প্রথম প্রতিশ্রুতি প্রখ্যাত ভারতীয় লেখিকা আশাপূর্ণা দেবীর একটি জনপ্রিয় উপন্যাস। প্রথম প্রতিশ্রুতি উপন্যাসটির বিষয়বস্তু অবলম্বনে একটি সিনেমাও তৈরী করা হয় এবং প্রথম প্রতিশ্রুতি উপন্যাসটির জন্য আশাপূর্ণা দেবী সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মান জ্ঞানপীঠ পুরস্কার লাভ করেন। প্রথম প্রতিশ্রুতি বইটি আনন্দ পাবলিশার্স ১৯৬৪ সালে প্রকাশ করেন। সুরতাং আর দেরি না করে এখনি বিখ্যাত এই উপন্যাসটি পড়া শুরু করুণ।

প্রথম প্রতিশ্রুতি উপন্যাস বিবরণঃ

০১. সত্যবতীর গল্প

ভূমিকা

বহির্বিশ্বের ভাঙাগড়ার কাহিনী নিয়ে রচিত হয় বিগত কালের ইতিহাস। আলো আর অন্ধকারের পৃষ্ঠপটে উচ্চকিত সেই ধ্বনিমুখর ইতিহাস পরবর্তীকালের জন্য সঞ্চিত রাখে প্রেরণা, উন্মাদনা, রোমাঞ্চ। কিন্তু স্তিমিত অন্তঃপুরের অন্তরালেও কি চলে না ভাঙাগড়ার কাজ? যেখান থেকে রং বদল হয় সমাজের, যুগের, সমাজ মানুষের মানসিকতার। চোখ ফেললে দেখা যায়। সেখানেও অনেক সঞ্চয়। তবু রচিত ইতিহাসগুলি চিরদিনই এই অন্তঃপুরের ভাঙাগড়ার প্রতি উদাসীন। অন্তঃপুর চিরদিনই অবহেলিত। বাংলাদেশের সেই অবজ্ঞাত অন্তঃপুরের নিভৃতে প্রথম যাঁরা বহন করে এনেছেন প্রতিশ্রুতির স্বাক্ষর, এ গ্রন্থ সেই অনামী মেয়েদের একজনের কাহিনী।

তুচ্ছ দৈনন্দিনের পৃষ্ঠপট আঁকা এই ছবি যদি বহন করে রাখতে পেরে থাকে বিগত কালের সামান্যতম একটি টুকরোকে, সেইটুকুই হবে আমার শ্রমের সার্থকতা।

–লেখিকা

॥ এ গ্রন্থে বর্ণিত চরিত্রগুলির পরিচয় ॥

মূল চরিত্র – সত্যবতী

রামকলী – সত্যবতীর বাবা

জয়কালী – ঠাকুর্দা

কুঞ্জ – জ্যাঠামশাই

জটা—পিসির ছেলে

নবকুমার—স্বামী

নীলাম্বর বাঁড়ুয্যে—শ্বশুর

সাধন—ছোট ছেলে

সরল—ছোট ছেলে

ফেলু বাঁড়ুয্যে—রামকালীর শ্বশুর

রাসবিহারী—কুঞ্জর বড় ছেলে

নেড়ু—কুঞ্জর ছোট ছেলে

ভবতোষ—নবকুমারের শিক্ষক

নিতাই—নবকুমারের বন্ধু

লক্ষ্মীকান্ত বাড়ুয্যে—পাটমহলের জমিদার

শ্যামাকান্ত—ঐ জমিদার-পুত্র

রাখহরি ঘোষাল—ঐ প্রতিবেশী

দয়াল মুখুয্যে

নগেন—কাটোয়র যুবক

বিদ্যারত্ন—রামকালীর ভক্তিভাজন পণ্ডিত

গোবিন্দ গুপ্ত—আশ্রয়দাতা

পটলী ঘোষাল

বিপিল লাহিড়ী—প্রতিবেশী

মুকুন্দ মুখুয্যে—সৌদামিনির স্বামী

তুষ্ট—গোয়ালা

রঘু—তুষ্টুর নাতি

বিন্দে—ওঝা

গোপেন–রাখাল

সরল–চ্ছোট

ভুবনেশ্বরী–সত্যবতীর মা

দীনতারিনী — ঠাকুমা

কাশীশ্বরী

মোক্ষদা– পিসঠাকুর

শিবজায়া

নন্দরানী – জ্ঞাতিঠাকুমা

নিভাননী

সুকুমারী – মামী

এলোকেশী–সত্যবতীর শাশুড়ী

পুণ্যি— সত্যবতীর সমবয়সী পিসি

খেঁদি–বাল্যবান্ধবী

সুবৰ্ণ – মেয়ে

সেজ পিসি – জটার মা

শশীতারা–কুঞ্জর বোন

অভয়া–স্ত্রী

সারদা–রাসুর বৌ

পটলী–রাসুর দ্বিতীয় স্ত্রী

শঙ্করী (কাটোয়ার বৌ)– কাশীশ্বরীর নাতবৌ

বেহুলা–শ্যামাকান্তের স্ত্রী

ভাবিনী–নিতাইয়ের স্ত্রী

মুক্তকেশী–এলোকেশীর সইয়ের মেয়ে

সৌদামিনী–এলোকেশীর ভাগ্নী

সুহাস–শঙ্করীর মেয়ে

সাবিপিসি, রাখুর মা, নাপিত-বৌ, দত্তগিন্নী ক্ষ্যান্ত ঠাকরুণ ইত্যাদি।

০১.

সত্যবতীর গল্প আমার লেখা নয়। এ গল্প বকুলের খাতা থেকে নেওয়া। বকুল বলেছিল, একে গল্প বলতে চাও গল্প, সত্যি বলতে চাও সত্যি।

বকুলকে আমি ছেলেবেলা থেকে দেখছি। এখনও দেখছি। বরাবরই বলি, বকুল, তোমাকে নিয়ে গল্প লেখা যায়। বকুল হাসে। অবিশ্বাস আর কৌতুকের হাসি। না, বকুল নিজে কোনদিন ভাবে না—তাকে নিয়েও গল্প লেখা যায়। নিজের সম্বন্ধে কোন মূল্যবোধ নেই বকুলের, কোন চেতনাই নেই।

বকুলও যে সত্যিই পৃথিবীর একজন এ কথা মানতেই পারে না। বকুল। সে শুধু জানে, সে কিছুই নয়, কেউই নয়। অতি সাধারণের একজন, একেবারে সাধারণ–যাদের নিয়ে গল্প লিখতে গেলে কিছুই লেখবার থাকে না।

বকুলের এ ধারণা গড়ে ওঠার মূলে হয়তো ওর জীবনের বনেদের তুচ্ছতা। হয়তো এখন অনেক পেয়েও শৈশবের সেই অনেক কিছু না পাওয়ার ক্ষোভটা আজও রয়ে গেছে তার মনে। সেই ক্ষোভই স্তিমিত করে রেখেছে তার মনকে। কুণ্ঠিত করে রেখেছে তার সত্তাকে।

বকুল সুবৰ্ণলতার অনেকগুলো ছেলেমেয়ের মধ্যে একজন। সুবৰ্ণলতার শেষদিকের মেয়ে।

সুবৰ্ণলতার সংসারে বকুলের ভূমিকা ছিল অপরাধীর।

অজানা কোন এক অপরাধে সব সময় সন্ত্রস্ত হয়ে থাকতে হবে বকুলকে, এ যেন বিধি-নির্দেশিত বিধান।

বকুলের শৈশব-মন গঠিত হয়েছিল তাই অদ্ভুত এক আলোছায়ার পরিমণ্ডলে। যার কতকাংশ শুধু ভয় সন্দেহ আতঙ্ক ঘৃণা, আর কতকাংশ জ্যোতির্ময় রহস্যপুরীর উজ্জ্বল চেতনায় উদ্ভাসিত। তবু মানুষকে ভাল না বেসে পারে না বকুল। মানুষকে ভালবাসে বলেই তো—

কিন্তু থাক, এটা তো বকুলের গল্প নয়। বকুল বলেছে, আমার গল্প যদি লিখতেই হয় তো সে আজ নয়। পরে। জীবনের দীর্ঘ পথ পার হয়ে এসে বুঝতে শিখেছে বকুল, পিতামহী প্রপিতামহীর ঋণশোধ না করে নিজের কথা বলতে নেই।

নিভৃত গ্রামের ছায়ান্ধকার পুষ্করিণীই ভরা বর্ষায় উপচে উঠে নদীতে গিয়ে মিশে স্রোত হয়ে ছোটে। সেই ধারাই ছুটে ছুটে একদিন সমুদ্রে গিয়ে পড়ে। সেই ছায়ান্ধকারের প্রথম ধারাকে স্বীকৃতি দিতে হবে বৈকি।

আজকের বাংলাদেশের অজস্র বকুল-পারুলদের পিছনে রয়েছে অনেক বছরের সংগ্রামের ইতিহাস। বকুল-পারুলদের মা দিদিমা পিতামহী আর প্রপিতামহীদের সংগ্রামের ইতিহাস। তারা ংখ্যায় অজস্র ছিল না, তারা অনেকের মধ্যে মাত্র এক-একজন। তারা একলা এগিয়েছে। এগিয়েছে খানা ডোবা ডিঙিয়ে পাথর ভেঙে কাটাঝোঁপ উপড়ে। পথ কাটতে কাটতে হয়তো দিশেহারা হয়েছে, বসে পড়েছে নিজেরই কাটা-পথের পথ জুড়ে। আবার এসেছে আর একজন; তার আরব্ধ। কর্মভার তুলে নিয়েছে নিজের হাতে। এমনি করেই তো তৈরী হল রাস্তা। যেখান দিয়ে বকুল-পারুলরা এগিয়ে চলেছে। বকুলরাও খাটছে বৈকি। না খাটলে চলবে কেন? শুধু তো পায়ে চলার পথ হলেই কাজ শেষ হল না।

রথ চলার পথ চাই যে!

সে পথ কে কাটবে কে জানে? সে রথ কারা চালাবে কে জানে?

যারা চালাবে তারা হয়তো অলস কৌতূহলে অতীত ইতিহাসের পাতা উলটে দেখতে দেখতে সত্যবতীকে দেখে হেসে উঠবে।

নাকে নোলক, আর পায়ে মাল পরা আট বছরের সত্যবতীকে।

বকুলও একসময় হাসত।

এখন হাসে না। অনেকটা পায় পার হয়ে বকুল পথের মর্মকথা বুঝতে শিখেছে। তাই যে সত্যবতীকে বকুল কোনোদিন চোখেও দেখে নি, তাকে দেখতে পেয়েছে স্বপ্নে আর কল্পনায়, মমতায় আর শ্রদ্ধায়।

তাই তো বকুলের খাতায় সত্যবতীর এমন স্পষ্ট চেহারা আঁকা রয়েছে।

নাকে নোলক, কানে সার মাকড়ি, পায়ে ঝাঁঝর মিল, বৃন্দাবনী-ছাপের আটহাতি শাড়িপরা আট বছরের সত্যবতী। বিয়ে হয়ে গেছে। বছরখানেক আগে—এখনও ঘরবসতি হয় নি। অপ্রতিহত প্ৰতাপে পাড়াসুদ্ধ ছেলেমেয়ের দলনেত্রী হয়ে যথেচ্ছ খেলে বেড়ায়। সত্যবতীর মা ঠাকুমা জেঠী পিসী ঐটে উঠতে পারে না ওকে।

পারে না হয়তো সত্যবতীর যথেচ্ছাচারের ওপর ওর বাপের কিছু প্রশ্ৰয় আছে বলে।

সত্যবতীর বাপ রামকালী চাটুয্যে, চাটুয্যে বামুনের ঘরের ছেলে হলেও ব্রাহ্মণ-জনোচিত পেশা তাঁর নয়। অন্য শাস্ত্ৰপালা বেদ-বেদান্ত বাদ দিয়ে তিনি বেছে নিয়েছেন আয়ুৰ্বেদ। ব্ৰাহ্মণের ছেলে হয়েও কবিরাজী করেন রামকালী। তাই গ্রামে ওঁর নাম নাড়ীটেপা বামুন। ওঁর বাড়ির নাম নাড়ীটেপা বাড়ি।

রামকালীর প্রথম জীবনটা ওঁর অন্য সব ভাই আর অন্যান্য জ্ঞাতিগোত্রের চাইতে ভিন্ন। কিছুটা হয়তো বিচিত্ৰও। নইলে ওই আধাবয়সী লোকটার ওইটুকু মেয়ে কেন? সত্যবতী তো রামকালীর প্রথম সন্তান। সে যুগের হিসেবে বিয়ের বয়স একেবারে পার করে ফেলে তবে বিয়ে করেছিলেন রামকালী। সত্যবতী সেই পার হয়ে যাওয়া বয়সের ফল।

 

শোনা যায় নিতান্ত কিশোর বয়সে বাপের ওপর অভিমান করে বাড়ি থেকে পালিয়েছিলেন রামকালী। কারণটা যদিও খুব একটা ঘোরালো নয়, কিন্তু কিশোর রামকালীর মনে বোধ করি সেটাই বেশ জোরালো ছাপ মেরেছিল।

কি একটা অসুবিধেয় পড়ে রামকালীর বাবা জয়কালী একদিনের জন্যে সদ্য উপবীতধারী পুত্ৰ রামকালীর উপর ভার দিয়েছিলেন গৃহদেবতা জনাৰ্দনের পূজা-আরতির। মহোৎসাহে সে ভার নিয়েছিল রামকালী। তার আরতির ঘণ্টাধ্বনিতে সেদিন বাড়িসুদ্ধ লোক ত্ৰাহি জনাৰ্দন ডাক ছেড়েছিল। কিন্তু উৎসাহের চোটে ভয়ঙ্কর একটা ভুল ঘটে গেল। মারাত্মক ভুল।

রামকালীর ঠাকুমা ঠাকুরঘর মার্জনা করতে এসে টের পেলেন সে ভুল। টের পেয়ে ন্যাড়া মাথার উপর কদমছাট চুল সজারুর কাটার মত খাড়া হয়ে উঠল তার ৷ ছুটে গিয়ে ভাইপোর অর্থাৎ রামকালীর বাবা জয়কালীর কাছে প্ৰায় আছড়ে পড়লেন।

সর্বনাশ হয়েছে জয়!

জয়কালী চমকে উঠলেন কি হয়েছে পিসী?

ছেলেপুলেকে দিয়ে ঠাকুরসেবা করালে যা হয় তাই হয়েছে। সেবা-অপরাধ ঘটেছে। রেমো জনাৰ্দনকে ফল-বাতাসা দিয়েচে, জল দেয় নি।

চড়াৎ করে সমস্ত শরীরের রক্ত মাথায় গিয়ে উঠল জয়কালীর। অ্যাঁ করে একটা আর্তনাদধ্বনি তুললেন তিনি।

পিসী একটা হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে সেই সুরেই সুর মিলিয়ে বললেন, হ্যাঁ! জানি না এখন কার কি অদৃষ্ট আছে! ফুল তুলসীর ভুল নয়, একেবারে তেষ্টার জল!

সহসা জয়কালী পায়ের খড়মটা খুলে নিয়ে চিৎকার করে উঠলেন, রেমো! রেমো!

চিৎকারে রামকালী প্রথমটায় বিশেষ আতঙ্কিত হয় নি, কারণ পুত্র-পরিজনদের প্রতি স্নেহসম্ভাষণও জয়কালীর এর চাইতে খুব বেশী নিম্নগ্রামের নয়। অতএব সে বেলের আঠার হাতটা মাথায় মুছতে মুছতে পিতৃসকাশে এসে দাঁড়াল।

কিন্তু এ কী! জয়কালীর হাতে খড়ম!

রামকালীর চোখের সামনে কতকগুলো হলুদ রঙের ফুল ভিড় করে দাঁড়াল।

ভগবানকে স্মরণ করা রেমো, জয়কালী ভীষণ মুখে বললেন, তোর কপালে মৃত্যু আছে!

রামকালীর চোখের সামনে থেকে হলুদ রঙের ফুলগুলোও লুপ্ত হয়ে গেল, রইল। শুধু নিরন্ধ অন্ধকার। সেই অন্ধকার হাতড়ে একবার খুঁজতে চেষ্টা করল রামকালী কোন অপরাধে বিধাতা আজ তার কপালে মৃত্যুদণ্ড লিখেছেন। খুঁজে পেল না, খোঁজবার সামর্থ্যও রইল না। সেই অন্ধকারটা ক্রমশ রামকালীর চৈতন্যর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।

জনার্দনের ঘরে আজ পূজো করেছিলি তুই না?

রামকালী নীরব।

পূজার ঘরেই তা হলে কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু কই? কি? যথারীতি হাত-পা ধুয়ে তার পৈতেয় পাওয়া চেলির জোড়টা পরেই তো ঘরে ঢুকেছিল রামকালী। তারপর? আসন। তারপর? আচমন। তারপর? আরতি। তারপর—ঠাঁই করে মাথায় একটা ধাক্কা লাগল।

জল দিয়েছিলি ভোগের সময়?

এই প্রশ্নটি পুত্ৰকে করছেন জয়কালী খড়মের মাধ্যমে।

দিশেহারা রামকালী আরও দু-দশটা ধাক্কার ভয়ে বলে বসল—হ্যাঁ, দিয়েছি তো!

দিয়েছিলি?? জল দিয়েছিলি? জয়কালীর পিসী যশোদা একেবারে নামের বিপরীত ভঙ্গীতে বলে উঠলেন, দিয়েছিলি তো সে জল গেল কোথায় রে হতভাগা? গেলাস একেবারে শুকনো?

প্ৰশ্নকর্ত্রী ঠাকুমা।

বুকের গুরু-গুরু ভাবটা কিঞ্চিত হালকা মনে হল, রামকালী ক্ষীণস্বরে বলে বসিল, ঠাকুর খেয়ে নিয়েছে বোধ হয়!

কী? কী বললি? আর একবার ঠিক করে একটা শব্দ, আর চোখে অন্ধকার হয়ে যাওয়ার আরও গভীরতম অনুভূতি।

লক্ষ্মীছাড়া, শুয়োর বনবরা! ঠাকুর জল খেয়ে নিয়েছে? শুধু ভূত হও নি তুমি, শয়তানও হয়েছ। ভয় নেই প্ৰাণে তোমার? ঠাকুরের নামে মিছে কথা?

অর্থাৎ মিথ্যা কথাটা যত না অপরাধ হোক, ঠাকুরের নামের সঙ্গে জড়িত হয়ে ভীষণ অপরাধে পরিণত হয়েছে। রামকালী ভয়ের বশে আবারও মিছে কথা বলে বসে, হ্যাঁ, সত্যি বলছি। ঠাকুরের নামে দিব্যি। দিয়েছিলাম জল।

বটে। রে হারামজাদা! বামুনের ঘরে চাঁড়াল! ঠাকুরের নামে দিব্যি? জল দিয়েছিস তুই? ঠাকুর জল খেয়ে ফেলেছে? ঠাকুর জল খায়?

মাথার মধ্যে জ্বলছে।

রামকালী মাথার জুলায় অস্থির হয়ে সমস্ত ভয়-ডর ভুলে বলে বসল, খায় না জানো তো দাও কেন?

ও, আবার মুখে মুখে চোপা! জয়কালী আর একবার শেষবেশ খড়মটার সদ্ব্যবহার করলেন। করে বললেন, যা দূর হ, বামুনের ঘরের গরু! দূর হয়ে যা আমার সুমুখ থেকে!

এই।

এর বেশী আর কিছুই করেন নি জয়কালী। আর এরকম ব্যবহার তো তিনি সর্বদাই সকলের সঙ্গে করে থাকেন। কিন্তু কিসে যে কি হয়!

রামকালীর চোখের সামনে থেকে যেন একটা পর্দা খসে গেল।

চিরদিন জেনে আসছে জনাৰ্দন বেশ একটু দয়ালু ব্যক্তি, কারণে-অকারণে উঠতে বসতে বাড়ির সকলেই বলে, জনাৰ্দন, দয়া করো। কিন্তু কোথায় সে দয়ার কণিকামাত্ৰ!

রামকালী যে মনে মনে প্ৰাণ ফাটিয়ে চিৎকার করে প্রার্থনা করল, ঠাকুর এই অবিশ্বাসীদের সামনে একবার নিজমূর্তি প্রকাশ করো, একবার অলক্ষ্য থেকে দৈববাণী করো, ওরে জয়কালী, বৃথা ওকে উৎপীড়ন করছিস। জল আমি সত্যই খেয়ে ফেলেছি। একমুঠো বাতাসা খেয়ে ফেলে বড্ড তেষ্টা পেয়ে গিয়েছিল।

নাঃ, দৈববাণীর ছায়ামাত্র নেই।

সেই মুহূর্তে আবিষ্কার করল রামকালী, ঠাকুর মিথ্যে, দেবতা মিথ্যে, পূজোপাঠ প্রার্থনা–সবই মিথ্যে, অমোঘ সত্য শুধু খড়ম।

পৈতের সময় তারও একজোড়া খড়ম হয়েছে। তার উপর্যুক্ত ব্যবহার কবে করতে পারবে রামকালী কে জানে!

অথচ এই দণ্ডে সমস্ত পৃথিবীর উপরই সে ব্যবহারটা করতে ইচ্ছে করছে।

পৃথিবীতে আর থাকব না আমি।

প্ৰথমে সংকল্প করল রামকালী।

তারপর ক্রমশ পৃথিবীটা ছেড়ে চলে যাবার কোনো উপায় আবিষ্কার করতে না পেরে মনের সঙ্গে রিফা করল।

পৃথিবীটা আপাতত হাতে থাক, ওটা তো যখন ইচ্ছেই ছাড়া যাবে। ছাড়বার মত আরও একটা জিনিস রয়েছে, পৃথিবীরই প্রতীক যেটা।

বাড়ি।

বাড়িই ছাড়বে রামকালী।

জন্মে আর কখনও জনার্দনের পূজো যাতে না করতে হয়।

তখন নাড়ীটেপার বাড়ি নাম হয় নি, আদি ও অকৃত্রিম চাটুয্যে বাড়িই ছিল। সকলের শ্রদ্ধাসুমী ও সাধার ছিল। কাজেই বেশ কিছুদিন গ্রামে সাড়া পড়ে রইল, চাটুয্যেদেরর ছেলে হারিয়ে যাওয়া নিয়ে।

গ্রামের সমস্ত পুকুরে জাল ফেলা হল। গ্রামের সকল দেবদেবীর কাছে মানসিক মানা হল। রামকালীর মা রোজ নিয়ম করে ছেলের নামে ঘাটে প্ৰদীপ ভাসাতে লাগল, জয়কালী নিয়ম করে জনার্দনের ঘরে তুলসী চড়াতে লাগলেন, কিছুই হল না।

ক্রমশ সকলে যখন প্ৰায় ভুলে গেল। চাটুয্যেদের রামকালী বলে একটা ছেলে ছিল, তখন গ্রামের কোনো একটি যুবক একদিন ঘোষণা করল, রামকালী আছে। সে মুকণ্ডদাবাদে গিয়েছিল, সেখানে নিজের চোখে দেখে এসেছে রামকালী নবাব বাড়ির কবরেজ গোবিন্দ গুপ্তর বাড়িতে রয়েছে, তার সাকরেদি করে কবরেজি শিখছে।

শুনে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন জয়কালী। ছেলের বেঁচে থাকার খবর, আর ছেলের জাত যাওয়ার খবর, যুগপৎ উল্টোপাল্টা দুটো খবরে তিনি ভুলে গেলেন, আনন্দে হৈহৈকার করতে হবে কি শোকে হাহাকার করতে হবে!

ছেলে বদ্যিবাড়ির ভাত খাচ্ছে, বদ্যিবাড়ির আশ্রয় গ্ৰহণ করেছে, এ তো মৃত্যুসংবাদেরই সামিল।

অথচ রামকালী এযাবৎ মরে নি, একথা জেনে প্ৰাণের মধ্যে কী যেন ঠেলে উঠছে। কী সে? আনন্দ? আবেগ? অনুতাপের যন্ত্রণা-মুক্তির সুখ?

গ্রামের সকলের সঙ্গে পরামর্শ করতে লাগলেন জয়কালী। অবশেষে রায় বেরোল, জয়কালীর নিজের একবার যাওয়া দরকার। সরেজমিনে তদন্ত করে দেখে আসুন প্রকৃত অবস্থাটা কি! তা ছাড়া সেই লোক প্রকৃতই রামকালী। কিনা— তাই বা কে জানে! যে দেখেছে সে তো নিকট-আত্মীয় নয়, চোখের ভ্রম হতে কতক্ষণ?

কিন্তু পরামর্শ শুনে জয়কালী আকাশ থেকে পড়লেন, আমি যাব? আমি কি করে যাব? জনার্দনের সেবা ফেলে আমার কি নড়বার জোর আছে?

রামকালীর মা, জয়কালীর দ্বিতীয় পক্ষ দীনতারিণী শুনে কেঁদে ভাসাল। মুখে এসেছিল, বলে, জনাৰ্দনই তোমার এত বড় হল?

বলতে পারল না। সাহস করে, শুধু চোখের জল ফেলতে লাগল।

অবশেষে অনেক পরিকল্পনান্তে স্থির হল, জয়কালীর এক ভাগ্নে যাবে, বয়স্থ ভাগ্নে। তার সঙ্গে জয়কালীর প্রথম পক্ষের বড় ছেলে কুঞ্জকালী যাবে।

কিন্তু এই গন্ডগ্রিাম থেকে মুকণ্ডদাবাদে যাওয়া তো সোজা নয়! গরুর গাড়ি করে গঞ্জে গিয়ে খোঁজ নিতে হবে কবে নৌকা যাবে মুকগুদাবাদ। তারপর আবার চাল চিড়ে বেঁধে নিয়ে গরুর গাড়িতে তিন ক্রোশ রাস্তা ভেঙে নৌকোর কিনারে গিয়ে ধর্না পাড়া।

খরচও কম নয়।

জয়কালী ভাবলেন, খরচের খাতায় বসানো সংখ্যা আবার জমার খাতায় বসাতে গেলে ঝঞ্ঝাট বড় কম নয়। এত ঝঞাটের দরকারই বা কি ছিল? রাগ হল সেই ফাজিল ছোঁকরাটার ওপর; যে এসে খবর দিয়েছে। যে এত ঝঞাট বাধানোর নায়ক।

রামকালী তো খবচ হয়েই গিয়েছিল। ওই ফাজিলটা এসে খবর না দিলে আর—

কিন্তু দরকার ছিল রামকালীর মার দিক থেকে, তাই সব ঝঞাট পুইয়ে ভাগ্নেকে আর ছেলেকে পাঠালেন জয়কালী। আর কদিন পরে তারা এসে জানাল খবর ঠিক। রামকালী নিঃসন্তান গোবিন্দ বন্দির পুষ্যি হয়ে রাজার হালে আছে, এর পর নাকি পাটনা যাবে। এদের কাছে বলেছে একেবারে রাজবদ্যি হয়ে টাকার মোট নিয়ে দেশে যাবে, তার আগে নয়।

শুনে যাদের বেশী ঈর্ষা হল, তারা বলল, এমন কুলাঙ্গার ছেলের মুখদর্শন করতে নেই। তা ছাড়া ও তো জাতিচ্যুত।

যাদের একটু কম ঈর্ষা হল, তারা বলল, তবু বলতে হবে উদ্যোগী পুরুষ! আর জাতিচু্যতই বা হবে কেন? কুঞ্জ তো বলছে নাকি জেনে এসেছে গোবিন্দ গুপ্ত রামকালী চাটুয্যের জন্যে কোন এক বামুনবাড়িতে ভাতের ব্যবস্থা করে রেখেছে।

গ্রামে আবার কিছুদিন এই নিয়ে আলোচনা চলল। এবং যখন এসব আলোচনা ঝিমিয়ে গিয়ে ক্রমশ আবার সবাই রামকালীর নাম ভুলতে বসল, তখন একদিন রামকালী সশরীরে হাজির হল টাকার বস্তা নিয়ে।

গোবিন্দ গুপ্ত পরামর্শ দিয়েছেন, তোমার আর রাজবদ্যি হয়ে কাজ নেই বাপু, রাজ্যে এখন ভেতরে ভেতরে ঘুণ ধরতে বসেছে, নবাবের নবাবী তো শিকেয় উঠেছে। আমার এই দীর্ঘকালের সঞ্চিত অৰ্থরাশি নিয়ে দেশে পালিয়ে গিয়ে নিজে নবাবী করো গে। আমরা স্ত্রী-পুরুষ উভয়ে কাশীবাসে মনঃস্থির করেছি!

অগত্যা চলে এসেছে রামকালী।

গঞ্জের ঘাট থেকে নিজের পালকি করে।

গোবিন্দ গুপ্তের পালকিটাও পেয়েছে রামকালী। নৌকায় চাপিয়ে নিয়ে এসেছে।

কিন্তু তখন জয়কালী মারা গেছেন এই এক মস্ত আপসোস।

বাবাকে একবার দেখাতে পারল না। রামকালী, সেই তাড়িয়ে দেওয়া ছেলেটা মানুষ হয়ে ফিরল।

০২. গঞ্জে মেলায় যেমন

গঞ্জে মেলায় যেমন লোক দল বেঁধে পাঁচপেয়ে গরু দেখতে ছোটে, তেমনি করে দেশের সমস্ত লোক আসতে লাগল রামকালীকে দেখতে। রামকালী মনে মনে বিব্রত হলেও সকলকে যথোচিত মান্য করল এবং বয়োজ্যেষ্ঠ সকলকে একজোড়া করে ধুতি ও নগদ টাকা দিয়ে প্রণাম করল।

ঘরে ঘরে সবাই বলাবলি করতে লাগল, উঃ, কী উঁচু  নজরটাই হয়ে এসেছে! অনেকে নিজের নিজের চিরদিন বাড়ি বসে থাকা ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে নিঃশ্বাস ফেলল।

তবু কিছুদিন একটু জাতে-ঠেলা জাতে-ঠেলা হয়ে থাকতে হয়েছিল বৈকি রামকালীকে। বারবাড়িতে শুত, খেত, বাড়ির ছোট ছেলে।পুলে দৈবাৎ কেউ রামকালীকে ছুঁয়ে ফেললে তাকে কাপড় ছাড়ানো হত। কিন্তু রামকালীই একদিন গ্রামকর্তাকে ডেকে সালিশ মানল।

এটা কেন হবে?

একটি দিনের জন্যে সে বৈদ্যের অন্ন গ্রহণ করে নি, এক দিনের জন্য কোন অনাচার করে নি, শুধু শুধু পতিত হয়ে থাকতে হবে কেন তাকে?

গ্রামকর্তারা মাথা চুলকে হেঁ হেঁ করতে লাগলেন, স্পষ্ট কিছু বলতে পারলেন না। কারণ ছোঁড়াটা নাকি রাজবদ্যি গোবিন্দ গুপ্তর সমস্ত বিদ্যে আর সমস্ত টাকা হাতিয়ে নিয়ে এসেছে।

তাছাড়া ছোঁড়ার হাতটা দরাজ।

কর্তাদের হেঁ হেঁ করার অবসরে রামকালী নিজের বক্তব্য ব্যক্ত করল, দেখুন। আমার গুরুর ওষুধ ডেকে কথা কয়। আমি তার কিছু-কিঞ্চিৎ আশীৰ্বাদও তো পেয়েছি। সে বিদ্যে আমার জন্মভূমির, আমার পাড়াপাড়শীর, আমার জ্ঞাতি-গোত্তরের কাজে লাগুক এই আমি চাই। তবে যদি আপনারা তা না চান, তা হলে আবার আমাকে গ্রামের বাস উঠিয়ে চলে যেতে হবে।

এবার গ্রামকর্তারা হা হা করে উঠলেন। সত্যিই তো, কথাটা তো উড়িয়ে দেবার নয়? সকলেরই একদিন না একদিন নিদেনকাল আছে।

ওঁদের হাঁ-হাঁর অবসরে রামকালী বললে, এই যে একটি পুকুর কাটাবার ইচ্ছে হয়েছে, সেই উপলক্ষ্যে গ্রাম-ভোজন দেব। আশা করে বসে আছি, সে আশা তা হলে পূরণ হবে না!

