০১. মিছিল

ধ্বনিটা অতিপরিচিতশব্দগুলোও বহুপরিচিতচেয়ার থেকে উঠে জানলার ধারে না গেলেও বোঝা যেত কারা চলেছে মিছিল করেআর কী বলে চলেছে তারা। মিছিল তো চন্দ্রসূর্যের মতই নিত্য ঘটনা। কানের পর্দায় যেন লেগেই থাকে ধ্বনিটাচলবে নাচলবে নাযেন অহরহই মস্তিষ্কের কোযে কোষে ধাক্কা মারেমানতে হবেমানতে হবে, আমাদের দাবী মানতে হবে।

তবু হাতের কলম নামিয়ে রেখে জানলায় এসে দাঁড়ালেন অনামিকা দেবী!

কিন্তু কেন দাঁড়ালেন?

মিছিলের ওই উচ্চরোলে লেখার ব্যাঘাত ঘটছিলো বলেনাকি নেহাৎই অকারণ কৌতূহলেহয়তো তাই। অকারণ কৌতূহলেই। শুধু জেনে নেওয়ানতুন কোন অন্যায় বা অত্যাচারের বিরুদ্ধে আজকের এই প্রতিবাদ। নইলে রাস্তার গোলমালে লেখার ব্যাঘাত ঘটলে চলে না

কলকাতা শহরের এমন একটি জনবহুল রাস্তার একেবারে মোড়ের ধারের বাড়িতে যাদের আজন্মের বাসএই কোলাহলের মাঝখানে বসেই যার কলম ধরার শুরুতার কি করে এ আবদার করা সম্ভবনিঃশব্দে নির্জনতার গভীরে মগ্ন হয়ে লিখতে চাই আমি!

বিচিত্র শব্দবিরক্তিকর কোলাহল আর অগণিত মানুষের আনাগোনার মধ্যে থেকেই তো সাধনা করে যেতে হয় শহরে সাহিত্যিকদের। প্রতিক্ষণই করতে হয় প্রতিকূলতার সঙ্গে সংগ্রামকিন্তু একেবারে স্তব্ধ শান্ত স্তিমিত পল্পীজীবনের পরিবেশই কি সাধনার নিতান্ত অনুকূলতেমন পরিবেশ পেলেই অনামিকা দেবী আরো অধিক লিখতে পারতেনঅধিকতর উচ্চমানেরঅধিকতর মননশীল?

অপরাপর শহরবাসী কবি সাহিত্যিকরা কী বলেনকী মনোভাব পোষণ করেনঅনামিকা দেবীর জানা নেইমনের কথার আদানপ্ৰদান হবে এমন অস্তরঙ্গ তাই বা কার সঙ্গে আছেতবে নিজে তিনি তা বলেন না। তা ভাবেন না।

তাঁর মনে হয়শহরের মুহূর্তে মুহূর্তে পরিবর্তনশীল উত্তাল জীবনরসের মধ্যেই সাহিত্যের তীব্ৰ তপ্ত জীবনীরস। শহরের অফুরন্ত বৈচিত্র্যের মধ্যেই সাহিত্যের অফুরন্ত উপাদান।

নির্জনতার শাস্তিতে গতিবেগ কোথায়শহরের নাড়ি সর্বদাই জ্বরতপ্ত চঞ্চল। সেই জ্বর ছাড়াবার ওষুধ জানা নেই কারোতবু একথা সবাই জানে ওই জুরাটাই প্রেরণা দিচ্ছে শিল্পকেসাহিত্যকেজীবনচিস্তাকে। এই জুরাটাই বরং রোগীকে চাঙ্গা করে রেখেছে।

তাই কোলাহলকে কখনো বাধা স্বরূপ মনে হয় না। অনামিকা দেবীর। তিনি সর্বদা এই কথাই বলেনআমি জনতার একজন। আমি জনতার সাহিত্যিক। কোলাহল থেকেই রস আহরণ করে নেওয়া আমার কাজ।

কিন্তু অনামিকা দেবীর সেই কবি সেজদিতিনি কিন্তু অন্য কথা বলেনতিনি বরং বলেনধন্যবাদ দিই তোকে। এই কলরবের মধ্যে লিখিস!

তা তিনি একথা বলবেন সেটাই স্বাভাবিক। অনামিকা দেবী যদি জনতার তো তিনি নির্জনতার।

তিনি কবি।

ইচ্ছের কবি।

তিনি তাঁর সেই মফঃস্বলের বাড়িটিতে নিঃসঙ্গতায় নিমগ্ন হয়ে বসে সেই ইচ্ছার ফুলগুলি ফোঁটান। সেইগুলিই হয়তো তার সঙ্গী।

অনামিকা দেবীর ভূমিকা আলাদা।

এ যুগের আরো সকলের মতইঅহরহ পরের ইচ্ছের বায়না মেটাতে হয় তাঁকে! পরের ইচ্ছেয় পরিচালিত হতে হয়

মনের মধ্যে ওই মিছিলের ধ্বনি উঠলেও মেটাতে হয়

জানলার ধারে এসে দাঁড়ালেন অনামিকা দেবীনীচের দিকে তাকালেনমানুষের প্রাচীর এগিয়ে চলেছে একটা অখণ্ড মূর্তিতেআর যান্ত্রিক একটা শব্দ উঠছে তা থেকে চলবে না! চলবে না!

হঠাৎ অদ্ভুত একটা কৌতুক বোধ করলেন অনামিকা দেবী।

একদিক থেকে অবিরাম প্রতিবাদ উঠবে চলবে না চলবে নাআর একদিকে অব্যাহত গতিতে চলেই চলবে সেই অসহনীয়।

কোটি কল্পকালের পৃথিবীর বুকে কোটি কোটি বছর ধরেই চলেছে এই লীলা। পাশাপাশি চলেছে। অন্যায় আর তার প্রতিবাদ। আজকের মিছিলটা যে বিশেষ একটা কিছু তা বোঝা যাচ্ছে তার দৈর্ঘ্যেশেষ হয়েও শেষ হচ্ছে না। একবার স্তিমিত হয়ে আসছে আওয়াজআবার পিছন থেকে আসছে নতুন আওয়াজের ঢেউ।

অবশেষেঅনেকক্ষণের পর হালকা হয়ে এল দলফিকে হয়ে এল ধ্বনিযারা পিছিয়ে পড়েছিল তারা ছুটে ছুটে আসছেতাদের ফাঁকে ফাঁকে অন্য অন্য পথচারীর চেহারা দেখা যাচ্ছে।

দূরে এগিয়ে যাওয়া আওয়াজটা নিয়মমাফিক কমে কমে আসছে।

জানলা থেকে আবার ফিরে এলেন অনামিকা দেবী। চেয়ারে এসে বসলেনকলামটা হাতে তুলে নিলেন। কিন্তু চট করে যেন মনে এল না কি লিখছিলেনঅন্যমনস্কের মত সম্পূর্ণ অবান্তর একটা কথা মনে এল। লেখার কথা নয়ওই মিছিলের কথা নয়দেশের বহুবিধ অন্যায় অনাচার দুর্নীতি আর রাজনীতির কথাও নয়মনে এল। এই বাড়িটা যখন তৈরী হয়েছিল তখন এপাশেওপাশে ফাঁকা ফাকা মাঠ পড়ে ছিল।

এখন সমস্ত রাস্তাটা যেন দম আটকে দাঁড়িয়ে আছে।

কিন্তু বাড়িটা কি আজ তৈরী হয়েছেকত দিন মাস বছর পর হয়ে গেল তার হিসেব করতে হলে বুঝি খাতা পেনসিল নিয়ে বসলে ভাল হয়

অনামিকা দেবী ভাবলেনআমি এর শৈশব বাল্য যৌবন আর এই প্রৌঢ়াবস্থা সব অবস্থার সাক্ষী। অথবা এই বাড়িটাই আমার সমস্ত দিন মাস বছরের সাক্ষী। এর দেওয়ালে দেওয়ালে লেবা আছে আমার সব কথা

আচ্ছাদেওয়াল কি সত্যি সাক্ষ্য দিতে পারেসে কি সব কথা ধরে রাখতে পারে অদৃশ্য কোনো অক্ষরেবিজ্ঞান এত করছেএটা করতে পারে না কোনো দিনমৌন মূক দেওয়ালগুলোকে কথা কইয়ে ইতিহাসকে পুরে ফেলবে হাতের মুঠোয়! নির্ভুল ইতিহাস!

টেলিফোনটা ডেকে উঠলো ঘরের কোণ থেকে। আবার চেয়ার ছেড়ে উঠলেন অনামিকা দেবীরিসিভারটা তুলে নিলেন হাতে।

টেলিফোনটা লেখার টেবিলে রাখাই সুবিধেসময় বঁচেপরিশ্রম বাঁচেতবু কোণের ওই ছোট্ট টেবিলটার উপরেই বসিয়ে রাখেন সেটা অনামিকা দেবী। এটা তার এক ধরনের শপ। বার ব্যার উঠতে হলেও।

থেমে থেমে কেটে কেটে বললেনহ্যাঁআমি কথা বলছিবলুন কি বলছেন?..নতুন পত্রিকা বার করছেনশুনে খুশি হলাম। শুভেচ্ছা জানাচ্ছিসাফল্য কামনা করছি।লেখামানে গল্পপাগল হয়েছেন?…কী করবো বলুনঅসম্ভবসম্পূর্ণ অসম্ভব।উপায় থাকলে না করতাম না।বেশ তো চলুক না কাজপয়ে হবে। কী বলছেনআপনি বলব নাবয়সে আপনি আমার থেকে অনেক ছোটঠিক আছেনা হয় তুমিই বলা যাবে। কিন্তু গল্প তো দেওয়া যাচ্ছে না।কীকী বলছেনকথা দিয়ে রাখবো?…না না। ওইটি পারবো নাকথা দিয়ে বসে থাকতে থারবো না। সে আমাকে বৃশ্চিকযন্ত্রণা দেবে।...তা বটে। বুঝছি তোমার খুব দরকারকিন্তু উপায় কি?

উপায় কি? অপর অর্থ নিরুপায়। তা সত্ত্বেও ও-পক্ষ তার নিজের নিরুপায়তার কথা ব্যক্ত করে চলে এবং কথার মাঝখানে এমন একটু কমা সেমিকোলন রাখে না, ফাঁকিটুকুতে ফুলস্টপ বসিয়ে দিতে পারেন অনামিকা দেবী।

অতএব শেষ পর্যন্ত বলতেই হয়আচ্ছা দেখি।

পক্ষের উদ্দণ্ড কণ্ঠের ধ্বনি এ ঘরের দেওয়ালে ধাক্কা মারেনা নাদেখিটেখি নয়। আমি নাম অ্যানাউন্স করে দিচ্ছি।

ছেড়ে দিলো এবার।

অনামিকা দেবীকে আর কিছু বলবার অবকাশ না দিয়ে

অনামিকা দেবী জানেনএরপর যদি তিনি সময়ে লেখা দিয়ে উঠতে না পারেনতাহলে ওই ভাবী সম্পাদক ভদ্রলোক এখানে সেখানে সকরুণ গলায় বলে বেড়াবেনকী করবো বলুনকথা দিয়ে যদি কথা না রাখেনএই তো আমাদের দেশের অবস্থা। কেউ একটু নাম করলেন কি অহঙ্কারআমাদেরও হয়েছে শাঁখের করাত। ওনাদের লেখা না নিলেও নয়–।

বলেন বটে না নিলেও নয়কিন্তু আসল ভরসা রাখেন তঁরা সিনেমাস্টারদের ছবির উপর। তারা কী ভাবে হাঁটেনকী ভাবে চলেনকোন ভঙ্গীতে কলা ছাড়িয়ে মুখে ফেলেনকোন ভঙ্গীতে দোলে আবীর ছড়ানইত্যাদি প্রভৃতি সবওই ভঙ্গীগুলিই ওদের পত্রিকার মূল জীবনীরসতা ছাড়া তো আছে ফিচার। তথাপি গল্পউপন্যাসও আবশ্যকসব শ্রেণীর পাঠককেই তো মুঠো পুরতে হবে। আর সেক্ষেত্রে ওই নাম করে ফেলা লেখকদের লেখা নেওয়াই নিরাপদপাণ্ডুলিপিতে চোখ বোলাতে হয় নাসোজা প্রেসে পাঠিয়ে দেওয়া যায়। নতুন কাগজের সম্পাদকও এ ছাড়া নতুন কিছু করবেন কি?

আগে নাকি সাংবাদিকতার একটি পবিত্র দায়িত্ব ছিল। সম্পাদকেরা নাকি লেখক তৈরী করতেনতৈরী করতেন পাঠকও অনামিকা দেবী যে সে বস্তু দেখেননি তা নয় তাঁর জীবনেই তিনি একদা সেই উদার আশ্রয় পেয়েছেন।

কিন্তু কদিনের জন্যেই বা?

সেই মানুষ চলে গেলেন।

তারপর কেমন করে যেন অনামিকা দেবী এই হাটে দাঁড়িয়ে গেছেনচালিয়ে যাচ্ছেন। বাংলা দেশের পাঠকপাঠিকারা অনামিকা দেবীকে ভালবাসে।

রিসিভার নামিয়ে রেখে আবার এসে কলম নিয়ে বসলেন অনামিকা দেবীআর ওর ভাইঝি। শম্পার কথাটা আবার নতুন করে মনে এল।

আচ্ছা পিসিতত্বার ওঠা উঠি করতে হয়ওটাকে তো তোমার লেখার টেবিলে রেখে দিলেই পারে।

অনামিকা দেবী নিজের উত্তরটাও ভাবলেননাঃ! টেবিলে টেলিফোন বসানো থাকলেঘরটাকে যেন অফিস ঘর অফিস ঘর লাগে।

হ্যাঁএই কথাই বলেন বটেকিন্তু আরও কারণ আছে। আর হয়তো সেটাই প্রকৃত কারণ। মাঝে মাঝেই একটি তাজা আর সপ্ৰতিভ গলা কথা কয়ে ওঠেশম্পাকে একটু ডেকে দিন তো!

ডেকে দেন অনামিকা দেবী।

শম্পা আহ্লাদে ছলকাতে ছলকাতে এসে ফোন ধরে। পিসির দিকে পিঠ আর দেওয়ালের দিকে মুখ করে গলা নামিয়ে কথা বলে মিনিটের পর মিনিটঘণ্টায় গিয়ে পৌঁছয়

টেবিলে রাখলে অসুবিধে উভয় পক্ষেরই। শম্পার জীবনে এখন একটি নতুন প্রেমের ঘটনা চলছে। এখন শম্পা সব সময় আহ্লাদে ভাসছে।

অনামিকা দেবী সঠিক খবর জানেন নাসত্যি কিছু আর সব খবর রাখেনও নাতবু যতটুকু ধারণা তাতে হিসেব করেনশম্পার এ ব্যাপারে এই নিয়ে সাড়ে পাঁচবার হলো। সাড়ে অর্থে এটা এখনও চলছেতার মানে অর্ধপথে।

প্রথম প্রেমে পড়েছিল শম্পা ওর দূরসম্পর্কের মামাতো দাদা বুবুলের সঙ্গে। শম্পার তখন এগার বছর বয়েসবুবুলের বছর সতেরো।

মফঃস্বলের কোনো স্কুল থেকে স্কুল ফাইনাল পাস করেজায়গার অভাবে এই দূর সম্পর্কের পিসির বাড়িতে থেকে কলেজে পড়তে এসেছিল বুবুল।

চাঁদের মত ছেলেমধুর মত স্বভাবনিঃস্বও নয়। বাপ টাকা পাঠায় রীতিমত। কার আর আপত্তি হবেপিসিরও হল না। মানে অনামিকার ছোটবৌদির।

কিন্তু জোরালো আপত্তি হল তার ভাইপোর সঙ্গে মেয়ের প্রেমে পড়ায়তিনি প্রথমে বিনিপয়সায় বাড়িতে এসেপড়া (যেগুলোর জন্যে অনামিকা দেবী দায়ীরাশি রাশি সিনেমা পত্রিকার দোষ দিলেনঅনামিকা দেবী রচিত প্ৰেমকাহিনীগুলির প্রতি কটাক্ষপাত করলেনতারপর মেয়েকে তুলে ধুনলেন এবং ভাইপোকে পথ দেখতে বললেন।

এগারো বছরের মেয়ের উপর এ চিকিৎসা চালানো গেলঅনামিকা দেবীর ছোটবৌদি ভাবলেনযাকশিক্ষা হয়ে গেল। আর প্রেমে পড়তে যাবে না মেয়ে

কিন্তু কী অলীক সেই আশা!

সাড়ে বারো বছরেই আবার প্রেমে পড়ল। শম্পাপাড়ার এক স্টেশনারী দোকানের সেলসম্যান ছোকরার সঙ্গে। খাতা পেনসিল রবার আলপিন চকোলেট ইত্যাদি। কিনতে গিয়ে আলাপের শুরুতারপর কোন ফাঁকে আলাপ গিয়ে প্ৰেমালাপের পর্যায়ে উঠে বসলো। বিনা পয়সায় চকোলেট আসতে লাগলো।

এটা বেশ কিছুদিন চাপা ছিলউদ্‌ঘাটিত হলো একদিন পাড়ার আর একটি ছেলের দ্বারা। হয়তো নিজে সে প্রার্থী ছিলতাই বলে দিয়ে আক্রোশ মেটালো।

খবরটা বাড়িতে জানাজানির পর দিনকতক শম্পার গতিবিধির দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা হলোশম্পার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে এনে দেওয়ার ভার নিলো তার বাবা। কিন্তু প্রয়োজন তো শম্পার জিনিসের নয়প্রেমের।

অতএব কিছুদিন মনমরা হয়ে ঘুরে বেড়ালো শম্পাতারপর আবার নতুন গাছে বাসা বাঁধলো। এবারে এক সহপাঠিনীর দাদা।

এ খবরটা বাড়িতে এসে পৌঁছবার কথা নয়। কারণ সহপাঠিনী সহায়িকা। সে তার বান্ধবীকে এবং দাদাকে আগলে বেড়াতে যত রকম বুদ্ধিকৌশল প্রয়োগ করা সম্ভব তা করতে ত্রুটি করেনি।

কিন্তু খবরটা তথাপি এলো

এলো অনামিকা দেবীর কাছে।

প্ৰণয়ভঙ্গের পর।

শম্পা নিজেই তার লেখিকা পিসির কাছে বাক্ত করে বসলো। কারণ শম্পার তখন বয়স বেড়েছেসাহস বেড়েছে। একদিন অনামিকা দেবীর এই তিনতলার ঘরে এসে বললোপিসিএকটা গল্পের প্লট নেবে?

তারপর সে দিব্যি একখানি প্ৰেমকাহিনী ব্যক্তি করার পর প্রকাশ করলো প্লটের নায়িকা সে নিজেই। এবং স্বচ্ছন্দ গতিতে সব কিছু বলার পর হেসে কুটিকুটি হয়ে বলতে লাগলোবল তো পিসিএরকম বুদ্ধমার্কা ছেলের সঙ্গে কখনো প্রেম চালানো যায়না তাকে সহ্য করা যায়?

অনামিকার নিজের গল্পের অনেক নায়িকাই দুঃসাহসিকা বেপরোয়ামুখরা প্রখরা। তথাপি অনামিকা তার নিজের দাদার মেয়েনিজের বাবার নাতনীর এই স্বচ্ছন্দ বাকভঙ্গীর দিকে তাকিয়ে রইলেন অভিভূত দৃষ্টি মেলে।

শম্পা বললোলিলি তো আমার ওপর মহা খাপপাওর দাদার নাকি অপমান হয়েছে।

তা সেটাই স্বাভাবিক।

বলেছিলেন অনামিকা দেবী।

শম্পা হেসে হেসে বলেছিলতা কি করা যাবেউনিশ বছর এখনো পার হয়নিসবে থার্ড ইয়ারে ঢুকেছেবলে কি না তোমার পিসিকে বলেকয়েহি হি হি,—বিয়ের কথাটা পাড়াও!

অনামিকা দেবী মৃদু হেসে বলেছিলেনতা তুমিও তো এখনো স্কুলের গণ্ডি ছাড়াওনিসবে পনেরো বছরে পা দিয়েছ

তা আমি কিহি হিবিয়ের চিন্তা করতে বসেছি?

প্রেম করছো!

শম্পা লেশমাত্র অপ্রতিভ না হয়ে বলেছিলসে আলাদা কথা। ওটা হচ্ছে একটা চার্ম। একটা থ্রিলও বলতে পারো। তা বলে বিয়েহি হি হি!

তা সেই বুদ্ধুটাকে ত্যাগ করার পর শম্পা অন্ততঃ মনমরা হয়ে বেড়ালো না। সাঁতার ক্লাবে ভর্তি হলোআবদার করে সেতার কেনালো।

মা পিসি বাপ ঠাকুমা সরাই ভাবলোএটা মন্দ নয়বেটা ছেলেদের সঙ্গে হৈচৈ করে বেড়ানোর থেকে ভাল। দাদা তখন নিজের ব্যাপারেই মগ্নএকটা স্কলারশিপ যোগাড় করে বিলেত যাবার তাল করছেতুচ্ছ একটা বোন আছে কিনা তাই মনে নেই। তাছাড়া শম্পার মাও মেয়ের ব্যাপারটা সাবধানে ছেলের জ্ঞানগোচর থেকে তফাতেই রাখতে চেষ্টা করতেন। যা কিছু শাসন চুপি চুপি

কিন্তু শম্পা চার্ম চায়।

তাই শম্পা তাদের ওই সাঁতার ক্লাবের এক মাস্টার মশায়ের প্রেমে হাবুড়ুবু খেতে শুরু করলো। বোধ করি তিনিও এর সদ্ব্যবহার করতে লাগলেন।

সাঁতারের ঘণ্টা বেড়েই চলতে লাগল এবং বেড়ে চলতে লাগলো। শম্পার সাহস।

অতএব ক্রমশঃ মা বাবা শাসন করবার সাহস হারাতে লাগলো। দাদা তো তখন পাড়ি দিয়েছে সমুদ্রপারে। শম্পার বাড়ি আরো বেড়ে যায়। শম্পাকে এক কথা বললে,—একশো কথা শুনিয়ে দেয়বাড়ি ফিরতে রাত হয়েছে বলে রাগারাগি করলে পরদিন আরো বেশী রাত্তির করেবেরোতে হবে না বললে তৎক্ষণাৎ চটি পায়ে গলিয়ে বেরিয়ে যায়। বলেহারেমের যুগে বাস করছে নাকি তোমরা?

বাবা রাগ করে বললোমরুকগে। যা খুশি করুকগে।

অনামিকা দেবী বললেনভালো দেখে একটা বর খোজো বাপুসব ঠিক হয়ে যাবে। সময়ে বার না পেয়েই মেয়েগুলো আজকাল বর্বর হয়ে উঠছে। লেখিকার মতো নয়। অবশ্য কথাটানিতান্তই মাসিপিসির মত কথা।

শম্পার মা কথাটা নস্যাৎ করলেন। বললেনসবে ফাস্ট ইয়ারে পড়ছেএক্ষুনি বিয়ে দিতে চাইলে লোকে বলবে কিতাছাড়া কৃতী ছেলেই বা পাবো কোথায় বয়সের সঙ্গে মানানোআমাদের আমলের মতো দশবারো বছরের বড় বর তো আর ধারে দিতে পারি না?

কি আর করা। তবে?

শম্পাই ছেলে ধরে বেড়াতে লাগলো। সাঁতারুকেও ত্যাগ করলো একদিন লোকটার কথাবার্তা বড় একঘেয়ে বলে।

তারপর কিছুদিন খুব উঠে পড়ে লেগে লেখাপড়া করলে শম্পামনে হলো এইবার বুঝি বুদ্ধি থিতিয়েছে।

কিন্তু নিজে মুখেই স্বীকার করে গেল একদিন শম্পা পিসির কাছেএকটা প্ৰেমট্রেম থাকবে নাকেউ আমার জন্যে হাঁ করে বসে থাকবে নাআমায় দেখলে ধন্য হবে নাএ ভালো লাগে নাবুঝলে পিসিকিন্তু সত্যি প্রেমে পড়তে পারি এমন ছেলে দেখি না!

তা যখন সত্যি প্রেমের প্রশ্ন নেইতখন আজেবাজেতেই শুধু চার্ম খুঁজলে বা ক্ষতি কিসেই সময়টায় শম্পা একজন ক্যাবলীমার্কা প্রফেসরের প্রেমে পড়লো।

প্রফেসারটি যদিও বিবাহিত।

কিন্তু তাতে কিশম্পা বললেআমি তো আর তাকে বিয়ে করতে চাইছি নাশুধু একটু ঘোল খাওয়ানো নিয়ে কথা।

সেই ঘোল খাওয়ানো পর্বটার পর কলেজলাইব্রেরীর লাইব্রেরীয়ান ছোকরার সঙ্গে কিছুদিন এখন শম্পার আর একটি চলছে।

অনামিকা আর একবার লেখায় মন দেবার চেষ্টা করেছিলেনফোনটা আবার বেজে উঠলো।

একটি তাজা সপ্রতিভ কণ্ঠ বলে উঠলোশম্পাকে একটু ডেকে দিন তো।

ডেকে দিলেন।

শম্পা উঠে এল।

বললেবাবাঃতোমার এই তিনতলায় উঠতে উঠতে গেলামকই দেখি আবার কে বকবকাতে ডাকছে!…এই নাওনীচে তোমার একটা চিঠি এসেছিল

টেবিলের ওপর খামের চিঠিটা রেখে পিসির দিকে পিঠ আর দেওয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়ালো শম্পা রিসিভারটায় কানমুখ চেপে।

অনামিকা দেবী খামের মুখটা না খুলেই হাতে ধরে নাড়াচাড়া করতে লাগলেন। সেজাদির চিঠি।

অনেক দিন পরে এসেছে। সেজদি আর চিঠিপত্র লেখে না।

 

কিন্তু অনামিকাই বা কত চিঠি দিচ্ছেনশেষ কবে দিয়েছেন মনেও পড়ে না। অথচ কত চিঠিই লিখে চলেছেন প্রতিদিন রাশি রাশি। আজেবাজে লোককে। সেজদি বড় অভিমানী। কাজে সারা চিঠি চায় না সে।

০২. সেজদি বড় অভিমানী

সেজদি বড় অভিমানী।

সে অভিমানের মূল্যও আছে অনামিকা দেবীর কাছে। অনেকখানি আছে। তবু সেজদির চিঠির উত্তর দেওয়া হয়ে ওঠে না। নিজে থেকেও একখানা চিঠি সেজদিকে দেওয়া হয়ে ওঠে কই! অথচ সেই না হয়ে ওঠার কাঁটাটা ফুটে থাকে মনের মধ্যে। আর সেই কাঁটা ফোটা মন নিয়েই হয়তো অন্য সাতখানা চিঠি লিখে ফেলেন। মানে লিখতে হয়।

বাংলা দেশের অসংখ্য পাঠক-পাঠিকা অনামিকা দেবীর লেখা ভালবাসে, তাই অনামিকা দেবীকেও ভালবাসে, সেই ভালবাসার একটা প্ৰকাশ চিঠি লিখে উত্তর পাবার প্রার্থনায়। সেই প্রার্থনায় থাকে কত বিনয়, কত আবেগ, কত সংশয়, কত আকুলতা!

অনামিকা দেবী তাদের বঞ্চিত করবেন?

তাদের সেই সংশয় ভঞ্জন করবেন না?

সামান্য একখানি চিঠি বৈ তো নয়!

চিঠিও নয়, চিঠির উত্তর।! কিঞ্চিৎ ভদ্রতা, কিঞ্চিৎ মমতা, কিঞ্চিৎ আন্তরিকতা, মাত্র এইটুকু। সেটুকু দিতে না পারলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবেন কি করে অনামিকা দেবী? তাছাড়া তাদের কাছেই বা অনামিকা দেবীর মূর্তিটা কোন ভাবে প্রকাশিত হবে?

হয়তো ওই কয়েক ছত্র লেখার অভাবে তাদের ক্যামেরায় অনামিকা দেবীর চেহারাটা হয়ে দাঁড়াবে উন্নাসিক অহঙ্কারী অভদ্র!

অনামিকা দেবী তা চান না।

অনামিকা দেবী নিজের বাইরের চেহারাটা ভিতরের মতই রাখতে চান। সামান্য অসতর্কতায়, ঈষৎ অবহেলায় তাতে ধুলো পড়তে দিতে চান না। এছাড়া প্রয়োজনীয় চিঠিপত্রের সংখ্যাও তো কম নয়? গতানুগতিক সাধারণ জীবনের বাইরে অন্য কোনো জীবনের মধ্যে এসে পড়লেই তার একটা আলাদা দায়িত্ব আছে।

সে সব দায়িত্ব সম্ভবমত পালন করতেই হয়। অস্তুতঃ তার চেষ্টাটাও করতে হয়। ব্যবহারটা যেন ত্রুটিহীন হয়।

অতএব কিছুই হয় না। শুধু একান্ত প্রিয়জনের ক্ষেত্রে।

সেখানে ত্রুটির পাহাড়।

সেখানে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ভারী হয়ে ওঠে অপরাধের বোঝা। তবু ‘হয়ে ওঠে না’।

কিন্তু কারণটা কি? ওই সাতখানার সঙ্গে আর একখানা যোগ করা কি এতই অসম্ভব?

হয়তো অসম্ভব নয়। কিন্তু আবার অসম্ভবও। প্রিয়জনের পত্র দায়সারা করে লেখা যায় না। অস্তুতঃ অনামিকা দেবী পারেন না। অনামিকা দেবী তার জন্যে চান একটুকরো নিভৃতি। একমুঠো অবকাশ। ‘অনামিকা দেবী’র খোলসের মধ্যে থেকে নিজেকে বার করে এনে খোলা মনের ছাদে এসে বসা।

কিন্তু কোথায় সেই নিভৃতি?

কোথায় সেই অবকাণ?

কোথায় সেই নিজেকে একান্তে নিয়ে বসবার খোলা ছাদ?

নেই। মাসের পর মাস সে অবস্থা অনুপস্থিত।

তাই ত্রুটির পাহাড় জমে। তাই প্রিয়জনের খামের চিঠি খোলার আগে বুকটা দুরু দুরু করে। মনে হয় খোলার সঙ্গে সঙ্গে ওর মধ্যে থেকে টুক করে যেটুকু খসে পড়বে, সে হচ্ছে একখণ্ড উদাসীন অভিমান।

কিন্তু প্রিয়জনের সংখ্যা অনামিকা দেবীর কত?

.

খামখানা খোলার আগে তার উপর মৃদু একটু হাত বোলালেন অনামিকা। যেন সেজদির অভিমানের আবরণটুকু মুছে ফেলতে চাইলেন, তারপর আস্তে খামের মুখটা খুললেন।

আর সেই সময় টেলিফোনটা আবার ঝনঝনিয়ে উঠলো।

অনামিকা দেবী আছেন?

কথা বলছি।

শুনুন আমি বাণীনগর বিদ্যামন্দির থেকে বলছি—

বললেন তিনি তাঁর বক্তব্য। অনামিকা দেবীর কথায় কানমাত্র না দিয়ে জোরালো গলায় যা জানালেন তা হচ্ছে, এই উচ্চ আদর্শপূত বিদ্যামন্দিরের পারিতোষিক বিতরণ উৎসবে ইতিপূর্বে অনেক মহা মহা ব্যক্তি এসে গেছেন, এবার অতঃপর অনামিকা দেবীর পালা।

অতএব ধরে নিতে হয় এই সূত্রে অনামিকা দেবী মহামহাদের তালিকায় উঠলেন। অথবা ইতিপূর্বে উঠেই বসেছিলেন, শুধু পালাটা আসতে বাকি ছিল।

অনামিকা দেবীর ক্ষীণ প্রতিবাদ মৃদু আপত্তি বানের জলে ভেসে গেল। ওপিঠ থেকে সবল ঘোষণা এল, কার্ড ছাপতে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

.

সেজদির চিঠিটা অনেকক্ষণ আর পড়তে ইচ্ছে হল না। যেন একটা কোমল সুরের রেশের উপর কে তবলা পিটিয়ে গেল।

তারপর খুলে পড়লেন।

সেজদি লিখেছে–

অনেক তো লিখেছে। কাগজ খুললেই অনামিকা দেবী, কিন্তু সেটার কি হল? সেই বকুলের খাতাটার?
খাতাখানা পোকায় কেটে শেষ করেছে? নাকি হারিয়ে গেছে? কিন্তু—

কিন্তু বলে ছেড়ে দিয়েছ। সেজদি।

আর কোনো কথা লেখেনি।

শুধু তলায় নাম সই—সেজদি।

চিঠি লেখার ধরনটা সেজদির বরাবরই এই রকম। চিঠির রীতিনীতি সম্পর্কে মোটেই নিষ্ঠা নেই তার। বাড়ির যাকেই চিঠি দাও, বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের যথাবিহিত সম্মান ও আশীৰ্ব্বাদ জানানো যে একান্ত অবশ্যক, চিঠিটা যে প্রধানত কুশল বিনিময়ের উদ্দেশ্যে, আর পরিচিত জগতের সব কিছু খবরের আদান-প্ৰদানটাই যে আসল প্রসঙ্গ হওয়া সঙ্গত, এ বোধ নেই সেজদির। চিঠিতে সেজদি হঠাৎ যেন কথা কয়ে ওঠে। আর কথা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে যাওয়াটা যেমন স্বভাব তারা, তেমনিই হঠাৎ থেমে যায়। তাই কিন্তু বলে থেমে গেছে।

কিন্তু বক্তব্যটা শেষ করলে বুঝি অনামিকার মনের মধ্যে এমন একটা কণ্টক প্রবেশ করিয়ে দিয়ে রাখতে পারতো না সেজদি।

অনামিকা চিঠিটা শেষ করে তার সেই অশেষ বাণীটি চিন্তা করতে লাগলেন।

বকুলের খাতার কি হল?

অনামিকা দেবী কি সেটা হারিয়েই ফেলেছেন? না সত্যিই অবহেলায় ঔদাসীন্যে পোকায় কাটিয়ে শেষ করেছেন?

কোথায় সেই খাতা?

অনামিকা কি খুঁজতে বসবেন?

.

কিন্তু সেই অনেকদিনের আগের অনাদৃত খাতাটা খোঁজবার সময় কোথায় অনামিকার? আজই একটা সাহিত্য সম্মেলন উপলক্ষে উত্তরবঙ্গে যেতে হচ্ছে না তাকে? গোটাতিনেক দিন সেখানে যাবে, তারপর ফিরে এসেই ওই বাণীনগর বিদ্যামন্দির, তার পরদিন বিশ্বনারী প্ৰগতি সংঘ, দুর্গার পরদিন যুব উৎসব, তারপর পর পর তিন দিন কোথায় কোথায় যেন। ডায়েরি খাতা দেখতে হবে।

বকুলের খাতা তবে কখন খোঁজা হবে? ধুলোর ন্তর সরিয়ে কখন খুলে দেখা হবে? দিন যাচ্ছে ঝড়ের মত, সেই ঝড়ের ধুলো গিয়ে জমছে সমন্ত পুরনোর উপর, সমন্ত তুলে রাখা সঞ্চয়ের উপর।

সেজদির সেই এখানে বাতাস নেই নামের কবিতায় লেখা চিঠিটার কথা মনে পড়লো। বরের উপর, অথবা জীবনের উপরই অভিমান করে সেজদি একদা কবিতা লেখা বন্ধ কয়ে দিয়েছিল। প্রেমের কবিতা আর লিখতে না।

সেজদির বর অমলবাবুর ধারণা ছিল, ভিতরে ভিতরে একটি প্রণয়কাণ্ড আর গোপন কোনো প্ৰেমাস্পদ না থাকলে এমন গভীর প্রেমের কবিতা লেখা সম্ভব নয়।

আদি অনন্তকালের সমন্ত মানুষের মধ্যেই যে অল্প বিন্তর একটি প্রণয়কাণ্ড থাকে, আর চিরন্তন এক প্ৰেমাস্পদও অবিনশ্বর মহিমায় বিরাজিত থাকে, হৃদয়ের সমন্ত আকূতি সেখানে গিয়েই আছাড় খায়, একথা বোঝবার মনটা ছিল না অমলবাবুর।

তাই অমলবাবু তার আপন হৃদয়ের অধীশ্বরীর হৃদয়ের উপর কড়া নজর রাখতেন, সে হৃদয়ের জানলা দরজার খিল ছিটিকিনি যেন কোনো সময় খোলা না থাকে। যেন বাইরের ধুলো জঞ্জাল এসে ঢুকে না পড়ে, অথবা ভিতরটাই ফসকে বেরিয়ে না পালায় কোনো ফাঁক দিয়ে।

খিলছিটিকিনিগুলো তাই নিজের হাতে বন্ধ করতে চেষ্টা করতেন।

সেজদিও চোরের উপর রাগ করে মাটিতে ভাত খেয়েছিল। সেজদি প্রেমের কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়েছিল। তারপর তো–

হ্যাঁ, তারপর তো অমলবাবু মারাই গেলেন।

.

কিন্তু তারপর সেই নিঃসঙ্গতার ভূমিতেও আর গভীর গভীর প্রেমের কবিতা লেখেনি সেজদি, বরং তলিয়ে গেছে আরো গভীরে। সেখানে বুদ্বুদ ওঠে না। অথবা হৃদয় নামক বস্তুটা একতলার ঘরটা থেকে উঠে গেছে। মস্তিষ্কের চিলেকোঠায়।

নামকরা লেখিকা অনামিকা দেবীও বলেন, তোর কবিতা এখন আর পড়ে বুঝতে পারিনে বাবা!

দেখা-সাক্ষাৎ প্ৰায় নেই, সেজদি জীবনে আর বাপের বাড়ি আসবো না প্ৰতিজ্ঞা নিয়ে বসে আছে দূরে, অথচ অনামিকা দেবীর সেই বাপের বাড়িটাই একমাত্র ভরসা। অনামিকার নিজের কোন বাড়ি নেই। সেজদির কাছে তাই কদাচ কখনো নিজেই যান। তা সে কদাচই-চিঠির মধ্যেই সব। নতুন কবিতা লিখলে লিখে পাঠায় সেজদি। মন্তব্য পাঠান অনামিকা দেবী।

তবে আবার মাঝে মাঝে খুব সরল ভাষায় আর সাদাসিধে ছন্দে কবিতায় চিঠি লেখে সেজদি, অনামিকাকে আর তার সেই ছোট্ট বন্ধু মোহনকে। অসমবয়সীর সঙ্গে বন্ধুত্ব করবার আশ্চর্য একটা ক্ষমতা আছে সেজদির। আর সেই অসমরাও দিব্যি সহজে নির্দ্বিধায় সেজদির সঙ্গে সমান হয়ে গিয়ে মিশে যায়।

এ ক্ষমতা সকলের থাকে না, এ ক্ষমতা দুর্লভ। শিশুর বন্ধু হতে পারার ক্ষমতাটা ঈশ্বরপ্রদত্ত।

একদা নাকি সেজদিদের পাশের বাড়ির বাসিন্দা ছিল মোহনরা। অর্থাৎ তার মা বাবা। অবাঙালী সেই ভদ্রলোকদের সঙ্গে সেজদিদের পরিচয় স্বল্পই ছিল, কিন্তু তাদের বছর চারপাঁচের ছেলেটা সেজদির কাছেই পড়ে থাকতো। সেজদির সঙ্গে গল্প করে করে বাংলায় পোক্ত হয়ে গিয়েছিল সে।

কবেই তারা অন্যত্র চলে গেছে, মোহন স্কুলের গণ্ডি ছাড়িয়ে হয়তো কলেজেই উঠে গেছে এখন, তবু আন্টির সঙ্গে সম্পর্কটা রেখেছে বজায়।

সেজদিকে নাকি তাকে মাঝে মাঝে ছন্দবদ্ধে পত্র লিখতে হয় সেই তার ছেলেবেলার মত। সেও নাকি আজকাল বাংলা কবিতায় হাত মকশ করছে। আর সেটা সেজদির উপর দিয়েই। অতএব ওটা চলে।

আর চলে অনামিকা দেবীর সঙ্গে।

এখানে বাতাস নেই লিখেছিল কবে যেন। একটু একটু মনে পড়ছে–

এখানে বাতাস নেই, দিন রাত্রি স্তব্ধ হয়ে থাকে
ওখানে উন্মত্ত ঝড় তোমারে আচ্ছন্ন করে রাখে।
তোমার কাজের ডানা অবিশ্রাম পাখা ঝাপটায়,
আমার বিশ্রাম সুখ সময়ের সমুদ্রে হারায়।
এখানে বাতাস নেই, দেয়ালের ক্যালেণ্ডার চুপ,
তোমার তারিখ পত্র ঝড়ে উড়ে পড়ে ঝুপঝুপ।
ঘন্টামিনিটেরা যেন—

নাঃ, আর মনে পড়ছে না। আরো অনেকগুলো লাইন ছিল। অনামিকা দেবী সেই তুলনামূলক ভঙ্গীতে লেখা কবিতাপত্র পড়ে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন সেজদির সঙ্গে আমার কতদিন দেখা নেই, সেজদি আমার এই ঝড়টা তো চোখেও দেখেনি, তবু এত পরিষ্কার বুঝলো কি করে? শুধু নিজের বিপরীতে দেখে?

অথচ এই ঝড়ের গতিবেগটা সৰ্ব্বদা যারা দেখে, তারা তো তাকিয়েও দেখে না। বরং বলে, বেশ আছো বাবা! দিব্যি টেবিল চেয়ারে বসে বানিয়ে বানিয়ে যা ইচ্ছে লেখো, আর তার বদলে মোটা মোটা চেক–

যাক গে, থাক তাদের কথা, বকুলের খাতটা খুঁজতে হবে। কিন্তু কোথায় সেই খোঁজার ঠাঁইটা? বাক্স? আলমারি? পুরনো সিন্দুক? না আরো অন্য কোনোখানে?

সেই অন্য কোনো খানটা কি আছে এখনো অনামিকা দেবীর?

.

তিনতলা থেকে নেমে এলেন অনামিকা দেবী। কারা দেন দেখা করবার জন্যে অপেক্ষা করছে।

এমন অবস্থা সারাদিনে অনেকবার ঘটে, তিনতলা থেকে নেমে নেমে আসতে হয়। মেজদা বলে, তার থেকে বাবা তুই নীচের তলায় একটা ঘরেই পড়ে থাক। এতবার সিঁড়ি ভাঙার চেয়ে ভাল।

ভালবেসেই বলে, অন্য কোনো মতলবে নয়। তিনতলার লোভনীয় ঘরখানা বোন আগলে রেখেছে বলে কৌশলে তাকে নীচে নামাতে চাইবে, এমন নীচ ভাবা উচিত নয় দাদাদের। এটা ঠিক বাবার উইলের অধিকারেই আছেন তিনি, তথাপি দাদারা তেমন হলে টিকতে পারা সম্ভব ছিল কি?

না, অনামিকার প্রতি কোনো দুর্ব্যবহার হয় না। এই যে রাতদিন বাড়িতে লোকজন আসছে, এই যে যখন তখন মহিলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন, বৌদিরা তাকে কিছু বলতে আসেন?

না। অনামিকা দেবীকে কেউ কিছু শোনাতে আসেন না। যে যা শোনান নিজ নিজ স্বামীপুত্রকে অথবা ভগবানের বাতাসকে।

বড় তরফের অবশ্য দাদা বেঁচে নেই, আর বড় বৌদি থেকেও নেই, তবে বড়র অংশটুকু আগলে বাস করছে তার ছেলে অপূর্ব। আছে, তবে অপূর্ব তার স্ত্রী-কন্যা নিয়ে বাড়ির মধ্যেই আলাদা।

অপুর্বর স্ত্রীর রুচিপছন্দ শৌখিন, মেয়েকে আধুনিক স্টাইলে মানুষ করতে চায়, খুড়শাশুড়ীদের সঙ্গে ভেড়ার গোয়ালে থাকতে রাজী নয় সে। তাই বাড়ির মধ্যেই কাঠের স্ক্রীন দিয়ে নিজের বিভাগ ভাগ করে নিয়েছে অপূর্ব।

দোতলার দক্ষিণের বারান্দাটা অপূর্বর ভাগে। বারান্দাটাকে অবশ্য আর বারান্দা রাখেনি অপূর্ব, কাঁচের জানলা আর গ্ৰীল বসিয়ে সুন্দর একখানি হল-এ পরিণত করে ফেলেছে। সেখানে তার খাবার টেবিল আর বসবার সোফাসেট দুভাগে সাজানো।

অপুর্বর স্ত্রী অলকার মাথাটা চমৎকার। তার মাথা থেকেই তো বেরিয়েছে এসব পরিকল্পনা। তা নইলে এই চিরকেলে সনাতনী বাড়িটি তো সেই সনাতন ধারাতেই চলে আসছিল।

সেই মাটিতে আসন পেতে খাওয়া, সেই মাটিতে সরঞ্জাম ছড়িয়ে এলোমেলো করে চা বানানো, কোথাও কোনো সৌকুমার্যের বালাই ছিল না।

বাড়িখানা নেহাৎ ছোট নয়, কিন্তু সবটাই কেমন একাকার। ফ্ল্যাটবাড়ির স্টাইল নেই কোনোখানে; ভাই বাড়ি থেকে কোনো আয়ের উপায়ও নেই। ভবিষ্যৎবুদ্ধি ছিল না আর কি বাড়ি-বানানেওয়ালার!

এসব দেখেশুনে অলকা হতাশ হয়ে নিজের এলাকাটুকু নিজের মনের মত করে সাজিয়ে নিয়েছে। তার মেয়ে অভিজাতদের স্কুলে পড়ে, তার চাকর বুশ শার্ট আয় পায়জামা পরে, চটি পায়ে রাঁধে।

অনামিকা দেবীর মেজ বৌদি আর সেজ বৌদি প্রথম দিকে ভাসুরপো-বৌয়ের অনেক সমালোচনা করেছিলেন, অনেক বিদ্রুপের ফুলঝুরি ছড়িয়েছিলেন, কিন্তু ক্রমশঃ নিজেরাই ওই আধুনিকতার সুবিধেগুলো অনুধাবন করেছেন এবং কখন অলক্ষ্যে সেগুলির প্রবর্তনও করেছেন। এখন ওরা পুরুষদের অন্ততঃ টেবিলে খেতে দেওয়াটা বেশ ভালো মনে করেন।

অনামিকা দেবী অবশ্য এসবের মধ্যে ঢোকেন না কখনো। না মন্তব্য, না মতপ্রকাশে। আজীবনের এই জায়গাটায় তিনি যেন আজীবনই অতিথি।

অতিথির সৌজন্য, অতিথির কুণ্ঠা এবং অতিথির নির্লিপ্ততা নিয়েই বিরাজিত তিনি।

.

নীচে নেমে এসে দেখলেন, জনা তিন-চার বিজ্ঞ বিজ্ঞ ভদ্রলোক। অনামিকাকে দেখে সসম্ভ্রমে নমস্কার করলেন। প্রতি-নমস্কারের পালা চুকলো। তারপর কাজের কথায় এলেন তারা।

একটি আবেদনপত্রে স্বাক্ষর করাতে এসেছেন। দেশের সমন্ত মান্যগণ্য, বিশিষ্ট চিন্তাবিদ শিক্ষাবিদ সমাজকল্যাণী আর শুভবুদ্ধি-সম্পন্নদের স্বাক্ষর সংগ্ৰহ করতে নেমেছেন তারা। অনামিকা দেবীকেও ফেলেছেন সেই দলে।

কিন্তু আবেদনটা কিসের?

আবেদনটা হচ্ছে দুর্নীতির বিরুদ্ধে।

এই দুর্নীতিসাগরে নিমজ্জিত দেশের অন্ধকার ভবিষ্যৎ দেখে বিচলিত বিপর্যন্ত এরা সে সাগরে বাঁধ দিতে নেমেছেন।

ওজস্বিনী ভাষায় এবং বিক্ষুব্ধ গলায় বলেন তারা, ভাবতে পারেন কোথায় আজ নেমে গেছে দেশ? খাদ্যে ভেজাল দিচ্ছে, ওষুধে ভেজাল দিচ্ছে, শিক্ষা নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে–

এমন ভাবে বলেন, যেন এইমাত্র টের পেয়েছেন তারা দেশে এইসব ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা ঘটছে!

অনামিকা দেবী মনে মনে বলেন, খোকাবাবুরা এইমাত্ৰ বুঝি স্বৰ্গ হতে টসকে পড়েছ! এ মর্ত্যভূমে বিধাতার হাত ফসকে? কিন্তু সে তো মনে।

মুখে শান্ত সৌজন্যের পালিশে ঈষৎ দুঃখের নক্সা কেটে বলেন, সে তো করছেই।

করছেই বলে তো চুপ করে থাকলে চলবে না অনামিকা দেবী। সমাজের দুর্নীতিতে আপনাদের দায়িত্ব সর্বাধিক। শিল্পী-সাহিত্যিকরা যদি দায়িত্ব এড়িয়ে আপন উচ্চমানসের গজদন্তমিনারে বসে শুধু কল্পনার স্বৰ্গ গড়েন, তাহলে সেটা হবে দেশের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা।

অনামিকা দেবী চমকিত হন।

না, ভয়ঙ্কর নতুন এই কথাটায় নয়, ভদ্রলোকের কণ্ঠস্বরে। ওঁর মনে হয় বাড়ির লোকেরা শুনলে ভাববে, কেউ আমাকে ধমক দিতে এসেছে।

চমকিত হলেও শান্ত স্বরেই বলেন, কিন্তু আবেদনটা কার কাছে?

কার কাছে?

ভদ্রলোক উদ্দীপ্ত হন, মানুষের শুভবুদ্ধির কাছে।

মানুষ? মানে ওই সব ভেজালদার চোরাকারবারীদের কাছে?

খুব আস্তে, খুব নরম করেই কথাটা বললেন অনামিকা দেবী, ভদ্রলোকরা যেন আহত হলেন, আর সেটা অপ্রকাশও রাখলেন না। ক্ষুব্ধ গলাতেই বললেন, আপনি হয়তো আমাদের প্রচেষ্টাকে লঘুচক্ষে দেখছেন, কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি, মানুষের শুভবুদ্ধি কোনো সময় না কোনো সময় জাগ্রত হয়।

সে তো নিশ্চয়। অনামিকা দেবী নম্র গলায় বলেন, দেখি আপনাদের আবেদনপত্রের খসড়া।

ব্যাগ খুলে সন্তর্পণে বার করেন ভদ্রলোক।

জোরালো গলায় বলেন, দেশের এই দুর্দিনে আপনাদের উদাস থাকলে চলবে না অনামিকা দেবী। অন্ধকারে পথ দেখাবে কে? কল্যাণের বাতি জ্বেলে ধরবে কে? যুগে যুগে কালে কালে দুর্নীতিগ্রন্ত সমাজকে পঙ্কশয্যা থেকে আবার টেনে তুলেছে সাহিত্য আর শিল্প।

অনামিকা দেবী মৃদু হেসে বলেন, তাই কি ঠিক?

ঠিক নয়? বলেন কি?

তাহলে তো সম্ভবামি যুগে যুগে কথাটার অর্থই হয় না— বলে মৃদু হেসে কাগজটায় চোখ বুলোন অনামিকা দেবী।

ভাষা সেই একই। যা ভদ্রলোকরা আবেগদীপ্ত গলায় বলছেন।

দেশ পাপপঙ্কে নিমজ্জিত, মানুষের মধ্যে আর আদর্শ নেই, বিশ্বাস নেই, শ্রদ্ধা নেই, প্ৰেম নেই, পরার্থপরতা নেই, মানবিকতা বোধ নেই, সর্বস্ব হারিয়ে মানুষ ধ্বংসের পথে চলেছে। কিন্তু চলেছে বলেই কি চলতে দিতে হবে? বাঁধ দিতে হবে না?

অনামিকা দেবী মনে মনে হাসলেন। ভাবলেন আমার একটি স্বাক্ষরেই যদি এতগুলো নেই হয়ে যাওয়া দামী বস্তুকে ফিরিয়ে আনার সাহায্য হয় তো দেব বৈকি সেটা।

তবে বিশ্বাস জিনিসটা যে সত্যিই বড় বেশী চলে গেছে তাতে আর সন্দেহ কি? নচেৎ তোমাদের এই সব মহৎ চিন্তা আর মহৎ কথাগুলির মধ্যে কোনো আশার রস পাচ্ছি না কেন? কেন মনে হচ্ছে, কেবলমাত্র দুর্নীতিগ্রন্ত মানুষকে শুভবুদ্ধির শুভ্ৰ আলোক দেখাবার ব্ৰত নিয়েই তোমরা এই দুপুর রোদে গলদঘর্ম হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ, এ কি আর সত্যি? এটা বোধ হয় তোমাদের কোনো মতলবগ্রন্থের সুচারু মলাট!

তারপর ভাবলেন, মলাট নিয়েই তো কারবার আমাদের। এই যে সাহিত্য নিয়ে এত গালভরা কথা, সে-সাহিত্যও বিকোয় তো মলাটের জোরে। যার গেট আপ যতো জমকালো তার ততো বিক্রী।

কলামটা তুলে নিয়ে বসিয়ে দিলেন স্বাক্ষর।

ওঁরা প্ৰসন্ন মুখে ফিরে গেলেন।

অনামিকা দেবী তাকিয়ে রইলেন অনেকক্ষণ সেই চলে যাওয়া পথের দিকে। তারপর ভাবলেন, মতলবী যদি না হও তো তোমরা অবোধ। তাই চোরাকারবারীর শুভবুদ্ধির দরজায় হাত পাততে বসেছ।

যাক, যাইহোক, উদ্দেশ্যসিদ্ধির খুশি দেখা গেল ওদের মুখে। সেদিন দেখা যায়নি তাদের, সেই আর এক মানবকল্যাণ-ব্রতীদের।

.

তিন-চারটি রোগা রোগা কালো কালো ছেলে আর একটি মেয়ে এসেছিল সেদিন এই একই ব্যাপারে।

আবেদনপত্রে স্বাক্ষর!

তাদের চিন্তা শুধু দেশের গন্ডীতেই সীমাবদ্ধ নয়, সমগ্ৰ বিশ্বের পরিপ্রেক্ষিতে চিন্তা তাদের। এই যুদ্ধোন্মাদ পৃথিবীকে শান্তির মন্ত্র দেবার জন্য স্বাক্ষর সংগ্রহ করে বেড়াচ্ছে তারা।

অনামিকা দেবী বলেছিলেন, আমার মনে হয় না যে এই পদ্ধতিতে সত্যকার কাজ হবে।

ওরা ক্ষুব্ধ হয়নি, আহত হয়নি, ফোঁস করে উঠেছিল।

বলেছিল, তবে কিসে সত্যকার কাজ হতে পারে বলে মনে হয় আপনার?

অনামিকা দেবী হেসে উঠেছিলেন, আমার এমন কি বুদ্ধি যে চট করে একটা অভিমত দিই! তবে মনে হচ্ছিল উন্মাদের কাছে শান্তির আবেদনপত্রের মূল্য কি?

ওরা যুক্তি ছেড়ে ক্রোধের শরণ নিয়েছিল। বলেছিল, তাহলে আপনি যুদ্ধই চান? শান্তি চান না?

তারপর দুএকটা বাক্য বিনিময়ের পরই, আচ্ছা ঠিক আছে। সই দেওয়া না দেওয়া আপনার ইচ্ছে। তবে এই থেকে আপনাদের সাহিত্যিকদের মনোভাব বোঝা যাচ্ছে। বলে ঠিকরে বেরিয়ে গিয়েছিল।

শান্তির জন্য দরজায় দরজায় আবেদন করে বেড়াচ্ছে ওরা, কিন্তু সহিষ্ণুতা শব্দটার বানান ভুলে গেছে।

সেদিন তারা রাগ করে চলে গিয়েছিল।

অনামিকা দেবী অস্বস্তি বোধ করেছিলেন।

আজ আর অস্বস্তি নেই। আজ এরা প্ৰসন্ন মুখে বিদায় নিয়েছেন। স্বস্তি কেনবার এই উপায়!

অন্যের বাসনা চরিতার্থের উপকরণ হও, অন্যের মতলবের শিকার হও, আর তাদের ওই উপরের মলাটটা দেখেই প্রশংসায় পঞ্চমুখ হও। ভিতর পৃষ্ঠায় কী আছে তা বুঝতে পেরেছ, একথা বুঝতে দিও না। ব্যাস, পাবে স্বস্তি। নচেৎ বিপদ, নচেৎ দুঃখের আশঙ্কা।

বাইরে এখনো রোদ ঝাঁ ঝাঁ করছে, গরমের দুপুর কেটেও কাটে না। কত কাজ জমানো রয়েছে, কত তাগাদার পাহাড় গড়ে উঠছে, তবু এই সময়টাকে যেন কাজে লাগানো যাচ্ছে না। সেজদিকে কি চিঠি লিখবেন এখন?

সেজদির চন্দননগরের সেই গঙ্গার ধারের বাড়িটা মনে পড়লো। অমলবাবু সেজদির জীবনে আর কোন সঞ্চয় রেখে গেছেন কিনা জানা নেই, তবু স্বীকার না করে উপায় নেই, এই এক পরম সঞ্চয় রেখে গেছেন তিনি সেজদির জীবনে। গঙ্গার ধারের সেই ছোট্ট বাড়িটি।

সেখানে একা থাকে সেজদি।

শুধু নিজেকে নিয়ে।

দুই-কৃতী ছেলে থাকে নিজ নিজ কাজের জায়গায়। তাদের মন্ত কোয়ার্টার, মন্ত বাগান, আরাম আয়েস স্বাচ্ছন্দ্য।

কিন্তু সেজদিকে সেখানে ধরে না।

সেজদির চাই আরো অনেকখানি আকাশ, আরো অনেকখানি বাতাস। তাই গঙ্গার ধারের বারান্দা দরকার তার।

তবু সেজদি লেখে-এখানে বাতাস নেই।

বাতাসের যোগানদার তবে কে?

 ০৩. শম্পা সেজেগুজে আনন্দে ছলছল

শম্পা সেজেগুজে আনন্দে ছলছল করতে করতে এসে দাঁড়ালো, সিনেমা যাচ্ছি পিসি। মাৰ্ভেলাস একখানা বই এসেছে লাইটহাউসে। যাচ্ছি, বুঝলে? দেরি হয়ে গেল সাজতে। সেই হতভাগা ছেলেটা টিকিট নিয়ে হাঁ করে বসে আছে তীর্থের কাকের মত, আর বোধ হয় একশো শাপমন্যি দিচ্ছে! চললাম। মাকে বলে দিও, বুঝলে?

ওর ওই আহ্লাদে-ভাসা চেহারা কি কোনদিন দেখেননি অনামিকা দেবী? রোজই তো দেখছেন। তবু হঠাৎ কেন আজ বহু যুগের ওপার হতে আষাঢ় এসে আড়াল করে ফেললো ওঁকে? সেই ছায়ায় হঠাৎ শম্পাকে বকুল মনে হল অনামিকা দেবীর?

ওর ওই হাওয়ায় ভাসা দেহটার সঙ্গে খাপ খাওয়া হাওয়া শাড়িটার জায়গায় একটা স্বদেশী মিল-এর মোটা শাড়ির একাংশ দেখতে পেলেন যেন।

বকুলের সেই শাড়িটা চাবিবাধা আঁচলের ধরনের ঘরোয়া করে পরা, বকুলের চুলের রাশি টান টান করে আঁচড়ে তালের মত একটা খোঁপা বাঁধা, বকুলের পা খালি। বকুলের হতে দুটি বই।

কিন্তু শম্পাকে হঠাৎ বকুল মনে হচ্ছে কেন? বকুলের তো শম্পার মত এমন আহ্লাদেভাসা চেহারা নয়?

বকুল ভীরু কুণ্ঠিত নম্র।

বকুলের মধ্যে দুঃসাহসের ভঙ্গী কোথায়?

নেই।

তবু শম্পাকে আড়াল করে বকুল এসে দাঁড়াচ্ছে। আর সেই ঘাড় নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকা বকুলকে কারা যেন ধমক দিচ্ছে, খবরদার আর ওদের বাড়িতে যাবে না তুমি। খবরদার নয় এত বড় ধিঙ্গী মেয়ে হয়েছ, রাতদিন নাটক-নভেলের শ্রাদ্ধ করছ, আর এ জ্ঞান নেই কিসে নিন্দে হয়?

বকুলের চেহারায় দুঃসাহসের ভঙ্গী নেই, তবু বকুল একটা দুঃসাহসিক কথা বলে বসলো। হয়তো এই জন্যই শম্পার সঙ্গে কেমন একটা মিল মনে হচ্ছে হঠাৎ।

বললো, হঠাৎ নিন্দে হবে কেন? চিরকালই তো যাই!

চিরকালের সঙ্গে এখনকার তুলনা কোরো না—, একটা ভাঙা-ভাঙা প্রৌঢ় গলা বলছে, এখন তোমার মাথার ওপর মা নেই। তাছাড়া ওদের ঘরে বড় ছেলে-

হ্যাঁ, এমন একটা অ-সভ্য কথা অনায়াসেই উচ্চারণ করেন তিনি।

বকুলের ক্ষীণ কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হয়, আচ্ছা বেশ, আর যাবো না, আজ শুধু এই বই দুটো ফিরিয়ে দিয়ে আসি।

কি বই?

এমনি।

এমনি মানে? নাটক-নভেল?

বকুল চুপ।

ওই তো, ওইটিই হয়েছে কুয়ের গোড়া! তিন পুরুষে একই রোগ! শুনতে পাই দিদিমার ছিলো, মার তো ষোলো আনা ছিলো, তারপর আবার মেয়েরও-দেখি কি বই!

বকুলের হাত থেকে বই দুটো প্রায় কেড়ে নেন তিনি। খুলে ধরেন। তারপর বিদ্রুপের গলায় বলেন, ওঃ, পদ্য! রবি ঠাকুর! সাধে আর বলছি তিন পুরুষের একই রোগ!- হুঁ, ঠিক আছে। আমি দিয়ে দেব। বই কার? ওই নির্মলটার নিশ্চয়?

বকুল পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বকুল উত্তর দিতে পারে না।

প্রৌঢ়র গলা থেকে একটি একাক্ষর শব্দ বেরোয়, হুঁ!

সেই শব্দের অন্তর্নিহিত ধিক্কারে পাথরের বকুল আষাঢ়ের ছায়ার আড়ালে মিলিয়ে যায়। শম্পার আহ্লাদে-ভাসা মূর্তিটা ঝলসে ওঠে সেই শূন্যতার উপর।

ঝলসে-ওঠা শম্পা বলে, যাচ্ছি তাহলে। মাকে একটু মুড বুঝে বোলো!

অনামিকা দেবী ঈষৎ কঠিন স্বরে বলেন, তুই নিজেই বলে যা না বাপু। আমি তোর মার মুডফুড বুঝতে পারি না।

তুমি পারো না? শম্পা হি হি করে হেসে ওঠে, তুমি বলে ওই করেই খাচ্ছ! দোহাই পিসি! এখন মাকে বলতে গেলে, সিনেমার বারোটা বেজে যাবে। হতভাগাটা হয়তো কাটা টিকিট ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে রেলে কাটা পড়তে যাবে!

হাসতে হাসতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় শম্পা পিসিকে টা-টা করার ভঙ্গী করে।

অনামিকা দেবী অপলকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ ভাবেন, আশ্চর্য! ও এ বাড়িরই মেয়ে? কত যুগ পরের মেয়ে?

শম্পা যখনই একটু দুঃসাহসিক অভিযানে বেরোয়, পিসিকে জানিয়ে যায়। পিসির সঙ্গে তার মাই-ডিয়ারি ভালোবাসা।

তাই তার প্ৰেমাস্পদের গল্পগুলো পিসির সঙ্গেই জমাতে আসে।

হয়তো অনামিকা দেবী সময়ের অভাবে ছটফটিয়ে মরছেন। হয়তো প্ৰতিশ্রুত লেখা প্রতিশ্রুতিমত সময়ে দিয়ে উঠতে না পারায় তাগাদার উপর তাগাদা আসছে, একটুমাত্র সময় সংগ্রহ করে বসেছেন খাতা কলম নিয়ে, তখন শম্পা তিনতলায় উঠে এসে জাঁকিয়ে বসলো, বুঝলে পিসি, হতভাগা বলেছি বলে বাবুর কী রাগ! বলে কিনা ভবিষ্যতেও তুমি তাহলে আমাকে এইরকম গালাগাল দেবে? বোঝো! এ অবতারাও সেই ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছেন! অর্থাৎ একটু প্ৰেম প্ৰেম ভাব দেখেছে কি বিয়ের চিন্তা করতে শুরু করেছে! ছেলেগুলো যে কেনই এত বোকা হয়? তা বুঝলে পিসি, আমিও ওকে বলে দিলাম, হতভাগা নয় তো কি? হতভাগা নইলে আমি ছাড়া আর ভালমত একটা সুইট-হার্ট জুটলো না তোমার? ঠিক বলিনি পিসী?

অনর্গল কথা বলে যায়।

অনামিকা তাকে শাসন করতে পারেন না। অনামিকা দেবী বলতে পারেন না, এত বাচালতা করে বেড়াস কেন?

না, বলতে পারেন না। বরং প্রশ্ৰয়ই দেন বলা যায়।

প্রশ্ৰয় দেন হয়তো নিজেরই স্বার্থে। এই মেয়েটার কাছাকাছি এলেই যেন অনামিকা দেবীর খাঁচার মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসে একটি বন্দী পাখী, এসে আলোর দরজায় উঁকি মারে।

ও যে অনামিকা দেবীকে নস্যাৎ করে দিয়ে তার পিসির কাছে এসে দাঁড়ায়, এটাই যেন সর্বাঙ্গে ভালবাসার হাত বুলিয়ে দেয় অনামিকার।

জিনিসটা বড় দুর্লভ।

কিন্তু অনামিকার এমন হ্যাংলামি কেন?

কি নেই তার জন্যে?

যশ আছে, খ্যাতি আছে, শ্রদ্ধা-সম্মান আছে, ভালবাসাও আছে। অজস্রই আছে। কিন্তু এ সবেরই হেতুও আছে।

অহেতুক ভালবাসাই বড় দুর্লভ বস্তু। তাছাড়া যা আছে, সব তো আছে অনামিকা দেবী নামক খোলসটার জন্যে।

তাই শম্পার ওই বাচালতা, ওই বেপরোয়া ভঙ্গী, ওই লাজলজ্জার বালাইহীন কথাবার্তা সব কিছুই সহ্য হয়ে যায়। বরং ভালই লাগে। মনে হয়, যেন শম্পাকে এ ছাড়া আর কোন ভঙ্গীতে মানায় না।

বাড়ির লোক অন্য অনেক কিছু না বুঝুক, এটা বোঝে।

তাই প্রত্যক্ষে এবং পরোক্ষে অনামিকা দেবীকেই দায়ী করে শম্পার বেচালের জন্যে।

বড় গাছে নৌকো বেঁধেছে যে —, ছোট বৌদি দেওয়ালকে উদ্দেশ করেই বলেন, ভয় কেন থাকবে? শুধু আমার নিজের হাতে মেয়ে থাকলে, কেমন না ঢিট করতাম দেখত সবাই। ছেলে জন্মাবার পর অনেকগুলো বছর বাদে শম্পার আবির্ভাব হয়েছিল। বড়ো বয়সের এই মেয়েটাকে এঁটে উঠতে কোনো দিনই পারেন না ছোট বৌদি, কিছু দোষারোপটা করেন অনামিকাকে।

অনামিকা দেবী তাই মাঝে মাঝে বলেন, তোর মাকে জিজ্ঞেস কর না বাবা! তোর মাকে বলে যা না বাবা!

শম্পা চোখ গোল করে বলে, মাকে? তাহলে আজকের মত বেরোনোর মহানিশা। কেন কি বৃত্তান্ত কোথায় কার সঙ্গে? ইত্যাদি, প্রভৃতি সে কী জেরা! উঃ, কী একখানা ব্রেন! মার বাবা যদি মাকে লেখাপড়া শিখিয়ে উকিল করে ছেড়ে দিতো, তাহলে দেশের দশের উপকার হতো, আর এই শম্পাটারও প্রাণ বাঁচত। কেন যে সে বুদ্ধিটা মাথায় আসেনি ভদ্রলোকেরা!

অনামিকা ওর এই কথার ফুলঝুরিতে হাসেন, কিন্তু অনামিকার সেই হাসির অন্তরালে একটি গভীর দীর্ঘশ্বাস স্তব্ধ হয়ে থাকে।

তোরা আজকের মেয়েরা জানিস না, খেয়ালও করিস না, তখন কোনো ভদ্রলোকের মাথাতেই ও বুদ্ধিটা আসতো না। আর যদি বা দৈবাৎ কারো মাথায় আসতো, লোকে তাকে তখন আর ভদ্রলোক বলতো না।

তাই এমন কত মস্তিষ্কই অপচয় হয়েছে, কত জীবনই অপব্যয়িত হয়েছে। আজ পৃথিবী তোদের পায়ের তলায়, আকাশ তোদের মুঠোয়, তোরা নিজের জীবনকে নিজের হাতে পাচ্ছিস, আর তার আগে সেটা গড়ে দিচ্ছে তোদের গার্জেনরা।

তোরা কি বুঝবি গড়নের বালাইহীন একতাল কাদার জীবনটা কেমন? তাও সেই বাঁকাচোরা অসমান ডেলাটাও অন্যের হাতে!

সেই অন্যের হাতের চাপে বিকৃত অসমান কাদার জীবনকে দেখেছি আমরা, তাই ভাবি তোরা কত পেয়েছিস! কত পাচ্ছিস! কিন্তু সে বোধ কি আসে কোনোদিন তোদের? কিন্তু কেনই বা আসবে? প্রাপ্য পাওনা পাওয়ার জন্যে কি কৃতজ্ঞতা আসে?

বুকভরা নিঃশ্বাস নেবার মত বাতাস থাকলে কি কেউ ভাবতে বসে কে কবে কোথায় বাতাসের অভাবে দম আটকে মরেছে?

বকুলের ছবিটা একবার ভেসে এসেছিল বহু যুগের ওপার থেকে, কিন্তু তার খাতাটা? সেটা যে কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছেন না অনামিকা দেবী। খোঁজবার জায়গাটাই খুঁজে পাচ্ছেন না।

তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছেন, আর মনে হচ্ছে, এই সব নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর উপাদানের মধ্যে বকুলকে কোথায় পাবো?

বকুল বাপ-ভাইয়ের কঠোর শাসনে তার ভালবাসাকে লোহার সিন্দুকে পুরে ফেললো, এটুকু তো দেখতে পেলাম। কিন্তু সেটা কি একটা বলবার মত উপকরণ?

অথচ বকুলের কথা লেখবার জন্যে কোথায় যেন অঙ্গীকার ছিল। সে অঙ্গীকার কি ভুলে গেছেন অনামিকা দেবী?

ভুলে হয়তো যাননি, তবু কত হাজার হাজার পৃষ্ঠা লেখা হল জীবনে, কত হাজার হাজার বানানো মানুষের কথা, অথচ সেই কথাটা চাপা পড়ে রইল।

কিন্তু ও নিয়ে এখন আর ভাবনার সময় নেই। বনবাণীর সম্পাদক টেলিফোনযোগে হতাশ গলায় জানাচ্ছেন, আপনার কপিটার জন্যে কাগজ আটকে রয়েছে অনামিকা দেবী। সামনের সপ্তাহে বোরোবার কথা, অথচ-

বনবাণীর পরেই সীমান্তের কপি, তারপর অন্তহীন সাগরের প্রুফ। তার ভিতরেই তো উত্তরবঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন।

দিন আষ্টেক পরে সেজদির চিঠির উত্তর দিলেন, বকুলের খাতাটা কোথাও খুঁজে পেলাম না মনে হচ্ছে হারিয়েই ফেলেছি। আর তার সঙ্গে মনে হচ্ছে, হয়তো তোর কাছেই আছে। দেখা না খুঁজে।

 ০৪. মেয়েরা শাড়ি কুঁচিয়ে নিয়ে পরতো

আগেকার দিনে মেয়েরা শাড়ি কুঁচিয়ে নিয়ে পরতো। হালকা মিহি ‘খড়কে ড়ুরে’ ‘চাঁদের আলো’ ‘গঙ্গাজলী’। কড়া করে মোচড় দিয়ে দিয়ে পাকানো সেই কোঁচানো শাড়িকে বাঁধন খুলে বিছিয়ে দিলে, তার ছোট ছোট ঢেউতোলা জমিটা যেমন দেখাতো, গঙ্গাকে এখন যেন তেমনি দেখতে লাগছে।

জোয়ার নেই, ভাঁটা নেই, স্থির গঙ্গা।

শুধু বাতাসের ধাক্কায় ছোট ছোট তরঙ্গ। সেই তরঙ্গ কোঁচানো গঙ্গাজলী শাড়ীর মত একূল ওকুল আঁচল বিছিয়ে তিরতির করে কাঁপছে।

এখন পড়ন্ত বিকেল, এখন গঙ্গা আর গঙ্গাতীরের শোভার তুলনা নেই, এই শোভার শেষবিন্দুটুকু পান করে তবে এই বারান্দা থেকে উঠবেন সেজদি। যার নাম পারুল, আর যাকে নাম ধরে ডাকবার এখানে কেউ নেই।

এই তার পুজো, এই তার ধ্যান, এই তার নেশা। রোদ পড়লেই গঙ্গার ধারের বারান্দায় এসে বসে থাকা। হাতে হয়তো একটা বই থাকে, কিন্তু সে বই পড়া হয় না। এ সময়টা যেন নিজেকে নিয়ে ওই গঙ্গারই মত কোনো অতল গভীরে ড়ুবে যান তিনি।

ফর্সা রং, ধারালো মুখ, ঈষৎ কোঁকড়ানো হালকা রুক্ষ চুলে রুপোলি ব্রাশের টান। সম্পূর্ণ নিরাভরণ হালকা পাতলা দেহটি ঘিরে যে সাদা থান আর ব্লাউজ, তার শুভ্রতা যেন দুধকেও হার মানায়। সাদা ফুলের সঙ্গেই বরং তুলনীয়।

পাড়ার মহিলারা কখনো কখনো বেড়াতে আসেন, সধবা বিধবা দু দলই। আর পথে বেরোলে অবশ্যই ফর্সা কাপড় পরেন, কিন্তু এখানে এসে বসলে তাদের সে শুভ্রতা সম্ভ্রম হারায়।

মহিলারা বিস্ময়-প্রশ্ন করে বসতেও ছাড়েন না, কোন ধোবায় আপনার কাপড় কাচে দিদি? কী ফর্সা করে! আর বাড়িতেও যে আপনি কি করে কাপড় এত ফর্সা রাখেন! আমাদের তো বাবা রান্নাঘরে গেলাম, আর কাপড় ঘুচে গেল।

সেজদি এতো কথার উত্তরে শুধু মৃদু হেসে বলেন, আমার রান্নার ভারী বহর!

সেজদি অল্প কথার মানুষ।

অনেক কথার উত্তরে ছোট দুএকটি লাইনেই কাজ সারতে পারেন। মহিলারা নিজেই অনেক কথা বলে, তারপর যাই দিদি, আপনার অনেক সময় নষ্ট করে গেলাম বলে চলে যান।

সেজদি এ কথাতেও হৈ-হৈ করে প্রতিবাদ করে ওঠেন না। শুধু তেমনি হাসির সঙ্গে বলেন, আমার আবার সময় নষ্ট! সারাক্ষণই তো সময়!

গমনোন্মুখ মহিলাকুল আবার থমকান, ঈষৎ ঈর্ষা আর ঈষৎ প্রশংসায় বলে ওঠেন, কি জানি ভাই, কি করে যে আপনি এতো সময় পান! আমরা তো এতোটুকু সময় বার করতে হিমসিম খেয়ে যাই! ইহ-সংসারের খাজনা আর শেষ হয় না! •

সেজদি এ উত্তর দিয়ে বসেন না, খাবেন না কেন হিমসিম, কাজের তালিকা যে আপনাদের বিরাট। নিত্য গঙ্গা নাইবেন, নিত্য যেখানে যত বিগ্ৰহ আছেন তাদের অনুগ্রহ করতে যাবেন, নিত্য ভাগবত পাঠ শুনতে বেরোবেন। তাছাড়া বাড়িতেও কেউ এক ডজন ঠাকুর নিয়ে ফুলচন্দন দিতে বসবেন, কেউ তুলসীর মালা নিয়ে হাজার জপ করতে বসবেন।

নিত্য এতগুলি নিত্যের নৈবেদ্য যুগিয়ে তবে তো আপনারা অনিত্য ইহ-সংসারের খাজনা দিতে বসেন। তার মধ্যেও আছে ইচ্ছাকৃত কাজ বাড়িয়ে তোলার ধরন! ভরা জল আবার ভরা, মাজা কলসী আবার মাজা, কাচা কাপড়কে আকাচা সন্দেহে আবার কাচা, এসব বাদেও—তুচ্ছ জিনিসকে উচ্চমূল্য দিতে অবকাশকে গলা টিপে মারেন। একমুঠো কাঁকর-ভর্তি চাল, একমুঠো কয়লার গুঁড়ো, এ যে আপনাদের কাছে সময়ের থেকে অনেক বেশী মূল্যবান।

না, এসব কথা বলেন না সেজদি।

তিনি শুধু হেসে বলেন, আপনাদের সংসার করা, আর আমার সংসার করা! কীই বা সংসার!

নিজের আর নিজের দিন নির্বাহের আয়োজনের সম্পর্কিত কথায় ভারী কুণ্ঠা সেজদির। কেউ যদি জিজ্ঞেস করে, কী রাঁধলেন? উত্তর দিতে সেজদি যেন লজ্জায় মরে যান। তাছাড়া রান্নার পদ সম্পর্কে বলতে গেলেই তো বিপদ। সেজদির অন্নপাত্রে একাধিক পদের আবির্ভাব দৈবাতের ঘটনা। শুধু যখন ছেলেরা কেউ ছুটিতে বেড়াতে আসে তখনই–

বাইরে থাকে ছেলেরা। ছুটি হলেই কলকাতা তাদের টানে। দুটি হলেই বৌ-ছেলে নিয়ে ট্রেনে চড়ে বসে মনকে বলে, চলো কলকাতা। অবশ্য এটা সম্ভব হয়েছে দুই ছেলেরই শ্বশুরবাড়ি কলকাতায় বলে। তা নইলে হয়তো বলতে হতো–চলো মধ্যপ্রদেশ, চলো উত্তরবঙ্গ।

স্বামীর ছুটির সুযোগে বৌদের গন্তব্যস্থল আর কোথায় হবে বাপের বাড়ি ছাড়া? আদিঅন্তকালই যে এই নিয়ম চলে আসছে, স্বয়ং মা দুর্গাই তার প্রমাণ। বৃন্তচ্যুত ফুলের মর্মকথা কারো জানা নেই, কিন্তু বৃন্তচ্যুত নারী-সমাজের মর্মকথা ধরা পড়ে তাদের এই পিত্ৰালয়প্রীতিতে।

থাকবেই তো প্রীতি।

শৈশবের সোনার দিনগুলি যেখানে ছড়িয়ে আছে স্মৃতির সুরভি হয়ে, কৈশোরের রঙিন দিনগুলি যেখানে বিকশিত হয়েছে, কম্পিত হয়েছে, আশা-আনন্দে দুলেছে, সেখানটার জন্যে মন ছুটবে না? যেখানে গিয়ে দাঁড়ালেই একান্ত প্রিয়জনের মুখ, সেখানে আকর্ষণ দুর্বার হবে না?

হয়।

তাই বৌরা স্বামীর ছুটি হলে বলে, ছুটিতে কাশ্মীরে বেড়াতে যাবার কথা বলছো, কিন্তু মা না অনেকদিন থেকে বলছেন–

ছেলেরা অতএব বাক্সবিছানা বেঁধে স্ত্রী-পুত্র নিয়ে শিবঠাকুরের মতো গিরিবাজের গৃহেই এসে উদিত হয়। শ্বশুরের বাড়ি ছোট, ঘর কম, কি অন্য অসুবিধে, এসব চিন্তা বড় করে না। শুধু হয়তো ছুটির তিরিশ দিনের মধ্যে থেকে তিনদিন কেটে বার করে নিয়ে নিজের মায়ের কাছে ঘুরে আসে।

এটা অবশ্য শুধু অনামিকা দেবীর সেজদির ঘরেই ঘটছে তা নয়, ঘরে ঘরেই এই ঘটনা। মেয়েরা অনেক কিছু বোঝে, বোঝে না শুধু স্বামীরও হৃদয় নামক একটা বস্তু আছে।

প্রবাসে চলে গেলে পুরুষ বেচারীদেরও যে শৈশব-কল্যের সেই স্মৃতিময় ঘরখানির জন্য হৃদয়ের খানিকটা অংশে থাকে একটি গভীর শূন্যতা, তা মেয়েরা বুঝতে চায় না। পুরুষের আবার মন কেমন কি? তাই ওই তিনদিনের বরাদ্দে যদি আর দুটো দিন যোগ হয়ে যায়, বৌ অনায়াসেই ঝঙ্কার দিয়ে বলতে পারে, তুমি তো ছুটির সবটাই ওখানে গিয়ে কাটিয়ে এলে?

অনেক কিছু প্রোগ্রাম থাকে তাদের, তিরিশ দিনের ঠাসবুনুনি। সেই বুনুনি থেকে দুএকটা সুতো সরিয়ে নিলেও ফাঁকটা প্রকট হয়ে ওঠে।

সেজদির দুই বৌ দুধরনের, কিন্তু ছুটিতে বাপের বাড়ির ব্যাপারে প্রায় অভিন্ন। তবু বড় বৌ কদাচ কখনো চন্দননগরে অ্যাসে, ছোট বৌ কদাচ না।

ওরা এলে সেজদির সংসারটা সংসারের চেহারা নেয় দুতিন দিনের জন্যে।

তাছাড়া সারা বছর শুধু একটি অখণ্ড স্তব্ধতা।

পাড়ার মহিলারা দৈবাৎই আসেন, কারণ মোহনের মার সঙ্গে ওঁদের সুরে মেলে না। যেটুকু আসেন, নিতান্তই কৌতূহলের বশে। নিতান্তই সংবাদ সংগ্রহের আশায়, নচেৎ বলতে গেলে সেজদি তো জাতিচ্যুত।

গঙ্গাবক্ষে বাস করেও মোহনের মা নিত্য তো দূরের কথা, যোগেযাগেও গঙ্গাস্নান করেন না, পুজো করেন না, হিন্দু বিধবা-জনোচিত বহুবিধ আচারই মানেন না। এমন কি জানেনও না। বিধবাকে যে হরির শয়ন পড়ার পর পটল আর কলমি শাক খেতে নেই, একথা জানতেন না তিনি, তারকের মা সেটা উল্লেখ করায় হাসিমুখে বলেছিলেন, তাই বুঝি? কিন্তু হরির শয়নকালের সঙ্গে পটল-কলমির সম্পর্ক কি?

তারকের মা গালে হাত দিয়েছিলেন, ওমা শোনো কথা! বলি মোহনের মা, কোন বিলেতে মানুষ হয়েছিলে তুমি গো? শ্ৰীহরি যে কলমি শাকের বিছানায়, পটলের বালিশ মাথায় দিয়ে ঘুমোন, তাও জানো না? সেদিনকে-ইয়ে তোমার সেই অম্বুবাচীর দিনকের কথায় আমরা তো তাজ্জব! দত্তদিদি ফুলকুমারী আর আমি হেসে বাঁচি না। অম্বুবাচীতে বিধবাকে আগুন স্পর্শ করতে নেই শুনে তুমি আকাশ থেকে পড়লে!..যাই বলে ভাই, তোমার চোখ-কান বড় বন্ধ! ঘরে না হয় শাশুড়ী-ননদ ছিল না, পাড়াপাড়শীর সংসারও তো দেখে মানুষ!

সেজদির বড় ছেলের নাম মোহন।

তাই সেজদি এই মহিলাকুলের অনেকের কাছেই মোহনের মা নামে পরিচিত।

সেজদির স্বামী অমলবাবুর বদলির চাকরি ছিল, জীবনের অনেকগুলো দিনই সেজদির বাইরে বাইরে কেটেছে, শেষের দিকে অমলবাবু দেশের পোড়ো ভিটের সংস্কার করে, গঙার ধার ঘেঁষে এই বারান্দাটি বানিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, এ বারান্দা তোমার জন্যে। তুমি কবি মানুষ। স্বামী সেজদিকে ভালবাসতেন বৈকি, খুবই ভালবাসতেন, কিন্তু তার নিজস্ব ধরনের সেই ভালবাসা-কিন্তু ও কথা থাক। পৃথিবীতে কত মানুষ, কে কার ছাঁচে ঢালা?

