কিন্তু এক কথায় কি করে বলা যায়–হ্যাঁ আচ্ছা, তাই যাও!
তাই আস্তে আস্তে,ভয়ে ভয়ে বলে, কাশীতে? বাবার কাছে? তাই কি সম্ভব? তিনি একা মানুষ, তাঁর কাছে গিয়ে কি থাকবে?
সত্য সংক্ষেপে বলে, সে যা হয় হবে। সাধন, তুই আমায় পৌঁছে দিতে পারবি না?
সাধনকেই প্রশ্ন করেছিল সত্য, বড় ছেলে বলেই করেছিল। কিন্তু সাধন এ প্রশ্নের উত্তর দিতে অকূলপাথারে পড়লো। একা সে নিজের দায়িত্বে মাকে নিয়ে কাশী যাবে, এ হেন প্রস্তাবটাই যেন তার কাছে মার আর এক পাগলামি বলে মনে হল।
ছেলের এই বিপন্ন মুখের দিকে তাকিয়ে সত্যর মুখে হঠাৎ সূক্ষ্ম একটি হাসির রেখা ফুটে উঠল, আর তেমনই সূক্ষ্মভাবে সে বললে, পারবি না বলেই মনে হচ্ছে, তবে থাক!
অন্য সময় হলে এই হয়তো ছেলেকে তীব্র তিরস্কার করত সত্য, কিন্তু আজ আর করল না। ওইটুকু বলেই হাতের কাজ সারতে লাগলো।
নবকুমারের চোখে ওই সূক্ষ্ম হাসিটুকু ধরা পড়ার কথা নয়, কিন্তু কেন কে জানে পড়লো। আর কেন কে জানে সে এতে একটা অপমানের জ্বালা অনুভব করলো। আর সেই অনুভূতির ফলেই ফট করে বলে বসলো, কেন, সাধনই বা কেন, আমি পারি না?
আমি নিয়ে যাবো, এ কথা বললো না অবশ্য, বললো, আমি পারি না? সত্য এবার ওদের অবাক করে দিয়ে ভাল গলাতেই হেসে উঠল। হেসে বলল, কী আশ্চর্য, পারবে না এ কথা কখন বললাম? তবে ওরা বড় হয়েছে, ওদের মায়ের ভার কিছু কিছু নেবে, এইটাই তো আশা।
বড় হয়েছে, ভারী লায়েক হয়েছে! বলে কথায় যবনিকাপাত করে অন্য এক মতলব ভঁজতে থাকে নবকুমার।
তবে আর একটা ঝড়ের আশঙ্কা করে। কিন্তু ঝড় ওঠে না। নবকুমার আশ্বস্ত হয়, আবার আশ্চর্যও হয়।
সত্য কি হঠাৎ বদলে গেল?
.
ঝড় উঠল অন্যত্র।
উঠল পরদিন।
স্কুল থেকে ফিরে বইখাতা নামিয়ে সুবর্ণ ছুটে এসে হঠাৎ দু হাতে মাকে জড়িয়ে ধরে বলে ওঠে, মা মা, আমার একটা দিদি আছে?
সুবৰ্ণর প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে সত্য গালে হাত দিয়ে বলে, ওমা, এই আমি কাঁচা কাপড়টা পরলাম, আর তুই ইস্কুলের জামায় ছুঁয়ে দিলি?
যাক গে, হোক গে, সুবর্ণ মায়ের হাতে হাত ঘষতে ঘষতে বলে, ইস্কুল কি কিছু খারাপ জায়গা?
কাপড়ের কাঁচাত্ম যখন ঘুচেইছে, তখন আর কি করা! সত্য সস্নেহে মেয়েকে কাছে টেনে বলে, দুর্গা দুর্গা! তাই কি বলেছি? তবে বাইরের জামাকাপড়ে কত ধুলো-নোংরাও তো লাগে। সে যাক, দিদির কথা কি বললি?
সেই তো বলছি– সুবর্ণ মহোৎসাহে বলে, আমাদের ইস্কুলে একজন নতুন মাস্টারনী এসেছেন, তিনি আমার দিদি হন।
আঃ সুবর্ণ! আবার ওই রকম বিচ্ছিরি করে বলছিস? কতদিন বলেছি মাস্টারনী বলবি না!