এরা আবার দ্বিধাশূন্য হয়ে ‘সে কি? সে কি?’ করে উঠলেন।

আর ইত্যবসরে ফেলু বাঁড়ুয্যে এক চাল চেলে বসলেন। কি এক সংস্কৃত শ্লোক আউড়ে বললেন হেসে হেসে, জানো তো, উপর্যুক্ত বয়সে বিবাহ-সংস্কার না হলে কন্যা যেমন অরক্ষণীয়া হয়, পুরুষও তেমনি পতিত হয়।

রামকালী মাথা নীচু করে বললে, বয়স প্রায় ত্ৰিশ পার হতে চলল, এ বয়সে কে আমাকে কন্যাদান করবে?

ফেলু বাঁড়ুয্যে বীরদৰ্পে বলে উঠলেন, আমি করব। এতে আমার ভায়েরা আমাকে জাতে ঠেলেন তো ঠেলুন।

ফেলু বাঁড়ুয্যেকে জাতে ঠেলা! জাতের যিনি মাথা!

‘হাঁ-হাঁ’র স্রোত বইতে লাগল সভায়।

আর ফেলুর চালাকি দেখে মনে মনে সবাই নিজেদের গালে মুখে চড়াতে লাগল। মেয়ে আর কার ঘরে নেই!

এরই কিছুদিন পরে ফেলু বাঁড়ুয্যের ন বছরের মেয়ে ভুবি। বা ভুবনেশ্বরীর সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল রামকালীর।

বহুদিন এত ঘটার বিয়ে হয় নি গ্রামে।

কারণ রামকালী নাকি নিজে পাঁচ-পাঁচশ টাকা লুকিয়ে ওর মা দীনতারিণীর হাতে গুঁজে দিয়েছিল। ঘটা করতে।

এই বেহায়ামিটা যথেষ্ট নিন্দনীয় সন্দেহ নেই, কিন্তু ঘটার মাছমোণ্ডাগুলো অনিন্দনীয় ছিল।

অতএব রামকালী পুনশ্চ সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল। অনুমতি পেল বাড়ির মধ্যে গিয়ে খাবার শোবার।

যাক, তার পরও তো কাটল কতকাল।

সেই ভুবি। বড় হল, ঘর-বসতি হল, পনেরো-ষোলো বছরের ভরা-নদী হল। তার পর তো সত্যবতী।

বুড়ো বয়সের প্রথম সন্তান বলেই হয়তো বাপের কাছে কিছু প্রশ্ৰয় আছে সত্যবতীর।

০৩. দীনতারিণী নিরামিষ ঘরে

দীনতারিণী নিরামিষ ঘরে রান্না করছিলেন, সত্যবতী দাওয়ার নীচের ছাঁচতলায় এসে দাঁড়াল। উঁচু  পোতার ঘর। দাওয়ার কিনারাটা সত্যবতীর নাকের কাছাকাছি, পায়ের বুড়ো আঙুলের ওপর সমস্ত দেহভারটা দিয়ে ডিঙি মেরে গলা বাড়িয়ে সত্যবতী তার স্বভাবসিদ্ধ মাজাগলায় ডাক দিল, অ ঠাকুরমা, ঠাকুরমা!

নিরামিষ হেঁসেলের দাওয়ায় ওঠবার অধিকার সত্যবতীর কেন, বাড়ির মেটে দাওয়ার একপেশে কোণা থেকে খাজ কেটে সিঁড়ি বানানো হয়েছে, আর সে সিঁড়ি থেকে পায়ে পায়ে এগিয়ে যাওয়া পথ হয়েছে একেবারে ঘাট বরাবর। দীনতারিণী, দীনতারিণীর সেজজা শিবজায়া, দীনতারিণীর দুই ননদ কাশীশ্বরী আর মোক্ষদা–মাত্র এঁরাই এই পথে পদক্ষেপের অধিকারিণী। ঘড়া নিয়ে ঘাটে যান এবং স্নান সেরে ঘাড়া ভরে ভিজে কাপড়ে পায়ে পায়ে এসে একেবারে ওই সিঁড়ি কটি দিয়ে স্বৰ্গে উঠে পড়েন। ওই রান্নাঘরের দেওয়ালেই তাদের কাঁচাকাপড় শুকোয়, কারণ রাত্রে তো আর এঘরে রান্নার পাট নেই। ঘর নিকোনোর কাজেও কিছু আর অছ্যুৎরা কেউ এসে ঢুকবে না। সে কাজ মোক্ষদার। এটোসিকড়ির ব্যাপারে মোক্ষদা বোধ করি স্বয়ং ভগবানকেও সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতে পারেন না। কাজেই সে কাজ নিজের হাতে রাখেন। তা ছাড়া মোক্ষদাই বয়সে সব চেয়ে ছোট, অন্যান্যরা সকলেই তাঁর গুরুজন, অতএব সকলের খাওয়ার শেষে তারই ডিউটি।

রান্নার দায়িত্ব দীনতারিণীর, মোক্ষদার ওপর সে রান্নার বিশুদ্ধতা রক্ষার দায়িত্ব। বাকি দুজন যোগাড়ে। তা অবিশ্যি যোগাড়ের কাজটাও কম না। প্রয়োজনটা চারজনের হলেও আয়োজনটা অন্তত দশজনের মত হয়।

কিন্তু এসব কথা থাক।

আসলে ছেলে।পুলের এ উঠোনে পা দেবারও হুকুম নেই, কিন্তু সত্যবতীকে কেউ এঁটে উঠতে পারে না। ও যখন তখন দাওয়ার নিচে থেকে নাক বাড়িয়ে হাঁক পাড়ে, অ-ঠাকুরমা অথবা অ-পিসঠাকুরমা!

দীনতারিণী ওর গলা পেয়েই নিজের গলাটা বাড়িয়ে দরজা দিয়ে উঁকি মেরে বলেন, এই মলো যা, এ ছড়ি কি দস্যি গো! আবার এসেছিস? বেরো বেরো, ছোটঠাকুরঝি দেখতে পেলে আর রক্ষে রাখবে না!

সত্যবতী ঠোঁট উল্টে বলে, ছোটঠাকুরমার কথা বাদ দাও। তুমি শোন না একটু।

সত্যবতী দীনতারিণীর উপায়ী ছেলের মেয়ে, তাছাড়া সত্যর বিয়ে হয়ে গেছে, কাজেই খুব দূর-ছাইটা ওর কপালে জোটে না। তাই ওর আবদারে অগত্যাই দীনতারিণী একটু ডিঙি মেরে দাওয়ায় এসে দাঁড়ালেন। ইশারায় বললেন, কি চাই?

সত্যবতী পিঠের দিকে গোটানো হাতটা ঘুরিয়ে একখানা ছোট মাপের কচি মানপাতা মেলে ধরে চুপি চুপি বলে একটা জিনিস দাও না!

এই মরেছে, এখন আবার জিনিস কি রে? এখন কি কিছু রান্না হয়েছে? আর হলেও তোর সেজঠাকুরমার গোপালের ভোগের আগ আগে দিয়েছি, টের পেলে কুরুক্ষেত্তর করবে না?

আগ চাই নি, আগ চাই নি, ভালমন্দ রোধে নিজেরাই খেয়ো বাবা, আমাকে একমুঠো পান্তাভাত দাও দিকি!

পান্তাভাত?

দীনতারিণী আকাশ থেকে পড়লেন। আর সঙ্গে সঙ্গে যেন পাতাল ফুড়ে উঠলেন মোক্ষদা। রনে সপাসপে। ভিজে থান, কাখে ভরন্ত কলসী।

এইটা বোধ করি মোক্ষদার তৃতীয় দফা স্নান।

যে কোন কারণেই হোক, চাল ধুতে কি শাক ধুতে ঘাটে গেলেই মোক্ষদা একবার সবস্ত্ৰ স্নান সেরে নেন। দাওয়ার পৈঠে দিয়ে কখন যে উঠে এসেছেন, ঠাকুরমা নাতনী কারো চোখে পড়ে নি, চোখ পড়লো একেবারে সশরীরিণীর উপর।

দীনতারিণী অপ্ৰতিভের একশেষ, সত্যবতী বিরক্ত।

আর মোক্ষদা?

তিনি হাতেনাতে চোর ধরে ফেলা ডিটেকটিভের মতই উল্লসিত।

আবার তুই এখেনে! খনখনে গলায় প্রশ্ন করেন মোক্ষদা।

সত্যবতী ঈষৎ আমতা আমতা করে বলে, বাঃ রে, আমি কি তোমাদের দাওয়ায় উঠেছি?

দাওয়ায় উঠিস নি, বলি সকড়ি রাস্তা মাড়িয়ে এসে সেই পায়ে ওই উঠোনে তো পা দিয়েছিস! তুলসী গাছে জল দিতে উঠোনে নামতে হবে না। আমাদের?

সত্যবতী গোজ গোজ করে বলে, নামবার সময় তো দশঘড়া জল না ঢেলে নামো না, তবে আবার অত কি?

মুখে মুখে চোপা করিসনে সত্য, অব্যেস ভাল করা, মোক্ষদা ঘড়াটাকে দুম করে রান্নাঘরের চৌকাঠের ওপিঠে বসিয়ে আঁচল নিংড়ে নিংড়ে পায়ের কাদা ধুতে ধুতে বলেন, বাপের সোহাগে যে একেবারে ধিঙ্গী পদ পেয়ে বসে আছিস, বলি শ্বশুরঘর করতে হবে না? পরের বাড়ি যেতে হবে না? আর কদিন ধিঙ্গীনাচ নেচে বেড়াবি? মেরে কেটে আর দুটো-চারটে বছর, তাপর গলায় রসুড়ি দিয়ে টেনে নিয়ে যাবে না? তখন করবি কি?

প্রতি কথায় এই পরের ঘরে যাওয়ার বিভীষিকা দেখিয়ে দেখিয়ে জব্দ করার চেষ্টাটা দু-চক্ষের বিষ সত্যবতীর। বরং তাকে ওরা ধরে দু-ঘা মারুক, সহ্য হবে। কিন্তু ওই পরের ঘরের খোঁটা সয় না। অথচ ওইটিই যেন এদের প্রধান ব্ৰহ্মাস্ত্ৰ। সত্যবতী তাই বিরক্তভাবে বলে, করবো। আবার কি!

কি আর করবি? উঠতে বসতে শাউড়ীর ঠোনা খাবি। ওই পটলা ঘোষালের ভাইপো-বেঁটার মতন ঠোনা খেতে খেতে গালে কালসিটে পড়ে যাবে।

সত্যবতী বয়েস-ছাড়া ভঙ্গীতে ঝঙ্কার দিয়ে বলে ওঠে, ছিষ্টি সংসারের লোক তো আর পটলকাকার ভেজের মতন দজল নয়!

ওমা ওমা, শোন কথা মেয়ের, মোক্ষদা হত্তেলের রং নিটোল টাইট হাত দুখানা নেড়ে বললেন, তা বলবি বৈকি! বোর দোষ হলো না, দোষ হলো শাউড়ীর! অবাধ্য চোপাবাজ বৌকে কি করবে শুনি? টাটে বসিয়ে ফুল-চন্দন দিয়ে পূজো করবে?

আহা পূজো করা ছাড়া আর কথা নেই যেন! একটু ভাল চোখে চাইতে পারে না! দুটো মিষ্টি কথা বলতে পারে না!

ও মাগো! মোক্ষদা খনখনে গলায় হেসে উঠে বলেন, ভেতরে ভেতরে মেয়ে পাকার ধাড়ি হয়েছেন! দেখবো লো দেখবো, তোর শাউড়ী কি মধুঢালা কথা কইবে! কত সোনার চক্ষে দেখবে!… সে যাক, বলি পান্তাভাতের কথা কি বলছিলি?

এতক্ষণ চুপ ছিলেন, এবারে দীনতারিণী হাসেন।

হেসে ফেলে বলেন, ও আমার কাছে এসেছে পান্তাভাত চাইতে।

পান্তাভাত চাইতে এসেছে! মোক্ষদা সহসা যেন ফেটে পড়েন, আমাদের হেঁসেলে পান্তা চাইছে, আর তুমি সেই শুনে গা পাতলা করে হাসছ নতুন মেজবৌ? আর কত আহ্লাদ দেবে নাতনীকে? পরকাল যে ঝরঝরে হয়ে যাচ্ছে! বলি শ্বশুরবাড়ি গিয়ে যদি বিধবার হেঁসেল থেকে দুটো পান্তা চেয়ে বসে, তারা বলবে কি? একথা ভাববে না যে, আমরা বুঝি গপগপ কয়ে বাসিহাঁড়ির ভাতগুলো গিলি! বলো বলবে কি না?

তাই কখনো কেউ বলে ছোটঠাকুরঝি! দীনতারিণী কথাটা হালকা করতে একটু কষ্টহাসি হেসে বলেন, ছেলে-বুদ্ধি অজ্ঞানে কি না বলে!

ছেলে-বুদ্ধি! ও মা লো! সোয়ামীর ঘর করতে পাঠালে ও এখন ছেলের মা হতে পারে, বুঝলে নতুন মেজবৌ! মোক্ষদা কাঁধ থেকে গামছাখানা নিয়ে জোরে জোরে ঝাড়তে ঝাড়তে বলে, মেয়ের বাক্যি-বুলি শোন না তো কান দিয়ে? সোহাগেই অন্ধ! এই তোকে সাবধান করে দিচ্ছি সত্য, খবরদার পাঁচজনের সামনে এমনি বেফাঁস কথা বলে বসবি না! পাড়াপাড়শী উনুনমুখীরা তো মজা দেখতেই আছে, এমন কথাটা শুনলে ঠিক বলবে আমরা বাসি হাঁড়িতে খাই!

হঠাৎ হি-হি করে হেসে ওঠে সত্যবতী, হেসে বলে, লোকে বললেই বা! বললে কি তোমার গায়ে ফোস্কা পড়বে!

মোক্ষদা নেহাৎ মেয়েটাকে ছুতে পারবেন না, তাই নিজের গালেই একটা চড় মেরে বলেন, শুনলে নতুন মেজবৌ, তোমার নাতনীর আস্‌পদ্দার কথা? বলে কি না লোকে বললেই ব! ডাক শাস্তরের কথা, যাকে বললো ছি, তার রইলো কি? আর বলে কি না—

সেরেছে!

দীনতারিণী ভাবেন মোক্ষদা একবার মুখ ধরলে তো আর রক্ষে নেই! দুৰ্দান্ত স্বাস্থ্য মোক্ষদার, দুরন্ত ক্ষিদে-তেষ্টা, সেই ক্ষিদে-তেষ্টা চেপে রেখে তিন পহর বেলায় জল খায়, বেলা গড়িয়ে অপরাহ্ন বেলায় ভাত, সকালের দিকে শরীরের মধ্যে ওর খা খা বা ঝা করতে থাকে। তাই কথার চোটে থরহরি করে ছাড়ে সবাইকে।

প্ৰসঙ্গটা তাই তাড়াতাড়ি পরিবর্তন করেন দীনতারিণী, হ্যাঁ লা সত্য, সকালবেলা জলপান খাস নি? অসময়ে এখন পান্তাপাতের খোঁজ?

আহা কী বুদ্ধির ছিরি! সত্য ঝেজে ওঠে, আমি যেন খাবো! কেঁচো আর পান্তাভাত দিয়ে টোপ ফেলবো!

কি করবি? দীনতারিণীর আগেই মোক্ষদা দুই চোখ কপালে তোলেন, কি করবি?

টোপ ফেলবো, টোপা! মাছের টোপ! পেয়েছ। শুনতে? নেড় আমায় কঞ্চি চেঁচে খু-ব ভালো একটা ছিপ করে দিয়েছে, খিড়কির পুকুরে মাছ ধরবো।

সত্য! মোক্ষদা যেন ছিটাপিটিয়ে ওঠেন, ছিপ ফেলে মাছ ধরবি তুই? খুব নয় বোপসোহাগী আছিস, তাই বলে কি সাপের পাঁচপা দেখেছিস? মেয়ে ছিপ ফেলে মাছ ধরবি?

সত্য ঝাঁকড়া চুলে মাথা ঝাকিয়ে বলে, আহা! র কী বাক্যির ছিরি! মেয়েমানুষ মাছ ধরে না? রাঙা খুড়িমারা ধরে না? ও বাড়ির পিসিরা ধরে না?

আ মরণ মুখপোড়া মেয়ে! ওরা ছিপ ফেলে মাছ ধরে? ওরা তো গামছা ছাকা দিয়ে চুনোপুটি তোলে!

তাতে কি! সত্য হাতের মানপাতাখানা দাওয়ার গায়ে আছড়াতে বলে, গামছা দিয়ে ধরলে দোষ হয় না, ছিপ দিয়ে ধরলেই দোষ! চুনোপুটি ধরলে দোষ হয় না, বড় মাছ ধরলেই দোষ! তোমাদের এসব শাস্তর কে লিখেছে। গা?

সত্য! দীনতারিণী কড়াস্বরে বলেন, একফোঁটা মেয়ে, অত বাক্যি কেন লা? ঠিক বলেছে ছোটঠাকুরঝি, পরের ঘরে গিয়ে হাড়ির হাল হবে এর পর!

বাবা বাবা! দুটো পান্ত চাইতে এসে কী খোয়ার! যাচ্ছি। আমি আঁশ হেঁসেলের ওদের কাছে। যাবো কি? সেখানে তো আবার বড় জেঠি! গুলি ভাটার মতন চাউনি! খেঁদিদের বাড়ি থেকে নিলেই হত তার চেয়ে!

কি বললি! খেঁদিদের বাড়ি থেকে ভাত? কায়েত-বাড়ির ভাত নিয়ে ঘাঁটবি তুই?

ঘেঁটেছি নাকি? বাবাঃ বাবাঃ! ফি হাত তোমাদের খালি দোষ আর দোষ! আচ্ছা যাচ্ছি। আমি ও হেঁসেলেই। কিন্তু যখন ইয়াবড় মাছ ধরবো। তখন দেখো।

বলে সত্য আছড়ানোর চোটে চিরে চিরে যাওয়া মানপাতাটা হাত থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চলে যায় দাওয়ার কোণ-বরাবর ধরে ও মহলে।

সেখানে বিরাট এক কর্মকাণ্ড চলেছে অহরহ। দিনে দুবেলায় দুশো আড়াইশো পাত পরে।

সেখানেও এমনিই উঁচু পোতার রান্নাঘর, তবে দাওয়ায় উঠতে তেমন বাধা নেই। বেপরোয়া উঠে গেল। সত্য। আর এদিক ওদিক তাকিয়ে দাওয়ার কোণ থেকে একখানা খালি নারকেলের মালা কুড়িয়ে নিয়ে রন্ধনশালার দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে সাহসে ভর করে ডাকলো, বড় জেঠি!

০৪. সারাদিন গুমোটের পর

সারাদিন গুমোটের পর হঠাৎ একচিলতে ঠাণ্ডা হাওয়া উঠল। গা জুড়িয়ে এল, কিন্তু প্ৰাণে জাগছে আতঙ্ক। সময়টা খারাপ, চৈত্রের শেষ। ঈষাণকোণে মেঘ জমেছে, তার কালো ছায়া আধখানা আকাশকে যেন ঘোমটা পরিয়ে দিল। যেন একটা দুরন্ত দৈত্য হঠাৎ পৃথিবীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বার আগের মুহূর্তে পায়তাড়া কষছে।

মাঠের ঘাটে পথে পুকুরের যে যেখানে বাইরে ছিল, তারা ঘন ঘন আকাশের দিকে তাকাতে তাকাতে হাতের কাজ চটপট সারাতে শুরু করল।

আর বাতাসে বাতাসে তরঙ্গ তুলে গ্রামের এ-প্ৰান্ত থেকে ও-প্রান্ত অবধি ছড়িয়ে পড়ল একটানা একটা সানুনাসিক স্বরের ধুয়ো। সে স্বর ধাপে ধাপে চড়ছে, মাঝে মাঝে খাদে নামছে। তার ভাষাটা এই বুধী আঁ-য়! সুন্দরী আঁ-য়! মুংলী আঁ-য়! লক্ষ্মী আঁয়!

ঝড়ের আশঙ্কায় গৃহপালিত অবোলা জীবগুলিকে গোচারণ ভূমি থেকে গোহালে ফেরার আহবান জানানো হচ্ছে।

সত্যবতী জানে না। ঝড়ের আগের মুহূর্তে কিংবা সন্ধ্যার আগে গরুগুলোকে যখন ডাক দেওয়া হয়, তখন নাকি সুরে ডাকা হয় কেন ও জানে এই নিয়ম। অবিশ্যি যারা ডাকে, তারা নিজেরাই বা আট বছরের সত্যবতীর চাইতে ৰোশী কি জানে? তারাও জ্ঞানাবধি দেখে আসছে। গরুকে সাবসন্ধ্যায় ঘরে ফিরিয়ে আনবার সময় আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে যে আহবানটা জানানো হয়, সেটার সুর সানুনাসিক। কে জানে কোন কালে কোন বেরপ্রাপ্ত গরু মানুষের ভাষা শিখে ফেলে, মানুষের কাছে তার পছন্দ-অপছন্দর নমুনাটা জানিয়েছে কিনা। বলেছে কিনা। এই সানুনাসিক স্বরটাই আমার রত চিকর।

আপাতত দেখা যাচ্ছে এই অবোলা জীবগুলি এ-প্ৰান্ত ও-প্রান্ত ধুয়োতে সচকিত হয়ে দ্রুতগতিতে গোহালিমুখী হচ্ছে। তারাও গলা তুলে আকাশটাকে দেখে নিচ্ছে একবার একবার।

সত্যবতী একটা সংবাদ বহন করে দ্রুতগতিতে বাঁড়ুয্যে-পাড়া থেকে বাড়ির দিকে আসছিল, তবু আশেপাশে ধুয়ো শুনে অভ্যাসবশে গলার সুর চড়িয়ে হাঁক পাড়ল, শ্যামলী আঁ-য়! ধবলী আঁ-য়!

আমবাগানের ওদিক দিয়ে রামকালী ফিরছিলেন রায়পাড়া থেকে পায়ে হেঁটে।

পালকিটি ধার দিয়ে আসতে হয়েছে রায়পাড়ায়।

গ্রাম-বৃদ্ধ রায়মহাশয়ের অবস্থা খারাপ, খবর পেতে নাড়ী দেখতে গিয়েছিলেন রামকালী। নাড়ীর অবস্থা দেখে গঙ্গাযাত্রার ব্যবস্থা দিলেন, আর ব্যবস্থা দিয়েই পড়লেন বিপাকে।

রায়মশায়ের ছেলেরা দুজনেই গত হয়েছে, আছে তিন নাতি কিন্তু তাদের এমন সঙ্গতি নেই যে পালকিভাড়া দিয়ে আর চারটে বেহারাকে মজুরি জলপানি দিয়ে ঠাকুরদার গঙ্গাযাত্রা করাবে। অথচ আমন নিষ্ঠাবান সদাচারী প্রাচীন মানুষটা ঘরে পড়ে মরবে? এটাই বা চোখে দেখে সহ্য করা যায় কি করে? আর গেলে ত্ৰিবেণীর গঙ্গাই উত্তম। গঙ্গাযাত্রার ঘোষণা শুনেই রায়মশাইয়ের নাতিরা যেই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল, সঙ্গে সঙ্গেই বলতে হল রামকালীকে, পালকির জন্যে চিন্তা করো না, আমার পালকিতেই যাবেন রায় কাকা।

নাতিরা অস্ফুটে একবার বলল, আপনাকে রোগী দেখতে দূরে দূরে যেতে হয়, পালকিটা দিলে–

রামকালী গম্ভীর হাস্যে বললেন, তবে নয়। ঠাকুরদাকে কাঁধে করেই নিয়ে যাও! তিন নাতি রয়েচ উপর্যুক্ত!

বয়োজ্যেষ্ঠর পরিহাসবাক্যে হেসে ফেলবে এমন বেয়াদপির কথা অবশ্য ভাবাই যায় না, কাজেকাজেই তিনজনে ঘাড় চুলকোতে লাগল। আর ওরই মধ্যে যে বড়, সে সাহসে ভর করে বলল, ভাবছিলাম গো-গাড়ি করে—

ভাবাটা খুব উচিত হয় নি বাপু! রামকালী বলেন, গো-বাড়ি চড়িয়ে নিয়ে গেলে ওই বিরোনব্বই বছরের জীর্ণ খাঁচাখানা কি আর প্রাণপাখি সমেত গঙ্গা পর্যন্ত পৌঁছবে? পাখি খাঁচাছাড়া হয়ে উড়ে যাবে। আমিও ওঁর সন্তানতুল্য বাপু, তোমাদের সঙ্কোচ করবার কিছু নেই। তাছাড়া চটপট ব্যবস্থার দরকার, কখন কি হয় বলা যায় না।

রায়মশাইয়ের ঘোলাটে চোখ দুটো থেকে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। তিনি শিরাবহুল ডানহাতখানা আশীর্বাদের ভঙ্গীতে তুলে বললেন, জয়স্তু।

বাইরে এসে রামকালী পালকিবোহারা কটাকে নির্দেশ দিলেন, পালকিটা আর মিথ্যে বয়ে নিয়ে যাবি কেন, ওটা এখানেই থাক, তোরা বাড়ি গিয়ে খেয়ে-দোয়ে নে গে। শেষ রাতে উঠে চলে আসবি। আর দেখ, বাড়ি থেকে কালকের সারাদিনের মতন জলপান নিয়ে আসবি, বুঝলি? আর শোন, তোরা এখন এখানে কিছু কাজকর্মের প্রয়োজন আছে কিনা দেখ। আমি বাড়ি ফিরছি।

জোর পায়েই ফিরছিলেন রামকালী, কারণ বেরিয়েই দেখেছিলেন ঈষাণ কোণে মেঘ। পালকি চড়ে রুগী দেখতে যান বলে যে রামকালী হাঁটতে অনভ্যস্ত তা নয়। প্রতিদিন ব্ৰাহ্মমুহূর্তে উঠে, প্রাতঃকৃত্য সেরে ক্রোশ-দুই হেঁটে আসা তাঁর নিত্যকর্মের প্রথম কর্ম। তবে হ্যাঁ, রোগীর বাড়ি যাওয়ার কথা আলাদা, সেখানে মান-মর্যাদার প্রশ্ন।

পথ সংক্ষেপের জন্য বাগানের পথ ধরেছিলেন, কিন্তু আমবাগানের কাছবরাবর আসতেই ঝরাপাতা আর ধুলোর ঝড় উঠল। রামকালী তাড়াতাড়ি বাগানের মাঝামাঝি থেকে বেরিয়ে কিনারায় এলেন, আর আসতে না আসতেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। গলা কার?

সত্যর না?

হ্যাঁ, সত্যরই তো মনে হচ্ছে।

যদিও ঝড়ের সোঁ সোঁ শব্দের বিপরীতে শব্দটা হওয়ায় বুঝতে সামান্য সময় লেগেছিল, কিন্তু সে সামান্যই। তা ছাড়া গরু দুটোর নামও পরিচিত। শ্যামলী ধবলী রামকালীর বাড়িরই গরু। গরু অবিশ্যি চাটুয্যেদের একগোহাল আছে, কিন্তু এই গরু দুটি বিশেষ সুলক্ষণযুক্ত বলে রামকালীর বড়ই প্রিয়। সময় পেলেই রামকালী নিজে হাতে ওদের মুখে ঘাস ধরে দেন, গায়ে হাত বুলেন। বাড়ির কুমারী মেয়েরা শ্যামলী ধবলীকে নিয়েই গোকাল ব্ৰত করে, মোক্ষদা তাদের কাছ থেকে সংগৃহীত গোময় দ্বারাই সম্যক বিশুদ্ধতা রক্ষা করে চলেন।

কান খাঁড়া করে ধ্বনির মূল উৎসের দিকটা অনুমান করে নিলেন রামকালী, তারপর দ্রুতপায়ে এগিয়ে গিয়ে ধরে ফেললেন কন্যাকে। সত্যবতী তখন ধুলোর আচোট থেকে চোখ রক্ষা করতে আঁচলের কোণটা দুহাতে মুখের সামনে তুলে ধরে ছুটছিল।

যাচ্ছিস কোথায়?

জলদগম্ভীর স্বরে হাঁক দিলেন রামকালী।

সত্যবতী চমকে মুখের ঢাকা খুলে থ!

যদিও সকলেই সত্যবতীকে বাপ-সোহাগী আখ্যা দেয় এবং সত্যিই সত্যবতী রামকালীর বিশেষ আদরিণী,–তা ছাড়া পয়মন্ত মেয়ে বলে রামকালী মনে মনে বেশ একটু সমীহও করেন। তাকে, তাই বলে সামনাসামনি যে কোন আদর-আদিখ্যেতার পাট আছে তা নয়। কাজেই বাবার গলা শুনেই সত্যবতীর হয়ে গেছে!

রামকালী আর একবার প্রশ্ন করেন, এমন সময়ে একা গিয়েছিলি কোথায়?

সত্যবতী ক্ষীণ কণ্ঠে বলে, সেজপিসীর বাড়ি।

সত্যবতী যাকে সেজপিসী আখ্যা দিল তিনি হচ্ছেন রামকালীর খুড়তুতো বোন, এ গ্রামেই শ্বশুরবাড়ি। এ গ্রামেই বাস।

রামকালী ভুরু কুঁচকে বলেন, অত দূরে আবার একা একা যাবার দরকার কি? সঙ্গে কেউ নেই কেন?

এইজন্যেই সত্যবতীর বাপসোহাগী আখ্যা।

চড় নয়, চাপড় নয়, নিদেন একটা কানমলাও নয়। শুধু একটু কৈফিয়ত তলব।

সত্যবতী এবার সাহস পেয়ে বলে, না একা কেন, পুণ্যপিসি আর নেড়ু ছিল। তারপর আমি তোমাকে ডাকতে ছুটতে ছুটতে আসছি।

আমাকে ডাকতে ছুটতে ছুটতে আসছিস? রামকালী ভুরু কুঁচকে বলেন, কেন? আমায় কি দরকার?

সত্যবতী এবার পূর্ণ সাহসে ভর করে সোৎসাহে বলে, জটাদার বৌ যে মর-মার। নাড়ী ছেড়ে গেছে। তাই সেজপিসী কেঁদে বললে, যা সত্য, একবার মেজদাকে ডেকে নিয়ে আয়, যেখানে পাস। তা আমি রায়পাড়া গিয়ে শুনলাম তুমি এই মাত্তর চলে এসেছ!

আবার রায়পাড়াও গিছিলি! নাঃ, বিপদ করলে দেখছি। জটার বৌয়ের আবার হঠাৎ কি হল যে নাড়ী ছেড়ে যাচ্ছে?

যাচ্ছে কি বাবা, সত্য আরও উৎসাহ সহকারে বলে, গেছে। সেজপিসী চোঁচাচ্ছে, বুক চাপড়াচ্ছে আর বালিশ বিছানা সরিয়ে নিচ্ছে।

আঃ কি যে বলে! চল দেখি গে। রামকালী বলেন, ঝড় উঠে পড়ল, এখুনি বিষ্টি আসবে, কি মুশকিল! হয়েছিল কি?

কিছু নয়। সেজপিসী বললে, রান্নাবান্না সেরে যেই খেতে বসেছে জটাদার বৌ, আর আমনি ওটাদা পান চেয়েছে! জটাদার বৌ বলেছে, পান ফুরিয়ে গেছে, ব্যস বাবু মহারাজের রাগ হয়ে গেছে। দিয়েছেন ঠাঁই ঠাঁই করে পিঠের ওপর লাথি। আর অমনি জটা-বৌঠান কাসিতে মুখ থুবড়ে। হঠাৎ খুক খুক করে হেসে ওঠে সত্যবতী।

হাসছিস যে!