কেউ না।

তবু যারা বুদ্ধিমান, তারা সুবিধে আর শান্তির মুখ চেয়ে নিজের ধারালো কোণগুলো ঘষে ক্ষইয়ে ভোঁতা করে নিয়ে অন্যের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়। নিয়ত সংঘর্ষের হাত এড়ায়।

তারা জানে সংসার করার সাধ থাকলে, ওই ধারালো কোণগুলো তো থাকবে না, যাবেই ক্ষয়ে। শুধু সেটা যাবে নিয়ত সংঘর্ষের যন্ত্রণাময় অভিজ্ঞতায়। তার থেকে নিজেই ঘষে নিই।

আর যারা বুদ্ধিমান নয় এবং সংঘর্ষকে ভয় পায়, তারা একপাশে সরে থাকে, নিজেকে নিয়ে গুটিয়ে থাকে। তারা কদাচ কখনো একটি মনের মতো মন পেলে, তবেই সেখানে নিজেকে খোলে।

সেজদি বুদ্ধিমতী নয়।

সেজদি এদের দলে।

সেজদি তাই ওই তারকের মা, ফুলকুমারীদের সঙ্গে একথা বলে তর্ক করতে বসেন না, আপনাদের শ্ৰীহরির গোলোক বৈকুণ্ঠে কি অন্য বিছানা জোটেনি? মা-লক্ষ্মীর ভাণ্ডার ফাঁকা? তাই ভদ্রলোককে কলমি-পটলের শরণাপন্ন হতে হয়? অথবা এ তর্কও করেন না, বাড়িতে যদি শুধু বিধবা মা আর ছেলেরা থাকে, মা ওই আগুন-নিষেধ পালন করতে না খাইয়ে রাখবে তাদের? রেঁধে দেবে না? কথাগুলো তো মনে এসেছিল সেজদির।

হয়তো সেজদি এই তর্ককে বৃথা শক্তিক্ষয় বলে মনে করেন, অথবা সেজদি ওই মহিলা দলের সমালোচনাকে তেমনি গুরুত্ব দেন না। হয়তো তাদের তেমন গ্রাহ্য করেন না।

সেজদিকে বাইরে যতই অমায়িক মনে হোক, ভিতরে ভিতরে হয়তো দস্তুর মতো উন্নাসিক।

তাই তিনি ছেলেদের বিদায়দানকালে কখনো চোখের পাতা ভিজে করেন না, কখনো আবার শীগগির আসিস বলে সজল মিনতি জানান না।

হাসি-কথার মধ্য দিয়েই তাদের বিদায় দেন।

নাতি-নাতনীদের যে তার দেখতে খুব ইচ্ছে হয়, তারা এলে যে মনটা ভরে ওঠে, একথা সেজদির মোহন শোভন জানে না। তাই তারা খেয়ালও করে না, মায়ের কাছে নিয়ে যাই ওদের।

শুধু শোভনের মেয়েটা বড় বেশী সুন্দর দেখতে হয়েছে বলে একবার দেখাতে নিয়ে এসেছিল। শুধু মোহনের ছোট ছেলের একবার পক্স হওয়ায় বড়টিকে মার কাছে কিছুদিনের জন্য রেখে গিয়েছিল। ছেলের দিদিমারা তখন সপরিবারে তীর্থে গেছেন।

আসানসোলে থাকে মোহন, খুব একটা দূরত্ব তো নয়।

শোভন অনেক দূরে।

শোভনের দূরত্ব ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। মাইলের হিসেব দিয়ে সে দূরত্বকে আর মাপা যাচ্ছে না।

অথচ আগে শোভনই মার বড় নিকট ছিল। শোভনই প্রথম ভাল আর বড়ো কোয়ার্টার পাওয়া মাত্ৰই মাকে নিজের কাছে নিয়ে গিয়েছিল।… বলেছিল, তোমার একা পড়ে থাকা চলবে না।

কিন্তু শোভনের এই বোকাটে সেণ্টিমেণ্ট শোভনের বৌ সহ্য করবে কেন? বরের ওই আহ্লাদেপনার তালে তাল দিতে গেলে তার নিজের জীবনের সব তাল বেতাল হয়ে যাবে না? সব ছন্দপতন হয়ে যাবে না?

তার এই ছবির মতো সাজানো সংসারে শাশুড়ী বস্তুটা একটা অদ্ভুত ছন্দপতন ছাড়া আর কি?…দুচার দিনের জন্যে এসে থাকো, আদর করবো যত্ন করবো, ব্যবহার কাকে বলে তা দেখিয়ে দেব। কিন্তু শেকড় গাড়তে চাইলে?

অশ্বখের চারাকে চারাতেই বিনষ্ট করতে হয়।

আদুরে বেড়ালকে পয়লা রাত্তিরেই কাটতে হয়।

শোভনের বৌ জানতো একথা।

শোভনের বৌ তার জানা বিদ্যেটা প্রয়োগ করতে দেরি করেনি।

হয়তো কিছুটা দেরি করতো, হয়তো একবারও শোভনতা-অশোভনতার মুখ চাইতো, যদি শাশুড়ী তার সাধারণ বিধবা বুড়ীর মত ভাঁড়ার ঘর পুজোর ঘরের মধ্যেই নিমগ্ন থাকতো। যদি কৃতী ছেলের বৌয়ের সঙ্গে যেমন সসম্ভ্রম ব্যবহার করতে হয় তা করতো, যদি ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়ার পদ্ধতিতে বৌকে ডিঙিয়ে ছেলের সঙ্গে বসে গল্প না জুড়তো।

কিন্তু শোভনের নির্বোধ মা সাহেব ছেলেকে সাহেবের দৃষ্টিতে না দেখে ছেলের দৃষ্টিতে দেখতে গেলেন। শোভনের মা ভাঁড়ার ঘর পুজোর ঘরের ছায়াও না মাড়িয়ে ড্রইংরুমে এসে সোফায় বসে খবরের কাগজ পড়তে শুরু করলেন, পশম বুনতে শুরু করলেন।

বুনলেন অবশ্য শোভনের জন্যেই, কিন্তু কে চায় সে জিনিস? বৌ কি বুনতে জানে না? আর সেই জানাটা জানাবে না?

.

সেজদি তাই ছেলেকে বললেন, বললে তুই আমায় মারবি শোভন, আমার কিন্তু গঙ্গার ধারের সেই বারান্দাটার জন্যে বেজায় মন-কেমন করছে। আমায় বাবু একটু পৌঁছে দিয়ে আয়। তোর ছুটি না থাকে তোর চাপরাসী-টাসী কাউকে দিয়ে—

শোভন হয়তো ভিতরে ভিতরে কিছুটা টের পাচ্ছিল, শোভন হয়তো একটা অদৃশ্য উত্তাপের মধ্যেই কাটচ্ছিল, কিন্তু অকস্মাৎ এতটার জন্যে প্ৰস্তুত ছিল না। মায়ের শক্তির উপর আস্থা ছিল তার।

শোভনের অতএব অভিমান হল।

হয়তো শোভন তার মায়ের প্রকৃতিই বেশী পেয়েছে। তাই শোভন হাঁ হাঁ করে উঠলো না। শোভন শুধু বললো, আজই যেতে চাও?

কী মুশকিল! আজই কি রে! কাল পরশু তোর সুবিধে মতো-

থাকাটা একেবারেই অসম্ভব হলো?

শোভনের মা হালকা গলায় হেসে বললেন, নাঃ, তুই দেখছি বড্ড রেগে যাচ্ছিস। কিন্তু সত্যিই রে, কদিন ধরে কেবলই সেই গঙ্গা-গঙ্গা মন করছে।

শোভন বললো, আচ্ছা ঠিক আছে। মানে সব চেয়ে বেঠিকের সময় যে কথাটা বলে লোকে। ঠিক আছে—অর্থাৎ ঠিক নেই।

সেজদির ছেলে কি মাকে নিষ্ঠুর ভাবলো না? সে কি মনে করলো না-মা আমার মনের দিকটা দেখলেন না? মার অহমিকাটাই বড় হলো? জানি রেখা তেমন নম্র নয়, কিন্তু করা যাবে কি? সবাই কি সমান হয়? আমি ওকে নিয়ে ঘর করছি না?

হয়তো শোভনের মা ছেলের মুখের রেখার এই ভাষা পড়তে পারলেন, কিন্তু তিনি বলে উঠতে গেলেন না, ওরে তুই যতটুকু দেখতে পাস, সেইটুকুই সব নয়।

শোভনের মা সমন্ত অপরাধের বোঝা নিজের মাথায় তুলে নিয়ে হাস্যমুখে ছেলের বাড়ি থেকে সরে এলেন। এই সরে আসাটা কি অপরাধ হলো পারুলের? অনামিকা দেবীর সেজদির? মোহন-শোভনের মার?

তা অপরাধী বৈকি।

ছেলে-বৌয়ের একান্ত ভক্তির নৈবেদ্য পায়ে ঠেলে একটা তুচ্ছ মান অভিমান নিয়ে খরখরিয়ে চলে যাওয়াটা অপরাধ নয়?

আশেপাশে সমন্ত কোয়ার্টারের বাসিন্দারা এই হঠাৎ চলে যাওয়ায় অবাক হয়ে প্রশ্ন করতে গিয়ে আরো অবাক হল।

একদিন বৌ শাশুড়ীর রাত্রের আহারের ক্ষীর করে রাখতে ভুলে গিয়ে বেড়াতে চলে গিয়েছিল বলে, চলে যাবে মানুষ ছেলের বাড়ি ছেড়ে? ছিঃ!

কেউ কেউ বললো, দেখলে কিন্তু ঠিক এরকম মনে হতো না।

রেখা মুখের রেখার অপূর্ব একটি ব্যঞ্জনা ফুটিয়ে বললে, বাইরে থেকে যা দেখা যায় তার সবটাই সত্যি নয়।

আশ্চর্য!

আশ্চর্য কিছুই নয়, বড় ছেলের সংসারেও তো ঠিক এই করেছিলেন!

যারা পারুলকে ভালবাসতো, তারা একটু মনঃক্ষুন্ন হল, যারা বান্ধবীর শাশুড়ীকে বা বন্ধুর মাকে ভালবাসার মতো হাস্যকর ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামায় না, তারা শুধু খানিকটা নিন্দে করলো।

তারপর আর শোভনের সংসারে শোভনের মার অস্তিত্বের কোনো স্মৃতি রইল না। শোভনের জন্যে সেই আধবোনা সোয়েটারটা অনেকদিন পর্যন্ত ট্রাঙ্কের উপর পড়ে থাকতে থাকতে কোথায় যেন হারিয়ে গেল।

শোভনের দামী কোয়ার্টারে সুন্দর লন, গেঞ্জি-ট্রাউজার পরা সাহেবদের এবং কোমরে আঁচল জড়ানো মেমসাহেবদের টেনিস-কল্লোলে-মুখরিত হতে থাকলো, শোভনের খাবার টেবিল প্রায়শই নিমন্ত্রিত অতিথির অভ্যর্থনার আয়োজনে প্ৰফুল্লিত হতে থাকলো, শোভনের ঘর যখন তখন রেখার উচ্ছ্বসিত হাসিতে মুখরিত হতে থাকলো।

তবে আর শোভন তার ভিতরের একটি বিষণ্ণ শূন্যতাকে লালন করে করে দুঃখ পেতে যাবে কেন?

হৃদয়ভারাবনত জননী, আর অভিমান উত্তপ্ত স্ত্রী, এই দুইয়ের মাঝখানে অপরাধীর ভূমিকা নিয়ে পড়ে থাকায় সুখই বা কোথায়? একটাকে তো নামাতেই হবে জীবন থেকে?

০৫. ট্রেনের জানলায় মুখ রেখে

ফেরার পথে পারুল ট্রেনের জানলায় মুখ রেখে বাইরের গভীর অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ ভেবেছিল, ধারণা ছিল যুগের নিয়ম অনেকটা সিঁড়ির নিয়মের মত। সে ধাপে ধাপে পরিবর্তিত হতে হতে চলে…তা হলে কি আমার অন্যমনস্কতার অবকাশে একটা যুগ তার কাজ করে চলে গেছে, আমি খেয়াল করিনি?

নইলে সে যুগটা কোথায় গেল?

আমার যুগটা? আমি আমার মাকে দেখেছি।–দেখেছি জেঠিমা কাকিমা পিসিমাদের, দেখেছি, আমার শাশুড়ী খুড়শাশুড়ীদের। ওপরওয়ালার জাঁতার তলায় নিষ্পিষ্ট সেই জীবনগুলি শুধু অপচয়ের হিসেব রেখে চলে গেছে…আমরাও আমাদের বধূজীবনে সেই অপচয়ের জের টেনেই চলে এসেছি আর ভেবেছি আমাদের কাল আসতে বুঝি বাকি আছে এখনো। সেই আসার পদধ্বনির আশায় কান পেতে বসে থাকতে থাকতে দেখছি আমরা কখন যেন বাতিলের ঘরে আশ্রয় পেয়ে গেছি!

সে কাল টা তবে গেল কোথায়?

যেটার জন্যে আমাদের আশা ছিল, তপস্যা ছিল, স্বপ্ন ছিল?

এখন যাদের কাল তারা একেবারে নতুন, একেবারে অপরিচিত। তাদের কাছে গিয়ে খোঁজ করা যায় না, হাঁ গো সেই কালটা কোন ছিদ্র দিয়ে গলে পড়লো? দেখতে পাচ্ছি না তো? আমার তপস্যাটা তাহলে স্রেফ বাজে গেল?

আমরা মেয়েরা লড়াই করেছিলাম—

মনে মনে উচ্চারণ করেছিল পারুল অন্যায়ের বিরুদ্ধে, উৎপীড়নের বিরুদ্ধে, অযথা শাসনের বিরুদ্ধে, পরাধীনতার বিরুদ্ধে-আমি, আমার পূর্বতনীরা।….

সেই লড়াইয়ে তবে জিত হয়েছে আমাদের।

সব শক্তি হাতে এসে গেছে মেয়েদের। সব অধিকার।

…শুধু প্রকৃতির অসতর্কতায় আমাদের ভাগটা পেলুম না। আমার যুগটা কখন স্খলিত হয়ে পড়ে গেছে।

তবে আর কী করবো?

প্রত্যাশার পাত্রটা আর বয়ে বেড়াবো কেন?

জানলাটা বন্ধ করে একখানা বই খুলে বসেছিল পারুল, তার মুখে একটা সূক্ষ্ম হাসি ফুটে উঠেছিল। ভেবেছিল, এ যুগের নাটকে তবে আমাদের ভূমিকা কি? কাটা সৈনিকের? স্টেজে আসবার আগেই যাদের মরে পড়ে থাকতে হয়?

কিন্তু ওসব তো অনেকদিন আগের কথা। তখন তো শোভনের ওই ডল পুতুলের মত মেয়েটা জন্মায়নি। যাকে নিয়ে এসে দেখিয়ে গেল সেবার শোভন আহ্লাদে গৌরবে জ্বল-জ্বল করতে করতে। কত বকবক করে গেল মেয়ের অলৌকিক বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে।

মেয়েটাকে দেখে সত্যিই বুক ভরে উঠেছিল পারুলের। মনে হয়েছিল এমন একটা অনিন্দ্যসুন্দর বস্তুর অধিকারী হতে পারা কী সৌভাগ্যের!

কিন্তু চলে যাবার সময় তো কই বলে ওঠেনি, আবার আনিস রে! চলে যাওয়ার পর এই এতোদিনের মধ্যে তো কই চিঠিতে অনুরোধ জানায়নি, আর একবার বড় দেখতে ইচ্ছে করছে রে!

শোভন নিজে ইচ্ছে করে মেয়ের নতুন নতুন অবস্থার আর বয়সের ফটো মাকে পাঠায়। তাই থেকেই জেনেছে পারুল মেয়েটা এখন ইউনিফর্ম পরে স্কুলে যেতে শুরু করেছে!

সুখে থাক, ভাল থাক, তবু তো এই ভালবাসাটুকুও রেখেছে শোভন মার জন্যে।

পারুল ওদের কাছে কৃতজ্ঞ।

পারুল তার পরলোকগত স্বামীর প্রতিও কৃতজ্ঞ, এই বারান্দাটির জন্যে।

এইখানে

যখন পড়ন্ত বিকেলের আলো মুখে মেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবছিল কী আশ্চর্যের তুলনাই রেখে গেছেন কবি!

ওই যেথা জ্বলে সন্ধ্যার কুলে দিনের চিতা।

দিনের চিতা! কী অভাবনীয় মৌলিক!

আগে কী কেউ কখনো দেখেছিল এই চিতাকে?

বহুদিনের পড়া, মুখস্থ করা এই কবিতাটাই হঠাৎ যেন নতুন একটা অর্থ বহন করে এসে দাঁড়িয়েছে, পারুল সে অর্থকে কোথায় যেন মিলোচ্ছে, সেই সময় অনামিকা দেবীর চিঠিখানা এলো।

বকুলের স্কুলের খাতাটা আমি খুঁজে পাচ্ছি না, তুই খুঁজে দেখিস।

বকুলের সেজদিকে কিছু খুঁজে দেখতে হয় না।

সেজদির সিন্দুকে সব তোলা থাকে। কে জানে সিন্দুকটা সেজদির কত বড়!

সেজদির চিঠিটা হাতের মুঠোয় চেপে রেখে মনে মনে বললেন, আছে আমার কাছে তবে। সবটা নয়, অনেকটা। কিন্তু আমি সেটা বার করে কী করবো? আমি কি লিখতে পারি?

লিখতে পারেন না সেজদি।

কবিতা পারেন, গদ্য নয়।

তাই মনে মনে উচ্চারণ করেন, আমি খুঁজে পেয়ে কী করবো?

তারপর বলেন, বকুল বলেছিল নিজেদের কথা আগে বলতে নেই। আগে পিতামহী প্রপিতামহীর ঋণ শোধ করতে হয়।…সে ঋণ তবে শোধ করছে না কেন বকুল? না কি করেছে া কখন, সেও আমার অসতর্কতায় চোখ এড়িয়ে গেছে?

 ০৬. উত্তরবঙ্গের সাহিত্য সম্মেলন

উত্তরবঙ্গের সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হলো।

তিনদিন ব্যাপী অধিবেশনের প্রথম দিনেই অধিবেশনের মধ্যকালে প্রধান অতিথির ভাষণ উপলক্ষ করে উদ্দাম এক হট্টগোল শুরু হয়ে সভা পণ্ড হয়ে গেল।

আর শুধু যে সেদিনের মতই গেল তা নয়, আগামী কাল পরশুর আশাও আর রইল না। কারণ পরিস্থিতি শোচনীয় তো বটেই, আশঙ্কাজনকও। এই সামান্য সময়েরই মধ্যেই সভা-সজ্জা ভেঙেচুরে পুড়ে এমনই তছনছ হয়ে গেছে যে, তার থেকে সম্মেলনের ভবিষ্যৎ ললাটলিপি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।

ভয়ঙ্কর হৈ-চৈটা কমলে দেখা গেল সভায় সাজানো ফুলদানি ভেঙেছে, মঙ্গলঘট ভেঙেছে, বরেণ্য মনীষীদের ছবি ভেঙেছে, কাঁচের গ্লাস ভেঙেছে, সেক্রেটারীর বাড়ি থেকে সভাপতি প্রধান অতিথি আর উদ্বোধকের জন্য আনীত চেয়ার টেবিল ভেঙেছে এবং অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতির নাকের হাড় ভেঙেছে।

পুড়েছে প্যাণ্ডেলের বাঁশ, ডেকরেটারের পর্দা চাঁদোয়া, স্থানীয় এক তরুণ শিল্পীর বহু যত্নে তৈরী মণ্ডপের রূপসজ্জা এবং পরোক্ষে সম্মেলন আহ্বানকারীদের কপাল। এই সম্মেলনকে সাফল্যমণ্ডিত করতে অর্থ এবং সামর্থ্য তো কম ব্যয় করেননি তারা।

আয়োজনে ত্রুটিমাত্র ছিল না।

বিশেষ আমন্ত্রিতদের সময় ও শ্রম বাঁচাতে, এরা তাদের কলকাতা থেকে আনার জন্যে আকাশযানের ব্যবস্থা করেছিলেন, আকাশ থেকে ভূমিষ্ঠ হবামাত্র উলুধ্বনি ও শঙ্খধ্বনির ব্যবস্থা রেখেছিলেন, মাল্যে চন্দনে তিলকে ভূষিত করে সসম্মানে গাড়িতে তুলিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তাদের বিশ্রাম নিকেতনে।

তাদের শ্রম না হলেও শ্রম অপনোদনের প্রচুর বাবস্থা ছিল, আর তার সঙ্গে ছিল কৃতকৃতার্থের ভঙ্গী।

বাংলা সাহিত্যের ওই শ্রেষ্ঠ শ্রেষ্ঠ দিকপালেরা যে নিজ নিজ বহু মূল্যবান সময় ব্যয় করে উত্তর বাংলার এই সাহিত্য-সম্মেলনকে গৌরবান্বিত করতে এসেছেন এতে স্থানীয় আহ্বানকারীদের যেন কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।

প্রধান অতিথিই অবশ্য মধ্যমণি, বাকিরাও সঙ্গগুণে প্ৰাপ্যের অতিরিক্তই পেয়েছেন। অন্ততঃ অনামিকা দেবী তাই মনে করেছেন—এ নৈবেদ্য অমলেন্দু ঘটকের জন্যে—আমরা সর্বদেবতার একজন।

তা সৎসঙ্গে স্বৰ্গবাস, এ তো শাস্ত্রের বচন।

অনামিকা দেবী নিজে একথা ভাবলেও স্থানীয়রা তাকে অমলেন্দু ঘটকের থেকে কিছু কম ন্তব করছিল না। বিশেষ করে মহিলা-পাঠিকা কুল। অনামিকা দেবীর লেখায় নাকি তারা অভিভূত, বিচলিত, বিগলিত। তিনি নাকি মেয়েদের একেবারে হৃদয়ের কথা বুঝে লেখেন। মেয়েদের সুখ-দুঃখ, ব্যথা-বেদনা, আশা-হতাশা, ব্যর্থতা-সার্থকতা অনামিকা দেবীর লেখনীতে যেমন ফোটে তেমন বুঝি আর কারো নয়।

উচ্ছাসের ফেনাটা বাদ দিলেও, এর কিছুটা যে সত্যি, সে কথা অনামিকা দেবী কলকাতার বাইরে সুদূর মফঃস্বলে সভা করতে এসে অনুভব করতে পারেন। যারা দূর থেকে শুধু লেখার মধ্যে তাঁকে চিনেছে, ভালবেসেছে, তাদের ভালবাসাকে একান্ত মূল্য দেন অনামিকা দেবী।

কলকাতায় থাকেন, সেখানেও অজস্র পাঠিকা, কে বা তাকে দেখতে আসে, কিন্তু এসব জায়গায় যেন এরা তাঁকে একবারটি শুধু চোখে দেখবার জন্যেই পাগল।

এই আগ্রহে উৎসুক মুখগুলির মধ্যেই অনামিকা দেবী তাঁর জীবনব্যাপী সাধনার সার্থকতা খুঁজে পান। মনে মনে বলেন, হ্যাঁ আমি তোমাদের লোক। তোমাদের নিভৃত অন্তরের কথাগুলি মেলে ধরবার জন্যেই আমার কলম ধরা। আমি যে দেখতে পাই ভয়ঙ্কর প্রগতির হাওয়ার মধ্যেও জায়গায় জায়গায় বন্দী হয়ে আছে সেই চিরকালের দুৰ্গতির রুদ্ধশ্বাস। দেখতে পাই আজও লক্ষ লক্ষ মেয়ে-সেই আলোহীন বাতাসহীন অবরোধের মধ্যে বাস করছে। এদের বাইরের অবগুণ্ঠন হয়তো মোচন হয়েছে, কিন্তু ভিতরের শৃঙ্খল আজও অটুট।

কলকাতার বাইরে আসতে পেলে খুশী হন অনামিকা দেবী।

কিন্তু এবারের পরিস্থিতি অন্য হয়ে গেল।

অবশ্য সভায় এসে বসা পর্যন্ত যথারীতিই সুন্দর সৌষ্ঠবযুক্ত পরিবেশ ছিল। এয়ারপোর্ট থেকে আলাদা আলাদা গাড়িতে করে উদ্বোধক, প্রধান অতিথি এবং সভানেত্রীকে আলাদা আলাদা জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। সভানেত্রীকে অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতির বাড়িতে, উদ্বোধককে একটি বিশিষ্ট স্কুলবাড়িতে এবং প্রধান অতিথিকে স্বয়ং সেক্রেটারীর বাড়িতে!

আলাদা আলাদা করে রাখার কারণ হচ্ছে সম্যক যত্ন করতে পারার সুযোগ পাওয়া! ভা সারাদিন যত্নের সমুদ্রে হাবুড়ুবুই খাচ্ছিলেন অনামিকা দেবী। বাড়ির একটি বৌ কলকাতার মেয়ে, সে এতো বেশী বিগলিত চিত্তে কাছে কাছে ঘুরছিল, যেন তার পিত্ৰালয়ের বার্তা নিয়েই এসেছেন অনামিকা দেবী।

উত্তরবঙ্গে ইতিপূর্বে আসেননি অনামিকা দেবী, ভালই লাগছিল বেশ। অধিবেশনের পালা চুকলে যথারীতি আমন্ত্রিত অতিথিদের নিয়ে বহির্দৃশ্য দেখিয়ে আনার ব্যবস্থা আছে। সেটাও ভাল লাগছিল।

মোট কথা, কলকাতা থেকে আসার সময় যে ক্লান্তি এবং অবসাদ ধরনের একটা অনিচ্ছা গ্ৰাস করেছিল, এখানে এসে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই সেটা সহসা অন্তৰ্হিত হয়ে ভালই লাগিছিল আগাগোড়া। আর অবিরত একটা কথা মনে হচ্ছিল-কতখানি আগ্রহ আর উৎসাহ থাকলে এমন ভাবে হরিদ্বার-গঙ্গাসাগর এক করে এহেন একটি সম্মেলনের আয়োজন ঘটিয়ে তোলা সম্ভব হয়!

সেই আয়োজন ভয়ঙ্কর একটা নিষ্ঠুরতায় তছনছ হয়ে গেল।

এ নিষ্ঠুরতা কার?

মানুষের?

না ভাগ্যের?

গোলমাল শুরু হওয়ার প্রথম দিকে সম্পাদক এবং স্বয়ং অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতিও, একে একে মাইকে মুখ দিয়ে অমায়িক কণ্ঠে করজোড়ে প্রার্থনা করেছিলেন, আপনারা ক্ষান্ত হোন, আপনারা শান্ত হোন। আপনাদের যা বক্তব্য তা বলবার সুযোগ আপনাদের দেওয়া হবে। প্রতিনিধি স্থানীয় কেউ মঞ্চে উঠে আসুন।

কিন্তু সে আবেদন কাজে লাগেনি।

বাঁধ একবার ভেঙে গেলে কে রুখতে পারে উদ্দাম জনস্রোতকে?

প্রধান অতিথির ভাষণের সুরে ক্ষিপ্ত হয়ে যারা সভায় একটা ঢিল নিক্ষেপ করে চিৎকার করে উঠেছিল, বন্ধ করে দেওয়া হোক, বন্ধ করা দেওয়া হোক, এ কথা চলবে না। তারা ছাড়াও তো আরো অনেক ছিল। যাদের বক্তব্যও নেই, প্রতিবাদও নেই, আছে শুধু দুৰ্দম মজা দেখার উম্মাদ উল্লাস।

ভাঙবার এবং পোড়াবার কর্তব্যভার এরাই গ্রহণ করেছিল।

হয়তো বরাবর তাই করে।

এ দায়িত্ব এরাই নেয়।

সাদা-পোশাক-পরা পুলিসের মতো সর্বত্রই বিরাজ করে এরা শান্ত চেহারায়। প্রয়োজন না ঘটলে হয়তো দিব্য ভদ্রমুখে তারিয়ে তারিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত উপভোগ করে অথবা যন্ত্রসঙ্গীতে তাল দেয়। বড়জোর কোনো গায়িকার গানটা ভাল লাগলে, ভিড়ের মধ্যে থেকে-আর একখানা হোক না দিদি-বলে চেঁচিয়ে উঠেই ঝুপ করে আবার বসে পড়ে। এর বেশী নয়।

কিন্তু প্রয়োজন ঘটলে?

বাধা ভাঙলে?

মুহূর্তে ওদের কর্তব্যবোধ সজাগ হয়ে ওঠে। ওরা সেই ভাঙা বাঁধ আরো ভেঙে বন্যার স্রোতকে ঘরের উঠোনে ডেকে আনে। রেলওয়ে স্টেশনের কুলিদের মতো নিজেরাই হট্টগোল তুলে ঠেলা ঠেলি গুতোগুতি করে এগিয়ে যায় চেয়ার ভাঙতে, টেবিল ভাঙতে, মণ্ডপে আগুন ধরাতে।

ও রাস্তা শুধু ওই প্রথমটুকুর।

সেটুকু করেছিল বোধ হয় অতি প্ৰগতিবাদী কোনো দুঃসাহসিক দল। তারপর যা হবার হলো।

মাইকের ঘোষণা, করজোড় প্রার্থনা কিছুই কাজে লাগলো না, ঢিলের পর ঢিল পড়তে লাগলো ঠকাঠক।

অতএব উদ্যোক্তারা তাদের পরম মূল্যবান অতিথিদের নিয়ে পালিয়ে প্রাণ বাঁচালেন। সেক্রেটারীর বাড়ি মণ্ডপের কাছে, সেখানে এই বিশেষ তিনজন এবং অবিশেষ কয়েকজন এসে আশ্রয় নিলেন, এবং সেখান থেকেই মণ্ডপের মধ্যেকার কলরোল শুনতে পেলেন।

যাঁরা অনেক আগ্রহ নিয়ে, অনেক আয়োজন করে হয়তো দূর-দূরান্ত থেকে সম্মেলনে যোগ দিতে এসেছিলেন, তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলেন, শিশু বৃদ্ধ মহিলা নির্বিশেষে দিগ্বিদিকে ছুটলেন।

কারণ কিছুক্ষণের মধ্যেই ভাঙা-পর্ব শেষ করে জ্বালানোর কাজে আত্মনিয়োগ করেছিল তারা।

যাদের মাইক তারা বেগতিক দেখে দড়িদড়া গুটিয়ে নিয়ে সরে পড়ছিল, তাদেরই একজনের হাত থেকে একটা মাইক কেড়ে নিয়ে কোনো একজন কর্তব্যনিষ্ঠ তারস্বরে গান জুড়েছিল, জীর্ণ প্ৰাণের আবর্জনা পুড়িয়ে দিয়ে আগুন জ্বালো…আগুন জ্বালো…আগুন জ্বালো।

এখান থেকে শুনতে পাওয়া যাচ্ছিল সে গান।

অমলেন্দু ঘটক ক্ষুব্ধ হাসি হেসে বললেন, রবীন্দ্রনাথ সকলের, তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। …সকলের জন্যেই তিনি গান রেখে গেছেন।

তাড়াতাড়ি মঞ্চ থেকে নামতে গিয়ে কোঁচায় পা আটকে হোঁচট খেয়ে তাঁর চশমাটা ছিটকে কোথায় পড়ে গিয়েছিল, তাই চোখ দুটো তার কেমন অদ্ভুত অসহায়-অসহায় দেখতে লাগছে।

উদ্বোধক বললেন, আমার মনে হয় এটা সম্পূর্ণ পলিটিক্‌স।

সেক্রেটারীর কান এবং প্ৰাণ সেই উত্তাল কলরোলের দিকে পড়েছিল, তবু তিনি এদের আলোচনায় যোগ দেওয়া কর্তব্য মনে করলেন। শুকনো মুখে বললেন, ঠিক তা মনে হচ্ছে না। পাড়ায় কতকগুলো বদ ছেলে আছে, তারা বিনে পয়সায় জলসার দিনের টিকিট চেয়েছিল, পায়নি। শাসিয়ে রেখেছিল, আচ্ছা আমরাও দেখে নেব। সভা করা ঘুচিয়ে দেব।—তখন কথাটায় গুরুত্ব দিইনি, এখন বুঝছি শনি আর মনসার পুজো আগে দিয়ে রাখাই উচিত।

সম্মেলনে আগত কয়েকজন কিন্তু ব্যাপারটাকে পাড়ার কতকগুলো বদ ছেলের অসভ্যতা বলে উড়িয়ে দিতে রাজী হলেন না, তারা এর থেকে শৌলমারীর গন্ধ পেলেন, নকশালবাড়ির পদধ্বনি আবিষ্কার করলেন। অর্থাৎ ব্যাপারটাকে জুড়িয়ে দিতে রাজী হলেন না তারা।

সেক্রেটারীর বড় বাড়ি, দালান বড়।

অনেকেই ঢিল থেকে আত্মরক্ষা করতে এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে কেউ আলোচনার ধারা অন্য খাতে বাওয়ালেন।

গলার স্বর নামিয়ে বলাবলি করতে লাগলেন তারা, প্রধান অতিথি অবিমৃষ্যকারিতা করেছেন, এরকম সভায় ফট করে আধুনিক সাহিত্যে শ্লীলতা-অশ্লীলতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা ঠিক হয়নি ওর। মৌচাকে ঢিল দিতে গেলে তো ঢিল খেতেই হবে, সাপের ল্যাজে পা দিলে ছোবল।…

আরে বাবা বুঝলাম তুমি একজন প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক, বাজারে তোমার চাহিদা আছে, যথেষ্ট নামডাক আছে, মানে মানে সেইটুকু নিয়ে টিকে থাকো না বাবা! তা নয়—তুমি হাত বাড়িয়ে হাতী ধরতে গেলে! যুগকে চেনো না তুমি? জানো না এ যুগ কাউকে অমর হতে দিতে রাজী নয়, সবকিছু ঝেঁটিয়ে সাফ করে নিজের আসন পাতবার সংকল্প নিয়ে তার অভিযান?

অনামিকা দেবী ঘরের ভিতরে বসেছিলেন ভি আই পি-দের সঙ্গে, তিনি বাইরের ওই কথাগুলো শুনতে পাচ্ছিলেন না। তিনি শুধু ওই রাজনীতিই শুনছিলেন আর ভাবছিলেন, আগুন ধূমায়িত হয়েই আছে, যে কোনো মুহূর্তে জ্বলে ওঠবার জন্যেই তার প্রস্তুতি চলছে, শুধু একটি দেশলাই-কাঠির ওয়াস্তা।

হয়তো ওই প্ৰস্তুতিটা ভিন্ন ভিন্ন, কিন্তু আগুন যখন জ্বলে ওঠে তখন সব আগুনের চেহারাই এক।

সেই ভাঙচুর, তছনছ।

কার জিনিস কে ভাঙছে, কে কাকে ক্ষতিগ্রন্ত করছে, হিসেবও নেই তার।

হঠাৎ এই সময় ওই খবরটা এসে পৌঁছলো। মাইকের ডাণ্ডা ঠুকে অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতির নাকের হাড় ভেঙে গেছে।

০৭. খবরটা শুনে স্তব্ধ

খবরটা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলেন অনামিকা দেবী।

সেই সদাহাস্যমুখ প্রিয়দর্শন ভদ্রলোকটি।

তার বাড়িতেই অনামিকা দেবী রয়েছেন। আর একদিনেই যেন একটি আত্মীয়তা-ভাব এসে গেছে।

ভদ্রলোকের নাম অনিল, তার মা কিন্তু তাকে ডাকছিলেন নেনু নেনু বলে। ভদ্রলোক হেসে বলেছিলেন, নাঃ, তুমি মানসম্মান কিছু রাখতে দেবে না মা! দেখুন-এতো বড় ছেলেকে আপনার মতো একজন লেখিকার সামনে, এই রকম একটা নামে ডাকা!

সুন্দর ঘরোয়া পরিবেশ।

এটা প্রীতিকর।

অন্ততঃ অনামিকা দেবীর কাছে। অনেক সময় অনেক বাড়িতে দেখেছেন অদ্ভুত আড়ষ্ট একটা কৃত্রিমতা। অনামিকা দেবী যে একজন লেখিকা, এটা যেন তারা অহরহ মনে জাগরূক না রেখে পারছেন না। বড় অস্বস্তিকর।

অনামিকা দেবী তখন অনিলবাবুর কথায় হেসে বলেছিলেন, ওতে অবাক হচ্ছি না আমি। আমারও একটি ডাকনাম আছে, যা শুনলে মোটেই একটি লেখিকা মনে হবে না।

ভদ্রলোক বলেছিলেন, অধিবেশন হয়ে যাক, আপনার লেখার গল্প শুনবো।

লেখার আবার গল্প কি? হেসেছিলেন অনামিকা দেবী।

অনিলবাবু বলেছিলেন, বাঃ গল্প নেই? আচ্ছা গল্প না হোক ইতিহাসই! কবে থেকে লিখছেন, প্ৰথম কী ভাবে লেখার প্রেরণা এলো, কী করে প্রথম লেখা ছাপা হলো, এই সব!

অনামিকা দেবী বলেছিলেন, বাল্মীকির গল্প জানেন তো? মরা মরা বলতে বলতে রাম। আমার প্রায় তাই। লেখা শব্দটা তখন উল্টো সাজানো ছিল। ছিল খেলা। সেই খেলা করতে করতেই দেখি কখন অক্ষর দুটো জায়গা বদল করে নিয়েছে। কাজেই কেন লিখতে ইচ্ছে হলো, কার প্রেরণা পেলাম এসব বলতে পারবো না।

অনিলবাবুর স্ত্রী বলেছিলেন, আচ্ছা ওঁকে নাইতে খেতে দেবে না? যাও এখন পালাও। গল্প পরে হবে।

সেই পর টা আর পাওয়া গেল না।

সমন্ত পরিবেশটাই ধবংস হয়ে গেছে।

হঠাৎ ভয়ানক একটা কুণ্ঠা আসে অনামিকা দেবীর, নিজেকেই যেন অপরাধী অপরাধী লাগছে।

এই অনিলবাবুর বাড়িতেই তো তার থাকা। এই বিপদের সময় অনিলবাবুর মা আর স্ত্রী হয়তো অনামিকা দেবীর অসুবিধে নিয়ে, আহার আয়োজন নিয়ে ব্যন্ত হবেন। হয়তো অনামিকা দেবীকে

না, ওঁরা যদিও বা না ভাবেন, নিজেই নিজেকে অপয়া ভাবছেন অনামিকা দেবী।

ভাববার হেতু না থাকলেও ভাবছেন।

আর ভেবে কুণ্ঠার অবধি থাকছে না। এখনই অনামিকা দেবীকে ওঁদের বাড়িতে গিয়ে ঢুকতে হবে, খেতে হবে, শুতে হবে।

ইস! তার থেকে যদি তাকেও সেই স্কুলবাড়ির কোনো একটা ঘর দিতো!

কিন্তু তা দেবে না।

মহিলাকে মহিলার মত সসম্ভ্রমেই রাখবে। তাই স্বয়ং মূল মালিকের বাড়িতেই।

অথচ অনামিকা দেবীর মনে হচ্ছে, আমি কী করে অনিলবাবুর মার সামনে গিয়ে দাঁড়াবো?

হঠাৎ কানে এলো কে যেন বলছে, নাকের হাড়! আরে দূর! ও এমন কিছু মারাত্মক নয়।

শুনে খারাপ লাগলো।

মারাত্মক নয় বলেই কি কিছুই নয়?

যে আঘাতে উৎসবের সুর যায় থেমে, নৃত্যের তাল যায় ভেঙে, বীণার তার যায় ছিঁড়ে— সেটাও দুঃখের বৈকি।

কতো সময় ওই তুচ্ছ আঘাতে কতো মুহূর্ত যায় ব্যর্থ হয়ে!

.

মারাত্মক নয়, কিন্তু বেদনাদায়ক নিশ্চয়ই।

বাড়িটা যেন থমথম করছে।

যেন শোকের ছায়া কোথায় লুকিয়ে আছে। অপ্রত্যাশিত এই আঘাত যে সেই উৎসাহী মানুষটার মনের কতখানি ক্ষতি করবে। তাই ভেবে শঙ্কিত হচ্ছেন জননী-জায়া।

হাসপাতাল থেকে রাত্রে ছাড়েনি, কাল কেমন থাকেন দেখে ছাড়বে। মন-ভাঙা মা আর স্ত্রী অনামিকা দেবীর সঙ্গে সামান্য দু-একটি কথা বলেন, তারপর সেই বৌটির হাতে ওকে সমর্পণ করে দেন। যে বৌটি কলকাতার মেয়ে, যে অনামিকা দেবীর পায়ে পায়ে ঘুরছে আজ সারাদিন।

খিদে নেই বলে সামান্য একটু জল খেয়ে শুয়ে পড়লেন অনামিকা দেবী। বৌটি ওর মশারি গুঁজে দিতে এসে হঠাৎ বিছানার পায়ের দিকে বসে পড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, আপনি এতো নতুন নতুন প্লটে গল্প লেখেন, তবু আপনাকে একটা প্লট আমি দিতে পারি।

শুনে অনামিকা দেবীর মনের মধ্যে একটু সূক্ষ্ম হাসির রেখা ফুটে উঠলো। প্লট!

তার মানে আপন জীবনকাহিনী!

যেটা নাকি অনেকেই মনে করে থাকে আশ্চর্য রকমের মৌলিক, আর পৃথিবীর সব থেকে দুঃখবহ।

হ্যাঁ, দুঃখই।

সুখী সন্তুষ্ট মানুষেরা নিজের জীবনটাকে উপন্যাসের প্লট বলে ভাবে না। ভাবে দুঃখীরা, দুঃখ-বিলাসীরা।

বৌটিকে তো সারাদিন বেশ হাসিখুশি লাগছিল, কিন্তু হঠাৎ দেখলেন তার মুখে বিষণ্নতা, সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলছে, আমি আপনাকে একটি প্লট দিতে পারি।

তবে দুঃখবিলাসী!

নিজের প্রতি অধিক মূল্যবোধ থেকে যে বিলাসের উৎপত্তি।

আমি আমার উপযুক্ত পেলাম না।

এই চিন্তা নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, সমন্ত পাওয়াটুকুকেও বিস্বাদ করে তুলে এরা অহরহই দুঃখ পায়।

অনিলবাবুর ভাগ্নেবৌ।

কিন্তু মামাশ্বশুরের বাড়িতে থাকে কেন সে? তার স্বামী কোথায়?

এ প্রশ্ন অনামিকা দেবীর মনের মধ্যে এসেছিল, কিন্তু এ প্রশ্ন উচ্চারণ করা যায় না। তবু ভাবেননি হঠাৎ এক দীর্ঘশ্বাস শুনতে হবে।

শুনে না বোঝার ভান করলেন।

বললেন, আমাদের এই জীবনের পথের ধুলোয় বালিতে তো উপন্যাসের উপাদান ছড়ানো। প্রতিনিয়তই জমছে প্লট! এই যে ধর না, আজকেই যা ঘটে গেল, এও কি একটা নাটকের প্লট হতে পারে না?

নমিতা যেন ঈষৎ চঞ্চল হলো।

নমিতার এসব তত্ত্বকথা ভাল লাগলো না তা বোঝা গেল। অথবা শোনেওনি ভাল করে। তাই কেমন যেন অন্যমনস্কের মতো বললো—হ্যাঁ তা বটে। কিন্তু এটা তো একটা সাময়িক ঘটনা। হয়তো আবার আসছে বছর এর থেকে ঘটা করেই সাহিত্যসভা হবে। কিন্তু যে নাটক আর দুবার অভিনয় হয় না? তার কী হবে?

অনামিকা দেবী ঈষৎ চকিত হলেন। যেন ওই রোগা পাতলা সুশ্ৰী হলেও সাদাসিধে। চেহারার তরুণী বৌটির মুখে এ ধরনের কথা প্ৰত্যাশা করেননি।

আস্তে বললেন, তারাও কোথাও কোনো সার্থক পরিসমাপ্তি আছেই।

নাঃ, নেই।

নমিতা খাট থেকে নামলো।

মশারি গুজতে লাগলো।

যেন হঠাৎ নিজেকে সংযত করে নিলো।

অনামিকা দেবী মশারি থেকে বেরিয়ে এলেন। বললেন, এক্ষুনি ঘুম আসবে না, বোসো, তোমার সঙ্গে একটু গল্প করি।

না না, আপনি ঘুমোন। অনেক ক্লান্তি গেছে। আমি আপনাকে বকাচ্ছি দেখলে মামীমা রাগ করবেন।

বাঃ, তুমি কই বকাচ্ছ? আমিই তো বকবক করতে উঠলাম। বসো বসো। নাকি তোমারই ঘুম পাচ্ছে?

আমার? ঘুম? মেয়েটি একটু হাসলো।

অনামিকা দেবী আর ঘুরপথে দেরি করলেন না।

একেবারে সোজা জিজ্ঞেস করে বসলেন, আচ্ছা, তোমার স্বামীকে তো দেখলাম না? কলকাতায় কাজ করেন বুঝি?

নমিতা একটু চুপ করে থাকলো।

তারপর হঠাৎ বলে উঠলো, কলকাতায় নয়, কাজ করেন হৃষিকেশে। পরকালের কাজ। সাধু হয়ে গেছেন। বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

প্লটটা জলের মত পরিষ্কার হয়ে গেল অতএব।

যদিও এমন আশ্চর্য একটা প্লটের কথা আদৌ ভাবেননি অনামিকা দেবী।

ভেবেছিলেন সাংসারিক ঘাত-প্ৰতিঘাতের অতি গতানুগতিক কোনো কাহিনী বিস্তার করতে বসবে নমিতা। অথবা জীবনের প্রথম প্রেমের ব্যর্থতার। যেটা আরো অমৌলিক

প্ৰথম প্ৰেমে ব্যর্থতা ছাড়া সার্থকতা কোথায়?

কিন্তু নমিতা নামের ওই বৌটি যেন ঘরের এমন একটা জানলা খুলে ধরলো, যেটা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত।

অনামিকা দেবী অবাক হয়ে ভাবলেন, সেই ছেলেটা যদি এতোই ইচড়ে পাকা তো বিয়ে করতে গিয়েছিল কেন?

ক দিনই বা করেছে বিয়ে?

এই তো ছেলেমানুষ বৌ!

আহা ওকে আর একটু স্নেহস্পর্শ দিলে হতো। ওকে আর একটু কাছে বসালে হতো!

ওকে কি ডাকবেন?

নাঃ, সেটা পাগলামি হবে। তা ছাড়া আর হয়তো একটি কথাও মুখ দিয়ে বার করবে না ও! কোন মুহূর্তটা যে কখন কী কাজ করে বসে!

এমনি হঠাৎ হারিয়ে যাওয়া মুহূর্ত, হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যাওয়া মুহূর্ত এরাই তো জীবনের অনেকখানি শূন্য করে দিয়ে যায়।

আলোটা নিভিয়ে দিলেন।

জানলার কাছে এসে দাঁড়ালেন।

সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা দৃশ্য।

নিরন্ধ্র অন্ধকার, মাথার উপর ক্ষীণ নক্ষত্রের আলো। সমন্ত পটভূমিকাটা যেন বর্তমানকে মুছে নিচ্ছে।

কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আস্তে আস্তে বিছানায় এসে বসলেন। আর ঠিক সেই মুহূর্তে বকুল এসে সামনে দাঁড়ালো। সেই অন্ধকারে।

অন্ধকারে ওকে স্পষ্ট দেখা গেল না। কিন্তু ওর ব্যঙ্গ হাসিটা স্পষ্ট শোনা গেল।

কী আশ্চর্য! আমাকে একেবারে ভুলে গেলে? স্রেফ বলে দিলে খাতাটা হারিয়ে ফেলেছি?

অনামিকা দেবী ওই ছায়াটার কাছে এগিয়ে গেলেন। বললেন, না না। হঠাৎ দেখতে পাচ্ছি, হারিয়ে ফেলিনি। রয়েছে, আমার কাছেই রয়েছে। তোমার সব ছবিগুলোই দেখতে পাচ্ছি।

ওই যে তুমি নির্মল নামের সেই ছেলেটার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রয়েছে, ওই যে তুমি তোমার বড়দার সামনে থেকে মাথা নিচু করে চলে যাচ্ছ, ওই যে তোমার সেজদি পারুল আর তুমি কবিতা মেলানো-মেলানো খেলা খেলছো, ওই যে তোমার মৃত্যুশয্যাশায়িনী মায়ের চোখবোজা মুখের দিকে নিষ্পলক চেয়ে রয়েছ, সব দেখতে পাচ্ছি।

দেখতে পাচ্ছি মাতৃশোকের গভীর বিষণ্ণতার মধ্যেও তোমার উৎসুক দৃষ্টির প্রতীক্ষা। ওই মৃত্যুর গোলমালে দুটো পরিবারের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা গিয়েছে বেড়ে, বাঁধটা খানিক গেছে ভেঙে। বকুলের বড়দা তখন আর সর্বদা তীব্র দৃষ্টি মেলে দেখতে বসছেন না, বেহায়া বকুলটা পাশের বাড়ির ছেলেটার সঙ্গে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়েছে কিনা।

০৮. বকুলের বড়দাই

হ্যাঁ, বকুলের বড়দাই ওই গুরুদায়িত্ব মাথায় তুলে নিয়েছিল। বকুলের বাল্যকাল থেকেই। বকুলটা কোনো ফাঁকে পিছলে সরে গিয়ে পাশের বাড়ির ছেলেটার মুখোমুখি হচ্ছে কিনা তা দেখার।

আচ্ছা বাল্য আর কৈশোরের সীমারেখাটা বয়সের কোন রেখায় টানা হত সে যুগে!

বকুল জানে না সে কথা।

বকুল দশ—এগারো বছর বয়েস থেকেই শুনে আসছে, ধাড়ি মেয়ে, তোমার বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকবার এত কী দরকার?.. ধিঙ্গী অবতার! এবাড়ি ওবাড়ি বেড়িয়ে বেড়ানো হচ্ছে? যাও না সংসারের কাজ করগে না।…ছাতে ঘোরা হচ্ছিল? কেন? বড় হয়েছো, সে খেয়াল কবে হবে?

বড়দা বলতো, বাবা বলতেন।

বড়দাই বেশী।

আর বড়দার ওই শাসন-বাণীর মধ্যে যেন হিতচেষ্টার চাইতে আক্ৰোশটাই প্রকট ছিল। পাশের বাড়ির ওই নির্মলটার যে এ বাড়ির বকুল নামের মেয়েটার প্রতি বেশ একটু দুর্বলতা আছে, সে সত্য বড়দার চোখে ধরা পড়তে দেরি হয়নি। অতএব এদিক ওদিক কিছু দেখলেই বড়দার দেহের শিরায় শিরায় প্রবাহিত সনাতনী রক্ত উত্তপ্ত হয়ে উঠতো এবং শাসনের মাত্রা চড়ে উঠতো। বড়দা নির্মলকেও দূচক্ষের বিষ দেখতো। সে কি নির্মল বড়লোকের একমাত্র ছেলে বলে?

বকুলের মা বেঁচে থাকতে তবু বকুলের পৃষ্ঠবল ছিল। মা তার বড় ছেলের এই পারিবারিক পবিত্ৰতা রক্ষার কর্তব্যপালন দেখে রেগে উঠে বলতেন, তোর অতো সব দিকে নজর দিয়ে বেড়াবার কী দরকার? যা বারণ করবার আমি করবো।

তুমি দেখলে তো কোনো ভাবনাই ছিল না— বলতো বড়দা, অম্লান বদনে মার মুখের উপরেই বলত, তা দেখতে তো দেখি না। বরং আমাদের ওপর টেক্কা দিয়ে মেয়েকে আস্কারা দেওয়াই দেখি। খু-ব মনের মতন মেয়ে কিনা!

মা চুপ করে যেতেন।

শুধু কখনো কখনো মায়ের চোখের মধ্যে যেন আগুনের ফুলকি জ্বলে উঠতো। তবু মা বকুলকেই কাছে ডেকে বলতেন, দাদা যা ভালবাসে না, তা দাদার সামনে কোরো না।

ছেলেবেলা থেকে মা বকুলদের শিখিয়েছেন, যা করবে সাহসের সঙ্গে করবে! লুকোচুরির আশ্রয় নিয়ে কিছু করতে যেও না। অথচ মা তাঁর বড় ছেলের তীব্র তিক্ত ব্যঙ্গের মুখটা মনে করে বলতেন, ওর সামনে কোরো না। বলতেন না, কোনো সময়ই কোরো না।

কিন্তু মা আর বকুলের ভাগ্যে কতোদিনই বা ছিলেন? মৃত্যুর অনেক দিন আগে থেকেই তো সংসারের দৃষ্টিতে মৃত হয়ে পড়েছিলেন। ছায়া দিতে পারতেন। কই?

তারপর তো প্রখর সূর্যালোকের নীচে, সনাতনী সংসারের জাঁতার তলায় বড়দার সঙ্গে মুখোমুখি দাঁড়ানো বকুলের।

অকারণেই হঠাৎ-হঠাৎ বলে বসতো বড়দা, ওদের বাড়ির জানলার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে কী করছিলি?…বলত-বারান্দায় দাঁড়িয়ে কার সঙ্গে ইশারায় কথা হচ্ছিল?

অপরাধটা সত্যি হোক বা কাল্পনিক হোক, প্রতিবাদ করবার সাহস ছিল না বকুলের। বকুল শুধু মাথা হেঁট করে অস্ফুটে বলতো, কার সঙ্গে আবার, বাঃ!

বলতো, জানলার দিকে দাঁড়াতে যাবো কেন?

এর বেশী জবাব দেবার সাহস ছিল না বকুলের। বকুলের ভয়ে বুক টিপ টিপ করতো।

এ যুগের মেয়েরা যদি বকুলের সেই অবস্থাটা দেখতে পেতো, না জানি কতো জোরেই হেসে উঠতো।

অনামিকা দেবীর ভাইঝিটাই যদি দর্শক হত সেই অতীতের ছবির?

তা ও হয়তো হেসে উঠতো না।

ওর প্রাণে মায়া-মমতা আছে।

ও হয়তো শুধু মুখের রেখায় একটি কৃপার প্রলেপ বুলিয়ে বলতো, বেচারা!

তা শুধু ভাইঝি কেন, অনামিকা দেবীরও তো ওই ভীরু নির্বোধ মেয়েটার দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে-বেচারা! কী ভীরু! কী ভীরু!

কিন্তু ভীরু হওয়া ছাড়া উপায়ই বা কী ছিল বকুলের? কার ভরসায় সাহসী হবে? পাশের বাড়ির সেই ছেলেটার ভরসায়? অনামিকা দেবীর মুখে সূক্ষ্ম একটি কৃপার হাসি ফুটে ওঠে।

হাতে একবার হাত ছোঁয়ালে শীতের দিনে ঘেমে যেতো ছেলেটা। একটু ভালবাসা মত কথা কইতে গেলে কথাটা জিভে জড়িয়ে যেতো তার। আর জেঠিপিসির ভয়ে চোখে সর্ষেফুল দেখত।

তা জেঠি-পিসিদেরও তো ভীষণ ভাবে রাইট ছিল তখন শাসন করবার। নির্মল নামের সেই ছেলেটা তার দূর্দান্ত এক জেঠির ভয়ে তটস্থ থাকতো। জেঠির ঘ্রাণশক্তিটাও ছিল তীব্র। বিড়ালরা যেমন মাছ বস্তুটা বাড়ির যেখানেই থাকুক তার আঘ্রাণ পায়, জেঠিরও তেমনি বাড়ির যেখানেই কোনো অপরাধ সংঘটিত হোক তার আঘ্রাণ পেতেন।

অতএব নির্মলদের তিনতলার ছাতের সিঁড়ির ঘরটাকে অথবা সাতজন্ম ধুলো হয়ে পড়ে থাকা বাড়ির পিছন দিকের চাতালটাকে যখন বেশ নিশ্চিন্ত নিরাপদ ভেবে ওরা দুমিনিট দাঁড়িয়ে কথা বলছে, হঠাৎ জেঠির সাদা ধবধবে থানধুতির আঁচলের কোণটা ওদের চোখের সামনে দুলে উঠতো।

ওমা নির্মল তুই এখানে? আর আমি তোকে সারাবাড়ি গরু খোঁজা করে খুঁজে বেড়াচ্ছি!

ওই দুমিনিটের আগের মিনিটটায় নির্মল জেঠিমার চোখের সামনেই ছিল, মানে আর কি ইচ্ছে করেই চোখের সামনে ঘোরাঘুরি করে এসেছিল, যাতে তার অনুপস্থিতির পিরিয়ডটা অনেকক্ষণের ধূসবতায় ছড়িয়ে না পড়ে। তবু জেঠিমা ইতিমধ্যেই নির্মলকে গরুখোঁজা খুঁজে ফেলে বাড়ির এই অব্যবহৃত অবান্তর জায়গাটায় খুঁজতে এসেছেন!

কিন্তু খোঁজার কারণ?

সেটা তা অনুক্তই থেকে যায়।

জেঠিমার বিস্ময়োক্তিটাই যে শ্রোতা যুগলের বুকের মধ্যেটা ছুরি দিয়ে কেটে কেটে নুন দেয়।

ওমা! বকুলও যে এখানে? কতক্ষণ এলি মা? আহা মা-হারা প্ৰাণ, বাড়িতে তিষ্ঠোতে পারে না, ছুটে ছুটে পাড়া বেড়িয়ে বেড়ায়। আয় মা আয়, আমার কাছে এসে বোস।

অতএব মাতৃহীনা বালিকাকে ওই মাতৃস্নেহ-ছায়ায় আশ্রয় নিতে গুটিগুটি এগোতে হয়। নির্মল তো আগেই হাওয়া হয়ে গেছে, কোনো বানানো কৈফিয়তটুকু পর্যন্ত দেবার চেষ্টা না করে।

জেঠিমা বালবিধবা, জেঠিমা অতএব নিঃসন্তান। কিন্তু জেঠিমার সীমাহীন স্নেহসমূদ্র সৰ্বক্ষণ অভিষিক্ত করছে দেবর-পুত্রকন্যাদের। সেই অভিষিক্ত প্রাণীগুলো কি এমনই অকৃতজ্ঞ হবে যে তার প্রতি সশ্রদ্ধ সমীহশীল হবে না? বকুলেরই বা উপায় কি সেটা না হবার?

বকুলকেও জেঠির সঙ্গে সঙ্গে হয়তো তার নিরিমিষ রান্নাঘরের দরজায় গিয়ে বসতে হত এবং জেঠি শাক বাছতে বাছতে, কিংবা খুন্তি নাড়তে নাড়তে সুমধুর প্রশ্ন করতেন, তা হ্যাঁরে বকুল, তোর বাবা কি নাকে সর্ষের তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছে? তোর বিয়ের কিছু করছে না?

বলা বাহুল্য বকুলের দিক থেকে এ প্রশ্নের কোনো জবাব যেতো না। জেঠি পুনঃপ্রশ্ন করতেন, হচ্ছে কোনো কথাবার্তা? শুনতে পাস কিছু? তারপর ওই নিরুত্তর প্রাণীটার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে নির্মলের মায়ের দিকে তাকিয়ে বলতেন, বুঝলে ছোটবৌ…মেয়ের বিয়েটিয়ে আর দিচ্ছে না বকুলের বাবা, লাউ-কুমড়োর মতো পাঁড় রাখবে!

নির্মলের মা মানুষটা বড় সভ্য ছিলেন, এ ধরনের কথায় বিব্রত বোধ করতেন, কিন্তু দোর্দণ্ড প্রতাপ বড় জায়ের কথার উপর কথা বলার ক্ষমতা তার ছিল না।

তিনি অতএব শ্যাম কুল দুই রাখার পদ্ধতিতে বলতেন, মা-টি মারা যাওয়াতে আরো গড়িয়ে গেল! নইলে দিদি হয়ে যেতো এতোদিনে। ভদ্রলোক আরও তিন-তিনটে মেয়ে তো পার করেছেন।

জেঠিমা এ যুক্তিতে থেমে যেতেন না, তেতো-তেতো গলায় বলতেন, করেছেন, তখন সময়কালে। মেয়েরা নিজের ছক্কা পাঞ্জা হয়ে ওঠকার আগে। এবার ক্রমশঃ যতো শেষ, ততো বেশ। বকুল হল নভেলপাড়া একেলে মেয়ে, ও হয়তো একখানা লভ-টিভ করে বসে ব্যাপকে বলে বলবে, বাবা, হাড়ি ডোম বামুন কায়েত যাই হোক, অমুক লোকটার সঙ্গেই বিয়ে করতে চাই।…কী রে বকুল, বলবি নাকি?

জেঠিমা হেসে উঠতেন।

জেঠিমার সামনের একটা দাঁত ভাঙা ছিল, সেই ভাঙা দাঁতের গহ্বর দিয়ে হাসিটা যেন ছিটকে ছিটকে বেরিয়ে আসতো।

তাই জেঠি মিনিট কয়েক পরেই বলে উঠতেন, বকুল, কুমড়োফুলের বড়া-ভাজা খাবি?. কেন, না কেন? পিটুলীবাটা দিয়ে মুচমুচে করে ভেজেছি। নে একখানা ধর। তোরা যখন এ বাড়িতে প্রেথম এলি, তুই তো তখন কাঁথায় শোওয়া মেয়ে, তোর মা মাঝে মাঝে বেড়াতে আসতো। তা একদিন এমনি কুমড়োফুলের বড় ভাজছি, বললাম, গরম গরম ভাঁজছি, খাও দুখানা; খেয়ে অবাক, বলে পিটুলীবাটা দিয়ে যে এমন বড় হয় এ তো কখনো জানি না, ভাল-বাটা দিয়ে হয় তাই জানি।

বকুলের সেই এক আবেগ-থরথর মুহূর্তের উপর চিলের ডানার ঝাপটা বসিয়ে ছিনিয়ে নিয়ে এসে এইরকম সব আলাত-পালাত অবান্তর কথা বলতে শুরু করতেন জেঠি, হয়তো বা কিছু খাইয়েও ছাড়তেন। অবশেষে বকুলকে তার বাড়ির দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে তবে ফিরতেন।

আর শেষবেশ আর একবার বলতেন, তোর বাপকেই এবার ধরতে হবে দেখছি। সোমত্ত মেয়ে শূন্যপ্ৰাণ নিয়ে এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াবে, ঘরসংসারে মাথা দেবে না, আর বাপ বসে বসে পরিবারের শোকে তুষ হতে থাকবেন এটা তো নেয্য নয়।

বকুল মরমে মরে যেতো, বকুল লজ্জায় লাল হয়ে যেতো, বকুল মাথা তুলতে পারতো না। ওই মাথা-নীচু চেহারাটার দিকে তাকিয়ে অনামিকা দেবীর আর একবার মনে হল, বেচারা!

জেঠির এই নেয্য কথার হূলটির জ্বালা সহজে মিটতো না, অনেকদিন ধরেই তাই ওবাড়ির চৌকাঠে বকুলের পদচিহ্ন পড়তো না। সমন্ত আবেগ আকাঙ্খাকে দমন করে বকুল আপন খাতাপত্রের জগতে নিমগ্ন থাকতে চেষ্টা করতো। কিন্তু সে তপস্যা কি স্থায়ী হত? দুর্বার একটা আকর্ষণ যেন অবিরত টানতে থাকত বকুলকে ওই বাড়িটার দিকে। তাছাড়া ও বাড়ির রাস্তার দিকের জানলায় ছাতের আলসে ধরে একখানি বিষণ্ণ-বিষণ্ণ মুখ মিনতির ইশারায় তপোভঙ্গ করে ছাড়তো।

ভাবলে হাসি পায়, একটা পুরুষ ছেলে প্ৰায় একটা ভীরুলাজুক তরুণী মেয়ের ভূমিকায় রেখে দিতো নিজেকে।

বকুল ওই আবেদন-ভরা চোখের আহ্বানকে অগ্রাহ্য করতে পারতো না। বকুল আবার একদিন কোনো একটা ছুতো করে আস্তে ও-বাড়ির দরজায় গিয়ে দাঁড়াতো।

বকুলের সেই ছুতোটা আদৌ জোরালো হত না, কাজেই ছুতোটা অতি সহজেই ছুতো বলেই ধরা পড়তো।

কিন্তু অবোধ বকুল আর তার অবোধ প্ৰেমাস্পদ দুজনেই ওরা ভেবে নিতো বড়দের বেশ ফাঁকি দেওয়া গেল।

যেমন একদিনের কথা-বাবার আবার হাঁপানির টানের মত হয়েছে আর হোমিওপ্যাথির পর বকুলের বাবার আস্থা, এবং পাশের বাড়ির নির্মল নাকি কোন একজন ভালো হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারের নাম জানে। এ কি একটা কম বড় ছুতো!

অতএব বকুল এসে অনায়াসেই নির্মলের মার কাছে জিজ্ঞেস করতে পারে, কাকিমা নির্মলদা কি বাড়ি আছেন? বাবা বলছিলেন নির্মলদা নাকি কোন একজন হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার—মানে সেই হাঁপানি মতনটা আবার একটু—

স্পষ্ট স্পষ্ট করে নির্মলদা নামটা উচ্চারণ করতে হয়, যেন কিছুই না। যেন ওই নামটা উচ্চারণ করতে গিযে ওর গলা কাঁপে না, ওর বুকের মধ্যেটা কেমন যেন ভয়-ভয় করে না। তবে নির্মলের মা মানুষটি নিতান্তই ভালমানুষ, অতএব সরলচিত্ত। ওই ছেলেবেলা থেকে বড়চিত ছেলেমেয়ে দুটো যে আবার কোনো নতুন পরিচয়ের মধ্যে নতুন হয়ে উঠতে পারে, এমন সম্ভাবনা তার মাথায় আসতো না। এবং তার ভালমানুষ ছেলেটা এবং পাশের বাড়ির নিরীহ মেয়েটা যে তাঁর সঙ্গে এমন চাতুরী খেলতে পারে তা ভাবতেও পারতেন না। কাজে কাজেই জানলা থেকে চোখের ডাক পেয়ে বিভ্রান্ত হয়ে চলে আসা বকুল ওঁর সামনে বেশ সপ্ৰতিভ গলায় বলতে পারতো, কাকিমা নির্মলদা কি বাড়ি আছেন?

কাকিমার এক মস্ত বাতিক চটের আসন বোনা, তাই তিনি সংসারের কাজের ফাঁকে ফাঁকে বড় জা ও দজ্জাল ননদের চোখ এড়িয়ে যখন-তখনই ওই চটের আসন নিয়ে বসতেন। ওই আসনের ঘর থেকে চোখ না তুলেই তিনি জবাব দিলেন, নির্মল? এই তো একটু আগেই ছিল। আছে বোধ হয়। দেখগে দিকি তার পড়ার ঘরে। বাবার আবার শরীর খারাপ হল?

হুঁ।

আহা তোর মা গিয়ে অবধি যা অবস্থা হয়েছে! মানুষটা আর বোধ হয় বাঁচবে না। যা দেখগে যা। কোন ডাক্তার কে জানে? আমাদের অনাদিবাবু তো-

ততক্ষণে বকুল হাওয়া হয়ে গেছে। পৌঁছে গেছে নির্মলের পড়ার ঘর, মানে এদের তিনতলার ছাদের চিলেকোঠার ঘরে।

কিন্তু এসে কি বকুল তার প্ৰেমাস্পদের বুকে আছড়ে পড়তো? নাকি নিবিড় সান্নিধ্যের স্বাদ নিতো?

কিছু না, কিছু না।

এ যুগের ছেলেমেয়েরা সেকালের সেই জোলো জোলো প্রেমকে শহুরে গোয়ালার দুধের সঙ্গে তুলনা করবে।

ধরা সেদিনের কথাই

বকুল হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বললো, বলতে হল বাবার হাঁপানিটা আবার বেড়েছে, সেই পাপে নিজেরই হাঁপানি ধরে গেল।

নির্মল এগিয়ে এসে হাতটাও ধরলো না, শুধু কৃতাৰ্থমন্যের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, কাকে বললে?

বললাম কাকিমাকে। এই মিছে কথা বলার পাপটি হল তোমার জন্যে।

নির্মলের মুখে অপ্রতিভের ছাপ।

খুব মিছে কথা আর কি? মেসোমশাই তো ভুগছেনই।

নির্মলের মাকে বকুল কাকিমা বলে, নির্মলের জেঠাইমাকে জেঠাইমা, কিন্তু নির্মল বকুলের মাকে যে কোন নিয়মে মাসীমা বলতো, আর বাবাকে মেসোমশাই,-কে জানে! তবে বলতো তাই।

ডাকা হচ্ছিল কেন?

এমনি। দেখা-টেখা তো হয়ই না। আর। অথচ লাইব্রেরী থেকে সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের একখানা নতুন বই আনা পড়ে রয়েছে।

বকুল উৎসুক গলায় বলে, কই?

দেব পারে। আগে একটু বসবে, তবে।

বসে কি হবে?

এমনি।

খালি এমনি আর এমনি! নিজে যেতে পারেন না বাবু!

নিজে?

নির্মল একটা ভয়ের ভান করে বলে, ও বাবা! তোমার বড়দার রক্তচক্ষু দেখলেই গায়ের রক্ত বরফ হয়ে যায়! যা করে তোকান আমার দিকে!

বড়দা তোমার থেকে কী এমন বড় শুনি যে এতো ভয়! বাবা তো কিছু বলেন না। মা তো—তোমাকে কতো–

হা, মাসীমা তো কত ভালোবাসতেন। গেলে কতো খুশি হতেন। কিন্তু বড়দা? মানে বেশী বড় না হলেও, সাংঘাতিক ম্যান! পুলিস অফিসার হওয়াই ওঁর উপযুক্ত পেশা ছিল।

তা আমারই বুঝি খুব ইয়ে? পিসি আর জেঠির সামনে পড়ে গেলে-

এই, আজকে পড়নি তো?

নাঃ! জেঠিমা বোধ হয় পুজোর ঘরে। আর পিসি রান্নাঘরে।

সত্যি ওঁদের জন্যে তোমার-

নির্মল একটা হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে।

বকুলের চোখে আবেগের ছায়া।

বকুল ক্ষুব্ধ অভিমানের গলায় বলে, সত্যি, ওঁদের জন্যে তোমার-বলে নিঃশ্বাস ফেললেই তোমার সব কাজ মিটে গেল, কেমন?

কী করবো বল?

ঠিক আছে। আমি আর আসছি না।

না না, লক্ষ্মীটি, রাণীটি! অত শাস্তি দিও না।

ওই!

প্ৰেম সম্বোধনের দৌড় ওই পর্যন্তই।

আর প্রেমালাপের নমুনাও তো সেই লাইব্রেরীর বই, আর কেউ আসছে কিনা এইটুকুর মধ্যে সীমাবদ্ধ।

কেউ এসে তো কোনো দৃশ্যই দেখবে না, তবু ভয়।

ভয়-ভয়! ভালবাসা মানেই ভয়।

বারেবারেই মনে হয় পিছনে বুঝি কেউ এসে দাঁড়ালো। বারেবারেই মনে হয় বাড়িতে হঠাৎ খোঁজ পড়লেই ধরা পড়বে বকুল নির্মলদের বাড়ি গেছে।

সেই ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তো ধরা পড়ে যাবে ওই ছুতোটা ছুতোই।

বাবা বলবেন, কই, নির্মলকে বলতে যেতে তো বলিনি! শুধু বলেছিলাম, নির্মলদের বাড়িতে তো বড় বড় অসুখেও হোমিওপ্যাথি চালায়!

আর দাদা বলবে, ও বাড়িতে গিয়েছিলি কী জন্যে? ও বাড়িতে? কী দরকার ওখানে? ধিঙ্গী মেয়ের এতো স্বাধীনতা কিসের?

তবু না এসেও তো পারা যায় না।

তবে এ বাড়িতে মুখোমুখি কেউ বলে ওঠে না, এ বাড়িতে এসেছ কি জন্যে? এ বাড়িতে? এতো বেহায়ামি কেন?

এ বাড়িতে যেন সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি।

দৈবাৎ যদি জেঠি এসে উপস্থিত নাও হন, সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামবার সময় তো কারুরনা-কারুর সঙ্গে দেখা হয়েই যাবে। হয়তো পিসিরই সঙ্গে।

পিসিও ভুরু কুঁচকে বলবে, বকুল যে। কতক্ষণ এসেছিস?

বকুলকে বলতে হবে, এই একটু আগে।

কোথায় ছিলি? কই দেখিনি তো?

ইয়ে-নির্মলদা লাইব্রেরীর একটা বই দেবেন বলেছিলেন–

ও; বই! তা ভাইপোটাকে একটু পাঠিয়ে দিলেও তো পারিস বাছা! বাপের এই অসুখ, আর তুই ডাগর মেয়ে বই বই করে তাকে ফেলে রেখে এসে-আবার সেই হাঁপাতে হাঁপাতে তিনতলার ছাদে যাওয়া। নির্মল ছিল বাড়িতে?

হাঁ।

গলার মধ্যে মরুভূমি, চোখের সামনে অর্থই সমুদ্র। তবু সেই গলাকে ভিজিয়ে নিয়ে বলতে হয়–হ্যাঁ। এই যে দিলেন বই।

নভেল-নাটক?

ইয়ে, না। গল্পের বই।

ওই একই কথা! তা এ বয়সে এতো বেশী নভেল-নাটক না পড়াই ভালো মা, কেবল কুচিন্তা মাথায় আসার গোড়া। বাবা গা করছেন না তাই, নচেৎ বয়সে বিয়ে হলে তো এতো দিনে দুছেলের মা হয়ে বসতিস।

এই উপদেশ! এই ভাষা!

তাই বকুল বলে, এই ছাত থেকে ছাতে যদি অদৃশ্য হয়ে উড়ে যাওয়া যেতো!

প্ৰভাত মুখুয্যের মনের মানুষের গল্পের মতো!

যা বলেছ। সত্যি ভীষণ ইচ্ছে হয় স্বপ্নে কোনো একটা শেকড় পেলাম, যা মাথায় ছোঁয়ালেই অদৃশ্য হয়ে যাওয়া যায়! তোমার মাথায় আর আমার মাথায় ঠেকিয়ে নিয়ে বেশ সকলের নাকের সামনে বসে গল্প চালানো যায়-

হঠাৎ ভীরু নির্মল একটা সাহসীর কাজ করে বসে।

সম্মুখবর্তিনীর একখানা হাত চেপে ধরে হেসে বলে ৰসে, অদৃশ্য হলে বুঝি শুধুই গল্পে ছাড়বো?

আহা! ধ্যেৎ!

ওই আহার সঙ্গে সঙ্গেই অবশ্য হাত ছাড়ানো হয়ে গেছে।

ছাত থেকে ছাতে একটা ফেলা সিঁড়ি থাকলে বেশ হত! ডিটেকটিভ গল্পে যেমন দড়ির মইটই থাকে-

হ্যাঁ, এমনই সব কথা।

কিন্তু কেন যে, ওই সব দূরূহ পথের চিন্তা, তা দুজনের একজনও জানে না।

শুধু যেন দেখা হওয়াটাই শেষ কথা।

বকুল এ-যুগের এই অনামিকা দেবীর ভাইঝির মতো বলে উঠতে পারবার কথা কল্পনাও করতে পারতো না, আগে মনস্থির কর বাড়ির অমতে বিয়ে করতে পারবে এবং বিয়ে করে বৌকে রাজার হালে রাখতে পারবে, তবে প্রেমের বুলি কপচাতে এসো!

বকুলের যুগ অন্য ছিল।

বকুল মেয়েটাও বোধ হয় আরো বেশী অন্য টাইপের ছিল।

তাই বকুলের অভিমান ছিল না, অভিযোগ ছিল না, শুধু ভালবাসা ছিল। মানে সেই গোয়ালার দুধের জোলো ভালোবাসাই।

বকুল বললো, কই বইটা দাও, পালাই।

এসেই কেবল পালাই-পালাই!

তা কী করবো, বাঃ!

যদি যেতে না দিই, আটকে রাখি?

ইস! ভারী সাহস। আটকে রেখে করবে কি?

কিছু না এমনি।

সঙ্গীন মুহূর্তগুলো এইভাবেই ব্যর্থ করতো নির্মল।

কারণ ওর বেশী ক্ষমতা তার ছিল না।

ওই ছেলেটার দিকে তাকিয়েও মায়া হয় অনামিকা দেবীর।

বলতে ইচ্ছে করে, বেচারা!

কিন্তু সেদিন ওই বেচারাও রেহাই পায়নি। শেষরক্ষা হয়নি। যখন বইটা হাতে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে যাচ্ছে, সামনেই জেঠি জপের মালা হাতে।

ওমা, ই কি কাণ্ড! বকুল তুই এখানে? ওদিকে তোদের বাড়ি থেকে-তা বই নিতে এসেছিলি বুঝি?

হুঁ।

আমি তো তা জানি না। তাহলে বলে দিতাম তোর ভাইপোকে। আমি এসেছি ছাদটা পরিষ্কার আছে কিনা দেখতে। দুটো বড়ি দেব কাল।

কাল বড়ি দেবেন জেঠি, আজ তাই জপের মালা হাতে ছুটে এসেছেন, ছাদ পরিষ্কার আছে কিনা দেখতে!

আর ভাইপো?

সে খবরটা সম্পূর্ণ কল্পিতও হতে পারে। জানা তো আছে বকুল বাড়ি গিয়ে ভেরিফাই করতে যাবে না। অথবা সত্যিই হতে পারে। বড়দা যেই টের পেয়েছে বকুল বাড়ি নেই, পাঠিয়েছে।

.

কলকাতার দক্ষিণ অঞ্চলে রাজেন্দ্রলাল স্ট্রীটের একেবারে রাস্তার উপর বয়সের ছাপধরা এই বাড়িখানার দোতলায় সাবেকি গড়নের টানা লম্বা দালানের উঁচু  দেয়ালে সিঁড়ির একেবারে মুখোমুখি চওড়া ফ্রেমের বেষ্টনীর মধ্যে আবদ্ধ যে মুখখানি দেদীপ্যমান, সে মুখ এ বাড়ির মূল মালিক প্ৰবোধচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের।

চারিদিকে খোলা জমির মাঝখানে সস্তায় জমি কিনে তিনিই এই বাড়ি খানি বানিয়ে একান্নাবর্তী পরিবারের অন্ন-বন্ধন ছিন্ন করে এসে আপন সংসারটিকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। বর্তমান মালিকরা, অর্থাৎ প্ৰবোধচন্দ্রের পুত্ররা এবং তাদের বড়ো-হয়ে-ওঠা পুত্ররা অবশ্য প্ৰবোধচন্দ্রের দূরদর্শিতার অভাবকে ধিক্কার দেয়, কারণ আশেপাশের সেই ফেলাছড়া সস্তা জমির দুচার কাঠা জমি কিনে রাখলেও এখনকার বাজারে সেইটুকু জমি বেচেই লাল হয়ে যাওয়া যেতো। কিন্তু অদূরদর্শী প্ৰবোধচন্দ্ৰ কেবল নিজের মাপের মতো জমি কিনে আজেবাজে প্ল্যানে শুধু একখানা বাড়ি বানিয়ে রেখেই কর্তব্য শেষ করেছিলেন; যে বাড়িটায় তার পুত্র-পৌত্রবর্গের মাথা গুঁজে থাকাটুকু পর্যন্তই হয়। তার বেশি হয় না। অথচ সুপরিকল্পিত নক্সায় ফ্ল্যাটবাড়ির ধাঁচে বাড়িটা বানালে যে, একতলার খানিকটা অংশ ভাড়া দিয়ে কিছুটা আয় করা যেত এখন, সেটা সেই ভদ্রলোকের খেয়ালেই আসেনি।

এদেরও অথচ খেয়ালে আসে না, ফ্ল্যাট শব্দটাই তখন অজানা ছিল তাঁদের কাছে! তখন সমাজে ফ্ল্যাটের অনুপ্রবেশ ঘটাবার আভাসও ছিল মা! বাসা ভাড়া, ঘর ভাড়া, বাড়ি ভাড়া এই তো কথা।

খেয়াল হয় না বলেই যখন-তখন সমালোচনা করে।

তবে হ্যাঁ, স্বীকার করে ঘরটরগুলো ঢাউশ ঢাউশ, আর ফালতু ফালতু এদিক ওদিক ক্ষুদে ক্ষুদে ঘরের মতন থাকায় ফেলে ছড়িয়ে বাস করার সুবিধে আছে।

কিন্তু ওই যে লম্বা দালানটা একতলায়, দোতলায়? কী কাজে লাগে ও দুটো? যখন সপরিবারে পিঁড়ি পেতে পংক্তিভোজনে বসার ব্যবস্থা ছিলো, তখন নীচের তলার দালানটা যদিও বা কাজে লাগতো, এখন তো তাও নেই। এখন তো আর পরিবারের সকলেই একান্নভুক্ত নয়? যাঁরা আছেন তাঁরা নিজ নিজ অন্ন পৃথক করে নিয়েছেন এবং খাবার জন্যে এলাকাও ভাগ করে নিয়েছেন।

প্ৰবোধচন্দ্রের বড় ছেলে অবশ্য এখন আর ইহ-পৃথিবীর অন্নজলের ভাগীদার হয়ে নেই, তার বিধবা স্ত্রী একতলায় নিজস্ব একটি পবিত্র এলাকা ভাগ করে নিয়ে আপন হবিষ্যান্নের শুচিতা রক্ষার মধ্যে বিরাজিতা, তারই জ্যৈষ্ঠপুত্র অপূর্ব দোতলার ঘর-বারান্দা ঘিরে নিয়ে নিজের মেলোচ্ছপনার গণ্ডির মধ্যে বিরাজমান।

অপুর্বর আর দুই ভাই চাকরি-সূত্রে ঘরছাড়া, তারা দৈবাৎ কোনো ছুটিতে কেউ আসে, কোনোদিন মায়ের রান্নাঘরে, কোনোদিন বৌদির রান্নাঘরে, আর কোনো-কোনোদিন নেমন্তন্ন খেয়েই কাটিয়ে চলে যায়। একজন থাকে রেঙ্গুনে, একজন ত্রিপুরায়, যেতে আসতেই সময় যায়। নেমন্তম জোটে কাকাদের ঘরে, শ্বশুরবাড়ির দিকের আত্মীয়দের বাড়িতে, কদাচ বড় পিসির বাড়ি। কলকাতায় বড় পিসি চাঁপাই আছে।

প্ৰবোধচন্দ্রের মেজ ছেলে, যাঁর ডাকনাম কানু, তার সংসার নিয়ে দোতলার আর এক অংশে বাস করেন। তিনি। তাঁর গিন্নী বাতের রোগী, নড়াচড়া কম, ছেলেমেয়েরা চাপা আর মুখচোরা স্বভাবের, তাদের সাড়াশব্দ খুব কম পাওয়া যায়।

মেজ কানুও তার বড়দা-বড়বৌদির নীতিতে বিশ্বাসী, মেয়েদের যতো তাড়াতাড়ি পেরেছেন বিয়ে দিয়ে ফেলেছেন, বিবাহিতা মেয়েদের আসা-যাওয়া কম, কারণ কানু নামের ব্যক্তিটি আয়-ব্যয় সম্পর্কে যথেষ্ট সতর্ক, হৃদয়কে প্রশ্রয় দিতে গেলেই যে পকেটের প্রতি নির্দয়তা হবে, তা তিনি বোঝেন।

বুঝতেও হয়, কারণ সম্প্রতি অবসর নিয়েছেন।

আর আছেন প্ৰবোধচন্দ্রের সেজ ছেলে, ডাকনাম মানু, ভাল নাম প্রতুল। বর্তমানে যিনি ছোট।

এ পরিবারের পোশাকী নামের ব্যাপারে প্ৰয়ের প্রতাপ প্ৰবল!

সুবল নামের যে ছোট ছেলেটি একদা প্ৰবোধচন্দ্রের সংসারে সম্পূর্ণ বহিরাগতের ভূমিকায় নির্লিপ্ত মুখে ঘুরে বেড়াতে, সংসার-টংসার করেনি, সে অনেকদিন আগে চলে গেছে তার জায়গা ছেড়ে দিয়ে।

বরাবর ছোড়দা বলে বকুল।

ছোড়দার রান্নাঘরেই বকুলের ঠাঁই।

প্ৰবোধচন্ত্রের এই সৃষ্টিছাড়া ছোট মেয়েটা তো চিরদিনের জন্যই এই সংসারে শিকড় গেড়ে বসে আছে।

.

