- বইয়ের নামঃ নদী দিকহারা
- লেখকের নামঃ আশাপূর্ণা দেবী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. বৌভাতের রাত্রে
নদী দিকহারা – উপন্যাস – আশাপূর্ণা দেবী
ব্যাপারটা ধরা পড়ল দীপকের বৌভাতের রাত্রে। যখন সারা বাড়ি নিমন্ত্রিত অভ্যাগতে গমগম করছে, যখন কোথাও কোনখানে এক ফালি অন্ধকারের আড়াল না রেখে আপাতমস্তক আলোর অলঙ্কারে ঝকমকাচ্ছে নতুন রং করা পুরনো বাড়িটা, আর নতুন শাড়ির আঁচলে চাবির গোছা বেঁধে হাঁপিয়ে এবং দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন জয়াবতী। ঠিক সেই সময় জয়াবতীর বড় ননদের মেয়ে মহাশ্বেতা ওঁকে একান্তে ডেকে নিয়ে গিয়ে কপালে হাতচাপড়ে খবরটা দিল।
প্রচলিত অনেক কথার মতই জয়াবতী যখন তখন অকস্মাৎ বজ্রাঘাত কথাটা ব্যবহার করে থাকেন, এটা যে অর্থবহ কথা তা বোধকরি কখনও খেয়ালও করেন না, বোধকরি আজই প্রথম টের পেলেন কথাটার যথার্থ অর্থ কি?
আকাশের বজ্র সত্যিই এসে মাথায় পড়লে তো বরং এর থেকে ভালই ছিল, তাতে কাঠ হয়ে গিয়ে কাঠ হয়েই থাকতে পেতেন জয়াবতী, আবার তখুনি কিংকর্তব্য চিন্তা করতে বসতে হত না।
চাপা-গলায় দাঁতে পিষে উচ্চারণ করলেন জয়াবতী, ওরে মহাশ্বেতা, এ কী ভাগ্য আমার! শাস্তি দিয়ে দিয়েও কি আশ মিটছে না ভগবানের!
মহাশ্বেতা বলল, ও কথা পরে ভেবো মামী, এখন কি করবে তাই বল।
তা বটে। ভাগ্য আর ভগবান এই দুই আসামী এখন হাজতে থাক, তাদের বিচার পরে, আপাতত বর্তমান আততায়ীর হাত থেকে আত্মরক্ষা করতে হবে।লোকচক্ষু নামক আততায়ীর দলে যে আজ বাড়ি বোঝাই।
সেই বোঝাই বাড়ি থেকে আততায়ীদের চোখ এড়িয়ে জয়াবতী মেয়ে নিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করলেন। কিন্তু দরজা বন্ধ করেও মাথা খোঁড়বার উপায় নেই, টু শব্দটি না ওঠে। শুধু যে। লোক জানাজানির ভয়ে তাও নয়, একটা হুলস্নাড়ে নিমন্ত্রিতের খাওয়া-দাওয়ার যে বিঘ্ন ঘটবে। এত খরচ করা বিপুল আয়োজন পণ্ড হবে শেষটা!
দাঁতে দাঁত চেপে মেয়ের হাত ধরে বসে রইলেন জয়াবতী, মহাশ্বেতা মাথায় জল দিয়ে বাতাস করতে লাগল তাকে।
হ্যাঁ মহাশ্বেতা ঘরে আছে, তাকে না নিলে চলবেই বা কেন? একা জয়াবতীর সাধ্য কি যে এই উন্মাদিনীকে সামলায়? তাছাড়া মহাশ্বেতাই তো আগে দেখেছে, আবিষ্কর্তার গৌরব তো তারই। তবু যাই ভাগ্যিস দেখেছিল, নইলে হঠাৎ যদি বাইরের কারও চোখে পড়ত! আঃ, তাহলে কি হত সেই কথা ভেবে জয়াবতী আর একবার নিঃশব্দে কপাল চাপড়ালেন।
মহাশ্বেতা মৃদুস্বরে আশ্বাসবাণী উচ্চারণ করে, তুমি অত ভেঙে পোড়োনা মামী, হিস্টিরিয়াও হতে পারে।
হতে পারে! আশ্বাসে নিশ্চয়তার সুর নেই।
জয়াবতী বললেন, আমার কপালে তা হয়ে রেহাই যাবে না রে মহা, ও যা ভাবছি তাই। নইলে বরফে কখনো আগুন ধরে?
তা তুলনাটা বোধকরি খুবই ঠিক দিলেন জয়াবতী, বেশি নভেল নাটক না পড়লেও, আর অনেক কথা জানা না থাকলেও, প্রাণ ফেটে বেরিয়ে এসেছে কথাটা।
অমিতার মত মেয়ের পক্ষে উন্মত্ততা, বরফে আগুন লাগার মতই ভয়ঙ্কর বিস্ময়। এত শান্ত, এত স্তব্ধ, এত সভ্য আর এত মৃদু মেয়ে এ যুগে কটা দেখতে পাওয়া যায়?
ভাগ্য তাকে মেরে রেখেছে, কিন্তু সেই মার খাওয়ার পর থেকে, একদিনের জন্যেও কেউ দেখেছে ভাগ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছে সে? যেদিন থেকে জেনেছে–অতঃপর সারাজীবনটাই তার পিত্রালয় বাস যোগ, সেদিন থেকেই মা বাপের সংসারের সমস্ত দায় মাথায় তুলে নিয়েছে সে। আর সে দায়িত্ব পালন করে চলেছে নিঃশব্দে হাসিমুখে।
এই যে পিঠোপিঠি ছোট ভাই দীপকের বিয়ের ব্যাপার-এর তন্ত্রধারক কে? ওই অমিতা। দীপক যখন এম. এ. পড়তে পড়তে প্রেমে-ট্রেমে পড়ে একাকার করল, কার কাছে এসে জানাল সেই ভয়ঙ্কর সুখ আর ভয়ঙ্কর বিপদের বার্তা? ওই অমিতাকেই তো। আবার মা-বাপের মত করানোর মত দুরূহ কাজটাও ছোড়দির ওপর দিয়েই গেল। ছোড়দিই যে তার আজীবনের বন্ধু, সঙ্গী, সুহৃদ।
অমিতা বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে যাওয়াতে সবচেয়ে নিঃসহায় হয়ে পড়েছিল দীপকই। তা অবিশ্যি বেশিদিন সে অবস্থা রইল না, আবার পুরনো কেন্দ্রে ফিরে আসতে হল অমিতাকে।
প্লেন ক্র্যাশ হয়ে মারা গেল অমিতার বর, কায়রো পর্যন্ত এসে!
বিয়ে করেই বিলেত চলে গিয়েছিল জামাই, সবে ফিরছে। অনেক উপঢৌকন, অনেক আকুলতা, আর অনেক আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিল সবাই। পরিকল্পনা চলছিল কে কে দমদমে যাবে ফুলের মালা নিয়ে। সবকিছুই স্তব্ধ হয়ে গেল।
পরিকল্পনা অমিতাকে নিয়েও চলল কিছুদিন। সে কি তবে আবার এম. এ.-টা পড়বে? না কি যতটা বিদ্যে আছে ততটা নিয়েই কোন কর্মক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়বে? নাকি মহারাজজীর চরণেই ধরে দেওয়া হবে ওকে, যা করো ঠাকুর বলে?
কিন্তু পরিকল্পনা আর কাজ এক নয়, শেষ পর্যন্ত সবই ধামাচাপা পড়ে গেল। অবশ্য অমিতার শিথিলতাও চাপা পড়ে যাবার একটা বড় কারণ। ও যদি নিজের সম্পর্কে কিছু একটা স্থির করে ফেলতে পারত, তাহলে হয়তো সে ব্যবস্থাটা হতই। কিন্তু অমিতা অন্তঃপুরের অন্ধকার কোণটাই বেছে নিল।
অতএব সংসার নিয়ে জয়াবতীর গতর খরচ বাঁচল, ছোট ছেলে দুটোর প্রাইভেট টিউটরের খরচ বাঁচল, সমস্ত পরিবারের দরজির খরচ বাঁচল। যতদিন বিয়ে হয় নি পড়া ছিল, গান শেখা ছিল, সিনেমা দেখা এবং গল্পের বই গেলা ছিল, আর ছিল ভবিষ্যতের রঙিন স্বপ্ন দেখা। অতগুলো কাজের একটাও যখন আর রইল না, অফুরন্ত সময় কেন থাকবে না অমিতার হাতে?
সে সময়ের যথার্থ সদ্ব্যবহার করেছে অমিতা, এই দেখেই ঘরে পরে সবাই ধন্যি ধন্যি করে তাকে।
তা কোন কাজটাই বা অমিতার ধন্যি ধন্যি করবার মত নয়? এই যে বিয়ের জন্যে অমিতা আজ দুমাস থেকে সিল্ক সাটিন লেস চিকন জরি পুঁতি আর রেশম চুমকি নিয়ে মাথা বিকোল, চোখ খারাপ করে ফেলল, সেগুলো কি কলের কাজকে হার মানায় নি? দরজিকে লজ্জা দেয় নি?
তারপর এই তিনচারদিন?
তাঁতির মাকুর মত টানা-পোড়েন করছে না অমিতা? নান্দীমুখের ঘরে কাঁচকলা কম পড়েছে কিনা, আর কাটলেটের কিমাটা কম থোড়া হল কিনা, এ তদারক কে করছে, অমিতা ছাড়া?
.
যজ্ঞির বিকেলে সংসারের তদারকিতে একটু ছুটি মিলেছিল। খাওয়া-দাওয়ার সমগ্র ব্যাপারটা বৃহৎ কর্মে গিয়ে ঠেকেছে, তাই কনে সাজানোর কাছে এসে একটু বসেছিল অমিতা।
সাজাবার সাধ অমিতার নিজেরই ছিল, কত আদরের দীপকের ভালবাসার বিয়ের বৌ। দেখতেও মোটামুটি ভালই। অমিতার হাতে সাজানোর ভার পড়লে সুন্দরীতে গিয়ে পৌঁছতে পারত, মনের মধ্যে এমনি একটা অহঙ্কারও ছিল বোধকরি, কিন্তু বাদ সাধল মহাশ্বেতা।
সে মুখটা করুণ করুণ করে বলল, তুই সাজাবি? তা বেশি ইচ্ছে হয় তো সাজা, তুই তো সর্বদাই দীপুর হিতকামনা করিস, করবি, তোর দ্বারা কি আর অমঙ্গল হবে?
অমিতা হাত গুটিয়ে নিয়ে বলল, অমঙ্গল হবে বুঝি? তবে থাক। একটু চুপ করে আবার বলল, আচ্ছা মহাদি, এ যুগেও ওসব অমঙ্গল-টমঙ্গল হয়?
মহাশ্বেতা গালে হাত দিয়ে বলল, শোন কথা! অমঙ্গলের আবার এ যুগ সে যুগ কি রে! যুগ পালটেছে বলে কি আর সাপে কামড়ালে বিষ লাগে না?
মোক্ষম যুক্তি! চুপ করে গেল অমিতা।
মহাশ্বেতা স্নেহময়ী, মহাশ্বেতার হৃদয় নরম, তাই সে ওর পিঠে হাত রেখে আদরের সুরে বলল, সাজাস! কাল থেকে যত পারিস সাজাস বৌকে, হাতের সুতোটা গলার মোনামুনিটা খোলা হোক, কাজললতাখানা হাত থেকে নামুক।
অমিতা আস্তে পিঠটা ওর হাতের ছোঁওয়া থেকে সরিয়ে নিল।
এই তো! শেষ খবর তো এই!
এই পর্যন্ত সবাই দেখেছে অমিতাকে, সহজ স্বাভাবিক। তারপর আর কই, কে তাকে দেখেছে? এত হট্টগোলে কে বা কাকে দেখে?
দেখেছিল, স্বয়ং বিয়ের বরই দেখেছিল। অমিতা তখন কনে সাজানোর পরবর্তী ব্যাপার মিটোচ্ছে। যারা সাজিয়েছিল তারা কনের চারখানা বেনারসী, যাবতীয় গহনা, এক সুটকেশ প্রসাধন সামগ্রী আর ডজন দুই সেফটিপিন, এক পাতা আলপিন, গোছ গোছ ফিতে কাটা ক্লিপ নিয়ে ছড়িয়ে বসেছিল। সাজাবার পর অমিতাকে সে সব তোলবার ভার দিয়ে হুড়োহুড়ি করে চলে গেছে আসরে, কনের সঙ্গে।
পাটখোলা বেনারসীগুলো খাটের ওপর স্তূপাকার হয়ে পড়েছিল, অমিতা পাট করে তুলছিল একে একে, এই সময় দীপক এসে দাঁড়াল, কিরে ছোড়দি, খুব খাটছিস?
অমিতা হাসল।
দীপকের মন কানায় কানায় উথলোচ্ছে, কথার সুখেই কথা কয়, কী রে বাবা কত শাড়ি।
অমিতা আর একবার হাসল।
এই ছোড়দি, জানিস অতনুদা এসেছেন!
অমিতার হাত থেকে পাট করা শাড়িখানা খস করে খসে গিয়ে ছড়িয়ে পড়ল।
দীপক অবশ্য সেদিকে তাকায় নি, সে সোৎসাহে বলে, এই তো কালই শুভেচ্ছা বাণীর টেলিগ্রাম এসেছে, আজ এসে হাজির। আমি তো অবাক! বললাম, এটা কি হল? হাসতে লাগলেন, বললেন, টেলিগ্রামটা করেই মনটা কেমন চঞ্চল হয়ে উঠল, বেরিয়ে পড়লাম। বললেন, তোর আবার বিয়ে! ভেবেছি আর হাসি পেয়েছে। আমাকে বরাবরই খুব ভালবাসেন
অমিতা ছড়িয়ে পড়া শাড়িখানা আবার তুলে নিয়ে পরিপাটি ভাঁজ করতে লাগল।
রংটা খুব কালো হয়ে গেছে, দেখো চট করে চিনতেই পারবে না। বললেন, ম্যাড্রাসে। থাকতে হলে সকলেরই সোনার বরণ কালি হয়ে যায়। কথাবার্তা ঠিক সেই রকমই আছে।
এবার অমিতা কথা বলে।
কয়েক বছরে মানুষ একেবারে বদলে যায় এই বুঝি ধারণা তোর?
দীপক তাড়াতাড়ি বলে, তা নয়। মানে, মস্তবড় অফিসার-টফিসার হয়ে গেছেন।
অফিসার তো আজকাল গড়াগড়ি যাচ্ছে। বলে মাটিতে গড়াগড়ি খাওয়া সেফটিপিনগুলো গুটোতে বসল অমিতা।
দীপক অবশ্য ঠিক এটা ভাবে নি।
বছর আষ্টেকের অদর্শন হলেও ওর ধারণা ছিল ছোড়দির প্রতি অতনুদার এবং অতনুদার প্রতি ছোড়দির বিশেষ একটু যে আকর্ষণ ছিল, সেটা এখনও আছে কোথাও, তাই অতনু আসার খবরটা ছোড়দিকেই আগে দিতে এসেছিল। কিন্তু অমিতার কাছ থেকে কোন সাড়া এল না। না চমকেই উঠল, না বা মুখের রংটাই একটু বদলাল! কথা একটা কইল, তাও আগ্রহ-শূন্য রসশূন্য। তবে আর কি করা।
মনটা খারাপ হয়ে গেল দীপকের। ভাবল ছোড়দির মনটা একেবারে মরে গেছে। ভাবল– যাবে না? সমস্ত দিন ওই হলুদ পাঁচফোড়ন নিয়ে পড়ে থাকলে মন মরে যাবে না?
তোর শ্বশুরবাড়ির লোকজন এসেছে? জিগ্যেস করল অমিতা।
দীপক এই প্রসঙ্গ পরিবর্তনটা ধরতে পারল না। না পারবারই কথা। বিয়ের ঠিক পরমুহূর্ত থেকে গোটাকয়েক দিন কোন্ ছেলেটাই বা একটু বুদু বনে না যায়? আর দীপক তো চিরকেলে বুন্ধু। এই প্রেমে পড়ে বসাই তো তার প্রমাণ। বুদ্ধ না হলে আর কে কবে প্রেমে পড়ে?
বুন্ধুর মতই উত্তর দিল সে, না রে ছোড়দি, সেই থেকে তো তাই ভাবছি। ফোন করব একটা?
অমিতা হেসে বলল অত করতে হবে না, আসবে ঠিকই। না আসা পর্যন্ত তোর বৌয়ের মনটা মনমরা হয়ে থাকবে এই আর কি।
বাঃ তা কেন? দীপক শরীরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলে ওঠে, এখন থেকে তো এ বাড়িটাকেই নিজেদের বাড়ি বলে মনে করতে হবে?
হবে বলেই সঙ্গে সঙ্গে তাই হইয়ে ফেলবে? মেয়েরা তোদের মত নয়।
তুমি তো সব সময় ছেলেদের নিকৃষ্ট ভাবো। ও নিজে কি বলছিল, জানো?
বলেই হঠাৎ লজ্জা পেয়ে চুপ করে যায় দীপক।
ও আবার কী বলল? এবার আলপিন খোঁজার জন্যে খাটের তলায় মাথা ঝোকাচ্ছে অমিতা।
কথাটা বলল নেহাত অন্যমনস্কের মত। আর বলল নেহাত দীপক বলেই। দীপকের সঙ্গে ছাড়া এত কথা আর কার সঙ্গে কয় অমিতা?
না, বলব না। বলে আপন মনে মৃদু মৃদু হাসতে থাকে দীপক। ভাগ্যিস ছোড়দিটা মাথা ঝুঁকিয়েছে, নইলে হাসিটা দেখে ফেলত।
বলব না বলাতেও যেন অমিতার কোন কৌতূহল নেই। আলপিন তুলে বলল, পরিবেশন সুরু হয়ে গেছে রে?
দীপক মনে মনে বলল, ইস! এখন ওই কথা!
সাধে কি আর ভাবছিল, ছোড়দির মনটা একদম মরে গেছে। ছোড়দি একবার অতনুর সঙ্গে দেখা করতে চায় কিনা, এইটাই তো ওর এখনকার প্রধান প্রশ্নের বিষয় ছিল। কিন্তু অতনুর খবরে তো গ্রাহ্যই করল না ছোড়দি।
গ্রাহ্য করলে অন্তত এক্ষুনি খোঁজ নিতে বসত না পাতা পড়েছে কিনা!
রেগে বলল, কেন, তুই তা হলে এবার কোমর বেঁধে লেগে যাবি?
অমিতা হাসল, কোমর বাঁধলে তোদের লোকসানটা কোথায়?
লাভলোকসান নিয়েই সর্বদা চলবে নাকি মানুষ? আরও রাগ করে বলল দীপক।
অমিতা আবার হাসল, প্রেমে পড়লি, বিয়ে করলি, তবু ছেলেমানুষই থেকে গেলি!
লাভলোকসান দেখবে না তো কি নিয়ে তবে চলবে রে মানুষ?
মানুষ মানুষের মতই চলবে। সুখ দুঃখু, সাধ বাসনা, ইচ্ছে অনিচ্ছে, ভাল লাগা মন্দ লাগা নিয়ে।
ওগুলো অমানুষের।
যা যা, আমরা সব তাহলে অমানুষ!
তুই বড় তাড়াতাড়ি রেগে যাস! বৌটার যে কি দশা হবে?
বাঃ সে কথা তো আমাদের হয়েই গেছে। জানো না?
তোদের কখন কি কথা হয়ে যাচ্ছে আমি জানছি?
শুনতে চাইলে তো জানবে? ঠিক হয়ে গেছে, আমরা কেউ কারুর ওপর রাগ করব না। করব না এই কথাটা একটা স্ট্যাম্প পেপারে লিখে, দুজনে সই করে রেখে দেবো। যেই। একজন রাগ করবে, তার নামের সামনে ধরে দেখানো হবে কাগজটা।
অমিতা মৃদু হেসে বলে, আর যখন তা সত্ত্বেও তার রাগ ভাঙবে না, তখন চুক্তিভঙ্গের অপরাধে তার নামে আদালতে নালিশ করতে ছোটা হবে, কেমন? যত সব ছেলেমানুষী! কই বললি না ছাতের কী অবস্থা?
আরে বাবা, এই মাত্তর দেখে এসেছি ফার্স্ট ব্যাচের পাত রেডি, আগে মহিলাদের আর শিশুদের বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। শিশু আর মহিলা তো একই শ্রেণীর! বলে হেসে চলে যায় দীপক। আর–আর একবার ভাবে, ছোড়দির মনটা একেবারে মরে গিয়েছে।
তারপর তো মেয়েরা অনেকে খেতে বসেছে, কে কোথায় হই হই করে বেড়াচ্ছে, অমিতা যে ঠিক কোন্ কর্মকেন্দ্রে আছে তা কেউ দেখে নি।
দেখল এসে মহাশ্বেতা। যে মহাশ্বেতা সর্বঘটের কাঠালীকলারূপে সারা বাড়ী ঘটঘটিয়ে বেড়াচ্ছিল।
মেয়েরা খেতে চলে যাওয়াতে দোতলাটা প্রায় নির্জন, আর কনে সাজাবার জন্যে নির্বাচিত এই কোণের দিকের ঘরটার তো ত্রিসীমানায় কেউ নেই, মহাশ্বেতার যে এখানে কী দরকার পড়েছিল মহাশ্বেতাই জানে।
সে ভেজানো দরজাটা হাত দিয়ে একটু ঠেলেই ভিতরের দৃশ্য দেখে পাথর হয়ে গেল।
তখনো অমিতা তাকে দেখতে পায় নি।
অমিতা তখন ঘরের প্রকাণ্ড ড্রেসিং আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে…হ্যাঁ, অসম্ভব অবিশ্বাস্য হলেও নিজের চোখকে তো আর অবিশ্বাস করতে পারে না মহাশ্বেতা? নিজের চোখে দেখল, আরশির সামনে দাঁড়িয়ে কপালে টিপ পরছে অমিতা! কুঙ্কুম আর চন্দনে সাজিয়ে তোলা ত্রিনেত্রর গড়নের লম্বাটে একটি টিপ। নিখুঁত করে আঁকছে।
আয়নায় অমিতার ছায়া পড়েছে। পুরো শরীরের ছায়া। যে শরীরটায় জড়ানো রয়েছে নতুন বৌয়ের একখানা জমকালো লাল বেনারসী শাড়ি।
নতুন বৌয়ের শাড়ি আর নতুন বৌয়ের কতকগুলো গয়না দিয়ে নিজেকে সাজিয়েছে অমিতা। আরশির সামনে দাঁড়িয়ে আছে যেন বাহ্যজ্ঞানশূন্যের মত।
তা সে জ্ঞান মহাশ্বেতাও হারিয়ে ফেলেছিল বুঝি! বেশ কিছুক্ষণ পাথর হয়েই দাঁড়িয়ে ছিল সে।
জ্ঞান ফিরল তখন, যখন দেখল শাড়ির আঁচলটা মাথা দিয়ে ঘুরিয়ে টেনে মুঠোয় চেপে ধরে ঘুরে ফিরে নিজেকে দেখছে অমিতা, আর তার ঠোঁটে মৃদু একটু হাসির রেখা!
অমি!
ঘরে ঢুকেই ভিতরের ছিটকিনিটা লাগিয়ে দিয়েই মহাশ্বেতা চাপা আর্তনাদ করে উঠল, অমি!
অমিতার কি এতক্ষণে বাহ্যজ্ঞান ফিরল? না সেটা চিরদিনের মতই হারিয়ে ফেলেছে সে? চোখে তার দৃষ্টিটা ঠিক কি? চমকে উঠেছিল কি একবার?
নাঃ, ওঠেনি বোধ হয়। চমকে ওঠাটাই উচিত ছিল, এই অস্বাভাবিক কাণ্ডের মধ্যেও কিছুটা স্বাভাবিকতা খুঁজে পাওয়া যেত তবে, কিন্তু তা সে উঠল না।
তার বদলে?
তার বদলে সহসা মহাশ্বেতাকে জড়িয়ে ধরে খিলখিল করে হেসে উঠে বলল, কেমন দেখাচ্ছে বলে তো মহাদি?
মহাশ্বেতা কিন্তু এই অকস্মাৎ বজ্রাঘাতে স্তম্ভিত হয়ে মাথাটা ঠিক হারাল না, দুহাতে অমিতার দুই কাঁধ ধরে প্রবলভাবে ঝাঁকুনি দিয়ে বলে উঠল, অমি! অমি! এ কী সর্বনাশ হল রে তোর অমি!
অমিতার হাসির পালা, কেন গো মহাদি, সর্বনাশ কি? কেমন কনে সেজেছি, কেমন টিপ এঁকেছি
ওলো সর্বনাশী, কার জন্যে-কার জন্যে? তাকে ধরে অনবরত ঝাঁকুনি দিতে থাকে মহাশ্বেতা।
আঃ, লাগে না?
ছাড়িয়ে নেয় অমিতা নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ফিক ফিক করে হেসে বলে, কেন, বরের জন্যে।
কোথায় তোর বর অমিতা? মহাশ্বেতা হাত পা ছেড়ে দিয়ে খাটের ওপর বসে পড়ে করুণ সুরে বলে, সে কি আর আছে হতভাগী?
বাঃ, তাকে তোমরা সরিয়ে দিচ্ছ বুঝি? আছে, আছে সে। নীচে আছে। এসেছে বিদেশ থেকে। তাকে একবার ডেকে দাও না গো মহাদি!
অমিতার কি নেশা লেগেছে? নেশাচ্ছন্নের মত চোখ মুখ কেন তার?
মহাশ্বেতা বেনারসী শাড়ির একটা কোণ অমিতার চোখে তুলে ধরে বলে, এ শাড়ি তুই কেন পরেছিস? এ কি তুই পরিস? এ তো নতুন বৌয়ের শাড়ি। তোর কাপড় তো এই!
অমিতার পরিত্যক্ত ইঞ্চিপাড়ের শান্তিপুরী হাফ-শাড়িটা তুলে এনে ধরে মহাশ্বেতা।
ও কাপড় বিচ্ছিরী, ছিঃ! অমিতা সেটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলে, ও আমি পরবো না।
অতঃপর আর সংশয় থাকে না মহাশ্বেতার।
কিন্তু এ কী আকস্মিক!
এ কী আকস্মিক!
জল খাবি অমিতা?
না না, জল খাব কেন? আমি নেমন্তন্ন খাব! অমিতা চোখ ভুরু নাচিয়ে বলে, কত কি ভাল ভাল রান্না হয়েছে। ওকেও ডেকে নিয়ে এসো না মহাদি! দুজনে একসঙ্গে খাই।
মহাশ্বেতা কাছে এসে দৃঢ়স্বরে বলে, তুই সব ভুলে যাচ্ছিস কেন অমি, সে তো নেই। সে তো বিলেত থেকে আসতে গিয়ে প্লেন ভেঙে মারা গেল, মনে নেই?
অমিতা ভাবশূন্য মুখ নিয়ে আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে।
ভাল করে ভাব, চেষ্টা করে মনে কর মহাশ্বেতা যেন মন্ত্র পড়ায়, সেই তুই দমদমে গেলি, তার মৃতদেহের সামনে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলি, তারপর মামার সঙ্গে- ইয়ে, তোর বাবার সঙ্গে চলে এলি, কিছু মনে পড়ছে না?
আবার আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে অমিতা।
তোর বরের নাম ছিল বীরেশ্বর, সেই চিঠি-ছাপা হল, পদ্য ছাপা হল–আপ্রাণ চেষ্টা করে মহাশ্বেতা, কত ঘটা করে বিয়ে হল–ভুলে যাচ্ছিস কেন?
দূর, তুমিই সব ভুলে যাচ্ছ মহাদি, আমার বরের নাম তো অতনু-অতনু সেন! সেই কোথায় যেন চলে গেল, কত দুঃখু হল আমার! একবার ডেকে আনো না মহাদি!
আনছি, তুই বসে থাক। বেরোস নে ঘর থেকে বলে ঘর থেকে বেরিয়ে এল মহাশ্বেতা, বেরিয়ে এসে ছিটকিনিটা ঠেলে বন্ধ করে দিয়ে জয়াবতীকে ডেকে–একান্তে টেনে নিয়ে গিয়ে কপালে করাঘাত করে খবরটা দিল।
.
সমস্ত অভ্যাগতের চোখ এড়িয়ে জয়াবতী এসে মেয়ে নিয়ে ঘরে খিল দিলেন। অবিশ্যি মহাশ্বেতাও রইল, নইলে মাথায় জল দিয়ে বাতাস করবে কে?
জয়াবতী ঘরে ঢুকে প্রায় আছড়ে পড়ে বললেন, অমি, অমু, কি হয়েছে মা? খেটে খেটে শরীরটা খারাপ লাগছে? গরম লাগছে? এই ভারী শাড়িটা খুলে দিই মা, নরম কাপড় পরে শোও একটু।
শাড়িটায় টান দিলেন জয়াবতী। অমিতা মায়ের হাতটা ঠেলে দিয়ে বলে উঠল, আঃ!
অমি, আমাকে আর মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা দিসনি মা! তুই সহজ হ ঠিক হ! মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন জয়াবতী।
ছেড়ে দাও বলে ফুঁসে উঠে মায়ের কবল থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিল অমিতা।
অমি, অমু, অমি! আমায় চিনতে পারছিস না?
চোখ দুটো কপালমুখী করে অমিতা খিলখিল করে হেসে উঠে বলল, পারছি। তুমি তো বড় পিসিমা।
আমি বড় পিসিমা!…ও মহা, একখানা থান ইট এনে আমার মাথায় বসিয়ে দে মহা, আমার সকল জ্বালা জুড়োক। এ দৃশ্য আমি আর একদণ্ডও সহ্য করতে পারছি না। ..অমু, অমিতা, আমি যে তোর মা অমি!
না, তুমি মহাদির মা। বলে সরে গিয়ে ও-দেওয়ালে গিয়ে দাঁড়ায় অমিতা।
জয়াবতী বারবার বোঝাতে চেষ্টা করলেন, গরমে ঘামে আর কতদিনের পরিশ্রমে এমন হচ্ছে তোর। গয়না কাপড় খুলে রাখ মা, পরে পরিস, নেমন্তন্ন খাবার দিন পরিস, এখন নরম কাপড় পরে শো
বুনো গোঁ ধরে হাত ছাড়িয়ে নিল অমিতা, আঃ ছেড়ে দাও বলছি! লাগে না আমার?
তবু দুজনের সঙ্গে একলা জোরে পারা শক্ত।
বেনারসী শাড়ি থেকে মুক্ত করলেন ওকে জয়াবতী আর মহাশ্বেতা। মাথায় মুখে জল দিলে শাড়িটা যে যাবে! দামী শাড়িটা!
জোর করেই জল দিয়ে শুইয়ে দিলেন জয়াবতী মেয়েকে। কিছুক্ষণের জন্যে চোখটা বুজল সে, বোধকরি ঘুমিয়েই পড়ল।
ঘুমোনো ভাল লক্ষণ! মহাশ্বেতা বলল, হিস্টিরিয়ায় ঘুম ভাল।
হিস্টিরিয়া বলে আর আমায় প্রবোধ দিস নে মহা, জয়াবতী চাপাগলায় ডুকরে উঠলেন, যা হয়েছে তা বুঝতে পেরেছি, আমার কপালের উপযুক্তই হয়েছে। নইলে আমার একটা ঘরণী গিন্নী মেয়ে স্বামীপুত্তুর ফেলে চলে গেল, আর একটার নগরে না উঠতেই বাজারে আগুন লাগল।
তবু সেও তো বুক বেঁধে সয়ে ছিলাম। এ আমার কি হল মহা? কেন হল?
মহা বিজ্ঞের মত বলে, আজকাল সব ডাক্তারদের নানান মতামত বেরুচ্ছে। বলছে, বেশি বয়সের আইবুড়ো মেয়ে কি কমবয়সী বিধবার পাগলামী হিস্টিরিয়া এসব হওয়ার কারণ না কি… ঢোক গেলে মহাশ্বেতা, তুমি গুরুজন কি আর বলব! তবে
জয়াবতী মেয়ের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকালেন–ঘুম কি, না আচ্ছন্ন? ভুরু কুঁচকে উঠছে, ঠোঁট কাঁপছে, কাঁপছে নাকের পাটা। গলা আরও নামিয়ে বললেন, এই বাড়িভর্তি লোক, এখন ডাক্তারের ব্যবস্থাই বা কি করে করি? অথচ
যাক যাক একটু। ভিড়টা একটু মিটুক, ঘুমোচ্ছে ঘুমোক। হয়তো ঘুমোলেও কিছু কমতে পারে। আশ্বাস দিয়েই আবার আশঙ্কার ঢেউ তোলে মহাশ্বেতা, তবে আশা কম। বড্ড ভরা বয়েস তো!
জয়াবতী বলেন, ভগবান জানেন, পাপের মন, পাঁচজনে জড় হয়েছে। কেউ কিছু খাইয়ে দিল না তো?
ওকে আর কে কি খাওয়াবে? ও কী বা খায়?
চা কে করেছিল আজকে? তোদের সে মামীর বোনঝি না? জয়াবতী সন্দেহে কুটিল হয়ে ওঠেন।
মহাশ্বেতা কি উত্তর দিত কে জানে, সেজ মামীর বোনঝির স্বপক্ষে না বিপক্ষে, কিন্তু উত্তর দেওয়ার আগেই দরজায় ধাক্কা পড়ল, বৌদি, বৌদি, আছ নাকি এখানে? অমিতাই বা কোথায় হাওয়া হল? কে আছ এখানে? আবার সজোরে ধাক্কা।
বলা বাহুল্য খুলতে হয় দরজা।
রক্ষে যে অমিতার ঘুম ভাঙে না।
কী ব্যাপার! সেজ দেওর বিজয় ঘরের ভিতরের দৃশ্যটা চকিতে দেখে নিয়ে বলে, হল কি? শুয়ে কে? অমি? শরীর খারাপ হয়েছে?
ঠাকুরপো! জয়াবতী ভ্যাক করে কেঁদে ফেলেন।
আরে বাবা, হল কি?
