিনই তো তোতে আর আমাতে আকাশ-পাতাল তফাত।
সুমিতা আবার হেসেছিল, তফাতটাই তো আসল মিল। যেমন মেয়ে আর পুরুষ।
সুমিতা প্রায় সব সময়ই হাসত। মনে হত হেসে কথা কওয়াই তার স্বভাব ছিল। কিন্তু সেটা যে সত্যি স্বভাব নয়, সেই হাসিটাকে যে ওকে বুক ছিঁড়ে বার করতে হত, এ কথা যখন স্পষ্ট বোঝা গেল, তখন ওর সেই হাসি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। শুধু আসামের চা বাগানের ম্যানেজারের কোয়ার্টার্সেই নয়, পৃথিবীর কোথাও রইল না সেই হাসি।
.
কিন্তু সেদিন হাসেনি সুমিতা।
যেদিন রাত্রে খোকার গায়ে হাত দিয়ে দেখেছিল খোকার গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। সেদিন ডুকরে কেঁদে উঠেছিল, ওগো, খোকা কীরকম করছে বলে।
আচমকা এই প্রবল জ্বরে, তড়কা হল খোকার। সুমিতা কেঁদে উঠল। উদ্ভ্রান্ত হয়ে ডাক্তার আনাল প্রিয়মাধব। ডাক্তার বলে গেল সারারাত ওয়াচ করতে। বলে গেল, ওষুধটা দেবেন যদি বাড়ে।
সারা বাড়িতে একটা তোলপাড় পড়ে গিয়েছিল। আয়া চাকর সবাই উঠেপড়ে ছুটোছুটি করছিল। নমিতা ও ঘর থেকে উঠে এসে ছেলের কাছে বসে ছিল। জলপটি আর বাতাস চলল।
জ্বর কমলে প্রিয়মাধব বলল, সুমিতা, তুমি বরং একটু ও ঘরেই না হয় শুতে যাও।
সুমিতা বলল, না, আমি এখানেই থাকি।
প্রিয়মাধব নমিতার সামনেই ওকে পিঠে হাত বুলিয়ে বলল, লক্ষ্মীটি, তোমার শরীর ভাল নয়, রাত জেগে তুমি আবার একটা অসুখ বাধিয়ে বসবে–
সুমিতা কখনও জেদ করে না, সেদিন করল।
বলল, না, কিচ্ছু বাধাব না কথা দিচ্ছি। আমার শরীর খুব ভাল আছে। আমার চলে যেতে ভয় করছে।
তবু প্রিয়মাধব তাকে নিবৃত্ত করল। বলল, ভয় নেই, ভয়ের কিছু নেই। তড়কা তো বাচ্চাদের হয়েই থাকে।
নমিতা কিন্তু সেদিন নিষ্ঠুরতা করেনি। বলেছিল, আহা, থাক না হয় জামাইবাবু! যতই হোক মায়ের প্রাণ!
সুমিতাকে আহা বলতে পারার সুযোগ পেয়েই কি করুণাময়ী হয়ে উঠেছিল নমিতা?
সুমিতা ওই আহা শুনে ওই করুণাবতীর মুখের দিকে চোখ তুলে তাকিয়েছিল।
সে দৃষ্টিতে নমিতা কেঁপে উঠেছিল।
নমিতা যেন পায়ের তলার মাটি খুঁজে পায়নি।
নমিতা সেদিন সে দৃষ্টির মানে বুঝতে পারেনি, কোনওদিনই বুঝতে পারেনি। এই সুদীর্ঘকাল পরেও কোনওদিন বুঝতে পারল না নমিতা, কী ছিল সেই চোখে?
রাগ? ঘৃণা? করুণা? হতাশা? মানুষের অপরিসীম নির্লজ্জতায় বিস্ময়? না শুধুই শূন্যতা?
সেই চোখকে নমিতার সমস্ত জীবনের উপর পুঁতে রেখে দিয়ে আস্তে উঠে গিয়েছিল সুমিতা ছেলের ঘর থেকে। পরদিন আর ছেলের ঘরে আসেনি!
পরদিন প্রিয়মাধবই ছেলে কোলে করে সুমিতার কাছে এল, অবাক হয়ে বলল, তুমি এই লবিতে পড়ে ছিলে বাকি রাতটা?তারপর বলল, দেখো আজ খোকা একেবারে সুন্দর সুস্থ। জ্বর ছেড়ে গেছে, মুখচোখের চেহারা বদলে গেছে। হাসছে খেলছে। এই নাও, একটু কোলে করো।
সুমিতা ক্লান্ত গলায় বলল, থাক। শরীরটা খারাপ লাগছে।
সুমিতার শরীর খারাপ লাগছে।
ছেলের সোহাগ মাথায় উঠল প্রিয়মাধবের। তাড়াতাড়ি ছেলেকে নমিতার কাছে দিয়ে এসে কাছে বসে পড়ল, ব্যস্ত হল। বারবার বলতে লাগল, দেখছ তো? বুঝতে পারছ শরীরের অবস্থা? বুঝতে পারছ কেন আমরা অত ব্যস্ত হই? কাল সেই যে রাত বারোটা অবধি জেগে ছিলে, তাতেই এইটি ঘটেছে।
তাই দেখছি। বলল সুমিতা, ক্লান্ত চোখ বুজে।
প্রিয়মাধব বলল, এই যদি সারারাত বসে জাগতে, কী হত বলো তো? খোকাটা হয়ে পর্যন্ত শরীরটা যে গেছে! তোমার ক্ষমতা থাকলে কেন তোমাকে আমরা
সুযোগ পেয়ে নিজের নিষ্ঠুরতার কৈফিয়ত দিয়ে নিয়েছিল প্রিয়মাধব। সুমিতা সায় দিয়েছিল।
সুমিতা বলেছিল, হ্যাঁ, বুঝতে পারিনি ক্ষমতা কত কম।
.
দুদিন উঠতে পারল না সুমিতা।
অর্ধেক রাত জেগেই এমন কাবু হয়ে পড়ল! শুধু চুপ করে শুয়ে রইল।
আর এমনি ভাগ্যের খেলা, ঠিক তখনই হঠাৎ ছুটি ক্যানসেল হয়ে বদলির অর্ডার এল প্রিয়মাধবের।
পঁচিশ মাইল দূরের একটা বাগানে কুলিরা খেপেছে, বুদ্ধিমান প্রিয়মাধবকে সেখানে দরকার। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে চলে যেতে হবে।
দেখো কাণ্ড!
মাথায় হাত দিয়ে পড়ল প্রিয়মাধব। একেই খোকার ওই শরীর, এদিকে তোমার শরীর খারাপ, এখন এই অর্ডার!
সুমিতা বলল, তা কী করবে? চাকরি।
চাকরি তো বুঝলাম, কিন্তু এই কঘণ্টার মধ্যে সব গুছিয়ে নেওয়া
নমিতা আছে, সব ঠিক হয়ে যাবে।
প্রিয়মাধব বলল, তা যেন হবে, কিন্তু তোমার এই অবস্থায় যাওয়া যাবে?
সেও ঠিক ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
যাই নমিতাকে বলিগে।বলল প্রিয়মাধব।
সুমিতা যেন অবাক হল।
সুমিতা বলল, এতক্ষণ বলনি ওকে?
হ্যাঁ বলেছি। অর্ডারের কথা বলেছি। গুছিয়ে-টুছিয়ে নিতে বলিগে।
ব্যস্ত হয়ে চলে গেল প্রিয়মাধব।
নমিতাকে বলতে গেল কাজের কথা।
কিন্তু নমিতা কেন সুমিতার ঘরে আসেনি? সুমিতা দুদিন বিছানায় পড়ে আছে, তবুও না। ও কি পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল?
ওর সর্বাঙ্গে যে দৃষ্টির দাহ, সেই দৃষ্টির ভয়ই কি করছিল আবার?
না কি ও শুধু ব্যস্ত ছিল?
আজ খানিক পরে ও এল।
খুব ব্যস্ততা দেখিয়ে বলল, একেই তো তুই অসুখ বাধিয়ে বসে আছিস দিদি, খোকারও শরীর খারাপ! হঠাৎ এ কী হাঙ্গামা! ক ঘণ্টার মধ্যে সব গুছিয়ে নেওয়া। নে, গণেশ-জননী হয়ে বসে থাক। ধর। আমি রণাঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়ি গে।
সুমিতা হাত বাড়িয়ে ছেলেকে নিল না।
সুমিতা বলল, সামলাতে পারব না, শরীরে বল নেই।
নমিতা এ আশা করেনি। নমিতা থতমত খেল।
অপ্রতিভ গলায় বলল, একটু দেখতে পারবি না? খানিকটা গুছিয়ে নিতাম।
সুমিতা বলল, আয়ার কাছে দে গে।
সুমিতা ক্লান্তিবোধ করছিল, তাই চোখ বুজল।
সুমিতার রোগা হয়ে যাওয়া বুকের উপর পাতলা শাড়িটা নিশ্বাসের ভারে কাঁপতে লাগল।
নমিতা অপ্রতিভ হয়েছিল।
নমিতার বুকটা কাঁপছিল। তবু নমিতা আগের পার্ট প্লে করে বলল, বাঃ, তোর ছেলে তোর সংসার, তুই একটু সামলাবি না?
তারপর নমিতা আবার কেঁপে উঠল। আপাদমস্তক বিদ্যুতের শক খেল।
নমিতা প্রায় ছুটে পালিয়ে গেল।
নমিতাকে তাড়া করতে আসছে সেই চোখ! সেই সে রাত্রের চোখ।
নমিতা যতদিন বেঁচে ছিল, সেই চোখ তাকে অবিরাম তাড়া করেছে। নমিতার দিনের শান্তি রাতের ঘুম, সব হরণ করেছে সেই চোখ। সুমিতার সেই চোখ। কোনও দিনই যার ঠিক মানে বুঝতে পারেনি নমিতা।
.
কিন্তু নমিতা আর কদিন বেঁচে ছিল? যেদিন বদলি হল প্রিয়মাধব, সেইদিনই না নমিতার দেওরদের টেলিগ্রাম করতে হল তাকে। নমিতা মারা গেছে। হঠাৎ বিষ পোকার কামড়ে
হ্যাঁ সেই তারিখ। প্রিয়মাধবের বদলির আর নমিতার মৃত্যুর তারিখ একই।
সুমিতা চাঙ্গা হয়ে উঠল। ছেলে কোলে নিয়ে সুমিতা তার বরের সঙ্গে নতুন চা বাগানে চলে গেল, নমিতা মারা গেল।
অথচ নমিতার ওই রাতারাতি মারা যাবার কথাটা বাংলোয় বলতে সাহস করেনি প্রিয়মাধব। বিদায় বেলায় যখন বকশিশের আশায় একধার থেকে ভিড় করে দাঁড়িয়েছিল চাকরানি, গয়লানি, ধোপানি, জমাদারনির দল, ওরা অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিল, মাসি মেমসাহেব কোথায়?
প্রিয়মাধব বলেছিল, ও হঠাৎ শ্বশুরবাড়ি চলে গেছে। শাশুড়ির অসুখের খবর পেয়ে।
চলে গেছে! ওরা হাঁ করে তাকাল।
কেউ দেখল না। চলে গেল।
কে আর দেখবে? রাত্রের প্লেনে চলে গেছে। হ্যাঁ, উড়োজাহাজে চড়ে উড়ে চলে গেছে মাসি মেমসাহেব।
ওরা নিশ্চয় মাসি মেমসাহেবের শাশুড়ি-ভক্তি দেখে ধন্য ধন্য করেছে। তা ছাড়া প্রশংসাও করেছে বিস্তর। বলেছে, এমন লোক হয় না। বলেছে, এরপর নতুন জায়গায় একা মেমসাহেবের খুব কষ্ট হবে। তারপর বকশিশ পেয়ে চলে গেছে।
নতুন বাগানে কেউ মাসি মেমসাহেবের নাম শোনেনি।
সেখানে শুধু সুমিতা, তার স্বামী-পুত্র নিয়ে সংসার করেছে। করেছে নিপুণ হাতে, অবলীলায়।
মরে গিয়ে কি নমিতা তার কর্মক্ষমতার ক্ষমতাটুকু তার চিরদিনের ভালবাসার দিদিকে দিয়ে গেল?
এটা একটা জিজ্ঞাসার চিহ্ন বইকী! যে চিহ্নটা আমার মনের মধ্যে চিরদিন খাঁড়ার মত উদ্যত হয়ে রইল।
কিন্তু এই আমিটা কে।
আমি কি সুমিতা? না আমি নমিতা? আমি যদি নমিতা হই, আমি তো তা হলে মারা গেছি। হ্যাঁ, প্রিয়মাধবের সেই বদলির তারিখে তো নমিতা মারা গেল। রইলাম শুধু আমি সুমিতা।
অথচ সুমিতাই হারিয়ে গিয়েছিল।
হ্যাঁ, সেই বদলির দিন গাড়িতে উঠবার আগের মুহূর্তে আসল সুমিতাকে আর দেখতে পাওয়া গেল না। সুমিতা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল।
.
সুমিতা কি কর্পূরের পুতুল ছিল?
তাই উবে গেল?
কী জানি কী ছিল সুমিতার মনে। বোঝা তো যেত না। মনে হত সোনারুপোর ও নয়, নেহাত মাটির পুতুল। কিন্তু মাটির পুতুল কি উবে যেতে পারে?
সুমিতা তবে কীসের পুতুল ছিল?
স্ফটিকের? ওর গায়ে কিছু লেগে থাকত না, তাই মনে হত খুব শক্ত। লেগে থাকত না? কে জানে। কিন্তু পুতুলটা হারিয়ে গেল। যেন বাতাসে উড়ে গেল।
ঘরে বারান্দায় ছাতে বাগানে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না তাকে।
চা বাগানের এলাকা থেকে হারিয়ে যাওয়া শক্ত, তবু সেই শক্ত কাজটা করে বসল সুমিতা।
অপটু সুমিতা যে এমন ভয়ানক একটা শক্ত কাজ করে বসতে পারবে এ কথা কে কবে ভেবেছিল?
অথচ সুমিতা তো পারল।
নিজেকে মুছে দিয়ে চলে গেল।
.
বিষ পোকা তা হলে ওকেই কামড়েছিল? যে পোকা আস্ত একটা মানুষকে খেয়ে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে পারে, মুছে দিতে পারে সবটা?
কিন্তু ঠিক সেই মোছার দিনটাকে কিছুতেই স্পষ্ট করে মনে আনা গেল না কোনওদিন। সুমিতা কি চলে যাবার সময় তার যমজ বোনের স্মৃতিশক্তিটাও মুছে দিয়ে গেল?
তাই শুধু খাপছাড়া খাপছাড়া কতকগুলো দৃশ্যের টুকরো যেন দাঁত খিঁচিয়ে ওঠে চোখের সামনে!
সেই দৃষ্টির ধাক্কায় সারাদিন পালিয়ে পালিয়ে, রাত্রে ভাঁড়ার ঘরের জাল আলমারিটার গায়ে ঠেশ দিয়ে বসে পড়ল নমিতা, দু হাতে চোখ চাপা দিল।
কিন্তু সেই ভয়ংকর দৃষ্টি তো আর চোখের সামনে ছিল না। সে যে নমিতার মনের উপর, নমিতার সমস্ত জীবনের উপর পুঁতে রেখে দিয়ে চলে গিয়েছিল সুমিতা।
নমিতা তাকে উপড়ে ফেলতে চেষ্টা করল, পারল না। নমিতা ঘরের সিলিংয়ের দিকে তাকাল, দেখল ওখান থেকে দড়ি ঝোলানো যায় কিনা।
দেখল কোম্পানি বাড়ি করবার সময় ভেবে দেখেনি হঠাৎ কারও এমন একটা দরকার পড়তে পারে। প্লেন পরিষ্কার সিলিং। তখন নমিতা ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে বাগানের দিকে বেরিয়ে এল, বাগানের বাইরের দিকে তাকাল, চোখের সামনে ঘন জঙ্গলাবৃত পাহাড়, দূরে দূরে ছড়ানো ছিটনো বাড়ি। আলো জ্বলছে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সেই আলোটা হয়তো দুচার মাইল দূরে। নমিতা হাঁটতে শুরু করলে কেউ কোথাও দেখতে পারে কি? কিন্তু কতটা হাঁটবে নমিতা? কোন দিকে, রাস্তায় কেউ দেখতে পাবে না? চা-বাগানের এলাকা যে শক্ত ঘাঁটি। এখান থেকে কি পালানো সহজ? যদি কেউ জিজ্ঞেস করে কে তুমি?কী পরিচয় দেবে নমিতা? রাতদুপুরে রাস্তায় বেড়ানোর কৈফিয়তই বা কী দেবে? খাদে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো সুযোগ জোগাড় করার আগেই যদি ওই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়? নমিতা বাগানের সীমানা থেকে সরে এল।
নমিতা ভাবল বিষ নামের জিনিসটা নমিতা আগে থেকে কেন সংগ্রহ করে রাখেনি? নমিতার জীবনে যে কোনও মুহূর্তে ওর দরকার পড়তে পারে, এটা নিশ্চয় ভাবা উচিত ছিল নমিতার।
নমিতা এ যাবৎ কেবল নিজের বুদ্ধির অহংকারে স্ফীত হয়েছে, অথচ নমিতা এত বড় একটা বোকামি করে রেখেছে।
নমিতা যখন বাগানের দরজায় দাঁড়িয়ে নিজের এই অপরিসীম মূঢ়তার জন্যে ধিক্কার দিচ্ছিল নিজেকে, তখন প্রিয়মাধবও সেখানে এসে হাজির হল। খুব ব্যস্ত গলায় বলল, তুমি একা? সুমিতা কই?
নমিতা ভুরু কোঁচকাল।
বলল, দিদি? সে রাতদুপুরে বাগানে বেড়াতে এসেছে, হঠাৎ এ কথা ভাবার হেতু?
তা হলে গেল কোথায়? কোথাও তো দেখছি না!
সর্বত্র ঘুরে বেড়াবার অবস্থা রয়েছে নাকি তার? বাথরুমে গেছে বোধহয়। নিশ্চিন্ত গলায় বলল নমিতা।
এক মিনিট আগেও যে নমিতা খাদে লাফিয়ে পড়তে যাবার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছিল, সে কথা বোঝ গেল না ওর গলার স্বরে।
প্রিয়মাধবই অসহিষ্ণু গলায় বলে উঠল, না না! সব দেখলাম তো! কোথায় গেল সে?
এ কি শুধুই প্রশ্ন?
না রুষ্ট অভিযোগ?
যেন সুমিতা কোথায় যায় না যায় তার খবর রাখার সব দায়িত্ব নমিতার। তাই প্রশ্নটা তীব্র। এই তীব্র প্রশ্নের ধাক্কায় বুকটা ধড়াস করে উঠল নমিতার।
আর সেই মুহূর্তে মনে হল তার, সুমিতা হারিয়ে গেছে, সুমিতাকে আর পাওয়া যাবে না!
আশ্চর্য, নমিতার সেই মুহূর্তের অনুমানটাই এমন সত্য হয়ে গেল?
আর একটা ছবির টুকরো দেখতে পায় নমিতা, তীব্র একটা টর্চের আলো দিকভ্রান্তের মতো এদিকে ওদিকে ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছে। বাইরের ঘন অন্ধকারের গায়ে সেই আলোটা যেন প্রেতের চোখের মতো ক্ষণে ক্ষণে জ্বলছে আর নিভছে।
তারপর ঘুরঘুটে অন্ধকারে দীর্ঘ একটা ছায়া ফিরে এসেছিল, পাগলের মতো আছড়ে পড়ে বলেছিল, নিশ্চয় ও খাদে ঝাঁপিয়ে পড়েছে নমিতা! আমি বুঝতে পেরেছিলাম, ওর মন ভেঙে গেছে।
.
সুমিতার মন ভেঙে গিয়েছে বুঝতে পেরেছিল প্রিয়মাধব, সুমিতার প্রাণের স্বামী, তবু সে সেই ভাঙা মনকে টেনে তুলে দাঁড় করাবার চেষ্টা করেনি। নমিতার তবে কীসের এত অপরাধবোধ?নমিতাও কেন তবে খাদের গভীরত্বর কথাই জপ করছে?
না, নমিতা দিশেহারা হবে না, নমিতা প্রিয়মাধবের মতো ছুটোছুটি করবে না, নমিতা শুধু দাঁতে দাঁত চেপে খোকাকে আগলে বসে থাকবে।
সন্ধের সময় আয়াকে যে ছুটি দিয়েছিল সুমিতা, সে কথা জানা গেল পরে। সুমিতা তাকে নাকি বলেছিল, কাল সকালবেলাই তো সাহেব বদলি হয়ে অন্য বাগানে চলে যাবেন, তুমি আর কী করবে? আজই তোমার বাসায় চলে যাও।বকশিশ দিয়েছিল অনেক।
আর সেইটাই তো সুমিতাকে খোঁজ পড়ার কারণ। বসবার ঘরে বসে অফিসের কাগজপত্র দেখছিল তখন প্রিয়মাধব, ওকে বলল, আচ্ছা। মেমসাহেব যখন ছুটি দিয়ে দিয়েছেন–
কিন্তু খানিক পরে কাগজপত্র তুলে রেখে ঘরের দরজায় এসে বলল, আজ থেকেই আয়াকে ছুটি দিলে কেন সুমিতা? আজ রাত কাল সকাল
ঘরে মশারি ফেলা ছিল, আর ঘরটা অন্ধকার ছিল, সাড়া না পেয়ে আলোটা জ্বালাল প্রিয়মাধব, দেখল শূন্য বিছানাটাকে ঘিরে মশারির ঝালরগুলো বাতাসে দোল খাচ্ছে।
নমিতার ঘরে?
না, নমিতার ঘরে নমিতার দিদির কোনও চিহ্ন নেই।
অথবা আছে।
সুমিতার জ্বলন্ত আর জীবন্ত চিহ্ন।
দোলা-খাটের বিছানায়, মশারির মধ্যে নিরুদ্বেগে ঘুমোচ্ছ।
প্রিয়মাধব উদ্বিগ্নচিত্তে এঘর ওঘর ভাঁড়ার ঘর রান্নাঘর সব দেখেছিল, দুই বোনের কাউকেই দেখতে পায়নি। ভেবেছিল, শেষলগ্নে দুই বোন তবে নির্ঘাত বাগানে বেড়াতে গেছে। রাগ হয়েছিল, ভেবেছিল এত কবিত্বর কোনও মানে হয় না। সাপখোপের দেশ–
তখন বাগানে এসেছিল।
হ্যাঁ, এসব পরে জেনেছিল নমিতা।
আরে, কী আশ্চর্য! নমিতা আবার কোথায় তখন? সুমিতা, সুমিতা। সুমিতা নামটাকে কর্পূরের মতো উবে যেতে দিলে চলবে কেন? সুমিতাই তো ম্যানেজার সাহেবের মেমসাহেব। মেমসাহেব হঠাৎ রাতারাতি উবে গেলে সাহেবের মান সম্ভ্রম থাকবে কোথায়?
অথচ নমিতা, যেনাকি শুধু মাসি মেমসাহেব, সে যদি সেই রাত্রেই তার শাশুড়ির জবর অসুখ শুনে উড়ে কলকাতায় চলে যায়, কোথাও কোনও লোকসান নেই।
আর যদি সেই উড়োজাহাজখানা হঠাৎ মাঝরাস্তায় হারিয়ে যায়, যদি কলকাতায় তার শ্বশুরবাড়িতে তাকে নামিয়ে না দেয়, কী উপায় আছে সেখানে টেলিগ্রাম করা ছাড়া?
বিষ পোকার কামড়ে মারা যাওয়া তো আসামের এই চা বাগানে অভূতপূর্ব ঘটনা নয়।
চট করে যে কোনও অবস্থাকে ম্যানেজ করে ফেলতে পারে বলেই তো এখানকার ম্যানেজার সাহেবকে বেকায়দায় জায়গায় চালান করা হচ্ছে চব্বিশ ঘণ্টার নোটিশে।
.
