আমাকে ধাক্কা দিয়ে অশ্রুকণা বলল, কি আবোল তাবোল বলছ? কোথায় রেহানা? কে বা ককসানা? কার কথা বলছ তুমি?
আমি চোখ মেলে তাকালাম। আমাকে তার কোলের উপরে টেনে নিয়ে অপলক তাকিয়ে আছে অশ্রুকণা। বললাম কি বলছ কণা? কে রুকসানা? বললাম আমার জীবনের অভিশাপ। মানে? মানে তুমি বোঝনা কণা? কে আমার জীবনটাকে এমনি তিলে তিলে ধ্বংস করে দিয়েছে? কে আমাকে মৃত্যুর কিনারে দাঁড় করিয়ে দিয়ে এখনো বলছে তোমার পরীক্ষা শেষ হয় নি। কে? ওই রাক্ষসী রুকসানা। ওর হাত থেকে তুমি আমায় বাঁচাও কণা। ও আমার সেলিনাকেও ধ্বংস করে দিতে চায়। তারপর অশ্রুকণার হাত দুটো ধরে কাকুতি করে বললাম, তুমি আমায় বাঁচাও কণা। বাঁচাও সেলিনাকে। না হলে ওর গরল নিশ্বাসে ও যে পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে। চোখে জল এস গেল অশ্রুকণার। টপটপ করে শিশির ফোঁটার মত তা গড়িয়ে পড়তে লাগল অশ্রুকণার দুই কপোল বেয়ে। ভিতরে যতটা আবেগ সবটা উজাড় করে দিয়ে ও বলতে লাগলো। তোমার কি হয়েছে প্রান্তিক আমায় বল না লক্ষ্মীটি। তোমার এ অবস্থা যে আমি দেখতে পাচ্ছি না। আমি বললাম আমি কি পারছি তোমাকে এমন ভাবে দেখতে? গ্রামের এক সাধারণ অতি সাধারণকে কোথায় পৌঁছিয়ে দিয়েছে ভাবতেও পারছনা তুমি, তাইনা কণা? একদিন তুমি রেহানার শান্ত প্রেমে মুগ্ধ হয়ে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলে। যেটুকু দ্বিধাছিল, তাও একদিন সেলিনাকে দিয়ে মনে করলে ঋণমুক্ত হলে বুঝি? পারলে কি? ও দৃপ্ত কণ্ঠে বলল কে বলেছে পারিনি? হাসলাম আমি। তারপর বললাম, যদি পারতে তবে তোমার নিঃসঙ্গ অনুভূতি কেন এমন করে আমায় নেশায় আচ্ছন্ন করে রাখে? আসলে যা তুমি দিতে চেয়েছিলে, নেওয়ার যোগ্যতা না থাকায় তাই তোমার বুকের মধ্যে দ্বিগুন হয়ে ফিরে এসেছে। এতক কেমন করে সইবে কণা। ও বলল, তোমার জন্য কোন কষ্টই আমার কষ্ট বলে মনে হয় না। তাইতো তোমায় হাসি মুখে তুলে দিতে পেরেছি কখনো রেহানাকে, কখনো বা সেলিনাকে। আমি বললাম আমি কি জড় পদার্থ যে এই ভাবে তুলে দেওয়া যায়?
ভোরের ঠান্ডা হাওয়ায় গায়ে কাঁপুনি দিচ্ছে। এই লাল মাটির দেশে শেষ রাতটা বেশ ঠান্ডা। বললাম, কশা চল ঘরে। ও বলল তাই চল, তারপর ও ওর খোঁপা থেকে একটা একটা করে ফুল যা আমি পরম যত্নে পরিয়ে দিয়েছিলাম তা খুলে খুলে প্রতিটি ফুল ছিঁড়তে ছিঁড়তে আর ছড়াতে ছড়াতে ঘরে এলো। আমি বললাম, মনে পড়ে কণা, একদিন তোমার জন্য যে ফুল কিনেছিলাম তোমার অবহেলায় তা আমি বাইরের রাস্তায় ফেলে দিয়েছিলাম, আজ কি তবে তার শোধ নিলে? ও শুধু বলল, জীবনে কোন কিছু কি শোধ করা যায় প্রান্তিক? যায় না। তুমি বোস। আমি তোমার জন্য কফি নিয়ে আসছি। কফি? এই এত রাতে? রাত বেশী নেই। তারপর ঠাট্টা করে বলল, সত্যভূষণের চুরি করা সময় কিন্তু তোমায় ফিরিয়ে দিয়েছিলাম প্রান্তিক? হ্যাঁ দিয়েছিলে, অনেকগুণ বেশী ফিরিয়ে দিয়েছিলে। তাহলে? আমি হাসিমুখে বললাম, তা হলে কি? কিছু না, বলে ও চলে গেল। খানিক পরে ধূমায়িত কফি নিয়ে এসে রাখল আমার সামনে। বললাম তোমারটা? ও বলল, একটা অনুরোধ রাখবে আমার? বল? আমাকে ভুলে যেতে পার না? পারি। তা হলে তাই যাও না? যাব।