বিজয়ের স্বরে ব্যস্ততা। ফার্স্ট ব্যাচের যুগ্যি মিষ্টি বার করা ছিল, এখন মিষ্টির ভাড়ার চাবির মধ্যে সংরক্ষিত। আর চাবি জয়াবতীর আঁচলে। সারা বাড়ি খুঁজে বেড়াচ্ছিল বেচারা বৌদিকে।
খুব কসে ধমকে দেবার মনোভাব নিয়েই এসেছিল বিজয়। কিন্তু পারিপার্শ্বিকতার আকস্মিকতায় থতমত খেয়ে বলে, কি, মাথাটাথা ঘুরে গেছে বুঝি? যাবেই তো, যা চরকীর মত ঘুরছে কদিন! থাক, একটু রেস্ট নিচ্ছে নিক। তা সবাই মিলে ভিড় বাড়াচ্ছ কেন, একা ঘর অন্ধকার করে একটু ঘুমুতে দাও। আর তুমি মিষ্টির ঘরের চাবিটা চট করে দাও দিকি আমাকে। শীগগির শীগগির, লোক খেতে বসে গেছে।
বৌদি আঁচল থেকে চাবি খুলে দেবার আগেই তার আঁচলটা টেনে নিজেই দ্রুত হস্তে গিট খুলে চাবিটা নিতে নিতে বিজয় আর একবার বলে, মেয়েটা খেয়েছিল কিছু? নাকি উপোস করেই ঘুরছিল?
এ কথার আর উত্তর শোনার অবকাশ হয় না বিজয়ের, চাবি নিয়ে দৌড় মারে সে।
জয়াবতী আর মহাশ্বেতা ঘরের বাইরে এসে চুপি চুপি কথা বলেন।
তোর বড় মামাকে একবার ডাক দিকি মহা! হতাশ নিঃশ্বাস ফেলেন জয়াবতী।
বড়মামা তো সেই বাইরে। রাশ রাশ লোক সেখানে। গিয়ে কি বলব?
বলগে অমির হঠাৎ শরীর খারাপ হয়েছে।
কি হয়েছে জিগ্যেস করবেনই। তা হলেই সোরগোল পড়ে যাবে। আমি বলি কি, একটু ব্রোমাইড খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখলে–
না মহা, নিজেদের বুদ্ধিতে কিছু করতে ভরসা নেই। যদি হিতে বিপরীত হয়?
আশা, আমি কি আর একেবারেই আনাড়ী গো? আমার পিসশাশুড়ীর যখন মাঝে মাঝে ভীমরতি বাড়ে, বাড়ির লোককে উৎখাত করেন, তখন তো ওই ব্রোমাইডই ভরসা!
এবার বোধকরি জয়াবতী ওঁর পরমহিতৈষী ভাগ্নীর ওপর একটু বিরক্ত হন, বেজার মুখে বলেন, কী যে বলিস মহা! কিসের সঙ্গে কিসের তুলনা!
আহা তুলনায় আর ভুল কি? সবই তো সেই মাথায় রক্তচড়া?
ব্যস, আর কথা চালানো যায় না। হুড়মুড়িয়ে ছাতের দ্বিতীয় ব্যাচের মহিলারা নামছেন রূপের ছটায়, রঙের ছটায়, সোনা-মোতির ছটায়, আর কথার ছটায় তুফান তুলতে তুলতে।
ওরই মধ্যে একজনের নজর পড়ে যায় বারান্দার এ পাশের কোণের ঘরের সামনে মনুষ্যমূর্তি দুটির প্রতি। উৎসবের উল্লাসেই অকারণ খিলখিলিয়ে ওঠে সে, কি গো মেজখুড়ি, তোমরা ওখানে আঁতুড়ের দোর আগলানোর মতন করছ কি দুজনে?
জয়াবতী তাড়াতাড়ি এগিয়ে আসেন, বোধকরি পরিস্থিতি ঢাকতে বলতে যান, ভাল করে খেয়েছ তো? কিন্তু ততক্ষণে মহাশ্বেতা রক্ষক হয়েও ভক্ষকের ভূমিকা নিয়ে বসে।
আর বোলো না নদি, এদিকে তো মহা বিপত্তি! অমিতা এক মস্ত রোগ বাধিয়ে বসে মামীর তো নাড়ি ছাড়িয়ে দিচ্ছে?
ওমা সে কি?
রূপ, রং, গন্ধ, শব্দের সেই প্রবল তুফান মুহূর্তে একটিমাত্র সূক্ষ্ম সুরের তরঙ্গে কেন্দ্রীভূত হয়, ওমা সে কি? কি হল?
কি হল? কি হল? কি হল? জিগ্যেস করে উত্তরের অপেক্ষা কেউ করে না, ঠেলে ঢুকতে চেষ্টা করে ছোট্ট সেই ঘরখানার মধ্যে।
না, মহাশ্বেতাকে দোষ দিতে জয়াবতী পারেন না। আইন বাঁচিয়ে কাজ করেছে সে, রোগের নাম বলে নি। শুধু বড়মামীর অবস্থাটা বর্ণনা করেছে।
কি হয়েছে মা অমিতা!
কি হল হঠাৎ?.. মাথা ঘুরে গেছে? বুক কেমন করছে?
আহা মরে যাই, ভেতরে আগুনের জ্বালা পুরে রেখে বাইরে সহজের মত ঘুরে বেড়ায় বই তো নয়। অ মা অমিতা, কী কষ্ট হচ্ছে মা?
দেখা গেল নিমন্ত্রিতা নারীমণ্ডলীর প্রত্যেকেই স্নেহময়ী মমতাময়ী করুণাময়ী। ঘুমন্ত মানুষটাকে ঠেলে, গায়ে হাত বুলিয়ে, কপালের চুল সরিয়ে আকুল প্রশ্ন করতে থাকেন তারা সহসা কি হল অমিতার?
যে অমিতা গুণের খনি, কাজের অবতার, সহিষ্ণুতার প্রতিমূর্তি, আর অভাগ্যের প্রতীক।
ঘুম!
ঘুমই।
মাথায় রক্তচড়া রোগীর অস্বাভাবিক ঘুম হলেও মহানিদ্রা তো নয়! এমন সুগভীর সহানুভূতির আর মমতার স্পর্শে যে মহানিদ্রার মহাশিলাও গলে জল হয়ে যেতে পারে!
জয়াবতীর ভাজ আহা মরে যাই, আহা মরে যাই রবে অমিতার বুকের ভিতর হাত বুলোতে যেতেই সহসা ধড়মড় করে উঠে বসে অমিতা, আর জয়াবতীদের সমস্ত সাবধানতা ব্যর্থ করে দিয়ে তীক্ষ্ণ চীৎকার করে ওঠে, কে? কে এরা? এত ভিড় কেন ঘরে? একলা থাকব আমি, একলা থাকব।
নীল মৃদু বাল্ব জ্বলছিল ঘরে, অপমানাহত রমণীকুল জোরালো আলোটা জ্বেলে দেন, আর মুহূর্তে ধরা পড়ে যায় অমিতার ইতিহাস।
মাথায় জল দেওয়ার প্রতাপে কপালের সেই টিপের বাহারটা অমিতার ঘুচেছে, কিন্তু দুই কানে তখনও দুটি মকরকুণ্ডল, গলায় মুক্তোর পেন্ডেন্ট, দুই হাতে দুগাছি চূড়। বাহুল্য বোধে কনেসাজানিরা যেগুলো পরিত্যাগ করেছিল।
অমিতার পরনে শুধু সায়া-ব্লাউজ, যে কাপড়খানা পরেছিল বিকেলে সেখানা মাটিতে লুটোচ্ছে, আর খাটের বাজুর ওপর কনের নতুন লাল বেনারসীটা ছড়ানো জড়ানো!
এ কী!
এটা কী! এ কোন ধরনের অসুখ?
এই সাজ, আর এই চীঙ্কার! খানিক আগেও তো সবাই দেখে গেছে সহজ স্বাভাবিক অমিতা। বসে আছে, কাজ করছে।
তোমরা যাবে? আর একবার চীৎকার করে ওঠে উন্মাদিনী।
যাব না তো কি আর থাকবার জন্যে এসেছি!
অসুস্থ বলে ক্ষমা করেন না কেউ। হাঁড়িমুখে, কালিমুখে, আগুনমুখে বেরিয়ে আসেন সবাই। কেউ কেউ এমনিই নীচে নেমে যান, কেউ কেউ বা জয়াবতীকে একটু উপদেশের কামড় দিয়ে যান–মেয়ের যখন শরীর খারাপ, তখন বাড়িতে এত লোক জড় করা উচিত হয় নি জয়াবতীর।
এরপর আসেন বাড়ির কর্তারা, আর আত্মীয়রা, একে একে, দুইয়ে দুইয়ে। ঘরে ঢোকেন না, ঘরের বাইরে থেকে কি বৃত্তান্ত শোনেন, এবং সকলেই রায় দেন, বেশি খাটুনি, কম খাওয়া, ভিড় গরম, সব কিছু মিলিয়ে হিস্টিরিয়াই দেখা দিয়েছে, আজ ওকে ডিসটার্ব না করে ঘুমুতে দেওয়া হোক।
কিন্তু জয়াবতী প্রতিষেধকটা মোক্ষম চান।
তোমরা একটা ডাক্তার টাক্তার এনে দেখাও ঠাকুর-জামাই, একটু ঠাণ্ডা ওষুধ ওর পেটে পড়ক, যাতে ঘুম থেকে ওঠার পর আর কিছু বিঘ্ন না থাকে!
ডাক্তার!
তাই তো!
আহা ইস!
মুখে মুখে হিসেব হয়ে যায় কজন ডাক্তার আত্মীয় আজ নিমন্ত্রণে এসেছিলেন, আর ঠিক এই মুহূর্তেই কিভাবে ব্যাপারটা না জানায় সবাই প্রস্থান করেছেন।
অন্তত সাত-আটজন ভাল ভাল ডাক্তার ছিল!
ইস একটু আগে জানালে না?
আরে আমাদের তরুর জামাই তো মানসিক রোগেরই চিকিৎসক, এই–এইমাত্তর চলে গেল!
দীপকের মুখ দিয়ে আর কথা বেরচ্ছিল না, চুপ করে জটলার একপাশে দাঁড়িয়েছিল সে।
এর আগে বেচারা জনসমুদ্রের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হতাশ নিঃশ্বাস ফেলছিল, কারণ এ ঢেউ বিদায় না হলে ফুলশয্যার কথাই উঠবে না। একটা করে ব্যাচ নিঃশেষ হচ্ছিল, আর একটা করে অশ্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল সে, কিন্তু এ কী অভাবিত দুর্ঘটনা।
এ কী কূলে এসে তরী ডোবা!
আর তাছাড়াও ছোড়দির এই অবস্থা তাকে বিমূঢ় বিচলিত করে তুলেছিল। ছোড়দি তার সকল সুখ দুঃখের অংশীদার, তার আশৈশবের আশ্রয়। পিঠোপিঠি হলেও স্বভাবগুণে অনেক বড়। এই বিয়েটার ছোড়দিই তো মূলাধার।
মা বাপকে রাজী করানো তো বটেই, তার উপর দীপকের যা কিছু ইচ্ছে বাসনা, সবগুলি ছোড়দির মাধ্যমেই পেশ হয়েছে, এবং সেগুলি কার্যকরীও হয়েছে। আরও আশ্বাস দিয়ে রেখেছিল ছোড়দি তাদের, মধুচন্দ্রের পারমিটও আদায় করে দেবে সে ওপরওলাদের কাছ থেকে।
কোথায় তলিয়ে গেল সব আশা! পাগল একা অমিতাই হয় নি, দীপকের মনে হচ্ছিল সেও পাগল হয়ে যাবে।
নতুন বৌ কাঠ হয়ে বসে আছে পাশের ঘরে, তার প্রতি কারও দৃষ্টিপাত নেই। ফুলশয্যার অনুষ্ঠানটাও যে যো সো করে করে দেবে কেউ সে ভরসা নেই। হাতের কাজললতা গরম হয়ে উঠছে। হাতে বাঁধা সুতোয় জং ধরে গেছে। ধরবেই তো! এই গরম, তাছাড়া জল লাগছে সাবান লাগছে দুদিন ধরে। ও সুতো কি খোলা হবে আজ?
রাত কত হল?
না এমনি করে বসেই কেটে যাবে এই রাত? তাছাড়া আরও এক ভয়ে বুক গুড়গুড় করছিল সেকেন্ড ইয়ারের পড়ুয়া মেয়েটার। বিয়ের আগে থেকে দীপকের মুখে সে অবিরতই ছোড়দির মহিমার কথা জেনেছে, ছোড়দির বুদ্ধির প্রশস্তি শুনেছে, এসেও দেখছে কাল থেকে সারা বাড়িতে শুধু অমিতা অমিতা রব। কোনও কাজ হবে না অমিতা এসে না দেখলে।
সেই অমিতার বুদ্ধির গোড়াতেই এমন দুর্বিপাক ঘটল, নতুন বৌ এসে বাড়িতে পা দিতে না দিতে। যুগ যতই সভ্য হোক, আর মহিলাকুল যতই আলোকপ্রাপ্তা হোন, অপয়াকে অপয়া না বলবে কে? যুগ পালেটেছে বলে তো আর সাপের বিষ অমৃত হয়ে যায় নি?
এই কঘণ্টা আগেও আলোকোজ্জ্বল আর উৎসবমুখর বাড়িখানার দিকে তাকিয়ে বুকটা আনন্দের আবেশে শিথিল হয়ে আসছিল তার। তার জন্যে, এই সব কিছুই তার জন্যে, তাকে কেন্দ্র করেই সব।
কিন্তু এই বিপদপাতে কোন্ কে যেন কেচ্যুত হয়ে পড়ল সে বেচারা!
তবু দুটি নিকটআত্মীয়া মহিলার নিভৃত আলোচনা কানে আসে নি ভয়ে মুহ্যমান নববিবাহিতার। ওঁরা নিতান্ত ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে বলছিলেন এইটুকু কৃপা।
হ্যাঁ গা, নতুন বৌয়ের মা কিছু তুকতাক করে দিল না তো?
ওমা সে কি? কেন?
আহা কেন আর বুঝছ না? ঘরে দস্যি বিধবা ননদ থাকলে পাছে মেয়ের ষোলোআনা সুখ না হয়! জানতে তো পেরেছে ওই মেয়েই সর্বময় কী, সকলের আদরের আদরিণী, মাথায় মণি!
কি জানি ভাই, না দেখে আর কি বলব! তবে জগতে কিছুই অসম্ভব নয়।
দীপক দূর থেকে দেখছে, ঘরে বৌ বসে বসে ঢুলছে। একবার কাছে যাবার প্রবল ইচ্ছে বিবেকের দংশনে গুটিয়ে যাচ্ছে। ছি ছি, ছোড়দির এই অবস্থা, আর আমি কি না!
মনটাকে জোর করে টেনে এনে ছোড়দির ব্যাপারে দিতেই কানে এল ডাক্তার প্রসঙ্গ।
আর খানিক আগে জানাজানি হলেই যে অন্তত গণ্ডা-দুই ডাক্তারকে এখানে এনে বসানো যেত সেই কথাই হচ্ছে।
দীপক সহসা বলে ওঠে, অতনুদা তো রয়েছেন!
অতনু! তাই বটে, অতনু এসেছিল যে!
অতনু তো ভাল ডাক্তার। এখন অবশ্য মিলিটারীর ডাক্তার, আর তাতে বিদ্যে ভোতা হয়ে যায় এটাও ঠিক, তবু ভাল ছাত্র ছিল, স্কলারশিপ পেয়েছে দুবার।
মরা হাতী লাখ টাকা! আর লাখ টাকা না হোক, পাঁচটাকাই যদি হয়, তবু তো পাঁচ টাকাই। সেটুকু কাজও তো হবে।
অমিতার বাবা স্রেফ মাটিতে বসেছিলেন, রগ দুটো টিপে ধরে। দীপকের কথায় ক্লান্ত স্বরে বলেন, সে কি এখনো আছে?
বাঃ আছেন বইকি! পরিবেশনের তদারকি করছিলেন যে! বলেছিলেন বাড়ির লোকের মানে, আমাদের সঙ্গে খাবেন। নীচেই আছেন।
দীপকের মৃতদার বড় ভগ্নীপতি সস্নেহ সুরে বলেন, তুমিও তো খাওনি এখনও?
দীপক মাথা নাড়ল, সেজকাকা, ছোটকাকা, পিসেমশাই, বাবা, আপনি, কেউই তো খান নি আপনারা?
আহা আমাদের কথা আলাদা, সে হচ্ছে পরে। কিন্তু তুমি ছেলেমানুষ, এতটা অনিয়ম! তাছাড়া–ওই সব মেয়েলি কাজটাজগুলোসারতে তো হবে যা হোক করে!
পুরুষমানুষ দীপক, সহসা আর এক পুরুষের হৃদয় স্পর্শে প্রায় কেঁদে ফেলে–আর ওসব! ছোড়দির এই হল!
ভগ্নিপতি আশ্বাস দেন, হয়েছে সেরে যাবে, মেয়েদের এসব বয়সে ওরকম ঢের হয়। ঘাবড়াবার কি আছে? যাও যাও, তোমরা খেয়ে নাও গে। অতনু পরের ছেলে
সহসা ঘরের মধ্যে থেকে তীক্ষ্ণ তীব্র একটা শব্দ আসে, খায় নি কেন? খায় নি কেন ওরা? বিয়েবাড়িতে খায়নি কেন?
এঁরা শশব্যস্তে গিয়ে বলেন, খাচ্ছে-খাচ্ছে, এই সবাই খেয়ে নেবে একেবারে।
খাচ্ছে না, কেউ খাচ্ছে না। আমি বলি নি, তাই খাচ্ছে না। ডুকরে কেঁদে ওঠে অমিতা।
তা যা দিকিন, অতনুকেই একবার ডাক দিকি। বললেন দীপকের বাবা জগন্ময়।
মহাশ্বেতার মনে পড়ে গেল, পাগলিনীর প্রথম উন্মত্ত অভিব্যক্তি। কাছে এসে চাপা ধমকের সুরে বলল, ওকে আবার কেন বড় মামা? যতই তোক নিষ্পর, ওর কানে এসব কথা তোলার দরকারই বা কি? আত্মীয় হয় সে আলাদা কথা!
না না, সে কি!
মৃতদার বলে ওঠেন, অতনু তো এ বাড়ির আত্মীয়ের বাড়া। দেখেছি তো ছেলেবেলা থেকে।
.
কানাঘুসো শুনছিল অতনু। সবটা না জেনে যাওয়াও যায় না, অন্য কাজেও লাগা যায় না।
দীপক এসে আবেদন জানালো।
কানাঘুসোটা অনেকটা ক্ষেত্র প্রস্তুত করে রেখেছিল, অতনু অদ্ভুত একটা দৃষ্টিতে দীপকের দিকে তাকিয়ে বলল, ডাক্তার বলে ডাকতে এসেছ আমায়?
আহা ডাক্তার বলে কেন, এমনি বাড়ির লোক বলেই। সবাই তো গেছেন।
চল। নিঃশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল অতনু।
কিন্তু কে জানতো ডাক্তারের করস্পর্শেই ক্ষ্যাপা রোগী আরও ক্ষেপে যাবে?
স্পর্শ?
সে আর কতটুকুই বা? আঙুলের আগা কটি দিয়ে রক্তবহা ধমনীর রক্তধারার গতি করতে যতটুকু স্পর্শ অপরিহার্য।
ও মা–আ আ! কেঁদে উঠেছে অমিতা, ও আমাকে ছুঁয়ে দিলে, পুজো করতে যাচ্ছিলাম আমি!
পুজো! অমিতা আবার পূজো করে কখন?
জগন্ময় হতাশ দৃষ্টি মেলে জয়াবতীকে শুধালেন, পূজো করে?
না, কই? মহারাজজীর কাছে নিয়ে যাওয়ার নামে তো তেমন ইয়ে হল না!
অতনুর মুখ যেন ভাবলেশ-শূন্য। বাড়ির লোকের সঙ্গে খাবে বলে খাবার সময়টা টালবাহানা করে কাটিয়ে দিয়েছিল সে, সে কি এই দেখবার জন্যে?
ক্ষীণতম একটু আশা কি ভিতরে ধুকধুক করছিল না, যদি সেই সূত্রে কোনও মমতাময়ীর দেখা মেলে! যে সকলের খাওয়ার যত্নের সূত্র ধরে একবার সামনে এসে দাঁড়াবে।
জগন্ময় এতক্ষণে মেয়েকে ডেকে কথা কন, অমন উতলা হচ্ছ কেন মা অমিতা? এ যে অতনু, দীপুর বিয়ে বলে সেই ম্যাড্রাস থেকে এসেছে, চিনতে পারছ না?
বাপ, কাকা, অতনু, উপস্থিত সকলকেই চমকে দিয়ে খিল খিল করে হেসে ওঠে অমিতা, তুমি তো ভারি মজার কথা বল বাবা! নেমন্তন্ন খেতে রেলগাড়ি চড়ে এল?
হাসি কান্না, অসংলগ্ন কথা! আর বাকী কি!
জগন্ময় সকলের অলক্ষ্যে বুঝি নিজের গলাটাই একবার টিপে ধরেন নিজে, তারপর আবার সহজ হবার চেষ্টা করেন, বাঃ আসবে না? দীপুর বিয়ে! দেখতে আসবে না?
না না না!
চীৎকার করে উঠে বসে অমিতা, ও দীপুর বিয়ে দেখতে আসে নি, আমাকে দেখতে এসেছে। বল বল অতনু, তুমি আমাকে দেখতে এসেছ কিনা!
অতনু দাঁতে ঠোঁট চেপে বোধকরি নিজেকে সংহত করে নিয়ে শান্ত গম্ভীর গলায় বলে, এসেছি তো, তাই তো এসেছি। তোমার হঠাৎ অসুখ করে গেল, ওষুধ দিতে হবে না? কোত্থানে কষ্ট হচ্ছে বল।
কষ্ট! অমিতা সহসা অতনুর একটা হাত সজোরে চেপে ধরে বলে ওঠে, কোন্খানটায় নয়? সবখানে কষ্ট, জানো না? ছি ছি ছি, আবার বলে কিনা ডাক্তার হয়েছে! ডাক্তারে বুঝতে পারে না কোথায় কষ্ট!
অতনু কষ্টে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সরে এসে নিচু গলায় বলে, ঘুমের ওষুধ ছাড়া উপায় নেই। কাল স্পেশালিস্ট দেখানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
রাতটা তুমি থাকো বাবা!
জগন্ময়ও মেয়ের মত ওর হাতটা সজোরে চেপে ধরেন, একজন কেউ না থাকলে বড় ভরসা-ছাড়া হয়ে যাব। রাত তো অনেক হয়েছে।
বাড়ি অতনুদের কাছেই, একটা গলি বাদে, চাকরির জন্যেই দূরে যাওয়া। নইলে এখানে থাকতে তো অনেকে অতনুকে এ বাড়ির ছেলে বলে ভ্রম করত।
তা সে আজ বছর আট হয়ে গেল।
এতদিন অদর্শনে একটু সমীহ এসেছে, একটু দূরত্ব এসেছে। তাই অতনুর হাত ধরে। অনুরোধ করেন জগন্ময়, রাতটা তুমি থাক বাবা!
মহাশ্বেতা ততক্ষণে সরে এসে সেজ মামীর নিকটবর্তী হয়ে সন্ধ্যার ঘটনা আনুপূর্বিক বিবৃত করছে, জগন্ময়ের কথায় সেজমামীকে ইশারা করে, এই দেখ, আবার কি বিপত্তি ডেকে আনা নয়। থাকতে তো বলছেন, শেষে না বলেও আমার কাছে থাকুক!
তা মহাশ্বেতার আজ গৌরবের দিন। একে তো প্রথম দর্শনের গৌরব, তাছাড়া ভবিষ্যদ্বাণী সফল হওয়ার গৌরব।
কারণ পরমুহূর্তেই অমিতার ভাঙা ভাঙা গলা শোনা যায়, তুমি আমার কাছে থাক অতনু! আর কেউ না, শুধু তুমি। চুপটি করে বসে থাকো।
উক্তিটা পাগলের। কিন্তু উপস্থিত সকলে তো পাগল নয়? লজ্জায় লাল হয়ে ওঠেন ওঁরা।
ওষুধটা তুমি তাড়াতাড়ি দিয়ে দাও অতনু!
আজ্ঞে দিই।
কিন্তু এত রাত্রে পাওয়া যাবে কোথা?
আমার সঙ্গে আছে। চাকর-টাকর কাউকে দিয়ে আমার ব্যাগটা আনিয়ে দিতে পারবেন?
চাকর ছোটে।
.
অমিতা ওষুধটা খাও। তেমনি শান্ত গম্ভীর কণ্ঠে উচ্চারণ করে অতনু, খেয়ে নাও কষ্ট কমবে।
কষ্ট কমবে? কষ্ট কমবে? সহসা এক কীর্তি করে বসে পাগলিনী, উঠে বসে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর বুকের ওপর, মাথাটা ওর কাঁধের কাছে চেপে ধরে ডুকরে ওঠে, তুমি বুঝি আমায় বিষ দিচ্ছ অতনু? দাও তাই দাও। সব কষ্ট সেরে যাবে আমার!
কি হচ্ছে? নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে অমিতাকে শুইয়ে দিয়ে এবার ধমকে ওঠে অতনু, যথারীতি ডাক্তারের মতই, ওষুধটা ফেলে দিলে? বিষ দেব কেন? বিষ দিলে পুলিশে ধরে তা জানো না?
পুলিশে ধরে? পাগলিনীর বিহূল প্রশ্ন।
ধরে না? আমি পুলিশে যাই এই চাও বুঝি তুমি?
না অতনু, না! তুমি রাগ কোরো না। আবার কাঁদতে বসে পাগল।
মাত্রাতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দেওয়া হয় জোর করে, ঘর অন্ধকার করে বাতাস করতে থাকেন জয়াবতী।
বাকী সকলে চলে যায়।
.
নামমাত্র হিসাবে খেতেও বসে সকলে, আর রাত আড়াইটের সময় নতুন কনের হাতের সুতোটাও ভোলা হয় নিতান্ত অনাড়ম্বরে।
শাঁখ বাজে না, উলু পড়ে না। দীপক ক্লান্ত গলায় বলে, দোহাই তোমাদের, একটু ঘুমুতে দাও আমায়।
এমন সাহস কারও হয় না যে এই কথাটুকু ধরে ঠাট্টা করে।
অতনু থাকলে জগন্ময় ভরসা পাবেন, তাই জগন্ময়ের ঘরের একাংশে অতনুর বিছানা পাতা হয়। সবাই যে যার একটু গড়িয়ে নিতে যায়।
নিথর নিস্তব্ধ বাড়িটায় শুধু ঘূর্ণমান পাখার ব্লেডের শন শন শব্দের সঙ্গে ভারী হালকা নানা রকমের নিঃশ্বাসের শব্দ ওঠা-পড়া করে।
অতনুও কি একটু ঘুমের ওষুধ খাবে? মাথার শির ছিঁড়ে পড়ার মত যন্ত্রণাটা কমাতে?
এ কী অভাবনীয় অদ্ভুত পরিস্থিতি! কী এর অর্থ
অতনু কেন সেই দূরের পথপাড়ি দিয়ে এই উৎসববাড়িতে এল? কোন্ বাসনায়? কোন্ লোভে?
হ্যাঁ লোভ বইকি। লোভ ছাড়া আর কি। দীপকের বিয়ের উৎসব না দেখতে পেলে জীবন বৃথা হয়ে যেত না অতনুর। শুভেচ্ছা জানিয়ে টেলিগ্রাম করে তো উপসংহার করে দিয়েছিল। আবার কেন মাতাল হয়ে উঠল মন? কেন জরুরী প্রয়োজনের ছাপ মেরে ছুটির আবেদন করে তখুনি সে ছুটি মঞ্জুর করিয়ে নিয়ে ছুটেছিল বিমান অফিসে?
শুধু একটুখানি লোভ! উৎসববাড়ির এলোমেলোয় যদি একান্তে কোথাও দেখা হয়ে যায়! যদি শুধু একবার বলা যায়, কী অমিতা, কেমন আছ?
তবু এ প্রশ্নকেও বারবার মনের মধ্যে তোলাপাড়া করে দেখেছে, কেমন আছ এ প্রশ্ন কি আর এখন করা যায় অমিতাকে? ব্যঙ্গের মত শোনাবে না? যদি অমিতা বলে বসে সে কথা? যদি নিজেই সে তিক্ত ব্যঙ্গে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে, ঘটা করে আকাশে উড়ে ছুটে এলে বুঝি ঠাট্টা করতে?
তবে কেমন আছ এ প্রশ্ন থাক। অন্য কথা বলবে অতনু।
বলবে দীপক খুব লায়েক হয়ে গেছে তো? এই বয়সেই প্রেমে পড়া, বিয়ে করা, সব সেরে নিল! •
না, এ কথাটুকু নিয়েও দ্বিধা করেছে অতনু। ভেবেছে, থাক থাক ওকথা। কে বলতে পারে কোন্ কথায় কোন কথা এসে যাবে। হয়তো এ কথায় অমিতার ঠোঁটটি আরও বেঁকে যাবে। হয়তো আরও তীক্ষ্ণ করে বলবে সে, পুরুষমানুষ একটু পুরুষমানুষের মত হওয়াই তো ভাল।
হয়তো বা কিছুই বলবে না, শুধু সেই একজোড়া নীল চোখের স্থির দৃষ্টি দিয়ে অতনুর পৌরুষকে ধিক্কার দিয়ে উঠবে।
আর নয়তো বা সেই ওর চিরদিনের ভঙ্গিতে হেসে উঠে বলবে, প্রেমে পড়ার উপযুক্ত বয়স ওর হয় নি একথা মনে হচ্ছে তোমার?
তবে থাক, দীপকের কথা থাক।
দীপকের বৌয়ের কথাই বরং জিগ্যেস করবে অতনু, যদি উৎসববাড়ির গোলমালে কোথাও একান্তে পায় অমিতাকে। বলবে, কেমন বৌ হল দীপকের? সুন্দর? কি পড়ে? অবশ্যই এখনও ছাত্রী দীপকের বৌ!
আচ্ছা, এ প্রশ্নেই কি অমিতা ছেড়ে কথা কইবে? যা দুষ্টু সে! হয়তো বলে উঠবে, বৌ কেমন হল, সেটা আমার মাধ্যমেই জেনে নিতে চাও বুঝি অতনুদা বিনা খরচে? উঁহু ও চলবে না, সোনা পত্তর বার করো তবে বৌয়ের কথা। সোনা আনো নি? ঠিক আছে, পকেটে দুচারটে নয়া পয়সা কি আর নেই? তাই নিয়ে চল। বৌকে বলব কেমন একখানি চালাক লোক দেখো। তারপর হয়তো চোখ মুখের সেই অপূর্ব ভঙ্গী করে বলবে, আমার বিয়েতে তো স্রেফ ফকি মারলে, দীপকের বিয়েতে নয়া পয়সাই সই। আচ্ছা, আমার বিয়েতে কিছু দিলে না কি বলে?
না, ওসব কথা হয়তো আর বলবে না অমিতা।
হয়তো ভয়ানক কি এক রকম বদলে গেছে সে। হয়তো শান্ত মৃদু হেসে বলবে, বৌ ভালই, দেখো নি এখনো? চল দেখাই গে।
অমিতা যদি শান্ত হয়ে গিয়ে থাকে, না জানি কী অদ্ভুত দেখতে সে জিনিসটা! দেখলে যন্ত্রণা হবার মত বোধ হয়।
উৎসববাড়ির গোলমালে একান্তে কোথাও দেখা হয়ে গেলে অমিতা যদি শুধু নীল চোখ দুটো তুলে একটু শান্ত হাসি হাসে?
না, তা হলে আর কোনও প্রশ্ন নয়, কোনও কথা নয়, শুধু অতনুও দেখিয়ে দেবে সেও শান্ত হতে জানে। শান্তই তো হয়ে গেছে সে। আর হয়ে গেছে ভেবে নিজের উপর রীতিমত একটা আস্থা এসে গিয়েছিল। তবে হঠাৎ কেন কলকাতায় আসার একটা উপলক্ষে অশান্ত হয়ে উঠল রক্তবাহী শিরাগুলো?
যদি না আসত অতনু! যদি ছুটি মঞ্জুর না হত তার!
এমন অদ্ভুত আর লজ্জাকর পরিস্থিতিতে তো পড়তে হত না। তখনকার সেই ভয়ঙ্কর বিপদের মুহূর্তটা কী প্রবল শক্তিতেই কাটিয়ে উঠেছিল অতনু! এখন আর মনে পড়ছে না, কী করেছিল সে, কী বলেছিল। শুধু মনে পড়ছে কান দুটো অসম্ভব গরম হয়ে উঠে ঝা ঝাঁ করছিল। সেই ঝ ঝ গরমটা এখন মাথার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে তোলপাড় করছে।
তবু আজ রাতটা এখানেই থাকতে হচ্ছে অতনুকে। এঁরা অনুরোধ করেছেন। যে অনুরোধ অবহেলা করবার শক্তি হয় নি অতনুর। এঁরা অতনুকে ভালবাসেন, বিশ্বাস করেন। অতনুকে এঁদের ঘরের ছেলের মত মনে করেন।
ঘরের ছেলের মত মনে করেন বলেই তো ঘরের মেয়েকে তার হাতে তুলে দেবার কথা ভাবেন নি কেউ।
অতনুও কি শুধু সেই ঘরের ছেলের ভূমিকা অভিনয় করবার লোভে বিনা প্রতিবাদে নির্লিপ্ত হয়ে দেখল বসে বসে তার সম্পত্তি নীলেম হয়ে যাচ্ছে? কিন্তু তাই কি? অতনু তখন কোন ভরসায় দাবী করবে? কী তখন আছে অতনুর? মা বাপ মরা ছেলে, দাদা বৌদির সংসারে থেকে লেখাপড়াটা করেছে মাত্র। ডাক্তারী পাশ করেছে? করেছে তো কী মাথা কিনেছে? অমন কত পাশকরা ডাক্তার গড়াগড়ি যাচ্ছে।
অমিতা এঁদের দামী মেয়ে না? রূপে গুণে আলো করা মেয়ে!
দামী আর সেরা বর খুঁজছেন না এঁরা মেয়ের জন্যে? অতনুর পাগলামী শুনলে হেসে উঠতেন না এঁরা?