মৃত্যুকালে প্ৰবোধচন্দ্ৰ তার পুরনো বাড়ির নবনির্মিত তিনতলার ঘর বারান্দা ছাদ ইত্যাদি কেনই যে তার চির বিরক্তিভাজন হাড়জালানী ছোট মেয়ের নামে উইল করে দিয়ে গিয়েছিলেন, সেই এক রহস্য। তবে দিয়ে গিয়েছিলেন। তার পুত্রদের চমকিত বিচলিত ও গোত্ৰান্তরিত কন্যাদের ঈর্ষিত করে।

তিনতলার ওই ঘরের সংলগ্ন একটুকরো ঘরের মতও আছে রান্নাবাবদ কাজে লাগাতে, কিন্তু সে কাজে কোনোদিন লাগেনি সেটা। সেখানে অনামিকা দেবীর ফালতু বই কাগজের বোঝা থাকে স্তুপীকৃত হয়ে।

পিতৃগোত্রের মধ্যে অবিচল থেকে অনামিকা অবিচল সাহিত্য সাধনা করে চলেছেন।

অনামিকার আমলে প্ৰবোধচন্দ্রের মত রক্ষণশীল ব্ৰাহ্মণের ঘরে বিয়ে না হয়ে পড়ে থাকা মেয়ের দৃষ্টান্ত প্রায় অবিশ্বাস্য, তবু এহেন অবিশ্বাস্য ঘটনাটি ঘটেও ছিল। ঘটেছিল নেহাৎই ঘটনাচক্রে। না, কোনো উল্লেখযোগ্য কারণে নয়, স্রেফ ঘটনাচক্রেই।

নামের আগে চন্দ্ৰবিন্দু হয়ে যাওয়া সেই প্ৰবোধচন্দ্রের রাশ খুব ভারী না হলেও গোঁয়ার্তুমি ছিল প্ৰবল, তিন-তিনটে মেয়ের যথাবয়সে যথারীতি বিয়ে দিয়ে এসে ছোট মেয়ের বেলায় তিনি যে হেরে গেলেন, সেটা মেয়ের জেদে অথবা তার চিরকুমারী থাকবার বায়নায় নয়, নিতান্তই নিজের আলস্যবশতঃ।

অথবা শুধুই আলস্য নয়, আরো কিছু সূক্ষ্ম কারণ ছিল।

তাঁর চার ছেলে আর চার মেয়ের মধ্যে সাত-সাতটাই তো হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল, ছেলেদের মধ্যে তিনটিকে নিয়ে নিয়েছিল বৌরা অর্থাৎ পরের মেয়েরা। সেই ছেলেদের পোশাকী এক-একটা গালভরা নাম থাকলেও ডাকনাম তো ওই ভানু, কানু আর মানু; বাকি ছেলেটাকে কোনো পরের মেয়ে এসে দখল করে নিতে পারেনি, কারণ সুবল নামে সেই ছেলেটাকে তো কারো দখলে পড়ার আগে ভগবানই নিয়ে নিয়েছিলেন।

আর মেয়ে চারটের মধ্যে চাপা, চন্দন আর পারুল নামের বড় মেজো সেজো তিনটিকে যথারীতি হাতিয়ে নিয়েছিল পরের ছেলেরা। হয়তো সেই জন্যেই জামাইদের দুচক্ষে দেখতে পারতেন না প্ৰবোধচন্দ্ৰ। স্ত্রী-বিয়োগের পর আরো। মেয়েদের আনাআনির নামও করতেন না, সঙ্গে সঙ্গে ওই জামাইরা আর তাদের ছানা-পোনারা এসে ভিড় বাড়ায় এই আশঙ্কায়।

অতএব শেষ ভরসা সর্বশেষটি।

তাকে হাতছাড়া করার ভয়ে তার বয়স সম্পর্কে চোখ বুজে থেকে থেকে ভদ্রলোক যখন চিরতরে চোখ বুজলেন যে, তখন আর তার বিয়ে দেবার প্রশ্ন ওঠে না। কাজে কাজেই তার দাদারা সে প্রশ্ন নিয়ে মাথা ঘামাতে বসলো না।

আর বসবেই বা কি? পারুলের জুড়ি বকুল নামের সেই শান্ত নম্র নিরীহ মেয়েটা যে তখন অন্য নামে ঝলসে উঠে ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে পড়েছে।

তাছাড়া-বাপের উইল!

সেই উইলের বলে বকুল যদি এ বাড়ির একাংশ দখল করে বসে থাকতেই পায়, তাকে আর বাড়িছাড়া করবার চেষ্টায় লাভ কী? বরকে সুদ্ধু নিয়ে এসে বসলেই কি ভালো?

অতএব বিশেষ কোনো কারণে নয়, বিশেষ কোনো ইতিহাস সৃষ্টি করে নয়, নিতান্ত মধ্যবিত্ত এবং নেহাতই মধ্যবিত্ত এই পরিবারের একটা মেয়ে সেকালের সমাজ নিয়মের বজ্রআঁটুনির মধ্য থেকে ফসকে বেরিয়ে পড়ে একালের সমাজে চরে বেড়াচ্ছে।

এখন আর কে কী বলবে? একালে কেউ কাউকে কিছু বলে না।

কিন্তু একালের সমাজে পড়ার আগে?

তা তখন বলেছিল বৈকি অনেকে অনেক কথা। প্ৰবোধচন্দ্ৰ অনেক দিন আগে যে–পরিবারের একান্নের বন্ধন ছিন্ন করে চলে এসেছিলেন, তারা বলেছিলো। মহিলাকুল গাড়ি ভাড়া করে কলকাতার উত্তর অঞ্চল থেকে দক্ষিণ অঞ্চলে এসে হাজির হয়ে বংশমর্যাদার কথা শুনিয়ে গিয়েছিল, তবে সেই বলার মধ্যে তেমন জোর ফোটাতে পারেনি তারা, কারণ ততদিনে তো আসামী পলাতক!

প্ৰবোধচন্দ্রের মৃত্যুর পরই না তাদের টনক নড়েছিল? শ্রাদ্ধের সময় জ্ঞাতিভোজনে এসেই তো দেখে হাঁ হয়ে গিয়ে বয়েস হিসেব করতে বসেছিল এই অবিশ্বাস্য ঘটনার নায়িকার।

তাছাড়া ততোদিলে–বকুলের অন্য নামটাও দিব্যি চাউর হয়ে উঠেছে।

মোট কথা, তালগোল অথবা গোলে-হরিবোলে, বকুল রাজেন্দ্রলাল স্ট্রীটের এই বাড়িটায় শেকড় গেড়ে বসে থেকে চোখ মেলে দেখে চলেছে কেমন করে বাড়ির চারিপাশের উদার শূন্যতা সংকীর্ণ হয়ে আসছে, আর সমাজের বন্ধ সংকীর্ণতা উদার হয়ে পড়ছে।

বকুলের নিজের জীবনটার সঙ্গে বুঝি এই পাড়াটার মিল আছে। বকুলের নিজের মধ্যে কোনোখানে আর হাঁফ ফেলবার মত ফাঁকা জমি পায় না বকুল, কোনোদিন যে কোনোখানে অনেকখানি শূন্যতা ছিল, তা স্মরণে আনতেও সময় নেই তার, সবখানটাই ঠাসবুনুনিতে ভর্তি। ঠিক ওই রাস্তার ধারের বাড়ির সারির মত।

রাস্তার ধার থেকে দেখলে শুধু একসারি। আর তিনতলায় ওপরের ছাদে উঠলে——তার পিছনে, আরো পিছনে শুধু বাড়ি আর বাড়ির সারি।

কিন্তু তিনতলারও ওপরের ছাদে উঠে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখার মত বিলাসিতার সময় কোথায় বকুলের? ঘরের সামনের ছাদটুকুতে একটু দাঁড়িয়ে তাকিয়ে দেখার সময় হয় না!

আশ্চর্য!

যখন সময় ছিল, তখন এই তিনতলার ওপরের ছাদটা পেলে একটা রাজ্য পাওয়ার সুখানুভূতি হতে পারতো, তখন ওটার জন্ম হয়নি। এখন কদাচ কোনোদিন ওই ছাদটায় ওঠবার সরু লোহার সিঁড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে মনে মনে কল্পনা করে বকুল, বকুলের কৈশোরকালে যদি এটা থাকতো!

থাকলে যে কী হতো তা জানে না বকুল, যদি থাকতো ভাবতে গেলেই অন্য একটা বাড়ির ছাদে একখানা হাসি-হাসি মুখ ভেসে ওঠে।

যে মুখের অধিকারীকে সেজদি পারুল বলতো, বোকা, হাঁদা, নীরেট।

অবিশ্যি সে-সব তো সেই তামাদি কালের কথা। যখন এক-আধবার আসতো পারুল বাপের বাড়িতে। অনেক দিন আগে বিয়ে হওয়া তিন মেয়ের মধ্যে পারুলই মা মারা যাওয়ার পরও মাঝে মাঝে এসেছে।

আর চাপা, চন্দন?

তারা তো আর মরণকালে কেঁদে কেঁদে বলেছিলই, মা তুমিও চললে, আমাদেরও বাপের বাড়ি আসা ঘুচলো—

যদিও তখন সেখানে উপস্থিত মহিলাকুল, যাঁরা নাকি ওদের খুড়ি জেঠি পিসি, তারা বলেছিলেন, ষাঠ-ষাঠ, বাপ বেঁচে থাকুন একশ বছর পরমায়ূ নিয়ে–

ওরা সেই ক্ৰন্দন-বিজড়িত গলাতেই সতেজ সংসারের নিয়ম বুঝতে দিয়েছিল গুরুজনবৰ্গকে। বলেছিল, থাকুন, একশো কেন হাজার বছর, মা মরলে বাপ তালুই, এ আর কে না জানে?

হয়তো মা থাকতেই বাপের ব্যবহারে তার আঁচ পেয়েছিল তারা। টের পেতো বাবার একান্ত অনিচ্ছার ওপরও মা প্ৰায় জোর করেই তাদের নিয়ে আসেন। যদিও এও ধরা পড়তে নাকি থাকতো না-এই যুদ্ধের মধ্যে স্নেহবিগলিত চিত্তটা ততো নয়, কর্তব্যবোধটাই কাজ করেছে বেশী।

সুবৰ্ণলতার এই প্ৰবল কর্তব্যবোধটাই তো প্ৰবোধচন্দ্ৰকে চিরকাল জব্দ করে রেখেছিল। প্ৰবোধচন্দ্ৰ বুঝে উঠতে পারতেন না নিজের জীবনটা নিয়ে নিজে যা খুশি করতে পারে না কেন মানুষ।

নেহাৎ অসচ্ছল অবস্থা না হলে-মানুষ তো অনায়াসেই খাওয়া থাকা আয়েস আরাম সুখভোগ করে কাটিয়ে দিতে পারে, তবে কী জন্যে মানুষ কর্তব্য নামক বিরক্তিকর একটা বস্তুকে নিয়ে ভারগ্রস্ত হতে যাবে? সেই বস্তুটার পিছনে পিছনেই তো আসবে যাতে রাজ্যের চিন্তা, আর যতো রাজ্যের অসুবিধে।

প্ৰবোধচন্দ্রের এই মতবাদের সঙ্গে চিরকাল লড়ালড়ি ছিল সুবৰ্ণলতার, কিন্তু শেষের দিকে কতকগুলো দিন যেন সুবৰ্ণলতা হাত থেকে অস্ত্ৰ নামিয়ে যুদ্ধবিরতির অন্ধকার শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিলেন।

মায়ের কথা মনে করতে গেলেই বকুলের মায়ের সেই নির্লিপ্ত নিরাসক্ত হাত থেকে হালনামানো মূর্তিটাই মনে পড়ে।

মৃত্যুর অনেক আগে থেকেই সুবৰ্ণলতা যেন এ সংসার থেকে বিদায় নিয়ে নিজেকে মৃতের পর্যায়ে রেখে দিয়েছিলেন। সেই মৃত্যুর শীতলতার মধ্যে কেটেছে বকুলের কৈশোরকাল।

তবু আশ্চৰ্য, সেই শীতলতার মধ্যেই ফুটেছে ফুল, জ্বলেছে আলো।

তারপর তো সুবৰ্ণলতা সত্যিই বিদায় নিলেন।

তার কতোদিন যেন পরে সে-বার পারুল এলো বাপেরৰাড়ি।

ঠিক মনে পড়ে না কবে!

 ০৯. পারুল সেবার এসেছিল বাপের বাড়ি

অনেক দিন পরেই পারুল সেবার এসেছিল বাপের বাড়ি। এ পক্ষের আগ্রহের অভাবেই শুধু নয়, নিজেরও আসাটা তার কদাচিৎ হয়, কারণ শ্বশুরবাড়িতে থাকে না সে, থাকে বরের বাড়ি। বরের বদলীর চাকরি এবং বৌয়ের বদলে রাঁধুনী-চাকরের হাতে খেতে সে নারাজ, তাই বৌকে বাসায় নিয়ে গেছে মা বাপের সঙ্গে মতান্তর করে। ছেলে তার বৌকে নিয়ে গিয়ে নিজের কাছে রাখতে চাইলে কোন মা-বাপাই বা প্ৰসন্নচিত্তে সে যাওয়াকে সমর্থন করতেন তখন? বৌ যদি নাচতে নাচতে বরের সঙ্গে বাসায় যায়, এবং সেখানে পূর্ণ কর্ত্রীত্বের স্বাদ পায়, আর কি কখনো সে বৌ শাশুড়ী পিসশাশুড়ীর ছত্ৰতলে বৌগিরি করতে রাজী হবে? কদাচ না।

তাহলে আর কি? বাসায় যাওয়া মানেই বৌয়ের পরকাল ঝরঝরে হয়ে যাওয়া। কি জন্যে তবে ছেলেকে মানুষ-মুনুষ করে বড় করে তুলে তার বিয়ে দেওয়া, যদি ছেলের বৌয়ের হাতের সেবা-যত্নটুকু না পেলেন? কিন্তু পারুলের বর বৌয়ের সেই কর্তব্যের দিকটা দেখেনি, নিজের দিকটাই দেখেছে।

আর পারুল? পারুলের একটা কর্তব্যৰোধ নেই? অন্ততঃ চক্ষুলজ্জা?

বকুলের সেই প্রশ্নের উত্তরে পারুল হেসে উঠে বলেছিল, হ্যাঁ, সেটা অবিশ্যি দেখাতো ভালো। আমি যদি শাশুড়ীর পা চেপে ধরে বলতে পারতাম, ওই বেহায়া নির্লজ স্বাৰ্থপরটা যা বলে বলুক, আমি আপনার চরণ ছাড়ব না, তাহলে নিশ্চয়ই ধন্যি-ধন্যি পড়ে যেতো। কিন্তু সেই ধন্যি-ধন্যিটার মধ্যে আছে কী বল? ছদ্মবেশ ধারণ করে ধন্যি-ধনি কুড়োনোয় আমার দারুণ ঘেন্না। তাছাড়া-পারুল আরো একটু হেসেছিল, লোকটাকে দগ্ধে মারতে একটু মায়াও হলো। আমায় চোখছাড়া করতে হলে ও তো অহরহ অগ্নিদাহে জ্বলতো।

বকুলও হাসে।

কুমারী মেয়ে বলে কিছু রেখেঢেকে বলে না। আহা শুধু তারই নিন্দে করা হচ্ছে। নিজের দিকে যেন কিছুই নেই। অমলবাবু বাক্স-বিছানা বেঁধে নিয়ে ভাগলবা হলে, তুই নিজে বুঝি বিশ্বভুবন অন্ধকার দেখতিস না?

তা তাও হয়তো দেখতাম। যতই হোক বেঘোরে বেপোটে একটা পৃষ্ঠবল তো!

শুধুই পৃষ্ঠবল? আর কিছু নয়?

আরও কিছু? তাও আছে হয়তো কিছু। চক্ষুলজার মায়াটা কাটিয়ে বেরিয়ে যেতে পারলে অন্ততঃ রান্নাঘর ভাড়ার-ঘরটার ওপর তো নিরঙ্কুশ কর্ত্রীত্ব থাকে। সে স্বাধীনতাটুকুই কি কম?

যাঃ, তুই বড় নিন্দেকুটে। অমলবাবু তোকে সর্বস্ব দিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে বসে আছেন।

সেই তো জ্বালা। পারুল কেমন একটা বিষণ্ন হাসি হেসেছিল, সর্বস্ব লাভের ভারটা তো কম নয়। সেটা না পারা যায় ফেলতে, না পারা যায় গিলতে।

ফেলতে পারা যায় না সেটা তো বুঝলাম, কিন্তু গিলতে বাধা কি শুনি?

আরে বাবা ও প্রশ্ন তো আমিই আমাকে করছি অহরহ, কিন্তু উত্তরটা খুঁজে পাচ্ছি কই? ভারটাই ক্রমশঃ গুরুভার হয়ে উঠছে।…কিন্তু সে যাক, আমার অমলবাবুর চিন্তা রাখ, তোর নির্মলবাবুৰ খবর কি বল?

আঃ অসভ্যতা করিস না।

অসভ্যতা কী রে? এতোদিনে কতদূর কী এগোলো সেটা শুনি!

তুই থামবি?

পারুল হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল। বলেছিল, হতভাগাটা বুঝি এখনো সেই মা-জেঠির আঁচলাচাপা খোকা হয়ে বসে আছে? কোনো চেষ্টা করেনি?

গম্ভীর বকুলও হয়েছিল তখন, চেষ্টা করবার তো কোনো প্রশ্নই নেই সেজদি!

ওঃ, প্রশ্নই নেই? সেই গণ-গোত্র, কুল-শীল, বামুন-কায়েত, রাঢ়ী-বারেন্দ্র? তাহলে মরতে তুই এখনো কিসের প্রত্যাশায় বসে আছিস?

প্ৰত্যাশা? প্ৰত্যাশা আবার কিরে সেজদি? বসে থাকা কথাটাও অর্থহীন। আছি বলেই আছি।

কিন্তু ভাবছি অভিভাবককুল তবে এখনো তোকে বাড়িছাড়া করবার জন্যে উঠেপড়ে লাগছে না কেন?

তা আমি কি জানি?

.

বলেছিল বকুল, তা আমি কি জানি?

কিন্তু সত্যিই কি জানতো না বকুল সে কথা? বকুলের বাবা তাঁর চিরদুর্বল অসহায় চিত্তের সমস্ত আকুলতা নিয়ে ওই মেয়েটাতেই নির্ভর করছেন না কি? বড় হয়ে ওঠা ছেলেরা তো বাপের কাছে জ্ঞাতির সামিল, অন্ততঃ বকুলের বাবার চিন্তা ওর উর্ধ্বে আর পৌঁছুতে পারে না। বিবাহিত ছেলেদের তিনি রীতিমত প্ৰতিপক্ষই ভাবেন। বিবাহিতা মেয়েদের কথা তো বাদ। আপন বলতে অতএব ওই মেয়ে। কুমারী মেয়েটা।

যদিও মেয়ের চালচলন তাঁর দুচক্ষের বিষ, তবু সময়মত এসে ওষুধের গ্লাসটা তো ও-ই সামনে এনে ধরে। ওই তো দেখে বাবার বিছানাটা ফর্সা আছে কিনা, বাবার ফতুয়াটার বোতাম আছে কিনা, বাবা ভালমন্দ একটু খাচ্ছে কিনা।

ওই ভরসাস্থলটুকুও যদি পরের ঘরে চলে যায়, বিপত্নীক অসহায় মানুষটার গতি কি হবে? হতে পারে জাত মান লোকলজ্জা, সবই খুব বড় জিনিস, কিন্তু স্বার্থের চাইতে বড় আর কী আছে? আর সবচেয়ে বড় স্বাৰ্থ প্রাণরক্ষা।

বকুল বোঝে বাবার এই দুর্বলতা।

কিন্তু এ কথা কি বলবার কথা?

নাঃ, এ কথা সেজদির কাছেও বলা যায় না। তাই বলে, আমি কি জানি। কিন্তু বাবার এই দুর্বলতাটুকুর কাছে কি কৃতজ্ঞ নয় বকুল?

পারুল বলে, তাহলে আপাততঃ তোমার খাতার পাতা জুড়ে ব্যর্থ প্রেমের কবিতা লেখাই চলছে জোর কদমে?

বকুল হেসে উঠে বলে, আমি আবার প্রেমের কবিতা লিখতে গেলাম কখন? সে তো তোর ব্যাপার! যার জন্যে অমলবাবু-

দোহাই বকুল, ফি কথায় আর তোর অমলবাবুকে মনে পড়িয়ে দিতে আসিসনে, দু-চারটি দিন ভুলে থাকতে দে বাবা।

ছিছি সেজদি, এই কি হিন্দুনারীর মনোভাব?

ওই তো মুশকিল। পারুল হেসে ওঠে, কিছুতেই নিজেকে হিন্দু নারীর খোলসে ঢুকিয়ে ফেলতে পারছি না, অথচ খোলসটা বয়েও মরছি। হয়তো মরণকাল অবধিই বয়ে মরবো।

পারুলের মুখটা অদ্ভুত একটা রহস্যের আলোছায়ায় যেন দুর্বোধ্য লাগছে, মনে হচ্ছে ইচ্ছে করলেই পারুল ওই খোলসটা ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে পারে। বেরোচ্ছে না, শুধু যেন নিজের উপর একটা নির্মম কৌতুকের খেলা খেলে মজা দেখছে।

অনামিকা ওই মুখটা দেখতে পাচ্ছেন, সেদিকে নিষ্পলকে তাকিয়ে থাকা বকুলের মুখটাও। বকুল ফর্সা নয়, পারুলের রং চাপা ফুলের মত। পারুলের বর সেই রঙের উপযুক্ত শাড়িও কিনে দেয়। সেদিন পারুল একখানা মিহি চাঁদের আলো শাড়ি পরেছে, তার পাড়াটা কালো চুড়ি। সেই পাড়টা মাত্র খোঁপার ধারটুকু বেষ্টন করে কাঁধের পাশ থেকে বুকের উপর লতিয়ে পড়েছে। পারুলকে বড় সুন্দর দেখতে লাগছে।

চাঁদের আলো শাড়িতে লালপাড় আরো সুন্দর লাগে। কিন্তু লালপাড় শাড়ি পারুলের নাপছন্দ। কোনো উপলক্ষে এয়োস্ত্রী মেয়ে বলে কেউ লালপাড় শাড়ি দিলে পারুল অপর কাউকে বিলিয়ে দেয়। কারণটা অবশ্য বকুল ছাড়া সকলেরই অজ্ঞাত। কিন্তু বকুল ছাড়া আর কাকে বলতে যাবে পারুল, লালপাড় শাড়িতে বড় যেন পতিব্ৰতা-পতিব্ৰতা গন্ধ। পরলে মনে হয় মিথ্যে বিজ্ঞাপন গায়ে সেঁটে বেড়াচ্ছি।

ছেলেবেলায় পারুলের এমনি অনেক সব উদ্ভট ধারণা ছিল। আর ছিল একটা বেপরোয়া সাহস।

তাই পারুল তার বাপের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করেছিল, বকুলের তো বিয়ের বয়স হয়েছে, আমাদের হিসাবে সে বয়েস পেরিয়েই গেছে, বিয়ে দিচ্ছেন না কেন?

পারুল-বকুলের বাবা থতমত খেয়ে বলে ফেলেছিলেন, তা দেব না বলেছি নাকি? পাত্র না পেলে? আমার তো এই অশক্ত অবস্থা, বড় বড় ভাইরা নিজ নিজ সংসার নিয়েই ব্যন্ত–

খুব একটা অশক্ত ছিলেন না ভদ্রলোক, তবু স্ত্রীবিয়োগের পর থেকেই তিনি স্বেচ্ছায় নিজেকে অশক্ত করে তুলেছিলেন। কে জানে কোন মনস্তত্ত্বে।

হয়তো অপরের করুণা কুড়োতে।

হয়তো বা সংসারে নিজের মূল্য বজায় রাখতে। কেউ কিছু বলেনি, তবু বুঝি তখন থেকে নিজেকে তাঁর সংসারে অবান্তর বলে মনে হতো, তাই যখন তখন মর-মর হতেন।

সে যাক, নিজেকে অশক্ত বলে বলে অবশেষে তাই-ই হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। কথা বললেই কাসতে শুরু করতেন।

পারুল বলতো, ওটা নার্ভাসনেস, মিথ্যে কাসি কেসে শেষ অবধি—

কিন্তু পারুল তো অমন অনেক উদ্ভট কথা বলে। সেদিনও বাপের মুখের ওপর বলে উঠেছিল, আপনারা স্রেফ চোখ থাকতে অন্ধ। পাত্র তো আপনার চোখের সামনেই রয়েছে।

চোখের সামনেই পাত্র!

পারুলের বাবা আকাশ থেকে পড়েছিলেন, কার কথা বলছিস তুই?

কার কথা আবার বলবো বাবা? কেন-নির্মলের কথা মনে পড়লো না আপনার?

নির্মল! মানে অনুপমবাবুর ছেলে সুনির্মল?

অশক্ত মানুষটা সহসা শক্ত আর সোজা হয়ে উঠে বলেছিলেন, ওঃ, ওই হারামজাদি বুঝি উকিল খাড়া করেছে তোকে? নির্মলের বাড়ি যাওয়া বার করছি আমি ওর!

আর এখন যায়ও না। তাছাড়া আপনি তো জানেন। পরের শেখানো কথা কখনও কইনা আমি। আমি নিজেই বলছি-

নিজেই বলছো।

বাবা বিবাহিত মেয়ে এবং কৃতী জামাইয়ের মর্যাদা বিস্মরণ হয়ে খোঁকিয়ে ওঠেন, তা বলবে বৈকি! বাসায় গিয়েছ, আপটুডেট হয়েছ! বলি ওদের সঙ্গে আমাদের কাজ হয়?

এই খেঁকিয়ে ওঠাটা যদি পারুলের নিজের সম্পর্কে হতো, অবশ্যই পারুল আর দ্বিতীয় কথা বলতো না, কিন্তু পারুল এসেছিল বকুল সম্পর্কে একটা বিহিত করতে। তাই পারুল বলেছিল, হয় না কথাটার কোনো মানে নেই। হওয়ালেই হয়।

হওয়ালেই হয়?

তাছাড়া কি? নিয়ম-কানুনগুলো তো ভগবানের সৃষ্টি নয় যে তার নড়াচড় নেই! মানুষের গড়া নিয়ম মানুষেই ভাঙে।

বাঃ, বাঃ! বাপ আরো খোঁকিয়ে উঠেছিলেন, বাক্যি তো একবারে মা বসিয়ে দিয়েছে। তা বলি আমি ভাঙতে চাইলেই ভাঙবে? ওরা রাজী হবে?

যদি হয়?

হবে! বলেছে তোকে?

আমি বলছি যদি হয়, আপনি অরাজী হবেন না তো?

বাপ আবার অশক্ত হয়ে শুয়ে পড়ে বলেছিলেন, আমার আবার অরাজী। রোগা মড়া, একপাশে পড়ে আছি, মরে গেলে একদিন ছেলেরা টেনে ফেলে দেবে। মেয়ে যদি লভ করে কারুর সঙ্গে বেরিয়েও যায়, কিছু করতে পারবো আমি?

পারুল নির্নিমেষে তাকিয়ে ছিল ওই বুকে হাত দিয়ে হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে নিঃশ্বাস ফেলা লোকটার দিকে। তারপর চলে এসেছিল।

চলে এসে ভেবেছিল, হালটা কি তবে আমিই ধরবো?

কিন্তু হাল ধরলেই কি নৌকো চলে? যদি বালির চড়ায় আটকে থাকা নৌকো হয়? তবু শেষ চেষ্টা করে যাব।

নাঃ, তবু বকুলের জীবন-তরণীকে ভাসিয়ে দিয়ে যেতে পারেনি। পারুল, শুধু সেবার চলে যাবার সময় বলে গিয়েছিল, তোর কাছে আমি অপরাধী বকুল, শুধু শুধু তোকে ছোট করলাম।…আশ্চর্য ভাবতেই পারিনি একটা মাটির পুতুলকে তুই-

রোষে ক্ষোভে চুপ করে গিয়েছিল পারুল।

.

কিন্তু বকুলের সেই কথাটার শেষটুকু শোনা হল না। সেই মৃদু হাসির উপর রূঢ় রুক্ষ কর্কশ একটা ধাক্কা এসে আছড়ে পড়লো।

ঘড়ির অ্যালাম!

নিয়মের বাড়িতে শেষ রাত্রি থেকে কৰ্মচক্ৰ চালু করার জন্যে ঘড়িতে অ্যালার্ম দেওয়া থাকে। ভারী লক্ষ্মী আর হুঁশিয়ার বৌ নমিতা। ওই অ্যালার্মের শব্দে উঠে পড়েই ও সেই চাকাটা ঘোরাতে শুরু করবে। শীতের দেশ, চাকরবাকররা ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠতে চায় না, অথচ ভোর থেকেই বাড়ির সকলের বেড-টি চাই, গরম জল চাই।

এ কাজ নমিতাকে কেউ চাপিয়ে দেয়নি, নমিতা স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিয়েছে। আত্মপীড়নও এক ধরনের চিত্তবিলাস। এ বিলাস থাকে কারো কারো। কেউ না চাইলেও তারা ত্যাগস্বীকার করে, স্বাৰ্থত্যাগ করে, অপ্রয়োজনে পরিশ্রম করে অহেতুক সেবা করে।

নইলে অনামিকা দেবীর বন্ধ দরজায় করাঘাত করে বেড-টি বাড়িয়ে ধরবার দরকার ছিল না তার, অনামিকা দেবীর দায়িত্ব তার নয়।

অ্যালার্মের শব্দে চকিত হয়ে টেবিলে রাখা হাতঘড়িটা দেখেছিলেন অনামিকা দেবী, অবাক হয়ে ভাবছিলেন, আমি কি তবে ঘুমোইনি?

চায়ের পেয়ালা দেখে আরো অবাক হয়ে ভাবলেন, এ মেয়েটাও কি ঘুমোয়নি?

বললেন সেকথা।

নমিতা একটু উদার হাসি হাসলো, ঘুমিয়েছিলাম, উঠেছি। এই সময়ই উঠি আমি। ঘড়িতে অ্যালাম দিয়ে রাখি।

কেন বল তো? এই অন্ধকার ভোর থেকে এতো কী কাজ তোমার?

সহজ সাধারণ একটা প্রশ্ন করেন অনামিকা দেবী। নমিতা কিন্তু উত্তরটা দেয় অসহজ। গলা নামিয়ে বলে, থাক, ও-কথা। কে কোথা থেকে শুনতে পাবেন।

অনামিকা গম্ভীর হয়ে যান।

বলেন, যাক, আজ আমারও তোমার ওই অ্যালার্মের জন্যে সুবিধে হলো। ছটার সময় তো বেরোবার কথা।

কয়েক মাইল মোটর গাড়িতে গেলে তবে রেলস্টেশন, আর সকাল সাতটার গাড়ি ধরতে হবে।

নমিতা কিন্তু তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, সে কী, আজই চলে যাবেন কি? আরো তো দুদিন ফাংশান আছে না?

অনামিকা ওর অবোধ প্রশ্নে হাসেন।

বলেন, কথা তাই ছিল বটে। কিন্তু এর পরও ফাংশান হবে বলে ধারণা তোমার?

নমিতা মৃদু অথচ দৃঢ়স্বরে বলে, হবে। কাল আপনি শুয়ে পড়ার পর অনেক রাত্রে সম্মেলনের কারা এসেছিলেন এ বাড়িতে, জানিয়ে গেলেন। আপনি উঠলে যেন বলা হয় অধিবেশন হবে। রীতিমত পুলিস পাহারা বসাবার ব্যবস্থা হয়েছে।

পুলিস পাহারা!

রীতিমত পুলিস পাহারা দিয়ে সাহিত্য সম্মেলন!

অনামিকা দেবী কি হেসে উঠবেন? না কেঁদে ফেলবেন?

অবশ্য দুটোর একটাও করলেন না তিনি, শুধু বললেন, না, আমি আজকেই চলে যাবে। সকালের গাড়িতে হয়ে না উঠলে দুপুরের গাড়িতে। হয়ে ওঠা মানে, ওদের তো বলতে হবে।

হাঁ, চলেই এলেন অনামিকা দেবী। অনেক অনুরোধ উপরোধ এড়িয়ে। পুলিস পাহারা বসিয়ে সাহিত্য সম্মেলনে রুচি হয়নি তার।

অনুষ্ঠান সমিতির সভাপতি কাতর মিনতি জানিয়েছিলেন, অনিলবাবু যে হাসপাতাল থেকেও অনুরোধ জানিয়েছেন তা বললেন, কিন্তু কিছুতেই যেন পলাতক মেজাজকে ফিরিয়ে অজানতে পাবলেন না। অনামিকা দেবী।

অবশেষে বললেন, শরীরটাও তেমন-মানে কালকের ঘটনায় কী রকম যেন–

শরীর বলার পর তবে অনুরোধ প্রত্যাহার করলেন তাঁরা। শরীর হচ্ছে সর্ব দেবতার সার দেবতা, ওর নৈবেদ্য পড়বেই। মন? মেজাজ? ইচ্ছে? অনিচ্ছে? সুবিধে? অসুবিধে? ওদের খণ্ড খণ্ড করে ফেলার মতো সুদৰ্শন চক্ৰ আছে অনুষ্ঠানকারীদের হাতে! শুধু শরীরের কাছে তাঁরা অস্ত্ৰহীন; অতএব অপর পক্ষের ব্ৰহ্মাস্ত্রই ওই শরীর। শুধু নাম করেই ছাড়পত্র পেলেন।

কিন্তু ওদের, মানে সম্মেলন আহ্বানকারীদের এবার শনি রাহু যোগ।

সেটা টের পাওয়া গেল কলকাতায় এসে খবরের কাগজ মারফৎ।

কাগজটা পড়তে পড়তেই সিঁড়ি দিয়ে উঠে এল শম্পা শাড়ির কোঁচা লটপটাতে লটপটাতে।

ও পিসি, পিসি গো, তোমাদের উত্তরবঙ্গের সাহিত্য সম্মেলনের এই পরিণতি? পুলিসী শাসন ব্যর্থ! স্থানীয় যুবকদের সহিত পুলিসের সংঘর্ষে দুইজন নিহত ও বাইশজন আহত। অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি গুরুতর আহত হইয়া হাসপাতালে।…হি হি হি, কী কাণ্ড! কই কাল তুমি তো বললে না কিছু?

অনামিকা দেবী সেই মাত্র কোনো এক সম্পাদকের তাগাদায় উত্যক্ত হয়ে মনের সমন্ত শক্তি প্রয়োগ করে কলম নিয়ে বসেছিলেন, ওই হি হিতে প্ৰমাদ গুনলেন। সহজে যাবে না ও এখন, জোর তলবে জেরা করে জেনে নেবে কী ঘটনা ঘটেছে আসলে।

কাণ্ডতে ভারী কৌতূহল শম্পার।

যেখানে এবং যে বিষয়েই হোক, কোনো একটা কাণ্ড ঘটলেই শাম্প উল্লসিত। আর সেই উল্লাসের ভাগ দিতে আসে মাই-ডিয়ার পিসিকে। অনামিকা দেবী গম্ভীর হতে চাইলেও, সে গাভীর্য ও নস্যাৎ করে ছাড়ে!

পিসি, শুনেছো কাণ্ড, শিবনাথ কলেজের প্রিন্সিপাল ছাত্ৰগণ কর্তৃক ঘেরাও। বেচারী প্রিন্সিপাল করজোড়ে ক্ষমা ভিক্ষা করে তবে–, হিহি করেই বাকিটা বোঝায়।

পিসি, জানো কী কাণ্ড। এই সেদিন অতো ঘটা করে বিয়ে করলো ললিতা, এক্ষুনি সেপারেশান, দুজনেই অনমনীয়!.পিসি, যত সব বানানো মানুষ নিয়ে রাতদিন মিথ্যে কাণ্ডকারখানা ঘটাচ্ছে, সত্যি মানুষের দিকে দৃষ্টিই নেই তোমার। পাড়ায় কি কাণ্ড ঘটেছে জানো? অনিন্দবাবুর গাড়ি থেকে সতীশবাবুর প্যাণ্টে কাদা ছিটকেছিল বলে দুজনের তুমুল একখানা হাতাহাতি হয়ে গেছে, এখন দুজনেই কেস ঠুকতে গেলেন।

এই সব হচ্ছে শম্পার উল্লাসের উচ্ছাস!

অনামিকা দেবী হতাশ-হতাশ গলায় বলেন, এতো খবর তোর কাছেই কি করে আসে বল তো?

শম্পা দুই হাত উল্টে বলে, চোখ-কান খোলা থাকলেই আসে।

ওই সব বাজে ব্যাপারে চোখ-কান একটু কম খোলা রাখ শম্পা, জগতে আরো অনেক ভালো জিনিস আছে।

ভালো!

শম্পা এমন কথা শুনলে আকাশ থেকে পড়ে। বলে, ভালো শব্দটার অর্থ কি পিসি? কোন স্বর্গীয় অভিধানে আছে ওটা?…যেগুলোকে তুমি বাজে বলছে, ওইগুলোই হচ্ছে আসল কাজের। এই কাণ্ডগুলোই হচ্ছে সমাজের দর্পণ। সমাজ, সংস্কৃতি এগুলোর গতিপ্রকৃতি তুমি দেখবে কোথা থেকে, যদি কাণ্ডগুলোকে আমল দেবে না? ডালপালা তো শো মাত্র, কাণ্ডই আসল বস্তু। ওই কাণ্ড!

স্বভাবগত ভঙ্গিমায় ঝরঝর করে অনেক কথা বলে শম্পা। সব সময় বলে।

আজও বলে উঠলো, কাল যে বললে, তোমার ভাষণ হয়ে গেছে বলে তুমি আর অকারণে দুদিন বসে থাকলে না! এদিকে এই কাণ্ড? তুমি থাকতেও তো—

অনামিকা দেবী নিরুপায় ভঙ্গীতে কলমটা হাত থেকে নামিয়ে রেখে বলেন, তা কি করবো বলো? তোমার কাছে কাণ্ড আওড়াতে বসলে, আমার আর কিছু কাজ হতো? জেরার চোটে এক কাণ্ডকে সাত কাণ্ড করে তুলতে! কিন্তু সে যাক, কী লিখেছে কাগজে? সত্যিই দুজন নিহত?

তাই তো লিখেছে-, শম্পা আবার হেসে ওঠে, অবিশ্যি খবরের কাগজের খবর। দুয়ের পিঠে দুই বাইশ হতে পারে। হয় পুলিসী নির্দেশে একটা দুই চেপে ফেলা হয়েছে, নয় ছাপাখানার ভূত একটা দুই চেপে ফেলেছে। হয়তো বাইশজন নিহত, বাইশজন আহত।

অনামিকা দেবী ওর ওই উথলে পড়া মুখের দিকে তাকিয়ে ঈষং কঠিন গলায় বলেন, সেই সন্দেহ মনে নিয়ে তুমি হেসে গড়াচ্ছে? নিহত শব্দটার মানে জানো না বুঝি?

এই সেরেছে—, শম্পা তার তিনকোণা চশমার কোণকে আরো তীক্ষ্ণ করে তুলে চোখ উচিয়ে বলে, পিসি রেগে আগুন! মানে কেন জানবো না বাছা, এ যুগে ও শব্দটার মানে তো খুব প্রাঞ্জল হয়ে গেছে। রাস্তা থেকে একখানা থান ইট তুলে টিপ করে ছুঁড়তে পারলেই তো হয়ে গেল মানে জানা!..সেদিন যেই তুমি বেরোলে…তক্ষুনিই প্রায় ঘটে গেল তো একখানি ঘটনা। পাড়ার ছেলেরা রাস্তার মাঝখানে যেমন ইট সাজিয়ে ক্রিকেট খেলে তেমনি খেলছে, হঠাৎ কোথা থেকে এক মস্তান এসে এই তম্বি তো সেই তম্বি! রাস্তাটা পাবলিকের হাঁটবার জায়গা, ইটের দেওয়াল তোলবার জায়গা নয়, উঠিয়ে নিয়ে যাও ইত্যাদি ইত্যাদি।

ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে হাতে হাতে প্রতিফল। নেহাৎ বরাতজোর ছিল, তাই কারো ভাবলীলা সাঙ্গ হয়নি, কপাল কাটার ওপর দিয়েই গেছে। তবে যেতে পারতো তো?

অনামিকা দেবী হতাশ গলায় বললেন, শম্পা, আমাকে এখন খুব তাড়াতাড়ি একটা লেখা শেষ করতে হবে।

বাবাঃ বাবাঃ, সব সময় তোমার তাড়াতাড়ি লেখা শেষ করতে হবে! ভাবলাম। এই দুদিনের ঘটনাগুলো বলি তোমাকে। যাকগে, মরুকগে, এই রইল তোমার উত্তরবঙ্গ। পঞ্চম পৃষ্ঠার সপ্তম কলমে দেখুন! আমি বিদেয় হচ্ছি। দুটো কথা কইবারও লোক নেই বাড়িতে। সাধে বেরিয়ে যাই-

অনামিকা দেবী তো ওকে যেতে দিতে পারতেন। অনামিকা দেবী তো সর্ব শক্তি প্রয়োগ করে লিখতে বসেছিলেন, তবু কেন ওর অভিমানে বিচলিত হলেন?

কে জানে কী এই হৃদয়-রহস্য!

ওর প্রায় সব কিছুই অনামিকা দেবীর কাছে দৃষ্টিকটু লাগে, তবু ওর জন্যে হৃদয়ে অনেকখানি জায়গা।

তাগাদার লেখা লিখতে সত্যিই কষ্ট হয় আজকাল, সত্যিই জোর করেই বসতে হয়। সে লেখা লিখতে, তবু গা এলিয়ে দিলেন তিনি এখন। বলে উঠলেন, যেমন অসভ্য চুলবাঁধা, তেমনি অসভ্য কথাবার্তা!

শম্পা টকটিকিয়ে চলে যাচ্ছিল, এ কথায় ঘাড় ফেরালো। সতেজে বলে উঠলো, কেন, খোঁপার মধ্যে কি অসভ্যতা আছে শুনি?

সবটাই আছে! অনামিকা দেবী তার একটা হাত চেপে ধরে চেয়ারের কাছে টেনে এনে বলেন, কী আছে খোঁপার মধ্যে আমের টুকরি ও গোবরের ঝুড়ি?

ওর মধ্যে থাকার জনযে বাজারে অনেক মালমশলা বিকোচ্ছে পিসি, কিন্তু কথা হচ্ছে খোঁপার গড়নটা তোমার ভাল লাগছে না?

লাগছে বললে হয়তো তুই খুশি হাতিস, কিন্তু খুশি করতে পারছি না! ভেবে পাচ্ছিনা তুই এই কিছুদিন আগেও ঘাড়ের বোঝা হালকা করে ফেলি বলে চুল কাটতে বদ্ধ পরিকর হয়েছিলি, নেহাৎ তোর মোর দিব্যি-দিলেশায় কাটিসনি, সেই তুই হঠাৎ স্বেচ্ছায় মাথার ওপর এতো বড় বোঝা চাপালি কি করে!

চাপালাম কি করে? হি হি হি, কেন পিসি, তুমিই তো যখন আমাকে ছেলেবেলোয় গল্প বলতে, বলেছিলে-যে সুয়োরানী পানের বাটা বইতে মূৰ্ছা গিয়েছিল, সেই সুয়োরানীই ফ্যাশানের ধুয়োয় গলায় সোঁনাবাঁধানো শিল বুলিয়েছিল!

মনে আছে সে গল্প? অনামিকা দেবী মৃদু হেসে বলেন, গল্পগুলো কেন তৈরী হতো। আর বলা হতো, বল দিকি?

আহা রে! তা যেন জানি না! লোকশিক্ষার্থে, আবার কি? বিশেষ করে মহিলাকুলকে শিক্ষা দিতেই তো যত গল্পের অবতারণা!

সবই যদি জানিস, এটাও তাহলে জানা উচিত, শিক্ষা জিনিসটা নেবার জন্যেই। ফ্যাশানের শিকার হয়ে মেয়েজাতটা কতো হাস্যাস্পদই হয় ভাব।

শম্পা অভিমান ভুলে পিসির পাশে আর একখানা চেয়ারে বসে পড়ে বলে, এই খোঁপাটার ব্যাপারে তুমি সেটি বলতে পারবে না মহাশয়া, এ স্রেফ অজন্তা স্টাইল।

হতে পারে। কিন্তু অজন্তার সেই স্টাইলিস্ট মেয়েরা কি ওই খোঁপার সঙ্গে হাইহিল জুতো পরতো? হাতে ঘড়ি বঁধতো? ছুটোছুটি করে বাস ট্রাম ধরে অফিস কলেজ যেতো? নিজে হাতে ড্রাইভ করে মাইলের পর মাইল রাস্তা পাড়ি দিতো?

কে জানে!

শম্পা চেয়ারটার পিঠে ঠেস দিয়ে দোলে।

কে জানে নয়। দিতো না। সাজের সঙ্গে কাজের সামঞ্জস্য থাকা দরকার, বুঝলি?

বুঝলাম না-, শম্পা বলে হেসে হেসে, সাজ বজায় রেখেও যদি কাজ করা যায়?

মানায় না।

ওটা তোমাদের বদ্ধ দৃষ্টিতে। দৃষ্টি মুক্ত করো মহিলা, দেখবে সামঞ্জস্য কথাটাই অর্থহীন! আশ্চৰ্য, লেখিকা হয়েও কেন যে তুমি এতো সেকেলে! অথচ লোকে তোমার নামের আগে প্ৰগতিশীল লেখিকা বলে বিশেষণ বসায়।

তাতে তাহলে তোর আপত্তি?

রীতিমত।

তবে যা, যারা বিশেষণ বসায়, তাদের বলে দিগে, যেন ওই প্ৰগতিটার আগে একটা অ বসিয়ে দেয়। কিন্তু এই দুদিনের কী খবর বলছিলি?

থাকগে সে কিছু না।

বলে শম্পা টেবিলে টোকা দিয়ে সুর তোলে। অথচ মুখের ভাবে ফুটিয়ে রাখে সেটা অনেক কিছু।

অনামিকা দেবী ওর এ ভঙ্গী জানেন।

মনে মনে হেসে বলেন, কিছু না? তবে থাক। আমি ভাবছিলাম বুঝি—

আহা, আমি একেবারে কিছু না বলিনি। বলছি এমন কিছু না। যাকগে, বলেই ফেলি! পরশু ছোঁড়া এক কীর্তি করেছে।

শম্পা একটু দম নেয়, তারপর ঝরঝরে গলায় বলে, বিয়ে বিয়ে করে আমায় তো পাগল করে মারছিলই, আবার পরশু সোজা এসে বাবার কাছে হাজির। বলে কিনা-আপনার মেয়েকে আমি বিয়ে করতে চাই। বোঝ ব্যাপার!

শম্পা সহজ হাসি হেসে-হেসেই বলে কথাগুলো, কিন্তু অনামিকা দেবীর হঠাৎ মনে হয় শম্পা যেন ব্যঙ্গহাসি হাসছে। যেন বলতে চাইছে, দেখো দেখো, আমাদের যুগকে দেখো! ছিলো এমন সাহস তোমাদের যুগের প্রেমিকদের? হুঁ! সে সাহসের পরাকাষ্ঠা তো দেবদাস, শেখর, রমেশ মাটির ঘোড়া, স্রেফ মাটির ঘোড়া। ছোটার ভঙ্গীটি নিয়ে অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

মাথা থেকে পা পর্যন্ত যেন একটা বিদ্যুৎপ্রবাহ বহে গেল।

অন্য অনেক দিনের মতো আজও একবার ভাবলেন অনামিকা দেবী, আমি কি এ যুগকে হিংসে করছি? আমার ওই না-পছন্দটা কি সেই হিংসেরই রূপান্তর?

কী হল পিসি, আমন চুপ মেরে গেলে যে?

অনামিকা দেবী কলমটা আবার হাতে তুলে নিলেন এবং যে কথাটা মুহূর্ত আগেও ভাবেননি, হঠাৎ সেই কথাটাই বলে বসলেন, ছেলেটা তো দেখছি ভারী হ্যাংলা!

কেন বললেন?

ঠিক এই মুহূর্তে কি সম্পূর্ণ বিপরীত ভাবনাটাই ভাবছিলেন না অনামিকা দেবী?

ভাবছিলেন না কি, বকুল, তোমার নির্মলের যদি এ সাহস থাকতো?

কিন্তু শম্পা ওই মনের মধ্যেকার কথাটা জানে না। তাই বলে ওঠে, আমিও ঠিক সেই কথাটাই বলেছি হতভাগাকে। কিন্তু ও যা নাছোড়বান্দা, মনে হচ্ছে বিয়ে না করে ছাড়বে না।

তোর বাবা কি বললো?

বাবা? বাবা আবার নতুন কি বলবেন? বাবা মাত্রেই যা বলে থাকে তাই বললেন–বললেন, পাত্র হিসেবে তুমি কী, তোমার চালচুলো কিছু আছে কিনা সে-সব না জানিয়েই হঠাৎ আমার মেয়েকে বিয়ে করবার ইচ্ছে প্ৰকাশ করলেই আমি আহ্লাদে অধীর হয়ে কন্যা সম্প্রদান করতে বসবো, এই কি ধারণা তোমার? তাতে ও–

তাতে ও কী? ভাবী শ্বশুরকে পিটিয়ে দিয়ে গেল?

শম্পা হেসে উঠে বলে, অতটা অবিশ্যি নয়, তবে শাসিয়ে গেছে। বলেছে–দেখি কেমন না দেন!

চমৎকার! কোথা থেকে এসব মাল জোটাস তাই ভেবে অবাক হই!

ব্যাপারটা কী হচ্ছে জান পিসি-—, শম্পা পা দোলাতে দোলাতে বলে অবস্থাটা মরীয়া। আমি আবার কিছুদিন থেকে ওকে দেখিয়ে দেখিয়ে আর একটা ছেলের সঙ্গে চালাচ্ছি কিনা। অবিশ্যি সেটা একেবারেই ফলস। স্রেফ ওর জেলাসি বাড়াবার জন্য—

ওকে কথা শেষ করতে দিলেন না অনামিকা দেবী, হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলেন, আচ্ছা! তোমার ফাজলামি পরে শুনবো, এখন আমায় এটা শেষ করতে দাও।

শম্পা ঝপ করে উঠে দাঁড়ায়, ক্ষুব্ধ অভিমানের গলায় বলে, আমি চলেই যাচ্ছিলাম, তুমিই ডেকে বসালে!

তরতর করে নেমে যায় সিঁড়ি দিয়ে।

অনামিকা দেবীও সেই দিকে তাকিয়ে থাকেন। বন্ধ কলমটাই হাতে ধরা থাকে, সর্বশক্তি প্রয়োগের ইচ্ছেটাকে যেন খুঁজে পান না।

খুব আস্তে, খুব গভীরে ভাবতে চেষ্টা করেন, এ যুগের কোন কর্নারে আমি আমার ক্যামেরাটা বসাবো? কোন অ্যাঙ্গেল থেকে ছবি নেবো?…এই বাড়িরই কোনোখানে কোনোখানে যেন এখনো ভাশুর দেখে ঘোমটা দেওয়া হয়, ভাঁড়ারের কোণে ইত্য ঘটপাতা হয়, হয়তো বা বিশেষ বিশেষ দিনে লক্ষ্মীর পাঁচালিও পড়া হয়। অথচ এই বাড়িতেই শম্পা–

এর কোনটা সত্য?

 ১০. সে যুগের কোনো স্পষ্ট অবয়ব

না, এ যুগে সে যুগের কোনো স্পষ্ট অবয়ব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কোথাও সে দুরন্ত সংহারের মূর্তি নিয়ে মুহূর্তে মুহূর্তে রেণু রেণু করে উড়িয়ে দিচ্ছে বহুযুগসঞ্চিত সংস্কারগুলি, উড়িয়ে দিচ্ছে চিরন্তন মূল্যবোধগুলি, অভ্যস্ত ধ্যান-ধারণার অবলম্বনগুলি, আবার কোথাও সে আদ্যিকালের বদ্যিবুড়ীর মত আজও তার বহু সংস্কারে বোঝাই ঝুলিটি কাঁধে নিয়ে শিকড় গেড়ে বসে পাপপুণ্য, ভালোমন্দ,–ইহলোক-পরলোকের চিরাচরিত খাজনা যুগিয়ে চলেছে।

তাই এ যুগের মানসলোকে সত্যের চেহারাও অস্থির অস্পষ্ট। দোদুল্যমান দৰ্পণে প্রতিফলিত প্রতিবিম্বের মত সে চেহারা কখনো কম্পিত, কখনো বিকৃত, কখনো দ্বিধাগ্ৰন্ত, কখনো যেন অসহায়। যেন ঝড়ে বাসাভাঙা পাখি ডানা ঝাপটে ঝাপটে পাক খেয়ে মরছে, এখনো ঠিক করে উঠতে পারছে না, ঝড় থামলে পুরনো বাসাটাই জোড়াতালি দিয়ে আবার গুছিয়ে বসবে, নাকি নতুন গাছে গিয়ে নতুন বাসা বাঁধবে!

কিন্তু বড় কি থামবে?

ভাঙনের ঝড় কি ভেঙেচুরে তছনছ না করা পর্যন্ত থামে? সে কি ওই আদ্যিকালের বুড়ীটাকে শিকড় উপড়ে তুলে ফেলে না দিয়ে ছাড়ে?

অথবা হয়তো থামে।

হয়তো ছাড়ে।

কোথায় যেন একটা রফা হয়ে যায়। তখন বুড়ীটাকে দেখতে পাওয়া না গেলেও শিকড়টা থাকে যায় মাটির নীচে। নিঃশব্দে সে আপন কাজ করে যায়। তাই এই বিশ্বনস্যাতের যুগেও মহাত্মা আর মহারাজের সংখ্যা বেড়েই চলেছে, বেড়ে চলেছে ভাগ্যগণনা কাৰ্যালয় আর গৃহশান্তির রত্ন-কবচ।

তাই যখন সাম্য মৈত্রী আর স্বাধীনতার জয়ডঙ্কায় আকাশবাতাস প্রকম্পিত হচ্ছে, এখনও শুধু মাত্র চামড়ার রঙের তারতম্যের ছুতোয় মানুষ মানুষের চামড়া ছড়িয়ে নিচ্ছে! এবং যখন মানুষের একটা দল চাঁদে পৌঁছবার সাধনায় আকাশ পরিক্রম করছে, তখন আর একটা দল সভ্যতার সব পথ-পরিক্রমা শেষ করে ফেলেছি বলে আবার গুহার দিকে মুখ ফিরিয়ে চলতে যাচ্ছে।

একটানা এতোখানিকটা বলে বক্তা একবার থামলেন। সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলেন। বহু আসন-বিশিষ্ট বিরাট সুরম্য হল। সভার উদ্যোক্তা মোটা টাকা দক্ষিণা এবং অক্লান্ত ধর্নার বিনিময়ে একটি সন্ধ্যার জন্য সংগ্রহ করেছেন এই হল, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও সাহিত্য সম্মেলনের জন্য। ওই ভাবেই বেশ কয়েকদিন থেকে প্রচার কার্য চলেছে। অভিনব সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও সাহিত্য সম্মেলন। আসুন অগ্রিম টিকিট সংগ্রহ করুন। পঁচিশ টাকা, দশ টাকা ও পাঁচ টাকা। দুই টাকার টিকিট কেবলমাত্র অনুষ্ঠান-দিবসে হল-এ বিক্রয়!…আর একটি ঘোষণা, এই অনুষ্ঠানের প্রবেশপত্রের বিক্রয়লব্ধ অর্থের এক-তৃতীয়াংশ দুঃস্থত্রাণ সমিতির হস্তে অৰ্পণ করা হইবে।

মানুষ যে যথেষ্ট পরিমাণে হৃদয়বান তা এই প্রবেশপত্ৰ সংগ্রহের উদগ্র আগ্রহের মধ্যেই প্রমাণিত হয়ে গেছে। তিনদিন আগেই উচ্চ মূল্যের টিকিট নিঃশেষিত, হল-এ বিক্রয়ের বিকল্পনার নির্বুদ্ধিতায় বিপর্যন্ত উদ্যোক্তারা পুলিসের শরণাপন্ন হতে বাধ্য হয়েছেন।

দুঃস্থদের জন্যে প্ৰাণ না কাঁদলে কি এতোটা হতো? নিন্দুকেরা হযতো অন্য কথা বলবে, কিন্তু নিন্দুকে কি না বলে? অন্য কথা বলাই তো তাদের পেশা। যাই হোক-দুঃস্থদের জন্যেই হোক, অথবা দুর্লভদের জন্যই হোক, সব টিকিট বিক্ৰী হয়ে গেছে।

আর সে সংবাদ ঢাক পিটিয়ে প্রচার করাও হয়েছে।

অতএব আশা করা অসঙ্গত নয় সামনের ওই সারিবদ্ধ আসনের সারির জমজমাট ভরাট ভরাট রূপ দেখতে পাওয়া যাবে।

কিন্তু কোথায় সেই ভরাট রূপ?

কোথায় সেই পূর্ণতার সমারোহ?

আজকের সম্মেলনের প্রধান বক্তা সুবিখ্যাত অধ্যাপক চক্তপানি চট্টোপাধ্যায় তার বক্তৃতার মাঝখানে একবার দম নিয়ে হল-এর শেষপ্রান্ত অবধি তাকিয়ে দেখলেন। না, মানুষ নেই, শুধু চকচকে ঝকঝকে গদি আটা মূল্যবান আসনগুলি শূন্য হৃদয় নিয়ে প্রতীক্ষার প্রহর গুনছে।

কেবলমাত্র সামনের কয়েকখানি আসন, যাতে নাকি অতিথি ছাপমারা, তারা জনাকয়েক বিশিষ্ট অতিথিকে হৃদয়ে ধারণ করে বসে আছে। এদের হয়তো গাড়ি করে আনা হয়েছে, তাই এর সভার শোভা হয়ে বসতে বাধ্য হয়েছেন। এদের মধ্যে বেশ কয়েকজন গণ্যমান্য সাংবাদিক, বাকি সব বিশিষ্ট নাগরিক। এরা এরা সভায় উপস্থিত ছিলেন বলে কাগজে যাদের নাম উল্লেখ করা হয়, এরা হচ্ছেন তারা।

চক্ৰপাণি এদের অনেককেই বেশ চেনেন, অনেকের মুখ চেনেন।

কিন্তু এঁদের কাউকেই তো নবযুগের বাহক বলে মনে হচ্ছে না, তবে যুগের বাণী কাদের শোনাবেন চক্ৰপাণি?

অথচ তার ভাষণের বিষয়বস্তু নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে, যুগসাহিত্যে সত্য। অবশ্য সত্যি বলতে, ওই শিরোনামটার প্রকৃত অর্থ তাঁর কাছে তেমন প্রাঞ্জল মনে হয়নি, খুব ভালো বুঝতে পারেননি উদ্যোক্তারা আসলে ওই শব্দটা দিয়ে কী বোঝাতে চেয়েছেন, অথবা জনা তিন-চার মহা মহা সাহিত্যরথীদের ডেকে এনে তাদের কাছে কী শুনতে চেয়েছেন।

তবু অধ্যাপকদের ভাষণের জন্য আটকায় না, যে কোনো বিষয়বস্তু নিয়েই তারা ঘন্টার পর ঘণ্টা সারগর্ভ ভাষণ দিতে পারেন। চক্ৰপাণি আবার শুধু অধ্যাপক নন, অধ্যাপকসাহিত্যিক! প্রৌঢ়ত্বের কাছে ছুঁই ছুঁই বয়েস, ছাত্রমহলে বিশেষ প্রতিভাজন (যেটা নাকি এ যুগে দুর্লভ) এবং পাঠক-মহলে আজও অম্লানজ্যোতি নায়ক। অতি আধুনিকদের প্রবল কলকল্লোলেও চক্ৰপাণির জয়জয়কার অব্যাহতই আছে। অস্তুতঃ তাঁর রচিত গ্রন্থের বিক্রয়-সংখ্যা দেখে তাই মনে হয়।

কিন্তু বক্তৃতা-মঞ্চে দাঁড়ালে কেন সেই অগণিত ভক্ত-সংখ্যাকে দেখতে পাওয়া যায় না? কেন গোনাগুনতি কয়েকটা চেনা-মুখের পিছনে শুধু শূন্যতার অন্ধকার?

অথচ ওই চেয়ারগুলির ন্যায্য মালিক আছে।

এসেওছে তারা। শুধু ঝুটঝামেলা কতকগুলো বক্তৃতা শোনবার ভয়ে হল-এর বাইরে এদিক ওদিক ঘুরছে, ঝালমুড়ি অথবা আইসক্ৰীম খাচ্ছে, আড্ডা মারছে।

তাছাড়া আরো আকর্ষণ আছে, গায়ক-গায়িকার সঙ্গে কিছু নায়ক-নায়িকার নামও ঘোষণা করা হয়েছে, যাঁরা নাকি দুঃস্থদের কল্যাণে বিনা দক্ষিণায় কিছু শ্রমদান করতে স্বীকৃত হয়েছেন। তারা যে শুধু অভিনয়ই করেন না, কণ্ঠসঙ্গীতেও সক্ষম, সেটা স্পষ্ট তাদের সামনে বসে দেখা যাবে। এখন কথা এই–সেই নায়ক-নায়িকারা অবশ্যই আকাশপথে উড়ে এসে মঞ্চাবতরণ করবেন না। গাড়ি থেকে নেমে প্ৰকাশ্য রাজপথ দিয়েই আসতে হবে তাঁদের। সেই অনবদ্য দৃশ্যের দর্শক হবার সৌভাগ্য থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে চাইবে, এমন মুর্খ কে আছে!

ওরা এসে প্রবেশ করলে উল্লাসধ্বনি দিয়ে তবে ভিতরে ঢোকা যাবে। টিকিটে সিট নম্বর আছে ভাবনা কি?

প্ৰথম বক্তা চক্ৰপাণি বুদ্ধিমান হলেও অবস্থাটা সম্যক হৃদয়ঙ্গম করতে পারেননি। বিরাট প্রেক্ষাগৃহের বিরাট শূন্যতার দিকে তাকিয়ে প্রতিষ্ঠানের সম্পাদককে ক্ষুব্ধ প্রশ্ন করেছিলেন, আরম্ভ তো করবো, কিন্তু শুনবে কে? ফাকা চেয়ারগুলো?

সম্পাদক সবিনয়ে বলেছিলেন, সবাই এসে যাবে স্যার।

কিন্তু ওই আশ্বাসবাণীর মধ্যে আশ্বাস খুঁজে পাননি চক্ৰপাণি। কাজেই আবারও বলেছিলেন, আর কিছুটা অপেক্ষা করলে হতো না?

শুনে সম্পাদক এবং স্থায়ী সহ-সভাপতি হাঁ হাঁ করে উঠেছিলেন, আর দেরি করলে চলবে না স্যার! আপনাদের এই চারজনের ভাষণ সাঙ্গ হতে-হতেই তো সভার বারোটা বেজে যাবে। মানে সকলেই তো স্যার-ধরলে কথা থামায় কে? আপনার বক্তৃতাই যা একটু শোনবার মতো। বাকি সবাই-

এ মন্তব্য অবশ্য খুবই নিম্নসুরে বলা হয়েছিল, উদ্যোক্তারা তো অভদ্র নয় যে চেঁচিয়ে কোনো মন্তব্য করে বসবেন।

চক্ৰপাণির সন্নিকটে বসেছিলেন সাহিত্যিক মানস হালদার। তিনি আবার বিশিষ্ট একটি সাপ্তাহিকের সম্পাদকও। বক্তৃতা দেওয়ার অভ্যাস নেই বলে খানকয়েক ফুলস্ক্যাপ কাগজের দুপিঠে খুদে খুদে অক্ষরে তাঁর বক্তব্য লিখে এনেছেন। তিনি উসখুস করে বলেন, তা আপনাদের কার্ডে লেখা রয়েছে ছটা। এখন পৌনে সাতটা পর্যন্তও-

ব্যাপার কি জানেন স্যার-, সম্পাদক হাত কচলে বলেন, আর্টিস্টরা সব বড্ড দেরী করে আসেন কিনা। আর ওনাদের জন্যেই তো এত সেল। পয়সা খরচ করে সাহিত্য শুনতে কে অ্যাসে বলুন?

না, না, ছেলেটা সাহিত্য বা সাহিত্যিকবৃন্দকে অবমাননা করবে মনস্থ করে বলেনি কথাটা। নেহাতই সারল্যের বশে সহজ কথাটা বলে বসেছে।

মানস হালদার চাপা ক্রুদ্ধ গলায় বলেন, তা হলে এই সাহিত্য সম্মেলনের ফার্স কেন?

ছেলেটা এ প্রশ্নের উত্তরে সারল্যের পরাকাষ্ঠা দেখায়। অমায়িক গলায় বলে, তা যা বলেছেন। তবে কি জানেন, ফাংশানের খরচ তুলতে স্যুভেনির তো একটা বার করতেই হয়, আর তাতে নামকরা লেখকদের লেখা না থাকলে অ্যাডভার্টাইজমেণ্ট পাওয়া যায় না। কাজেকাজেই-মানে বুঝছেনই তো, আপনাদের লেখা নেবো। অথচ-ইয়ে একবার ডাকবো না এটা কেমন দেখায় না? তাই যাঁদের যাঁদের লেখা নেওয়া হয়েছে, বেছে বেছে শুধু তাদেরই ডাকা হয়েছে, দেখবেন লক্ষ্য করে। নচেৎ সাহিত্য নিয়েঃ বকবকানি শুনতে কার আর ভালো লাগে? কথা তো ঢের হয়েছে আমাদের দেশে, কাজের কাজ কিছু নেই, কেবল কথার ফুলঝুরি।

ছেলেটা নিজেও যে অনেক ভালো ভালো কথা শিখেছে তার পরিচয় দিতে নিজেই ফুলঝুরির ঝুরি ছড়ায়, দেশ কোথায় যাচ্ছে বলুন! রুচি নেই, সভ্যতা নেই, সৌন্দর্যবোধ নেই, গভীরতা নেই, চিন্তাশীলতা নেই, কেবলমাত্ৰ কথার স্রোত ভাসছে। তাই স্যার আমাদের শশাঙ্কদা বলে দিতে বলেছেন, আপনাদের ভাষণগুলো একটু সংক্ষিপ্ত করবেন। ভারী মজার কথা বলেন উনি–, ছেলেটা একসার দাঁত বার করে নিঃশব্দে হেসে বলে, বললেন, ভাষণ সংক্ষিপ্ত না হলে শ্রোতারা সম্যকরূপে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। আরো একটা কথা, আর্টিস্টদের গুমোর জানেন তো-একটু বসে থাকতে হলেই, অন্যত্র কাজ আছে বলে উঠে চলে যাবেন। একজন বিখ্যাত গায়িকা তো আবার গানের সময় সভায় কেউ একটি কথা বললেই উঠে চলে যান। শিল্পী তো! ভীষণ মুডি। বিগলিত হাস্যে ছেলেটি বলে, শেষ পর্যন্ত থাকবেন তো স্যার? শেষের দিকে ভালো আর্টিস্টদের রাখা হচ্ছে।

কিন্তু তোমাদের সভানেত্রী?

এসে গেছেন স্যার। মেয়েছেলে হলে কি হবে, খুব পাংচুয়াল। তা ওনাকে নিয়ে পড়েছে একদল কলেজের মেয়ে, অটোগ্রাফ খাতা এনেছে সঙ্গে করে। এই যে উইংস-এর ওদিকে। এসে বসে যাবেন, আপনি শুরু করে দিন না।

চক্ৰপাণি বিরক্তভাবে বলেছিলেন, তাই কি হয়? সভার একটা কানুন আছে তো?

আপনি তো বলছেন স্যার, এদিকে আমাদের যে মিনিটে মিনিটে মিটার উঠছে।

মিটার উঠছে!

অধ্যাপকসাহিত্যিক সভয়ে এদিকওদিক তাকান।

মিটার উঠছে? কিসের মিটার?

আজ্ঞে এই হল-এর। ছেলেটি তার গুজগুঁজে কথার মধ্যেই একটু উচ্চাঙ্গের হাসি হেসে বলেঅনেক ধরেকরে কনসেশনেই পাঁচশো টাকাধরুন বিকেল পাঁচটা থেকে রাত দশটা। দশটা বেয়ঙ্ক গেলেইঘণ্টা পিছু একস্ট্রা একশো টাকা। তা হলেই বলুন মিটার ওঠাটা ভুল বলেছি কিনাআপনাদের এই সাহিত্যের কচকচি না থামতেই যদি আর্টিস্টরা কেউ কেউ এসে পরেন, কী অবস্থা হবে?

ছেলেটা একদা চক্ৰপাণির ছাত্র ছিল, তাই এত অন্তরঙ্গতার সুর! কিন্তু ওই শিশুজনসদৃশ সরল অথচ গোঁফদাড়ি সম্বলিত দীর্ঘকায় প্রাক্তন ছাত্রটিকে দেখে চক্ৰপাণির স্নেহধারা উথলে উঠছে বলে মনে হল না। নীরস গলায় প্রশ্ন করেছিলেন, কেন, কী অবস্থা হবে?

কী হবে সে কি আর আমি আপনাকে বোঝাবো স্যার? সময় নষ্ট হতে দেখলে অডিয়েন্স ক্ষেপে যাবে। কী রকম দিনকাল পড়েছে দেখছেন তো? ওই তো সভানেত্রী এসে গেছেন। তবে আর কি!

তবে আর কি করা!

মাইকের প্রথম বলি চক্ৰপাণি চট্টোপাধ্যায় যুগসাহিত্যে সত্য নিয়ে আলোচনা শুরু করে দিলেন।

বলছিলেন, কিন্তু বার বার সামনের ওই শূন্য আসনের সারির দিকে তাকাচ্ছিলেন।…আর ভাবছিলেন, এ যুগের স্পষ্ট চেহারা কি তবে এই শূন্যবক্ষ প্রেক্ষাগৃহের মতো?

তবে ভাবছিলেন বলে যে থেমে থেমে যাচ্ছিলেন তা নয়। একবারই শুধু থেমেছিলেন। তারপর আবার একটানা বলে চলেন–শিল্পী সাহিত্যিক কবি বুদ্ধিজীবী চিন্তাবিদ, এদের তাই আজ বিশেষ সঙ্কটের দিন। তাঁরাও আজ দ্বিধাগ্ৰন্ত। তারা কি চিরাচরিত সংস্কারের মধ্যেই নিমজ্জিত থেকে গতানুগতিক ভাবে সৃষ্টি করে যাবেন, যা নতুন নতুন পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে নতুন সত্য উদঘাটিত করবেন, এই প্রশ্ন আজ সকলের মধ্যে।

গুটিগুটি দুটি তরুণ এসে ঢুকে পিছনের সারিতে বসেছিল, চাপা গলায় হেসে উঠে একজন অপরজনকে বলে উঠলো, লে হালুয়া! ওই সত্যটা কি আজব চীজ বল দেখি? সত্য সত্য কবে এতো মাথা খুঁড়ে মরে কেন দাদুরা?

বাছাদের নিজেদের সব কিছুই ক্রমশঃ মিথ্যে হয়ে আসছে বলে বোধ হয়!

দূর বাবা, এতোক্ষণ পরে এসে ঢুকলাম, তাও বসে বসে বক্তিমে শুনতে হবে? কৰ্তারা মধু পরিবেশনের আগে খানিকটা করে নিমের পাঁচন গেলায় কেন বল দিকি?

ওই ফ্যাশান!

চক্ৰপাণি তখনও বলে চলেছেন, এই যুগকে তবে কোন নামে অভিহিত করবো? অনুসন্ধানী যুগ? যে যুগ তন্নভন্ন করে খুঁজছে, যাচাই করছে কোথায় সেই অভ্রান্ত সত্য, যা মানুষকে সমন্ত মিথ্যা বন্ধন থেকে মুক্ত করে-

আবার সেই সত্য! কালো রোগা ছেলেটা সাদা সাদা দাঁত বার করে হেসে অনুচ্চ কণ্ঠে বলে ওঠে, সত্য মারা গেছে দাদু! তাকে খুঁজে বেড়ানো পণ্ডশ্রম!

চক্ৰপাণি ভালো বলছেন, তথাপি অপর বক্তারা ঘন ঘন হাত উল্টে উল্টে ঘড়ি দেখছিলেন। মানস হালদার বেজার মুখে পকেটে হাত দিয়ে টিপে টিপে নিজের লিখিত ভাষণটি অনুভব করছিলেন আর বিড়বিড় করছিলেন, নাঃ, লোকটা দেখছি, একাই আর সকলের বারোটা বাজিয়ে দিলো। উদ্যোক্তাদের উচিত প্রত্যেককে একটা নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া। ওদেশে এরকম হয় না। সে একেবারে সামনে ঘড়ি রেখে কাজ! আমাদের দেশে? হুঁ!

তা উদ্যোক্তাদের আছে সে শুভবুদ্ধি, তাদের একজন আস্তে পিছন থেকে এসে সবিনয়ে জানালেন, একটু সংক্ষেপ করবেন স্যার!

সংক্ষেপ?

চক্ৰপাশি ক্ষুব্ধ বিস্ময়ে সামনের দিকে তাকালেন, সবে দুচারটি করে লোক এসে বসতে শুরু করেছে এবং সবে বক্তব্যের গোড়া বাঁধা হয়েছে, এখন কিনা সংক্ষেপের অনুরোধ?

তবে তিনি নাকি আদৌ রগচটা নন, বরং কৌতুকপ্ৰিয়, তাই কৌতুকের গলায় একটি তীক্ষ্ণ মন্তব্য করে বক্তব্যের উপসংহার করে দিলেন। কিন্তু তাঁর সেই বুদ্ধিদীপ্ত তীক্ষ্ণ মন্তব্যটি মাঠেই মারা গেল।

বাইরে থেকে ঘরে তুমুল একটা হর্ষোচ্ছাসের ঢেউ খেলে গেল, এসে গেছেন! এসে গেছেন!

কে এসে গেছেন?

যার জন্যে এই তুমুল হর্ষ?

আঃ, জিজ্ঞেস করবার কী আছে? ওঁকে না চেনে কে?

উনি এসে গেছেন। পিছনে পিছনে ওঁর তবলচি।

তারপর আরও এক নায়ক। তাঁর সঙ্গে এক নায়িকা।

বলা বাহুল্য, এরপর আর সাহিত্য-বক্তৃতা চলে না। মানস হালদার, সিতেশ বাগচী এবং সভানেত্রী অনামিকা দেবী নিতান্তই অবাঞ্ছিত অতিথির মতো তাঁদের ভাষণ সংক্ষেপে শেষ করে নিলেন, মঞ্চাধিপতি সেই ভাইস প্রেসিডেন্ট তারস্বরে ঘোষণা করলেন, সাহিত্য-সভা শেষ হলো। এইবার আমাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আরম্ভ হবে। আপনারা অনুগ্রহ করে স্থির হয়ে বসুন।

কিন্তু দোদুল্যমান পর্দার সামনে কে স্থির হয়ে বসে থাকতে পারে? দোদুল্যমান চিত্তের মৃদু গুঞ্জন স্পষ্ট হয়ে ওঠে, গদি একখানা পেলে আর কোনো মিঞাই ছাড়তে চান না। শেষক্ষণ পর্যন্ত গদি আঁকড়ে বসে থাকবো এই পণ। এই ভাষণ শুনতে এলেই আমার ওই গদি আঁকড়ানোদের কথা মনে পড়ে যায়।

আহা বুঝছিস না, কে কতো পণ্ডিত, কার কতো চিন্তাশক্তি, বোঝাতে চেষ্টা করবে না?

সবাইকে ওনাদের ছাত্র ভাবে, তাই বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আর আশ মেটে না। কোন নতুন কথাটা বলবি বাবা তোরা! সেই তো কেবল লম্বা লম্বা কোটেশন! অমুক এই বলেছেন, তমুক এই বলেছেন! আরে বাবা, সে-সব বলাবলি তো ছাপার অক্ষরে লেখাই আছে, সবাই পড়েছে, তুই কী বলছিস তাই বল?

পর্দার ওপারে তখন জুতো খুঁজতে খুঁজতে অধ্যাপক-সাহিত্যিক ক্ষুব্ধ হাসি হেসে বলেছিলেন, এতোক্ষণ অসংস্কৃতির আসর চলছিল সেটা শেষ হলো, এবার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আরম্ভ। সংস্কৃতির বেশ একখানা প্রাঞ্জল ব্যাখ্যা বেরিয়েছে দেশে! সংস্কৃতি মানে নাচ গান! কী বলুন অনামিকা দেবী?

অনামিকা দেবীর চটি যথাস্থানেই পড়ে আছে, তিনি অতএব আত্মস্থ গলায় বলেন, তাই তো দেখি আর আশ্চৰ্য হই, কে যে এই নতুন ব্যাখ্যার ব্যাখ্যাকার।

কে আর! এই ফাংশানবাজরা!

মানস হালদারের জুতোটা মঞ্চে ওঠার বাঁশের সিঁড়িয়ে নীচে ঢুকে পড়েছিল, তিনি সেটা টেনে যার করতে করতে কঠিন-পেশী-পেশী-মুখে বলেন, এই ফাংশানবাজরাই দেশের মাথা খেলো! কী পাচ্ছি আমরা ছেলেদের কাছে? আমাদের পরবর্তীদের কাছে? হয় পলিটিক্স, নয় ফাংশান! কোনো উচ্চ চিন্তা নেই, উচ্চ আদর্শ নেই, সুস্থ একটা কর্মপ্রচেষ্টা নেই, শুধু রাস্তায় রাস্তায় রকবাজি! নাঃ, এ ছাড়া আর কিছুই পাচ্ছি না আমরা ছেলেদের কাছে।

অনামিকা দেবী এই সব প্ৰবলদের সঙ্গে তর্ক করতে ভয় পান। জানেন এদের প্রধান অস্ত্ৰই হবে প্ৰাবল্য। অনামিকা দেবীর সেখানে তাই হার। ওঁর প্রশ্নে শুধু মৃদু হাসেন।

উত্তরটা মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে।

আমরা ওদের কাছে কিছুই পাচ্ছি না। ঠিক। কিন্তু ওরাই বা আমাদের কাছে কী পাচ্ছে?

আদর্শ? আশ্রয়? সভ্যতা? সত্য?

ওরা নেমে এসে সামনের সারিতে নির্দিষ্ট আসনে বসলেন। অস্তুতঃ দুএকটি গান শুনে না গেলে ভালো দেখায় না।

যদিও ভালো গানের আশা দুরাশা।

প্ৰথমে শুধু দায়েপড়ে নেওয়া গায়কদের গান। হয় এরা বেশী টাকা দিয়েছে, অথবা এরা উদ্যোক্তাদেরই কেউ। সারমেয়র সামনে মাংসখণ্ড ঝুলিয়ে রেখে তাকে ছুটিয়ে নেওয়ার মতো, ভালো আর্টিস্টদের শেষের জন্যে ঝুলিয়ে রেখে এইগুলি পরিবেশিত হবে একটির পর একটি।

দশটা বেজে যাবে?

যাক না।

বারোটা বাজিলেই বা কী! ঘণ্টা পিছু একশো টাকা বৈ তো নয়! পুষিয়ে যাবে।

প্রধান অতিথি সভানেত্রীকে উদ্দেশ করে চাপা গলায় ক্ষুব্ধ মন্তব্য করেন, এতে মিটার ওঠে না, দেখছেন?

হাসলেন অনামিকা দেবী, দেখছি তো অনেক কিছুই।

সত্যি দেখছেন তো অনেক কিছুই!

তার ভূমিকাটাই তো দর্শকের।

.

অনুষ্ঠান-উদ্যোক্তারা তাঁদের সাহিত্যসভার সভানেত্রী ও উদ্বোধককে সসম্মানে ট্যাক্সিতে তুলে দিলেন। তুলে দিলেন তাদের মালা আর ফুলের তোড়া। তারপরে প্রায় করজোড়ে বললেন, অনেক কষ্ট হলো আপনাদের।

কথাটা বলতে হয় বলেই বললেন অবশ্য, নইলে মনে মনে জানেন কষ্ট আবার কি? গাড়ি করে নিয়ে এসেছি, গাড়ি চড়িয়ে ফেরত পাঠাচ্ছি, বাড়তির মধ্যে মঞ্চ দিয়েছি মাইক দিয়েছি, একরাশ শ্রোতার সামনে বসে ধানাই-পানাই করবার সুযোগ দিয়েছি, আরামসেই কাটিয়ে দিলে তোমরা এই ঘণ্টা দুই-তিন সময়। কষ্ট যা তা আমাদেরই। কন্যাদায়ের অধিক দায় মাথায় নিয়ে আমরা তোমাদের বাড়িতে বার বার ছুটেছি, মাথায় করে নিয়ে এসেছি, ঘাড়ে করে নিয়ে যাচিছ।

তবু সৌজন্যের একটা প্ৰথা আছে, তাই ওঁরা হাত কচলে বললেন, আপনাদের খুব কষ্ট হলো।

তা এরাও সৌজন্যের রীতি পদ্ধতিতে অজ্ঞ নয়। তাই বললেনসে কি সে কিকষ্ট বলছেন কেন? বড় আনন্দ পেলাম।

আমাদের অনেক ভুল-ত্রুটি রয়ে গেছে, ক্ষমা করবেন।

আ ছি ছি, এ কী কথা। না না, এসব বলে লজ্জা দেবেন না।

আচ্ছা নমস্কার-যাবো আপনার কাছে। এটা মানস হালদারের উদ্দেশ্যে, কারণ তিনি একটা কাগজের সম্পাদক।

আচ্ছা নমস্কার—

গাড়িটা কারো ঘরের গাড়ি হলে হয়তো এই সৌজন্য-বিনিময়ের পালা আরও কিছুক্ষণ চলতো, ট্যাক্সি-ড্রাইভারের অসহিষ্ণুতায় তাড়াতাড়ি মিটলো। গাড়ি ছেড়ে দিলো।

পিঠে ঠেস দিয়ে গুছিয়ে বসলেন সভানেত্রী অনামিকা দেবীআর উদ্বোধক মানস হালদার।

প্রধান অতিথি চক্ৰপাণি চট্টোপাধ্যায়?

নাতিনি এসব সৌজন্য বিনিময়ের ধার ধারেননিনিজের গাড়িতে বাড়ি চলে গেছেন একটা মাত্র গান শুনেই। এঁরা দুজন গাড়িহীনএবং একই অঞ্চলের অধিবাসীকাজেই একই গতি।

মানস হালদারের যত্ন সহকারে লেখা ফুসস্ক্যাপ কাগজের গোছা অপঠিত অবস্থায় পকেটে পড়ে আছে সময় সংক্ষেপের আবেদনে যা হোক কিছু বলে সারতে হয়েছে, মনের মধ্যে সেই অপঠনের উষ্মা! যদিও নিজে তিনি একটা সাপ্তাহিকের সম্পাদক, কাজেই শ্রমটা মাঠে মারা যাবার ভয় নেই, স্বনামে বেনামে বা ছদ্মনামে পত্ৰস্থ করে ফেলবেন সেটাকে, তবু মাইকে মুখ দিয়ে দশজন সুধীবৃন্দের সামনে ভাষণ দেওয়ার একটা আলাদা সুখ আছে। সে সুখটা থেকে তো বঞ্চিত হলেন।

গাড়িটা একটু চলতেই মানস হালদার ক্ষোভতপ্ত স্বরে বলে ওঠেন, এরা সব যে কেনই পায়ে ধরে ধরে ডেকে আনে। আসল ভরসা তো আর্টিস্টরা।

অনামিকা দেবী মৃদু হেসে বলেন, ওদের দোষ কি? জনগণ যা চায়-

তা সে শুধু ওদের ডাকলেই হয়, সাহিত্য কেন?

প্রোগ্রামও তেমনি লম্বা। একাসনে ব্ৰহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর, ইন্দ্ৰ চন্দ্র বরুন বায়ূ সবাইকে বসানো চাই। এক ক্ষুরে সবাইয়ের মাথা মুড়োবে, এক তলওয়ারে সবাইয়ের গর্দান নেবে। গোড়ায় যে গায়কদের বসিয়ে দিয়েছে, তারা কী বলুন তো?

অনামিকা দেবী ওঁর উত্তেজনায় কৌতুক অনুভব করেন, মৃদু হাসির সঙ্গে বলেন, আহা ওই ভাবেই তো নতুনরা তৈরি হবে।

তৈরি? মানস হালদার মনের ঝাঁজকে মুক্তি দিয়ে বলে ওঠেন, ওই দাঁত উঁচু  ছেলেটা জীবনেও তৈরি হবে বলে আপনার বিশ্বাস?