তবু প্রথমটায় ভয়ংকরভাবে এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল বইকী ম্যানেজার সাহেব। টর্চের ব্যাটারিটা জবাব না দেওয়া পর্যন্ত ঘুরে বেড়িয়ে আর আলো ফেলে ফেলে, শেষ অবধি অন্ধকারে ফিরে এসেছিল। আছড়ে পড়ে বলেছিল, নিশ্চয় ও খাদে ঝাঁপিয়ে পড়েছেনমিতা! দিনের আলো হলে দেখতে পেতাম।
নমিতা শুকনো গলায় বলেছিল, খাদে ঝাঁপিয়ে পড়েনি।
পড়েনি? তুমি জানো? তোমায় বলে গেছে?
নমিতার হাত জড়িয়ে ধরেছিল প্রিয়মাধব। আকুল আবেগে আত্মবিস্মৃতের মতো।
নমিতা হাত ছাড়িয়ে নিয়েছিল।
বলেছিল, বলে যায়নি, লিখে রেখে গেছে।
লিখে রেখে গেছে? লিখে রেখে গেছে? উদভ্রান্ত প্রিয়মাধব ছটফটিয়ে উঠেছিল, কই বলছ না এতক্ষণ?
দেখিনি। এতক্ষণ দেখিনি। এই মাত্র দেখলাম। আমার থান কাপড় আর সাদা ব্লাউজের ব্যাগটা খুলে চুরি করেছে একটা কাপড় আর ব্লাউজ, তার মধ্যে রেখে গেছে চিঠি আর তার শাড়ি গয়না।
নমিতার থান কাপড় পরে চলে গেছে সে! তার মানে হারিয়ে গেল নমিতা নামের পরিচয়টা!
তবে?
প্রিয়মাধব ছুটে গেল, দেখল সেই শাড়ি, গয়না, দেখল চিঠি, যাতে লেখা ছিল–আমায় খুঁজো না, আমি হারিয়ে গেলাম।
প্রিয়মাধব বলল, নমিতা, আমায় বাঁচাও! আমার মান-সম্ভ্রম, চাকরি, সন্তান, সব কিছু বাঁচাতে পারো একমাত্র তুমিই!
নমিতার অনেক বুদ্ধি, তবু নমিতা অবাক হয়ে বললে, তার মানে?
তার মানে তুমি ভুলে যাও তুমি নমিতা। তুমি সুমিতা হয়ে যাও। সুমিতা তোমার কাপড় চুরি করে পরে চলে গেছে। তুমিও তার শোধ নাও। তুমি তার নাম চুরি করো। নমিতা হারিয়ে যাক। নমিতা মুছে যাক।
আমি,
হ্যাঁ, তখনও আমি নমিতা ছিলাম।
আমি চমকে উঠলাম। আমি শিউরে উঠলাম। আমি ছিটকে উঠে বললাম, বলছেন কী আপনি?
প্রিয়মাধব আমায় জড়িয়ে ধরল। অভিনেতা প্রিয়মাধব হাহাকার করে বলল, এ ছাড়া আমার বাঁচবার কোনও উপায় নেই নমিতা! আজ সারাদিন পর্যন্ত এখানে আমার স্ত্রী ছিল, সন্তান ছিল, হঠাৎ কাল সকালে আমি একটা ছমাসের শিশু, আর বিধবা শালিকে নিয়ে নতুন একটা জায়গায় গিয়ে দাঁড়াব কী করে?
দাঁড়াতে হবে। আমাকেও বিদায় দিন।
বললাম আমি, নিজেকে রূঢ়ভাবে ছাড়িয়ে নিয়ে।
প্রিয়মাধব আবার হাহাকার করে উঠল। তা হলে খোকা? খোকাকেও তো তা হলে বাঁচানো যাবে না নমিতা? কেউ বুঝতে পারবে না নমিতা। অবিকল একরকম দেখতে তোমরা, শুধু সাজে তফাত দেখাত। সুমিতার সাজের খোলসে ঢুকে পড়লে কেউ ধরতে পারবে না। এ ছাড়া আমার বাঁচবার আর কোনও উপায় নেই নমিতা! আমাকেও তা হলে খাদে ঝাঁপ দিতে হবে।
তোমার উপায়টা তো খুঁজে বার করলে,আমি কঠিন গলায় বললাম, আর আমার বাঁচবার উপায়?
প্রিয়মাধব থতমত খেল!
প্রিয়মাধব বলল, কী বলছ?
বলছি, গয়না কাপড়ে গা ঢেকে তোমার স্ত্রী আর তোমার সন্তানের মা সেজে একা তোমার বাংলোয় গিয়ে উঠব আমি, আমায় কে রক্ষা করবে?
প্রিয়মাধব আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকাল। বোধহয় ওই রক্ষার প্রশ্নটা তার মাথায় আসেনি। বোধহয় নমিতাকে সুমিতা করে দেওয়ার মধ্যেই ও সব মুশকিলের আসান খুঁজছিল।
তাই কেমন যেন হয়ে গেল।
তারপর আস্তে বললে, আমিই করব।
আমিই করব!
ওই রক্ষাকবচ নিয়ে সুমিতার পরিত্যক্ত শাড়ি গয়না পরে নিলাম আমি। সুমিতার সিঁদুর-কৌটো থেকে সিঁদুর। সুমিতার ছেলে কোলে নিয়ে গাড়িতে গিয়ে উঠলাম। যারা বকশিশ নেবার জন্যে কাতার দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল গাড়ির ধারে, তারা কেউ ধরতে পারল না।
তারা মাসি মেমসাহেবের আকস্মিক অন্তর্ধানে আক্ষেপ প্রকাশ করতে লাগল।
.
নমিতার মৃত্যু হল।
সেই বিদীর্ণ খোলসে সুমিতার জন্ম হল।
নতুন জন্ম! দুটো সত্তার মেশানো একটা নতুন সত্তা নিয়ে ম্যানেজার সাহেবের ঘর করতে লাগল মেমসাহেব। নমিতার অফুরন্ত জীবনীশক্তি, আর সুমিতার গাম্ভীর্য, নমিতার দৃঢ়তা আর সুমিতার স্থিরতা এই দুইয়ের সংমিশ্রণে গঠিত নতুন মেমসাহেবকে ম্যানেজার সাহেব ভয় করে চলতে শুরু করল।
ক্রমশই ধরা পড়তে লাগল তার কাছে, মৃত্যুর খাদ কেটে তাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঁচতে চেয়েছিল সে। প্রিয়মাধব ক্রমশ বিকৃত হতে থাকল।
প্রথমটা বুঝতে পারেনি।
প্রথমদিন যেন অবিভূত গলায় বলেছিল, আরশির সামনে দাঁড়িয়ে দেখেছ তুমি তোমাকে? চিনতে পেরেছ?
আমি ওর ওই বিহ্বল অভিভূত দৃষ্টিকে প্রশ্রয় দিইনি, কড়াগলায় বলেছি, থামুন!
ও ম্রিয়মাণ হয়ে বলেছিল, এখন ধরা পড়ছে তুমি সুমিতা নও। সুমিতা কোনওদিন জোরে কথা বলত না। সুমিতা কোনওদিন ধমক দিয়ে ওঠেনি কাউকে, চাকরবাকরকেও না। কিন্তু তুমি যখন চুপ করে বসে ছিলেহ্যাঁ, এতক্ষণ তুমি যে ওই জানলার ধারটায় বসে ছিলে, যেন ধরতে পারিনি তুমি সুমিতা নও। অবাক হয়ে দেখছিলাম।
তবু আমি আরও কড়া হলাম।
বললাম, ওসব বাজে কথা রাখুন। যমজ বোন আমরা চিরদিনই একরকম দেখতে, এটা আপনার নতুন আবিষ্কার নয়। দিদিকে খোঁজার কী হবে তাই বলুন।
দিদিকে খোঁজার
ও যেন শেখানো মন্ত্রের মতো উচ্চারণ করল, দিদিকে খোঁজার?
রাগে আপাদমস্তক জ্বলে গেল। এই পরিস্থিতিতে ওর ওই ভাব বিহ্বলতা অসহ্য লাগল, বললাম, হ্যাঁ দিদিকে! কথাটা মাথায় ঢুকছে না নাকি?
ও এবার বিহ্বলতা ত্যাগ করল। যুক্তির গলায় বলল, ঢুকবে না কেন। কিন্তু পথ তো খুঁজে পাচ্ছি না। এ বাগানে তো এখন ভয়ংকর গোলমাল। আজই ভোর থেকে হঠাৎ ছোট ডিরেক্টর রবার্ট সাহেবকে নাকি দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। সবাই সন্দেহ করছে খুন হয়েছে সাহেব। অবস্থা আয়ত্তে আনতে পারব কিনা বুঝতে পারছি না। এই তো এক্ষুনি বেরিয়ে যাব, জানি না কখন ফিরতে পারব।
বললাম, তা হলে খোঁজা হবে না? ম্যানেজার সাহেবের কাছে স্ত্রীর চাইতে চাকরিই বড়?
ও বলল, বড় ছোটর কথা হচ্ছেনা, হচ্ছে সম্ভব অসম্ভবের কথা। এখন যদি আমি চাকরিতে রিজাইন দিতে চাই তার পরিণাম জেল, তা জানো? বন্ডে সই করে চাকরি নিয়ে এসেছি
আমি কিন্তু বিশ্বাস করলাম না ওর কথা, মনে করলাম ও আমাকে নিবৃত্ত করতে বাজে ভয় দেখাচ্ছে। তাই উড়িয়ে দিলাম ও কথা। বললাম, রাখুন ও কথা, দিদির মতন বোকা পাননি আমায় যে, যা ইচ্ছে বুঝিয়ে ভয় খাইয়ে রাখবেন। বেশ তো, নিজে সময় না পান খোঁজবার জন্যে তোক লাগান।
ও বিমূঢ় গলায় বলল, লোক? লোকের কাছে বলব? তবে তোমাকে এই শাস্তি দেবার অর্থ?
আমি মনে মনে কেঁপে উঠলাম ওর কথায়। মনে হল ও তো বলছে শাস্তি, কিন্তু আমার কাছে কি আমার এই অদ্ভুত রূপান্তর সত্যি শাস্তি হয়েই দেখা দিয়েছে? আমি বাদ প্রতিবাদ করছি বটে, তবু কি এই অচিন্তনীয় পরিস্থিতি আমাকে একটা উগ্র রোমাঞ্চের স্বাদ এনে দিচ্ছে না? ঝাল আচারের মতো আকর্ষণীয় এই স্বাদ কি আমার তারিয়ে তারিয়ে পেতে ইচ্ছে করছে না? ঝালে চোখে জল এলেও।
করছে।
বোধ করি মদের আস্বাদ এই রকমই।
শুনেছি সে স্বাদেও নাকি বুক জ্বলে যায় পেট জ্বলে যায়, তবু মাতাল সেই জ্বালাতেই ডুবে থাকতে চায়। আমিও একটা তীব্র জ্বালাময় অনুভূতির রসে জারিত হচ্ছিলাম, তবু মান মর্যাদা রাখতে ওর সঙ্গে বাদ প্রতিবাদ করছিলাম আমি দিদিকে খোঁজা নিয়ে।
কিন্তু শুধুই কি মান মর্যাদা রাখতে?
দিদির জন্যে কি ভয়ংকর একটা শূন্যতা বোধ করছিলাম না? তাও করছিলাম। হাহাকার করছিল প্রাণ, আর ভয়ংকর একটা অপরাধবোধের ভারে শিথিল হয়ে যাচ্ছিলাম। আর সেই ভারাক্রান্ত হৃদয়ের ভার হালকা করতে অনবরত ওকে আঘাত হানতে ইচ্ছে করছিল, ওকে দোষী সাব্যস্ত করতে ইচ্ছে করছিল। তাই বাদ প্রতিবাদের চেহারাটা অনেকটা এই ধরনের হয়েছিল।
ওর ওই বিমূঢ় প্রশ্নের উত্তরে আমি বলেছিলাম, আমার শাস্তির জন্যে মাথা ঘামাবার দরকার নেই। লোককে জানাবেন তো–কি নিজে উদভ্রান্ত প্রেমিকের মতো পথে পথে সুমিতা সুমিতা করে খুঁজে বেড়াবেন? বেশ তো রাষ্ট্র করুন গে ম্যানেজার সাহেবের শালিই হারিয়ে গেছে
সে পথ তো আগেই বন্ধ করে রেখেছি, লোকে তো জানে সে কলকাতায় চলে গেছে।
ধরে নিন কলকাতা থেকে খবর এসেছে পৌঁছয়নি সেখানে। পথের মাঝখানে অথবা পথের প্রথমেই কোথাও হারিয়ে গেছে।
লোকে হাসবে মুখ ফিরিয়ে। বলবে বয়েসটা অবশ্য হারানোরই মতো। রূপটাও কম যায় না।
তা হলে দিদি সত্যিই মুছে যাবে?
যদি তার ভুল ভাঙে, অভিমান ভাঙে, যদি নিজে থেকে এসে
ওর কথা থামিয়ে তীব্র স্বরে বলেছিলাম, এ বিশ্বাস আপনার আছে?
ও কেঁপে উঠল।
বলল, ভাগ্যের কাছে প্রার্থনা করছি। তারপর হঠাৎ বলে উঠল, সর্বনাশ, কত দেরি করে ফেললাম, এক্ষুনি বেরোতে হবে, দেখি ভেবে।
সাজপোশাক করে ছুটে বেরিয়ে গেল ও, আর বেরিয়ে পড়বার পরই বিছানায় আছড়ে পড়লাম। আমি, ও যে সকাল থেকে কিছু খায়নি, সেটা মনে পড়ল ও বেরিয়ে যাবার পর। মনে হল ওর পিছু পিছু ছুটি, ওকে পায়ে ধরে ফেরাই।
আশ্চর্য, ওকে আঘাতে আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলতে ইচ্ছে করে, অথচ ওর জন্যে নিজের প্রাণ এমন বিদীর্ণ হতে চায় কেন? চিরজীবন ওর সঙ্গে এই সম্পর্ক থাকল আমার। ওকে জড়িয়ে ধরতে প্রাণ শত বাহু মেলে এগিয়ে যেতে চায়, আবার ওকেই ছোবল হানবার জন্যে জিভ যেন উগ্র ক্ষুধায় উন্মুখ হয়ে থাকে।
.
সেদিন অনেক রাত্রে ফিরল ও।
সারাদিন আমিও অভুক্ত থেকেছি, কিন্তু যেমন করে বিছানায় পড়ে থাকতে ইচ্ছে হয়েছিল, ওকে সেই অভুক্ত অভিমানহত মূর্তিটা দেখাতে বাসনা জাগছিল তেমন আর হল কই? দিদি যে লোহার শিকল পরিয়ে দিয়ে গেছে আমার গলায়। খোকার জন্যে উঠতে হয়েছে আমায়, সবই করতে হয়েছে।
নিজের কাছে অস্বীকার করব না, সেই বাধ্য হয়ে করার বিরক্তিতে খোকার উপর ভয়ানক একটা আক্রোশ অনুভব করেছি সেদিন, অবাক হয়ে ভেবেছি এই বিরক্তিকর বস্তুটাকে নিয়ে দিদির সঙ্গে হারজিতের খেলা খেলে মরেছি আমি? দিদিকে মেরেছি সেই খেলার রেজাল্টে!…
কেন?
দিদি থাকতে খোকার সব কাজই আমি করেছি, কিন্তু তা কাজ বলে মনে হয়নি। ফুলের মতো পাখির পালকের মতো বাতাসের মতো হালকা সেই কাজের ভার অবলীলায় বহন করেছি। কিন্তু দিদিহীন শূন্য বাড়িটায় খোকার ভার যেন পাহাড়ের ভার হয়ে উঠছে।…এ ভাব কাটিয়ে উঠতে অনেকদিন লেগেছিল।
সেদিন ও ফিরল অনেকটা দেরি করে।
সম্পূর্ণ নতুন জায়গায় অত রাত পর্যন্ত একা কীভাবে যে কেটেছে আমার অন্তর্যামী জানেন। সামান্য একটু শব্দে মনে হচ্ছে বুকের মধ্যে পাহাড় পড়ছে। সারা বাড়িটা যেন একটা নিঃশব্দ পৈশাচিক হাসির মূর্তি নিয়ে ঘিরে ধরছে দাঁত বসাবে বলে। ওই ভয়ংকরতার মাঝখানে থেকে থেকে খোকার কান্নাটা যেন একটা জান্তব চিৎকারের মতো লাগছিল।
খোকা তো কই কোনওদিন এমন কাঁদত না।
তবে কি ও সব কিছু বুঝে ফেলেছ? তবে কি ও ওর মাকে চিনত? এরপর ও ধরে ফেলবে আমি ওর মা নই, আমি ছদ্মবেশী! আমি পিশাচী, আমি ওর মার হত্যাকারিণী?
এমনি একটা অস্বাভাবিক চিন্তায় ক্রমশই আমার সব শক্তি হারিয়ে ফেলছিলাম, তারপর যখন রাত বেড়ে উঠল, খোকা ঘুমিয়ে পড়ল, তখন হঠাৎ মনে হতে থাকল এ ঘুম থেকে আর উঠবে না খোকা। খোকা আমাদের উপর ঘৃণায় ধিক্কারে ওর মার কাছে চলে গেছে। খোকা মরে গেছে।
মৃত সন্তানের শিয়রে একা বসে থাকা মায়ের মতোই অসহ্য যন্ত্রণার আবেগে কাঁপতে থাকলাম আমি, আর সেই সময় প্রিয়মাধব এল।
আমি ধৈর্য হারালাম, জ্ঞান হারালাম, এতদিনের সযত্ন লালিত মান মর্যাদা সব হারালাম, ছুটে গিয়ে ওর গায়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। দু হাতে ওকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বলে উঠলাম, কেন? কেন? কেন তুমি আমায় ফেলে পালিয়ে গিয়েছিলে?
হ্যাঁ, ঠিক সেই মুহূর্তে আবিষ্কার করলাম আমার এতক্ষণকার বহুবিধ যন্ত্রণার জনক ছিল ওই ভয়। আমার সুপ্ত চেতনার মধ্যে ওই ভয় কাজ করছিল। সেই ভয়ে দিশেহারা হচ্ছিলাম আমি।
আমার এই দুর্বলতার সুযোগ ও ছাড়ল না।
অথবা ও সাংঘাতিক রকমের দুর্বল হয়ে পড়েছিল, তাই ও আমাকে যেন দুহাতের মধ্যে পিষে ফেলতে চাইল। যেন মনে হল ওর সমস্ত দেহমন এই আবেগের আছড়ানির জন্যে তৃষিত হয়ে ছিল।
সুমিতা ওকে ভালবাসা দিয়েছে, আবেগের স্বাদ দেয়নি।
কিন্তু সেদিন আমাকে ঈশ্বর রক্ষা করলেন।
সেদিন ও রাত অবধি সাহেবদের ক্লাবে বসে মদ খেয়ে এসেছিল।
ওর সেই মদ খাওয়া আমার কাছে সেদিন বিরাট একটা শুভগ্রহ হয়ে দেখা দিল। নইলে–
হ্যাঁ,নইলে কে বলতে পারে কী ঘটতে পারত সেদিন। হয়তো অনিবার্যই ছিল সেই ঘটনা, আর সেই অনিবার্যতার পথ ধরে আমাদের এই অস্বাভাবিক জীবনের ইতিহাসই যেত পালটে। জানি না সেই পালটানোটাই শুভ ছিল কিনা। হয়তো তা হলেই সহজ আর স্বাভাবিক হতে পারতাম আমরা। পৃথিবীর আরও অনেক হাজার হাজার মানুষের মতো সাধারণ আর স্বাভাবিক।
কিন্তু তা হল না।
কারণ ও সেদিন মদ খেয়ে এসেছিল।
আর সেই উন্মাদ মুহূর্তের পরক্ষণেই আমার মনে হয়েছিল ওর এই মদ খাওয়াটা আমার পক্ষে বিরাট একটা শুভগ্রহ।
ওর বাহুবন্ধনের মধ্যে আটক পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ওর মুখটা ঠেলে দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম আমি। হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, তুমি মদ খেয়ে এসেছ?
সেই বোধহয় প্রথম তুমি বললাম।
আবেগে দুঃখে ধিক্কারে ঘৃণায় আর বোধ করি পরমুহূর্তেই ভয়ংকর একটা বিপদ থেকে মুক্ত হওয়ায়।
আমার সেই প্রশ্নটা কতখানি তীব্র হয়েছিল তা আমি জানি না। আমার মনে নেই, সেটা মানুষের স্বর হয়েছিল, না জানোয়ারের।
তবে তারপরে ওর গলার স্বরটা শুনতে পেয়েছিলাম। ক্ষুব্ধ আহত দুঃখী মানুষের মতো।
খেয়েছি! না খেয়ে কী করব? আমাকে তো বাঁচতে হবে!
আমি বলে উঠলাম, বাঁচবার জন্যে বিষের শরণ? বাঃ বেশ চমৎকার! নিজের সেই ক্ষণপূর্বেরক্ষণিক দুর্বলতা প্রকাশ করে ফেলার গ্লানি আবার ওর উপরই ছোবল হানতে চাইল। বললাম–মনে হচ্ছে এমনই একটা নাটকীয় জীবনই তোমার কাম্য ছিল। দিদি সরে গিয়ে পথ পরিষ্কার করে দিয়ে গেল।
হঠাৎ প্রিয়মাধব একটা অপ্রত্যাশিত তীব্র চিৎকার করে উঠল, চুপ! আর একবারও যেন শুনতে না হয় ও নাম। দিদি, দিদি, দিদি! দিদি বলে কেউ নেই, কোনওদিন কেউ ছিল না বুঝলে? তুমি সুমিতা, আমার বিবাহিতা স্ত্রী! তুমি তোমার বাবার একমাত্র মেয়ে। যমজ বোন বলে কিছু ছিল না তোমার।
আমি আমার ফণা বার করলাম।
বললাম, তা বটে। তা হলেই নিষ্কণ্টক সুখ সুবিধেটা জোটে। তাই না? বিধবা শালি তবু ভয়ের, বিবাহিতা স্ত্রীকে যা খুশি করা যায়–
ও আহত হয়ে বলল, আমার সাহস ছিল না! তুমিই
কথাটা সত্যি।
কিন্তু সেই সত্যি কথাটা মেনে নেওয়া তো মস্ত পরাজয়। তাই গম্ভীরভাবে বলালাম, একবার বাজিয়ে নিলাম!
বাজিয়ে নিলে?
হ্যাঁ! দেখলাম টাকাটা খাঁটি না মেকি।
কী দেখলে? মেকি?
তা আবার বলতে। বললাম আমি নিষ্ঠুর গলায়, স্রেফ দস্তার টাকা। ছি ছি! এই নিয়েই এত বড়াই ছিল দিদির!
আর যদি তোমার কথা বিশ্বাস না করি? যদি বলি ওই বাজিয়ে নেওয়া বানানো।
বলো। বলতে তো পয়সা লাগে না। ভগবান মুখ দিয়েছে বলবার জন্যে।
ওকে অপদস্থ করতে করতেই নিজের শক্তি ফিরে পাচ্ছিলাম ক্রমশ, তাই ওকে ছাড়লাম না। শেষ পর্যন্ত ওকে ধিক্কারে জর্জরিত করে খোকার মাথায় হাত দিইয়ে শপথ করালাম কোনওদিন আমার দিকে হাত বাড়াবে না।
ও মন্ত্রাহতের মতো করল সেই শপথ। প্রথম মদের নেশা ওকে আবেগে উত্তাল করে তুলেছিল, তাই যখন মোড় ঘুরল, তখন ভাল করেই ঘুরল।
তবু পরে বলেছিল, আর নমিতা, যদি তুমি নিজে না পারো?
ভুরু কুঁচকে বললাম, বটে? তা বেশ তো, তেমন অপারগ অবস্থা হয়, নিজে এসেই তোমার শরণ নেব।
আর আমি যদি শপথ না রাখতে পারি? আমি তো আজ মাতাল হয়েছি, মাতালের শপথের মূল্য কী?
মনে রেখো খোকার কল্যাণ অকল্যাণ এতে জড়িত।
ও চুপ করে গেল।
মনে হল যেন শিউরে উঠল।
আমি পরিস্থিতি হালকা করতে, প্রসঙ্গ পরিবর্তন করলাম। বললাম, সাহেবদের ক্লাব থেকে তো বেশ ভাল জিনিসই খেয়ে এসেছ, সারাদিনের উপোসের পারণ হয়ে গেছে বোধহয়?