ধমকে উঠলেন রামকালী। বিরক্ত হলেন। কী অসভ্য হচ্ছে মেয়েটা! হাসির কি সময় অসময় নেই? বললেন, মানুষ মরছে দেখে হাসতে হয়? এই শিক্ষাদীক্ষা হচ্ছে?

সত্যবতী নিতান্তই হেসে ফেলেছিল, এখন বাপের ধমকে সামলে নিয়ে মুখটা স্নান করবার চেষ্টা করে বলে, সেজপিসী বলছিল যেই না ধাক্কা খাওয়া আমনি কুমড়ো গড়াগড়ি হয়ে দাওয়া থেকে উঠোনে পড়ে গেল! কষ্টে হাসি চেপে ফের বলে সত্যবতী, জটাদার বৌ অনেক ভাত খায় না বাবা! তাই অত মোটা!

আঃ! বলে বিরক্তি প্ৰকাশ করে তাড়াতাড়ি এগোতে থাকেন। রামকালী।

সত্যবতীও হাঁটায় কিছ কম দাঁড় নয়। বাপের সঙ্গে সমানই এগোতে থাকে।

রামকালী জটার বৌয়ের জন্য সহানুভূতিতে যতটা না হোক, জটার ব্যবহারে মনে মনে অত্যন্ত বিরক্তি বোধ করেন। হতভাগা বামুনের ঘরের গরু, পেটে ক অক্ষরের আঁচড় নেই, গাজা-গুলি সবেতেই ওস্তাদ। আবার বংশছাড়া বিদ্যে হয়েছে, বৌ-ঠেঙানো! জটা, ফাটর বাপ তো আমন ছিল না! বরং রামকালীর গুণবতী বোনই লোকটাকে সারাজীবন জুলিয়ে পুড়িয়ে খেয়েছেন!

কে জানে কী কী ভাবে বেটক্করে লেগেছে, সত্যিই যদি মরে-টারে যায়, দস্তুরমত ফ্যাসাদে পড়তে হবে।

সত্যবতীর কথা ভুলে গিয়ে আরও জোরে পা চালান রামকালী। সত্যবতী এবার দৌড়তে শুরু করে। হেরে যাবে না। সে।

চোখ কপালে উঠে স্থির হয়ে গেছে, মুখে ফেনা ভেঙ্গে সে ফেনা শুকিয়ে উঠেছে। হাত পা ঠাণ্ডা পাথর।

সন্দেহ আর নেই, সমস্ত লক্ষণই স্পষ্ট। তুলসীতলায় শুইয়ে দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যেই। অবশ্য কষ্ট করে আর ঘর থেকে বয়ে আনতে হয় নি, লাথি খেয়ে গড়িয়ে তো উঠোনেই পড়েছিল তুলসীতলার কাছবরাবর। দণ্ডখানেকের মধ্যেই বেতারবার্তায় সারা পাড়ায় সংবাদ রটে গেছে এবং পাড়া ঝেটিয়ে মহিলাবৃন্দ এসে জড়ো হয়েছেন, আসন্ন ঝড়ের আশঙ্কা তুচ্ছ করে।

ব্যাপারটা তো কম রংদার নয়, দৈনন্দিন বৈচিত্ৰ্যশূন্য জীবননাট্যের মধ্যে এমন একটা জোরালো দৃশ্য দর্শনের সৌভাগ্য জীবনে কবার আসে?

প্ৰথমে সমস্ত জনতার মধ্যে উঠল একটা চাপা উত্তেজনার আলোড়ন, জটা নাকি বৌটাকে একেবারে শেষ করে ফেলেছে! তারপর হায় হায়। জটা সম্পর্কে মন্তব্যগুলিও এখন আর জটার মার কান বাঁচিয়ে হচ্ছে না। কারণ স্পষ্ট কথা বলে নেবার মত এ-হেন সুযোগই বা কার জীবনে কবার আসে?

সত্যি শেষ হয়ে গেছে? ছিছিছি, কী খুনে দস্যি ছেলে গো! ধন্যি সন্তান পেটে ধরেছিল ম্যাগী! আচ্ছা জটাটাই বা এত গোয়ার হল কোথা থেকে? ওদের বাপ তো ভালমানুষ ছিল! হল কোত্থেকে? তুমি আর জ্বলিও না ঠাকুরঝি, বলি গৰ্ভধারিণীটি কেমন? এ হচ্ছে খোলের গুণ!. আহা হাবাগোবা নিপাট ভাল মানুষ বেঁটা, মা-বাপের বাছা, বেঘোরে প্রাণটা গেল! এমনি নানাবিধ আলোচনা চলতে থাকে। একটা মেয়েমানুষের জন্যে, এর চাইতে আর কত বেশী দরদ আশা করা যায়?

প্রতিবেশিনীদের আক্ষেপোক্তিগুলো নীরবে হজম করতে বাধ্য হচ্ছিলেন জটার মা, কারণ আজ তিনি বড় বেকায়দায় পড়ে গেছেন। তাই সমস্ত মন্তব্য চাপা পড়ে যায় এমন সুরে মড়াকান্নাটা জুড়ে দেন তিনি, বুক চাপড়ে চাপড়ে মৰ্মভেদী হৃদয়বিদারক ভাষায় ইনিয়ে বিনিয়ে।

বাড়ির কাছাকাছি আসতে না আসতেই শুনতেই পেলেন রামকালী খুড়তুতো ছোটবোনের সেই পাজারভাঙা শোকগাথা, ওরে আমার ঘরের লক্ষ্মী ঘর ছেড়ে আজ কোথায় গেল রে! ওরে সোনার পিতিমেকে বিসর্জন দিয়ে আমি কোন প্ৰাণে ফের সংসার করব রে! ওরে জটা, তোর যে নগরে না। উঠতেই বাজারে আগুন লাগল রে!

সত্যবতী বলে উঠল, যাঃ, সৰ্বনাশ হয়ে গেল!

দ্রুত পদক্ষেপটা হঠাৎ স্তিমিত হল, ভুরুটা একবার কুঁচকোলেন রামকালী। যাক তা হলে হয়েই গেছে! তবে আর তিনি গিয়ে কি করবেন? এখন জটা হতভাগার কপালে কত দুৰ্গতি আছে, কে জানে!

হঠাৎ ভয়ানক রকমের একটা চিৎকার উঠল, বোধ করি ফিনিশিং টাচ্‌। ওরে বাবা রে, আমার কী সর্বনাশ হল রে! কী রাঙের রাঙা বৌ এনেছিলাম রে!

রামকালী পায়ে পায়ে এগোতে এগোতে সহসা দরজার কাছাকাছি এসেই ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, যাক, সত্যিই শেষ হয়ে গেছে তা হলে! সত্য তুই বাড়ি যা।

সত্যবতী কাঠ!

বাড়ি! একলা?

কেন একলা কেন, নেড়ু আর পুণ্য এসেছিল বললি না?

সত্যবতী ভয়ে ভয়ে বলে, এসেছিল তো, আর কি এখন যাবে তারা?

যাবে না? যাবে না। মানে? ওদের ঘাড় যাবে! দেখ কোথায় আছে। আমাকে তো আবার এদের এদিক দেখতে হবে।

কৈফিয়ত দিয়ে কথা রামকালী কদাচ কাউকে বলেন না, কিন্তু সত্যর কাছে সামান্য একটু সহজ রামকালী।

সত্যবতী গুটি গুটি এগিয়ে একবার পিসীর উঠোনের ভিতর গিয়ে দাঁড়ায়, এদিক ওদিক তাকিয়ে নেড় পুণ্য কারও দেখা না পেয়ে ফিরে এসে ম্লান মুখে বললে, ওদের কাউকে দেখতে পাচ্ছি না!

কেন, গেল কোথায় সব?

কি জানি! সত্য আস্তে আস্তে সাহসে ভর করে প্রাণের কথাটা বলে ফেলে, বাবা, তুমি তো মারা বাঁচাতে পার!

মরা বাঁচাতে? দূর পাগলী!

সত্য মিয়মাণ ভাবে বলে, তবে যে লোকে বলে!

লোকে বলে? কি বলে? অন্যমনস্ক ভাবে মেয়ের কথার জবাব দিয়ে রামকালী এদিক ওদিক তাকাতে থাকেন, যদি একটা বেটা ছেলের মুখ চোখে পড়ে। এসে যখন পড়েছেন তিনি, দায়িত্ব এড়িয়ে চলে যেতে তো পারেন না। জটাদের তেমন বাঁশঝাড় না থাক, রামকালীর বাগান থেকেই বাঁশ কেটে আনতে হুকুম দেবেন। কিন্তু কই? কে কোথায়? বাড়ির ভিতর থেকে সুর উঠছে নানা রকম, বাইরেটা শূন্য স্তব্ধ!

ভালর মধ্যে আকাশটায় হঠাৎ মেঘ উড়ে গিয়ে দিব্যি পরিষ্কার হয়ে উঠেছে, আর বোঝা যাচ্ছে সন্ধ্যার এখনো দেরি আছে।

হঠাৎ সত্যবতী একটা অসমসাহসিক কাণ্ড করে বসে, বাপের একখানা হাত দু হাতে চেপে ধরে রুদ্ধকণ্ঠে বলে ওঠে, বলে যে কবরেজ মশাই মরা বাঁচাতে পারেন! দাও না বাবা একটুখানি ওষুধ জটাদার বৌকে!

রামকালী এই অবোধ বিশ্বাসের সামনে থতমত খেয়ে সহসা কেমন অসহায় অনুভব করেন। তাই ধমকে ওঠার পরিবর্তে মাথা নেড়ে বলেন, ভুল বলে মা! কিছুই পারি নে! মিথ্যে অহঙ্কারে কতকগুলো শেকড়-বাকড় নিয়ে নাড়ি আর লোক ঠকাই!

সত্যবতী এ কথার সুর ধরতে পারল না, পারার কথাও নয়, বুঝল এ হচ্ছে বাবার রাগের কথা। কিন্তু আপাতত সে মরীয়া। যা থাকে কপালে, বাবার হাতে যদি ঠেঙানি খাওয়া থাকে তাই খাবে সত্য, কিন্তু সত্যবতীর চেষ্টায় জটাদার বেঁটা যদি বাঁচে! তাই চোখ-কান বুজে সে বাবার গায়ের চাদরের খুঁটটা টেনে বলে ফেলে, তোমার পায়ে পড়ি বাবা, জন্মের শোধ একটু ওষুধ দাও না। আহা, বিনি চিকিচ্ছেয় মারা যাবে জটাদার বৌ!

মরার পর যে আর চিকিচ্ছে চলে না, এ কথা আর মেয়ের কাছে ব্যাখ্যা করতে পারলেন না রামকালী। শুধু একটা নিঃশ্বাস ফেলে ফের ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, চল দেখি।

জমজমাট নাটকের মধ্যখানে যেন হঠাৎ আসরের চাঁদোয়া ছিঁড়ে পড়ল। কবরেজ মশাইয়ের গলা-খাঁকারি না?

হ্যাঁ, তাই বটে। বিশালকার সুকান্তি পুরুষ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। সঙ্গে সঙ্গে সত্যর শানানো গলা বেজে উঠেছে, বাবা বলছেন, ভিড় ছাড়তে হবে!

পাড়ার মহিলারা মাথায় কাপড় টেনে চুপ করে গেলেন। শুধু জটা-জননী ড়ুকরে উঠলেন, ও মেজদা গো, আমার জটা আজ লক্ষ্মীছাড়া হল গো!

থাম। যেন একটা বাঘ হুঙ্কার দিল, তোর জটা আবার লক্ষ্মীছাড়া না ছিল কবে? একেবারে শেষ করে ফেলেছে তো?

ভির সরে গেছে, কবরেজ মশাই ভাগ্নে-বৌয়ের কাছে গিয়েও যতটা সম্ভব ছোঁয়া বাঁচিয়ে হেঁট হয়ে দু আঙুলে নাড়িটা টিপে ধরেন, আর মুহূর্তকাল পরেই চমকে ওঠেন।

যাক, সব রং-তামাশা ফক্কিকার!

শুধু নাটকের একটা দৃশ্যই জখম নয়, আগাগোড়া নাটকটাই খতম! বেহব্বারম্ভে লঘূক্রিয়ার এহেন উদাহরণ আর কখনও কেউ দেখেছে না। শুনেছে? জটার বৌয়ের এই আচরণটা যেন ধাষ্টামোর চরম, ক্ষমার অযোগ্য! ছি:। ছি, মেয়েমানুষের প্রাণ বলে কি এমনই কাঠ-পরমায়ূ হতে হয় গো? তবে এ মেয়েমানুষের কপালে যে অশেষ দুঃখ তোলা আছে, তাতে আর কারও মতভেদ থাকে না। মরে গিয়ে তুলসীতলায় শুয়ে আবার চারদণ্ড পরে ঘরে উঠে শোয়, ঢাক ঢকা করে একবাটি গরম দুধ গেলে, এমন মেয়েমানুষের খবর এর আগে এরা অন্তত কেউ পান নি!

ছি ছি, কী ঘেন্না! পুরুষের প্রাণ হলে আর এই স্বর্ণসিঁদুরটুকু জিভে ঠেকিয়েই চোখ খুলতে হত না!  কিন্তু যাই বল, জটার বৌ। খুব খেল দেখালো বটে! … এইবার শাশুড়ী মাগীর হাতে যা খোয়ার হবে টের পাচ্ছি, মাগীর যা অপমান্যি হয়েছে আজ! … কিন্তু যাই বলো, তুলসীতলা থেকে অমন হুট্‌ করে ঘরে তোলাটা ঠিক হয় নি, একটা অঙ্গ-প্ৰচিত্তির-টাচিত্তির করা কোর্তব্য ছিল।

কে জানে বাবা, সত্যি বেঁচে ছিল না কোন অবদেবতায় ভর করল! আমার তো কেমন সন্দ হচ্ছে! থাম সেজবৌ, সাঁজসন্ধ্যোয় একা ঘাটে-পথে যাই, ভাবলে গা ছম্‌ ছম্‌ করবে। কিন্তু ছাউনিটা একটু কেমন কেমনই লাগিল! না না, ওসব কিছু না, কবরেজ মশাই তো বললেনই, আচমকা ধাক্কা খেয়ে ভির্মি গেছল!

নে বাবা চল চল, ছিষ্টি সংসারের কাজ পড়ে, নাহক পাঁচ দণ্ড সময় বৃথা নষ্ট হল। জটার মান আদিখ্যেতাটা দেখলি? যেন বৌ মরে বুক একেবারে ফেটে যাচ্ছিল! … দেখেছি। দেখতে আর বাকী কিছুই নেই। বুক যদি ফেটেছে, বৌ জীইয়ে ওঠায়! বড় আশায় ছাই পড়ল। ভাবছিল তো বেট তার ভাগ্যিমান হল। আবার এখুনি তার বে দিয়ে, দানসামগ্ৰী গয়নাপত্তর ঘরে তুলবে!

বাক্যের স্রোত আর থামে না।

ঘাটে পথে, আপনি বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে বাক্যের বৃন্দাবন বসে যায়। এত বড় একটা ঘটনাকে এ॥৩ সহজে জুড়িয়ে ফেলতে ইচ্ছে কারুরই ইচ্ছে না; জটার মাকে পেড়ে ফেলবার এত বড় সুবর্ণ সুযোগটাও মাঠে মারা গেল। জটার বৌয়ের উপর কিছুতেই আর প্রসন্ন হতে পারছেন না কেউ, ধৌটা যেন সবাইকে বড় রকমের একটা ঠকিয়েছে। জ্ঞাতি খুড়শাশুড়ী খবর পেয়েই আঁচলের তলায় লুকিয়ে আলতাপাতা আর সিঁদুরগোলা এনেছিলেন, যাতে প্রথম সিঁদুর দেওয়ার বাহাদুরিটা তারই হয়। সেগুলো এখন ঘাটে ভাসিয়ে এলেন। যতই হোক, মড়ার জন্যে আনা তো! তা রাগটা তারই বেশী হচ্ছে জটার বউয়ের ওপর!

না, নাম কেউ জানে না, জানিবার চেষ্টাও করে না—জটার বৌ এই তার একমাত্র পরিচয়, এরপর শেষ পরিচয় হবে অমুকের মা। তবে আর নামে দরকার কী? নামে দরকার নেই, কিন্তু তার কথায় সকলেরই দরকার আছে। সেই দরকারী কথাগুলোর মধ্যে হঠাৎ জ্ঞাতি খুড়শাশুড়ী বলে উঠলেন, আমাদের বাপের বাড়ির দেশ হলেও বৌকে আর ঘরে উঠতে হত না, ওই গোয়ালে কি টেকশেলে জীবন কাটাতে হত!

দুএকজন মুখ-চাওয়াচাওয়ি করলেন, জীবন নিয়ে বিচারটা কেন?

খুড়শাশুড়ী ফের রায় দেন, একে তো তুলসীতলায় বার করা, তাপর আবার কত বড় অনাচার ভাবো, মামাশ্বশুরের ছোঁয়াচ খাওয়া! কবরেজ মশাই যখন নির্ভরসায় নাড়ী টিপে ধরলেন, তখনই তো আমি হ্যাঁ। অবিশ্যি উনি ভেবেছিলেন মরেই গেছে। আর মারে গেলে সৎকারের আগে দেহশুদ্ধি তো একটা করতেই হত। কিন্তু এ যে একেবারে জলজ্যান্ত জীইয়ে উঠল! প্ৰচিত্তির না করলে কি করে চলবে?

বহু গবেষণান্তে স্থির হল, মামাশ্বশুর-স্পর্শের পাতকস্বরূপ একটা প্ৰায়শ্চিত্ত জটার বৌকে করতেই হবে, তা ছাড়া মরে বাঁচার পাতকে আর একটা। নইলে জটার মাকে পতিত থাকতে হবে।

বেচারা অপরাধিনী তো অচৈতন্য। জটার মাও জটাকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন, কাজেই একতরফা ডিক্রী হয়ে যায়।

কিন্তু সত্যবতী এসবের কিছুই জানে না। ও এক অদ্ভুত গৌরবের আনন্দে ছলছল করতে করতে বাবার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি ফেরে।

উঃ, রাগ করে বাবা কি উল্টো কথা বলছিলেন! বলছিলেন। কিনা চিকিচ্ছে-টিকিচ্ছে কিছু জানি না। —সাধে কি আর সত্য অত দুঃসাহস করে বাবাকে হাতে ধরে বলেছিল একটু ওষুধ দিতে, তাই না বেচারী বেঁটা বাঁচল! আহা সত্য যখন শ্বশুরবাড়ি যাবে, তখন যদি সত্যর বর (মুখে অলক্ষ্যে একটু হাসি ফুটে ওঠে) আমনি মেরে সত্যকে মেরে ফেলে বেশ হয়। বাবা খবর পেয়ে গিয়ে একটিমাত্রা স্বর্ণসিঁদুর মধু দিয়ে মেড়ে খাইয়ে দেবেন, আর একটু পরেই সত্য চোখ খুলে সবাইকে দেখে তাড়াতাড়ি মাথায় ঘোমটা টেনে ফেলবে।

উঃ, কী মজাই হবে তা হলো!

দেশসুদ্ধ লোকের তাক লেগে যাবে সত্যর বাবা রামকালী কবরেজের গুণের মহিমায়। বাপ রে বাপ, সোজা বাবা তার! গায়ের আর কোন মেয়েটার এমন বাপ আছে?

হাসির কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ সশব্দে হেসে ফেলা সত্যর বরাবরের রোগ।

রামকালী চমকে প্রশ্ন করলেন, কী হল? হাসলি যে?

সত্য কষ্টে সামলে নিয়ে ঢোক গিলে বলল, এমনি।

তোর ওই এমনি হাসিটা একটু কমা দিকি, প্ৰায় সহাস্যেই বলেন রামকালী, নইলে এর পর শ্বশুরবাড়ি গিয়ে ওই জটার বৌয়ের দশা হবে তোর!

মনটা বড় প্রসন্ন রয়েছে, এই সামনে রাত, না-হক্‌ কতগুলো ঝঞ্ঝাট-ঝামেলায় পড়তে হত, জটার বৌ তার হাত থেকে বাঁচিয়েছে। বাপের মনের প্রসন্নতার কারণটা অনুমান করতে না পারলেও প্ৰসন্নতাটুকু অনুধাবন করতে পারে সত্যবতী এবং তারই সাহসে প্রায় উচ্ছ্বসিত ভাবে বলে, ওই জন্যেই হাসলাম! আমি মরে গেলে তুমি বেশ গিয়ে বাঁচিয়ে দেবে!

হুঁ, বটে! বলেন স্বল্পভাষী রামকালী।

রামকালী নিঃশব্দে হন।হন করে খানিকটা অগ্রসর হয়ে যান এবং সত্যবতী বাপের সঙ্গে তাল রাখতে প্ৰায় ছুটতে থাকে।

হঠাৎ একসময় থেমে রামকালী বলেন, মরে গেলে স্বয়ং ভগবান এসেও কিছু করতে পারেন না, বুঝলি? জটার বৌ মরে নি।

মরে নি! সত্য একটু আনমনা হয়ে যায়, মরাটা তা হলে আর কোন রকম? হঠাৎ চিন্তার গতি বদলায়, সত্য সোৎসুকে বলে, কিন্তু বাবা, তুমি গিয়ে নাড়ি দেখে স্বর্ণসিঁদুর না কি না খাওয়ালে ওই রকম মর্যা-মরা হয়েই তো থাকত জটাদার বৌ! আর সবাই মিলে বাশ বেঁধে নিয়ে গিয়ে পাকুড়তলার শশানে পুড়িয়ে দিয়ে আসত!

রামকালী একটু চমকালেন।

আশ্চর্য! এতটুকু মেয়ে, এত তলিয়ে ভাবে কি করে? আহা মেয়েমানুষ তাই সবই বৃথা। এ মগজটা যদি নেড়ুটার হত! তা হল না–আট বছরের হাতী এখনও অ আ ইতে দাগা বুলোচ্ছে। নেড়ু রামকালীর দাদা কুঞ্জর শেষ কুড়োত্তি। তেরোটা ছেলেমেয়ে মানুষ করার পর চৌদ্দটার বেলায় রাশ একেবারে শিথিল হয়ে গেছে কুঞ্জ আর তার পরিবারের। ছেলেটা বামুনের গরু হবে। আর কি!

কিন্তু মেয়ে-সন্তানের বোধ করি এত বেশী তলিয়ে ভাবতে শেখাও ভাল নয়, তাই রামকালী ঈষৎ ধমকের সুরে বলেন, থাম থাম, মেলা বকিস নি, পা চালিয়ে চল! গহীন অন্ধকার হয়ে গেছে দেখছিস!

অন্ধকার? হুঁ! সত্যবতী স-তাচ্ছিল্যে বলে, অন্ধকারকে আমি ভয় করি নাকি? এর চাইতে আরও অনেক অনেক অন্ধকারে বাগানে গিয়ে পেচার চোখ গুনি না!

অন্ধকারে কী করিস? চমকে ওঠেন। রামকালী।

সত্য থমমত খেয়ে বলে, ইয়ে আমি একলা নয়, নেড়ু আর পুণ্যপিসীও থাকে। পেঁচার চোখ শুনি।

হঠাৎ রামকালী হা-হা করে হেসে ওঠেন।

অনেকক্ষণ ধরে দরাজ গলায়। এই মেয়েকে আবার ধমকবেন কি, শাসন করবেন কি!

নির্জন পথে অন্ধকারের গায়ে সেই গম্ভীর গলায় দরাজ হাসি যেন স্তরে স্তরে ধ্বনিত হতে থাকে।

বাঁড়ুয্যেদের চণ্ডীপণ্ডপ থেকে উৎকীর্ণ হয়ে ওঠেন দু-একটি গ্রাম্য প্রৌঢ়।

গুনি।

একলা কি আর! নিশ্চয় ধিঙ্গী মেয়েটা সঙ্গে আছে। নইলে আর–

ওই এক মেয়ে তৈরি করছেন রামকালী। ও মেয়ে নিয়ে কপালে দুঃখু আছে।

আর দুঃখু! টাকার ছালা ঘরে, ওর আবার দুঃখু! শুনছি। নাকি বর্ধমানের রাজার কাছ থেকে লোক এসেছিল কাল, রাজার সভা-কবরেজ হবার জন্যে সাধতো!

তই নাকি? কই শুনি নি তো? তা হলে গায়ের মায়া কাটাল এবার চাটুয্যে!

না না, শুনছি। যাবে না।

বটে! তবু ভাল। তোমায় বললে কে?

কুঞ্জর বড় ছেলেটা বলছিল।

হুঁ ভালই, এ বয়সে আবার বিদেশে গিয়ে রাজদরবারে চাকরি! তবে রামকালীর মতিগতি বড় বড় অত বড় বিসি মেয়েকে এতটা বাড় বাড়তে দেওয়া উচিত হয় না, পাড়ার ছেলেগুলো ওর খেলুড়ি!

হ্যাঁ, গাছে চড়তে, সাতার কাটতে, মাছ ধরতে বেটা ছেলের দশগুণ ওপরে যায়।

এটা একটা গৌরবের কথা নয় খুড়ো। যতই হোক মেয়েছেলে, তায় আবার একটা মান্যিমান ঘরের বৌ হয়েছে। তারা টের পেলে ও বেঁকে ঘরে নিতে বেঁকে বসবে না!

একটা কলঙ্ক রটিয়ে দিতেই বা কতক্ষণ?

বদ্যি চাটুয্যের ও তার ধিঙ্গি মেয়ের আলোচনায় চণ্ডীমণ্ডপ ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। যাকে সামনে সমীহ করতে বাধ্য হতে হয়, তাকে আড়ালে নিন্দে করতে না পেলে বাঁচবে কেমন করে মানুষ!

এইসব সমালোচনার প্রধানা পাত্রী তখন বাবার পিছন পিছন ছুটছে আর মনে মনে আকুল প্রার্থনা করছে, হেই ভগবান, আমার পা-টা বাবার মতন লম্বা করে দাও নাগো, তা হলে বাবার মতন হাঁটি, হেরে যাই না!

হেরে যেতে একান্ত আপত্তি সত্যবতীর।

কোন ক্ষেত্রে কোথাও হার মানবে না। এই পণ।

এই পুণ্যি, ছড়া বাঁধতে পারিস?

চিলেকোঠার ছাদের ওপর সত্যবতীর খেলাঘর। প্রধান খেলুড়ি রামকালীর জ্ঞাতি খুড়োর মেয়ে পুণ্যবতী। সত্য তাকে পাঁচজনের সামনে সভ্যতা করে পুণ্যিপিসী বললেও, নিজের এলাকায় পুণ্যিই বলে।

বাবুই পাখীর বাসা আনতে পারিস? অথবা কাচপোকা ধরতে পারিস? কিংবা সঁতরে তিনবার বড় দীঘি পারাপার হতে পারিস? এ ধরনের পরীক্ষামূলক প্রশ্ন প্রায়ই করে সত্য, কিন্তু ছড়া বাধতে পারিস কিনা, এহেন প্রশ্ন একেবারে আনকোরা নতুন!

পুণ্য বিমূঢ়ভাবে বলে, ছড়া! কিসের ছড়া?

জটাদার নামে ছড়া, বুঝলি? ছড়া বেঁধে গা-সুদ্ধ সব ছেলেমেয়েকে শিখিয়ে দেবী, জটাদাকে দেখলেই তারা হাততালি দিয়ে ছড়া কাটবে।

হি হি হি!

জটাধরের দুর্দশার চিত্র কল্পনা করে দুজন দুলে দুলে হাসতে থাকে।

অতঃপর পুণ্যবতী একটা পাল্টা প্রশ্ন করে, খুব তো বললি, বলি মেয়েমানুষকে আবার ছড়া বাধতে আছে নাকি?

বাঁধতে নেই? সহসা অগ্নিমূর্তি ধরে সত্য, কে বলেছে তোকে নেই? মেয়েমানুষ! মেয়েমানুষ! মেয়েমানুষ যেন মায়ের পেটে জনায় না, বানের জলে ভেসে আসে! অত যদি মেয়েমানুষ-মেয়েমানুষ করবি তো আমার সঙ্গে খেলতে আসিস নে।

পুণ্যি মুচকি হেসে বলে, আহা, মশাই রে! আর তোর বর যখন বলবে?

কি বলবো?

ওই মেয়েমানুষ!

ইস, বলবে বৈকি! দেখিয়ে দেব না! আমি ওই জটাধার বৌয়ের মত হব ভেবেছিস? কক্ষনো না। দেখ না, ছড়া বেঁধে জটাদাকে কী উৎপাত করি!

পুণ্যি ঈষৎ সমীহভাবে বলে, কিন্তু কি করে বাঁধবি?

কি করে আবার কথক ঠাকুর। যেমন আখর দেন তেমনি করে। একটুখানি তো বেঁধেছি, শুনিবি?

বেঁধেছিস! অ্যাঁ! বল না ভাই, বল না।

সত্য আত্মস্থভাবে চেখে চেখে তেঁতুল খাওয়ার ভঙ্গীতে বলে—

জটাদাদা, পা গোদা
যেন ভোঁদা হাতী,
বৌ-ঠেঙানো দাদার পিঠে
ব্যাঙে মারুক লাথি।

ওরে সত্য? পুণ্যি সহসা ড়ুকরে ওঠে সত্যকে জড়িয়ে ধরে, তুই কী রে! এরপর তো তুই পয়ার বাধতে শিখবি রে?

সেটাও যেন সত্যর কাছে কিছু নয় এমন ভাবে বলে, সে যখন শিখব, তখন শিখব, এখন এটা যে-যেখানে আছে সবাইকে শিখোতে হবে, বুঝলি? আর জটাদাকে দেখলেই—হি হি হি হি!

 ০৫. রোদে পিঠটা চিনচিন করছে

রোদে পিঠটা চিনচিন করছে অনেকক্ষণ থেকে, হঠাৎ যেন হু-হু করে জ্বলে উঠল। ওঃ, বকুলগাছের ছায়াটা দাওয়া থেকে সরে গেছে! বেলা তা হলে কম হয় নি! বিপদে পড়লেন মোক্ষদা, দু হাত জোড়া, অথচ পিঠের কাপড়টা সরে গিয়ে সরাসরি রোদটা পিঠের চামড়ায় লাগছে। নিজে দেখতে পাচ্ছেন না মোক্ষদা, আর কেউ কাছে থাকলে দেখতে পেত মোক্ষদার হত্তেল-রঙা পিঠটার কতকাংশ ফোস্কাপড়ার মত লাল হয়ে উঠেছে।

নাঃ, তসর থানখানা না পরে ভিজে থানখানা পরে আমতেল মাখতে বসলেই হত। ভিজে কাপড়ে যেন দেহের দাহ অনেকটা নিবারণ হয়। কানাউঁচু ভারী ভারী পাথরের খোরা দুখানা খানিকটা টেনে নিয়ে গিয়ে সরে দাওয়ার খুঁটির ছায়াটুকুতে পৃষ্ঠরক্ষা করতে গেলেন মোক্ষদা।

সমুদ্রে তৃণখণ্ড। তাছাড়া রোদ এখন দৌড়চ্ছে, এখুনি খুটির ছায়া সরবে।

হঠাৎ মোক্ষদা একটা সত্য আবিষ্কার করে বসলেন। সারা বছরটাই রোদে পুড়ে পুড়ে মরেন তিনি। এই তো কচি আমের আমতেল, এর পরই বাখড়া বাধা আমের গুড়-আম, মসলা-আম, তার পরেই পড়ে যাবে আমসত্ত্বর মরসুম। আর সে মরসুমকে সামলে তোলা তো সোজা নয়। আমসত্ত্বর পালা চুকতে চুকতেই অবশ্য বর্ষা নামে, সেই দু-তিনটে মাসই শুধু রোদে পোড়ার ছুটি, বর্ষা শেষ হতেই দুর্গোৎসবের সুর ওঠে। দুর্গোৎসবের আগে সারা ভাড়ারটাতেই তো ঝাড়া বাছা রোদে দেওয়ার ধুম চলে, তারপর পড়ে তিলের নাড়ুর ধূম।

বদ্যি চাটুয্যের বাড়ির দুর্গোৎসবের তিলের নাড়ু একটা বিখ্যাত ব্যাপার, হাতে বাগিয়ে ধরে কামড় দিতে পারা যায় না। এত বড় নাড়ু! পক্কান্ন আনন্দ নাড়ু মুড়কির মোয়া সবই কবরেজ-বাড়ির বিখ্যাত, কিন্তু সে সব তো তবু পাঁচহাতের ব্যাপার, নিতান্ত প্ৰতিমার ভোগের উপর্যুক্ত সেরকতক জিনিস গঙ্গাজলে ভোগের ঘরে তৈরী হলেও বিরাট অংশটায় অনেকে হাত লাগায়। কিন্তু তিলের নাড়ুটি সম্পূর্ণ মোক্ষদার ডিপার্টমেন্ট। কারণ তিলের নাড়ুর অমন হাত নাকি —শুধু এ গ্রামে কেন—এ তল্লাটে নেই। তা সেই নাম কি আর আমনি হয়েছে, আগাগোড়া নিজের হাতে রাখেন বলেই না এদিক ওদিক হতে পায় না! বস্তা বস্তা তিল তো এসে হাজির হল, তার পর? সেই তিল ঝাড়া-বাছা, নিখুঁত করে ধুয়ে নিপাট করে রোদে শুকিয়ে ঝুনো করা, ঢেকিতে কোটা, প্ৰকাণ্ড পেতলের সরা চড়িয়ে গুড় জ্বাল দিয়ে দিয়ে নিটুট নিশ্চিছদির ধামায় সেই তিলচুর মেখে মেখে তাড়াতাড়ি গরম থাকতে থাকতে নাড়ু পাকিয়ে ফেলা, এর কোনটা নিজের হাতে না করলে চলে? একবার বুঝি তিলটা কুটেছিল। সেজবৌতে আর বড়বৌমাতে, সেবার তো নাড়ু দিয়ে মজল। আগাগোড়া খোসায় ভর্তি। রঙও হল তেমনি কেলে-কিষ্টি। রামকালী নাড়ু দেখে হেসেছিলেন, প্রশ্ন করেছিলেন, এ নাড়ু কার তৈরী?