এসব কথার উত্তর দেওয়া বড় মুশকিল। নেহাৎ সৌজন্যের জন্যে একটু সায় দিয়ে বসলেই হয়তো পরে তাঁর কানে ফিরে আসবে, তিনিই নাকি নতুনদের বেজায় অবজ্ঞা করেন এবং ওই অনুষ্ঠান সম্পর্কে কড়া সমালোচনা করেছেন। এ অভিজ্ঞতা আছে অনামিকা দেবীর। যে প্রসঙ্গের মধ্যে তিনি হয়তো এতটুকু সায় দেওয়ার কথা উচ্চারণ করেছেন, সেই প্রসঙ্গের পুরো বক্তব্যের দায়িত্বই তার উপরে বর্তেছে।

অমুক এসে অন্য এক অমুকের কথা তার কাছেই পেশ করে গেছেন। দেখতে দেখতে ক্ৰমশঃ সাবধান হয়ে গেছেন অনামিকা দেবী।

তাই মৃদু হেসে বর্লেনঅবিশ্বাসেরও কিছু নেইঅভ্যাসে কী না হয়কী না হয় চেষ্টায়।

মানস হালদার ক্ষুব্ধ গলায় বলেন, এটা আপনার এড়িয়ে যাওয়া কথা। আমরা অনেক জ্বালায় জ্বলি, কাজেই আপনাদের মতো অতো ভদ্রতা করে কথা বলে উঠতে পারি না। জানেন বোধ হয়, একটা কাগজ চালাই? উইকলি! নতুন লেখক-লেখিকাদের উৎসাহের প্রাবল্যে জীবন মহানিশা। কী বলবো আপনাকে, সাহিত্য জিনিসটা যে ছেলেখেলা নয়, তার জন্যে যে অভ্যাস দরকার, চেষ্টা ও নিষ্ঠা দরকার, তা মানতেই চায় না। একটা লিখলো, তক্ষুনি ছাপাবার জন্যে নিয়ে এলো …আমাদের কী? সব ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে চালান করে দিই-

কিন্তু, অনামিকা দেবী বলেন, ওর মধ্যে সম্ভাবনার বীজও থাকতে পারে তো? একেবারে না দেখে–

কী করা যাবে বলুন? বস্তা বস্তা লেখা জমে উঠছে দপ্তরে। দেশসুদ্ধ সবাই যদি সাহিত্যিক হয়ে উঠতে চায়-

তবু লেখক তৈরি করা, নতুন কলমকে স্বাগত জানানো সম্পাদকেরই ডিউটি।

ওসব সেকালের কথা অনামিকা দেবী, যেকালে নতুনদের মধ্যে নম্রতা ছিল, ভব্যতা ছিল, প্রতীক্ষার ধৈর্য ছিল। আর একালে? একটুতেই অধৈৰ্য, নিজের প্রতি অগাধ উচ্চ ধারণা, এবং শুধু লেখা ছাপা হবার আনন্দেই বিগলিত নয়, সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণার প্রত্যাশা! নাঃ, দেশের বারোটা বেজে গেছে!

বলে পকেট থেকে রুমাল বার করে কপালের ঘাম মোছেন মানস হালদার।

ভদ্রলোক অল্পেই উত্তেজিত হন, তা বোঝা গেল।

অনেকেই হয়। দেখে কৌতুক লাগে।

অনামিকা দেবী কখনোই খুব বেশী উদ্বেলিত হন না, হন না খুব বেশী উত্তেজিত।

কিছুক্ষণ আগেই যে বলেছিলেন, আমাদের ভূমিকাটাই তো দর্শকের, সেটা হয়তো কেবলমাত্ৰ কথার কথাই নয়। প্রায় দর্শকের নির্লিপ্ত মন নিয়েই জীবনটাকে দেখে আসছেন তিনি।

হয়তো তাঁর এ প্রকৃতি গড়ে ওঠার পিছনে তাঁর মায়ের প্রকৃতি কিছুটা কাজ করেছে। অর্থাৎ মায়ের প্রকৃতির দৃষ্টান্ত।

বড় বেশী আবেগপ্রবণ ছিলেন অনামিকা দেবীর মা সুবৰ্ণলতা, বড় বেশী স্পর্শকাতর। সামান্য কারণেই উদ্বেলিত হতেন তিনি, সামান্যতেই উত্তেজিত।

তার মানে সেই সামান্যগুলি তার কাছে সামান্য ছিল না। সংসারের অন্য আর সকলকে যা অনায়াসেই সয়ে নিতে পারে, তিনি তার মধ্যে থেকে কুশ্রীতা দেখে বিচলিত হতেন, রুচিহীনতা দেখে পীড়িত হতেন। মানুষের নীচতা ক্ষুদ্রতা হীনতা দৈন্য তাঁকে যেন হাতুড়ির আঘাত হানতো, সেই আঘাতে চুর্ণ হতেন তিনি।

অনামিকা দেবীর বয়েস যখন নিতান্তই তরুণী, তখন মা মারা গেছেন, তবু তখনই তিনি মায়ের এই মুঢ়তায় দুঃখবোধ করতেন। মায়ের ওই সদা উদ্বেলিত বিদীর্ণ হয়ে যাওয়া চিত্তের দিকে তাকিয়ে করুণাবোধ করতেন, বুঝতে পারতেন না সাধারণ ঘটনাগুলোকে এতো বেশী মূল্য কেন দেন তিনি।

পরে বুঝেছেন, মানুষ সম্পর্কে মার বড় বেশী মূল্যবোধ ছিল বলেই এত দুঃখ পেয়েছেন! পৃথিবীর কাছে বড় বেশী প্রত্যাশা ছিল অনামিকা দেবীর মার, মানুষ নামের প্রাণীদের তিনি মানুষ শব্দটার সংজ্ঞার সঙ্গে মিলোতে বসতেন।

এই ভুল অঙ্কটা কষতে বসে জীবনের পরীক্ষায় শুধু ব্যর্থই হয়েছিলেন মহিলা, আর পৃথিবীর আঘাতে চূৰ্ণ হয়ে যাওয়া সেই প্রত্যাশার পত্ৰখানার দিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে নিজেও চূর্ণ হয়ে গিয়েছিলেন; মাকে বুঝতে পেরেছিলেন অনামিকা।

আর সেই চুৰ্ণ হয়ে যাওয়ার দৃশ্য থেকেই এই পরম শিক্ষাটি অর্জন করেছেন অনামিকা, মানুষ সম্পর্কে ভুল অঙ্ক কষতে বসেন না তিনি।

কী হলো অনামিকা দেবী? আপনি হঠাৎ চুপ করে গেলেন যে? বললেন মানস হালদার। নতুন লেখকদের সম্পর্কে আপনার যেন বেশ মমতা রয়েছে মনে হচ্ছে। তা থাকতে পারে, তাদের মুখোমুখি তো হতে হয়নি কখনো?

অনামিকা দেবী বলেন, তাই হবে হয়তো। মুখোমুখি হতে হলে, বোধ হয় আপনাদের জন্যই মমতা হতো!

হ্যাঁ, তাই হতো।–, দৃঢ়স্বরে বললেন মানস হালদার। তারপর বললেন, তা ছাড়া আজকালকার কবিতার মাথামুণ্ডু কিছুই তো বুঝতে পারি না, ওর আর বিচার করবো কি? নির্বিচারে বাতিক করে দিই।

আপনার কাগজে কবিতা দেন না?

দেব না কেন? নিয়মমাফিক দুটো পৃষ্ঠা কবিতার জন্যে ছাড়া থাকে, যাঁদের নামটাম আছে তারা সাপ ব্যাঙ যা দেন চোখ বুজে ছেপে দিই।

অনামিকা ঈষৎ কৌতুকের গলায় বলেন, শুনে ভরসা পেলাম। ভবিষ্যতে যদি সাপ ব্যাঙ লিখতে শুরু করি, তার জন্যে একটা জায়গা থাকলো।

মানস হালদার নড়েচড়ে বসলেন, আপনার সম্পর্কে এটা বলা যায় না, আপনার লেখা কখনো হতাশ করে না।

কি জানি আপনাদের করে কি না-অনামিকা বলেন, তবে আমাকে করে-

আপনাকে করে? অর্থাৎ?

অর্থাৎ কোনো লেখাটাই লিখে শেষ পর্যন্ত সন্তুষ্ট হতে পারি না। মনে হয় যা বলতে চেয়েছিলাম, তেমন করে বলতে পারিনি।

ওটাই তো আসল শিল্পীর ধর্ম-মানস হালদার বোধ করি মহিলাকে সান্ত্বনা দান করতেই সোৎসাহে বলেন, সত্যিকার শিল্পীরা কখনোই আত্মসন্তুষ্টির মোহে আপনি কবর খোড়েন না। আপনি যথার্থ শিল্পী বলেই–

আরো সব অনেক ভালো ভালো কথা বললেন মানস হালদার, যা নাকি অনামিকাকে প্রায় আকাশে তুলে দেওয়ার মত। অনামিকা অস্বস্তি অনুভব করেন, অথচ না না, কী যে বলেন গোছের কথাও মুখে যোগায় না, অতএব মানস হালদারের গন্তব্যস্থল এসে গেলে হাঁফ ফেলে বাঁচেন। বাকি পথটুকু একা হবেন, নিজেকে নিয়ে একটু একা থাকতে পাওয়া কী আরামের!

নমস্কার বিনিময়ের পর নেমে যান মানস হালদার।

অনামিকা পিঠ ঠেসিয়ে ভাল করে বসেন, আর আস্তে আস্তে নিজের মধ্যে হারিয়ে যান যেন।

কিন্তু শুধুই কি মায়ের প্রকৃতির দৃষ্টান্ত থেকেই অনামিকার প্রকৃতির গঠন? বকুলের কাছ থেকেও কি নয়? বকুলের মধ্যেও কি আবেগ ছিল না? ছিল না মোহ, বিশ্বাস, প্ৰত্যাশা? মার মত তীব্রভাবে না হোক, সুষমার মূর্তিতে?

বকুলের সে মোহসে বিশ্বাসসে প্রত্যাশা টেকেনি।

বকুল অতএব অনামিকা হয়ে গিয়ে আবেগ জিনিসটাকে হাস্যকর ভাবতে শিখেছেন।

তবু সেই সুষমাটুকু?

সেটুকু কি একেবারে হারিয়ে গেছে?

বকুলের সেদিনের সেই মূর্তিটা দেখলে তো তা মনে হয় না। বকুল যেন সব ঝেড়ে ফেলে দিয়ে সেই সুষমাটুকুকে মনের মধ্যে আগলে রেখেছিল।

সেই সেদিনযেদিন পারুল ওবাড়ি গিয়ে বলেছিলমা নেইবাবারও খেয়াল নেইতাই আমিই বলতে এলাম জেঠাইমাবিয়েটার আর দেরি করবার দরকার কি?

নির্মলের জেঠাইমা আকাশ থেকে পড়ে বলেছিলেন, কার বিয়ের কথা বলছিস রে পারু?

পারুল জানতো এমন একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি হতেই হবে তাকে, তাই পারুল স্থির গলায় বলেছিল, আমি আর কার বিয়ের কথা বলতে আসবো জেঠাইমা, বকুলের কথাই বলছি!

জেঠাইমার পাশে নির্মলের মা বসেছিলেন, তার চোখমুখে একটা ব্যাকুল অসহায়তা ফুটে উঠেছিল, তিনি সেই অসহায়-অসহায় মুখটা নিয়ে প্রত্যাশার দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন বড় জায়ের দিকে। কিন্তু বড় জা তার দিকে তাকিয়ে দেখেননি। তিনি পারুলের দিকেই দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে উদাস গলায় বলেছিলেন, তা সে আর আমরা পাড়াপড়শীরা কী করবো বল মা? তোর বাবা তো আমাদের পোছেও না!

বাবা তো বরাবরই ওই রকম জেঠাইমা, দেখছেন তো এতকাল। কিন্তু তাই বলে তো চুপ করে বসে থাকলে চলবে না? মা নেই, বৌদিদের কথাও না বলাই ভালো, বকুলটাকে আপনাদের কাছে পৌঁছে দিতে পারলে আমি শান্ত হয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে যেতে পারি।

হ্যাঁ, এইভাবেই বলেছিল পারুল।

বোধ হয় নিজের বুদ্ধির আর বুদ্ধি-কৌশলের উপর বেশ আস্থা ছিল তার, ভেবেছিল একেবারে এইভাবেই বলবো, আবেদন-নিবেদনের বিলম্বিত পথে যাবো না। কিন্তু কতো ভুল আস্থাই ছিল তার!

জেঠাইমা এবার বোধ করি আকাশেরও ঊর্ধ্বতর কোনো লোক থেকে পড়লেন। সেই আছড়ে পড়ার গলায় বললেন, তোর কথা তো আমি কিছু বুঝতে পারছি না পারুল! আমাদের কাছে রেখে যাবি বকুলকে? তোর মানী বাবা সে প্রস্তাবে রাজী হবে? নচেৎ আমাদের আর কি, মা-মরা সোমত্ত মেয়েরা যেমন মাসী পিসির কাছে থাকে, থাকতো আমাদের কাছে।

পারুল তথাপি উত্তেজিত হয়নি, পারুল বরং আরো বেশী ঠাণ্ডা গলায় বলেছিল, এ ধরনের কথা কেন বলছেন জেঠাইমা? আপনি কি সত্যিই বুঝতে পারেননি, বকুলের বিয়ের কথা আপনার কাছে বলতে এসেছি কেন?

জেঠাইমা বিরস গলায় বলেছিলেন, এর আবার সত্যি-মিথ্যে কি তা তো বুঝছি না পারু! হেঁয়ালি বোঝবার চেষ্টার বয়েসও নেই। তোমাদের মা আমাকে বড় বোনের তুল্য মান্যভক্তি করতো, আমাদের কাছে একটা পরামর্শ চাইতে এসেছে এটাই বুঝছি। এ ছাড়া আর কি তা তো জানি না।

নির্মলের মা এই সময় একটুখানি চাপা ব্যাকুলতায় অস্ফটে বলে উঠেছিলেন, দিদি!

দিদি সেই অস্ফুটের প্রতি কান দেননি।

হয়তো সমাজের চাকা আজ এমন উল্টো গতিতে ঘোরার কারণই ভই কান না দেওয়া। যাঁরা ক্ষমতার আসনে বসেছেন, গদির অধিকার পেয়েছেন, তারা এই অস্ফুট ধ্বনির দিকে কান দেওয়ার প্রয়োজন বিবেচনা করেননি। তারা আপন অধিকারের সীমা সম্পর্কে সচেতন থাকেননি, অস্ফুটকে দাবিয়ে রেখে শাসনকাৰ্য চালিয়ে যাওয়ার নীতি বলবৎ রেখেছেন, আজ আর তাই সেই অস্ফুটের ভূমিকা কোথাও নেই। আজ সর্বত্র প্রচণ্ড কল্লোল। সেই কল্পোলে, সেই তরঙ্গে ভেসে গেছে উপরওলাদের গদি, ভেসে গেছে তাঁদের শাসনদণ্ড। নির্বাক অসহায় দৃষ্টি মেলে সেই কল্লোলের দিকে তাকিয়ে আছেন এখন উপরওলারা। হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধারের আশা আর নেই। শুধু যে কেবলমাত্র গুরুজন, এই পদমর্যাদায় যা খুশি করা আর চলবে না তাই নয়, যারা এসে বসলো গদিতে, সেই লঘুজনদের কাছে মৌন হয়ে থাকতে হবে। ইতিহাসের শিক্ষা হয়তো এই নিয়মেই চলে। কিন্তু নির্মলের মায়ের দল নিহত হলো মধ্যবতী যুদ্ধে।

অতএব তখন তার ক্ষমতায় ওই দিদি ডাকটুকু ছাড়া আর কিছু কুলোতো না। আর এখন-নাঃ, এখনের কথা থাক।

তখন দিদি সেদিকে তাকালেন না।

দিদি বললেন, দুধ চড়িয়ে আসোনি তো ছোটবৌ?

ছোটবৌ মাথা নাড়লেন।

ছোটবৌ পারুলের দিকে তাকাতে পারছিলেন না বলে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

পারুল বললে, আমারই ভুল হয়েছিল জেঠাইমা, এভাবে বললে আপনি খেয়াল করতে পারবেন না সেটা খেয়াল করতে পারিনি। স্পষ্ট করেই বলি-নির্মলদার সঙ্গে বকুলের বিয়ের কথা বলতেই আমার আসা। অনেক বড় হয়ে যাচ্ছে বকুল। নির্মলদাও তো কাজকর্ম করছে——

জেঠাইমা পারুলকে সব কথাগুলো বলে নেবার সময় দিয়েছিলেন। তারপর সবটা শোনার পর মুখে একটি কুটিল হাসি ফুটিয়ে বলেছিলেন, আমার বিশ্বাস ছিল তোমার একটু বুদ্ধিসুদ্ধি আছে, তা দেখছি সে বিশ্বাস ভুল। সাহেব বরের ঘর করে মেমসাহেব বনে গিয়েছ। নির্মলের সঙ্গে বকুলের বিয়ে? পাগল ছাড়া এ প্রস্তাব আর কেউ করবে না পারু!

কিন্তু কেন বলুন তো? পারুল শেষ চেষ্টাটা করেছিল, হেসে বলেছিল, আপনাদের ওই রাঢ়ী-বারেন্দ্ৰ গাইগোত্র? ওসব আর আজকাল ততো মানে না।

জেঠাইমা সংক্ষেপে বলেছিলেন, আমরা আজকালের নই পারু।

নির্মলের মা এই সময় একটা কথা বলে ফেলেছিলেন। অস্ফুটেই বলেছিলেন অবশ্য, পারুর বাবাদের ঘর তো আমাদের উঁচু  দিদি!

জেঠাইমা ছোট জায়ের দিকে একটি কঠোর ভর্তসনার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলেছিলেন, তুমি থাম ছোটবৌ! উঁচু -নীচুর কথা নয়, কথাটা রীতিনীতির। যাকগে, অলীক কথা নিয়ে বৃথা গালগল্প করবার সময় আমাদের নেই পারু। তাছাড়া তোমার ওই ধিঙ্গী অবতার বোনটি স্বঘরের হলেও আমি ঘরের বৌ করতাম না বাছা, তা বলে রাখছি। একটা পরপুরুষ বেটাছেলের সঙ্গে যখন তখন ফুসফুস গুজগুজ, তাকে আকর্ষণ করার চেষ্টা, এসব মেয়েকে আমরা ভাল বলি না।

পারুলের মুখটা যে টকটকে লাল হয়ে উঠেছে, সেটা পারুল নিজে নিজেই অনুভব করেছিল, এবং আর একটি কথাও যে বলবার ক্ষমতা ছিল না তার তখন তাও বুঝেছিল। পারুল নিঃশব্দে উঠে এসেছিল।

তবু বেচারা পারুল তার একান্ত মোহপাত্রটির জন্যে আরও কষ্ট করেছিল। গলির মোড়ে নির্মলকে ধরেছিল। বলেছিল, তোমার সঙ্গে কথা আছে নির্মলদা!

নির্মল খতমত নেয় বললে, কী কথা?

পথে দাঁড়িয়ে হবে না সে-কথা, এসো একবার।

আচ্ছা আগে দেখ, আমাদের জানলায় কেউ আছে কিনা?

পারুল নিষ্পলকে ওর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেছিল, থাকলে কী হয়?

ওই দৃষ্টিতে বোধ করি অপ্রতিভ হয়েছিল নির্মল। বলেছিল, না, হবে আর কি! তবে জেঠিমাকে তো জানো। দেখতে পেলেই এখুনি জিজ্ঞেস করতে বসবেন, কেন, কী বৃত্তান্ত, ওখানে কী কাজ তোর?

পারুলের মুখে একটু হাসি ছড়িয়ে পড়েছিল। পারুল আস্তে আস্তে বলেছিল, থাক, আর কোন কথা নেই তোমার সঙ্গে। কথা আমার হয়ে গেছে।

নির্মল কোঁচার খুঁটে মুখ মুছতে মুছতে অবাক গলায় বলেছিল, কথা হয়ে গেছে? কোন কথা?

পারুল একটু বিচিত্ৰ হাসি হেসে বলেছিল, তুমিও দেখছি তোমার জেঠাইমার মত। বিশদ করে না বললে একটুও বুঝতে পারো না। যাক-তাই বলি-বলছিলাম, বাঁড়ির অমতে বিয়ে করবার সাহস আছে তোমার? অথবা বাড়ির অমতকে স্বমতে আনবার শক্তি?

নির্মল মাথা নীচু করেছিল।

নির্মল অকারণেই আধার কপালের ঘাম মুছেছিল। তারপর অস্ফুট বলেছিল, তা কী করে হয়?

হয় না, না?

নির্মল আবেগরুদ্ধ গলায় বলে উঠেছিল, শুধু মা-বাবা হলে হয়তো আটকাতো না পারুল, কিন্তু জেঠাইমা–? ওঃ, ওঁকে রাজী করানো অসম্ভব?

তা অসম্ভবই যখন, তখন আর বলবাঁর কি আছে? পারুল হেসে উঠে বলেছিল, যাও, আর তোমায় আটকাবো না। জেঠাইমা হয়তো তোমার দুধ গরম করে নিয়ে বসে আছেন!

নির্মলের মুখটাও লাল হয়ে উঠেছিল।

আর বড় বেশী ফর্সা রং বলে খুব বেশী প্রকট হয়ে উঠেছিল।

নির্মল বলেছিল, তুমি আমায় ঠাট্টা করছ পারুল, কিন্তু ওদের অবাধ্য হব, এ আমি কল্পনাও করতে পারি না।

ওঁদৈর বলছে কেন? তোমার মা-বাবার তো অমত নেই!

তাতে কোন ফল নেই পারুল। জেঠাইমার ওপর কথা কইবার ক্ষমতা কারুর নেই।

ওরে বাবা, তাহলে তো আমারও কোনো কথাই নেই।–, পারুল হঠাৎ খুব কৌতুকের গলায় হেসে উঠেছিল।

বলেছিল, কিন্তু একটা বড় ভুল করে ফেলেছিলে ভাই, জেঠাইমার কাছে অনুমতি না নিয়ে পাড়ার মেয়ের সঙ্গে প্ৰেম-ট্রেম করা ঠিক হয়নি। তাহলে সে মেয়েটা মরতো না।

আমিও বেঁচে নেই পারুল-, হঠাৎ নির্মলের চোখ দিয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়েছিল। কোঁচার কাপড় দিয়ে সেই জলটুকু মুছতে মুছতে চলে গিয়েছিল নির্মল, আমার মনের অবস্থা বোঝাবার ক্ষমতা তোমাদের কারুরই নেই পারুল।

পারুলের কি সেই দিকে তাকিয়ে মমতা হয়েছিল?

না।

পারুল বড় নির্মম!

পারুলের ঘৃণা হয়েছিল। পারুল বলেছিল, মাটির পুতুল।

কিন্তু বকুলের মনে ওই মাটির পুতুলটার জন্যে অনেকখানি মমতা ছিল। সুষমায় মোড়া সেই মমতাটুকু ৰকুলের কোনো একখানে রয়ে গেছে।

 ১১. পারুল বরের কাছে যাবার সময়

পারুল বরের কাছে যাবার সময় বলে গিয়েছিল, বুঝতে পারিনি, স্রেফ একটা মাটির পুতুলকে হৃদয় দান করে বসে আছিস তুই! না বুঝে তোর ভাল করতে গিয়ে শুধু ছোটই করলাম তোকে!

বকুল বলেছিল,  ‘ছোট হলাম না’ ভাবলে আর কে ছোট করতে পারে সেজদি?

পারুল বললো, ওটা তত্ত্বকথা। ও দিয়ে শুধু মনকে চোখ ঠারা যায়। ভেবে দুঃখ হচ্ছে, এমন ছাই প্রেম করলি যে একটা মাটির গণেশকে তার জেঠির আঁচলতলা থেকে টেনে বার করে আনতে পারলি না!

বকুল বলেছিল, থাম সেজদি! বাবার মতই বলি, জিবনটা নাটক নভেল নয়!

কিন্তু কথাটা কি বকুল সত্যি প্ৰাণ থেকে বলেছিল? বকুলের সেই অপাত্রে দান করে বসা হৃদয়টা কি নাটক-নভেলের নায়িকাদের মতই বেদনায় নীল হয়ে যায়নি? যায়নি যন্ত্রণায় জর্জরিত হয়ে?

গভীর রাত্রিতে সারা বাড়ি যখন ঘুমিয়ে অভেতন হয়ে যেত, তখন বকুল জেগে জানলায় দাঁড়িয়ে দেখতে চেষ্টা করতো না কি ও-বাড়ির তিনতলার ঘরটায় এখনো আলো জ্বলছে, না অন্ধকার?

না, ওই আলো-অন্ধকারের মধ্যে কোনো লাভ-লোকসান ছিল না বকুলের, তবু বকুলের ওই আলোটা ভালো লাগতো। বকুলের ভাবতে ভালো লাগতো, ওই তিনতলার মানুষটাও ঘুমোতে পারছে না, ও জেগে জেগে বকুলের কথা ভাবছে। এ ভাবনাটা নভেলের নায়িকাদের মতই নয় কি?

এ ছাড়াও অনেক সব অবাস্তব কল্পনা করতো বকুল।

যেমন হঠাৎ একদিন বিনা অসুখে মারা গেল বকুল, বাড়িতে কান্নাকাটি শোরগোল। ওবাড়ি এই আকস্মিকতায় বিমূঢ় হয়ে নিষেধবাণী ভুলে ছুটে চলে এলো এ-বাড়িতে, এসে শুনলো ডাক্তার বলেছে মানসিক আঘাতে হার্ট দুর্বল হয়ে গিয়ে হার্তফেল করেছে–

সেই কথা শুনে মাটির পুতুলের মধ্যে উঠতো দুরন্ত প্ৰাণের চেতনা, শূন্যে মাথা ঠুকে ঠুকে ভাবতো সে, কী মূর্খ আমি, কী মূঢ়!

হ্যাঁ, বিনিদ্র রাত্রির দুর্বলতায় এই রকম এক-একটা নেহাৎ কাঁচা লেখকের লেখা গল্পের মত গল্প রচনা করতো বকুল, কিন্তু বেশী দিন নয়, খুব তাড়াতাড়ির মধ্যেই ও-বাড়িতে অনেক আলো জ্বললো একদিন-ওই তিনতলার ঘরটায় সারারাত্রি ধরে অনেক আলো ঝলসালো, সেই আলোয় আত্মস্থ হয়ে গেল বকুল।

আর —আর ওই কাঁচা গল্পগুলো দেখে নিজেরই দারুণ হাসি পেলো তার। ভাবলো ভাগ্যিস মনে মনে লেখা গল্পের খবর কেউ জানতে পারে না!

কিন্তু বকুল কি ওই আলোটা শুধু নিজের ঘরে বসেই দেখলো? বকুল ওই আলোর নদীতে একবার ঘট ডোবাতে গেল না? তা তাও গেল বৈকি! বকুল তো নাটক-নভেলের নায়িকা নয়!

নির্মলের বাবা নিজে এসেছিলেন লাল চিঠি হাতে করে। সনির্বন্ধ অনুরোধ জানালেন বকুলের বাবার কাছে, আমার এই প্রথম কাজ দাদা, সবাইকে যেতে হবে, দাঁড়িয়ে থেকে তদ্বির করে কাজটি সম্পন্ন করতে হবে। না না, শরীর খারাপ বলে এড়াতে চাইলে চলবে না। কোনো ওজর-আপত্তি শুনবো না। বৌমাদের ডেকে আমার হয়ে বলুন, ও-বাড়ির কাকা বলে যাচ্ছেন, গায়েহলুদের দিন আর বৌভাতের দিন, এই দুটি দিন এ বাড়িতে উনুন জ্বলবে না। ছেলেপুলে সবাই ও-বাড়িতেই চা-জলখাবার, খাওয়াদাওয়া–

বকুলের বাবা বলেছিলেন, যাবে যাবে, ছেলেরা বৌমারা যাবে।

শুধু ছেলেরা বৌমারা নয় দাদা, নির্মলের বাবা নিৰ্বেদ সহকারে বলেছিলেন, নাতিনাতনী সবাইকে নিয়ে আপনাকেও যেতে হবে। আর নির্মলের মা বিশেষ করে বলে দিয়েছেন। বকুল যেন নিশ্চয় যায়। তার ওপর তিনি অনেক কাজের ভরসা রাখেন।

হয়তো বকুলের যাওয়া সম্পর্কে ওঁদের একটা সন্দেহ ছিল, তাই এভাবে বিশেষ করে বলেছিলেন বকুলকে।

বকুলের বাবা প্ৰবোধবাবু এই সময় তাঁর বাতের ব্যথা ভুলে সোজা হয়ে বসে বলেছিলেন, বৌমাকে বোলো ভাই, বকুলের কথা আমি বলতে পারছি না, বয়স্থ কুমারী মেয়ে, বুঝতেই পারছে পাঁচজনের সামনে একটা লজ্জা,–

তা বকুলদের আমলে বান্তবিকই ওতে লজ্জা ছিল। বয়স্থা কুমায়ী মেয়েকে চোরের অধিক লুকিয়ে থাকতে হত। প্ৰবোধবাবু বাহুল্য কিছু বলেননি। কিন্তু নির্মলের বাবা সেটা উড়িয়ে দিলেন। হয়তো মেয়েটাকে তাঁরা বিশেষ একটু স্নেহদৃষ্টিতে দেখতেন বলেই মমতার বশে সঙ্গেকার সম্পর্কটা সহজ করে নিতে চাইলেন। বললেন, এ তো একই বাড়ি দাদা, বাড়িতে বিয়ে হলে কী করতো বলুন!

বকুলের বাবা অনিচ্ছের গলায় বললেন, আচ্ছা বলবো।

নির্মলের বাবা বললেন, তাছাড়া ওর খুড়ির আর একটি আবদার আছে, সেটিও বলে যাবো। ওর খুড়ি কাজকর্মে বেরতে পারছে না, পরে আসবে, তবে সময় থাকতে বলে রাখতে বলেছে। ডাকুন না একবার বকুলকে। অনেকদিন দেখাটেখা হয়নি, নইলে আরো আগেই বলতেন। তা ছাড়া-বিয়েটা তো হঠাৎ ঠিক হয়ে গেল!

বকুলের বাবা এতো আত্মীয়তাতেও খুব বেশী বিগলিত হলেন না, প্ৰায় অনমনীয় গলায় বললেন, বাড়ির মধ্যে কাজকর্মে আছে বোধ হয়, ব্যাপারটা কী?

ব্যাপারটা তখন খুলে বললেন নির্মলের বাবা।

নির্মলের মা বকুলের কাছে আবেদন জানিয়েছে, বকুল যেন তাঁর ছেলের বিয়েতে তাঁর নামে একটি প্রীতি উপহার লিখে দেয়।

বকুলের বাবার কপাল কুঁচকে গিয়ে আর সোজা হতে চায় না, কী লিখে দেবো?

প্রীতি উপহার, মানে আর কি পদ্য! বিয়েতে পদার্টদ্য ছাপায় না? সেই আর কি।

বকুলের বাবা ভুরু কুঁচকে বিস্ময়-বিরস কণ্ঠে বলেন, বকুল আবার পদ্য লিখতে শিখলো কবে?

নির্মলের বাবা বিগলিত হাস্যে বলেন, কবে। ছেলেবেলা থেকেই তো লেখে। কেন, ওর পদ্য তো ম্যাগাজিনে ছাপাও হয়েছেদেখেননি। আপনি? লজ্জা করে দেখায়নি বোধ হয়। ওর ওবাড়ির খুড়ি দেখেছে। বলে তো খুব ভালো। তা সেই জন্যেই একটি প্রীতি উপহারের অর্ডার দিতে আসা। ডাকুন একবারনিজে মুখে বলে যাই।

ওষুধ-গেলা মুখে মেয়েকে ডেকে পাঠান প্ৰবোধচন্দ্ৰ। বলেন, তুমি নাকি পদ্য লেখো?

বকুল শঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকায়।

ও-বাড়ির কাকাই বা এ-বাড়িতে কেন, আর তার সামনে এ কথাই বা কেন?

তা কেন যে সেটা টের পেতে দেরি হল না। নির্মলের বাবা তড়বড় করে তার বক্তব্য পেশ করলেন।

বকুল নভেলের নায়িকা নয়, তবু বকুলের পায়ের তলার মাটি সরে যায়নি কি? বকুলের কি মনে হয়নি, কাকীমা কি সত্যিই অবোধ, না নিতান্তই নিষ্ঠুর? বকুলের সমন্ত সত্তা কি একবার বিদ্রোহী হয়ে উঠতে চায়নি এই নির্মম চক্রান্তের বিরুদ্ধে?

কেন? কেন? কেন তাকে যেতে হবে নির্মলের বিয়ে দেখতে? কেন তাকে নির্মলের বিয়ের পদ্য লিখতে হবে? উপন্যাসের নায়িকা না হলেও, একথা কি ভাবেনি বকুল? মানুষের এই নিষ্ঠুরতায় বকুল কি ফেটে পড়তে চায়নি?

হয়তো সবই হয়েছিল, তবু বকুল অস্ফুটে বললে, আচ্ছা।

আপনার বকুলের মত মেয়ে এ যুগে হয় না দাদা, নির্মলের বাবা হৃষ্টচিত্তে বলেন, ওর খুড়ি তো সুখ্যাতি করতে করতে-

বকুলের ইচ্ছে হল চেঁচিয়ে বলে ওঠে, আপনি থামবেন?

কিন্তু বকুলের শরীরের ভিতরটা থরথর করা ছাড়া আর কিছু হল না।

নির্মলের বাবা হৃষ্টচিত্তে চলে গেলেন আরো একবার সবাই মিলে নেমন্তন্ন খাবার জন্যে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানিয়ে। হয়তো ওই মানুষটা সত্যিই অজ্ঞ অবোধ। কারণ নির্মলের মা পারুলের প্রস্তাবের কথাটুকু ছাড়া আর কিছুই বলেননি তাঁকে। কী-ই বা বলবেন? বকুল আর নির্মলের ভালবাসার কথা? তাই কি বলা যায়?

চলে যাবার পর ফেটে পড়েছিলেন প্ৰবোধচন্দ্ৰ। বলেছিলেন, অমনি বলে দিলি আচ্ছা! লজ্জা করলো না তোর হারামজাদি?

বকুল বলেছিল, ওঁদের যদি চাইতে লজ্জা না করে থাকে, আমার কেন দিতে লজ্জা করবে বাবা?

এই সেদিন অত বড় অপমানটা করলো ওরা—

অপমান মনে করলেই অপমান–, বকুল সে-যুগের মেয়ে হলেও বাপের সঙ্গে খোলাখুলি কথা কয়েছিল, বিয়ের মত মেয়ে-ছেলে থাকলেই লোকে সম্বন্ধ করতে চেষ্টা করে, করলেই কি সব জায়গায় হয়? তা বলে সেটা না হলে তারা শত্রু হয়ে যাবে?

প্ৰবোধচন্দ্র এই রকম উন্মুক্ত কথায় থতমত খেয়ে বলেছিলেন, তুমি পারলেই হল! পারুলবালা তো অনেক রকম কথা বলে গেলেন কিনা–।

সেজদির কথা বাদ দিন। বলে সব কথায় পূর্ণচ্ছেদ টেনে দিয়েছিল বকুল।

হাঁ, তারপর স্নেহের সুনির্মলের শুভ বিবাহে স্নেহ উপহার লিখে দিয়েছিল বকুল নির্মলের মার নাম দিয়ে। সে পদ্য পড়ে ধন্যি ধন্যি করেছিল সবাই। নির্মলের মা বলেছিলেন, আমি তো তোকে কিছু বলে দিইনি। বাছা, তবু আমার মনের কথাগুলি সব কি করে বুঝে নিলি মা? কি করেই বা অমন মনের মত লিখলি?

বকুল শুধু হেসেছিল।

নির্মলের মার চোখ দিয়ে হঠাৎ জল পড়েছিল, তিনি অন্য দিকে চোথা ফিরিয়ে বলেছিলেন, ভগবানের কাছে তোর জন্যে প্রার্থনা করি মা, তোরা যেন রাজা বর হয়।

শুনে বকুল আর একটু হেসেছিল।

সেই হাসিটাকে স্মরণ করে অনামিকা দেবীও এতোদিন পরে একটু হাসলেন। নির্মলের মারা সেই আশীর্বাদটা স্রেফ অকেজো হয়ে পড়ে থেকেছে।

নির্মলের মা ছলছল চোখে আবারও বলেছিলেন, তোর জন্য ভগবান অনেক ভাল রেখেছেন, অনেক ভাল।

তা এ ভবিষ্যদ্বাণীটি হয়ত ভুল হয়নি তাঁর। বকুল হয়তো অনেক ভালোই পেয়েছে, অনেক ভালো-, ভাবলেন অনামিকা দেবী।

বকুল বৌ দেখতে তিনতলায় উঠে গিয়েছিল। বকুল আর সেদিন জেঠাইমার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিকে গ্রাহ্য করেনি। বকুল বৌ দেখেছিল, নেমন্তন্ন খেয়েছিল, মেয়েদের দিকে পরিবেশনও করেছিল। আবার পরদিন নির্মলের মার কাছে বসে বউয়ের মুখ-দেখানি গহনা টাকা জিনিসপত্রের হিসাব লিখে দিয়েছিল।

সেই সূত্রে অদ্ভুত একটা হৃদ্যতা হয়ে গেল নির্মলের বৌয়ের সঙ্গে। ব্যাপারটা অদ্ভুত বৈকি। এমন ঘটে না! তবু কিছু কিছু অদ্ভুত ঘটনাও ঘটে জগতে মাঝে মাঝে।

হিসেব মেলানোর কাজ হচ্ছিল, বৌ অদূরে ঘোমটা ঢাকা হয়ে বসে বসে ঘামছিল, শাশুড়ীর উপস্থিতিতে কোন কথা বলেনি। কি একটা কাজে তিনি উঠে যেতে, ঘোমটা নামিয়ে মৃদু অথচ পরিষ্কার গলায় বলে উঠলো, নেমন্তন্ন খেতে এসে এতো খাটছো কেন?

বকুল এ প্রশ্নের জন্যে প্রস্তুত ছিল না, তাই একটু চমকালো। ভাবলো–বৌ আমায় চিনলে কি করে? তারপর আবার ভাবলো, এ প্রশ্নের অর্থ কি? বড় জেঠির কাছে তালিম নিয়ে যুদ্ধে নামলো নাকি বকুলের সঙ্গে?

হ্যাঁ, এই ধরনের একটা সন্দেহ মুহূর্তে কঠিন করে তুলেছিল বকুলকে। বকুল তাই নিজেও যুদ্ধে নামতে চাইল। স্থির আর শক্ত গলায় বললো, আমার সঙ্গে যে শুধু নেমন্তন্ন খাওয়ারই সম্পর্ক এ কথা আপনাকে কে বললো?

বৌ চোখ তুলে তাকিয়েছিল।

দীর্ঘ পল্লবাচ্ছাদিত গভীর কালো দুটি চোখ।

নির্মলের বৌ খুব সুন্দরী হচ্ছে এ কথা আগে থেকেই শুনেছিল বকুল। বৌ আসার পর দেখে বুঝেও ছিল। ধন্যি-ধন্যিটাও কানে এসেছিল, তবু ঠিক ওই মুহূর্তটার আগে বুঝি অনুধাবন করতে পারেনি সেই সৌন্দর্যটি কী মোহময়! ওই গভীর চোখের ব্যঞ্জনাময় চাহনির মধ্যে যেন অনেক কিছু লুকানো ছিল, ছিল অনেকখানি হৃদয়। যে দিকটায় কথা এ পর্যন্ত আদৌ চিন্তা করেনি বকুল।

নির্মলের বৌ শব্দটাকে বকুল যেন অবজ্ঞা করার প্রতিজ্ঞা নিয়েই বসেছিল। চেতনে না হোক। অবচেতনে।

কিন্তু বৌ বকুলের দিকে ভালবাসার ভর্ৎসনায় ভরা দুটি চোখ তুলে ধরলো। বকুল প্ৰতিজ্ঞার জোরটা যেন হারাতে বসলো।

বৌ মাধুরী সেই চোখের দৃষ্টি স্থির রেখে বললো, আমি তো তোমায় তুমি করে বললাম ভাই, তুমি কেন আপনি করছো?

খুড়িমা ঘরে নেই, মুখোমুখি শুধু তারা দুজনে-বকুল লজ্জা ত্যাগ করলো। বললো, তা করবো না? বাবা! আমি হলাম তুচ্ছ একটা পাড়ার মেয়ে, আর আপনি হচ্ছেন একজন মান্যগণ্য মহিলা! এ বাড়ির বড় বৌ!

বকুলের কণ্ঠস্বরে কি ক্ষোভ ছিল?

অথবা তিক্ততা?

হয়তো ছিল।

কিন্তু বৌ তার পাল্ট জবাব দিল না। সে এ কথার উত্তরে হাত বাড়িয়ে বকুলের একটা হাত চেপে ধরে ভালবাসার গলায় বলে উঠলো, যতই চেষ্টা কর না কেন, তুমি আমায় দূরে সরিয়ে রাখতে পারবে না ভাই। আমি জানি তুমি খুব কাছের মানুষ, খুব নিকটজন!

বকুল একটু অবাক হয়েছিল বৈকি।

এটা তো ঠিক জেঠিমার তালিম বলে মনে হচ্ছে না? তবে কী এটা?

বকুলের গলার স্বর থেকে বোধ করি তার অজ্ঞাতসারেই ক্ষোভ আর তিক্ততাটা ঝরে পড়ে গিয়েছিল। বকুল যেন ঈষৎ কৌতুকের গলায় বলেছিল, বেশনা হয় তুমিই বললাম, কিন্তু আমি খুব নিকটজন, এমন অদ্ভুত খবরটি তোমায় দিল কে?

মাধুরী-বৌ খুব মিষ্টি একটা হেসে বলেছিল, যে দেবার সে-ই দিয়েছে। সব কথাই বলেছে কাল আমায়।

মুহূর্তে আবার কঠিন হয়ে উঠেছিল বকুল রাগে, আপাদমন্তক জ্বলে গিয়েছিল তার।

ওঃ, ফুলশয্যার রাত্রেই বৌয়ের কাছে হৃদয় উজাড় করা হয়েছে! না জানি নিজের গা বাঁচিয়ে আর বকুলকে অপমানের সমুদ্রে ড়ুবিয়ে কতো কৌশলেই করা হয়েছে সেটি!

নির্মল এমন!

নির্মল এতো নীচ, অসার, ক্ষুদ্র! অথবা তা নয়, একেবারে নির্বোধ মুখ্যু!

ভেবেছে কানাঘুষোয় কিছু যদি শুনে ফেলে বৌ, আগে থেকে সাফাই হয়ে থাকি। সেটা যে হয় না, সে জ্ঞান পর্যন্ত নেই।

বকুল অতএব কঠিন হয়েছিল।

রুক্ষ গলায় বলেছিল, সব কথাই বলেছে? এক রাত্তিরেই এতো ভাব? তা কি কি বলেছে? আমি তোমার বরের প্রেমে হাবুড়ুবু খেয়ে মরে পড়ে আছি? তার জন্যে আমার জীবন ব্যর্থ পৃথিবী অর্থহীন? এই সব? তাই করুণা করছো?

বলেছিল।

আশ্চর্য! বকুলের মুখ থেকেও এমন কুশ্রী কথাগুলো বেরিয়েছিল সেদিন। বকুলের মাথার মধ্যে আগুন জ্বলে উঠেছিল যেন।

কিন্তু মাধুরী-বৌ এই রুক্ষতার, এই কটুক্তির উচিত জবাব দিল না। সে শুধু তার সেই বড় বড় চোখ দুটিতে গভীরতা ভরে উত্তর দিল, না, তা বলবে কেন? সে নিজেই ভালবাসায় মরে আছে, সেই কথাই বলেছে।

বা চমৎকার! বকুল কড়া গলায় হেসে উঠেছিল, সত্যসন্ধ যুধিষ্ঠির! তা যাক, তুমি সেই মরা মানুষটাকে বাঁচাবার প্রতিজ্ঞা নিয়েছ অবিশ্যি? অতএব নিশ্চিন্দি!

কথাগুলো কে বলেছিল?

বকুল, না বকুলের ঘাড়ে হঠাৎ ভর-করা কোনো ভূত? হয়তো তাই। নইলে জীবনে আর কবে বকুল অমন অসভ্য কথা বলেছে? তার আগে? তার পরে?

মাধুরী-বৌ তবুও শান্ত গলায় বলেছিল, আমি তো পাগল নই যে তেমন প্ৰতিজ্ঞা নেবো। তোমাকে ও কখনো ভুলতে পারবে না।

বৌয়ের মুখে এমন একটা নিশ্চিত প্রত্যয়ের আভা ছিল যে, তাকে ব্যঙ্গ করা যায় না।

বকুল অবাক হয়েছিল।

মেয়েটা কি?

অবোধ? না শিশু?

ন্যাকা ভাবপ্রবণ বরের ওই গদগদ স্বীকারোক্তি হজম করে এমন অমলিন মুখে আলোচনা করছে সেই প্রসঙ্গ? তবে কি সাংঘাতিক ধড়িবাজ? কথা ফেলে কথা আদায় করতে চায়? এই সরলতা সেই কথার রুই টেনে তোলবার চার?

ঠিক এই ভাষাভঙ্গীতে না হলেও, এই ভাবের কিছু একটা ভেবেছিল বকুল সেদিন প্রথমটায়।

কিন্তু তারপর বকুল সেই দেবীর মত মুখের দিকে ভাল করে তাকিয়ে দেখেছিল, তাকিয়ে দেখেছিল সেই দীর্ঘ পল্লবাচ্ছাদিত কালো কালো বড় বড় চোখের দিকে, আর দেখো যেন লজ্জায় মরে গিয়েছিল। বকুল বুঝেছিল, এ এক অন্য জাতের মেয়ে, সংসারের ধারণ মাপকাঠিতে মাপা যাবে না একে।

বকুলের ভিতর একটা বোবা দাহ বকুলকে ভয়ানক যন্ত্রণা দিচ্ছিল, বাইরে ভদ্রতা আর অহঙ্কার বজায় রাখতে রাখতে বকুল কষ্টে মরে যাচ্ছিল, কিন্তু মাধুরী-বৌয়ের ওই জ্বালাহীন ঈর্ষাহীন পবিত্র সরলতার ঐশ্বর্যের দিকে তাকিয়ে বকুল নিজের চিত্তদৈন্যে মরমে মরলো।

বকুলের সেই দাহটাও বুঝি কিছুটা স্নিগ্ধ হয়ে গেল। বকুল সহজ কৌতুকের গলায় বললো, তুমি তো আচ্ছা বোকা মেয়ে! তোমার বর এমন একখানা পরমা সুন্দরী বৌকে ঘরে এনে পাড়ার একটা কালো-কোলো মেয়েকে হৃদয়ে চিরস্মরণীয় করে দেবে, আর তুমি সে ঘটনা সহ্য করবে?

কালো-কোলো? বৌ একটু হাসে, তোমার খুব বিনয়!। তারপর হাসিমুখেই বলে, বাইরের রূপটাই তো সব নয়!

বকুলই এবার হাত বাড়িয়ে ওর হাতটা ধরে। যাকে বলে করপল্লব। যেমন কোমল তেমনি মসৃণ; নির্মলটা জিতেছে সন্দেহ নেই। এ মেয়েকে দেখে বকুলই মুগ্ধ হচ্ছে।

বকুল সেই ধরা হাতটায় একটা গভীর চাপ দিয়ে বলে, তোমার বাইরের রূপও অতুলনীয়, ভেতরের রূপও অতুলনীয়।

মাধুরী-বৌ একটুক্ষণ চুপ করে থেকে আস্তে বলে, প্রথম ভালবাসার কাছে কোনো কিছুই লাগে না।

বকুলের বুকটা কেঁপে ওঠে, বকুলের মাথাটা যেন ঝিমঝিম করে আসে, নিজের সম্বন্ধে ভালবাসা শব্দটা অপরের মুখে এমন স্পষ্টভাবে উচ্চারিত হতে এর আগে কি কোনোদিন শোনেনি বকুল? পারুল তো বলেছে কতো!

কিন্তু এ যেন অন্য কিছু, আর কিছু।

নির্মলের বিয়ের ব্যাপারের গোড়া থেকে নিজেকে কেবলই অপমানিত মনে হয়েছে বকুলের, এখন হঠাৎ নিজেকে যেন অপরাধী মনে হলো। যেন বকুল নির্লজ্জের মত কারো ন্যায্য প্ৰাপ্যে ভাগ বসিয়ে রেখেছে। এখন বকুল নিজেকে সেই দাবিদারের থেকে অনেক তুচ্ছ ভাবছে।

ওই মেয়েটার কাছে বকুল শুধু রূপেই তুচ্ছ নয়, মহিমাতেও অনেক খাটো।

বকুল নিজেকে সেই তুচ্ছর দরেই দেখতে চেষ্টা করলো।

মাধুরী-বৌয়ের কথায় হেসে উঠে বললো, ওরে বাস! খুব লম্বা-চওড়া কথা বলে নির্মলদা তো দেখছি তোমার কাছে নিজের দর বাড়িয়ে ফেলেছে! ওসব হচ্ছে স্রেফ কল্পিত কল্পনার ব্যাপার, বুঝলে?

এটা তুমি লজ্জা করে বলছো—, মাধুরী-বৌ মৃদু হেসে বলে, মেয়েরা তো সহজে হার মানে না। পুরুষমানুষ মনের ব্যাপারে অতো শক্ত হতে পারে না। তা ছাড়া ও তো একেবারে–

মাধুরী-বৌ নিজেই বোধ করি লজ্জায় চুপ করে গিয়েছিল।

বকুল সেই পরম সুন্দর মুখটার দিকে যেন মোহগ্রস্তের মত তাকিয়ে রইল। এই ঐশ্বর্যের মালিক হয়েছে নির্মল নামের ছেলেটা?

বকুল কি নির্মলকে হিংসে করবে?

এ-যুগের কাছে কী হাস্যকরই ছিল সেকালের সেই জোলো-জোলো প্ৰেম ভালবাসা!

অনামিকা দেবী সেই বহু যুগের ওপর থেকে ভেসে আসা আষাঢ়ের দিকে তাকিয়ে প্রায় হেসে উঠলেন।

এখনকার মেয়েরা যদি বকুলের কাহিনী শোনে, স্রেফ বলবে, শ্ৰীমতী বকুলমালা, তোমাকে ফ্রেমে বাঁধিয়ে দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখা উচিত!

তুমি কিনা তোমার প্ৰেমপাত্তরের প্রিয়ার রূপে গুণে মুগ্ধ হয়ে তার প্রেমে পড়ে বসলে?

তার সেই রূপসী প্রিয়া যখন বললো, তোমার ওপর ঈর্ষা কেন হবে ভাই? ও তোমায় এতো ভালবাসে বলেই তো আমারও তোমাকে ভালবাসতে ইচ্ছে করছে। তোমার সঙ্গে আমি বন্ধু পাতালাম আজ থেকে।

তুমি তখন একেবারে বিগলিত হয়ে বন্ধুত্বের শপথ নিয়ে বসলে! নির্মল নামের সেই ভাবপ্রবণ ছেলেটা না হয় প্রথম ঝোঁকে নতুন বৌয়ের কাছে অনেস্ট হয়েছে, প্রথম ভালবাসার বড়াই করে কাব্যি করেছে, কিন্তু তুমি সেই ফাঁদে ধরা দিলে কী বলে?

বেশ তো বলছিলে, বেশী গল্প উপন্যাস পড়েই এই ঢং হয়েছে নির্মলদার, দেবদাস হতে ইচ্ছে হচ্ছে, শেখর হতে ইচ্ছে হচ্ছে, তিলকে তাল করে তোমার কাছে হীরো হয়েছে!

বেশ তো বলছিলে, এই সব আজেবাজে কতকগুলো কথা তোমার মাথায় ঢুকিয়ে দিয়ে নির্মালদার কী ইষ্টসিদ্ধি হল জানিনে বাবা! বাজে কথায় কান দিও না।

বলেছিলে, সংসার জায়গাটা স্রেফ বাস্তব, বুঝলে বৌঠাকরুণ! ওসব কাব্যিটাব্যি চলে না। বিশেষ করে যেটা প্রবল প্ৰতাপ শ্ৰীমতী জেঠিমার সংসার।–

তারপর-হঠাৎ তবে ওই মেয়েটার কোমল করপল্লবখানা হাতে ধরে স্তন্ধ হয়ে বসে রইলে কেন অনেকখানি সময়? কেন তারপর আস্তে নিঃশ্বাস ফেলে বললে, আচ্ছা, বন্ধুত্বই পাতালাম।

তার মানে তোমার সব গর্ব ধূলিসাৎ হল, তুমি ধরা দিলে!

একটি সরল পবিত্রতা, একটি ভালবাসার হৃদয়, একটি হিংসাশূন্য, অহঙ্কারশূন্য, নির্মল মন অনেক কিছুই বদলে দিতে পারে বৈকি। সকল গর্ব চুৰ্ণ করে দিয়ে একেবারে জয় করে নিতে পারে সে।

বকুলও বিজিত হল।

মাধুরী নামের মেয়েটার ওই অদ্ভুত জীবনদর্শন বকুলকে আকৃষ্ট করলো, আবিষ্ট করলো।

তোমার আর আমার দুজনেরই ভালবাসার পাত্র যখন একই লোক, তখন আমাদের মতো আপনজন আর কে আছে বল ভাই? তুমিও ওর মঙ্গল চাইবে, আমিও ওর মঙ্গল চাইবো, বিরোধ তবে আসবে কোনখান দিয়ে?

এই হচ্ছে মাধুরী-বৌয়ের জীবনদর্শন!

ষোল আনা অধিকারের দাবি নিয়ে রাজরাজেশ্বরী হয়ে এসে ঢুকেছিল সে, তবু বলেছিল, তোমার কাছে যে ভাই আমার অপরাধের শেষ নেই। সর্বদাই মনে হবে-বিনা দাবিতে জোর করে দখল করে বসে আছি আমি।

বকুল হেসেছিল।

বলেছিল, তোমার মতন এরকম ধর্মনিষ্ঠ মহামানবী সংসারে দুচারটে থাকলে–সংসার স্বৰ্গ হয়ে যেতো ভাই বৌঠকরুণ। নেই, তাই মর্ত্যভূমি হয়ে পড়ে আছে!

অবশ্য ঠিক সেই দিনই এত কথা হয়নি। সেদিন শুধু স্তব্ধতার পালা ছিল।

দিনে দিনে কথা উঠেছে জমে।

তুচ্ছতার গ্লানি, বঞ্চনার দাহ, সব দূর হয়ে গিয়ে মন উঠেছে অন্য এক অনুভূতিতে কানায় কানায় ভরে! আর সেই ভরা মনে নির্মল নামের মেরুদণ্ডহীন ছেলেটার উপর আর রাগবিরক্তি পুষে রাখতে পারেনি। খাড়া রাখতে পারেনি নিজের মধ্যেকার সেই ঔদাসীন্যের বোবা দেওয়ালটাকে, যেটাকে বকুল নির্মলের সামনে থেকে নিজেকে আড়াল করতে চেষ্টা করে গেঁথেছিল। পারেনি, বরং মগ্নতাই জমা হয়েছে তার জন্যে।

তবে সেদিন নয়।

যেদিন সেই মাধুরী-বৌয়ের হাতে হাত বেথে বন্ধুত্বের সংকল্প নিচ্ছিল, সেদিন দেওয়ালটাকে বরং বেশী মজবুত করার চেষ্টা করেছিল।

কাকীমা কোথায় যেন কোন কাজে ভেসে গিয়েছিলেন, একটু পরে নির্মল এসে দরজায় দাঁড়িয়েছিল। নিজে থেকে আসবার সাহস হত না নির্মলের, কারণ এ ঘরে তার দু-দুটা অপরাধের বোঝাঁ। অথবা দু-দুটো আতঙ্কের বস্তু। তাই ঘরে ঢুকতে ইতস্তত করছিল।

বকুল যদি দেখে নির্মল বৌয়ের ধারে-কাছে ঘুরঘুর করছে, নিশ্চয় বকুল ঘৃণায় ধিক্কারে ব্যঙ্গ হাসি হেসে উঠবে। আর জেঠাইমা যদি দেখেন-হতভাগা গাধাটা বিয়ের পরও ওই পাজি মেয়েটোর আনাচে-কানাচে ঘুরছে, রসাতল করে ছাড়বেন।

বৌয়ের কাছে?

না, বৌয়ের জন্যে ভয় নেই নির্মলের! বৌয়ের কাছে তো নিজেকে উদঘাটিত করেছে সে।

বলেছে তার কাছে আবাল্যের ব্যাকুলতার ইতিহাস।

বলেছে, ওকে ভুলতে আমার সময় লাগবে, তুমি আমায় ক্ষমা কোরো।

বৌ তখন অদ্ভুত আশ্চর্য একটা কথা বলেছিল। বলেছিল, তুমি যদি ওকে ভুলে যাও, তাহলেই বরং তোমাকে কখনো ক্ষমা করতে পারবো না। মনে করবো তুমি একটা অসার মানুষ।

তুমি আমার দুঃখ বুঝতে পারছে মাধুরী?

চোখ দিয়ে জল পড়েছিল ওর।

মাধুরী বলেছিল, মানুষের প্রাণ থাকলেই মানুষের দুঃখ বোঝা যায়। তা আমাকে কি তোমার সেই রকম মনপ্রাণহীন পাষাণী মনে হচ্ছে?

তারপর নির্মল কি বলেছিল, সে কথা অবশ্য বকুল জানে না।

কিন্তু এতো কথাই বা জানলো কি করে বকুল? বকুল কি আড়ি পাততে গিয়েছিল নির্মলের ঘরে? না, তেমন অসম্ভব ঘটনা ঘটেনি।

বলেছিল নির্মলই স্নান বিষণ্ণ মুখে। নির্মলের মুখে তখন চাঁদের আলোর মত একটা স্নিগ্ধ আলোর আভাস ফুটে উঠেছিল। নির্মল তার ওই দেবীর মত মেয়ে বৌয়ের মহিমান্বিত হৃদয়ের পরিচয়ে বিমুগ্ধ হতে শুরু করেছে, নির্মল আস্তে আস্তে তার প্রেমে পড়তে শুরু করেছে তখন। আর নির্মল যেন তাই ব্যাকুল হয়ে বকুলকে বোঝাতে চেষ্টা করেছে নির্মল কতো নিরুপায়!

এর থেকে যদি খুব দুষ্ট পাজি ঝগড়াটে একটা মেয়ে আমার বৌ হত!

নিঃশ্বাস ফেলে বলেছিল নির্মল।

বকুল হেসে ফেলেছিল।

বকুল যেন তখন অনেক বড় হয়ে গিয়েছিল নির্মলের চেয়ে।

নির্মলের বিয়েটাকে ঘিরে যতো সব ঘটনা ঘটেছিল, সেই ঘটনাগুলো যেন বকুলকে ঠেলে হঠাৎ একদিনে একটা দশক পার করে দিয়েছিল।

বকুলের বৌদিরা বলেছিল, ঢের বেহায়া মেয়ে দেখেছি বাবা, ছোট ঠাকুর ঝির মত এমনটি আর দেখলাম না! নইলে ওই বিয়েতে নেমন্তন্ন যায়, পদ্য লিখে দেয়!

বকুলের বাবা বলেছিলেন, যেতেই হবে? এতো কিসের চক্ষুলজা? বলি এতো কিসের চক্ষুলজ্জা? বেশ তাই যদি হয়, অসুখ করেছে বলে বাড়িতে থাকলেই হত? অসুখের তো কথা নেই!

বকুলের দাদারা বলেছিল, কি করবো, ও-বাড়ির কাকা নিজে এলেন তাই, তা নয়তো এক প্ৰাণীও যেতাম না। তবে ধারণা করিনি বকুল যাবে!

বকুলের ভালবাসার ইতিহাস আন্দাজে অনুমানে সকলেই জানতো এবং রাগে ফুলতো, আর কেবলমাত্র বড় হওয়ার অজুহাতটাকেই বড় করে তুলে ধরে তাকে শাসন করতো, কিন্তু উদঘাটন করেনি কেউ। খোলাখুলি বলেনি কেউ। পারুলের ব্যর্থ চেষ্টাই সব উদঘাটিত করে বসলো। পারুলের ব্যর্থতার পর সে চলে গেলে জেঠাইমা একদিন এ বাড়িতে এসে মিষ্ট মধুর বচনে অনেক যাচ্ছেতাই করে গেলেন, এবং বৌদের ওপর ভার দিয়ে গেলেন পরিবারের সুনাম রক্ষার।

বলে গেলেন, শাশুড়ী নেই, তোমাদেরই দায়। যতোদিন না বিয়ে দিতে পারছ, ননদকে চোখে চোখে রাখবার দায়িত্ব তোমাদেরই, আর স্বামী-শ্বশুরকে বলে বলে বিয়েটা দিয়ে ফেল চটপট! বয়সের তো গাছপাথর নেই আর!

সে-কথা বকুলের কানো যায়নি তা নয়।

সেই কথার পর যে আবার কোনো মেয়ে সে বাড়িতে যায়, এ বৌদিরা ভাবতেই পারেনি।

অথচ বকুল গিয়েছিল।

হয়তো বকুল ওই জেঠাইমাকে ওদের বাড়ির প্রকৃত মালিক মনে করতো না অথবা বকুল না গিয়ে থাকতে পারেনি।

বিয়ে করে ফিরে নির্মলের মুখটা কেমন দেখায় দেখতে বড় বেশী বাসনা হয়েছিল। কিন্তু বকুল উদাসীন থেকেছিল, বকুল নিষ্ঠুর হয়েছিল।

নির্মল যখন সেই ভোজবাড়ির গোলমালে একবার বকুলের নিতান্ত নিকটে এসে বদ্ধগম্ভীর গলায় ডেকেছিল, বকুল!

বকুল তখন ব্যন্ত হয়ে বলেছিল, ওমা তুমি এখানে? দেখা গে তোমার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা এসে গেছে বোধ হয়। যাও যাও।

নির্মল আরো সন্নিকটে এসে বলেছিল, বকুল, তুমি আমায় কী ভাবছো জানি না—

বকুল কথা শেষ করতে দেয়নি।

বলে উঠেছিল, হঠাৎ আমি তোমায় কী ভাবছি, এ নিয়ে মাথা ঘামাতে বসছো কেন? আর তোমার কথা নিয়ে আমিই বা ভাবতে বসবো কেন?

বকুল—

সব কিছুরই একটা সীমা আছে নির্মলদা। বলে চলে গিয়েছিল বকুল।

আর তারপর থেকে যতোবারই নির্মল নিকটে আসবার চেষ্টা করেছে, বকুল সরে গেছে।

কিন্তু সেদিন ঘরে নতুন বৌ ছিল।

নির্মল ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে যেন দেয়ালকে উদ্দেশ করে বলেছিল, মা বললেন, মা এখন আর আসতে পারবেন না, সব কিছু দেরাজে তুলে রাখতে।

বকুল হাতের জিনিসগুলো নামিয়ে রেখে বলেছিলো, শুনলে তো বৌ হুকুম? তা হলে রাখো তুলে, বরের একটু সাহায্য নিও বরং। বলে নির্মলের পাশ কাটিয়ে চলে গিয়েছিল।

বকুলের সেই নিষ্ঠুরতা ভেবে আশ্চর্য লাগে অনামিকা দেবীর। অতো নির্মম হয়েছিল কি করে সেদিন বকুল? কোন পদগৌরবেই বা? নির্মলের বৌ তো বকুলের থেকে দশগুণ বেশী সুন্দরী, তার ওপর আবার অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে!

আর বকুল? কিছু না। বকুল তো শুধু নির্মলের দেওয়া মৰ্যাদাতেই এতোখানি মূল্যবান। অথচ বকুল—

.

কিন্তু তারপর বদলে গেল বকুল।

নির্মলের বিয়ের পর জেঠাইমা বোধ করি নিশ্চিন্ত হয়েই কেদারবদরী গেলেন কিছু বান্ধবী জুটিয়ে। সেই পরম সুযোগে নির্মলের মা আর বৌ এ-বাড়ি ও-বাড়ি এক করে তুললো। মাধুরী-বৌয়ের তো এই বাড়িটাই একটা বেড়াতে আসার জায়গা হল। নির্মলের মাও যেন একটা ভারী জাঁতার তলা থেকে বেরিয়ে এসে বেঁচেছিলেন দুদিনের জন্যে।

এই মুক্তির মধ্যে মাধুরী-বৌ যেন বকুলকে এক নিবিড় বন্ধনে বেঁধে ফেললো। আর সেই সূত্রে নির্মলের সঙ্গে সম্পর্কটা হঠাৎ আশ্চর্য রকমের সহজ হয়ে গেল।

বকুল যেন মাধুরীরই বেশী আপন হয়ে উঠলো। বকুল যেন নির্মলের সঙ্গে ব্যবহারে শ্যালিকার ভূমিকা নিলো। প্রখর কৌতুকময়ী মুখরা শ্যালিকা।

হ্যাঁ, ওই সময়টা থেকেই একেবারে বদলে গিয়েছিল বকুল। এই কিছুদিন আগেও কী ভীরু আর লাজুক ছিল সে। সেই ভীরু কুণ্ঠিত লাজুক কিশোরীর খোলস ভেঙে যেন আর একজন বেরিয়ে এসেছে। প্রখরা পূর্ণযৌবনা, অসমসাহসিকা।

নির্মল তার অসমসাহসিক কথাবার্তায় ভয় পেতো, অবাক হত আর বোধ করি আরও বেশী আকৃষ্ট হত। বকুল তখন ওকে ব্যঙ্গ-কৌতুকের ছুরিতে বিধতো। মাধুরী-বৌ সেই কৌতুকে হাসতো, কৌতুক বোধ করতো।

কেদার-বদরী ঘুরে এসে জেঠাইমা দেখলেন সংসারের যে জায়গাটি থেকে তিনি সরে গিয়েছিলেন, সে জায়গাটি যেন আর নেই। যেন কে কখন তার শূন্য সিংহাসনটা কোন দিকে ঠেলে সরিয়ে রেখে নিজেদের আসর বসিয়েছে। হয়তো এমনই হয় সংসারে।

কোনো শূন্য স্থানই শূন্য থাকে না।

সেখানে অন্য কিছু এসে দখল করে।

নির্মলের বৌ যেন জেঠশাশুড়ীর থেকে নিজের শাশুড়ীকেই প্রাধান্য দেয় বেশী, পুরনো ঝি চাকারগুলো পর্যন্ত যেন আর বড়মার ভয়ে তটস্থ হয় না। কেবলমাত্র নির্মলই ছিল আগের মূর্তিতে।

বড়মা এ দৃশ্য দর্শনে কোমর বেঁধে আবার নতুন করে লাগছিলেন, দুবাড়ির শ্ৰীক্ষেত্র ভাবটা দূর করতে চেষ্টিত হচ্ছিলেন, এই সময় মোতিহারিতে বদলি হয়ে গেল নির্মল।

মাধুরী-বৌ চলে গেল বরের সঙ্গে।

হয়তো সেটাই বকুলের প্রতি তার বিধাতার আশীর্বাদ। জেঠাইমা আবার নতুন করে কি কলঙ্ক তুলতেন বকুলের নামে কে জানে! কারণ একদিন বাড়ি বয়ে এসে ঝগড়া করে গেলেন তিনি। বললেন, এ যুগে আর জাত যায় না বলে কি মেয়ের বিয়ে দেবে না ঠাকুরপো? মেয়েকে বসিয়ে রাখবো?

প্ৰবোধচন্দ্র মাথা নীচু করে ছিলেন।

প্ৰবোধচন্দ্ৰ কিছু বলতে পারেননি। তারপর উনি চলে যাওয়ার পর সব ঝাল ঝেড়েছিলেন বকুলের উপর।

যাক ওসব কথা।

এখন আর ও নিয়ে ভাববার কিছু নেই। নির্মল তারপর অনেক দূরে চলে গেল।

মোতিহারীর মতো নয়, অনেক অনেক দূরে।

কিন্তু সে কবে?

বকুল তখন কোথায়?

তখন কি তার ওই বকুল নামের খোলসটার মধ্যেই আবৃত ছিল সে?

না, তখন আর বকুল নামের পরিচয়টুকুর মধ্যেই নিমগ্ন ছিল না সে। ছড়িয়ে পড়েছিল আর এক নতুন নামের স্বাক্ষরে। সেই নতুন নামটার ভেলায় চড়ে বেরিয়ে এসেছিল নালা থেকে নদীতে, ডোবা থেকে সমুদ্রে।

.

ক্রমশঃ সেই নতুন নামটাই পুরনো হয়ে গেছে, পরিচয়ের উপর শক্ত খোলসের মত এটে বসেছে। কিন্তু তখনো ততোটা বসেনি। তখন ওই নতুন নামটার ভেলাখানা যেন নিঃশব্দে ঘাটে এসে দাঁড়িয়েছে। ও যে বকুল নামের নেহাত তুচ্ছ প্ৰাণীটাকে নাম খ্যাতি পরিচিতির ঘাটে ঘাটে পৌঁছে দিয়ে যাবে, এমন কোনো প্ৰতিশ্রুতিও বহন করে আনেনি। বরং বেশ কিছু অপ্রীতিকর অথচ কৌতুকাবহ ঘটনাই ঘটিয়েছিল।

তার মধ্যে সর্বপ্ৰথম ঘটনা হচ্ছে সেই নামে একটা খামের চিঠি আসা।

চিঠিখানা পড়েছিল প্ৰবোধচন্দ্রের হাতে। কারণ প্ৰবোধচন্দ্র সর্বদাই বাইরের দিকের ঘরে সমাসীন থাকেন, রাত্রে ছাড়া দোতলায় ওঠেন না। সিড়ি ভাঙতে কষ্ট হয়। পথে বেরোনোও তো প্রায় বন্ধ।

রোগী সেজে-সেজেও আরো নিজের পথে নিজে কাঁটা দিয়ে রেখেছেন প্ৰবোধচন্দ্ৰ। ছেলেমেয়েয়া যদি কোনো সময় বলেছে, বাবা, সর্বদা আপনি এই একতলার চাপা ঘরখানায় বসে থাকেন, একটুখানি বাইরে বেড়িয়ে আসতেও তো পারেন–

প্ৰবোধচন্দ্ৰ ক্ষুব্ধ ভর্ৎসনায় তাদের ধিকৃত করেছেন, বেড়িয়ে? বেড়িয়ে আসবার ক্ষমতা থাকলে আমি সর্বদা এই কুয়োর ব্যাঙের মত এখানে পড়ে থাকতাম? …তোমরা বলবে তবে বেরবো এই অপেক্ষায়? আমার প্রাণ হাঁপায় না?…কী করবো, ভগবান যে সব ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে! তোমরা বিশ্বাস না করো, ভগবান জানছে আমার দেহের মধ্যে কী হচ্ছে! হাত-পা তুলতে কাঁপে, চোখে অন্ধকার দেখি,ইত্যাদি ইত্যাদি…

অতএব প্ৰবোধচন্দ্র ওই কুয়োর ব্যাঙের মতই মলিন শতরঞ্চি পাতা একখানা চৌকিতেই দেহভার অর্পণ করে বসে বসে হিসেব রাখেন, কে কখন বেরোয়, কে কখন ফেরে, গোয়ালা কতটা দুধ দিয়ে যায়, ধোবা ককুড়ি কাপড়ের মোটের লেনদেন করে, পিয়ন কার কার নামে কখানা চিঠি আনে।

চিঠিগুলি অবশ্য সব থেকে আকর্ষণীয়।

পিয়নের হাত থেকে সাগ্রহে প্রায় টেনে নিয়ে প্ৰবোধচন্দ্র সেগুলি বেশ কিছুক্ষণের জন্য নিজের কাছেই রাখেন, চাটু করে যার জিনিস তাকে ডেকে দিয়ে দেন না। এমন কি সে ব্যক্তি কোনো কারণে ঘরে এসে পড়লেও, তখনকার মত চাটু করে বালিশের তলায় গুঁজে রেখে দেন।

কেন?

তা প্ৰবোধচন্দ্র নিজেও বলতে পারবেন কিনা সন্দেহ। হয়তো তার সৃষ্টিকর্তা বললেও বলতে পারেন। তবে প্ৰবোধচন্দ্ৰ জানেন যে, চিঠি যার নামেই আসুক, পোস্টকার্ডগুলি পড়ে ফেলা তার কর্তব্য, এবং খামের চিঠির নাম ঠিকানার অংশটুকু বার বার পড়ে পড়ে আন্দাজ করে নেওয়া কার কাছ থেকে এসেছে। এটা তিনি রীতিমত দরকার মনে করে থাকেন।

বেশীর ভাগ চিঠিই অবশ্য বৌমাদের বাপের বাড়ি থেকে আসে, হাতের লেখাটা অনুমান করতে ভুরু কুঁচকে কুঁচকে বার বার দেখতে থাকেন প্ৰবোধচন্দ্র, এবং স্মরণ করতে থাকেন এই হস্তাক্ষরের চিঠি শেষ কবে এসেছিল।

তাড়াতাড়ির মধ্যে হলে মুখটা একটু বাঁকান, মনে মনে বলেন, উঃ, মেয়ের জন্যে মনকেমন উথলে উঠছে একেবারে! নিত্য চিঠি!–আর আমার আপনার লোকেরা? মেয়েরা? জামাইরা? পুত্তুরটি? দিল্লী দরবারে (ওই ব্যাখ্যাই করেন প্ৰবোধচন্দ্ৰ) অধিষ্ঠিত যিনি? কই বুড়ো বাপ বলে মাসে একখানা পোস্টকার্ড দিয়েও তো উদ্দিশ করেন না। তাঁরা? দুটো পয়সার তো মকদ্দমা!

এই চিঠিগুলো যেন ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে হয় প্রবোধের।

তবু পোস্টকার্ডগুলোর একটু মাদকতা আছে, পড়ে ফেলে তার অজানিত অনেক কিছু খবর জানা হয়ে যায়। প্রবাহিত সংসারের কোনো ঘটনা-তরঙ্গই তো কেউ প্ৰবোধচন্দ্রের কাছে এসে পৌঁছে দিয়ে যায় না। প্ৰবোধচন্দ্ৰ নিজেই হেঁই হেঁই করে জিজ্ঞেস করে করে যেটুকু সংগ্ৰহ করতে পারেন। এ তবু

না, পরের চিঠি পড়াকে কিছুমাত্র গৰ্হিত বলে মনে করেন না প্ৰবোধচন্দ্র। বাড়ির কর্তা হিসাবে ওটুকু তার ন্যায্য দাবি বলেই মনে করেন। তবু খামের চিঠি খুলতে সাহসে কুলোয় না। বার বার নেড়েচেড়ে, অনেকক্ষণ নিজের কাছে রেখে দিয়ে, অবশেষে যেন নাপায্যিমানেই দিয়ে দেন, কেউ ঘরে এলে তার হাত দিয়ে।

এই চিঠিখানা হাতে নিয়ে কিন্তু প্ৰবোধচন্দ্রের চক্ষু বিস্ফারিত হয়ে গেল। এ আবার কার নামের চিঠি।

খামের চিঠি, এ বাড়িরই ঠিকানা, অথচ মালিকের নামটা সম্পূর্ণ অজানা। তাছাড়া চিঠিটা প্ৰবোধচন্দ্রের কেয়ারে আসেনি। চিঠি যার জন্যেই আসুক-ঠিকানার জায়গায় জ্বলজ্বল অক্ষরে কেয়ার অব প্ৰবোধচন্দ্র মুখোঁপাধ্যায় তো লেখা থাকবেই।

যা রীতি!

যা সভ্যনীতি!

অথচ এ চিঠিতে সেই সুরীতি সুনীতি লঙ্ঘন করা হয়েছে। কর্তা প্ৰবোধচন্দ্রের কর্তৃত্বকে অস্বীকার করা হয়েছে।

অন্য বাড়ির চিঠি?

ভুলক্রমে এসেছে?

তাই বা বলা যায় কি করে?

এই তো স্পষ্ট পরিষ্কার অক্ষরে লেখা রয়েছে, তেরোর দুই রাজেন্দ্রলাল স্ট্রীট

তেরোর একটা হচ্ছে নির্মলদের, তেরোর দুইটা হচ্ছে প্ৰবোধচন্দ্ৰদের।

তাহলে? কে এই চিঠির অধিকারিণী? তবে কি বৌমাদের কারো পোশাকী নাম এটা? নাকি বড়বৌমার ওই যে বোনঝিটা কদিন এসে রয়েছে তারই?

কিন্তু সেই একটা বছর দশ-বারোর নোলোক-পরা মেয়ের নামে এমন খামেমোড়া চিঠি কে পাঠাবো?

দুর্দমনীয় কৌতূহলে খামের মুখটায় এক ফোঁটা জল দিয়ে টেবিলে রাখলেন প্ৰবোধচন্দ্ৰ, যাতে আঠটা ভিজে খুলে যায়।

কিন্তু অদৃষ্টের পরিহাসে ঠিক সেই মুহূর্তেই বকুল এসে ঘরে ঢুকলো বাপের দুধের গ্লাস হাতে।

থতমত খেয়ে চিঠিটা সরাতে ভুলে গেলেন প্ৰবোধচন্দ্র। আর এমনি কপালের ফের তার, তদণ্ডেই কিনা তার ওপর চোখ পড়লো ওই ধিঙ্গী মেয়ের! যাকে নাকি প্ৰবোধচন্দ্ৰ মনে মনে রীতিমত ভয় করে থাকেন! ভয় করার কারণ-টারণ স্পষ্ট নয়, তবু করেন ভয়! আর সেই ভয়ের বশেই-বকুল যখন তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চিঠিটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, চিঠিটায় জল পড়লো কি করে বাবা? বলে বসেছিলেন প্ৰবোধচন্দ্ৰ, জল নয়, ইয়ে ঘাম। টপ করে চিঠিটার ওপরই পড়লো, তাই হাওয়ায়—

ঘাম!

বকুল হতবাক দৃষ্টিতে বাপের দিকে তাকিয়েছিল। তারপর শীতের অগ্রদূত হেমন্তকালের ঝাপসা-ঝাপসা আকাশের দিকে তাকিয়েছিল, আর তারপর বকুলের মুখে ফুটে উঠেছিল একটুখানি অতি সূক্ষ্ম হাসি। যে হাসিটার বদলে এক ঘা বেত খেলেও যেন ভাল ছিল প্ৰবোধচন্দ্রের।

ওই, ওই জন্যেই ভয় ঢুকেছে।

আগে এই হাসিটি ছিল না হারামজাদির। কিছুদিন থেকে হয়েছে। দেখলে গা সিরসির করে ওঠে। মনে হয় যেন সামনের লোকের একেবারে মনের ভিতরটা পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে।

বকুল কিন্তু আর কিছু কথা বলেনি, শুধু বলেছিল, ঘাম!

তারপর হাত বাড়িয়ে চিঠিটা তুলে নিতে গিয়েছিল।

প্ৰবোধচন্দ্ৰ যেন একটা সুযোগ পেলেন, হাঁ-হাঁ করে উঠলেন, থাক থাক, পরের বাড়ির চিঠি, পিয়নব্যাটা ভুল করে দিয়ে গেছে।

কিন্তু ততক্ষণে তো তুলে নেওয়া হয়ে গেছে এবং উল্টে দেখাও হয়ে গেছে।

খামের উপর লেখা নামটার উপর চোখ দুটো স্থির হয়ে গিয়েছিল বকুলের, তারপর বলেছিল, ভুল করে নয়, এ বাড়িরই।

এ বাড়িরই!

প্ৰবোধ সেই সূক্ষ্ম হাসির ঝাল ঝাড়েন, বাড়িতে তাহলে আজকাল আমার অজানিতে বাড়তি লোকও বাস করছে?

বাড়তি কেউ নেই বাবা!

নেই! নেই তো এই শ্ৰীমতী অনামিকা দেবীটি কে শুনি?

বকুল মৃদু হেসে বলেছিল, আসলে কেউই নয়।

আসলে কেউই নয়! অথচ তার নামে চিঠি আসে! চমৎকার! তোমরা কি এবারে বাড়িতে রহস্যলহরী সিরিজ খুলছে? রাখো চিঠি! আমি জানতে চাই কে এই অনামিকা দেবী?

চিঠি অবশ্য রাখেনি বকুল।

আরো একবার মৃদু হাসির সঙ্গে বলেছিল, বললাম তো, আসলে কেউই নয়, ওটা একটা বানানো নাম

বানানো নাম! বানানো নাম মানে? প্ৰবোধচন্দ্ৰ যথারীতি হাঁপানির টান ভুলে টানটান হয়ে উঠে বলেছিলেন, বানানো নামে চিঠি আসে কী করে? তাহলে—প্রেমপত্র পাঠাবার ষড়যন্ত্র?

তা তাই মনে হয়েছিল তখন প্ৰবোধচন্দ্রের; কারণ স্পষ্ট বুঝতে পারছিলেন ওই বানানো নামটার সঙ্গে বকুল নামের মেয়েটার কোনো যোগসূত্র আছে। সঙ্গে সঙ্গেই তার সঙ্গে মোতিহারীর যোগসূত্র আবিষ্কার করে বসেছিলেন তিনি।

লক্ষ্মীছাড়া মেয়ে তাহলে এই কল ফেঁদেছে? বানানো নামে চিঠি আসবে, কেউ ধরতে পারবে না?…নির্ঘাত ওই চিঠির সন্ধানেই এসেছিল, দুধ আনাটা ছল!

রাগে ব্ৰহ্মাণ্ড জ্বলে গিয়েছিল প্ৰবোধচন্দ্রের। উঃ, সেই মিটমিটে পাজী চরিত্রহীন শয়তানটা এখনো আমার মেয়েটার মাথা খাচ্ছে! বিয়ে করেছিস, বিদেশ চলে গেছিস, তবু দুষ্প্রবৃত্তি যাচ্ছে না?…এনভেলাপে চিঠি লিখছিস? এতো আসপদ্দা যে, কেয়ার অবটা পর্যন্ত দেবার সৌজন্য নেই!

প্রবোধচন্দ্রের অভিভাবক-সত্তা গৃহকর্তা-সত্তা, দুটো একসঞগে চাড়া দিয়ে উঠেছিল।

প্ৰবোধচন্দ্ৰ ধমকে উঠেছিলেন, খোলো চিঠি, দেখতে চাই আমি।

দেখতে চান সে তো দেখতেই পাচ্ছি—, বকুল খামখানা আবার বাপের টেবিলেই ফেলে দিয়ে বলেছিল, জলে ভিজিয়ে আড়ালে খোলবার চেষ্টা না করে এই অনামিকা দেবীর চিঠি এলে আপনি খুলেই দেখবেন বাবা।

তারপর চলে গিয়েছিল ঘর থেকে।

বাপের অবস্থার দিকে আর তাকিয়ে দেখে যায়নি।

অথচ এই কিছুদিন আগেও বকুল বাপের মুখের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারতো না। হঠাৎ এই সাহসটা তাকে দিল কে? এই অনামিকা দেবী? যার নামে কোনো এক কাগজের সম্পাদক চিঠি পাঠিয়েছে, আপনার গল্পটি আমাদের মনোনীত হয়েছে। আগামী সংখ্যার জন্য আর একটি গল্প পাঠালে বাধিত হবো।

নাকি নির্মলের বিয়ে উপলক্ষ করে যে-বকুল উদঘাটিত হয়ে গিয়েছিল, সেই বকুল স্থির করেছিল পায়ের তলার মাটিটা কোথায় সেটা খুঁজে দেখতে হবে। হয়তো সেটা খুঁজেও পেয়েছিল বকুল। তাই বকুল তার খাতার একটা কোণায় কবে যেন লিখে রেখেছিল, ভয় করতে করতে এমন অদ্ভূত অভ্যাস হয়ে যায় যে, মনেই পড়ে না ভয় করার কোনো কারণ নেই। অভ্যাসটা ছাড়া দরকার।

আর মনের মধ্যে কোনখানে যে লিখেছিল, নির্মলকে সেজদি ধিক্কার দেয়, কিন্তু আমি ওকে ধন্যবাদই দিই। ওর কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। ও আমার নৌকোখানাকে দাঁড় বেয়ে খেয়া পার করে দিতে পারেনি বলেই না সেটা স্রোতের টানে সাগরে এসে পড়েছে।

তা এই সাগরটি উপমা মাত্র হলেও প্ৰবোধচন্দ্রের অনামিকা দেবী একটা বিস্ময়ের ঘটনা, বৈকি।

অনামিকা দেবীর নামের সেই চিঠিখানা প্ৰেমপত্র না হলেও, সেটা নিয়ে বাড়িতে কথা উঠেছিল কিছু। বকুলের বড়দা সেই না-দেখা সম্পাদকের উদ্দেশে মুচকি হেসে বলেছিল, শালুক চিনেছে গোপাল ঠাকুর!

বকুলের ছোড়দা যার ডাকনাম মানু-বকুল পারুল ওকেই ছোড়দা বলে। সুবল ছিল শুধু সুবল! সে তো এখন শুধু একটা নাম, দেয়ালের একটা ছবি। সে থাকলে হয়তো ইতিহাস একটু অন্যরকম হতো। তা সেই ছোড়দা হেসে বলেছিল, মেয়ে বলেই তাই লেখা ছেপে দিয়েছে!..শুনতে পাস না ইউনিভাসিটিতে পর্যন্ত গোবর মাথা মেয়েগুলোকে কি রকম পাস করিয়ে দিচ্ছে? ওই লেখা একটা বেটা ছেলের নাম দিয়ে পাঠালে, দেখতে স্রেফ ওয়েস্টপেপার বাস্কেটে চলে গেছে!

আর বকুলের বড়বৌদি অবাক-অবাক গলায় বলেছিল, নামডাক হবার জন্যেই তো লোকে বই লেখে বাবা, ইচ্ছে করে নাম বদলে লেখে, এ তো কখনো শুনিনি! লেখাটা যে তোমারই তা প্রমাণ হবে কী করে ভাই? এই আমিই যদি এখন বলি, আমিই অনামিকা দেবী?