ও চমকে বলল, সারাদিন? ওঃ তাই তো! তুমিও খাওনি?
আমি ভাঙব তবু মচকাব না।
আমি আমার সেই ক্ষণিকের দুর্বলতার শোধ তুলব! তাই আমাকে বলতে হল, কেন আমি খাব না। কেন? ম্যানেজার সাহেবের স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করছি বলে কি সত্যিই হিন্দুবিবাহের পতিব্রতা-স্ত্রী হয়ে গেছি নাকি?
খেয়েছ? তবু ভাল। আমি মানে কিছু খাব না। হয়ে গেছে কিছু খাওয়া দাওয়া। রবার্ট সাহেবকে পাওয়া গেল, তারই আহ্লাদে খানাপিনা হল–
কোথায় পাওয়া গেল সাহেবকে, কৌতূহল হলেও, সে প্রশ্ন করলাম না আমি। আমার সারাদিনের উপবাসক্লিষ্ট দেহ ওর এই নির্লজ্জ স্বীকারোক্তিতে যেন দপ করে জ্বলে উঠল। তাই আবার বিষদাঁত বসালাম।
বললাম, বাঃ চমৎকার! একেই তো বলে পুরুষ! মেয়ে হলে স্বামী বিয়োগে বাকি সারাজীবন হবিষ্যি করে মরত! আর এ দেখ মাত্তর কাল জলজ্যান্ত বউটা হারিয়ে গেল, আর সাহেব আজ খানাপিনা করে টগবগ করতে করতে এলেন যদি আরও কিছু লোভনীয় খাদ্য জোটে এই আশায়।
ও বলল, নমিতা, জানতাম তুমি নিষ্ঠুর। কিন্তু এত নিষ্ঠুর তা জানতাম না।
প্রথম দিনের ইতিহাস এই। ও বলল, জানতাম না তুমি এত নিষ্ঠুর!
.
কিন্তু আমিই কি ছাই জানতাম আমি এত নিষ্ঠুর!
ও তো বারে বারেই ভেঙে পড়েছে, বারে বারে বলেছে, নমিতা, মুখের শপথটাই কি সব? তুমি কি বুঝতে পারছ না আমি আর পারছি না!
আমি খোকার মাথায় হাত দেবার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছি। অথচ প্রতি মুহূর্তে কামনা করেছি ও ওর শপথ ভাঙুক! ও বন্য হয়ে উঠুক, পশু হয়ে উঠুক।
আমি জানি না কে আমার মধ্যে বসে থেকে আমাকে সমস্ত সুখের স্বাদ থেকে বঞ্চিত করেছে। আমার তৃষ্ণার জলের পাত্র মুখের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে মাটিতে ফেলে দিয়েছে।
সে কি দিদি?
না আমার আজন্মসঞ্চিত সংস্কার?
না কি বিবেক?
বিবেক-টিবেককে আমি বিশ্বাস করি না, মনে হয় দিদিই তার অশরীরী আত্মার ভার দিয়ে আমাকে গ্রাস করে রেখেছে চিরদিন। দিদির সেই চোখকে আমি কোনওদিন উপড়ে ফেলতে পারিনি।
সে চোখ অহরহ আমার সঙ্গে সঙ্গে ফিরে পাহারা দিয়েছে। খোকাকে কোনওদিন এতটুকু অযত্ন করে ফেললে মনে হয় সেই চোখ ব্যঙ্গ হাসি হেসে বলছে, কেন? এখন কেন? খুব যে কেড়ে নিয়েছিলে?
আর যখন প্রিয়মাধবকে ফিরিয়ে দিই?
তখনও কেন সেই চোখ স্নিগ্ধ হয় না, কোমল হয় না? তখনও কেন আরও তীব্র ব্যঙ্গের ছুরি উঁচিয়ে বলে, সে কী? কেন? আর তো কোনও বাধা নেই। চিরদিনের সাধ মিটিয়ে নিচ্ছ না কেন?
হ্যাঁ ফিরিয়ে দিতে হত প্রিয়মাধবকে।
প্রায় প্রতিদিনই।
রাত্রে শুতে যাবার আগে খোকাকে দেখবার ছুতোয় ও আমার ঘরে এসে আর উঠতে চাইত না, এটা ওটা কথায় সময়কে ঠেলে ঠেলে দিত। তারপর একটুখানি ভিখিরির হাসি হেসে বলত, ঘরটা ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না।
বলত, পাশাপাশি ঘর, তবু এ ঘরটা এমন মোলায়েম গরম, আর ও ঘরটা অমন হিম হিম ঠাণ্ডা মনে হয় কেন বলো তো?
আমি খোকার জন্যে সোয়েটার টুপি কি মোজা বুনতে বুনতে নির্লিপ্ত গলায় বলতাম, ইচ্ছে হয় ঘরটা বদলে নিতে পারো। বলো তো কালই চাকরদের দিয়ে খাট বদলে নেব।
ও বলত, কী নিষ্ঠুর!
তারপর বলত, আচ্ছা জগতে শুধু শপথই আছে, তার কাটান আর কিচ্ছু নেই?
আমি বলতাম, থাকবে না কেন? না মানলেই কাটান! পশুপক্ষী জন্তু জানোয়ারের তো আবার শপথেরও বালাই নেই।
হ্যাঁ, এইভাবে প্রতিনিয়ত অপমান করতাম ওকে। আমার সমস্ত ব্যর্থতা, সমস্ত যন্ত্রণা, সমস্ত ক্ষুধা, ওর উপরেই গিয়ে আছড়ে আছড়ে পড়ত পাথরের গায়ে নদীর ঢেউয়ের আছড়ানির মতো।
ধাক্কায় ধাক্কায় ক্রমশ বিকৃত হতে থাকল ও। ২৯৬
কিন্তু আমি?
যে আমি নমিতাও নই, সুমিতাও নই। হয়তো বা কিছুই নই।
আমি অবিকৃত থাকছি?
এখন যে আর ছেলের অসুখ করলে রাত জাগতে প্রিয়মাধবের সঙ্গে একসঙ্গে রাত জাগা চলবে না, একথা তো আমাকেই বলতে হবে?
ছেলের সূত্র ধরে ঘনিষ্ঠতার সীমারেখা লঙ্ঘন করতে এলে ওকে অপমান আমাকেই তো করতে হবে?
আর ও যখন হতভাগ্যের মতো আমার পায়ের কাছে বসে পড়ে বলবে, তোমায় তো আমি সুমিতা ছাড়া আর কিছু ভাবছি না নমিতা, তবে কেন তুমি এমন মুখ ফিরিয়ে থাকবে?
তখন তো আমাকেই বিদ্রুপের হাসি হেসে বলতে হবে, জীবনটা নাটকভেল নয়!
তবু নাটকনভেলের মতোই করেছে প্রিয়মাধব।
দিনের পর দিন আমার কাছে এসে আছড়ে পড়েছে, তুমি সুমিতা হও, তুমি সুমিতা হও, নমিতা! তুমি তো আমায় চিরদিন ভালবেসে এসেছ, আমি তো তোমার মন জানি, তবে এত দ্বিধা কেন তোমার? তোমার চিরদিনের অপূর্ণ জীবন পরিপূর্ণ করে তোলো তুমি সুমিতার পানপাত্রে।
আমি কি কেঁপে উঠতাম?
আমার শিরায় শিরায় রক্তধারা কি উন্মাদ হয়ে উঠত না? আমার কি মনে হত না, কী লাভ আমার এই মিথ্যা মর্যাদার ভানে? চিরদিন যে স্বর্গের দিকে জ্বালাভরা লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে এসেছি, সে স্বর্গ যদি হাতের মুঠোয় আসতে চায়, কেন নেব না আমি?…
মনে হত।
তবু আমার চিরদিনের অহমিকা আমার সেই ভোগের পাত্র ধরতে যাবার বাড়ানো হাত চেপে ধরত। আমি ব্যঙ্গ হাসি হেসে বলতাম, হ্যাঁ, সুমিতা দেবীর ফেলে দেওয়া পানপাত্র।
৫. অন্য সুর
এরপর প্রিয়মাধব অন্য সুর ধরেছিল। বলত, স্বাভাবিক জীবন থেকে চ্যুত হয়ে স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যাচ্ছে আমার। প্রকৃতির প্রতিশোধ হঠাৎ একদিন কিছু একটা কঠিন রোগে না পড়ে যাই।
আমি কটু হতাম।
বলতাম, এ অঞ্চলে স্বাস্থ্যরক্ষার ওষুধের তো অভাব নেই। খুঁজতে হবে না, ইচ্ছে করলেই মিলবে। প্রিয়মাধব এই কটু কথায় আহত হত।
দু-চারদিন চুপ করে থাকত।
কিন্তু আসামের ওই ভয়ংকর বর্ষার রাতগুলো কি চুপ করে ঘুমিয়ে থাকবার?
আমিই কি পেরেছি চুপ করে ঘুমিয়ে থাকতে?
জেগে উঠতাম।
ভয়ংকর কিছু একটার প্রতীক্ষা করতাম। মনে হত বাজ পড়বে, সব জ্বলে খাক হয়ে যাবে।
কিন্তু পড়ত না সেই বাজ।
শুধু দরজার বাইরে দ্রুত পদধ্বনি আরও দ্রুত হত।
.
তারপর একদিন, খোকা তখন বছরখানেকের, সেই বাজ পড়তে এল। দরজার কাছে পায়ের শব্দ থামল। দরজায় ধাক্কা পড়ল।
সুমিতার খোলস সেই ধাক্কার আঘাত সইতে পারল না। প্রিয়মাধবের স্ত্রী সেজে প্রিয়মাধবের সন্তানকে নিয়ে যে শুয়ে রয়েছে, সে সহসা বিভ্রান্ত হল।
দরজা খুলে ফেলল।
বলল, কী? কী চাই?
প্রিয়মাধব বলল, আর কিছু শুনতে চাই না, তোমায় চাই। তোমায় সুমিতা করে নিতে চাই। নমিতা তো মরে গেছে। তবে নমিতার ভূত সুমিতাকে আগলে থাকবে কেন?
সুমিতার খোলস সেদিন ওই কেনর উত্তর খুঁজে পাচ্ছিল না। সে শুধু বলে উঠেছিল, তোমার পায়ে পড়ি। তোমার পায়ে পড়ি। তোমার পায়ে পড়ি।
সেই ভয়ংকর মুহূর্তে সুমিতার খোলসকে রক্ষা করল সুমিতার ছেলে। সুমিতার ছেলে বোধ করি হঠাৎ ঘরের মধ্যে নতুন কণ্ঠস্বরে চমকে জেগে উঠল। জেগে উঠে পরিত্রাহি কান্না ধরল।
শিশুও বোধ করি পশুর মতো ভাবী অমঙ্গলের ছায়া দেখতে পায়। অকল্যাণ থেকে সাবধান করবার চেষ্টা করে সহজাত শক্তিতে।
অরুণমাধবের সেই কান্নাটা না হলে সে রাত্রে অমন অস্বাভাবিক হয়েছিল কেন? কাঁদতে কাঁদতে তড়কা হয়ে গিয়েছিল কেন?
তারপর থেকে আছড়ানি থামল প্রিয়মাধবের। ধীরে ধীরে বোধ করি স্বাস্থ্যরক্ষার সহজ পথ বেছে নিল সে।
.
কিন্তু প্রথম প্রথম ওর সেই ভয়ংকর সহজটা সহ্য করে নিতে আমি যে যন্ত্রণা ভোগ করেছি সে কি লিখে উঠতে পারব আমি?
আমি দেখছি–চোখ মেলে দেখছি, প্রিয়মাধব বাগানের পিছনের ঘরটায় কোনও একটা দেহাতি মেয়েকে নিয়ে আসছে, দেখছি প্রিয়মাধব অনেক রাত্তির পর্যন্ত বাইরে কাটিয়ে মত্ত অবস্থা বাড়ি ফিরছে, দেখছি প্রিয়মাধব সকালবেলা মানের আগে খোকাকে ছুঁচ্ছে না।
দেখছি বুঝতে পারছি প্রিয়মাধব হৃদয় বেদনায় কাতর হয়ে হৃদয় খুঁজতে বেরোচ্ছে না, ওর যন্ত্রণা নিছক স্থূল। তাই নীচ সংসর্গ করছে প্রিয়মাধব। অসহ্য জ্বালা নিয়ে সহ্য করছি সেই বুঝতে পারা।
বারণ করব কোন মুখে?
ধিক্কার দেব কোন ভাষায়?
ওকে এ রাস্তার পথ দেখিয়ে দিয়েছি তো আমিই। আমি ওকে আছড়ে ভেঙে চুর করলাম, নতুন মূর্তিতে গড়তে পারলাম না। দিদির মন্দিরের দেবতাকে রাস্তার ঢেলা করে ফেলে দিলাম আমি।
আমি কি তবে আত্মহত্যা করব?
আত্মহত্যা!
আশ্চর্য! এই শব্দটা চিরদিন আমাকে আশার গান শোনাল, আমাকে সোহাগের হাতছানি দিল, আমাকে মুক্তির দরজা দেখিয়ে দেবার অঙ্গীকার করল, অথচ ওর শরণাপন্ন হলাম না আমি। আমি শুধু ওকে যখন ইচ্ছে ভোগ করব এই মনোভাব নিয়ে আদরে লালন করলাম। কিন্তু ভোগ করলাম কই?
আমার ভাগ্যবিধাতা আমার ভোগের ঘরটা শূন্য রেখেছিল বলেই কি ওই কী যত্নে লালিত বস্তুটাও ভোগ করা হল না?
নইলে কেন আমি ওই আত্মহত্যা নামের মধুর আশ্বাসবাহী সোহাগের হাতছানি দেওয়া প্রেমিকের কাছে ধরা দিলাম না? সারাজীবন শুধু ওর ডাককে সরিয়েই রাখলাম।
প্রাণের মায়া কি আমার বড় বেশি?
কই, তাও তো মনে হয় না।
নিজের দিকে যুক্তি খাড়া করতে থোকাকে সামনে খাড়া করেছি, ভেবেছি কারণ খোকা। দিদিকে যদি খুঁজে পাওয়া যায়, তন্মুহুর্তেই আমি গলায় দড়ি পরিয়ে ঝুলে পড়তে পারি।
হ্যাঁ, বহুকালাবধি দিদিকে খুঁজে পাওয়ার কথা ভেবেছি আমি। যদিও প্রিয়মাধব সব সময় বলত, সে এ পৃথিবীতে নেই! সে আর আসবে না। বলত, সে স্বর্গের দেবী ছিল স্বর্গে চলে গেছে।
কিন্তু আমার আশা ছিল, দিদি আসবে।
আমার ভয় ছিল, দিদি আসবে।
এই ভয় আর আশা নিয়ে জীবন কাটিয়েছি আমি। সব দিকেই ভয় আর আশা।
প্রিয়মাধবকে নিয়ে ঘর করছি ভয় আর আশা, অরুণমাধবকে নিয়েও ভয় আর আশা। হ্যাঁ অরুণকে নিয়েও সেই দ্বন্দ্বদোলা।
ও হয়তো সত্যিই মা মনে করছে আমায়। ও হয়তো বুঝতে পারবে আমি ওর মা নই।
আমার ছদ্মবেশ ধরা পড়ে গেলে ও হয়তো আমাকে ঘৃণা করবে। আমার যন্ত্রণা টের পেলে হয়তো ও আমায় মমতা করবে।
এই জীবন আমার!
আনাড়ি এক মাঝির নৌকোয় চড়ে বর্ষার গঙ্গায় খেয়া পার হওয়া যেন! নৌকোর কানা চেপে ধরে ভাবনা, ডুবল বুঝি, ডুবল বুঝি।
কিন্তু প্রিয়মাধব যেন ক্রমশ সুস্থ হতে লাগল। ওর সেই বিকৃত জীবনটা যেন আর একটা সত্তায় ভর করে রইল ঘরের বাইরে, পারিবারিক গণ্ডির বাইরে, ঘরের ভিতরকার মানুষটা বিরাজ করতে লাগল আর একটা সত্তায়।
আর ক্রমশই আগের মতো হাসিখুশি হতে থাকল, অরুণমাধবকে কেন্দ্র করে চলতে লাগল এই অদ্ভুত সম্পর্কের দুটি নরনারীর সংসার।
আরও বার দুই বাগান বদল হল প্রিয়মাধবের। নতুন নতুন পরিবেশে একেবারে মেমসাহেব হয়ে গিয়ে দিব্যি মানিয়ে গেল নতুন মেমসাহেব।
নমিতা সুমিতার খোলসটাই শুধু আঁটল। সুমিতা হতে পারল না। তবু নমিতার উপর রাগ করল না প্রিয়মাধব। যেন মনকে মানিয়ে নিল। চার আনা বাদ দিয়ে বারো আনাতেই সন্তুষ্ট থাকতে শিখল।
তাই অরুণমাধব জ্ঞানাবধি শুনতে লাগল, সুমিতা, সুমিতা, সুমিতা।
সুমিতা, দেখ তোমার ছেলের কাণ্ড, সুমিতা, দেখ তোমার ছেলের বুদ্ধি, সুমিতা, দেখ তোমার ছেলের দুষ্টুমি!
সুমিতার সংসার, সুমিতার ছেলে, সুমিতার স্বামী!
যা কিছু হিংসের ছিল আমার, সবই পেলাম আমি।
কিন্তু এই কি পাওয়া?
আমি যদি সুমিতার সঙ্গে লড়াই করে জিতে নিতে পারতাম তার ঐশ্বর্য, সে পাওয়ায় হয়তো শান্তি ছিল না, তবু গৌরব ছিল।
এ পাওয়ায় আছে কী?
সুমিতার ঘৃণাভরে ত্যাগ করে যাওয়া ছেঁড়া জুতো মাথায় করে বইব আমি ঐশ্বর্য বলে!
এই ঘৃণা সুমিতার ঐশ্বর্যকে ভোগ করতে বাধা দিয়েছে আমায়, এই ঘৃণা আমাকে কিছুতেই সুমিতা হতে দেয়নি।
না, সুমিতা হতে পারলাম না আমি। সুমিতা হারিয়ে গেল। নমিতা মরে গেল।
আর ওই দুটো শবদেহের ভেলায় চড়ে অদ্ভুত একটা প্রাণী সংসার ঠেলতে লাগল। ছেলে মানুষ করে তুলতে লাগল।
.
কম বয়সে কবিতা লিখেছি।
সুমিতার চা বাগানের সংসারেও লিখেছি।
এখন সে কথা ভাবলে অবাক লাগে।
আরও অবাক লাগে ভেবে, এত কথা আমি লিখছি কেন?
আমি কি আমার বোনের ছেলে অরুণমাধবের কাছে সাফাই গাইতে চাইছি?… না, শুধু যন্ত্রণার কবল থেকে মুক্ত হবার আর কোনও উপায় পাচ্ছি না বলেই?
লোকে বলে, মিসেস মুখার্জি, প্রিয়মাধব বলে, সুমিতা।
আমিও সুমিতার গয়না, কাপড়, আসবাব, শখের জিনিস, সব কিছু দখল করে দেখি সুমিতা হতে পারি কিনা।
মাঝে মাঝে মনে হয়, হয়তো হয়ে গেছি।
যখন অরুণমাধব মা বলে ছুটে আসে, সব আদর আবদার জানায়, বাপের নামে নালিশ করে, কিছুতেই মনে হয় না, আমি বিধবা নমিতা, আমি মৃত হেমন্ত উকিলের বউ।
আর তখনই মনে হয়, এই সুমিতা হয়ে যাওয়া মনটাকে সেই হেমন্ত উকিলের স্ত্রীর দেহে আটকে রেখে লাভ কী হল আমার? আমার মনটা তো ধীরে ধীরে সুমিতা হয়ে এল, দেহটাকেই বা আগলে রেখে হল কী?
কিন্তু এখন আর সে আক্ষেপে লাভ নেই।
এখন প্রিয়মাধব নামের এই অশান্ত প্রাণীটা ঘোলা জলে তার পিপাসা মেটাবার ব্যবস্থা করে নিয়েছে। এখন তার কাছে ঠাণ্ডা শরবতের গ্লাস বাড়িয়ে ধরতে যাব কি আমি?
সে হয় না।
আমি শুধু মিসেস মুখার্জি।
আমি শুধু সুমিতা।
আমি অরুণমাধবের মা।
প্রিয়মাধবের বউ নই আমি।
আমার এই অদ্ভুত জীবন নিয়ে চরেও তো বেড়াচ্ছি দিব্যি। প্রিয়মাধবের সব পরামর্শ আমার সঙ্গে, প্রিয়মাধবের টাকাকড়ি সব আমার হাতে, প্রিয়মাধবের নেশার বস্তু আমার সামনে।
আমি মেপে দিয়ে বলি, আর নয়! ক্রমশই বাড়াবার তাল তোমার, অত আহ্লাদ চলবে না।
আমি বাড়ি থেকে বার করে দিয়ে বলি, বারোটার মধ্যে ফেরা চাই,–চাই। বলছি, রাত কাবার করলে দেখাব মজা।
প্রিয়মাধব বলে যায়, মজাটা কেমন জিনিস এক আধদিন দেখতে সাধ হয়। কিছুতেই কেন সাহস হয় না বলো তো?
আমি হাসি, পেতনি যে! যারা মরে গিয়েও চলেফিরে বেড়ায়, জ্যান্ত মানুষরা তাদের ভয় করে।
প্রিয়মাধব বলে, তোমার ওই আলমারির চাবি হস্তগত করে একদিন পুরো বোতল গলায় ঢেলে মাতলামি করব দেখো।
আমি সংক্ষেপে বলি, দেখব।
এমনি চলতে চলতে খেয়াল হল অরুণকে এবার মানুষ করে তোলার চেষ্টা দরকার, ভাল স্কুলে দেওয়া দরকার। কিন্তু এখানে কোথায় সেই ভাল স্কুল?
প্রিয়মাধব প্রথমে হেসে ওড়াল। বলল, কেন, এক্ষুনি ছেলে পড়ানোর দায়িত্ব ত্যাগ করতে চাও কেন? তোমার বিদ্যেয় আর কুলোচ্ছে না খোকার?
বললাম, কুলোচ্ছে না-ই তো। আমার আবার বিদ্যে কোথায়?
বাঃ ম্যাট্রিক পাস করেছিলে না তুমি?
সে সব তামাদি হয়ে গেছে।
আবার বানাও।
বললাম, না না, স্কুলে না পড়লে পড়ার মনোভাব আসে না। তা ছাড়া ওর মনটাও তো দেখতে হবে? কতখানি নিঃসঙ্গ ও, তা ভাবো তো!
সত্যিই খোকার নিঃসঙ্গতার দিক থেকে চিন্তা করেই স্কুল স্কুল করে ব্যস্ত হয়েছিলাম আমি। নইলে বছর আষ্টেকের ছেলেটাকে আরও কিছুদিন পড়ানো হয়তো আমার পক্ষে শক্ত ছিল না।
কিন্তু নিঃসঙ্গতার যন্ত্রণা আমি বুঝতাম।
সেই ভয়াবহ যন্ত্রণা, যা আমার উপর তার দাঁত বসিয়েই রেখেছে, আর প্রতিক্ষণ সেই দাঁতের চাপে কেটে কেটে খাচ্ছে আমায়, সেই যন্ত্রণাই যে উঠছে ক্রমশ বড় হয়ে ওঠা খোকার মধ্যে, এ আমি অনুভব করছিলাম। তাই
নিজের বিদ্যেকে নস্যাৎ করে দিয়ে বললাম, তা ছাড়া আমাদের আমলের পড়া আবার পড়া ছিল নাকি? তাও আবার মেয়ে স্কুলের।
পাস তো করেছিলে ইউনিভার্সিটিতে? বলল প্রিয়মাধব।
সেও মেয়ে বলে করুণায়। জানো না তখন মেয়ে বলে খাতায় বিশেষ একটা চিহ্ন থাকত!
