- বইয়ের নামঃ বিবাগী পাখি
- লেখকের নামঃ আশাপূর্ণা দেবী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. মেয়েটার বয়েস বছর চোদ্দ-পনেরো
মেয়েটার বয়েস বছর চোদ্দ-পনেরোর কম নয়, কিন্তু স্কার্ট আর আঁটো জ্যাকেটের কারসাজিতে অধিকারী তাকে দশে নামিয়েছে।
তবু যেটুকু সন্দেহ আসতে পারত, সেটুকুও মেরে নেওয়া হয়েছে কোমরে ওই চওড়া জরির কোমরবন্ধটাকে কষে বেঁধে দিয়ে। ওটার জন্যেই বিশেষ করে বালিকা বালিকা লাগে। তা ছাড়া ভঙ্গিটাও লিলির নিতান্তই বালিকাসুলভ। যেন মনটাকেও সে ওই খাটো স্কার্ট, আঁটো জ্যাকেট আর চওড়া কোমরবন্ধের দেওয়ালের মধ্যে আটকে রেখেছে। পুরনো কালের চীনের মেয়েদের লোহার জুতোয় পা আটকে রাখার মতো।
অধিকারীকে সবাই অধিকারীমশাই বললেও ভবানী অপেরার অধিকারী কুঞ্জলাল দাস সেই সম্বোধনটাকে খুব না-পছন্দ করে। বলে, মিস্টার দাস বললে কি হয়? কি হয়?
হাঁ, মিস্টার শব্দটা বিশেষ পছন্দ কুঞ্জলালের। কারণ নিজেকে সে প্রোপ্ৰাইটার বলে থাকে। তা বলবার অধিকার তার নেই তা নয়।
প্রোপ্ৰাইটার দাসের ভবানী অপেরা শুধু মফস্বর শহরেই নাম কিনে বেড়ায় না, কলকাতার যাত্ৰা প্ৰতিযোগিতার উৎসবে এসেও নাটক দেখিয়ে মেডেল নিয়ে যায়।
পৌরাণিক পালার দিকে মন নেই কুঞ্জর, সামাজিক নাটক নামায় সে। সমাজের সর্ববিধ অনাচার কদাচারকে লোকের সামনে তুলে ধরে তার ওপর চাবুক মেরে দেখাতে চায় কুঞ্জ, কোথায় তলিয়ে যাচ্ছে সমাজ, কী পরিমাণ দুর্নীতিতে ড়ুবে যাচ্ছে দেশ?
তাই কুঞ্জর পালাগুলির নাম সাধারণত এই ধরনের হয়—ভণ্ডামীর মুখোস, একেই কি বলে দেশসেবা? দুঃখীর রক্ত, নিরন্নের কান্না, চাবুক, কষাঘাত ইত্যাদি।
কুঞ্জ অধিকারী যে কতবড়ো বুকের-পাটাওয়ালা লোক একথা টের পাওয়া যায়। ওই সব পালা দেখলে। রাজা-উজির থেকে শুরু করে, দারোগা, দেশ নেতা, কালোবাজারী বা অসতী নারী, সব্বাইকে এক তরোয়ালে কাটে কুঞ্জ, এক চাবুকে দাগে। কাউকে রেয়াত করে না।
শোনা যায় কোথায় নাকি কোন বারোয়ারি পুজের মণ্ডপে একখানা পালা নামিয়েছিল কুঞ্জ, যার নাম ছিল দুঃশাসন এবং যার নায়ক ছিল এক পুলিশ ইনস্পেক্টর। সাদা বাংলায় দারোগাবাবু।
বলা বাহুল্য সে নাটকে দারোগাবাবুদের প্রীত হবার মতো উপকরণ ছিল না। আর ভাগ্যের খেলায় সেখানে দর্শকের আসনে এক দারোগাবাবু উপস্থিত ছিলেন। খুব সম্ভব তিনি ওই উদ্যোক্তাদের কোনো মাননীয় আত্মীয়, আমন্ত্রিত হয়ে এসেছেন।
দুঃশাসন নামটি শুনেই তিনি মহাভারতের পৃষ্ঠায় পৌঁছে গিয়েছিলেন, এবং কুরুক্ষেত্ৰ যুদ্ধ ও ভয়ঙ্কর একটি রক্তপান উৎসব-এর অপেক্ষায় স্পন্দিত হচ্ছিলেন। কিন্তু অভিনয় শুরু হতেই কেমন যেন চাঞ্চল্য অনুভব করতে থাকেন দারোগাবাবু, তারপর মাঝপথে হঠাৎ রে রে করে তেড়ে ওঠেন। আর সেই রে রে করার প্রতিক্রিয়ায় কুরুক্ষেত্র কাণ্ডের অভাব প্রায় পূর্ণ হয়।