বলো না, আপত্তি কি? বলে হেসে চলে গিয়েছিল বকুল।

বৌদি যে রীতিমত অবিশ্বাস করছে তা বকুল বুঝতে পেরেছিল।

ইতিপূর্বেও তার লেখা ছাপা হয়েছিল, কিন্তু সে খবরটা নিতান্তই বকুলের নিজের আর নির্মলের বাড়ির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, এ বাড়িতে ধাক্কা দেয়নি।

এবার ধাক্কা দিল বলেই ধাক্কা উঠলো।

আরও একটা ধাক্কার খবর পাঠিয়েছিল সেজদি পারুল।

লিখেছিল.এদিকে তো দিব্যি এক কাণ্ড বাধিয়ে বসেছিস। তোর গল্প নিয়ে তো এখানে পুরুষমহলে বেজায় সাড়া উঠেছে। নবীন ভারত পত্রিকাখানা এখানে খুব চালু কিনা।…তা ওনারা বলেছেন, নিরুপমা দেবী, অনুরূপ দেবী, প্রভাবতী দেবী এসব তো জানি, এই নতুন দেবীটি আবার কে? এ নির্ঘাত কোনো মহিলার ছদ্মনামে পুরুষ।…লেখার ধরন যে রকম বলিষ্ঠ—…অর্থাৎ বলিষ্ঠ হওয়াটা পুরুষেরই একচেটে!

তোর বুদ্ধিমান ভগ্নীপতিটি অবশ্য লেখিকার আসল পরিচয়টা কারো কাছে ফাস করে বসেননি, কিন্তু নিজে তো জানেন। তিনি বিষম অপমানের জ্বালায় জ্বলছেন। কেন জানিস? তিনি নাকি ওই গল্পের ভিলেন নায়কের মধ্যে নিজের ছায়া দেখতে পাচ্ছেন।

যত বোঝাচ্ছি, গল্পটার নাম যখন আয়না, তখন ওর মুখোমুখি হলে তো নিজের ছায়া দেখা যাবেই, কিন্তু নিজেকে কেন তুমি–তা কে শোনে এসব সুযুক্তির কথা। বলছেন, ওনার শালী নাকী ওনাকে অপমান করতেই এমন একখানা মর্মান্তিক চরিত্র সৃষ্টি করেছে। তখন হেসে বলতেই হলো, শালী তাহলে শালীর মতই ব্যবহার করেছে। দেখ, তোদের অমলবাবুর সামনে গ্ৰাম্য ভাষা ব্যবহার করেছি বলে ছিছি করিস নে। বাংলা ভাষা মেয়েদের সম্পর্কে যে কত উদাসীন তা প্রতি পদেই টের পাবি। মানে লিখতে যখন বসেছিস, লক্ষ্য পড়বেই…শালার সম্পর্কে সম্বন্ধী বড় কুটুম্ব দুএকটা কথা তবু আছে, কিন্তু শালী? বড় জোর শ্যালিকা! ছিঃ! কোনো গুণবাচক শব্দ খোঁজ, নেই, মেয়েদের জন্যে কিছু নেই। অতএব বলতে হবে মহিলা কবি মহিলা সাহিত্যিক, মহিলা ডাক্তার ইত্যাদি ইত্যাদি, দেখিস মিলিয়ে মিলিয়ে। কাজে কাজেই শালী ছাড়া উপায় কি? তা লোকটা বলে কিনা ঠিক বলেছি, যা সম্পর্ক তেমনি ব্যবহার করেছে তোমার বোন!

এ কথাও বললাম, তোমার ছায়াই বা দেখছো কেন? তুমি কি অত নিষ্ঠুর?

সে সাত্ত্বনায় কিছু হচ্ছে না।

১২. সান্ত্বনায় কিছু হয় না

হয় না। তেমন সান্ত্বনায় কিছু হয় না।

সেটা অনেক সময় টের পেয়েছেন অনামিকা দেবী। তার এই দীর্ঘকালের লেখিকা জীবনে অনেকবার কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে তাঁকে। তিনি নাকি তাঁর সব পরিচিত জনেদের মধ্যে থেকে বেছে বেছে কাউকে কাউকে অপদস্থ করতে তাঁর গল্পের নায়ক-নায়িকা সৃষ্টি করেছেন।

অবশ্য কাহিনীর মধ্যেকার মহৎ চরিত্রগুলি সম্পর্কে এ ধরনের দাবি কেউ করে না। হাস্যকর অথবা ক্ষুদ্রতা তুচ্ছতার মধ্যে নিমজ্জিত চরিত্রগুলিতেই নাকি অনামিকা দেবীর কুটিল প্রচেষ্টা দেখতে পায় পরিচিত জনেরা। তাই মুখ কালো করে বলে, এ তো আমাকে নিয়েই লেখা।…বলে, তোমার মনের মধ্যে এই সব ছিল তা জানতাম না। তা এতোটা অপদস্থ না করলেও পারতে।

তারা নিজেরা ধরতে না পারলেও বন্ধু-বান্ধবেরা নাকি চোখে আঙুল দিয়ে ধরিয়ে দেয়, এই দেখো তোমার অমুক দেবী এবার তোমাকে একহাত নিয়েছেন!

তা অমলবাবুর ক্ষেত্রেও নাকি ওই বন্ধুরাই জ্ঞানাঞ্জনশলাকার কাজ করেছিলেন।

বন্ধুর শলাকার পর তো আর কোন শলাকাই কাজ করে না। কাজেই সেজদির যুক্তি মাঠে মারা গেছে। আমায় নিয়ে লিখেছে ভেবে খাপপা হয়েছিলেন অমলবাবু!

আবার এমন অনুরোধও বার বার আসে-আমায় নিয়ে লেখো-

না লিখলে ভাবে অবহেলা করলো।

কিন্তু আসলে যে সত্যিকারের কোনো একজনকে নিয়ে কোনো একটা সত্যিকার চরিত্র সৃষ্টি করা যায় না, এ সত্যটা কেউ ভেবেও দেখে না।

হয়তো জানেই না!

জানে না অথবা মানে না যে ওটার নিয়ম অনেকটা বৃষ্টির মত।

পৃথিবীর মাটি থেকে ওঠা জলটাই আবার জল হয়ে পৃথিবীতে এসে পড়ে বটে, তবু দুটোই এক নয়। সে জলকে আগে বাষ্প হতে হয়, তারপর মেঘ হতে হয়, তবেই তার আবার বৃষ্টি হয়ে পড়ার লীলা।

তেমনি নিয়মেই প্রায় বহু চরিত্রের, আর বহু বৈচিত্র্যের সংস্পর্শে আসা অনুভূতির বাষ্পও মনের আকাশে উঠে জমা হয়ে থাকে চিন্তা হয়ে। তারপর কোনো এক সময় চরিত্রে রূপায়িত হয়ে কলমে এসে নামে।

কিন্তু এত কথা বোঝানো যায় কাকে? বুঝতে চায় কে? তার থেকে তো রাগ করা অনেক সোজা। অনেক সোজা ভুল বুঝে অভিমান করা।

যাকে নিয়ে লেখা হল না, সে-ও আহত। আর আয়নায় যে নিজেকে দেখতে পেলো সে-ও আহত। অতএব তারা দূরে সরতে থাকে।

অবশ্য এ সমস্যা কেবলমাত্র পরিচিত জন্যেদের নিয়ে।

যারা দূরের, তারা তো আবার ওই আয়নায় মুখ দেখতে পাওয়ার সূত্রেই কাছে এসে দাঁড়ায়। আনন্দের অভিব্যক্তি নিয়ে বলে, ইস, কী করে লিখেছেন! মনে হচ্ছে ঠিক আমাদের কথা!

অনামিকা দেবীও হাসেন।

বলেন, আপনাদের কথা ছাড়া আর কোথায় কথা পাবো বলুন? আমি তো আপনাদেরই একজন। আকাশ-পাতাল এক করে কথা খুঁজতে যাই এমন ক্ষমতা নেই আমার। আপনারাই যদি আমার ফসল তো, আপনারাই আমার সার। পাঠক পাঠিকাই আমার নায়ক নায়িকা।

কিন্তু অমলবাবুকে এসব কথা বোঝানো যায়নি। অমলবাবু তদবধি সেজদিকে আসতেই দেয়নি এ বাড়িতে।

আশ্চর্য অভিমান মানুষকে কী নির্বোধ করে তোলে! অথবা মানুষজাতটাই নির্বোধ!

বকুলের কথা লেখবার দায়িত্ব নিয়ে বকুলকে ভাবতে ভাবতে, বকুলের সঙ্গে কখন যেন একাত্মা হয়ে যান অনামিকা দেবী। ওই বানানো নামের খোলস খুলে পড়ে, আর সেদিন অনেকদিন আগে বকুল যে-কথা ভেবেছিল, সেই কথাই ভাবতে বসেন তিনি, সত্যি মানুষ কি নির্বোধ!

শুধু দুটো মাত্ৰ হাত দিয়ে শতদিক সামলাবার কী দুঃসহ প্ৰয়াস তার! শুধু দুটো মুঠোর মধ্যে সমন্ত পৃথিবীটাকে পুরে ফেলবার চেষ্টায় কী তার জীবন-পণ! কতো তাব দুশ্চিস্তা, কতো তার ষড়যন্ত্ৰ!

অথচ মুহূর্তে সে মুঠি আলগা করে ফেলে চলে যেতে হয় পৃথিবী ছেড়ে! হাত দুখানা সব কিছু সামলানোর দায়িত্ব থেকে কী সহজেই না মুক্তি পায়!

অমলবাবু তার চাকরিতে অধিক উন্নতি করবার জন্যে কী আপ্রাণ চেষ্টাই না করছিলেন, অমলবাবু তার স্ত্রীকে মুঠোর মধ্যে ভরে রাখতে কী দুঃসহ ক্লেশই না। স্বীকার করেছেন, স্ত্রীর শুধু দৈহিক মঙ্গলই নয়-ঐহিক, পারিত্রিক, নৈতিক, চারিত্রিক, সববিধ মঙ্গলের দায় নিয়ে ভদ্রলোক দিশেহারা হয়ে যেতেন, কিন্তু কতো কম নোটিশে চলে যেতে হল তাকে! কত অস্বস্তি বুকে নিয়ে!

সেজদি বলেছিল, দেখ বকুল, স্বৰ্গ জায়গাটা সত্যিই যদি কোথাও থাকে, আর সেখান থেকে এই মর্ত্যলোককে দেখতে পাওয়া যায়, তাহলে তো অবিশ্যিই আমায় দেখতে পাচ্ছে। বেচারা মরেও কী যমযন্ত্রণা পাচ্ছে তাই ভেবে দুঃখিত হচ্ছি।

বকুল বলতো, তোর মতো দজ্জাল বেপরোয়া স্ত্রীকে মনে রাখতে তার দায় পড়েছে।

সেজদি বলতো, দজ্জাল বেপরোয়াদেরই তো মনে রাখে মানুষ। দেখিস না-স্বয়ং ভগবান ও সাধুসজনদের মনে না রেখে, অহরহ জগাই-মাধাইকে মনে রাখেন, মনে রাখেন কংস, জরাসন্ধ, হিরণ্যকশিপুদের।…এই যে লোকটি আমায় চোখের আড়াল করতো না, সেও তো ওই আমি দজ্জাল আর বেপরোয়া বলেই। শিষ্ট শান্ত সাধ্বী নারী হলে কবে আমায় ভুলে মেরে দিয়ে ভাঁড়ার ঘরের এককোণে ফেলে রেখে দিতো।…তাই ভাবছি কী ছট্‌ফট করছে ও, যদি সত্যি দেখতে পায়।

কিন্তু নাঃ, দেখতে পাওয়া যায় না। মানুষ বড় অসহায়।

সৰ্ব্বস্ব নামিয়ে রেখে সর্বহারা হয়ে চলে যেতে হয় তাকে।

তারপর আর কিচ্ছু করার নেই।

করার থাকলে আজ প্ৰবোধচন্দ্রের পৌত্রী প্ৰবোধচন্দ্রের ভিটেয় বসেই প্ৰেম করাটাকে মস্ত একটা বাহাদুরি মনে করে মহোল্লাসে তার পিসির কাছে এসে বলতে পারে, পিসি, বললে তুমি বিশ্বাস করবে কিনা জানি না, আবার একটা নতুন শিকার জালে ফেলেছিা!

এই হতভাগা মেয়েটার সামনে কিছুতেই যে কেন গাম্ভীর্য বজায় রাখতে পারেন না অনামিকা দেবী! মেয়েটার প্রতি বিশেষ একটা স্নেহ আছে বলে? তা হলে তো স্নেহান্ধর দশা ঘটেছে বলতে হয়।

কিন্তু তাই কি?

না, ওর ওই লজ্জাহীনতার মধ্যে কোথায় যেন একটা অমলিন সততা আছে বলে? যে বস্তু ইহসংসারে প্রায় দুর্লভ। তবুও তিনি গাম্ভীর্ঘ বজায় রাখবার চেষ্টায় চোখ পাকিয়ে বলেন, নতুন শিকার জালে ফেলেছি মানে? ও আবার কী অসভ্য কথা?

শম্পা কিন্তু কিছুমাত্র না দমে জোর গলায় বলে ওঠে, হতে পারে অসভ্য, কিন্তু জগতের কোন সত্যি কথাটাই বা সভ্য পিসি? সভ্য মাত্রেই অ-সভ্য, মানে সংসাবী লোকেরা যাকে অসভ্য বলে!

তা সংসারে বাস করতে হলে সংসারী লোকের রীতিনীতির মাপকাঠিতেই চলতে হবে।

শম্পা চেয়ারে বসেছিল, এখন বেশ জোরে জোরে পা দোলাতে দোলাতে বলে, ও কথা আমার পরমারাধ্যা মাতৃদেবী বলতে পারেন, তোমার মুখে মানায় না।

অনামিকা দেবী চেষ্টাটা আরো জোরালো করতে বলেন, না মানাবার কী আছে? মা পিসি কি আলাদা? মা যা বলবে, পিসিও তাই বলবে।

শম্পা হঠাৎ তড়াক করে লাফিয়ে উঠে, দুই কোমরে হাত দিয়ে বলে ওঠে, এ কথা তোমার সত্যি মনের কথা?

এই সরাসরি আক্রমণে অনামিকা দেবী হেসে ফেলেন, মেয়েটার মাথায় একটা থাবড়া মেরে বলেন, এইখানটিতে আছে কেবল দুষ্টবুদ্ধির পাহাড়! কিন্তু ওই সব শিকার-টিকার কী ভালো কথা?

ভালোমন্দ জানি না বাবা, ওই কথাটাই বেশ লাগসই মনে হলো, তাই বললাম, একটা করে ধরি আর মেরে ছেড়ে দিই যখন, তখন শিকার ছাড়া আর কি!

আমি তোর গুরুজন কি না?

হাজার বার।

তবে? আমার সামনে এই সব বেহায়া কথা বলতে তোর লজ্জা করে না?

বলে অনামিকা দেবীও হঠাৎ অন্যমনস্ক ভাবে ওর মতই পা দোলাতে থাকেন।

শম্পা সেই দিকে একবার কটাক্ষপাত করে বলে, দেখো পিসি, লজ্জা-ফজ্জা বলে আমার কিছু নেই, একথা আমি বাবাকেও বলতে পারি, কিন্তু বলতে প্ৰবৃত্তি হয় না। কথাটার মানেই বুঝবে না। তুমি সাহিত্যিক, মনন্তত্ত্ব-টত্ত্ব বোঝ, তাই তোমাকে বলি। কই বড় মেজ সেজ পিসিকে তো বলতে যাই না!

তাদের পাচ্ছিস কোথায়?

আহা ইচ্ছে করলে তো পেতে পারি। একজন তো এই কলকাতা শহরেই বাস করছেন, আর দুজনও আশেপাশে। কথা তো তা নয়, আশা করি যে তুমি অন্ততঃ বুঝবে আমায়।

অনামিকা দেবী ওর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেন। ভাবেন, ও আমার ওপর এ বিশ্বাস রাখে আমি ওকে বুঝবো? যদিও এ সংসারে ওইটাই হচ্ছে সব চেয়ে শক্ত কাজ। কে কাকে বোঝে? কে কাকে বুঝতে চায়?

আমি ওকে বুঝতে চেষ্টা করি, ও সেটা বুঝতে পারে। তাই ও আমার কাছেই মনের কথা বলতে আসে। কিন্তু নিত্য নতুন এই প্রেমিকই বা ও জোটায় কোথা থেকে?

সেই প্রশ্নই করেন অনামিকা দেবী।

শম্পা একগাল হেসে বলে, ও ঠিক জুটে যায়। একসঙ্গে দুটো তিনটে এসেই ভিড় করে কত সময়, আর এ তো এখন আমার ভেকেন্সি চলছিল! তোমরা সেই যে বল না, রতনে রতন চেনে, সেই রকম আর কি!।

অনামিকা দেবী হেসে ফেলে বলেন, তা নতুন রতনটি বোধ হয় কারখানার কুটিটুলি হবে?

শম্পা ভুরু কুঁচকে বলে, হঠাৎ এ সন্দেহ করলে যে? শুনেছো বুঝি কিছু?

শুনতে যাবো কোথায়, অনুমান করছি। পছন্দর ক্রমোন্নতি দেখছি কিনা।

শম্পা আরো একগাল হেসে বলে, তোমার অনুমান সত্য। হবেই তো। লেখিকা যে! সত্যি, কারখানাতেই কাজ করে। এণ্টালিতে একটা লোহার যন্ত্রপাতির কারখানা আছে, তারই অ্যাসিসটেন্ট ফোরম্যান। বেশ একখানা কংক্রাট চেহারা, দিব্যি একটি বন্য-বর্বর বন্য-বর্বর ভাব আছে–

বন্য-বর্বর বন্য-বর্বর ভাব আছে!

বাঃ, অবাক হচ্ছ কেন? থাকে না কারো কারো?

অনামিকা দেবী হতাশ গলায় বলেন, থাকতে পারে, কিন্তু—

কিন্তুর কিছু নেই পিসি। পুরুষমানুষের পক্ষে ওটাই তো সৌন্দর্য। দেখলে মনে হয় রেগে গেলে দুঘা মেরেও দিতে পারবে। নিদেনপক্ষে বাসন ভাঙবে বিছানা ছিড়বে, বইপত্তরকে ফুটবল করে স্যুট করবে, হয়তো আমাকেও–।

চমৎকার! শুনে মোহিত হয়ে যাচ্ছি! এ নিধিটিকে পেলে কোথায়?

সে এক নাটক, বুঝলে পিসি শম্পা চেয়ারের মধ্যে নড়েচড়ে বসে, তাহলে শোনো বুলি—বেগবাগানের ওই মোড়টায় বাস চেঞ্জ করতে নেমেছি, দেখি ওটাও এসে কাছাকাছি দাঁড়ালো। কালিঝুলি মাখা নীল প্যান্ট আর খাকি শার্ট পরা, মাথার চুল স্রেফ কদমছাট, মুখটা নিগ্রো প্যাটার্নের, বেঁটেখাটো মুণ্ডবা-মুগুর গড়ন, রংটা ছাতার কাপড়ের কাছাকাছি। ভারী ইণ্টারেস্টিং লাগলো। অনিমেষ নয়নে তাকিয়েই থাকলাম যতক্ষণ না বাস এলো। আর দেখি না আমার ওই তাকানো দেখে সে পাজীটাও ড্যাবড্যাব করে তাকাতে শুরু করেছে। ওমা তারপর কিনা একই বাসে উঠলো! বোঝ ফন্দী। উঠে একেবারে কাছে দাঁড়িয়ে বলে কিনা, অমন ভাবে তাকাচ্ছিলেন যে? চিড়িয়াখানার জন্তু দেখছিলেন নাকি?…শুনে মনটা যেন আহ্লাদে লাফিয়ে উঠলো। গলার আওয়াজ কী! যেন সত্যি চিড়িয়াখানার বন্দী বাঘের হুঙ্কার! ওই একটি কথা শুনেই মনে হলো এমন একখানা প্রাণীকে লটকে সুখ আছে।…ব্যস, চেষ্টায় লেগে গেলাম!

চেষ্টায় লেগে গেলাম!

অনামিকা দেবী ওর মুখের দিকে তাকান। ছলা-কলার মুখ নয়, নির্ভেজাল মুখ অথচ অবলীলায় কী না বলে চলেছে! এযাবৎকাল ওর চুলগুলো খাটো করে ছাঁটা ছিল, কিন্তু সম্প্রতি সেই চুল দিয়েই, কোন অলৌকিক উপায়ে কে জানে, মাথার মাঝখানে চুড়ো করে খোঁপা বেঁধেছে, আর সেই খোঁপাটার জন্যে ওর চেহারাটা একদম বদলে গেছে।

ওকে যেন একটা অহঙ্কারী মেয়ের মতো দেখতে লাগছে।

অনামিকা দেবীর হঠাৎ তার মায়ের মুখটা মনে পড়ে গেল।

অনেক চুল ছিল মার। আর গরমের দুপুরে যখন চুড়ো করে মাথার ওপর বেঁধে রাখতেন, অনেকটা এই রকম দেখাতো। অহঙ্কারী-অহঙ্কারী।

শম্পার মুখে অনামিকা দেবীর মায়ের মুখের আদল আছে। অথচ শম্পার বাবার মুখে তার ছায়ামাত্র নেই। আর শম্পার মা তো সম্পূৰ্ণ আলাদা এক পরিবারের মেয়ে। প্রকৃতির এ এক আশ্চর্য রহস্য! সে যে কতো রহস্যের সিন্দুক আগলে বসে নিঃশব্দে আপন কাজ চালিয়ে যায়! হঠাৎ আবার মায়ের মুখের আদল দেখে কি নতুন করে ওকে ভালো লাগলো অনামিকা দেবীর? আর ওকে এই অহেতুক প্রশ্রয় দেবার ওটাও একটা কারণ?

মায়ের মতো মুখ!

মাকে ভাবলেই মার জন্যে ভয়ানক একটা কষ্ট হয় অনামিকা দেবীর।

এখনো হলো।

মনে পড়লো বহির্জগতের জন্যে কী আকুতি ছিল মার! কী আকুলতা ছিল একটু আলোর জগতের টিকিটের জন্যে!

অথচ এরা–

সিগারেটের সেই প্ৰসিদ্ধ বিজ্ঞাপনটিার কথা মনে পড়লো অনামিকা দেবীর.. আপনি জানেন না আপনি কী হারাইতেছেন।

এরা জানে না। এরা কী পাইতেছে।

এদের হাতে যথেচ্ছ বিহারের ছাড়পত্র, এদের হাতে সব দরজার চাবি, সব জগতের টিকিট। এরা ভাবতেও পারে না, সুবৰ্ণলতা কতো শক্ত দেওয়ালের মধ্যে আটকা থেকেছে আর বকুলকে কতো দেওয়াল ভাঙতে হয়েছে, কতো ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে দিয়ে।

এদের কোনোদিন সে পরীক্ষা দিতে হয়নি।…মহাকাল এগিয়ে চলেছে আপনি নিয়মে, সমন্ত প্রতিকূল চিত্র সে প্রবাহে ভাসতে ভাসতে আপনিই অনুকূল হয়ে যাচ্ছে।

বকুলের যে বড়দা তার ছোট বোনকে একবার পাড়ার ছেলের মুখোমুখি দাঁড়াতে দেখলে সৃষ্টি রসাতলে যাচ্ছে ভেবে রাগে দিশেহারা হতেন, সেই দাদার ছেলে আঠারো বছরের মেয়েকে তার বয়-ফ্রেণ্ডদের সঙ্গে পিকনিক করতে ছেড়ে দেয় দীঘায়, পুরীতে, রাঁচিতে, কোলাঘাটে, নেতারহাটে।

সেই মেয়েটা অনামিকা দেবীর নাতনী সম্পর্ক হল না? তা তারই তো উচিত ছিল অনামিকা দেবীর কাছে এসে হেসে হেসে তার বয়-ফ্রেণ্ডদের গল্প করা।

কিন্তু তা সে করে না।

সে মেয়েটা এদিকও মাড়ায় না।

তার মাতৃদেবী আপন পরিমণ্ডলে আত্মস্থ, তুচ্ছ লেখিকা-টেখিকাকে সে ধর্তব্যের মধ্যে আনে না। তার পিতৃকুলের দিকে-দিগন্তে সকলেই পদস্থ ব্যক্তি, সরকারের উচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত। সেই সমাজটাকেই সে বোঝে ভালো, সেই সমাজের উপযুক্ত করে মানুষ করে তুলছে সে মেয়েকে। মেয়েকে নাচিয়ে মেয়ে করে তুলতে অনেক কাঠখড় পুড়োচ্ছে।

সাহিত্য-টাহিত্য ওদের কাছে একটা অবান্তৱ বস্তু।

সেই মেয়েটা, যার ভালো নাম নাকি সত্যভামা, আর ডাকনাম কৃষ্ণা (মহাভারতের নামগুলিই তো এযুগে লেটেস্ট ফ্যাশান। আর চট করে বোঝাও যায় না বাঙালী কি অবাঙালী), সে যখন গায়ে টানটান শালোয়ার কামিজ চাপিয়ে আর পুরু করে পেণ্ট করা লালচে-লালচে মুখে মোমপালিশ লাগিয়ে হি হি করতে করতে তার একপাল বয়ফ্রেণ্ডের সঙ্গে বেড়াতে বেরিয়ে যায়, তখন সে দৃশ্য চোখে পড়লে অনামিকা দেবীর অজ্ঞাতসারেই তাঁর বড়দার মুখটা মনে পড়ে যায়।

সেই বাড়ি, সদর দরজাটাও একই আছে। যে দরজার সামনে ভীম মনোভাব নিয়ে পাহারা দিতো বড়দা, আর বকুল পাশের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে ফিরলেই চাপা গৰ্জনে প্রশ্ন করতো, কোথায় গিয়েছিলি?

পাশের ওই বাড়িটা ছাড়া যে বকুলের যাবার আর কোনো জায়গা ছিল না, সে কথা জানা সত্ত্বেও বকুলের বড়দা ওই বৃথা প্রশ্নটাই করতেন।

সত্যভামার মা, অলকাদের সেই বড়দার অনেক যত্নে খুঁজে আনা বৌমাটি কি ওই সেকেলে শ্বশুরটিকে উচিত জবাব দেবার জন্যেই ছোট্ট থেকে মেয়েকে হাতিয়ার বানিয়েছেন!

এখন অবশ্য বড়দা মরে বেঁচেছেন। কিন্তু ওই সযত্নে শান দেওয়া হাতিয়ারটি আবার তার নিজের মা-বাপের জন্যেই আরো শাণিত হচ্ছে কিনা কে জানে! সংসারের নিয়মই তো তাই!

সত্যভামা আর শম্পার বয়সের পার্থক্য সামান্যই, এক বাড়িতেই বাস, তবু ওদের মধ্যে ভাব নেই। শম্পা সত্যভামাকে কৃপার দৃষ্টিতে দেখে, সত্যভামা শম্পাকে কৃপার দৃষ্টিতে দেখে।

শম্পার একমাত্র প্রিয় বান্ধবী পিসি।

তাই শম্পা অবলীলায় বলে বসতে পারে, চেষ্টায় লেগে গেলাম!

অনামিকার কড়া গলাকে অবশ্য শম্পা গ্রাহ্য করে না, তবু অনামিকা কড়া গলায় বলে ওঠেন, চেষ্টায় লেগে গেলাম মানে?

এই সেরেছে, তোমায় আবার মানে বোঝাবো কি? কী না জানো তুমি! আর কী না লেখো! চেষ্টায় লেগে গেলাম মানে-কটমট করে তাকিয়ে বললাম, সাহস থাকে তো একসঙ্গে নেমে পড়ুন, জবাব দিচ্ছি!.ব্যস, যেই আমি নেমে পড়লাম, অমনি সেও দুম করে নেমে পড়লো!

নেমে পড়লো?

পড়বে না? শম্পা একটু বিজয়-গৌরবের হাসি হেসে বলে, অলরেডি তো জালে পা আটকে গেছে ততক্ষণে! রাস্তায় নেমে আমি প্রথম বললাম, আপনার কথার জবাব হচ্ছে, চিড়িয়াখানার জীবকে খোলা রাস্তায় ছাড়া দেখলে তাকাবেই মানুষ। কিন্তু আপনি ড্যাবডেবিয়ে তাকাচ্ছিলেন কী করতে শুনি? পাজীটা বললো কিনা, আপনাদের মতো উদ্ভট সাজ করা হাস্যকর জীবদের দেখলেও তাকাবেই মানুষ…তারপর এইরকম কথাবার্তা হলো-আমি বললাম, জানেন এতে আমি অপমানিত বোধ করছি!

ও বললে, তার মানে আপনাদের গায়ের চামড়া আঙুরের খোসার মতো! সত্যি কথা শুনলেই ফোঁসকা পড়ে!

আমি-—জানেন আপনার এই স্পর্ধাজনক উক্তি যদি রাস্তার লোককে ডেকে বলে দিই তো যে যেখানে আছে একযোগে আপনার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে গায়ের ছাল ছাড়িয়ে নেবে!

তা জানি। আর সেইখানেই তো আপনাদের বুকের বল! জানেন দোষ যে পক্ষই করুক, কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে এই পুরুষ জাতটাকেই!

করা হয় তো কুলিগিরি, এতো লম্বা লম্বা কথা শেখা হলো কোথা থেকে?

কড়া গলায় ও বললে, আপনাদের মতো মেয়েদের দেখে দেখে।

বললাম, এতো দেখলেন কোথা থেকে?

বললে, চোখ থাকলেই দেখা যায়। কেউ তো আর হারেমে বাস করে না! তারপর সে অনেক কথা। মোট কথা, শেষ অবধি ভাব হয়ে গেল।… একসঙ্গে চা খেলাম।–আর সেই অবধি–

শম্পা একটু হেসে চুপ করে।

তার সঙ্গেই তা হলে ঘুরে বেড়াচ্ছিস এখন?

ঘুরে ঠিক নয়। সময় কোথায় তার? কারখানার কাজ, ওভারটাইম খাটে, ওই মাঝে মাঝে ঘুরি। কালিকুলিমাখা জামা পরেই হয়তো কোনো পার্কে-টার্কে এসে বসে পড়ে।

খুব ভাল লাগে, কেমন? বিশেষ করে চেহারার যা বর্ণনা শুনলাম!

শম্পা এবার গম্ভীর হয়।

বলে, চেহারায় কী এসে যায় পিসি! মানুষটা কেমন সেটাই দেখবার বিষয়। এদেশে একসময় পুরুষের চেহারার আদর্শ ছিল কার্তিক ঠাকুর, আর তার সাজ-সজ্জার আদর্শ ছিল লম্বা-কেঁচা ফুলবাবুটি। এখন বরদাস্ত করতে পারো সে চেহারা? মনের সঙ্গে সঙ্গে চোখের পছন্দও বদলাবে বৈকি।

অনামিকা দেবী হেসে ফেলে বলেন, তা এখন তো ওই বন্য-বন্য বর্বরে-বর্বরে এসে ঠেকেছে! এর পর? পুরো অরণ্যের প্রাণী?

শম্পা উদাস উদাস গলায় বলে, সেটাও অসম্ভব নয়। মানুষ জাতটা দিন দিন যে রকম ভেজাল হয়ে যাচ্ছে!

টেলিফোনটা বেজে উঠলো।

সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠলো শম্পা, নির্ঘাত সে।

রিসিভারের মুখটা হাত দিয়ে ঢেকে অনামিকা চাপা গলায় বলেন, তোকে না বলেছিলাম, তোর ওই বন্ধুদের আমার ফোন নম্বর দিবি না?

বলেছিলে, মানছি সে-কথা। কিন্তু না দিলে ওদের কী গতি হবে সেটা বলো!

কিন্তু ফোন ধরেই হতাশ হয়ে পড়ে শম্পা, সে নয়।

অনামিকা দেবী ততক্ষণে কথা শুরু করে দিয়েছেন, দেখা করতে চান? কারণটা বলুন? লেখা না সভা? দুটোতেই কিন্তু আপাততঃ অপারগ। …কী বললেন? আমাকে সম্বর্ধনা দিতে চান? কী সর্বনাশ! কেন? হঠাৎ কী অপরাধ করে বসলাম? …পাগল হয়েছেন? না না, ও সব ছেলেমানুষী ছাড়ুন।…দেশ চায়? কেন আমার তো এখনো আশী বছর বয়েস হয়নি। আশীর আগে ওসব করতে নেই।… তবু দেখা করতে আসবেন?…দেখুন, আমার বাড়ি আসবেন না এটা বলা শক্ত, কিন্তু এসে কি করবেন? ওসব সঙ সাজ-টাজা আমার দ্বারা হবে না …তা হোক, তবু আসবেন?.. ঠিক আছে, আসুন, তবে কার্ড-ফার্ড ছেপে বসলে কিন্তু তার দায়িত্ব আপনাদের …কী বললেন? নাকতলা শিল্পী সংস্থা?…আচ্ছা ধন্যবাদ।

নামিয়ে রাখলেন।

ক্লান্ত-কান্তু দেখালো তাকে।

এই আবার চলবে খানিক ধন্তাধস্তি, নিতান্ত অভদ্র না হওয়া পর্যন্ত ওদের হাত এড়ানো যাবে না।… কারণ ওই সম্বর্ধনার অন্তরালে অভিসন্ধি নামক যে জন্তুটি অবস্থান করছে, সে তার মুখের গ্রাসটি কি সহজে ছাড়তে রাজী হবে?

দেশ অনামিকা দেবীকে সম্বর্ধনায় ভূষিত করতে চায় বলেই নাকতলা শিল্পী সংস্থা দেশবাসীর মুখপাত্র হয়ে সেই গুরু দায়িত্ব মাথায় তুলে নিতে চাইছে, এমন কথা বিশ্বাস করার মতো ছেলেমানুষ অবশ্যই আর নেই অনামিকা দেবী। তবু যেটুকু দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, সেইটুকু বিশ্বাস করবার ভানই ভালো। সব সত্য উদঘাটিত না করাই বুদ্ধির কাজ। শম্পার নিয়মে সংসারে বাস করা চলে না।

শম্পা বললে, কী গো পিসি, তোমায় সম্বর্ধনা দিতে চায়?

সেই রকম বাসনাই তো জানাচ্ছে। হ্যাঁ, মনে হয় মরবার আগেই শ্রাদ্ধের মন্ত্র পাঠ করে শেষকৃত্য করে দিচ্ছে।

অথচ বেড়েই চলেছে ব্যাপারটা। রোজই তো শুনি এর সম্বর্ধনা তার সম্বর্ধনা।

বাড়বেই তো। দেশকে যে ফাংশানের নেশায় পেয়ে বসেছে। এ নেশা কাটাতে পারে এমন আর কোনো নতুন নেশা না আসা পর্যন্ত চলবে। উত্তরোত্তর বাড়বে।

মুখে বলবেন ওইটুকু, মনে মনে বলবেন, শুধু তো নেশাই নয়, ওই ফাংশানের পিছনে যে অনেক মধুও থাকে। নেশাটা সেই মধুরই। দেশের লোকের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করা, সরকারের ঘর থেকে এড বার করা, নিদেনপক্ষে নিজেকে পাদপ্রদীপের সামনে তুলে ধরা, সব কিছুর মাধ্যমেই তো ওই ফাংশান। যখন যে উপলক্ষটা পাওয়া যায়।.

আশ্চর্য আগে কী মূল্যবানই মনে হতে এই সব জিনিসগুলো! প্রথম প্রথম যখন তেরোরদুই রাজেন্দ্রলাল স্ট্রীটের চৌকাট পার হয়ে বাইরের পৃথিবীর আসরে গিয়ে বসেছেন অনামিকা দেবী, যখন ওই অভিসন্ধি নামের লুকনো জন্তুটার গোঁফের ডগাটি দেখে চিনে ফেলবার মতো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি লাভ হয়নি, তখন সব কিছুই কী ভালোই লাগতো। ভাল ভাল কথাগুলো যে কেবলমাত্র কথা একথা বুঝতে বেশ কিছুদিন লেগেছে তার।

তাই বলে কি খাঁটি মানুষ দেখেননি অনামিকা দেবী? ছিছি, একথা বললে পাপ হবে।

উদার দেবোপম চরিত্র সেই মানুষটিকে কি আজও প্রতিদিন প্রণতি জানান না অনামিকা দেবী? যে মানুষটি বকুল নামের মেয়েটাকে হাত ধরে খোলা আকাশের নীচে ডেকে এনেছিলেন, যে মানুষটির স্নেহ অনামিকার একটি পরম সঞ্চয়?

সেই খোলা গলার উদাত্ত স্বর এখনো কানে বাজে, বাবা আপত্তি করবেন? রাগ করবেন? করেন তো চারটি ভাত বেশী করে খাবেন। তুমি আমার সঙ্গে চলো তো। দেখি তোমায় কে কী বলে!..কী আশ্চর্য! অন্যায় কাজ নয়, অন্যের অনিষ্টকর কাজ নয়, কবিকে দেখতে যাবে। এতে এতো ভয়? কতো লোক যাচ্ছে, সমন্ত পৃথিবীর মানুষ আসছে। অথচ দেশের মধ্যে থেকে দেখবে না? দেব-দর্শনে যায় না লোকে? তীর্থস্থানে যায় না? মনে করো তাই যাচ্ছ। আর তাই-ই তো বোলপুর শান্তিনিকেতন আজ ভারতবর্ষের একটি তীর্থ। তাছাড়া তুমি এখন লেখিকা-টেখিকা হচ্ছ, তোমাদের কাছে তো বটেই।

ভরাট উদার সেই গলার স্বর যেন ভয়ের খোলসগুলো খুলে খুলে দিয়েছে।

তবুও কম বাধা কি ঠেলতে হয়েছিল?

প্ৰবোধচন্দ্রের চার দেয়ালের মধ্যে থেকে বেরিয়ে প্ৰবোধচন্দ্রের বয়স্থা কুমারী মেয়ে এক নিতান্ত দূর-আত্মীয় পুরুষের সঙ্গে একা বেড়াতে গিয়ে দুরাত বাড়ির বাইরে কাটিয়ে আসবে, এর থেকে অনিয়ম পৃথিবীতে আর আছে কিনা, সেটা তো প্ৰবোধচন্দ্রের জানা ছিল না, জানতে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছিল তাঁকে, অনেক বাধার সৃষ্টি করতে হয়েছিল।

তবু বেরিয়ে পড়তে পেরেছিল প্ৰবোধচন্দ্রের বয়স্থ কুমারী মেয়ে। একবার স্ত্রীর তীর্থযাত্ৰা রোধ করতে যে কৌশল গ্রহণ করেছিলেন, সে কৌশল করতে সাহস হয়নি প্ৰবোধচন্দ্রের।

হ্যাঁ, বকুলের মা সুবৰ্ণলতা একদা সঙ্গিনী যোগাড় করে কেদারবন্দরীর পথে পা বাড়িয়েছিলেন, প্ৰবোধচন্দ্ৰ সেই বাড়ানো পা-কে ঘরে ফিরিয়ে এনেছিলেন কেবলমাত্র সামান্য একটু কৌশলের জোরে। কিন্তু সে কৌশল এখন আর প্রয়োগ করা চলে না। এখন আর সাহস হয় না একসঙ্গে অনেক বেশী মাত্রায় জোলাপ খেয়ে নাড়ি ছাড়িয়ে ফেলতে। এখন ভয় হয় সেই চলে যাওয়া নাড়ি আর যদি ফিরে না আসে!

অতএব শেষ পর্যন্ত এ সংসারে সেই ভয়ঙ্কর অনিয়মটা ঘটেছিল। তখনো বকুলের বড়দাদার ছেলে স্কুলের গণ্ডি পার হয় নি, আর বাকি সবই তো কুচোকাচার দল।

তখন এ বাড়িতে আসামী শুধু বকুল নামের মেয়েটা।

বড়দা তাই বাবাকে প্রশ্ন করেছিল, বাড়িতে তা হলে এই সব স্বেচ্ছাচার চলবে?

প্ৰবোধচন্দ্ৰ কোঁচার খুঁটে চোখ মুছে বলেছিলেন, আমি কে? আমি তো এখন মনিষ্যির বার হয়ে গেছি! তোমরা বড় হয়েছে।–

আমরা আমাদের নিজেদের ঘর শাসন করতে পারি, আপনার ধিঙ্গী মেয়েকে শাসন করতে যাবো কিসের জোরে? তায় আবার তিনি লেখিকা হয়েছেন, পৃষ্ঠবল বেড়েছে!

তবু এসেছিলো শাসন করতে। বড়দা নয়, যে মেজদা সাতে পাঁচে থাকে না, সে।

বলেছিল, বাবার উঁচু  মাথাটা এইভাবে হেঁট না করলে হতো না?

বকুল ওর মেজদার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলেছিল, বাবার এতে মাথা হেঁট হবে, একথা আমি মনে করি না মেজদা। অনেকে তো এমন যায়।

ও মনে কর, না? অনেকে এমন যায়! চমৎকার! তা হলে আর বলার কি আছে? কিন্তু সুবিধের খাতিরে এটাও বোধ হয় ভুলে যাচ্ছে, সকলের বাড়ি সমান নয়। এ বাড়ির রীতিনীতিতে–

বকুলের মুখে একটু হাসি ফুটে উঠেছিল।

বকুল সেই হাসিটা সমেতই বলেছিল, সুবিধের খাতিরে অনেকে তো অনেক কিছুই ভুলে যায় মেজদা। একদা এ বাড়িতে গৌরীদানের রীতিও ছিল, এখন কুমারী মেয়ের বয়স পঁচিশে গিয়ে ঠেকলেও অনিয়ম মনে হচ্ছে না। এটাই কি মনে থাকছে সব সময়?

তার মানে বকুল তার এই পঁচিশ বছরের কুমারীত্বের কথা তুলে দাদাকে খোঁটা দিয়েছিল। তার মানে এটা যে বকুলের জেদে ঘটেনি সেটাই বোঝাল বকুল।

ওঃ তাই! মেজদা একটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলেছিল, যথাসময়ে বিয়ে দেওয়া হয়নি বলে যথেচ্ছাচারের ছাড়পত্র পেয়ে গেছ, সেটা খেয়াল হয়নি! তবে বিয়ের চেষ্টাটা বাবা থাকতে আমাদেব করার কথা নয়। বাবা না থাকলে অবশ্যই–

এবার বকুল জোরে হেসে উঠেছিল। বলেছিল, দোহাই মেজদা, তোমরা আমার বিয়ে দাওনি বলে ক্ষেপে উঠে যথেচ্ছাচার করতে চাইছি, এতোটা ভেবো না লক্ষ্মীটি! ওই বিয়েটা না হওয়া আমার পক্ষে পরম আশীর্বাদ। সনৎকাকা আগ্রহ করে বললেন, তাই সাহস। জীবনের এ স্বপ্ন যে কখনো সফল হবে, তা কোনো দিন ভাবিনি। যদি তোমাদের বাড়ির একটা মেয়ের জীবনে এমন অঘটন ঘটে——

১৩. ঘটেছিল সেই অঘটন

তা শেষ পর্যন্ত ঘটেছিল সেই অঘটন।

সনৎকাকার সঙ্গে বোলপুরের পথে পা বাড়িয়েছিল বকুল।

জীবনের প্রথম বিস্ময়!

সে কী আশ্চর্য স্বাদ! .

সে কী অভাবিত রোমাঞ্চ!

আকাশে কতো আলো আছে, বাতাসে কতো গান আছে, জগতে কতো আনন্দ আছে, সে কথা আগে কবে জেনেছিল বকুল?

কিন্তু বকুল কি সেই জ্যোতির্ময় পুরুষের কাছাকাছি পৌঁছেছিল? তার পায়ে হাত রেখে প্ৰণাম করেছিল? তাকে বলতে পেরেছিল আমার জীবন ধন্য হলো?

পাগল!

বকুল অনেকের ভিড়ে অনেক পিছনে বসেছিল, শুধু অন্যকে বলা কথা শুনেছিল। অথবা কথাও শোনেনি। বকুল শুধু এক রূপময় শব্দময় আলোকময় জগতের দরজায় দাঁড়িয়েছিল–সমন্ত চেতনা লুপ্ত করে।

পৌষ মেলা দেখতে মেলার মাঠে নিয়ে গিয়েছিলেন সনৎকাকা।

বাধ্য হয়েই ওঁর সঙ্গে যেতে হয়েছিল বকুলকে। কিন্তু বকুলের মনে হয়েছিল কী অর্থহীন এই ঘোরা! কী লাভ ওই মাটির কুঁজো, কাঠের বারকোশ, রঙিন কুলো, মেটে পাথরের বাসন, লোহার কড়া, চাটু আর নাগরদোলা দেখায়। অবশ্য শুধু ওই নয়, মেলায় আরো অনেক আকর্ষণ ছিল, লোকেরা তো ওই মেলার মাঠেই পড়ে থাকছিল, এবং তাদের মুখ দেখে আদৌ মনে হচ্ছিল না কোনো অর্থহীন কাজ করছে। শুধু বকুলেরই মনে হচ্ছিল, অনন্তকাল সেই দেবমন্দিরের দরজায় বসে থাকলেই বা কী ক্ষতি? জীবনে কি আর কখনো এ সৌভাগ্য হবে?

হয়ওনি। কতো-কতোগুলো দিন গিয়েছিল তারপর।

তারপর তো দেবতা বিদায় নিয়েছিলেন।

সনতকাকা এসে বলেছিলেন, যাই ভাগ্যিস সেদিন বাপের ভয়ে আটকে বসে থাকনি, তাই না–

কিন্তু বকুলদের সংসারে বকুলের সনৎকাকার পরিচয় কি?

মাসিক পত্রিকার সম্পাদক?

প্রেসের মালিক?

পুস্তুষ্ক প্রকাশক?

আসলে তো এইগুলোই পরিচয়ের সূত্র।

তবু আরো একটা টিকিট ছিল, যার জোরে সনৎকাকার এ বাড়িতে প্রবেশাধিকার প্ৰবোধচন্দ্রের খুব দূর-সম্পর্কের মামাতো ভাই উনি। নইলে শুধু কাগজের সম্পাদক অথবা পুস্তক প্রকাশক হলে কে ডিঙোতে দিতো এ চৌকাঠ? আর কে গলাধঃকরণ করতো সেকথা–মেয়েটি যে আপনার রত্ন প্ৰবোধদা! একে আপনি বাড়ি বসিয়ে রেখেছেন? কলেজে-টলেজে পাঠালে–

কিন্তু শুধুই কি সম্পর্ক?

চরিত্র নয়?

যার জোরে জোর গলায় বলতে পারে মানুষ, আমার সঙ্গে যাবে, তবে আবার এতো চিন্তা কী?

.

অনেকটা সময় পার হয়ে গিয়েছিল বোধ হয়, হঠাৎ শম্পার প্রশ্নে যেন অন্য জগৎ থেকে ছিটকে সরে এলেন অনামিকা দেবী।

শম্পা প্রশ্ন করছে, তোমার সেই সনাতনী বাবার মেয়ে হয়েও চিরকুমারী থেকে গেলে কী করে বল তো পিসি? যা সব গল্প শুনি তোমার বাবা বুড়োর!..হতাশ প্ৰেম-ট্রেম নয় তো?

তোর বড্ডো বাড় বেড়েছে শম্পা-

আহা বাড়বৃদ্ধিই তো ভালো পিসি! বল না তোমার ঘটনা-টটনা—

তোর মত রাতদিন ঘটনা ঘটাতাম, এই বুঝি মনে হয় তোর আমায় দেখে?

মনে অবশ্যি হয় না, তবে চিরকুমারী থাকাটার কারণটাও তো জানা দরকার।

তুই থামবি? নাকি ধাড়ি বয়সে মার খাবি?

বাচাল শম্পাকে ধমক দিয়ে থামালেন অনামিকা দেবী। কিন্তু ওর প্রশ্নের ধাক্কাটাকে তখুনি থামিয়ে ফেলতে পারলেন না। সেই আর একদিনের মতই ভাবতে বসলেন, তার জীবনের এই অবিশ্বাস্য ঘটনাটা, এই নিজের মনে নিজের মত থেকে যাওয়া, এটা আর কিছুই নয়, তার ভাগ্যদেবতার অপার করুণার ফল। সে করুণার স্পর্শ সারাজীবনে বারেবারেই অনুভব করেছেন, তবু এটাই বুঝি সবচেয়ে বড়ো। যার জন্যে কৃতজ্ঞতার আর অন্ত নেই তাঁর ভাগ্যের কাছে।

হতাশ প্রেম?

পাগল নাকি?

এখনকার দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সেই প্রথম প্রেমকে সকৌতুকে দেখে তার মূল্যায়ন করে অবজ্ঞা করছেন না অনামিকা দেবী, শুধু সেই কালের পরিপ্রেক্ষিতে তাকিয়ে দেখে বলেছেন, পাগল নাকি!

হতাশ প্রেমে কাতর হবার যার কথা, সে কী অনামিকা দেবী? সে তো বকুল!

সেই বকুলের পক্ষে কি অমন একটা অদ্ভুত কথা ভাবা সম্ভব ছিল?

বকুলের বাবা-দাদারা যদি যোগ্য পাত্ৰ যোগাড় করে এনে, সেই তরুণী মেয়েটাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দিত, মেয়েটা কি এ যুগের সিনেমার নায়িকার মত বিয়ের পিঁড়ি থেকে ছিটকে উঠে, কনেচন্দন রুমালে মুছে ফুলের মালা গলা থেকে টান মেরে ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে জমজমাট বিয়েবাড়ি থেকে উধ্বশ্বাসে পথে বেরিয়ে পড়তে পারতো, এ অসম্ভব এ অসম্ভব বলতে বলতে?

নাকি অভিভাবকদের চেষ্টার মুখে তাদের মুখের ওপর বলতে পারতো, বৃথা চেষ্টা করবেন না। যদি করেন তো নিজের দায়িত্বে করবেন।

নাঃ, এসব কিছুই করতে পারতো না সে। কেউই পারতো না তখন। বকুলরা দেবদাস পড়ে মানুষ হওয়া মেয়ে। অভিভাবকরা বিয়ে দিলে সে বর হাতিপোতার জমিদারই হোক আর মশাপোতার ইস্কুলমাস্টারই হোক, তার চাদরে গাঁটছড়া বেঁধে ঠিকই তার পিছু পিছু গিয়ে দুধে-আলতার পাথরে দাঁড়াতো।

তারপর?

তারপর সারাজীবন সেই জীবনের জাবর কাটতো, আর কখনো কোনো এক অসতর্ক মুহূর্তে হয়তো একটা উন্মনা নিঃশ্বাস ফেলতো।

পারুলের জীবনে প্রথম প্রেম-ট্রেম কিছু নেই, তবু পারুলের জীবনটাও ওই জাবরকাটা ছাড়া আর কি? পারুলও অনেক উন্মানা নিঃশ্বাস ফেলেছে বৈকি। যে প্ৰেম জীবনে কখনো আসেনি তার বিরহেই নিঃশ্বাস ফেলেছে পারুল। হয়তো এখনো তার সেই গঙ্গার ধারের বারান্দায় পড়ন্ত সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে যে নিঃশ্বাসটা ফেলে পারুল সেটা তার ছেলেদের প্রতি অভিমানে নয়, সেই না-পাওয়ায় গভীর শূন্যতার।

হঠাৎ একটা কথা ভাবলেন অনামিকা দেবী, নির্মল যদি সেজদিকে ভালবাসতো!

যদিও পারুল নামের প্রখরা মহিলাটি নির্মল নামের মেরুদণ্ডহীন ভীরু ছেলেটাকে নস্যাৎ করে দিয়েছিল, তবু এ কথাটা এতোদিন পরে মনে হলো অনামিকা দেবীর।

নির্মলের ওপর বকুল সম্পর্কে একটা প্রত্যাশা ছিল বলে পারুল হয়তো অতো ধিক্কার দিয়েছিল ছেলেটাকে। যদি সে রকম কোনো প্ৰত্যাশা না থাকত, যদি ছেলেটা তার পরিপূর্ণ জীবনের মাঝখানে বসেও পারুলের দিকে দীন-দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো, পারুল হয়তো সম্পূর্ণতা পেতো। পারুল সেই সঞ্চয়টিকে পরম মূল্য দিতো।

সেজদি এখনো প্ৰেম-ট্রেম ভালো বোঝে-মনে মনে বললেন অনামিকা দেবী, আমার মত এমন নীরস হয়ে যায়নি। অবিরত যতো রাজ্যের কাল্পনিক লোকের প্ৰেম-ভালবাসার কথা লিখতে লিখতে, নিজের অনুভূতিগুলো ভোঁতা হয়ে গেছে আমার।

নইলে সেদিন মহাজাতি সদনে, সেই ফাংশানের দিন, কেমন করেই আমি—

হঠাৎ কেমন স্তব্ধ হয়ে গেলেন অনামিকা দেবী।

ভোঁতা হয়ে যাওয়া অনুভূতিও কি হঠাৎ তীক্ষ্ণ হয়ে ঝনঝনিয়ে উঠলো? সেই ধাক্কায় স্তব্ধ হয়ে গেলেন?.

নির্মল, সুনিৰ্মল নামের সেই বড় চাকুরে ছেলেটার মধ্যেও বুঝি সব পেয়েও বরাবর সেজদির মতোই একটা না-পাওয়ার শূন্যতা ছিল।

তাই নির্মল বলেছিল, কতো গল্প লিখছো, আমাদের গল্পটা লেখো না।

তখন আর মোতিহারীতে নেই নির্মল, বদলির চাকরির সূত্রে আরো কোথায় যেন ছিল। সেখানে বাংলা পত্রিকা দুর্লভ, তবু খুঁজে খুঁজে পড়তো। আর ছুটিতে বাড়ি এলেই সেই নিতান্ত কম বয়সের মতো চেষ্টা করে করে উপলক্ষ খুঁজে অনামিকা দেবীর সঙ্গে দেখা করে যেতো।

তা তখনো উপলক্ষ খোঁজার চেষ্টা করতে হতো বৈকি।

জগৎসংসারে এতো লোক থাকতে, একজন আর একটি জনের সঙ্গে দেখা হওয়ার জন্যে ব্যাকুল হচ্ছে, এটা ধরা পড়ে যাওয়া যে দারুণ লজ্জার! হোক না তাদের যতোই কেননা বয়েস, ধরা পড়লেই মারা গেলে!

আর পড়বেই ধরা।

ওই ব্যাকুলতাটা এমনি জিনিস যে সংসারের বুনো মানুষগুলো তো দূরের কথা, শিশুর চোখেও ধরা পড়তে দেরি হয় না। শিশুও বিশেষ দৃষ্টিটা যে বিশেষ তা বুঝে ফেলে কৌতূহলদৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে দেখে।

অতএব নিজের ক বছরের যেন বাচ্চা ছেলেটাকেও ভয়ের দৃষ্টিতে দেখে, চেষ্টা করে করে উপলক্ষ সৃষ্টি করতে নির্মল।

তেমনি এক মিথ্যা উপলক্ষের মুহূর্তে গভীর একটু দৃষ্টি মেলে বলেছিল নিৰ্মল, এতো গল্প লিখছো, আমাদের গল্পটা লেখো না!

বকুল তো তখন অনামিকার খোলসে বন্দী, সে খোলস ভেঙে ফেলে বকুল হয়ে ফুটে উঠবার উপায় কই তার? বকুলকে তো চিরকাল ওই খোলসের বোঝাটা বয়ে বেড়াতেই হবে।

এই খোলস জিনিসটা বড় ভয়ানক, প্ৰথমে মনে হয় আমি বুঝি নিজেই গায়ে চড়ালাম ওটাকে, খুলে রাখতে ইচ্ছে হলেই খুলে রাখবো, কিন্তু তা হয় না। আস্তে আস্তে নাগপাশের বন্ধনে বেঁধে ফেলে সে, তার থেকে আর মুক্তি নেই।

অতএব অনামিকা দেবীকে অনামিকা দেবী হয়েই থাকতে হবে। আর কোনদিনই বকুল হওয়া চলবে না, অন্য আর কিছু হবার ইচ্ছে থাকলেও চলবে না।

কাজে কাজেই বকুলকে নির্মলের ওই ছেলেমানুষি কথায় হেসে উঠে বলতে হয়েছিল, আমাদের গল্প? সেটা আবার কী বস্তু?

নির্মলের সেই ছেলেমানুষ অথচ গভীর চাহনির মধ্যে আঘাতের বেদনা ফুটে উঠেছিল। নির্মল আহত গলায় বলে উঠেছিল, এখন হয়তো সে বস্তু তোমার কাছে তুচ্ছ হয়ে গেছে, অনেক বড় হয়ে গেছে তুমি, তবু আমার কাছে সে সমান মূল্যবানই আছে। তুচ্ছ হয়ে যায়নি।

মনকে চঞ্চল হতে দিতে নেই।

কারণ সেটা ছেলেমানুষি, সেটা ওই খোলসখানার উপযুক্ত নয়। তাই আচঞ্চল কৌতুকে বলতে হয়, ওরে বাবা! সেই তামাদি হয়ে যাওয়া দলিলটা এখনো আয়রন চেস্টে তুলে রেখেছে? তোমার তো খুব অধ্যবসায়া!

নির্মল তার প্রকৃতিগত আবেগের সঙ্গে বলেছিল, তোমার কাছে হয়তো তামাদি হয়ে গেছে বকুল, আমার কাছে নয়।

তাই তো, তাহলে তো ভাবালে!

বলে হেসে ফেলেছিলেন অনামিকা দেবী।

আর ভেবেছিলেন, মনে করি বুঝি অনুভূতির ধারগুলো সব ঘষে ঘষে ক্ষয়ে গেছে আমার, কিন্তু সত্যিই কি তাই? তাই যদি হয়, কেন তবে ওকে দেখলে ভিতর থেকে এমন একটা উথলে ওঠা আহ্লাদের ভাব আসে? কেন ওর যে কদিন ছুটি থাকে, মনে হয় আকাশ-বাতাস সব যেন আনন্দে ভাসছে? কেন ওর ছুটি ফুরোলে মনে হয়, কী আশ্চৰ্য,এরইমধ্যে এক মাস হয়ে গেল! আর কেন মনে হয়, দিনগুলো কেমন যেন একরঙা হয়ে গেল!

ভাবাতে পারলাম? নির্মল আগ্রহের গলায় কৌতুক-স্বরে বলেছিল, সেটাও আশার কথা। তা ভাবনাটাকে রূপ দিয়ে ফেলো না, লেখো না আমাদের গল্প। এতো লিখছো বানানো গল্প।

অনামিকা দেবীর ওই আবেগের দিকে তাকিয়ে মমতা হয়েছিল, হঠাৎ যেন কোথায় কোন ধুলোর স্তরের নিচে থেকে মাথা তুলে একটা বিশ্বাসঘাতক দুষ্ট চুপি-চুপি বলে উঠেছিল, বাজে কথা বলছ কেন? বুকে হাত দিয়ে বল দিকি জিনিসটা একেবারে তামাদি হয়ে গেছে, একথা তুমি নিজেই বিশ্বাস কর!

তাই অনামিকা মৃদু হেসে বলেন, আচ্ছা না হয় লিখলামই একটা সত্যি গল্প, কিন্তু তারপর?

কী তারপর?

লোকে ভুলে-টুলে গেছে, আবার তাদের মনে পড়িয়ে দিয়ে এই বুড়ো বয়সে ধরা পড়া তো? খুব তরল শুনিয়েছিল গলাটা।

নির্মলের ঝকঝকে চোখ দুটো হঠাৎ খুশির আলোয় ঝলসে উঠেছিল। নির্মল কি অনামিকার ওই তরলতার বুদবুদে বকুলের ছায়া দেখতে পেয়েছিল?

আশ্চর্য নির্মলের চোখের সেই ঝলকানিটা কোনোদিনই ম্লান হয়ে যায়নি! হয়তো এই দীপ্তিটা অন্য এক আলোর। হয়তো নির্মল তাঁর জীবনের বহিরঙ্গের সমন্ত সমারোহের অন্তরালে একটি অন্তরঙ্গ কোণে একটি অকম্প দীপশিখা জেলে, সেটিকে বিশ্বস্ততার স্ফটিকের কৌটোয় ভরে রেখেছিল, এই দীপ্তি সেই শিখার।

নির্মল সেই দীপ্তি দিয়ে বলেছিল, ধরা পড়ে যাওয়া মানে? তবে আর কিসের বড় লেখিকা? এমন কৌশলে লিখবে যে, কেউ জানতেই পারবে না এটা সত্যি গল্প!

চেনা লোকেরা পারবে।

উহুঁ। যাতে না পারে, সেইভাবে লিখবে।

হেসে উঠেছিলেন অনামিকা দেবী, তবে আর লিখে লাভ? কেউ যদি টেরই না পেলো?

বাঃ, নাই বা টের পেলো। না পাওয়াই তো চাইছি। লোকের জন্যে তো নয়, নিজেদের জন্যেই। কেউ ধরতে পারবে না, শুধু আমরা দুজনে বুঝবো। বল তো কী মজা হবে সেটা!

তা হলেও—, অনামিকা দেবী একটু দুষ্ট হাসি হেসেছিলেন, গল্পের মূল নায়িকা তো বড় জেঠিমাকেই করতে হবে!

ধ্যেৎ! ওই গল্পটা লিখতে কে তোমায় সাধছে? একেবারে আমাদের নিজেদের গল্পটা লেখো, যে গল্পটা এখনো রোজ তৈরি হচ্ছে।

লিখলে কিন্তু পাল্লা দুটো ভয়ানক উঁচু -নিচু দেখাবে! অনামিকা দেবী বলেছিলেন হেসে হেসে, একদিকে সুন্দরী স্ত্রী, সোনারচাঁদ ছেলে, মোটা মাইনের চাকরি, কর্মস্থলে প্ৰতিপত্তি, অন্যদিকে একটা অখাদ্য গল্পলেখিকা-বর জোটেনি, ঘর জোটেনি, তাই সময় কাটাতে কলম ঘষে।

নির্মলের চোখের সেই ঝকঝকানির ওপর মেঘের ছায়া নেমে এসেছিল। নির্মল বলেছিল, সুন্দরী স্ত্রী, মোটা মাইনের চাকরি, সেটা বাইরের লোক দেখবে! তুমি লেখিকা, তুমিও সেটাই দেখবে?

বাঃ, লেখিকা আবার নতুন কী দেখবে?

লেখিকা দেখবে সমারোহের অন্তরালে অবস্থিত দৈন্য। দেখবে অনেক জমজমাটের ওপিঠের গভীর শূন্যতা। কিন্তু-, নির্মল মিষ্টি একটু হেসে বলেছিল, কিন্তু এ গল্পও এখন চাই না আমি। এ গল্প পরে লিখো, যখন মরে-টরে যাবো। আমি চাই সেই বোকা ছেলেমেয়ে দুটোর গল্প-যাহারা আঁকেনি ছবি, সৃজেছিল শুধু পটভূমি।

অনামিকা দেবী হেসে কুটিকুটি হয়ে বলেছিলেন, কেন? নতুন করে অনুভব করতে, কী বোকা ছিল তারা?

তারপর বলেছিলেন, আচ্ছা লিখবো।

নির্মল বললে, ঠিক আছে! কিসে দেবে বল, সেই পত্রিকাটার গ্রাহক হবে কাল থেকে।

আরে তুমি গ্রাহক হতে যাবে কোন দুঃখে? লেখিকা নিজেই না হয় পাঠিয়ে দেবে!

নাঃ। ও মৃদু হেসে বলেছিলো, বিনা প্রতীক্ষায় পেলে সে জিনিস আর মূল্যবান থাকে না। এ বেশ প্রতি মাসে ডাকের প্যাকেটটা খোলবার সময় হাত কাঁপিবে–

অনামিকা দেবীর ভাবনা ধরে গিয়েছিল।

অনামিকা দেবীর মনে হয়েছিল, এমনি ছোট্ট ছোট্ট কথার চাবি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নির্মল নামের ছেলেটা বুঝি অনামিকা দেবীর সেই অনেক আগে বন্ধ করে দেওয়া, অনেক নীচের পাতাল-ঘরটা খুলে ফেলতে চায়।

তাই অনামিকা দেবী খুব জোরে হেসে উঠেছিলেন, ও বাবা! বল কি? এতো?

তুমি ঠাট্টা করছো?

বাঃ, ঠাট্টা করবো কেন? এমনিই বলছি-এতো?

নির্মল উদাস হাসি হেসে বলেছিল, ঠাট্টা অবশ্য করতে পারো তুমি, সে রাইট আছে তোমার। আমার আর মুখ কোথায়?

ও কথা বোলো না নির্মলদা, বকুল তখন ব্যাকুল হয়ে বলেছিল, ও কথা কোনোদিনও বলবে না। আমার মতে এটাই ভালো হয়েছে।

তাই ভাববো।

দীর্ঘনিঃশ্বাসের মত একটা শব্দ পেয়েছিলেন অনামিকা দেবী।

তারপর আবার সেই আবেগের গলায় উচ্চারিত কথা, আমি কিন্তু প্ৰতীক্ষা করবো।

বলেছিল নির্মল।

প্রতীক্ষা করবো!

কিন্তু সে গল্প লেখা হয়েছিল কোনোদিন?

কই আর?

লেখা হলে আর সেই ঘর-সংসারী বড় বয়সের মানুষটা কতোদিন পরে আবার একখানা চিঠি লিখে বসবে কেন? কই? কোথায় সেই গল্প? যে গল্প কেবল তুমি বুঝবে আর আমি বুঝবো, আর কেউ বুঝতে পারবে না?

 ১৪. অকস্মাৎ একদিন সেই চিঠিটা

হ্যাঁ, অকস্মাৎ একদিন সেই চিঠিটা এসে হাজির হয়েছিল। অবাক হয়ে গিয়েছিলেন অনামিকা দেবী। আশ্চর্য রকমের ছেলেমানুষ আছে তো মানুষটা? এখনো সেই গল্পটার কথা মনে রেখে বসে আছে? এখনো ভাবছে সেই গল্পটা ভালো লাগবে তার? শুধু একা বুঝে ফেলে পরম আনন্দে উপভোগ করবে?

অথবা পরম বেদনায় একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে, সে দীর্ঘশ্বাসকে মিশিয়ে দেবে অনন্তকালের বিরহী হিয়ার তপ্তশ্বাসের সঙ্গে!

ভগবান জানেন কী ভাবছে!

কিন্তু আশ্চর্য লাগে বৈকি!

আশ্চর্য লাগে এই ভেবে, অথচ মাধুরী-বৌকে ও প্রাণ তুল্য ভালবাসে। নিবিড় গভীর স্নেহসহানুভূতি-ভরা সেই ভালবাসার খবর বকুলের অজানা নয়। অজানা নয়, এই অনামিকা দেবীরও। তবু সেই অতীত কৈশোরকালের প্রথম-প্রেম নামক হাস্যকর মুঢ়তাটুকুকে আজও আঁকড়ে ধরে রেখেছে লোকটা!

আজও ওর প্রাণের মধ্যে গোপন গভীরে সেই মূঢ়তাটুকুর জন্যে হাহাকার!

হয়তে ওর এই ছেলেমানুষি মনটা বজায় থাকার মূলে রয়েছে মাধুরী-বৌয়ের আশ্চর্য হৃদয়ের অনাবিল ভালবাসার অবদান। মাধুরী-বৌ যদি সংসারের আরো অসংখ্য মেয়ের মত ঈর্ষাবিদ্বেষ, সন্দেহ আর অভিমানে ভরা একটা মেয়ে হতো, যদি মাধুরী-বৌ তার তীব্ৰ তীক্ষ্ণ অধিকারের ছুরিটা নিয়ে ওই অবোধ মানুষটার সেই মূঢ়তাটিকে দীৰ্ণবিদীর্ণ ছিন্নভিন্ন করে উৎপাটিত করে ফেলবার কাজে উৎসাহী হয়ে উঠতো, যদি ওকে বুঝিয়ে ছাড়ত এখনো তোমার ওই প্রথম প্রেমকে পরম প্রেমে লালন করাটা মহাপাতক তাহলে কী হতো বলা যায় না। হয়তো মূঢ় ছেলে মানুষটা সেই তীব্র শাসনবাণীতে কুণ্ঠিত হয়ে গুটিয়ে যেতো, সঙ্কুচিত করে ফেলতো নিজেকে।

কিন্তু মাধুরী-বৌ কোনো দিন তা করেনি।

মাধুরী-বৌ ওকে যেন মাতৃহৃদয় দিয়ে ভালবেসেছে। ভালবেসেছে বন্ধুর হৃদয় দিয়ে।

মাধুরী-বৌ ওর ওই প্রথম প্রেমের প্রতি নিষ্ঠাকে শ্রদ্ধা করে।

.

চিঠি মাধুরী-বৌও লিখতো বকুলকে।

অথবা বলতে পারা যায় মাধুরী-বৌই লিখতো। নির্মল তো মাত্ৰ দুবার। সেই অনেক দিন আগে ছোট্ট দু লাইনের একটা, কী যে তাতে বক্তব্য ছিল ভুলেই গেছেন অনামিকা দেবী। আর তারপর অনেক দিন পরে এই চিঠি।

যোগাযোগ রাখতো মাধুরী-বৌ।

কোথায় কোথায় বদলি হয়ে যাচ্ছে তারা, কেমন কোয়ার্টার্স পাচ্ছে, দেশটা কেমন, এমনি ছোটখাটো খবর দেওয়া চিঠি।

কিন্তু বকুল?

উত্তর দিতো নিয়মিত?

নাঃ, মোটেই না।

প্রথম দিকে ভদ্রতা করে দিয়েছিল উত্তর দুচারটে, তারপর আর নয়।

তারপর কি অভদ্র হয়ে গেল? নাকি অহঙ্কারী হয়ে গেল? অথবা অলস?

তা ঠিক নয়।

বকুল নিষেধাজ্ঞা পালন করতে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল।

তা এই নিষেধাজ্ঞা কি বকুলের বড়দার? না নির্মলের সেই বড় জেঠির?

সেই নিষেধাজ্ঞা পালন করেছিল বকুল?

নাঃ, তখন আর অতোটা হাস্যকর কোনো ঘটনা ঘটেনি।

নিষেধাজ্ঞা ছিল স্বয়ং পত্ৰদাত্রীর।

মাধুরী-বৌ নিজেই লিখেছিল, আমাদের খবরটা দিয়ে মাঝে মাঝে আমি তোমায় চিঠি দেব ভাই, তাতে তুমি খুশি হও না-হও, আমি খুশি হবো। তুমি কিন্তু ভাই উত্তরপত্রটি দিও না।…কী? ভাবছে নিশ্চয় এ আবার কোন ধরনের ভদ্রতা? তা তুমি ভাবলেও, এ অভদ্রতাটি করছি ভাই আমি। হয়তো এমন অদ্ভুত অভদ্রতা সংসারের আর কারো সঙ্গেই করতে পারতাম না, শুধু তুমি বলেই পাবলাম! জানি না এটা পারছি তুমি লেখিকা বলে, না আমার বরের প্রেমিকা বলে! যাই হোক, মোট কথা পারলাম। না পেরে উপায় কি বল? যেদিন তোমার চিঠি আসে, লোকটার আহারনিদ্রা যে প্রায় বন্ধ হবার যোগাড়!

খেতে বসে খিদে কম, শুতে গিয়ে ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস। আবার এমনও সন্দেহ হয় আমায় বুঝি ঈর্ষাই করছে। যে বস্তু ওর কাছে দুর্লভ, সে বস্তু আমি এমন অনায়াসে লাভ করছি, এটা হিংসের বিষয়, হলেও হতে পারে তো?

অথচ বাবুর নিজে সাহস করে লেখার মুরোদ নেই; বলেছিলাম, আমার চিঠি পড়ছে কি জন্যে শুনি? ইচ্ছে হয় নিজে চিঠি লিখে উত্তর আনাও! আমার চিঠিতে তো আছে ঘোড়ার ডিম, তোমার চিঠিতে বরং রোমান্স-টোমান্স থাকবে!.. তা উচিতমত একটা জবাবই দিতে পারলো না। রেখে দিয়ে বললো, ঠিক আছে, পড়তে চাই না।

বোঝ ভাই!

এর পরে আবার মান খুইয়ে পড়তেও পারবে না, দীর্ঘশ্বাস আরো বাড়বে।

এই রকমই চিঠি লিখতো মাধুরী–বৌ।

একবার লিখেছিল, মাঝে মাঝে ভাবি, আশ্চৰ্য, তোমরা চিঠি লেখালিখিই বা করোনা কেন? চিঠির দ্বারা আর সমাজকে কতোটা রসাতলে দেওয়া যায়? আবার ভাবি, থাকগে, হয়তো এই-ই ভালো। লক্ষ্মীর কৌটোয় তুলে রাখা মোহর ভাঙাতে না বেরোনোই ভালো।

আর একবার লিখেছিল, উঃ বাবা, ক্ৰমে ক্রমে কী লেখিকাই হয়ে উঠছ! এখানে তো তোমার নামে ধন্য ধন্য। আমি বাবা মরে গেলেও ফাঁস করি না, এই বিখ্যাত লেখিকাটি আমার চেনা-জানা।…কী দরকার বলো? এনে তো দেখাতে পারবো না? তাছাড়া এও ভাবি, সত্যিই কি চেনা-জানা? যে তুমি-কে দেখি, গল্প করি হয়তো বা হতাশ প্রেমের নায়িকা বলে, মাঝে মাঝে করুণাও করে বসি, এই সব জটিল কুটিল ভয়ঙ্কর গল্পটল্প কি তারই লেখা? না আর কেউ লিখে দেয়? সত্যি ভাই, তোমার মুখের ভাষার সঙ্গে তোমার লেখার ভাষার আদৌ মিল নেই।… তবু মাঝে মাঝে ওই অভাগা লোকটার জন্যে মায়া হয়। এমন একখানি নিধি ঘরে তুলতে পারতো বেচারা, কিন্তু বিধি বাম হলো। তার বদলে কপালে এই রাঙামূলো।

শ্লেষ করে লিখতো না, অসূয়ার বশেও লিখতো না, মনটাই তো এমনি সহজ সরল মাধুরীবৌয়ের। মেয়েমানুষের মন এমন অসূয়াশূন্য, এটা বড় দুর্লভ।

মাধুরী-বৌ বলেছিল, লক্ষ্মীর কৌটোয় তুলে রাখা মোহর না ভাঙানোই ভালো।

তবু সেবার সে মোহর বার করে বসেছিল নির্মল। কে জানে মাধুরী-বৌকে জানিয়ে কি না-জানিয়ে!

হয়তো জানায়নি।

হয়তো অফিসে বসে লিখে পাঠিয়েছে, কই? কোথায় সেই গল্প? যে গল্প কেবল তুমি বুঝবে, আর আমি বুঝবো। আর কেউ বুঝবে না।…চিঠির উত্তর চাই না, গল্পটাই হবে উত্তর।

চিঠির উত্তর দিতে নির্মলও বারণ করেছিল।

পড়ে হেসে ফেলেছিলেন অনামিকা দেবী। তার ভাগ্যটা মন্দ নয়, লোকে চিঠি দিয়ে উত্তর দিতে বারণ করে!

কিন্তু উত্তর স্বরূপ যেটা চেয়েছিল?

যার জন্যে হয়তো দিনের পর দিন, মাসের পর মাস প্রতীক্ষা করেছিল। সে গল্প কোথায়?.. সেই এক বিদারণ-রেখা টানা আছে।অনামিকা দেবীর জীবনে। সে গল্প লেখা হয়নি।

অথচ তারপর কতো গল্পই লিখলেন। এখনো লিখে চলেছেন।

কিন্তু একেবারেই কি লেখা হয়নি সে গল্প?

সেদিন মহাজাতি সদন থেকে ফিরে চুপিচুপি সেই প্রশ্নটাই করেছিলেন অনামিকা দেবী আকাশের কোন এক নক্ষত্ৰকে, একেবারেই কি লিখিনি তোমার আর আমার সেই গল্পটা? লিখেছি লিখেছি। লিখেছি নানা ছলে, নানা রঙে, নানা পরিবেশের মাধ্যমে। আমাদের গল্পটা রেণু রেণু করে মিশিয়ে দিয়েছি অনেক-দের গল্পের মধ্যে!

তবু—

তুমি জেনে রইলে, অনেক গল্প লিখলাম আমি, শুধু তোমার আর আমার সেই গল্পটা লিখলাম না কোনো দিন। তুমি অনেকবার বলেছ, তবু লিখিনি। তুমি প্রতীক্ষা করেছ ছেলেমানুষের মত, হতাশ হয়েছে ছেলেমানুষের মত, বুঝতেও পেরেছি সেকথা, তবু হয়ে ওঠেনি।

কেন হয়ে ওঠেনি, আমি নিজেই ভাল জানি না। হয়তো পেরে উঠিনি বলেই। তবু আজ আমার সে কথা ভেবে খুব যন্ত্রণা হচ্ছে। খুব যন্ত্রণা।

কিন্তু নক্ষত্রটা কি বিশ্বাস করেছিল সেকথা? বিশ্বাস করবার তো কথা নয়। সে তো সব কিছুই দেখেছিল আকাশের আসনে বসে।

দেখেছিল মহাজাতি সদনে মন্ত এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছে, ভিড়ে ভেঙে পড়েছে হল, আলোয় ঝলমল করছে প্রবেশদ্বার।

মস্তবড় একখানা গাড়ি থেকে নামলেন অনুষ্ঠানের সভানেত্রী। এরাই পাঠিয়েছিল গাড়ি।

শান্ত প্ৰসন্ন চেহারা, ভদ্রমার্জিত সাজসজ্জা। উদ্যোক্তাদের আভূমি নমস্কারের বিনিময়ে নমস্কার করছেন। পাড়ার সেই একটা ছেলে, রাজেন্দ্রলাল স্ট্রীটের কোনো একখানে যার বাড়ি, অনামিকা দেবীকে ধরে কবে এই অনুষ্ঠানের প্রবেশপত্র একখানা যোগাড় করেছিল, সেই ছেলেটা কেমন করে যেন মহাজনবেষ্টিত সভানেত্রীর একেবারে কাছ ঘেঁষে খুব চাপা গলায় বললে, আপনিও বেরিয়ে এলেন, আর সঙ্গে সঙ্গেই আপনাদের পাশের বাড়ির একটা স্যাড ব্যাপার! বিরাট কান্নাকাটি!

ছেলেটা কাছ ঘেঁষে আসার চেষ্টা করায় অনামিকা দেবী ভাবছিলেন, তার সঙ্গ ধরে একেবারে প্রথম সারির চেয়ারে গিয়ে বসবার তাল করছে বোধ হয়।… পাড়ার ছেলেরা সুযোগ-সুবিধের তালটা খোঁজে, বাড়ির ছেলেরা কদাচ নয়। অনামিকা দেবীর ভাইপোরা কোনোদিন সামান্য একটা কৌতূহল প্রশ্নও করে না অনামিকা দেবীর গতিবিধি সম্পর্কে। কদাচ কখনো কোনো ভালো অনুষ্ঠানের প্রবেশপত্ৰ উপহার দিয়ে দেখেছেন, দেখতে যাবার সময় হয়নি ওদের; অথচ তার থেকে বাজে জিনিসও দেখতে গিয়েছে পয়সা খরচ করে। গিয়েছে হয়তো পরদিনই।

পাড়ার ছেলেরাই সুযোগ টুযোগের আশায় কাছে ঘেঁষে আসে।

অনামিকা দেবী ভাবলেন তাই আসছে। কিন্তু ছেলেটা হঠাৎ কাছ ঘেঁষে এসে পাশের বাড়ির খবর দিতে বসলো।

বললে, আপনিও যেই বেরিয়ে এলেন—

অনামিকা দেবী ঝাপসা ভাবে একবার তার বাড়ির এপাশ-ওপাশ স্মরণ করলেন!

তারাচরণবাবুর মা মারা গেলেন তা হলে! ভুগছিলেন অনেক দিন ধরে। বললেন, তাই নাকি? আমি তো–

এগিয়ে চলেছেন উদ্যোক্তারা ছেলেটাকে পাশ-ঠ্যালা করছেন তবু ছেলেটা যেন নাছোড়বান্দা।

হয়তো ও সেই স্বভাবের লোক যারা কার কাছে একটা দুঃসংবাদ পরিবেশন করব্বার সুযোগটাকে বেশ একটা প্রাপ্তিযোগী মনে করে, তাই সুযোগটাকে ফস্কাতে চায় না; সঙ্গে সঙ্গে এগোতে থাকে, হলের মধ্যে ঢুকে যায়, আর হঠাৎ একবার চান্স পেয়ে বলে নেয়, আপনি কি করে জানবেন? এক্ষুনি টেলিগ্রাম এলো। ওই যে আপনাদের পাশের বাড়ির সুনির্মলবাবু ছিলেন। বক্সারে থাকতেন–

কথাটা শেষ করতে পেলো না।

ততক্ষণে তো অনামিকা দেবীকে মঞ্চে তোলার জন্য গ্রীন রুমের দিকে নিয়ে চলে গেছে। এরা সর্বসমক্ষে দোদুল্যমান ভেলভেটর পর্দার ওদিকে সাজিয়ে বসিয়ে মাহেন্দ্রক্ষণে যবনিকা উত্তোলন করবে!

এখনো ভাবতে গেলে বিস্ময়ের কুল খুঁজে পান না অনামিকা দেবী!

বুঝতে পারেন না সত্যিসত্যিই সেই ঘটনাতা ঘতেছিল কি না। অথচ ঘটেছিল। যবনিকা উত্তোলিত হয়েছিল নাটকীয় ভঙ্গীতে, উৎসুক দর্শকের দল দেখতে পেয়েছিল সারি সারি চেয়ারে সভানেত্রী, প্ৰধান অতিথি এবং উদ্বোধক সমাসীন।

তারপর নাটকের দৃশ্যের মতই পর পর দেখতে পেয়েছিল, উদ্বোধন সঙ্গীত অন্তে তিন প্রধানকে মোটা গোড়ে মালা পরিয়ে দেওয়া হলো, সমিতি-সম্পাদক উদাত্ত ভাষায় তাদের লক্ষ্য, আদর্শ ইত্যাদি পেশ করলেন। তারপর একে একে উদ্বোধক, প্রধান অতিথি এবং সভানেত্রী ভাষণ দিলেন, তারপর যথারীতি সমাপ্তি সঙ্গীত হলো।

আর তারপর আসল ব্যাপার সংস্কৃতি অনুষ্ঠান শুরু হবার জন্যে পুনর্বার যবনিকা নামলো।

সভানেত্রীর ভাষণ হয়েছিল কি?

হয়েছিল বৈকি।

এমন জমজমাট অনুষ্ঠানের ত্রুটি হতে পারে কখনো?

তারপর যদি সভানেত্রী হঠাৎ অসুস্থতা বোধ করে বাড়ি চলে যান, তাতে অনুষ্ঠানে ত্রুটি হবার কথা নয়।

.

না, কোনো ত্রুটি হয়নি অনুষ্ঠানের।

সভানেত্রীর ভাষণেও নাকি ত্রুটির লেশ ছিল না। উদ্যোক্তাদেদর একজন এ অভিমতও প্রকাশ করলেন, এই রকম মৃদু সংক্ষিপ্ত এবং হৃদয়গ্রাহী ভাষণই তাঁরা চান। দীর্ঘ বক্তৃতা দুচক্ষের বিষ।

অতএব ধরা যেতে পারে সভা সাফল্যমণ্ডিত হয়েছিল। তাছাড়া কৃতজ্ঞতা প্রকাশ, ধন্যবাদ, শুভেচ্ছাজ্ঞাপন ইত্যাদি সব কিছুই ঠিকমত সাজানো হয়েছিল।

আকাশের সেই নক্ষত্ৰখানি আকাশের জানলা দিয়ে সবই তো দেখেছিল তাকিয়ে।

কী করে তবে বিশ্বাস করবে সে, এই ভয়ানক যন্ত্রণাটা সত্যি। বিশ্বাস করেনি, নিশ্চয়ই বিশ্বাস করেনি। হয়তো মৃদু হেসে নিঃশব্দ উচ্চারণে বলেছিল, এতোই যদি যন্ত্রণা তো ওই সব সাজানো-গোছানো কথাগুলি চালিয়ে এলে কী করে শুনি? শোনামাত্রই তো সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়তে পারতে তুমি। এরকম ক্ষেত্রে যেটা খুব স্বাভাবিক ছিল।

আকস্মিক সেই অসুস্থতাকে লোকে এমন কিছু অস্বাভাবিক বলেও মনে করতো না।

বলতো গরমে, বলতো অতিরিক্ত মাথার খাটুনিতে। অথবা বলতো, শরীর খারাপ নিয়ে এসেছিলেন বোধ হয়।

আর কী?

সভা পণ্ড হতো?

পাগল!

রাজা বিনে রাজ্য চলে, আর সভানেত্রী বিহনে সভা চলতো না?

কতো কতো জায়গায় তো এমনিতেই সভাপতির অন্তর্ধান ঘটে। এই আসছেন এখুনি আসছেন, আনতে গেছে বলতে বলতে কর্তৃপক্ষ হাল ছেড়ে দিয়ে আর কোনো কেষ্টবিষ্টুকে বসিয়ে দেন সভাপতির আসনে!

অনামিকা দেবী সেদিন হঠাৎ সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়লে তাই হতো। তাছাড়া আর কী লোকসান?