ও কি আঘাত পেল? না হলে অমন চুপ হয়ে গেল কেন? বললাম কি হলো? দেখছিলাম তোমার ব্যথার অতলান্ত সাগর। ঠিক আছে, আমি আর রান্না ঘরে যেতে পারব না, তোমার অর্ধেক খাওয়া শেষ হলে, বাকীটা আমায় দিও। তারপর বলল রেহনার কথা কি বলছিলে, আর রুকসানা বা কে? আমি বললাম ওরা দুজনেই একজন। কালকে রাতে যে চিঠিটা আমায় দিয়েছিলে তা নিশ্চয়ই পড়ে দেখনি? না। আমি বললাম ওটা তপতীর চিঠি। তপতীদি? হ্যাঁ, কি লিখেছে তপতীদি? আমি বললাম, ও লিখেছে বাঁকুড়া জেনারেল হাসপাতালে রুকসানা নামে একটি মেয়ে ভর্তি আছে ও ঠিক রেহানার মত। তাই তোমাকে যেতে লিখেছে। ঠিক বলছ? হা কশা ঠিক বলছি। তারপর বললাম এই রেহানাই একদিন রুকসানার নাম নিয়ে ডালিমের সঙ্গে দেখা করে। তাকে বলে তুমি ভাল হয়ে ফিরে এস আমি তোমাকে বাঁচার পথ দেখাব। আশ্চর্য হয়ে অশ্রুকণা বলে, তারপর? সাতদিন সময় নেয় ডালিম। কিন্তু যে দিন সেই সাতদিন আসে যাওয়ার কথা ডালিমের কাছে, সেদিন সকালেই সে আত্মহত্যা করে। সত্যি বলছ তো তুমি। ওর একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলি, সব সত্যি কণা। ও জানতে চাইল রেহানা এসেছিল সাতদিন পরে? হয়তো এসেছিল, কিন্তু ডালিমতো তার আগে নিজের ঠিকানায় পৌঁছিয়ে গেছে। দেখা আর হয়নি। তুমি জানলে কি করে? সেটা জানতে গিয়েই তো জীবনের সব এলোমেলো হয়ে গেল। ও গভীর উৎকণ্ঠা নিয়ে বলল, বলা যাবে না সে কাহিনী? সংক্ষেপে ওকে সব খুলে বললাম। মোসলেউদ্দীন সাহেব, মনোয়ারা বেগম। কেন সেলিনাকে হাতে নোয়া, সিঁথিতে সিঁদুর পরতে হয়েছিল সব। তারপর প্রতীমকাকুর কথা, হাওড়া স্টেশনের সেই ঘটনা, গ্রামের বাড়ী থেকে বাবার আগমন, সেলিনা কেন রেহানা হতে চায়, তার মাতৃত্বের কথা, কোনটাই বাকী না রেখে এক এক করে সব খুলে বললাম। ও শুনতে শুনতে মাঝে মাঝে কেঁপে কেঁপে উঠলো। সব শুনে গম্ভীর হয়ে উঠে গেল ও। তারপর কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে বলল, তা হলে সেলিনাকে তুমি বাধ্য হয়ে গ্রহণ করেছে? এ প্রশ্ন কেন কণা। আমার মন বলছে তুমি একটা জিনিষ এড়িয়ে গেছে। কি? তুমি নিজেই যে তাকে সিঁদুরের অধিকার দিয়েছ একথা তুমি একবারও বলনি। আমি চুপ করে রইলাম। তারপর বললাম দাঁড়াও। ও ব্যাকুল হয়ে বলল, কোথায় যাচ্ছ? আমি বললাম আসছি। ফিরে এলাম একটু পরে সেভ করার একটা ব্লেড নিয়ে মুহূর্তে একটা আঙুলের উপর জোরে চেপে ধরতে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এলো। ও ভয় পেয়ে বলল, একি করলে প্রান্তিক এত রক্ত। আমি হাসছি, বললাম কাছে এগিয়ে এস কণা। ও কাছে এগিয়ে এলে আমি ওকে এক হাতে নিজের কাছে টেনে সেই রক্তে ওর সিঁথি রাঙিয়ে দিলাম। ও বলল একি করলে তুমি প্রান্তিক। বললাম, যে অধিকার দিতে আমি পথে পথে ঘুরেছি, আমার রক্তে সেই অধিকার প্রতিষ্ঠা করলাম। আমার মৃত্যুতে সেলিনার সিঁথির সিঁদুর হয়তো মুছে যাবে। কিন্তু এ রক্তের দাগ তো মুছবেনা কোন দিন। কোনদিন তোমাকে আর হারাবার ভয় থাকবেনা। জীবন যুদ্ধে বারবার হেরে গেছি। অন্তত একবার যে জয়ী হতে পেরেছি, এটা কি কম বড় প্রাপ্তি? ও বলল, তোমার কাছে যা প্রাপ্তি, আমার কাছে তা পূর্ণতা, সেকি তুমি বোঝ প্রান্তিক? আজ যে বাঁধনে বাঁধলে, প্রভাত সূর্যের আলোকে যখন অন্ধকার কেটে যাবে, ক্ষণিকের আবেগ বলে, তুমি আমাকে এড়িয়ে যাবে না তো? প্রভাত সূর্যকে সাক্ষী রেখেই তো অলক্তরাগে বেঁধে দিলাম এই বন্ধন হীন গ্রন্থি। ও বলল, তা হলে আমি এখন কি করব? তোমার পথের ঠিকানা তুমি নিজেই খুঁজে পাবে একদিন কণা। এবার আমার মুক্তি।