সেই থেকে সাবধান হয়ে গেছেন মোক্ষদা। টেকির গড়ের কাছে কাউকে একটু বসানো ছাড়া আর সব একা করেন।

দুর্গাপূজোর রোদে পোড়া তো শুধুই তিলের নাড়ু নয়, বাড়ি বাড়ি নেমন্তন্নর কথা বলতে যাওয়া, গুরুপুরুতের বাড়ি সিধে দিতে যাওয়া সে সবও তো মোক্ষদার ডিউটির মধ্যেই। কারণ তিনি ঝিউড়ি মেয়ে। কাশীশ্বরীও কতকটা করেছেন আগে আগে, কিন্তু ইদানীং তিনি রোগে কেমন জবুথবু হয়ে গেছেন। মাঠঘাট ভেঙে রোদে রোদে ঘুরে কাজ উদ্ধার করার সামর্থ্য নেই। মোক্ষদাই সব করেন, আর দিনে অন্তত বার চোদ্দ-পনেরো স্নান করেন।

কেন কে জানে, আজ রোদের কথাটাই বার বার মনে পড়ছে মোক্ষদার। মনে হল পূজোর ঝঞ্ঝাট কাটতে না-কাটতেই তো বড়ির মরসুম। বছরে বারো-চোদ্দ মণ বড়ি লাগে। আশা-নিরামিষ দুদিকের প্রয়োজনের দায়টা পোহানো হয় এই দিকেই, কারণ বড়িও তো আম-কাসুন্দির মতই শুদ্ধাচারের বস্তু। আর শুদ্ধাচারের ব্যাপারে কাকে দিয়ে নিশ্চিন্ত হবেন মোক্ষদা নিজেকে ছাড়া?

বড়ি দিতে দিতে মোক্ষদার হত্তেল রঙ কালসিটে মেরে যায়। তবে জিনিস যা হয় তাক লাগাবার মত। ডাকসাইটের হাত। সাবধানীও খুব মোক্ষদা, কাউকে ছুতেই দেন না। সাধ্যপক্ষে, বড় বড় তিজেলে ভরে সরাচাপা দিয়ে সাঙায় তুলে রাখেন, সময়মত বার করে দেন। কত তার স্বাদ। কুমড়ো বড়ি, খাস্তা বড়ি, পোস্ত বড়ি, তিলের বড়ি, জিরের বড়ি, ঝালমশলার বড়ি, টকে-সুক্তয় দিতে মটর-খেসারির বড়ি—ব্যবহার অনেক।

ওরই মধ্যে মূলোর বড়িটা আবার আলাদা রাখতে হয়, মাঘ মাসে পাছে ভুলে খাওয়া হয়ে যায়। মাঘ মাসে মূলো খাওয়া আর গোমাংস খাওয়ায় তো তফাৎ কিছু নেই। … খুঁটির রোদটা সরে গেছে, পিঠটা আবার চিনচিন করছে। মনটাও যেন চিনচিন করছে।

বড়িপর্ব সারা হতেই আসে কুল, আসে তেঁতুল।

কবে তবে রোদে পোড়ার ছুটি?

সারা বছর ধরে এই রোদে পোড়ার দায়িত্ব মোক্ষদাকে দিয়েছে কে, এ কথা কে বলবে? তবে মোক্ষদা জানেন এটা তাঁরই দায়িত্ব।

আমতেল মাখা একটা সময়সাপেক্ষ কাজ। চটকে চটকে তেলে-আমে। মিশোতে হবে তো? হয়েছে এতক্ষণে, এবার রাইসরষের মিহিগুঁড়ো ছড়িয়ে দিয়ে ক্ৰমাগত রোদ খাওয়ানো।

কোমরটা টান করে উঠে পড়লেন মোক্ষদা, পিঠের জ্বালা-কয়ার জায়গাটা নড়াচড়া পেয়ে আর একবার হু-হু করে উঠলো। কিন্তু কী আশ্চর্য, সরষে গুঁড়োবার জন্যে রান্নাঘরে এসে ঢুকতেই মনটা হুঁ-হুঁ করে উঠলো কেন?

ঘরে ঢুকেই হঠাৎ কেমন বোকার মত দাঁড়িয়ে পড়লেন মোক্ষদা। ঘরটা আজ এত বড় দেখাচ্ছে কেন? কই, এমন তো কোন দিন দেখায় না! বরং ভাত বাড়ার সময় পরস্পরের গা বাঁচিয়ে ব্যবধান রেখে ঠাঁই করতে তো জায়গার অকুলানই লাগে।

ঘরের মধ্যে তো রোদ নেই, তবু এই ছায়াশীতল প্ৰকাণ্ড লম্বা ঘরখানা যেন ওই রোদে খা খাঁ প্ৰকাণ্ড উঠোনটার মতই বা ঝা খা খা করছে। আর সেই খা খা করা ঘরের এক প্রান্তে বড় বড় দুটো উনুন তাদের মাজাঘষা নিকোনো চুকোনো চেহারা নিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে বহু অকথিত শূন্যতার প্রতীকের মত।

উনুন দুটোকে আজ আগুনের দাহ সহ্য করতে হবে না। ওরা হয়তো এই নিরালা ঘরে স্তব্ধ হয়ে বসে নিজেদের শূন্যতার পরিমাপ করবার অবকাশ পাবে।

আজ ওদের ছুটি। আজ এদের একাদশী।

মোক্ষদার ছুটি নেই কেন?

ঘরের নর্দমার কাছবরাবর একটা জলভর্তি ঘড়া বসানো থাকে-নেহাৎ সময়-অসময়ের জন্যে। মোক্ষাদাই শেষবারের মানের পর এনে রেখে দেন।

তেল-তেল হাতটা ঘড়া কাত করে ধুয়ে নিয়ে মোক্ষদা। হঠাৎ আছড়া আছড়া জল নিয়ে সজোরে ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারতে লাগলেন, পিঠের রোদে চিনচিনে জায়গাটার জুলুনি একটু ঠাণ্ডা হোক। দূর ছাই, হাত ধুয়ে পুকুরে গেলেই হত, তবু একবার গা-মাথা ভিজিয়ে আসা যেত। গায়ের চামড়াটা খানিক ভিজলেও যেন ভেতরের তেষ্টাটা খানিক কমে।

একাদশীর দিন তেষ্টা কথাটা মনে আনাও পাপ। এ কি আর জানেন না মোক্ষদা? তায় আবার তার মত বয়স-ভাটিয়ে-যাওয়া শক্তিপোক্ত মজবুত বিধবার! কিন্তু মনে করব না বললেও মনে যদি এসে যায়, সে পাপকে তাড়ানো যায় কোন অস্ত্ৰে?

রোদ লাগলে বোশেখ-জষ্টির দুপুরে তেষ্টাটা জানান দেয় বেশী। কিন্তু উপায় কি? আজকেই যে যত রাজ্যের বাড়তি কাজ করবার পরম দিন। আজকের মতন এমন অখণ্ড অবসর আর কদিন জোটে।

রাইসরষের সন্ধানে কুলুঙ্গীতে তুলে রাখা রঙিন ফুলকাটা ছোট ছোট ছোবা হাঁড়ির একটা পাড়লেন মোক্ষদা। সব হাঁড়িতে একেবারে সম্বৎসরের মশলা ঝেড়ে বেছে তুলে রাখা হয়, আর নিত্য প্রয়োজনে দুটি দুটি বার করে কাঁচা ন্যাকড়ার কোণে কোণে পুঁটুলি বেঁধে রাখা হয। শুধু এরকম অনিত্য প্রয়োজনেই মূল ভাঁড়ারে হাত পড়ে।

একটা পাথরবাটিতে আন্দাজমত সরষে ঢেলে নিয়ে শিল পেতে বসতে যাচ্ছিলেন মোক্ষদা, হঠাৎ দরজার কাছে শিবজায়ার গলা বেজে উঠল, কালে কালে কি হল গো, এ যে কলির চারপো পুরল দেখছি! আমাদের ধিঙ্গ অবতার মেয়ের আস্‌পদ্দার কথাটা শুনেছ ছোটঠাকুরঝি?

ধিঙ্গী অবতার মেয়ের আস্‌পদ্দার ইতিহাস শোনার আগেই ভাজের আসপদ্দায় রে-রে করে ওঠেন। মোক্ষদা, উঠোনের পায়ে তুমি দাওয়ায় উঠলে সেজবৌ? আর ওইখানেই আমার আচারের খোরা! বলি তোমরা সুদ্ধ যদি এরকম যবন হও—

শিবজায়া ঈষৎ রুষ্টভাবে বললেন, তোমার এক কথা ছোটঠাকুরবি, উঠোনের পায়ে দাওয়ায় উঠে আসব আমি অমনি আমনি! এই দেখা পায়ে গোবর লেগে। হাতে করে একনাদ এনে পৈঠের নীচেয় ফেলে সেই গোবর দুপায়ে মাড়িয়ে তবেই না উঠেছি!

নিতান্তপক্ষে পুকুরে নেমে পা ধুয়ে আসা যদি অসম্ভব হয়, তা হলে অনুকল্প হিসেবে এই ব্যবস্থা দিয়ে রেখেছেন মোক্ষদা। তবু সেজবৌয়ের আশ্বাসবাণীতে তেমন নিশ্চিন্ত হলেন না। সন্দিগ্ধ সুরে বললেন, বলি গোবরটা নিজেদের তো? নাকি আর কারুদের ঘরের এটোকাটা খাওয়া গরুর?

শোন কথা— জেরা থামানোর চেষ্টায় বলে ওঠেন শিবজায়া, তোমাদের উঠোনে আবার অপরের গরুর গোবর আসবে কোথা থেকে?

কিন্তু থামাতে চাইলেই কি সব জিনিস থামে? মোক্ষদার জেরাও থামল না। তিনি একটু কটুহাস্যে বলে উঠলেন, ও মা লো! আমাদের উঠোনে অন্যের গরুর গোবর আসবে কোথা থেকে? তোমার কথা শুনে মাঝে মাঝে মনে হয়। সেজবৌ, তুমি যেন এইমাত্তর মায়ের পেট থেকে পড়লে!

শিবজায়া ননদকে খুব ভয় করলেও, তবু ছোট ননদ। তাই বিরক্ত সুরে বলে ফেলেন, নাও বাবা, তোমার কাছে আসাই দেখছি ঝকমারি! গোবিন্দবাড়ি থেকে ফিরতে পথে আমাদের কীর্তিমান মেয়ের কীর্তির কথা শুনে হা হয়ে গেলাম, তাই, থাক গে—

মোক্ষদা এতক্ষণে একটু নরম হন। প্রায় সন্ধির সুরেই বলেন, কেন, কী আবার করল কে? সত্য বুঝি?

তবে আবার কে! শিবজায়া ঔদাসীন্য ত্যাগ করে। মহোৎসাহে পুরনো সুর ধরেন, সত্য ছাড়া আর কার এত বুকের পাটা হবে? হারামজাদী নাকি জটার নামে ছড়া বেঁধে পাড়ার গুষ্টিসুদ্ধ ছেলেমেয়েকে শিখিয়ে দিয়েছে, আর গাসুদ্ধ ছেলেপিলে জটাকে কি জটার মাকে দেখলেই ঝোপেবাড়ের আড়াল থেকে শুনিয়ে শুনিয়ে তাই আওড়াচ্ছে। জটার মা তো রেগে গাল দিয়ে শাপশাপান্ত করে একাকার!

শেষ পর্যন্ত সবটুকু শোনবার জন্যে ধৈর্য ধরে চুপ করে তাকিয়েছিলেন মোক্ষদা, এবার ভুরু কুঁচকে তীক্ষ্ণস্বরে বলে ওঠেন, ছড়া বেঁধেছে মানে কি?

মানে কি, তাই কি আমিই আগে বুঝতে পেরেছিলাম? মেয়েমানুষ যে আবার ছড়া বাধে বাপের জন্মেও শুনি নি। তাপর পথে আসতে আসতে দেখি একপাল ছোঁড়া হি হি করে হাসতে হাসতে বলছে, জটা মোটা পা গোদা— ভেঙচি কেটে আরও সব কত কি পয়ার ছন্দ বলতে বলতে যাচ্ছে!

মোক্ষদা আরও ভুরু কুঁচকে বলেন, ছড়া বেঁধেছে সত্য?

তবে আর বলছি কি!

ওই মেয়ে হতেই এ বংশের মুখে চুনকালি পড়বে— মোক্ষদা এবার শিলটা পাততে পাততে বলেন, রামকালী চন্দর এখন বুঝছেন না, এর পর টের পাবেন, যখন শ্বশুরঘর থেকে ফেরত দিয়ে যাবে। ভেঙচি-কাটা ছড়া বোধ হয়। জটা বৌ ঠেঙিয়েছিল বলে!

তবে না তো কি? বলি পরিবারকে আবার না মারে কোন মন্দ? ঢলানি বৌ আমনি তিলকে তাল করে দাঁতকপাটি লাগিয়ে পাড়ায় লোক-জানাজানি করে ছাড়লেন। জটার মা বলছে, ছোঁড়াগুলোর জুলায় নাকি জটা বেচারা ঘরের বার হতে পারছে না, কি গেরো বল দেখি!

মোক্ষদা ঘাস ঘাস করে শিলে সরষে রাগড়াতে রাগড়াতে বলেন, হাতের কাজটা মিটিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। আমি বৌমার কাছে। ভাল করে সমঝে দিয়ে আসছি। মায়ের আসকারা না থাকলে মেয়ে কখনও এত বড় বেয়াড়া হয়? পাড়ার ছোঁড়াদের সঙ্গেই বা রাতদিন এত মস্করা কিসের? একটা কলঙ্ক রটে গেলে তখন রামকালীর মুখটা থাকবে কোথায়? পয়সাওলা বলে তো সমাজ রেয়াৎ করবে না!

শিবজায়ার কাজ কিছুটা সিদ্ধ হল।

বড় জায়ের নাতনীর বিরুদ্ধে ছোট ননদকে কিছুটা তাতাতে পেরেছেন। শেষবেশ বলেন, তুমি যাই আছ ছোট ঠাকুরঝি, তাই এখনও সংসারে একটা হক কথা হয়, নইলে আমরা তো ভয়ে কাটা!

ভয় আবার কিসের?

মোক্ষদা দুম করে শিলটা তুলে ফেলে বলেন, ভয় করব ভূতকে, ভয় করব। ভগবানকে। মানুষকে ভয় করতে যাব কেন? বিধবা পিসিকে ভাত দিয়ে পুষিছে বলে যে হক কথা শুনতে হবে না রামকালীকে, এ তুমি ভেবো না। সেজবৌ! সে যাক, জটার বোর প্রাচিত্তিরের কিছু ব্যবস্থা হয়েছে?

ওমা, তুমি শোন নি সে কথা? প্ৰচিত্তির তো করবে না!

করবে না?

না। রামকালী নাকি ভটাচাৰ্যকে শাসিয়েছে, প্ৰচিত্তিরের বিধান দিলে তাকে গাঁ-ছাড়া করবে!

তার মানে? আকাশ থেকে পড়লেন মোক্ষদা।

মানে বোঝ! অহমিকা আর কি! আমি গায়ের মাথা, আমি যা খুশি তাই করব!

হুঁ।

মোক্ষদা সরষে-গুঁড়ো-ছড়ানো আচারের খোরা দুটো দুম করে ঘরে তুলে ঘরের কপাটটা টেনে : তুলে দিয়ে বলেন, যাচ্ছি, দেখছি পয়সার বাড় কত বেড়েছে রামকালীর! সত্য আছে বাড়ি?

বাড়ি! দুপুরবেলা বাড়ি থার্কবারই মেয়ে বটে সে! কোথায় আগানে-বাগানে ঘুরে বেড়াচ্ছে! বেওলা মেয়ের এত বুকের পাটা, এতখানি বয়সে দেখি নি কখনও।

তসরখানা গুছিয়ে পরে উঠোন পার হয়ে খরা খর পায়ে বেড়ার দরজা খুলে পথে পড়লেন মোক্ষদা। ফিরে তো স্নান করতেই হবে, একবার কেন—কতবার, কিন্তু এসবের একটা হেস্তনেস্ত দরকার।

জগতের কোথাও কোনও অনাচার ঘটবে, এ মোক্ষদা বরদাস্ত করতে পারবেন না।

কিন্তু ও কী?

একটু এগোতেই থমকে দাঁড়াতে হল।

বজ্রাহতের মতই থমকানি।

দেখলেন একখানা তেপেড়ে শাড়িতে গাছকোমর বেঁধে, একরাশ রুক্ষ চুল উড়িয়ে একহাঁটু ধুলো মেখে একদল ছেলেমেয়ের সঙ্গে আমবাগানের মাঝখান দিয়ে চলেছে সত্য হি-হি করতে করতে আর সমস্বরে কি যেন একটা ছড়ার মতই আওড়াতে আওড়াতে।

দাঁতে দাঁত চেপে আরও একটু এগিয়ে গেলেন। মোক্ষদা, দলের পিছন দিকে একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে সবটা শুনতে চেষ্টা করলেন। হি-হি হাসির চোটে সব শোনা যায় ছাই! তবু বালককণ্ঠের শানানো সুর, আর বার বার উচ্চারণ করছে, কাজেই ক্রমশ সবটাই কর্ণগোচর থেকে মৰ্মগোচর হয়ে যায়।

শুনতে পেলেন খাজে খাজে। হাসি ছড়ানো সেই ছড়া—

জটাদাদা পা গোদা
যেন ভোঁদা হাতী,
বৌ-ঠেঙানো, দাদার পিঠে
ব্যাঙে মারে লাথি।
জটা জটা পেট মোটা–
দেখিব মজা কেমন সাজা
যাও না শ্বশুরবাড়ি।

বলতে বলতে চলে গেল ওরা।

মোক্ষদা স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।

না, ভাইপোর মেয়ের কবিত্বশক্তির পরিচয়ে অভিভূত হয়ে নয়, স্তম্ভিত হলেন এ মেয়ের ভবিষ্যৎ ভেবে। একে তিনি শাসন করতে এসেছেন! এর পরে আর একে শাসন করে শায়েস্তা করবার সাধ তাঁর নেই; শুধু এইটে মনে মনে অনুধাবন করলেন—একে নিয়ে চিরকাল জ্বলে-পুড়ে মরতে হবে তাদেরই, কারণ শ্বশুরবাড়ি থেকে তো মারতে মারতে খেঁদিয়ে দেবেই!

কাগজের চিলতেয় মোড়া গোটাকতক ওষুধে বড়ি আঁচলের গিট থেকে খুলতে খুলতে সত্য তার শানানো গলাটাকে কিঞ্চিৎ নামিয়ে বলল, এই নাও বৌ, কি যেন বটিকা! বাবা বলে দিলেন সকাল সন্ধ্যে একটা করে বটিকা পানের রস দিয়ে খেতে, গায়ে বল পাবে।

আর গায়ে বল!

মনের বল তো সমুদ্রের তলায়। ভয়ে বুক কেঁপে থর-থর। জটার বৌ কাতর করুণ কণ্ঠে ফিসফিস করে বলে, হেই ঠাকুরঝি, তোমার পায়ে ধরি, ওষুধ তুমি নিয়ে যাও। ওষুধ খাচ্ছি। দেখলে ঠাকরুণ। আর আমাকে আস্ত রাখবেন না!

সত্য গিনির মত গালে হাত দিয়ে বলে, ওমা, শোনো বিত্তান্ত! দেহ দুব্বল হয়েছে, মিনিমাগনায় ওষুধ পাচ্ছ, খেলে শাউড়ী তোমায় মেরে ফেলবে? তুমি যে তাজ্জব করলে গা!

দোহাই গো ঠাকুরঝি, একটু আস্তে— প্রায় কাঁদো কাঁদো মুখে বলে জটার বৌ, তোমার দুটি পায়ে পড়ছি, ঠাকরুণের কানে গেলে পুকুরে ড়ুবে মরা ছাড়া আর গতি থাকবে না। আমার।

সত্য এবার একটু গুছিয়ে বসে, বসে অবাক গলায় আস্তে আস্তে বলে, কী শুনলে গো?

ওই যে মেরে ফেলার কথা বললে! জানো তো ভাই সমস্ত? মামাঠাকুর ওষুধ পাঠিয়ে দিয়েছেন, আর সেই ওষুধ আমি খাচ্ছি! ওরে ব্যাপারে! এই দেখা ঠাকুরঝি, আমার বুকের ভেতর কেমনতর ঢেঁকির পাড় পড়ছে!

জটার বৌয়ের ওই ব্যাধের তাড়া খাওয়া হরিণের চোখের মত চোখ আর ঘুটের ছাইয়ের মত। পাশুট-রঙা মুখের দিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে হঠাৎ কেমন চিন্তাশীল দেখায় সত্যবতীকে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ওষুধগুলো ফের আঁচলে বাঁধতে বাধতে বলে, আচ্ছা তা হলে ফেরত নে যাই।

ফেরত!

মামা ঠাকুরের কাছে!

আর এক ভয়ে বুকের রক্ত হিম হয়ে আসে জটার বৌয়ের। আর এবার আর কাঁদো কাঁদো নয়, ভ্যাক করে কেঁদেই ফেলে। ও সত্য ঠাকুরঝি, তোমার পা-ধোওয়া জল খাই, তোমার কেনা গোলাম হয়ে থাকি, ও বড়ি মামাঠাকুরকে ফেরত দিতে যেও না!

ফেরত দিতে যেও না!

হঠাৎ সত্য তার নিজের স্বভাবসিদ্ধ হাসি হেসে ওঠে, এই সেরেছে! ব্যায়রামে পড়ে দেখছি তোমার ভীমরতি ধরেছে বৌ! শাউড়ীর ভয়ে ওষুধ খাবে না, আবার ফেরতও দেবে না, তবে বড়িগুলো কি আমি খেয়ে নেব? দাও, তা হলে একখোরা পানের রস করে দাও, সবগুলো একসঙ্গে গুলে গিলে ফেলি।

জটার বৌ এবার মনের কথা খুলে বলে। শাশুড়ীর অসাক্ষাতে ওষুধ খাবার সাহস তার নেই, বলে কয়ে সাক্ষাতে খাবার তো আরোই নেই, অতএব–

অতএব পুকুরের জলে!

পুকুরে?

সত্যর চোখে আগুন জ্বলে ওঠে। বাবার দেওয়া বড়ি স্বয়ং ধন্বন্তরী, তা জান? এ বাড়ির অপমান করলে, ধন্বন্তরীর অপমান তা জান?

তবে আমি কী করি?

ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে জটার বৌ।

সত্য ওর অবস্থা দেখে কাতর না হয়ে পারে না, একটু ভেবেচিন্তে বলে, তা হলে নয় এক কাজ করি, পিসীকেই দিয়ে যাই, বলি বাবা পাঠিয়ে দিয়েছেন। বাবা অবিশ্যি বলেছিলেন পিসীকে দিস না, তা হলে খেতে দেবে না, ফেলে দেবে। তুতিয়েপাতিয়ে কাকুতি-মিনতি করে বলে যাই।

উঠে দাঁড়ায় সত্য, আর সঙ্গে সঙ্গে ওর কাপড়ের একটা খুঁট ধরে হুমড়ে প্রায় ওর পায়ে পড়ে জটার বৌ, ও ঠাকুরঝি, তার চাইতে তুমি আমার গলায় পা দিয়ে মেরে রেখে যাও, আঁশবিটি দে কেটে রেখে যাও আমায়।

সত্য আবার বসে পড়ে।

একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে, আচ্ছা বৌ, তোমাদের এত ভয় কিসের বলতে পার?

০৬. শুধু হাঁটু পর্যন্ত

হুম্ হুম্ হুম্!

শুধু হাঁটু পর্যন্ত আটফাটা পা-গুলোর নয়, জিভে-মুখেও ধুলো বেতে যাচ্ছে বেহারাগুলোর। জ্যৈষ্ঠের দুপুর আর দুরন্ত মেঠো রাস্তা। খানিক খানিক পথ তো একেবারে ধু-ধু প্ৰান্তর, গাছ নেই ছায়া নেই। পথ সংক্ষেপের জন্য মাঝে মাঝে মোঠ ভাঙতে হচ্ছে বলেই লোকগুলো যেন আরও একেবারে জেরবার হয়ে যাচ্ছে। চারটে লোক পালা করে কাঁধ বদলে ছুটছে, তবু থেকে থেকে ঝিমিয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু রামকালীরও তো আর এখন পালকি-বোহারাগুলোর ওপর দরদ দেখাবার উপায় নেই। আজ চার দিন গা ছাড়া, তো ধর মো ধর না হলেও হাতে কটা রুগী ছিল, কে জানে কেমন আছে সে কটা!

গিয়েছিলেন জীরেটের জমিদারবাড়িতে রুগী দেখতে। শুধু তো এক-আধখানা গাঁয়ে নয়, দশখানা গাঁ অবধি নামডাক বদ্যি চাটুয্যের।

রাজার আদরে রেখেছিল ওরা, আর পায়ে ধরে সাধছিল আরও দুটো দিন থেকে যাবার জন্যে। রাজী হন নি। রামকালী। বলে এসেছেন, প্রয়োজন নেই, যে ওষুধ দিয়ে গেলাম এতেই রুগী তিন দিনে উঠে বসবে। তবে পথ্যাপথ্যের যা ব্যবস্থা দিয়ে যাচ্ছি সেটি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করা চাই।

কবিরাজ মশাই পথে খাবেন বলে ওরা একঝুড়ি কলমের আম ওঁর পালকির মধ্যে তুলে দিয়েছে, আপওি শোনে নি। পা ছড়াতে অনবরত ঝুড়িটা পায়ে ঠেকছে আর বিরক্তি বোধ করছেন রামকালী। এই এক আপদ! পথে তিনি কিছু খান না, একথা ওরা মানতে চাইল না। স্বয়ং জমিদার মশাই দাঁড়িয়ে তুলিয়ে দিলেন। তবু মুখ কাটা ডাব গোটাচারেক পালকিতে তুলতে দেন নি। রামকালী, বলেছিলেন, ব্যায়রাগুলো তা হলে আপনার বাগানের এই ফলটলগুলোই বয়ে নিয়ে যাক রায়মশাই, আমি পদব্ৰজেই যাই!

সম্পূৰ্ণ তৈরী আম, জ্যৈষ্ঠের দুপুরের ঝলসানি হাওয়ায় একেবারে শেষ তৈরি হয়ে উঠে, থেকে থেকে মিষ্ট সুবাস ছড়াচ্ছিল। রামকালী বিরক্ত হচ্ছিলেন, আর বেহারাগুলো যেন অন্তর দিয়ে সেই সুবাসটুকুই লেহন করছিল। আর ভাবছিল ডাব চারটে পালকির বাঁকে বাঁকে নিলেই বা ক্ষতি কি ছিল? তবু তো কেষ্টর জীবের ভোগে লাগত।

অন্যমনস্ক হয়ে বোধ হয় ঝিমিয়ে এসেছিল তারা। হঠাৎ চমকে উঠল কর্তার হাঁকে।

পালকি থেকে মুখ বাড়িয়ে রামকালী হাঁকছেন, ওরে বাবা সকল, ঘুমিয়ে পড়িস নে, একটু পা চালা।

কথাটা শেষ করেই হঠাৎ সুর-ফের্তা ধরলেন। কবরেজ, এই দাঁড়া দাঁড়া, আস্তে কর, পেছনে হঠাৎ যেন আর একটা পালকির শব্দ পাচ্ছি।

চার বেহারিার আটখানা পা থমকে দাঁড়াল।

হ্যাঁ, শব্দ একটা আসছে বটে। পিছন থেকে। হঠাৎই আসছে। হুম, হুম আওয়াজটা ক্রমশই স্পষ্ট হচ্ছে।

প্রধান বেহারা গদাই ভূইমালী পালকির বাঁক থেকে ঘাড় সরিয়ে পিছন সড়কের দিকে তাকিয়ে উৎফুল্ল কণ্ঠে বলে ওঠে, আজ্ঞে কৰ্তামশাই, নিয্যস বলেছেন বটে! পালকিই একটা আসছে, মনে নিচ্ছে কোন বিয়ের বর আসছে!

বিয়ের বর!

রামকালী পালকি থেকে গলাটা আরও একটু বাড়িয়ে এবং সে গলার স্বরটাকে অনেকখানি বাড়িয়ে বলেন, বিয়ের বর এ খবরটা আবার চট করে কে দিয়ে গেল তোকে?

গদাই ভূইমালী মাথা চুলকে বলে, পালকির কপাটে হলুদ ছোগানো ন্যাকড়া ঝুলছে দেখতে পাচ্ছি কর্তা, ব্যায়রাগুলোর পরনে লালছোপ খেটে!

খেটোটা হচ্ছে ধুতির সংক্ষিপ্ত সংস্করণ। আরও অনেক শ্রমজীবীদের মত পালকি-বেহারাদের পুরো ধুতি পরা চলে না। জোটেই বা কই? ছালার মত মোটা সাতহাতি খেটেই তাদের জাতীয় পোশাক। লোকের বাড়ি কাজে-কর্মে বিয়ে-পৈতেয় লাল রঙে ছোপানো ওই ধুতি মাঝে মাঝে তাদের জোটে। এতে সুবিধেটা খুব। মাস তিন-চার ক্ষার না কোচে চালানো হয়।

লাল হলুদ রঙটাই শুধু নয়, ক্রমশ মানুষগুলোও স্পষ্ট হচ্ছে। গদাই আরও একটা উৎফুল্ল আবিষ্কার করে, পশ্চাতে গো-গাড়িও আসছে কত্তা, বলদের গলার ঘন্টি শুনতে পাচ্ছি। এ আর বরযাভীর না হয়ে যায় না। ইন্দিকেই কোথাও বে। উই পাশের গার সড়ক দিয়ে বেরিয়েছে।

পালকি নামা! গম্ভীর কণ্ঠে হুকুম করেন। রামকালী।

দেখা দরকার প্রকৃত ঘটনা গদাইয়ের আন্দাজ অনুযায়ী। কিনা। আর এও জানা দরকার যদি সত্যিই তাই হয়, কে এমন দুর্কিনীত আছে তার গ্রামে, যে ব্যক্তি মেয়ের বিয়ে দিতে বসেছে, অথচ রামকালীকে জানায় নি! আর এ গ্রামের যদি নাও হয়, খোঁজ নেওয়াও চাই, গ্রামের ওপর দিয়ে বারযাত্রী নিয়ে যাচ্ছে কোথায়!