অথচ ওই মূর্খ সভানেত্রী আপ্রাণ চেষ্টায় সেই সংজ্ঞাটাকেই ধরে রাখতে চেষ্টা করেছেন। সত্যিই তাই করেছিলেন অনামিকা। ওই পালিয়ে যেতে চেষ্টা করা বস্তুটাকে ধরে রাখবার জন্যে তখন যেন একটা লড়াইয়ের মনোভাব নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে নেমেছিলেন।

হার মানবো না!

কিছুতেই হার মানবো না।

বুঝতে দেবো না কাউকে! জানতে দেবো না। আমার মধ্যে কী ঘটছে।

কিন্তু সম্ভব হয়েছিল তো!

বহুবার নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করেছে বকুল, কী করে হলো সম্ভব?

তার মানে আসলে মন নামক লোকটার নিজস্ব কোনো চরিত্র নেই? সে শুধু পরিবেশের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত!

ভগবান সম্পর্কে কখনোই খুব একটা চিন্তা ছিল না বকুলের। চলিত কথার নিয়মে ভগবান শব্দটা ব্যবহার করতে হয়তো। ভগবান খুব রক্ষে করেছেন। ভগবান জানেন কী ব্যাপার! খুব ভাগ্যি যে ভগবান অমুকটা করেননি।

এই রকম।

এ ছাড়া আর কই?

শুধু এই একটি জায়গায় ভগবানকে মুখোমুখি রেখে প্রশ্ন করেছে বকুল, এখনো করে, ভগবান! কী দরকার পড়েছিল তোমার ওই শান্ত সভ্য অবোধ মানুষটাকে তাড়াতাড়ি পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেবার? কী ক্ষতি হতো তোমার, যদি সেই মানুষটা পৃথিবীর একটুখানি কোণে সামান্য একটু জায়গা দখল করে থাকতো আরো কিছুদিন! তোমার ওই আকাশে তো নক্ষত্রের শেষ নেই, তবে কেন তাড়াতাড়ি আরো একটি বাড়াবার জন্যে এমন নির্লজ্জ চৌর্যবৃত্তি তোমার!

ভগবানকে উদ্দেশ করে কথা বলার অভ্যাস সেই প্ৰথম।

ভগবানের নির্লজ্জতায় স্তম্ভিত হয়ে, ভগবানের নিষ্ঠুরতায় স্তব্ধ হয়ে গিয়ে।

বকুলের খাতায় ছন্দের চরণধ্বনি উঠলেই সে ধ্বনি পৌঁছে যেতো সেজদির কাছে। এটাই ছিল বরাবরের নিয়ম।

শুধু সেই একসময়, মহাজাতি সদনে অনুষ্ঠিত ফাংশানের কদিন পরে বকুলের খাতায় ছন্দের পদপাত পড়েছিল, কিন্তু সেজদির কাছে পৌঁছয়নি। খাতার মধ্যেই সমাধিস্থ হয়ে আছে সে।

সেই খাতাটা, যার পাতার খাঁজে সেই চিঠিখানা ঘুমিয়ে আছে এখনো।

কই? কোথায়? আমাদের সেই গল্পটা?

না, সেজদির কাছে যায়নি খাতার সেই পৃষ্ঠাটা। গেলে হয়তো যত্নের ছাপ পড়তো তাতে। দেখা হতো ছন্দে কতটা ত্রুটি, শব্দচয়নে কতটা দক্ষতা।

আর হয়তো শেষ পর্যন্ত শেষও হতো। কোনো একখানা সমাপ্তির রেখা টানা হতো। কিন্তু ওটা যায়নি সেজদির কাছে। বকুলের অক্ষমতার সাক্ষী হয়ে পড়ে আছে খাতার মধ্যে!

অথচ সেই রাত্রেই লেখেনি বকুল যে, অক্ষমতোটাকে ক্ষমা করা যাবে! লিখেছিল তো কদিন যেন পরে—

লিখেছিল–

রাত্রির আকাশে ওই বসে আছে যারা
স্থির অচঞ্চল,
আলোক স্ফুলিঙ্গ সম
লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি তারা,
আমরা ওদের জানি।
পৃথিবী হতেও বড়ো বহু বড়ো
গ্ৰহ উপগ্রহ।
নাম-পরিচয়হীন দূরান্তের পড়শী মোদের।
দুর্লঙ্ঘ্য নিয়মে অহৰ্নিশি আবর্তিছে
আপন আপন কক্ষে।
কিরণ বিকীর্ণ করি।
বিজ্ঞানের জ্ঞানলোকে
ধরা পড়ে গেছে ওদের স্বরূপ।
অনেক অঙ্কের আর অনেক যুক্তির
সারালো প্রমাণে
রাখেনি কোথাও সন্দেহের অবকাশ।
ওরা সত্য, ওরা গ্রহদল।
তবু মনে হয়–
জীবনের ঊষাকালে মাতৃমুখ হতে
শুনেছি যা ভ্ৰান্তবাণী, শিখেছি যা ভুল,
সব চেয়ে সত্য সেই।
সত্য সব চেয়ে যুক্তিহীন বুদ্ধিহীন
সেই মিথ্যা মোহ।
তাই স্তব্ধ রাত্রিকালে,
নিঃসীম নিকষপটে নির্নিমেষ দৃষ্টি মেলি
দেখি চেয়ে চেয়ে–
অনেক তারার মাঝে কোথা আছে
দুটি আঁখিতারা।
যে দুটি তারকা কোটি কোটি যোজনের
দূরলোকে বসি
চেয়ে আছে তন্দ্ৰাহীন।
চেয়ে আছে সকরুণ মৌন মহিমায়
মাটির পৃথিবী পরে।
যেথা সে একদা–
একটি নক্ষত্র হয়ে জ্বলিত একাকী
আলোকিয়া একখানি ঘর।
নিয়তির ক্রুর আকর্ষণে যেথা হতে নিয়েছে বিদায়
প্রাণবৃন্তখানি হতে ছিঁড়ে আপনারে।
লক্ষ ক্রোশ দূর হতে–
হয়তো সে আছে চেয়ে
সেই গৃহখানিপানে নতনেত্ৰ মেলি।
হয়তো দেখিছে খুঁজে–
দীপহীন দীপ্তিহীন সেই ঘর হতে
দুটি নেত্ৰ আছে কিনা জেগে
ঊর্ধ্ব আকাশেতে চেয়ে।
কোটি তারকার মাঝে
খুঁজিবারে দুটি আঁখিতারা
সহসা একদা যদি–

না, আর লেখা হয়নি।

কতকাল হয়ে গেল, খাতার পাতার রংটা হলদেটে হয়ে গেছে, ওটা অসমাপ্তই রয়ে গেল। কি করে তবে বলা যায় মন নামক কোনো সত্যবস্তু আছে?

না নেই, মন নামক কোনো সত্য বস্তু নেই। অন্ততঃ অনামিকা দেবীর মধ্যে তো নেইই। থাকলে তারপর আরো অনেক অনেক গল্প লিখতে পারতেন না তিনি। থাকলে সেই চিঠিখানাই তাঁর কলমের মুখটা চেপে ধরতো। বলে উঠতো, থামো থামো, লজ্জা করছে না তোমার? ভুলে যাচ্ছে নক্ষত্রেরা অহনিশি তাকিয়ে থাকে?

কিন্তু সে সব কিছু হয়নি। সে কলম অব্যাহত গতিতে চলেছে। বরং দিনে দিনে নাকি আরো ধারালো আর জোরালো হচ্ছে। অন্ততঃ শম্পা তো তাই বলে। আর শম্পা নিজেকে এ যুগের পাঠক-পাঠিকা সমাজের মুখপাত্র বলেই বিশ্বাস রাখে।

শম্পা মাঝে মাঝেই এসে বলে, আচ্ছা পিসি, তুমি এমন ভিজেবেড়াল প্যাটার্নের কেন?

অনামিকা দেবী ওর কোনো কথাতেই বিস্ময়াহত হন না, তাই মৃদু হাসেন। অথবা বলেন, সে উত্তর সৃষ্টিকর্তার কাছে। তুই বা এমন বাঘিনী প্যাটার্নের কেন, সেটাও তো তাহলে একটা প্রশ্ন!

বাজে কথা রাখে। শম্পা উদ্দীপ্ত গলায় বলে, তোমায় দেখলে তো স্রেফ একটি ভোঁতা। পিসিমা মনে হয়, অথচ কলম থেকে লেখাগুলো এমন জব্বর বার করো কী করে বাছা?

আজও শম্পা উদ্দীপ্ত মূর্তিতেই এসে উদয় হলো, নাঃ, তোমার এই ভিজে বেড়াল নামটাই হচ্ছে আসল নাম!

অনামিকা দেবী বোঝেন তার সাম্প্রতিককালের কোনো একটা লেখা ওর বেদম পছন্দ হয়ে গেছে, উচ্ছাস তৎ-দরুন। মৃদু হেসে বলেন, সে কথা তো আগেই হয়ে গেছে।

গেছে, তবু কিছুটা সংশয় ছিল, আজ সেটা ঘুচলো।

বাঁচলাম।

তুমি তো বাঁচলে, মুশকিল আমারই! তোমার কাছে এসে বসলেই ভাবনা ধরবে ভিজে বেড়ালটির মতো চক্ষু মুদে বসে আছ, কিন্তু কোন ফাঁকে অন্তরের অন্তস্থল পর্যন্ত দেখে বসছো!

তাতে ভাবনাটা কী? অনামিকা হাসেন, তোর অন্তস্থলে তো আর কোন কালিঝুলি নেই।

সে না হয় আমার নেই। শম্পা অনায়াস মহিমার গলায় বলে, আমার ভেতরটা না হয় দেখেই ফেললে, বয়েই গেল আমার; কিন্তু অন্যদের? তাদের কথাও তো ভাবতে হবে।

তুইই ভাব। তারপর আমার কী কী শাস্তিবিধান করিস কর।

শাস্তি!

শম্পা উত্তাল গলায় বলে, শাস্তি কী গো? বল পুরস্কার! কী একখানা মারকাটারী গল্প লিখেছে এবারের উদয়নে, পড়ে তো আমার কলেজের বন্ধুরা একেবারে হাঁ! বলে, আচ্ছা তোর পিসিকে তো আমরা দেখেছি, দেখলে তো একেবারেই মনে হয় না উনি আমাদের, মানে আর কি আধুনিক মেয়েদের এমন বোঝেন। আশ্চৰ্য, কী করে উনি আধুনিক মেয়েদের একেবারে যাকে বলে গভীর গোপন ব্যথা-বেদনার কথা এমন করে প্রকাশ করেন? সত্যি পিসি, তোমায় দেখলে তো মনে হয় তুমি আধুনিকতা-টাধুনিকতা তেমন পছন্দ কর না!

অনামিকা দেবী ঈষৎ গম্ভীর গলায় বলেন, এমন কথা মনে করার হেতু?

কী মুশকিল! মনে করার আবার হেতু থাকে?

থাকে বৈকি। কার্য থাকলেই কারণ থাকবে, এটা তো অবধারিত সত্য। দেখা সে কারণ।

ওরে বাবা, অতো চেপে ধরো না। ওরাই তো বলে।

দ্যাখ বিচ্ছু তোর ওই ওদের যদি কখনো এ প্রশ্নের উত্তর দিতে চাস তো বলিস আধুনিকতা আর উচ্ছৃঙ্খলতা এক বস্তু নয়। আর- অনামিকা দেবী একটু হাসলেন, আর আধুনিক শব্দটার বিশেষ একটা অর্থ আছে, ওটা বয়েস দিয়ে মাপা যায় না। একজন অশীতিপর বৃদ্ধও আধুনিক হতে পারেন, একজন কুড়ি বছরের তরুণ যুবকও প্রাচীন হতে পারে। ওটা মনোভঙ্গী। কেবলমাত্র বয়সের টিকিটখানা হাতে নিয়ে যারা নিজেদের আধুনিক …ভেবে গরবে গৌরবে স্ফীত হয়, তারা জানে না ও টিকিটটা প্রতিমুহূর্তে বাসি হয়ে যাচ্ছে, অকেজো হয়ে যাচ্ছে। কুড়ি বছরটা পচিশ বছরের দিকে তাকিয়ে অনুকম্পার হাসি হাসবে। আমি একজনকে জানি, আজ যার বয়েস আশীর কম নয়, তবু তাকেই আমি আমার জানা জগতের সকলের থেকে বেশী আধুনিক মনে করি।

জানি নে বাবা! শম্পা দুই হাত উল্টে বলে, তোমার সেই আশী বছরের আধুনিকটিকে দেখিয়ে দিও একদিন, দেখে চক্ষু সার্থক করা যাবে। তবে তোমার ওই উদয়নের নবকন্যা পড়ে কলেজের মেয়েরা তোমায় ফুলচন্দন দিচ্ছে এই খবরটা জানিয়ে দিলাম। লিলি তো বলছিল, ইচ্ছে হচ্ছে গিয়ে পিসির পায়ের ধুলো নিয়ে আসি।…লেখক মশাইরা তো দেখতে পান শুধু যুগযন্ত্রণায় ছটফটিয়ে মরা ছেলেগুলিকেই, সে যন্ত্রণা যে মেয়েদের মধ্যেও আছে,–কে কবে খেয়াল করেছে? ওনারা জানেন কেবলমাত্ৰ দেহযন্ত্রণা ছাড়া মেয়েদের আর কোনো যন্ত্রণা নেই। ঘেন্না করে, লজ্জা করে, রাগে মাথা জ্বলে যায়। পিসিকে গিয়ে বলবো।–

অনামিকা দেবী কথায় বাধা দিয়ে বলেন, তা যেন বুঝলাম, কিন্তু পায়ের ধুলো নেওয়া!। তা যে বাপু বড় সেকেলে! এই তোর বন্ধু!  সেকেলে গাইয়া! ছি!

তা বলো। ক্ষতি নেই।

শম্পা গেঁটিয়ে বিছানায় বসে গম্ভীর গলায় বলে, দ্যাখো পিসি, তোমায় আর আমি কী বুঝবো, তুমি কী না বোঝ! তবে আমি তো দেখছি আসলে প্রাণের মধ্যে যখন সত্যিকার আবেগ আসে তখন তোমার গিয়ে ওসব সেকেলে একেলে জ্ঞান থাকে না।

থাকে না বুঝি?

কই আর? নিজেকে দিয়েই তো দেখলাম, সাতজন্মেও ঠাকুর-দেবতার ধার ধারি না, ধারেকাছেও যাই না, যারা ওই সব ঠাকুর-টাকুর করে তাদের দিকে বরং কৃপার দৃষ্টিতে তাকাই। কিন্তু তোমার কাছে আর বলতে লজ্জা কি, জাম্বোর যেদিন হঠাৎ একেবারে একশো জ্বর উঠে বসলো চড়চড় করে, ডাক্তার মাথায় হাত দিয়ে পড়লো বলেই মনে হলো, সেদিন দুম করে ঠাকুরের কাছে মানত না কি যেন তাই করে বসলাম। বললাম, হে ঠাকুর ওর জ্বর ভালো করে দাও, তোমায় অনেক পুজো দেব। বোঝ ব্যাপার!

অনামিকা দেবী হেসে ফেলে বলেন, ব্যাপার তো বেশ বুঝলাম, জলের মতোই বুঝলাম, কিন্তু জাম্বোটি কী বস্তু তা তো বুঝলাম না!

জাম্বো কে জানো না?

শম্পা আকাশ থেকে পড়ে।

ওর নামটা তোমায় কোনোদিন বলিনি নাকি?

কার নাম?

আঃ, ইয়ে সেই ছেলেটার! মানে সেই মিস্ত্রীটার আর কি! যেটার বেশ বন্য বন্য ভাবের জন্যে এখনো রিজেক্ট করিনি!

তার নাম জাম্বোআফ্রিকান বুঝি?

আহা আফ্রিকান হতে যাবে কেন? ওর চেহারাটার জনো ওর কাকা নাকি ওই নামেই ডাকতো। শুনে আমারও বেশ পছন্দ হয়ে গেল।

তা তো হবেই। তুমি নিজে যেমন। তোর নামও শম্পা না হয়ে হিড়িম্বা হওয়া উচিত ছিল। কেন, একটু সভ্য-ভব্য হতে পারিস না? বাড়িতে তো তোর বয়সী আরো একটা মেয়ে রয়েছে, তাকে দেখেও তো শিখতে পারিস?

কী শিখতে পারি? সভ্যতা? কাকে দেখে? তোমার ওই নাতনীটিকে দেখে? আমার দরকার নেই! শম্পা অবজ্ঞায় ঠোঁট উল্টোয়।

তারপর বলে, আমি নেহাৎ অশিক্ষিত অ-সভ্য বলেই ওর কীর্তিকলাপ মুখে আনতে চাই না, শুনলে না তুমি মোহিত হয়ে যেতে নাতনীর গুণাপনায়!

আহা লেখাপড়ায় হয়তো তেমন ইয়ে নয়, কিন্তু আর সব কিছুতে তো-

লেখাপড়ার জন্যে কে মরছে? শম্পা ঝাঁঝিয়ে উঠে বলে, বর্ণপরিচয় না থাকলেও কোনো ক্ষতি নেই, কিন্তু আর সবটা কী শুনি?

কেন, নাচ গান, ছবি আঁকা, সূচের কাজ, টেবল ম্যানার্স, পার্টিতে যোগ দেবার ক্যাপাসিটি-

থামো পিসি, মাথায় আগুন জেলে দিও না। তোমার ওই বৌমাটি মেয়েটার ইহকাল পরকাল সব খেয়ে মেরে দিয়েছেন, বুঝেছো? ছবি আঁকে! হুঁ! যা দেখবে সবই জেনো ওর মাস্টারের আঁকা। সেলাই তো স্রেফ সমস্তই ওর মাতৃদেবীর—তবে হ্যাঁ, সাজতে-টাজতে ভালই শিখেছে। যাকগে মরুকগে, মহাপুরুষরা বলে থাকেন পরচর্চা মহাপাপ। তুমি যে দয়া করে তোমার ওই নাতনীটিকেই এ যুগের আধুনিকাদের প্রতিনিধি ভাবোনি এই ভালো! যাক লিলি যদি আসে, আর পায়ের ধুলোফুলো নিয়ে বসে, ওই নিয়ে কিছু বোলো না যেন।…আবেগের মাথায় আসবে তো! আর আবেগের মাথায়-হঠাৎ ঠাট্টা-টাট্টা শুনলে–

আচ্ছা আচ্ছা, তোর বন্ধুর ভারটা আমার ওপরই ছেড়ে দে। কিন্তু সেই যে জাম্বুবান না কার জন্যে যেন ঠাকুরের কাছে মানত করে বসেছিলি-পুজো দিয়েছিস? নাকি তার জ্বর ছেড়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই তোরও ঘাড় থেকে ভগবানের ভূত ছেড়ে গেল!

শম্পা হেসে ফেলে। অপ্রতিভ-অপ্ৰতিভ হাসি।

বলে, ব্যাপারটা আমি নিজেই ঠিক বুঝতে পারছি না পিসি। ঠাকুর-টাকুর তো মানি না, হঠাৎ সেদিন কেনই যে মরতে— এখন ভেবে পাচ্ছি না কী করি? পুজো ফুজো দেওয়া মনে করলেই তো নিজের ওপর কৃপা আসছে, অথচ—

তবে আর অথচ কি? অনামিকা নির্লিপ্ত গলায় বলেন, ভেবে নে হঠাৎ একটা বোকামি করে ফেলেছিলি, তার জন্য আবার কিসের দায়?

তাই বলছো?

শম্পা প্ৰায় অসহায়-অসহায় মুখে বলে, আমিও তো ভাবছি সে কথা, মানে ভাবতে চেষ্টা করছি, কিন্তু কী যে একটা অস্বস্তি পেয়ে বসেছে! কাপড়ে চোরকাঁটা বিধে থাকলে যেমন হয়, প্ৰায় সেই রকম যেন! দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু-

তাহলে জিনিসটা চোরকাটাই। অনামিকা মুখ টিপে হেসে বলেন, চোরের কাঁটা। অলক্ষিত চোর চুপি চুপি সিঁদ কেটে—

পাগল! ক্ষেপেছো! শম্পা হৈ-চৈ করে ওঠে, তুমি ভাবছো এই অবকাশে আমার মধ্যে ঠাকুর ঢুকে বসে আছে? মাথা খারাপ! তবে আর কি, ওই অস্বস্তিটার জন্যই ভাবছিলাম-তুমি দিয়ে দিতে পারবে না?

দিয়ে দিতে? কী দিয়ে দিতে?

আহা বুঝছে না যেন! ন্যাকা সেজে কী হবে শুনি? ওই কিছু পুজোফুজো দিয়ে দিলেই–মানে সত্যরক্ষা আর কী! প্ৰতিজ্ঞাটা পালন করা দরকার।

অনামিকা ক্ষুব্ধ গলায় বলেন, কার কাছে প্ৰতিজ্ঞা? যাকে বিশ্বাস করিস না তার কাছে তো? সেখানে আবার সত্যরক্ষা কি? অনায়াসেই তো ভাবতে পারিস, দেব না, বয়ে গেল! ঠাকুর না হাতি!

চেষ্টা-করেছি—, শম্পা আরো একটু অপ্রতিভ হাসি হেসে বলে, সুবিধে হচ্ছে না। ও তুমি যা হয় একটা করে দিও বাবা।

আমি? আমি কী করে দেব?

আঃ বললাম তো, ওই পুজোটুজো যা হোক কিছু। তোমার কাছ থেকে টাকা নিয়েই তো দিতে হতো।

অনামিকা কৌতুকের হাসি গোপন করে বলেন, সে আলাদা কথা। কিন্তু তুই কোন ঠাকুরের কাছে পুজো কবলালি, আমি তার কী জানি?

কোন ঠাকুর! শম্পা আবার আকাশ থেকে পড়ে, ঠাকুর আবার কোন ঠাকুর? এমনি ঠাকুর!

আহা, কোনো একটা মূর্তি তো ভেবেছিলি? কালী কি কেষ্ট, দুর্গা কি শিব-

না পিসি, ওসব কিছু ভাবি-টাবিনি। শম্পা এবার ধাতস্থ গলায় বলে, এমনি আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে মরেছি। মানে ওর টেম্পারেচারটাও যতো ওপর দিকে উঠে চলেছে, আমার চোখও তো ততো ওপর দিকে এগোচ্ছে। জ্বর যখন একশো ছয় ছড়িয়ে আরো চার পয়েন্ট, আমার চোখও তখন স্রেফ চড়কগাছ ছাড়িয়ে আকাশে। মূর্তি-টুর্তি কিছু ভাবিনি, শুধু ওই আকাশটাকেই বলেছি, ছোঁড়াটা তোমার এমন কী কাজে লাগবে বাপু যে টানাটানি শুরু করেছো? তোমার ওখানে তো অনেক তারা আছে, আরো একটা বাড়িয়ে তোমার লাভ কী? হঠাৎ জোরে হেসে ওঠে শম্পা, দেখেছো পিসি, কুসংস্কারের কী শক্তি? যেই না বিপদে পড়া, অমনি স্রেফ ছেলেমানুষের মতো ভাবতে শুরু করা-মৃত্যুর দূত আকাশ থেকে নেমে আসে, মরে গেলে মানুষরা সব আকাশের নক্ষত্র হয়ে যায়। এসব হচ্ছে ভুল শিক্ষার কুফল! …যাচ্চলে, ঘুমিয়েই পড়লে যে! বাবা তোমার আবার কবে থেকে আমার মাতৃদেবীর মতো ঘুমের বহর বাড়লো? মা তো-থাক বাবা, ঘুমোও। রাত জেগে জেগে লিখেই বুড়ী মলো!

নেমে যায় শম্পা।

বোজা চোখেই অনুভব করেন অনামিকা।

আর সেই মুদ্রিত পল্লবের নীচটা ভয়ানক যেন জ্বালা করতে থাকে।

ঠিক সেই সময় চোখ জ্বালা করছিল আর একজনের। সে চোখ শম্পার মা রমলার। তার মেয়ে যে কেবলই কেবলই তাকে ছাড়িয়ে, অথবা সত্যি বলতে তাকে এড়িয়ে কেবলই গুণবতী পিসির কাছে ছুটবে, এটা তার চক্ষুসুখকর হতেই পারে না। অথচ করারও কিছু নেই। শ্বশুর ঠাকুর বাড়িটি রেখে গেছেন, কিন্তু উঠানের মাঝখানে একটি বিষবৃক্ষ পুঁতে রেখে গেছেন।

হতে পারে ননদিনীটি তার পরম গুণাবতী, তার নিজেরই বোনেরা, ভাজেরা, ভাজের বোনেরা এবং বোনেদের জা ননদ ভাগ্নী ভাসুরঝি ইত্যাদি পরিচিতকুল সকলেই যে ওই গুণবতীর ভক্ত, তাও জানতে বাকী নেই শম্পার মার, এমন কি তিনি অনামিকা দেবীর সঙ্গে একই বাড়িতে বাস করার মতো পরম সৌভাগের অধিকারিণী বলে অনেকে ঈর্ষার ভানও করে থাকে, কিন্তু নিজে ত তিনি জানেন সর্বদাই হাড় জ্বলে যায় তার ননদিনীর বোল-বোলাও দেখে।

এদিকে তো ইউনিভার্সিটির ছাপও নেই একটা, অথচ বড় বড় পণ্ডিতজনেরা পর্যন্ত মান্য করে কথা বলতে আসে, খোসামোদ কয়ে ডেকে ডেকে নিয়ে যায় সভার শোভাবর্ধন করতে, এটা কি অসহ্যের পর্যায়ে পড়বার মতো নয়?

যাক গো মরুক গে, থাকুন না হয় আপন মান যশ অর্থ প্রতিষ্ঠার উচ্চ মঞ্চে বসে, শম্পার মার মেয়েটা কেন ওঁর পায়ে পায়ে ঘুরতে যায়? মেয়েকে যে তিনি হাতের মুঠোয় পুরে রাখতে পারলেন না, তার কারণ তো ওই গুণবতীটি!

না। সত্যি, সংসারের মধ্যে যদি কোনো একজন বিশেষ গুণসম্পন্ন হয়ে বসে, সে সংসারের অপর ব্যক্তিদের জ্বালার শেষ নেই। শুধু চোখই নয়, অহরহ সর্বাঙ্গ জ্বালা করে তাদের। প্রতিভা-ট্ৰতিভা ওসব দূর থেকেই দেখতে ভালো, কাছের লোকের থাকায় কোনো সুখ নেই। তা সংসারের কোনো একজন যদি সাধু-সন্ন্যাসীও হয় তাহলেও। আত্মজনের ভক্তজন এসে জুটলেই বাড়ির লোকের বিষ লাগতে বাধ্য।

অতএব শম্পার মাকে দোষ দেওয়া যায় না।

তবু পুরুষমানুষ হলেও বা সহ্য হয়, এ আবার মেয়েমানুষ!

তাছাড়া শম্পার মার কপালে ওই মেয়ের জ্বালা। বাড়িতে তো আরো মেয়ে আছে, আরো মেয়ে ছিল, যাদের বিয়ে হয়ে গেছে একে একে, কেউ তো তার ওই বেয়াড়া মেয়েটার মতো পিসিভক্ত নয়। আর বেয়াড়া যে হয়েছে সে তো শুধু ওই জন্যেই।

এই তো অলকা বৌমার মেয়ে, খুবই নাক-উঁচু  ফ্যাশানি, মানুষকে যেন মানুষ বলে গণ্যই করে না, তবু দাখো তাকিয়ে, এই বয়সে মা-দিদিমাদের সঙ্গে গুরুদীক্ষা নিয়েছে। এদিকে যতই ফ্যাশান করুক আর নেচে বেড়াক, সপ্তাহে একদিন করে সেই আত্মাবাবার মঠে হাজিরা দিতে যাবেই যাবে। তবু তো একটা দিকেও উন্নতি হচ্ছে। তাছাড়া সেখানে —নাকি সমাজের যতো কেষ্ট-বিষ্টুরা এসে মাথা মুড়োন, কাজেই গুরুমন্ত্র বলে একটা লোকলজ্জাও নেই। কুলগুরুর কাছে দীক্ষা নেওয়ায় যে গ্রাম্যতা আছে, এদের কাছে দীক্ষা নেওয়ায় তো সেটা নেই। বরং ওতেই মানমর্যাদা, ওতেই আধুনিকতা।

ওসব জায়গায় আরো একটা মস্ত সুবিধে, বাবার যত কেষ্ট-বিষ্টু শিষ্যরা তো সপরিবারেই এসে ধর্না দেন, ভালো ভালো পাত্র-পাত্রীরও সন্ধান পাওয়া যায় সেই সুযোগে। বাবা নিজেও নাকি কতো শিষ্য-শিষ্যার ছেলেমেয়ের বিয়ে ঘটিয়ে দিয়েছেন।

শম্পার মার অবিশ্যি এসব শোনা কথা। ব্যাপারটা একবার দেখে আসবার জন্যে যতোই কেন না কৌতূহল থাকুক, মান খুইয়ে ভাশুরপো-বৌকে তো গিয়ে বলতে পারেন না, তোমার গুরুর কাছে আমায় একবার নিয়ে চল!

আর বললেই যে নিয়ে যাবে, তারই বা নিশ্চয়তা কি? এই তো ওর নিজের শাশুড়ীই তো বলেছিল একদিন। সেখানে ভীষণ ভিড়, সেখানে আপনার কষ্ট হবে, আপনি ব্লাড-প্রেসারের রোগী–সংকীর্তনের আওয়াজে আপনার প্রেসার বেড়ে যাবে বলে কেমন এড়িয়ে গেল। সোজা তো নয় বৌটি, ঘুঘু! তবু নিজের মেয়েটিকে কেমন নিজের মনের মতোটি করে গড়তে পেরেছে। ভাগ্য, ভাগ্য, সবই ভাগ্য! শম্পার মার ভাগ্যেই সব উল্টো।

মেয়েকে নামতে দেখেই শম্পার মা আটকালেন, কোথায় না কোথায় সারাদিন ঘুরে বাড়ি এসেই তো পিসির মন্দিরে গিয়ে ওঠা হয়েছিল, বলি সেখানে কি ডানহাতের ব্যাপারটা আছে? নাকি পিসির মুখ দেখেই পেট ভরে গেছে?

শম্পা দাঁড়িয়ে পড়ে কঠিন গলায় বলে, আর কোনো কথা আছে তোমার?

আমার আবার কী কথা থাকবে। শম্পার মা-ও ধাতব গলায় বলে ওঠেন, যতোক্ষণ আমার হেফাজতে আছ, ঠিকসময় খেতে দেওয়ার ডিউটিটা তো পালন করতে হবে আমায়। দয়া করে কিছু খাবে চল!

আমার খিদে নেই।

খিদে নেই? ওঃ, পিসি বুঝি ঘরে কড়াপাকের সন্দেশের বাক্স বসিয়ে রেখেছিল ভাইঝির জন্যে!

শম্পা একটু তীক্ষ্ণ হাসি হেসে বলে, না, কড়াপাকটা পিসির ভাজেরই একচেটে!

ওঃ বটে! বড় তোর কথা হয়েছে! কবে যে তোকে ভিন্ন গোত্র করে দিয়ে হাড় জুড়বো—

শম্পা আর একটু হেসে বলে, ওটার জন্যে তুমি আর মাথা ঘামিও না মা। ওই গোত্র বদলের কাজটা আমি নিজেই করে নিতে পারবো।

কী বললি? কী বললি শুনি?

যা বলেছি তা একবারেই বুঝেছো মা। আবার শুনে কেন রাগ বাড়াবে! বলে শম্পা একটা পাক খেয়ে ঘরে ঢুকে যায়।

আর ঠিক সেই মুহূর্তে শম্পার বাবা প্রায় তার নিজের বাবার গলায় মেয়েকে বলে ওঠেন, দাঁড়াও। তোমার সঙ্গে কথা আছে।

বাপের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়লো শম্পা।

শম্পার বাবার বোনের মতো ভীরু ভঙ্গীতে নয়, দাঁড়ালে নিজের ভঙ্গীতেই। যে ভঙ্গীতে ভীরুতা তো নয়ই, বরং আছে কিঞ্চিৎ অসহিষ্ণুতা। যেন ট্রেনের টিকিট কাটা আছে, যাবার সময় পার হয়ে যাচ্ছে, অতএব যা বলবে চটপট বলে নাও বাপু।

বাবা এই অসহনীয় ভঙ্গীটাকেও প্রায় সহ্য করে নিয়ে পাথুরে গলায় বলেন, ছেলেবেলা থেকেই তোমায় বার বার বলতে হয়েছে, তবু কোনোমতেই তোমায় বাধ্য বিনীত সভ্যতা জ্ঞানসম্পন্ন করে তোলা সম্ভব হয়নি! তুমি যে একটা ভদ্র বাড়ির মেয়ে, সেটা যেন খেয়ালেই রাখো না! কিন্তু মনে হচ্ছে সেটা এবার আমাকেই খেয়ালে রাখতে হবে। তোমার নামে অনেক কিছু রিপোর্ট পাচ্ছি কিছু দিন থেকে, এবং

কথার মাঝখানে বাবাকে তাজ্জব করে দিয়ে শম্পা টুক্ করে একটু হেসে ফেলে বলে, রিপোর্টারটি অবশ্যই আমাদের মা-জননী!

থামো! বাচালতা রাখে!

বাবা সেই তার নিজের ভুলে যাওয়া বাবার মতই গর্জে ওঠেন, আমি জানতে চাই সত্যবান দাস কে?

সত্যবান দাস১

শম্পা আকাশ থেকে পড়ে, সত্যবান দাস কে তা আমি কি করে জানব?

তুমি কি করে জানবে! ওঃ একটা গুণ ছিল না জানতাম, সেটাও হয়েছে তাহলে? মিথ্যে কথা বলতে শিখেছো? হবেই তো, যেমন সব বন্ধু-বান্ধব জুটছে। কলের মজুর, কারখানার কুলি

কারখানার কুলি! শম্পার মুখে হঠাৎ একচিলতে বিদ্যুৎ খেলে যায়।

জাম্বোর নাম যে আবার সত্যবান, তা তো ছাই মনেই থাকে না।

মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে হাসি লুকিয়ে বলে শম্পা, মিথ্যে কথা বলবার কিছু দরকার নেই, শুধু চট করে মনে পড়ছিল না। ডাকনামটাই মনে থাকে

ওঃ! শম্পার বাবা ফেটে পড়বার অবস্থাকেও আয়ত্তে এনে বলেন, ডাকনামে ডাকা টাকা চলছে তাহলে? কিন্তু আমি জানতে চাই কোন্ সাহসে তুমি একটা ছোটলোকের সঙ্গে মেশো?

শম্পা ফেরানো ঘাড় এদিকে ফিরিয়ে স্থির গলায় বলে, ছোট কাজ করলেই কেউ ছোট হয়ে যায় না বাবা!

থাক থাক, ওসব পচা পুরনো বুলি ঢের শুনেছি। আমি চাই না যে আমার মেয়ে একটা ইতরের সঙ্গে মেশে।

শম্পার সমস্ত চাপল্যের ভঙ্গী হঠাৎ একটা কঠিন রেখায় সীমায়িত হয়ে যায়। শম্পা তার বাবার চোখের দিকে সোজা তাকিয়ে বলে, তোমার চাওয়ার আর আমার চাওয়ার মধ্যে যদি মিল না থাকে বাবা!

যদি মিল না থাকে?

শম্পার বাবা এই দুঃসাহসের দিকে তাকিয়ে শেষ পর্যন্ত ফেটে পড়েন। বলে ওঠেন, তাহলে তোমার আর এ বাড়িতে জায়গা হবে না।

আচ্ছা, জানা রইল। শম্পা এবার আবার সেই আগের অসহিষ্ণু ভঙ্গীতে ফিরে আসে, আর কিছু বলবে? আমার একটু কাজ ছিল, বেরোতে হবে!

বেরোতে হবে? শম্পার বাবা ভুলে যান তিনি তার বাবার কালে আবদ্ধ নেই। শম্পার বাবার মনে পড়ে, এখন আর চার টাকা মণের চাল খান না তিনি, খান না আট আনা সেরের রুই মাছ। শম্পার বাবা তীব্র কণ্ঠে বলেন, এক পা বেরোনো হবে না তোমার। কলেজ ভিন্ন আর কোথাও যাবে না।

হঠাৎ বাবাকে থ করে দিয়ে ঝরঝরিয়ে হেসে ওঠে শম্পা।

হাসতে হাসতে বলে, তুমি ঠিক যেন সেই সেকালের রাজরাজড়াদের মত কথা বললে বাবা! যাঁরা আজ যাকে কেটে রক্তদর্শন করতেন, কাল আবার তাকে ডেকে আনতে বলতেন! এইমাত্র তো হুকুম হয়ে গেল, এ বাড়িতে জায়গা হবে না, আবার এখুনি হুকুম হচ্ছে বাড়ি থেকে বেরোনো হবে না–অদ্ভুত!

হঠাৎ কী হয়ে যায়!

শম্পার বাবা কাণ্ডজ্ঞানশূন্যভাবে মেয়ের সেই চুড়ো করে বাধা খোঁপাটা ধরে সজোরে নাড়া দিয়ে বলে ওঠেন, ওঃ আবার বড় বড় কথা! আস্পদ্দার শেষ নেই তোমার। তোমাকে আমি চাবি-বন্ধ করে রেখে দেব তা জানো, পাজী মেয়ে।

শম্পা নিতান্ত শান্তভাবে খোঁপা থেকে ঝরে পড়া পিনগুলো গোছাতে গোছাতে বলে, পারবে না, খামোকা আমার কষ্ট করে বাধা খোঁপাটাই নষ্ট করে দিলে! যাক গে মরুক গে, আচ্ছা যাচ্ছি তাহলে!

বলে দিব্যি চটিটা পায়ে গলিয়ে টানতে টানতে বাবার সামনে দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে। বাবার মুখ দিয়ে আর একটি কথাও বেরোয় না। হঠাৎ ওই চুলটা ধরার সঙ্গে সঙ্গেই কি নিজের ভুলটা চোখে পড়লো তার! মনে পড়ে গেল নিরুপায়তার পাত্র বদল হয়েছে!

তাই ওই চলে যাওয়ার দিকে স্তব্ধ-বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন? নাকি অধস্তনের ঔদ্ধত্য শক্তিহীন করে দিয়ে গেল তাকে?

হতে পারে।

চার টাকা মণের চালের ভাতে যাদের হাড়ের বনেদ, তাদের চিত্তজগৎ থেকে যে কিছুতেই ওই উধ্বতন-অধস্তন প্রভু-ভৃত্য গুরুজন-লঘুজন ইত্যাদি বিপরীতার্থক শব্দগুলো পুরনো অর্থ হারিয়ে বিপরীত অর্থবাহী হয়ে উঠতে চাইছে না! তাই না তাদের প্রতি পদে এত ভুল! যে ভুলের ফলে ক্রমাগত শক্তিহীনই হয়ে পড়ছে তারা!

অনিবার্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গেলেই তো শক্তির বৃথা অপচয়।

অনামিকা দেবী এসবের কিছুই জানতে পারেননি, অনামিকা তিনতলার ঘরে আপন পরিমণ্ডলে নিমগ্ন ছিলেন। ছোড়দার উচ্চ কণ্ঠস্বর যদিও বা একটু কানে এসে থাকে, সেটাকে গুরুত্ব দেননি। নানা কারণেই তো ওনার কণ্ঠস্বর মাঝে মাঝে উচ্চগ্রামে উঠে যায়, খবর নিতে গেলে দেখা যায় কারণটা নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর।

অতএব স্বরটা কান থেকে মনে প্রবেশ করেনি। কিন্তু ঘটনাটাকে কি সত্যিই একটা ভয়াবহ ঘটনা বলে মনে হয়েছিল শম্পার মা-বাপের! ওঁরা শুধু মেয়ের দুঃসহ স্পর্ধা দেখে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন!

তার মানে নিজের সন্তানকে আজ পর্যন্ত চেনেননি ওঁরা।

কেই বা চেনে?

কে পারে চিনতে?

সব থেকে অপরিচিত যদি কেউ থাকে, সে হচ্ছে আপন সন্তান। যাকে নিশ্চিন্ত বিশ্বাসের মোড়ক দিয়ে মুড়ে রাখে মানুষ।

কাজেই সামান্য ওই কথা-কাটাকাটির সূত্রে কী ঘটে গেল, অনুধাবন করতে পারলেন না শম্পার মা-বাপ। ওঁরা ঠিক করলেন মেয়ে এলে কথা বলবেন না, বাক্যালাপ বন্ধই করে ফেলবেন।

অনামিকা দেবী লেখায় ইতি টেনে একটু টান-টান হয়ে বসলেন, আর তখনি চোখ পড়লো টেবিলের পাশের টুলটার ওপর, আজকের ডাকের চিঠিপত্রগুলো পড়ে রয়েছে।

বাচ্চা চাকরটা কখন যেন একবার ঢুকেছিল, রেখে গেছে। অনেকগুলো বইপত্তরের উপর একখানা পরিচিত হাতের লেখা পোস্টকার্ড।

১৫. পোস্টকার্ডখানার মাথার উপর

পোস্টকার্ডখানার মাথার উপর তারিখের নিচে লেখা ঠিকানাটা দেখে চোখটা যেন জুড়িয়ে গেল। আগ্রহে তুলে নিলেন সেটা, তুলে নিয়ে দ্রুত চোখ বুলিয়ে ফেললেন, তারপর আবার ধীরেসুস্থে পড়তে বসলেন।

অথচ অনামিকা দেবীর নামাঙ্কিত ওই পোস্টকার্ডটায় তো মাত্র দু’তিন ছত্র।

..অনেক দিন পরে কলকাতায় ফিরে তোমার কথাটাই সর্বাগ্রে মনে পড়লো, তাই একটা
চিঠি পোস্ট করে দিচ্ছি। নিশ্চয় ভালো আছ।
সনৎকাকা।

এই ধরন সনৎকাকার চিঠির।

গতানুগতিক পদ্ধতিতে স্নেহ-সম্বোধনান্তে শুরু করে আশীর্বাদান্তে ইতির পাট নেই সনৎকাকার। বাহুল্য কথাও নয়। ঝরঝরে তরতরে প্রয়োজনীয় কয়েকটি লাইন। কখনো বা পোস্টকার্ডের পুরো দিকটা সাদাই পড়ে থাকে, ও-পিঠের অর্ধাংশে থাকে ওই লাইন কটা।

একদা, অনামিকা দেবীর বাবা যখন বেঁচে ছিলেন, ওই চিঠির ব্যাখ্যা করে তীব্র আপত্তি তুলেছিলেন তিনি, এ আবার কি রকম চিঠি তোমার সনৎ? একে কি চিঠি বলে?

সনৎকাকা হেসে বলেছিলেন, চিঠি তো বলে না। বলে কার্ড। পোস্টকার্ড।

তাতে কি হয়েছে? লিখছো যখন সে চিঠিতে একটা যথাযোগ্য সম্পর্কের সম্বোধন থাকবে, কুশল প্রশ্ন থাকবে না, নিজে কেমন আছো এ খবর থাকবে না, প্রণাম আশীর্বাদ থাকবে না, মাথার ওপর একটা দেবদেবীর নাম থাকবে না, এ কেমন কথা? না না, এটা ঠিক নয়। এতে কু-দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়। তোমার দেখাদেখি অন্যেও এইরকম ল্যাজামুড়োহীন চিঠি লিখতে শিখবে।

শুনে কিন্তু সনৎকাকা কিছুমাত্র লজ্জিত না হয়ে বরং হেসেই উঠেছিলেন। বলেছিলেন, তা চিঠিটা তো আর টাটকা রুইমাছ নয় যে, ল্যাজামুড়ো বাদ গেলে লোকসান আছে! যথাযোগ্য সম্বোধন তো নামের মধ্যে রয়েছে। তোমায় লিখলে লিখবো প্রবোধদা, বোঝাই যাবে তুমি গুরুজন, বকুলকে লিখলে শুধু বকুলই লিখবো, অতএব বুঝতে আটকাবে না লঘুজন।

তা বলে একটা শ্রীচরণকমলেষু কি কল্যাণীয়াসু লিখবে না?

সেটা না লিখলেই কি বোঝা যায় না? সনৎকাকা বোধ করি তার প্রবোধদার এই তুচ্ছ কারণে উত্তেজিত হওয়াটা দেখে আমোদ পেয়েছিলেন, তাই হেসে হেসে বলে চলেছিলেন, ঘটা করে না বললেও বোঝা যায় ছোটদের আমরা সর্বদাই কল্যাণ কামনা করি, আশীর্বাদ করি। এবং বড়দেরও ভক্তিটক্তি প্রণাম-টণাম করে থাকি। কুশল প্রশ্ন তো থাকেই। নিশ্চয় ভালো আছে এটাই তো কুশল প্রশ্ন। অথবা কুশল প্রার্থনা।

নিশ্চয় ভালো আছো এটা একটা কথা নাকি? মানে আছে এর? সনৎকাকার প্রবোধদা চটে লাল হয়ে গিয়েছিলেন, সব সময় মানুষ নিশ্চয় ভালো থাকে? এই যে আমি! ক’দিন ভাল থাকি?

আমাদের সকলের ইচ্ছের জোরে ভালো থাকবে, সেটাই প্রার্থনা।

বাজে কথা রাখো। এ সব হচ্ছে তোমাদের এ যুগের ফাঁকিবাজি। নিজে কেমন আছি এটুকু লিখতেও আলিস্যি।

সনৎকাকাকে তার প্রবোদা এ যুগের বলে চিহ্নিত করতেন। সেটা যেন কতদিন হয়ে গেল? সনৎকাকার বয়েসটাই বা কোথায় গিয়ে পৌঁছলো? অথচ তার প্রবোধদার অর্ধশতাব্দী পার হয়ে যাওয়া মেয়েটাও বলে, সনৎকাকাকে আমি বলি আধুনিক।

তার মানে সনৎকাকা হচ্ছেন সেই দলের, যারা চির-আধুনিক। সেই আধুনিক সনৎকাকা আজও তেমনি চিঠি লিখেছেন। যাতে ল্যাজামুড়ো নেই। আপন কুশলবার্তাও নেই। যেটাকে তিনি প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিলেন, ওটাকে কিছুতেই আলসা বলতে দিতে রাজী হবো না আমি। আমার ভালো থাকা মন্দ থাকার খবর আমি যেচে যেচে দিতে যাবো কেন? কার কাছে। সেটা দরকারী জানি আমি। যার দরকার সে নিজে জানতে চেয়ে চিঠি লিখবে। পোস্টকার্ডের দাম ওই দু’লাইনেই উসুল হয় বাবা!

পারুলও এইরকম চিঠি লেখে। হয়তো ওই কু-দৃষ্টান্তের ফল।

খামের চিঠিতে অবশ্য ব্যতিক্রম ঘটে সনৎকাকার। সেটার দাম শুধু উসুল করেই ছাড়েন না তিনি। উসুলের উপর বাড়তি মাশুল চাপিয়ে তবে ছাড়েন অনেক সময়ই। আর সেটারও ওই ল্যাজামুড়ো থাকে না বলেই অনেক সময় পত্র না বলে প্রবন্ধও বলা চলে। হয়তো কোনো একটা বিশেষ প্রসঙ্গ নিয়েই তার শুরু এবং শেষ।

তেমনি একখানা চিঠি দিল্লীতে ভাইপোর কাছে গিয়ে মাত্র একবারই লিখেছিলেন সনৎকাকা। দিল্লীর সমাজ নিয়ে যার শুরু এবং সারা। তবে এও লিখেছিলেন, এটা হচ্ছে প্রথম ছাপ, অর্থাৎ বিশুদ্ধ বাংলায় ফাস্ট ইম্প্রেশান, দেখি এখানে থাকতে থাকতে এদের মর্মের গভীরে প্রবেশ করতে পারি কিনা এবং ছাপ বদলায় কিনা।

কিন্তু সে চিঠি আর আসেনি তার। দিল্লীর সমাজের মর্মমূলে প্রবেশ করাটাই কি হয়নি তার এখনো? নাকি সেই প্রবেশের ছাপটা প্রকাশ করতে বসার উৎসাহ পাননি আর?

কিন্তু অনামিকাই কি খোঁজ করেছিলেন, কি ধরনের ছাপ পড়লো আপনার সনৎকাকা? আর জানিয়েছিলেন কি, আপনি কেমন আছেন সেটা জানা আমার কাছে খুব দরকারী? না! হয়ে ওঠেনি।

ভাইপোর কাছেই শেষ জীবনটা থাকতে হবে, এই অনিবার্যকে মেনে নিয়েই থাকতে গিয়েছিলেন সনৎকাকা। কারণ লোকজন চরিয়ে একা সংসার করার মতো বয়েস যে আর নেই অথবা থাকবে না, এটা উপলব্ধি করে ফেলেছিলেন। আর তা না পারলে শেষ গতি তো ওই ভাইপো আর ভাইপো-বৌ। নিজের স্ত্রীটি এমন অতীতকালে তাকে ছেড়ে গেছেন যে এখন আর বোধ করি মনেও পড়ে না–একদা তিনি ছিলেন। একালের পরিচিত সমাজ অনেকেই সনং ব্যানার্জিকে চিরকুমার বলেই জানে!

অনামিকা ওঁর স্ত্রীকে একবার মাত্র দেখেছিলেন। স্ত্রীকে নিয়ে কোথায় যেন বেড়াতে যাবার পথে একবার প্রবোধদার বাড়িতে নেমেছিলেন তিনি। প্রেমঘটিত বিবাহ বলে বৌভাতের ভোজ-টোজ তো হয়নি। তাই বিয়ের সময় কেউ বৌ দেখেনি।

.

অনামিকার মনে আছে, ওরা চলে গেলে প্রবোধচন্দ্র বলেছিলেন, এই বৌ? রোগাপটকা কেলে! কী দেখে মজলেন আমাদের সনৎবাবু! তাই বাড়ুয্যে হায় ঘোষালের গরে মাথা মুড়োতে গেলেন! ছ্যাঃ!

যাক সেই অতীত ইতিহাস নিয়ে আর কেউ চিন্তা করে না। ধরেই নিয়েছে সবাই, লোকটা এতোদিন স্বাধীনভাবে একা থাকলেও, এবার ওকে পরাধীন হতে হবে। আর সেই সূত্রে বাংলা বিহার উড়িষ্যা মধ্যপ্রদেশ, এক কথায় ভারতবর্ষের যে কোন প্রদেশেই হোক, শেষ জীবনটা কাটাতে হবে। অতএব বহুদিনই সনৎকাকা বাংলা দেশ ছাড়া।

এতদিন পরে যে হঠাৎ এলেন, সে কি কোনো বিশেষ প্রয়োজনীয় চিকিৎসার জন্যে? সনৎকাকার সেই ভাইপোটি বদলি হয়ে আবার বাংলা দেশের কোনো চেয়ারে অধিষ্ঠিত হতে এলেন? তার সঙ্গে লটবহরের মত সনৎকাকাও?

অনামিকাকে উনি এ ইঙ্গিতের কণামাত্রও দেননি যে তুমি এসো অথবা তোমায় দেখতে ইচ্ছে করছে।

তবু অভিমানের কোনো প্রশ্ন নেই।

এসো শব্দটি ব্যবহার না করলেও অনামিকা দেবী যে সেখানে সর্বদাই স্বাগত এ কথা অনামিকা যতটা জানেন, ততটা বোধ করি সনৎ ব্যানার্জি নিজেও জানেন না…ওই চিঠিটাই তো এসো!

সেই একটি অনুক্ত এসো শব্দটি অনামিকাকে টেনে বার করলো ঘর থেকে।

বেরোবার সময় আশা অথবা আশঙ্কা করছিলেন, দুষ্ট মেয়েটা কোন্ ফাঁক থেকে এসে জেরা করতে শুরু করবে, এ কি শ্রীমতী লেখিকা দেবী, নিজে নিজে ট্যাক্সি ডেকে বেরোনো হচ্ছে যে? রথ আসেনি তোমার? পুষ্পমাল্য ভূষিত করে সভার শোভাবর্ধন করতে বসিয়ে রাখবার জন্যে?

না, মেয়েটাকে ধারেকাছে কোথাও দেখতে পেলেন না। নির্ঘাত সেই কারখানার কুলিটার সঙ্গে কোথাও ঘুরছে, নচেৎ আর কোথা? আজ তো কলেজের ছুটি।

বাড়ি জানা ছিল, তবু খুঁজে বার করতে কিছু দেরি হয়ে গেল। রাস্তার চেহারাটা একেবারে বদলে গেছে। অনেক দিন যে আসা হয়নি সেটা ধরা পড়লো ওই চেহারাটা দেখে।

মাঝারি একটা গলির মধ্যে পৈতৃক বাড়ি সনৎকাকাদের, সেই গলির মোড়ে অনেকখানিটা জমি পড়ে ছিল বহুকাল যাবৎ। সেটা ছিল পাড়ার বালকবৃন্দের খেলার মাঠ এবং পাড়ার ঝিয়েদের ডাস্টবিন। কষ্ট করে আর কেউ ছাইপাশ-জঞ্জালগুলোকে নিয়ে রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে কর্পোরেশনের ডাস্টবিনে ফেলতে যেতো না, ওই মাঠেই ফেলতো। তাতে যে ছেলেদের খেলার আমোদ কিছুমাত্র ব্যাহত হতো এমন নয়, শুধু খেলার শেষে বাড়ি ফেরার পর মা-ঠাকুমার জামাকাপড় ছাড়, পা ধুয়ে ফেল ইত্যাদি চিৎকারে তাদের শান্তিটা কিঞ্চিৎ বিঘ্নিত করতো।

অনেকদিন পরে এসে দেখলেন অনামিকা দেবী সেই মাঠটায় বিরাটকলেবর একটি ম্যানসন উঠেছে। যাতে অজস্র খোপ। সেই খোপ খোপ কে জানে কতো পরিবার এসে বাসা বেঁধেছে। কে জানে এর মধ্যে থেকেই তারা জীবনের মানে খুঁজে পাচ্ছে কিনা।

তবে আপাততঃ চেনা বাড়িটাও খুঁজে পেতে দেরি হলো ওই বহুখোপবিশিষ্ট আকাশছোঁয়া বাড়িটার জন্যে। তারপর ঢুকে পড়লেন।

হৈ-চৈ করে উঠলেন না সনৎকাকা, খুব শান্ত সহৃদয় হাস্যে বললেন, আয়। তোর অপেক্ষাই করছিলাম।

প্রণাম করে বসে পড়ে ছেলেমানুষের মতো বলে উঠলেন অনামিকা দেবী, অপেক্ষা করছিলেন মানে? আসতে বলেছিলেন নাকি আমায়?

বলিনি? সে কী রে? না বললে এলি কেন? হাসলেন সনৎকাকা।

লজ্জিত হলেন অনামিকা দেবী। বললেন, তারপর, কেমন আছেন বলুন।

খুব ভালো। খাচ্ছি দাচ্ছি বাড়ি বসে আছি, খাটতে-টাটতে হচ্ছে না, এর থেকে আরামদায়ক অবস্থা আর কি হতে পারে?

অনামিকা অবশ্য এই আরামদায়ক অবস্থার খবরে বিশেষ উৎসাহিত হলেন না, বরং ঈষৎ শঙ্কিত গলায় বললেন, কেন, বসে আছেন কেন? বেরোন না?

বেরোবো? কেন? সনৎকাকা দরাজ গলায় হেসে উঠলেন, চলৎশক্তি জুন্মাবার জন্যে যদি একটা বছর লেগে থাকে, সেটা বাদ দিয়েই ধরছি, উনআশী বছর কাল ধরে তো হাঁটলাম বেরোলাম বেড়ালাম, বাকি দিনগুলো ঘরে বসে থাকাই বা মন্দ কি?

ওটা তো বাজে কথা, অনামিকা আরো শঙ্কিত গলায় বলেন, আসল কথাটা বলুন তো! শরীর ভাল নেই?

এই দ্যাখো! শরীর ভাল নেই মানে? ভাল না থাকলেই হলো?

তবে? তবে বাড়ি বসে থাকবেন কেন?

বাঃ, বললাম তো! জীবনের প্রত্যেকটি স্টেজই চেখে চেখে উপভোগ করা দরকার নয়? নীরুকে বললাম, দ্যাখ নীরু, এই হৃদযন্ত্রটা তো বহুকাল যাবৎ খেটে মরছে, এবার যদি ছুটি চায় তো চাক না, ছুটি নিতে দে। তা শুনতে রাজী নয়। ধরে নিয়ে এলো এক ব্যাটা ডাক্তারকে, মোটা ফী, সে তার পাণ্ডিত্য না দেখিয়ে ছাড়বে কেন? ব্যস হুকুম হয়ে গেল নট নড়নচড়ন নট কিচ্ছু। অতএব স্রেফ “গাব্বুপিল” হয়ে পড়ে আছি।

অনামিকা বুঝে নিলেন ব্যাপারটা। আস্তে বললেন, কতোদিন হয়েছে এরকম?

আরে বাবা, হয়নি তো কিছুই। তবে কী করে দিনের হিসেব দেবো? তবে তো কবে থেকে চুল পাকলো, কবে থেকে দাঁত নড়লো, এসব হিসেবও চেয়ে বসতে পারিস। একটা যন্ত্র বহুদিন খাটছে, একদিন তো সেটা বিকল হবেই, তাকে ঘষে মেজে আবার চাকায় জুড়ে দেবার চেষ্টা কি ঠিক? কিন্তু কী আর করা? কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। আপাততঃ যখন নীরুবাবুই কর্তা, তার ইচ্ছাই বলবৎ থাকুক।

নীরুদা বুঝি আবার কলকাতায় বদলি হয়ে এলেন?

বদলি? আরে না না। ও তো রিটায়ার করে দেশে এসে বসলো।

রিটায়ার করে। অনামিকা অবাক হয়ে বলেন, এখুনি?

এখুনি কি রে? সরকারী হিসেব কি ভুল হয়? যথাযথ সময়েই হয়েছে। আমরাই শুধু মনে রাখতে ভুলে যাই দিন এগিয়ে চলেছে।

তাহলে এখন এখানেই, মানে কলকাতাতেই থাকবেন?

তাছাড়া? সনৎকাকা আবার হাসেন, নীরুর সংসারের আবোল-তাবোল আসবাবপত্তরগুলোর সঙ্গে এই একটা অবান্তর বস্তুও থাকবে। যতদিন না–

হেসে থেমে গেলেন।

কলকাতায় এসে আর কোনো ডাক্তার দেখানো হয়েছে?

দ্যা বকুল, যে রেটে কেবলই মনে করিয়ে দিতে চেষ্টা করছিস–কাকা তুমি বুড়ো হয়েছে, কাকা তুমি রুগী হয়ে বসে আছে, তাতে তোকে আর নীরুকে তফাৎ করা শক্ত হচ্ছে। এ প্রসঙ্গয় যবনিকাপাত কর। তোর কথা বল। খুব তো লিখছিস-টিখছিস। দিল্লীতেও নামডাক। নতুন কি লিখছিস বল?

নতুন কি লিখছি?

অনামিকা হাসলেন, কিছু না।

কিছু না? সে কী রে? এই যে শুনি এবেলা-ওবেলা বই বেরোচ্ছ তোর!

খবর তো যতো হাঁটে ততো বাড়ে! অনামিকা আর একটু হাসেন, নশো মাইল ছাড়িয়ে গিয়ে পৌঁছেছে তো খবরটা।

তার মানে, তুই বলছিস খবরটা আসলে খবরই নয়, স্রেফ বাজে গুজব। লিখছিস টিকছিস না!

লিখছি না তা বলতে পারি না, বললে বাজে কথা বলা হবে, তবে নতুন কিছু আর লিখছি কই?

কেন রে? সনৎকাকা একটু চাঙ্গা হয়ে উঠে বসে বলেন, সমাজে সংসারে এত নতুন ঘটনা ঘটছে রোজ রোজ, মুহূর্তে মুহূর্তে সমাজের চেহারা পাল্টাচ্ছে, তবু নতুন কথা লিখতে পারছিস না?

অনামিকা হঠাৎ যেন অন্যমনস্ক হয়ে যান, যেন নিজের সঙ্গে কথা বলেন, হয়তো এই জন্যেই পারছি না। রোজ রোজ যে নতুন নতুন ঘটনা ঘটছে তার হিসেব রাখতে পারছি না, মুহূর্তগুলোকে ধরে যেতে পারছি না, হারিয়ে যাচ্ছে, অন্য রকম হয়ে যাচ্ছে তারা।

ধরতে চেষ্টা করতে হবে, জোর দিয়ে যেন নির্দেশ দিলেন সনৎকাকা।

চেষ্টা করছি, হচ্ছে না। এই মুহূর্তগুলো তো স্থায়ী কিছু দিয়ে যাচ্ছে না, ওরা শুধু সাবানের ফেনার মতো রঙিন বুদবুদ কেটে বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে। আর একদিকে–, একটু যেন ভাবলেন অনামিকা দেবী, আর একদিকে কোথায় যেন চলছে ভয়ানক একটা ভাঙনের কাজ, তার থেকে ছিটকে আসা খোয়া পাথরের টুকরো, উড়ে আসা ধুলো গায়ে চোখে এসে লাগছে, কিন্তু সেই ভয়ানককেই বা ধরে নেব কী করে? তার সঙ্গে তো আমার প্রত্যক্ষের যোগ আছে, যোগ নেই নিকট অভিজ্ঞতায়। আধুনিক, না আধুনিক বলবো না, বলবো বর্তমান সমাজকে তবে আমি কলমের মধ্যে ভরে নেব কী করে? শুনতে পাই অবিশ্বাস্য রকমের সব নাম-না– জানা ভয়ানক প্রাণী জঙ্গল থেকে বেরিয়ে ঘরের মধ্যে এসে ঢুকে পড়ছে, ঘরের লোকের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে, এবং সেই প্রাণীরা তাদের নখ দাঁত শিঙ লুকোবারও চেষ্টা করছে না। বরং ওইগুলোই গৌরবের বস্তু ভেবে সমাজে দেখিয়ে বেড়াচ্ছে। আর ঘরের লোকেরাও তাই দেখে উঠে পড়ে লাগছে নখ দাঁত শিও গাবার কাজে। কিন্তু এ সমস্তই তো আমার শোনা কথা। শোনা কথা নিয়ে লিখতে চেষ্টা করাটা তে হাস্যকর কাকা। অথচ এও শুনতে পাই, ওদের কাছেই নাকি সাহিত্যের নতুন খোরাক, ওদের কাছেই সাহিত্যের নতুন কথা।

সনৎকাকা আস্তে বলেন, বঙ্গভূমি সম্পর্কে একটা মোহ ছিল, সেটা তাহলে আর রাখবো লেছিস?

অমন জোরালো একটা রায় দিয়ে বসবো, এমন সাহস নেই কাকা! আমি তো নিজেই জানি না মোহটা একেবারে মুছে ফেলে দেবার মতো দুঃসময় সত্যিই এসেছে কিনা। তবে মাঝে মাঝে ভাবি, এইটাই কি চেয়েছিলাম আমরা? এইটাই কি আমাদের দীর্ঘদিনের তপস্যার পুরস্কার? বহু দুঃখ, বহু ক্লেশ সয়ে, এই দেবতাকেই জাগালাম আমরা আমাদের ধ্যানের মন্ত্র? তা যদি হয় তো সেটা সেই মন্ত্রেরই ত্রুটি।

তবে সেই কথাই বল্ জোর গলায়। তোরা সাহিত্যিকরা, কবিরা, শিল্পীরা, তোরাই তো বলবি। মানে তোরা বললেই লোকের কানে পৌঁছবে। আমাদের মত ফালতু লোকেরা একযোগে তারস্বরে চেঁচালেও কিছু হবে না। কি না!

অনামিকা হেসে ফেলেন, ওই আশী বছরের বৃদ্ধের এই একটা নেহাৎ ছেলেমানুষি ভঙ্গী। দেখে ভারী কৌতুক অনুভব করেন অনামিকা! হেসে বলেন, কারুর বলাতেই কিস্যু হবে না। সমাজের একটা নিজস্ব গতি আছে, যে গতিটা যাকে বলে দুরন্ত দুর্বার দুর্জয়। এবং তার নিজেরও জানা নেই গতির ছকটা কি। যতো দিন যাচ্ছে, ততই অনুভব করছি কাকা, গোটাতিনেক জিনিসকে অন্ততঃ পরিকল্পনা করে গড়ে তোলা যায় না। সে তিনটে হচ্ছে সমাজ, সাহিত্য এবং জীবন।

এই সেরেছে, মেয়েটা বলে কি! সনৎকাকা একটি বিস্ময়-আতঙ্কের ভঙ্গী করেন, বলিস কি রে! দুটো না হয় না পারা গেল, কিন্তু বাকিটা? সাহিত্যকে পরিকল্পনা মত গড়ে তোলা যায় না? সে তো নিজের হাতে।

আগে তাই ভাবতাম, অনামিকা আবার যেন অন্যমনা হয়ে যান, আগে তাই ধারণাই ছিল। ভাবতাম কলমটা তো লেখকের নিজের আয়ত্তে। কিন্তু ক্রমশই মনে হচ্ছে হয়তো ঠিক তা নয়। কোথাও কোনোখানে কারো একটি গভীর অভিপ্রায় আছে, সেই অভিপ্রায় অনুসারেই যা হবার হচ্ছে।

সর্বনাশ! তুই যে তত্ত্বকথায় চলে যাচ্ছিস। অর্থাৎ সকলই তোমারই ইচ্ছা ইচ্ছাময়ী তারা তুমি!

মাঝে মাঝে তাই মনে হয়। অনামিকা মৃদুস্বরে বলে চলেন, ইচ্ছাময়ী কি অনিবার্য যে নামই দেওয়া হোক, অদৃশ্য একটা শক্তিকে কি আপনি অস্বীকার করতে পারেন কাকা? কবিত্ব করে বললে, জীবনদেবতা। কবির কথাতেও এ কথা বলা হয়েছে, এ কী কৌতুক নিত্য নতুন ওগো কৌতুকময়ী, আমি যাহা চাই বলিবারে তাহা বলিতে দিতেছ কই?

সনৎকাকা মৃদু হেসে যোগ দেন, অন্তর মাঝে বসি অহরহ মুখ হতে তুমি ভাষা কেড়ে লহ, মোর কথা নিয়ে কি যে কথা কহ, এই তাহলে তোর বক্তব্য?

সব সময় না হলেও অনেক সময়ই। অন্তরদেবতাই বলুন, আর অনিবার্যই বলুন, একটা কিছু ঘটনা আছে। সে কোন্ ফাঁকে লেখকের কলমটাকে নিজের পকেটে পুরে ফেলে! সেই জন্যেই বলছিলাম, সাহিত্যের নিজের একটা গতি আছে। সভা ডেকে, আইন করে, অথবা নির্দিষ্ট কোনো ছক কেটে দিয়ে তাকে বিশেষ একটি গতিতে নিয়ন্ত্রিত করা যায় না। আমার তে অন্ততঃ তাই মনে হয়।

তার মানে তোর মতে যে যা লিখছে সবই ওই অদৃশ্য শক্তির ক্রীড়নক হয়ে?

কে কি করে জানি না কাকা, তবে আমি অনেক সময়ই অনুভব করি এটা।

সনৎকাকা মৃদু হাসেন, শুনতে পাই আরো একটা জোরালো শক্তিই নাকি তোদের আজকালের সাহিত্যের নিয়ন্ত্রক! তার শক্তির প্রভাবেই লেখকের কলম—

অনামিকা হেসে ফেলেন, শুনতে তো কিছু বাকি নেই দেখছি আপনার। কিন্তু যত দোষ নন্দঘোষ বললে চলবে কেন? এ ধাঁধ তো চিরকালের–পৃথিবীটা কার বশ?

আহা সে ধাঁধার উত্তর তো সকলেরই জানা। কিন্তু আমরা চাই কবি সাহিত্যিক শিল্পী, এঁরা সে পৃথিবীর বাইরের হবেন। অন্ততঃ সেটাই আমাদের ধারণার মধ্যে আছে।

তেমন হলে উত্তম। কিন্তু তেমন ধারণার কি সত্যিই কোনো কারণ আছে কাকা? সেকালেও মহা মহা কবিরা রাজসভার সভাকবি হতে পেলে কৃতার্থ হতেন। সেটাই তাদের পরম পাওয়ার মাপকাঠি ছিল। আর সেটা আশ্চর্যেরও নয়। পৃথিবীটা যেহেতু টাকার বশ, সেই হেতুই সব কিছুর মূল্য নির্ধারণ তো হয় ওই টাকার অঙ্ক দিয়েই নিজের প্রতি আস্থা আসারও তো ওইটাই মানদণ্ড! তার ওপর আবার সাহিত্য জিনিসটা আজকাল ধান চাল তুলো তিসির মত ব্যবসার একটি বিশেষ উপকরণ হয়ে উঠেছে। অতএব লেখকরাও টাকার অঙ্ক দিয়ে নিজের মূল্য নিরূপণ করতে অভ্যস্ত হবেন এ আর বিচিত্র কী? আর যে লেখা বেশী টাকা আনবে, সেই রকম লেখাকেই কলমে আনবার চেষ্টা করাটাও অতি স্বাভাবিক।

সনৎকাকা ঈষৎ উত্তেজিত গলায় বলেন, তার মানে তুইও ওই টাকার জন্যে লেখাটাকে সমর্থন করিস?

অনামিকা হেসে ফেলে বলেন, সমর্থনের কথা নয় কাকা, সমর্থনের কোনো প্রশ্নই নেই। আমি সেই অনিবার্যের কথাই বলছি। আমার ধারণায় এইটা হলে ওইটা হবেই। আপনি অবশ্যই জানেন, আজ এমন একটা অবস্থা দাঁড়িয়েছে, সমাজের প্রতিটি স্তরের লোক অর্থাৎ প্রতিটি সুযোগ-সন্ধানীই লেখকের কলম ভাঙিয়ে খাচ্ছে। লেখকের কলমই তো বিজ্ঞাপনের বাহন। কাগজের সম্পাদকরা এখন আর লেখক তৈরি করে তোলার দায়িত্বর ধার ধারেন না, ধার ধারেন শুধু সেই লেখকের যার লেখা থাকলে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন আসবে। অতএব প্রতিষ্ঠিত লেখকরা ক্রমশই তাদের ওই বিজ্ঞাপন সংগ্রহের কল হয়ে উঠছেন। আর তার অবশ্যম্ভাবী পরিণাম হিসেবে নতুনরা ওই দরবারে ঢোকবার পথ না পেয়ে লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে উৎকট রঙের উদ্ভট পোশাক গায়ে চাপিয়ে দরবারের দরজায় দাঁড়িয়ে অঙ্গভঙ্গী করে টিন পেটাচ্ছে। জানে এতে লোক জুটবেই। দরবারে ঢুকে পড়তে পারলে তখন দেখানো যাবে প্রতিভা।

অবস্থাটা তো বেশ মনোরম লাগছে রে!

কিন্তু কিছু বাড়িয়ে বলছি না কাকা। নতুন লেখকদের অনেক সংগ্রাম করে তবে প্রতিষ্ঠিত হতে হয়। অনেক নতুন ভঙ্গী, নতুন চমক লাগাতে না পারলে উপায় নেই। আর তারই অনিবার্য প্রতিক্রিয়াতে একবার প্রতিষ্ঠিত হয়ে বসতে পেলে আর কেউ খাটতে চায় না। আর নতুন কথা দেবার চিন্তা থাকে না, চিন্তা থাকে না কি বলবার জন্যে এসেছিলাম। ওই টিন পেটানোটাই যখন সহজ কার্যকরী, আর হাঙ্গামায় কাজ কি! তাছাড়া ওই জিনিসটার ওপর বিশেষ একটা আস্থাও থাকে। দেখেছে যখন ওইটাই দরবারের দরজা খোলার চাবি! আসল কথা কি জানেন কাকা, মননশীলতায় স্থির হতে পারার অবকাশও কেউ দিচ্ছে না শিল্পী সাহিত্যিককে, নির্জন থাকতে দিচ্ছে না। তার সেই স্থিরতার স্বপ্নের মধ্যে ঢুকে পড়ে ভিড় বাড়াচ্ছে।

সনৎকাকা হেসে বলেন, তাতে আর আক্ষেপের কি? তোর মতে তো এ সবই অনিবার্যের হাতের পুতুল!

সেটাও ভুল নয়। তাছাড়া মুশকিল কি, ওই টিন পেটানোদের কাছে লোকে টিন পেটানোই চাইবে। যেমন কৌতুক অভিনেতার কাছে কৌতুক অভিনয় ছাড়া আর কিছু নয়। জীবনে। একবার যে ভাড়ামি করে মরেছে, জীবনে কখনো আর তার সীরিয়াস নায়ক হবার উপায় নেই।

তাহলে তো দেখছি তোদের এই সাহিত্যক্ষেত্রটাও দস্তুরমতো গোলমেলে!

দারুণ গোলমেলে কাকা। নিভৃত চিন্তায় নিমগ্ন হবার গভীর আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়ে উদ্ভ্রান্ত হয়ে বেড়াচ্ছে সবাই।

তোরও তাই অবস্থা নাকি? সনৎকাকা একটু কৌতুকের হাসি হাসেন।

আমার কথা বাদ দিন। অনামিকা বলে ওঠেন, লিখলেই “সাহিত্যিক” হয় না। নিজেকে অন্ততঃ আমি “সাহিত্যিক” শব্দটার অধিকারী ভাবিও না। লেখার অধিকার আছে কিনা একথা ভেবেচিন্তেই একদা লিখতে শুরু করেছিলাম, এখন দেখি পাঠকরাই অথবা সম্পাদকরাই লেখাচ্ছেন। এর বেশী কিছু নয়। তবে ইচ্ছে করে নতুন কিছু লিখি, বিশেষ কিছু লিখি, হেসে ওঠেন অনামিকা, তা সেই বিশেষের ক্ষমতা থাকলে তো? সত্যিই বলবো কাকা, এ যুগকে আমি চিনি না। চেনবার চেষ্টা করবো এমন পরিবেশও নেই। এ যুগ সম্পর্কে যেসব ভয়াবহ চিত্র শুনি অথবা পড়ি সেটা বিশ্বাস করতে পেরে উঠি না।

কিন্তু–, সনৎকাকা আস্তে বলেন, অনেক ক্ষেত্রেই তো “বাস্তব” বস্তুটা কল্পনার থেকেও অবিশ্বাস্য!

হয়তো তাই। আবার যেন কেমন অন্যমনা হয়ে যান অনামিকা, তার সত্য সাক্ষী পুলিসের রিপোর্ট, ডাক্তারের রিপোর্ট। কিন্তু সাহিত্যিকও কি সেই সত্যেরই সাক্ষী হবে? সাহিত্যিকও কি এই সত্য উদঘাটনের কাজে কলম ধরবে? জানোয়ারের সঙ্গে মানুষের তফাৎ শুধু বাইরের চেহারাটায়! অন্য কোনো তফাৎ আছে কিনা সে সন্ধান না করেই হেসে বলে উঠবে, আরে বাবা থাক, তফাৎ থাকবে কেন? এখানেও রক্তমাংস, ওখানেও রক্তমাংস। রক্তমাংস ব্যতীত আর কোথায় কি?

এই প্রশ্নটাই আজকাল খুব প্রবল হয়েছে, তাই না রে?

খুব! হয়তো অনবরত ওইটা শুনতে শুনতে ওটাই বিশ্বাসের বস্তু হয়ে দাঁড়াবে।

সনৎকাকা দৃঢ়স্বরে বলেন, উঁহু, লোকে তো অনবরত নতুন কথা শুনতে চাইবে, এ কথা আর কতদিন নতুন থাকবে? মানুষ নামের জীবটা তো বাঘসিংহীর মতো অত বড়োও নয়, মাত্র সাড়ে তিন হাত দেহখানা নিয়ে তো তার কারবার! তার রক্তমাংস ফুরোতে কতক্ষণ?

সেই তো কথা। সেইটাই তো ভাবি। ওপরদিকে অনন্ত আকাশ, নিচের দিকে পা চাপালেই কায় পা। কোনটা সত্য?

না, যা বুঝছি তোর দ্বারা আর নতুন কথা লেখা হবে না! সনৎকাকা হাসেন।

হয়তো তাই। হাসেন অনামিকাও, অন্যমনস্কের হাসি। তারপর বলেন, মানুষের সংজ্ঞা যে শুধু জীব মাত্র, শিব শব্দটা যে অর্থহীন, এর প্রমাণ যখন এখনো স্পষ্ট পাইনি, তখন হবে নাই মনে হয়। তবে এটাও ঠিক কাকা, যা আমার অজানা, তা নিয়ে লিখতে গেলে পদে পদে ভুলই হবে সেটা জানি। আমার তো ভাবলে অবাক লাগে–

কথায় বাধা পড়ে।

সনৎকাকার ভাইপো-বৌ এসে দাঁড়ান। বলেন, ওষুধ খাওয়ার সময় হয়েছে কাকামণি।

কোমল মধুর কণ্ঠ। মায়ের আদর ভরা। মনে হলো যেন একটি শিশুর কাছে এসে কথা বললেন।

সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠলেন অনামিকা, কারণ উত্তরে পরক্ষণেই সত্যসত্যই যেন একটি শিশুর কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন তিনি।

নাঃ, এই নির্ভুল হুঁশিয়ার মা-জননীটির কাছ থেকে বুড়ো ছেলেটার আর ছাড়ান-ছোড়ান নেই। দাও কোথায় কি ওষুধ আছে তোমার?

কে বললো কথাটা? সনৎকাকা? হ্যাঁ, তিনিই বটে।

অথচ অনামিকার কানে যেন ভয়ঙ্কর রকমের অপরিচিত লাগলো স্বরটা। স্বর, সুর, ভঙ্গী।

সর্বদা যারা সাজিয়ে গুছিয়ে ছেঁদো-ছেঁদো কথা বলে, ঠিক যেন তাদের মতো। অনামিকার খারাপ লাগলো, খুব খারাপ লাগলো, অথচ এমন কি আর ঘটেছে এতে খারাপ লাগার মত?

যে মহিলাটি তার একজন বৃদ্ধ গুরুজনকে স্নেহ-সমাদর জানাতে মহিমাময়ী মাতৃমূর্তিতে কাছে এসে দাঁড়িয়ে স্রেফ মায়ের গলাতেই জানালেন ওষুধ খাবার সময় হয়েছে, তার কণ্ঠস্বর সুরেলা, মুখশ্রী সুন্দর, সাজসজ্জা গ্রাম্যতা-বর্জিত, এবং সর্ব অবয়বে একটি মার্জিত রুচির ছাপ।

এঁর সঙ্গে কথা বলতে হলে তো ওই রকম গলাতেই বলা উচিত। মহিলাটি যদি তার পূজনীয় গুরুজনটির দ্বিতীয় শৈশবের কালের কথা স্মরণ করে তার সঙ্গে শিশুজনোচিত ব্যবহার করেন, গুরুজনটির কি শ্বশুরমোচিত ব্যবহার সঙ্গত?

তবু অনামিকার খারাপ লাগলো। সত্যিই খুব খারাপ।

মহিলাটি যেন এতক্ষণে অনামিকাকে দেখতে পেলেন, তাই ওষুধের শিশি গ্লাস টেবিলে নামিয়ে রেখে দুই হাত জোড় করে ঈষৎ নমস্কারের ভঙ্গীতে সৌজন্যের হাসি হেসে বললেন, শুনেছি আপনি আমার স্বামীর ছোট বোন, তবু কিন্তু আপনি করে ছাড়া কথা বলতে পারবো। না

হঠাৎ এরকম অদ্ভুত ধরনের কথায় বিস্ময়ের সঙ্গে কৌতুক অনুভব করলেন অনামিকা। মৃদু হেসে প্রতিনমস্কার করে বললেন, কেন বলুন তো?

মহিলাটি অবসরপ্রাপ্ত স্বামীর স্ত্রী, এবং দ্বিতীয় পক্ষও নয়, কাজেই নিতান্ত তরুণীর পর্যায়ে পড়েন না, তবু নিতান্ত তরুণীর গলাতেই সভয় সমীহে বলে উঠলেন, বাবা, আপনি যা একজন ভীষণ বড় লেখিকা! উঃ, আপনার সঙ্গে তো কথা বলতেই ভয় করে।

সনৎকাকার ভাইপো-বৌয়ের উচ্চারণ স্পষ্ট মাজা, প্রতিটি শব্দ যেন আলাদা আলাদা করে উচ্চারিত। কথা বস্তুটা যে একটি আর্ট, এ বোধ যে আছে তার তাতে সন্দেহ নেই। একজন ভীষণ বড় লেখিকার সঙ্গে কথা বলছেন বলেই কি ভাইপো-বৌ এমন কেটে ছেঁটে মেজে ঘষে কথা বললেন, না এই ভাবেই কথা বলেন?

হয়তো তাই বলেন।

হয়তো এইটাই ওঁর নিজস্ব ভঙ্গী; তবু কেনই যে অনামিকার মনে হলো অনেকদিনের চেষ্টায় উনি ওই কথা বলার আর্টটি আয়ত্ত করেছেন।

ভাইপো-বৌয়ের শাড়ি পরার ধরনটি ছিমছাম, চুলগুলি সুছাদের করবীতে সুবিন্যস্ত, গায়ে হালকা দু’একটি অলঙ্কার, চোখের কোণে হালকা একটু সুর্মার টান, পায়ে হালকা একজোড়া চটি, শাড়ির জমিটা ধরা যায়-কি-না-যায় গোছের হালকা একটু ধানীরঙের, এবং চশমার ফ্রেমও হালকা ছাই-রঙা।

অর্থাৎ, সব মিলিয়ে একটি হালকা ওজনের তরুণীই লাগল তাকে।

অনামিকা হেসে বললেন, বড় লেখিকা এই শব্দটাকে অবশ্য আমি মেনে নিচ্ছি না, তবু প্রশ্নটা হচ্ছে যদি কেউ কোনো ব্যাপারে বড়ই হয়, বাড়ির লোকেরাও কি তাকে সমীহ করবে?

ওরে বাবা তা আবার বলতে! ভাইপো-বৌ হেসে ওঠেন, এই তো আপনার দাদা যখন বড় অফিসার ছিলেন, ভীষণ বিগ অফিসার, তখন আমি তো একেবারে ভয়ে কাটা হয়ে থাকতাম। খিলখিল করে হেসে ওঠেন ভাইপো-বৌ, আর সেই হাসির সঙ্গে এমন লীলা বিচ্ছুরিত হয়, ওই বিগ অফিসারদের গৃহিণীদেরই মানায়।

এই ভঙ্গীতেই উনি হয়তো বলতে পারেন, বাড়ি সারাবো? কোথা থেকে? খেতেই কুলোয় তো বাড়ি।

সখী-সামন্ত নিয়ে যখন বসেন এরা, তখনো ওই বাজারদর দিয়েই আক্ষেপ যেন হয়তো এমনি লীলাভরে।

অনামিকা ওই লীলাহাস্যমণ্ডিত মুখের দিকে তাকিয়ে বলেন, এখন আর ভয় করেন না। তো?

উহু। আর করবো কেন? এখন তো বেকার!

সনৎকাকা বলে ওঠেন, দেখছিস তো বকুল, মেয়েটা কী সাংঘাতিক!

অনামিকা বলেন, দেখছি বৈকি।

হ্যাঁ, দেখছেন। দেখতে পাচ্ছেন ওঁর ওই সাংঘাতিক মহিমায় সনৎকাকা সুদ্ধ সাজিয়ে কথা বলতে শিখেছেন। হয়তো শিখতে সময় লেগেছে, হয়তো শিখতে বিরক্তিই এসেছে, তবু শিখেছেন।

কিন্তু শেখার কি সত্যই দরকার ছিল? কে জানে, হয়তো বা ছিল। পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না শিখলে তো প্রতিপদেই আবহাওয়া বিষময় হয়ে ওঠে।

দিল্লিতেও তো আপনার খুব নামডাক। ওষুধটি ঢেলে দিয়ে ওষুধ মাপা গলায় ওই মন্তব্যটি করলেন ভাইপো-বৌ।

অনামিকা মৃদু হেসে বলেন, তবে তো আর নিজেকে বড় লেখিকা না ভেবে উপায় নেই।

সনৎকাকা অনামিকার মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাস্যে বলেন, করতে হলে তো স্বীকার তাহলেই বল মেয়েটাকে “সাংঘাতিক” বলতে হয় কিনা? আমার কাছে তো এতোক্ষণ স্বীকার করছিলিই না। মা-জননীদের কী যেন একটি সমিতি আছে, তার লাইব্রেরীতে তোর কত্তো বই আছে, তাই না মা-জননী?

ভাইপো-বৌ স্মিতহাস্যে বলেন, হ্যাঁ, আছে কিছু কিছু। আমিই কিনিয়েছি। লাইব্রেরীর সব কিছুর ভার আমার ঘাড়েই চাপিয়ে রেখেছে তো!

অনামিকার মুখে আসছিল, যাই ভাগ্যিস আপনি আমার একটি বৌদি ছিলেন রাজধানীতে, তাই আমার লেখা “কিছু কিছু” বইয়ের প্রবেশাধিকার ঘটেছে রাজধানী হেন ঠাইতে! তা মুখে আসা কথাটাকে আর মুখের বাইরে আনলেন না, বললেন, পড়েছেন তা হলে আমার লেখা?

