আপনে কি নিজ বাসভূমে কবিতা অনলাইনে পড়তে চাচ্ছেন? নিজ বাসভূমে – শামসুর রাহমানের একটি জনপ্রিয় কবিতার বই। নিজ বাসভূমে কবিতা বইটি পড়তে নিচে স্ক্রোল করুণ এবং বইটি পড়তে থাকুন। আমাদের এখানে আপনে কোন প্রকার সমস্যা ছাড়াই নিজ বাসভূমে কবিতার বই পড়তে পারবেন।
নিজ বাসভূমে কবিতার বিবরণঃ
- বইয়ের নামঃ নিজ বাসভূমে
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- প্রকাশনাঃ বিভাস
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অকথ্য এক অন্ধকারে
অকথ্য এক অন্ধকারে মগ্ন আমি
খুপরিটাকে আঁকড়ে ধরে;
বাঁচার নেশা অদ্যাবধি বেশ ঝাঁঝালো,
তাই তো টিকি এই শহরে।
জগৎ জুড়ে জোর কলহ চলছে এখন,
উলুখড়ের ঘোর বিপদ।
এরই মধ্যে চায়ের বাটি সামনে রেখে
রাজা উজির করছি বধ।
বুঝতে পারা সহজ তো নয় পাচ্ছি কী-যে
মজা খালের কাদা সেঁচে।
অকথ্য এক অন্ধকারে, স্বীকার করি,
মন্দ-ভালোয় আছি বেঁচে।
জানলা ছেড়ে শীতের কালো সন্ধ্যাবেলা
ফের টেবিলে কথার গানে
মও হয়ে রাত্রি জেগে পদ্য লিখে
বেহুঁশ খুঁজি বাঁচার মানে।
লেখার ফাঁকে ছন্দ মিলের হাতছানিতে
মধ্যপথে খন্দে পড়ি,
রেশমী কোনো শব্দ শুনে ব্যাকুল হয়ে
আবার নতুন ছন্দে নড়ি।
শয্যা ছেড়ে সিঁড়ির ধাপে হঠাৎ থেমে
চড়ুইটাকে ডাকি কাছে।
আমার হাতের নড়া দেখেই লেজ দুলিয়ে
পালায় চড়ুই সজ্নে গাছে।
আমার ওপর ছোট্র পাখির নেই ভরসা,
পালায় দূরে কিরাত ভেবে।
চতুর্দিকে খুনখারাবি আছেই লেগে,
চড়ুইটাকে দোষ কে দেবে?
অজস্র মাইক্রোফোন
অজস্র মাইক্রোফোন রটায় শান্তির বাণী, অথচ সর্বত্র
তীব্র কুচকাওয়াজ চলছে অবিরাম। শান্তি-ছত্র
মেলে দিয়ে হিরন্ময় হয়ে ওঠে সম্মেলন, শীর্ষ সম্মেলন
সুভাষণে। দিকে দিকে অবিরল প্রেসক্রিপশনের মতন
বিলি হয় শান্তি-সমর্থক পুস্তিকা ইত্যাদি আর
প্রেস ফটোগ্রাফারের ক্যামেরার
ঘূর্ণিল ফিল্মের রিল দ্রুত ভরে ওঠে শান্তিবাদী নেতাদের
নিম নেতাদের মুখের বিচিত্র ভঙ্গিমায়। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের
ভবিষ্যৎ ভেবেই রাসেল আর্তস্বরে করেন সতর্কবাণী,
হয়তো দেখেন তিনি চরাচরে ডিনোসরাসের ভিড়, সব রাজধানী
বিশীর্ণ কংকাল হয়ে ভাসে তাঁর চোখে। এমনকি লম্বা চুল
সাবান-বিদ্বেষী হিপ্পিরাও কখনো ব্যাকুল
ঘোরে পথে পথে বোমা-তাড়ানিয়া বিক্ষোভ মিছিলে।
অস্ত্রাগারে সটান দাঁড়িয়ে সামরিক নায়কেরা ধীরে প্রশান্ত গলায়
ছড়াচ্ছেন আশ্বাসের বাণী ওড়াচ্ছেন শান্তির ফানুস
যখন তখন মরু সমুদ্র পর্বত আকাশের নীলে।
এদিকে মানুষ সব সন্ত্রস্ত মানুষ
ক্রমাগত ঢাকা প’ড়ে যাচ্ছে গাদা গাদা রাইফেলের তলায়।
আকাশের পেটে বোমা মারলেও
আকাশের পেটে বোমা মারলেও ছাই এক কাচ্চা
বিদ্যে-বুদ্ধি বেরুবে না, ঠিকরে পড়বে না পরামর্শ।
অথচ সুদূর
আকাশেরই দিকে ফ্যালফ্যাল চেয়ে থাকি বারবার।
পা-পোষে পাম্পশু ঘষে ঘষে কতদিন গেল, তবু
পদোন্নতি মাঠে মারা যাচ্ছে,
দপ্তরের খিটখিটে কিন্তু ফিটফাট বড় কর্তা
কেবলি ধমকাচ্ছেন হপ্তায় হপ্তায়।
যিনি হলে হতে পারতেন আমার শ্বশুর, তিনি তাঁর
আত্মজাকে পশুর মতোই
অন্যত্র চালান দিতে করেননি কসুর, হায় রে,
আমি শুধু আকাশের দিকে চেয়ে থাকি ফ্যালফ্যাল।
বোনগুলো আইবুড়ো থেকে যাচ্ছে ক্রমাগত আর
অনুজ ক’মাস ধরে ছেঁড়া প্যান্ট পরে ষাঁচ্ছে স্কুলে।
উপরন্তু বিমুখ পাড়ার মুদি; বাবার বাতের
মালিশ কেনার পয়সাও নেই হাতে!
