বাবাঃ বাবাঃ, সব সময় তোমার তাড়াতাড়ি লেখা শেষ করতে হবে! ভাবলাম। এই দুদিনের ঘটনাগুলো বলি তোমাকে। যাকগে, মরুকগে, এই রইল তোমার উত্তরবঙ্গ। পঞ্চম পৃষ্ঠার সপ্তম কলমে দেখুন! আমি বিদেয় হচ্ছি। দুটো কথা কইবারও লোক নেই বাড়িতে। সাধে বেরিয়ে যাই-
অনামিকা দেবী তো ওকে যেতে দিতে পারতেন। অনামিকা দেবী তো সর্ব শক্তি প্রয়োগ করে লিখতে বসেছিলেন, তবু কেন ওর অভিমানে বিচলিত হলেন?
কে জানে কী এই হৃদয়-রহস্য!
ওর প্রায় সব কিছুই অনামিকা দেবীর কাছে দৃষ্টিকটু লাগে, তবু ওর জন্যে হৃদয়ে অনেকখানি জায়গা।
তাগাদার লেখা লিখতে সত্যিই কষ্ট হয় আজকাল, সত্যিই জোর করেই বসতে হয়। সে লেখা লিখতে, তবু গা এলিয়ে দিলেন তিনি এখন। বলে উঠলেন, যেমন অসভ্য চুলবাঁধা, তেমনি অসভ্য কথাবার্তা!
শম্পা টকটিকিয়ে চলে যাচ্ছিল, এ কথায় ঘাড় ফেরালো। সতেজে বলে উঠলো, কেন, খোঁপার মধ্যে কি অসভ্যতা আছে শুনি?
সবটাই আছে! অনামিকা দেবী তার একটা হাত চেপে ধরে চেয়ারের কাছে টেনে এনে বলেন, কী আছে খোঁপার মধ্যে আমের টুকরি ও গোবরের ঝুড়ি?
ওর মধ্যে থাকার জনযে বাজারে অনেক মালমশলা বিকোচ্ছে পিসি, কিন্তু কথা হচ্ছে খোঁপার গড়নটা তোমার ভাল লাগছে না?
লাগছে বললে হয়তো তুই খুশি হাতিস, কিন্তু খুশি করতে পারছি না! ভেবে পাচ্ছিনা তুই এই কিছুদিন আগেও ঘাড়ের বোঝা হালকা করে ফেলি বলে চুল কাটতে বদ্ধ পরিকর হয়েছিলি, নেহাৎ তোর মোর দিব্যি-দিলেশায় কাটিসনি, সেই তুই হঠাৎ স্বেচ্ছায় মাথার ওপর এতো বড় বোঝা চাপালি কি করে!
চাপালাম কি করে? হি হি হি, কেন পিসি, তুমিই তো যখন আমাকে ছেলেবেলোয় গল্প বলতে, বলেছিলে-যে সুয়োরানী পানের বাটা বইতে মূৰ্ছা গিয়েছিল, সেই সুয়োরানীই ফ্যাশানের ধুয়োয় গলায় সোঁনাবাঁধানো শিল বুলিয়েছিল!
মনে আছে সে গল্প? অনামিকা দেবী মৃদু হেসে বলেন, গল্পগুলো কেন তৈরী হতো। আর বলা হতো, বল দিকি?
আহা রে! তা যেন জানি না! লোকশিক্ষার্থে, আবার কি? বিশেষ করে মহিলাকুলকে শিক্ষা দিতেই তো যত গল্পের অবতারণা!
সবই যদি জানিস, এটাও তাহলে জানা উচিত, শিক্ষা জিনিসটা নেবার জন্যেই। ফ্যাশানের শিকার হয়ে মেয়েজাতটা কতো হাস্যাস্পদই হয় ভাব।
শম্পা অভিমান ভুলে পিসির পাশে আর একখানা চেয়ারে বসে পড়ে বলে, এই খোঁপাটার ব্যাপারে তুমি সেটি বলতে পারবে না মহাশয়া, এ স্রেফ অজন্তা স্টাইল।
হতে পারে। কিন্তু অজন্তার সেই স্টাইলিস্ট মেয়েরা কি ওই খোঁপার সঙ্গে হাইহিল জুতো পরতো? হাতে ঘড়ি বঁধতো? ছুটোছুটি করে বাস ট্রাম ধরে অফিস কলেজ যেতো? নিজে হাতে ড্রাইভ করে মাইলের পর মাইল রাস্তা পাড়ি দিতো?