বাবা তো বলেন! গোঁভরে বলে সুবর্ণ।
বলুক! সত্য দৃঢ়স্বরে বলেন, ছেলেমানুষদের ওসব কথা বলতে নেই। তোমরা কি ওঁদের মাস্টারনী বলে ডাকো?
ধ্যাৎ, আমরা তো দিদি বলি! একজন নতুন দিদি এসেছেন, তিনি বললেন, তিনি আমার দিদি হন!
সত্য অবাক হয়ে বলে, কে রে? নাম কি?।
নাম? নাম হচ্ছে নাম হচ্ছে–নাম হচ্ছে সুহাস দত্ত। উনির বিয়ে হয়েছে, কিন্তু সিঁথেয় সিঁদুর নেই। একটা মেয়ে বললো, বেহ্ম তো, বেহ্মদের সিঁদুর থাকে না।
মেল ট্রেন চালিয়ে যায় সুবর্ণ।…হয়তো আরোই যেত। সত্য থামায়। রক্তিম মুখে বলে, সুহাস দত্ত? তুই ঠিক শুনেছিস?
এই দেখ মা’র কাণ্ড! শুনবো না? সবাই বলছে। কী সুন্দর দেখতে! আমায় বললেন, জানো আমি তোমার দিদি হই?
সত্য রুদ্ধকণ্ঠে বলে, তা তুই কি উত্তর দিলি?
আমি? আমি বললাম, দিদি হন তো আমাদের বাড়ি যান না কেন? তা উনি বললেন, সময় পান না। সত্যি মা? তোমার নিজের মেয়ে?–আমার মায়ের পেটের বোন?
সত্য বিচলিত গলায় বলে, কী বকিস বাজে? অত বড় মেয়ে আমার হতে পারে? ও আমার সম্পর্কে মেয়ে!
তবে যে উনি বললেন, তোমার মা আমার মা।
বলেছে, এই কথা বলেছে? সত্য হঠাৎ কেমন উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে, তাতে তুই কি বললি?
বললাম, আচ্ছা আজ মাকে শুধাবো
দূর বোকা, ওকথা বলতে নেই। বলতে হয়—
কিন্তু কী বলতে হয়?
সত্য নিজের কি জানে এক্ষেত্রে কি বলতে হয়! তবু সত্য বলে, বলতে হয়, তবে চলুন আমাদের বাড়ি। ভারি বোকা তুই!
সুবর্ণ লজ্জা পেয়ে বলে, তাই বলবোই তো ভাবলাম। কিন্তু ভয় হল তোমাকে। তুমি পাছে রাগ করো।
সত্য হঠাৎ মেয়ের হাতটা ধরে আরো কাছে টেনে কেমন একরকম হতাশ গলায় বলে, ভয় হল? আমাকে তোদের ভয় হল? আমি কেবল রাগই করি?
সুবৰ্ণ মায়ের এই স্বর-বৈচিত্র্যে বিশেষ বিচলিত হয় না, সুযোগ পেয়ে যাওয়ার ভঙ্গীতে অবলীলায় বলে ওঠে, তা ভয় হয় না? ভয়ে তো কাটা হয়ে থাকি। বাবা এস্তক সবাই। তোমার মুখের পানে চাইতে প্রাণ উড়ে যায়। আবার বলা হচ্ছে, আমি কেবল রাগই করি? রাতদিন রাগের ঠাকুর হয়েই তো আছ!
রাগের ঠাকুর!
মেয়ের এই মনোহর নামকরণের ভঙ্গিমায় কি হেসে উঠল সত্য? বলে উঠল কি, আর তুই হচ্ছিস কথার ঠাকুর!
না, তা বলল না সত্য।
সত্য হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেল।
সত্য এই অবোধ শিশুর অবাধ উক্তির মধ্যে যেন নিজের বহিমূর্তিটা দেখতে পেল।
ঠাকুর!
তা ঠাকুরই যদি হয় তো গাছতলায় পড়ে থাকা রুক্ষ দীর্ণ রৌদ্রের তাপে ঝলসানো এক শ্রীহীন শোভাহীন ভয়ঙ্করী ঠাকুর!
স্বামী-সন্তানের কাছে অতএব এই পরিচয় সত্যর?… প্রীতিকর নয়, ভীতিকর? এলোকেশীর সঙ্গে তফাৎটা কোথায় সত্যর?