এই জগন্ময়, যিনি এই একটু আগে কাতর হয়ে অতনুর হাত ধরে বলেছিলেন, তুমি থাকলে একটু ভরসা পাই বাবা! আর এখন সেই ভরসার জোরে পরম নিশ্চিন্ত চিত্তে গাঢ় ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে আছেন অতনুর থেকে গজখানেক তফাতে। কি বলতেন তিনি সেদিন?
যদি পাড়ার ছেলে অতনু তার দামী মেয়েটিকে চেয়ে বসত।
অতনু যদি আস্তে আস্তে উঠে চলে যায় এখান থেকে? এ ঘর থেকে? এ বাড়ি থেকে, এ দেশ থেকে? আজকের এই সৃষ্টিছাড়া জটিল পরিস্থিতিটা কি তাহলে সহজ হয়ে যাবে?
ঘুমের ওষুধ খাওয়া গাঢ় ঘুম থেকে উঠে আবার সহজ আর শান্ত হয়ে যাবে ওই ক্ষেপে যাওয়া মেয়েটা?
কিন্তু অতনুকে কি বলবে সবাই?
না, যা হোক একটা কিছু করে ফেলবার সামর্থ্য অতনুর নেই। কোনদিনই ছিল না। অতনু স্বাভাবিক। অমিতাও তো স্বাভাবিক ছিল। হঠাৎ এ কী হল?
অমিতা যদি পাগল হল তো এতদিন পরে কেন হল? সেই অনেকদিন আগে হল না কেন? যেদিন বিজয় আর জগন্ময় অমিতার জন্যে পাত্র দেখে এসে উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছিলেন?
সেদিন কেন অমিতা আজকের মত পাগল হয়ে গিয়ে ভুল বকল না, কেন বলে ওঠেনি আমায় ছেড়ে দাও, আমার ছেড়ে দাও। আমি ওকে বিয়ে করব না! তোমরা আমায় মেরে ফেলছ, আমায় শেষ করে দিচ্ছ।
না, সেদিন পাগল হয় নি অমিতা।
হয়তো জীবনকে আর জীবনের নিয়মকে মেনে নিতে চেয়েছিল সে।
কিন্তু আশ্চর্য! এতদিন পরে এই মুহূর্তে সেই মেনে নেওয়ার ইচ্ছেকে বিসর্জন দিল অমিতা?
এই ঘণ্টাকয়েক আগেও দীপক বলেছে যা কিছু ছোড়দি! যা অসম্ভব খাটছে ছোড়দি! বিজয় তখন মিষ্টি মিষ্টি রবে হাঁক পেড়ে বলতে বলতে ছুটেছিলেন, আঃ এই চাবিটা বৌদির নিজের আঁচলে বাঁধবার যে কী দরকার ছিল! অমির কাছে থাকলে কোনও এদিক ওদিক হত না।
শুনে শুনে একটু আশ্চর্য হচ্ছিল বইকি অতনু।
কই আগে তো এমন ভারসই কর্মিষ্ঠি মেয়ে ছিল না অমিতা। বরং জয়াবতীর মুখে যখন তখন এই আক্ষেপই শোনা গেছে অমিটা কোনও কর্মের হল না। নমিতার আমার কত গোছ, কত ব্যবস্থা! না, তখন নমিতা মারা যায় নি।
কিন্তু নমিতা কি মৃত্যুকালে তার সব কর্মক্ষমতা অমিতাকে দান করে দিয়েছিল? তাই অকর্মা অমিতা এমন কাজের মেয়ে উঠল যে, সারা সংসার নাকি অমিতাই মাথায় করে রাখে।
মাথার যন্ত্রণাটা প্রবল হয়ে উঠেছে। ওষুধের ব্যাগটা কেন অতনু দীপকের ঘরে রেখে দিল? যদি নিজের কাছে রাখত, খেয়ে নিত একটু ঘুমের ওষুধ।
বোকামী করেছে। সারা জীবনই বোকামী করে এল অতনু।
মুখের উপর পাখা ঘুরছে। তবু শুয়ে পড়ে থাকা শক্ত হচ্ছে।
জগন্ময়ের নাকের গর্জন যেন একটা অশ্লীলতার মত চেতনায় এসে এসে বিঁধছে! তার চেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে ওই খোলা বারান্দাটায় গিয়ে একটু দাঁড়ানো ভাল। পায়চারি করবার জায়গা নেই, বারান্দার দুটো কোণই বোকই। ঘরে জায়গা বার করবার জন্যে এটা ওটা আজেবাজে বার করে জড় করে রাখা হয়েছে এখানে।
তবু ভাল, ওই তেঠেঙে বেতের চেয়ারটার ওপরই একটু বসা চলে। ধরানো চলে একটা সিগারেট।
কে ভেবেছিল অতনুর কোনও একটা রাত এ বাড়িতে কাটবে?
বাড়ির ছেলের মত হলেও রাত কাটাবার প্রশ্ন উঠবে কি ভাবে? ওর বাড়ি যে কাছেই। নমিতার বিয়ের রাত্রে, বিজয়ের বৌভাতের রাত্রে, মনে আছে অতনুর অনেক রাত পর্যন্ত এ বাড়িতে হইহুল্লোড় করে পান খেয়ে সিল্কের পাঞ্জাবিতে পানের রস ফেলে ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে ও বাড়ি গিয়ে শুয়ে পড়েছিল।
একথা কেউ ভাবে নি, আহা এখানেই থাকুক না!
আজ জগন্ময় বললেন।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য ক্রমশই দূরত্ব এসেছিল। অতনুর বৌদিই তার কিছুটা কারণ। তিনিই প্রথম প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন অলক্ষিত জগতে কোথাও একটি হৃদয়ঘটিত ব্যাপার রয়েছে।
সেই অনুক্ত অনুচ্চারিত বস্তুকে যখন তখন তিনি বক্রোক্তির সুতীক্ষ্ম কৌশলে উচ্চারণ করে বসতেন। আর প্রশ্ন করতেন, অতবড় মেয়ে ওদের ঘরে, এই সব পাড়ার ছেলেদের দিব্য অবারিত দ্বার করে রেখেছে?
অথবা আরও সুকোমল প্রশ্নে বলতেন, কিসের আশায় নিত্য ধরণা দাও ভাই ওরা কি তোমার মত সস্তা ছেলের হাতে মেয়ে দেবে?
হোপসেল! অসহ্য! এমনি ছোটখাটো মন্তব্যে বৌদির স্থূল রসিকতাগুলোকে উড়িয়ে দিতে চেষ্টা করত অতনু, কিন্তু কুণ্ঠাকে উড়িয়ে দিতে পারত না। ধীরে ধীরে আপনিই নিয়ন্ত্রিত হয় গিয়েছিল গতিবিধি।
ছেলেবেলার সেই দুদ্দাড়িয়ে সিঁড়ি উঠে তিনতলার ছাতে গিয়ে প্রবল দৌরাত্মটা অবশ্য সেরে গিয়েছিল নমিতার বিয়ের পর। কারণ সে খেলার প্রধান অংশীদার ছিল নমিতা। বয়সের হিসেবে নমিতাই তো বরং অতনুর সমান সমান। বড় জোর যদি এক আধ বছরের বড় হয় নমিতা। তখন নমিতা আর অতনু ওদের হাঁটুর বয়সী অমিতাকে কী কৃপাদৃষ্টিতেই না দেখত! খেলায় যদি নিত তো সে নেহাই ক্ষ্যামাঘেন্না করে।
তারপর কেমন করে কোথা দিয়ে যে সেই ভাবনাহীন বাল্য-কৈশোরের উজ্জ্বল শাদা দিনগুলো হু হু করে পার হয়ে গেল, কোথা থেকে এল রঙিন ভাবনা, আর ভাবনায় রাঙা দিন! কোথা থেকে কেমন করে সেই হাঁটুর বয়সী মেয়েটা ফ্রক ছেড়ে শাড়ি ধরে এক অপরূপ আকর্ষণের মহিমা নিয়ে চোখের সামনে ঝলসে উঠল।
কিন্তু সেই ঝলসানিতে কি দৃষ্টি অন্ধ হয়ে গিয়েছিল অতনুর? শোভন অশোভনতার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল? না, ঠিক তার উল্টো। বরং শোভনতা বোধের মাত্রাটাকে অতনু যেন বাড়িয়েই তুলেছিল।
নইলে কেউ তো ওকে কোনদিন মুখে ফুটে বলে নি, তুমি আর এ বাড়িতে ঘন ঘন এসো না অতনু, আমাদের ঘরে বড় মেয়ে। অথবা এ-ও বলে নি, অতনু তুমি বড় হয়েছ, বেড়াতে এলে নীচে বসবার ঘরে বসাই তো উচিত। দোতলায় ওঠার দরকার কি?
না না, তেমন দোষারোপ করা যায় না এঁদের উপর। অতনু নিজে থেকেই যখন তখন আসা কমিয়ে দিয়েছে। ইচ্ছেমত দোতলায় ওঠা বন্ধ করে দিয়েছে। যখন এসেছে, হয়তো নীচে বসবার ঘরে বসে জগন্ময় হিরন্ময় বিজয়ের সঙ্গে কথা বলে চলে গিয়েছে। হয়তো বা ভিতরে এসে রান্নাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে বলেছে, কী কাকীমা, কি করছেন?
অবিশ্যি কাকীমারাও কোনদিন হৃদয় বাড়িয়ে দিয়ে বলেন নি, তুমি আর তেমন যখন তখন আস না কেন অতনু? আসবে, দোতলায় উঠে যাবে, বসবে, গল্প করবে। পরের মত বাইরে থেকে চলে যাও কেন?
আসল কথা, তেমন কথা বলবার খেয়ালই হয় নি কারুর। ছেলেটা ছোট ছিল, পড়শীর বাড়ি এসে হুড়োহুড়ি করত। এখন বড় হয়েছে, সভ্য শান্ত হয়েছে, বাইরে বেটাছেলেদের সঙ্গে কথা বলে চলে যাবে, এটাই তো স্বাভাবিক। এতে হায় হায় বোধ আসবে এমন আদিখ্যেতাওয়ালা মন তাদের কারুরই নয়।
আর মহাশ্বেতা যখন মাঝে মাঝে মামার বাড়ি আসত, তখন তো অতনু এ বাড়ির ছায়াও মাড়াতো না। ভারি ভয় লাগত ওর মহাশ্বেতাকে। অথচ কোনওদিনই কিছু বলে নি তাকে মহাশ্বেতা। শুধু সেই একটি দিন!
তা সেই বা এমন কি!
অতনু এ বাড়িতে এসেছিল, আর সামনেই অমিতাকে দেখে ব্যস্ত হয়ে প্রশ্ন করেছিল, কাকাবাবু কোথায় অমিতা?
যেন কাকাবাবুর কথা ভেবেই সারারাত ঘুম আসে নি অতনুর। আর কাকাবাবুর জন্যেই উদ্বেল হয়ে ছুটে এসেছে।
দুষ্ট অমিতা হেসে উঠে সেই প্রশ্নই করেছিল। বলেছিল, সক্কালবেলাই বাবাকে খুঁজছ যে, কী দরকার? রাতে স্বপ্ন দেখেছ বুঝি?
স্বপ্ন! হ্যাঁ, স্বপ্ন তো দেখেইছি। অতনুও হেসে বলেছিল, ঘুম হয় না অথচ স্বপ্ন দেখি, এ কী অদ্ভুত রহস্য বল তো?
ঘুম আবার হয় না! অপূর্ব ঝঙ্কারে হেসে উঠে বলেছিল অমিতা, রাত্তির নটা থেকে সকাল
ছটা পর্যন্ত তো স্রেফ নাসিকাধ্বনি।
বটে! গিয়ে দেখে আসো বুঝি?
যেতে হবে কেন? এ বাড়ি থেকে শব্দ কানে আসে যে!
অতনু এদিক ওদিক তাকিয়ে টুক্ করে বলেছিল, এমন তো হতে পারে, সেটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ।
উত্তরটা আর শোনা হয় নি। হঠাৎ দেখা দিয়েছিল মহাশ্বেতা, সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে ঝুঁকে নীচের উঠোনটা দেখছে।
মৃদুস্বরে বলেছিল অতনু, পালাও। আশেপাশে প্রহরীর চক্ষু। আর গলা তুলে বলেছিল আচ্ছা আমি তাহলে ও বেলা আর একবার আসব। দরকার আছে কাকাবাবুর সঙ্গে।
উৎসববাড়ির গোলমালের সুযোগ না থাক, একান্তে দেখা হলে এ রকম বা এ ধরনের বাক্য বিনিময় তাদের হত। কিন্তু তার বেশি আর কিছু নয়। আর বেশি উদ্ঘাটিত করে নি কেউ নিজেকে। কি করেই বা করবে? আশৈশবের পরিচয়ই যে সেই নতুন উদঘাটনের বাধা।
স্থান কাল পাত্র গভীর সুরে গভীর কথা শোনাবার মত ছিল না।
কিন্তু মহাশ্বেতার সন্ধানী দৃষ্টি সেই হাল্কা সুরে বলা হালকা কথা কটির মধ্য থেকেই আবিষ্কার করে বসেছিল এক গভীর তথ্য। তাই বলে ফেলা কথা রাখতে অতনু যখন ও বেলা এসে আবার জগন্ময়ের খোঁজ করেছিল, তখন পড়ে গিয়েছিল মহাশ্বেতার কবলে।
মহাশ্বেতা কিন্তু বিশেষ কিছুই বলে নি। শুধু নেহাৎ নিরীহ সুরে বলেছিল, তুমিই অতনু? আগে তো তোমার নমিতার সঙ্গে খুব ভাব ছিল, তাই না? এখন বুঝি অমির সঙ্গে ভাব?
অতি তুচ্ছ একটি প্রশ্ন।
তবু সেই থেকে মহাশ্বেতা মামার বাড়ি এসেছে এ খবর টের পেলে এ-মুখো হত না অতনু। আর ক্রমশ তখন অমিতার কলেজ যাওয়া আসার পথে হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়াটাই প্রধান হয়ে উঠেছে।
তারপর নমিতা মারা গেল। বাড়িতে শোকের ছায়া পড়ল।
একটু গম্ভীর হয়ে গেল অমিতা, একটু ম্লান হয়ে গেল অতনু। আর সেই সময় চলতে লাগল অমিতা-পারের তোড়জোড়।
ছেলেবেলা থেকে কত ঘটনা কত ছবি! সব ঘটনাগুলো যেন সাম্প্রতিককার মত কাছাকাছি এসে ভিড় করছে! সব ছবিগুলো যেন গতির চাঞ্চল্য পেয়ে চোখের সামনে ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছে!
দোতলায় ওঠা বন্ধ করে ফেলেছিল, তবু একদিন সন্ধ্যায় এই বারান্দায় দেখা হয়েছিল অমিতার সঙ্গে। সেদিনও এ বাড়িতে কী যেন উৎসব ছিল। বোধহয় বিজয়ের প্রথম সন্তানের অন্নপ্রাশন। নেমন্তন্ন খেতে ছাতে উঠে, সোজা সিঁড়ি দিয়ে নেমে না গিয়ে, যেন ছিটকেই এদিকে চলে এসেছিল অতনু। এখানে দাঁড়িয়ে ছিল অমিতা। অতনু বলেছিল, কোনও কাজই তো করতে দেখছি না। পানটা পরিবেশন করলেও গেরস্থর কিছু করা হত।
গেরস্থর কাজ করবার অনেক লোক আছে। বলেছিল অমিতা।
তাই শুধু শুধু দাঁড়িয়ে আছ?
না, শুধু শুধু তো দাঁড়িয়ে নেই!
কি করছিলে তাহলে?
অমিতা চোখ তুলে বলেছিল, অপেক্ষা!
অপেক্ষা? কিসের? ভারি যেন আশ্চর্য হয়েছিল অতনু।
আর সঙ্গে সঙ্গে মুখের ভাব বদলে গিয়েছিল অমিতার। গভীর থেকে তরলে, বিষণ্ণতা থেকে উচ্ছলতায়।
কিসের? তাও বুঝিয়ে দিতে হবে? আশ্চর্য! অপেক্ষা করছিলাম খাবার ডাকের। বাড়ির লোকদেরও যে খিদে পায় এটা কারও মনে পড়ে কিনা তাই দেখছিলাম নিঃশব্দে।
লুচির খিদে!
প্রায় ধিক্কার দিয়ে বলে উঠেছিল অতনু। আর অমিতা হেসে উঠে বলেছিল, তা ওর থেকে সূক্ষ্ম ক্ষুধা বোধ হলেই বা লাভ কি? বোঝে কে?
তারপর আরও কি কি কথা হয়েছিল মনে নেই অতনুর। বোধকরি ছোটকাকার ছেলেকে তার মামার বাড়ি থেকে কী অদ্ভুত সুন্দর একটা গিনির মালা দিয়েছিল তারই ব্যাখ্যা করেছিল অমিতা। তারপর আরও কত কি!
তবু সেদিন অনেকক্ষণ এখানে দাঁড়িয়েছিল অতনু এটা মনে আছে, কিন্তু এ বাড়িতে কোনদিন রাত কাটায় নি অতনু। আজও অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে। আজ রাত কাটাবে।
ইচ্ছে করলেই বসা যায়। কত কিই তো রয়েছে বসবার মত। তবু দাঁড়িয়েই আছে।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছে পায়চারি করতে সুরু করা যায় কিনা। আর যদি তা যায়, তাহলে দালানের ও প্রান্তের ওই ঘরটার খোলা জানলাটার সামনে দিয়ে একবার ঘুরে আসা যায় কি না। যে জানলাটা দিয়ে শুধু ও ঘরের ঘূর্ণমান পাখার ব্লেডটার একাংশ ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
হঠাৎ অদ্ভুত একটা কথা মনে এল অতনুর। মনে হল, এ বাড়িতে একদিন রাত কাটাতে পারত সে, যদি সে এমনি কোনও উৎসবের কেন্দ্র হয়ে আসত, ফুলের মালা আর টোপর পরে।
২. উৎসবরাত্রি
উৎসবরাত্রির পরবর্তী সকালটায় সংসারের চেহারাটা থাকে যেমন শ্রীহীন তেমনি অরুচিকর। এ যেন শত্রুপক্ষের সৈন্য-অধ্যুষিত শহর। সৈন্যরা চলে গেছে, কিন্তু যথেচ্ছ রেখে গেছে তচনচ করা অসম পদচিহ্নের স্বাক্ষর।
অথচ চাঙ্গা হয়ে উঠে তখুনি আবার সব ঠিক করার উৎসাহও কারও থাকে না। মিটে গেছে তো কাজ, নিভে গেছে তো সমস্ত বাড়তি আলো, আবার তবে এখুনি ওঠাবার কি আছে?
উৎসব-ক্লান্ত রাত্রির শেষে অলস ঘুমে আচ্ছন্ন প্রাণীগুলো যখন চোখ খুলেই একবার আজকের হালকা মাথাটার অপূর্ব সুখ অনুভব করে ফের পাশ ফিরে ঘুমোয়, তখন তাদের দেখে মনে হয়, জীবনে বুঝি ওদের এইটা ছাড়া আর কোন কাজ ছিল না, অতএব জীবনের সব কর্ম সমাধা হয়ে গেছে, এবার নিশ্চিন্তে অনন্ত নিদ্রা দিতে পারে।
কিন্তু ঘুম থাকে না গৃহিণীর। সংসারের যিনি কর্ণধার।
তিনি জানেন গত দিনের চাইতেও আজকের কর্তব্যকর্ম অনেক কঠিন! আজ জোয়ার নেই, শুধুই ভঁটা।
সকলকে চালাতে হবে নিরুৎসাহের ভাটা ঠেলে ঠেলে। আজ কাউকে কোনও কাজ বললেই
বাড়ির লোকেরা ক্লান্তির চরম অভিব্যক্তি দেখাবে, এবং মাইনে করা লোকেরা মেজাজের চরম নমুনা দেখাবে।
এ ছাড়া প্রত্যেকের মুখেই শুনতে পাওয়া যাবে, তারা কিছুই দেখে নি, কিছুই খায় নি।
কারণ?
কারণ আবার কি, তারা তো শুধু খেটেছে। অতএব আবার ভাল খাওয়াও এবং বকশিশের লোভ দেখিয়ে তবে তাদের কাজে নামাও! চোখ রাঙিয়ে কাজ আদায় করার দিন এখন চলে গেছে। কী দাসদাসী, কী পরিজন, সবাইকে তোয়াজ করতে হবে। নচেৎ ছাদের এঁটোকলাপাতা সন্ধ্যা অবধি উড়বে, এখানে সেখানে স্তূপীকৃত মাটির খুরি-গেলাসগুলো সারাদিন কাকে ওলটাবে, আর গতরাত্রের পাতা শতরঞ্চি আর অস্থায়ী বিছানাগুলো আবার আজ রাত্রের দরজায় পৌঁছবে!
যায়, সবাই শিথিল হয়ে যায়। এমনিতেই উৎসব-অন্তে এরকমই হয়ে থাকে, আর দীপকের বৌভাতের রাত্রের ব্যাপার তো আরওই।
রাত তিনটে সাড়ে তিনটেয় সবাই ঘুমিয়েছে। ভোরবেলা কে উঠবে?
কিন্তু উঠলেন। জয়াবতী উঠলেন।
মনে পড়ল আজ অমিতা কিছু পারবে না, অমিতা বিছানায় পড়ে।
সঙ্গে সঙ্গে প্রাণটা হাহাকার করে উঠল, অমিতা কি আর কোনদিনই তেমন করে পারবে? তেমন করে করবে? জয়াবতীকে বেলা আটটা অবধি বিছানার কোমল স্পর্শ অনুভব করতে দিয়ে সংসারের চণ্ডীপাঠ থেকে জুতো সেলাইয়ের কাজে আত্মনিয়োগ করবে?
না না, ভগবান জয়াবতীর সব সুখ কেড়ে নিলেন!
জয়াবতী উঠলেন, সাবধানে নিঃশব্দে, অমিতার পাশ থেকে! সে ঘুমোচ্ছে অঘোরে।
উঠে এসে একবার চারিদিক দেখলেন, এখুনি যদি কেউ ঝাটা ন্যাতা আর জলের বালতি নিয়ে নেমে না পড়ে তো আজকের আহার আয়োজনের বারোটা বেজে যাবে। ডাকলেন চাকর কেষ্টকে। বাবা বাছা বলেই ডাকলেন, সে একটা উ ধরনের শব্দ করে আবার পাশ ফিরল।
আশ্চয্যি! যত সুখ আমার দেখেছে! বলে পুরনো চাকর হরিকে ডাকলেন বেশ উষ্ণ ভাবেই। উত্তরে হরি গায়ে চাদরটা ভাল করে টেনে নিয়ে জড়ানো গলায় যা বলল তার অর্থ এই দাঁড়ায় তার মাথায় অসহ্য যাতনা তার কোমরে অসম্ভব বেদনা, অতএব
তোরা ভেবেছিস কি? এই বাড়ি কি তবে আমি পরিষ্কার করব? প্রায় ডুকরে কেঁদে উঠলেন জয়াবতী, সবাই যে যার আয়েস করে ঘুমোতে থাকলেন, যত জ্বালা আমার! কী চোরদায়েই আমি পড়েছি!
এই সবাইটা অবশ্য চাকরবাকর নয়, লক্ষ্যস্থল আরও ব্যাপক। সেজ আর ঘোট দুই জা আছে, অছেন বড় ননদ আর ভাগ্নী, জায়েদের আইবুড়ো মেয়েরাও আছে।
সকলেই ঘুমে অচেতন। কেন? কেন?
এমন কি নতুন বৌয়ের ওপরও রাগ এসে গেল জয়াবতীর। রোদ উঠে দালান ভরে দিল, ফুলশয্যার কনে এখনো বরের ঘরে শুয়ে! ছি ছি ছি! জয়াবতীরা এ রকম করতে পারতেন?
বিয়ের দুচার বছর পর পর্যন্তও যে জয়াবতী কাক-কোকিল ডাকার আগে উঠে পড়ে আপন শয়নমন্দির ত্যাগ করে যেখানে সেখানে এসে পড়ে থেকেছেন, এতদিন পরেও সেটা মনে পড়ে গেল।
নতুন বৌ তার কোন্ কাজে এখন লাগবে সে কথা স্মরণ না করেই রাগে জ্বলতে থাকলেন জয়াবতী। জ্বলতে জ্বলতে সেজ এবং ছোট জায়ের ঘরের সামনাসামনি দাঁড়িয়ে সশব্দ স্বগতোক্তি করে উঠলেন, রাত করে ঘুমিয়েছে সবাই, আমিও কিছু সন্ধ্যে থেকে ঘুমুচ্ছি না। আমার ওপর দিয়ে যে কী ঝড় বয়ে গেছে, আমি জানি আর ভগবান জানেন।
ভগবান অবশ্য সমর্থন কি প্রতিবাদ কিছুই জানালেন না। বন্ধ দরজাগুলি থেকেও কোনও সাড়া এল না।
জয়াবতী স্বর আর একটু উচ্চগ্রামে তুললেন, আমারই বা কী দায়! আমি আমার অসুখ মেয়ের কাছে শুয়ে পড়ে থাকিগে। যেখানে যেমন আছে থাকুক পড়ে। দরকার সকলেরই আছে, ভাত সবাই খাবে, আমি একাই খাব না!
আরও হয়তো কিছু বলতেন, কিন্তু বাধা পড়ল। কোন্ ঘর থেকে যেন অতনু উঠে এল রাঙা রাঙা চোখে। বলল, কাকীমা! ওখানে কে একটা মেয়ে বোধহয় আপনাকে খুঁজছে।
মেয়ে! এই সকালবেলা জয়াবতীকে খুঁজছে! ভয় পেয়ে গেলেন জয়াবতী, কি রকম মেয়ে?
অতনু ব্যস্ত হয়ে বলে, না না, এমন কেউ না। এই ঝিটিয়ের মেয়ের মত!
অ্যাঁ, ঝিয়ের মেয়ে!
ভয় চরমে ওঠে। ভূতের বাঘের সাপের সব কিছু ভয়ের বাড়া ভয়ের ছায়া দেখতে পেলেন জয়াবতী।
তাহলে নির্ঘাৎ মাগী আসতে পারবে না বলে খবর পাঠিয়েছে! ও অতনু, আমি কি করি বাবা! …কে রে কে? লতিকা? কী? কী খবর শুনি।
মা বলল আসতে পারবে না, জ্বর–গা হাত পা ব্যথা–পেটের অসুখ—
ফিরিস্তি বড়, তার মানে অন্তত দিনতিনেকের মত!
বিয়ের বকশিশ, তত্ত্বর পাওনা, সবই যখন পাওয়া হয়ে গেছে, আর এত কষ্টর দরকার কি?
জয়াবতী ভয়ঙ্কর স্বরে বলেন, তোদের ওসব মিছে কথা আমি শুনতে চাই না। মাকে বলগে যা, যেতে বলেছে, নইলে চাকরি থাকবে না।
না থাকে না থাকবে! বছর এগারোর মেয়েটা একান্ন বছরের মুখের ওপর ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে, তা বলে তো আর মরে মরে কাজ করতে পারবে না? না পোষায়, আপনারা লোক দেখ।
খরখর করে চলে যায় সে, ছিটের ফ্রক দুলিয়ে।
অতনু সামনে, নচেৎ বোধকরি ডাক ছেড়েই কাঁদতেন জয়াবতী, একটু সামলালেন। কিন্তু কথা যা বললেন ডুকরে কেঁদে ওঠার মতই।
দেখলে অতনু দেখলে! কী সব আসপদ্দা হয়েছে! ওই আমার একটা রুগী মেয়ে কাল থেকে–খাওয়া না-দাওয়া সহসা জয়াবতীর আক্ষেপোক্তি চাপা পড়ে যায় একটা ডুকরে ওঠা কান্নার তীক্ষ্ণ তীব্র শব্দে।
টানা করুণ সুর। অমিতার গলা বলে চেনবার উপায় নেই।
সর্বনাশ করেছে! ছুটে এগিয়ে গেলেন জয়াবতী।
.
মুহূর্তে ঘরে ঘরে দরজা খুলে যায়। বিয়ের বর ফুলের আর সিঁদুরের দাগে কলঙ্কিত গেঞ্জিটা গায়ে দিয়েই ছুটে বেরিয়ে আসে, কনে ভয়ে ভয়ে দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়।
আবার সেই প্রশ্ন
কি হয়েছে মা, কি হয়েছে?
অমিতার চুল এলোমেলো, কাপড় এলোমেলো, চোখ রাঙা, চোখভর্তি জল। ভাঙা ভাঙা গলায় কাঁদছে সে, আমায় ফেলে সবাই চলে গেল। ডাক্তার আমায় ওষুধ দিল না!
সম্পূর্ণ উন্মত্ততা! সম্পূর্ণ উন্মাদিনীর চেহারা!
দেবে মা, ওষুধ দেবে।–জগন্ময় বলেন, আমি এই তোমার সেজকাকামণিকে পাঠাচ্ছি, ভাল ডাক্তার ডেকে আনতে। খুব ভাল ওষুধ দেবেন তিনি, ভাল হয়ে যাবে তুমি।
উন্মাদিনী ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায়, বাপের হাতটা চেপে ধরে শিথিলকণ্ঠে বলে, সেদিন যে ডাক্তার ওষুধ দিল! সব কষ্ট সেরে গেল। সে কবে চলে গেল বাবা?
কার কথা বলছ মা? অতনুর? এই তো, এই তো সে তোমার মার কাছে দাঁড়িয়ে, দেখতে পাচ্ছ না?
ওঃ আচ্ছা! বলে যেন পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ে অমিতা।
নিশ্চিন্তের নিঃশ্বাস ফেলে সবাই।
কিন্তু কতক্ষণের জন্যেই বা? ক্ষণপরেই ভুরু কুঁচকে ওঠে অমিতার, ঠোঁট কাঁপতে থাকে, নাকের ডগা ফুলে ফুলে ওঠে। পূর্ণ বিকারের লক্ষণ।
ব্যস আবার কান্না!
সক্কলে কেন আমায় জ্বালাতন করছে বাবা?
সেজকাকা এগিয়ে এসে ভরাট গলায় ধমকের সুরে বলেন, কই তোমাকে জ্বালাতন করছে?
ও মা গো, আমায় বকছে! চীৎকার আরও তীব্র হয়ে ওঠে, সব্বাই আমাকে ধরছে, আমার ঘর অন্ধকার করছে।
ভিড় ছাড়ো, ভিড় ছাড়ো সবাই। জগন্ময় বলেন, আর বিজয়, তুই একবার আমাদের ডাক্তারবাবুর কাছে গিয়ে অবস্থা বুঝিয়ে, কোন স্পেশালিস্টকে আনাবার ব্যবস্থা কর ভাই! আমার তো আর হাত পা উঠছে না।
আমার সেই ছেলেটা! পাগলিনী চেঁচিয়ে ওঠে, কোথায় গেল সে?
ছেলেটা! সবাই মুখ চাওয়াচায়ি করে।
ছেলেটা কে মা অমি?
সেই যে–খুব ভাল ছেলেটা! বিয়ে হল, টোপর পরল—
ও দীপুকে ডাকছ? আয় দীপু সরে আয়। এই তো, এই যে! তোমার ভাই, ছোট ভাই।
চোখভর্তি জলসুদ্ধু খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে অমিতা, হ্যাঁ হ্যাঁ, ভাই ভাই! আমি বড্ড ভুলে যাই, না বাবা?
দীপকের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে খানিকক্ষণ আবার চুপ করে থাকে অমিতা, তারপর আস্তে আস্তে বলে, একটা ডাক্তার এসেছিল সে কোথায় গেল রে? আমায় খুব ভাল ওষুধ দিলে, সব কষ্ট কমে গেল। ওকে বল না রে, তোমার পায়ে পড়ি, আর একটু সেই ওষুধ দাও।
জয়াবতী কাতরভাবে অতনুকে বলেন, তাই দেবে নাকি বাবা আর একটু?
অতনু মাথা নেড়ে বলে, পাগল হয়েছেন। ডাক্তার আসুক।
.
মহাশ্বেতা সেজমামীকে গিয়ে বলে, দেখেছ তো, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ওই অতনু! এ সব অন্য পাগল! বইতে পড়ি তত ঢের!
সেজমামী এক ঢিলে দুই পাখী মারার কায়দায় বলেন, আমরা অবিশ্যি বই পড়ি না ঢের, তবে কিছু বুঝি বইকি। আর আজই নতুন বুঝছি না, অনেক কাল থেকেই বুঝছি। সেই এতটুকু বেলা থেকে ওই অতনুদা অতনুদা! ভাবে দেখাত যেন কিছুই না, এমনি ভাই-বোনের মত, কিন্তু জগতের আর সবাই তো অন্ধ নয়! অতনু এসে দাঁড়াল তো-মেয়ের মুখে চোখে যেন ইলেকট্রিক লাইট জ্বলে উঠল! কোথায় না কোথায় আছে, যেই অতনুর গলার সাড়া পেল, সেইমাত্র যেন হঠাৎ না জেনে এসে পড়েছে এইভাবে এসে হাজির। সব সময় কিছু আর দৈবাৎ হয় না। তবু সত্যি কথা বলব, অতনু ছেলেটা চিরকালই সভ্য শান্ত। তা নইলে একটা লোক-জানাজানি কাণ্ড না হয়ে যেত না।
আর আমাদের বড়মামীটিকেও বলি–মহাশ্বেতা ঠোঁট উল্টে বলে, যেন ন্যাকা চণ্ডী! যেন দুনিয়ার হালচাল কিছুই জানেন না! বিধবা মেয়ে পাগল হয়ে পরপুরুষের নাম করছে তো তাকে সামনে ধরে দিতে হবে!
সেজমামী বলেন, এদিকে সংসারের বুদ্ধিতে তো কিছু কাঁচা দেখি না। সংসারে কে কাজটি করছে, আর কে আরামটি করছে, তার হিসেব কষতে তো নিক্তি হাতে নিয়ে বসে আছেন! এই আজই সকালে দেখলে তো?
দেখলাম বইকি! বলেই চুপ করে যায় মহাশ্বেতা। কারণ ছোট মামীকে আসতে দেখা যাচ্ছে।
ছোটমামী শত্রুপক্ষের কি মিত্রপক্ষের বোঝা শক্ত, তাই ছোটমামীকে একটু এড়িয়ে চলে মহাশ্বেতা।
কিন্তু মামারবাড়িতে মহাশ্বেতার শত্রুপক্ষ মিত্রপক্ষের প্রশ্ন কেন?
