সেজদা উদ্দীপ্ত হয়ে বলে উঠেছিল, কেউ এসে কিছু লাগিয়েছে বুঝি? কিন্তু আমি এই তোমায় বলে দিচ্ছি বকুল, রকে বসে বলেই সে রকবাজ ছেলে? নিজের বাড়ির রকে বসে, ছেলেবেলা থেকে যাদের সঙ্গে চেনা সেই ছেলেরা এসে গল্পগাছা করে এই পর্যন্ত। তারা যে যেমন হোক, আমার প্রভাংশু সে জাতেরই নয়।
সেজদা তার ছেলের জাতি সম্পর্কে নির্ভয়ে যত বড় সার্টিফিকেটই দিন, তাকে ফেরাতে হয়েছিল বকুলকে।
বলেছিল, একেবারে না চিনে এভাবে লিখতে অসুবিধে বোধ করছি সেজদা।
সেজদা অপমানাহত হয়েই চলে গিয়েছিলেন এবং বলে গিয়েছিলেন, বাইরের জগতে তোমার একটু নামডাক আছে বলেই বলতে এসেছিলাম, নইলে সেজখুড়িমা আমাদের যে রকম অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখতেন তাতে এ-বাড়িতে পা দেবার কথা নয় আমাদের।
অনামিকা অবাক হয়ে তাকিয়েছিলেন সেই ক্ৰোধারক্ত মুখের দিকে, আর ক্ষণপূর্বের বিগলিত-হাস্য-মুখটার সঙ্গে মেলাতে চেষ্টা করছিলেন।
যাক, সেই তো এক ঘটনা ঘটে বসে আছে ও-বাড়ির সঙ্গে। আবার কী?
সেদিন ছোটবৌদি বলেছিল, লিখে দিলেই হতো বাপু দুলাইন, আপনার লোকের ছেলের একটু উপকার হতো। কোনো উপকারেই তো লাগি না।
ছোড়দা বলেছিল, না না, ও ঠিক করেছে। জানা নেই কিছু নেই, ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট দিলেই হল? এখনকার ছেলেরা তো দুধে-দাঁত ভাঙবার আগেই পলিটিক্স করছে! কে কোন পার্টিতে ঢুকে বসে আছে কে জানে!
বন্ধুবিচ্ছেদ হল এই আর কি!
বলেছিল ছোটবৌদি।
তখন শম্পা ছিল।
তখন বিচ্ছেদ শব্দটার মানে জানত না ছোটবৌদি। ওকেই বিচ্ছেদ বলেছিল।
সে যাক, আজ আবার জ্যাঠামশাইয়ের ছেলে কোন পরিস্থিতিতে ফেলবেন কে জানে!
তবু এটা ভাবেনি। এটা অভাবনীয়।
ও-বাড়ির বড়দা প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন, তোমার তো অনেক জানাশোনা, শুনলাম ম্যাজিসিয়ান অধিকারী তোমায় খুব খাতির করে, আমার এই নাতনীটাকে যদি ওদের দলে ঢোকাবার একটু চান্স পাইয়ে দিতে পারো!
বকুলের মনে হয়েছিল বাংলা কথা শুনছে না, যে ভাষা শুনছে তা বকুলের অবোধ্য। বকুল অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, কোন দলে?
আহা ওই ম্যাজিকের দলে!
বকুল প্রায় অভিভূতের মত বলে ফেলে, ও ম্যাজিক জানে?
আহা ম্যাজিক না জানুক, ম্যাজিকের দলে অনেক মেয়েটয়ে নেয় তো। সুন্দরী সুন্দরী মেয়েদের চাহিদা আছে। এই যে বেবির একটা ফটো সঙ্গে এনেছি, এটা তুমি দেখাবে।
বড়দা পকেট থেকে একটি খাম বার করে তার থেকে সন্তর্পণে একখানি ফটো বার করে টেবিলে রাখেন।
বকুল তুলে নেয় হাতে করে। চেয়ে থাকে ছবিটার দিকে।
অনেকটা যেন তার দিদি চাপার মত দেখতে। বংশের গড়ন থাকে, কাছে দূরে কোথাও কোথাও সেটা ধরা পড়ে।
মেয়েটা যেন বড় বড় চোখে তাকিয়ে রয়েছে, ফটোটা তোলা ভাল হয়েছে।
বকুল কি বলবে ভেবে না পেয়ে একটা অবাস্তব কথা বলে বসে, কোনখান থেকে তুলিয়েছেন ফটোটা?