ভাইপো-বৌ আর একবার লীলাভরে হাসলেন, ওই প্রশ্নটি করলেই উত্তর দেওয়া মুশকিল। আমি আবার ধৈর্য ধরে বসে বসে গল্প-উপন্যাস পড়তেই পারি না। তাছাড়া

ভাইপো-বৌ ওষুধের গ্লাস শিশি যথাস্থানে রাখতে রাখতে বলেন, তাছাড়া আজকালকার বইটই তো পড়ারই অযোগ্য।

পড়ারই অযোগ্য?

ভাইপো-বৌয়ের বক্তব্যটি অনুধাবন করবার আগেই প্রশ্নটি যেন স্খলিত হয়ে পড়ে অনামিকা দেবীর কষ্ট থেকে।

ভাইপো-বৌ তার হালকা চটি পরা একটি পা টেবিলের পায়ায় তালে তালে ঠক ঠক করতে করতে বললেন, তাই তো শুনি! ভীষণ নাকি অশ্লীল!

শোনেন! তবু ভালো! অনামিকা মৃদু হাসেন, ভাগ্যিস পড়েন না!

ভাইপো-বৌয়ের হাস্যরঞ্জিত মুখটা মুহূর্তে যেন কাঠ হয়ে যায়, গম্ভীর মুখে বলেন, রুচিও নেই। যে সব বই নিয়ে আদালতে কেস ওঠে, সে-সব বই যে মানুষ কী করে পড়ে।

আমিও তো তাই বলি, সনৎকাকা মৃদু হাস্যে বলেন, তোমার ওই মহিলা সমিতির মহিলারা যে কী বলে কেবলই আধুনিক সাহিত্য পড়বার জন্য অস্থির হন।

ভাইপো-বৌ একবার তার শ্রদ্ধেয় গুরুজনটির দিকে কটাক্ষপাত করেন, মুখটা আর একটু কাঠ হয়ে যায়, চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ান তিনি, সকলের রুচি সমান নয় বলে।

চেয়ারটা ঠিক করেন, ঘর থেকে বেরিয়ে যান।

আর সেই মুহূর্তেই অনুভব করেন অনামিকা, সনৎকাকার কণ্ঠে অমন একটা অপরিচিত সুর শুনতে পেয়েছিলেন কেন?

ভাইপো-বৌ চলে যাবার পর সনৎকাকা মৃদু হেসে বলেন, বুদ্ধিমানের ধর্ম অ্যাডজাস্ট করে চলা, কী বলিস?

অনামিকা কিছু বলেন না, শুধু তাকিয়ে থাকেন ওঁর হাস্যরঞ্জিত মুখের দিকে।

কীরে, অমন করে হাঁদার মত তাকিয়ে আছিস কেন?

দেখছি!

কী দেখছিস?

কিছু না।

সনৎকাকা আর কিছু বলতেন হয়তো, হঠাৎ ঘরে ঢোকেন সনৎকাকার ভাইপো, যার পুরো নামটা জানাই নেই অনামিকার। নীরুদা বলেই জানেন।

নীরুদার পরনে গাঢ় রঙের সিল্কের লুঙ্গি, গায়ে একটা টেস্ গেঞ্জি, হাতে টোব্যাকোর টিন। স্ত্রীর সম্পূর্ণ বিপরীত ভঙ্গীতে একেবারে হৈ চৈ করতে করতে ঢোকেন তিনি, আরে আমাদের কী ভাগ্য! শ্রীমতী লেখিকা দেবীর আগমন! তারপর আছো কেমন? বাড়ির সব খবর কি? খুব তো লিখছো-টিখছে!

অনামিকা বলেন, একে একে জবাব দিই, কেমন? আছি ভালো, বাড়ির খবর ভালো, লিখছি অবশ্যই, তবে “খুব” কিনা জানি না।

জানো না কি! শুনতে পাই তুমি নাকি দারুণ পপুলার! মেয়েরা নাকি তোমার লেখার নামে পাগল!

অনামিকা হেসে ফেলে বলেন, মেয়েরা তো? মেয়েদের কথা বাদ দাও। ওরা কিসে না পাগল হয়?

তা যা বলেছে–, নীরুদা হো হো করে হেসে ওঠেন, খুব খাঁটি কথা। শাড়ি দেখলো তো পাগল, গহনা দেখলে তো পাগল, লোকের গাড়ি-বাড়ি দেখলো তো পাগল। সিনেমার নামে পাগল, খেলা দেখার নামে পাগল। বাজার করতে পাগল, বাপের বাড়ির নামে পাগল, এমন কি একটা উলের প্যাটার্নের জন্যও পাগল। তাছাড়া রাগে পাগল, সন্দেহে পাগল, অভিমানে পাগল, অহঙ্কারে পাগল, অপরের ওপর টেক্কা দেবার ব্যাপারে পাগল, মোট কথা নেচার ওদের আধাআধি পাগল করেই পাঠিয়েছে, বাকিটা ওরা নিজে নিজেই–

মেয়েদের তো তুমি অনেক স্টাডি করেছে নীরুদা? অনামিকা হাসেন, লিখলে তুমিও সাহিত্যে নাম করতে পারতে।

লিখলে?

নীরুদা উদাত্ত গলায় বলে ওঠেন, দরকার নেই আমার অমন নাম করার। দেশের ছেলেগুলোকে বখিয়ে সমাজকে উচ্ছন্ন দিয়ে জাতির সর্বনাশ করে নাম আর পয়সা করা হচ্ছে। এই সিনেমাগুলো হচ্ছে, কী থেকে এর উৎপত্তি? ওই তোমাদের সাহিত্য থেকেই তো? কী ঘটছে তা থেকে? ছেলেগুলো ওই থেকেই অসভ্যতা অভব্যতা খুনোখুনি রাহাজানি শিখছে না?

সনৎকাকা হেসে ফেলে বলে ওঠেন, শুনলি তো? এবার কী জবাব দিবি দে!

জবাব দেবার কিছু থাকলে তো? অনামিকা হাসলেন, জবাব দেয়া নেই, স্রেফ কাঠগড়ায় আসামী যখন। আর সিনেমার গল্পকেও যদি সাহিত্য বলে ধরতে হয়, তাহলে তো ফাঁসির আসামী!

বলে ফেলেই অনামিকা ঈষৎ ভীত হলেন, এর মুখেও সঙ্গে সঙ্গে কাঠের চাষ হবে না তো?

কিন্তু ভীতিটা অমূলক নীরুদা বরং আরো বীরদর্পে বলে ওঠেন, তা সাহিত্য নয় কেন? সাহিত্যিকদের লেখা গল্প-টল্পই যখন নেওয়া হচ্ছে।

তা বটে।

হুঁ বাবা! স্বীকার না করে উপায় আছে? নীলা কাকার সামনেই টোব্যাকোর টিন ঠুকে কুচো তামাক বার করে একটা সিগারেট বানাতে বানাতে বলেন, তা তোমার গল্প-টল্পও তো শুনেছি সিনেমা হয়, তাই না?

অনামিকা লক্ষ্য করলেন, নীরুদা আর তাকে ‘তুই’ করে কথা বলছেন না, অথচ আগে বলতেন। তুই ছাড়াই বলতেন না বরং। তার মানে এখন সমীহ করছেন। নাকি দীর্ঘদিন দূরে থাকার দূরত্ব? কিন্তু তাই কী হয়? কই সনৎকাকা তো তাকে ‘তুমি’ বলতে বসলেন না!

বেদনা অনুভব করলেন অনামিকা।

আত্মীয়জন সমীহ করছে, এটা পীড়াদায়ক। অথচ অনেক ক্ষেত্রেই এটা ঘটতে দেখেন। পুরোনো সম্পর্কের সহজ ভঙ্গীটি যেন খুঁজে পান না। নেহাৎ যারা বাড়ির লোক তারাও কি মাঝে মাঝে এমন দূরত্ব দেখায় না? যেন বকুল নামের মেয়েটা অন্য নামের ছদ্মবেশ পরে অন্যরকম হয়ে গেছে।

অতএব তারাই বা অন্যরা হয়ে যাবে না কেন?

অথচ এই নামটার সম্পর্কে তাদের অনাগ্রহের শেষ নেই, জানবার ইচেছর লেশ নেই। শম্পা বাদে, বাড়ির আর সকলে অনামিকা দেবীর বহির্জীবন এবং কর্মকাণ্ড সম্পর্কে শুধু উদাসীনই নয়, যেন বিদ্বিষ্ট। তাদের কথার সুরে কণ্ঠস্বরের ভঙ্গীতে অনেক সময়ই মনে হয়, অনামিকা বুঝি স্রেফ সংসারকে ফাঁকি দেবার জন্যেই দিব্যি একটি ছুতো আবিষ্কার করে নিয়ে মনের সুখে স্বাধীনতা উপভোগ করছে। যেন বকুলের যেটি প্রাপ্য নয়, সেটি ওই কৌশলটি করে লুটে নিচ্ছে বকুল।

অনামিকা কি লিখছেন, কতো লিখছেন, কোথায় লিখছেন, এ ব্যাপারে কারো মাথাব্যথা নেই, অনামিকা যে বিনা পরিশ্রমে শুধু কাগজের উপর কতকগুলো আঁকিবুকি টেনে অনেকগুলো টাকা পেয়ে যান, সেইটা নিয়েই কোনো এক জায়গায় ব্যথা। সেই টাকার সুযোগ যারা গাছে–ষোলো ছেড়ে আঠারো আনা, তাদেরও।

না, অনামিকার দাদা-বৌদিরা হাত পেতে কোনো খরচা নেন না অনামিকার কাছ থেকে, কিন্তু অনামিকারই বা ওরা ছাড়া আর কে আছে? কোথায় করবেন খরচ? দূর সম্পর্কের দুঃস্থ আত্মীয়জন? হয়তো কিছুটা করতে হয় সেখানে, কিন্তু তাতে পরিতৃপ্তি কোথায়?

কিন্তু ওই রূঢ় রুক্ষ কথাটা থাক, অভিমানের আরো ক্ষেত্র আছে বৈকি। অনামিকার সাহিত্যের ব্যাপারে একেবারে বরফ শীতল হলেও, বাইরে অনামিকার অসাক্ষাতে যে ওরা অনামিকার নিতান্ত নিকটজন বলে পরিচিত হতে পরম উৎসাহ, সে তথ্য অনামিকার অবিদিত নেই।

হয়তো জীবন এই রকমই। এতে আহত হওয়াটাই নির্বুদ্ধিতা। অনামিকা যখন তার পরিচিত বন্ধু সমাজের দিকে তাকিয়ে দেখেন, তখন এই অনুভূতিই স্পষ্ট হয়ে ওঠে–জীবন এই রকমই।

মানুষের সম্পর্কে মর্যাদাবোধ নেই, শুধু ভাঙিয়ে খাবার মতো মানুষকে ভাঙিয়ে খাওয়ার চেষ্টাটা আছে প্রবল। আজকের দিনের সব থেকে বড় শিল্প বোধ করি মানুষ ভাঙিয়ে খাওয়ার শিল্প।

যদি অনামিকা নামের মানুষটাকে ভাঙিয়ে কিছুটা সুবিধে অর্জন করে নিতে পারা যায়, তবেই সেই অর্জনকারীরা অনামিকার অনুরক্ত ভক্ত বন্ধু। কিন্তু অনামিকা ভালই জানেন যে মুহূর্তে তিনি ওই ভাঙিয়ে খাওয়াটা বুঝতে পারছেন সেটা জানতে দেবেন, সেই মুহূর্তে সকলের সব ভক্তি নিশ্চিহ্ন।

আর নিজে যদি তিনি প্রত্যাশার পাত্র হাতে নিয়ে একবার বলে বসেন, আমায় তো অনেক ভাঙালে, এবার আমার জন্যে কিছু ভাঙো না, তা হলেই লজ্জায় ঘৃণায় দুঃখে ধিক্কারে বন্ধুরা সহস্র যোজন দূরে সরে যাবেন!

হ্যাঁ, এই পৃথিবী।

তুমি যদি বোকা হও, অবোধ হও, আত্মস্বার্থে উদাসীন হও, বন্ধুর গুণগুলি সম্পর্কে চক্ষুষ্মান আর দোষগুলি সম্পর্কে অন্ধ হও, তুমি যে পৃথিবীর সব কিছু ধরে ফেলতে পারছ, সেটা ধরতে না দাও, তবেই তোমার বন্ধুজন তোমার প্রতি সহৃদয়।

নচেৎ? হৃদয়বর্জিত!

এই তো এখনই দেখো, এই নীরুদা নামের বিজ্ঞ বয়স্ক এবং আপন প্রাক্তন পদমর্যাদা সম্বন্ধে যথেষ্ট অবহিত আত্মীয়টি, অনায়াসেই ইনি ছেলেমানুষের মতো ওজনহীন উক্তি করছেন, কিন্তু তার উক্তি যে ছেলেমানুষী ও কথা একবার উচ্চারণ করুন দিকি অনামিকা দেবী?

সঙ্গে সঙ্গেই যে উনি ভিন্ন মূর্তি ধারণ করবেন, তাতে সন্দেহ নাস্তি। যেমন করলেন ওঁর স্ত্রী। তিনি হয়তো শিরিষ কুসম সম অতি সুকুমার, ইনি হয়তো তার থেকে কিছুটা সহনশীল, কিন্তু কলসীর মধ্যে গোখরো আছেই।

অতএব হাস্যবদনে উপভোগ কর ওঁর ছেলেমানুষী! অতএব বলে ফেলো, ও বাবা, তোমার ওই বিরাট কর্মচক্রের ঘর্ঘর ধ্বনির মাঝখানেও এতো খবর পৌঁছেছে তোমার কাছে? অতো দূরে থেকে?

পৌঁছবে না?

নীরুদা খুব একটা উচ্চাঙ্গের রসিকতার হাসি হেসে বলে ওঠেন, মোর সুখ্যাতিতে তো কান পাতা নয়। যাক, তুমি যে ওই সব আধুনিক লেখকদের মতো অশ্লীল-অশ্লীল লেখা লেখো না এতেই আমাদের পক্ষে বাঁচোয়া।

অনামিকা মনে মনে হাসলেন। ভদ্রলোক হয়তো তাবৎ জীবনকাল উচ্চ রাজকর্মচারী হিসেবে যথেষ্ট কর্মদক্ষতা দেখিয়ে এসেছেন, হয়তো সূক্ষ্ম দর্শন ক্ষমতায় অধস্তনদের চোখে সর্ষেফুল এবং ঊধ্বতনদের চোখে নিস্কৃতির আলো ফুটিয়ে এসেছেন, কিন্তু সংসারক্ষেত্রে যে আর একজনের চোখ দিয়ে জগৎ দেখে আসছেন, তাতে সন্দেহ নেই।

এ একটা টাইপ। বশংবদ স্বামীর উদাহরণ।

যাক, কথাবার্তাগুলো কৌতুককর।

তাই হাসি-মুখে উত্তর দেন অনামিকা, আমি যে ওই সব মারাত্বক লেখা লিখি না সে কথা কে বললে তোমায়?

আহা ওটা আবার একটা বলবার মতো কথা নাকি? তুমি ওসব লিখতেই পারবে না। হাজার হোক ভদ্রঘরের মেয়ে তো? আমাদের ঘরের মেয়ে! কচি অমন কু হতে যাবে কেন?

তা বটে।

অনামিকা অমায়িক গলায় সায় দেয়, সে কথা সত্যি। তাছাড়া আমি তো আর আধুনিক নই।

বয়সের কথা বলছো? নীরুদা উদাত্ত গলায় বলেন, সেটা আর আজকাল মানছে কে? যতো রাজ্যের বুড়োরাও তো শিং ভেঙে বাছুরের দলে ঢুকছে শুনছি। কী এরা? সমাজের শত্রু নয়? হয়তো এরাই কলেজের প্রফেসর-ট্রফেসর, হয়তো সমাজের মাথার মণি, অথচ স্রেফ পয়সার লোভে কদর্য-কদর্য লিখে

কথাটার উপসংহারটা বেশ জুৎসই করবার জন্যেই বোধ হয় নীরুদা একবার দম নিলেন, সেই অবকাশে অনামিকা খুব নিরীহ গলায় প্রশ্ন করলেন, আর কার লেখা তোমার এতো কদর্য লাগে নীরুদা?

কার আর? নীরুদা সুপুরি একগালে দেওয়ার সুরে বলেন, কার নয়? একধার থেকে সবাইয়ের। আজকাল কোন্ লেখকটা সভ্যভব্য লেখা লিখছে? লিখবে কেন? আজকাল তো অসভ্য লেখাতেই পয়সা। তাই না? যে বই অসভ্যতার দায়ে কোর্টে উঠবে, সেই বইয়ের তো এডিশন হবে।

অনামিকা মৃদু হেসে বলেন, কোর্ট ওঠেনি, এমন বইয়েরও অনেক সংস্করণ হয়। হতে পারে। আমি তার খবর-টবর রাখি না।

ও তাই বুঝি! শুধু এইসব আধুনিক সাহিত্যই পড়ো বুঝি খুব?

পড়ি? আমি?

নীরুদা যেন আকাশ থেকে পড়েন, আমি ছোঁবো ওই নোংরা অপবিত্র দুর্গন্ধ বই? রাবিশ! মলাটও উল্টে দেখিনি কারুর। আমার হাতে আইন থাকলে এইসব লেখকদের একধার থেকে জেলে পুরতাম, বুঝলে? যাবজ্জীবন কারাদণ্ড! ইহজীবনে যাতে আর কলম না ধরতে পারে বাছাধনেরা।

উত্তর দেবার অনেক কথা ছিল অবশ্য, তবে সেটা তো অর্থহীন। সেই নিরর্থক চেষ্টায় গেলেন না অনামিকা, শুধু খুব একটা ভীতির ভান দেখিয়ে বললেন, ওরে বাবা! ভাগ্যিস নেই! তাই বেচারীরা খেয়ে পরে বেঁচে আছে।

যার চোখ দিয়ে জগৎ দেখেন নীরুদা, তার মতো অনুভূতির সূক্ষ্মতা যে অর্জন করে উঠতে পারেননি নীরুদা এটা ঠিক। তাই শ্লেষের সুরে বলেন, শুধু খেয়ে পরে, গাড়ি-বাড়ি করে নয়? অথচ চিরদিনই শুনে এসেছি সরস্বতীর সঙ্গে লক্ষ্মীর বিরোধ। মাইকেল পয়সার অভাবে বই বেচে খেয়েছেন, গোবিন্দদাস না কে যেন না খেয়ে মরেছেন! গানেও আছে, হায় মা যাহারা তোমার ভক্ত, নিঃস্ব কী গো মা তারাই তত! অথচ এখন?

এতক্ষণ কৌতুকের হাসি মুখে মাখিয়ে নিঃশব্দে এই আলাপ-আলোচনা শুনে যাচ্ছিলেন সনৎকাকা, এখন হঠাৎ একটু যোগ দিলেন। বললেন, আহা হবেই তো। এঁরা তো আর মা সরস্বতীর ভক্ত নয়, ভক্ত হচ্ছেন দুই সরস্বতীর, কাজেই লক্ষ্মীর সঙ্গে বিরোধ নেই। কী বলিস বকুল?

তাই মনে হচ্ছে, অনামিকা হেসে ফেলে বলেন, কিন্তু যাই বলো নীরুদা, সরকারের অতোবড়ো একটা দায়িত্বের জোয়াল কাঁধে নিয়েও যে তুমি সাহিত্য নিয়ে এত ভেবেছো, চর্চা রেখেছে, এটা আশ্চর্যি! এমন কি এতো সব মুখস্থ-টুখস্থ রাখা—

চর্চা রাখতে দায় পড়েছ-, নীরুদা সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে অম্লান বদনে বলেন, তোর বৌদি বলে তাই শুনি। ও তো বলে-নাটক-নভেল গল্প-টল্প একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে যদি দেশের কিছু উন্নতি হয়! জিনিসপত্রগুলো কি? কতকগুলো বানানো কথা মাত্র, তাছাড়া আর কিছু? ওদের মেয়ে এদের ছেলের সঙ্গে প্রেম করলো, নয়তো এর বৌ ওর সঙ্গে পালিয়ে গেল, এই তো ব্যাপার! এই নিয়েই ফেনিয়ে ফেনিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে সাতশো পাতার বই, কুড়ি টাকা দাম, দশটা এডিশন, একটা ক্লাস ওয়ান অফিসারের থেকে বেশী আয় আজকাল নামকরা লেখকের! রাবিশ!

অনামিকার হঠাৎ মনে হয় গাত্রদাহটা বোধ হয় ওই আয়টাকে কেন্দ্র করেই এবং সহসা হাতের কাছে একটা ঘোরতর পাপীকে পেয়ে

চিন্তার ছেদ পড়লো।

সুদৃশ্য একটা ট্রে হাতে ঝাড়ন কাঁধে একটি ভৃত্যের আবির্ভাব ঘটলো। বলা বাহুল্য ট্রে-তে অনামিকার জন্য চা এবং টা!

নীরুদা একটু নড়েচড়ে বসলেন। একটু যেন অসহায়-অসহায় এবং অপ্রতিভ-অপ্রতিভ ‘গলায় বললেন, মেমসাহেব কোথায়?

ভৃত্যের গলায় কিন্তু গভীর আত্মস্থতা।

ঘরে আছেন। মাথা ধরেছে।

মাথা ধরেছে! এই সেরেছে!

নীরুদা চঞ্চল হয়ে ওঠেন, ওই একটি ব্যাধি সঙ্গের সাথী বেচারার। সনৎকাকা উদ্বিগ্ন গলায় বলেন, যা দিকিন দেগে তো একবার।

না, দেখবো আর কি, নীরুদার কণ্ঠস্বর স্খলিত, ও তো আছেই।

তারপর যেন জোর করেই নিজেকে চাঙ্গা করে নিয়ে বলেন, আচ্ছা বকুল, কাকাকে কেমন দেখছো বল?

ভালই তো।

তা এখন অবশ্য ভালই তো বলবে। যা অবস্থা হয়েছিল, আর যে ভাবে এই ভালর পর্যায়ে রাখা হয়েছে! কথা তো শুনতেই চাইতেন না। আর্গুমেন্টটা কী জানো? এতো সাবধানে সাবধানে নিজেকে জিইয়ে রেখে আরো কিছুদিন পৃথিবীতে থাকবার দরকারটা কী? বোঝ? শুনেছো এমন কথা? তোমার বইতে আছে এমন ক্যারেক্টার?

তাই নেই। অনামিকা ঈষৎ গভীর সুরে বলেন, সাধ্য কি যে এ ক্যারেক্টারকে আঁকি?

নীরুদা খোলা গলায় বলেন, অসাধ্য হবে না যদি আমার কাছে দু’দিন বসে ডিক্টেশান নাও। উঃ! তবে হ্যাঁ, একটি জায়গায় স্রেফ জব্দ।

এক ঝলক হাসিতে নীৰুদার মুখ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে, বৌমাটির কাছে তার ট্যা-ফোঁটি চালাতে পারেন না। বললে তুমি বিশ্বাস করবে না বকুল, এখন কাকার আমার রাতদিন মা জননী ছাড়া

হঠাৎ কেমন যেন চাঞ্চল্য বোধ করেন নীরুদা। বোধ করি শিরঃপীড়াগ্রস্ত সেই বেচারীর পীড়ার কথা সহসা হৃদয়ে এসে ধাক্কা মারে।

উঠে পড়েন উনি। কই তুমি তো কিছুই খেলে না, স্যাণ্ডুইচটা অদ্ভুতঃ খাও বলেই শিথিল চরণে চটি টানতে টানতে এগিয়ে যান।

সনৎকাকা কয়েক সেকেণ্ড সেই দিকে তাকিয়ে থেকে মৃদু হেসে বলেন, ছেলেটার জন্যে দুঃখ হয়।

সে কী কাকা! অনামিকা গালে হাত দেন, নিজে তো উনি সুখের সাগরে ভাসছেন!

সেটাই তো আরো দুঃখের।

সনৎকাকার কথাটা কি ধাঁধা? না খুব সোজা? জলের মতো একেবারে?

যারা সুখের সাগরে ভাসছে, তাদের জন্যেই চিন্তাশীলদের যতো দুঃখ! তাদের দুঃখবোধ জাগিয়ে তুলে, সেই দুঃখ নিরাকরণের জন্য মাথা খোঁড়াখুঁড়ি!

কিন্তু

মনে মনে একটু হাসলেন অনামিকা, কিন্তু যারা জেগে ঘুমোয়? যারা জেনে বুঝে কৃত্রিমতার দেবতাকে পুজো দিয়ে চলে? আচ্ছা কেন দেয়? চামড়া উড়ে যাওয়া শুধু রক্ত-মাংসের চেহারাটা সহ্য করতে পারে না বলে? রূপ-রস-রং-জৌলুসহীন পৃথিবীটায় বাস করতে পারবে না বলে?

.

সনৎকাকার বাড়ি থেকে অনামিকাদের বাড়ির দূরত্ব নেহাৎ কম নয়, ট্যাক্সিতে বসে চিন্তাকে ছেড়ে দিয়ে যেন গভীরে তলিয়ে যান অনামিকা।

নীরুদা উঠে যাবার পর আরো কিছুক্ষণ বসেছিলেন সনৎকাকার কাছে, আরো কত কথা হয়েছে, সনৎকাকার হাসির সুরমাখা প্রশ্নটা যেন কানের পর্দায় লেগে রয়েছে এখনো–চোখ থেকে মুছে যায় যদি, সব রং সব অনুরাগ, শুধিতে কাহার ঋণ, কাটাতেই হবে দিন, ধরণীর অন্নজলে বাইয়া ভাগ।

সনৎকাকা কি কবিতা লেখেন?

আস্তে আস্তে নিজের ভেতর থেকে আর এক প্রশ্ন ওঠে। লেখা নিয়ে তো অনেক হাস্যকর কথা হলো, হাসলামও। কিন্তু নিজের জমার খাতায় অঙ্কটা কী? সত্যিই কি কিছু লিখেছি?

যে লেখা কেবলমাত্র নগদ বিদায় নিয়ে চলে যায় না, কিছু পাওনা রেখে যায়?

আমি কি সত্যি সত্যি কারো কথা বলতে পেরেছি? আমি কি সত্যকার জীবনের ছবি আঁকতে পেরেছি? নাকি নীরুদার ভাষায়, শুধু কতকগুলো কাল্পনিক চরিত্র খাড়া করে গল্প বানিয়েছি?

হয়তো অপস্রিয়মাণ সমাজজীবনের কিছু ছবি রয়ে গেল আমার খাতায়, কিন্তু যে সমাজজীবন বর্তমানের স্রোতে উত্তাল? মুহূর্তে মুহূর্তে যার রং বদলাচ্ছে, গড়ন বদলাচ্ছে? আমার অভিজ্ঞতায় কি ধরতে পারছি তাদের? না, পারছি না। তার কারণ, আজ আর সমাজের একটা গোটা চেহারা নেই, সে খণ্ড ছিন্ন টুকরো টুকরো! সেই টুকরোগুলো অসমান তীক্ষ্ণ, তাতে যতটা ধার আছে ততটা ভার নেই। আর যেন ওই তীক্ষ্ণতাটা অদূর ভবিষ্যতে ভোতা হয়ে যাবার সূচনা বহন করছে। তবু এখন যারা সেটা ধরতে পারছে, তারা সামাজের সেই ধারালো টুকরোগুলো তুলে নিয়ে আরো শান দিচ্ছে।

তাহলে কি কলমকে এবার ছুটি দেবেন অনামিকা? বলবেন, তোমার ছুটোছুটি এবার শেষ হোক!

হয়তো অনামিকা দেবীর ভক্ত পাঠকের দল সেই অনুপস্থিতিতে হতাশ হবে, কিন্তু নতুন কিছু যদি তাদের দিতে না পারি, কী হবে পুরনো কথাকে নতুন মোড়কে সাজিয়ে?

গাড়ি একটা বাঁক নিল, সামান্য একটু নির্দেশ দিলেন চালককে, তারপর আবার ভাবলেন, কিন্তু সেই নতুন কথাটা কি? কেবলমাত্র নিষ্ঠুর হাতে সব কিছুর আবরণ উন্মোচন?

তা ছাড়া? তাছাড়া আর সবটাই তো পুরনো।

জীবন নিয়েই সাহিত্য, চরিত্র নিয়েই কল্পনা। আদ্যিকালেও যা ছিল, আজও কি তাই নেই? যেটা অন্যরকম সেটা তো পরিবেশ। সমাজে যখন যে পরিবেশ, তার খাঁজে খাজে ওই জীবনটাকে যেমন দেখতে পাওয়া যায়, সেটাই সাহিত্যের উপজীব্য। আজকের পরিবেশ যদি বাপছাড়া, পালছেঁড়া, হালভাঙা হয়, সাহিত্যই বা

না, না, বাঁ দিকে নয়, ডান দিকে– নির্দেশ দিলেন চালককে। তারপর শিথিল ভঙ্গী ত্যাগ করে উঠে বসলেন, এবার ঠিক জায়গায় নামতে হবে।

যে মনটাকে ছেড়ে দিচ্ছিলেন, তার দিকে তাকালেন, তারপর আস্তে বললেন, কিন্তু পরিবেশ সাহিত্যের উপর জয়ী হবে, না সাহিত্য পরিবেশের উপর? সাহিত্যের ভূমিকা কি পরাজিতের?

বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থেকে নামলেন, একটু চকিত হলেন, দরজার কাছে ছোড়দা দাঁড়িয়ে, দাঁড়িয়ে বড়দার ছেলেও।

ওরা এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কেন? অনামিকার দেরি দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে? সেটা তো অলীক কল্পনা! অনামিকার গতিবিধি নিয়ে কে মাথা ঘামায়? ব্যস্ত তেমন হলেন না, ভাবলেন নিশ্চয় সম্পূর্ণ অন্য কারণ। ধীরেসুস্থে মিটার দেখছিলেন, বড়দার ছেলে এগিয়ে এলো, দ্রুত প্রশ্ন করলো, শম্পার সঙ্গে দেখা হয়েছে?

শম্পার সঙ্গে!

হা হা, তোমার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেছে?

ভাইপোর গলায় যেন একটা নিশ্চিত সন্দেহের সুর, যেন যে প্রশ্নটা করছে সেটার উত্তরটা তার অনুকূল হওয়ারই সম্ভাবনা।

অনামিকা বিস্ময় বোধ করলেন। বললেন, আমি তো তাকে সকালের পর আর দেখিইনি। কেন কী হয়েছে?

যা হবার তাই হয়েছে। বড় ভাইপো যেন পিসিকেই নস্যাৎ করার সুরে বলে ওঠে, কেটে পড়েছেন। সকাল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না তাকে।

 ১৬. জলের অপর নাম যে কেন জীবন

জলের অপর নাম যে কেন ‘জীবন’ এ কথা বোধ করি এমন করে উপলব্ধি করতে পারতো না পারুল যদি সে তার এই চন্দননগরের বাড়িটিতে একা এসে বাস না করতো, আর যদি না ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুধু চুপচাপ গঙ্গার জলের দিকে তাকিয়ে থেকে কাটাত।

এক গঙ্গার কতো রূপ, কতো রং, কতো রঙ্গ, কত বৈচিত্র্য! শুধু ঋতুতে ঋতুতেই নয়, দিনে রাত্রে, সকাল সন্ধ্যায়, প্রখর রৌদ্রের দুপুরে, ছায়া-ছায়া বিকেলে, শুক্লপক্ষে কৃষ্ণপক্ষে বদল হচ্ছে তার রঙের রূপের ভঙ্গিমার। এই অফুরন্ত বৈচিত্র্যের মধ্যে যেন অফুরন্ত জীবনের স্বাদ।

সেকালের তৈরি বাড়ি, ছোট হলেও ছোট নয়, একালের ফ্ল্যাটবাড়ির ছোটত্বের সঙ্গে তার ছোঁটত্বের তুলনাই হয় না। ফেলে ছড়িয়ে অনেকগুলো ঘর-বারান্দা, অকারণ অর্থহীন খানিকটা দালান, এই বাড়িতে শুধু একা পারুল তার নিতান্ত সংক্ষিপ্ত জীবনযাত্রার মধ্যে নিমজ্জিত, গলার সাড়া নেই কোথাও, নেই প্রাণের সাড়া।

তবু যেন পারুলকে ঘিরে এক অফুরন্ত প্রাণপ্রবাহ। নিঃসঙ্গ পারুল শুধু ওই জলের দিকে তাকিয়েই যেন অফুরন্ত সঙ্গের স্বাদ পায়, যেন অনন্ত প্রাণের স্পর্শ পায়।

পরিবর্তন মানেই তো জীবন, যা অনড় অচল অপরিবর্তিত, সেখানে জীবনের স্পন্দন কোথায়? অচলায়তনের মধ্যেই মৃত্যুর বাসা। জীবনই প্রতি মুহূর্তে রং বদলায়। তাই নদীপ্রবাহ জীবন-প্রবাহের প্রতীক। তবু নদীর ওই নিয়ত রূপবৈচিত্র্যের গভীরে যে একটি স্থির সত্তা আছে, পারুলের প্রকৃতির মধ্যে বুঝি আছে তার একাত্মতা। পাগল হয়ে সেই সত্তার গভীরে নিমগ্ন থেকে ওই রূপ-বৈচিত্র্যের মধ্য হতে আহরণ করে বাঁচার খোরাক, বাঁচার প্রেরণা।

অথচ পারুলের মত অবস্থায় অপর কোনো মেয়ে অনায়াসেই ভাবতে পারতো, আর কী সুখে বাঁচবো? ভাবতে, আর বেঁচে লাভ কী?

পারুল তা ভাবে না। নিঃসঙ্গ পারুল যেন তার জীবনের পাত্রখানি হাতে নিয়ে চেখে চেখে উপভোগ করে।

প্রতিটি দিনই যেন পারুলের কাছে একটি গভীর উপলব্ধির উপচার হাতে নিয়ে এসে দাঁড়ায়।

পারুল যে কেবলমাত্র সেই দীর্ঘদিন পূর্বে মৃত অমলবাবু নামের ভদ্রলোকটির স্ত্রী নয়, পারুল যে মোহনলাল এবং শোভনলাল নামক দু-দু’জন ক্লাস ওয়ান অফিসারের মা নয়, পারুল যে বহু আত্মীয়জনের মধ্যেকার একজন নয়, পারুল একটি সত্তার নাম, সেই কথাটাই অনুভব করে পারুল। আর তেমনি এক অনুভবের মুহূর্তে মাকে মনে পড়ে পারুলের।

আগে পারুল মাকে বুঝতে পারতো না। পারুল তার মার সদা উত্তেজিত স্বভাবপ্রকৃতির প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করতে, পারুল তার মার ওই ডজনখানেক ছেলেমেয়ে বরদাস্ত করতে পারতো না। কিন্তু এখন পারুল যেন দর্শকের ভূমিকায় বসে মাকে দেখতে পায়।

পারুলের একটা নিঃশাস পড়ে। পারুল ভাবে মা যদি খুব অল্পবয়সে বিধবা হয়ে যেতো, তাহলে হয়তো মা বেঁচে যেতো।

হয়তো বকুলই পারুলকে এই দৃষ্টিটা দিয়েছে। বকুলই তার মার অপরিসীম নিরুপায়তার ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছে কাল্পনিক চরিত্রের মধ্যে দিয়ে। সেই অবরোধের অসহায় যুগে প্রায় সব বাঙালী মেয়ের জীবনেই তো বকুল-পারুলের মায়ের জীবনের ছায়ার প্রতিফলন।

শুধু কেউ ছিল অন্ধ অবোধ, কেউ দৃষ্টিশক্তি আর বোধের যন্ত্রণায় জর্জরিত। পারুল তার মার সেই বোধ-জর্জরিত জীবনের জ্বালা দেখেছে।

তখন পারুল মার ওই জ্বালাটা নিয়ে মাতামাতি দেখে বিরক্ত হতো, এখন দূরলোক থেকে মমতার দৃষ্টিতে তাকায়।

পারুল এক এক সময় যেন মাকে এই গঙ্গার উপরকার বারান্দায় এনে বসায়, তারপর গভীর একটা নিঃশ্বাস উৎসর্গ করে মুক্তির কাঙাল সেই মানুষটার উদ্দেশে। পারুলের বিধাতা পারুলের প্রতি কিঞ্চিৎ প্রসন্ন বৈকি, তাই পারুলকে দীর্ঘদিন ধরে একটা স্থূল পুরুষচিন্তের ক্লেদাক্ত আসক্তির শিকার হয়ে পড়ে থাকতে হয়নি, যে আসক্তি একটা চটচটে লালার মতো আবিল করে রাখে, যে আসক্তি কোথাও কোনোদিকে মুক্তির জানালা খুলতে দেয় না।

কিন্তু এখন নাকি পালাবদল হয়েছে।

তা হয়েছে বটে! এখন শিকার শিকারী জায়গা বদল করেছে।

পারুলের হঠাৎ-হঠাৎ তার ছেলে দুটোর কথা মনে পড়ে যায়।

কিন্তু ও কি মুক্তির জানালা খুঁজে বেড়ায়? পারুলের ছেলেরা? না পরম পরিতোষে সেই এটা আঠা-চটচটে আসক্তির লালা গায়ে মেখে পড়ে থেকে নিজেদেরকে খুব সুখী সুখী মনে করে? হয়তো তাই।

হয়তো অধিকার-বোধে তীব্র তীক্ষ্ণ সচেতন, অথচ অভিমানার সেই এক প্রভুচিত্তের কাছে সমর্পিত-প্রাণ হয়ে থাকই ওদের আনন্দ। প্রভুর ইচ্ছায় নিজের ইচ্ছা বিলীন করার মধ্যেই ওদের জীবনের চরম সার্থকতা।

আপন সন্তানকেই কি সম্পূর্ণ পড়া যায়? হয়তো অনেকটা যায়, তবু সবটা নয়। অনেকটা যায় বলেই শোভনের জন্যে একটি গভীর বেদনাবোধ আছে। যেন বুঝতে পারে পারুল, শোভনের শাস্তিপ্রিয়তাই শোভনকে অনেকটা অসহায় করে রেখেছে।

এক এক সময় ভারী অদ্ভুত লাগে পারুলের। মনে হয় পারুল যেন অনেক দড়িদড়ার গেড়ো কেটে কি একটা ভয়ঙ্করের কবল থেকে হাত-কয়েক পালিয়ে এসে নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচছে।

সেই ভয়ঙ্করটা কী? সমাজ? লোকসমাজ? বোধ হয় তাই।

লোকসমাজের মুখ চেয়ে পারুলকে আর এখন ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু করতে হয় না। হঠাৎ কখন এক সময় পারুল ওই ‘লোকনিন্দে’ জিনিসটার মধ্যেকার পরম হাস্যকর দিকটা উপানি করে ফেলে ‘তেলি হাত ফসকে গেলি’ হয়ে গেছে।

এখন আর পারুলের শ্বশুরকুলের কেউ পারুল সম্পর্কে কোনো প্রত্যাশা রাখে না। বিধবা পারুল, ঝাড়া-হাত-পা পারুল, আত্মীয়স্বজনের সুখে-দুঃখে গিয়ে পড়ে বুক দিয়ে করবে এমন আশা কারুর নেই। পারুল যদি কারুর অসুখ শুনে দেখতে যায়, তাহলে সে বিগলিত হয়, পারুল যদি কারুর বিয়ের নেমন্তন্ন পেয়ে গিয়ে দাঁড়ায়, সে ধন্যবোধ করে।

না গেলেও কেউ কিছু মনে করে না, কারণ এখন সবাই ধরে নিয়েছে উনি এই রকমই। এখন আর পারুলের বেয়ানেরা পারুলের ছেলে-বৌয়ের প্রতি কর্তব্যহীনতা নিয়ে সমালোচনায় মুখর হন না, তারাও ধরে নিয়েছেন উনি তো ওই রকমই।

কিন্তু সবাই কি পারে এই মুক্তি আহরণ করতে?

পারে না। কারণ বন্ধন তত বাইরে নয়, বন্ধন নিজের মধ্যে। সেই বন্ধনটি হচ্ছে ‘আমি’। সেই আমি’টি যেন লোকচক্ষুতে সব সময়ে ঝকঝকে চকচকে নিখুত নির্ভুল থাকে, যেন তাকে কেউ ত্রুটির অপরাধে চিহ্নিত করতে না পারে, এই তো চেষ্টা মানুষের। আমি’টিকে সত্যকার পরিশুদ্ধ করে নির্ভুল নিখুত হবার চেষ্টা ক’জনেরই বা থাকে? ‘আমি’টিকে পরিপাটি দেখানো’র সংখ্যাই অধিক। ওই দেখানোর মোহটুকু ত্যাগ করতে পারলেও বা হয়তো সেই ত্যাগের পথ ধরে পরিশুদ্ধি এলেও আসতে পারে। কিন্তু ‘আমি’র বন্ধন বড় বন্ধন।

পারুলের হয়তো ও বন্ধনটা চিরদিনই কম ছিল, এখন আরো গেছে। কিন্তু এই বন্ধনহীন পারুলের সামনে হঠাৎ একটি বন্ধন-রজ্জু এসে আছড়ে পড়লো।

তা এক রকম আছড়ে পড়াই। কারণ ব্যাপারটা ঘটলো বিনা নোটিশে।

পারুল আজ সামান্য রান্নার আয়োজন করে নিয়ে সবে স্টোভটা জ্বেলেছে, হঠাৎ বাইরে দরজায় একটা সাইকেল-রিকশার শব্দ হলো, সঙ্গে সঙ্গে রিকশাওয়ালারই ডাক শোনা গেল, মাইজী, মাইজী!

তার মানে আরোহী ওকেই ডাক দেবার কাজটা চাপিয়েছে।

কে এলো এমন সময়? কে এলো পারুলের কাছে?

আর কেই বা, ছেলেরা ছাড়া? যারা কর্মস্থল থেকে কলকাতায় আসা-যাওয়ার পথে এক আধবেলার জন্যে এসে দেখা দিয়ে যায়, অথবা মাকে দেখে যায়।

কিন্তু তারা তো নিজেই আগে উঠে আসে। পিছু পিছু হয়তো রিকশাওয়ালাটা মাল মোট নিয়ে–

তবে কি কেউ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে

তাড়াতাড়ি নিচের তলায় নেমে গেল পারুল।

আর নেমে গিয়েই থেমে দাঁড়িয়ে পড়লো।

সিঁড়ির জানলা থেকে রিকশায় বসা যে রোগা-রোগা মেয়েটাকে হঠাৎ শোভনের বৌ বলে ভুল হয়েছিলো, সে একটা অপরিচিত মেয়ে। তার পাশে একটি অপরিচিত পুরুষ-মূর্তি।

কিন্তু মেয়েটা কি একেবারেই অপরিচিত? কোথায় যেন দেখেছেন না?

আরে কী আশ্চর্য, মেয়েটা পারুলের পিতৃকুলের না? পারুলের ভাইঝি তো! তবু পারুল প্রশ্ন না করে পারলো না, কে?

আমি।

মেয়েটা নেমে এলো, যেন কষ্টে নিচু হয়ে একটা প্রণামের মতো করে বলে উঠলো, আমি হচ্ছি শম্পা। আপনার ভাইয়ের মেয়ে। পিসিকে, মানে ছোট পিসিকে অবশ্য আমি ‘তুমি’ করেই কথা বলি, কিন্তু আপনার সঙ্গে তো মোটেই চেনাজানা নেই, তাই আপনিই বলছি! যদি এখানে কিছুদিন থেকে যাওয়া সম্ভব হয় তো পরে দেখা যাবে। এখন কথা হচ্ছে থেকে যাওয়ার। …অদ্ভুত একটা পরিস্থিতিতে পড়ে চট করে আপনার এখানে চলে এলাম। কেন এলাম তা জানি না। আপনাকে তো চিনিও না সাতজন্মে, নেহাৎ পিসির লেখা খামে ঠিকানাটা ক্রমাগত দেখে দেখে মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল তাই।…এখন শুনুন ব্যাপার

আমাকে তুই তুমি’ই বল। পারুল হাসলো, আমি চটে যাবে না।

যাবে না তো? বাঁচলাম বাবা! এতক্ষণে কথা বলাটা সহজ হলো। শোনো, আমি না–যাকে বলে একটা অসুবিধেয় পড়ে, মানে বিরাট একটা অসুবিধেয় পড়ে, না ভেবে-চিন্তে তোমার এখানেই চলে এলাম, বুঝলে? না, একেবারেই যে ভাবিনি তা নয়, ভাবনা-চিন্তা করতে গিয়ে তোমার নামটাই মনে এসে গেল। এসেছি অবশ্য উপকারের আশাতেই, তবে উপকার করা না-করাটা তোমার ইচ্ছে। ওই যে ছেলেটাকে দেখছ না রিকশায়, ওর নাম সত্যবান দাস। মানে আর কি বুঝতেই পারছো–ব্রাহ্মণসন্তান-টন্তান নয়। আর মনে হচ্ছে, তোমরা যাক ভদ্দরলোক বলো ঠিক তাও নয়। মানে স্রেফ কুলি মজুর। তা সে যাই হোক, ওকেই বিয়ে করবো ঠিক করেছি, আর তাই ওর সঙ্গেই ঘুরছি-টুরছি, হঠাৎ আমার শ্রীযুক্ত বাবা, মানে আর কি তোমার ছোড়দা, কি করে এই ঘটনাটি টের পেয়ে একেবারে তেলেবেগুনে!..ও সে কী রাগ! এই হতভাগাটার সঙ্গে মিশলে এ বাড়িতে থাকা চলবে না– ইত্যাদি প্রভৃতি ..তা আমিও তো সেই বাবারই মেয়ে, আমিই বা কম যাবো কেন? বললাম–বেশ ঠিক আছে। ওকে যখন ছাড়তে পারবো না, তখন বাড়ি ছাড়লাম।…ব্যাস, চলে। এলাম, এদিকে ওই মহাপ্রভুর মেসের বাসায় এসে দেখি, বাবু দিব্যি একখানি একশো চার জ্বর করে কম্বল গায়ে দিয়ে পড়ে আছেন। বোঝ আমার অবস্থা! মেসের ঘর, আরো দু’দুখানা রুমমেট রয়েছে সেখানে ওই রুগীটাকে নিয়ে করি কি! বাড়ি ছেড়ে চলে এলাম ওর ভরসায়, আর ও কিনা এই দুর্ব্যবহারটি করে বসলো! তাহলে উপায় কি? তা এই উপায়টিই মাথায় এসে গেল!..মানে আর কি, বিপদে পড়লেই পিসির কাছে যাওয়াটাই অভ্যাস তো? অথচ পিসি এখন তার মান্যগণ্য দাদার বাড়িতে। তখন মনে পড়ে গেল, আরও পিসি তো রয়েছে, তার কাছেই গিয়ে পড়া যাক!…অবিশ্যি সকলেই কিন্তু একই রকম হয় না। তুমিও যে ছোট পিসির মতই হবে তার কোনো মানে নেই। না-জানা না-চেনা এক লক্ষ্মীছাড়া ভাইঝি রাস্তা থেকে এক-গা জ্বরসুদ্ধ আর এক লক্ষ্মীছাড়াকে জুটিয় এনে তোমার বাড়িতে থাকবো গো বলে আবদার করলেই যে তুমি আহ্লাদে গলে থাকো থাকো করবে এমন কথা নেই, কিন্তু কী করব? একদম উপায় ছিল না। যা হোক একটা বিছানার ব্যবস্থা করতে দিলেই চলবে এই নিচতলারই একটা ঘরে। একে একটু শুতে দেওয়া দরকার। দেখছো তো কী রকম ঘাড় গুঁজে বসে আছে, গড়িয়ে পড়ে গেলেই দফা শেষ! কিছুতে আসতে চাইছিল, আমি প্রায় জোর করে–

ওর কথার স্রোতে ভেসে যাওয়া পারুল এতোক্ষণে সেই স্রোতের মাঝখানে নিজেকে একটু ঢুকিয়ে দেয়, আচ্ছা তোর ওসব কাহিনী পরে শুনবো, এখন নিয়ে চল ওকে। রিকশাওয়ালা তুমি বাপু দাদাবাবুকে একটু ধরো—

এতক্ষণে গাড়ির আরোহীও একটু চেষ্টা করে সোজা হয়ে বসে জড়িত গলায় বলে, না না, ধরাতে হবে না—

না হবে না! ভারী সর্দার! প্রবলা গার্জেন ওর একটা হাত চেপে ধরে নামতে সাহায্য করে বলে, তারপর রাস্তার মাঝখামে আলুর দম হও আর কি! চলো আস্তে আস্তে, রিকশাওলা সাবধান

যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিচতলার বৈঠকখানা নামধারী চির-অব্যবহৃত ঘরটায় পড়ে থাকা চৌকিটার ওপর একটা বিছানা পেতে দিয়ে পারুলও ধরতে একটু সাহায্য করে, বলে, এখন নিচতলাতেই দিলাম বিছানাটা, জ্বর না কমলে তো সিঁড়ি ওঠা সম্ভব হবে না। স্বস্তি হয়ে শুলে ডাক্তারের ব্যবস্থা দেখবো?

ছেলেটা যেন শুয়ে বাঁচে।

পারুল একটা খবরের কাগজ নিয়ে বাতাস করতে করতে বলে, রিকশাওলা তুমি এক্ষুনি চলে যেও না, আমি একটু তোমার গাড়িটায় যাবো। বাজারের কাছে কোথায় যেন একটা ডাক্তারখানা আছে না? ডাক্তার বসেন তো?

যাক বাঁচা গেল বাবা! ধপ্ করে চৌকিটার একধারে বসে শম্পা। তারপর কাগজখানা তুলে নিয়ে নিজেই বাতাস খেতে খেতে বলে, দেখা যাচ্ছে আমার ঠাকুমা ঠাকুরুণের ছেলেগুলি যে মাটিতে তৈরী, মেয়েগুলি তা দিয়ে নয়। অবিশ্যি বড় পিসি, মেজ পিসির খবর জানি না, তবে তোমরা দুজনে লোক ভালো। এই, তুমি যে তখন বলছিলে তেষ্টা পেয়েছে, খাবে জল?

শুধু জল থাক, ডাব আছে, দাঁড়া, এনে দিই। তারপর ডাক্তার যা বলেন-, বলে উঠে যায় পারুল।

পারুলের পক্ষে কাজটা অভাবনীয় বৈকি। হঠাৎ এই পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়াতে না হলে পারুল কি ভাবতে পারতো সে বাজারের মোড় পর্যন্ত গিয়ে ডাক্তার ডেকে আনছে।

ভাবতে পারতো না, অথচ এখন সেই কাজটাই করে ফেললো সহজে অনায়াসে। মানুষ যে পরিস্থিতির দাস মাত্র, এতে আর সন্দেহ কি?

ওকে ওষুধপথ্য খাওয়ানোর পর শম্পা হাঁপিয়ে বসে পড়ে বলে, এতক্ষণ বলতে লজ্জা করছিল, কে জানে তুমি হয়তো ভাববে মেয়েটা কী পিশাচী গো, এই দুঃসময়ে কিনা নিজের ক্ষিদে পাওয়ার কথা মনে পড়লো ওর! কিন্তু এখন তো আর থাকতে পারা যাচ্ছে না!

ইস! আহা রে! পারুল লজ্জার গলায় বলে, ছি ছি! আমি কী রে? এটা তো তোর বলবার কথা নয়, আমারই উচিত ছিল তোকে আগে একটু জল খেতে দেওয়া।

উচিত আবার কী? অকস্মাৎ যা একখানা গন্ধমাদন পর্বত এনে চাপিয়ে দিলাম তোমার মাথায়!

 ১৭. ভাল জিনিস কিছু মজুত থাকে না

আমার বাড়িতে কিন্তু ভাল জিনিস কিছু মজুত থাকে না–

শম্পাকে বসিয়ে তার সামনে খানকয়েক বিস্কুট আর কিছুটা হালুয়া ধরে দিয়ে চা ঢালতে ঢালতে পারুল বলে, রসগোল্লা-টসগোল্লা খেতে ইচ্ছে হলে নিজে দোকানে যেতে হবে।

আপাততঃ নয়, তবে ইচ্ছে খুবই হবে। শম্পা আগেই ঢকঢক করে এক গেলাস জল শেষ করে বলে, ওই ছোঁড়াটা সেরে উঠলেই যাওয়া যাবে। ভীষণ পেটুক ওটা, বুঝলে? মিষ্টি খাওয়ার যম একেবারে। আমি একলা খেলে দেখে হিংসেয় মরে যাবে। তা তোমার হালুয়াও কিছু মন্দ নয়। এখন তো মনে হচ্ছে স্বর্গের সুধা। চাও ঢালছো? গুড। তা তোমার রান্না-খাওয়া হয়ে গেছে?

পারুল হেসে উঠে বলে, সে কী রে! তুই আসছিস, আমি খেয়ে-দেয়ে বসে থাকবো?

তার মানে? শম্পা চোখ কপালে তুলে বলে, তুমি জানতে নাকি আমি আসছি

জানতাম বৈকি। পারুল হাসে, জানা যায়।

সে কী রে বাবা, জ্যোতিষ-ট্যোতিষ জানো নাকি?

পারুল আবারও মুখ টিপে হেসে বলে, ধরে নে জানি।

জানো? সত্যি?

শম্পা তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বলে, তাহলে খাওয়ার পর আমার হাতটা দেখো দিকি একবার। প্রেম, বিবাহ, পারিবারিক সুখ, শিক্ষাদীক্ষা, এসবের কী কী ফলাফল!

পারুল ওর মুখের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে বলে, সব ফলই ভালো।

ওটা তো কঁকির কথা! দেখতে হবে…কই, তুমি চা খেলে না?

পারুল হেসে ফেলে, আমি এরকম বেলা বারোটায় চা খাই না।

আরে বাবা, এ করি না, এ খাই না, এসবের কোন মানে আছে? ইচ্ছে হলেই করবে!

তাহলে ধর ইচ্ছে হচ্ছে না।

সে আলাদা কথা। তবে না হয় আমাকেই আর এক কাপ দাও। আচ্ছা পিসি, ওকে একটু দিলে দোষ আছে?

ওকে? ও! মানে, চা? না না, এতো রোদের সময় জ্বরের ওপর–এই মাত্র ওষুধ খেয়েছে

তবে থাক। চা বলে মরে যায় কিনা! তাই একটু মন-কেমন করছে।

বলে অন্যমনাভাবে পেয়ালার ধারে চামচটা ঠুকঠুক করে ঠুকতে থাকে শম্পা।

ওর নামটা কি যেন বললি?

খেয়ে-দেয়ে ধাতস্থ হয়ে শম্পা মুখটা মুছতে মুছতে বলে, মানে মা-বাপের দেওয়া নাম সত্যবান, তবে আমি জাম্বুবান-টান বলি আর কি!

পারুল যেন মেয়েটার কথাবার্তায় ক্রমশই অধিকতর আকৃষ্ট হতে থাকে। আশ্চর্য তো, পারুলের সেই ছোড়দার মেয়ে এ! ছোড়দার চালচলন ধরণ-ধারণ সবই তো সনাতনী। সেই নাতনীর আবহাওয়া থেকে এমন একখানি বেহেড মেয়ে গজালো কী করে?

বললো, ভালই করো। তা হঠাৎ জাম্বুবানের গলায় মালা দেবার ইচ্ছে হলো যে?

ওই তোমরা বিধিলিপি না কি বল, তাই আর কি!

আমরা যে বিধিলিপিতে বিশ্বাসী, এটা তোকে কে বললো?

আরে বাবা, ও কি আর বলতে হয়? ও হতেই হয় সবাইকে, কোনো না কোনো সময়। এই আমাকেই দেখোনা, মানিও না কিছু আবার ওই হতভাগাটার জন্যে পুজোও মানত করে বসে আছি। এখন কী করে যে

পারুল হেসে বলে, আর আশ্চর্য কি, পিতৃপিতামহের রক্তধারা যাবে কোথায়? কিন্তু এই নিধিটিকে জোটালি কোথা থেকে?

ওমা! তুমি যে ঠিক পিসির মতো কথা বললে গো! হঠাৎ মনে হলো, পিসিই বুঝি কথা বলে উঠলো! গলার স্বরটাও তোমার পিসি-পিসি! যদিও দেখতে তুমি আরো অনেক সুন্দরী। তোমাদের বাবা বুড়ো খুব সুপুরুষ ছিল, তাই না?

ছিলেন। পারুল ঈষৎ গভীর সুরে বলে, মা-ও সুন্দর ছিলেন।

শম্পাও হঠাৎ গভীর সুরে বলে ওঠে, ভাবলে কিন্তু এক এক সময় ভারী আশ্চর্য লাগে। বাড়িটা সেই একই আছে, সেই ঘর দালান জানলা দরজা, অথচ মানুষগুলো বদলে যাচ্ছে, সংসারের রীতিনীতি বদলে যাচ্ছে, এক দল যাচ্ছে অন্য দল আসছে–

পারুল মৃদু হেসে বলে, হ্যাঁ, এক দল দেয়ালে মাথা ঠুকছে, আর পারের দল সেই দেয়াল ভাঙছে–

শম্পা একটু তাকিয়ে দেখে আবার বলে, তোমাদের দুই বোনে খুব মিল-কথায় চিন্তায়। কিন্তু বল তো, তোমার কি মনে হয় যারা ভাঙছে তারা ভুল করছে?

পারুল তেমনি মৃদু হেসে বলে, আমি বলার কে? কোনটা ভুল কোনটা ঠিক তার রায় দেবার মালিক শুধু ইতিহাস। শুধু এইটুকুই বলতে পারি, যা হচ্ছে তা অনিবার্য। ইতিহাসের নিয়ম। সেই নিয়ম রক্ষার্থে আমার বাবার নাতনী জাম্বুবানের গলায় মালা দেবে।…এখন আজ্ঞা ভঙ্গ হোক বাবা, যাই দেখি গে পিসি-ভাইঝিতে কি খেতে পারি। অবশ্য আমার রান্নাঘরে কোনো সমারোহের আশা কোরো না, নেহাৎ আলুসেদ্ধ ভাতেরই ব্যবস্থা। বড়জোর। খিচুড়ি।

ব্যস ব্যস, ওতেই চলবে। শম্পা বলে ওঠে, দূর দূর করে খেদিয়ে না দিয়ে বাড়িতে ঠাঁই দিয়েছ এই ঢের, আবার রাজভোগের বায়না করতে যাবো নাকি! আমার বেশী কথা-টথা আসে না তাই, নইলে তোমার উদ্দেশ্যে মহৎ-টহৎ বলে একটা প্রশস্তি গেয়ে দিতে পারতাম।

খুব বাঁচান যে বেশী কথাটথা আসে না, এখন যা দেখ গে তোর রুগীর কি হচ্ছে। এখন ঘুমোচ্ছে না ঘুম ভেঙেছে?

যাচ্ছি শম্পস সহসা গভীরভাবে বলে, ভেবে অবাক লাগছে, তোমায় না জেনে-চিনে এসে পড়লাম কী করে?

জানতিস চিনতিস না কে বললে?

জানতাম বলছো? ত হবে। হয়তো জানতাম, তাই সাহস হলো। হঠাৎ ওর এই জ্বরটরগুলো হয়েই–মানে কিছুদিন আগে একবার খুব শক্ত অসুখ করেছিল, বাঁচে কিনা। তা ভাল করে সারতে-না-সারতেই আবার খাটতে লেগে এইটি হলো। কুলিমজুরের কাজ তো! যাক, নিজের কথাই সাতকাহন করছি, তোমার কথা শুনি। তোমার ছেলে দু’জন তো অন্য জায়গায় থাকে, তোমার কাছে কে থাকে?

আমার কাছে? আমিই থাকি।

বাঃ চমৎকার! বেশ ভালই আছো মনে হচ্ছে। গঙ্গার ওপর বারান্দাবসানো এমন একখানি বাড়ি, শুধু নিজেকে নিয়ে আছো–

পারুল মৃদু হেসে বলে, শুধু নিজেকে নিয়ে থাকা তোর কাছে খুব আদর্শ জীবন বুঝি?

আমার কাছে? শম্পা হেসে ওঠে, আমি তো এটা ভাবতেই পারি না। আমার মনে হয়–কেউ আমায় ভালবাসছে না, কেউ আমার জন্যে হেদিয়ে মরছে না, কেউ আমার বিহনে পৃথিবী অন্ধকার দেখছে না, এমন জীবন অসহ্য। তবে তোমার কথা আলাদা-বয়েসটায়েস হয়ে গেছে!…আচ্ছা। যাই তাহলে নিচে!

পারুল বোধ করি শেষের বিদায়-প্রার্থনায় শুনতে পায় না, তাই আস্তে বলে, এতো কথা তুই শিখলি কোথা থেকে?

কি জানি! হয়তো নিজের থেকেই। তবে মা বলে নাকি পিসিই আমার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। পিসির দৃষ্টান্তই আমার পরকাল ঝরঝরে করে দিয়েছে! অথছ দেখো, মিলটিল কিছুই নেই। পিসি জীবনভোর শুধু বানানো প্রেমের গল্পই লিখলো, সত্যি প্রেমের ধার ধারলো না কখনো, আর আমি তো সেই আট বছর বয়স থেকেই প্রেমে পড়ে আসছি।

চমৎকার! তা সবগুলোই বোধ হয় “সত্যি” প্রেম?

তৎকালীন অবস্থায় তাই মনে হয় বটে, তবে কী জানো, ধোপে টেকে না। দু-দশদিন একটু ভালোবাসা-ফালোবাসা হলেই ছোঁড়ারা অমনি ধরে নেয় বিয়ে হবে। দু’চক্ষের বিষ। শুধু ভালোবাসাটা বুঝি বেশ একটা মজার জিনিস নয়।

পারুল ঈষৎ গম্ভীর গলায় বলে, তা মজার বটে। তবে কথা হচ্ছে এটিকেই বা তাহলে দু’চক্ষের বিষ দেখলি না কেন? বিয়ের প্রশ্ন তুলেই তো বাপের সঙ্গে ঝগড়া!

শম্পাও হঠাৎ গম্ভীর গলায় বলে, এক্ষেত্রে ব্যাপার একটু আলাদা। এখানে ওই হতভাগাই বিয়ের বিপক্ষে। কেবলই বলে কিনা, সরে পড়ো বাবা, আমার দিক থেকে সরে পড়ো। তোমার বাবা কতো দামীটামী পাত্র ধরে এনে বিয়ে দিয়ে দেবে, আমি হতভাগা, চালচুলো নেই, চাকরির স্থিরতা নেই, বৌকে কী খাওয়াবো তার ঠিক নেই, আমার সঙ্গে দোস্তি করতে আসা কেন?…আমারও তাই রোখ চেপে গেছে

পারুল ওর দিকে তাকিয়ে আস্তে বলে, এ বিয়েতে সুখী হতে পারবি?

শম্পা অম্লানবদনে বলে, হতে বাধা কী? সুখী হওয়া-টওয়া তো স্রেফ নিজের হাতে। তবে যদি হতভাগা মরে-ফরে যায় সে আলাদা কথা।

বালাই ষাট! পারুল বলে, তোর মুখে কি কিছুই আটকায় না বাছা?

পিসিও তাই বলে। শম্পা চলে যায় হাসতে হাসতে।

অভাবনীয় একটা বৃহৎ ভার ঘাড়ে পড়া সত্ত্বেও খুব একটা ভালো-লাগা ভালো-লাগা ভাব আসে পারুলের।

১৮. বহু-বহুদিন পরে চন্দন এলো

বহু-বহুদিন পরে চন্দন এলো বাপের বাড়িতে। অথবা ভাইদের বাড়িতে।

আবির্ভাবটা অপ্রত্যাশিত।

স্বগত কর্তা প্রবোধকুমারের বড় মেয়ে চাপা বরং কদাচ কখনো এ বাড়িতে আসে, পাকা চুলের মাঝখানটায় সুগোল টাকের উপর বেশ খানিকটা সিঁদুর লেপে আর কপালের মাঝখানে বড় একটা সিঁদুর টিপ– পরে, ঢোলা সেমিজের ওপর চওড়াপাড় একটা শাড়ি জড়িয়ে প্রসাধিত হয়ে এসে পা ছড়িয়ে বসে। যতক্ষণ থাকে, নিজের হাঁটুর বাত, অম্বলশুল ও কর্তার হাঁপকাশ রক্ত আমাশা এবং খেকি মেজাজের গল্প করে, ভাই ভাই-বৌ এবং ভাইপো-বৌদের ওপর বিশ-পঁচিশ দফা নালিশ ঠুকে, বাঁধানোদাঁতের পাটি খুলে রেখে মাড়ি দিয়ে পাকলে পাকলে– সিঙ্গাড়া কচুরি সন্দেশ রসগোল্লা খেয়ে, বকুল সম্পর্কে কিছু তথ্য আর তার লেখা দু’চারটে বই সংগ্রহ করে চলে যায়। বকুলের সঙ্গে কোনোদিন দেখা হয়, কোনোদিন দেখা হয় না। দেখা হলে প্রত্যেকবারই নতুন করে একবার জিজ্ঞেস করে, তা নিজের অমন খাসা নামটা থাকতে এই একটা অনামা-বিনামা নামে বই লিখতে যাস কেন?

তারপর ফোকলা মুখে একগাল হেসে বলে, আমার দ্যাওরঝি ভাসুরপো-বউরা আর নাতনী ছুঁড়িটা তোর নাম করতে মরে যায়! এইসব বইটই ওদের জন্যেই নিয়ে যাওয়া। আমি বাবা সাতজন্মেও নাটক-নভেল পড়ি না। তা ওদেরই একশো কৌতূহল। তুই কেমন করে লিখিস, কেমন করে হাঁটিস চলিস, উঠিস বসিস, এই সব। আমি বলি, আরে বাবা, আমাদেরই বোন তো, যেমন আমরা, তেমনি। চারখানা পাও নেই, মাথায় দুটো সিংও নেই। তবে বে থা করলো না, গায়ে হাওয়া দিয়ে জীবনটা কাটিয়ে দিলো, তাই ডাঁটো আছে।..তা ছুঁড়িদের খুব ইচ্ছে বুঝলি তোর সঙ্গে দেখা করবার, মানে তোকে একবার দেখবার, আমিই আনি না।

বকুল মৃদু হেসে বলে, তা আনো না কেন?

চাপা হয়তো ফট করে দালানের কোণে, কি সিঁড়ির কোণে খানিকটা পানের পিচ ফেলে মুখ হালকা করে নিয়ে বলে, আনা মানেই তো আমার জ্বালা। তাদের জন্যে গাড়ি ভাড়া কারো, হাপিত্যেশী হয়ে বসে থাকো কতোক্ষণে সাজগোজ হবে, আবার ফেরার জন্যে তাগাদা থাকবে, অতো ভালো লাগে না। এ বাবা স্বাধীনভাবে এলাম, দু-দণ্ড বসলাম, মুখ খুলে সংসারের দুটো গল্পগাছা করলাম, চুকে গেল। ওদের তাই বলি, সেই অনামী দেবীকে দেখে তোদের কী চারখানা হাত গজাবে রে?…তা তখন বলে, বেশ তবে ওঁর বই নিয়ে এসো? দে বাবা দু’চারখানা বই-ই দে।

চাঁপাকে সুবর্ণলতার মেয়ে বলে মনেই হয় না।

ফেরার সময় বইয়ের প্যাকেট বাঁধতে বাঁধতে আর একটি কথাও বলে যায় চাঁপা, এখন তো নতুন আইনে মেয়েরাও বাপের সম্পত্তি পাচ্ছে, তা আমাদের কপালে আইনকানুন সব মিথ্যে, যে ঘাসজল সেই ঘাসজল! তুই তবু চালাকি করে বাবার বাড়িটা খুব ভোগ করে যাচ্ছিস!

বকুল মৃদু হাসে।

হাসিটা কি নিজের চালাকির মহিমায়?

চাঁপার ওই আসাটা দৈবাতের ঘটনা হলেও, তবু ঘটে কদাচ কদাচ।

কিন্তু চন্দন?

তার চেহারাটাই তো প্রায় ভুলে গেছে এ বাড়ির লোকেরা। অথচ এমন কিছু দূরে সে থাকে না। থাকে রাণাঘাটে।

তবু চন্দনের পায়ের ধুলো এ বাড়িতে দুর্লভ।

চন্দনের শ্বশুর রাণাঘাটের এক নামকরা উকিল ছিলেন, সেখানে তিনি প্রচুর বিষয় সম্পত্তি করে রেখে গিয়েছিলেন–জমিজমা বাগানপুকুর ধানচাল। চন্দনের স্বামী জীবদ্দশাকাল সেই ভাঙিয়ে খেয়েছেন। এখন চন্দনই তার মালিক! ছটা মেয়ে চন্দনের, ছেলে নেই, মেয়েদের প্রায় সব কটাই বিয়ে হয়ে গেছে। একটাই বুঝি আছে এখনও আইবুড়ো। তবু চন্দনের মরবার সময় নেই।

সেই দুর্মূল্য সময় থেকে কিছুটা বাজে খরচ করে, এবং রেলগাড়ি ভাড়া খরচ করে চন্দন হঠাৎ ভাইয়ের বাড়ি এলো কেন, এটা দুর্বোধ্য। মেয়েদের বিয়েতে ডাকে একটা নেমন্তন্ন পর পাঠানো ছাড়া আর তো কোন যোগাযোগই রাখে না। এরাও অবশ্য নয়। পত্রোত্তরে কিছু মনিঅর্ডার, ব্যস!

এসে দাঁড়িয়েই বিস্ময় আনন্দ এবং কৌতূহলের প্রশ্ন শিকেয় তুলে রেখে দিন আগে ট্যাক্সি থেকে নামানো জিনিসপত্রগুলো নিয়েই ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে।

বাড়ির সবাই এখনো এক হাঁড়ির না ভিন্ন হাঁড়ির, এ প্রশ্ন তাকে উতলা করে তোলে। ভিন্ন হাঁড়ি হলে তো যা কিছু এনেছে যথা রাণাঘাটের বিখ্যাত কাঁচাগোলা এবং মানকচু, কচি ট্যাড়শ, সজনেডাঁটা, কাঁচা পেপে ইত্যাদি, সবই ভিন্ন ভিন্ন ভাগে ভাগ করতে হবে।

কিন্তু জিজ্ঞেস করাও তো কঠিন।

তবে কথার কৌশলেই জগৎ চলে এই ভরসা। চন্দন হাঁক দিয়ে বলে, কই গো গিন্নীরা, সবাই রান্নাঘরে নাকি? দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করে দেখবে কোন্ দিক থেকে কে আসে।

খবরটা ইতিমধ্যেই রটে গিয়েছিল এবং সকলেই সচকিত হয়ে উঁকিবুকি দিচ্ছিল, উনি হঠাৎ কেন? অপ্রতিভ হবার কথা ওনারই, কিন্তু উনি অপ্রতিভ হবার মেয়ে নন, উনি ওঁর ঠাকুমা মুক্তকেশীর হাড়ে তৈরী। তাই উনি কোনোদিকে না তাকিয়ে সঙ্গের লোকটাকে নির্দেশ দিতে থাকেন, মাছটা উঠোনে রেখে ওই কলে হাত ধুয়ে তবে অন্য জিনিসে হাত দে। রোস রোস, টোপাকুলগুলো যেন চটকে ফেলিস নে। আচার তৈরি করেই আনবো ভেবেছিলাম, তা হুট করে আসা হয়ে গেল-সঙ্গী তো জোটে না সব সময়। ভাই-ভাজ তো আর ডাকবে না কখনো, তবু বাপের ভিটে মা-বাপের স্মৃতি একবার তো চোখেও দেখতে ইচ্ছে করে!… বড় পুকুরে জাল ফেলাতে পারলাম না এইটাই খেদ রয়ে গেল–হঠাৎ আসা তো। মেয়েটি কার? বিয়ে হয়নি দেখছি।..মাথায় ও কিসের খোঁপা রে? আমের টুকরি বসিয়ে তার ওপর চুড়ো বানিয়েছিস নাকি? এই এক বিটকেল ঢঙের খোঁপার ফ্যাশান হয়েছে বাবা। আমাদের রাণাঘাটেও কসুর নেই। যাদের পেটে ভাত জোটে না, তাদেরও মাথায় এতো বড়ো খোঁপা! …কানুর বৌকে দেখছি না যে? তারপর বকুল কোথায়? বই-লিখিয়ে বোন আমাদের? তার তো খুব নামডাক। রাণাঘাটেও কমতি নেই।…বকুল বাড়ি নেই? কোথায় গেছে?

অপূর্বর বৌ অলকা মুচকে হেসে বলে, কোথায় গেছেন তা আর কে জানতে যাচ্ছে?

ওমা সে কি! কোথায় যায় বলে যায় না? যতই মিটিং করুক আর লেকচার মারুক, মেয়েমানুষ বেরোবার সময় বাড়িতে বলে যাবে না?…স্বাধীন জেনানা হয়ে গেছেন বুঝি? আমার মেয়েরা তো নিত্যিই খবর-কাগজ এনে খুলে দেখায়, এই দেখো তোমার বোনের ছবি, মা এই দেখো তোমার বোনের নাম। তা আমি বলি, তোরা ওই অনামী দেবীকে দ্যাখ, তোরা গদগদ হ! আমার কাছে সেই চিরকেলে বোকা মুখচোরা বকুলই হচ্ছে বোন। মুখে একটা বাক্যি ছিল না, কেউ অন্যায় করে শাসন করলে বলতে জানতো না, শুধু শুধু বকছো কেন? আমি তো ও দোষটা করিনি! সেই বকুল লেকচার দিয়ে বেড়ায় শুনলে হাসি পায়। অবিশ্যি আমাদের তো বাবা অতি সকালে গলা টিপে বাড়ি থেকে বার করে দিয়ে খালাস হয়েছিলেন, পরে পারুল বকুলকে আধুনিক-টাধুনিক করে মানুষ করে থাকবেন। ছেলেদের তাই বলি, ওরে এক মায়েরই পেটের আমরা, তোদের মাকেও অতি সকালে গোয়ালে ঢুকিয়ে না দিলে, তোদের মাসির মতোই হতে পারতো!…তবে বাবা এও বলবো, বকুল একটা কীর্তি রাখা কাজ করেছে বিয়ে না করে। এ বংশের তিনকুলে কেউ আর দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত দেখাতে পারবে না। প্রথম প্রথম তো শ্বশুরবাড়িতে মুখ দেখাতে পারতাম না, বাপের বাড়ি আসা বন্ধই হয়ে গিয়েছিল ওই কারণে

অপূর্বর বৌ অলকা মৃদু হেসে বলে, সে সব তো ক্লাইভের আমলের কথা।

চন্দন মহোৎসাহে বলে, তোমাদের কাছে তাই আমাদের কাছে যেন এই সেদিন। সে যাক, মিষ্টিটা ঘরে তোলো গো কেউ, পিঁপড়ে ধরবে। কুলগুলো এইবেলা রোদে ফেললে হতো!

মানকচু, কাঁচা পেপে, টোপাকুল, কাতলা মাছ–সব কিছুর সঙ্গে বাড়ির প্রসঙ্গ মিশিয়ে মিশিয়ে একাই সব কথা কয়ে যায় চন্দন।

অলকা আর তার মা ঘরে ঢুকে হাসাহাসি করে বলে, আজব চীজ!

কানুর বৌ ঘরে বসেই কাকে বলে, ভাগ্যিস ওঁর বাপের বাড়ি আসা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল! না হলে হেসেই মারা যেতে হতো আমাদের। কিন্তু হঠাৎ এরকম আসার কারণটা কী বুঝতে পারছো?

কানু বলে, তাই ভাবছি।

এই মেজকর্তা মেজগিন্নী সাতে-পাঁচে থাকেন না, বাড়িতে যে ধরনের ঘটনাই ঘটুক তারা নির্লিপের ভূমিকা অভিনয় করে যান, তবু তারাও চন্দনের আগমন সম্পর্কে কৌতূহলী হয়ে ওঠেন। সকলেরই এক চিন্তা-ইনি কেন হঠাৎ?

বকুল ফিরলো সন্ধ্যার পর।

দরজায় ছোট চাকরটা বসে ছিল, তাড়াতাড়ি বলে উলো, পিসিমা, আপনার একজন বোন এসেছেন বিদেশ থেকে।

বকুলের বুকটা আহ্লাদে ধক করে উঠলো, পারুলের ঝকঝকে মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো তার। পারুল ছাড়া আর কে? দিদি মানে তো পারুল!

সত্যি বলতে, চাঁপা চন্দনকে কোনোদিনই তার নিজের দিদি বলে মনেই হয় না। একে তো তার জ্ঞানের আগেই ওদের বিয়ে হয়ে গেছে, তাছাড়া ওলের সঙ্গে বকুল পারুলের মানসিক ব্যবধান আকাশ-পাতাল।

পারুলের আর্বিভাব আশায় বকুলের মনের ভারটা ভারী হাল্কা হয়ে গেল। হা, মনের ভার একটা ছিল বৈকি। শম্পা চলে যাওয়ার সব দোষটাই তো ছোড়দা ছোটবৌদি অব্যক্তভাবে তারই উপর চাপিয়ে বসে আছে।

অথবা একেবারে অব্যক্তও নয়। যখন জানা গেল বাপের নাকের সামনে দিয়ে সেই যে চটি পায়ে দিয়ে আচ্ছা তোমার আদেশ মনে রাখবো বলে বেরিয়ে গেল শম্পা, সেটাই তার শেষ যাওয়া–তখন তো বকুলকে নিয়েই পড়েছিল তার ছোড়দা ছোটবৌদি। এমন কি ভাইপো অপূর্ব এবং তস্য স্ত্রী-কন্যা পর্যন্ত।

নিজেই যখন খুব চিন্তিত বকুল, মেয়েটা কোথায় যেতে পারে ভেবে (কারণ বকুলের তো ওই যাত্রাকালীন ইতিহাসটা জানা ছিল না), তখন যে-ছোড়দা জীবনে কখনো তিনতলার এই ঘরটার ছায়াও মাড়ায় না সে একেবারে সস্ত্রীক উঠে এসে বলে উঠল, শ্রীমতী অনামিকা দেবীর মূল্যবান সময় একটু নষ্ট করতে এলাম!

অনামিকা দেবী!

বকুল একবার ছোড়দার মুখের দিকে তাকালো, তার মুখে এলো হঠাৎ পাগলামি শুরু করলে কেন? কিন্তু তা সে করলো না, সঙ্গে সঙ্গে অনামিকা দেবীই হয়ে গেল সে। স্রেফ বাইরের লোকের সঙ্গে কথা বলার মতো শান্ত ভঙ্গীতে বললো, বোস, কী বলবে বল।

নতুন করে বলার কিছু নেই, বললো পিছনে দাঁড়ানো অপূর্ব। ইতিপূর্বে অপূর্বকে কোনোদিন তার ছোট কাকার এমন কাছাকাছি দেখেছেন কিনা মনে করতে পারলেন না গাম্ভীর্যময়ী অনামিকা দেবী! সেই গাম্ভীর্যের অন্তরালে এক টুকরো ব্যঙ্গ হাসি খেলে গেল–ওঃ, পারিবারিক মানমর্যাদার প্রশ্ন যে! এ বাড়িতে যেটা বরাবর বাড়ির পুরুষদের মৈত্রীবন্ধনে বেঁধেছে। বাবার সঙ্গে বড়দার কোনোদিনই হৃদ্যতার বালাই ছিল না, কিন্তু বকুলের নির্মলদের বাড়িতে যাওয়া-আসার ব্যাপার নিয়ে পিতাপুত্রে রীতিমত একদল হয়েছিলেন।

অনামিকা অপুর্বর এই উত্তেজিত মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলেন শুধু, কিছু বললেন না। অপূর্ব বললো বাকি কথাটা–শম্পার ব্যাপার নিয়েই কথা হচ্ছে। তার ঠিকানাটা তো জানা দরকার।

অনামিকা খুব স্থিরভাবে বললেন, সেই ঠিকানাটা আমার খাতায় লেখা আছে, এইটাই কি তোমাদের ধারণা?

এবার ছোড়দা উত্তর দিলেন, সে ধারণাটা খুব অস্বাভাবিক নয় নিশ্চয়ই?

আমার তো খুবই অস্বাভাবিক ঠেকছে।

এটা হচ্ছে তোমার এড়িয়ে যাওয়া কথা বকুল, তোমার কাছেই ছিল তার সব কথা, সব গল্প।

এ কথাটা বললেন ছোট বৗদি।

অনামিকা দেবীর ভঙ্গীতেই মৃদু হাসলো বকুল, তোমাদের তো দেখছি ত্রিশক্তি সম্মেলন, একা কী পেরে উঠবো? তবে এটা তোমাদের বোধ হয় ভুলে যাবার কথা নয়, শম্পা কোনো পূর্বপরিকল্পিত ব্যবস্থায় বাক্সবিছানা বেঁধে নিয়ে চলে যায়নি। কথা বলতে বলতে জেদের মাথায় চলে গেছে, আমি অন্ততঃ যা শুনেছি তোমাদের কাছে। অতএব আমার পক্ষে ওর ঠিকানা জানার প্রশ্নই ওঠা অদ্ভুত বৈকি। ব্যবস্থা করে যদি যেতো, হয়তো আমায় জানিয়ে। যেতো।

হয়তো কেন নিশ্চয়ই, সব পরামর্শই তো তোমার সঙ্গে– ছোটবৌদি পুঞ্জীভূত ঝাল উদ্গীরণ করে বলেছিলেন, মা মুখ্যু, সেকেলে গাঁইয়া, পিসী বিদুষী, আধুনিকা, সভ্য–কাজেই মার চেয়ে পিসীর মানসম্মান বেশী হবে এটাই তো স্বাভাবিক। তবে এটাও বলবো–তুমি যদি সত্যিই ওর হিতৈষী হতে, তা হলে ওকে ওর ইষ্ট-অনিষ্ট বোঝাতে। তা তুমি করোনি, শুধু আহ্লাদ দিয়ে দিয়ে নিজের দলে টেনেছে।

দলে! অনামিকার মুখটা হঠাৎ খুব বেশী লাল দেখায়, তবু কথা তিনি খুব নিরুত্তেজ গলাতেই বলেন, আমার যে বিশেষ কোনো দল আছে, তা তো আমার নিজেরই জানা ছিল না ছোটবৌদি! তবে দল থাকলে দলে টানার চেষ্টা থাকাটাও স্বাভাবিক।

এটা ঝগড়া করবার সময় নয়, ছোড়দা গম্ভীর গলায় বলে উঠেছিলেন, একটা পারিবারিক সুনাম-দুর্নামের প্রশ্ন নিয়ে কথা হচ্ছে। তোমার যদি জানা থাকে বকুল তবে সেটা বলে ফেলাই উচিত, সে বারণ করলেও।

কিন্তু আমার উত্তর তো আগেই শুনে নিয়েছ ছোড়দা। ঠিকানা ঠিকঠাক করে যদি কোথাও যেতো শম্পা, তাহলে হয়তো আমাকেই দিয়ে যেত ঠিকানাটা কিন্তু ঘটনাটা তো তা নয়!

কিন্তু মা-বাপকে বাদ দিয়ে তোমাকেই বা দিতো কেন?

অনামিকা হেসে ফেলেছিলেন, এ ‘কেন’র উত্তর আমার জানা নেই ছোড়দা। মেয়েটা কাছে থাকলে তাকেই করা চলতো প্রশ্নটা।

প্রশ্রয় দিলেই সে সুয়ো হয়, ছোটবৌদি তীব্র গলায় বলেন, কাঁদের সঙ্গে মিশতো সে, সে খবর তো জানা আছে তোমার, সেইগুলোই না হয় বলো।

যাদের সঙ্গে মিশত, তাদের আকৃতি-প্রকৃতির পরিচয় সে মাঝে মাঝে আমায় দিতে আসতো। কিন্তু ঠিকানা? কই মনে তো পড়ছে না!

তা হলে তুমি বলতে চাও জলজ্যান্ত মেয়েটা কর্পূরের মতোন উপে যাবে, আর সেটাই মেনে নিতে হবে?

হঠাৎ ছোটবৌদির চোখ থেকে একঝলক জল গড়িয়ে পড়েছিল।

অনামিকা সেই দিকে তাকিয়ে দেখে আস্তে বকুলের কাঠামোয় ফিরে এসেছিলে, নম্রকোমল গলায় বলেছিলেন, আমি এই অদ্ভুতটা চাই, তা কেন ভাবছো ছোটবৌদি? সত্যিই বলছি আমি তোমাদের মতোই অন্ধকারে আছি।

সে কথা বলে তুমি নিশ্চিন্দি হয়ে উপন্যাস লিখতে বসতে পারো বকুল, আমরা পারি না।

ছোটবৌদির গলায় কাঠিন্য, কিন্তু চোখে এখনো জল। বকুলকে অতএব নম্র আর কোমলই থাকতে হয়। বলতেই হয়, সে তো সত্যি কথাই বৌদি। মা-বাপের মনপ্রাণের সঙ্গে আর কার তুলনা!