রামকালীর মনে যাই থাক, বেহারাগুলো একটুখানির জন্যেও বাঁচল। একটা পাকুড় গাছতলায় পালকি নামিয়ে, খানিক তফাতে গিয়ে কাঁধের গামছা ঘুরিয়ে বাতাস খেতে লাগল।

কত্তামশায়ের চোখের সামনে তো আর বাতাস খাওয়া চলে না!

কিছুক্ষণ পরেই দূরবতী পালকি অদূরবতী এবং ক্রমশ নিকটবর্তী হল।

রামকালী বেরিয়ে পড়ে কাঁধের মটকার চাদরখানা গুছিয়ে কাঁধে ফেলে রাজ্যোচিত ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে জলদগম্ভীর কণ্ঠে হাঁক দিলেন, কে যায়?

পালকি থামল। না থেমে এগিয়ে যাবার সাধ্য কার আছে, এই কণ্ঠকে উপেক্ষা করে?

পালকি থামল।

বর আর বরকর্তা এতে সমাসীন। বরকর্তার সঙ্গে সঙ্গে কিশোর বরটিও সভয়ে একটু মুখ বাডাল।

ওই দীর্ঘকায় গৌরকান্তি পুরুষ মাটিতে নেমে দাঁড়িয়ে, অতএব কে পালকি চড়ে বসে থাকতে পারে তার সামনে?

সে পালকি থেকেও নামলেন। বরকর্তা।

করজোড়ে বললেন, আপনি আজ্ঞে?

রামকালীর কিন্তু তখন ভুরু কুঁচকেছে, তীক্ষ্ণ দৃষ্টির শরসন্ধান চলছে পালকির মধ্যে। অভ্যাবসশতই দুই হাত তুলে প্রতি-নমস্কারের ভঙ্গীতে বললেন, আমি রামকালী চাটুয্যে।

রামকালী চাটুয্যে!

ভদ্রসন্তান বিহ্বল হয়ে—না আত্মগত, না প্ৰশ্নসূচক, কেমন যেন আলগা ভাবে উচ্চারণ করলেন, কবরেজ!

হ্যাঁ। ছেলেটির কপালে চন্দন দেখলাম মনে হল, বিবাহ নাকি!

সে ভদ্রলোক রামকালীর চাইতে ছোট না হলেও বিনয়ে কীটানুকীটের মত ছোট হয়ে পায়ের ধুলো নিয়ে বলেন, আজ্ঞে হ্যাঁ। ওঃ, কী পরম ভাগ্য আমার যে এই শুভযাত্রায় আপনার দর্শন পেলাম।

আহাহা! আপনাকে চেনে না। এ তল্লাটে এমন অভাগা কে আছে? তবে নাকি চাক্ষ্মষ দর্শনের সৌভাগ্য ইতিপূর্বে হয় নি। রাজু, বেরিয়ে এসে পায়ের ধুলো নাও!

থাক থাক, বিয়ের বর! রামকালী স্বভাবসিদ্ধ গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলেন, আপনার পুত্ৰ? আজ্ঞে না, ভ্রাতুষ্পপুত্র। পুত্র আমার কনিষ্ঠ সহোদরের। সে আছে পেছনে গো-যানে। আরও সব আত্মকুটুম্ব আসছেন তো!

হুঁ, কন্যাটি কোথাকার?

আজ্ঞে এই যে পাটমহলের। পাটমহলের লক্ষ্মীকান্ত বাঁড়ুয্যের পৌত্রী—

লক্ষ্মীকান্ত বাঁড়িয্যের পৌত্রী? রামকালী যেন সহসা সচেতন হলেন, তাই নাকি? আপনারা কোথাকার? আপনার ঠাকুরের নাম?

আমরা বলাগাড়ের। ঠাকুরে নাম ঈশ্বর গঙ্গাধর মুখোঁপাধ্যায়, পিতামহের নাম ঈশ্বর গুণধর মুখোঁপাধ্যায়, আমার নাম-

থাক, আপনার নামে প্রয়োজন নেই। তা হলে আপনারা মুখুটি কুলীন? তা হাবভাব এমন যজমেনে ভট্টচায্যের মতন কেন? কিন্তু সে যাক, দুটো কথা আছে আপনার সঙ্গে। বর নিয়ে বেরিয়েছেন কখন?

যজমেনে ভট্টচার্য শব্দটায় ঈষৎ ক্ষুব্ধ হয়ে পাত্রের জেঠা গভীরভাবে বলেন, আভ্যুদায়িক শ্ৰাদ্ধের পর।

সে তো বুঝলাম, কিন্তু সেটা কত বেলায়?

এই এক প্রহরটিাক আগে হবে।

হুঁ! পাত্রের কপালের ঐ চন্দন রেখা কি সেই তখনকারই নাকি?

চন্দন রেখা!

এ আবার কেমন প্রশ্ন!

পাত্রের জেঠা নানাবিধ প্রশ্নের সম্মুখীন হবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন, কিন্তু পাত্রের কপালের চন্দনরেখাঙ্কনের কালনির্ণয়ের মত এমন অদ্ভুত প্রশ্নের জন্য নিশ্চয় প্রস্তুত ছিলেন না। তাই অবোধের মত বলেন, কি বলছেন?

বলছি, ছেলের কপালে এই যে চন্দন পরানো হয়েছে, ওটা কি সেই যাত্রাকালেই?

আজ্ঞে হ্যাঁ, তা তো নিশ্চয়ই। পাত্রের জেঠা সোৎসাহে বলেন, যাত্রাকালে মেয়েরা যেমন পরিয়ে দেয় তেমনি দেওয়া হয়েছে, আমাদের বাড়ির মেয়েদের বুঝলেন। কিনা এসন ব্যাপার খুব নামডাক আছে। পাড়া থেকে ডাকতে আসে পিঁড়ি আলপনা দিতে, শ্ৰী গড়তে, বর কনে সাজাতে—

রামকালী ওই পালকির দিকে তাকাতে তাকাতে আবার কেমন অন্যমনা হয়ে পড়েছিলেন, ইত্যবসরে পশ্চাৎবর্তী গোরুর গাড়ি দুখানা এসে পড়েছে। পালকি নামানো এবং অপর এক পালকির আরোহীর সঙ্গে বাক্যবিন্যাসের ব্যাপার দেখে ঈষৎ ঘাবড়ে গিয়ে বরের বাপিও নেমে এসে দাঁড়িয়েছেন।

অন্যমনা রামকালী একটা দীর্ঘঃনিশ্বাস ফেলে গাঢ় স্বরে বলেন, আমি আপনাকে একটা অনুরোধ করছি মুখুজ্যে মশাই, আপনি যাত্ৰা স্থগিত করুন।

যাত্রা স্থগিত করুন!

বিবাহযাত্ৰা! হাঁ করে তাকিয়ে থাকেন বরের জেঠা আর বরের বাপ। লোকটা পাগল না। শয়তান! না কনের বাড়ির সঙ্গে গভীরতম কোন শক্ৰতা আছে?

ওদিকে ঘুম ছুটে যাচ্ছে বেহারাদের, রোদুরটা অসহনীয় হয় উঠেছে। দু পালকির বেহারারা অদূরে দাঁড়িয়ে পরস্পর বাক্যবিনিময় করে ব্যাপারটা অনুধাবন করার চেষ্টা করতে ঘন ঘন এদিকে তাকাচ্ছে কখন পালকি তোলার ডাক পড়ে।

ব্যাপারটা যে একটা কিছু হচ্ছে, এ অনুমান করে ইত্যবসরে গরুর গাড়ি থেকে এক ব্যক্তি লাফিয়ে নেমে পড়েছেন, যিনি হচ্ছেন বরের পিসে; গাড়ির ছাঁইয়ের মধ্যে গলদঘর্ম হয়ে আসতে আসতে এমনিতেই মেজাজ তার চড়ে উঠেছিল, নেমেই যাত্ৰা স্থগিতের কথা শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বললেন, কে মশাই আপনি? ভাঙচি দেবার আর জায়গা খুঁজে পান নি? যাত্রা করে বর বেরিয়েছে, পথের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে ভাঙচি দিচ্ছেন?

মুখুজ্যে ভ্রাতৃদ্বয় ভগ্নীপতির এ হেন দুর্বিনয়ে বিচলিত হয়ে তাড়াতাড়ি বলে ওঠেন, আঃ গাঙ্গুলী মশাই, কাকে কি বলছেন? ইনি কে তা জানেন?

জানতে চাইনে মুখুয্যে, থামো তুমি। যে ব্যক্তি এ হেন অর্বাচীনের ন্যায় কথা কয়—

চোপরাও! হঠাৎ যেন ঘুমন্ত বাঘ জেগে উঠে গর্জে উঠল, চোপরাও বামুনের ঘরের কুষ্মাণ্ড!

মুখুজ্যে! চেঁচিয়ে উঠল বাঘের পর খেকশিয়াল, দাঁড়িয়ে অপমানিত হবার জন্যে তোমার ছেলের বিয়ের বরযাত্তর হয়ে আসিনি। ইটি বোধ হয় তোমার কোন বড় কুটুম্ব? তা একে নিয়েই ৰিয়ে দেওয়াও গে, আমি চললাম।

আহাহা, করেন কি গাঙ্গুলী মশাই! ইনি হচ্ছেন আমাদের সাতখানা গায়ের মাথা কবিরাজ চাটুয্যে মশাই। অবশ্যই অনিবাৰ্য কোন কারণে ইনি যাত্ৰা স্থগিতের আদেশ-

কবরেজ চাটুয্যে! অ্যাঁ!

গাঙ্গুলীর কাছার কাপড় আলগা হয়ে পড়ে, তিনি সহসা আধাবিঘৎটাক জিভ বার করে সে জিভে দাঁতে কেটে, দু হাতে দু কান মলে বয়সের মর্যাদা ভুলে প্ৰণাম করে বসেন।

রামকালী প্ৰণামরতের প্রতি দৃকপাত মাত্র না করে সমান স্থৈ্যুর্যের সঙ্গে বলেন, হ্যাঁ, অনিবার্য কারণেই বলছি মুখুয্যে মশাই, যাত্রা স্থগিত রাখুন! নইলে অকারণ আপনাদের পুত্রের বিবাহযাত্রা স্থগিত রাখতে বলব, এমন অর্বাচীন সত্যিই আমি নই।

বড় মুখুয্যে দুহাত কচলে বলেন, আজ্ঞে তা আর বলতে! মানে ইয়ে লক্ষ্মীকান্তবাবুর বংশে কোন দোষ-

আঃ মুখুয্যে মশাই, অনুগ্রহ করে আমাকে অন্ত ইতর ভাববেন না। আমি বলছি পুত্রের বিয়ে দিতে গিয়ে আপনি বিপদে পড়বেন। আপনার পুত্ৰ অসুস্থ।

পুত্ৰ অসুস্থ! এ আবার কি প্যাঁচের কথা!

এ যে দেখছি সমুদ্রের দিক থেকে পাথর ছুটে আসা! এ পাথরের আশঙ্কা তো ছিল না! কন্যাপক্ষে কোন গোলমাল আছে, এবং ইনি অবশ্যই কন্যাপক্ষের কোন বিশেষ হিতৈষী, এইটাই ভাবছিলেন মুখুয্যেরা। যেটা স্বাভাবিক। তা নয়, পথের মাঝখানে আটকে এ কী উলটো চাপ।

পুত্ৰ অসুস্থ! বলেন কি কবিরাজ মশাই? এ যে একটা অসম্ভব কথা বলছেন। অমন সুস্থ সহজ পুত্র আমার। উপবাসে ও মধ্যাহ্নকালের উত্তাপে বোধ করি ঈষৎ শুষ্ক দেখাচ্ছে! ছোট মুখুয্যে কাতরভাবে বলেন।

না, শুষ্ক দেখাচ্ছে না। রামকালী জলদগম্ভীর স্বরে বলেন, বরং বিপরীত। রীতিমত রসস্থই দেখাচ্ছে, লক্ষ্য করলেই টের পাবেন। আমি গোড়াতেই লক্ষ্য করেছিলাম,এবং আপনাকে নিবৃত্ত করবার সংকল্প নিয়েই আটকেছি। ছেলেটির চেহারায় আমি শিরঃশূলী-সান্নিপাতিকের লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি। বিবাহসভায় নিয়ে গিয়ে সঙ্কটে পড়বেন। বাড়ি ফিরে যান, কন্যার বাড়িতে সংবাদ দিন।

বরের পিসে পূর্ব বিনয় ভুলে গিয়ে রুখে ওঠেন, ভ্যালা ঝামেলা করলে তা দেখছি। আজ বিবাহ, রাত্রির প্রথম প্রহরে লগ্ন, এখন ছেলেকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাব, আর কন্যাপক্ষকে সংবাদ দেব পাত্ৰ অসুস্থ? এ কি ছেলের হাতের মোয়া নাকি? বুঝতে পারছি আপনি কন্যাপক্ষের একজন মস্ত হিতৈষী!

রামকালীর গৌর মুখ রোদের তাতে এমনিতেই লাল টকটকে হয়ে উঠেছিল, এবার আগুনের মত গানগনে দেখাল।

তবু উত্তেজিত হলেন না।

স-তাচ্ছিল্যে গাঙ্গুলির প্রতি একটা কটাক্ষপাত করে বললেন, হ্যাঁ ঠিক বলেছেন, বিশেষ হিতৈষী। লক্ষ্মীকান্ত বাঁড়ুয্যে মশাই আমার মাতুলের সতীর্থ পিতৃতুল্য। তাঁর পৌত্রীটি যে বিবাহরাত্রেই বিধবা হয় এটা আমার অভিপ্রেত হতে পারে না।

নির্মল নির্মেঘ আকাশ থেকে যেন বজ্রপাত ঘটল।

এ কী সর্বনেশে অলক্ষণের কথা!

এ কী অভিশাপ, না অপ্রকৃতিস্থ মস্তিষ্কের প্রলাপ? মুখুয্যে গলার পৈতে হাতে জড়িয়ে হাঁ হাঁ করে উঠলেন।

রামকালী নিবাত নিষ্কম্প দীপশিখা, —কঠিনহৃদয় বিচারক অপরাধীর প্রতি মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েও যেমন স্থির থাকে, তেমনি অচল অটল স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।

অভিশাপ দেওয়া হল না, পৈতে হাত থেকে ছেড়ে মুখুয্যেরা কেঁদে উঠলেন, এ কী বলছেন কবরেজ মশাই?

কি করব বলুন, আমি মুখের উপর স্পষ্ট বলতে চাই নি, আপনারাই বললেন। শুনুন, যদি হিত চান, এখনও পুত্রকে তার জননীর কাছে নিয়ে যান। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি স্বয়ং কাল ওর শিয়রে দাঁড়িয়ে। আর বেশী বাক্যব্যয়ে সময়ের অপচয় করবেন না, তাছাড়া আপনারা উচাটন হলে পুত্ৰ বিহ্বল হবে।

কিন্তু মুখুয্যেরাও তো রক্তমাংসের মানুষ। ওদের বিশ্বাস-অবিশ্বাস দিয়ে তৈরী মন। যে ছেলে পালকির মধ্যে দিব্যি বসে রয়েছে, মাঝ-মাঝে মুখ বাড়িয়ে দেখেও নিচ্ছে কী হচ্ছে এখানে, যার কপালে এখনও চন্দনের রেখা জ্বলজ্বল করছে, আর গলার মালা থেকে সুগন্ধ বিকীরণ করছে, সামান্য একটা মানুষের কথায় বিশ্বাস করে বসবেন যে সে ছেলের শিয়রে শমন দাঁড়িয়ে! আর সেই কথায় বিশ্বাস করে একটা নিরীহ ভদ্রলোককে মরণান্তক সর্বনাশের গহবরে নিক্ষেপ করে মূঢ়ের মত যাত্ৰা-করা বর নিয়ে ফিরে যাবেন! বাঁড়িয্যেদের হবে কি? কন্যা ভ্ৰষ্টালগ্ন হওয়া মৃত্যুর চাইতে কি কিছু কম?

না, এ অসম্ভব! নিশ্চয় এ কোন চক্রান্ত!

হয় এই চাটুয্যের সঙ্গে লক্ষ্মীকান্ত বাঁড়ুয্যের ঘোরতর কোন শত্রুতা আছে, নচেৎ এই লোকটা আদৌ চাটুয্যেই নয়! কোন ক্ষ্যাপাটে বামুন! তবু এই ব্যক্তিত্বের প্রভাবের সামনে কেমন যেন সব গুলিয়ে যাচ্ছে। আর সন্তানের সম্পর্কে অত বড় অভিশাপ-সদৃশ্য বাণী!

ছোটমুখুয্যে একবার অদূরবতী পালকির দিকে তাকিয়ে রুদ্ধশ্বাস-বক্ষে বলেন, আমি তো রোগের কোন লক্ষণ দেখছি না। কবরেজ মশাই!

রামকালী একটু বিষাদব্যঞ্জক হাসি হাসেন, তা দেখতে পেলে তো আমার সঙ্গে আপনার কোন প্রভেদ থাকত না মুখুজ্যে মশাই। আসুন, এদিকে সরে আসুন। দেখছেন তাকিয়ে ছেলের ললাটে ওই চন্দনরেখা দেখা? সদ্য চন্দনের মত আৰ্দ! অথচ বলছেন এক প্রহরকাল আগে চন্দন পরানো হয়েছে! তাহলে সে চন্দন এতক্ষণে শুকিয়ে খড়ি হয়ে যাবার কথা। হয় নি। কারণ চোরা সান্নিপাতিকে সর্বশরীর রসস্থ হয়ে উঠেছে—

এই কথা! হঠাৎ পাত্রের জেঠা হেসে ওঠেন, কবিরাজ মশাই, খুব সম্ভব পথশ্রমে আপনি কিছু অধিক ক্লান্ত, তাই লক্ষণ নির্ণয়ে ভুল করছেন। গ্ৰীষ্মকালে ঘাম-নিৰ্গমের দরুন চন্দন শুকিয়ে ওঠবার অবকাশ পায় নি, এই তো কথা! ওহে বেয়ারারা, চল চল। পালকি ওঠাও। শুভযাত্রায় এ কী বিপত্তি!

লক্ষণ নির্ণয়ে ভুল করেছেন রামকালী! রামকালীর নিজেরই মাথার শিরা ফেটে যাবে নাকি!

একবার নিজের পালকির দিকে অগ্রসর হতে উদ্যত হলেন রামকালী, কিন্তু আবার কি ভেবে থমকে দাঁড়িয়ে আরও ভারী গলায় বললেন, শুনুন মুখুয্যে মশাই, রামকালী চাটুয্যের লক্ষণ নির্ণয়ে ভুল হয়েছে, এ কথা যদি অন্য কোন ক্ষেত্রে উচ্চারণ করতেন, সে ঔদ্ধত্যের সমুচিত উত্তর পেতেন। কিন্তু এখন আপনার সঙ্কট সময়, ওদিকে বাঁড়ুয্যেরাও বিপন্ন, তাই মার্জনা পেয়ে গেলেন। লক্ষ্মীকান্ত লাড়ুয্যের বাড়ি এখনই সংবাদ দেওয়া প্রয়োজন, এবং সে কাজ আমাকেই করতে হবে। প্রয়োজন হলে পালকি ছেড়ে দিয়ে ঘোড়া নিতে হবে। তবে আপনাকে শেষ সাবধান কথা জানিয়ে যাচ্ছি, ছেলেটির মাথার শিরা ছিঁড়ে ভিতরে রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে, চোখের শিরার রং এবং রাগের শিরার স্ফীতির দিকে লক্ষ্য করলে আপনিও ধরতে পারবেন। মনে হচ্ছে খানিক বাদেই বিকার শুরু হবে। জানানো আমার কর্তব্য বলেই জানিয়ে দিলাম। বলছিলেন না লক্ষণনির্ণয়ে ভুল! ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছি, রামকালী কবরেজের বিচারে যেন ভুলই হয়ে থাকে। রোদের ঘামকে কালঘাম ভাবার ভ্রান্তিই তার হয়েছে, এই যেন হয়। আর কি বলব! আচ্ছা নমস্কার। …ওরে গদাই, তোল পালকি। পা চালিয়ে একবার বসিরের ওখানে চল দিকি, ঘোড়াটাকে নিতে হবে।

পালকি চলতে শুরু করেছে। হঠাৎ ছুটে এলেন ছোট মুখুয্যে, প্রায় ড়ুকরে কেঁদে চীৎকার করে উঠলেন, কবরেজ মশাই, এত বড় সর্বনাশের কথা বললেন যদি তো একটু ওষুধ দিলেন না?

রামকালী গম্ভীর বিষণ্ণ ভাবে হাতটা একটু নেড়ে সে হাত কপালে ঠেকিয়ে বললেন, দেবার হলে আপনাকে বলতে হত না, আমি নিজেই দিতাম। কিন্তু এখন আর স্বয়ং ধন্বন্তরীর বাবারও সাধ্য নেই।

ও পালকিতে তখন বড় মুখুয্যে উঠে পড়ে বিরক্তভাবে বলে ওঠেন, দুৰ্গা দুর্গা, যত সব বিঘ্ন! কালে কার মুখ দেখে বেরোনো হয়েছিল! কোথা থেকে এক উৎপাত জুটে, —এই রাজু, অমন ঢলছিল কেন? গরমে কষ্ট হচ্ছে?

রাজু রক্তবর্ণ দুটি চোখ মেলে বলে, না জেঠামশাই, শুধু বড্ড শীত করছে।

০৭. আঁচল ডুবিয়ে নাড়া

আঁচল ডুবিয়ে নাড়া দিয়ে দিয়ে তলার জল ওপরে আর ওপরের জল তলায় করছিল ওরা তপ্ত জল শেতল করতে। বেলা পড়ে এসেছে, তবু পুকুরের জল টগবগিয়ে ফুটছে, এ জলে নেমে ঝাপাই বুড়িলে গা ঠাণ্ডা হবার বদলে দাহই হয়, তবু জলের আকর্ষণ তাই বেলা পড়তেই জলে পড়া চাই পাড়ার নবীনাকুলের।

চাটুয্যে-পুকুরের জল তোল মাটি ঘোল করছিল পুণ্য টেঁপি পুঁটি খেঁদি প্রমুখ নবীনারা। সত্য কেন এখনো এসে হাজির হয়নি। তাই ভাবছে ওরা আর অনুপস্থিত সত্যর সন্তোষ বিধানের জন্যেই বোধকরি জল শেতল করার অভিযানটা এত জোর কদমে চালাচ্ছে। সত্য ওদের প্রাণপুতুল।

সত্য কি শুধুই তাদের দলনেত্রী?

ভগবান জানেন কোন গুণে সত্য সকলের হৃদয়নেত্রীও। সত্য-বিহীন খেলা ওদের শিবহীন দক্ষযজ্ঞেরই সামিল। পুকুরে ঝাপাই ঝোড়ার ব্যাপারে সত্যই রোজ অগ্রণী, তাই ওরা বার বার ফুটন্ত জলকে তলা-ওপর করতে করতে এ ওকে প্রশ্ন করছিল, সত্যর কি হল রে? ঘরে তো দেখলাম না? বলেছিল তো ঠিক সময়ে দেখা হবে। বাগানে কোথাও আছে নাকি এখনো? দূর, একা এক কি আর বাগানে ঘুরবে? বেওলা মেয়ে, ভয় নেই পরাণে? ভয়! সত্যুর আবার ভয়! দেখিস ও শ্বশুরবাড়ি গিয়ে শাউড়ী পিসশাউড়ীকেও ভয় করবে না। তা আশ্চয্যি নেই, ও যা মেয়ে!

সত্য যে তার সমস্ত সখী-সঙ্গিনীদের প্রাণের দেবতা তার প্রধান কারণ বোধ হয় সত্যর এই নিভীকতা। নিজের মধ্যে যে গুণ নেই, যে সাহস নেই, সে গুণ সে সাহস অন্যের মধ্যে দেখতে পেলে মোহিত হওয়া মানুষের স্বভাবধর্ম। নিভীকতা ব্যতীত ও আরও কত গুণ আছে সত্যর। খেলাধূলোর ব্যাপারে সত্যর উদ্ভাবনী শক্তির জুড়ি নেই, বল আর কৌশল দুই-ই তার অন্যের চাইতে বেশি একশ গুণ। মোটাসোটা একটা গাছের কাটা গুড়িকে দড়ি বেঁধে একা আনা সত্যবতীর পক্ষে আদৌ অসম্ভব নয়, আবার সেই গাছের গুড়িকে গড়িয়ে পুকুরের জলে ফেলে ডিঙি বানানোও সত্যর কৌশলেই সম্ভব।

এর ওপর আবার পয়ার বাঁধা!

পয়ার বাঁধার পর থেকে পাড়ার সমস্ত ছোট ছেলে-মেয়েই তো সত্যর পায়ে বাঁধা পড়েছে।

সেই সত্যর জন্য জল শেতল করছে ওরা এ আর বেশী কথা কী! কিন্তু সত্যর এত দেরি কেন? এদিকে যে এদের মেয়াদ ফুরিয়ে আসছে। ঠাকুমা-পিসিমা একবার চৈতন্য পেয়ে খোঁজ করলেই তো হয়ে গেল!

নেহাৎ নাকি ঠিক এই সময়টুকুই অভিভাবিকদলের কিঞ্চিৎ দিবানিদ্রার সময়, তাই এদের এই অবাধ স্বাধীনতা। হ্যাঁ, এই পড়ন্ত বেলাতেই গিন্নীরা একটু গড়িয়ে পড়েন। সারা বছর তো নয়, (মেয়েমানুষের দিবানিদ্রার মত অলুক্ষ্মণে ব্যাপার আর কি আছে সংসারে?) নেহাৎ এই আমের সময়টা।

আমের যে একটা নেশা আছে।

গিন্নীরা বলেন, আমের মদ।

আম খাও বা না খাও, এ সময়ে শরীর টিস টিস করবেই। অবশ্য না খাওয়ার প্রশ্ন ওঠেই না। আম-কাটাল আবার কে না খায়? হরু ভট্টচায্যের মার মত কে আর আম-হেন বস্তুকে জগন্নাথের নামে উৎসর্গ করতে পারে? হরু ভট্টচায্যের মা সেবার শ্ৰীক্ষেত্তর গিয়ে এই কাণ্ড করে এসেছেন, ক্ষেত্তর করার পর জগন্নাথকে ফল দিতে হয় বলে আম ফলটি দিয়ে এসেছেন। মনের আক্ষেপে সেবার হরু ভট্টচায। আমবাগান বেচে দিতে চেয়েছিলেন। বলেছিলেন, মার ভোগেই যদি না লাগল। তো, আমবাগানে আমার দরকার? তা ভট্টচায্যের মা ছেলেকে হাতে ধরে বুঝিয়ে ঠাণ্ডা করেছিলেন, বলেছিলেন, বাবা, আজন্মকাল তো খেয়ে এলাম। তবু খাওয়ার লালসা ঘোচে না, তাই বলি যে দব্যিতে এত আসক্তি, সেই দিব্যিই জগন্নাথকে উছুগু্য করব। তাই বলে তুই বাগান নষ্ট করবি? ছেলে।পুলে খাবে না?

ছেলেপুলে বুড়ো যুবো। আমের ভক্ত সবাই। আমের মরশুমে দিনে এককুড়ি দেড়কুড়ি আম খাওয়া তো কিছুই না

অবশ্য সব আমি সবাই খায় না।

অর্থাৎ পায় না।

সংসারের সদস্যদের শ্রেণী হিসেবেই আমের শ্রেণী হিসেব করে ভাগ হয়। কর্তাদের নৈবেদ্যে লাগে জোর কলম গোলাপখাস, ক্ষীরসাপাতি, নবাব পছন্দ, বাদশা ভোগ, ঢাউশ ফজলী ইত্যাদি, গিন্নীদের জন্যে সরানো থাকে। পেয়ারাফুলি, বেলসুবাসী, কাশীর ছিনি, সিঁদুরে মেঘ।

আর বৌ ঝি ছেলেপুলেদের ভাগ্যে জোটে রাশির আম। তা রাশি রাশি না পেলে যাদের আশ মিটবে না। তাদের জন্যে রাশির বরাদ্দ ছাড়া আর কি বরাদ্দ হতে পারে? বাড়ির ঝুঁড়ি-ঝুড়িতেই কি ওদের আশা মেটে? দু বেলাই জলখাবার ঝুড়ি ঝুড়ি তো পায়, কারণ গিন্নীরা প্রকৃতির এই দাক্ষিণ্যের সময় মুড়ি ভাজা পর্বটি থেকে কিঞ্চিৎ রেহাই নেন। কিন্তু হলে কি হবে, বাড়ি থেকে মধুকুলকুলি আমের পাহাড় শেষ করেই ওরা তক্ষুণি ছোটে হয়তো বা বৌ পালানে কি বাঁদর ভ্যাবা-চ্যাঁকা আমের বাগানে। বাঘা তেঁতুলের বাবা জাতীয় সেই আমগুলি পার করার সহায় হচ্ছে মুঠো মুঠো নুন অবশ্যি তুচ্ছ হলেও বস্তুটা সংগ্ৰহ করতে বালক-বাহিনীকে বিশেষ বেগ পেতে হয়, কারণ ওর আশ্রয়স্থল যে একেবারে রান্না-ভাঁড়ারে। যা নাকি সম্পূর্ণ গিন্নীদের এলাকা। আর যে গিন্নীরা হচ্ছেন একেবারে সহানুভূতিহীনতার প্রতীক। ছেলেপুলেদের সব কিছুতেই তো তাঁরা খড়গহস্ত। নুন একটু চাইতে গেলেই প্রথমটা একেবারে তেড়ে মারতে আসবেন জানা কথা! তবে নাকি ছেলেগুলোর খুব ভাগ্যের জোর যে প্রায় সব সময়ই ওরা ওনাদের অস্পৃশ্য। কাজেই মারতে আসলেও মারতে পারেন না। তার পর বহুবিধ কাকুতি-মিনতির পর যদি বা দেবেন। তো, সে একেবারে সোনার ওজনে। দেবেন। আর সঙ্গে সঙ্গে বলবেন যাচ্ছিস তো টক বিষ আমগুলো গিলতে? ঘরে এত খায়। তবু আশ মেটে না গা! কী রাক্ষুসে পেট গো, কী লক্ষ্মীছাড়া দিশে! মরবি মরবি, রক্ত-আমাশা হয়ে মরবি। সবগুলো একসঙ্গে মনসাতলায় যাবি। যত সব পাপগুলো একত্তর জুটেছে।

গালমন্দ-বিহীন লবণ?

সে ওরা কল্পনাও করতে পারে না।

তবে সত্য আগে আগে চরণ মুদির দোকান থেকে বেশ খানিকটা সংগ্রহ করে আনতে পারত, কিন্তু ইদানীং অর্থাৎ বড় হয়ে ইস্তক মুদির দোকানে ভিক্ষে করতে যেতে লজ্জা করে। বড় জোর দূরে দাঁড়িয়ে থেকে নিতান্ত একটা শিশুকে লেলিয়ে দেয়।

কবরেজের মেয়ে বলে সমাজে সত্যর কিছুটা প্ৰতিষ্ঠা আছে।

সে প্রতিষ্ঠার মর্যাদাটাও তো রাখতে হয়?

আজি দুপুরে আমবাগান-পর্বে সত্য ছিল, তার পর কখন একসময় যেন বাড়ি চলে গিয়েছিল।

খেঁদি একটু কল্পনা-প্রবণ, তাই সে বলে, সত্যর শ্বশুরবাড়ি থেকে কেউ আসে নি তো?