ভারত স্টুডিও থেকে। কেন, ভাল হয়নি?
ভাল হয়েছে বলেই বলছি।
বললে তুমি কি মনে করবে জানি না বকুল, দেখতে আরো ভাল। এ ফটো যদি তুমি একবার দেখাও, লুফে নেবে। তাছাড়া অন্য কোয়ালিফিকেশন আছে। সেবার সাইকেলে বাংলা বিজয় করে এলো জানো বোধ হয়। ওদের দলে আরো পাঁচটা ছেলে ছিল, ও সেকেণ্ড হয়েছিল। তাহলেই বোঝ।
বকুল বুঝতে থাকে। বুঝতে বুঝতে ঘামতে থাকে।
তারপর আস্তে বলে, কিন্তু এত সুন্দর মেয়ে, বিয়েটিয়ে না দিয়ে
বড়দা উত্তেজিত হয়ে বলেন, বিয়ে তো আর অমনি হয় না বকুল! আমার অবস্থা তুমি না জানলেও তোমার ভাইয়েরা জানে! ওর বাপ তো চিরকালই নি-রোজগেরে। তাস-পাশা খেলে, পান খায়, ঘুরে বেড়ায়, আর রোজগারের কথা তুললেই বলে আমার হার্টের অসুখ, বুক গেল! তবে? ঘরের কড়ি যেখানে যা আছে খরচা করে বিয়ে না হয় দিলাম, তাতে আমার কী লাভ হলো? উনি মহারানী রাজ্যপাটে গিয়ে বসলেন, আমার হাড়ির হাল আরো হাড়ির হলো। না না, এটি তোমায় করে দিতেই হবে বকুল, খুব আশা নিয়ে এসেছি। ওরা নাকি মাইনেপত্তর ভাল দেয়।
বকুল আস্তে বলে, তা হলেও শুনতে খারাপ তো! অন্য কোথাও কোনো কাজে যদি
বড়দা আরো উত্তেজিত হয়ে বলেন, অন্য কোথায় কী কাজ জুটবে ওর বলো? স্কুল ফাইন্যালটাও তো পাস করেনি। কেবল এটা-ওটায় মন! আর শুনতে খারাপের কথা বলছে!… ওসব কথা আজকাল আছে নাকি? নেই। যে যাতে সুবিধে বুঝবে, তাই করবে, ব্যাস! ধিক দিতে সবাই পারে, ভিখ দিতে কেউ পারে না। আমার এক বন্ধুও সেদিন এই কথা বলেছে। বলেছে, দেখ ভাই, আমি ঠিক করেছি মেয়েদের বিয়ের চেষ্টা আর করব না। ওর আবার বুড়ো বয়সের সংসার, এখনো ঘরে আইবুড়ো মেয়ে। তাই বলে, বিয়ের চেষ্টা টেষ্টা করছি না। সারাজীবন ধরে দাতে দড়ি দিয়ে যেটুকু সংস্থান করেছি, তা কি ওই মেয়েটি তিনটের চরণে ঢালতে?…না, ওসবের মধ্যে আমি নেই। বরং মেয়েদের বলি, এতকাল যে বাবার পয়সায় খেলি পরলি, লেখাপড়া শিখলি, এবার বুড়ো বাপকে তার শোধ দে।… তা বড় মেজ দুই মেয়েই যাহোক কিছু করছে, ছোট মেয়েটাই একবগ্গা, বলে, ওসব আমার ভাল লাগে না। আমি বলি, তবে কী ভাল লাগে? বাপের মাথায় কাঁঠাল ভাঙতে? যখন বাইরে থেকে টাকা আহরণ করে আনবার ক্ষমতা রয়েছে, তখন ঘরের টাকা ভেঙে বাইরে যাবি কেন? আমিও তাই ভাবছি, জ্ঞানচক্ষু খুলে দিয়েছে সে। তুমি ভাই নাতনীর জন্যে একটু চেষ্টা করো। বলো খুব চালাক চতুর মেয়ে, যা শেখাবে তাই চটপট শিখে নেবে।