ছোড়দাও এবার কোমল হয়েছিলেন, বলেছিলেন, না, সে কথা হচ্ছে না, তুইও ওকে মা বাপের থেকে কম ভালবাসিস না, বরং বেশীই। আর সেইজন্যেই তোকে ব্যস্ত করতে আসা। মনে হচ্ছে খবরটবর যদি কিছু দেয় সেই উদ্ধত অহঙ্কারী নিষ্ঠুর মেয়েটা, তোর কাছেই দেবে। যদি দেয় সঙ্গে সঙ্গে জানাস।

বকুল চোখ তুলে একটু হেসেছিল। যে হাসিটা কথা হলে এই দাঁড়াতো, সেটা আবার বলছো?

আর সেই সময়ই হঠাৎ খেয়াল হয়েছিল বকুলের, যেন যুগযুগান্তর পরে ছোড়দা তাকে ‘তুই’ করে কথা বললো।

বকুলের একান্ত বাসনা হতে থাকে কালই যেন খবর আসে শম্পার, আর সেটা যেন ওর মা-বাপের কাছেই আসে। বকুলের গর্ব খর্ব হোক, সেটাই প্রার্থনা। সে প্রার্থনা পূরণ না হওয়া পর্যন্ত যেন মাথা তুলতে পারবে না বকুল।

কিন্তু তারপর কতগুলো দিন কেটে গেল, কারুর গর্বই বজায় রইল না, খবর এলো না শম্পার। না পিসির কাছে, না মা-বাপের কাছে।

তবু কি ওরা সবাই ভাবতে বসবে, রাগের মাথায় বেরিয়ে যেতে গিয়ে কোনো দুর্ঘটনার মুখে পড়েছে শম্পা? কিন্তু তাই বা ভাবতে পারছে কই? তেমন খবর কি চাপা থাকে? তেমন খবর চাপা থাকে না নিশ্চয়ই।

কোনো খবরই চাপা থাকে না। বিশেষ করে দুঃসংবাদের।

দুঃসংবাদের একটা দুরন্ত গতিবেগ আছে, সে বাতাসের আগে ছোটে। নইলে শম্পার এই হারিয়ে যাবার খবরটা শম্পাদের সমস্ত আত্মীয়জনের কাছে পৌঁছয় কি করে?

পৌঁছয় বৈকি, নইলে হঠাৎই বা কেন এদের বাড়িতে এতো আত্মীয়-বন্ধুর পদধূলি পড়তে থাকে? আর কেনই বা তারা অনেক গল্পগাছা করে উঠে যাবার প্রাক্কালে হঠাৎ সচকিত হয়ে প্রশ্ন করেন, শম্পাকে দেখলাম না যে!

শম্পার আরো ভাই বিলেতে আছে, বাড়িতে আরো মেয়েটেয়ে আছে সেজ কর্তার দিকে, সকলের কথা তো মনে পড়ে না সকলের।

গোঁজামিল দেওয়া একটা উত্তরে তারা সন্তুষ্ট হন না, শুধু সন্তোষভাব দেখান। কিন্তু মুখের চেহারা অন্য কথা বলে।

তথাপি ওই প্রশ্নটা যে নিরুদ্দেশ রাজার উদ্দেশ করিয়ে ছাড়বে, রাণাঘাট থেকে এ বাড়ির কর্তার বহুদিন নিরুদ্দিষ্ট মেজো মেয়ে সেই প্রশ্নটা বহন করে আনবে, এতোটা কেউ আশা কারেনি। আশা করবার মতো নয় বলেই করেনি।

তাই বিদেশ থেকে বোন এসেছে শুনে আশায় আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিল বকুলের বুক।

বকুলের চোখের সামনে পারুলের ঝকঝকে চেহারাটা ভেসে উঠেছিল।

কিন্তু

কিন্তু তার বদলে?

তার বদলে চির-অব্যবহৃত ‘মেজদি’ শব্দটার পোশাক-আঁটা অজ্ঞাত অপরিচিত মানুষটা বকুলের ঘরে এসে বকুলের মুখের কাছাকাছি মুখ এনে ফিসফিসিয়ে প্রশ্ন করে, হারে, মানুর মেয়েটা নাকি কোন একটা ছোটলোকের সঙ্গে বেরিয়ে গেছে?

বকুল চমকে উঠলো।

তার ভিতরের রুচি নামক শব্দটাই যেন সিঁটিয়ে উঠলো এ প্রশ্নে। আর সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ মনে হলো বকুলের, ইনি আমার সেজদিরও সহোদরা বোন। ইনি আমাদের মায়ের গর্ভজাত।

আশ্চর্য বৈকি!

ভাবলে কী অদ্ভুত আশ্চর্য লাগে! একই মানুষের মধ্যেই সৃষ্ট হয় কতো বর্ণ-বৈচিত্র্য, কতো জাতি-বৈচিত্র্য! মেজদি আর সেজদি কি এক জাতের?

বড়দি আর আমি? অথবা সবই পরিবেশের কারসাজি?

ওই ভাবনাটার মাঝখানেই মেজদি আবার প্রশ্ন করে উঠলো, কথাটা তাহলে সত্যি? বাবার বংশে তাহলে সব রকমই হলো?

বকুল মুখটা একটু সরিয়ে নিয়ে একটু কঠিন হেসে বললো, শুধু আমাদের বাবার বংশে কেন মেজদি, আজকের দিনে সকলের বংশেই সব রকম হচ্ছে!

হচ্ছে? সবাইয়েরই হচ্ছে?

হচ্ছে বৈকি। আর সেটা তো হতেই হবে। কালবদল হবে না? যুগবদল হবে না? সমাজের রীতিনীতি আচার-আচরণ সব অনড় হয়ে থাকবে? মানুষ চিরকাল এক ছাঁচেই থেকে যাবে?

এ ধরনের কথা বড় একটা বলে না বকুল। বললো শুধু মানুষটা তার একান্ত অন্তরঙ্গ হয়ে একান্তে তার ভাই-ভাইবৌ-ভাইঝির সমালোচনা করতে বসেছে দেখে।

বকুলের এই তিনতলার ঘরটাতেই বিছানা বিছানো হয়েছে চন্দনের জন্যে, আর অপ্রতিবাদেই সেটা মেনে নিতে হয়েছে বকুলকে। তাই প্রথম থেকেই বকুল আত্মরক্ষায় সচেতন হতে চাইছে।

যুগ যে বদল হয়, কাল যে বদল হয়, এটা স্পষ্ট করে বলে নিজেকে মুক্ত রাখতে চাইছে। ওই সমালোচনার জাল থেকে।

মেজদি বলে ওঠে, তা তুই তো ও কথা বলবিই! তুই তো আবার নভেল লিখিস! ওই নাটক নভেল আর সিনেমা এই থেকেই তো দেশ ধ্বংস হতে চলেছে!

কে বললে তোমায় এ কথাটা?

বলবে আবার কে? চন্দন গভীর আত্মস্থ গলায় বলে, চোখ নেই দুটা? দেখতে পাচ্ছি না? কী ছিল সমাজ, আর কী হয়ে উঠেছে?

খারাপ হয়ে উঠেছে কিছু?

খারাপ নয়? চন্দন গালে হাত দেয়, আজকাল যা হচ্ছে তা খারাপ নয়, ভালো হচ্ছে? এই যে মেয়েগুলো হুট হুট করে পৃথিবী পয়লট্ট করছে, এটা ভালো? এই তো আমার সেজমেয়ের ননদটা, বিয়ে হলো আর বরের সঙ্গে আমেরিকা চলে গেল, এটাকে তুই খুব ভালো বলিস?

বকুল হেসে ফেলে, খারাপই বা কী? নিজের বরের সঙ্গেই তো?

বাবা বাবা, তোর সঙ্গে কথা কওয়া ঝকমারি! তুইও অতি আধুনিক হয়ে গিয়েছিস! বর হলেই অমনি তাকে ট্যাকে পুরতে হবে? দুদিন সবুর কর! যেখানে বিয়ে হলো তাদের সঙ্গে একটু চেনাজানা কর! তা নয়, জগতে শুধু বরটি আর বৌটি। যেন জীবজন্তু, পাখী-পক্ষী। ত্রিভুবনে আর কেউ নেই, শুধু উনিটি আর আমিটি। তাও তো সেই জুটিটিও ভাঙছে, যখন ইচ্ছে তখন আর একটার সঙ্গে জোড় বেঁধে ভাঙা সংসার জুড়ে নিয়ে দিব্যি আবার সংসার করছে। তবে আর এতকাল ধরে পৃথিবীতে এতো বেদ পুরাণ শাত্তর পালা গড়া হলো কেন? এই রকম চললে মানুষ এরপর হয়তো গাছের ফল পাতা খাবে আর উলঙ্গ হয়ে বেড়াবে যা দেখছি!

বকুল এঁর মতবাদে চমৎকৃত হয়, আবার শঙ্কিতও হয়, এঁকে নিয়ে সারা রাত্তিরটা কাটাতে হবে বকুলকে! হয়তো মাত্র একটা রাত্তিরই নয়, একাধিক রাত্তির!

অথচ পারুলও আসতে পারতো। আশ্চর্য, পারুলের একবারও মা-বাপের স্মৃতি-সম্বলিত বাড়িটার কথা মনে পড়ে না?

চন্দনের আবার মুহুর্মুহু দোক্তা খাওয়ার অভ্যাস, সেই বিজাতীয় গন্ধটা থেকে নিজেকে খানিক তফাতে সরিয়ে এনে বকুল বলে, তা এক সময়ে তো মানুষ তাই বেড়াত মেজদি, আর লোকে সেটাকেই “সত্যযুগ” বলে।

অনাছিষ্টি কথা বলিসনে বকুল, দেখছি তোর মতিগতি একেবারে বেহেড হয়ে গেছে। ছোটবৌ দুঃখ করে যা বললো, তা দেখছি সত্যি!

বকুল চমকালো না। চুপ করে থাকলো। ছোটবৌ দুঃখ করে কী বলেছে সেটা সে অনুমান করতে পারছে।

চন্দন কৌটো খুলে পান বার করে মুখে দিয়ে বললো, তা তোরও বাপু উচিত নয় সোমত্ত মেয়েটাকে এভাবে আস্কারা দেওয়া! লেখিকা হয়ে নাম করেছিস বলে কি মাথা কিনেছিস? কত বড় বংশ আমাদের, সেটা ভেবে দেখবি না?

বকুলের ইচ্ছে হয় না আর এর সঙ্গে তর্ক করে, তবু কথার উত্তর না দেওয়াটা অসৌজন্য এই ভেবে শান্ত গলায় বলে, বড় বংশ কাকে বলে বল তো মেজদি?

মেজদি একটু থতমত খেয়ে বলে, কাকে বলে, সেটা আমি তোকে বোঝাবো? এ বংশে আগে কখনো এদিক-ওদিক হয়েছে?

সেইটেই বড় বংশের সার্টিফিকেট মেজদি?

মেজদি তা বলে হারেন না, তাই বলে ওঠেন, তা আমরা সেটাকেই বড় বলি। সব বংশেই কি আর রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ জন্মায়?

তা বটে। বলে একটু হাসে বকুল।

চন্দন উঠে গিয়ে ছাতের কোণে পানের পিক ফেলে এসে বলে, ছোট বৌটার প্রাণে জ্বালাও তো কম নয়। একেই তো ছেলেটা লেখাপড়া শেষ করেও বিলেতে বসে আছে, ভগবান জানেন কী মতলবে, তার ওপর মেয়ে এই কীর্তি করলো

প্রসূন তো বিলেতে চাকরি করছে

তুই থাম বকুল! বিলেতে চাকরি করছে। বিলেতে আর চাকরির উপযুক্ত লোক নেই, তাই একটা বাঙালীর ছেলেকে ধরে চাকরি দিয়েছে! ও সব ভুজুং শোনবার পাত্রী চন্দন নয়। মেম ফেম বিয়ে করেছেন কিনা বাছাধন কে জানে!

বকুল আর একবার নিঃশ্বাস ফেললো। এই ভদ্রমহিলা বকুলের সহোদরা!

চন্দন আবার বলে ওঠে, অবিশ্যি দোষ ছেলে-মেয়েকে দেব না, বাপ-মাকেই দেব। যেমন গড়েছ তেমনি হয়েছে। তুমি গড়তে পারলে শিব পাবে, না পারলে বাঁদর পাবে।

বকুল মৃদু হেসে বলে, তাই কি ঠিক মেজদি? আমাদের মা-বাপ তো তোমাকেও গড়েছেন, আবার আমাকেও–।

মেজদি ভুরু কুঁচকে বলেন, কী বলছিস?

অন্য কিছু না। তোমার বড়দির কত শিক্ষাদীক্ষা, শাস্ত্রজ্ঞান, সে তুলনায় সেজদি আর আমি তো যা-তা! অথচ একই মায়ের

চন্দন এই অভিমতটি পরিপাক করে বলে, আমাদের শিক্ষা-দীক্ষা সবই বাবা শ্বশুরবাড়ির। এ সংসার থেকে তো কবেই দূর হয়ে গেছি। নেহাৎ নাড়ির টান, তাই মানুর মেয়েটার বেরিয়ে যাওয়ার খবর শুনে

বকুল শান্ত গলায় বলে, মেজদি, তোমার মেয়েদের খবর বলো

চট করে নিজের জগতে চলে যায় চন্দন। একে একে তার পাঁচ মেয়ের নিখুঁত জীবনী আওড়াতে বসে।

ক্লান্ত বকুলের মাথার মধ্যে কিছুই ঢোকে না। কিন্তু বকুলকে কে উদ্ধার করবে?

.

তা তেমন কাতর প্রার্থনা বুঝি ভগবান কানে শোনেন।

নইলে রাত সাড়ে নটায় একটি ভদ্রমহিলা দেখা করতে আসেন অনামিকা দেবীর সঙ্গে?

ছোট চাকরটার মুখস্থ হয়ে গেছে ভাষাটা, সে সিঁড়ির আধখানা পর্যন্ত উঠেই গলা তুলে ডাক দেয়, পিসিমা, একটি ভদ্রমহিলা দেখা করতে এসেছে আপনার সঙ্গে।

ভদ্রমহিলা! এই রাত্তির সাড়ে নটায়?

বকুল অবাক একটু হয়, তবে এমন ব্যাপার একেবারেই অপূর্ব অঘটন নয়। রাত দশটার পরেও এসে হানা দেয় এমন লোক আছে।

বকুল তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে বলে, জিজ্ঞেস করে আয় তো কোথা থেকে আসছেন?

জিজ্ঞেস করেছি। জানি তো নইলে আবার ছুটতে হতো। বলল, বল গে জলপাইগুড়ির নমিতা, তাহলেই বুঝতে পারবেন।

ছেলেটা চৌকস। সিনেমা-থিয়েটারের ভৃত্যের ভূমিকাভিনেতাদের মতো উজবুক অদ্ভুত নয়।

এ ছোঁকরা পায়জামা প্যান্ট ভিন্ন পরে না, রোজ সাবানকাঁচা ভিন্ন জামা গেঞ্জি ছুঁতে পারে না এবং পাউরুটি ব্যতীত হাতেগড়া রুটি জলখাবার খেতে পারে না। সপ্তাহে একবার করে সিনেমা যাওয়া ওর বাঁধা এবং বাঙালীর ছেলে হলেও বাংলা নাটকের থেকে হিন্দীকে প্রাধান্য দেয় বেশী। বাবুটাবুদের সামনেই সেই হিন্দী ছবির গানের কলি গুনগুনাতেও কিছুমাত্র লজ্জাবোধ করে না এবং পুজোর সময় ওকে ধুতি দিলে ধুতি পরতে পারি না, পায়ে জড়িয়ে যায় বলে ফেরত দিয়ে দিতে কুণ্ঠাবোধ করে না।

এহেন চাকরকে দিয়ে বাইরের কাজ করানোর অসুবিধে নেই।

তাছাড়া পিসিমার কাজের ব্যাপারে ছেলেটা পরম উৎসাহী, অনামিকার কাছে অনেক লোকজনই তো আসে, ছেলেটা তাদের জন্যে চায়ের জল চাপাতে একপায়ে খাড়া।

বকুল হাত নেড়ে বলে, আচ্ছা তুই যা, আমি যাচ্ছি।

.

জলপাইগুড়ির নমিতা! নামটা খুব স্পষ্ট মনে পড়ছে, তার কথাগুলোও। কিন্তু চেহারাটা? সেটা স্পষ্ট নয়, যেন ঝাঁপসা-ঝাঁপসা। ভাবতে ভাবতে নেমে এল।

মেজদি খুব বিরক্ত হয়ে বলে উঠলো, বাবা, এই রাতদুপুরে আবার কে এলো? মরণ! তাই বলেছিল ওরা, বাড়ি তো নয় হাটবাজার, রাতদিন লোক! দেখালি বটে বাবা খুব!

শেষটা কানে যায় না বকুলের, নেমে গেছে ততক্ষণে।

জলপাইগুড়ির নমিতা!

সেই মাঝরাত্তিরে এসে আস্তে আস্তে কথা বলা, বিষণ্ণ-বিষম মেয়েটা। একদিনের দেখাতেই জীবনের কাহিনী বলতে বসেছিল। অবশ্য অনামিকার ভাগ্যে তেমন অভিজ্ঞতা অনেক আছে, অদেখা মানুষ টেলিফোনে ডেকেও আপন জীবনের দুঃখের কাহিনী শোনাতে বসে, কিন্তু এই বৌটির দুঃখ যেন একটু অন্য ধরনের।

কী ধরনের? মনে পড়িয়ে নিয়ে নিচে যাওয়া দরকার, তা নইলে হয়তো লজ্জায় পড়তে হবে। আহত হয়ে বলবে, সে কি? আমার কথা আপনার মনে নেই?

তা মনে পড়ে গেল। স্বামী সাধু হয়ে চলে গেছে, হরিদ্বারে না হৃষিকেশে কে জানে কোথায়! কিন্তু ওর মুখটা মনে পড়ছে না কেন? কেমন দেখতে নমিতার মুখটা? ভাবতে ভাবতে নেমে এসে পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গেই মনে মনে খুব একটা লজ্জাবোধ করলেন অনামিকা। এতো চেনা মুখটা মনে করতে পারছিলাম না! অথচ এখন একেবারে অতি-পরিচিত লাগছে!

হয়তো ওই লাগাটার কারণ মেয়েটার একান্ত বিশ্বস্ত চেহারাটার জন্যে। ও যেন ওর কোন পরম আত্মীয়ের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। ওর মুখে সেই আশ্রয় প্রাপ্তির ছাপ।

ওই ছাপটাই মনে করালো মুখটা বড় বেশী পরিচিত। কী আশ্চর্য, এইটা মনে আসছিল না!

এরকম আজকাল প্রায়-প্রায় হচ্ছে অনামিকার। নাম মনে পড়ছে তো মুখ মনে পড়ছে। আবার হয়তো মুখ মনে পড়ছে, নামটা কিছুতেই মনে আসছে না! স্মৃতির দরজায় মাথা খুঁড়ে ফেলেও না।

বয়েস হওয়ার এইটাই বোধ করি প্রথম লক্ষণ। অবশ্য সবাইয়ের বয়েস একই নিয়মে বাড়ে না। সনৎকাকার কি কারো মুখ চিনতে দেরি হয়? অথবা তাদের নাম মনে আনতে? কি জানি!

অনামিকাকে দেখেই তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালো নমিতা, এগিয়ে এসে অনামিকা ‘থাক থাক’ বলে পিছিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও পায়ের ধুলো না নিয়ে ছাড়লো না। এবং অনামিকা কিছু বলবার আগেই তাড়াতাড়ি বলে উঠলো, এতো রাত্তিরে এসে খুব বিরক্ত করলাম তো?

এক্ষেত্রে যা বলতে হয় তাই বললেন অনামিকা। বিরক্তির প্রশ্ন ওঠে না সেটাই জানালেন সুন্দরভাবে।

তারপর বললেন, কী খবর?

নমিতা স্বভাবসিদ্ধ মৃদু গলায় বললে, খবর কিছু না, আপনাকে দেখবার ইচ্ছে হচ্ছিল খুব

শুধু আমাকে একবার দেখবার ইচ্ছেয়? অনামিকা হাসলেন, আশ্চর্য তো! তার জন্যে এত কষ্ট করে? কবে এলে কলকাতায়? এখানে এলে কার সঙ্গে?

ও একে একে বললো, আমার একটি ভাইপো পৌঁছে দিয়ে গেছে। এই পাড়ায় তার মাসির বাড়ি, ওখানে ঘুরে আবার এসে নিয়ে যাবে। কলকাতায় এসেছি দিন দশেক। আপনাকে দেখবার জন্যে কষ্ট করে আসার কথা বলছেন? কষ্ট কী? বলুন যে ভাগ্য! আপনাদের মতো মানুষদের চোখে দেখলেও প্রাণে সাহস আসে।

তার মানে নমিতা নামের মেয়েটা প্রাণে সাহস সংগ্রহের জন্যেই এই রাত্তিরে চেষ্টা করে সঙ্গী জুটিয়ে এসে হাজির হয়েছে! তার মানে নমিতার এখন কোনো কারণে সাহসের দরকার হয়েছে।

তবে প্রশ্ন করে বিপন্ন হবার সাহস অনামিকার হলো না। তিনি আলতোভাবে বললেন, জলপাইগুড়ির খবর কী?

খবর ভালই! মামা বেশ ভাল আছেন। বলেই খাপছাড়া ভাবে বলে ওঠে নমিতা, আমি ওখান থেকে চিরকালের মতো চলে এসেছি। আর ফিরবো না।

এমনি একটা কিছু অনুমান করেছিলেন অনামিকা। ওকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে, যতই মৃদুছলে কথা বলুক, আপাততঃ ও একটি ছন্দপতনের শিকার। সেই যে ওর লক্ষ্মী-বৌয়ের ভূমিকা, সে ভূমিকায় আর বন্দী নেই নমিতা।

তবু প্রশ্নের মধ্যে গেলেন না অনামিকা, সাবধানে বললেন, তাই বুঝি?

হ্যাঁ, আমি মনস্থির করে ফেলেছি। কেন ফিরবো বলুন তো? সেখানে আমার প্রত্যাশার কী আছে?

অনামিকার মনে হলো, ও বদলে গেছে। আবার ভাবলেন, ও বদলে গেছে এ কথা ভাবছি কেন? ও হয়তো এই রকমই ছিল। এক-দুদিনে কি মানুষকে চেনা যায়? আমি ওর জীবনের সব ইতিহাস জানি? হয়তো ও এই ভাবেই একাধিক আশ্রয় থেকে ছিটকে ছিটকে বেরিয়ে এসেছে। হয়তো মূলকেন্দ্র থেকে চ্যুত হলে এমন একটা অবস্থাই ঘটে।

স্বামীর ঘরটা একটা আইনসঙ্গত অধিকারের মাটি, যেখানে দাঁড়িয়ে জীবনযুদ্ধে লড়ে যাওয়া সহজ। ওখানে প্রেম নামক দুর্লভ বস্তুটি নিয়ে মাথা না ঘামালেও কাজ ঠিকই চলে যায়। কিন্তু আর সেই সবই তো অনধিকারের জমি। সেখানে কেবলমাত্র মনোরঞ্জন ক্ষমতার জোরে টিকে থাকতে হয়। অতএব প্রতিপদেই হতাশ হতে হয়। নমিতা হয়তো তেমনি হতাশ হয়েছে।

দেখেছে চেষ্টা করে, কারো মনোরঞ্জন করা যায় না। কোথাও কোনো মন যদি আপনি রঞ্জিত হলে তো হলো, নচেৎ শ্রমই সার।

কিন্তু এসব কথা জিজ্ঞেস করা যায় না, তাই অনামিকা বলেন, কলকাতায় তোমার বাপের বাড়ি, তাই না?

আন্দাজে ঢিল ফেলেন অবশ্য। হয়তো নমিতা ওর পরিচয়লিপি পেশ করেছিল সেই সেদিন রাত্রে, কিন্তু মনে থাকা সম্ভব নয়। অথচ সম্ভব যে নয়, সেকথা অপরকে বোঝানো কঠিন। সে ভাববে, আশ্চর্য, অতো কথা মনে রইল না! তবুও নমিতা এ প্রশ্নে আহত হয়।

সেই আহত সুরেই বলে, বাপের বাড়িতে আবার আমার কে আছে? আপনি তো সবই জানেন। বলেছি তো সবই।

বিপদ!

অনামিকা মনে মনে বলেন, বলেছে তো সবই, কিন্তু আমার কি ছাই মনে আছে? কিন্তু মুখে তো সেকথা বলা যায় না। তাই বলতে হয়, হ্যাঁ, সে তো জানিই। তবে মানে বলছিলাম কি, এখন তো কলকাতাতেই থাকতে হবে?

স্বরটা নিদারুণ নির্লিপ্ত, কিন্তু নমিতা সেই নির্লিপ্ত ভঙ্গীটি ধরতে পরে না; নমিতার বোধ করি মনে হয়, এটা নির্দেশ, তাই নমিতা ঈষৎ উত্তেজিত গলায় বলে, থাকতেই যে হবে তার কোনো মানে নেই। এখন আমি স্বাধীন, এখন আমি যা ইচ্ছে করতে পারি।

তাজ্জব! হঠাৎ এমন অগাধ স্বাধীনতাটি কোন সূত্রে লাভ করে বসলো নমিতা?

তা সূত্রটা নমিতা নিজেই ধরিয়ে দিল। ধরিয়ে দিল তার উত্তেজিত চিত্তের পরস্পর বিরোধী সংলাপ।

হঠাৎ একদিন চোখটা খুলে গেল, বুঝলেন? হঠাৎ নিজেকে নিজে জিজ্ঞেস করলাম, এখানে এইভাবে দাসীর মত পড়ে আছিস কেন তুই? উত্তর পেলাম, “শুধু দুটো ভাতের জন্যে।” ঘেন্না ধরে গেল নিজের ওপর।

অনামিকা শান্ত গলায় বলেন, শুধু ভাতের জন্যে কেন বলছো নমিতা? তার থেকে অনেক বড়ো কথা ‘আশ্রয়’। আশ্রয়, নিরাপত্তা, সামাজিক পরিচয়–এইগুলোর কাছেই মানুষ নিরুপায়।

কিন্তু নমিতা এ যুক্তিতে বিচলিত হলো না। কারণ নমিতার হঠাৎ চোখ খুলে গেছে।

দৃষ্টিহীনের হঠাৎ দৃষ্টি খুলে যাওয়া বড় ভয়ানক, সেই সদ্য-খোলা দৃষ্টিতে সে যখন নিজের অতীতকে দেখতে বসে, এবং সেই দেখার মধ্যে আপন অন্ধত্বের শোচনীয় দুর্বলতাটি আবিষ্কার করে, তখন লজ্জায় ধিক্কারে মরীয়া হয়ে ওঠে। আর তখন সেই দুর্বলতার ত্রুটি পূরণের চেষ্টায় কাণ্ডজ্ঞানহীন হয়ে ওঠে।

আমাকে সবাই ঠকিয়ে খেয়েছে, বুঝলেন, আমাকে সবাই ভাঙিয়ে খেয়েছে। আমি যে একটা রক্তমাংসের মানুষ, আমারও যে সুখ-দুঃখ বোধ আছে, শ্রান্তি-ক্লান্তি আছে, ভাল-লাগা ভাল-না-লাগা আছে সেকথা কোনোদিন কারুর খেয়ালে আসেনি।

খেয়ালে যে নমিতার নিজেরও আসেনি, এ কথা এখন ওকে বোঝায় কে?

লক্ষ্মী-বৌ নাম কেনার জন্যে, অসহায়ের পরম আশ্রয়টিকে শক্ত রাখবার জন্যে, নমিতা নিজেকে পাথরের মতো করে রেখেছিল, কাজেই নমিতার পরিবেশটাও ভুলে গিয়েছিল নমিতা রক্তমাংসের মানুষ।

কিন্তু ওর এই উত্তেজিত অবস্থায় বলা যায় না সেকথা বলা যায় না, নমিতা একবার পাথরের দেবী বনে বসলে আবার রক্তমাংসের মাটিতে নেমে আসা বড় কঠিন! তুমিই তোমার মুক্তির প্রতিবন্ধক হবে! অথবা হয়তো তুমি তোমার এই নবলব্ধ স্বাধীনতাটুকুকে অপব্যবহার করে নাম-পরিচয়হীন অন্ধকারে হারিয়ে যাবে!

কিন্তু এসব তো অনুমান মাত্র, এসব তো বলবার কথা নয়। অথচ বলবার কথা আছেই বা কী? একজনের জীবনের সমস্যার সমাধান কি অপর একজন করে দিতে পারে?

অথচ নমিতা চাইতে এসেছে সেই সমাধান। কেবলমাত্র দেখবার ইচ্ছেয় ছুটে চলে আসার যে মধুর ভাষ্যটি নমিতা উপহার দিয়েছে অনামিকাকে, সেটার মধ্যে যে অনেকখানিটাই ফাঁকি, তা নমিতা নিজেই টের পায়নি।

নমিতা তাই সেই কথা বলার পর সহজেই বলতে পারছে, আপনি বলে দিন এখন আমার কোন পথে যাওয়া উচিত? এই প্রশ্ন করবার জন্যেই এতো কষ্ট করে আসা।

অনামিকা আস্তে বলেন, একজনের কর্তব্য কি আর একজন নির্ণয় করে দিতে পারে নমিতা?

আপনারা নিশ্চয়ই পারেন! নমিতা আবেগের গলায় বলে, আপনারা কবিরা, সাহিত্যিকরাই তো আমাদের পথপ্রদর্শক।

সেটা অজ্ঞাতসারে এসে যেতে পারে, অনামিকা মৃদু হাসেন, প্রত্যক্ষ ভাবে গাইড সেজে কিছু বলা বড় মুশকিল। তোমার নিজের তো অবশ্যই কোনো একটা পথ সম্পর্কে পরিকল্পনা আছে।

নমিতা একটু চুপ করে থেকে একটা হতাশ-হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বলে, বিশেষ করে একটা কোনো কিছু ভাবতে পারছি না আমি। অনেক পথ অনেক দিকে চলে যাচ্ছে। শুনলে হয়তো আপনি হাসবেন, হঠাৎ-হঠাৎ কী মনে হচ্ছে জানেন, একটা গরীব লোক হঠাৎ লটারীতে অনেক টাকা পেয়ে গেলে তার যেমন অবস্থা হয়, কী করবে ভেবে পায় না, আমার যেন তাই হয়েছে। আমার এই জীবনটা যেন এই প্রথম আমার হাতে এসেছে, ভেবে পাচ্ছি না সেটাকে নিয়ে কী করবো?

অনামিকা আবার হাসলেন, তোমার উপমাটি কিন্তু এর নমিতা, আমার ইচ্ছে করছে কোথাও লাগিয়ে দিতে। কিন্তু বুড়ো মানুষের পরামর্শ যদি শোন তো বলি, লটারীতে পেয়ে যাওয়া টাকাটা কী ভাবে খরচ করবো ভেবে দিশেহারা হবার আগে সর্বপ্রথম কর্তব্য হচ্ছে টাকাটা ব্যাঙ্কে রাখা। তারপর ভেবেচিন্তে ধীরেসুস্থে–

নমিতা ক্লান্ত গলায় বলে, কিন্তু ধীরেসুস্থে কিছু করার আমার সময় কোথায়? একজন পিসতুতো দাদার বাড়িতে এসে উঠেছি, কদিন আর সেখানে থাকা চলে বলুন? এখান থেকে চলে যেতেই হবে। কিন্তু কোন্ দিকে যাবো?

অনামিকা কোমল করে বলেন, মনে কিছু কোরো না নমিতা, জিজ্ঞেস করছি জলপাইগুড়িতে থাকাটা কি সত্যিই আর সম্ভব হলো না?

নমিতা চোখ তুলে তাকায়।

নমিতা বোধ করি একটু হাসেও, তারপর বলে, অসম্ভবের কিছু ছিল না। যেমন ভাবে ছিলাম, ঠিক সেই ভাবেই থেকে গেলে মৃত্যুকাল অবধিই থাকতে পারতাম। আমায় তো কেউ তাড়িয়ে দেয়নি। আর নতুন কোনো মতের মতান্তরের ঘটনাও ঘটেনি। এতোদিন জীবনের খাতাখানার দিনের পাতাগুলো উল্টেই চলেছি, দিন থেকে রাত্তির, রাত্তির থেকে দিন–খাতার পাতা হঠাৎ কোনও জায়গায় ফুরিয়ে যেত হয়তো। কিন্তু একসময় একটা হিসেবনিকেশ তো করতেই হবে। সেইটা করতে বসেই হঠাৎ চোখে পড়ে গেল শুধু বাজে খরচের পাহাড় উঠেছে জমে।

নাঃ, তোমার বাপু সাহিত্যিক হওয়াই উচিত ছিল। অনামিকা বলেন, যা সব সুন্দর উপমা দিতে পারে। কিন্তু আমি বলছিলাম কি, হয়তো ওই বাজে খরচের অঙ্কটা সবটাই ঠিক নয়। হয়তো ওর মধ্যেও কিছু কাজের খরচ হয়েছে।

কিছু না, কিছু না। আপনি জানেন না, এতোদিনের প্রাণপাত সেবার পুরস্কারে একটুকু ভালোবাসা পাইনি। শুধু স্বার্থ, তার জন্যেই একটু মিষ্টি বুলি। বলুন যেখানে একটুখানিও ভালবাসা নেই, সেখানে মানুষ চিরকাল থাকতে পারে?

অনামিকা মনে মনে হাসলেন।

অনামিকার মনে হলো, চোখটা তোমার হঠাৎই খুলেছে বটে। আর অন্ধত্বটা বড় বেশী ছিল বলেই ওই খোলা চোখে মধ্যদিনের রৌদ্রটা এতো অসহ্য লাগছে।

তবু ওই ভালবাসা-চাওয়া মেয়েটার জন্যে করুণা এলো, মেয়েটার জন্যে মমতা অনুভব করলেন।

এতোটুকু বাসার কাঙাল একটা ছোট্ট পাখিকে দেখলে যেমন লাগে। ওই বাসাটার আশায় পাখিটা ঝড়ের মুখে পড়তে যাচ্ছে।

বললেন, পৃথিবীটা এই রকমই নমিতা।

এই রকমই? নমিতা উত্তেজিত হলো, আপনি বলছেন কি? পৃথিবীতে ভালোবাসা নেই? মমতা নেই? হৃদয় নেই? নেই যদি তো আপনি আমায় এতো ভালোবাসলেন কেন? আপনি তো আমার কেউ নন?

অনামিকা যেন হঠাৎ একটা হাতুড়ির ঘা খেলেন। অনামিকা মরমে মরে গেলেন। এই নিতান্ত নির্বোধ মেয়েটার এই সরল বিশ্বাসের সামনে নিজেকে যেন একান্ত ক্ষুদ্র মনে হলো।

ভালোবাসা! কোথায় সেই ঐশ্বর্য?

শম্পার জন্যে যে উদ্বেগ, শম্পার জন্যে যে প্রার্থনা, শম্পার জন্যে যে অগাধ ভালোবাসা তার শতাংশের একাংশও কি এই মেয়েটার জন্যে সঞ্চিত ছিল অনামিকার?

অনামিকা তো ওকে ভুলেই গিয়েছিলেন।

অথচ ও ভেবে বসে আছে অনামিকা ওকে ভালবাসেন!

ইস্, সত্যিই যদি তা হতো?

অনামিকার যেন নিজের কাছেই নিজের মাথা কাটা যাচ্ছে।

আমাদের চিত্ত কতো দীন! আমাদের প্রকৃতিতে কতো ছলনা!

আমাদের ব্যবহারের মধ্যে কতো অসত্য!

কই, অনামিকা কি স্পষ্ট করে ওর মুখের ওপর বলতে পারলেন, ভালবাসা? কই? সে জিনিসটা তো তোমার জন্যে আছে বলে মনে হচ্ছে না? দেখতে তো পাচ্ছি না? যা আছে তা তো কেবলমাত্র একটু করুণামিশ্রিত মমতা

না, বলতে পারলেন না।

সেই মিথ্যার মোহ দিয়ে গড়া কটি মিষ্টি কথাই বললেন, তুমি যে আমায় খুব ভালোবাসো। ভালোবাসাই ভালোবাসাকে ডেকে আনে।

ছাই আনে! দেখলাম তো পৃথিবীকে!

অনামিকার মনে হলো অভিমানটা যখন মানুষের ছোট সংসারের পরিধি ছাপিয়ে সমগ্র পৃথিবীর ওপর গিয়ে আছড়ে পড়ে, তখন তার স্বাভাবিক সুস্থতা ফিরিয়ে আনা শক্ত।

তবু কিছু তো বলতেই হবে, তাই বলেন, আচ্ছা নিজে নিজে কিছুও একটা তো ভাববে?

সেই তো! নমিতা মাথা তুলে বলে, আমি ওর মতো সন্নিসি হয়ে যাবো? ওর কাছে চলে যাবো? কিছুদিন থেকে এই ভাবনাটাই পেয়ে বসেছে। সে জীবনে কতো মান-সম্মান গৌরব! আর এই পরের আশ্রিত জীবনে কী আছে? মান নেই, সম্মান নেই, গৌরব নেই

অনামিকার সত্যিই খুব দুঃখ হয়।

অনামিকা হৃদয়ঙ্গম করেন ব্যথাটা কোথায়।

তবু আস্তে বলেন, ওঁর কাছে চলে যাবো বললেই তো যাওয়া যায় না। ওঁর মতামত জানা দরকার, সেখানে থাকা সম্ভব কিনা জানা দরকার।

আপনিও এ কথা বলছেন? নমিতা যেন হঠাৎ আহত হয়ে অভিমানে ফুঁসে ওঠে, সেই আমার জলপাইগুড়ির আত্মীয়দের মতো? থাকা কেন সম্ভব হবে না? আমি তো ওঁর সঙ্গে ঘরসংসার পাতিয়ে সংসার করতে চাইছি না। তাছাড়া মতের কথা ওঠে কেন? আমি কি ওঁর বিবাহিতা স্ত্রী নই? আমার কি একটা অধিকার নেই?

ওর এই সদ্যজাগ্রত অধিকারবোধের চেতনা ও স্বাধীনতার চেতনাই যে ওকে বিপর্যস্ত করছে, তাতে সন্দেহ নেই। ওর এই অস্থির-চাঞ্চল্যের মাটিতে উপদেশের বীজ ছড়ানো বৃথা, তবু অনামিকা বলেন, জীবনকে আরো কতো ভাবে গড়ে তোলা যেতে পারে!

কিছু পারে না। আমার মতো মেয়েদের কিছু হয় না। আমি কি সাহিত্যিক হতে পারবো যে লোকের কাছে বড়ো মুখ করে দাঁড়াতে পারবো? আমি কি বড় গায়িকা হতে পারবো? আমার কি অনেক টাকা আছে যে দান-ধ্যান করে নাম কিনতে পারবো? আমার পক্ষে বড়ো হবার তো ওই একটাই পথ দেখতে পাচ্ছি, ভগবানকে ডেকে ডেকে অধ্যাত্মজগতের অনেক উঁচুতে উঠে যেতে পারি।

অনামিকা ওর আবেগ-আবেগ মুখটার দিকে তাকান। অনামিকা নিঃশব্দে একটু হতাশ নিঃশ্বাস ফেলেন। বড় বার ক্ষমতা না থাকলেও যে সেটা হতে চায় তাকে বাঁচানো কঠিন।

অথচ এদিকে রাত বেড়ে যাচ্ছে, ছোট চাকরটা বার দুই ঘুরে গেছে দরজার কাছে, কারণ এই বসবার ঘরটিই তার রাত্রের শয়নমন্দির।

কত কম ক্ষমতা আমাদের! নিঃশ্বাস ফেলে ভাবলেন অনামিকা, কার জন্যে কতোটুকু করতে পারি?

আমরা হয়তো লোকের রোগের সেবা করতে পারি, অভাবে সাহায্য করতে পারি, সংসারে চলার পথের পাথর-কঁকর সরিয়ে দিতে পারি, পায়ের কাটা তুলে দিতে পারি, কিন্তু কারো জীবনে যদি বিশৃঙ্খলা এসে যায়? যদি কারো মন তার নিজের শুভবুদ্ধির আয়ত্তের বাইরে চলে যায়?

কিছু করতে পারার নেই। হয়তো কিছুটা শুকনো উপদেশ বিতরণ করে মনকে চোখ ঠারতে পারি। ভাবতে পারি, অনেক তো বললাম! না,শুনলে কী করবো?

তাছাড়া প্রত্যক্ষভাবেই বা কতোটুকু করার ক্ষমতা আছে আমার? ভাবলেন অনামিকা, আমি কি ওকে সঙ্গে করে ওর সেই পলাতক স্বামীটার কাছে পৌঁছে দেওয়ার সাহায্যটুকুই করতে পারি? পারি না। মাত্র ওকে আর্থিক সাহায্য করতে পারি। খুব সন্তর্পণে বললেন, তা তুমি কি তার–মানে তোমার স্বামীর ঠিকানা জানো?

জানি।

চিঠিপত্র দাও?

নমিতার দুই চোখ দিয়ে হঠাৎ জল গড়িয়ে পড়ে, আগে আগে অনেক দিয়েছি, জবাব দেয় না। একবার মামাকে একটা পোস্টকার্ড লিখে পাঠালো, ওখান থেকে যে কোনো চিঠিপত্র আসে এ আমি পছন্দ করি না। ব্যাস, সেই অবধি

অনামিকা সেই অশ্রুলাঞ্ছিত মুখটার দিকে তাকিয়ে দেখেন, অনামিকার নিজেকেই যেন অপরাধী মনে হয়। যেন এই মেয়েটার দুঃখের কারণের মধ্যে তারও কিছু অংশ আছে। সারাজীবন ধরে তিনি যা কিছু লিখেছেন, তার অধিকাংশই মেয়েদের চিন্তার মুক্তির কথা ভেবে। কিন্তু মুক্তির পথটা কোথায় তা দেখিয়ে দিতে পারেননি।

কিন্তু কেউ কি পারে সেটা?

কোনো কবি, কোনো সাহিত্যিক? কোনো সমাজসেবী?

সামগ্রিকভাবে কিছু করবার ক্ষমতা এদের নেই।

এবার ভেবেছি কোনো খবর না দিয়ে সোজা চলে যাবে। দেখি কেমন করে তাড়িয়ে দেয়।

অনামিকা চিন্তিত হন।

বলেন, সেটা কী ঠিক হবে? বলছো তো আশ্রম, সেখানে নিশ্চয়ই অন্য সাধুটাধু আছেন, তারা যদি

নমিতা প্রায় ছিটকে উঠে বলে, আপনার কাছে আমি নতুন কিছু শুনতে এসেছিলাম। অথচ আপনি আমার সব আত্মীয়দের মতোই কথা বলছেন।

লজ্জিত হন বৈকি অনামিকা।

কিন্তু কী নতুন কথা বলবেন তিনি এই হঠাৎ পাগলা-হয়ে-যাওয়া মেয়েটাকে? পৃথিবীটাকে তো তিনি ওর মতো অতো কম দিন দেখছেন না?

আস্তে অপরাধীর গলায় বলেন, আমিও তোমার আত্মীয় নমিতা। তাই তোমাকে নতুন কথা হলে বিভ্রান্ত করতে পারবো না। তবে সত্যিই যদি তুমি যাও, নিশ্চয়ই তোমার সঙ্গে কোনো ছেলে-টেলেকে নিতে হবে। অনেক তো খরচা হবে–কিছু যদি রাগ না করো তো বলি

নমিতা থামিয়ে দেয়।

নমিতা এবার নম্র গলায় বলে, আপনার ভালবাসা মনে থাকবে। কিন্তু খুব দরকার পড়লেও টাকার সাহায্য আমি আপনার কাছে নেব না। আমার গায়ে তো এখনো সামান্য সোনা-টোনা আছে।

কিন্তু নমিতা, অনামিকা থামলেন।

এখনই ওকে হতাশার কথা শোনানো উচিত হবে? অথচ নিশ্চিত বুঝতে পারছেন, ফিরে নমিতাকে আসতেই হবে।

সাবধানে বলেন, কিন্তু নমিতা, ধরো যদি তোমার সেখানে ভাল না লাগে, ধরো যদি ঠিকমতো সুবিধে না হয়–

বলুন না, ধরো যদি তাড়িয়ে দেয়–হঠাৎ বেখাপ্পা ভাবে হেসে ওঠে নমিতা। বলে, তাহলে তখন আবার আপনার কাছে আসবো। শুনবো জীবনকে আর কোন্ দিক থেকে গড়া যায় যা আমার সাধ্যের মধ্যে।

ছোট চাকরটা অভ্যাসমতো একসময় এক কাপ চা ও দুটো সন্দেশ রেখে গিয়েছিল, নমিতা তাতে হাতও দেয়নি। অনামিকা কয়েকবারই উসখুস করেছেন, এখন বললেন, চা-টা যে ঠাণ্ডা হয়ে গেল নমিতা!

নমিতা অদ্ভুত একটু হেসে বললো, তাই দেখছি। ঠিক আমার জীবনটার মতো, তাই না? ভরা ছিল, গরম ছিল, কেউ খেলো না। এখন কি আর-পেয়ালাটা হঠাৎ তুলে নিলো,

ঠাণ্ডা চা-টা ঢক্‌ করে এক চুমুকে খেয়ে নিয়ে বললো, তবু খেয়েই ফেললাম, নষ্ট হওয়ার থেকে ভাল হলো, তাই না?

অনামিকা অবাক হলেন। এ ধরনের কথা ওর মুখে যেন অপ্রত্যাশিত। অনামিকা চিন্তিত হলেন।

মানসিক ব্যাধির পূর্বলক্ষণ নয় তো?

পেয়ালাটা নামিয়ে রেখে নমিতা এবার ঘড়ির দিকে তাকালো, একটু চঞ্চল হলো। বললো, দেখছেন তো আমার ভাইপোর কাণ্ড! এখনো এলো না! মাসির কাছে খেয়ে-দেয়ে আসছে বোধ হয়-পরনির্ভরতার এই জ্বালা!

ওর সহজ গলার কথা শুনে স্বস্তি পান অনামিকা, তিনিও সহজভাবে বলেন, তা আজকাল তো আর বাপু মেয়েরা এতো পরনির্ভর নেই, নিজেরাই তো একা একা চলা-ফেরা করে!

নমিতা উঠে দাঁড়িয়ে বলে, তা জানি। কিন্তু এযাবৎ তো পায়ে শেকল বাঁধা ছিল। অভ্যাস ভে নেই। রাস্তা-টাস্তা কিছুই চিনি না। এইবার থেকে উঠে পড়ে লেগে চিনতে হবে। একটু হেসে বললে, শিকলিটা তো কেটেছি মনের জোর করে। এগিয়ে এসে নিচু হয়ে আবার প্রণাম

অনামিকা দু’পা পিছিয়ে গিয়ে বলেন, কী হলো?

ওই যে আসছে আমায় নিতে। খুব জ্বালাতন করে গেলাম আপনাকে। হয়তো আবারও আসবো।

বেরিয়ে গেল দরজার বাইরে। অনামিকা তাকিয়ে থাকলেন ওই হঠাৎ-শিকলি-কাটা পাখিটার গতির দিকে। ও কি সত্যিই আকাশে উড়তে পারবে? নাকি অনভ্যস্ত ডানায় উড়তে গিয়ে ঝটপটিয়ে মাটিতে পড়ে ডানা ভাঙবে?

এই মেয়েটাকে আমি কোন পথ দেখাতে পারতাম? অনামিকা নিচে থেকে উঠে এসে সিঁড়ির জানলা-কাটা দরজা থেকে বেরনো দু-ফুট বাই চার-যুট ক্ষুদে ব্যালকনিটায় এসে দাঁড়িয়ে পড়ে ভাবলেন, ও যদি আমার গল্পের নায়িকা হত, ওর জন্যে কোন্ পরিণতি নির্ধারণ করতাম আমি?

হঠাৎ এক ঝলক ঠাণ্ডা হাওয়া এসে গায়ে লাগলো, আর হঠাৎই মনে এলো, বেশ বহু বহুকাল এখানটায় এসে দাঁড়াননি। এটা যে ছিল তাই মনে পড়তে না কখনো। আজ মনে পড়লো- নিজের ঘরে ‘মেজদি’র উপস্থিতি স্মরণ করে। ঠিক এই মুহূর্তে সেই অতি-সংসারী মানুষটার কাছাকাছি গিয়ে পড়তে ইচ্ছে হলো না। যে মানুষটা নিকট আত্মীয়ত্বের দাবিতে নিতান্ত অন্তরঙ্গ সূরে কথা বলতে চায়, অথচ যার কাছে বলতে চায় সে অনুভব করে কতো যোজন ব্যবধান তাদের মধ্যে। সম্পূর্ণ ভিন্ন জাতি তারা।

এই যোজন ব্যবধান নিয়েই তো আত্মীয়ের সঙ্গে অন্তরঙ্গতা। সব ক্ষেত্রে না থোক বহু ক্ষেত্রেই।

অনবরত বিদ্যুৎপাখার হাওয়া খাওয়ায় অভ্যস্ত শরীরকে এই বেশী রাত্রির উড়ো-উড়ো হাওয়াটা যেন আচ্ছন্ন করে তুলছে।

এই ক্ষুদে বারান্দাটুকুর পরিকল্পনা ছিল বকুলের মা সুবর্ণলতার! বাড়ি হয়ে পর্যন্তই এই জানলা ফুটিয়ে দরজা করে বারান্দার কথা বলে চলেছিলেন তিনি। বলতেন–টানা উঠতে নামতে মাঝে মাঝে এক নিঃশ্বাস ফেলার জায়গা থাকা দরকার।

তখন বকুলের বাবা রেগে রেগে বলতেন, কী এমন বেণীমাধবের ধজার সিঁড়ি যে মাকে মাঝে নিঃশ্বাস ফেলতে হবে। এতো এতো নিঃশ্বাস নেবারই যে দরকারটা কী বুঝি না। দেয়াল ফেড়ে বেরিয়ে গিয়ে নিঃশ্বাস নিতে হবে। আশ্চর্য!

অথচ সুবর্ণলতা মারা যাবার কিছুদিন পরে হঠাৎ বাবা মিস্ত্রী ডেকে, বেশ কিছু খরচা করে জানলা কাটিয়ে দরজা করে এই ক্ষুদ্র স্কুল-বারান্দা দুটো করিয়ে ফেললেন ওপর নীচে দুটো সিঁড়িতে।

কিন্তু কে কবে এসেছে নিঃশ্বাস নিতে? কে কবে আসে? নূতন নূতন বেলায় বকুলের তো আসতে পা ওঠেইনি। মনে হয়েছে মা বুঝি কোথায় বসে করুণ চোখে তাকিয়ে বলবেন, সেই হলো, শুধু আমারই ভোগে হলো না! তোরা বেশ–                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                   হ্যাঁ, এই ধরনের অনুভূতিই তখন দরজার চৌকাঠের কাছে এলেই বকুলকে হঠাৎ দাঁড় করিয়ে দিতো। অথচ তখন বকুলের মাঝে মাঝে দেয়াল ফেঁড়ে নিঃশ্বাস নেবার দরকার ছিল।

দরকার ছিল আপন চিত্তের, দরকার ছিল একটা লাজুক মানুষের আবেদনের। সুযোগ পেলেই যে বলতে, অমন চমৎকার অলিন্দ হলো তোমাদের, একটু দাঁড়াতে পারো না?

তবু পারতো না বকুল।

দরজাটা খুললেই আকাশের তারার দিকে চোখ পড়ে যেতো। কেমন একটা অপরাধ-বোধ এসে যেতো।

তারপর?

তারপর তো বকুল অনামিকা হয়ে গেল। অনামিকার আর বাতাসের ওই একমুঠো দাক্ষিণ্য নেবার অবকাশ রইল কই?

কিন্তু অবকাশ কারই বা আছে এ বাড়িতে? দরকারই বা কই? ছুটতে ছুটতে নামা ওঠা, এই তো! জানে সিঁড়ির দরকার ওইটুকুই।

হয়তো এমনিই হয়। বাতাসের যার বড়ো প্রয়োজন সে পায় না, যে সেটা অনায়াসে পায় সে তার প্রয়োজন বোধ করে না। তবু আজ সাময়িক একটা কারণ প্রয়োজন বোধ করলেন অনামিকা আর যেন কৃতার্থ হয়ে গেলেন।

ভাবতে লাগলেন, নমিতা যদি আমার গল্পের নায়িকা হতো, কোন্ পরিণতি দিতাম আমি ওকে?

নিশ্চয়ই ওকে সন্ন্যাসী সাজিয়ে দেবতাত্মা হিমালয়ের শান্তিময় কোলে বসিয়ে নিশ্চিন্তের নিঃশ্বাস ফেলতাম না!…তাহলে আবার কি ওকে সংসার-আশ্রয়ের নিশ্চিন্ত ছায়ায় ফিরিয়ে দিতাম? সেই উত্তরবঙ্গের একটি সমৃদ্ধ পরিবারের মধ্যে?

না না, ছি!

তবে?

তবে কি নিতান্তই বাজারচলতি সমাধানে ওকে নার্স করে ছেড়ে দিতাম? আর একদিন ওর সেই মিথ্যা সন্ন্যাসী স্বামীটাকে ব্যাধিগ্রস্ত করে ওর করতলে সমর্পণ করতাম?

দূর দূর! তবে কি ওকে ডানা ভেঙে স্রেফ ফেলেই দিতাম পথে-প্রান্তরে?

একটু চুপ করে ভাবলেন, তারপর প্রায় নিজের মনকেই বললেন, হয়তো গল্পের নমিতাকে শেষ পর্যন্ত তাই-ই করতাম। হয়তো বা তার মধ্যেই কিছু নতুনত্ব আনবার চেষ্টা করতাম।

কিন্তু ওই চোখে-দেখা-সত্যি-মেয়েটার জন্যে আমি সে পরিণতি ভাবতেই পারছি না। ওর সেই স্বামীটাকে জব্দ করার জন্যেও না–তাকে  মুখের মত জবাব দেবার জন্যেও না। আচ্ছা প্রগতিশীল মন কাকে বলে? সে মন কি নিতান্ত প্রিয়জনের জন্যে, নিকটজনের জন্যে তেমন দুঃসাহসিক প্রগতির পথ দেখাতে পারে? যে পথে অকল্যাণ, যে পথে গ্লানি?

তেমন প্রগতিশীল হওয়া আমার কর্ম নয়, ভাবলেন অনামিকা। তবে কী হবে ওর। মানে–কী করবে ও? ওর মধ্যে এখন একটা সর্বনাশা আগুন জ্বলছে, মনে হচ্ছে সে আগুন ওকে ছাড়া আর কাকে দগ্ধ করবে?

তারপর খুব হালকা এবং নেহাৎ সংসারী একটা কথা মনে এলো, এ সংসারটা যদি আমার হতো, হয়তো ওকে কিছুদিন আমার কাছে থাকতে বলতে পারতাম। তা আমিই তো বলতে গেলে আশ্রিত। নেহাৎ বাবার উইলে কী একটা আছে তাই–

তারপর মনে মনেই হেসে উঠলেন, তা তাতেই বা কি লাভ হতো নমিতার? সেই তো পরিচয় হতে পরাশ্রিত! আর ও নির্ঘাত ওর নিজস্ব স্বভাবে আমার মনোরঞ্জন করতে বসতো!.না, ওটা সমাধানের কোনো পথই নয়। ওর সত্যিকার দরকার ভালবাসার। করুণার নয়, দয়ার নয়, মমতার নয়, শুধু গৌরবময় ভালবাসার। এছাড়া আর বাঁচার উপায় নেই ওর। কিন্তু সে-বস্তু কে এনে ওর হাতে তুলে দেবে?

একমাত্র সুপথ হতে পারে, যদি ওর স্বামী মিথ্যা সন্ন্যাসের খোলস খুলে ফেলে ওর কাছে এসে দাঁড়ায়–

ভাবতে গিয়ে মনটা কেন কে জানে কেমন বিরূপ হয়ে গেল। মনে হলো, ভারী জোলো আর বিবর্ণ একটা ভাবনা ভাবছি। নাঃ, সত্যি বিধাতা হবাঁর সাধ্য দ্বিতীয় বিধাতার নেই।

কিন্তু বিধাতারই বা প্লটের বাহাদুরি কোথায়?

নতুনত্বের নামও তো দেখি না। সবই তো অমনি জোলো-জোলো।…

পাশের বাড়িটার দিকে তাকালেন, বাড়িটা এখন এই দশটা সাড়ে-দশটা রাত্রেই গভীর অন্ধকারে আচ্ছন্ন।..ওরই কোণের একটা ঘরে দীনহীন একটু গৃহসজ্জার মধ্যে নির্মলের বৌ হয়তো ঘুমে নিমগ্ন হয়ে পড়ে আছে, হয়তো বা অনিদ্রার শিকার হয়ে পড়ে পড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে। ওকে দেখলে এখন আর মনেও হয় না একদা ও পরমা সুন্দরী ছিল।…

বৌদিদের আলাপ-আলোচনার মাঝে মাঝে কানে আসে ওর ছেলের বৌটি নাকি মেয়ে সুবিধের নয়, কেমন করে যেন ওকে কোণঠাসা করে ফেলে নিজে সর্বগ্রাসী হয়ে বসেছে… বাড়িতে আর কেই বা আছে? নির্মলের জেঠি একটা ভাইপোকে পুষেছিলেন, ইদানীং সেই ই নাকি বাড়ির অর্ধাংশ দখল করে আছে। আর তাদের সঙ্গেই নাকি নির্মলের ওই ছেলের বৌয়ের খুব হৃদ্যতা। কী পুরনো প্লট!

আগে ওই বাড়ি রাত বারোটা অবধি গমগম করতো, গ্রামোফোনের গান শোনা যেতো অনেক রাত অবধি, আলো জ্বলতো ঘরে ঘরে।

এখন? ওই অন্ধকারই তার উত্তর দিচ্ছে। তবে? বিধাতার প্লটে নতুনত্বের নামও নেই। আলো জ্বালা আর আলো নিভানো এই ওঁর প্লট।…

আমি এ বাড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখিনি কতদিন!

তাকিয়ে থাকতে থাকতে যেন হঠাৎ অবাক হয়ে গেলেন অনামিকা। কবে এতো জরাজীর্ণ হয়ে গেল বাড়িটা? হয়ে গেল এমন মলিন বিবর্ণ?

একদিনে হয়নি। আস্তে আস্তেই হয়েছে।

তার মানে দিনের পর দিন, কতো কতেদিন–আর আমি তাকিয়ে দেখিনি, তার মানে—নির্মল নামের একটা অনুভূতিও আস্তে আস্তে ওইরকম বিবর্ণ জরাজীর্ণই হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তবু

এই শিরশিরে বাতাসে রাত্রির আকাশের নিচে চিরপরিচিত অথচ অপরিচিত জায়গায় দাঁড়িয়ে ওই বিবর্ণ জানলাটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অনুভূতিটা আবার যেন আলোয় ভরে গেল…সেই আলোটা ওই জানলায় গিয়ে পড়লো যেন। দেখা গেল খোলা জানলায় ফ্রেমে আঁটা একটা আলোর ছবি।

ঘরের মধ্যে থেকে গ্রামোফোনে গান ভেসে আসছে!…দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার গানের ওপারে–

ধরা-ছোঁয়া নেই, তবু যেন কোথাও আছে বক্তব্যের আভাস। যারা লাজুক, যারা ভীরু–তারা পরের কথার মধ্যেই নিজের কথা মিশিয়ে দিয়ে নিবেদন করে। জানে যে ধরবার সে-ই ধরবে, যে ছোঁয়ার সে-ই ছোঁবে, আর কারো সাধ্য নেই ধরতে ছুঁতে।

দেবতারে যাহা দিতে পারি, দিই তাই প্রিয়জনে–, তাই ‘আমার সুরগুলি পায় চরণ, আমি পাই না তোমারে’।

আজকাল আর কেউ অমন বোকার মতো আর বেচারীর মতো ভালবাসে না!

এ যুগ ওই মৃদুতাকে-ওই চারুতাকে ভালবাসাই বলবে না। দেখলে ঠোঁট বাঁকাবে, রাবিশ বলবে, অথবা জোলো, ভাবালুতা বলে হেসে উড়িয়ে দেবে। এ যুগ জানে ভালোবাসা একটা ভোগ্যবস্তু, তাকে লুটে নিতে হয়, ছিঁড়ে আনতে হয়, দখল করতে হয়

হয়তো এরাই ঠিক জেনেছে। অথবা এরাই কিছু জানেনি, সত্যিকারের জানাটা আজও অপেক্ষা করছে কোনো এক ভবিষ্যৎ যুগের আশায়। যদিও শম্পারা ভেবে আত্মপ্রসাদ অনুভব করছে, আমরাই ঠিক জেনেছি।

তবু সেটুকুও তো জুটছে ওদের ভাগ্যে! ওই আত্মপ্রসাদ! ওরা তো ভাবছে, আমরা নিলাম, আমরা পেলাম! সে যুগের ভাগ্যে সেটুকুও জোটেনি।

অথচ সে যুগেও ভাবত-ভালবাসলাম! ভাবতো এর নামই ভালবাসা!..শম্পারা– আশ্চর্য, শম্পা আমাকেও একটা চিঠি দিল না! যদিও আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছিলাম, হে ঈশ্বর, আমার অহঙ্কার খর্ব হোক, ওর মা-বাপের কাছেই আগে চিঠি আসুক। তবু যেন কোথায় একটা শূন্যতাবোধ সব সময় সব কিছুতে নিরানন্দ করে রেখেছে।

মনে মনে নিশ্চিত ভেবেছিলাম, ও আমাকে অন্তত জানাবে।

শম্পা যেন নিজের জীবনটাকে বাজি ধরে বাপের সঙ্গে খেলতে বসেছে। শম্পা তেমনি লড়ুইয়ে মেয়ে। কে জানে এ খেলায় কে জিতবে? শম্পা না শম্পার বাবা? বাবার জেতাটা তো পরম দুঃখের। অথচ বাবার হারও দুঃখের।

.

এ বাড়িতে আরো একটি মেয়ে আছে, তাকে নিয়ে তার মা আপন সম্পত্তি ভেবে খেলতে বসেছে। সেটা আরো দুঃখের, বরং বা বলা যায় ভয়াবহও।

ওর মা এই পরিবেশ থেকে–তার নিজের ধারণা অনুযায়ী উঁচুতে উঠতে চায়। অনেক উঁচুতে। যে উঁচুর নাগাল পেতে হলে খুব বড় কিছু একটা বাজি ধরে জুয়ায় বসতে হয়।

‘জীবন’ জিনিসটাই সব চেয়ে বড়ো, আর সব চেয়ে হাতের মুঠোর জিনিস।

কিন্তু ওই হতভাগা মেয়েটার যে নিজের জীবনটা এখন আর চড়া দামে বিকোবে না, তাই দামী বস্তুটা নিয়েছে মুঠোয় চেপে। মেয়েটার বোঝবার ক্ষমতা নেই ওকে নিয়ে কী করা হচ্ছে, ওকে কতোখানি ভাঙানো হচ্ছে।

তা যাদের বোঝার ক্ষমতা আছে তারাই কি কিছু প্রতিকার করতে পারছে? পারে কী?

আশ্চর্য, আমাদের ক্ষমতা কতো সীমিত।

আরো একবার নিজের ক্ষমতার পরিসর মেপে দেখে যেন লজ্জায় মরে গেলেন অনামিকা।

কী অক্ষম আমি।

আমার চোখের সামনে একটা নির্বোধ মেয়ে আর একটা বোধহীন মেয়েকে হাত ধরে কাদায় পিছল গভীর জলের ঘাটে নামতে যাচ্ছে, আমি তাকিয়ে দেখছি। খুব দূরে বসেও দেখছি না, বরং খুব কাছেই গাছের ছায়ায় বসে আছি।

আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবো ওরা পিছলোবে, ওরা ডুবে যাবে।

ওইটাই ওদের নিশ্চিত পরিণতি জেনেও আমি হাঁ হাঁ করে চেঁচিয়ে উঠছি না, ছুটে গিয়ে ওদের হাত চেপে ধরে টেনে আনার চেষ্টা করছি না, আমি শুধু ভয়ানক একটা স্বস্তি বোধ করছি, ভয়ানক একটা নিরুপায়তার যন্ত্রণা অনুভব করছি।

কারণ আমি ধরেই নিয়েছি আমার ভূমিকা দর্শকের।

ধরে নিয়েছি ওরা আমার কথা শুনবে না, আমার নিষেধ-বাণী শুনবে না। তবে কেন মিথ্যে অপমানিত হতে যাওয়া ভেবে কথাটি কইছি না। চেষ্টা করে না দেখেই সেই কল্পিত অপমানটার ভয়ে উদাস দৃষ্টি মেলে বসে বসে ওদের ডুবতে যাওয়া দেখছি।

আমাদের অক্ষমতা হচ্ছে আমাদের অহমিকা। আমাদের নিরুপায় হচ্ছে আমাদের একটা অর্থহীন আত্মসম্মানবোধ। তাই আপন সন্তানকেও হয়তো ভুল পথ থেকে নিবৃত্ত করতে হাত বাড়াই না। অনিষ্টের পথ থেকে টেনে আনতে ছুটি না। এই ভেবে নিথর হয়ে বসে থাকি, যদি আমার কথা না শোনে!

সেই না শোনা মানেই তো খর্ব হবে আমার অহমিকা, ঘা পড়বে অহঙ্কারে।

আমার এই আমিটাকে কী ভালই বাসি আমরা।

কই, আমি কি একদিনও ছোড়দার ঘরে গিয়ে বসে পড়ে প্রশ্ন করতে যাচ্ছি, ছোড়দা, কোনো চিঠি এলো?

অথচ মাঝে মাঝে সন্দেহ হচ্ছে, কি জানি হয়তো এসেছে, হয়তো গ্রাহ্য করে অথবা মান খুইয়ে বলতে আসছে না আমায়!..

এই, ‘মান’ জিনিসটা কী কঠিন পাথরের মতোই না ঘিরে রেখেছে আমাদের। ওর থেকে বেরিয়ে পড়বার দরজা আমাদের নেই। অথচ আশ্চর্য, কী তুচ্ছ কারণেই না জিনিসটা খোওয়া যায়।

ও যেন একটা ভারী দামী রত্ন, তাই খোওয়া যাবার ভয়ে সদা সন্ত্রস্ত হয়ে থাকি। ও যেন আমার প্রভু, তাই ওর দাসত্ব করি।

আচ্ছা ওকে আমার অধীন করে রাখা যায় না? আমিই প্রভুত্ব করলাম ওর ওপর? অথবা যদি মনে করি কিছুতেই খোওয়া যেতে দেব না ওকে, দেখি কার সাধ্য নেয়? সযত্নে পাহারা দিয়ে নয়, অযত্নে রেখে দিয়ে যদি রক্ষা করি ওকে?

নাঃ, যতো সব এলোমেলো চিন্তা। আসলে আমি আমার সেই মেজদির ঘুমের জন্যে অপেক্ষা করছি। বয়েস হয়েছে, রেলগাড়িতে এসেছেন, সারাদিন কথা বলেছেন, আর কতোক্ষণ পারবেন ঘুমের সঙ্গে লড়াই করতে? নিশ্চয় এতোক্ষণ ঘুমিয়ে পড়েছেন।

অলকা আর অপূর্বর সঙ্গে এই কঘণ্টাতেই মেজদির যেন বেশ হৃদ্যতা হয়ে গেছে। একত্রিত পরিবারে এই কৌতুক নাটকের অভিনয়টি সর্বদাই হতে দেখা যায়। বহিরাগত অতিথিরা অর্থাৎ কিনা এসে পড়া.আত্মীয়েরা হঠাৎ কেমন করেই যেন ওই একের মধ্যেই একাধিকের সন্ধান পেয়ে যান। আর কেমন করেই যেন কোনো একটি বিশেষ দলভুক্ত হয়ে যান। অবশ্য বাইরে ঠাটটা সর্বজীবে সমভাবে থাকে, কিন্তু আস্তে আস্তে দলভেদটা প্রকট হয়ে ওঠে, এবং নোনাধরা যে দেওয়ালটা তবুও ছাদটাকে ধরে রাখার কাজে সাহায্য করছিল, সেটা ধসে পড়ে ছাদটাকে নামিয়ে দেয়।

হতো অবশ্যই এগুলো, কালক্রমে হতো, আত্মীয় অতিথি সেটুকু ত্বরাণ্বিত করে দেন। হ্যাঁ, এ নাটক হামেশাই হচ্ছে ঘরে ঘরে!

কিন্তু দুই দলকেই বা ওঁরা চট করে চিনে ফেলেন কী করে?

সেটাই আশ্চর্য রহস্য! অবশ্য সেই খুঁটিটাই ধরা নিয়ম। নৌকো বাঁধতে হলে বড়ো গাছেই বাধতে হয়। আর কে না জানে শিষ্টের থেকে দুষ্টই শক্তিতে বড়ো।

মেজদি কেমন করেই যেন ওই বড়ো গাছটাকে চিনে ফেললেন, আর নৌকোটি বাঁধলেন। কিন্তু উনি তো থাকতে আসেননি।

আসেননি সত্যি, তবে এখন যে ওঁর একটা অবিবাহিতা মেয়ে আছে, সেটাকে কলকাতার আবহাওয়ায় রাখতে চান, সেটা বোঝা গেছে ওঁর তখনকার কথায়।

যখন খেতে বলা হয়েছিল, এবং অনামিকা আটপৌরে শাড়িটা আটপৌরে ধরনে জড়িয়ে নিয়ে বকুল হয়ে গিয়ে বসেছিলেন সে আসরে, তখন মেজদি আমিষের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে বড় ভাজের পাশে খেতে বসে ইচ্ছেটা ব্যক্ত করেছিলেন, কলকাতার হালচাল তো দেখলে গা জ্বলে যায়, তবু এখনকার ছেলেদের তো ওই পছন্দ, মেয়েটাকে এখেনে চালান করে দেবো, বলবো, নে কতো হালচাল শিখতে পারিস শেখ।

বলা নিষ্প্রয়োজন, শ্ৰোত্রীবর্গ কেউই এ ইচ্ছেয় উৎসাহ প্রকাশ করেনি, এবং মেজদিও সঙ্গে সঙ্গেই সেটা বুঝে ফেলে বলেছিলেন, অবিশ্যি কন্যে আমার থাকতে চাইবে কিনা সন্দেহ। “মা” ভিন্ন আর কিছুতে দরকার নেই তার। কোলের তো!…তবে আমিই বলি, পরের ঘরে যেতে হবে না? তা হারামজাদি হেসেই মরে, বলে, “যাবোই না”।

বকুলকে মাথা নিচু করে যেতেই হয় সেখানে। এদিকে ছোড়দার বউও থাকেন, থাকে বড়দার বিয়ে-টিয়ে হয়ে যাওয়া সংসারী মেয়ে হেনা। অপূর্বর নিজের বোন সে, কিন্তু বাপের বাড়ি এলে এদিকেই খায়। বলে, বাবা, অলকার ওখানে কে খাবে? বাসন-মাজা ঝিতে রাধে, চাকর বাসি কাপড়ে জল-বাটনা করে!

বকুল হাসে মনে মনে। ভাবে, তোমার মহা বিশ্বে কিছু হারায় নাকো কভু– না, কোন কালেই হারিয়ে যায়।

হেনা যখনই আসে বেশ কিছুদিন থাকে, কারণ ওর স্বামী অফিসের কাজে ট্যুরে যায়, আর সেটাই ওর পিত্রালেয় আসার সময়। এসেই বলে, চলে এলাম! বরবিহন শ্বশুরবাড়ি-ছ্যাঁ, যেন নুনবিহীন পান্তা!

হেনার ছেলে-মেয়ে নেই, তাই হেনার স্বাধীনতাটা এত বেশী। চন্দ্র-সূর্যের গতির নিয়মেই হেনা তার নিজের ভাই-বৌয়ের থেকে খুড়ো-খুড়ীকেই ভজে বেশী। মা? তিনি তো এখন নখদন্তবিহীন, তাকে বড়জোর একটু করুণা করা চলে। তার কাছে তো আশ্রয় নেই।

বড়দার আরও মেয়ে-টেয়ে আছে। তারা বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে আর আসে না। যেমন আসা ছেড়ে দিয়েছিল চাপা আর চন্দন, সুবর্ণলতা মারা গেলে। বলেছিল, আর কোথায় যাবো?

কিন্তু পারুল?

ভাবনাগুলো যেন পারার মতো, কিছুতেই হাতে ধরে রাখা যায় না, গড়িয়ে পড়ে যায়, যেখানে-সেখানে ছিটকে পড়ে, শুধু যেখানেই পড়ুক ঝকঝকে চোখে তাকায়।

পারুলের কথা মনে হতেই পারুল যেন সামনে দাঁড়িয়ে হেসে উঠলো।

যেন বললো, কই রে বকুল, তোর সময় আর তাহলে হলো না? অথচ বলেছিলি-যাবো সেজদি তোর কাছে! বকুলকে আস্ত করে খুঁজে দেখবো তোর সঙ্গে একসঙ্গে। আমার কাছে কেবলই ভাঙাচোরা টুকরো।

বলেছিল বকুল। কিন্তু সেই আস্তটা খুঁজে দেখতে যাবার সময় সত্যিই হয়ে উঠলো না আজ পর্যন্ত।

কেন?

খাতাপত্তরের জঞ্জাল সরিয়ে তুলতে পারি না বলে? পাহাড়ের ওপর আবার পাহাড় জমে ওঠে বলে? আর সেইগুলোর গতি করবো বলে দৃঢ় সংকল্প নিয়ে বসামাত্র ফাংশানবাজেরা বাজপাখির মতো এসে ছোঁ মেরে নিয়ে যায় বলে?… তার মধ্যিখান থেকেও ফাঁক বার করে নেবার চেষ্টার সময় দর্শনার্থী আর বিনামূল্যে লেখা প্রার্থীর ভিড় এসে জোটে বলে?

যখন ইচ্ছে হবে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলি–এ তো বড়ো মুশকিল, দেশসুদ্ধ সবাই তোমরা পত্রিকা প্রকাশ করবে? আর আমরা হবো সেই যূপকাষ্ঠের বলি?

তখন খুব মধুর করে হেসে বলতে হবে, কি করবো, বল বাপু? সময় তো মোটে নেই, কতো কাগজ বেরোচ্ছে প্রতিদিন!

সমুদ্রে বালির বাঁধ-এর মতো সেই কথার বাঁধ ভেসে যাবে ওদের কথার তোড়ে বলে?

এইগুলোই সব থেকে বড়ো দরকারী?

এই দরকারগুলোর স্তূপের ওপরে সেজদি বসে বসে মিটি মিটি হাসবে, আর তারপর মুখ ফিরিয়ে নেবে, আর তারও পরে আস্তে আস্তে বুড়ো হয়ে যাবে, বদলে যাবে! হয়তো সেই চেনা সেদিকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না কোনদিন, হয়তো মরেই যাবে কোনোদিন, আর বকুল বসে বসে টেবিলে জমানো স্তূপ সাফ করবে! কোনোদিনই সাফ হবে না, আবার জমে উঠবে জেনেও।

এর খাজ থেকে একবার পালিয়ে যাওয়া যায় না?

হঠাৎ গিয়ে বলে ওঠা যায় না, দেখ তত চেয়ে আমারে তুমি চিনিতে পারে কিনা?

অফিসের কাজেই পশ্চিম থেকে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসতে হয়েছিল মোহনকে, তবু মোহন এমনভাবে এসে দাঁড়ালো, দেখে মনে হতে পারে শুধু মাকে ওই প্রশ্নটাই করতে এসেছিল মোহন, এই মাত্র যে প্রশ্নের উত্তরটা দিলো পারুল হেসে উঠে, ওমা, তা তাড়িয়ে দেব নাকি? এসেছে পিসির কাছে দুদশদিন থাকবে বলে-

মোহন রাগটা লুকোবার চেষ্টা না করেই বলে, একা থাকলে দু’দশদিন কেন, দু’দশ মাসই থাকতে পারতো, আপত্তির কিছুই ছিল না, কিন্তু আর একটা যা শুনলাম

কী শুনলি আর একটা? প্রশ্ন করলো পারুল।

মোহন মনে মনে ঠোঁট কামড়ালো।

মনে মনেই চেঁচিয়ে উঠলো, মা, তোমার এই ন্যাকামিটি আর গেল না কোনোদিন? সেই ছেলেবেলা থেকে এই বুড়ো-বেলা পর্যন্ত দেখছি–তুমি ঠিক শরৎবাবুর নভেলের নায়িকার প্যাটার্ন নিয়ে কথা বলবে! আমরা অতশত বুঝি না। গেরস্ত লোক গেরস্ত ধরনে কথা কইবো, উত্তর পাবো, মিটে গেল ল্যাঠা, তা নয়।…কেন বুঝতে পারছে না তুমি, কী শুনছি আর একটা? ঠিকই বুঝতে পারছো, তবু আমার মুখ দিয়েই বলিয়ে নিতে চাও। সাধে কি আর ছেলের বৌরা এত বিমুখ, আমি তোমার নিজের ছেলে, তবু যেন আমাকে অপদস্থ করার মধ্যেই তোমার আনন্দ।

বলছিল মনের মুখ দিয়ে চেঁচিয়ে, কিন্তু বাইরে সেও পারুলের ছেলে। আত্মস্থ অচঞ্চল।

যা শুনলাম, সেটা তুমি বুঝতে পারনি তা নয়। আমি বলতে চাইছি–একটা কুলিকামিন ধরনের বাজে লোককে নিয়ে নাকি সে এসে উঠেছে তোমার কাছে। এবং সেটা নাকি রোগগ্রস্ত?

রোগগ্রস্ত? না তো, পারুল বিস্ময়ের গলায় বলে, তোমাকে যে খবর দিয়েছে, সে তো দেখছি ভালো করে খবর-টবর না নিয়েই

আমায় কেউ কোনো খবর-বৈর দেয়নি! বলে বসে মোহন।

পারুলের কি মনে পড়ে না, মোহন রেলের রাস্তায় অনেকটা দূর থেকে এসেছে, ওর তেষ্টা পেয়ে থাকতে পারে, খিদে পেয়ে থাকতে পারে। আর তার পর মনে পড়ে না মোহন তার নিজের পেটের ছেলে! পারুল মোহনের মা!

মনে পড়েই না হয়তো।

যাদের মন অন্য এক ধাতু দিয়ে গড়া, তাদের হয়তো ওই সব ছোটখাটো কথাগুলো মনে পড়ে না। তারা শুধু খাঁটি বাস্তবটা দেখতে পায়।

সেই বাস্তব দৃষ্টিতে পারুল মোহনকে পারুলের ‘অপরাধের বিচারক’ ছাড়া আর কোন দৃষ্টিতেই দেখতে পাচ্ছে না, অতএব পারুল নিজ পক্ষে উত্তর মজুত রাখতেই তৎপর থাকছে। আর এও স্থিরনিশ্চিত যে, অনধিকারে যদি কেউ বিচারক সেজে জেরা করতে আসে, পারুল তাকে রেহাই-টেহাই দেবে না। ছেলে বলেও না।

তাই পারুল ছেলেটার ক্লান্ত মুখটার দিকে না তাকিয়েই খুব হালকা একটু হাসির সঙ্গে বলে, কেউ খবর-টবর দেয়নি? ওমা, তাই নাকি? তুই তাহলে বুঝি আজকাল হাতটাত গুনতে শিখেছিস? কার বই পড়ছিস? কিরোর?

কথাটা বলে ফেলে অপ্রতিভ হয়ে গিয়েছিল মোহন একথা সত্যি, তাই বলে এইভাবে অপদস্থ করা? মোহন গম্ভীর হয়। মোহনের ক্লিষ্ট মুখ আরক্ত হয়ে ওঠে, তীব্রতা পরিহার করে গম্ভীর সুরেই বলে সে, আমি বেশীক্ষণ সময় হাতে নিয়ে আসিনি মা! সোজা আর সহজ ভাবে কথা বললে তাড়াতাড়ি হয়ে যায়।

ওঃ তাই বুঝি!

পারুল চট করে নিজেকেও প্রায় সোজা দাঁড় করিয়ে বলে, তবে তুই-ই চটপট করে বল তোর কী জানবার আছে? কী উদ্দেশ্যে হঠাৎ এসেছিস? এক নম্বর দুনম্বর করে বল–উত্তরটা চটপট হয়ে যাবে।

উঃ অসহ্য! বললো মোহনের মনের মুখ।

তবু বাইরের মুখটা সহ্যের ভানে রইলো, আমি জানতে চাই তোমার ওই ভাইঝির সঙ্গে আর একটা লোক আছে কিনা?

আছে। যান্ত্রিক উত্তর পারুলের। মোহনের মনের মুখ আবার চেঁচাতে শুরু করে, ওঃ, সাধে কি আর ভাবি বাবা সাতসকালে মরে বেঁচেছেন!…

লোকটা কে, তার সন্ধান নিয়েছিলে?

দরকার বোধ করিনি।

ওঃ দরকার বোধ করনি? তোমার সাতজন্মে না দেখা এক ভাইঝি এসে তোমার বাড়িতে উঠলো একটা বাজে লোক নিয়ে, তুমি তার পরিচয়টা জানবারও দরকার বোধ করলে না?

আমার ভাইঝি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে, এটাই যথেষ্ট পরিচয় বলে মনে করেছি—

চমৎকার? তোমার ভাইঝি যদি একটা রাস্তার কুলি-মজুরকে নিয়ে আসে—

সেটাও মেনে নিতে হবে। সেই কুলিটাকেই যখন সে ভাবী স্বামী বলে ঠিক করে রেখেছে।

অতএব তাকে বাড়িতে আশ্রয় দিয়ে জামাই আদরে রাখতে আপত্তি নেই, কেমন? তোমার ওই ভাইঝির বয়েস নিশ্চয়ই এমন বেশী হয়নি যে, মানুষ চিনতে পেরে উঠবে। লোকটা জেলপালানো আসামী কিনা–

মোহনের দ্রুত কথার ঠাসবুনুনির মাঝখানেও আস্তে একটা পাতলা ছুরি বসায় পারুল, বয়েসটা অনেক বেশী হলেই মানুষ চেনবার ক্ষমতা হয়, এটা আবার তোকে কে বললো মোহন? তা তোর তো অনেকটা বয়েস হয়েছে, আমাকে দেখছিসও জন্মাবধি, কই, চিনে উঠতে পারলি কই?

১৯. নমিতা যে এভাবে দড়ি-ছেঁড়া হয়ে

নমিতা যে এভাবে দড়ি-ছেঁড়া হয়ে চলে যেতে পারে একথা জলপাইগুড়ির ওরা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। যে নমিতার মুখ দিয়ে কথা বেরোতো না, সেহঠাৎ কিনা স্পষ্ট গলায় বলে বসলো আমি চলে যাবো! বলে বসলো এই দাসত্ব-বন্ধন থেকে মুক্তি চাই!

আশ্রয়দাতাদের কাছে এ কথাটা লজ্জারও বটে দুঃখেরও বটে। সর্বোপরি অপমানেরও।

মামীশাশুড়ী ফেটে পড়লেন, মামাশ্বশুর পাথর, আর দিদিশাশুড়ী গাল পাড়তে শুরু করলেন।

ও হতভাগী নেমকহারামের বেটী, যে মামাশ্বশুর অসময়ে তোকে মাথায় করে এনে আশ্রয় দিয়েছিল, তার মুখের ওপর এতো বড়ো কথা? সে তোকে দানবৃত্তি করাতে এনেছিল? ভেতর ভেতরে এতো প্যাঁচ তোর? বলি যাবি কোন চুলোয় যাবার যদি জায়গা আছে তো এসেছিলি কেন কেতেথ্য হয়ে পড়েই বা ছিলি কেন এতোকাল?

অনিলবাবু ক্লান্ত গলায় বললেন, আঃ মা, থামো! বোমার যদি হঠাৎ এখানে অসুবিধে বোধ হয়ে থাকে, আর তার প্রতিকারের উপায় আমাদের হাতে না থাকে, বাধা দেওয়ার কথা ওঠে না।

মামীশাশুড়ী নমিতার ওই দৃঢ় ঘোষণার পর থেকে সমগ্র সংগারের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলেন, আর তার ভিতরটা ডুকরে ডুকরে উঠছিল, এই সমস্ত কাজ তার ঘাড়েই পড়তে বসলো। নমিতা চলে যাবে মানেই তাকেই বিছানা ছেড়ে উঠত হবে ভোর পাঁচটার সময়, উঠেই গরম জল বসাতে হবে বাড়িসুদ্ধ সকলের মুখ ধোবার জন্যে। হা, হাত-মুখ ধোওয়ার জলও গরম না করে উপায় নেই এ সময়টা, কারণ কালটা শীতল। কেমন বুঝে বুঝে মোক্ষম সময়টিতে চালটি চাললো! কিছুদিন থেকেই বেশ বে-ভাব, দেখা যাচ্ছিল, যেন এই সংসারে কাজ করে সেবা-যত্ন করে তেমন কৃতাৰ্থমন্য ভাব আর