দূর! শ্বশুরবাড়ি থেকে আবার শুধু শুধু কেউ আসবে কেন? আর আসেও যদি, সত্যর সঙ্গে কি? যে আসবে সে তো চণ্ডীমণ্ডপে বসবে।

সহসা পুঁটি চেঁচিয়ে ওঠে, আসছে আসছে!

আসছে! বাবা, ধড়ে পেরাণ পাই।

এত দেরি কেন রে সত্য? আমরা সেই কখন থেকে জল ঠাণ্ডা করছি!

সত্য বিনাবাক্যে গম্ভীর ভাবে ঘাটের পৈঠের ভাঙাচোরা বাঁচিয়ে জলে নামে।

কি রে সত্য, মুখে কথা নেই যে? বাবা, আজ এত পায়া-ভারী কেন রে তোর?

সত্যি একমুখ জল নিয়ে কুলকুচো করে ঠোঁট বাকিয়ে বলে পায়া-ভারী আবার কী! মনিষ্যির রীত-চরিত্তির দেখে ঘেন্না ধরে গেছে!

ওমা, কেন রে? কাকে দেখে? কার কথা বলছিস?

সত্য জ্বলন্ত স্বরে বলে, বলছি আমাদের জটাদার বৌয়ের কথা। গলায় দড়ি! গলায় দড়ি! গলায় দড়ি মেয়েজাতের কলঙ্ক!

সত্যের বয়েস ন বছর, অতএব সত্যর পক্ষে এ ধরনের বাক্যবিন্যাস অসম্ভব, এমন কথা ভাববার হেতু নেই। শুধু সত্য কেন-নেহাৎ ন্যাকাহারা মেয়ে ছাড়া, সে আমলে আট-ন বছরের মেয়েরা এ ধরনের বাক্যবিন্যাসে পোক্তই হত! না হবে কেন? চার বছর বয়স থেকেই যে তাকে পরের বাড়ি যাওয়ার তালিম দেওয়া হত, আর বয়স্কদের মহলেই বিচরণের ক্ষেত্র নির্বাচন করা হত। সে ক্ষেত্রে শিশু বলে কোন কথাই বাদ দেওয়া হত না তাদের সামনে।

কাজেই সত্য যদি কারো উপর খাপাপা হয়ে তাকে মেয়েজাতের কলঙ্ক বলে অভিহিত করে। থাকে, আশ্চর্য হবার কিছু নেই।

পুণ্যি তাড়াতাড়ি প্রশ্ন করে ওঠে, কোন রে, কি হয়েছে?

যম জানে! বলে প্রথমটা খানিকক্ষণ যমের উপর ভার ফেলে রেখে, অতঃপর সত্য মুখ খোলে, জন্মে আর ওর মুখ দেখছি না! ছি:। ছি! গেছলাম! বলি আহা, সোয়ামীর শাউড়ীর ভয়ে রোগের ওষুধ টুকু পর্যন্ত খেতে পায় না, যাই একবার দেখে আসি কেমন আছে। সেজপিসী তারকেশ্বর গেছে শুনেছি, মনটা তাতেই আরও খোলসা ছিল। ওমা, গিয়ে ঘেন্নায় মরে যাই, কী দুষপিবিত্তি, কী দুষপিবিত্তি!

এরা শঙ্কিত দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকে, না জানি কোন ভয়ঙ্কর কাহিনী উদঘাটন করে বসে সত্য।

শুধু পুণ্য ভয়ে ভয়ে বলে, কি দেখলি রে?

কি দেখলাম? বললে পেত্যয় করবি? দেখি কিনা ঘরে জটাদা বসে, আর বৌ। কিনা তাকে পান সেজে দিচ্ছে, আর হাসি-মস্করা করছে।

জটাদা?

খেঁদি পুঁটি সকলে একযোগে বলে ওঠে, ও হরি! এতেই তোর এত রাগ! শাউড়ী বাড়ি নেই, তাতেই বুকের পাটাটা বেড়েছে আর কি।

বুকের পাটা বেড়েছে বলে পান। সেজে খাওয়াবে? হাসি-মস্করা করবে? সত্য যেন ফুলতে থাকে।

পুণ্যি আরও ভয়ে বলে, তা পরপুরুষ তো আর নয়? নিজের সোয়ামী—

নিজের সোয়ামী! সত্য ঝট্‌পট্‌ বার-দুই কুলকুচো করে বলে, খ্যাংরা মারো অমন সোয়ামীর মুখে! যে সোয়ামী লাথি মেরে যমের দক্ষিণ দোরে পাঠায় তার সঙ্গে আবার হাসি-গপপ? গলায় দিতে দড়ি জোটে না? আবার আমায় কি বলেছে জানিস? আমার সোয়ামী আমায় মেরেছে, তোমায় তো মারতে যায় নি। ঠাকুরঝি? তোমার এত গায়ে জ্বালা কেন যে ছড়া বেঁধে গালমন্দ করতে আস? এর পর আবার আমি ওর মুখ দেখব?

আঁচলটাকে গা থেকে খুলে জোরে জোরে জলের ওপর আছড়াতে থাকে সত্য।

সখীবাহিনী কিঞ্চিৎ বিপদে পড়ে।

ওরা অভিযুক্ত আসামিনীকে খুব একটা দোষ দিতে পারে না, কারণ স্বামী একদা একদিন বেদম মেরেছে বলে যে জন্মে আর সে স্বামীকে পান সেজে খাওয়ানো চলবে না, এতটা কঠোর ক্ষমাহীন মনোভাব তাদের পক্ষে আয়ত্ত করা শক্ত। অথচ সত্যর কথার প্রতিবাদ চলে না, সত্যর কথায় সমর্থন না করলে চলে না।

কিন্তু ও কি! ও কি! ও কিসের শব্দ!

হঠাৎ বুঝি ওদের বিপদে রক্ষা করলেন মধুসূদন। পুকুরপাড়ের রাস্তায় তালগাছের সারির ওদিকে যেন অশ্বক্ষুরধ্বনি ধ্বনিত হল।

ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ না?

ঘোড়ায় চড়ে কে আসে?

পুণ্যি তড়বড় করে ঘাটে উঠে এগিয়ে দেখে পড়ি তো মারি করে ছুটে আসে, এই সত্য, মেজদা!

মেজদা!

অর্থাৎ রামকালী!

সত্য অবিশ্বাসের হাসি হেসে মুখ ভোঙিয়ে বলে ওঠে, স্বপ্ন দেখছিস নাকি? বাবা না জিরেটে গেছে?

আহা, তা সেখেনে তো আর বাস করতে যায় নি? আসবে না?

ইত্যবসরে ক্ষুরধ্বনি একবার কিছুটা নিকটবর্তী হয়েই ক্রমশ দূরবতী হয়ে যায়।

সত্য গলা বাড়িয়ে একবার দেখতে চেষ্টা করে, তারপর নির্লিপ্তভাবে বলে, যেমন তোমার বুদ্ধি! বাবা বুঝি ঘোড়ায় চড়ে জিরেটে গেছল? নাকি পালকিটা মাঝরাস্তায় ঘোড়া হয়ে গেল!

পালকি! তাও তো বটে! পুণ্যি দ্বিধাযুক্ত স্বরে বলে, আমি কিন্তু সদ্য দেখলাম মেজদা আর মেজদার ঘোড়াটা। বাড়ির দিকেই তো গেল।

তা গেল বটে। তবে কি হঠাৎ জীরেটের সেই রুগীর নেয়-দেয় অবস্থা ঘটেছে! তাই হঠাৎ কোন মোক্ষম ওষুধের দরকার পড়েছে? যার জন্যে পালকি রেখে ঘোড়ায় চড়ে ছুটে আসতে হয়েছে চিকিৎসক রামকালীকে?

খেঁদি বলে, যাই হোক বাপু সত্য, তুই বাড়ি যা। কবরেজ জ্যাঠা ভিন্ন এ গোরামে ঘোড়াতেই না চড়বে কে?

এ কথাও খাঁটি।

ঘোড়া আর আছেই বা কার? এ অঞ্চলে কালেকস্মিনে বর্ধমান রাজের কোন কর্মচারী কি কোম্পানির কোন লোক ঘোড়ার পিঠে চড়ে আসে, নইলে ঘোড়া কে কোথায় পাচ্ছে?

ঘাট থেকে উঠে পড়ে সত্য-বাহিনী।

এখন প্রথমটা সকলেরই সত্য-ভবনে অভিযান। কারণ ঘোড়া-রহস্য ভেদ না করে কে স্থির থাকতে পারবে?

ভিজে কাপড়ে জল সপৃসপিয়ে আর মিলের গোছা বাজিয়ে ওরা রওনা হল, কিন্তু এ কী তাজ্জব! এ যে একেবারে রূপকথার গল্পর মত!

সত্যদের বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছতে না পৌঁছতে হাঁ হয়ে দেখে ওরা রামকালী ফের ফিরে যাচ্ছেন ঘোড়া হাঁকিয়ে, শুধু এবারে বাড়তির মধ্যে তাঁর পিছনে পিঠ আঁকড়ে আর একজন বসে।

সে জনটি হচ্ছে, সত্যর বড়দা।

রামকালী চাটুয্যের বৈমাত্র ভাই কুঞ্জবেহারীর বড় ছেলে রাসবিহারী।

পুণ্যির কথাই সত্যি বটে। অশ্বারোহী ব্যক্তি রামকালীই। কিন্তু এ নিয়ে এখন আর বাহাদুরি ফলায় না পুণ্যি, শুধু হাঁ করে অনেকক্ষণ ঘোড়ার পায়ের দাপটে ঠিকরে ওঠা ধুলোর ঝড়ের দিকে তাকিয়ে থেকে নিঃশ্বাস ফেলে বলে, ব্যাপার কি বল তো?

আমিও তো তাই ইনতাম করছি। সত্য অবাক ভাবে বলে, ওষুধ নিতে আসবে। যদি বাবা, তো বড়দাকে পিঠে বেঁধে নিয়ে যাবে কেন?

সেই তো কথা!

প্ৰচণ্ড গরম, তবু সপ্তসাপে ভিজে কাপড়ের ওপর হাওয়ার ডানা বুলিয়ে যাওয়ার দরুন গা-টা কেমন সিরসির করে এল। সত্য এবার হা করে ভাব করে বিচক্ষণের সুরে বলে, নে নে চল, দোরে দাঁড়িয়ে গুলতুনি করে আর কি হবে? বাড়ি গেলেই টের পাব, কি হয়েছে! তোরা যা, ভিজে কাপড় ছেড়ে আয়। আমি দেখি গিয়ে কি হয়েছে!

কি হয়েছে!

যা হয়েছে তা একেবারে সত্যর হিসেবের বাইরে। শুধু সত্যর কেন, সকলেরই হিসেবের।ংরে। ঘোড়ায় চড়ে ঝড়ের বেগে এসে সমগ্র সংসারটার উপর যেন প্ৰকাণ্ড একখানা পাথর ছুঁড়ে মেরে ফের ফিরে গেছেন রামকালী। সেই পাথরের আঘাত সহজে কেউ সামলাতে পারছে না।

সত্য ভেতরবাড়ির উঠোনে ঢুকে দেখল, উঠোনের মাঝখানে বসানো মরাই দুটোর মাঝখানে যে সরু জমিটুকু, সেইখানে দাঁড়িয়ে আছে বড়জেঠী, ঠিক যেন কাঠের পুতুলটি, আর দাওয়ায় পৈঠেয় গলে হাত দিয়ে কাঠ হয়ে বসে তার ঠাকুমা। এবং দাওয়ার ওপর জটলা বেঁধে বাড়ির আর সবাই। শুধু যা পিসঠাকুমাই অনুপস্থিত।

অবশ্য সেটাই। স্বাভাবিক, কারণ তিনি এই যবনাচারী দাওয়ায় কখনো পা ঠেকান না। এ দাওয়ায় রাস্তা-বেড়ানো ছেলেপুলে ওঠে, কর্তাদের খড়ম ওঠে।

পিসঠাকুমা না থাক, আর সবাই তো জটলা করছে। কেন করছে? অথচ কারো মুখে বাক্যি নেই কেন? ফিসফিস কথা, ঘোমটার ভেতর হাত-মুখ নাড়ানাড়ি। সত্য ঠাকুমার যতটা সম্ভব গা বাঁচিয়ে গা ঘেঁসে বসে পড়ে সাবধানে ইশারায় প্রশ্ন করে, কি হয়েছে গো ঠাক্‌মা?

দীনতারিণী নীরব।

অতঃপর সত্য সরব।

ও ঠাকমা, বাবা আমন করে ছুটে এসেই আবার কোথায় গেল?

কী গেরো! কথার উত্তর দিচ্ছ না কেন গো? ও ঠাকমা, বাবা জীরেট থেকে আমন হাঁপাতে হাঁপাতে ঘোড়া ছুটিয়ে এলই বা কেন, আবার ছুটিলই বা কেন? অ ঠাকমা, বলি তোমাদের সব বাক্যি হরে গেল কেন?

একবারও দীনতারিণীর ঠোঁট নড়ে না, তবে ঠোঁট নাড়েন তাঁর সেজজা শিবজায়া। শুধু ঠোঁট নয়, সহসা পা মুখ সব নড়িয়ে তিনি বলে ওঠেন, বাক্যি হরে যাবার মতন কাণ্ড ঘটলে আর হরবে না? তোর বাবা যা অভাবনী কাণ্ড করে গেল?

বাবা বাবা, খুলেই বল না। স্পষ্ট করে! বাবা জীরেট থেকে ঘোড়া ছুটিয়ে এসেই তক্ষুনি আবার কোথায় গেল?

অ, তবে তো দেখেইছিল। তবে আর ন্যাকা সাজছিল কেন? রাসুকে নে গেল তোর বাবা বে দিতে।

বে দিতে! ধ্যেৎ! সত্য পরিস্থিতির মর্যাদা ভুলে হি হি করে হেসে গড়িয়ে পড়ে আহা, আমায় যেন ন্যাক পেয়েছে। সেজঠাকুমা, তাই পাগল বোঝাচ্ছে। বড়দার বুঝি বে দিতে বাকি আছে? বলে ছেলের বাবাই হয়ে গেল বড়দা!

গেল তায় কি? এবার হঠাৎ দীনতারিণী মৌন ভঙ্গ করে নাতনীকে ধমকে ওঠেন, বড্ড তো দেখছি ট্যাকটেকে কথা হয়েছে তোর? ছেলের বাবা হলে আর বে করতে নেই? মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়?

সত্য উত্তর দেবার আগে শিবজায়াই সাংসারিক মাৎস্যন্যায় ভুলে ফস করে বড়জায়ের মুখের ওপর বলে বসেন, মহাভারত অশুদ্ধর কথা হচ্ছে না দিদি, তবে এও বলি রামকালী যে একেবারে কাউকে চোখে কানে দেখতে দিলে না, চিলের মত ছোঁ। মেরে নে গেল ছেলেটাকে, বালস-পোয়াতি বেঁটা, যাত্রাকালে সোয়ামীকে একবার দূর থেকে চোখের দেখাটুকু পর্যন্ত দেখতে পেল না, এটা কি ভাল হল?

কখন যে ইতিমধ্যে মোক্ষদা এসে দাঁড়িয়েছেন এপাশের বেড়ার দরজা দিয়ে, এবং আলোচনার শেষাংশটুকু শুনে নিয়েছেন, সে আর কেউ টের পায় নি। মোক্ষদার থান ধুতি গুটিয়ে হাঁটুর ওপর তোলা, কাঁধে গামছা অর্থাৎ স্নানে যাচ্ছেন মোক্ষদা। অবিশ্যি স্নানে যাচ্ছেন বলেই যে এই ভেতর বাড়ির অর্থাৎ শয়নবাড়ির উঠোনে তিনি পা দিতেন তা নয়, তবে আজকের কথা স্বতন্ত্র। আজকের উত্তেজনায় অত মরণ-বাচন জ্ঞান রাখলে চলে না, আজ নয় ঘাটে দু-দশটা ড়ুব দিয়ে ফের দীঘিতে ড়ুব দিতে যাবেন, তবে এদের মজলিশে যোগ দেওয়াটা দরকার।

মোক্ষদা সেজভাজের কথাটুকু শুনতে পেয়েছেন, এবং তাতেই সমগ্ৰ নাটকটি অনুধাবন করে ফেলেছেন। তাই তিনি তিন আঙুলে হেঁটে খানিকটা এগিয়ে এসে গলা বাড়িয়ে বলে ওঠেন, কী বললে সেজবৌ, কী বললে? আর একবার বল তো শুনি?

শিবজায়া অবশ্য আর একবার বললেন না, শুধু মাথার কাপড়টা অল্প টেনে মুখটা একটু ফেরালেন।

মোক্ষদা একটু বিষ-হাসি হেসে বলেন, বলতে অবিশ্যি আর হবে না, কানে প্রবেশ করেছে সবই। তবে ভাবছি। সেজবৌ তুমি হঠাৎ এমন ভট্টচায্যি হয়ে উঠলে কবে থেকে? যাত্রাকালে রাসুর আমাদের পরিবারের সঙ্গে চোখাচৌখি হয় নি এই আক্ষেপে মরে যোচ্ছ তুমি? কলি আর কত পুন্ন হবে? চারকাল হয়ে তো কলি এখন উপচোচ্চে। শুভকাজে যাত্রাকালে লোকে ঠাকুর-দেবতার পট দেখে বেরোয়, গুরুজনের চরণ দর্শন করে বেরোয় এই তো জানি, জেনে এসেছি। এতকাল। পরিবারের বদন দর্শন না করে বেরোলে জাত যায়, এটা তুমিই প্রেথম শোনালে সেজবৌ।

শিবজায়া ননদকে ভয় করলেও এতজনের মাঝখানে হেরে যেতে রাজী হন না, তাই বলে ওঠেন, রাসুর কথা আমি বলি নি ছোট্ৰঠাকুরঝি, বড় নাত-বৌয়ের কথা বলছি। আবাণী জানল না। শুনল না। আচমকা মাথায় পাহাড় পড়ল, আপনার সোয়ামী একা আপনার থাকতে থাকতে একবার শেষ দেখাও দেখতে পেলে না; সেই কথা হচ্ছে।

মোক্ষদা সহসা খলখলিয়ে হেসে ওঠেন, অ সেজবৌ, আর কেন ঘরে বসে আছ? যাত্রার পালা বঁধ না। সত্য পয়ার বেঁধেছে—তুমিই বা বাকি থাক কেন? যা তোমাদের মতিগতি দেখছি, এ আর গোরস্ত-ঘরের যুগ্যি নয়। বুড়ো-মাগী তুমি, চারকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে, লজ্জা এল না ও কথা মুখে আনতে? সোয়ামী কি মণ্ডা মিঠাই, যে একলা আস্তটা না খেতে পেলে পেট ভরবে না, ভাগ হয়ে গেলে প্ৰাণ ফেটে যাবে? ছিঃ ছিঃ! একটা ভদরলোকের কত বড় বিপদ থেকে উদ্ধার করতে ছুটীল রামকালী, আর তার কাজের কিনা ব্যাখ্যানা বসেছে!

বড়দের এই বাকযুদ্ধের মাঝখানে সত্য হাঁ করে তাকিয়েছিল, মোক্ষদার কথা শেষ হতেই হঠাৎ ঠাকুমার কোলের গোড়া থেকে উঠে সরে এসে বলে বসে, সেজ ঠাকুমা তো ঠিকই বলেছে পিসঠাকুমা। নিয্যসি বাবার অন্যাই হয়েছে।

বাবার অন্যায়! সন্দেহযুক্ত নয়, একেবারে নিয্যস!

উঠোনে কি বাজ পড়ল!

কলিকাল শেষ হয়ে কি প্ৰলয় এল!

০৮. দুঃসংবাদের সঙ্গে সঙ্গে

দুঃসংবাদের সঙ্গে সঙ্গেই অন্দরে কান্নার রোল উঠল। এ কী হরিষে বিষযাদ! এ কী বিনামেঘে বজ্রাঘাত! এমন দুর্ঘটনা আর কবে কার সংসারে ঘটেছে? এত বড় সর্বনাশের কল্পনা দুঃস্বপ্নেও কে কবে করেছে?

এই তো এইমাত্র মেয়ে কলাতলায় শিলে দাঁড়িয়ে স্নান করে আইবুড়ো মুচি ভেঙে, গায়ে-হলুদের দরুন কোরা লালপাড় শাড়িটুকু পরে চুল বিঁধতে বসেছে, পাড়ার শিল্পী মহিলার ঝাঁক কনের কেশ-রচনায় কে কত নৈপুণ্য দেখাতে পারেন তারই আলোচনায় অন্দরের দালান মুখর করে তুলেছেন, হঠাৎ বাইরের মহল থেকে আগুনের হলকার মত এই সংবাদ এসে ছড়িয়ে পড়ল।

পরিণামে? দাবানল!

অতি বড় অবিশ্বাস্য হলেও এ যে বিশ্বাস না করে উপায় নেই। কারণ সংবাদ এনেছেন। আর কেউ নয় স্বয়ং রামকালী। যার সম্পর্কে বিন্দুমাত্ৰও সন্দেহ পোষণ করা অসম্ভব। নচেৎ মিথ্যা দুঃসংবাদ বুট কুর বিয়ে ভাল করে দিয়ে মজা দেখবে এমন আখীয়েরও অভাব নেই। কিন্তু ইনি হচ্ছেন রামকাল।

কাজেই সংবাদ মিথ্যা হতে পারে, এমন আশার কণিকামাত্ৰও নেই। নাঃ, কোন আশাই নেই। তা ছাড়া কবরেজ নিজের চোখে দেখে এসেছেন। পাত্রের শিয়রে শিমন।

অতএব কোরা শাড়ি জড়ানো বছর আষ্টেকের সেই হতভম্ব মেয়েটাকে ঘিরে প্রবল দাপটে কান্নার যা রোল উঠেছে তাতে ভয়ে মেয়েটার নাড়ি ছেড়ে যাবার যোগাড় হচ্ছে।

বিয়ের দিন যাত্ৰা-করা-বর মৃত্যুরোগ নিয়ে যাত্ৰা ভঙ্গ করে বাড়ি ফিরে গেলে এবং বিয়ের লগ্ন ভ্ৰষ্ট হলে এমন কি সর্বনাশ সংঘটিত হতে পারে, সেটা বেচারার বুদ্ধির অগম্য, অনিষ্ট যদি কিছু হয় সে নয়। তার ঠাকুর্দার হবে, তার কি?

কিন্তু তার কি, সে কথা সে কিছু না বুঝলেও মহিলার দল তাকে ধরে নাড়া দিয়ে দিয়েই তারস্বরে চেঁচিয়ে চলেছেন, ওরে পটলী, তোর কপালে এমন ছাই পোরা ছিল, একথা তো কেউ কখনও চিন্তে করি নি রে। ওরে লগ্ন-ভ্রেষ্ট মেয়ে গলায় নিয়ে আমরা কী করব রে! ওরে এর চাইতে ৩োকেই কেন শমনে ধরল না রে, সে যে এর থেকে ছিল ভাল! ওঁরা লুটোপুটি করতে থাকেন, আর প৮লী কাঠ হয়ে বসে থাকে। বসে বসে শুধু এইটুকু বিচার করতে পারে সে যে এত সব কাণ্ডকারখানা কিছুই হত না, যদি পটলীই রাতারাতি ওলাউঠো হয়ে মরত!

ওদিকে চণ্ডীমণ্ডপে লক্ষ্মীকান্ত বাড়ুযে মাথায় হাত দিয়ে পাথরের পুতুলের মত বসে আছেন, আর সেই পুতুলের মস্তিষ্কের কোষে কোষে ধ্বনিত হচ্ছে, এ কী করলে ভগবান! এ কী করলে ভগবান!

রামকালী চলে যাওয়ার পর থেকে লক্ষ্মীকান্ত আর একটিও কথা বলেন নি, অপর কেউ তাঁকে সম্বোধন করতে সাহস পায় নি। ওদিকে বড় ছেলে শ্যামকান্তও বিশুষ্ক মুখে ঘাটের ধারে শিবতলায় গিয়ে বসে আছে চুপচাপ, বাপের দিকে যাবার সাহস তার নেই। তার জামাই হচ্ছে বটে কিন্তু বয়সটা আর তার কি? এখনও তো তিরিশের নিচে। বাপকে সে যমের মত ভয় করে।

পটলীর মা বেহুলাও মুখ লুকিয়েছে ভাড়ার ঘরের কোণে। নিজেকেই তার সব চেয়ে অপরাধিনী মনে হচ্ছে। নিশ্চয়ই মহাপাপিষ্ঠা সে, নইলে তার মেয়ের বিয়ের ব্যাপারেই এত বড় দুর্লক্ষণ দুর্ঘটনা! সকলেই ফিসফাস বলাবলি করছে মেয়ে নাকি তার আস্ত রাক্ষসী, তাই বাসায় না। উঠতেই সোয়ামীটার মাথা কড়মড়িয়ে চিবিয়ে খেল। থাকুক এখন বেহুলা চিরজন্ম ওই দ’পড়া সর্বনাশী মেয়েকে গলায় গেঁথে। জাত ধৰ্ম কুল সবই গেল, রইল। শুধু আমরণ যম-যন্ত্রণা।…

হ্যাঁ, বিয়ের রাত্রে বর-বিভ্ৰাট কি আর হয় না? ছাঁদনাতলা থেকেও বর উঠে যেতে দেখেছে অনেকে, কিন্তু সে সব অন্য কারণে। হয়তো পণের টাকা ঠিক সময়ে হাজির করতে না পারার জন্যে বাচসার ফলে, নয়তো বা কোন হিতৈষীর দ্বারা কোন পক্ষের কুলের ঘাটতির কথা প্ৰকাশ হয়ে পড়ায়, অথবা কন্যাপক্ষের কনেকে বদলে ফেলে কালো কুশ্ৰী কনে গছিয়ে দেবার চেষ্টার ফলে, বাচসা থেকে হাতাহাতি মারামারি হতে হতে বরপক্ষ রেগো-টেগে বর উঠিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু তখনি তার পারাপারও হয়ে যায়।

কারণ লগ্ন ভ্ৰষ্ট হয়ে গেলেই মেয়ে চিরকালের মত আধাবিধবা হয়ে বাপের ঘরে বসে থাকবে, এই আক্ষেপে পাড়ার কেউ না কেউ করুণাপরবশ হয়ে কোমর বেঁধে লেগে গিয়ে রাতারাতি অন্য পাত্তর যোগাড় করে আনেন। অতএব ভদ্রলোকের জাত মান রক্ষা পায়।

কিন্তু এ যে একেবারে বিপরীত কাজ! এ যে সদ্য রাক্ষসী কন্যা!

এ হেন পতিঘাতিনী মেয়ের জন্যে আপনার ছেলেকে ধরে দেবে এমন মহানুভব ত্ৰিজগতে কে আছে?

না, বেহুলার এই মেয়ের জন্যে রাতারাতি পাত্রসংগ্ৰহ হওয়ার আশা দূরাশা। রামকালী কবরেজ অবশ্য একটু নাকি আশ্বাস দিয়ে গেছেন, চেষ্টা দেখছি বলে; কিন্তু বোঝাই তো যাচ্ছে সেটা সম্পূর্ণ স্তোকবাক্য! এত বড় দুঃসংবাদটা বাড়ি বয়ে এসে দিয়ে গেলেন, মুখটা একটু হেট হল তো, তাই একটা অলীক স্তোক দিয়ে পালিয়ে গেলেন।

বেহুলা বোকা হতে পারে, কিন্তু একটু বুদ্ধি ধরে।

হায় মা ভগবতী, পটলী যে এত বড় অপয়া মেয়ে এ কথা তো কোনদিন বুঝতে দাও নি? ফুলের মত দেখতে মেয়ে, বাড়ির প্রথমা সন্তান, সকলের আদরের আদরিণী। আগানে-বাগানে হেসে খেলে বেড়িয়েছে এতদিন, ইদানীং সম্প্রতি ডাগরটি হয়েছে বলেই যা বাড়ির মধ্যে আটক ছিল। তা যেমন সুন্দরী তেমনি হাস্যবন্দনী, কে বলতে পেরেছে। এ মেয়ে সর্বনাশী রাক্ষসী?

শ্বশুর ঠাকুর তো বলেন পটলীর নাকি দেবগণ, তবে? দেবগণ কন্যে রাক্ষসগণের কপাল পেল কি করে? আর শুধুই কি আজ? ও মেয়ে যদি ঘরে থাকে সংসার তো ছারখারে যাবে।

মানদার পিসী তো স্পষ্টই বললেন সে কথা, কে নেবে মা ও মেয়েকে? কার বাসনা হবে সংসারটা ছারে-গোল্লায় দিই? ও চিরটা কাল এই দপড়া হয়ে পড়ে থাকবে। আর ঠাকুদার সংসারটা চিবিয়ে চিবিয়ে খাবে, এই আর কি!

বেহুলা ড়ুকরে কেঁদে ওঠে।

কাঁদতে কাঁদতে বলে, হে মা ওলাই বিবি, হে মা শেতলা, পটলীকে তোমরা নাও, ওরা যেন এ ভিটেতে তেরাত্তির না পোহায়।

মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে কাঁদতে থাকে বেহুলা!

কাঁদছে সবাই।

বাড়ির গিন্নী থেকে শুরু করে বিচুলিকাটুনি বাগদী মাগীটা পর্যন্ত। পরের দুঃখে কাঁদবার এত বড় সুযোগ জীবনে কবার আসে?

কাঁদছে না শুধু পটলী, যে হচ্ছে এই বিবাহবিভ্ৰাট নাটকের প্রধানা নায়িকা। সে শুধু অনেকক্ষন কাঠ হয়ে বসে থেকে সবে এইমাত্ৰ ভাবতে শুরু করেছে বিয়েটাই যদি না হয়, তা হলে এখনও পটলীকে উপুসী রেখেছে কেন এরা? কেন কেউ একবারও বলছে না, ওরে তোরা। তবে এখন পটলীকে দুটো মতিচুর কি দেদোমণ্ডা দিয়ে জল খেতে দে। পটলীর বুক থেকে পেট অবধি যেন মাঠের ধুলোর মতো শুকনো লাগছে।

কিন্তু পটলীর মুখে বুকে ধুলো বেটে যাচ্ছে, এ তুচ্ছ খবরটুকু ভাবতে বসবার সময় কার আছে? বরং পটলীর ওপর রাগে ঘৃণায় রি রি করছে সবাই!

শ্যামকান্ত বার দুই-তিন পুকুরপাড়ের দিক থেকে এসে উঁকি মেরে বাবাকে দেখে গেছে এবং যতবারই দেখেছে। বাবা তামাক খাচ্ছেন না, বাবার হাতে হুঁকো নেই, ততবারই তার প্রাণীটা ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু সাহস করে তামাক সেজে এনে সামনে ধরে দেবে এত বুকের বল নেই, অপেক্ষা শুধু পাড়ার কোন বিজ্ঞ ব্যক্তি এসে পড়েন। হয়তো তেমন কেউ এলে লক্ষ্মীকান্তের মৌনভঙ্গ হবে।

নিজের যতবড় বিপত্তিই হোক, মানীর মান অবশ্যই রাখবেন লক্ষ্মীকান্ত।

কিন্তু পাড়ার ভদ্রলোকদের আর আসতে বাকী আছে কার? তারা তো সবাই একে এসে গেছেন।

বেলা পড়ে এল।

অর্থাৎ সর্বনাশের সময় ঘনিয়ে এল।

এ হেন সময় শ্যামকান্তর প্রার্থনা পূর্ণ হল। এলেন রাখহরি ঘোষাল। রীতিমত বয়স্ক ব্যক্তি, অপেক্ষাকৃত দূরের পাল্লায় থাকেন, তাই এতক্ষণে এসে উঠতে পারেন নি। তিনি এসে নীরবে খড়ম খুলে ফরাসে উঠে বসলেন, ট্যাঁক থেকে শামুকের খোলের নস্যদানি বার করে দুটিপ নিলেন, তারপর ধীরে সুস্থে বললেন, ব্যাপার তো সব-ই শুনলাম লক্ষ্মীকান্ত, কিন্তু তুমি এভাবে মচ্ছিভঙ্গ হয়ে বসে থাকলে তো চলবে না।

লক্ষ্মীকান্ত বাঁড়ুয্যে বয়সের সম্মান রাখতে জানলেও ঘোষাল-ব্রাহ্মণের পায়ের ধুলো তো আর নেবেন না, তাই মাথাটা একটু নিচু ভাব করে ক্লান্ত স্বরে নেপথ্যের দিকে গলা বাড়িয়ে বলেন, ওরে কে আছিস, ঘোষাল মশাইকে তামাক দিয়ে যা।

থাক থাক, ব্যস্ত হতে হবে না। রাখহরি ঘোষাল বলেন, সন্ধ্যা তো আগতপ্ৰায়, এখন কি করবে। স্থির করলে?

