টাকা।
টাকা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে লোকটা?
ইয়ার্কি নাকি? এ আবার একটা নতুন চাল। আর কিছু নয়, ভুলিয়ে বাসা থেকে বার করে নিয়ে পুলিসের হাতে ধরে দেবে! কথায় ভেজাতে এসেছে।
অতএব যতীন সেন ভেজে না, তীব্রস্বরে বলে, দেখুন আমি গরীব, আমি হতভাগা, আমার সঙ্গে ঠাট্টা মস্করা করতে আসবার দরকার আপনার নেই। যেতে পারেন।
ভদ্রলোক পকেট থেকে একগোছা একশো টাকার নোট বার করে এগিয়ে ধরে হেসে বলেন, কী আশ্চর্য, ঠাট্টা করব কেন? কথা হয়েছিল সেদিন—
যতীন সেন সেই মোহময় বস্তুটার দিকে নিষ্পলকে তাকিয়ে থাকে। কথা বলে না। ভদ্রলোক হাত বাড়িয়ে এগিয়ে ধরে বলেন, নিন।
যতীন আস্তে হাত বাড়ায়।
যতীনের মুখে কথা নেই।
যতীনের স্ত্রী বেড়ার ধার থেকে অনবরত যে ইশারা করছে ভদ্রলোককে যত্ন করে বসাবার জন্যে, সে দিকে দৃষ্টিই নেই যতীনের।
টাকাগুলো সত্যি, না জাল! না কি নম্বরী নোট গছিয়ে দিয়ে ফাঁদ পাতবার ফন্দি! হাত থেকে পড়ে যায় টাকাটা।
নাঃ আপনার দেখছি টাকাকড়ির দরকার নেই। কিন্তু আমি যে সত্যবদ্ধ হয়ে আছি, না নিলে অশান্তিতে মরব।
টাকাটা তুলে নিয়ে এদিক ওদিক তাকান তিনি।–কই আর কেউ আছেন না কি?
যতীন এবার নেয়।
গম্ভীর গলায় বলে,–আপনাকে আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।
ভদ্রলোক হেসে উঠে বলেন–না পারবেন কেন সেটাই বলুন? কবে কখন আপনার সঙ্গে কি কি বিশ্বাসঘাতকতা করেছি। সেদিন আপনি চটেমটে বেরিয়ে এলেন। টাকাটা নিয়ে এলেন না। অথচ ঠিকানা জানা নেই। খুঁজে খুঁজে কোন মতে
কিন্তু এত আপনি করবেন কেন? সেটাই তো সন্দেহ। নম্বরী নোট গছিয়ে দিয়ে পুলিসে ধরিয়ে দেবেন কিনা কে বলতে পারে?
ভদ্রলোক তবুও হাসেন? যেন খুব একটা মজা দেখছেন
। বলেন, আপনাকে পুলিসে দেবার জন্যে এতসব করতে যাবার তো কথা নয়। বিনা কষ্টেই তো দেওয়া যেত, সেদিন তক্ষুনি। কাজেই বুঝতে পারছেন ওতে আমাদের দরকার নেই। আমাদের যা দরকার সেটাই জানাতে এসেছি।…আমি কলকাতার মানুষ নয়, বাইরের মানুষ, সেই কোন্ দূর দূরান্তরে থাকি। ছুটিতে এসেছিলাম, চলে যাচ্ছি। যাবার সময় আপনার মেয়েটিকে নিয়ে যেতে চাই!
দপ্ করে জ্বলে ওঠে যতীনতার মানে? নিয়ে যেতে চান মানে? কী ভেবেছেন কি?
-নাঃ মশাই ভারি রগচটা আপনি। কথা কয়ে সুখ নেই।…মা লক্ষ্মী, তুমি শোন তো, এস এদিকে।
সীমার হাতে মাটি খোঁড়বার খুরপি, সীমার হাতে কাপড়ে ধুলো মাটি। ভদ্রলোককে দেখে নিথর হয়ে দাঁড়িয়েছিল বেড়ার গা ঘেঁষে। ডাক শুনে শুধু একবার যেন কেঁপে উঠল, কিন্তু নড়ল না।
ভদ্রলোক অতএব নিজেই এগিয়ে যান। বলেন–শোনো! তোমার বাবার কাছে একটা প্রস্তাব করছিলাম, আমি দেরাদুনে ফিরে যাচ্ছি কদিন পরে, যাবার সময় তোমাকে আমাদের সঙ্গে নিয়ে যেতে ইচ্ছে করছি, তা তোমার রগচটা বাবা তো মারতেই উঠলেন আমায়, তুমি কি বল?