দারোগাবাবুর চিৎকার, সমবেত জনগণের প্রবল প্রতিবাদ, আর শিশুকুলের কান্না, সব মিলিয়ে সে একেবারে কেলেঙ্কারি চরম। দারোগাবাবু দাপিয়ে বেড়ান—আমি ওই অধিকারী শা-কে অ্যারেস্ট করব, ওকে আমি ঘানি টানাব, ওকে ওর বাবার বিয়ে দেখাব, ওর যাত্রাপালা করে বেড়ানো জন্মের শোধ ঘোচাবা, ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থাৎ একজন ক্ষমতামদমত্ত ব্যক্তির আগুন-জ্বলে-ওঠা মাথায় যা যা বলা সম্ভব সবই বলে চলেন। ওদিকে নাটক পণ্ড হওয়ায় অগণিত অসহিষ্ণু দর্শক হই-চই করতে থাকে।
কিন্তু সহসা এক নাটকীয় আবির্ভাব ঘটে।
বুক ভর্তি মেডেলে সুসজ্জিত গৰ্বদৃপ্ত প্রোপ্রাইটার কুঞ্জ দাস এসে কথার ভণিতায় একেবারে ঠাণ্ডা করে দেয়।–
কুঞ্জ দাস এসে দাঁড়ায়, তার বুকের উপরকার মেডেলগুলো আলোয় ঝকমকিয়ে ওঠে, আর পিছন থেকে একটা লোক সেই আদ্যিকালের গ্রামোফোনের চোঙ একটা বাড়িয়ে ধরে কুঞ্জর মুখের কাছে।
কুঞ্জ তার ভিতর থেকে আবেদন জানায়, গরিবের মা-বাপ দারোগাসাহেব, অ্যারেস্টই করুন, আর ফাঁসিই দিন, কোনো আপত্তি নেই, দয়া করে শুধু আপনার সামনে একখানা প্রশ্ন নিবেদন করতে দিন।?
হঠাৎ এই বাজখাঁই নিবেদনে গোলমালটা উদ্দামত হারায়, কৌতূহলী জনতা কান খাড়া করে সেই প্রশ্নখানি-র আশায়। দারোগাবাবুও হঠাৎ একটু থিতিয়ে যান। আর হিজ মাস্টারস ভয়েস-এর চোঙ বলে চলে, অপরাধটা আমার কোথায় বলতে পারেন আজ্ঞে? মানছি। আমার নাটকে একজন পাজী বদমাস ঘুষখোর দারোগার চরিত্র-চিত্রণ করা হয়েছে। যে লোকটা হাতে-পাওয়া ক্ষমতাবলে যত পারছে বেআইনী কাজের সাহায্য করে তার বিনিময়ে মোটা মোটা টাকা উৎকোচ নিচ্ছে। আছে আমার নাটকে এমন চরিত্র। কিন্তু বাবুমশায়, বলুন। একবার, সেই লোক কি আপনি? আপনার চরিত্র কি এত নীচ? বলুন? বলুন, আমার দুঃশাসনকে দেখে কি আপনার নিজের প্রতিবিম্ব বলে মনে হচ্ছে? তা যদি হয়, আমাকে এখুনি গুলি করুন, মানীলোকের মানের ক্ষতি করেছি, এই ভেবে কান মূলতে মূলতে মরব।
কিন্তু বাবুমশায়, আমার প্রশ্নখানার জবাব দিয়ে তবে গুলি করতে হবে। বলুন নাটকের এই চরিত্র আপনকার প্রতিবিম্ব বলে মনে হচ্ছে?
বক্তব্য এবং বক্তব্যের ভাষায় দর্শকদের মধ্যে থেকে একটা চাপা হাসির গুঞ্জন ওঠে। আর দারোগাবাবুর মুখ লাল হয়ে ওঠে?
কিন্তু হঠাৎ পরিস্থিতির পরিবর্তনে ডাকহাঁকটা সামলাতে হয় তাঁকে। ক্রুদ্ধ কণ্ঠে গাভীর্য এনে বলেন তিনি, আমার কথা হচ্ছে না, কিন্তু এভাবে একজন পুলিশ ইনস্পেক্টরের গায়ে কালি ছিটানো মানেই পুলিশ জাতটাকে অপমান করা। স্বজাতি প্রেমবিগলিত দারোগাবাবু কণ্ঠস্বর উচ্চগ্রামে তোলেন। বলেন, সেই অবমাননার অপরাধে তোমার নামে চার্জ আনব আমি।