এই কথার হাওয়ায় তখনকার মতো হয়তো হাওয়া হালকা হয়ে যেত, কিন্তু আমি জেদ ছাড়লাম না। আমি বদ্ধপরিকর।
আবার সে কথা তুলতাম।
প্রিয়মাধব আবারও বলত, এখন বলছ, দেখো ওকে পাঠিয়ে দিয়ে তুমি টিকতে পারবে না।
বলতাম, কেন? আমাকে কি খুব একটা হৃদয়বতী বলে মনে হয়?
হয় বইকী! শুধু একজনের ক্ষেত্র বাদে।
সব ক্ষেত্রেই সমান। বিধাতা পুরুষ আমার মধ্যে ওই হৃদয় নামের বালাইটা দেননি। খুব সম্ভব যমজের ভাগ করতে করতে ভুলে দুটো ভাগই একই অংশে দিয়ে ফেলেছিলেন।
প্রিয়মাধবকে পাংশু দেখাত এ ধরনের কথায়, পারতপক্ষে ও দিদির কথা তুলত না, শুধু এ ধরনের কথায় স্নান গলায় বলত, তার প্রমাণই বা রইল কই? অনায়াসেই তো খোকাকে ফেলে
আমি ঝংকার দিয়ে বলতাম, অনায়াসে কি অনেক আয়াসে, তা জানো তুমি?
ও বলত, কী জানি, হয়তো তাই।
এইসব সময় আমি আবার দিদিকে খোঁজার কথা তুলতাম। ধিক্কার দিতাম, কটুকথা বলতাম।
ও অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে চুপ করে থাকত।
কিন্তু কেন আমি ও রকম করতাম?
সত্যিই কি চাইতাম দিদি ফিরে আসুক।
কোনওদিনই কি চেয়েছি?
না, চাইনি। যদি চাইতাম তা হলে সত্যিই যখন ধূসর একটা আশ্বাসবাহী খবর এল, তখন অমন ভয়ানক নিষ্ঠুর পাপটা করে বসতাম না।
তবে খবরটা তখন আসেনি।
যখন অরুণকে বোর্ডিঙে দেওয়ার কথা চলছে, তখন সেই পাপের স্পর্শ লাগেনি আমার গায়ে।
তখন শুধু উৎখাত করছি প্রিয়মাধবকে। ছেলের শিক্ষা আর নিঃসঙ্গতার জন্যেও নয়। হয়তো ও বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ভয়ানক একটা ভয়ের সৃষ্টি হচ্ছিল মনের মধ্যে। যদি ও আমাদের দুজনের ভিতরকার সম্পর্কটার ফাঁকি ধরে ফেলে? যদি সে রহস্য উদঘাটনে যত্নবান হয়?
এর পর প্রিয়মাধব বলল, অরুণ তোমায় ছেড়ে থাকতে পারবে না।
বললাম, আমায় না তোমায়?
আমার থেকে তোমাকে অনেক বেশি ভালবাসে, বলল প্রিয়মাধব।
আমি অগ্রাহ্যের হাসি হাসলাম।
বললাম, তা হয় না। প্রকৃতির নিয়ম তা বলে না। রক্তমাংসের যোগ, নাড়ির যোগ, এটা সহজাত আকর্ষণের। আমার সঙ্গে ওর কোথায় কীসের যোগ?
ও বলল, একেবারেই কি নেই? যমজরা তো শুনেছি ভিন্নদেহে অভিন্ন। সেই পথ ধরেই ।
থামো! বাজে বোকো না। ও কোনও কথাই নয়। খোকা আমার চেয়ে অনেক বেশি ভালবাসে তোমাকে।
বেশ তবে না হয় বলছি–আমাদের ছেড়ে থাকতে পারবে না ও।
আমি তখন অরুণমাধবকেই ডাকলাম।
হেসে বললাম, কী রে, বোর্ডিঙে রেখে পড়াতে চাইলে পড়বি না তুই? আমাদের ছেড়ে থাকতে পারবি না বলে কাঁদবি?
অরুণমাধব লজ্জায় লাল হয়ে বলল, যা!
বাপের মতো বাঁচাল হয়নি ছেলেটা, মায়ের মতো স্বল্পভাষী হয়েছে। তাই ওইটুকুর বেশি কিছু বলল না।
প্রিয়মাধব রেগে বলল, তোমার প্রশ্নপত্রেই কারসাজি। আমি হলে ওভাবে প্রশ্ন করতাম না।
কীভাবে করতে তুমিই বলো–বললাম নিরীহ গলায়।
আমি বলতাম, কী রে খোকা, আমাদের ছেড়ে থাকতে পারবি তো? নির্ঘাত ও উত্তর দিত, না পারব না। আমি যাব না।
বেশ তুমিই জিজ্ঞেস করো।
আর হয় নাকি? ও সব শুনে নিল।
অরুণমাধব এবার হঠাৎ নিজে থেকে বলে উঠল, ইস্কুলে অনেক বন্ধু থাকবে তো!
অর্থাৎ সেই অনেক বন্ধুর বিনিময়ে কিছু ত্যাগস্বীকার করতে সে প্রস্তুত আছে।
আর প্রিয়মাধবের আপত্তি টিকল না।
বাগান থেকে কয়েক দিনের ছুটি নিয়ে শিলঙে চলে এল প্রিয়মাধব আমাদের সঙ্গে করে। সেখান থেকে ছেলের স্কুল আর বোর্ডিঙের সুব্যবস্থা করে ফিরল।
প্রচুর খরচ করল, প্রচুর জিনিস কিনল প্রিয়মাধব, আমার বকুনিতে কান দিল না। আমি যত বলি, বোর্ডিঙে আরও ছেলে থাকবে, তাদের সঙ্গে যাতে সমান হয় সেই তত ভাল। অত বেশি বস্তুর ভার চাপাচ্ছ কেন?
ও বলল, বেশি আর কী! চোখের বাইরে থাকবে, কখন কী দরকার হবে বলতে পারবে না।
তুমি যা জামা জুতো কিনলে, বিয়ে পর্যন্ত চলবে ওর!
প্রিয়মাধব গম্ভীর হয়ে বলল, ওই তো একটাই। জীবনে তো ভাগীদার আসবে না ওর!
এই আক্ষেপবাণীর সঙ্গে স্থির গভীর আর হতাশ একটা অভিযোগের দৃষ্টি নিয়ে আমার চোখে চোখ রাখল ও, তারপর আবার বলল, একা ওকে দিয়েই বুভুক্ষা মেটাচ্ছি।
আমি কেঁপে উঠলাম।
আমি তাড়াতাড়ি বললাম, কী রে খোকা, রেলগাড়ি চড়ে কেমন লাগছে?
গম্ভীর অরুণমাধবের মুখটা আহ্লাদে ভরে উঠল। তারপর বলল, খুব ভাল।
ওর মুখ দেখে মনে হচ্ছিল ও যেন মুক্তি পেয়ে বেঁচে যাচ্ছে।
অথচ এমনটাই কি সত্যি হবার কথা?
মা বাপের এক সন্তান কি থাকে না? তারা কি এইভাবে মুক্তির পিপাসায় অধীর হয়ে ওঠে? অন্তত এই বয়েসে?
তা তো নয়!
আমি অনুভব করলাম ওর মা বাপের মধ্যেকার সম্পর্কের ফাঁকাত্বটাই ওকে এমন কঠিন আর শুষ্ক করে তুলেছে।
ঠিক কিছু না বুঝলেও ও যেন প্রাণরসের স্বাদ পাচ্ছিল না। যান্ত্রিক নিয়মের মধ্যে থেকে হাঁপিয়ে উঠছিল।
অথচ আমিই সংসারের এই যান্ত্রিক নিয়মের কর্তা। আমার সংসারে এতটুকু এদিক ওদিক হবার জো নেই, কারও এতটুকু শৈথিল্য।
ওইটুকুই তো হাতিয়ার।
লড়ে টিকতে হলে একটা কিছু চাই বইকী!
যেদিন ওকে ছেড়ে রেখে চলে এলাম, সেদিন অবশ্য এ দৃঢ়তা থাকল না ওর! প্রিয়মাধব তো কেঁদেই ভাসাল, শুধু আমিই রইলাম দৃঢ় হয়ে।
কিন্তু ভিতরে কি সত্যিই ছিলাম তা?
আমার সামনে ভয়ংকর একটা শূন্যতার হাঁ তাড়া করে আসছিল নাকি?
আমার পিছন থেকে ভয়াবহ একটা ভয়ের হিমস্পর্শ?
তবু অবিচলতা বজায় রাখলাম আমি।
আর আশ্চর্য, বজায় রাখতে রাখতেই সহজ হয়ে গেল সেটা।
ফিরে এলাম শুধু দুজনে।
তার মানে বাড়িতে এখন শুধু প্রিয়মাধব আর আমি!
.
সেই রাত্রে, সেই শুধু দুজনের রাত্রে?
সে রাত্রি আমার জীবন-খাতার একটা কলঙ্কময় ক্লেদাক্ত পৃষ্ঠা। পরে ভেবে অবাক হয়েছি কী করে নিজেকে অমন ছোট করলাম আমি, কী করে অমন অপমান করলাম নিজেকে।
অথচ করেছিলাম!
সারারাত্রি ঘরের দরজা আলগা ভেজিয়ে রেখে জেগে বসে ছিলাম আমি সে রাত্রে। আর প্রতিটি মুহূর্তে অপেক্ষা করছিলাম ও আসবে।
হয়তো ঝড়ের মতো।
সারারাত কণ্টকিত হয়েছি এই উভয়বিধ কল্পনায়। আর হ্যাঁ আর ওই দুই অবস্থার জন্যেই প্রস্তুত করেছি নিজেকে, রচনা করেছি নিজের ভূমিকা। আশায় দুলেছি, আশাভঙ্গে ক্ষিপ্ত হয়েছি। সে যেন সমস্ত রাত্রিব্যাপী এক পাগলিনীর ভূমিকা অভিনয়।
তারপর রাত্রি যখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে
শেষ কলঙ্কের কালি মাখলাম নিজের মুখে।
বেরিয়ে এলাম নিজের ঘর থেকে, ওর দরজায় ধাক্কা দিলাম।
একবারেই দরজা খুলে দিল ও।
অবাক হয়ে বলল, কী হয়েছে? শরীর খারাপ?
যদি বলতাম, হ্যাঁ ভীষণ মাথার যন্ত্রণা হচ্ছে, দেখতে এলাম তোমার কাছে কোনও ওষুধ আছে। কিনা- তা হলে মুখরক্ষে হত!
কিন্তু তা বললাম না।
যে নকল কথাটা ভেঁজে নিয়ে এসেছি, সেটাই বললাম। আর বলার সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারলাম, কত বিশ্রি বেমানান খাপছাড়া কথা হল সেটা।
বললাম, হঠাৎ যেন তোমার ঘরে একটা গোঙানির শব্দ পেলাম মনে হল! খারাপ স্বপ্ন দেখেছ?
প্রিয়মাধব আরও অবাক হয়ে বলল, সে কী? না তো! ঘুমই আসছে না। সারারাতই তো জেগে!
আবার আশায় দুলে উঠল বুক!
ভাবলাম, ও তা হলে তোমারও একই দশা! এতই যদি, তবে খোয়ালে না কেন মানটুকু? আমি তো নিজেকে সঁপে দেবার জন্যে বসেই ছিলাম!
কিন্তু মনের কথা তো মুখে বলা যায় না। তাই ভুরু কুঁচকে বললাম, কেন? সারারাত জেগে কেন? শরীর খারাপ লাগছে?
ভাবলাম–এ প্রশ্নের পর ও আর নিজেকে সামলাতে পারবে না, কাণ্ডজ্ঞান হারাবে। শূন্য হৃদয় আর শূন্য ঘরের ভয়াবহতা থেকে ছুটে পালিয়ে আসবে আমার কাছে।
কিন্তু সে ভাবনা লজ্জায় ধিক্কারে মাথা হেঁট করল।
উত্তর নয়, একটা লাঠি বসাল ও আমার মাথার উপর।
ও ম্লান মুখে শিথিল গলায় বলল, না এমনি! মানে খোকাটা কী করল, কোথায় শুল, খেল কি না-খেল ভাবতে ভাবতে
খোকা!
সারারাত বাৎসল্যের আবেগে-ভরা সন্তানবিরহী মন নিয়ে ও জেগে বসে থেকেছে।
আর আমি?
আমি খোকার অনুপস্থিতিটাকে সুযোগ ভেবে নিয়ে ভিতরের অবরুদ্ধ সাপের ঝাঁপিটার মুখ খুলে দিয়েছি, আর ছড়িয়ে পড়া সাপগুলোকে নিয়ে খেলাচ্ছি!
একটা নীচ নোংরা মেয়েমানুষের মতো বাৎসল্য স্নেহের মধুর আবেগ, সন্তান বিরহের পবিত্র বেদনা খুলে, কামনায় উত্তাল হয়ে উঠেছি।
.
মাথা হেঁট করে ফিরে এলাম।
ঘরে এসে আছড়ে আছড়ে মারলাম সেই ক্লেদাক্ত সাপগুলোকে। চূর্ণ বিচূর্ণ করে ফেললাম, ধুলো ধুলো করে দিলাম তাদের বহুতর কঠিন প্রতিজ্ঞার ঝাঁপটে।
নতুন জন্ম নিয়ে নতুন সকালের বাতাসে শ্বাস নিলাম।
আশ্চর্য রকমের বদলে গেলাম। হ্যাঁ বদলে গেলাম। মদ্যপ চরিত্রহীন প্রিয়মাধবকে নিজের থেকে উঁচু ভাবতে শুরু করলাম সেদিন থেকে। প্রতিটি কথায় ছোবল হানা থেকে বিরত হলাম।
আর বাসনার তিক্ততাকে সরিয়ে রাখতে রাখতে ওর সত্যিকার হৃদয়ের খোঁজ পেলাম। দেখলাম ওর ভালবাসার প্রাণটি ভরা আছে সুমিতাকে দিয়ে। টের পেলাম এই এতগুলো বছর, ও লুকিয়ে লুকিয়ে অবিরতই সুমিতার খোঁজ করেছে।
অথচ আশ্চর্য, আমি যখন নিশ্চেষ্ট বলে শত ধিক্কারে লাঞ্ছিত করেছি ওকে, ও নীরবে সে লাঞ্ছনা মাথা পেতে নিয়েছে।
জানি না কেন এই নিপীড়ন।
এইটাই কি ও নিজের শাস্তি বলে গ্রহণ করেছিল? না কি ওর একেবারে মর্মলোকের সেই পবিত্রতম বস্তুটিকে আমার নির্লজ্জ হিংসার দৃষ্টি থেকে আড়াল করে রাখতে চেয়েছিল?
কিন্তু এও কি আমার পক্ষে ভয়ানক একটা অপমান নয়?
তবু আমি সেই অপমানকে উদঘাটন করে দিইনি। আমি বুঝতে দিইনি ওর সেই গোপনীয়তাটুকু টের পেয়ে গেছি আমি।
ও সব বিষয়ে আমার মুখাপেক্ষী, তাতেই যেন বিভোর আমি। ও যে প্রতি মুহূর্তে ডাক দেয় সুমিতা সুমিতা তাতে যেন নমিতার সব পাওনা পাওয়া হয়ে গেছে।
প্রিয়মাধবের ওই মুখাপেক্ষিতাটুকু কিন্তু কৃত্রিম ছিল না। ওটা নইলে ওদের মতো পুরুষ মানুষ বাঁচে না। একজনের হাতে সব ভার দিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়াই ওদের মতো লোকের প্রকৃতি। নমিতা সেই ভারবাহী পশু!
সেই পশুটাকে ও একেবারে যে ভালবাসত না তা নয়। আগে যে আকর্ষণটা ছিল, তার তীব্রতা মুছে গেলেও ওর প্রয়োজন ওকে ভালবাসিয়েছিল।
.
মিথ্যা সুমিতাকে দিয়ে ওর সম্ভ্রম বেঁচেছে, সন্তান বেঁচেছে, সংসার বেঁচেছে, তাই তার কাছে সে কৃতজ্ঞ। আর নমিতা নামের মেয়েটা চিরদিন ওই প্রিয়মাধবকে ভালবেসে এসেছে, নিজের সকল অহমিকা বিসর্জন দিয়েছে তার আকর্ষণে পড়ে, তাই তাকে একটু মমতা করেছে।
ওই নমিতা যদি সম্পূর্ণ সুমিতা হয়ে যেতে পারত, হয়তো হারানো সুমিতা হারিয়েই যেত, নমিতার জীবনটা এমন অনাসৃষ্টি হত না। দু নৌকোয় পা দেওয়া নমিতা এখন বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।
তার সেই অফুরন্ত কর্মশক্তি, অগাধ জীবনীশক্তি সব ফুরিয়ে এসেছে। অরুণমাধবের বউয়ের হাতে সংসার তুলে দিয়ে নিশ্বাস ফেলতে চায় সে। কিন্তু নিশ্বাস ফেলা হয়নি নমিতার। প্রিয়মাধবের সেই শালতরুর মতো স্বাস্থ্য-সতেজ দেহহঠাৎ হুড়মুড়িয়ে পড়ে গেল। হয়তো এও নমিতারই অপরাধের ফল।
স্বাস্থ্যরক্ষার যে খোলা দরজাটা দেখিয়ে দিয়েছিল সে প্রিয়মাধবকে, সেই পথ দিয়েই এসেছে এই ভাঙন, এই সর্বনাশ।
এখন যদি প্রিয়মাধব সেই নমিতাকে অহরহ তীব্র আর তীক্ষ্ণ বাক্যের বাণে বিধতে থাকে, যদি তাকে অপমান করেই সুখ পায়, যদি ওকে পীড়ন করেই উল্লাস অনুভব করে,কী করে তাকে দোষ দেবেনমিতা?
কিন্তু অরুণমাধবের বউ?
সে তো অনেক পরের কথা! প্রিয়মাধবের তীব্রতা আর তিক্ততা? সেও তো অনেক পরে।
মাঝখানে কত কত দিন পার হয়ে গেল না? যখন প্রিয়মাধব শালতরুর মতো সোজা আর সতেজ ছিল। যখন ছুটি হলেই অরুণমাধব চলে আসত বোর্ডিং থেকে, আর চা-বাগানের সাহেব মেমসাহেবের অদ্ভুত সংসারে লাগত উৎসবের স্পর্শ!
ছেলে এলে আহ্লাদে যেন উথলে উঠত ম্যানেজার সাহেব। কী করলে ছেলেকে সম্যক যত্ন করা হবে যেন ভেবে পেত না। রোজ ভোজ লাগাত, রোজ বাড়িতে লোকজন ডাকত, মাইলের পর মাইল গাড়ি করে বেড়িয়ে বেড়াত ছেলেকে নিয়ে। দাস-দাসীকে অপর্যাপ্ত বকশিশ দিত, আর সেই নৈশভ্রমণটা একেবারে চাপা দিয়ে ফেলত।
যেন খোকা জেনে ফেললেই ওর সর্বনাশ ঘটে যাবে।
আমার মনে হত এও যেন সুমিতার প্রতিই সম্মান! সুমিতা পবিত্র, সুমিতার ছেলে পবিত্র, সেখানে নিজের ধুলোমাখা অপবিত্র মূর্তিটাকে দেখাতে পারবে না সে।
মনের অগোচর পাপ নেই।
ভাবতাম নমিতা যদি এমন করে ইস্পাতের বর্মে নিজেকে ঢেকে না রাখত, যদি প্রিয়মাধবের সেই আছড়ে পড়ার দিনে নিজেকে বিকিয়ে দিত, নমিতার গর্ভেও নিশ্চয় আসত সন্তান। সেই সন্তানকে কি প্রিয়মাধব এমন সম্মান করত, সমীহ করত, প্রাণ উজাড় করে ভালবাসত?
এ প্রশ্নে ক্ষতবিক্ষত হয়ে নিজের মনের কাছে একটা উত্তরই পেয়েছি-না না না।
নিজেকে বিকিয়ে দিলে নমিতা নামের মেয়েটা প্রিয়মাধবের বাঁদির পদ পেত শুধু। তার সন্তান হত ঘৃণ্য গ্লানির। এ তো তবু ওর সংসারের গৃহিণীপদ পেয়ে গৌরবের আসনে আছে।
রাজ্যহীন রাজা!
ঘরহীন ঘরণী!
তবু সেই ঘর আঁকড়ে থাকবার দুরন্ত লোভ তো গেলও না সারা জীবনে। ক্লান্ত হয়েছি, নির্লিপ্ত হতে চেষ্টা করেছি, তবু দিদির মতো হঠাৎ একদিন নিরুদ্দেশ হয়ে যাবার প্রেরণা সংগ্রহ করতে পারিনি।
এই সময় একদিন এল সেই চিঠিটা!
যা থেকে এল আর এক কলঙ্কিত স্মৃতি।
সেদিন কবে কঘন্টা আগে ছুটির পর শহরে স্কুলে ফিরে গেছে অরুণমাধব।
কদিনের উল্লাস উত্তেজনা উৎসাহের পর বাসাটা যেন দেওয়ালির পরদিনের তেল সলতে জ্বলে যাওয়া মাটির প্রদীপটার মতো পড়ে আছে।
প্রিয়মাধব চলে গেছে কাজে।
তখন চিঠিটা এল। প্রিয়মাধবের নামে।
বৃন্দাবনের ছাপ মারা চিঠি। খামের চিঠি।
কিন্তু কার হাতের লেখা এই ঠিকানা?
মুক্তোর মতো সাজানো অক্ষরে পরিচ্ছন্ন ইংরেজিতে? সাপের ছোবল খাবার মতো শিউরে উঠেই অসাড় হয়ে তাকিয়ে রইলাম সেই খামে বন্ধ চিঠিখানার দিকে।
কার চিঠি এ? কার চিঠি? আমার চিরপরিচিত এই অক্ষরে কে চিঠি লিখল প্রিয়মাধবকে? বিষে আচ্ছন্ন হয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে শরীরে সমস্ত রক্ত ঝিমঝিম করে এল, চোখের সামনে থেকে সমস্ত পৃথিবী মুছে গেল, মুছে গেল ন্যায় অন্যায় পাপপুণ্য বোধ! ছিঁড়ে ফেললাম খামের মুখটা। আর ছেঁড়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন ভিতরের চিঠির টুকরোটা বড় বড় দাঁত খিঁচিয়ে ব্যঙ্গ হাসি হেসে উঠল।
প্রিয়মাধবের মার চিঠি!
আঁকা বাঁকা অক্ষরে আর বানান ভুলে ভর্তি। বয়েসের চাপে ক্রমশই বাড়ছে ভুল আর বক্রতা।
এ লেখা চেনে নমিতা।
যদিও বছরে একটি কি দুটি চিঠি আসে এই হাতের লেখায়। আসে বিজয়া দশমীতে, আর হয়তো বা এমনি কুশল সংবাদ চেয়ে, নয়তো প্রিয়মাধবের জন্মদিনে, আশীর্বাদ দিয়ে।
যা দেখে প্রিয়মাধব হেসে বলত, তিথিটা তো ভুলেও যায় না বুড়ি।
দেখত, বলত, তুলে রাখত ড্রয়ারে।
কিন্তু সে চিঠি কদাচ কি খামে?
না, এযাবৎকখনও সে দৃশ্য দেখেনি নমিতা। নিশ্চিত একখানি পোস্টকার্ড। প্রায় একই ভাষা, একই ভঙ্গি, একই বক্তব্য। পর পর পাঁচখানা চিঠি সাজিয়ে রাখলে দেখা যাবে তফাত মাত্র নেই।
সহসা খামে কী লিখেছেন উনি?
আর এই ঠিকানা?
কাকে দিয়ে লিখিয়েছেন?
খামের উপরকার সেই পরিপূর্ণ অক্ষরগুলো যেন গ্রাস করে ফেলছিল নমিতাকে। তবু আস্তে ওই আঁকাবাঁকা লেখাটা চোখের সামনে তুলে ধরল। নতুন কী আছে এতে? হ্যাঁ, এবারে বক্তব্য নতুন।
প্রিয়মাধবের বাবা মৃত্যুশয্যায়, প্রিয়মাধব যেন পত্রপাঠ মাত্র বউমাকে সঙ্গে নিয়ে চলে আসে। খুব শীঘ্র ব্যবস্থা না করলে হয়তো বাপের সঙ্গে শেষ দেখা হবে না প্রিয়মাধবের। দিন যে কীভাবে যাচ্ছে তিনিই জানেন আর বৃন্দাবনচন্দ্রই জানেন। অবশেষে লিখেছেন, তবে বৃন্দাবনচন্দ্রের কৃপায় একটি সংসার বৈরাগিণী বিধবা মেয়ে উপযাচক হয়ে যে সেবা ও সাহায্য করছে, তা দুর্লভ। মেয়েটির দেখা না পেলে কী যে করতেন বৃদ্ধা! দেখে মনে হয় যেন চিরকালের চেনা, কতজন্মের আপন।
.