হাঁড়ি ঠেলে ঠেলে দ্রুত জননী হচ্ছে ফৌত আর
আমি শুধু আকাশের দিকে ফ্যালফ্যাল চেয়ে থাকি।
শান্তির দোহাই পেড়ে সবাই মটকে দিচ্ছে পায়রার ঘাড়
এবং প্রগতিশীল নাটকের কুশী-
লবের কমতি নেই, পার্ট জানা থাক
অথবা না-থাক সমম্বরে চেঁচালেই কেল্লা ফতে।
অপরের পাকা ঘুঁটি বাঁচিয়ে নিজের ঘুঁটি ঘরে
তুলছে অনেকে,
একজন দিনদুপুরেই স্রেফ ছুরির ফলায়
নিপুণ ফাঁসিয়ে দিচ্ছে অন্যের উদর,
আমি শুধু আকাশের দিকে চেয়ে থাকি ফ্যালফ্যাল-
অথচ সুদূর
আকাশের পেটে বোমা মারলেও ছাই।
আমরা প্রার্থী তারই
তোমার আমার কাঙ্ক্ষিত ভোর
আসার আগেই স্বপ্ন-বিভোর
তোমাকে হানল ওরা।
একদা তুমিও চৈত্র দুপুরে
টলটলে সেই পুরোনো পুকুরে
ফেলেছ চিকন ছিপ।
আম্রছায়ায় কালো দিঘিটায়
এক হাটু জলে দাঁড়িয়েছ ঠায়
শাপলা তুলবে বলে।
সর্ষে ক্ষেতের হলদে হাওয়ায়
কী জানি সে কোন গভীর চাওয়ায়
হাত দুটি দিতে মিলে।
ঝোপের কিনারে কখনো হঠাৎ
গুলতিটা পেলে বাড়িয়েছ হাত
প্রজাপতিটার দিকে।
সেই কবে তুমি শিরীষের মূলে
আহত পাখিকে নিয়েছিলে তুলে
উদার ব্যগ্র বুকে।
যে-সাড়া তরুণ ঘাসের ডগায়
জ্যোৎস্না-ডোবানো স্বপ্ন জোগায়
তা-ও পেয়েছিলে তুমি।
বলেছিলে, তুমি, যে-কথা কখনো
বাজে না হৃদয়ে গান হয়ে কোনো
সে-কথা ব্যর্থ, ম্লান।
বলেছিলে আরও, যে-জীবন কারো
প্রাণকে করে না আলোয় প্রগাঢ়,
সে-জীবন নিষ্ফল।
বুঝি তাই প্রেমে বড় উৎসুক
তুলে ধরেছিলে স্বদেশের মুখ
নিবিড় অঞ্জলিতে!
খোলা রাস্তায় মিছিলে মিছিলে
চকিতে প্রহরে ছড়িয়ে কী দিলে?
চৌদিক থরথর।
তোমার আমার কাঙ্ক্ষিত ভোর
আসার আগেই স্বপ্ন-বিভোর
তোমাকে হানল ওরা।
এই আলো আরো পবিত্র হবে
তোমার রক্ত-রাঙা বৈভবে,-
বলল ব্যাকুল পাখি।
যে-আলো তোমার চোখে নেচেছিল,
যে-আলো তোমার বুকে বেঁচেছিল
আমরা প্রার্থী তারই।