কেন, তার উত্তর অতীব প্রাঞ্জল। এ প্রশ্নের উত্তর বহুদিন আগে বিদ্যাসাগর দিয়ে গেছেন। বড়মামী জয়াবতীই চিরদিন ননদ ননদাই, ভাগ্নে ভাগ্নী, আত্মীয় কুটুম্বকে যথাযথ আদর আপ্যায়ন করে এসেছেন, তাই। মহাশ্বেতার যে ভাল ঘরে বিয়েটা হয়ে উঠেছিল, সেও বলতে গেলে বড় মামা মামীর সাহায্যে সহায়তায়। পাত্রপক্ষের চাহিদা অনুযায়ী খরচ করবার সামর্থ্য মহাশ্বেতার বাবার ছিল না। জগন্ময় দিয়েছিলেন পণের নগদ টাকাটা, আর জয়াবতী নিজের দুখানা ভারী গহনা।
এই পাওয়ার ভারটা মন থেকে ঝেড়ে ফেলা শক্ত। ঋণের জ্বালা বড় জ্বালা! আবার যে ঋণ শোধাও যায় না, ভোলাও যায় না, তার আগুন তুষের আগুনের মত! গুমে গুমে পোড়, আর ঋণদাতাকেই সেই ভস্মের কালি মাখাতে চায়।
মহাশ্বেতা জানে বড়মামী না থাকলে সেজমামী ছোটমামী তাকে কোনদিন ডেকে এক গেলাস জলও খাওয়াবে না, তাই যত কিছু খোসামোদ তাদের খাতেই ব্যয় করে।
বিজয়ের বৌ নন্দা এসে বলে, মহাশ্বেতা, তুমি আজ সকালেই নাকি চলে যাবে?
মহাশ্বেতা সনিশ্বাসে বলে, না গিয়ে তো উপায় নেই। ছেলের আজ থেকে পরীক্ষা শুরু। তবে এ বাড়ির যা অবস্থা দেখছি, ইচ্ছে হচ্ছে না যে যাই।
নন্দা অগ্রাহ্যভরে বলে, অবস্থা আর কী এমন? মানুষের অসুখ করে না?
করবে না কেন? মহাশ্বেতা করুণাঘন কণ্ঠে বলে, স্বাভাবিক অসুখ হলে কে আর এত ভাবত? এ যা হলো, তাতে বড়মামীর জীবন তো চিরদিনের মত মহানিশা হয়ে গেল।
নন্দা আর একবার তাচ্ছিল্যের ভঙ্গী করল, চিরদিনের মত আবার কি? হিস্টিরিয়া হয় না কারুর? দেখনি কখনো?
কি জানি ভাই ছোটমামী, তোমার বাপের বাড়ির মস্ত সংসার, বিরিঙ্গী গুষ্টি, তুমি অনেক দেখে থাকবে, আমরা তো কই এতখানি বয়সে এমনধারা হিস্টিরিয়া দেখি নি। আর এখনো সেই অতনু অতনু করছে তো?
নন্দা উদাসীন মুখে বলে, কি জানি ভাই অত দেখি নি। তবে অতনুকে ওখানে ঘুর ঘুর করতে দেখলাম বটে। হয়, হিস্টিরিয়াতে ওই রকম হঠাৎ একজনের ওপরই ঝোঁক হয়।
তা হবে। বলে মহাশ্বেতা সেজমামীকে মধ্যস্থ মানে, তোমার কি মনে হয় সেজমামী? লোকলজ্জাই যদি ঘুচে গেল, তবে আর পাগল হওয়ার বাকী রইল কি?
নন্দা গম্ভীর মুখে বলে, পাগল আর এ জগতে কে নয়?
কথাটা এমন একটি উচ্চাঙ্গের দার্শনিক ভাবাশ্রিত যে, ওর ওপর আর কথা চলে না। তবে প্রশ্ন একটা থেকে যায় যে, তাহলে ধরে নিতে হবে জগতের সবাই লোকলজ্জামুক্ত।
ওদের কথার মাঝখানে হি হি করে হাসতে হাসতে এসে দাঁড়ায় বাড়ির রাঁধুনী বামুন মেয়ে।
আজ তার নিত্য কাজের ছুটি। কারণ আজও যজ্ঞির দরুন বামুনদেরই একজনের বাঁধবার কথা। তাই ছুটির আনন্দে গড়াতে গড়াতে এসে বলে সে, দিদিমণির কাণ্ডখানা শুনেছ সেজমা?
কিগো, আবার কি? নতুন কি?
বিছানায় শুয়ে শুয়ে আঙুল নাড়ছে আর গান গাইছে।
গান গাইছে!
কথাটা এমনভাবে উচ্চারণ করলেন সেজগিন্নী যে মনে হওয়া স্বাভাবিক, অমিতার গান গাওয়ার মত অঘটন ইতিপূর্বে আর কখনো ঘটেনি। বামুন মেয়ে বাকী বক্তব্য শেষ করে, আমি যেই গিয়ে জানলায় উঁকি দিয়েছি, অমনি এই মারে তো এই মারে। বলে কি, কে? কে ওখানে? পুলিশে দেব তা জানো? আমার ঘরে যে আসবে তাকেই পুলিশে ধরিয়ে দেব। বলেই আবার গান।
মহাশ্বেতা সন্দিগ্ধভাবে বলে, কী গান গাইছে?
তা জানি না বাপু!
যাই তো শুনে আসি। বলে অঙ্গ তুলে উঠে পড়ে মহাশ্বেতা। সঙ্গে সঙ্গে তার সেজমামীও। সকৌতূহলে বলেন, আহা, পাগল ছাগল যা হয় হোক, তবু তো একটু গাইছে। গান তো ভুলেই গিয়েছিল। যাই তো শুনিগে একটু।
মূলকথা, কোন ধরনের গান এখন পাগলিনীর কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হচ্ছে সেটা অবশ্য শ্রোতব্য। ব্যাপারটা বিশেষ কৌতূহলের বইকি। কে বলতে পারে সেই গানের ভাষার মাধ্যমেই পাগলিনীর হৃদয়ের আরও কোনও জটিল রহস্য উদঘাটিত হয়ে পড়বে কিনা। দ্রুত একতলার ভাড়ার ঘর থেকে দোতলায় শোবার ঘরের দিকে ধাবিত হন তারা।
কিন্তু হায় হায়, অভিযান নিরর্থক।
অমিতা একা বিছানায় শুয়ে গাইছে কিনা–এবার কালী তোমায় খাবো!
আর গুনগুনিয়েও মোটেই নয়, রীতিমত উচ্চস্বরে। যদিও গলাটা ভেঙে গেছে, সুরটা এবড়ো খেবড়ো লাগছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, লাইন ভুলে যায় নি সে। মহোৎসাহেই গাইছে ও তোর ডাকিনী যোগিনী দুটো তরকারি বানিয়ে খাব, আর মুণ্ডমালা কেড়ে নিয়ে অম্বলে সম্বরা দেব!
চিরপরিচিত এই রামপ্রসাদী গানের থেকে পাগলিনীর হৃদয়রহস্যের কোন কিছু আবিষ্কার করতে সমর্থ না হয়ে মহাশ্বেতা এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে। না, আশেপাশে কেউ নেই। বোধকরি জয়াবতী তখনো ঝিকামাইয়ের ঝড় ঠেলে স্নান সেরে উঠতে পারেন নি, পুরুষরা এদিক ওদিক নানা কাজে ব্যাপৃত।
সাহসে ভর করে ঘরে ঢুকে পড়ে মহাশ্বেতা। সেজমামীকেও একটা চোখটেপা কৌতুকের ইশারা করে ঘরে ঢুকতে নির্দেশ দিয়ে এগিয়ে গিয়ে বলে, ও কী বিচ্ছিরি গান গাইছিস অমি? একটু ভাল গান গা না? আগে তো কত ভালবাসার গান-টান জানতিস!
হঠাৎ পাগলিনী বিছানায় উঠে বসে হি হি করে হেসে উঠে বলে, এই যে! পেয়ে গেছি। ডাকিনী যোগিনী দুটোকে পেয়ে গেছি! এইবার তরকারি বানাই
বলা বাহুল্য শেষ অবধি আর দাঁড়িয়ে শোনবার সাহস হয় না দুজনের কারুরই। তড়াক করে উঠে বসা দেখেই পালিয়ে প্রাণ বাঁচায়। তাদের পিছনে পাগলিনীর উচ্ছ্বসিত হাসি যেন তাড়া করে ছোটে।
একটু আগেই সেজমামী সেজকর্তাকে বলছিলেন তোমরা যাই বল বাবু, আমার তো মনে হচ্ছে সাজা পাগল। এবং আরও যা মনে হচ্ছিল সেটা বলতে পারেন নি সেজকর্তার বিরক্তিব্যঞ্জক ভ্রূকুটিতে। কিন্তু এখন পিছনের ওই ভাঙা গলার উচ্চহাসি যেন বুকটাকে হিম করে দিয়ে নিঃসংশয় করে দিল তাকে।
ওদের ছুটে নেমে আসা, আর হাসির ধ্বনি, আবার বাড়ির অনেককেই একে একে ওই ঘরের আনাচেকানাচে টেনে আনে। বিয়ে উপলক্ষে আসা দেশান্তরের আত্মীয়-আত্মীয়াও আছেন কেউ কেউ, আছে চাকরবাকর, বাড়ির ছোট ছেলেপুলে।
দুঃখে কাতর বিষাদে ম্লান হয়ে নয়, সকলেই একটা কৌতুক কৌতূহলের দৃষ্টি নিয়ে দেখতে থাকে, এই গতকালও এমন সময় যে মানুষটা সমস্ত সংসারটায় চরকির মত ঘুরে কাজ করে বেড়াচ্ছিল শান্ত হাসি মুখে, আজ সে কেমন অদ্ভুত ভঙ্গিতে আঙুল নাড়ছে, পা নাড়ছে, উঠছে বসছে, শুয়ে পড়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
পাগলের মত কৌতূহলোদ্দীপক আর কী আছে?
পাগলের পাগলামীর ভিতর থেকে মানুষ সত্যই যেন কোন্ অজানিত রহস্যলোকের বার্তা আবিষ্কার করতে চায়। তাই সমুদ্রে ডুবুরি নামিয়ে মুক্তা তোলার মত, অনর্থক কৌতূহলের প্রশ্নকে নামিয়ে নামিয়ে দেখে কোথায় গিয়ে ঠেকে। কোন প্রশ্নের হাতে উঠে আসে সেই রহস্যের মুক্তা।
কিন্তু সব নতুনই ক্রমশ নতুনত্ব হারায়, সব কৌতূহলেরই নিবৃত্তি আসে।
পাগলের চমকপ্রদ আচার আচরণে বেশিক্ষণ আর নতুনত্ব খুঁজে পায় না কেউ, যে যার আপন কাজে চলে যায়।
পৃথিবী বরং থেমে যেতে পারে, কিন্তু মানুষের দৈনন্দিন চাকা থেমে পড়বে না। তাই নিতান্ত প্রিয়জনবিয়োগেও শ্মশানের খাট আনার সময় ভাবতে বসে মানুষ কিছু খাদ্যবস্তু জোগাড় করে রেখে গেলে ভাল হত। নইলে এসে কি খাওয়া হবে?
অমিতা যদি কাল রাত্রে মারাই যেত, কজন আর নাওয়া খাওয়া বন্ধ করে পড়ে থাকত? যারা থাকত, তারাই বা কদিন থাকত?
আর এ তো শুধু অমিতার মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে!
.
ক্রমশ সবাই চলে যায় দৈনন্দিন কাজে।
কাছে বসে থাকে শুধু নতুন বৌ আর দীপক। কার জন্যে কে বসে আছে, সে ব্যাখ্যা না করাই উচিত। পৃথিবীর সব রং মুছে ফেলেই বা লাভ কি?
জয়াবতী বলে গেছেন আমি এক্ষুনি আসছি। কিন্তু অনেকক্ষণ হয়ে গেছে আসছেন না। দূরে কেষ্ট আর হরির সঙ্গে তার বচসার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।
এখন অমিত মুহুর্মুহু ঘুমোচ্ছে আর জাগছে।
মহাশ্বেতা দাঁড়িয়ে দেখে বলে, আমার পিস-শাশুড়ি ঠিক এমনি করেন, এই ঘুমোন, এই জাগেন। ইচ্ছে হচ্ছে বসে থাকি এখন, কিন্তু কি করব, যেতেই হবে আজ।
আবার হঠাৎ জেগে উঠল অমিতা। যেমন ধড়মড় করে ওঠে তেমনি উঠল ডাক্তার কোথা গেল? ডাক্তার? আমার কাছে একটু বসতে পারে না? এত কি কাজ তার? নতুন বৌ, ডাক্তারকে ডেকে আন না ভাই!
নতুন বৌ নতুন বরকে কি যেন ইশারা করে, তারপর সহসাই বলে ওঠে, ওই যে আসছেন।
সত্যিই ডাক্তার আসেন।
দুজন।
এ বাড়ির গৃহচিকিৎসক, ও আর একজন ভারী ভারী বয়স্ক ডাক্তার। মনোরোগের চিকিৎসক।
কাছে বসে শান্তগলায় বলেন, কই দেখি হাতটা।
আমাকে মারবে, আমাকে মারবে! বলে বালিশে মাথা ঘষটাতে থাকে অমিতা।
আবার ঘরে রথ দোলের ভিড়।
আবার এক ঝাপট নতুনত্ব পাওয়া যাচ্ছে।
কেউ তোমাকে মারবে না! মারবে কেন, তুমি এত লক্ষ্মী মেয়ে!
তুতিয়ে পাতিয়ে নাড়ি দেখেন ডাক্তার, দেখেন বুক পিঠ। আলো ফেলে ফেলে দেখেন চোখের মণি। তারপর এদিকে সরে এসে বলেন খুব একটা ভয়ের কিছু দেখছি না আমি, সাময়িক হিস্টিরিয়া বলেই মনে হচ্ছে। তবে কোন রকমেই যেন উত্তেজিত না হয়। যা চাইছে সাধ্যমত সেটা পূরণ করবেন। ওষুধ দিচ্ছি আমি।
কিছু তো চাইছে না ডাক্তারবাবু জগন্ময় কাঁদো কাঁদো গলায় বলেন, শুধু কাঁদছে!
কাঁদছেন তো আপনি ডাক্তার মৃদু হাসেন, রোগীর সামনে আদৌ উতলা হবেন না, আর, ঘরে ভিড় করবেন না। এক-আধজন যাকে ও পছন্দ করে, তেমন কেউ কাছে থাকুন। তিনি খাওয়ান, ওষুধ দিন।
কি খাবে? কষ্টে অশ্রু সংবরণ করেন জগন্ময়।
লিকুইড খাক না হয় আজ! খাওয়ায় বাধা কিছু নেই, যা খেতে চাইবে দেবেন। কথা হচ্ছে, কোন কিছুতেই বাধা দেবেন না, প্রতিবাদ করবেন না। কাকে কাছে পেতে চায়? মাকে? নাকি আপনাকে? আপনার যা অবস্থা দেখছি, আপনার না থাকাই ভাল, অবিচলিত থাকতে পারবেন না। সেরে যাবে, দুচার দিনের মধ্যেই সেরে যাবে। এক্টা খারাপ, এই যা একটু
দেখছেন তো ডাক্তারবাবু, এই বয়সে বিধবা
হ্যাঁ সে তো দেখছিই। তবে অনুরোধ করছি এ ধরনের কথা আদৌ ওর সামনে বলবেন না। কেমন থাকে খবর দেবেন। আর ওই যা বললাম, এত লোক নয়, ভিড় সরান। শুধু মা
শুধু মা! ডাক্তার বলে গেছেন শুধু মা!
কিন্তু কে চায় মাকে?
অমিতা যে কেঁদে বালিশ ভাসাচ্ছে, না না, ও আমার মা নয়, ও মহাদির মা!
জয়াবতীও কাঁদতে শুরু করেন, আমি তোর মা নই অমি?
না, তুমি মহাদির মা! খাব না আমি তোমার হাতে, খাব না!
কবে কার হাতে খাবে? আর না খেয়ে কি করে বাঁচবে কাল থেকে উপোসী মানুষটা?
নতুন বৌয়ের হাতে খাবে? দীপকের হাতে? কাকাদের হাতে?
না না না, আমি খাব না।
দুধ নয়, চা নয়, ওষুধ নয়, কিছু খাবে না অমিতা।
মহাশ্বেতা টেপা মুখে বলে, কাল থেকে তো দেখছি অতনুর ওপর ঝোঁক করছে, তাকেই নয় ডাকো।
জয়াবতী একবার ভাগ্নীর মুখের দিকে তাকিয়ে বিরস গলায় বলেন, সে পরের ছেলে, তার ওপর আর কত জুলুম করব? এতক্ষণ থেকে ডাক্তার আসা দেখে তবে বোধহয় বাছা নাইতে খেতে বাড়ি গেল।
আহা, খাওয়া তো এখানেও একমুঠো হতে পারত–মহাশ্বেতা স্নেহে গলে গিয়ে বলে-কাল তো কিছুই খায় নি। মাছ দই চারিদিকে তো তোমার থই থই! খেতে বললেই হত। না না, ওকেই ডেকে পাঠাই।
থাক মহা! বলেন জয়াবতী।
কিন্তু মহা থাকে না, সে ততক্ষণে কেষ্টাকে পাঠিয়ে দেয় ও বাড়ি।
পরের ছেলেকে নিয়ে আর জ্বালাতন কেন? জয়াবতী বলেন, ও তো আর আমার জন্যে কলকাতায় বসে থাকবে না, হয়তো আজই চলে যাবে।
আহা একবারও যদি একটু খাইয়ে দিতে পারে, প্রাণটা তবু রক্ষে হয় অমিতার। বিগলিত স্নেহে বলে মহাশ্বেতা।
.
তা বারেবারেই মহাশ্বেতার জয়।
তার অনুমানই ঠিক। পরের ছেলের হাতেই তখনকার মত প্রাণটা রক্ষা হল অমিতার। দুধ . একটু খেলো।
অতনু এসে প্রায় ধমক দেয়, কি হচ্ছে কি? না খেলে ডাক্তারবাবু এসে গলায় নল দিয়ে খাইয়ে দেবেন, তা জানো?
ও আমায় বকছে।বলে চোখ মুছতে থাকে অমিতা।
হ্যাঁ বকবে, সবাই তোমায় বকবে! অতনু বলে, না খেলেই বকবে।
তবে তুমি থাক! অভিমানে ভাঙা গলায় বলে অমিতা, তুমি বসে থাক, আমি খাব, ঘুমোব, চুপ করে থাকব।
আর কি, এখানে বসে থাকব! আমার আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই! অতনু বলে, সবাইয়ের কত কষ্ট হচ্ছে, মেসোমশাই কাল থেকে খাওয়া দাওয়া করেন নি, এ সব বুঝতে পারছ না?
আমি কি করব? আমার কি দোষ? আমায় কেন বকছ?
বলেছি তো সবাই বকবে। বলে অতনু সরে এসে বলে, শুনুন মাসীমা, বেশি আদর করে কথা বলবেন না, স্নেহ দেখালে আরও বেড়ে যাবে এই হচ্ছে এসব রোগের নিয়ম। ওর যেন কিছু হয়নি এই ভাব দেখাবেন।
জয়াবতী কেঁদে বলেন, আমরা তো দেখাব, ও যে এলোমেলো বকছে বাবা!
ঠিক হয়ে যাবে। ভাববেন না, ডাক্তারের সঙ্গে কথা হল। বললেন ভয়ের কারণ নেই।
তাই বল বাবা! মেয়ের দিকে তো চাইতে পারছি না আমি। কী মেয়ে কী হয়ে গেছে!
অধীর হবেন না, অধীর হবেন না।
ও কি, তুমি চলে যাচ্ছ বাবা?
যাই।
থাক না বাবা, দীপুর সঙ্গে বসে দুটো খাবে। কাল তো কিছুই খাওয়া হয় নি, সারারাত জাগা, কী কষ্টই পেলে?
অনেক বেশি কষ্ট আপনারা পাচ্ছেন মাসীমা! খাবার জন্যে কী? ওখানে বৌদি
বৌদিকে বোলো মাসীমা ছাড়লেন না। দেখছি, অমি তবু তোমাকে একটু ভয় করছে, অনেক দিন দেখে নি বলে হয়তো। আর একবার যদি ধমকে টমকে আর একটু খাইয়ে যেতে পারো!
অতনু কি যেন ভাবে।
ভয়ঙ্কর একটা দ্বিধার সঙ্গে যেন লড়াই করে, তারপর সহসাই নিতান্ত সহজ স্বরে বলে, ঠিক আছে থাকছি আমি। দেখি সারাদিন একটু ওয়াচ করে, ডাক্তারকে একটা রিপোর্ট দেবারও কথা রয়েছে। দীপু কোথায়?
কি জানি কোথায়! বলে জয়াবতী এই বেলা বারোটায় পূজোর ঘরে গিয়ে ঢোকেন।
দীপু কোথায়’ বলে খোঁজ করলেও দীপুকে কি অতনু খুঁজে বেড়াতে গেল?
না, কী দরকার অতনুর দীপুকে!
অতনু যদি এখন কাউকে খোঁজে তো সে নিজেকে। হ্যাঁ, ওই নীল রঙের পর্দা ফেলা ঘরটার দুর্নিবার আকর্ষণ এড়িয়ে অতনু এদিকের ঘরে এসে বসল নিজেকে খুঁজতে। পুরনো আমলের গেরস্থ বাড়ি, বাইরেটা কিছু বা গোছালো, ভিতরটা যেমন তেমন অগোছালো। একান্নবর্তী পরিবারের রীতি অনুসারে, কর্তাদের আয় উন্নতি যা হয় সেটা জানতে পারে গিন্নীদের বাপের বাড়ির দিক। বাড়ির লোক যদি কিছু টের পায়, সে হচ্ছে অপর পক্ষের ব্যক্তিগত বিলাসিতার বহর। সংসার নামক এজমালী জায়গাটা কিছুই জানতে পারে না। ভোগ করতে পায় না কারুর কোন আয় উন্নতির উপস্বত্ত্ব।
তাই এ বাড়ির কর্তাদের রোজগারপাতি যথেষ্ট হলেও, বাড়ির ভিতরে সেই পুরনো আমলের বিবর্ণ গৃহসজ্জা। লম্বা দালানে জায়গার অভাব নেই, কিন্তু বসবার মত গোছালো কোন ব্যবস্থা কোথাও চোখে পড়ে না। যত্র তত্র ছড়ানো ছিটানো না একটা টুল, একটা বেতছেঁড়া আরাম কেদারা, একটা তেপায়া চৌকী।
এখান থেকেই একটা টুল সংগ্রহ করে ও ঘরে জানলাটার কাছে টেনে নিয়ে বসল অতনু। বসল নিজেকে খুঁজতে।
অতনু কেন এখানে রইল? জয়াবতীর অনুরোধে? নিরুপায়তায়?
ওটুকু অনুবোধ এড়াবার ক্ষমতা তার ছিল না? নম্র দৃঢ়তায় যদি বুঝিয়ে দিতে পারত আজই তাকে চলে যেতে হবে, বাড়িতে না খেলে দাদা বৌদি মনঃক্ষুণ্ণ হবেন, সত্যিই কি আর বুঝতেন না জয়াবতী?
নিরুপায়তা নয়, লোভের হাতে আত্মসমর্পণ করে বসেছে অতনু। হ্যাঁ, যে লোভের আক্রমণে অনেক অনেক মাইল অতিক্রম করে ছুটে এসেছে তুচ্ছ একটা উপলক্ষকে আঁকড়ে ধরে।
আজও এই তুচ্ছ উপলক্ষটা আঁকড়ে এ বাড়িতে বসে রইল অতনু। এখানে বসে থাকবে, এদের সঙ্গে ঘরের ছেলের ভূমিকা নিয়ে সহজভাবে খাবে দাবে, হয়তো বা গা গড়িয়ে বিশ্রামও করবে, আর ওই এক বেপরোয়া পাগলিনী চীৎকার করে উঠলে তার কাছে গিয়ে তাকে বকবে, সান্ত্বনা দেবে, ওষুধ খাওয়াবার জন্যে খোসামোদ করবে। কী অদ্ভুত পরিস্থিতি!
আর এ পরিস্থিতিকে স্বেচ্ছায় বরণ করে নিয়েছে অতনু।
আচ্ছা, সহজ স্বাভাবিক ধারার বদলে এরকম একটা অদ্ভুত অস্বাভাবিক ঘূর্ণির মধ্যে পড়ে কি অতনু খুশি হয়েছে? কৃতার্থ হয়েছে? ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিচ্ছে?
এটা তো সত্যি, এহেন একটা এলোমেলো কাণ্ড না হলে হয়তো অমিতার সঙ্গে দেখাই হত না। হয়তো বা দূরে থেকে সকলের মাঝখান থেকে একবার দেখা হত, চোখাচোখি করবারও সাহস হত না। বিধবা অমিতাকে কে অনুমোদন করত পুরনো বন্ধুর সঙ্গে মেলামেশা করতে? কেউ করত না। দেশ এখনো এত উদার হয় নি।
হয়তো এই জগন্ময়ই অতনুকে বাইরের ঘর থেকে বিদায় দিতেন অন্দরের দরজা আড়াল করে দাঁড়িয়ে। হয়তো এই জয়াবতীই স্নেহে বিগলিতভাব বজায় রেখেও ঠায় বসে থেকে পাহারা দিতেন অতনুর চঞ্চল দৃষ্টিকে, আশাতুর হৃদয়কে।
আজ ওঁরা বিপদে পড়েছেন।
তাই জগন্ময় বলছেন, তুমি থাক বাবা। জয়াবতী বলছেন, তুমি যদি পারো একটু খাওয়াতে। সংসারের আরও সদস্যরা ওসব কিছু না বলুন, তেমন কিছু বলছেনও না।
আর অতনু পরমোল্লাসে এর সুযোগ নিচ্ছে।
নিজেকে খুঁজে খুঁজে এই আবিষ্কারই করে অতনু, এমন একটা অঘটনের মাঝখানে এসে পড়ে সে যতটা ব্যথিত হয়েছে, পুলকিত হয়েছে তার চেয়ে বেশি।
বিধাতার আশীর্বাদে ভিতরটা কেউ দেখতে পায় না এই রক্ষে।
তবু সকালে একবারের জন্যে বাড়ি গিয়েই বৌদির প্রবল জেরার মুখে পড়তে হয়েছিল।
ঢুকতে না ঢুকতেই বৌদি মহোৎসাহে এগিয়ে এলেন মুখ বিষণ্ণ করে।
ব্যাপার কি ঠাকুরপো? ওদের অমিতার নাকি হঠাৎ কী অদ্ভুত অনাসৃষ্টি অসুখ করেছে? ওমা, এই তো কাল সন্ধ্যাবেলা দিব্যি নেমন্তন্ন খেয়ে এলাম ওদের বাড়ি থেকে, দেখলাম অমিতা কনে সাজানোর কাছে বসে আছে। কখন কী হল?
অতনুকে উত্তর দিতে হয়েছিল। বলতে হয়েছিল, কখন কি হল তা আর আমি কি করে জানব? লোকজন চলে যাবার পর গোলমাল শুনলাম দীপু বলল দেখতে
তা হ্যাঁ ঠাকুরপো, মানুষ এমন বিনা নোটিশে হঠাৎ পাগল হয়? ডাক্তার মানুষ তোমরাই জানো!
রোগ অসুখ যে হঠাৎ কি ভাবে হয় বা হতে পারে, সে কথা ডাক্তারের পক্ষেও বলা শক্ত। আমি অন্তত বলতে পারি না।
বৌদি মুখ করুণ করে বললেন, আহা দেখ দিকি কাণ্ড! তুমি সেই দূর দূরান্তর থেকে এলে একটু আমোদ আহ্লাদ করতে, আর এই ব্যাপার! যতই হোক ছেলেবেলার বন্ধু! দেখে তো মনটায় কষ্ট হচ্ছে।
অতনু গম্ভীরভাবে উত্তর দিয়েছিল, দেখে কষ্ট সকলেরই হচ্ছে। ছেলেবেলাকার বন্ধু না হলেও।
সে তো বটেই। তবে কি না– বলেই বৌদি হঠাৎ করুণ মুখটাকে হাসিতে উদ্ভাসিত করে বলে উঠলেন, অবিশ্যি এই গোলমালে বাল্যসখীকে একটু দেখতে পেলে। তা নইলে
আপনার দৃষ্টিটা খুব সুদূরপ্রসারী সন্দেহ নেই।
তা ভাই সত্যি ভিন্ন মিথ্যে বলি নি। তবে এও বলব, আজই তোমার চলে যাওয়া উচিত হয় না। বৌদি উদগত হাসি চেপে বলেন, শুনছি নাকি কাল থেকে কেবল তোমাকেই আঁকড়াচ্ছে, তোমার কাছে ভিন্ন খাচ্ছে না, কাজেই আর দুদিন না দেখে
দেখতে তো যান নি একবারও, এত কথা শুনলেন কার মারফৎ?
শোনো কথা! পাড়ার লোকের ঘরের খবর আবার কেউ কাউকে শুনিয়ে যেতে হয় নাকি? সে খবর বাতাসে ভাসে, বুঝলে?
বুঝলাম! বলে স্নানের উদ্যোগ করতে যাচ্ছিল অতনু, ঠিক সেই সময় আবার মহাশ্বেতার প্রেরিত চাকর ছুটে ডাকতে গিয়েছিল।
অতনু বোধকরি সবলে সমস্ত সঙ্কোচ কাটিয়েই বলল, চল যাচ্ছি।
বৌদি বললেন, দেখলে তো?
কিন্তু শুধুই কি বৌদি? অতনু টের পাচ্ছে, আড়ালে আড়ালে সকলেই ওই কথা বলাবলি করছে–দেখলে তো? সত্যি এ আবার কেমন লোগ! মা নয়, বাপ ভাই নয়, একটা পরপুরুষের জন্যে আকুলতা অস্থিরতা!
কিন্তু কি করে টের পাচ্ছে অতনু? কেউ কি বলে গেছে ওকে? না বলে কে যায়? হয়তো বা অতনুর বৌদির কথাই ঠিক, বলতে কাউকে কিছু হয় না। যে কথা অনেকের মুখে আলোচিত হয়, সে কথার রেশ বাতাসে ভাসে।
অতনু কি তা হলে চলে যাবে? এই লোকলজ্জার হাত থেকে মুক্তি নিয়ে? আর সেই চলে
যাওয়ার হতাশাতেই উন্মাদিনী স্তিমিত হয়ে যাবে, শান্ত হয়ে যাবে।
কিন্তু চলে যাবার শক্তি অর্জন করবে অতনু কোন শক্তির জোরে?
আচ্ছা, অমিতার একি হল? এমন করছে কেন ও? অতনুর এই দীর্ঘদিনের অদর্শনের অবকাশে ও কি এইভাবে নিজেকে ধ্বংস করছে বসে বসে?
লোকে তো তা বলছে না।
সবাই তো বলছে এত লক্ষ্মী মেয়ের এ কেমন ধারা! এত শান্ত মেয়ের এ কী ব্যবহার! বলছে, এ সংসার মাথায় করে রেখেছিল অমিতা। বলছে, অমিতার বুদ্ধি বিবেচনার তুলনা হয় না, তুলনা হয় না ভব্যতা আর সংযমের। বিধবা হয়ে পর্যন্ত অমিতা নাকি চুলে কোনদিন গন্ধতেল দেয় নি, গায়ে মাখে নি সৌখিন সাবান। খাওয়া দাওয়ায় এত কৃচ্ছসাধন নাকি এ যুগের বিধবাদের মধ্যে দুর্লভ। আর সেই যে একদিন দামী আর সৌখিন শাড়িটা অঙ্গ থেকে বিসর্জন দিয়েছিল, তদবধি ওই ইঞ্চিপাড় হাফ শাড়ি ছাড়া দুইঞ্চি পাড় পুরো শাড়ি একখানা পরে নি কোনদিন।
এমন মেয়ে, এমন স্থিতধী আর আত্মস্থ মেয়ে, সে কি করে এমনতর কাণ্ড করছে! ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছে না অতনু। ভেবে পাচ্ছে না নিজের ভূমিকা কতটুকু বিস্তৃত করবে? বকবে? ধমকাবে? ডাক্তারের মত কঠিন হবে?
জানলা দিয়ে দুপুরের রোদের প্রচণ্ড হলকা আসছে, আসছে ধূলো, অতনুর খেয়াল নেই। হঠাৎ পিছন থেকে ডাক পড়ল, এই দেখসে বাবা, আবার এক কাণ্ড!
জয়াবতী ডাকছেন আর্তচীৎকারে।
কী?
কোন্ ফাঁকে উঠে গিয়ে এই দুর্দান্ত রোদ্দুরে ছাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
সে কী? ব্যস্ত হয়ে এগোয় অতনু।
আর সে কী! জয়াবতী কপালে করাঘাত করে বলেন, আমার এই কপালটা একবার তোমাদের ওই ডাক্তারী ছুরি দিয়ে চিরে দেখাতে পারো অতনু? দেখি তার ভেতর কী আছে?
পরে দেখবেন। এখন আসুন। বলে অতনু ছাতে ছোটে।
হ্যাঁ ছুটবে।
সে ডাক্তার, তার অধিকার আছে। তার কর্তব্য রোগীর ভাল মন্দ দেখা।
জয়াবতী ভারী শরীর নিয়ে সিঁড়ি ভাঙতে হাঁপান, আর হাঁপাতে হাঁপাতে বলেন, পূজো করে উঠে ঠাকুরের চরণামৃত একটু মাথায় বুলিয়ে দেবো বলে নিয়ে এসে ঘরে ঢুকে দেখি মেয়ে নেই। সর্বশরীর তো হিম হয়ে গেল আমার। চেঁচিয়ে কেঁদে উঠতে যাচ্ছিলাম, বলি সর্বনাশের চরম করে বুঝি বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছে। কী গুরুর রক্ষে, নতুন চাকরটা এসে বললে, দিদিমণি ছাতে উঠেছে। ছোঁড়া কালকের দরুন জগ বালতি সব নামাতে গিয়েছিল–
কিন্তু জয়াবতীর এত কথা শুনছে কে? তার অর্ধেক সিঁড়ি ওঠার আগেই তো অতনু ছাতের জমিতে।
প্রকাণ্ড ছাত, একেবারে তারও সীমান্তে দাঁড়িয়ে রুক্ষ এলোকেশী।
এই রোদে ছাতে এসেছ কেন?