নমিতার ঠোঁটটা দাঁতের চাপে কেটে যাচ্ছে দেখতে পাচ্ছি আমি, দেখতে পাচ্ছি নমিতা সেই চিঠিটা কুচি কুচি করে ছিঁড়ছে।…দেখতে পাচ্ছি নমিতা সেই চিঠি আর চিঠির খামের কুচিগুলোয় দেশলাইয়ের কাঠি জ্বেলে আগুন ধরাচ্ছে।…
দেখতে পাচ্ছি সেই পোড়া ছাইগুলোকে বাথরুমে জল ঢেলে নিশ্চিহ্ন করছে নমিতা। তারপর দেখতে পাচ্ছি নমিতা বিছানায় পড়ে হাঁপাচ্ছে।
দেখতে পাচ্ছি প্রিয়মাধব এলে বলছে, অসুখ করেছে?
প্রিয়মাধবও আজ স্তিমিত।
আজ বাসায় ফিরে অরুণমাধবকে দেখবে না, এই বিষণ্ণতা নিয়ে ঢুকেছে। তবু ব্যস্ত হল। বারবার বলতে লাগল, কদিন খুব খাটনি গেল তো! ব্যস্ত হয়ে উঠল, ওষুধ ওষুধ করে।
আর হয়তো সে ব্যস্ততা নিরর্থকও হল না। অসুখ তো সত্যিই করেছিল নমিতার। ভিতরের অসহ্য যন্ত্রণায় জ্বরই এসেছিল ওর।
কী করবে ও?
কেমন করে জানাবে প্রিয়মাধবকে তার বাবার অবস্থা।
নমিতা কি বলবে, হঠাৎ অন্যমনস্কতায় খামটা ছিঁড়ে ফেলেছিলাম, পড়ে দেখলাম—
কী বলবে প্রিয়মাধব?
ঠিক আছে খুলেছ ক্ষতি নেই, কিন্তু চিঠিটা?
নমিতাকে তা হলে বলতে হবে, কোথায় রেখেছি খুঁজে পাচ্ছি না!
প্রিয়মাধবও তবে পাওয়া যাচ্ছে না ভেবে নিশ্চিন্ত হবে? খুঁজবে না?
নমিতা কি বলবে অচেনা অজানা একটা লোক হঠাৎ এসে খবর দিয়ে গেল?
প্রিয়মাধব পাগল নয় যে সেই অবাস্তব কথাটা শুনে বিশ্বাস করবে। তা ছাড়া–হ্যাঁ, তা ছাড়া বাপের ওই মৃত্যুশয্যার খবরটা দিলেই বা চলবে কেন প্রিয়মাধবকে? প্রিয়মাধব তা হলে ছুটবে না? না, প্রিয়মাধবের মার বউমাকে নিয়ে ছুটবে না অবিশ্যি, একাই ছুটবে। মা বাপের সামনে, মরণোন্মুখের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারবে না সুমিতা হয়ে যাওয়া নমিতাকে নিয়ে।
অতএব একাই ছুটবে। আর সেখানে গিয়ে দেখতে পাবে সেই মেয়েকে। যে নাকি ওর মার কতজন্মের আপন।
না, না, তার চেয়ে নমিতার অসুখ বাড়ুক। নমিতা বিছানা থেকে উঠতে না পারুক।
.
না, বাপের সঙ্গে শেষ দেখা হয়নি প্রিয়মাধবের। কদিন যেন পরে ধিক্কারের ভাষার একখানা পোস্টকার্ড এসেছিল।
যাতে প্রিয়মাধবের বাপের মৃত্যুসংবাদ ছিল, আর ছিল ওর মায়ের তীর্থযাত্রার সংবাদ। সংসারই যখন ত্যাগ করেছেন, তখন ছেলের হাতের আগুন পাবার প্রত্যাশাই ছিল ভুল। সে ভুল ভেঙেছে তাঁর, স্বামীর পারলৌকিক কাজ সাঙ্গ করে গুরুদেবের সঙ্গে তীর্থ পর্যটনে বেরোচ্ছেন তিনি। কোথায় যাচ্ছেন জানেন না। ভগবান যেখানে নিয়ে যান।
অক্ষর আঁকা আঁকা, কিন্তু বক্তব্য স্পষ্ট। প্রিয়মাধবের মার পুরনো চিঠির সঙ্গে এ চিঠির মিল নেই কোথাও।
প্রিয়মাধব মাথায় হাত দিয়ে পড়েছিল। বলেছিল, এ চিঠির মানে কী বলতে পারো?
নমিতা শুকনো গলায় বলেছিল, কী করে বলব?
অনেকক্ষণ উদভ্রান্তের মতো পায়চারি করেছিল প্রিয়মাধব। বলেছিল, খুব অন্যায় হয়ে গেছে আমার, খুব অন্যায় হয়ে গেছে! ওঁরা যে বুড়ো হচ্ছেন, সে খেয়াল করিনি। মাসে মাসে একটা মনিঅর্ডার, আর তাতেই দুছত্র লেখা, এতেই কর্তব্য শেষ হল ভেবেছি। ছেলে দেখাতে বলেছিলেন, দেখাইনি। আমি একটা জানোয়ার সুমিতা, আমি একটা রাসকেল!
সুমিতা!
সুমিতাই বলত বইকী! বলে বলে সহজ অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল, ওরও গলায় বেসুরো বাজত না, আমারও কানে বেখাপ্পা লাগত না।
আমি শুকনো মুখে বললাম, তোমার আর দোষ কী? তুমি তো জানতে না অসুখ?
অসুখ জানতাম না, বয়েস জানতাম তো!
ওঁরা তো তোমার সাহায্যের প্রত্যাশী ছিলেন না!
খোকাকে দেখাব এ প্রত্যাশা করেছিলেন।
খোকা!
আমি ক্ষুব্ধ হাসি হেসে বললাম, খোকা জন্মাবার সঙ্গে সঙ্গেই তো?
হ্যাঁ! খোকার জন্মের পরই–।
মাথার চুলগুলো মুঠোয় চেলে ও তীব্রস্বরে বলে ওঠে, মুখ দেখাবার পথ আর ছিল কোথায়?
.
বাবার সঙ্গে শেষ দেখা হল না, বাবার সঙ্গে শেষ দেখা হল না–এই আক্ষেপটা নিয়ে বড় বেশি বাড়াবাড়ি করল প্রিয়মাধব। যদি ছুটে চলে গিয়ে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে পারত, হয়তো এতটা অশান্তি ভোগ করত না, কিন্তু ওর মা সে পথ বন্ধ করে দিয়ে গেছেন। ওর সেই রুদ্ধ আবেগে তাই অমন করে মাথা কুটে মরছিল।
দীর্ঘকালের বিচ্ছিন্ন সম্পর্ক বাবার মৃত্যু যে ওকে এভাবে বিচলিত করে তুলবে, তা কে জানত!
এতদিনের কর্তব্যের ত্রুটি, আর নিজের এই ভেজাল জীবনের গ্লানি, একে অহরহ অপরাধবোধের তাড়নায় বিঁধছিল, শুধু স্বভাবগত চাপল্যে ভাসা ভাসা হালকা হয়ে থাকত, এই একটা ধাক্কায় বদলাতে শুরু করল।
দিদি চলে যাবার পর কিছুদিন যে বিকৃতি এসেছিল, এ বদল ঠিক তেমন নয়। এ যেন ওর মধ্যে একটা হিংস্র নিষ্ঠুরতা জন্ম নিচ্ছিল। যে হিংস্রতা অকারণ পুলকে উল্লসিত হয় অপরকে যন্ত্রণা দিয়ে, পীড়ন করে।
আর সেই পীড়নের পাত্র নমিতার মতো এমন আর কোথায় পাওয়া যাবে? এত হাতের কাছে, এমন নিরুপায়?
নমিতা যে কোনওদিন প্রিয়মাধবকে ধমক দিত, তীক্ষ্ণ বাক্যের বাণে বিদ্ধ করত, প্রতিপদে হেয় করত, সে কথা ভুলে গেল নমিতা। অতএব প্রিয়মাধবও ভুলল। তাই ভূমিকার বদল হল।
নমিতা সেই চিঠি পোড়ানোর পর থেকে নিজে পুড়ে পুড়ে খাক হল।
অথচ এখন আর উপায় কী?
কলেজে পড়া অরুণমাধবের সামনে, বিয়ের যুগ্যি অরুণমাধবের সামনে নমিতা কি প্রকাশ করতে বসবে এবার নমিতা-সুমিতার রহস্য!
আর হবে না কিছুই হবে না, নমিতাকে এখন শুধু তার ভাঙা নৌকোখানা ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে পৌঁছতে হবে কোনও এক অজানা লোকের উদ্দেশে।
তার আগে কিছু হবে না।
প্রিয়মাধবকে তার ছেলের সামনে ধিকৃত করবার শক্তি নেই নমিতার মধ্যে। শক্তি নেই তাকে পৃথিবীর চোখে হেয় করবার। তাকে সম্মানের উচ্চ শিখরে বসিয়ে রাখবার সাধনায় সব বিষ পান করে হাসিমুখে সংসার করতে হবে নমিতাকে!
কারণ?
কারণ একদা নমিতা নামের একটা আবেগপ্রবণ মেয়ে প্রিয়মাধব নামের একটা সর্বনাশাকে ভালবেসে বসেছিল।
কিন্তু প্রিয়মাধব তো সেই ভালবাসা বাসেনি!
তাই প্রিয়মাধব ওকে অপমান করেই সুখ পায়, পীড়ন করেই উল্লাস অনুভব করে।
অথচ ওর ভালবাসার এই রীতি।
তাই প্রিয়মাধবকে দোষ দিতে পারি না আমি। এ ছাড়া আর কী হতে পারত ও?
কিন্তু আমাকেই বা আমি দোষ দেব কেন? আমি যদি দিদির হাতের লেখার সাদৃশ্য দেখে শিউরে উঠি, সে কি খুব বেশি করেছি?
আমার অবস্থায় আমি এর বেশি কী হতে পারতাম?
দিদিকে আমি ভয় করব না?
দিদির সেই চোখ?
সেই ভয়ংকর অর্থবহ শূন্যদৃষ্টি?
সেই চোখ আজীবন আমাকে তাড়া করে ফিরেছে, আমাকে বিদ্রূপ করেছে, করুণা করেছে, ঘৃণা করেছে, আহা করেছে।
অনেকবার ভাবতে চেষ্টা করেছি, দিদির এই চলে যাওয়া সম্পূর্ণ বোকামি। চিরকেলে বোকাটা অভিমান করে সর্বস্ব খোয়াল। কিন্তু ওই চোখ? ও কি বোকার? তাই দিদিকেই আমি দোষী করব। চিরদিন করে এসেছি।
ওকে আমি ক্ষমা করতে পারলাম না কোনওদিন, ভালবাসতেও না। চিরদিন হিংসে করে এসেছি দিদিকে, চিরকাল করব। দিদি আমার জীবনের শনি!
.
সেই চিঠিখানার স্মৃতি ক্রমশ ধূসর হয়ে এসেছিল, ধূসর হয়ে এসেছিল অপরাধবোধের সেই তীব্র আগুন। ক্রমশই মনে হয়েছে হাতের লেখার সেই ছোবল সম্পূর্ণই আমার মনের ভুল। দড়িকে সাপ ভেবেছি আমি, সিঁদুরে মেঘকে আগুন। মানুষে মানুষে কত সাদৃশ্য থাকে, হাতের লেখাতেও থাকে। আমার মনে দুর্বলতা আমাকে ভয় দেখিয়েছে। দিদি নেই! পৃথিবীর কোথাও নেই। থাকলে–
মাঝখানে আর একটা ঘটনা ঘটে গেল।
বৃন্দাবন থেকে এক অচেনা হাতের লেখা চিঠি এল, আপনার মাতাঠাকুরাণী শ্রীমতী বিন্দুবাসিনী দেবী গত পূর্ণিমায় শ্রীশ্রীদ্বারকাধামে দেহরক্ষা করেছেন, গুরুদেবের আদেশে আপনার জ্ঞাতার্থে জানানো হইল। তাঁহার পারলৌকিক কার্যাদি শ্রীশ্রীগুরুদেবের নির্দেশানুযায়ী সম্পন্ন হইয়াছে, ইচ্ছা হইলে মাতাঠাকুরাণীর নামে ভাণ্ডারা দিয়া পুণ্য অর্জন করিতে পারেন। ব্রজবাসী মথুরামোহন দীনদাস, বৃন্দাবন, এই ঠিকানায় টাকা পাঠাইলে চলিবে।
পোস্টকার্ডের চিঠি।
বাপের মৃত্যুতে যতটা বিচলিত হয়েছিল, ততটা বিচলিত হল না প্রিয়মাধব, শুধু বলল, জানতাম আমি জানতাম, আমার যে এই শাস্তি হবে তা জানতাম আমি।
তারপর সেই ব্রজবাসীর নামে তিনশো টাকা পাঠিয়ে দিল।
সেই সময় সাহসে ভর করে বলেছিলাম, বৃন্দাবনে মা যেখানে থাকতেন, যাও না সেখানে একবার।
ও ভুরু কুঁচকে বলল, কেন? গোড়া কেটে আগায় জল দিতে?
তবু খৃষ্টের মতো বললাম, তা কেন, স্মৃতির জায়গাটা দেখে আসতে
অত ন্যাকামিতে কাজ নেই, বলে চলে গেল ও।
এই রকমই কথাবার্তা হয়েছে ওর ক্রমশ।
বুঝতে পারি ওর এই ত্রুটির জন্যে মনে মনে আমাকেই দায়ী করে ও। আশ্চর্য! চাকরি বজায় রাখতে ও কী করে বসেছিল তা ও ভেবে দেখে না। কিন্তু ওর এই নির্লজ্জতাকে কেটে চিরে বিশ্বের সামনে উদঘাটিত করতে পারি না ওকে, এমনকী ওর সামনেও পারি না। বলতে পারি না, তা আমায় শোনাতে এসেছ কেন ও কথা? আমাকে তোমার গলায় গাঁথো, পায়ে ধরে বলতে এসেছিলাম এ কথা? নিজের গলায় নিজে পাথর বেঁধেছ তুমি। এখন আমায় দোষ দিতে এলে চলবে কেন?
বলতে পারি না।
আমার সব তেজ সব দর্প সব সাহস কোথায় যেন চলে যাচ্ছিল, আমি শুধু নিজেকে খোলসের মধ্যে ঢুকিয়ে নিচ্ছিলাম। অতএব ও আমাকে যা ইচ্ছে বলে পার পাচ্ছে।…
আবার দু-একদিন পরে হয়তো নিজেই নরম হয়ে কথা কইতে আসে।
আমি কি তখন কথা বলব না?
মান-অভিমানের লীলা করব?
কীসের দাবিতে?
অথচ মনে হয় ও যেন সেটাই প্রত্যাশা করে। আমি মান করব, ও যে মান ভাঙাবে এই আশা নিয়েই যেন সন্ধি করতে আসে। আর আমি যখন পুরনো কটুক্তির বাষ্পমাত্র ভুলে গিয়ে নিতান্ত সহজভাবে কথা বলি, ও হতাশ হয়, ক্ষুব্ধ হয়, বুঝিবা বিরক্তও হয়।
ওর মা মারা যাবার পরে কদিন গুম হয়ে থেকেছিল, তারপর হঠাৎ একদিন কাছে এসে দাঁড়াল। বলল, সারাদিন কী এত কাজ করো? একটা কথা বলবার সুবিধে হয় না।
হেসে বললাম, হুকুম করলেই বাঁদি হাজির হতে পারে।
ও অসন্তুষ্ট স্বরে বলে, সব সময় ওভাবে কথা বলো কেন? আমি কি তোমার সঙ্গে দাসী বাঁদির মতো ব্যবহার করি?
আরও হাসলাম।
বললাম, তুমি করবে কেন? আমি তো জানি আমার পোজিশান।
পজিশানতুমি ইচ্ছে করে নাও না।
এবার হাসি থামিয়ে বলি, এই কথাটা বলার জন্যেই খুঁজে বেড়াচ্ছিলে?
ও বসে পড়ল বিছানায়।
বলল, কথার গোড়াতেই কোপ মেরো না। বলছি–এবার খোকার বিয়ের কথা ভাবলে কী হয়?
খোকার বিয়ের কথা আমিও ইদানীং ভাবছিলাম বইকী! লেখাপড়া শেষ করেছে, ভাল একটা ব্যাঙ্কে কাজ পেয়েছে, বয়েসও হল, তবু নিজে থেকে পাড়িনি কথাটা। কেন পাড়ব? আমি তো ওর সত্যি মা নয়। যার ছেলে সে বুঝুক। যদি মনে পড়ে।
দেখলাম ওর মনও নিষ্ক্রিয় নয়।
তাই হেসে বললাম, শুধু ভাবলেই হবে?
আহা প্রথম সোপান তো ভাবা।
সেটা তো হয়েই গেছে। এবার দ্বিতীয় সোপানে ওঠো।
কিনে খুঁজব তা হলে বলছ?
জোরে হেসে উঠে বললাম, বলছি! কিন্তু কেউ শুনলে ভাববে লোকটা কী বাধ্য!
ও মুচকি একটু হেসে আমার একটা হাত চেপে ধরে ঈষৎ কাছে টেনে নিয়ে বলে উঠল, স্ত্রৈণ ভাববে, এই আর কী!
আমি আস্তে আস্তে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম, তাও ভাবতে পারে।
যাক ভাবুক। এখন বলল, কেমন বউ চাই তোমার?
বললাম, ওটা খোকাকে জিজ্ঞেস করবার কথা।
সে জিজ্ঞেসটা তুমি করবে। তোমাকে জিজ্ঞেস করছি আমি।
বললাম, সুন্দরী বউ চাই।
কেন? খুব একটা সুন্দরীতে কী দরকার?
তা একটা মাত্তর ছেলের বউ, সুন্দরী করবে না?
লাভ কী? ছেলেটা তা হলে বউয়ের কেনা গোলাম হয়ে যাবে!
সুন্দরী না হলেও যাবে।
কে বললে?
কেউ বলেনি। ওর প্রকৃতিতে বশ্যতা। দেখোনা একদিনের জন্যে তোমার কোনও কথার প্রতিবাদ করে না।
আমি ওকে অন্যায়ও কিছু বলি না।
হেসে বললাম, সে কথা কি জোর করে বলা যায়? মানুষ কি নিজে বুঝতে পারে অন্যায় করছে কি ন্যায় করছে?
তা বটে! প্রিয়মাধব ম্লানভাবে বলল, অন্তত আমার মতো পশু তো বলতে পারেই না। ঠিক আছে, সুন্দরী মেয়েই দেখি।
আমি হাওয়া হালকা করতে হেসে উঠলাম, বললাম, আহা দেখলেই যেন ডানাকাটা পরী খুঁজে পাচ্ছ। ওর কপালে যেমন বউ লেখা আছে তাই হবে। তবে খোঁজাটা দরকার।
চলল খোঁজ।
মেয়ে জোগাড় হল।
নাম উত্তরা!
মাঝারি সুন্দরী।
প্রিয়মাধব বলল, এই বেশ, এই ভাল।
চলল সমারোহের তোড়জোড়।
বাজার চষে ফেলা হচ্ছে তত্ত্বের জিনিস কিনতে। কলকাতার বাজার।
হ্যাঁ, তখন তো কলকাতায় চলে এসেছি আমরা।
কাজে অবসর নিয়েছে প্রিয়মাধব। একটা বাগানের কিছু শেয়ার কিনেছিল, তার উপস্বত্ব আসে বছরে দুবার করে। অরুণও রোজগার করছে। মোটামুটি সচ্ছলতায় চলছে। বাড়ি করবে করবে করছে প্রিয়মাধব।
বলছে, যতই হোক, লোকে বলবে শ্বশুরের একখানা পচা বাড়ি পেয়েছিল তাই মাথা গুঁজে কাটাল!
শ্বশুরেরই বাড়ি।
কলকাতায় এসে আমাদের সেই সিকদার বাগানের পচা বাড়িটাতেই ওঠা হয়েছিল। আইনত যে বাড়ির মালিক এখন অরুণমাধব। মেয়েতে সম্পত্তি পাওয়ার আইন তো তৈরি হয়নি তখন, ছেলে না থাকলে দৌহিত্র সন্তানই উত্তরাধিকারী হত।
তা বিয়ে সেই পচা বাড়িতেই হল।
জিনিসপত্তরে বোঝাই হয়ে উঠল ছোট্ট বাড়ি। নীচের তলার ভাড়াটেদের উঠিয়ে দেওয়া হল। বাজার করতে একাই যেত প্রিয়মাধব। কোনওদিন বলত না, তুমিও চলো না।
যেত তো তখন গিন্নিরা, মেয়েরা।
ওর হয়তো তখনও ভয় ছিল কেউ বুঝে ফেলবে, চিনে ফেলবে। বলে উঠবে, আচ্ছা ইনি আপনার শালি না?
তা নয় তো, কেন ডাকত না?
একটা জিনিস নিয়ে বারবার ঘোরাফেরাও তো করত আমার পছন্দ হচ্ছে কিনা জিজ্ঞেস করে করে।
সেই বাজার করতে করতেই হঠাৎ আমার জন্যে একখানা জমকালো শাড়ি এনে হাজির করল। চওড়া লাল পাড়ের কড়িয়াল শাড়ি, আঁচলায় জরির ঝলক।
অবাক হয়ে বললাম, এই কাপড় পরব আমি?
ও বলল, কেন পরবে না? দোকানি বলল, বয়স্কা মহিলাদেরই কাপড় এটা! দেখে খুব পছন্দ হল। ওখানের বাজারে কখনও তো ভাল কিছু পাওয়া যেত না, যা কেনা হয়েছে সবই নেহাত লজ্জা নিবারণের মতো–
হেসে উঠে বললাম, তা সেটাই তো দরকার। লজ্জা বর্ধন তো কাম্য নয়।
এ শাড়িতে লজ্জা কী! ছেলের বিয়েতে ঘুরে বেড়াবে, এমন নইলে মানাবে কেন? বউ এসে মানবেই বা কেন!
এত মানামানির দরকার কী?
আশ্চর্য! দরকার নেই? নিশ্চয় আছে। এই শাড়ি পরে বউ বরণ না কি সেই বলে তাই করবে?
ওর এই আবেগের মাথায় হাতুড়ি বসালাম আমি।
তীক্ষ্ণ গলায় বললাম, বউ বরণ করব আমি?
প্রিয়মাধব থতমত খেল।
প্রিয়মাধব ঢিলে গলায় বলল, করবে না কেন? তুমিই তো ওর সত্যিকার মা!
আমি গম্ভীর ভাবে বললাম, মনেপ্রাণে তা যদি ভেবে থাকো তো করব বরণ!
ও কেমন শুকনো শুকনো মুখে চলে গেল।
.
তারপর এল সেই দিন।
বিয়ের সকালে নান্দীমুখে বসতে যাচ্ছে প্রিয়মাধব, হঠাৎ আমার কাছে এসে বোকাটে গলায় বলে উঠল, ভেবে দেখলাম তোমার কথাই ঠিক।
চমকে উঠলাম আমি।
ওর গলায় এ সুর নতুন।
ও তো হয় ব্যঙ্গে তীক্ষ্ণ, নয় ক্রোধে তীব্র, আর নয়তো কখনও কখনও অনুতাপে ম্লান। এমন আলগা গলা কেন? আর আমার কোন কথাটাই বা হঠাৎ ঠিক লাগল ওর?
শুধু তাকিয়ে রইলাম।
ও অন্যদিকে তাকিয়ে বলে উঠল, মানে ভাবছি ওই বরণ-টরণগুলো অন্য আর কেউ করুক। দেশের বড় খুড়ি বা সত্যদার বউ!