স্থির আর আমি কি করব ঘোষাল মশাই, লক্ষ্মীকান্ত হতাশভাবে বলেন, স্বয়ং যজ্ঞেশ্বরই যে যজ্ঞ পণ্ড করতে বসলেন–

তা বলে তো ভেঙে পড়লে চলবে না লক্ষ্মীকান্ত, কোমর বাঁধতে হবে। কন্যাকে নির্দিষ্ট লগ্নে পাত্ৰস্থ করতেই হবে। লগ্ন কখন?

মধ্যরাত্রের পর।

উত্তম কথা। সব কিছু পাচ্ছি। তুমি। আমি বলি কি, তুমি আমার সঙ্গে একবার দয়ালের ওখানে চল–

দয়াল? দয়াল মুখুয্যে?

হ্যাঁ, দেখা যদি হাতেপায়ে ধরে রাজী করাতে পারো। এমনিতেই তো কালবিলম্ব হয়ে গেছে।

লক্ষ্মীকান্ত বিস্মিত দৃষ্টি মেলে বলেন, মুখুয্যে মশায়ের কাছে কার আশায় যাব ঠিক বুঝতে পারছি না তো ঘোষাল মশাই?

কার আশায় আবার লক্ষ্মীকান্ত, তুমি নেহাৎ শিশু সাজছ দেখছি। মুখুয্যের আশাতেই যাবে। নইলে রাতারাতি আর তোমার স্ব-ঘর পাত্র পাচ্ছি কোথায়?

লক্ষ্মীকান্ত কাতর মুখে বললেন, মুখুয্যে মশায়ের সঙ্গে পটলীর বিয়ে? পলটীকে আপনি দেখেছেন ঘোষাল মশাই?

দেখেছি বৈকি, রাখহরি একটু রসিকহাসি হাসেন, নাতনীকে তোমার দেখলে ওর নাম গিয়ে মুনিরও মন টলে, ঘরে মিললে আমিই এই বয়সে টোপর মাথায় নিতে চাইতাম। মুখুয্যেও তোমার গিয়ে, বয়েস হলে কি হয়, রসিক ব্যক্তি। সেই সেদিনও পথে পটলীকে দেখে বলছিল—

রাখহরি একটু থামেন।

লক্ষ্মীকান্ত কিঞ্চিৎ বিরক্তভাবে বলেন, কি বলছিলেন?

আহা দুষ্য কিছু নয়, তামাশা করে বলছিল, বাঁড়ুয্যের নাতনীটিকে দেখলে ইচ্ছে হয় আমার তৃতীয় পক্ষটিকে ত্যাগ করে ফেলে ফের ছাঁদনাতলায় গিয়ে দাঁড়াই।

লক্ষ্মীকান্ত এবার ঘোরতর বিরক্তির স্বরে বলেন, এ প্রসঙ্গ ত্যাগ করুন ঘোষাল মশাই।

বটে? ও! রাখহরি সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ান, বুঝতে পারি নি, কলি পূর্ণ হতে এখনও কিছু বিলম্ব  আছে ভেবেছিলাম। যাক শিক্ষা হয়ে গেল। আর যাই করি কারুর হিত করবার চেষ্টা করব না…

লক্ষ্মীকান্ত এবার ত্ৰস্ত কাতরতায় বলে ওঠেন, আপনি অযথা কুপিত হবেন না ঘোষাল মশাই, য়ামার অবস্থাটা বিবেচনা করুন। মুখুয্যে মশাই আমার চাইতেও প্রায় চার পাঁচ বৎসরের বয়োধিক, তা ছাড়া হাপানি রোগগ্ৰস্ত।

হাপানিটা যমরোগ নয় লক্ষ্মীকান্ত,  রাখহরি সতেজে বলেন, আয়ুৰ্বেদমতে ওটা হচ্ছে জীওজ ব্যাবি। তাছাড়া বয়সের কথা যা বলছি। ওটা কোন কথাই নয়, পুরুষের আবার বয়েস! বরং মুখুয্যের আর দুটি পত্নীর ভাগ্য-প্ৰভাবে তোমার ঐ অলক্ষণা পৌত্রীটির বৈধব্য-যোগ খণ্ডন হয়েও যেতে পারে।

কিন্তু ঘোষাল মশাই—

থাক, কিন্তুতে আর কাজ কি লক্ষ্মীকান্ত? তবে এটা জেনো, নিজেকে সমাজের শিরোমণি ভেবে যতই তুমি নিৰ্ভয়ে থাক, এর পর অর্থাৎ তোমার ওই পৌত্রীকে নির্দিষ্ট লগ্নে পাত্ৰস্থ করতে না পারলে সদব্ৰাহ্মণের তোমার গৃহে জলগ্ৰহণ করবেন। কিনা সন্দেহ। এই দুঃসময়ে অপোগণ্ড একটা ষ্টুড়ির বুড়ো বর যুবো বরের ভাবনা তুমি ভাবতে বসছ, কুলমর্যাদা ধর্মসংস্কার জাতি-মান এসব বিস্মৃতি হচ্ছে, এ একটা তাজ্জব বটে!

ঘোষাল মশাই আপনি আমায় মার্জন করুন, বরং পটলীকে নিয়ে আমি কাশীবাসী হব-

তা হবে বৈকি, রাখহরি একটু বিষহাসি হেসে বলেন, বে-মালিক সুন্দরী যুবতীর পক্ষে কাশীর মত উপর্যুক্ত স্থান আয় কোথায় আছে? নাতনী হতে কাশীবাসের সংস্থানটাও তোমার হয়ে

ঘোষাল মশাই! লক্ষ্মীকান্ত বিদ্যুৎবেগে উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, আপনি আমার গুরুজনতুল্য, তাই এযাত্রা রক্ষা পেয়ে গেলেন। নচেৎ–

নচেৎ কি করতে লক্ষ্মীকান্ত, বিদ্রেরূপহাস্যে মুখ কুঁচকে রাখহরি বলে ওঠেন, নচেৎ কি মারতে নাকি?

শোধ নেবার দিন এসেছে, শোধ নেবেন বৈকি ঘোষাল। ঘোষাল-বামুনদের প্রতি লক্ষ্মীকান্ত বাঁড়ুয্যের অন্তঃসলিলা তাচ্ছিল্য ভাবটা তো আর অবিদিত নেই রাখহরির! যতই বিনয়ের ভাব দেখাক বাঁড়ুয্যে, ওর চোখের দৃষ্টিতেই সেই উচ্চনীচ ভেদাভেদটা ধরা পড়ে যায়। আজ সেই প্রতিশোধ নেবার সময় এসেছে, ছাড়বেন কেন রাখহরি?

ঘোষাল মশাই, আমাকে রেহাই দিন। দুই হাত জোড় করে লক্ষ্মীকান্ত বলেন, ভগবান যদি আমার জাতি ধর্ম রক্ষা করতে ইচ্ছুক থাকেন, লগ্নের আগেই উপর্যুক্ত পোত্র পেয়ে যাব, নচেৎ মনে করব।–

লগ্নের আগেই উপর্যুক্ত পোত্র! রাখহরি। আর একবার বিদ্রপহাস্যে মুখ বাকিয়ে বলেন, পাত্রটিকে বোধ হয়। স্বয়ং তিনি বৈকুণ্ঠ থেকে পাঠিয়ে দেবেন!

লক্ষ্মীকান্ত কী একটা উত্তর দিতে উদ্যত হচ্ছিলেন, সহসা শ্যামকান্ত নিজের স্বভাববিরুদ্ধ উত্তেজনায় ছুটে এসে বলে, বাবা, কবরেজ চাটুয্যে মশাই আসছেন ঘোড়ায় চেপে পিছনে কাকে যেন নিয়ে।

অ্যাঁ! নারায়ণ!

লক্ষ্মীকান্ত উঠে দাঁড়াতে গিয়ে বসে পড়েন।

০৯. আসর-সাজানো বরাসনে

আসর-সাজানো বরাসনে বসবার সময় আর ছিল না, হুড়মুড়িয়ে একেবারে কলতলায় খেউরী করিয়ে স্নান করিয়ে নিয়ে সোজা নিয়ে যেতে হবে সম্প্রদানের পিঁড়িতে। সেই পিঁড়িতেই ধান দুর্বে আর আংটি দিয়ে পাকা দেখা অনুষ্ঠানের প্রথাটা পালন করে নিতে হবে।

অবিশ্যি সারাদিনে অন্তত বার পাঁচ-ছয় চর্বচোষ্য করে খেয়েছে রাসু, কিন্তু কি আর করা যাবে! এরকম আকস্মিক ব্যাপারে ওসব মানার উপায় কোথায়? বলে কত মেয়েরই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে ওঠ ছুড়ি তোর বিয়ে করে। এই তো লক্ষ্মীকান্তরই এক জ্ঞাতি ভাইপোর মেয়ের বিয়ে হল সেবার ঘুমন্ত মেয়েটাকে মাঝরাতে টেনে তুলে। গ্রামের আর কার বাড়িতে বর এসেছিল বিয়ে করতে, তার পর যা হয়। কোথা থেকে যেন উঠে পড়ল কন্যেপক্ষের কুলের খোঁটা, তা থেকে বাচসা অপমান, পাত্ৰ উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া।

যাক সে কথা, মূল কথা হচ্ছে, আকস্মিকের ক্ষেত্রে চর্বচোষ্য খেয়েও বিয়ের পিঁড়িতে বসা যায়।

কথা হচ্ছে—এখন রাসুকে নিয়ে।

রাসুর অবস্থাটা কি?

সে কি এখন খুব একটা অন্তর্দ্বন্দ্বে পীড়িত হচ্ছে?

তীব্র একটা যন্ত্রণা, ভয়ঙ্কর একটা অনুতাপ, প্রবল একটা মানসিক বিদ্রোহের আলোড়ন রাসুকে ছিন্নভিন্ন করছিল? বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ এই চিলের মত ছোঁ মেরে উড়িয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে এনে আরও একটা সাতপাকের বন্ধনে বন্দী করে ফেলবার চক্রান্তে কাকার ওপর কি রাগে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছিল রাসু?

না, রাসুর মুখ দেখে তা মনে হচ্ছে না।

বলির পাঁঠার অবস্থা ঘটলেও ভয়ে বলির পাঁঠার মত কাঁপছিলও না রাসু, শুধু কেমন একটা ভাবশূন্য ফ্যালফেলে মুখে নিজের নির্দেশিত ভূমিকা পালন করে চলছিল সে।

হ্যাঁ, এই আকস্মিকতার আঘাতে বেচারা রাসুর শুধু মুখটাই নয়, মনটাও কেমন ভাবশূন্য ফ্যালফেলে হয়ে গিয়েছে। সেখানে সুখ-দুঃখ ভাল-মন্দ দ্বিধা-দ্বন্দু কোন কিছুরই সাড়া নেই।

সে-মনে ধাক্কা লাগল স্ত্রী-আচারের সময়। সে ধাক্কায় খানিকটা সাড় ফিরল।

সে সাড়ে মনের মধ্যে একটা ভয়ানক কষ্ট বোধ করতে থাকল রাসু।

সাত এয়োতে মিলে যখন মাথায় করে শ্ৰী, কুলো, বরণডালা, আইহাঁড়ি, চিতের কাঠি, ধুতরো ফলের প্রদীপ সাজানো থালা ইত্যাদি নিয়ে বরকনেকে প্ৰদক্ষিণ করছিল, ধাক্কাটা লাগল। ঠিক তখন।

এয়োদের অবশ্য একগলা করে ঘোমটা, কিন্তু তার মধ্যেও আদল বলে একটা কথা আছে। যে বৌটির মাথায় বরণডালা, আর আদলটা ঠিক সারদার মতন, যদিও দিনের বেলা হঠাৎ সারদার মুখটা দেখলে রাসু ঠিক চিনতে পারবে কিনা সন্দেহ, তবুও আদালটা চেনে। ওই রকম বেগনী রঙের জমকালো একখানা চেলিও যেন সারদাকে মাঝে মাঝে পরতে দেখেছে রাসু। পাড়ার কারুর বিয়েটিয়েতে কি সিংহবাহিনীর অঞ্জলি দেবার সময়।

দেখেছে অবিশ্যি নিতান্ত দূর থেকে, আর ভাল করে তাকাবার সাহসও হয় নি। কারণ রাতদুপুরের আগে, সমস্ত বাড়ি নিযুতি না হওয়া পর্যন্ত কাছাকাছি আসবার উপায় কোথা? আর তখন তো। সারদা সাজসজ্জা গহনাৰ্গাটির ভারমুক্ত। তা ছাড়া সারদা ঘরে ঢুকেই কোণের প্রদীপটা দেয় নিভিয়ে। বলে, কে কমনে থেকে দেখে ফেলে যদি!

অবিশ্যি দেখবার পথ বলতে কিছুই নেই। রামকালী চাটুয্যের বাড়ির দরজা-কপট তো আর পাড়ার পাঁচজনের মত আমাকাঠের নয় যে ফাটা-ফুটো থাকবে, মজবুত কাঁঠালকাঠের লোহার পাতমোরা দরজা। দরজার কড়া-ছেকলগুলোই বোধ করি ওজনে দুপাঁচ সের। আর জানলা? সে তো জানিলা নয়, গবাক্ষ। মানুষের মাথা ছাড়ানো উঁচু তে ছোট্ট ছোট্ট খুপরি জানলা, সেখানে আর কে চোখ ফেলবে? তবু সাবধানের মার নেই।

গ্ৰীষ্মকালে অবশ্য পুরুষরা এ রকম চাপা ঘরে শুতে পারেন না, তাদের জন্যে চণ্ডীমণ্ডপে কিংবা ছাতে শেতলপাটি বিছিয়ে রাখা হয় ভিজে গামছা দিয়ে মুছে মুছে। সেখানে তাকিয়া যায়, হাতপাখা যায়, গাড় গামছা যায়, বয়ে নিয়ে যায় রাখাল ছেলেটা কি মুনিযটা। কর্তাদের অসুবিধে নেই।

প্ৰাণ যায় বাড়ির মহিলাদের, আর নববিবাহিত যুবকদের। তারা প্ৰাণ ধরে বারবাড়িতে শুতে যেতে পারে না, অথচ ভেতরবাড়ির ঘরের ভিতরের গুমোটিও প্রাণান্তকর।

তবে সারদার মত বৌ হলে আলাদা। সারদা এই গ্রীষ্মকালে সারারাত্তির পাখা ভিজিয়ে বাতাস করে রাসুকে।

প্ৰাণের ভেতরটা হঠাৎ কেমন মোচড় দিয়ে উঠল রাসুর। গতকাল রাত্ৰেও সারদা সেই পতিসেবার ব্যতিক্রম করে নি। রাসু মায়া করে বার বার বারণ করছিল বলে কচি ছেলেটার গরমের ছুতো করে নেড়েছে। সারদা। আর সব চেয়ে মারাত্মক কথা, যেটা মনে করে হঠাৎ বুকটা এমন মুচড়ে মুচড়ে উঠছে রাসুর, মাত্ৰ কাল রাত্তিরেই সারদা তাকে ভয়ানক একটা সত্যবদ্ধ করিয়ে নিয়েছিল।

বাতাস দিতে বারণ করার কথায় চুপি চুপি হেসে বলেছিল। সারদা, এত তো মায়া, এ মায়ার

রাসু ঠিক বুঝতে পারে নি, একটু অবাক হাসি হেসে বলেছিল, চিরকাল কি গরম থাকবে?

আহা তা বলছি নে। বলছি-, রাসুর বুকের একবারে কাছে সরে এসে সারদা বলেছিল, সতীনজ্বালার কথা বলছি। তখন কি আর মায়া করবে? বলবে কি আহা ওর সতীনে বড় ভয়!

রাসু যতটা নিঃশব্দে সম্ভব হেসে উঠেছিল, হেসে বলেছিল, হঠাৎ দিবাস্বপ্ন দেখছি নাকি! সতীনাওলা আবার কে দিলে তোমায়!

দেয় নি, দিতে কতক্ষণ?

অনেকক্ষণ! আমার আমন দু-চারটে বৌ ভাল লাগে না। দরকারও নেই।

সারদা। তবু জেরা ছাড়ে নি, আর আমি বুড়ো হয়ে গেলে? তখন তো দরকার হবে!

রাসু ভারি কৌতুক অনুভব করেছিল, আবার হেসে ফেলে বলেছিল, এ যে দেখি হাওয়ার সঙ্গে মনান্তর! তুমি বুড়ো হয়ে যাবে, আর আমি বুঝি জোয়ান থাকব?

আহা, পুরুষ ছেলে কি আর অত সহজে বুড়ো হয়? তা ছাড়া ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ ছেলে, দেখতে সোন্দর। এত পয়সাওলা মানুষ তোমরা, কত ভাল ভাল সম্বন্ধ আসবে তোমার, তখন কি আর আমার কথা–

হঠাৎ আবেগে কেঁদে ফেলেছিল সারদা।

অগত্যাই নিবিড় করে কাছে টেনে নিয়ে বৌকে আদর সোহাগ করে ভোলাতে হয়েছে রাসুকে। বলতে হয়েছে, সাধে কি আর বলেছি হাওয়ার সঙ্গে মনান্তর।! কোথায় সতীন তার ঠিক নেই, কাঁদতে বসলো! ওসব ভয় করো না।

আরও অনেক বাক্য বিনিময়ের পর পতিব্ৰতা সারদা স্বামীকে আশ্বাস দিয়েছিল, তা বলে তোমাকে আমি এমন সত্যবন্দী করে রাখছি নে যে আমি মরে গেলেও ফের বে করতে পারবে না। আমি মলে তুমি একটা কেন একশটা বে করো, কিন্তু আমি বেঁচে থাকতে নয়।

নয়, নয়, নয়! হল তো? তিন সত্যি করেছিল রাসু।

মাত্র গতরাত্রে।

আর আজ সেই রাসু, এই টোপর চেলি পরে কলাতলায় দাঁড়িয়ে আছে, এই মাত্তর যে গিন্নীমানুষটা বরণ করছিল সে বলে উঠেছে, কড়ি দিয়ে কিনলাম, দড়ি দিয়ে বাঁধলাম, হাতে দিলাম মাকু, একবার ভ্যা কর তো বাপু!

একটা মানুষকে কতবার কেনা যায়?

বাঁধা জিনিসটাকে আবার কি ভাবে বাঁধা যায়?

হায় ভগবান, রাসুকে এমন বিড়ম্বনায় ফেলে কি সুখ হল তোমার?

আহা, রাসু যদি ঠিক আজকেই গায়ে না থাকত! রুগী দিদিমাকে দেখতে এমন তো মাঝে মাঝে গা ছেড়ে ভিনগায়ে যায় রাসু। আজই যদি তাই হত! যদি দিদিমা বুড়ী টেসে গিয়ে ওখানেই আজ আটকে ফেলত রাসুকে!

যদি ঠিক এই সময় জ্ঞাতিগোত্তর কেউ মরে গিয়ে অশৌচ ঘটিয়ে রাখত রাসুদের! যদি রাসুরও এদের সেই বরটার মতন আচমকা একটা শক্ত অসুখ করে বসত!

তেমন কোন কিছু ঘটলে তো আর বিয়ে হতে পারত না!

কন্যাদায়গ্ৰস্ত বিপন্ন ভদ্রলোকের বিপদের কথা মনের কোণেও আসে না রাসুর, মরুক চুলোয় যাক ওরা, রাসুর এ কী বিপদ হল!

এ যদি কাকা রামকালী না হয়ে বাবা কুঞ্জবেহারী হত! বাবা যদি বলত, ভদ্রলোকের বিপদ উপস্থিত রাসু, দ্বিধা-দ্বন্দূের সময় আর নেই, চল ওঠ। তা হলেও হয়ত বা রাসু খানিক মাথা চুলকোতে বসত!

কিন্তু এ হচ্ছে যার নাম মেজকাকা, যার হুকুমের ওপর আর কথা চলে না।

অনেক যদির শেষে অবশেষে হতাশচিত্ত রাসু এ কথাও ভাবল, আর কিছুও না হোক, যদি গতরাত্রে রাসুগ্ৰীষ্মের কারণে বারবাড়িতে শুতে যেত! তা হলে তো ওই সত্যবন্দীর দায়ে পড়তে হত না তাকে!

এর পর কি আর জন্মে কোন দিন কোন ব্যাপারে রাসুকে বিশ্বাস করতে পারবে সারদা? বিশ্বাস করতে পারবে, এক্ষেত্রে রাসু বেচারাও সারদার মতই নিরূপায়? কোন হাত ছিল না তার! নাঃ, বিশ্বাস করবে না। সারদা, বলবে, বোঝা গেছে বোঝা গেছে! বেটা ছেলেদের আবার মন-মায়া! বেটা ছেলের আবার তিন-সত্যি!

কিন্তু কথাই কি আর কখনো কইবে সারদা? হয়তো জীবনে আর কথা কইবে না। রাসুর সঙ্গে, নয়তো দুঃখে অভিমানে মনের ঘেন্নায়— হঠাৎ রাসুর মনশ্চক্ষে বিশালকায় চাটুয্যেপুকুরের কাকচক্ষু জলটার দৃশ্য ভেসে ওঠে।

মনের ঘেন্নায় আজ রাত্তিরেই সারদা কিছু একটা করে বসবে না তো!

বুকের ভেতরটা কে যেন খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে চিরে চিরে নুন দিচ্ছে। রাসু বুঝি আর চুপ করে থাকতে পারবে না, বুঝি হাউমাউ করে চেঁচিয়ে উঠবে।

না, চেঁচিয়ে ওঠে নি। রাসু, তবে মুখের চেহারা দেখে কন্যাপক্ষের কে একজন বলে উঠল, বাবাজীর কি শরীর অসুস্থ বোধ হচ্ছে?

আবার বিয়ের বরের শরীর অসুস্থ!

লক্ষ্মীকান্ত একবার এই হিতৈষী-সাজা দুর্মুখটার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকালেন, তারপর গম্ভীর কণ্ঠে আদেশ দিলেন, ওরে কে আছিস, আর একখানা হাতপাখা নিয়ে আয় দিকি, নতুন নাতজামাইয়ের মাথার দিকে বাতাসটা একটু জোরে জোরে দে।

জোর জোর বাতাসে মুখের চেহারাটা রাসুর সত্যি একটু ভাল দেখাল। আর না দেখালেই বা কি, ততক্ষণে তো বিয়ে সাঙ্গ হয়ে গেছে, বরকনেকে লক্ষ্মীর ঘরে প্ৰণাম করিয়ে বাসরে বসাতে নিয়ে যাচ্ছে সবাই ধরে ধরে, পায়ের গোড়ায় ঘটি ঘটি জল ঢালতে ঢালতে।

সেখানে আবারও তো সেই সেবারের মতন উপদ্রব হবে! সারদার বাপের বাড়ির সেই সব মেয়েমানুষদের বাক্যি আর বাঁচালতা মনে করলে রাসুর এখনো হৃৎকম্প হয়।

আবার তেমনি ভয়ঙ্কর একটা অবস্থার মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়াতে হচ্ছে এখন রাসুকে!

সম্পূর্ণ অসহায়, সম্পূর্ণ নিরস্ত্র।

হঠাৎ রাসু দার্শনিকের মত নিজের ব্যক্তিগত দুঃখজ্বালা ভুলে একটা বিরাট দর্শনের সত্য আবিষ্কার করে বসে!

মানুষ কি অদ্ভুত নির্বোধ জীব!

এই কুশ্রী কদৰ্যতাকে ইচ্ছে করে জীবনে বার বার সোধে নিয়ে আসে, বার বার নিজেকে কানাকড়িতে বিকেয়!

পরদিন সকালে এখানে বৌছত্ৰ আঁকা হচ্ছিল।

ইচ্ছে-শখের বিয়ের মত নিখুঁত করে বাহার করে না হোক নিয়মপালাটা তো বজায় রাখতে হবে?

আর এত বড় উঠোনটায় যেমন-তেমন করে একটু আলপনা ঠেকাতেও এক সেরা পাঁচ পো চাল না ভিজোলে চলবে না।

তা সেই পাঁচপো চালই ভিজিয়ে দিয়েছিলেন রামকালীর খুড়ী নন্দরাণী। রামকালীর নিজের খুড়ী নয়, জেঠতুতো খুড়ী। সংসারের যত কিছু নিয়মলক্ষণ নিতাকিতের কাজের ভার নন্দরাণীর আর কুঞ্জর বৌয়ের উপর। কারণ ওরাই দুজন হচ্ছে একেবারে অখণ্ডপোয়াতি। কুঞ্জর বৌয়ের তো সাতটি ছেলেমেয়েই ষোটের কোলে খোসমেজাজে বাহাল তবিয়াতে টিকে আছে।

নন্দরাণীর অবশ্য মাত্র দু-তিনটিই।

সে যাক, বিয়ের ব্যাপারে নিয়মপালার কাজের সব কিছুই যখন নন্দরাণীর দখলে–তখন এক্ষেত্রেই বা তার ব্যতিক্রম হবে কেন? কাজেই রাসুর এই বিয়েটাকে মনে মনে যতই অসমর্থন করুন নন্দরাণী, পুরো পাঁচপো আতপ চালই ভিজিয়ে দিয়েছিলেন তিনি উঠোনে বৌছত্তর আঁকতে। দুধে আলতার প্রকাণ্ড পাথর বসিয়ে তাকে কেন্দ্র করে আর ঘিরে ঘিরে দ্রুতহস্তে ফুল লতা শাঁখ পদ্ম একে চলেছিলেন নন্দরাণী; সাঙ্গ হতে কিছুকিঞ্চিৎ দেরি আছে এখনও, সহসা রাখাল ছোঁড়া ঘর্মািক্ত কলেবরে ছুটতে ছুটতে এসে উঠোনের দরজায় দাঁড়িয়ে আকর্ণবিস্তৃত হাস্যে জানান দিল, বরকনে এয়েলো গো! আমি উই-ই দীঘির পাড় থেকে দেখতে পেয়েই ছুটে ছুটে বলতে এনু।

তা তো এলো- নন্দরাণী বিপন্নমুখে এদিক ওদিক তাকিয়ে ঈষৎ উচ্চকণ্ঠে বলে ওঠেন, দিদি, বরকনে এসে পড়ল শুনছি—

বরকনে! এসে পড়ল!

দীনতারিণী কুটনো ফেলে ছুটে এলেন, এখুনি এসে পড়ল? রামকালীর কি এতেও তাড়াহুড়ো?

বারবেলা পড়বার আগেই বোধ করি নিয়ে এসেছেন রামকালী।

যদিচ ভাসুরপো, তথাপি ধনে-মানে এবং সর্বোপরি বয়সে বড়। কাজেই নন্দরাণী রামকালী সম্পর্কে ছেন দিয়েই বাক্যবিন্যাস করেন। এখনো করলেন।

দীনতারিণী বারবেলা শব্দটায় মনকে স্থির করে নিয়ে বললেন, তা হবে। তা তোমাদের নেমকন্মর সব প্ৰস্তুত?

নন্দরাণী আরও ব্যস্ত হাতে হাতের কোজ সারতে সারতে বলেন, প্রস্তুত তো একরকম সবই, কিন্তু দুধটা যে ওথলাতে হবে! সেটা আবার এখন কে করবে?

দুধা! তাই তো!

ওথলানোর দরকার বটে!

বৌ এসে সদ্য উথলে পড়া দুধ দেখলে, সংসার নাকি ধন-ধান্যে উথলে ওঠে।

দীনতারিণী উদ্বিগ্ন মুখে প্রশ্ন করলেন, বড় বৌমা কোথায় গেলেন?

বড় বৌমা? সে তো রান্নাশালে! তাড়াহুড়ো করে একঘর বেঁধে রাখতে হবে তো! বৌ এসে দৃষ্টি দেবে।

বড় বৌমা অর্থ রাসুর মা। তাকে তাই বলে তো নন্দরাণী।

কারণ নন্দরাণী বয়সে রাসুর মার সমবয়সী হলেও মান্যে বড়, সম্পর্কে খুড়-শাশুড়ী, কাজেই বৌমা।

যাই হোক, কুঞ্জর বৌ রান্নাশালে।

অতএব দুধ ওথলাতে আর কাউকে দরকার। ওদিকে বর-কনে আগতপ্ৰায়।

দীনতারিণী মনশ্চক্ষে চারিদিক তাকিয়ে নেন, আর কে আছে? অখণ্ডপোয়াতি সোয়ামীর প্রথম পক্ষী!

দ্বিতীয় তৃতীয় পক্ষ দিয়ে তো আর পুণ্যকর্ম হবে না?

কে আছে?

ওমা, ভাবার কি আছে?

সারদাই তো আছে!

তাকেই ডাক দেওয়া হোক তবে। একা ঘরের কোণে বসে রয়েছে মনমরা হয়ে, কাজকর্মে ডাকলে তবু মনটা অন্যমনস্ক হবে–তা ছাড়া নতুন লোক নির্বাচনের সময়ই বা কোথা?

সত্য উঠোন পার হচ্ছিল তীরবেগে, দীনতারিণী তাকেই ডাক দিলেন, এই সত্য, ধিঙ্গী অবতার! যা দিকিনী, বড় না।তবৌমাকে ডেকে আন দিকিন শীগগির, বরকনে এসে পড়ল পেরায়, দুধ ওথলাতে হবে।

বৌকে? বড়দার বৌকে ডেকে দেব? সত্য দুই হাত উলটে বলে, বৌ কি আর বৌতে আছে? ভোর থেকে মাটিতে পড়ে কেন্দে কেন্দে মরছে!

কেঁদে কেঁদে মরছে? দীনতারিণী বিরক্ত কণ্ঠে বলে ওঠেন, একেবারে মরছেন। কেন, এতে মরবার কি হল? ওমা, শুভদিনে ইকি অলক্ষণে কাণ্ড! যা, শীগগির ডেকে আন।

সত্য এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে, কে বাবা ডাকতে যায়! তুমি তো বললে কাঁদবার কি হয়েছে? বলি নিজের যদি হত? সতীন আছে কাঁদবে না, আহ্লাদে উর্ধবাহু হয়ে নাচবে মানুষ! হেঁ! কই, কোথায় কি আছে তোমাদের? আমিই দিচ্ছি। দুধ জ্বাল দিয়ে!

তুই? তুই দিবি দুধ জ্বল?

কেন, দিলেই বা! সত্য সোৎসাহে বলে, পিসঠাকুমা যে সেবার খুন্তির দিদির বিয়েতে বলল, সত্যর বছর ঘুরে গেছে, এখন এয়োডালায় হাত দিতে পারে!