দ্রুত পায়ে সামনে গিয়ে প্রবল সুরে প্রশ্ন করে অতনু, তোমার মা ভেবে অস্থির হচ্ছেন।
হঠাৎ স্রেফ পাগলিনীর হাসি হেসে ওঠে অমিতা, আমার মা আমার জন্যে ভেবে অস্থির হচ্ছেন? হি হি হি! খুব একটা মজার কথা শোনালে বটে ডাক্তার!
মার জন্যে তোমার কষ্ট হয় না? রূঢ় স্বরে প্রশ্ন করে অতনু।
কষ্ট? হি হি হি! মার জন্যে কষ্ট! তুমি তো বেশ দয়ালু!
এই সময় ধড়ফড় করতে করতে কোনমতে উঠে এসেছেন জয়াবতী। বলেন, এই রোদে ছাতে কেন মা অমি?
অমিতা এলোচুলের গোছা আঙুলে জড়াতে জড়াতে বলে, বোদ পোহাচ্ছি।
এই কি রোদ পোহানোর সময় মা? চল নীচে চল। দেখছ না অতনুদা তোমায় ডাকতে এসেছে! না গেলে বকবে।
আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে থাকেন জয়াবতী।
পাগলিনী অপরূপ এক ঠোঁটের ভঙ্গী করে বলে ওঠে, ইয়ে বিল্লি হিল্পী দিল্লী। বকবে! ও আমায় বকবে! ভারী সাহস ওর! যাব না আমি নীচে। দেখি তো কী করে!
অমিতা, পাগলামী কোর না। নীচে চল। এটা ছাতে বেড়াবার সময় নয়। নীচে না যাবে তো জোর করে নিয়ে যাওয়া হবে। অতনু বলে।
আহা সত্যি! হেসে গড়িয়ে পড়ে অমিতা, কর না একটু জোর! দেখি তুমি কেমন পালোয়ান।
অতনু কালা, অতনু নির্বিকার!
অতনু ডাক্তার। অতএব ধমক দিতে পারে অতনু। বলতে পারে, হচ্ছে কি? এ রকম যা ইচ্ছে করলে ডাক্তারবাবু এসে ইলেকট্রিক শক লাগিয়ে জব্দ করে দেবেন তা জানো?
অমিতা মুখ বাঁকিয়ে বলে, ডাক্তার হয়ে আবার ডাক্তারের ভয় দেখাচ্ছে। নিজের নেই কানাকড়া ক্ষমতা! আমি যাবো না। আমি রাস্তা দেখব–আলসের ধারে গিয়ে ঝোঁকে অমিতা।
হাঁ হাঁ করে ছুটে যান জয়াবতী, মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠে বলেন, অতনু, বুঝি কী সর্বনাশই করে!
আঃ। ঝটকা মেরে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় অমিতা।
অতনু জয়াবতীকে ইশারায় নিষেধ করে ব্যাকুলতা প্রকাশ করতে। নীচু গলায় বলে, ওসব কথা মাথায় ঢোকাবেন না। তারপর গলার স্বর উঁচু করে বলে, যাবে তো চলো, নইলে আমরা চলে যাচ্ছি। তুমি রোদে ঝলসাও বসে বসে।
সত্যিই ঝলসাচ্ছে অমিতা। রুক্ষ চুল বাতাসে উড়ছে, শুকনো মুখ রোদের দাহে তামাটে হয়ে উঠেছে, ঘাম ঝরছে কপাল বেয়ে। সেই ঝলসানো মুখে হঠাৎ কাঁদো কাঁদো গলায় কথা কয়ে ওঠে অমিতা, ঝলসাবোই তো। ঝলসে ঝলসেই তো মরব। আমায় তো কেউ ভালবাসে না? ছাতের আলসেয় ফের ঝেকে অমিতা।
জয়াবতী আবার দুহাত দিয়ে আগলে ধরতে যান, বাসে মা, সবাই ভালবাসে তোমায়। তুমি আমাদের চোখের মণি, বুকের হার, তোমায় ভালবাসবে না? এই দেখ এতখানি বেলা, এখনো জল মুখে দিই নি, তোর জন্যে ঘুরে মরছি।
মার হাতটা আবার ঠেলে দেয় অমিতা। কান্না ছেড়ে হাসে। মরছ কেন? যাও না, খাওগে। এদের বিয়ে বাড়িতে কত মিষ্টি কত খাবার! আহা তোমায় বুঝি দেয় নি কেউ?
অতনু গম্ভীরভাবে বলে, কে দেবে? কেউ দেখে ওঁর খাওয়া? তুমি এই রকম আহ্লাদ করে বেড়াবে, আর উনি উপোস করে বেড়াবেন? যাও না, দাও না গিয়ে ভাল করে খেতে। কাল থেকে খান নি।
ওমা! আহা-আহা মরে যাই, চল চল। সিঁড়ির দিকে দৌড় দেয় অমিতা।
ও অতনু, কী হবে? ও যে পড়ে যাবে! জয়াবতীও দৌড়ন। দৌড়তে দৌড়তে ডুকরে ওঠেন।
পড়বে না!
অতনু চাপা দৃঢ় স্বরে বলে, আপনি একটু কম অধীর হোন, ওসব মাথায় ঢুকিয়ে দেবেন না। চলুন, সত্যিই বসে পড়ে বলুন আপনাকে খেতে দিতে।
কী যে বল বাবা!
জয়াবতী বলেন, আর আমার সে কপাল হয়েছে! নইলে সেই মেয়ে এই হয়! পূজো করে উঠে এসে দাঁড়াতেই মুখের সামনে চায়ের গেলাস, জলখাবারের রেকাবী ধরে দিয়েছে। ভাত খেতে একটু বেলা হলে, কোথা থেকে জোগাড় করে এনে হাতে তুলে দিয়েছে ঘোলের শরবৎ, মিছরীর পানা। ও যেন মা, আর আমি মেয়ে হয়ে গিয়েছিলাম অতনু!
ততক্ষণে পাগলিনী তরতরিয়ে নেমে গেছে।
অতনু আর জয়াবতী আস্তে আস্তে নামছেন।
অতনু একবার জয়াবতীর মুখের দিকে তাকায়। বোধকরি বিরক্তি গোপন করা অসম্ভব হয়ে ওঠে, তাই গম্ভীর বিরক্ত কণ্ঠে বলে, বেশ করেছিলেন। এখন যান সেই ভাবেই খান গে। সহজ ব্যবহার করতে চেষ্টা করুন। অবিরত আক্ষেপ করবেন না ওর সামনে। দেখুনগে হয়তো খাবার গুছিয়ে বসে আছে ইতিমধ্যে।
.
আশ্চর্যের কথা, অতনুর কথাই সত্যি হয়ে দাঁড়ায়।
হয়তো অতনু ডাক্তার বলেই। ডাক্তার নইলে রোগীর মনস্তত্ত্ব কে বুঝবে?
নীচে নেমে এঘর ওঘর করে জয়াবতী দেখেন তার শোবার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে অমিতা, জয়াবতীকে দেখে হাতছানি দিল মিটিমিটি হেসে।
কাছে গিয়ে দেখেন কোথা থেকে না কোথা থেকে এক থালা মিষ্টি জোগাড় করে বসিয়ে রেখেছে ঘরের মাঝখানে, জলের কুঁজোটাই নামিয়ে রেখে দিয়েছে তার পাশে!
জয়াবতীকে দেখেই চোখ টিপে ব্যস্ত আর চুপিচুপি স্বরে বলে, খেয়ে ফেল খেয়ে ফেল, নইলে কেড়ে নেবে।
অমি, তুই আবার আমায় হাতে করে খেতে দিলি? জয়াবতী ঊ্যাক করে কেঁদে ফেলেন। চোখ মুছে বসে পড়ে বলেন, এত কি আমি খেতে পারি মা? আয় না, আমার সঙ্গে তুইও খা।
ওমা, কী বোকা! আমায় বলছে খেতে। ছুটে বেরিয়ে যায় পাগলী।
.
দেখলে? দেখলে ছোট বৌ?
সেজগিন্নী বলে ওঠেন, কাল থেকে তো মেয়ে স্বর্গ মর্ত্য এক করছে, এখন দেখলে? ভাড়ার উটকে টেনেহিঁচড়ে মিষ্টির কাড়ি নিয়ে কি রকম ছুট দিল? সে দিকে তো জ্ঞান টনটনে যে, মায়ের পূজো সারা হয়ে গেছে, জল খেতে দিতে হবে।
নন্দা গম্ভীর ভাবে বলে, ভালই তো, মাথার সাড় ফিরছে।
সে তো দেখতেই পাচ্ছি। সেজগিন্নী উঠে যান, তাড়াতাড়ি ঘরে গিয়ে সেজকর্তাকে বলেন, সেয়ানা পাগল বোঁচকা আগল!
সেজকর্তা গম্ভীর মুখে বলেন, কথাটা বড় পচা পুরনো।
যা খাঁটি তাই পুরনো! এই শুনলাম মেয়ে নাকি গলদঘর্ম হয়ে রোদ্দুরে ছাতে বেড়াচ্ছে, মা টেনে আনতে যাচ্ছেন। আবার এক্ষুনি মার জন্যে জলখাবারের থালা সাজাতে বসল।
কী করতে বসল? সেজকর্তা তীব্র প্রশ্ন করেন। ওই তো বললাম, খাবারের থালা সাজাতে। মস্ত একখানা থালা নিয়ে এত সন্দেশ, এত দরবেশ, এত পান্তুয়া, এত
তা ওটাও তো খেয়ালের ঝোঁক।
ওই আনন্দেই থাক। বলে সেজগিন্নী মুখ বাঁকান। আর পরক্ষণেই বলেন, আর তোমার ভাজের পায়েও কোটি কোটি প্রণাম। অতনু অতনু করে যা আদিখ্যেতা দেখাচ্ছেন?
যাক বড়গিন্নীর বরাত ভাল! যে দুর্লভ প্রণাম ভাগ্যে একটা জোটে না সেই প্রণাম কোটি কোটি।
এখন হাসছ পরে বুঝবে। বলে রোষভরে চলে যান সেজগিন্নী।
নীচের তলায় তখন বিজয় ব্যস্ত হয়ে গত কালকের ডেকরেটারের বিল মেটাচ্ছিল, কারণ বিয়ের উৎসব বাবদ কর্তৃত্বটা তারই অধিকারে এসেছিল।
পাওনাদাররা চলে যেতেই বিজয় স্ত্রীর কাছাকাছি এসে বলে, অতনু রয়েছে না?
হুঁ।
কোথায়? কোথায় রয়েছে?
কি জানি! ওপরের কোনও ঘরে। নন্দা স্বভাবসিদ্ধ তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বলে।
বিজয় বিরক্ত স্বরে বলে, কোনও ঘরে বলে গা ভাসিয়ে দিলে যে? নিশ্চয় ওই ঘরেই।
নন্দা অমায়িক মুখে বলে, সেটাই স্বাভাবিক, আর সেটাই উচিত।
উচিত।
নয় কেন, ডাক্তার বলে গেছে, ও যা চাইবে তা দিতে।
ডাক্তারের পক্ষে বোঝা সম্ভব ছিল না ওর চাহিদা কি, তাই বলেছে। বাস্তবিক এমন একটা বিশ্রী ব্যাপার হল?
ব্যাপারকে অবিরত ঢাকা দিয়ে দিয়ে সুশ্ৰী করে রাখতে গেলেই, একদিন সে বিশ্রী মূর্তিতে আত্মপ্রকাশ করে বসে। তোমাদের উচিত ছিল ওর আবার বিয়ে দেওয়া। আর ওই অতনুর সঙ্গেই দেওয়া। আশ্চর্য, কারুর যে কেন মাথায় আসে নি? হিস্ট্রিটা যখন সকলেরই জানা ছিল।
তোমারও ছিল!
আমি কি জন্যে বলতে যাব? আমি কে? সংসারে আমার কথা দাঁড়াচ্ছে কোথায়?
বিজয় গম্ভীরভাবে বলে, কথাকে দাঁড় করাতে হয়। সেটা নিজের ক্যাপাসিটি। তুমি এত বেশি–এই সেরেছে, আবার বড়দি আসছেন যে!
নন্দা ভুরু কুঁচকে বলে, বড়দি তো ছিলেনই। শুধু সকালে আশ্রমে গিয়েছিলেন, গুরুজয়ন্তী উৎসবে। আজই দিনটা পড়েছে বলে কত আক্ষেপ করে গেলেন।
তা না হয় গেলেন। কিন্তু গুরুজয়ন্তী কি?
কেন, গুরুর জন্মোৎসব! আসছে বছর সুবর্ণ জয়ন্তী হবে বলে এখন থেকেই তোড়জোড় চলছে।
বিজয় বলতে যাচ্ছিল, একটা মহারাজ টহারাজ বনে গেলে মন্দ হত না। কিন্তু বলা হল না, বড়দি এসে গেছেন।
বড়দি অর্থাৎ অমিতার বড়পিসিমা, মহাশ্বেতার মা। মহাশ্বেতার মতই করুণাময়ী।
কাছে এসেই করুণ কণ্ঠে বলেন, হ্যারে, মেয়েটার মাথাটা ঠাণ্ডা হয়েছে? নাওয়া খাওয়া করেছে?
কোথায়? বিজয় মাথা নাড়ে।
ওমা বলিস কি? তেমনিই চলছে? ডাক্তার আসে নি?
এসেছিল।
কি বলল?
বলল আর কি, বলল হিস্টিরিয়া।
বড়দি মাথা নেড়ে বলেন, কিন্তু আজকাল তো বাপু আর হিস্টিরিয়া হতে দেখি না! হ্যাঁ সে ছিল বটে আগে, ঘোমটা দেওয়া বৌ ঝি তোলপাড় কাণ্ড করত, লোকলজ্জার মাথায় লাঠি বসাতে। কিন্তু একালে–।
হ্যাঁ একালে মেয়েদের ঘোমটা উড়ে যাওয়া, আর ঘরের খাঁচা ভেঙে বাইরে বেরোনোর প্রথা প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে হিস্টিরিয়াটা দেশ থেকে বিদায় হয়েছে বটে, নন্দা খুব অমায়িক গলায় বলে, তবু সব জিনিসের মতই কোথাও না কোথাও একটু জের তো থাকবেই।
বড়দি বিস্ময় দৃষ্টি মেলে বলেন, ঘোমটার সঙ্গে, রাস্তায় বেরোনোর সঙ্গে রোগ-অসুখের কী হোটবৌ?
ওর কথা ছেড়ে দাও বড়দি, বলে বিজয় বড়দির অলক্ষ্যে বৌকে একটি শাসনদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বড়দির সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে যায়।
.
বড়দি অবশ্য হুড়মুড়িয়ে একেবারে কালকের সেই ঘরেই ঢোকেন, দেখেন অমিতা খাটের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে আঙুলে আঁচল জড়াচ্ছে।
বড়দির পরনে চওড়া লালপাড় গরদ শাড়ি, কপালে মস্ত সিঁদুরটিপ, সিঁথেয় চওড়া করে সিঁদুর ঢালা।
তিনি অমি, কেমন আছিস মা? বলে ঘরে ঢুকতেই অমিতা তাড়াতাড়ি উঠে এসে বলে, ওমা, কাদের কনেবৌটি গো? বাঃ, খাসা মুখখানি তো!
বড়পিসিমা সভয়ে পিছু হঠে বলেন, ও কী কথা অমি? সত্যিই কি তুই বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেলি?
অমিতা আরও কাছে এসে হেসে উঠে বলে, ও কনে, তোমার হাতে সুতো কই? কাজললতা কই?
বড়পিসিমা চেঁচিয়ে উঠে বলেন, ও বড়বৌ, মেয়ে এসব কি বলে গো? একেবারে বেহেড পাগল হয়ে গেল?
ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ায় অমিতার সবছোট ভাইটা, দাঁড়ায় সেজগিন্নীর মস্ত বড় মেয়েটা।
সে বিরক্তি মাখানো মুখে চাপা গলায় বলে, আপনাদের এই সব কাণ্ডর কোনও মানে . পাওয়া যায় না পিসিমা! মেজদির সামনে এসব কথা বলার দরকার কি?
পিসিমা অবাক বিস্ময়ে বলেন, ওমা, তুই যে আমায় অবাক করলি সবিতা, সামনে পিছনে আবার কি? মন্দ কথা কিছু বলেছি?
না খুব ভাল কথা! চলুন ও ঘরে গিয়ে বসি গে।
তুই থাম। বলে বড় পিসিমা আবার এগিয়ে যান, কিছু খেয়েছিস রে অমি?
হ্যাঁ! অমিতা অনেকখানি ঘাড় হেলিয়ে বলে, কত কী! হাতী ঘোড়া, সাপ ব্যাং মাছ—
ছি ছি, ও কথা বলতে নেই মা! চুপ করো চুপ করো।
সবিতা আবার বলে ওঠে, পিসিমা! চলুন না ও ঘরে।
এ তো আচ্ছা জ্বালা করল! পিসিমা বলেন, মেয়েটাকে দেখব বলে আমি গুরুভগ্নীদের অনুবোধ এড়িয়ে ছুটে এলাম!
সবিতা বিব্রতভাবে বলে, তা আপনি ভাতটাত খাবেন তো?
শোন কথা, আশ্রম থেকে আমি পেসাদ না খেয়ে এসেছি? দুবেলা পেসাদের নেমন্তন্ন। …অমি মা, আমার সঙ্গে যাবি আশ্রমে? সন্ধ্যেআরতি দেখিয়ে আনব।
হঠাৎ অমিতা সবাইকে চমকে দিয়ে চীৎকার করে উঠল, ওরে বাবা রে, আমাকে ধরে নিয়ে গিয়ে বলি দিতে চাইছে! তারপর সুরু হল কান্না।
আবার অমিতা গলা ভাঙল, চোখ ফুলিয়ে ঢোল করল। তাকে নাকি বেঁধে নিয়ে হাঁড়িকাঠে চড়ানো হচ্ছে।
ডাক্তারকে আর একবার কল দেওয়া হোক। বললেন সেজকর্তা, এভাবে তো বাড়তে দেওয়া যায় না।
জগন্ময় বসে পড়ে বললেন, যা পারো তোমরা কর ভাই!
জয়াবতী সারাদিনের পর অবেলায় একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, এই করুণ আর্তনাদে ধড়মড়িয়ে উঠে ছুটে এলেন। হাঁপিয়ে কেঁদে বলে উঠলেন, উপোস করে শরীরের ভেতরটা তোর জ্বলে খাক হয়ে গেল অমু, একটু কিছু খা, শরীর ঠাণ্ডা হবে।
অমিতা কেঁদে উঠে বলল, এই হাঁড়িকাঠটা থেকে আমায় একটু বার করে দাও না গো! · এক্ষুনি আমায় কেটে শেষ করে দেবে।
দীপুকে ডেকে আনবো অমি? তোমার সেই ছোট ভাইটি? টোপর পরলো বিয়ে হল।
না না, ও ভাল ছেলে লক্ষ্মী ছেলে, ও এখন শুধু সিনেমা দেখবে।
তবে নতুন বৌকে ডাকি?
না না! অমিতা ভাঙা গলায় বলে, ও আসবে না, ও শুধু নেমন্তন্ন খাবে। আমি মরে যাব, আমাকে কেটে ফেলবে।
তা পাগলে তো অর্থহীন অসংলগ্ন কথাই কয়।
জয়াবতীও বোধকরি মেয়ের সঙ্গে সঙ্গে পাগল হয়ে গেছেন, লোকলজ্জা ভুলেছেন, নইলে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে বলে বসেন, অতনুকে ডাকব অমু?
সঙ্গে সঙ্গে অনুচ্চারিত একটা ছিছিক্কারে ঘরের বাতাস ধাক্কা খেয়ে ওঠে। বিজয় জয়াবতীর দিকে একটা জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। কিন্তু সবাইকে অবাক করে আশ্বস্ত করে অমিতা চেঁচিয়ে ওঠে, ওকে কেন? ও পরের বাড়ির ছেলে। তোমার লজ্জা করে না?
.
ও পাশের ঘরে পরের বাড়ির ছেলে আর ঘরের ছেলেটা দুজনে বসে ছিল মুখোমুখি। অতনুর হাতে একটা জ্বলন্ত সিগারেট শুধু হাওয়ায় পুড়ে পুড়ে ক্ষয় হচ্ছে।
এতক্ষণে সেটাকে ঠুকে ছাই ঝেড়ে অতনু বলে, আমাদের দেশের মহিলাদের কবে যে সত্যিকার বুদ্ধিসুদ্ধি হবে! পৃথিবীতে কত আশ্চর্য এলো, কিন্তু সপ্তম আশ্চর্য দেখার বাসনার আর এঁদের নিবৃত্তি হল না। ক্রমাগত ওঘরে উঁকি দেবার দরকারটা কী, তাই বল দিকি? ওর চিকিৎসাই হচ্ছে একা চুপচাপ শান্তিতে থাকতে দেওয়া, তা নয় সবাই যেন জু-গার্ডেনের জু দেখতে এসেছে। কৌতূহলের শেষ নেই, উঁকিমারার শেষ নেই। বোঝে না এতে আরও ক্ষেপে যাবে।
আপনি গিয়ে বারণ করে আসুন না।
আমি?
দীপক বীরত্বব্যঞ্জক স্বরে বলে, কেন নয়? আপনি ডাক্তার, আপনার রাইট আছে রোগীর সম্পর্কে ব্যবস্থা দেবার।
ওরে বাবা! অতনু বিষণ্ণতার উপর সূক্ষ্ম একটু হাসির চাদর বিছিয়ে দেয়। বলে, রাইট নিয়ে তেড়ে গিয়ে অন্ধ তমসাচ্ছন্ন চিত্তে লাইট জ্বালাতে গেলে ভীষণ ফাইট হয়ে যাবে।
অতনুর কথার ধরনই এই।
একমাত্র বাড়িতে বৌদি বাদে সমান সমান সকলের সঙ্গেই সে পরিহাসে সরস করে কথা বলে।
দীপক ম্লান মুখে বলে, এখন মনে হচ্ছে, এই গরমে এই সব বিয়ে ফিয়ের ব্যাপার না। বাধালেই হত। গরমে বেশি খেটেখুটেই তো এইটি হল!
অতনু বলে, থামো বিবেকী পুরুষ! আর আত্মঅপরাধের ভারে পীড়িত হতে হবে না।
আর মনে মনে বলে, সে পীড়ন যে ভোগ করবার সে করছে। বলে, আমিই মূল, আমিই কারণ!
কিন্তু ওদিকে কান্নার সুর ক্রমেই করুণতর হচ্ছে।
নাঃ বিপদ করলে!
উঠল অতনু, বলল, চল দেখি।
এ ঘরের দরজায় তখনো সপ্তমাশ্চর্য দর্শনার্থীর ভিড়।
অতনুকে পৃষ্ঠবল করে দীপক বলে, এই দেখ, আবার সবাই এখানে গোলমাল করছ? অতনুদা বলছেন, ডাক্তার বলে গেছে চুপচাপ থাকতে দিতে।
অতনু উপস্থিত সকলকে অবাক করে দিয়ে বেশ উচ্চবরোলে বলে ওঠে, আমি কিছু বলিনি রে বাবা! শুধু বলছিলাম অতদূর থেকে ছুটে এলাম তোর বিয়ের নেমন্তন্ন খেতে, তা সে তো ডকে উঠল, তোর গায়িকা বৌয়ের দুখানা গানটানও যে শুনব, হিংসুটি অমিতা তার আদায় রাখল না।…মিছিমিছি কেঁদে বাড়ি মাথায় করছ কেন বল তো অমিতা? তার থেকে সুস্থির হয়ে বসে নতুন বৌয়ের গান শোন না।
অতনুর এই চড়াগলায় বুঝি কাজ হয়, পাগলীর কান্না থামে। সে ভাঙাগলায় বলে, আমায় কি কেউ গান শোনায়? আমায় শুধু ভয় দেখায়, বলে মন্দিরে নিয়ে গিয়ে বলি দেবে।
অতনু গম্ভীর ভাবে বলে, সেটা অনেক দিন সারা হয়ে গেছে। এক জন্তু দুবার বলি হয় না।…যা দিকি দীপু, তোর বৌকে–এই যে মাসীমা, আপনার বৌমাকে একবার ডাকুন দিকি, একটা গান শোনা যাক।
জয়াবতী শঙ্কিত দৃষ্টিতে নীচু গলায় বলেন, এ ঘরে?
হ্যাঁ, এ ঘরেই তো। অতনুর কণ্ঠস্বর প্রবল। গান শুনলে মন ভাল হয়।
কৃতাৰ্থমন্য দীপক ছোটে বৌয়ের বাজনাটা এনে হাজির করতে। আর ভাবতে ভাবতে যায়, চিরদিন শুনে এসেছি নারী মমতাময়ী, নারী করুণাময়ী, কি বাজে কথাই শুনে এসেছি! দয়া মায়ার কিছু যদি ওদের মধ্যে থাকে! মায়া মমতা করুণা সহানুভূতি যেটুকু যা আছে পৃথিবীতে, ওই পুরুষ মানুষের মনের মধ্যেই আছে।
এই গানের প্রস্তাব কোন মহিমময়ীর রসনা থেকে উচ্চারিত হত?
নতুন বৌ কুণ্ঠিত মুখে এসে দাঁড়ায়।
অতনু উদাত্ত স্বরে বলে, এই যে গায়িকা এসো এসো, বাড়ির আবহাওয়াটা একটু ভাল কর দিকি।
হ্যাঁ, যত পারে সপ্রতিভ হবে সে, তাছাড়া আর উপায় নেই।
বৌ গায়, এ পথ গেছে কোনখানে গো কোনখানে তা কে জানে!
এমন কিছু ওস্তাদ নয়, তবু গলাটি মিষ্টি, ধরনটি নরম, সত্যিই যেন বাড়ির উৎকট আবহাওয়াটার উপর একটা স্নিগ্ধ স্পর্শ বুলিয়ে যায়।…গানের পর গান চলে। পাকা গাইয়ে নয় যে, একটার বেশি দুটোর অনুরোধ এলেই গলাভাঙার অজুহাত দেখাবে। দেখা যায় ডাক্তার অতনুর বুদ্ধিতে কাজ হয়েছে, অমিতা শান্ত মুখে বসে আছে হারমোনিয়ামের কাছে।
কেউ বসে থাকে, কেউ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শোনে, কেউ একটু দাঁড়িয়ে চলে যায়। গান শুনে তো আর পেট ভরবে না কারুর।
জগতের আদিমতম সত্য পেট, শাশ্বত সত্য ক্ষুধা। এরা কোনদিন কখনো বিভোর হয়ে যেতে দেবে না মানুষকে।
শিল্পে নয়, সঙ্গীতে নয়, সাহিত্যে নয়, ঈশ্বরোপলব্ধির অনির্বচনীয়তায় নয়, মহৎ জীবনের আহ্বানে নয়, রোগে শোকে দুঃখে হতাশায় নয়। কোন কিছুতেই বিভোর হয়ে থাকা চলবে না। অদৃশ্য এক রজু মনের পিছু থেকে টানতে থাকবে–খাওয়া দাওয়া হয়নি, খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে তো?
খাবার দেরি হয়ে যাবে, খাওয়ার সময় উৎরে গেছে, না হলে আর একটু বসতাম।
.
চলে গেল প্রায় সবাই।
চলে গেলেন বড়পিসিমা আশ্রমে, গুরু জয়ন্তীর সন্ধ্যেআরতি দেখতে। জয়াবতী উঠে গেলেন গতকালের মিষ্টি কোথাও জমা হয়ে পড়ে আছে কি না দেখতে! যে গরম, আজ বাদ কালই তো ফেলা! তাছাড়া কোন ফাঁকে কোথায় পাচার হয়ে যাবে।
আপাতত মেয়ে আগলানোর থেকে মিষ্টি আগলানো বেশি জরুরী মনে হল জয়াবতীর।
আর তাকিয়ে দেখলেন এই গানের মূছনার মধ্যে কখন শুয়ে পড়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে সে। কটা গান শুনেছিল? কখন ঘুমিয়ে পড়ল? অত গভীর ঘুম এখুনি কি ভাঙবে?
.
কিন্তু ভাঙল।
যখন গান সেরে বৌ মিষ্টি হেসে উঠে গেল। আর দীপক উঠে গেল বাজনাটা রেখে আসার ছুতোয়। ওর নববিবাহিতারপশ্চাদ্ধাবনের ভঙ্গী দেখে অতনু একটু হাসল। নতুন বর কনে আর প্রেমিকা প্রেমিকা কত গল্পই না বানায়, কত ছুতোই না আবিষ্কার করে!
কিন্তু শুধুই কি নতুনেরা?
৩. ঘরে কেউ নেই
ঘরে কেউ নেই।
শুধু শিথিল শয়ানে রাজকন্যা ঘুমে অচেতন। ঘরে কেউ ঢাক পেটালেও এ ঘুম ভাঙবে এমন আশঙ্কা নেই। তবু ঘরের মাঝখানে মিনিট দুই চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল অতনু। তারপর গলা ঝেড়ে যেন দেয়ালকে শুনিয়ে শুনিয়ে নিষ্কম্প গলায় বলল, ভোরের প্লেনে চলে যাচ্ছি। গিয়ে যেন শুনি না একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।
বলা বাহুল্য এটুকুতে নিদ্রিতার নিদ্রাভঙ্গ হয় না।
অতনু আবার বলে, এবার বাড়ি যাচ্ছি, ভোরবেলা বেরুব। আর দেখা করে যাওয়া সম্ভব হবে না। এই শেষ। হয়তো চিরদিনের মতই।
হঠাৎ বুঝি পাগলিনীর গভীর ঘুমের পর্দাটা ছিঁড়ে যায়, আর সদ্য জাগরণের চেতনা এক করুণ অভিব্যক্তির মধ্যে পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। মৃদু গুঞ্জরণে কাঁদতে থাকে সে বালিশে মুখ গুঁজে।
অতনু একটু কাছে সরে গিয়ে বলে, এই দেখতে হবে জানলে কে আসত?
কান্নার বেগ আরও বাড়ল, ফুঁপিয়ে উঠল পাগলিনী, আমাকে শুধু বকল! ভালবাসল না আদর করল না।
অমিতা, তুমি এমন করছ কেন? ভারী গম্ভীর শোনায় অতনুর গলা। কিন্তু অমিতা এই সহজের সম্বোধনে সাড়া দেবে কি করে? অমিতার বুদ্ধির গোড়ায় যে শনি আশ্রয় করেছে। বিকৃত করে দিয়েছে সে বুদ্ধিকে। তাই সে বালিশে মুখ গুঁজে চাপা বিকৃত স্বরে বলে, চলে যাবে কেন? যারা এসেছে তারা চলে যাবে কেন? তারা থাকবে।
না, কেউ থাকবে না। তুমি সহজ না হলে, ঠিক না হলে, কেউ থাকবে না।
ওরে বাবারে, আমার অসুখ করেছে তবু আমার মনে কষ্ট দিচ্ছে। অমিতার ছড়ানো চুলগুলো বালিশে ঘষটে ঘষটে চামরের মত হয়ে ওঠে।
অমিতা, তুমি ইচ্ছে করলেই ভাল হয়ে যেতে পারো। অসুখ সারিয়ে ফেলতে পারো।
না না না! ইচ্ছে করব না।
বেশ কোর না। আমি তাহলে যাচ্ছি।
যাবে না, যাবে না। হঠাৎ উঠে বসে অমিতা, তুমি থাকবে, একশো দিন পঞ্চাশ দিন থাকবে।
থাকতে পারি। অতনু কয়েক মুহূর্ত সেই পূর্ণ উন্মাদিনী মূর্তির দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলে, একশো দিন নয়, আর একদিন থাকতে পারি, যদি দেখে যেতে পাই তুমি সভ্য হয়েছ শান্ত হয়েছ।
কে জানে কি উত্তর দিত সেই আরক্ত নয়ন, উড়ন্ত-চুল, উপবাসে শীর্ণ মেয়েটা! বাধা পড়ল। সেজগিন্নী কখন যেন দরজার বাইরে এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন, ঠিক এই সময় ঘরে ঢুকে বলেন, অতনু, দিদি বলছেন তুমি বাড়ি যাবার আগে তোমার রুগীকে কিছু খাইয়ে যাও।
অতনু তার দিকেও একবার পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। তারপর ঈষৎ অবহেলাভরে বলে, আপনারাই ভুলিয়ে ভালিয়ে খাওয়ান। আমার কথা শুনছে কে? তাছাড়া আমার আর দেরি করার সময় নেই। গোছগাছ আছে। সারাদিনটা তো এলোমেলো করে কেটে গেল।
তবু যাই তুমি আজ ছিলে, তাই যদি বঠাকুর একটু নিশ্চিন্ত ছিলেন। তুমি চলে যাবে, এই মেয়ে নিয়ে যে কী হবে! ভারী দুশ্চিন্তা প্রকাশ করেন সেজগিন্নী।
আমি আর কী করতে পারলাম!
ওঁর মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে অতনু বলে, তবু সন্ধ্যেবেলা এ ঘরে গানটান গাইয়ে কিছুটা সহজ করবার চেষ্টা করছিলাম।
সেই তো!
সেজগিন্নী অমায়িক মুখে বলেন, তুমি যতটা বুঝবে, ততটা কি আর আমরা বুঝব? যাক তাহলে দুধ একটু আনি?
অতনু সম্পূর্ণ অগ্রাহ্যভরে বলে, আনুন, খাওয়ান, যা পারেন করুন। আমার নিজের ওপর কোন আস্থা নেই। দেখছেন না, খাওয়ার নামেই দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে শুলো। বলে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে অতনু।
পথে বেরবার মুখে জগন্ময় হতাশভাবে বলেন, চলে যাচ্ছ বাবা?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
কোন উন্নতি দেখলে না?
মনে তো হচ্ছে। অতনু ইচ্ছে করেই একটু আশ্বাস দেয়, হয়ে যাবে, দুএকদিনের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে। ডাক্তারকে আর জানানো হয়েছিল?