পা থেকে মাথা পর্যন্ত আকস্মিক যে একটা অনুভূতি খেলে গেল আমার, তাকেই কি বিদ্যুৎ শিহরন বলে?
তারপর অনেকদিন পরে আমি ব্যঙ্গে তীক্ষ্ণ হলাম।
বললাম, কেন, আমি কী অপরাধ করলাম?
ও অপ্রতিভ গলায় বলল, না না অপরাধের কথা হচ্ছে না। মানে এসব তো মেয়েলি নিয়ম লক্ষণের ব্যাপার
বুঝলাম সেদিন ঝোঁকের মাথায় একটা বড় দানপত্রে স্বাক্ষর করে বসে ও এখন পস্তাচ্ছে। ছেলের কল্যাণ অকল্যাণের চিন্তা ওর চক্ষুলজ্জার দুর্বলতার উপর জয়ী হচ্ছে। ওর মনে পড়েছে আমি বিধবা, আমার কোনও শুভকর্মে যোগ দেবার অধিকার নেই।
মায়া হল।
ছেলে যে ওর প্রাণ! জানি তো?
তবু সুরটা বজায় রাখলাম।
মুচকি হেসে বললাম, চওড়া লাল পাড়ের বেনারসী গরদটা তা হলে মাঠে মারা?
ও তাড়াতাড়ি বলল, তা কেন? শাড়িটা পরবে না কেন? নিশ্চয় পরবে, পরে বিয়েবাড়ি ঝলসে বেড়াবে। শুধু
ও বুঝেছি, নিরীহ গলায় বললাম, শুধু বরণ করব না!
তুমি রাগ করছ?
কী মুশকিল, রাগ করব কেন? কী করতে হবে তাই জেনে নিচ্ছি। কিন্তু খোকার আসল মা কেন বউ বরণ করছে না তারও কোনও গল্প বানিয়ে কৈফিয়ত দিতে হবে? সে গল্পটা?
ও ফ্যাকাসে গলায় বলল, গল্প আবার কী? শরীর খারাপ-টারাপ কিছু একটা বলবে।
আমি আরও দুষ্টু হাসি হেসে বললাম, তা যেন বললাম, কিন্তু জরির আঁচলা দুলিয়ে বিয়েবাড়ি ঝলসে বেড়াব, অথচ শরীর খারাপ বলব, সেটা একটু বেমানান লাগবে না?
ওর চোখ দুটো হঠাৎ ছলছলিয়ে উঠল। কাতর গলায় বলল, তুমি তো সবই বোঝো, আমার মনটাও তো বুঝতে পারছ, তবে কেন–
আর নিষ্ঠুর হতে পারলাম না।
বিশেষ করে যখন ও শুভ কাজে বসতে যাচ্ছে। হেসে উঠে বললাম, তুমি-ই বা কিচ্ছু বোঝে না কেন? খোকার শুভাশুভ আমি দেখব না? তুমি বলেছ বলেই কি আমি বউ বরণ করতে বসতাম? তোমাদের দেশের জ্ঞাতি খুড়িমাকেই বলে রেখেছি।
বলে রেখেছ? সত্যি?
ও আমার এই বিবেচনার পরিচয়ে যেন বর্তে গেল। চলে গেল তাড়াতাড়ি ওদিকে ডাকাডাকিতে।
আমি তাকিয়ে রইলাম সে দিকে।
ভাবতে লাগলাম, এই গোলমালের বাড়ি থেকে কোনও এক ফাঁকে পালিয়ে গেলে কেমন হয়?
এর মধ্যে পালালে সহসা কেউ ধরতে পারবে না।
ভাবতেই লাগলাম।
যেমন সারাজীবন আত্মহত্যার কথা ভেবেছি।
সে সাহস হল না কোনও দিন।
সাহস দেখাতে যাই আজেবাজেতে।
যেমন দেখাতে গেলাম বিয়ের নেমন্তন্নর ছুতোয় প্রফুল্ল মাস্টারের সঙ্গে দেখা করে।
না, পুরনো গুরু বলে ভক্তিতে উথলে নয়। ভেবেছিলাম দেখি তো মাস্টার, তোমার প্রেম কত খাঁটি, তোমার দৃষ্টি কেমন নির্ভুল!
প্রিয়মাধব বলল, কী মুশকিল, তুমি যাবে মাস্টারের বাড়ি? বেঁচে আছে কিনা তার ঠিক নেই।
বললাম, আমি বেঁচে রয়েছি, তিনিই বা না থাকবেন কেন? কতই আর বেশি বয়েস? তবে আরও একটা বাঁচা আছে, সেটাই দেখতে যাচ্ছি।
তবে চল!
ও চলল ওর দীর্ঘ বলিষ্ঠ দেহ নিয়ে এক জোয়ান পুরুষের মতো টগবগিয়ে, আমি গেলাম ধীর শান্ত ভঙ্গিতে। আমাকে তো মনে রাখতে হবে আমি সুমিতা!
.
তুমি সুমিতা!
চমকে উঠেছিল প্রফুল্ল মাস্টার।
গায়ে চাদর জড়ানো খোঁচা খোঁচা দাড়ি, এক প্রায় অথর্ব বুড়ো।
বলল, তুমি সুমিতা! তুমি সুমিতা!
প্রিয়মাধব মুচকি হেসে নিমন্ত্রণ পত্রটা নামিয়ে দিয়ে আমাদের আসার উদ্দেশ্য ব্যক্ত করল।
কিন্তু প্রফুল্ল মাস্টার যেন দিশেহারার মতো তাকিয়ে রইল।
আমি সুমিতার ভঙ্গি নকল করতে চেষ্টা করলাম। নকল করতে চেষ্টা করলাম সুমিতার গলা। বিনয়ে মধুর নরম গলায় বললাম, আপনি নিশ্চয় আমাকে ভুলেই গেছেন?
মাস্টার এ কথায় যেন ব্যস্ত হয়ে উঠল। বলল, সে কী সে কী, ভুলে যাব কি! তুমি ছেলের বিয়েতে আমায় মনে করে নেমন্তন্ন করতে এসেছ, আর আমি ভুলে যাব?
প্রিয়মাধব হেসে উঠে লুকোনো বিদ্রুপের গলায় বলল, না মানে আর কি, আগে তো ভুলে গিয়ে থাকতে পারেন? এতদিন কি আর আপনি কবেকার কোন ছাত্রীকে মনে রেখেছেন?
মনে রাখিনি?
সেই অথর্ব ভাবের মধ্যে সহসা উত্তেজনার বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল।
মনে রাখিনি! বলেন কি! তবে মানে তুমি অনেক বদলে গেছ সুমিতা!
সুমিতা!
কতকাল ধরেই প্রিয়মাধবের মুখে এই সুমিতা ডাক শুনে আসছি, কানে তো সয়েই গেছে, তবু সেদিন মাস্টারের মুখে ওই ডাক শুনে যেন বুক কেঁপে উঠল।
মনে হল কে যেন কোথা থেকে এসে এই জালিয়াতি ধরে ফেলে ব্যঙ্গ হাসি হেসে উঠছে।
তবু সামলে নিতে হল।
বলতে হল, বাঃ বয়েস হচ্ছে বদলাব না? আপনিও তো কত বদলে গেছেন মাস্টারমশাই!
মাস্টার স্তিমিত হয়ে গেল।
বলল, তা বটে! সকলেই বদলে যায়। গলার স্বরটার সুষ্ঠু বদল হয়! তবু হঠাৎ যেন কেমন খাপ খাওয়াতে না পেরে বলে, আচ্ছা তোমার যে সেই যমজ বোন ছিল? মানে সেই নমিতা–
আমি গম্ভীর গলায় বললাম, সে তো অনেকদিন হল মারা গেছে।
মারা গেছে।
মাস্টার থতমত খেল।
মাস্টার অপ্রতিভ গলায় বলল, খবরটবর তো জানা নেই। কিছু মনে কোরো না।
না মনে করার কি? যাবেন তো?
যাব? আমি আর কী যাব? কাউকে চিনি না!
বাঃ আমায় তো চেনেন? অত স্নেহ করতেন আমায়!
দুঃসাহসের এই পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে তাকিয়ে রইলাম নির্নিমেষ! দেখলাম সেই খোঁচা খোঁচা দাড়িওলা বুড়োটে চিবুকটা কেমন নড়ে উঠল, চোখ দুটো কেমন কাঁচ কাঁচ হয়ে উঠল, তারপর স্নান গলায় উচ্চারিত হল, হ্যাঁ, তা তো ঠিক! কিন্তু মানে আমার শরীরের অবস্থাও তো দেখছ। না পারলে কিছু মনে কোরো না।
৬. হেসেই অস্থির
বাইরে এসে প্রিয়মাধব হেসেই অস্থির। উঃ আচ্ছা বিপদে ফেলেছিলে বুড়োকে! তবু ভাগ্যিস নাম দুটো মনে রেখেছিল!
বললাম, সেটাই তো আসল। নামই তো সব! নাম জপই তো সব। নাম জপেই দেবতার প্রাণ প্রতিষ্ঠা।
হল শুরু কবিত্ব! তোমার কি বিশ্বাস বুড়ো সেই পুরনো কালের দুর্বলতা মনে করে বসে আছে?
হেসে বললাম, মনে করে কি আর বসে থাকতে হয়? যে থাকবার সে নিজেই মনের মধ্যে চেপে বসে থাকে। আমি ঠিক বুঝতে পেরেছি, এ যদি আমি না হয়ে সত্যিকার সুমিতা হত, ও ঠিক অনুভব করতে পারত!
প্রিয়মাধব বিশ্বাস করেনি।
প্রিয়মাধব হেসেছিল।
তারপর প্রিয়মাধব গাড়িতে আসতে আসতে একটা কথা বলেছিল।
হ্যাঁ, গাড়িতে শুধু ও আর আমিই আসছিলাম। ও বলল, সুমিতা
হেসে বললাম, দেখ হাতে হাতে প্রমাণ। নামের মহিমা! বুঝতে পারছ নামই জপের বস্তু।
ও আস্তে বলল, সে তো বুঝি! কিন্তু একটা কথা–এতদিন সংসারে কোনও চোখ ছিল না, আমাদের মধ্যেকার ফাঁকি ধরা পড়ত না, এখন বাড়িতে বউ আসবে, যত ছেলেমানুষই হোক, তবু মেয়ের চোখ, যে যদি ধরে ফেলে?
ওর কথার উদ্দেশ্য বুঝতে পারছিলাম না। বলেছিলাম, মেয়ের চোখ যে ভয়ংকর বস্তু আমিও সে সত্য অস্বীকার করি না। তা হলে কী করা? চলে যাব? তা বলো তো কোনও তীর্থে-টির্থে চলে যাই
আঃ নমিতা!
ও রেগে উঠল।
রাগের গলায় বলল, আঃ নমিতা, আমি বলতে চাইছি, বাইরেটা আমাদের খুব মজবুত রাখতে হবে বুঝলে? দেখাতে হবে আমাদের মধ্যে কোনও ফাঁক নেই, কোনও ফাঁকি নেই। আমরা খুব সুখী!
আমি গম্ভীর গলায় বললাম, তার মানে ভেজালের উপর আরও ভেজাল? কিন্তু তাতে লাভ?
লাভ?
প্রিয়মাধব গাঢ় গলায় বলল, লাভ হচ্ছে প্রেস্টিজ বজায়। শ্বশুর শাশুড়ির মধ্যে যদি ইয়ে না দেখতে পায়, পরের মেয়ে জো পেয়ে যাবে, মানবে না, অবজ্ঞা করবে!
বিস্মিত হয়েছিলাম।
ও এমন ভাবে তলিয়ে ভাবতে পারে, কখনও টের পাইনি। আস্তে বললাম, তা হলে কী করতে হবে বলো?
ওই তো। বলছি যে নতুন চোখকে দেখাতে হবে আমরা খুব সুখী–
বুঝেছি! হেসে উঠলাম আমি, বোঝাতে হবে আমরা খুব সুখী, আমাদের মধ্যে প্রেমের বন্যা বইছে, আমরা দুজনে একদণ্ড না দেখলে অধীর হয়ে উঠি
প্রিয়মাধব বলল, জানতাম তুমি বুঝতে পারবে! শুধু সমস্ত জীবনটাই তুমি ব্যঙ্গের ছলনায় নিজেকে ঢেকে রেখে এলে!
তা একটা কিছু দিয়ে তো ঢাকতেই হবে–গম্ভীর গলায় বললাম, মানুষ তো পশু পক্ষী নয় যে কাপড়-চোপড় না হলেও চলবে তার!
ও বলল, সেই তো। চলে না বলেই তো এ কথা বলা! মোটা পোশাকে নিজেদের ঢাকতে হবে। পরের মেয়ের সামনে নিরাবরণ হলে চলবে না।
দেখা যাক! চেষ্টা করব সুখীর ভূমিকা অভিনয় করতে।
ও একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল।
বলল, অথচ এমন দিনও ছিল, যখন অভিনয় না করেও চলত! সত্যিই সুখী ছিলাম আমরা।
আমি লীলাভরে বলে উঠলাম, তাই নাকি? সেটা কবে গো? খ্যাপার মতো কবে সেই পরশ পাথর পেয়ে হারিয়েছি?
ও বলল, তুমি ঠাট্টা করছ। কিন্তু সেই প্রথম প্রথম, সুমিতাকে হারিয়েও! তখন কি সুখী ছিলাম না আমরা?
.
হয়তো ওর কথা ভুল নয়।
হয়তো তবুও আমরা সুখী ছিলাম।
আমাদের সেই যন্ত্রণাময় যৌবনের রাত্রির মার খেয়ে খেয়েও সুখীই ছিলাম।
কারণ আমাদের মধ্যে আকর্ষণের তীব্রতা ছিল তখন! পরস্পরকে আঘাত হানার মধ্যেও তাই উগ্র একটা সুখের স্বাদ ছিল।
আর অরুণ বড় হয়ে ওঠার পর সম্পর্কটাও কেমন সহজের সুরে গেঁথে গিয়েছিল।
অরুণের কাছে ফাঁকি ধরা পড়ার ভয়েই হয়তো সেই সুখের অভিনয়ের মধ্যে সহজের স্বাদ পাওয়া।
প্রিয়মাধব বলত, অরুণ। তোর মাকে বল তো গোটা তিরিশ টাকা বার করে রাখতে।…খোকা, তোর মার সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক কর সামনের ছুটিতে কোথায় আমরা বেড়াতে যাব।…বলল তো, সুমিতা তুমি আর তোমার ছেলেতে মিলে দেখছি এক দল হয়ে আমায় কোণঠাসা করে জব্দ করে ফেলছ। সুমিতা, এবার বোর্ডিঙে যাবার আগে তোমার ছেলের কী কী লাগবে লিস্ট করে রেখো!
.
খোকা, তোর মা!
সুমিতা, তোমার ছেলে!
বারবার এই মন্ত্র জপ করতে করতে সিদ্ধ হয়ে উঠছিল যেন ও।
আমিও সেই সিদ্ধির সুরে সুর লাগাতাম বইকী! বলতাম, দেখ থোকা, তোর বাবার প্রত্যাশায় বসে থাকলে আমাদের আর বেড়াতে যাওয়া হয়েছে!… দেখিস খোকা লিস্ট দেখে তোর বাবা প্রথমে তর্ক করবে, বাড়াবাড়ি বলবে, তারপর নিজেই ডবল জিনিস কিনে আনবে।
এমনি আরও কত কথার চাষই করতাম আমরা খোকাকে ঘিরে ঘিরে।
মায়ের মতো শান্ত মিতভাষী অরুণ আমাদের এই লীলার দর্শক হয়ে শুধু লাজুক মুখে হাসত।
বোর্ডিং থৈকে যখন আসত অরুণ, আমরা ঠিক মা বাপের মতোই শহরের স্টেশনে যেতাম ওকে আনতে। ছুটিতে বাড়ি আসার সেই প্রথম আবেগে অরুণ হয়তো একটু বেশি কথা কয়ে ফেলত, আমি বলতাম, খোকা তুই বাবার সঙ্গে বেশি কথা বলছিস।
অরুণ লজ্জা পেয়ে তার গল্পের শ্রোতা হিসেবে আমাকেই লক্ষ্য করত। প্রিয়মাধব তখন বলত, খোকা ভারসাম্য রক্ষা হচ্ছে না, ওদিকটা বড় ঝুঁকি হয়ে যাচ্ছে!
হেসে উঠতাম তিনজনেই।
তখন তো আমরা খুব অসুখে ছিলাম না।
পাছে লোকে আমাদের ভিতরের সম্পর্কের গলদ বুঝতে পারে, সেই ভেবে লোকের সামনে পরম সুখী দম্পতি সেজে সেই অভিনয়, তারপর প্রিয়মাধবের সেই বিষণ্ণ কাতর আক্ষেপ, এটা যদি সত্যিই হত নমিতা! যদি কোনও মন্ত্রবলে আমরা ভুলে যেতে পারতাম তুমি সুমিতা নও!
আর তারপর আমার কৌতুক হাস্যচ্ছটা, ব্যঙ্গ উপহাস, পরিহাস! ওর বিষণ্ণতা কেটে যেত। হয়তো রাগত, হয়তো হাসত।
মাঝে মাঝে আবার তবুও বিপদ আসত।
যেমন সেবার নতুন চা বাগানের ঝিটার কাছে ধরা পড়তে পড়তে রয়ে যাওয়া।
ঝিটা ভাল বাংলা বলত।
সে প্রথম দিন ঘর ঝাড়তে এসে গালে হাত দিয়ে বলেছিল, এ কী মেমসাহেব আপনার বিছানা আলাদা ঘরে কেন?
আমি তাড়াতাড়ি বলেছিলাম, সাহেব অনেক রাত অবধি বই পড়েন, চোখে আলো লাগলে ঘুম হয় না আমার!
ঝিটা প্রবল প্রতিবাদ জানিয়েছিল, আমার এই স্বার্থপরতার বিরুদ্ধে।
এ গল্প করেছিলাম প্রিয়মাধবের কাছে হেসে হেসে।
প্রিয়মাধব বলেছিল, তা এ প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া স্বাভাবিক। একটা বাড়তি বিছানা এ ঘরে সাজিয়ে রাখলেও হয়।
চমৎকার!
ও গভীর চোখে তাকিয়ে বলেছিল, আর সত্যি বলতে একটা ঘরে দুটো খাট রাখলেও এখন বোধহয় আর কোনও অসুবিধে ছিল না।
অসুবিধে ছিল না? বলেছিলাম নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে।
ও বলল, মনে হয় না।
খোলা তলোয়ারের উপর তো বাস করছি, সেটার ধার পরীক্ষা করতে চাও বুঝি?
চাইলেও ক্ষতি নেই। পাথরে তলোয়ার অকেজো।
নিজেকে খুব মহাপুরুষ ভাবো বুঝি এখন?
মোটেই না, চিরকালই নিজেকে কাপুরুষ বলে জানি। আর তোমাকে পাথরের প্রতিমা বলে জানি।
আমি চুপ করে গেলাম।
কিন্তু আমি প্রতিবাদ করলাম না।
এই জানাটাই তো ওকে জানিয়ে এসেছি আমি। আমার সেই বোকা অহংকার ওকেও নষ্ট করল, আমাকেও ক্ষয় করল।
তবু চা বাগানে ওর সঙ্গে বেড়াতে গেছি আমি মেমসাহেব সেজে, মেমসাহেবের মান্য আর সেলাম কুড়িয়েছি। অরুণের ছুটির সময় নতুন নতুন দেশে বেড়াতে গিয়ে ভিতরের শূন্যতা ভুলে যেন ভরাট হয়ে উঠেছি, সেই স্মৃতিই সুখস্মৃতি।
স্মৃতি বড় মমতাময়ী।
সে সযত্নে সমস্ত জ্বালা যন্ত্রণায় তিক্ত স্বাদগুলি ধুয়ে মুছে তুলে রেখে দেয় মধুরটুকু সুন্দরটুকু।
তাই দুর্গম দুরূহ পথের দুর্গতি ভুলে গিয়ে মানুষ আবার নতুন তীর্থযাত্রায় মাতে, প্রসব যন্ত্রণার ভয়াবহ স্মৃতি বিস্মৃত হয়ে মা আবার দ্বিতীয় সন্তানের জননী হতে চলে।
তাই আমাদের সেই চা-বাগানের মাথাকোটা দিনগুলোর মধ্যেও সুখের স্মৃতিটুকুই স্মৃতি হয়ে ছিল প্রিয়মাধবের মধ্যে!
তাই প্রশ্ন করেছিল, তখন কি আমরা সুখে ছিলাম না?
.
এখানে এসে সে জীবন হারিয়েছি আমরা।
তা ছাড়া বিয়ে হয়ে অরুণও তো কেমন বদলে গেল।
অথবা হয়তো বদলায়নি।
আমাদেরই অরুণকে তার বউ উত্তরার পৃষ্ঠপটে দেখতে অভ্যস্ত হচ্ছিলাম! যে পৃষ্ঠপটটা বিবর্ণ অনুজ্জ্বল ধোঁয়াটে।
উত্তরা যদি সোজাসুজি পাজি মেয়ে হত, হত মুখরা কি কুঁদুলে, অবাধ্য কি উদ্ধত, হয়তো স্বাভাবিকতা থাকত, আমাদেরও অসুবিধেটা কম হত।
কিন্তু উত্তরা তা নয়।
উত্তরা সভ্য মার্জিত, স্বল্পভাষিণী, আর সত্যের খাতিরে বলতেই হয়, নম্র বিনীত।
কিন্তু ওর ওই বিনয়ের পিছনে যে অবজ্ঞা ছিল, ওর ওই নম্রতার পিছনে যে অনমনীয়তা, আর ওই ভিজে বেড়াল মার্কা সভ্যতার অন্তরালে যে অসভ্যতা, তা যেন লঙ্কাবাটার জ্বালা ধরায়।
আগুনের জ্বালা ধরায় আমাকে, ওর ঈর্ষার বহর দেখে।
বিয়ের কনে থেকেই দেখছি আমাদের ভালবাসা উত্তরার চক্ষুশূল।
লক্ষ করে বুঝতে হত না, ওর প্রতিটি কথায়, প্রতিটি অভিব্যক্তিতে ধরা পড়ত সেই ঈর্ষা! প্রিয়মাধবকে বলেছিলাম, তোমার প্রেমাভিনয়টা একটু কমাও, পরের মেয়ের বিষ লাগছে।
প্রিয়মাধব উত্তর দিয়েছিল, খুব ভাল, এটাই তো চেয়েছি।
আচ্ছা কেন বলো তো?
বুঝবে না তুমি। আর বুঝবে নাই বা কেন? একটা মেয়ের চোখের সামনে, আমরা নিঃস্ব আমরা শূন্য, এটা ধরা পড়া কি গৌরবের? তা ছাড়া
হেসে উঠে বললাম, তুমি আজকাল লুকিয়ে বাংলা নাটক নভেল পড়ছ নাকি গো? নইলে এত ভাল ভাল কথা শিখলে কোথা থেকে?
ও বলল, আমার জীবনটাই তো একটা নভেল। শিখি তো তার থেকেই শিখেছি।
আগে বড় একটা ওর মধ্যে এই চিন্তার গভীরতা দেখিনি। হয়তো সত্যিই তাই, ওর জীবনটাই ওর মাস্টার। ওর এই সুরের সঙ্গে অন্তরঙ্গতার সুর মিশিয়ে যে কথা বলা উচিত ছিল, তা কি বলেছি? বলিনি। সেই চির অভ্যাসে হেসে হেসে বলেছি, ওরে বাস! শুনে ভয় করছে। কিন্তু তা ছাড়া-টা কী?
তা ছাড়া? তা ছাড়াও অন্য দিকে তাকিয়ে বলে, নিজের কাছেই নিজে একটা হেঁয়ালি! বুঝতে পারি না সবটাই অভিনয় কিনা।
কষ্টে বলি, তবে ভাবো বসে বসে হেঁয়ালির অর্থ!
নাঃ ভাবাভাবি ছেড়ে দিয়েছিও হঠাৎ সোজা হয়ে উঠে বসে বলে, কিন্তু উনিই বা কেমন অভদ্র ঘরের মেয়ে যে শ্বশুর শাশুড়ির ভাব দেখলে ওঁর রাগ হয়? কারণটা কী?