সীমা নির্নিমেষ দৃষ্টিতে একবার ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে–আমরা গরীব, অভাবে পড়ে অন্যায় করেছি, তার জন্যে যে শাস্তি ন্যায্য তাই দিন। পুলিসেই দিন আমাকে আর আমার বাবাকে। এছাড়া শান্তি পাচ্ছি না আমি।
ভদ্রলোক এবার আস্তে বলেন–শাস্তি তো তোমার হয়ে গেছে মা! এখনো হচ্ছে, হয়েই চলেছে। আর কত শাস্তি চাও?
–আরও অনেক অনেক। সত্যিকার শাস্তি।
ভদ্রলোক আবার হাসেন।
হেসে হেসে বলেন–সত্যিকার শাস্তিই দেওয়া হবে তোমায়। সেই উদ্দেশ্যেই আসা, একেবারে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের অর্ডার দিতে এসেছি।
-কী বললেন? সীমা যেন শিউরে ওঠে।
ভদ্রলোক কিন্তু আত্মস্থ–ওই তো বললাম, আমার বাড়িতে যেতে হবে, চিরকালের জন্যে
-না না না!
ভদ্রলোক মৃদু হাস্যে বলেন–আমায় না হয় না বলে ফিলোচ্ছ, সবাইকে পারবে?
–আমায় মাপ করুন, আমায় ক্ষমা করুন–বলে সীমা ছুটে পালিয়ে যায়, আর সীমার বাপ।
যতীন সেন এই দুর্বোধ্য নাটকের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে।
তবে বেশিক্ষণ থাকে না, হাতের মধ্যে এসে পড়েছে রাজার ঐশ্বর্য! নগদ পাঁচ হাজার টাকা –একসঙ্গে কবে দেখেছে যতীন সেন? ব্রজনাথ উকিলের কাছে মেয়ে জমা দিয়েও তো নয়।
এই টাকা দিয়ে সে একটা দোকান দেবে, ধীরে ধীরে ভবিষ্যৎ গড়ে তুলবে।…মেয়ের সাহায্যে ভবিষ্যৎ গড়ে তোেলা তো আর হল না।
এ টাকা এখুনি লুকিয়ে ফেলতে হবে।
পাওনাদাররা টের পেলে এক মুঠোও বাকি থাকতে দেবে না, রাক্ষস সংসারের নাগালের মধ্যে এলেও খাবল দিতে আসবে। টাকা বড় ভয়ানক জিনিস। ওর ব্যাপারে মা বাপ ভাই বন্ধু স্ত্রী পুত্র পরিবার কাউকে বিশ্বাস করতে নেই।
কিন্তু কোথায় সেই লুকনো জায়গা?
যতীন সেনের বাড়ি কি তিন মহল? ব্যাঙ্কের সঙ্গে যোগাযোগ আছে যতীন সেনের?
গচ্ছিত রাখতে পারে এমন কোনো প্রতিষ্ঠাপন্ন বড়লোক আত্মীয়ের লোহার সিন্ধুক আছে? নিজের দেহের সঙ্গে কতক্ষণ রাখা যায়? চানও তো করতে হবে তাকে?
.
লোহার গেটটার সামনে এসে দাঁড়াল সীমা।
এ বাড়ির লোহার গেটের সামনে গাড়ি থেকে নেমে ভিন্ন কখনো দাঁড়িয়েছে সীমা? দাঁড়ায়নি!
গেট থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠেছে, আবার গাড়ি থেকে নেমে গেটে ঢুকেছে।
শেষ বেরিয়ে গিয়েছিল পায়ে হেঁটে, আজ আবার পায়ে হেঁটেই ঢুকল।
গেটের কাছে এসে দাঁড়াল।
আশ্চর্য! আশ্চর্য!
দারোয়ান শোভাবাহাদুর ঠিক আগের মতই সসম্ভ্রমে অভিবাদন জানিয়ে সরে দাঁড়াল, গেট খুলে দিল।