বিকেলে চেম্বারে ফোন করেছিলাম। উনিই ওই কথাই বললেন। ঠিক হয়ে যাবে। বললেন সাময়িক। আর বললেন–।
জগন্ময় একটু ইতস্তত করলেন, তারপর বললেন, ডাক্তারের ধারণা অল্প বয়সে এমন অবস্থা হলে, মেয়েরা একটু বেশি অভিমানী হয়ে যায়। হয়তো হঠাৎ কারও কোনও কথায় আহত হয়েছে, শক খেয়েছে। কিন্তু ওকে তো বাবা কেউ কিছু বলি না। সবাই সব সময় ভাল কথা বলি।
সেটাও সব ক্ষেত্রে ঠিক নয়। অতনু বলে, তাতে মনে হয় সবাই আমায় করুণা করছে। একেবারে স্বাভাবিক ব্যবহার করবেন। ভালর সময় ভাল, বকার সময় বকা
ও কি আমার বকবার মত মেয়ে অতনু? জগন্ময় মেয়েমানুষের মত কেঁদে ফেলে কোঁচার খুঁটে চোখ মোছেন।
মানুষটাকে মমতা করে অতনু। কিন্তু মৌখিক সান্ত্বনা আর জোগায় না, তাই বিষণ্ণ ভাবে বলে, আচ্ছা তবে আসি।
কালই তো চলে যাচ্ছ? গলা ঝেড়ে বলেন জগন্ময়।
না, কাল আর যাওয়া হল কই? প্লেনের ব্যবস্থা করতে পারলাম না।
ধীরে ধীরে চলে যায় অতনু।
সরল মানুষের সঙ্গে মিথ্যা কথা বলতে বিবেকে বড় পীড়া দেয়। সেই কথাই ভাবতে ভাবতে যায়।
.
সবাই ভাবছে। যে যার নিজের রুচি প্রকৃতি ধারণা অনুযায়ী ভাবছে।
অমিতার এই অসুখটা যেন গোলকধাঁধার ঘুরন্তপথে ছেড়ে দিয়েছে সবাইকে।
কিন্তু অমিতা নিজে?
অমিতা কি ভাবতে পারছে? ভাববার ক্ষমতা কি আছে অমিতার?
তা মস্তিষ্ক তো কখনও চিন্তাশূন্য হয় না। সে যদি বিকৃত হয়ে যায় তো, বিকৃত চিন্তাই করে। সেই বিকৃত চিন্তার পথেই ঘুরপাক খেতে থাকে তার অসামাজিক বাসনা।
ওকে আমি যেতে দেবো না। যা ইচ্ছে করে যাওয়া বন্ধ করব। ও থাকুক, আমার কাছাকাছি থাকুক। ওকে না দেখে কী করে ছিলাম আমি? ওকে না দেখে কী করে থাকব!
.
ঘরে ঘরে পাখা আছে, তবু জগন্ময় মাদুর হাতে করে ছাতে উঠলেন। বাড়ির অনেককে শুনিয়ে শুনিয়ে বললেন, উঃ কী অসম্ভব গুমোট! ঘরে তো টেকা যাচ্ছে না। ছাতটা আজ ধোওয়া হয়েছিল না?
হ্যাঁ, ছাতটা আজ ধোওয়া হয়েছে বইকি। আলাদা বকশিশ কবুল করে নতুন চাকরকে দিয়ে ধুইয়েছেন জয়াবতী।
দেখি ছাতেই যাই, যদি একটু ঘুম আসে। বলে চলে গেলেন জগন্ময় গলাটা একবার ঝেড়ে।
কিন্তু সত্যিই কি আর ঘুম আসার জন্যে এত ঘটা করে ছাতে ওঠা?
জগন্ময়ের বয়েস পঞ্চাশ ছাড়িয়েছে, জগন্ময়ের একটা মেয়ে মারা গেছে, একটা মেয়ে শুধু বিধবা হয়েও রেহাই দেয় নি, আবার পাগল হয়ে উঠে বাপ-মার মাথায় বাজ হেনেছে, জগন্ময়ের ছেলে বিয়ে করে প্রেমের পাঠ সুরু করেছে, এ সবই সত্যি, তবু তিরিশ বছরের অভ্যাসটাও বড় বেশি সত্যি।
তিনি চৌকিতে শুয়ে নাক ডাকান, এবং জয়াবতী মেঝের বিছানায় শুয়ে শুয়ে সংসারের অপর সদস্যদের মধুর সমালোচনা স্বামীর কর্ণকুহরে ঢালবার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে বিরক্ত চিত্তে মশা চাপড়ান আর ছারপোকা মারুন তাতে কিছু এসে যায় না তার। চিরঅভ্যস্ত উপস্থিতিটুকুই নেশার মত। তার অভাব ঘটলে কিছুতেই যেন কেমন স্বাচ্ছন্দ্য আসে না।
অমিতার বৈধব্যের পর প্রথম প্রথম কিছুদিন জয়াবতী আপন শয়নমন্দির ছেড়ে ওপাশের ঘরে শয্যা বিছিয়েছিলেন, মেয়ের সঙ্গে। কিন্তু কিছুদিন পরেই সে ব্যবস্থা বাতিল হয়েছিল। অমিতাই বাতিল করে দিয়েছিল।
বলেছিল, তুমিও নাক ডাকায় বাবার থেকে কম যাও না, আমার ঘুম হয় না। নিজের জায়গায় যাও বাপু, তোমার ঢোলের বাজনা ঢাকের বাদ্যির নীচে ঢাকা পড়বে।
আশ্চর্য, নাক ডাকার মত অসহ্যতম অপবাদেও জয়াবতী রেগে ওঠেন নি, প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠেন নি। শুধু অপ্রতিভ মুখে বলেছিলেন, শোনো কথা মেয়ের! আমার বলে সারারাত ঘুমই আসে না!
ও বাবা, না আসতেই এই! এলে কী হত! আমার তো ওতেই ঘুম ঘোচে। আমি একাই বেশ শোব।
তাই রেখে কখনো আমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারি? বলেছিলেন জয়াবতী প্রত্যাশার শ্বাস চেপে।
বেশ তো, সবিতা শোবে আমার ঘরে।
রক্ষে কর! সেজগিন্নীর মেয়ে! সে ব্যবস্থা করলে সেজগিন্নী এখন কত অস্বস্তি করবে কে জানে। তোর সারারাত পাখার হাওয়া খাওয়া অভ্যেস, ওর ছেলেমেয়েদের ঠাণ্ডালাগার ধাত।
ঠিক আছে, খোকন শোবে।
খোকন অমিতার নিজের ভাই, জয়াবতীর সম্পত্তি, তার ওপর জোর চলে। অতএব সেই ব্যবস্থাই বহাল হল। এতদিন তাই চলে আসছিল। কিন্তু আবার যে অমিতা বিরাট এক সমস্যা হয়ে উঠেছে! আর তো অন্য কোন ব্যবস্থাই শোভন নয়। এখন থেকে যেটেরা পূজোর রাতের ঘর আগলানোর মত জেগে বসে আগলাতে হবে অমিতার ঘর। আর সে কাজ কে করবে, মা ছাড়া?
রাত্রে শুতে এসে সেই কথাটাই মনে পড়ল জগন্ময়ের। বুকের ভিতরটা খালি খালি ঠেকল। ঘরের মধ্যে প্রাণ হাঁপিয়ে এল। দেয়ালের কোণ থেকে দাঁড় করানো মাদুরটাকে টেনে উঠলেন ছাতে। আর বেশ শোরগোল করেই উঠলেন। বোধকরি অপ্রতিভতাটাকে ঢাকতে। কেউ কিছু মনে করত না, তবু জগন্ময়ের মনে হল সবাই বুঝি অনেক কিছু মনে করবে।
জয়াবতী মেয়ের ঘরের বড় আলোটা নিভিয়ে মৃদুনীল আলোটা জ্বালালেন, মেঝেয় নিজের বিছানাটা পাতলেন, পাখাটা রেগুলেটারের শেষ অঙ্কে ঠেলে দিলেন, কিন্তু সমস্ত দিনের কর্মক্লান্ত দেহটাকে ঝুপ করে ফেলে দিলেন না, মিনিট দুই ঘুরিয়ে নিয়েই বেড়ালেন এ জানলা থেকে ও জানলায়। তারপর সহসাই ঘুমের ওষুধ খেয়ে নিথর ঘুমিয়ে থাকা মেয়েটাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললেন, ছাতে বোধহয় ছিষ্টির কাপড় মেলে দেওয়া আছে। হরি কি আর তুলেছে! যা বাবু হয়েছে আজকাল! যাই দেখি গে, রাতে যদি আবার বৃষ্টি আসে! আমারই হয়েছে যত জ্বালা!
আস্তে আস্তে বাইরে থেকে দরজাটা টেনে ভেজিয়ে দিয়ে নিঃশব্দে উঠে গেলেন সিঁড়ি বেয়ে। মোটা মানুষ! তবে দিনের বেলায় রোদের সময় সিঁড়ি উঠতে যতটা হাঁপ ধরে, রাতে ততটা নয়।
.
ঘুমোলে নাকি? মাদুরের এক প্রান্তে বসে পড়ে এই অহেতুক প্রশ্নটি করলেন জয়াবতী।
কৃতাৰ্থমন্য জগন্ময় ব্যস্তে পা গুটিয়ে নিয়ে উঠে বসলেন। চুপি চুপি বললেন, কাকে রেখে এলে?
রাখব আর কাকে? জয়াবতী আঁচল তুলে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, ঘুমের ওষুধ খেয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছ। মনে হল সন্ধ্যেবেলা বুঝি ছাতের কাপড় তোলা হয়নি। রাতে যদি বৃষ্টি ঢালে! তা দেখছি হরিবাবু তুলেছেন দয়া করে।
না, এ বয়সে সত্যি কথাকে স্বীকার করা যায় না। পরস্পরের কাছেও নয়। বলা যায় না তোমার জন্যেই এলাম। তোমার কথা ভেবেই এলাম।
অতএব সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি।
কেউ কিছু বলবে না তো?
প্রায় তিরিশ বছর আগের শঙ্কিত বুক নিয়েই বললেন জগন্ময়।
বলবে আবার কি! জয়াবতী শঙ্কাকে অস্বীকার করার ভঙ্গিতে বলেন, মার চেয়ে দরদী, তারে বলে ডান! এই যে হল, এ কার গেল?
জগন্ময় করুণস্বরে বললেন, গেল বলছ কেন? ডাক্তার তো বলেছে–ও কিছু না, দুচার দিনের মধ্যে সেরে যাবে।
লোকের হলে সারতো। আমার ভাগ্যেনয়। কপালখানি তো দেখছি! কী যে করব আমি ওই মেয়ে নিয়ে! একে তো শত্ৰুপুরীর মধ্যে বাস!
শত্ৰুপুরী আবার কি?
একটু অসন্তোষ প্রকাশ করলেন জগন্ময়।
তুমি আর কী জানবে? পুরুষমানুষ বাইরে বাইরে থাক। কাল অতনুকে একটু ডেকেছিলাম, তাতেই আজ সংসারে কত কথা! তোমার বড়দি তো আমাকে মিঠে মিঠে করে একশো কথা শোনালেন।
তুমি একথা বলতে পারলে না, অতনু ডাক্তার! রোগ বিপদের সময় লোকে ডাক্তারের বয়েস দেখবে?
বলতে কি আর ছেড়েছি? বলেছি সবই। তবু সেজগিন্নীতে আর ওঁতে চোখ ঠারাঠারি হয়ে গেল। আর ওই বামুন মেয়েটিও কম নয়। ওটিও একটি দেইজি।
বিদেয় করে দিও। বলে কর্তার কর্ম সমাপন করেন জগন্ময়।
জয়াবতী অসন্তুষ্ট স্বরে বলেন, তোমার আর কি, বলে খালাস। ম্যাও সামলায় কে?
আহা তা বলে মাইনে করা লোক।
মাইনে করা লোকের দৌরাত্ম্যি তো চব্বিশ ঘণ্টাই সইতে হচ্ছে। আমার মুখ চাইতে মেয়েটা ছিল, তাও ভগবান মারলেন। তা হ্যাঁ গো, ডাক্তার ঠিক কি বললেন বল দিকি? ওই জিজ্ঞেস করতেই আরও তোমার কাছে আসা। কোনখানে তো একদণ্ড নিরিবিলি নেই।
আবেগের মুখে ছাতের কাপড়ের অজুহাতটা সম্পূর্ণ বিস্মৃত হন জয়াবতী।
জগন্ময় অবশ্য মনে পড়িয়ে দিয়ে লজ্জায় ফেলেন না। শুধু বলেন, ওই তো তখন বললাম। বলেছেন সেরে যাবে।
সেরে যাবে বললেই সব হল? কবে সারবে তা কিছু বলবে তো?
তা কি আর সঠিক বলা যায়?
তবে আর কিসের ডাক্তার? বলছিলাম মহারাজজীকে একবার জানানো হোক।
জগন্ময় নীরস স্বরে বলেন, ওঁকে আর জানিয়ে কী হবে? এখন ওঁর অনেক বড় বড় শিষ্য হয়েছে, হাইকোর্টের জজ পায়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে, যত সব আগরওয়ালা ঝুনঝুনওয়ালারা সোনার খড়ম, রূপোর সিংহাসন গড়িয়ে দিচ্ছে, আমাদের মতন চুনোখুঁটিদের কথায় কি আর মন দেবার অবকাশ আছে?
কথাটা জয়াবতীরও মনের কথা। তবে কি না জগন্ময়ের মত স্পষ্ট ভাষায় প্রকাশ করতে সাহস হয় না তার। ইতস্তত করে বলেন, বড়দি একটা কবচের কথা বলছিলেন, আমার কিন্তু বাপু সাহস হয় না।
কেন, এতে আর সাহসের কী আছে?
কি জানি কার মনে কি আছে, হিতে বিপরীত হবে কিনা! অমির বিয়েতে বড়দিই তো ওঁদের জ্যোতিষী দিয়ে কুষ্ঠি মিলিয়ে দিয়েছিলেন! বলেছিলেন রাজঘোটক হয়েছে।
সত্যটা নির্ভেজাল।
জগন্ময় গভীর নিঃশ্বাসের সঙ্গে বলেন, সবই আমাদের ভাগ্য!
তা ছাড়া আর কি! এখন ভাবছি তখন যদি অতনুর সঙ্গেই দিতাম!
আর ও কথায় কাজ কি?
কাজ না থাকলেও সে কথা লোকে বলে। পশ্চাত্তাপ করাই মানুষের রীতি। তাই জয়াবতী বলেন, মেয়ের মন তো আমি বুঝতাম। বলিনি তোমাদের কাছে, কিন্তু সাতপাঁচ ভেবেছিলাম অনেকবার, কিন্তু ওই যে কেমন মনে হল নেহাৎ পাড়াপড়শীর মধ্যে, আজন্ম দেখাশোনা, লোকে বলবে লভের বিয়ে, তাতেই মন সায় দিল না। তাছাড়া তখন আর কে ভেবেছে বিদেশে চলে যাবে, অমন চাকরি পাবে! এখানে তো ওই, না চাল না চুলো। গভীর একটা নিঃশ্বাস ফেলেন জয়াবতী।
জগন্ময়ও সে নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাস মেশান। বলেন, তুমি না বলল, ধরতে কি আর আমিই পারতাম না? তবে ওই যা বললে, একেবারে ঘরের ছেলের মত! আর ওর চেয়ে দশগুণ ভাল পাত্র পেয়েও গেলাম। আমাদের দুর্ভাগ্যে ওরকম হয়ে গেল তাই। নইলে বীরেশ্বর বেঁচে থাকলে কি আর আজ অতনুকে পুঁছতে অমি?
কি জানি! মেয়েমানুষের মন জয়াবতী নিজেও যে মেয়েমানুষ-জাতীয়া সে কথা বিস্মৃত হয়ে বলেন, স্বর্গ ছেড়ে পাতাল চায়। তা সেও তো রইল না। সেই তখনই যদি কথাও তো হয়েছিল– বিয়ে কথাটা আর উচ্চারণ করেন না জয়াবতী, ওটা এড়িয়েই বলেন, তখন হয়তো অতনুকে বললে রাজী হয়ে যেত!
তা হত! জগন্ময় সায় দেন, ইয়ংম্যান ওরা তো আর প্রেজুডিসের ধার ধারে না। তা ছাড়া মেয়েটাকে স্নেহও করত।
তা হ্যাঁগা এইবার আসল কথা পাড়েন জয়াবতী, এখন আর হয় না?
এখন? জগন্ময় ক্ষুব্ধ হাস্যে বলেন, তুমিও কি মেয়ের সঙ্গে পাগল হলে? এখন ওকথা বলব কোন্ মুখে? ও এখন একটা অত বড় অফিসার, কত ভাল ভাল পাত্রীর বাবা ছুটে আসবে, এখন আমি বলব, তুমি আমার পাগল ছাগল বিধবা মেয়েটাকে বিয়ে কর!
যুক্তিটা অকাট্য। জয়াবতী চুপ করে যান।
হ্যাঁ, এই ভাবেই মানুষ অপরের মনের হিসেবনিকেশ করে নিজস্ব সিদ্ধান্তে পৌঁছয়। তাছাড়া
আর করবেই বা কি! নিজের বুদ্ধির পরিধি ছাড়িয়ে কে কবে ভাবতে পারে?
তবু জয়াবতী একটু চুপ করে থেকে বলেন, তা সেই অবধি তো বিয়েও করল না।
করল না ওর দাদা বৌদির চেষ্টা নেই বলে। আর বাংলা দেশের বাইরে অনেকদূর চলে গেছে!
আরও খানিক ইতস্তত করে জয়াবতী বলেন, আমি ভাবছিলাম চুপি চুপি একবার বলে দেখব।
ক্ষেপেছ! অমন কাজও কোর না। জগন্ময় হাঁ হাঁ করে ওঠেন, কী ভাববে তোমায়? তাছাড়া কালই তো চলে যাচ্ছে।
যাচ্ছে বলেই তো! জয়াবতী বলেন, যাওয়াটা আটকাতাম।
না না, ওসব করতে যেও না। কার কান থেকে কার কানে যাবে। লোকে হাসবে। শুধু একটা কেলেঙ্কারী! অতনুর যদি তেমন ইয়ে হত, নিজেও তো সে প্রস্তাব করতে পারত? অমি বিধবা হবার খবর পেয়ে একটা চিঠিও তো দেয় নি। ও বাড়ি থেকে খবর কি আর পায় নি?
এ যুক্তিটাও অকাট্য।
জয়াবতী নিঃশ্বাস ফেলে বলেন, মনকে মানিয়ে নিয়ে ঘরসংসারে মন ঢেলে শান্ত হয়ে ছিল সে এক! এখন ওই ভয়ঙ্করকে অহরহ কী করে চোখের ওপর সইব? আর কি করেই বা সামলে বেড়াব?
ভাগ্য! যাও শুয়ে পড়গে। আবার জেগে উঠে কিছু করে বসবে।
আমি গলায় দড়ি দিয়ে মরবো, তুমি ভুগো মেয়ে নিয়ে। বলে কাদো কাঁদো হয়ে উঠে দাঁড়ান জয়াবতী।
জগন্ময় অনুনয়ের ভঙ্গিতে একটা হাত বাড়িয়ে হাত ধরে বসান। বলেন, অবুঝ হয়ে আর কি করবে? দেখ ডাক্তার তো বলছে ভাল হয়ে যাবে।
আমার কপালে আর হচ্ছে!
মন খারাপ কোর না। একটু বরং এখানে হাওয়ায় গড়িয়ে নিয়ে যাও।
নাঃ! বলে একরকম অভিমানভরেই ধপ ধপ্ করতে করতে নেমে যান জয়াবতী। দোষ ভাগ্যের, জগন্ময়ের উপর অভিমানের কারণ থাকার কথা নয়। কিন্তু বাঙালীর মেয়ে স্বামীকে ভাগ্য ভগবান সব কিছুর প্রতীক ভাবতেই অভ্যস্ত। তাই নিঃসঙ্কোচে দায় দোষ সবই সেই বেচারার ঘাড়ে চাপিয়ে নিশ্চিন্ত হয়।
কিন্তু আজ যদি জয়াবতী সেই তাঁর ভগবানের প্রতাঁকের কাছে পরামর্শ নিতে না আসতেন! যদি নিজের বুদ্ধিতে চুপিচুপি অতনুর কাছে বলতেন, বাবা অতনু, অমিতা তোমার ছেলেবেলার খেলার সঙ্গী, তোমার স্নেহের পাত্রী
তা হলে কি এ কাহিনীর ইতিহাস আলাদা হত না? কিন্তু জয়াবতী জগন্ময়ের পরামর্শ নিলেন–বুদ্ধি বিবেচনার পরিধি যাঁর বারো বছরের ছেলেটার থেকে খুব বেশি নয়।
.
কয়েকখানা বাড়ি পরেই আর একটা ছাতে শতরঞ্চ বিছিয়ে চুপচাপ আকাশের দিকে তাকিয়ে জেগে পড়ে ছিল এ কাহিনীর নায়ক। এঁদের আলোচনার ছন্দাংশও তার কানে গেল না।
বাতাসের তরঙ্গে তরঙ্গে নাকি জগতের সব শব্দই অক্ষয় হয়ে থাকে, কোথাও হারায় না। শুধু উপযুক্ত যত্ন থাকলেই ধরে ফেলা যায় সে শব্দকে। কোথাও কোনখানে যদি বসানো থাকত সে যন্ত্র! তাহলে কি পরদিন–
হ্যাঁ, পরদিনের কথাই ভাবছিল অতনু।
চলে যেতে হবে।
চলে যাওয়া ছাড়া উপায় কি? থেকেই বা কি করবে?
স্নেহ দিয়ে সেবা দিয়ে ভালবাসা দিয়ে ওকে কি সুস্থ করে তুলতে পারবে অতনু? সে অধিকার কি আছে ওর?
না, অধিকার না থাকলে কোন মহৎ কর্মও করা যায় না।
.
গত রাত্রে ফুলশয্যা তো না হওয়াই। আজ তবু ওরই মধ্যে একটু সকাল সকাল বরকনে ঘর পেয়েছে। আজ সবিতা তার প্রায় সমবয়সী দাদাকে একটু ঠাট্টাও করে গেছে। আর আজ বহিরাগতরা অনেকেই চলে গেছেন বলে বাড়িটাও কিঞ্চিৎ হালকা লাগছে।
তবু প্রথম মিলনোচ্ছ্বাসটা কেটে গেলে, কথায় কথায় সেই ভারী প্রসঙ্গটাই এসে পড়ে। যে ভয়ঙ্কর ভারে কাল থেকে বাড়িখানা হাঁপিয়ে উঠেছে।
গানের সময় ছোড়দি কিন্তু খুব শান্ত হয়েছিল তাই না?
রমলা দুষ্টুমী করে বলে, তা ছিলেন, কিন্তু ছোড়দির ভাই ভ্যাবাগঙ্গার মত যা হাঁ করে গান শুনছিল, দেখে হাসি চাপা দায় হচ্ছিল।
তার মানে? আমি ভ্যাবাগঙ্গার মত বসেছিলাম?
তবে না তো কি? ক্যামেরা থাকলে ফটো তুলে রাখা যেত।
কিন্তু সত্যি, ছোড়দির ওপর তোমার গান খুব প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিল। কী চুপ করেই
তোমার ধারণা গানের প্রভাবে? রমলা বলে।
তবে?
সাধে বলি গবেট! প্রভাবের উৎস আলাদা, বুঝলে?
না না, তুমি যা ভাবছ, মোটেই তা নয়।
নয় মানে? মেয়েদের চোখ কখনো ভুল করে না, বুঝলে? তোমার অতনুদা এবং ছোড়দির মধ্যে রীতিমত একটি গভীর ভালবাসা ছিল।
ছিল সামথিং, তবে গভীর টভীর কিছু নয়।
নয়, তোমায় বলেছিলেন?
আহা বলবার কি আছে? এই তো বিয়ের আগে যখন অতনুদার নামে নেমন্তন্ন চিঠি পাঠানো হল, ছোড়দি ছিল তো কাছেই, কোন চাঞ্চল্য দেখি নি। তা ছাড়া কাল যখন অতনুদার আসার খবর দিলাম, গ্রাহ্যই করল না ছোড়দি।
সাধে বলি জান না! গভীর সমুদ্রই ওপরে শান্ত, বুঝলে? কিন্তু তরঙ্গ যখন ওঠে, তখন জাহাজ ডোবায়, পাহাড় ভাসায়।
এই বয়সে এত কথা শিখলে কি করে?
মেয়েদের আবার কথা শেখবার জন্যে বয়েস বাড়বার দরকার হয় নাকি?
উঃ বাড়িসুদ্ধ লোক এই বৌকে বলছে, কী শান্ত, কী ঠাণ্ডা, কী ভালমানুষ!
শান্ত ঠাণ্ডা বলে বুদ্ধি থাকবে না?
কিন্তু বুদ্ধির জোরে যতটা ভাবছ, ঠিক তা নয়। ডাক্তার তো বলে গেল, এ রকম ক্ষেত্রে হঠাৎ এক একজনের ওপর ঝোঁক হয়।
যা শুনতে ভাল, ডাক্তাররা তাই বলে।
বাঃ তুমি একদিন দেখেই যে অনেক কিছু আবিষ্কার করছ? আমি দেখছি না চিরকাল?
চিরকাল মানে তো তোমার বারো বছর বয়েস অবধি? বললে না, অতনুদা যখন চলে গেছলেন তখন তোমার বয়েস মাত্র তেরো?
তেরো নয় মোটেই, চৌদ্দ।
রমলা হেসে ওঠে, উঃ একেবারে আকাশ পাতাল তফাৎ। একটা চৌদ্দ বছরের ছেলে! মানে হাফপ্যান্ট পরা খোকা। তার ওপর আবার তোমার মত গবেট। তোমার চোখে ধুলো দিয়ে কত রহস্য পার হয়ে যেত, সে এখন আমি দিব্যচক্ষে দেখতে পাচ্ছি।
তা পাবে বইকি। চক্ষু দুটি দিব্য কিনা! অতনুদা তো এসে বেশির ভাগই বাইরের ঘরে বাবার সঙ্গে কি কাকাদের সঙ্গে কথা বলে চলে যেতেন।
হু, তার মানে বাবার সঙ্গে বা কাকাদের সঙ্গে কথা বলবার জন্যে ওঁর প্রাণ অস্থির হয়ে উঠত, তাই ছুটে আসতেন কি বল?
বাঃ তার কি মনে আছে? বরাবর এসেছেন ছেলেবেলা থেকে
ও যুক্তি অচল! এ বাড়ি ওঁকে দুর্নিবার আকর্ষণে টানতো, বুঝেছ?
ক্রমশ সবই বুঝছি। মানে যে ভাবে বোঝাতে সুরু করেছ তুমি! তবে হ্যাঁ, আমি তো একেবারে অস্বীকার করছি না। হাঁদাই হই আর খোকাই হই, একেবারেই যে কিছু বুঝতাম না তা নয়। তবে কিনা তোমার ওই গভীর টভীর? কই? হয়তো অতনুদা চলে যাবার সময় ছোড়দিকে দেখতে পেল, বলে উঠল ইস, তুমি যে রীতিমত একটি মহিলা হয়ে উঠেছ। আর দেখাই পাওয়া যায় না।
রমলা উঠে বসে বলে, আর উত্তরটা?
না না, অমন ধড়ফড়িয়ে উঠে বসবার মত কিছু নয়। ও রকম কথায় ছোড়দি হয়তো বলতো, বাঃ বাড়িতেই তো থাকি। যখন কলেজে যাই তখন আসো তা হলে?
এই? শুধু এই?
তবে আবার কি।
আর তোমাকে দিয়ে কখনো কিছু বলে পাঠাতেন না?
আমাকে দিয়ে? আমাকে দিয়ে কেন?
তোমার মত হাঁদা মার্কাদের দিয়েই ওই রকম কাজ করানো যায় কিনা!
দীপক একটু চুপ করে থেকে বলে, আমাকে দিয়ে? নাঃ তা কোনদিন নয়। যদি বললে, তবে একদিনের কথা মনে আছে। যেদিন আমারও একটু খটকা লেগেছিল।
শুনি শুনি। দেখি তোমার বুদ্ধির বহর।
এমন কিছুই না। তবু–মানে আর কি, সেদিন বিকেলে পার্কে যাচ্ছি খেলতে, দেখি অতনুদা ওই মোড়ের বাস স্টপেজের কাছে দাঁড়িয়ে। বললাম, কি অতনুদা, কলেজ থেকে ফিরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন যে? বাড়ি যাবেন না?
অতনুদা ব্যস্ত হয়ে বললেন, না রে, ভীষণ একটা কাজ ভুলে গেছি তাই।
আমি তো হেসেই উঠেছি।
কাজ ভুলে গেছেন তো বাস স্টপেজে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? রাস্তায় কি কাজ?
অতনুদা খুব চঞ্চল হয়ে উঠে বললেন, না রে, মানে খুব দরকারি একটা নোট কলেজে ফেলে এসেছি, আবার যেতে হবে।
ওঁর কলেজ মানে তো মেডিক্যাল কলেজ! আমি হায় হায় করে বলে উঠলাম, আহা ইস! আবার অতটা যেতে হবে আপনাকে? তা অতনুদা সে কথার উত্তর না দিয়ে বলল, তুই কোথায় যাচ্ছিলি?
বললাম খেলতে।
অতনুদা হঠাৎ ভয়ানক ব্যস্ত হয়ে বললেন, তবে যা, বিকেলবেলাই হচ্ছে আসল খেলবার সময়, এ সময়টা নষ্ট করতে নেই। এই যে আমার গাড়ি এসে গেছে, বলেই একটা বাসে উঠে বসলেন, যে বাসটা সম্পূর্ণ উল্টোমুখো। ওই বাসে কলেজ! আমি তো অবাক।
কি জানি হঠাৎ আমার কেমন সন্দেহ হল, ওই দরকারি নোট ফোট সব বানানো কথা! অন্য কোন ব্যাপার। তাই পার্কের দিকে যেতে যেতেও আমি ফিরে ফিরে তাকাতে লাগলাম। আর দেখলাম ঠিক যা ভেবেছি! আমি সরে আসতেই সবে ছাড়া চলন্ত বাস থেকে নেমে পড়লেন অতনুদা।
তবে কি ভুলে ভুল বাসে উঠে পড়েছিলেন? ভাবলাম দাঁড়িয়ে। ওই যে মোড়ের কাছে স্টেশনারি দোকানটা আছে, যেখান থেকে আমি ঘুড়ি আর মার্বেল কিনতাম, সেই দোকানটার মধ্যে ঢুকে দাঁড়ালাম। আর দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই দেখি ছোড়দি নামল ছোড়দির বাস থেকে। আর যেন আলো জ্বলে উঠল ছোড়দির মুখে।
হাঁ করে দাঁড়িয়ে দেখলাম, কোথায় বা অতনুদার দরকারি নোট, কোথায় বা কি! দুজনে দিব্যি গল্প করতে করতে চলে গেল বাড়ি থেকে উল্টো দিকে।
রমলা হেসে বলে, ইস কে বলছিল তোমাকে বোকা! গোয়েন্দাগিরি পর্যন্ত করেছ?
না সত্যি, কি রকম যেন গোলকধাঁধায় পড়ে গিয়েছিলাম সে দিন। ভাবলাম এটা কি হল! খেলতে মন লাগল না, একটু পরেই বাড়ি চলে এলাম। বাড়ি এসে দেখি মা ব্যস্ত হয়ে এ ঘর ও ঘর করছেন, অমিতা এখনো কলেজ থেকে ফেরে নি বলে। একবার ভাবলাম বলে দিই। বলে দিই–ছোড়দির আসার কথা। কিন্তু কেমন যেন পারলাম না। মুখে আটকে গেল। মনে হল মা আমাকেই খুব বকবেন। তার একটু পরেই ছোড়দি এল, আর তার কথা শুনে আমি একেবারে আকাশ থেকে আছাড় খেলাম। মা যেই বললেন, আজ এত দেরি কেন রে অমি? ছোড়দি অম্লান মুখে বলল, কলেজের লাইব্রেরীতে বই পড়ছিলাম মা!
সন্ধ্যেবেলা আমি ছোড়দিকে ধরলাম। হারে ছোড়দি, তুই মার সঙ্গে মিছে কথা বললি যে? ছোড়দি কপাল কুঁচকে বলল, মিছে কথা আবার কখন বললাম? আমি তখনকার কথা তুললাম। বললাম, তুই তো কলেজ লাইব্রেরীতে ছিলি না? ঠিক সময়ই তো এসেছিলি। অতনুদার সঙ্গে গল্প করতে করতে ওদিকে চলে গেলি। তবে কেন
ছোড়দি গম্ভীরভাবে বলল, সব কথা বড়দের বলতে হয় না। সব কথা ছোটদের শুনতে হয় না।
ছোড়দির ওরকম গম্ভীর মুখ বড় কখনো দেখি নি। তাই আর কিছু বলতে সাহস করলাম না। এই মাত্র একটা দিন। আর কখনো কোনদিন ওদের দুজনকে দাঁড়িয়ে একটু বেশিক্ষণ কথা বলতেও দেখিনি।
ওই একদিনেই তো সব দেখা হয়ে গেল। রমলা গম্ভীরভাবে বলে, ওঁরা কেন যে নিজেদের ভালবাসাকে প্রকাশ করলেন না, এ একটা অদ্ভুত রহস্য। নেহাৎ তো আর দেবদাস পার্বতীর যুগ নয়!
সেই জন্যেই তো বলছি, খুব একটা কিছু হলে–
মানুষ অনেক সময় নিজেকে চিনতে পারে না, বুঝতে পারে না নিজের মনকে। না বুঝে আগে জীবনকে অবহেলা করে ওড়ায়, তারপর সেই জীবনের জন্যে পাগল হয়।
দীপক অবাক হয়ে ভাবে, আশ্চর্য, এত কথা কি করে জানল রমলা? ভাবল, ছোড়দি সহজ থাকলে বৌ দেখে কত খুসি হত! আর রমলাও ছোড়দিকে দেখে! তার ভাগ্যটাই খারাপ, তাই ছোড়দিকে রমলার সামনে মেলে ধরতে পারল না।
দীপক বোকা, দীপক গবেট কিন্তু দীপকের দিদি? দীপকের সেই দিদিকে রমলা কী মূর্তিতেই দেখল!