হেসে বললাম, দেবা ন জানন্তি।
কিন্তু এ ক্ষেত্রে উত্তরার ওই কারণটা জানা মোটেই শক্ত ছিল না। কারণ হচ্ছে অরুণমাধবের প্রকৃতির মৃদুতা! অরুণ আস্তে চলে ফেরে, আস্তে কথা বলে, আস্তে হাসে, আস্তে খায়। অরুণ দাড়ি কামায় এক ঘণ্টা ধরে, স্নান করে ঘণ্টা ছাড়িয়ে, সারা সকালই অফিস যাবার প্রস্তুতি ওর। স্ত্রীর কোনও দাবি মেটাবার সময়ই নেই ওর। এমন স্বামী কোন মেয়ের পছন্দ? কে না জানে উগ্র কড়া স্বামী অনেক পছন্দ মেয়েদের, নিরীহ শান্ত স্বামীর চেয়ে। উত্তরার কাছেও অরুণমাধব তাই অনেক নম্বরে ফেল।
উত্তরার স্বামী স্ত্রীকে নিয়ে মাতামাতি করতে জানে না, অথচ মা বাপের প্রাপ্য সম্মানের পাওনা দিতে জানে, এটাও কম বিরক্তিকর নয়।
তবু হয়তো এত বিরক্তি আসত না, যদি উত্তরা ওর প্রৌঢ় শ্বশুরের প্রকৃতিতে যুবকোচিত উত্তাপ আর উৎসাহ না দেখত! উত্তরার শ্বশুর হাঁটে টগবগিয়ে, কথা কয় জোরে জোরে, হাসে প্রচুর, খায় প্রচুর। সব কাজে চটপটে সে।
আর স্ত্রীকে নিয়ে মাতামাতিটা তো প্রায় দৃষ্টিকটু।
সারাদিন তার হাঁক পাড়াপাড়ি, বউমা, তোমার শাশুড়ি কোথায় গেল? বউমা তোমার শাশুড়ি ঠাকরুন করছেন কী?…সুমিতা, তুমি যে বলেছিলে তোমার চশমাটার পাওয়ার বদলানো দরকার, কই যাবে তো চলো।… সুমিতা, কই নতুন বউকে নিয়ে আমোদ-আহ্লাদ করছ না? বলো তো থিয়েটারের টিকিট কেটে আসি।…
ওর প্রকৃতির এই প্রাচুর্য তো সবটাই কৃত্রিম নয়। এটাই ওর প্রকৃতি। ওর বিধাতার দান। এই প্রাচুর্যের ফাঁদেই আটকা পড়েছিল একদিন নমিতা নামের একটা মেয়ে। শুধু এই অগাধ প্রাচুর্যের মুখে প্রকাণ্ড এক পাথর পড়ে গিয়ে সহজ প্রবাহের পথটা গিয়েছিল চেপে। তাই সে কখনও বিকৃতির পথে, কখনও ঘূর্ণি পথে, আর কখনও পথ হারিয়ে পাক খেয়ে মরেছে।
এখন
পরের মেয়ের কাছে মান সম্মান বজায় রাখবার জন্যে সেই পাথরটাকে জোর করে সরাচ্ছে ও, তাই কখনও বা কৃত্রিম লাগছে। কিন্তু আমি বুঝতে পারি এই অভিনয়টাই ওর আসল। এই জীবনটা পেলেই ও বর্তে যেত।
কিন্তু ওর বিধাতা কিছুতেই যে বর্তাতে দেবেন না ওকে। এই পণ করে রেখেছেন। কী দোষ আমার, কী বা দোষ ওর ছেলের বউয়ের?
শুধু উত্তরার হিংসের চোখ অতবড় দেহটাকে ভেঙে-চুরে হুড়মুড়িয়ে ফেলে দিল, এ কথা বলব। কোন মুখে?
ওর জীবনের অমিতাচারের ইতিহাস তো আমার অজানা নয়!
তবু ভাবি উত্তরা যদি অতটুকু বয়েসের খোলসে অতখানি পাকা মনটা ভরে নিয়ে না আসত!
হয়তো চারখানা থিয়েটারের টিকিট কেটে আনত প্রিয়মাধব, হাঁক পাড়ত খোকা নাম! বউমা তোমার শাশুড়ি ঠাকরুনকে নামাও মা!
খোকাও নামত না, বউমাও নামত না।
নামতাম আমি।
চাপা গলায় বলতাম, ওরা যাবে না। চলো আমরাই যাই।
প্রিয়মাধব আমার চাপা গলার মর্যাদা রাখত না। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলত, কেন, ওঁরা যাবেন না কেন শুনি? কী রাজকার্য পড়ল ওঁদের?
আমি ওকে নিবৃত্ত করতে পারতাম না।
তখন অরুণমাধব নেমে আসত, ভারী মুখে বলত, ওর মাথা ধরেছে নাকি, চলো আমরাই যাই।
প্রিয়মাধব বলত, ঠিক আছে। তাই যাব! আশ্চর্য, মাথাটাও খুব হাতধরা আমার বউমার। দরকার মাফিক ঠিক সময়ে ধরে ওঠে।
আমি হাঁ হাঁ করে বলতাম, কী যে বলো! মাথাধরার একটা ধাত থাকে বুঝলে? খোকা, তুই যাবি মানে? বউমা একা থাকবে?
খোকা চাপা ভারী গলায় বলত, থাকলেই বা, ভূতে তো আর খেয়ে ফেলবে না। চলো চলো। বুঝতে পারতাম না, এই বিরক্তিটা কার উপর! আমাদের নির্লজ্জতা, না বউমার অবাধ্যতা, কোনটা ওকে এমন প্রকৃতিছাড়া অসহিষ্ণু করে তুলছে।
তবু নির্লজ্জ আমাদের হতেই হচ্ছে।
ভালবাসার আধিক্য দেখানো ছাড়া উপায় কোথায় আমাদের? পায়ের নীচে মাটি কই?
ভালবাসা না দেখালে কীসের.জোরে খাড়া হয়ে থাকব ওদের সামনে? প্রিয়মাধবের সিদ্ধান্ত ভুল নয়।
.
আমার সঙ্গে ওর সতীনের সম্পর্ক নয়, এটা যেন মাঝে মাঝে ভুলে যায় উত্তরা। ওর চোখে সেই দৃষ্টি। অথচ বউকে নিয়েও তো কম মাতামাতি করতে চেষ্টা করেনি প্রিয়মাধব। বউমা, কী শাড়ি তোমার পছন্দ? বউমা, কোন মাছ খাবে বলো? বউমা, কোন ফুলে তোমার রুচি? বউমা, মুখখানি কেন পেঁচা করে বসে আছ মা! মায়ের জন্যে মন কেমন করছে বুঝি? বলো তো পৌঁছে দিয়ে আসি
এ তো হরদম চালিয়ে যেতে চেষ্টা করেছে।
কিন্তু চালাতে পারেনি।
পাথরে ঠেক খেয়ে ফিরে এসেছে।
মাঝে মাঝে বলেছে প্রিয়মাধব, আচ্ছা, ও কি আমাদের সন্দেহ করে?
আমি উড়িয়ে দিয়েছি। বলেছি, পাগল? সন্দেহের কারণ কী?
তবে অমন করে কেন ও?
কত মেয়ের কত রকম প্রকৃতি!
আমি বলতাম, কারও জীবনকে মহানিশা করার ক্ষমতা কি মানুষের? যার যা বিধিলিপি।
ও মাথা হেঁট করত।
বলত, তা বটে!
এমনি চলতে চলতে আমরা কি ক্রমশ পরস্পরের কাছাকাছি এসে যাচ্ছিলাম?
জানি না।
এর মধ্যেই তো এল সেই ভয়ংকর দিন!
প্রিয়মাধবের স্ট্রোক হল।
চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেল ও।
যেন ছুটন্ত ঘোড়া দুর্বার বেগে ছুটতে ছুটতে খাদে গড়িয়ে পড়ে গেল।
সেই ভয়ংকর মুহূর্তে আমি নাকি ওর নাম ধরে চেঁচিয়ে উঠেছিলাম!
জানি না, আমার জ্ঞান ছিল না।
পরে উত্তরা মুচকি হেসে বলেছিল, আপনারা বুঝি দুজনেই দুজনকে নাম ধরে ডাকেন মা?
ওর সামনে বেশিক্ষণ ভুরু সোজা রাখতে পারি না আমি, সেদিনও পারিনি। বলেছিলাম, তার মানে?
ও নিরীহ মুখ নিয়ে বলেছিল, মানে কিছু না। যেদিন বাবা সিঁড়িতে গড়িয়ে পড়ে গেলেন, সেদিন দেখলাম কিনা আপনি বাবার নাম করে চেঁচিয়ে ডেকে উঠে ঝাঁপিয়ে গিয়ে পড়লেন।
আমি এই ধৃষ্টতার দিকে তাকিয়ে বলেছিলাম, বিয়ে দেবার আগে মেয়েকে সহবত শিক্ষা দিতে হয়, এটা বোধহয় তোমার মা জানেন না বউমা!
ও মুখ কালো করে উঠে গিয়েছিল।
এই মুখ কালো করে উঠে যাওয়ার ভঙ্গিটাই ওর সব সময়ের ভঙ্গি!
ভাবি, বলব না কিছু।
তবু বলা হয়ে যায়। হয়তো ও বলিয়ে ছাড়বে পণ করেই আসে।
আমি যদি দৈবাৎ কোনও দিন সময় পেয়ে অরুণের কোনও প্রিয় খাদ্য তৈরি করে রাখি, উত্তরা। আত্মস্থ গলায় বলে, কেন বৃথা কষ্ট করছেন, ওসব ও খেতেই পারে না।
আমি যদি বামুন ঠাকুরের কাছে গাওয়া ঘিয়ের বোতল রেখে বলে রাখি দাদাবাবুর খাবার সময় মনে করে দিও ঠাকুর! উত্তরা আমার কানে পৌঁছনো সুরে আদেশ দেয়, দাদাবাবুকে কাঁচা ঘি দিও না ঠাকুর, সহ্য হয় না ওর!
আমি যদি দৈবাৎ কোনও দিন বলি, তোমার শ্বশুর ডাকাডাকি করছেন বউমা, চললাম, তুমি তোমার শ্বশুরের এই হালুয়াটুকু করে আনো তো৷
ও অম্লান বদনে বলে, আমার হাতের হালুয়া তো বাবার পছন্দ হবে না মা, ও আপনি পরে এসে করে নেবেন।
এতেও কি ভুরু সোজা রাখা সহজ?
চুপ করে থাকা সম্ভব?
বলব না বলেও মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়, পছন্দ হবেই, এমন ইচ্ছে নিয়ে করলেই পছন্দ হয় বউমা?
বলা হয়ে যায়, অরুণের কী সহ্য হয় না হয়, সেটা আমার থেকে তুমি বেশি জেনে ফেললে কী করে বলো তো বউমা?
ও মুখ কালো করে উঠে যায়।
আর তারপর অরুণ মুখ ম্লান করে ঘুরে বেড়ায়।
.
দিদি যদি থাকত, দিদির সংসার কি দিদিকে সসম্মানে জায়গা দিত?
পঙ্গু হয়ে পড়ে থেকেও নিষ্ঠুর হত না প্রিয়মাধব?
হয়তো তাই হত।
দিদি সহজ অধিকারের দাবিতে ঠিক জায়গায় প্রতিষ্ঠিত থাকত, আমি সেই প্রতিষ্ঠার জায়গাটা ঢিলে হয়ে যাবার ভয়ে বারবার স্কু আঁটতে যাই, তাই হয়তো সবটাই কড়া কঠিন হয়ে ওঠে।
বহু জন্মের শত্রু সেই আমার দিদিকে যদি সামনে পেতাম একবার!
মনে মনে বৃন্দাবনের পথে পথে কত ঘুরেছি, দিদিকে ধরে ফেলেছি, হাতে ধরে বলেছি, দিদি সাধ মিটেছে। তোর জিনিস তুই নে। ফিরিয়ে দে আমার সেই থান কাপড়খানা। যেটা চুরি করে নিয়ে যাবার
সঙ্গে সঙ্গে তুই আমার সারা জীবনের শান্তি চুরি করে নিয়ে গিয়েছিলি।
কিন্তু গেলাম কই সেই বৃন্দাবনে?
যেখানে দিদি মায়া হয়ে ছায়া হয়ে কল্পনা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে?
না, কোথাও গেলাম না আমি।
পালালাম না, আত্মহত্যা করলাম না। কলকাতার এই ছোট্ট বাড়িখানার একখানা ঘরে আস্তে আস্তে ক্ষয় হচ্ছি আমি।
ক্রমশই বাকি সব ধূসর হয়ে যাচ্ছে।
এখন শুধু জানি সকালে উঠেই প্রিয়মাধবের মুখ ধোওয়ার জল গরম করতে হবে, তারপর তার বেডপ্যান আনতে হবে, তারপর তাকে স্পঞ্জ করাতে হবে, তারপর তাকে ফলের রস আর দুধ খাইয়ে তার উপযুক্ত রান্নাটুকু করে নিতে হবে, তারপর তাকে খাইয়ে দিতে হবে, তারপর তাকে খবরের কাগজ পড়ে শোনাতে হবে–এই তারপরের মালার সুতো কোথাও ছিঁড়ে ঝুলে পড়ে না, জপের মালার মতো ঘুরে ঘুরে আসে শুধু!
প্রিয়মাধবের এই অবস্থার জন্যে নিজেকে দায়ী মনে করেই কি ওর এত সেবা করছি আমি? না ওর সেবা না করে আমার উপায় নেই বলে?
জানি না।
বোধ করি উপায় নেই বলেই।
ও আমাকে অপমান করে, আমি ওর এই অধঃপতনের মায়ায় মরে যাই, লজ্জায় মরে যাই।…
অরুণমাধব বলে, মা, এমন করে শরীরকে অযত্ন করছ, ওটা তোমার স্বার্থপরতা। বাবার জন্যেও অন্তত খাড়া থাকতে হবে তোমায়।
আমি বলি, তাই তো থেকে এলাম এতদিন।
ও মানে বুঝতে পারে না, তাকিয়ে থাকে।
কিন্তু আর কতকাল খাড়া থাকব আমি?
আমার এই দীর্ঘদিনের যন্ত্রণার ইতিহাস কেউ জানে? কেউ শুনবে কান দিয়ে?
কতবার ভেবেছি অরুণকে এ কথা বলে যাব আমি।
কোথাও একটা স্বীকারোক্তির দরকার আমার।
কিন্তু মায়াই আমার সর্বনাশ করেছে। বলতে দেয় না।
অরুণ যখন মা বলে কাছে আসে, তখন কী করে বলব, অরুণ, আমি তো তোর মা নই, আমি তোকে এতদিন শুধু ঠকিয়ে এসেছি।
কিন্তু মানুষ যে নিজেই নিজেকে অবিরত ঠকিয়ে চলে, বুঝতে পারে সেটা? নিজেকে চেনে না মানুষ! কলকাতায় আসার আগে কি ভাবতে পারতাম আমি, একদিন লুকিয়ে রিকশাগাড়ি চড়ে হেমন্ত উকিলের ভাইদের বাড়ির সামনে বেড়াতে যাব?
.
তবু গিয়েছিলাম একদিন। মনকে চোখ ঠেরে বলেছিলাম, দেখি গিয়ে সেই বুড়িটা আছে কিনা?
কিন্তু থাকা কি সম্ভব? আবার অসম্ভবও নয়। বাড়ির মালিকরা যদি আমায় দেখতে পেত? তারা কি চিনতে পারত? চিনে ফেলে বলে উঠত, এ কী, পেতনিটা আবার কোথা থেকে এল! এটা না মরে গিয়েছিল?
না কি ওরা ভাবত ইনি বউদির বোন সুমিতা দেবী। প্রিয়মাধবের স্ত্রী!
ওরা কী বলে, জানতে ইচ্ছে হয়েছিল আমার, কিন্তু ওদের কাউকে দেখতে পাইনি। ওরা ও বাড়ি ভাড়া দিয়ে কোথায় চলে গিয়েছিল।
আমি যদি এই বাড়িটাতেই থেকে যেতাম, ওদের সঙ্গে ঝগড়া কোঁদল করে, বার ব্রত আর উপোস করে, হেমন্ত উকিলের মার মতন একটা শুকনো বিধবা বুড়ি হয়ে যেতাম, তা হলেই কি উচিত হত আমার?
জীবনের সব কিছুই ভুল আমার?
না, সে কথা ভাবতে পারি না।
সে- জীবনে আমি প্রিয়মাধবকে পেতাম কোথায়?
তার ভালবাসা আর না-ভালবাসা, তার আদর সম্মান আর ঘৃণা অপমান, সব কিছুই তো অজানা থেকে যেত আমার?
সেই অর্থহীন জীবনের মূল্য কী?
তবু উকিলদের বাড়িটা দেখতে ইচ্ছে হল আমার।
.
রিকশা করে গেলাম।
আমাদের সিকদার বাগানের এই বাড়িটা থেকে খুব বেশি দুর ছিল না ও বাড়িটা।
বাড়িটার সামনে গিয়ে রিকশা থেকে নামলাম।
পয়সা দিলাম না।
বললাম, দাঁড়া, এক্ষুনি ফিরব!
তারপর ওকেই বললাম, কড়া নাড়া দে।
ভয়ানক একটা উত্তেজনা অনুভব করছিলাম। আবার কেমন যেন একটা ভয় ভয়। পালাতে পারলেই ভাল হয় যেন, কেনই বা এলাম? কী বলব?
কী বলব সেটা অবশ্য ঠিক করে রেখেছিলাম।
বলব, যমজ বোনের স্মৃতির জায়গাটা দেখতে এলাম একবার। এতদিন লোকালয়ের বাইরে চা বাগানে পড়ে ছিলাম।
ওরা নিশ্চয়ই সৌজন্য করে বসাবে।
নমিতার দেওর দুটোর নিশ্চয় বিয়ে হয়ে গিয়েছে, ছেলেমেয়ে হয়েছে, কাউকেই চিনতে পারা যাবে না। জিজ্ঞেস করে করে জেনে নিতে হবে।
কী লাভ হবে জেনে?
কী জানি!
হয়তো মনের একেবারে ভিতরের খাঁজে একটা অস্ফুট আকাঙ্ক্ষা ছিল, ওরা ওদের বাড়ির বিধবা বড় বউয়ের সেই আকস্মিক মৃত্যুর সংবাদ বিশ্বাস করেছিল কিনা, সে মৃত্যুতে দুঃখবোধ করেছিল কিনা।
যদিই দুঃখবোধ করে থাকে, লাভ কী হবে শুনে?
ভেবেছি সে কথা।
ভেবে ভেবে শেষ পর্যন্ত মনে হয়েছে, বোধ করি নিজের মূল্য যাচাই হওয়াই লাভ।
হেমন্ত উকিলের বিধবা স্ত্রীর কোথাও কোনও মূল্য আছে কিনা জানা।
অথচ ওই পরিচয়টার খোলসটার মধ্যে নমিতাকে তো কোনও দিনই ভরতে পারিনি।
কড়া নাড়ার পরে দোর খুলেছিল।
একটা বিরক্ত কণ্ঠ খবর দিয়েছিল, ও সব নামে এখানে কেউ থাকে না। হতে পারে বাড়িওয়ালার নাম, তারা ভাড়াটে।
কণ্ঠটা একটা বালিকার, কিন্তু ঝাঁজটা বালিকার মতো নয়। অকারণ জ্বালাতনে বিরক্ত সে।
বিরক্ত হবার অধিকার তার আছে।
আছে, সকলেরই বিরক্ত হবার অধিকার আছে। একদা হেমন্ত উকিলের বিধবা স্ত্রীরও ছিল, এখন আর নেই।
এখন শুধু পাথর হবার সাধনা তার।
এখন তার ছেলের শাশুড়ি যদি এসে বলে, সাবিত্রীর মতন মরা স্বামী নিয়ে যমের সঙ্গে যুদ্ধ বেয়ানের, তবু যুগটা তো সত্যযুগ নয় ভাই, তাই ভয় হয় সবই বুঝি বৃথা হয়।তা হলেও নরম মুখে বলতে হয় তাকে, বৃথা জেনেই তো করে চলেছি বেয়ান। যুদ্ধ নয়, ঋণ শোধ!
যদি বেয়ানের মেয়েও নরম গলায় বলে, কিন্তু আশ্চর্যের কথা এই, এত ইয়ে ছিল বাবার, অথচ এখন রাতদিন আপনাকে খিচোচ্ছেন!
ইয়ে বলেই সারে বেয়ানের মেয়ে।
তবু এখন আর ভুরু কোঁচকানো চলে না, মসৃণ রাখতে হয়। হেসে বলতে হয়, তবু রক্ষে বউমা যে, রোগে মতিভ্রংশ হয়ে রাতদিন আমাকেই খিচোচ্ছেন। অন্য কারও উপর কোপ পড়লে বিপদ আরও বাড়ত! কী বলেন বেয়ান?
ভাঙব তো মচকাব না, মরব তো মর্যাদায় হারব না, এই প্রতিজ্ঞার উপর জীবন কাটিয়ে এলাম, এখন কে জানে শেষরক্ষে হয় কিনা!
কিন্তু আমার এই লড়াইয়ের ইতিহাস কেউ জানবে না? আমার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সব শেষ হয়ে যাবে?
কিন্তু কাকে জানাতে চাই?
প্রিয়মাধবকে?
সে তো রথের পাদানিতে পা রেখেছে! আমার কথা জানবার জন্যে কি আমার মরণের পরে বসে থাকবে?
অরুণমাধব?
তাই কি ইচ্ছে হয়?
ও মানেই তো উত্তরা। যার ভয়ে রাত্রে ভিন্ন লিখি না। তবে কাকে?
চুপি চুপি তবে বলি, দিদি, তোর জন্যে লিখে মরছি এই কথার বোঝা!
হাঁ তোর জন্যে।
এখনও যে আমার আশা হয়, তুই আসবি।
হয়তো আমি মরে গেছি শুনলে নিশ্চিন্ত হয়ে এসে তোর ছেলেকে নিবি! দিদি তুই আর তোর সংসার তুই নে, পায়ে পড়ি তোর! শুধু তোর ওই চোখ জোড়াটা সরিয়ে নে আমার সর্বত্র থেকে।
.
এরপর ভারী খাপছাড়া খাপছাড়া লেখা।
কোনও পাতায় দু লাইন, কোনও পাতায় হয়তো দশ লাইন।
ভুল ভুল।
সারাটা জীবন আমি একটা ভুলের নৈবেদ্য জুগিয়ে এলাম।
দিদি আসবে না।
দিদি মরে গেছে।
দিদি সেই রাত্রেই খাদে পড়ে আত্মহত্যা করেছে।
আর আমাকে ঠেলে ফেলে দিয়ে গেছে আরও এক নিঃসীম অন্ধকার খাদের মধ্যে।
.
আচ্ছা, পরলোক বলে কি সত্যিই কিছু আছে? সেখানে কি সত্যিই আবার চেনা মানুষের সঙ্গে দেখা হয়?
দিদির কাছে গিয়ে কি বলতে পারব, দিদি চিরকাল তো শত্রুতা সাধলি, মরেও শত্রুতা সেধে যেতে ইচ্ছে হয়েছিল?
আত্মহত্যায় নাকি স্বর্গ নেই, পরলোক নেই, আছে শুধু প্রেতলোক! তা দিদির জন্যেই বা সেই প্রেতলোক নয় কেন? ও কি আত্মহত্যা করে মরেও স্বর্গে যাবার ছাড়পত্র পাবে? কেন? কেন? বেশ, আমিও তো সেখানে যাচ্ছি। নমিতাকে কি হত্যা করিনি আমি? অথবা এই সুমিতাকে?
প্রিয়মাধব আমায় বলে, যখন তখন কী অত লেখো?
আমি বলি, জবানবন্দি।
ও বুঝতে পেরেছিল, চেঁচিয়ে উঠে বলেছিল, পুড়িয়ে ফেলো বলছি, পুড়িয়ে ফেলল। ভেবেছ কি তুমি? তোমার ওই জবানবন্দি কে চায়?