কে জানে!
শম্পা চেয়ারটার পিঠে ঠেস দিয়ে দোলে।
কে জানে নয়। দিতো না। সাজের সঙ্গে কাজের সামঞ্জস্য থাকা দরকার, বুঝলি?
বুঝলাম না-, শম্পা বলে হেসে হেসে, সাজ বজায় রেখেও যদি কাজ করা যায়?
মানায় না।
ওটা তোমাদের বদ্ধ দৃষ্টিতে। দৃষ্টি মুক্ত করো মহিলা, দেখবে সামঞ্জস্য কথাটাই অর্থহীন! আশ্চৰ্য, লেখিকা হয়েও কেন যে তুমি এতো সেকেলে! অথচ লোকে তোমার নামের আগে প্ৰগতিশীল লেখিকা বলে বিশেষণ বসায়।
তাতে তাহলে তোর আপত্তি?
রীতিমত।
তবে যা, যারা বিশেষণ বসায়, তাদের বলে দিগে, যেন ওই প্ৰগতিটার আগে একটা অ বসিয়ে দেয়। কিন্তু এই দুদিনের কী খবর বলছিলি?
থাকগে সে কিছু না।
বলে শম্পা টেবিলে টোকা দিয়ে সুর তোলে। অথচ মুখের ভাবে ফুটিয়ে রাখে সেটা অনেক কিছু।
অনামিকা দেবী ওর এ ভঙ্গী জানেন।
মনে মনে হেসে বলেন, কিছু না? তবে থাক। আমি ভাবছিলাম বুঝি—
আহা, আমি একেবারে কিছু না বলিনি। বলছি এমন কিছু না। যাকগে, বলেই ফেলি! পরশু ছোঁড়া এক কীর্তি করেছে।
শম্পা একটু দম নেয়, তারপর ঝরঝরে গলায় বলে, বিয়ে বিয়ে করে আমায় তো পাগল করে মারছিলই, আবার পরশু সোজা এসে বাবার কাছে হাজির। বলে কিনা-আপনার মেয়েকে আমি বিয়ে করতে চাই। বোঝ ব্যাপার!
শম্পা সহজ হাসি হেসে-হেসেই বলে কথাগুলো, কিন্তু অনামিকা দেবীর হঠাৎ মনে হয় শম্পা যেন ব্যঙ্গহাসি হাসছে। যেন বলতে চাইছে, দেখো দেখো, আমাদের যুগকে দেখো! ছিলো এমন সাহস তোমাদের যুগের প্রেমিকদের? হুঁ! সে সাহসের পরাকাষ্ঠা তো দেবদাস, শেখর, রমেশ মাটির ঘোড়া, স্রেফ মাটির ঘোড়া। ছোটার ভঙ্গীটি নিয়ে অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
মাথা থেকে পা পর্যন্ত যেন একটা বিদ্যুৎপ্রবাহ বহে গেল।
অন্য অনেক দিনের মতো আজও একবার ভাবলেন অনামিকা দেবী, আমি কি এ যুগকে হিংসে করছি? আমার ওই না-পছন্দটা কি সেই হিংসেরই রূপান্তর?
কী হল পিসি, আমন চুপ মেরে গেলে যে?
অনামিকা দেবী কলমটা আবার হাতে তুলে নিলেন এবং যে কথাটা মুহূর্ত আগেও ভাবেননি, হঠাৎ সেই কথাটাই বলে বসলেন, ছেলেটা তো দেখছি ভারী হ্যাংলা!
কেন বললেন?
ঠিক এই মুহূর্তে কি সম্পূর্ণ বিপরীত ভাবনাটাই ভাবছিলেন না অনামিকা দেবী?
ভাবছিলেন না কি, বকুল, তোমার নির্মলের যদি এ সাহস থাকতো?
কিন্তু শম্পা ওই মনের মধ্যেকার কথাটা জানে না। তাই বলে ওঠে, আমিও ঠিক সেই কথাটাই বলেছি হতভাগাকে। কিন্তু ও যা নাছোড়বান্দা, মনে হচ্ছে বিয়ে না করে ছাড়বে না।
তোর বাবা কি বললো?