এ কথাও মনে হল দীপকের, আজ ছোড়দি এমন করে নিজেকে ছড়িয়ে ফেলল তাই রমলার সাধ্য হচ্ছে তার জীবনের নিভৃতে সন্দেহের সার্চলাইট ফেলবার, সাহস হচ্ছে তার প্রেম নিয়ে আলোচনা করবার। এমন না হলে রমলা ছোড়দিকে সমীহ করত, শ্রদ্ধা করত, হয়তো বা ভয়ও করত।
ছোড়দিকে যদি ভাল অবস্থায় দেখতে! নিঃশ্বাস ফেলল দীপক।
নিঃশ্বাস ফেলল রমলাও, আমার ভাগ্য! লোকে হয়তো আমাকেই অপয়া বলে নিন্দে করবে।
তোমায় নিন্দে করতে যাবে কেন? তোমার কি দোষ?
এ সংসারে আমার আবির্ভাব অশুভ।
এর পর আর ছোড়দির প্রসঙ্গ আশ্রয় পায় না, ভেসে যায় আদরের বন্যায়, আবেগের বন্যায়। দীপকের আদরিণী প্রিয়া নিঃশ্বাস ফেলবে!
অনেকক্ষণ পরে রমলা বলে, বিধবা বিয়েটা তো এখন আর নিন্দের নয়।
দীপক গম্ভীর ভাবে বলে, বিদ্যাসাগরের আমল থেকে। অন্তত বেআইনি তো নয়ই তখন থেকে।
গার্জেনরা ইচ্ছে করলেই, অথবা ওঁরা নিজেরা সাহস করলেই, এই মর্মান্তিক অবস্থার অবসান হতে পারে।
আর ওঁরা! দীপক নিঃশ্বাস ফেলে, ছোড়দি কি আর মানুষ রইল?
রমলা এ কথার উত্তর দিতে পারে না। ভাবে, তা সত্যি।
.
রাত্রিশেষের কোমল আলো ঘরে এসে ছড়িয়ে পড়ে, মধুর জাগরণে ক্লিষ্ট দুটি তরুণ তরুণী সচকিত হয়ে বলে, এ কী, ভোর হয়ে এল নাকি?
তাই তো দেখা যাচ্ছে। ইস ঘুমোও, ঘুমিয়ে নাও একটু।
কোথা দিয়ে যে রাতটা কেটে গেল!
সত্যি কী এত গল্প করলাম! শুধু তো সেই
কথা শেষ হবার আগে সচকিত হয়ে উঠল ওরা ঠিক কালকের মত সেই তীব্র তীক্ষ্ণ ভাঙা গলার করুণ কান্নায়। যে কান্না শুনে ঘরে ঘরে দরজা খুলে গিয়েছিল।
কিন্তু আজকের কান্নার বিষয়বস্তু বদলেছে না?
তীব্র করুণ সুরটা এই কথাই না বলছে-আমার মা কোথায় গেল গো! আমার মা! আমার মা মরে গেছে।
জয়াবতীর তৃষিত হৃদয় বুঝি সুধার সাগরে ডুবে যায়, লজ্জিত লাঞ্ছিত প্রাণ গৌরবের আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।
দেখুক! দেখুক এইবার সত্যই মেয়ের তার কালকের সেই পরপুরুষের জন্য ব্যাকুলতা নিতান্তই পাগলামী কি না। আজ সে কথা ভুলে গেছে সে। হয়তো অতনু যে কে, একথা জিজ্ঞেস করলে বলতে পারবে না। বলবে–জানি না, চিনি না, আমি কি করে জানব?
প্রথম ডাকেই জেগে উঠেছিলেন জয়াবতী, কিন্তু সাড়া দেন নি। থাক আরও ডাকুক। অমিতার মা মা সকলের কানে যাক। শুনুক সবাই, দেখুক অমিতা সত্যি উন্মাদ হয়ে গেছে কিনা।
হ্যাঁ দেখল সবাই।
অমিতা তার মার হাতটা চেপে ধরে বলছে আমার মা মরে গেছে।
অমিতা, অমিতা রে, এই তো আমি। এই তো তোর সামনে বসে রয়েছি, এই তো তোর হাত দিয়ে আমার হাত ধরা।
অমিতা বোজা চোখ খুলে পাগলের হাসি হেসে বলে, আছে? আমার মা আছে?
জগন্ময় কাছে আসেন, এই যে মা, আমিও রয়েছি। আমরা সবাই রয়েছি।
অমিতা কান্না থামিয়ে বলে, তবে কেন ওরা বলল, তোর মা নেই, তোর মা মরে গেছে।
ওরা কারা অমিতা?
ওই যে কালো কালো বিচ্ছিরি লোকগুলো!
বিভীষিকা দেখেছে! বিভীষিকা!
বড়পিসিমা নীচু গলায় ছোট ভাজকে বলেন, পাগলের মাথার মধ্যে যে নরকের বিভীষিকা চলে। যমদূত এসে ডাঙস মারে, তপ্ত তেলে ফেলবার ভয় দেখায়, বলে তোর কেউ নেই, সবাই মরে গেছে।
তাই নাকি? নন্দাও নীচু গলায় বলে, কে বললে? কী করে জানলেন?
ওমা, শোন কথা! এর আবার বলাবলির কি আছে? চিরকেলে জানা কথা।
অগত্যাই নন্দাকে চুপ করে যেতে হয়। সত্যিই তো। চিরকেলে জানা কথা, চিরকালীনরা তো জানবেই।
জগন্ময় সকলের অলক্ষ্যে জয়াবতীকে বলেন, রাত্তিরে টের পেয়েছিল নাকি?
জয়াবতীও সকলের অলক্ষ্যে বলেন, না না, আমি তো ছাত থেকে নেমে এসে দেখলাম অঘোরে ঘুমোচ্ছে।
আশ্বস্ত হন জগন্ময়।
আজ অমিতার মা বাপকে আশ্বস্ত করার পালা।
আজ আর তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে নি নতুন বরকনে, বেরিয়েছে একটু ধীরেসুস্থে একটু সময় দিয়ে, তার পর এসে ভিড়ে মিশে গেছে।
জয়াবতী ডাকেন, আয় দীপু কাছে আয়, ছোড়দির কাছে বোস।
হয়তো এই ডাকের মধ্যে শুধুই কন্যাস্নেহ বিগলিত হয়ে নেই, আরও কিছু রহস্য প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে। হয়তো নতুন বৌকে সমঝে দিতে চান জয়াবতী, আমার এই ছেলেটি কেবলমাত্র তোমার সম্পত্তি নয়। সকলের ভাগ আছে। আমার দাবী আছে।
দীপক এসে খাটের ধারে দাঁড়ায়।
অমিতা চেয়ে দেখ, দীপু তোর কাছে এসেছে।
হঠাৎ অমিতা মাকে অবাক করে দিয়ে হি হি করে হেসে বলে, আহা কী আশ্চয্যি কথাই বললে! দীপু আমার কাছে আসে না?
তবে কি অমিতা স্বাভাবিক হচ্ছে? কেটে যাচ্ছে হিস্টিরিয়ার কে? জয়াবতী কি সত্যনারায়ণের শিন্নি মানবেন?
বড় ননদের দিকে সরে আসেন জয়াবতী, কাল থেকে তো জ্ঞানে নেই, ঘোরে আছে। দেব দৈব কিছু করলে হত না ঠাকুরঝি?
ননদ সুযোগ ছাড়েন না।
উদাস মুখে বলেন, সে তো আমি সাতবার বলাবলি করছি। কিন্তু তোমাদের বিশ্বাস আছে কি নেই, তাই ভেকে গুটিয়ে আছি।
না না, তুমি যা করবে তাই হবে। আমার অপেক্ষা করবার কি আছে? কপালে একটা টাকা ছুঁইয়ে রাখবো? কালকের থেকে একটু যেন ভাল মনে হচ্ছে
কথা শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা হয় না, একটু যেন ভাল মনে হওয়া রুগী শুধু সায়া আর ব্লাউস পরে পরনের শাড়ীখানা পায়ের তলায় লুটোতে লুটোতে খাট থেকে নেমে দালান ডিঙিয়ে সিঁড়ির দিকে ছুটতে থাকে।
কি হল?
কি হল মা?
অমিতা বলে, বিলেত থেকে আমার বর আসছে যে এরোপ্লেন চড়ে, দেখতে যাব না?
.
হিরণয় চায়ের কাপটা টেনে নিয়ে চা পরিবেশনকারিণীর দিকে তাকিয়ে তিক্ত স্বরে বলে, কী মনে হচ্ছে? সাজা পাগল?
মনে যাই হোক, মুখে অপ্রতিভের বিনয় টেনে এনে সেজগিন্নী বলেন, ক্রমশ তো পাকাপাকিই হয়ে উঠছে দেখছি।
না বুঝে সুঝে কারও সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করা ঠিক নয়।
কারুর কাছেই মন্তব্য করতে যাইনি আমি, শুধু তোমার কাছেই
আমার কাছেও মনের সঙ্কীর্ণতা প্রকাশ করা উচিত নয়।
আচ্ছা মনে রাখবো। খেয়াল ছিল না যে আমি এক মহাপুরুষের ঘর করছি।
বিজয় স্ত্রীকে ডেকে বলে, আজ আর অতনু অতনু করছে না, না?
লক্ষ্য করি নি। করছে না বোধহয়।
লক্ষ্য না করবার কি আছে? সকাল থেকে মা মা করছে। তখন হঠাৎ বীরেশ্বরের নাম করল।
তার মানে পাগলের শোভনতা-জ্ঞান ফিরেছে। অথবা এ একটা রঙের তুরুপ। অনেকগুলো পিট কুড়িয়ে নেওয়া গেল।
এ কথার অর্থ?
কিছু না। আমার কথার আবার অর্থ! দাড়ি কামাও গে, বেলা হয়ে গেছে। আজ তো আর ছুটি নেই!
কথাটা সত্যি, বাড়িতে বিয়ে বাবদ দুদিন ছুটি নিয়েছিলেন কর্তারা, আজ অফিস।
.
তোমার অফিস যাওয়া হবে না। জয়াবতী তীব্রস্বরে রায় দেন।
জগন্ময় মাথা চুলকে আমতা আমতা করেন। বড় আশা করছিলেন বাড়ির এই দমবন্ধকারী জটিল জাল থেকে মুক্ত হয়ে বেরিয়ে পড়বেন যেখানে খোলা হাওয়া, যেখানে জীবনের আরাম।
বললেন, আজ একবার না গেলে–আমার তো আবার ওদিকেও দুদিন কামাই হয়েছে।
হোক! আমি একা ওই উন্মাদ মেয়ে নিয়ে মরবো নাকি?
আহা বাড়িতে তো সবাই রয়েছে।
সবাই তো আমার কতই ছাতা দিয়ে মাথা রক্ষা করছে!
একবার না হয় দেখা দিয়ে তাড়াতাড়ি চলে আসব।
যা খুশি করো। চিরদিনই তো দেখলাম, সকল জ্বালা আমার।
এত অল্পের উপর দিয়ে নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে তা আশা করেন নি জগন্ময়। পুলক গোপন করে তাড়াতাড়ি নেয়ে খেয়ে নেন। অফিস টাইমের ঘণ্টাখানেক আগে বেরিয়ে পড়েন। কিন্তু পথে বেরিয়ে কি মনে হয় কে জানে, গুটি গুটি অতনুদের বাড়ির দিকে এগোন।
অতনুর দাদা অবনী ব্যস্ত হয়ে বলে, কাকাবাবু যে! কেমন আছে অমিতা?
জগন্ময় বোধকরি নিজের অফিস বেরোনোর সমর্থনেই তাড়াতাড়ি বলেন, একটু ভালর দিকে বলেই তো মনে হচ্ছে। সেই ভরসায় বেরোচ্ছি একবার। অনেক কামাই হয়ে গেছে। বিজু, হিরণ, এদের কারুরই তো থাকবার জো নেই, কামাই হয়েছে দুতিন দিন। দীপু থাকবে অবিশ্যি, তা সে তো তেমন ইয়ে নয়। তাই অতনুকে বলে যেতে এসেছিলাম, একবার যেন খোঁজ নেয়। যতই হোক সে ডাক্তার মানুষ, একটা ভরসা। আজ আছে তো?
হ্যাঁ আছে। আজ সারা দিনটা আছে। রাত্রের গাড়িতে যাবে। প্লেনের টিকিট তো পায় নি বলছে।
বাড়ি নেই বুঝি? ইতস্তত প্রশ্ন করেন জগন্ময়। মুখোমুখি বলে যেতে পারলেই যেন ভাল ছিল। অবনী গ্রাহ্য করে বলবে কি না কে জানে।
অবনী বলে ওঠে, বাড়ি আছে। ঘুমোচ্ছ এখন।
ঘুমোচ্ছে এখনও?
তাই তো দেখছি। সারারাত ছাতে পড়েছিল, সকালবেলা ঘরে এসে ঘুমোচ্ছে।
আচ্ছা থাক। উঠলে মনে করে একটু বোলো বাবা। তোমাদের কাকীমাও তাহলে একটু ভরসা পান।
নির্বোধ জগন্ময় নিজের পথ সরল করতে, যে কুমীর অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল, আবার তাকে ডেকে নিয়ে আসেন খাল কেটে।
.
হ্যাঁ, সমস্ত রাত ছাতে পড়ে ছিল অতনু।
আর ভাবছিল, জীবনটাকে নিয়ে আর একবার চেষ্টা করা যায় না? এ যুগে এত সাহস, এত দুঃসাহস, অতনু পারে না একবার সাহস করে প্রস্তাব করতে? বলতে পারে না, তোমরা তো জিনিসটাকে রাখতে পারলে না, হাত থেকে ফেলে ভেঙে ফেললে! ওই ভাঙা টুকরোগুলো আমায় দিতে পারো না? দাও না? আমি একবার চেষ্টা করে দেখি সেই টুকরোগুলো জুড়ে আবার আস্ত পুতুল গড়ে তুলতে পারি কি না। তোমাদের তো তাতে কোন লোকসান নেই, অথচ আমার পরম লাভ।
বলা কি অসম্ভব?
দ্বিধাগ্রস্ত মন সারারাত শুধু চিন্তা করেছে। সর্বসন্তাপহারিণীর দেখা মিলেছে একেবারে ভোরবেলা। যখন ওবাড়িতে ঘরে ঘরে দরজা খুলে গেছে, আর পাগলিনী এক নতুন সুর নিয়ে, • কান্নার ঢেউ তুলেছে।
.
কিন্তু সাহস করে বলতে পারার অভাবেই তো কত জীবন অর্থহীন হয়ে যায়, কত জীবন বিস্বাদ!
ওকে আমার চাই, তোমাকে আমি নেবো, এ কথা উচ্চারণ করতে কজন পারে?
অতনুর নিজের কর্মস্থানের বাসা মনে পড়ল। শ্রীহীন লক্ষ্মীছাড়া সেই ঘর। ঘরও নয়, আশ্রয়ও নয়, শুধু আস্তানা। শুধু খাবার শোবার আর প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো রাখবার নির্দিষ্ট একটা জায়গা মাত্র।
সেই লক্ষ্মীছাড়া ঘরে লক্ষ্মীর আবির্ভাবের স্বপ্ন কি কোনদিন দেখেছে অতনু?
মনে পড়ছে না। ঘর নিয়ে কোনদিনই কিছু ভাবে নি বোধহয়। শুধু একটা যান্ত্রিক নিয়মে দৈনন্দিনের ঋণশোধ করে এসেছে। যদি কোনদিন সেই শ্রীহীন ঘর মনকে বিমুখ করে তুলেছে, বেরিয়ে পড়েছে বাইরে। হয়তো বা কোন সহকর্মীর ডেরায়।
ওর বিয়ের কথা নিয়ে প্রশ্ন তোলে অনেকেই, অতনু হেসে ওড়ায়। বলে, মিলিটারীতে কাজ করলে বিয়ে করতে নেই।
কিন্তু সত্যিই কি অমিতার জন্যেই নিজের জীবনটাকে এমন অর্থহীন করে রেখেছে অতনু? সেই গতানুগতিক ব্যর্থপ্রেমের স্মৃতি বুকে নিয়ে জীবনটাকে কাটিয়ে দেবে এই ভেবে এসেছে?
কই, তেমন তীব্রতা তো কোনদিন অনুভব করে নি! অমিতার কথা ভেবে ভেবে তো উত্তাল হয়ে ওঠে নি তার দিন আর রাত্রি!
শুধু একটু বিধুর বিষণ্ণতা। শুধু একটু কোমল করুণা।
অমিতা যদি এতদিনে তার স্বামীপুত্রের সংসারে সুখে আনন্দে জ্বলজ্বল করতো, যদি এমন করে নিঃস্ব হয়ে না যেত, হয়তো অতনু নিজের কথা ভাবত। ভাবত, দূরছাই, এই লক্ষ্মীছাড়া জীবন আর সহ্য হচ্ছে না।
কিন্তু অমিতার দুর্ভাগ্য তার চিত্তকে মূক করে রেখেছিল। তার বেশি কিছু নয়। অতনু ভাবে, তবু আমি নির্বোধের মত ছুটে এলাম তুচ্ছ একটু লোভের আকর্ষণে!
কিন্তু কে জানত অমিতা এমন করবে।
৪. বেলা দশটার রোদ
বাইরে বেলা দশটার রোদ।
অতনুর বৌদি বললেন, কি গো ঠাকুরপো, আজ আর উঠবে না, চা-টা খাবে না নাকি?
এই যে উঠি। শরীরটা তেমন
অবনী ওদিক থেকে শুনতে পেয়ে বলে ওঠে, শরীর ভাল নেই, তা হলেই তো মুশকিল। আজ আবার ট্রেনে যাবে। ওদিকে আবার জগন্ময়বাবু এসে।
হ্যাঁ, সামনে কাকাবাবু আড়ালে জগন্ময়বাবু!
অতনু বেরিয়ে এল। কিছু প্রশ্ন করল না।
অবনীই আবার বলল, বলে গেলেন ওঁরা সবাই অফিসে বেরোচ্ছেন, কারুর ছুটি নেই। দীপু ছেলেমানুষ, তুমি একবার গিয়ে যেন ওঁর মেয়ের খোঁজ টোজ নাও। ডাক্তার হওয়ার জ্বালা। কর্তব্যের পরিধি বেড়েই চলে। কিন্তু হল কি মেয়েটার?
কি জানি। শেষ পর্যন্ত কি যে দাঁড়ায় বলা শক্ত!
অতনুর বৌদি বলে ওঠেন, আমার তো মনে হচ্ছে ওর আবার বিয়েথাওয়া দিলে রোগ সেরে যায়।
অতনু ঘুরে দাঁড়িয়ে একবার ওঁর আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলে, আপনি কেন ডাক্তার হলেন না তাই ভাবছি। দেশের একটা মস্ত বড় লোকসান!
.
আজ শুধু মা!
আজ সমস্ত সংসারের উপর শান্তিবারি। আজ সারা বাড়িতে পবিত্রতার হাওয়া। আজ পাগলী নীচে নেমে এসেছে। খুঁজছে মাকে।
আমার মা কই গো? আমার মাকে খুঁজে পাচ্ছি না।
শোনো কথা। এই তো তোর মা। সেজখুড়ি চিনিয়ে দেয়।
হ্যাঁ-হ্যাঁ, ওই তো আমার মা!
অমিতা ধুলোর ওপর বসে পড়ে ভাড়ার ঘরের মেজেয়। সামনে পড়ে থাকা তরকারির ঝুড়ি থেকে একটা বেগুন তুলে নিয়ে সেটা লোফালুফি করতে করতে বলে, আমার মা চা খেয়েছে?
জয়াবতী কাঁদো কাঁদো হয়ে বলেন, খেয়েছি মা। বুকের আগুনের জ্বালায় তো পেটের আগুনের জ্বালা চাপা পড়ে না। বুঝি-বা দ্বিগুণ বেড়ে ওঠে।
সেজগিন্নী অমায়িক মুখে বলেন, তবু বলব দিদি, তোমার ভাগ্যকে হিংসে না করে থাকা যায় না। তোমার পাগলছাগল মেয়ে, তাও ধড়ফড়িয়ে নেমে আসে মায়ের খাওয়া হল কিনা খোঁজ করতে। হাতের কাছে খাবার দেখতে পেলে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায় থালা বোঝাই করে। আর আমার মাথাবুদ্ধিওলা মেয়ে, মা খেলো কি না খেলো, মরল কি বাঁচল, খোঁজও করে না।
জয়াবতী আহত স্বরে বলেন, আমার মেয়ে চিরদিন পাগল ছাগল ছিল না সেজবৌ! দুদিন আগেও সমগ্ৰ সংসার মাথায় করে বেড়িয়েছে।
আহা, সে আর কে অস্বীকার করেছে? এখনকার কথাই বলছি।
অমিতার দিকে আড়নজরে তাকিয়ে দেখেন ওঁরা, আজ কি একটু ভাল? একটু একটু করে কি ভাল হয়ে যাচ্ছে? এই ভাবেই সহজ হয়ে যাবে?
সেজখুড়ি স্নেহঢালা গলায় বলেন, কিছু খাবি রে অমিতা? খেতে ইচ্ছে করছে কিছু?
অমিতা আস্তে মাথা নাড়ে।
আহা না খেয়েই তো কাটছে। কত খিদে পেয়েছে বেচারার! কী খাবি বল?
অমিতা গম্ভীর ভাবে একটু এদিকে ওদিকে তাকিয়ে বলে, দেশলাই।
দেশলাই! দেশলাই খেতে চাইছে।
আর জয়াবতী কিনা আশায় বুক বাঁধছেন সেরে উঠছে বলে?
দেশলাই কি খাবার জিনিস অমি? সেজখুড়ি আবার মুক্তা অন্বেষণে রহস্যের সমুদ্রে ডুবুরি নামান, দেশলাই কেউ খায়?
খায় না? ও! তাহলে বালতি খাবো।
জয়াবতী ডুকরে কেঁদে ওঠেন, অমি, আমি যে বড় আশা করছিলাম তুই সেরে উঠছিস।
কান্নার স্বরে আকৃষ্ট হয়ে না আসে, কি হল? আবার কি হল আপনার দিদি? তার কণ্ঠে বিরক্তি।
মেয়েটা খেতে চাইছে, তাই মা কাঁদছে। অমিতা ঘটনাটা বোঝায় প্রশ্নকারিণীকে।
নন্দা শান্তভাবে বলে, কী খেতে চাইছে মেয়েটা?
অমিতা অম্লান বদনে বলে, বেগুনভাজা!
ও আমার কপাল, তুই কি বেগুনভাজা খেতে চেয়েছিলি? জয়াবতী ছোট জার কাছে হৃদয় জ্বালা ব্যক্ত করেন, জানো ছোট বৌ, বলে কি না দেশলাই খাবো, বালতি খাবো?
বেশ করেছে বলেছে! বাড়িসুদ্ধ সকলে মিলে ওর মুণ্ডু খাওয়া হয়েছে, ও আর এখন ও ছাড়া কি চাইবে? বলে গলাটা খাটো করে বলে, আপনাদের কথাবার্তাগুলো আর একটু বুদ্ধিমানের মত হওয়া উচিত। সব কিছুই খুঁচিয়ে তুললে বাড়ে, এ জ্ঞানটুকু অন্তত থাকলে ভাল হয়।
স্নেহময়ী সেজখুড়ি ততক্ষণে তৎপর হয়ে অমিতার হাতের বেগুনটা নিয়ে চারখানা করে কুটে হাঁক দেন, বামুনদি, এই বেগুন কখানা নিয়ে যাও তো, চট করে ভেজে দাও।
বলাবাহুল্য বামুনদির রান্নাঘরে অমিতার আহার নিষেধ। মহারাজজীর চরণে আত্মনিবেদিত এই সংসারটিতে অনাচার প্রবেশের ছিদ্রপথ নেই। এ যুগের মত বিধবার খাওয়ায় এলোমেলো ঘটে নি এখনো।
কিন্তু এখন যে সেজগিন্নী বামুনদিকে ডাকলেন, সে কি আচার আচরণ ভুলে গেছেন বলে? না কি মনে করলেন আর অমিতার বিচার কি? সমস্ত বিচার বিবেচনাই যখন হারিয়ে ফেলেছে।
জয়াবতী কান্না ভুলে তাড়াতাড়ি বলেন, বামুনদি আবার কোন্ হেঁসেলে
কিন্তু এ দুর্ভাবনার নিরাকরণ স্বয়ং অমিতাই করে দেয়। হঠাৎ ওগো বাবাগো! আমাকে বিষ খাওয়াচ্ছে, বলেই বেদম ছুট মারে অমিতা।
ভেতরে জ্ঞান আছে–সেজগিন্নী মন্তব্য করেন, বামুনদির হেঁসেলে খেতে নেই। তা বোধ রয়েছে।
তা রয়েছে। নন্দা ভুরু কুঁচকে বলে, পাগলের মধ্যেও ছিটেফোঁটা বোধ থাকে। থাকে না শুধু সহজদের।
সব সময় তুমি অমন হুল ফুটিয়ে কথা কও কেন বল তো ছোট বৌ? সেজগিন্নী তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠেন।
নন্দা কিন্তু নির্বিকার। হেসে উঠে বলে, পরীক্ষা করে দেখি, চামড়াটা কত মোটা।
হ্যাঁ, এমনি করেই প্রবাহিত হয়ে চলে একান্নবর্তীত্বের মাহাত্ম্যধারা। জগন্ময়ের সংসার পাড়ার লোকের দৃষ্টান্তস্থল।
.
ছোট ছেলেটার ভিজে মাথাটা ভাল করে মুছিয়ে দিচ্ছিলেন জয়াবতী। নিজে নাইতে পারে, নিজে মাথা ভাল করে মুছতে পারে না। এ যাবৎ ও ভারটা অমিতারই ছিল, আজ দুদিন পরে জয়াবতীর খেয়াল হয়েছে। টেনে ধরে মাথা মোছাচ্ছেন ঘষে ঘষে।
ছেলেটা বিরক্ত হয়ে বলে ওঠে, আঃ লাগছে যে!
লাগছে কি আবার! ভিজে মাথায় থাকলে অসুখ করবে না?
ছোড়দি তো লাগিয়ে দেয় না!
আর ছোড়দির কথা বলে কি হবে? ছোড়দি তো আমার মাথায় মুগুর মারলো।
মুগুর মারলো! ছেলেটা চমকে মায়ের মাথার দিকে তাকায়।
কি জানি হবেও বা। পাগলরা তো মানুষকে মারে ধরে! কিন্তু ছোড়দি কেন পাগল হল? সে তো রাস্তার ভিখিরিরা হয়।
জয়াবতী দুঃখের মধ্যেও দুঃখের হাসি হেসে বলেন, হাতে করে কি আর মারল? এই যে অসুখ করল এইটাই আমার পক্ষে মার।
ছেলেটা ম্লানভাবে বলে, ছোড়দি আর ভাল হবে না? পাগলই থেকে যাবে?
ভগবান জানেন। ভরসা তো দেখছি না।
তা হলে আমাদের কে পড়াবে?
আবার অন্য ব্যবস্থা দেখতে হবে, আত্মবিস্মৃত জয়াবতী আক্ষেপ ব্যক্ত করেন, মনে করেছিলাম, যা হল তা হল, তবু সংসারটার একটা সুব্যবস্থা হল। আমারও একটু গতরের আসান হচ্ছে, ওঁরও পয়সার দিকে সহসা বোধ করি চৈতন্য ফেরে জয়াবতীর। চুপ করে যান। আর এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখেন কেউ শুনতে পেল কিনা।
কিন্তু শুনতে একজন পায়, সে নতুন বৌ রমলা। কি জন্যে সে এদিকে এসেছিল কে জানে।
মিনিট খানেক সে বোধ করি পাথরের পুতুলের মতই দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর আস্তে কাছে এসে বলে, তিলককে পড়াতে আমিও তো পারি মা!
হঠাৎ জয়াবতীর যেন ব্রহ্মারন্ধ্রে জ্বালা ধরে যায়। ওঃ, সহৃদয় প্রস্তাব জানাতে এসেছেন। তার মানে আগাগোড়া কথা শুনেছেন। বৌয়ের উপর জয়াবতী আদৌ প্রসন্ন হতে পারেন নি। একে তো তার এক-ফোঁট্টা ছেলের হঠাৎ প্রেমের নায়ক হয়ে ওঠার আগাগোড়া দোষ সেই তার নায়িকাটির উপরই চাপিয়ে রেখেছিলেন, তার উপর বৌ আসতে না আসতেই এই দুর্বিপাক। বৌয়ের বাপের বাড়ি থেকেই কেউ কিছু করে দিল কিনা, এ সন্দেহের ধোঁয়াও মাঝে মাঝে মনের মধ্যে পাক খাচ্ছে।
ছেলের বৌকেও জয়াবতীর জায়েদের মতই একজন মনে হল, আর আপাতত তার কোন দোষ খুঁজে না পেয়ে ভিতরের ঝাঁজ প্রকাশ করলেন একটা অবান্তর কথায়। বলে উঠলেন, দ্যাওরদের নাম ধরে ডাকার রীতি এ বাড়িতে নেই বৌমা, ওকে তুমি ছোট ঠাকুরপো বলবে।
রমলা অন্যদিকে যতই চালাক হোক, সংসারে এখনও অনভিজ্ঞ, তাই হেসে বলে, নাইলে যাকে মাথা মুছিয়ে দিতে হয়, তাকে আবার ঠাকুরপো!
কিন্তু জয়াবতী এ পরিহাসে হাসেন না। ব্যাজার মুখে বলেন, আমি যখন শ্বশুরবাড়ি এসেছিলাম, আমার ছোট দ্যাওরকে ধরে ভাত খাইয়ে দিতে হত। তবুও তাকে ছোট ঠাকুরপো ডাকি বৌমা!
এবার আর বুঝতে অসুবিধে হয় না। রমলা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
জয়াবতী বলেন, দীপু কলেজ যাবে না?
কলেজ!
দীপক কলেজ যাবে, এমন অসম্ভব কোনও কথা রমলার মনের জগতে ছিল না। শুধু ভেবেছিল, আজ বাড়ির কর্তারা যে যার কর্মস্থানে রওনা দিয়েছেন, আর ছোড়দিও বেশি কাঁদছে না। অতএব হয়তো আজ দুপুরটা
এখন জয়াবতী সেই নিঃশঙ্ক চিত্তে ঢিল ছুঁড়লেন। বললেন দীপু কলেজে যাবে না?
যে জয়াবতী জগন্ময়কে জুলুম করছিলেন, বাড়িতে থাকবার জন্যে।
রমলা মাথা নেড়ে বলে, জানি না।
জান না? সকাল থেকে তো ওপরেই রয়েছ বাছা! যাবার কোন উযুগ দেখলে না?
না তো।
তা জানি! আর কি পড়া লেখা হবে? জয়াবতী ভবিষ্যৎবাণী ঘোষণা করেন, এইবার সবই জলাঞ্জলি।
রমলা বোধকরি পতিনিন্দাটা বরদাস্ত করতে পারে না, তাই বলে ফেলে, ছোড়দির এইরকম–
ছোড়দি তো এখন পাগল হয়ে নাচতেই থাকবে, তার ছুতোয় কারুর কিছু বন্ধ রাখবার দরকার নেই।
যে জয়াবতীর কথায় মধু ঝরে, তার রসনায় এমন তিক্তরস? রমলা অবাক হয়ে যায়।
বিষণ্ণভাবে বলে, আচ্ছা বলছি গিয়ে।
বলবার কিছু নেই। যে যা ইচ্ছে করুক। শেষে তো দোষ হবে মার!
উল্টোপাল্টা কথায় হাঁপিয়ে উঠে রমলা সরে যায়।
আর ঠিক এই সময় জয়াবতীর এই তিক্ত মেজাজের সামনে এসে দাঁড়ায় অতনু।
আর আর অতনুকে দেখে হাতে চাঁদ পান না জয়াবতী। পান না পরম আশ্বাসের অভয়। বরং মনটা বিমুখ হয়ে ওঠে তার।
আবার ওর আসার কী দরকার ছিল?
মেয়েটা যদি বা ঝোঁক বদলেছে।
আজ তো অমিতা শুধু মা। সেই সম্পদটুকু মুহূর্তে লুঠ করে নিতে পারে এই অতিভদ্র নিরীহ চেহারা দস্যুটা।
জয়াবতী ভাবেন, আজ ওর এ আক্কেল হওয়া উচিত ছিল, আর আসার কার নেই। দরকার থাকলে আমরাই ডেকে পাঠাতাম।
কিন্তু অতনু তার ছেলের বৌ নয় যে বিরক্তিটা প্রকাশ করে বসবেন। তাই শুকনো গলায় বলেন, এসো বাবা! আজই যাওয়ার ঠিক করলে তা হলে?
হ্যাঁ। আজ অবস্থা কেমন? রিপোর্ট কি বলছে?
জয়াবতী গতকালকের সমস্ত লজ্জার কলঙ্ক মুছে ফেলবার সুযোগ পেয়ে আত্মস্থ ভঙ্গিতে বলেন, আজ একেবারে অন্য রকম। আজ সকাল থেকে শুধু মা আর মা। আমার মা মরে গেছে বলে কেঁদেই নিল এক পালা। তারপর মা কোথা গেল, মা চা খেয়েছে কিনা, এই করে বেড়াচ্ছে।
গুড। অতনু বলে, খুব ভাল কথা। খেয়েছে কিছু? ডাক্তার অতনু ডাক্তারের মতন কথা বলবে বইকি।
জয়াবতী যদি বলতে পেতেন হ্যাঁ খেয়েছে, তাহলে বেঁচে যেতেন। কিন্তু একেবারে পুকুর চুরিটা করা শক্ত। তাই বলেন, ওই তো ওইটাই এখনো স্বাভাবিক হয় নি।
যেন আর সবটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে।
খাওয়ান! আপনিই একটু চেষ্টা করে খাওয়ান। আপনাকেই যখন ইয়ে করছে।
দেখি। বলে নীরস মুখে দাঁড়িয়েই থাকেন জয়াবতী। বলেন না, যাও না দেখে এসো।
কাল বলেছিলেন। কাল মনের মধ্যে নানা চিন্তার ওঠাপড়া ছিল। আজ হঠাৎ বিরূপতা আসছে। গতরাত্রে জগন্ময়ের সঙ্গে কথাবার্তায়, মনের অতি নিভৃতে যে ইচ্ছেটি অঙ্কুরিত হয়ে উঠছিল, সেটি অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়েছে। তাই আজ অন্য ভাব।
আজ হঠাৎ মনে হচ্ছে জয়াবতীর, বেশ তো, তুমি যদি পাড়াপড়শীর মতই ব্যবহার কর, আমিও তাই করব! বাইরের উঠোন থেকে বিদায় দেবো। কেন, তুমি নিজে থেকে একবার প্রস্তাব করতে পারতে না? বলতে পারতে না, কাকীমা, ওকে আমার হাতে দিন। আমি ওকে সারিয়ে তোলবার চেষ্টা করব। ওকে-সুখী করব। তা নয়, রুগীর খবর নিয়ে মহানুভবতা দেখাতে এলেন! ঠিক আছে, খবরই নিয়ে যাও।
.