আমি হেসে তুলে রেখেছি ওর সামনে আলমারিতে। জানি ও খাট থেকে নেমে এসে খুলে বার করতে পারবে না।
প্রতিদিন ও আমায় মিনতি করে, পুড়িয়ে ফেলো সুমিতা, পুড়িয়ে ফেলল।আমি হেসেছি। বলেছি, থাক না। যখন তুমিও থাকবে না–আমিও থাকব না। তখন কেউ দেখলেই বা কি?
ও রেগে বলেছে, যখন তুমিও থাকবে না–আমিও থাকব না, তখনকার জন্যে আমাদের কলঙ্ক কাহিনীটা পাকা খাতায় তোলা থাকুক, এই ইচ্ছে তোমার?
আমি হেসে বলেছি, কাহিনীটা কলঙ্কের? আমার তো তা মনে হয় না। আমি তো ভাবি প্রেমের।
হাসি দেখলেই জ্বলে যায় প্রিয়মাধব!
শুধু আমার নয়, সকলেরই।
পাশের বাড়ি থেকেও যদি কোনও সময় একটু হইহই হাসির আওয়াজ পাওয়া যায় তো চেঁচিয়ে ওঠে ও, হাসে কে? হাসে কে অমন অসভ্যের মতো? ঘুসি মেরে দাঁতগুলো ভেঙে দিতে পারে না কেউ?
আমি হাসলে তো কথাই নেই।
জ্বলে ওঠে, হাত বাড়িয়ে কাছের টেবিল থেকে ওষুধের শিশি নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে ভাঙে। আর বলে, লজ্জা করে না? লজ্জা করে না? হাসতে তোমার লজ্জা করে না? অন্য মেয়েমানুষ হলে কোনকালে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলত। বুঝলে? নয়তো বিষ খেত। অথচ তুমি বেহায়া মেয়েমানুষ, দাঁত বার করে হাসছ!
আমি কষ্টে ঠোঁটে দাঁত চেপে বলি, দাঁত পড়ে গেলে তো আর বার করে হাসবার উপায় থাকবে না? যতদিন আছে হেসে নিই!
ও বলত, ওঃ বটে! এখনও এত বাসনা? তবে যাও এ ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে হাসো গে! যাও যাও।
আসতেই হত একটুক্ষণের জন্যে।
খুবই একটুক্ষণের জন্যে।
কারণ পরক্ষণেই তো ডাক ছাড়বে ও, অরুণ অরুণ, তোমার মা-টি কোথায় গেলেন? এই হতভাগার এ সময় একটা ওষুধ খাবার কথা ছিল না?
আমি ঘরে আসি। বলি, এই তো ওষুধ খেলে, আবার ওষুধ খাবার বাসনা কেন?
ও চেঁচিয়ে ওঠে, ঘাট হয়েছে, অন্যায় হয়েছে। রোগের জ্বালায় সময়ের জ্ঞান ভুলে গিয়ে মহারানির বিশ্রামের ব্যাঘাত ঘটিয়ে ফেলেছি।
.
অরুণ আমায় একা পেলে বলে, মা আর কত খাটবে তুমি? একটা নার্স রাখা হোক।
আমি হেসে বলি, কূলে এসে তরী ডোবাব? এতদিনই যখন খেটে এলাম, তখন বাকি দিন কটাও–
.
ও অন্যদিকে তাকিয়ে অপ্রতিভ গলায় বলে, ডাক্তারবাবু তো বলেন, তার কোনও ঠিক নেই। হয়তো এই রকম অবস্থাতেই আরও দশ বছর
আমি ওর দিকে স্পষ্ট চোখ তুলে তাকাই।
বলি, তেমন হলে অবিশ্যিই নার্স রাখতে হবে তোকে।
ও হয়তো আমার এ কথার মানে বুঝতে পারে না। দুঃখিত গলায় বলে, তোমাকে একেবারে শেষ করে তবে নার্স রাখা হবে, এই তবে তুমি চাও?
আমি তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে দেখতে চেষ্টা করি এ আক্ষেপ ওর সত্যি, না শুধু ভদ্রতা? এ দুঃখ মায়ের জন্যে, না শুধু একটা মানুষের জন্যে?…ভালবাসা পেলেও তো বিশ্বাস করতে পারি না আমি এটা সত্যি। মনে হয় দয়া করছে, করুণা করছে। যাতে আমার আজীবনের বিতৃষ্ণা। অথচ কত লোককে দেখেছি শুধু দয়া কাড়বার জন্যেই বানিয়ে বানিয়ে দুঃখের গাথা গাইতে। বিশেষ করে মেয়েমানুষকে। অথচ আমার ওতেই
হ্যাঁ, তাই আমি অরুণের ভালবাসার চোখকেও সন্দেহের চোখে দেখেছি। ভাবছি দয়া নয় তো? ভাবছি রক্তমাংসের যোগ যেখানে নেই সেখানে সত্যি ভালবাসা আসবে কোথা থেকে?
ও যখন ছোট ছিল, ভাবতাম আমার উপর নির্ভর করতে হয়, তাই আমার উপর আকর্ষণ! মা ছেলের ভালবাসা যাচাই করতে হলে করতে হয় ছেলের বিয়ের পর। যখন ছেলেকে আর নির্ভর করতে হয় না।
কিন্তু আমি ওকে যাচাই করব কোন দাবিতে? আমায় যাচাই করবে কে?
আমি কি সত্যি মার মতো ভালবেসেছি ওকে? আমি তো ওকে আমার বলে ভাবতে পারিনি কোনওদিন। পরের জিনিস কেড়ে নিয়ে কাছে রেখেছি, সেই পাপে চিরদিন তার ভার বইছি, এই তো৷
.
দিদি, তুই স্বর্গে নরকে যেখানেই থাকিস, আমার এই দুঃসহ বঞ্চনার জীবনের যন্ত্রণা দেখতে পাচ্ছিস কি না?..যদি পাস তো একফোঁটা দয়া আমার জন্যে রাখিস।
হ্যাঁ দয়া।
যে দয়ায় আমার আজীবনের বিতৃষ্ণা।
শুধু তোর কাছে সেই জিনিসটা চাই দিদি।
আর যদি তুই এই পৃথিবীতেই থাকিস, আর আমার এই জবানবন্দির খাতা তোর চোখে পড়ে তো চোখের জল একফোঁটা ফেলিস আমার জন্যে।
অরুণকে আমি বলেছি, আমাকে শেষ করা তো তোদের হাতে নয় বাপু!
অরুণ ম্লান গলায় বলে, নয় কী করে বলি? বাবা তো সে ভার নিয়েইছেন দেখছি।
আমি হেসে উঠে বলি, যাক এতদিনে তোর বাবাকে চিনলি তুই। আহা মানুষটার কি আর মাথার ঠিক আছে?
অরুণ কিছু বলে না, হঠাৎ কোথা থেকে যেন ওর বউ এসে পড়ে নরম গলায় বলে, মাথার তো কোনও বেঠিক দেখি না। মাথা ঠিকই আছে। আপনার উপরই কেমন যেন একটা আক্রোশ–
আমি কি চেঁচিয়ে উঠব?
আমি কি ধমকে উঠব?…
না দেয়ালে মাথা ঠুকব আমি?
না কি আমার সেই চিরদিনের যত্নে লালিত বস্তুটিকে ভোগ করব এবার?
প্রিয়মাধবের ছেলে কৃতী হয়েছে, সে তার বাপের জন্যে নার্স রাখতে পারবে।
.
আশ্চর্য! এত পরিশ্রম এত অনিয়ম, তবু তো একদিনের জন্যে একটু অসুখ করছে না?
আমার মা-বাপের কোনও ফটো নেই, ফটো নেই পিসির। থাকলে এ বাড়িরই কোনও ধূলিধূসরিত দেয়ালে রং জ্বলে ঝাপসা হয়ে ঝুলত।
কারণ সিকদার বাগানের এই জরাজীর্ণ খাঁচাটা থেকে তো মুক্তি হয়নি আমাদের বাড়ি করব বাড়ি করব করতে করতেই তো প্রিয়মাধব পড়ে গেল।
ছবি নেই, তবু দেয়ালের ইটগুলো তো আছে। তাদের মধ্যে কি লুকোনো থাকে না আত্মা?
আছে ভেবেই বলি, তোমাদের এই যমজের আধখানা মেয়েটাকে কি লোহা দিয়ে গড়েছিলে?…তাই এত দুর্গতিতেও মরে না, অসুখ করে না।
কিন্তু একবার একটু অসুখ না করলে ওদের চোখে ধুলো দেব কী করে আমি? যাবার সময় কি হেয় হয়ে যাব আমি? হার মেনে চলে যাচ্ছি বলে দলিল রেখে যাব?
না না, কিছুতেই না।
আমি মানুষের মতন অসুখ করে মরে গেলাম, এ প্রমাণ রাখতে হবে।
দিদির চেয়ে বোকা হব নাকি আমি?
দিদি চালাকি করে আমার থান কাপড় চুরি করে নিয়ে পালিয়েছিল, নিজের সমস্ত বোকামি আর দুর্বলতা ওই থানখানার আড়ালে লুকোতে চেয়েছিল।
আমিই বা কেন সারাজীবনের জীবনান্তকর ফসল নিজের হাতে আগুনে পুড়িয়ে দিয়ে যাব?…
সামান্য একটু অসুখও আমার কাছে এত দুর্লভ?
আশ্চর্য!
আশ্চর্য!
আমি মরে যাচ্ছি। আমি চলে যাচ্ছি।
প্রিয়মাধবকে শেষ পর্যন্ত সেবা করা আর হল না আমার। চাবিটা ওকে দিয়ে যাব। খাতাটা ও পোড়াতে বলে, পোড়াতে পারব না। ওই খাতার মধ্যে নমিতা নামের সেই মেয়েটা আছে বেঁচে।
হেমন্ত উকিলের ভাইয়েরা তো তিরিশ বছর আগে তার শ্রাদ্ধ করে সেরে রেখেছে। আর নিশ্চয় লোকের কাছে বলে বেড়িয়েছে, ঢের বারণ করেছিলাম, জোর করে চলে গেলেন। বোন-ভগ্নিপতির নতুন শখের জীবন, ওঁকে কে বা দেখেছে, কে বা যত্ন করেছে? এখন মরলেন তো? কিনা একটা বিষপোকার কামড়ে। অপঘাত আর কাকে বলে!
তবে?
নমিতা মুছে যাবে?
নমিতা রইল এই খাতার পাতায়।
.
খাতাটা মুড়ে রাখল নীহার।
দেখল, রাত তিনটে!
সময়ের জ্ঞান হারিয়ে এতক্ষণ ধরে এই কাঁচা হাতের উপন্যাসখানা পড়ছিল সে?
অরুণমাধবের মায়ের নাম সুমিতা, সে কথা শুনেছিল সে। ওঁর একজন যমজ বোন ছিল, যার নাম নমিতা, তাও শুনেছিল। কিন্তু কে ভেবেছিল তাঁরা অদ্ভুত এক উপন্যাসের নায়িকা।
কিন্তু এই নায়িকাদের বধ করতে হবে নীহারকে।
নীহার যাঁর মাইনে খেয়েছিল, সেই প্রিয়মাধবের আদেশ পালন করতে হবে তাকে। নমিতা নামের ওই নায়িকাটি পৃথিবী থেকে মুছে যাবে? যাক না!
ক্ষতি কী?
গিয়েই তো ছিল।
নতুন করে আবার উদঘাটন করে লাভ কী? সত্যি খবর জেনে অরুণমাধব তার সত্যি মাকে খুঁজে বেড়াবে?
তিরিশ বছর ধরে কি সত্যিই টিকে আছেন তিনি এই পৃথিবীতে? যদি থাকেন, ছমাসের যে ছেলেটাকে ফেলে রেখে গিয়েছিলেন তিনি, তাকে কি আবিষ্কার করতে পারবেন ওই তিরিশ বছরের বিবাহিত পুরুষটির মধ্যে?
নমিতা, সুমিতা এবং প্রিয়মাধবের মধ্যেকার এই উপন্যাস অতএব খতম।
আমি খতম করার কে?
আমি নিমিত্ত মাত্র।
.
সকালবেলা
অরুণমাধব শুকনো মুখে এসে প্রশ্ন করল, মিস ঘোষ, কিছু যদি মনে না করেন তো একটা কথা বলছিলাম–
বলুন।
আচ্ছা, বাবার ঘরের ওই আলমারিটা সেদিন যখন খুলেছিলাম, দেখেছিলেন আপনি?
খুলেছিলেন তো। আমার সামনেই তো খুললেন।
আচ্ছা, একটা জিনিস ছিল দেখেছিলেন?
মিস ঘোষ নিজ পদমর্যাদায় ফিরলেন।
মিস ঘোষ বললেন, এই প্রশ্নটা কি বেশ শোভন মনে হচ্ছে আপনার অরুণবাবু?
অরুণমাধব অপ্রতিভ হল।
অরুণমাধব কুণ্ঠিত গলায় বলল, আমি অন্য কিছু মনে করে বলিনি মিস ঘোষ, মানে দেখেছিলেন কিনা?
দেখেছিলাম। আলমারিটা খুলেছিলেন, দেখেছিলাম।
একটা মোটামতো খাতা ছিল দেখেছিলেন।
খাতা! তবু ভাল।
নীহার হেসে উঠল, আমি ভাবলাম টাকাকড়ি গয়নাপত্তর। কীসের খাতা? ব্যাঙ্কের পাশবই নয় তো?
না না, মনে হল যেন একটা অর্ডিনারি খাতা
সাংসারিক আয়-ব্যয়ের?
কীসের তাই তো জানি না ছাই! অথচ বেশ মনে রয়েছে, দেখেছি।
নীহার এবার তীক্ষ্ণ হবে, আপনার কি ধারণা, আপনার বাবার কোনও একখানি অমূল্য খাতা আপনার বাবার নার্স সরিয়ে ফেলেছে?
ছি ছি, এ আপনি কী বলছেন মিস ঘোষ?
কিন্তু আপনি তো তা ছাড়া আর কিছু বলছেন না। খাতাটা ছিল, খাতাটা নেই। আলমারি খোলার সময় আমি ছিলাম, আর কেউ ছিল না। অতএব
আমার অন্যায় হয়ে গেছে মিস ঘোষ, আমায় মাপকরবেন। আপনাকে পরিবারের আত্মীয়ের মতো মনে করি বলেই বলছি, বাবার মৃত্যুকালের প্রলাপের সঙ্গে ওই খাতার কোনও যোগ আছে মনে হচ্ছিল আমার।
আপনার ভুলটা কোথায় জানেন অরুণবাবু? রোগীর প্রলাপকে গুরুত্ব দেওয়া। ব্রেন যখন অকেজো হয়ে যায়, কত অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বেরোয় তা থেকে, ধারণা নেই আপনার, তাই অত ভাবছেন। আজীবন ব্রহ্মচারী সাধু-মহাত্মার প্রলাপোক্তি শুনে অনেক সময় কানে আঙুল দিতে হয়, চিরদিনের শান্ত সভ্য নম্র ব্যক্তির প্রলাপোক্তি অনেক সময় ভাবিয়ে অবাক করে দেয়, এ সব গালমন্দ ভদ্রলোক শিখলেন কখন? প্রলাপ নিয়ে মাথা ঘামাবেন না।
কিন্তু খাতাটা–
আমার সুটকেস খুলে দেখুন!
নীহার জানে, খুলবে না সুটকেস।
তাই নীহার স্বচ্ছন্দে বলে, খুলুন সুটকেস!
হয়তো অরুণমাধব আর তার স্ত্রী, ওই মুহূর্তের দেখা খাতাখানা নিয়ে নীহারকেই সন্দেহ করবে। হয়তো চিরদিনই নিজেরা বলাবলি করবে, আর কারও নয়, ওই মিস ঘোষেরই কাজ। ভূতে তো উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে না? তবু ভদ্রতা বজায় রাখবে।
সে সন্দেহ ঘাড়ে নিয়েই বিদায় নেবে নীহার।
অরুণমাধব বলেছে, আপনি আমাদের পরিবারের বন্ধুর মতো।
বন্ধুর কাজই করবে নীহার।
অকারণ লোকটার মনটা কালিমাখা হতে দেবে না।
কী এসে যাবে যদি অরুণমাধবের জীবনে সুমিতা এবং নমিতার রহস্য অনুদঘাটিতই থাকে?
নীহার এই রহস্য কাহিনী ভুলে যাবে।
নীহার খাতাটা পুড়িয়ে ফেলে ভাববে, আমি যাঁর মাইনে খেয়েছি তাঁর আদেশ পালন করেছি।
অরুণমাধবও ভুলে যাবে।
অরুণমাধব ভাববে, প্রলাপ প্রলাপই। ভাববে খাতাখানা বোধহয় চোখের ভ্রম।
নমিতার আত্মা কি প্রেত হয়ে নীহারের ঘাড়ে চাপবে? নিজের মনে হেসে ওঠে নীহার।…
এই পৃথিবীতে কত জীবন কত ভাবে অপচয় হচ্ছে, কত ধ্বংস হচ্ছে, কত দীর্ঘনিশ্বাস ঘুরে মরছে। পৃথিবীর বাতাসে। প্রিয়মাধব নামের একটা লোককে ঘিরে দুটো মেয়ের দীর্ঘশ্বাস যদি উদ্বেল হয়েই থাকে কখনও, সে নিশ্বাস বাতাসে বিলীন হয়ে গেছে। ওদের গাড়ি এসেছে, ওরা চলে গেছে।
যারা আছে, তারা সুখে থাক, স্বস্তিতে থাক।
নীহার ওদের পরিবারের বন্ধু।
আগুন জ্বালো, আগুন জ্বালো…
জীর্ণ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে দিয়ে আগুন জ্বালো।
গুনগুন করে গান গাইছিল নীহার। খাতাখানা পুড়ছিল।
এই কাগজ পোড়া গন্ধ আর ধোঁয়া অরুণমাধবের কাছ পর্যন্ত পৌঁছবে না, কারণ এটা নীহারের বাসা।
কিন্তু তবু ধোঁয়া থেকে কি রক্ষা পাবে অরুণমাধব?
প্রিয়মাধবের সেই শেষ কথা কি ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন করে রাখবেনা তার বাকি জীবনটা? প্রিয়মাধব ওকে কখন ঠকালেন সে কথা ভাববে না ও বাকি জীবন?
আর ভাবতে ভাবতে মনে পড়বে না অরুণমাধবের, তার মা আর বাবার দাম্পত্য জীবনের অস্বাভাবিকতা?
উত্তরা তার শ্বশুর শাশুড়ির এই বুড়ো বয়েসের প্রেমের গভীরতা দেখে ঠোঁট উলটেছে, কিন্তু সত্যিই কি ছিল সেই গভীরতা?
এখন ভাববে অরুণমাধব।
তার ছেলেবেলার স্মৃতি থেকে প্রত্যেকটি দিনের কথা আর ঘটনা মনে আনবে।
ভাবতে ভাবতে অবাক হয়ে যাবে, আর মনে করবে, কী আশ্চর্য, আমার কেন সন্দেহ হয়নি?
ভাববে, অথচ সন্দেহ করবার তো ছিল।
বরাবর তো মাকে আমি আলাদা ঘরে শুতে দেখেছি। যখন অসুখে পড়লেন বাবা, তখন থেকেই শুধু–দিন দুই পরে প্রিয়মাধবের যখন জ্ঞান হয়েছিল, প্রিয়মাধব যে চেঁচিয়ে উঠেছিলেন, এ ঘরে কার বিছানা? কে শোবে এখানে? সে কথাও মনে পড়বে অরুণমাধবের। মনে পড়বে অরুণমাধব যখন বলেছিল, উত্তেজিত হচ্ছ কেন বাবা? ডাক্তার উত্তেজিত হতে বারণ করেছে। রাত্রে তোমায় দেখতে হচ্ছে বলে মা এখানে
তখন প্রিয়মাধব বলে উঠেছিল, ওঃ সেবার জন্যে! রোগীর সেবার জন্যে। দয়াবতী নার্স! এখন আর ভয় নেই বলে?
তন্নতন্ন করে প্রতিদিনকার কথা ভাবলে অনেক কথা মনে পড়বে অরুণমাধবের, আর বুঝতে পারবে প্রলাপেরও অর্থ থাকে।
বুঝতে পারবে, সুমিতা তার মা নয়। কিন্তু কে তবে মা অরুণমাধবের?
না, সে রহস্য কোনওদিন ভেদ করতে পারবে না অরুণমাধব।
নার্স নীহার ঘোষ তার বন্ধুর কাজ করেছে।
পুড়িয়ে ফেলেছে তার মার জীর্ণ প্রাণের আবর্জনা।
খাতাটা যে নীহার ঘোষ সরিয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই অরুণমাধবের।
কিন্তু কেন? সেইটাই বোঝবার উপায় নেই।
বলেছিল, রাত থেকে প্রলাপ শুরু হয়েছিল, অনেক গোপন কথাই উনি বলেছেন আমায়।
কে জানে কী সেই গোপন কথা?
নীহার ঘোষের মুখ থেকে বার করা যাবে না সে কথা।
যখন দূরের গাড়ির ঘণ্টা নিকটবর্তী হয়ে এসেছিল, যখন প্রিয়মাধব নামের মানুষটা তার অহংকার আর আভিজাত্য নিয়ে পৃথিবীকে গুডবাই করে চলে যাবার জন্যে পা বাড়িয়েছিল, তখন এমন অদ্ভুত ইচ্ছে হল কেন তার?
কেন মনে করল সেই অদ্ভুত ইচ্ছের মানুষটা, আদরের ছেলেটাকে সারাজীবন ধরে কী ঠকানো ঠকিয়ে এসেছি তার হিসেব দিয়ে যাই।
কেন মনে হল ওই হিসেব দেওয়াটার অভাবেই তাঁর গাড়ি আসছে না।
কিন্তু গাড়ি তো একদিন আসবেই।
কোনও ক্ষতিই কি হত প্রিয়মাধবের, যদি ওই হিসেবটা তাঁর ছেলের কাছে দাখিল না করতেন?
না, বাইরে থেকে এখনও কোথাও কোনও ক্ষতি দেখা যাচ্ছে না।
অনেকদিন পড়ে ছিলেন প্রিয়মাধব, তাই অনেক ঘটা করে শ্রাদ্ধ হল তাঁর।
উত্তরার মা এলেন। শ্রাদ্ধের গোছ করতে।
জামাইয়ের প্রাণ মুচড়োনো ভাষায় বলতে লাগলেন, তোমার মায়ের কাজ উদ্ধার করে দিয়ে গিয়েছিলাম বাবা, আবার তোমার বাপের কাজ উদ্ধার করতে এলাম। আহা, সে তো তবু সতীরানি ভাগ্যিমানী, চলে গেলেন। এ যে তোমার বড় কষ্ট, যার নাম উপতৃশোক।
মেয়েকে বললেন, ওরে তোর শাশুড়ির ছবিখানা নামিয়ে এনে শ্বশুরের ছবির পাশে বসিয়ে দে। দুগাছি মালা পরিয়ে দে দুখানি ছবিতে। বেঁচে থাকতে যেমন জোড়ের পায়রাটি ছিলেন, মরলেও তেমনি দেখাক।
মায়ের বাধ্য মেয়ে উত্তরা তার শাশুড়ির শ্রাদ্ধের সময় যে বড় ফটোটা করানো হয়েছিল, সেইখানা নামিয়ে এনে শ্বশুরের সম্প্রতিকার ছবির পাশে বসিয়ে দিল।
মালা পরিয়ে দিল দুগাছা।
বড় একটা সিঁদুরের টিপ পরিয়ে দিল শাশুড়ির ছবির কপালে।
শ্রাদ্ধে অনেকের সঙ্গে নার্স নীহার ঘোষকেও নেমন্তন্ন করা হয়েছিল। সে তাকিয়ে দেখল এইসব সাজ আর সমারোহ। ভাবল, এই নার্সের জীবনে কত মৃত্যুই দেখলাম! কত ফুলের মালাও দেখলাম। তার মূল্যও জানলাম।তারপর উত্তরার কাছে গিয়ে আমুদে গলায় বলল, দেখলেনতো? বলেছিলাম–আপনার শ্বশুরের শ্রাদ্ধের ভোজ খেয়ে তবে যাব। কথা রাখলাম কিনা?