অতনু ভাবছে ওঁর মুখে আজ এমন অপ্রসন্নতা কেন? গতকালকের প্রতিক্রিয়া? এই বিরূপ মুখের দিকে তাকিয়ে কি বলা সম্ভব, কাকীমা, ওকে তো আপনারা রাখতে পারলেন না! ভেঙে ফেললেন ছড়িয়ে ফেললেন, সেই ভাঙা টুকরোগুলো আমায় দিন না। আমি চেষ্টা করে দেখি
কেউ কারুর মনের মধ্যেটা দেখতে পায় না, এই হচ্ছে পরমতম লাভ। কেউ কারুর মনের কথা বুঝতে পারে না, এই হচ্ছে চরমতম লোকন।
তবে আর অতনু দাঁড়িয়ে থেকে কি করবে? চলে যাওয়াই তো উচিত।
বড় জোর বলা যায় দীপুর বৌ চলে গেছে নাকি?
যা বলা যায়, তাই বলে।
জয়াবতী বলেন, না, আজ আর কি যাবে? অষ্টমঙ্গলা হোক। আর এখনকার বৌরা বাপের বাড়ি যায় নাকি? লজ্জার যুগ তো নয়!
লজ্জার যুগ নয়।
তবু নির্লজ্জের মত অবান্তরের ভূমিকা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না।
অতএব অতনুকে বলতে হয়, যাচ্ছি তাহলে। কাকাবাবু অফিস যাবার সময় বলে এসেছিলেন একবার খোঁজ নিতে–
কাকাবাবু!
উনি? উনি বলেছিলেন খোঁজ নিতে? উনি গিয়েছিলেন তোমার কাছে?
হ্যাঁ ওই অফিস যাবার সময়
সহসা অনেকক্ষণের নিস্তব্ধ হয়ে থাকা বাড়িটা ঝনঝনিয়ে ওঠে, আমার মা কোথা গেল? আমার মা?
ওই দেখ।
জয়াবতী গর্বে, পুলকে, ব্যাকুলতায়, ব্যস্ততায় ধুপ ধুপ করতে করতে ছোটেন।
কিন্তু অতনু?
সে কি ওঁর পিছন পিছন ছুটবে? নাকি পড়শীর অধিকারহীন নিরুপায়তায় তাকিয়ে থাকবে? না দাঁড়িয়ে থাকবে ওই স্বরটুকু আবার কি বলে শোনবার জন্যে?
হঠাৎ নন্দা এসে দাঁড়ায়।
বিনা ভূমিকায় বলে, তুমি তো ইচ্ছে করলেই একটু সাহস দেখাতে পারো অতনু?
কি বলছেন? চমকে প্রশ্ন করে অতনু।
বলছি তুমি তো ইচ্ছা করলেই অমিতাকে বিয়ে করতে পারো।
এটা কি!
ব্যঙ্গ! অকারণ নিষ্ঠুরতা!
অতনুর মন বোঝার ছল? কথার জাল ফেলে তুলে আনবার চেষ্টা অতলে তলিয়ে থাকা সেই মনকে?
একটু বুঝি কঠিন হয়ে যায় অতনু। স্থির স্বরে বলে, ইচ্ছে করলেই পারা যায় এই আপনার বিশ্বাস?
নিশ্চয়। ইচ্ছের জোর থাকলে কী না হতে পারে? আমি তো কাল থেকে কেবল ভাবছি, তুমি এটা বলছ না কেন?
বললেই সে বলাকে মূল্য দেওয়া হবে!
না হয় অধিকারের জোর খাটাবে।
অধিকার! অধিকার কোথায়?
সহসা হেসে ওঠে না। বলে, সেটাও বলে বোঝাতে হবে? না, তোমাকে বোঝাতে আসাই দেখছি বিড়ম্বনা হয়েছে। বলে চলে যায় না।
এই ধরন নন্দার। কথাটা ছুঁড়ে মেরেই চলে যায়। তাকিয়ে দেখে না তার প্রতিক্রিয়াটা কি হল। হয়তো প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে নিঃসংশয় বলেই দেখে না।
অতনু কি নন্দার নির্দেশে কান দেবে? বিনা দ্বিধায় এগিয়ে গিয়ে
ঝন ঝন ঝন!
কণ্ঠস্বর নয়, কাঁচের বাসন ভাঙার শব্দ।
পাগলিনী চেঁচাচ্ছে, সেই শব্দের সঙ্গে বলছে, তুমি চলে যাও। তুমি থাকবে না। তুমি মহাদির মা। তুমি ওকে তাড়িয়ে দিলে, ওকে মারলে।
অতনুদা! অতনুদা!
দোতলার বারান্দা থেকে ঝুঁকে ডাকে দীপক, আপনি আছেন? উঃ বাঁচলাম! শীগগির ওপরে আসুন। ভয়ানক কি রকম করছে।
তাহলে এখন যাওয়া চলে।
বাড়ির বড় ছেলে বিপদে পড়ে ডাকছে। বাড়ির কর্তা ভার দিয়ে গেছেন।
.
খালি পায়ে নয়, খালি পায়ে নয়, চটি পরে! রমলা সাবধান করে দেয়, ওঘরে কাঁচের গ্লাস ভেঙে ছড়াছড়ি।
যাচ্ছি না এক্ষুনি ওঘরে, আবার কি হল? বহু কণ্ঠের বহু উচ্চারিত প্রশ্নটাই আবার উচ্চারণ করে অতনু।
কি জানি। সকাল থেকে তো খুব খারাপ ছিলেন না। নীচে থেকে বোধহয় আপনার গলার সাড়া পেয়ে মাকে কি বলেছেন। মা বললেন, চলে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে ব্যস! ওকে তুমি তাড়িয়ে দিয়েছ–বলে রেগে কাঁচের গ্লাস ছুঁড়ে
দেখছি আমিই শনি হয়ে এসেছিলাম এবার!
রমলা একবার চোখ তুলে দেখেই চোখ নামিয়ে নেয়। তারপর বলে, যাবেন না ওঘরে?
তাই ভাবছি। তাতে হিত করব না অহিত করব বুঝতে পারছি না।
তা অবিশ্যি সত্যি, রমলাও বুঝতে পারছে না। বুঝতে পারছে না তার শাশুড়ির মনোভাব। কিন্তু অমিতার ঘর থেকে দীপক আবার ডেকে উঠেছে অতনুদা!
ও ঘরের দরজার বাইরে দাঁড়ায় অতনু।
.
চারিদিকে ভাঙা কাঁচের টুকরো, তার মাঝখানে মেঝেয় লুটোচ্ছে অমিতা! ওকে তোমরা খালি খালি তাড়িয়ে দাও, ওকে মার। তাই তো ও চলে যাবে। অনেক দূরে চলে যাবে।
জয়াবতী শুধু ওর বিপর্যস্ত মাথাটা সামলাচ্ছেন।
মত্ততায় অস্বাভাবিকতা আসে। কিন্তু অস্বাভাবিকতারও মাদকতা আছে বইকি! তার নেশাও বাড়াতে বাড়াতে বাড়ে। নইলে কি করে পারে সুস্থ সহজ লোকে দু বাহু তুলে নগর সংকীর্তন করতে?
স্নায়ু শিরা সব টান টান হয়ে উঠেছে। ওকে আর সহজে রাশে আনা যাবে না। ও স্নায়ুকে নিস্তেজ করে দিতে হবে, শিথিল করে দিতে হবে।
দীপু, আমার বাড়ি থেকে ওষুধের ব্যাগটা আনিয়ে দিতে পারবি? একটু চট করে।
আমিই যাচ্ছি।
তুই আর কেন এই রোদ্দুরে? চাকর টাকর কাউকে বৌদিকে বললেই
থাক না, আমিই যাচ্ছি।
বাবা অতনু! জয়াবতী আর বিরস নেই। আবার কাতর হয়ে উঠেছেন।
অতনু ইসারায় কথা বলতে বারণ করে। ঘরে ঢুকে নীচু হয়ে আস্তে আস্তে কাঁচের টুকরোগুলো তুলতে চেষ্টা করে।
সহজ কথা বলা খুব শক্ত। কিন্তু শক্ত কাজ করতে পারাই তো পৌরুষের মহিমা।
ইস! এমন সুন্দর কাটগ্লাসের গ্লাসটা ভাঙল! আচ্ছা এক আহ্লাদী মেয়ে হয়েছে বটে আপনার?
জয়াবতী কথার এ টোনে মর্মাহত হন। এই কি হালকা রঙ্গরসের সময়?
হতাশ ক্ষুব্ধ গলায় বলেন, আর গেলাস! আমার কপালটাই ভেঙে চুরমার করে দিল!
ওর কি সাধ্যি যে আপনার কপালে হাত দেয়? নিজের কপালই ভাঙছে।…অমিতা, মুণ্ডুটা মাটিতে ঘষে ঘষে সত্যিই যে ভাঙবার জোগাড় করছ, কি হচ্ছে ওটা?
জয়াবতী ক্রমশ শিথিল হয়ে যাচ্ছেন, বলে ফেলতে যাচ্ছেন, ওর ভাঙা কপালখানা জোড়বার ভার তুমি নিতে পারো না অতনু? মিলিটারীর ডাক্তার বলে শুধু ভাঙা হাত পাই জুড়বে? জুড়তে পারবে না ভাঙা অদৃষ্ট?
অতনু ক্রমশ উত্তেজিত হয়ে উঠেছে, বলে ফেলতে যাচ্ছে, কাকীমা, পাগলটাকে আমার হাতে তুলে দিতে পারেন না? দেখি ওর পাগলামি সারিয়ে দিতে পারি কিনা। মনে করুন না এইটাই বিধাতার নির্দেশ ছিল। তাই
এই যে অতনুদা, আপনার ব্যাগ।
জোরে জোরে এসেছে দীপক। ভারী ভারী নিঃশ্বাস ফেলছে।
অতনু তাড়াতাড়ি ওর হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে নেয়।
তারপর খুলে দেখে পরীক্ষা করে। কোন্ কোন্ ওষুধ মজুত আছে। মরফিয়া ইনজেকশন দেবে, উত্তেজিত স্নায়ুকে বশে আনতে?
না না, ছুঁচ ফোঁটাতে পারবে না অতনু ওর ওই শীর্ণ হয়ে যাওয়া ফ্যাকাশে হাতে।
তোমার সেদিনের সেই ঘুমের ওষুধটা আর নেই?
আছে, সেটাই দেব। খাবার জল চাই একটু।
বৌমা! ডাকলেন জয়াবতী।
দুর্ভাগ্যক্রমে চট করে সাড়া পাওয়া গেল না। জয়াবতী তীব্র বিরক্তির সঙ্গে উঠে পড়লেন।
হুঁ! আমি আবার ফরমাস করব! সে সুখ ফুরিয়েছে। এখন এই রকমই হবে, চেঁচিয়ে মরে গেলেও কেউ শুনতে পাবে না। ভারী দেহ নিয়ে দুমদুম করতে করতে নীচে নামেন জয়াবতী।
সঙ্গে সঙ্গে দীপকও ব্যস্ত হয়ে নামে, আহা তুমি কেন? আমিই না হয় এনে দিচ্ছি। সিঁড়ি উঠলে তোমার
আমার কিছু হবে না বাবা, এ হচ্ছে মাষকড়াই, এতে পোকা ধরে না।
জয়াবতী খাবার জলের কাছে পৌঁছতে পৌঁছতে দীপক এসে পৌঁছে জল ঢালছে।
আমি নিয়ে যাচ্ছি জল। তুমি একটু জিরিয়ে তবে
কিন্তু দীপকই কি বৌ হঠাৎ কোন্ দিকে গেল, সেটা না দেখে যাবে? বৌকে আবার মা ডাকবেন কিনা কে বলতে পারে? তখন?
আশ্চর্য, মাকে তো কখনো ভীতিকর মনে হত না! বৌ আসার পর থেকেই মাকে এত ভয় করছে কেন দীপকের?
.
ভয়! ভয়!
ভয় বস্তুটা বোধকরি প্রেমের সহোদর অনুজ। তাই প্রেমের সঙ্গে সঙ্গে তার গতিবিধি।
তাই এত ভয় অতনুর।
কিন্তু অমিতারও তো ছিল কত ভয়। সব ভয় ঘুচিয়ে এ কী নির্ভীক হয়ে উঠল সে!
হঠাৎ নির্জন হয়ে গেছে ঘরটা। হঠাৎ শুধু অতনু আর অমিতা।
অতনু দ্রুত ব্যগ্র-স্বরে ডাকে, অমিতা!
অমিতা শুধু চোখটা খুলে তাকায়। লাল লাল ফুলো ফুলো চোখ।
অমিতা ওঠো, উঠে বোসো। আমার একটা কথা শুনতে হবে তোমায়।
কিন্তু উন্মাদিনী কেন সহজ সুরে সাড়া দেবে? তাই সে বলে ওঠে, শুনবো না শুনবো না, কারুর কথা শুনবো না আমি।
শুনতেই হবে।
দৃঢ়স্বরে বলে ওঠে অতনু, যাবার আগে সেই কথাটা শোনা চাই আমার।
না না, তুমি যাবে না। মাটি থেকে মাথা তোলে পাগলী।
যাব না? না গেলে চলবে?
চলবে। তুমি শুধু এখানে বসে থাকবে।
অতনু হঠাৎ ওর দুই বাহুমূল চেপে ধরে ওকে গায়ের জোরে উঠিয়ে বসিয়ে আরও দৃঢ়স্বরে বলে, শুনবে তুমি স্থির হয়ে?
কেন স্থির হবো? আমি যে পাগল হয়ে গেছি? দেখতে পাচ্ছ না আমার দশা? সহসা একেবারে কাণ্ডজ্ঞানশূন্যের মতই কাজ করে বসে অমিতা।
অতনুর কোলের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে কেঁদে ওঠে, বলছি চলে গেলে মরে যাব। তবু
.
অতনু কী করবে?
অতনু ওই কান্নায় ভেঙে পড়া পাখীর মত শরীরটুকু নিবিড় করে চেপে ধরবে? ওর সমস্ত শূন্যতা ভরিয়ে দেবে হৃদয়ের উষ্ণতায়?
না কি ঝড়ে এসে পড়া মরা পাখীর মত টেনে ফেলে দেবে ওটাকে কোল থেকে? স্পর্শ থেকে?
না, ঠেলে ফেলে দেয় না। শুধু ঠেলে তুলে দেয় অতনু সেই ডানাভাঙা পাখীটাকে।
তুলে দিয়ে ওর দুটো কাঁধ চেপে ধরে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে একবার ওর চোখের দিকে চেয়ে চাপা কঠিন স্বরে বলে, মিছিমিছি এরকম করছ কেন? তোমার তো কিছু হয় নি।
রোগিণী কেঁদে ওঠে না, কেঁপে ওঠে। কেঁপে উঠে বলে, আবার আমায় বকছে! আমার এত কষ্ট!
থামো!
অতনু বুঝি নতুন পদ্ধতিতে চিকিৎসা করতে চায়? তাই ওর কাঁধ দুটোয় ঝাঁকুনি দিয়ে তীব্রস্বরে বলে, থামো! এ রকম করতে লজ্জা হচ্ছে না? কিছু তো হয় নি তোমার!
ওমা, এত কষ্ট, তবু বলছে কিছু হয় নি! চীৎকার করে নয়, গেঙিয়ে গেঙিয়ে বলে অমিতা।
অতনুর কি নেশা লেগেছে? কতটা কঠোর হওয়া যায় তার পরীক্ষা করছে? সেইটাই ওর চিকিৎসাপদ্ধতি?
নইলে কেন অমন রূঢ় হয়ে ওঠে, রুক্ষ হয়ে ওঠে।
সবাইকে ঠকাতে পারো, আমায় ঠকাতে পারবে না। আমি জানি তোমার কোনও অসুখ করে নি! সব তুমি ইচ্ছে করে করছ।
পাগলী একবার চোখ তুলে তাকায়। যন্ত্রের মতো উচ্চারণ করে, ইচ্ছে করে করছি?
করছই তো? শুধু শুধু মিথ্যে পাগলামি করে গালে মুখে চুনকালি মাখছ। তোমার লজ্জা করছে না, আমার যে লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে।
আমার জন্যে তোমার মাথা কাটা যায়?
যায় না?
সহসা স্থির হয়ে যায় অমিতা। শান্ত হয়ে যায়। বুঝি একেবারে সহজ হয়ে যায়।
আচ্ছা আর করব না।
ঠিক বলছ?
ঠিক বলছি, ঠিক বলছি।
শান্ত হয়ে যাওয়া মানুষটা আবার হঠাৎ উদ্বেল হয়ে ওঠে। বুঝি নেশার ঘোর কেটেও কাটে নি। লেগে আছে মস্তিষ্কের কোষে কোষে। তাই বলে, শুধু তুমি একবার আদর কর।
ভয়ঙ্কর একটা উদগ্র বাসনাকে স্নায়ুর মধ্যে নিষ্পেষিত করে ফেলতে ভয়ঙ্কর একটা পরিশ্রম হয় না? সেই পরিশ্রমে আলোড়িত হয়ে ওঠে না রক্তমাংসের একটা মানুষ?
হয় বইকি! কিন্তু সে আলোড়ন কি ধরা পড়তে দেওয়া হবে? প্রশ্রয় দেওয়া হবে নিন্দনীয় একটা অসামাজিক ইচ্ছেকে?
না, প্রশ্রয় দেওয়া যায় না। তাই বলতে হয়, তাতে লাভ?
লাভ, লাভ? ভয়ঙ্কর লাভ! করো না গো একটু আদর। এতদিন পরে এসে শুধু বকছ আর বকছ। আবার কোলের উপর উপুড় হয়ে পড়ে সে।
অতনু কি ভুলে যাবে কাকে বলে অসঙ্গত, আর কাকে বলে অসামাজিক?
কিন্তু কি করে ভুলবে?
দরজায় যে ছায়া পড়েছে।
দীর্ঘছায়া। সাড়ে তিন হাত মানুষের ছায়া কি চৌদ্দ হাত? একুশ হাত? একশো হাত?
ছায়ার ভিতরে কিছু নেই, অসার বলেই নিজেকে এত বাড়িয়ে তুলতে পারে?
তাই সামান্য একটা সাড়ে তিনহাত মাপের মানুষের ছায়ায় লুপ্ত হয়ে যায় জগতের সমস্ত মমতা, সমস্ত করুণা, সমস্ত প্রেম! লুপ্ত না হলে কেমন করে অমন চেঁচিয়ে উঠল অতনু?
ফের? ফের ওই রকম মিথ্যে মিথ্যে পাগলামী হচ্ছে? কী বললাম এতক্ষণ? ভাবো! মনের জোর দিয়ে ভাববা–আমার কিছু হয়নি। আমি ঠিক আছি। আমি ভালো আছি।
দরজার ছায়া ঘরের মধ্যে এসে পড়েছে। একটা নয় দুটো।
অতনু পাখী পড়াচ্ছে।
কই বললে না? বল, আমি ভাল আছি। আমি ঠিক আছি।
হি হি হি! আমি ভাল আছি! আমি ভাল আছি! দাঁড়িয়ে উঠে ঘরের মধ্যেই একটা ঘুরপাক খেয়ে নিয়ে হেসে উঠেই উন্মাদিনী হঠাৎ চীৎকার করে ওঠে, এটা আবার কেন এল? এই রাক্ষুসীটা? তাড়িয়ে দাও তাড়িয়ে দাও ওটাকে। ঘাড় মটকে রক্ত খেতে আসছে।
অতনু একবার দীর্ঘছায়ার মালিক দুটোর মধ্যে একটার মুখের দিকে তাকায়। অনেকটা দূর থেকে ছুটে এসেছে যে অমিতার জন্যে হৃদয়ভরা ভালোবাসা নিয়ে।
কালো আর কঠিন হয়ে উঠেছে সে মুখ অবিশ্বাস্য অপমানে। অবিশ্বাসও যে ষোলআনা! দরজার বাইরে থেকে দেখে নি সে সেই কোলে আছড়ে পড়ার দৃশ্য? মনে মনে কি বলে নি ওঃ পাগল সেজে বৃন্দাবনলীলা চলছে?
ওই অবিশ্বাস আর অপমানে কঠিন কালো হয়ে যাওয়া মুখের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে অতনু বলে ওঠে, তোমার মতন মিথ্যে পাগলদের উচিত শাস্তি হচ্ছে কি জানো?
না, শাস্তির পদ্ধতিটা আর বলা হয় না, মিথ্যে পাগল পাগলীটা জানি দেখাচ্ছি বলে নিজেকে ভয়ঙ্কর একটা ঝাঁকুনি দিয়ে সকলের চোখে ধাঁধা লাগিয়ে বিদ্যুতের বেগে ছুটে উঠে যায় ছাতে।
অমিতা! অমিতা!
পিছনে দ্রুত ধাওয়া করছে মানুষ। তার থেকে এগিয়ে চলেছে মানুষের কণ্ঠের অমানুষিক আর্তনাদ।
অমিতা! অমিতা!
পায়ে পড়ি তোমার, অমন করে ঝুঁকো না।
কিন্তু কে কান দেবে সেই আর্তনাদে? কে ফিরবে সেই ডাকে?
মিথ্যে-পাগলের অপবাদে দিশেহারা হয়ে যে সত্যি উন্মাদিনী হয়ে উঠেছে, তার কি আর ফিরবার উপায় আছে? পাগল হয়ে গিয়েই যে প্রমাণ করতে হবে তাকে, সে পাগল হয়েছিল।
.
অসতর্কে ছাত থেকে পড়ে গেলে হয়তো বা বেঁচেও যায় মানুষ। ভেঙে-চুরে হাড় গুড়ো হয়েও বেঁচে থাকে।
কিন্তু উন্মত্ত আবেগের টান টান স্নায়ু শিরা নিয়ে ইচ্ছে করে ঝাঁপিয়ে পড়লে সে স্নায়ু শিরা কি অটুট থাকে?
না, থাকে না। ছিঁড়ে যায়।
তবু চেষ্টা করতে হবে বইকি। ত্রুটি হয় না সে চেষ্টার। সমস্ত বুদ্ধি আর বিবেচনার ত্রুটি ঢাকা পড়ে যায় যাতে, সেই রকম চেষ্টার।
মেয়ের বিয়েতে যত খরচ হয়েছিল জগন্ময়ের, তার বেশি খরচ হয়ে যায় ঘণ্টাকয়েকের ত্রুটিহীন চেষ্টায়।
ডাক্তার আসে, অ্যাম্বুলেন্স আসে, আত্মীয় আর বন্ধুজনে ছেয়ে যায় বাড়ি। তারপর হাসপাতালে গিয়ে পড়ে সমগ্র সংসার।
পাড়ার লোকে হায় হায় করে বলতে থাকে, ওমা ওদের ছাতে যে এখনো বিয়ের ম্যারাপের বাঁশ বাঁধা!
না, নিজ নিজ কর্তব্যের ত্রুটি কেউ করে না।
পুলিশের কর্তব্য পুলিশ করে। জেরায় জেরায় উৎখাত করে ঘরবার সবাইকে, বাড়িতে কারও সঙ্গে কোনও শত্রুতা ছিল কি না। কেউ ঠেলে ফেলে দিয়েছিল কি না। এই একান্নবর্তী পরিবারের মধ্যে একতা আছে কি না। অল্পবয়সী বিধবা মেয়ে, ভিতরে অন্য কোনও ব্যাপার ছিল কি না।
বাড়ির ডাক্তার আর সেই মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, তাঁরাই রক্ষা করলেন। তারাই গেরস্থকে উদ্ধার করলেন এই জেরার হাত থেকে।
সার্টিফিকেট দিলেন মস্তিষ্ক বিকৃতির।
একজন মরেছে বলে তো আর সংসারসুদ্ধ সকলের মরলে চলবে না! বাঁচতে হবে।
পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে হবে। লোকলজ্জার হাত থেকে বাঁচতে হবে।
.
অনেকগুলো ঘণ্টা পরে সহসা চোখ মেলে অমিতা। ব্যান্ডেজে ঢাকা আধখানা চোখ।
বাবা!
মা, ওমা, এই যে আমি। হাহাকার করে ওঠেন জগন্ময়।
কেন আমি অফিস চলে গেলাম মা! কেন তোকে কোলে করে বসে থাকলাম না!
আঃ কী করছেন– নার্স ঠেলে নিয়ে যায়, এইজন্যে খারাপ কেসে আমরা পেসেন্টের আত্মীয়দের অ্যালাউ করি না।
মাকে দেখতে চান?
না। শুধু ক্ষমা!
জড়িয়ে জড়িয়ে বলে মৃত্যুপথযাত্রিণী।
একটু পরে আবার নিঃশ্বাসের মত আস্তে উচ্চারণ করে, অতনু!
আর লজ্জা করবার সময় নেই!
এরপর নিজেকে চাবুক মেরে মেরে দেখবে অতনু, গায়ে তার মানুষের চামড়া আছে কিনা।
কিন্তু আর কি হবে দেখে?
অতনু!
বল! বল কি বলবে? বিছানার কাছে মুখ নামিয়ে আনে অতনু। নামিয়ে আনে সেই নিঃশ্বাসের মত মৃদু স্বরে শক্তির সীমানার মধ্যে।
বড় ক্লান্তিতে একটা নিঃশ্বাস ফেলে অমিতা। তারপর জড়ানো জড়ানো ক্লান্তস্বরে বলে, তোমার কথাই ঠিক। আমার কিছু হয়নি। আমি মিছিমিছি–
কেন এমন করেছিলে অমিতা? কেন এমন করেছিলে? আমায় এমন ভয়ঙ্কর শাস্তি দিলে কেন?
.
নেভার আগে প্রদীপের মত মৃত্যুনীল মুখে একটু হাসি ফুটে ওঠে, জব্দ করলাম তোমায়।
অমিতা! অমিতা!
কিন্তু অমিতা বুঝি ততক্ষণে বাইরের জগতের সঙ্গে লেনদেন চুকিয়ে ফেলেছে। হারিয়ে ফেলেছে সাড়া দেবার শক্তি।
লোভ…লোভ…নেশা…নেশা!…মহাদি তুমি যদি না আসতে!.আমি মরতে চাই নি।…আমি পাগল হতে চাই নি।…অতনু…তুমি কেন?
ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে আসে কণ্ঠস্বর…থেমে যায় অর্থহীন অসংলগ্ন কথা।
জগন্ময় চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কাঁদতে পারেন, জয়াবতী পারেন মাথা খুঁড়তে, কাকা খুড়িরা ঘন ঘন চোখ মুছতে পারে, দীপক পারে আকুল হয়ে মৃতার বিছানায় মুখ মাথা ঘষতে, অতনু কিছুই পারে না।
অতনু শুধু কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে খাটের বাজু ধরে।
যা পারে তাই করে অতনু। জ্বালাকরা শুকনো চোখে দাঁড়িয়ে থাকে। তাকিয়ে থাকে নীল হয়ে যাওয়া ওই মুখটার দিকে, যে মুখ থেকে মাত্র কিছু ঘণ্টা আগে উচ্চারিত হয়েছিল, বেশ, আর পাগলামী করব না। শুধু তুমি একবার আদর করো।
জীবনের সমস্ত কিছুর বিনিময়েও একটা চলে যাওয়া মুহূর্তকে ফিরিয়ে আনা যায় না।
কিন্তু যদি যেত? অতনু কি ওর সেই অসামাজিক ইচ্ছাটাকে পূরণ করতে করতে পারতো?
পারতো না।
পারলে, এখনই কি ওই চূর্ণবিচূর্ণ মৃত্যুবিবর্ণ দেহখানাকে বুকের মধ্যে ভরে নিতে পারতো না? নিজের দেহের সমস্ত স্নায়ু শিরা অস্থি মজ্জা মুচড়ে মুচড়ে দেওয়া যন্ত্রণাটাকে প্রকাশ করতে পারতো না উদ্দাম উন্মত্ত এক আদরের মূর্তিতে?
দুরন্ত সেই বাসনা তো লক্ষ বাহু মেলে ছুটে গিয়ে আছড়ে পড়তে চাইছে ওই দেহটার কাছে।
তবু কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অতনু।
কাঠ হয়েই দাঁড়িয়ে রইল শেষ পর্যন্ত, যতক্ষণ না মৃত্যুর মাশুল শোধ করা হল।
.
না, শোকে কেউ মরে না।
মা নয়, বাপ নয়, ভাই নয়, প্রেমাস্পদ নয়। অনেক ঝড় আর অনেক ঝঞ্ঝার পর আবার এক সময় যখন বাড়ি ফিরল সবাই, তখন আর শোক করবারও ক্ষমতা নেই কারুর।
সবাই এক গ্লাস করে শরবৎ খেয়ে শুয়ে বাঁচল।
অতনুর আবার শুয়ে পড়বারও জো নেই। জো নেই শুয়ে পড়ে থাকবার। ছুটি ফুরিয়েছে। তাকে চলে যেতে হবে।
এঁরা বললেন, আমাদের সঙ্গে ভাগ্য জড়িয়ে তুমিও অনেক ভুগলে বাবা, বলবার আর কিছু নেই। শুধু বলছিলাম, আর দুদিন বিশ্রাম করে যাওয়া যায় না?
অতনু শুকনো গলায় বলল, না।
ও বাড়িতে দাদা বৌদি বললেন, আর দুটো দিন থেকে গেলে কি খুব ক্ষতি হত?
অতনু বলল, হ্যাঁ।
পরের দুর্ভাগ্যে তোমারও তো কম দুর্ভোগ গেল না, চোখমুখ একেবারে বসে গেছে। ট্রেনে একটু খেয়ো ভাল করে।
খাব।
পৌঁছনো চিঠিটা দিতে বেশি দেরি কোর না, ভাবনায় থাকছি।
দেরি করবো কেন?
সত্যিই তো, দেরি করবে কেন?
এ পর্যন্ত কখন কোন্ সময় অতনু অস্বাভাবিক আচরণ করেছে? কেই বা করে?
অতনুর মত যারা সুস্থবুদ্ধি সহজ সাংসারিক নিয়মের মানুষ হয়?
একজন মরে যাচ্ছে বলেই যে কোনও অনিয়ম করা চলবে, তা তো আর সংসারের নীতি নয়।
অতনু যদি নিয়ম ভাঙতো, নীতি ভাঙতো, বিধিব্যবস্থার ব্যবস্থাকে জলাঞ্জলি দিত, তাহলে অমিতা বাঁচতো।
কিন্তু কী লাভ হতো সেই বাঁচায়? কে মূল্য দিত সেই জীবনকে?
মৃত্যু মহৎ, মৃত্যু সুন্দর, মৃত্যু সমস্ত ভালমন্দের উপর সমাপ্তির রেখা টেনে দিয়ে যায়, তাই মৃত্যুর চরণে জীবনের সমস্ত শ্রদ্ধার অর্ঘ্য। জীবন জানে মৃত্যুর হাতেই আছে সেই অমৃত, যা অমরত্ব এনে দেয়।
অমিতাকে বাঁচালে প্রতিদিনের তিল তিল মৃত্যুতে অমিতার মূর্তি বিকৃত হতো, কুৎসিত হয়ে উঠতো, ক্ষয়ে ক্ষয়ে নিঃশেষ হয়ে গিয়ে মূল্য হারাত।
মৃত্যু তাকে এক জ্যোতির্বলয়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করে রেখে গেল, সেখানে অমিতা ক্ষয়হীন সৌন্দর্যের মধ্যে বেঁচে থাকবে।
.
না, অতনু এসব কথা ভাবছে না।
অতনু অন্যকথা ভাবছে।
অতনু চলন্ত ট্রেনে বসে ধূ ধূ বিস্তৃত প্রান্তরের পানে চেয়ে শুধু বিগত সেই খানিকটা সময়কে বারবার উল্টেপাল্টে দেখছে।
অতনু যদি সেই নির্মমতার অভিনয়টুকু না করতো! মানুষ নিজেকেই সবচেয়ে ভালবাসে বইকি। তাই অমিতার মৃত্যুর চেয়েও দুঃসহ হয়ে উঠছে অতনুর, অমিতা তাকে পরম নিষ্ঠুর ভেবে গেল বলে!
কিন্তু এমনও তো হতে পারে, সবটাই অতনুর ভুল, অমিতা পাগলই হয়েছিল। পাগল না হলে কেউ পাগলের আচরণ করতে পারে?
অতনু কি পারছে ট্রেনের দরজাটা খুলে ওই ছুটন্ত প্রান্তরটায় ঝাঁপিয়ে পড়তে? যেমন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল অমিতা তিনতলার সেই ছাদটা থেকে?
পারছে না। অতনু পারছে না। ভয়ঙ্কর দুরন্ত সেই ইচ্ছের প্রলোভনকে জয় করে বসে আছে স্থির হয়ে হয়তো একটু পরে হাতের বইখানা খুলে ধরে পড়তে শুরু করবে।
তাছাড়া আর কি?
পাগল না হলে কেউ পাগলের আচরণ করতে পারে? অতনু হচ্ছে সেই স্বাভাবিকদের দলে, যারা মরবার মন্ত্রও জানে না, বাঁচবার মন্ত্র আবিষ্কার করতে শেখে নি! যারা উন্মাদ ইচ্ছের দুরন্ত আবেগকে প্রশমিত করতে পারে, শুধু হয়তো চোখের সামনে একটা বই খুলে ধরে।