বছর ঘুরে অর্থাৎ বিয়ের বছর ঘুরে।

সেটা আর স্পষ্টাম্পষ্টি উচ্চারণ করল না। সত্য।

দীনতারিণী সন্দিগ্ধ সুরে বলেন, বছর ঘুরলেই বুঝি হল? ঘরবসতি না হলে—

জানি নে বাবা। রাখো তোমাদের সন্দ। আমি এই হাত দিলাম।

বলেই সত্য দাওয়ার পাশে দুখানা ইট পাতা উনুনের উপর জ্বলে বসানো ছোট্ট সরা চাপা মাটির হাঁড়িটার নিচে ফুঁ দিতে শুরু করে।

ঘুঁটের আগুন জ্বলছে ধিকি ধিকি, ফুঁ পেড়ে দু-চারখানা নারকেলপাতা ঠেলে দিলেই জ্বলে উঠবে। দাউ দাউ করে। তা গোছালো মেয়ে নন্দরাণী নারকেল পাতার গোছাও এনে রেখেছেন পাশে।

সত্যর সকল কাজই উদ্দাম।

তার ফুঁয়ের দাপটে বরকনে আসার আগেই দুধ ওথলাতে শুরু করল। উথরে ধোঁয়া ছড়িয়ে ভেসে গেল। গড়িয়ে পড়ে।

দীনতারিণী হাঁ হাঁ করে উঠলেন, ওরে একটু রয়ে-বসে, নতুন বৌ ঢোকা মাত্তর যেন দেখতে পায়।

কথা শেষ হবার আগে বাইরের উঠোনে শাঁখ বেজে উঠল।

অর্থাৎ শুভাগমন ঘটেছে নতুন বৌয়ের।

মোক্ষদা শাঁখ হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন বাইরে। আজ পূর্ণিমা, বিধবাদের ঘরে রান্নার ঝামেলা নেই, কোন এক সময় আমকাঁঠাল ফল মিষ্টি খেলেই হবে। কাজেই আজ ছুটি মোক্ষাদাদের।

ছুটিই যদি, তবে ছোটাছুটি না করবেন কেন মোক্ষদা? স্নান তো করতেই হবে জল খাবার আগে।

তাই মোক্ষদাই অগ্রণী হয়ে বারবাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে আছেন। আছেন শাঁখ হাতে নিয়ে।

শুভকর্মে বিধবারা সমস্ত কর্মে অনধিকারী হলেও, এই একটি কর্মে তাদের অধিকার আছে, সমাজ অথবা সমাজপতিরা বোধ করি এটুকু আর কেড়ে নেন নি, ক্ষ্যামা-ঘেন্না করে ছেড়ে দিয়েছেন। শাক আর উলু।

অতএব সেই অধিকারটুকুর সম্যক সদ্ব্যবহার করতে থাকেন মোক্ষদা রাসুর দ্বিতীয় অভিযানান্তে। ৩।বর্তন উপলক্ষ্যে।

দীনতারিণী উদ্‌গ্ৰীব হয়ে এগিয়ে যেতে যেতে চমকে উঠে বলেন, আমন করে ফুঁ দিচ্ছিস যে সত্য? পোড়ালি বুঝি?

সত্য তাড়াতাড়ি সত্য গোপন করে ফেলে বলে, পোড়াবো কেন, হুঁ!

তবে হাতে ফুঁ পাড়ছিস কেন?

এমনি।

যাক এবার উনুনে ফুঁ পাড়, ঢোকার সময় যেন আর একবার দুধটা ফেপে ওঠে, তা উঠেছে, বৌ পয়মন্ত হবে। সেবার বরং-

কথা শেষ হবার আগেই রামকালীর গভীর কণ্ঠনিনাদ ধ্বনিত হল, তোমাদের ওই সব বরণ-টরণ তাড়াতাড়ি সেরে ফেলো ছোটপিসী, পিছনে পিছনে পাড়া ঝেটিয়ে অবগুণ্ঠনবতীর দল।

.

বিয়েটা যেভাবে আর যে অবস্থাতেই ঘটে থাকুক, বৌভাতের যজ্ঞি। একটা করতেই হবে। আমোদ-আহ্লাদের প্রয়োজনে নয়, সমাজ-জানিত করবার প্রয়োজনে। খামকা একদিন হূঁট করে লক্ষ্মীকান্ত বাঁড়ুয্যের পৌত্রী এসে চাটুয্যেবাড়ির অন্দরে সামিল হল, কাকে-পক্ষীতে টের পেল না, এটা তো আর কাজের কথা নয়। তার প্রবেশটা যে বৈধ, এ খবরটুকুর একটা পাকা দলিল তো থাকা চাই।

দলিল আর কি! লিখিত্ব পড়িত্ তো কিছু নয় সই-সবুদও নয়, মানুষের স্মরণ-সাক্ষ্যই দলিল তা সেই স্মরণ-সাক্ষ্য আদায় করতে হলে গ্রাম-সমাজকে একদিন গলবস্ত্ৰে ডেকে এনে উত্তম ফলার খাইয়ে দেওয়া ছাড়া অন্য উপায় কি?

তা ছাড়া বাঁড়ুয্যেদের মেয়ে যে চাটুয্যে পরিবারভুক্ত হল, তার স্বীকৃতিটাও তো দিতে হবে? বৌভাতের যজ্ঞিতে নতুন বৌয়ের হাত দিয়ে ভাত পরিবেশন করিয়ে জ্ঞাতিকুটুম্বের কাছ থেকে সেই স্বীকৃতি নেওয়া।

অতএব বিয়েতে যজ্ঞির আয়োজন না করলেই নয়। আগে থেকে বিলিবন্দেজ নেই, হুট্‌ক্কারি করে বিয়ে, তাই ভোজের আয়োজনেও হুড়োহুড়ি লেগে গেছে। অনুগত জনের অভাব নেই রামকালীর, দিকে দিকে লোক ছড়িয়ে দিয়েছেন। জনাইতে মনোহরার বায়না গেছে, বর্ধমানে মিহিদানার। তুষ্ট গয়লাকে ভার দেওয়া হয়েছে দৈ-এর, আর ভীমে জেলেকে ডেকে পাঠিয়েছেন মাছের ব্যবস্থা করতে। কোন পুকুরে জাল ফেলবে ক-মণ তোলা হবে, এই সব নির্দেশ দিচ্ছিলেন রামকালী, সহসা সেই আসরে এসে উপস্থিত হলেন মোক্ষদা।

এ তল্লাটে রামকালীকে ভয় করে না এমন কেউ নেই, বাদে মোক্ষদা। রামকালীর মুখের উপর হক কথা শুনিয়ে দেবার ক্ষমতা একা মোক্ষদা রাখেন। নইলে দীনতারিণী পর্যন্ত তো ছেলেকে সমীহ করে চলেন।

অবিশ্যি ভাবা যেতে পারে রামকালীকে হক কথা শুনিয়ে দেবার সুযোগটা আসে কখন? যে মানুষটা কর্তব্যপালনে প্রায় ত্রুটিহীন, তাকে দুকথা শুনিয়ে দেবার কথা উঠছে কি করে?

কিন্তু ওঠে।

মোক্ষদা ওঠান। কারণ মোক্ষদার বিচার নিজের দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে। রামকালীর মতে যেটা নিশ্চিত কর্তব্য, প্রায়শই মোক্ষদার মতে সেটা অনর্থক বাড়াবাড়ি।

তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হক কথার কারণ হয়ে দাঁড়ায় সত্যবতী। হবে না-ই বা কেন? রামকালী যদি এমন মেয়ে গড়ে তোলেন যেমন মেয়ে ভূ-ভারতে নেই, তাহলে আর কথা শোনানোয় মোক্ষদার দোষ কি? সৃষ্টিছাড়া ওই মেয়েটাকে তাই যখন-তখন তার বাপের সামনে হাজির করে ন ভূতো ন ভবিষ্যতি করতেই হয় মোক্ষদাকে।

আজও তাই রামকালীর দরবারে একা আসেন নি মোক্ষদা, এনেছেন সত্যবতীকে সঙ্গে করে। সত্যবতীও এসেছে বিনা প্ৰতিবাদে। অবশ্য প্ৰতিবাদে লাভ নেই বলেই হয়তো এই অপ্ৰতিবাদ। অথবা হয়তো এটা তার নির্ভীকতা।

ভীমে জেলের উপস্থিতির কালটুকু অবশ্য নিঃশব্দে দাঁড়িয়েছিলেন মোক্ষদা। কথার শেষে ভীম রামকালীকে দণ্ডবৎ হয়ে প্ৰেণাম করে চলে যাবার পরীক্ষণেই মোক্ষদা যেন ঝাঁপিয়ে পড়লেন।

এই নাও রামকালী, তোমার গুণের অবতার কন্যের হাতের চিকিচ্ছে করো এবার। আর চেরটাকালই করতে হবে তোমাকে, এ মেয়েকে তো আর শ্বশুরঘর থেকে নেবে না। একটু দম নিলেন মোক্ষদা।

মোক্ষদা দম নেবার অবকাশে রামকালী মৃদু হেসে বলেন, কি? কি হল আবার?

হয়েই তো আছে সমস্তক্ষণ, মোক্ষদা দুই হাত নেড়ে বলেন, উঠতে বসতেই তো হচ্ছে। কাটছে ছিঁড়ছে ছড়ছে। এই আজ দেখা মেয়ের হাতের অবস্থা। পুড়িয়ে-ঝুড়িয়ে এতখানি এক ফোস্কা! আবার বলে কি বলতে হবে না বাবাকে, এমনি সেরে যাবে! দেখো তুমি নিজের চক্ষে।

ইত্যবসরে রামকালী মেয়ের হাতখানা তুলে ধরে শিহরিত হয়েছেন।

কী ব্যাপার? এ কি করে হল?

কি করে হয়েছে শুধোও-ওকেই শুধোও। মেয়ের গুণের কথা এত বলি, কথা কানে করো না তো! তবে তোমাকে এই বলে রাখছি রামকালী, এই মেয়ে হতেই তোমার ললাটে দুঃখু আছে।

কথাটা নতুন নয়, কাঁহ ব্যবহৃত। কাজেই রামকালী যে বিশেষ বিচলিত হন এমন নয়। তবে বাইরে গুরুজনকে সমীহ করবার শিক্ষা রামকালীর আছে, তাই বিচলিত ভাবটা দেখান।

নাঃ, মেয়েটাকে নিয়ে—! আবার কি করলি? এত বড় ফোস্কা পড়ল কিসে?

দুধ ওথলানো হচ্ছিল গো। কালকে যখন রেসো বৌ নিয়ে এসে ঢুকল, উনি গেলেন পাতা জ্বেলে দুধ ওথলাতে! আর এও বলি, এত বড় বুড়ো ধিঙ্গী মেয়ে, এটুকু করতে হাতই বা পোড়ালি কি दळल?

রামকালী মেয়ের হাতের অবস্থাটা নিরীক্ষণ করে ঈষৎ গম্ভীর হয়ে মেয়ের উদ্দেশেই বলেন, আগুনের কাজ তুমি করতে গেলে কেন? বাড়িতে আর লোক ছিল না?

সত্য ঘাড় নিচু করে বলে, বেশী জ্বালা করছে না। বাবা।

জ্বালা করার কথা হচ্ছে না, করলেও সে জ্বালা নিবারণের ওষুধ অনেক আছে। জিজ্ঞেস করছি, তুমি আগুনে হাত দিতে গেলে কেন?

সত্য এবার ঘাড় তোলে। তুলে সহসা নিজস্ব ভঙ্গীতে তড়বড় করে বলে ওঠে, আমি কি আর সাধে আগুনে হাত দিয়েছি বাবা, বড়বৌয়ের মুখ চেয়েই দিয়েছি। আহা বেচারী, একেই তো সতীনকাঁটার জ্বালা তার ওপর আবার দুধ ওথলাবার হুকুম। মানুষের প্রাণ তো!

সত্যর এই পরিষ্কার উত্তরপ্রদানে এক রামকালীই নয়, মোক্ষদাও তাজ্জব বনে যান। এ কী সর্বনেশে মেয়ে গো! ওই হোমরাচোমরা বাপের মুখের ওপর এই চোটপাট উত্তর! গালে হাত দিয়ে নির্বাক হয়ে যান মোক্ষদা। কথা বলেন রামকালীই। দুই ভ্রূ কুঁচকে ঝাঁঝালো গলায় বলেন,

কি জিনিস সে কথা তুমি তোমার মেয়ের কাছেই এবার শেখে। রামকালী! মোক্ষদা সত্যবতীর আগেই তীক্ষ্ণ বিদ্রুপের স্বরে বলেন, আমরা এতখানি বয়সে যা কথা না শিখেছি, এই পুঁটকে ছুঁড়ী তা শিখেছে! কথার ধুকড়ি!

সত্য এই সব উলটোপালটো কথাগুলো দুচক্ষের বিষ দেখে। কেন রে বাপু, যখন যা সুবিধে তখন তাই বলবে কেন? এই এক্ষুণি সত্যকে বলা হলো বুড়ো ধিঙ্গী, আবার এখন বলা হচ্ছে পুঁটকে ছুঁড়ী! সবই যেন ইচ্ছে-খুশী!

রামকালী পিসীর দিকে একনজর তাকিয়ে নিয়ে জলদগম্ভীর স্বরে কন্যাকে পুনঃপ্রশ্ন করেন, কই, আমার কথার জবাব দিলে না? বললে না। সতীনকাটা কি জিনিস আর তার জ্বলাটাই বা কী বস্তু?

কী বস্তু সে কথা কি ছাই সত্য জানে? তবে বস্তুটা যে খুব একটা মর্মবিদারি দুঃখজনক, সেটা বোধ করি জন্মাবার আগে থেকেই জানে। তাই মুখটা যথাসম্ভব করুণ করে তুলে বলে, সতীন মানেই তো কাটা বাবা! আর কাটা থাকলেই তার জ্বালা আছে! বড়বৌ-এর প্রাণে তো এখন তুমি সেই জ্বালা ধরিয়ে দিলে–

থামো! হঠাৎ ধমকে উঠলেন রামকালী। বিচলিত হয়েছেন তিনি, বাস্তবিকই বিচলিত হয়েছেন এতক্ষণে। বিচলিত হয়েছেন মেয়ের ভবিষ্যৎ ভেবে নয়, সহসা মেয়ের অন্তরের মলিনতার পরিচয় পেয়ে।

এ কী?

এ রকম তো ধারণা ছিল না তার ছিল না হিসাবের মধ্যে। এটা হল কোন্ ফাঁকে? সত্যবতীর বহুবিধ নিন্দাবাদ তার কানে এসে ঢোকে, সে-সব তিনি কখনোই বড় একটা গ্রাহ্য করেন না। করেন শুধু মেয়ের স্বভাব-প্রকৃতিতে একটা নির্মল তেজের প্রকাশ লক্ষ্য করে। সত্যর হৃদয়ে হিংসাদ্বেষের ছায়ামাত্র নেই, এইটাই জমা ছিল হিসাবের খাতায়, এহেন নীচ হিংসুটে কথাবার্তা শিখে ফেললো সে কখন? কিন্তু বাড়তে দেওয়া ঠিক নয়, শাসনের দরকার।

তাই আরও বাঘ-গর্জনে বলে ওঠেন, কেন, সতীন কিসে এত ভয়ঙ্করী হল? সে এসে ধরে মারছে তোমাদের বড়বৌকে?

বার বার বাঘা-হুমকিতে সত্যবতীর চোখে জল উপচে এসে পড়ছিল, কিন্তু সহজে হার মানে না সে। আর কাঁদার দৈন্যটা প্রকাশ হয়ে পড়বার ভয়ে কষ্টে ঘাড় নিচু করে ধরা গলায় বলে, হাতে না মারুক, ভাতে মারছে তো? বড়বৌ একলা একেশ্বরী ছিল, নতুন বৌ হঠাৎ উড়ে এসে জুড়ে বসল–

আ, ছি ছি ছি!

রামকালী শিউরে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। মুখ দেখে মনে হল, সত্যবতী যেন সহসা তাঁর যত্নে আঁকা একখানি ছবিকে মুচড়ে দুমড়ে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছে।

এই ফাঁকে মোক্ষদা আবার একহাত নেন, ওই শোনো! শোনো মেয়ের কথার ভঙ্গিমে! সাধে বলি কথার ভশ্চায্যি! বুড়ো মাগীদের মতন কথা, আর ছেলেপেলের মতন দস্যিচাল্লি! হরঘড়ি অবাক করে দিচ্ছে কথার জ্বালায়!

রামকালী পিসীর আক্ষেপে কান না দিয়ে তিক্তবিরক্ত স্বরে বললেন, এমন ইতর কথাবার্তা কোথা থেকে শিখেছ? ছি ছি ছি! লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে আমার। উড়ে এসে জুড়ে বসা মানে কি? এক বাড়িতে দুটি বোন থাকে না? সতীনকে কাঁটা না ভেবে বোন বলে ভাবা যায় না?

.

বাবা এত ঘেন্না দেওয়ার পর অবশ্য সত্যবতীর সমস্ত প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়। একসঙ্গে অগুনতি ফোঁটা ঝর ঝর করে ঝরে পড়ে চোখ থেকে গালে, গাল থেকে মাটিতে। পড়তেই থাকে, হাত তুলে মোছে না সত্য।

রামকালী চাটুয্যে আর একবার বিচলিত হন। সত্যবতীর চোখে জল! এটা যেন একটা অদৃষ্টপূর্ব দৃশ্য মনে হচ্ছে। মনে হল ঘেন্নাটা বোধ করি একটু বেশী দেওয়া হয়ে গেছে।

ঔষধে মাত্রাধিক্য, রামকালীর পক্ষে শোচনীয় অপরাধ। মনে পড়ল, মেয়েটার হাতের ফোস্কাটাও কম জ্বালাদায়ক নয়। এখুনি প্রতিকার করা দরকার। তাই ঈষৎ নরম গলায় বলেন, এরকম নীচ কথা আর বলো না, বুঝলে? মনেও এনো না। সংসারে যেমন ভাই বোন ননদ দেওর জা ভাসুর সব থাকে, তেমনি সতীনও থাকে, বুঝলে? কই দেখি হাতটা!

হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে সত্যবতী নিজের উদ্বেল হৃদয়ভারকে সামলাতে চেষ্টা করে দাঁতে ঠোঁট চেপে।

মোক্ষদা বোঝেন মেঘ উড়ে গেল। হয়ে গেল রামকালীর মেয়ে শাসন করা। ছি ছি ছি! আর দাঁড়াতে ইচ্ছে হল না, বললেন, যাক গে, শাস্তি শাসন হয়ে গেছে তো? এবার মেয়েকে সোহাগ করো বসে বসে। তুমিই দেখালে বটে বাবা!

রঙ্গমঞ্চ থেকে বিদায় নেন মোক্ষদা।

রামকালী আশু প্রতিকার হিসাবে একটা প্রলেপ মেয়ের ফোস্কা ঘায়ে লাগাতে লাগাতে সহসা আবার বলেন, আজকের কথা মনে থাকবে তো? আর কোন দিন এ রকম কথা বলো না, বুঝলে? মানুষ তো বনের জানোয়ার নয় যে খালি হিংসেহিংসি কামড়াকামড়ি করবে! সকলের সঙ্গে মিলেমিশে সবাইকে ভালবেসে পৃথিবীতে থাকতে হয়।

বাবার গলায় আপসের সুর।

অতএব ফের একটু সাহস সঞ্চয় হয় সত্যবতীর। তা ছাড়া প্রাণটা তো ফেটে যাচ্ছে বাবার ধিক্কারে। কিন্তু তারই বা দোষ কোথায় বুঝে উঠতে পারে না সত্যবতী। সবাইকে ভালবেসে থাকাই যদি এত ধম্মে হয়, তা হলে সেঁজুতি বত্তটি করতে হয় কেন?

মনের চিন্তা মুখে প্রকাশ হয়ে পড়ে সত্যর, তাই যদি, তা হলে সেঁজুতি বত্ত করতে হয় কেন বাবা? পিসঠাকুরমা তো এ বছর থেকে আমাকে ফেন্তুকে আর পুণ্যিকে ধরিয়েছে!

রামকালী এবার বিরক্তির বদলে বিস্মিত হন। সেঁজুতি বত্ত সম্পর্কে অবশ্য তিনি সম্যক অবহিত নন, কিন্তু যাই হোক, কোনও একটি ব্রত যে মানবতাবোধ-বিরোধী হওয়া সম্ভব, সেটা ঠিক ধারণা করতে পারেন না। তাই প্রলেপের হাতটা ঘরের কোণে রক্ষিত মাটির জালার জলে ধুতে ধুতে বলেন, ব্রতের সঙ্গে কি?

কি নয় তাই বলো না কেন বাবা? চোখের জল শুকোবার আগেই সত্যর গলার সুর শুকনো খটখটে হয়ে ওঠে, সেঁজুতি বত্তর যত মন্তর সব সতীনকাটা উদ্ধারের জন্যে নয়?

রামকালী একটুক্ষণ চুপ করে থাকেন।

কোথায় যেন একটু আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন। হু, এই রকমই একটা কিছু গোলমেলে ব্যাপার ঢুকে গিয়েছে মেয়ের মাথায়। নচেৎ সত্যর মুখে অমন কথা!

হাতে অনেক কাজ।

তবু রামকালী বিবেচনা করলেন, সদুপদেশের দ্বারা কন্যার হৃদয়-কানন হতে সতীন-কণ্টকের মূলোৎপাটন করা কর্তব্য; তাই ভুরু কুঁচকেই বললেন তাই নাকি? সে মন্তরটা কি?

মন্তর কি একটা বাবা? সত্যবতী মহোৎসাহে বলে, গাদা গাদা মন্তর। সব কি ছাই মনেই আছে! ভেবে ভেবে বলছি রোসো। প্রথমে তো আলপনা আঁকা। ফুল-লতার নকশা কেটে তার ধারে কোণে হাতা-বেড়ি হড়িকুড়ি এস্তক ঘর-সংসারের প্রত্যেকটি জিনিস এঁকে নেওয়া। তা’পর একোটা একোটা ধরে ধরে মন্তর পড়তে হয়। হাতায় হাত দিলাম, বললাম–

হাতা, হাতা, হাতা,
খা সতীনের মাথা।
খোরায় হাত দিয়ে
খোরা গোরা পোরা,
সতীনের মাকে ধরে নিয়ে যাক
তিন মিনসে গোরা।

তা’পর

বেড়ি বেড়ি বেড়ি
সতীন মাগী চেড়ী।
বঁটি বঁটি বঁটি
সতীনের ছেরাদ্দর কুটনো কুটি।
হাঁড়ি হাঁড়ি হাঁড়ি,
আমি যেন হই জন্ম-এয়োস্ত্রী,
সতীন কড়ে রাঁড়ী।

চুপ চুপ।

রামকালী জলদগম্ভীর স্বরে বলেন, এই সব তোমাদের মন্তর?

এই সব যে ব্রতের মন্তর হওয়ার উপযুক্ত নয়, সেই সত্যটা যেন সত্যর বোধের জগতে সহসা এই মুহূর্তে একটা চকিত আলোক ফেলে যায়। সে উৎসাহের বদলে মৃদুস্বরে বলে, আরও তো কত আছে–

আরও আছে? বটে! আচ্ছা বলো তো শুনি আরও কি কি আছে! দেখি কি ভাবে তোমাদের মাথাগুলো চিবানো হচ্ছে! জানো আরও?

হ্যাঁ। সত্য বড় করে ঘাড় কাত করে বলে, আর হচ্ছে–

ঢেঁকি ঢেঁকি ঢেঁকি,
সতীন মরে নিচেয় আমি উপুর থেকে দেখি!

তা’পর গে

অশ্বথ কেটে বসত করি,
সতীন কেটে আলতা পরি।
ময়না ময়না ময়না,
সতীন যেন হয় না।

তা’পর একমুঠো দুব্বো ঘাস নিয়ে বলতে হয়, ‘ঘাস মুঠি ঘাস মুঠি, সতীন হোক কানা কুষ্ঠি’। গয়না এঁকেও ছুঁয়ে ছুঁয়ে মন্তর আছে–

বাজু বন্দ পৈছে খাড়ু,
সতীনের মুখে সাত ঝাড়।

পান এঁকে বলতে হয়–

ছচি পান এলাচি গুয়ো–
আমি সোহাগী, সতীন দুয়ো—

আচ্ছা থাক হয়েছে। আর বলতে হবে না।

রামকালী হাত নেড়ে নিবৃত্ত করেন, এসব গালমন্দকে তোমরা পূজোর মন্তর বল?

আমরা বলি কি গো বাবা? সত্যবতী তার পণ্ডিত বাপের এহেন অজ্ঞতায় আকাশ থেকে পড়ে চোখ গোল গোল করে বলে, জগৎ সুদ্ধ সবাই বলে যে। সতীন যদি বোনের মত হবে, তবে এত মন্তরের স্রেজন হবে কেন? বোনের খোয়ারের জন্যে কি কেউ বত্ত করে? আসল কথা বেটাছেলেরা তো আর সতীনের মর্ম বোঝে না, তাই একটা ঢোক গিলে নেয় সত্য, কারণ বেটাছেলে সম্পর্কে পরবর্তী যে বাক্যটি জিভের আগায় এসে যাচ্ছিল, সেটা বাবার প্রতি প্রয়োগ করা সমীচীন কিনা বুঝতে না পেরে দ্বিধা এল।

রামকালী গম্ভীর মুখে বলেন, তা হোক, এ ব্রত তোমরা আর করো না।

করো না!

ব্রত করো না!

মাথায় বজ্রপাত হল সত্যর।

এ কী আদেশ! এখন উপায়?

একদিকে পিতৃআজ্ঞে, অপরদিকে ‘ব্রেতোপতিত’। বেতোপতিত হলে তো জলজ্যান্ত নরক; পিতৃআজ্ঞে পালন না করার পাতকটা ঠিক কতদূর গর্হিত না জানা থাকলেও, সেই পাতকের পাতকীকেও যে নরকের কাছাকাছি পৌঁছতে হবে এ বিষয়ে সত্য নিঃসন্দেহ।

অনেকক্ষণ দুজনেই স্তব্ধ।

তার পর আস্তে আস্তে কথাটা তোলে সত্য, ধরা বত্ত উজ্জাপন না করে ছেড়ে দিলে যে নরকগামিন হতে হবে বাবা!

না, হবে না। এসব ব্রত করলেই নরকগামী হতে হয়।

পিসঠাকুরমাকে তা হলে তাই বলব?

কি বলবে?

এই ইয়ে– সেঁজুতি করতে তুমি মানা করেছ?

আচ্ছা থাক, এখুনি তাড়াতাড়ি তোমার কিছু বলবার দরকার নেই। যা বলবার আমিই বলব এখন। তুমি যাও এখন। হাতটা সাবধান। কোথাও ঘষটে ফেলো না।

সত্যবতীর অবস্থাটা দাঁড়ায় অনেকটা ন যযৌ, না তস্থৌ।

বাবার হুকুম চলে যাওয়ার, অথচ মনের মধ্যে প্রশ্নের সমুদ্র। সে সমুদ্রের ঢেউ আর কার পায়ের কাছে আছড়ে পড়লে সুরাহা হবে– বাবা ছাড়া?

বাবা!

কি আবার?

বত্তটা যদি অন্যায়, সতীন যদি ভাল বস্তু, তা হলে বড় বৌয়ের অত কষ্ট হচ্ছে কেন?

বড়বৌ? রাসুর বৌ? কষ্ট হচ্ছে? সে তোমাকে বলেছে তার কষ্ট হচ্ছে?

রামকালীর কণ্ঠে ফের ধমকের সুর ছায়া ফেলে।

কিন্তু সত্যবতী দমে না।

ধিক্কারে দমে বটে সত্য কিন্তু ধমকে নয়। তাই বাকভঙ্গীতে সতেজতা এনে মোক্ষদার ভাষায় ‘কথার ভশ্চায্যি’র মতই তড়বড় করে বলে, বলতে যাবে কেন বাবা? সবই কি আর মুখ ফুটে বলতে হয়? চেহারা দেখে বোঝা যায় না? কেঁদে কেঁদে চোখ-মুখ বসে গেছে, অমন যে সোনার বণ্ন, যেন কালি মেড়ে দিয়েছে। পরশু থেকে মুখে একবিন্দু জল দেয় নি। নোকনজ্জায় বলছে বটে পেটব্যথা করছে তাতেই খিদে নেই, তাতেই কাঁদছি, কিন্তু বুঝতে সবাই পারছে। কে আর ঘাসের ভাত খায় বল? মড়ার ওপর খাড়ার ঘা, তার ওপর আবার আজ নতুন বো’র হাতের সুতো খোলা! কেউ বলছে বড়বৌকে অন্য ঘরে দিয়ে ওই ঘরেই নেমকর্ম হবে, কেউ বলছে আহা থাক। বড়বৌ নাকি ও বাড়ির সাবি পিসীকে বলেছে, অত ধন্দয় কাজ নেই, চাটুয্যে-পুকুরে অনেক জায়গা আছে, তাতেই আমার ঠাই হবে।

সর্বনাশ!

প্রমাদ গণেন রামালী।

মেয়েমানুষের অসাধ্য কাজ নেই।

কে বলতে পারে মেয়েটা সত্যিই ওরকম কোন দুর্মতি করে বসবে কি না। এও তো মহাজ্বালা। কোথায় ভদ্রলোকের জাত-মান উদ্ধারের কথা ভেবে আনন্দ করবি, তা নয় এই সব প্যাঁচ!…. কেন, ত্রিভুবনে আর কারো সতীন হয় না?

হয়েছে আর কি, ওইসব অখদ্যে ব্রতপার্বণ করিয়ে শিশুকাল থেকে মেয়েগুলোর পরকাল ঝরঝরে করে রাখা হয়েছে কিনা!

মেয়েমানুষ জাতই কুয়ের গোড়া।

ঘরের লক্ষ্মী বলে সৌজন্য দেখালে কি হবে, এক-একটি মহা অলক্ষ্মী!

নইলে রেসোর এই বৌমা, কি বা বয়স, তার কিনা এত বড় কথা! জলে ডুবে মরবার সংকল্প। ছি ছি!

এই কথা বলেছেন বড় বৌমা?

অন্ধকার-মুখে বলেন রামকালী।

সাবি পিসী তো বলছিল।

বাবার মুখ দেখে এবার একটু ভয়-ভয় করে সত্যর। কিন্তু ভয় করলে তো চলবে না। তারও যে কর্তব্য রয়েছে– বাবাকে চৈতন্য করাবার।

এত বোধবুদ্ধি বাবার, অথচ সোয়ামী আর একটা বিয়ে করে আনলে মেয়েমানুষের প্রাণ ফেটে যায় কিনা সে জ্ঞান নেই! আর যদি না ফাটবে, তা হলে কৈকেয়ী কেন তিন যুগে হেয় হয়েও রামকে বনবাসে পাঠিয়েছিলেন? কথক ঠাকুরের কথাতেই তো শুনেছে সত্য।

রাজার রাণী তিনি, তার মনে এত বিষ!

আর বড়বৌ বেচারী নিরীহ ভালমানুষ, শুধু মনের ঘেন্নায় নিজে মরতে চেয়েছে।

সত্যর প্রাণে এত দাগা লাগার আরও একটা কারণ, বড়বৌকে দুটো সান্ত্বনার কথা বলবার মুখ তার নেই। নেই তার কারণ, এই মর্মান্তিক হৃদয়বিদারক নাটকের নায়ক হচ্ছেন স্বয়ং সত্যবতীরই বাবা। ইশারায় ইঙ্গিতে ঘরে-পরে সকলেই তো রামকালীকেই দুষছে।

দুষবার কথাও। ছেলের মায়ের যে গৌরব আলাদা। বড়বৌ যদি ছেলের মা না হত তা হলে কথা ছিল। কেঁদে কেঁদে যদি ওর বুকের দুধ শুকিয়ে যায়, ছেলে বাঁচবে কিসে?

.

এদিকে রামকালী ভাবছেন বৌটাকে শায়েস্তা করার উপায় কি? গ্রামসুদ্ধ লোক নেমন্তন্ন করেছেন, রাত পোহালেই যজ্ঞি, ও যদি সত্যিই কিছু একটা অঘটন ঘটিয়ে বসে! অনেক ভেবে গলাটা ছেড়ে বললেন, ওসব হচ্ছে ছেলেবুদ্ধির কথা! তুমি আমার হয়ে বৌমাকে গিয়ে বলো গে, ওসব ছেলেমানুষী বুদ্ধি ছেড়ে দিতে। বলো গে, বাবা বললেন, মন ভাল করব ভাবলেই মন ভাল করা যায়। বলো গে, উঠুন, কাজকর্ম করুন, ভাল করে খান-দান, মনের গলদ কেটে যাবে।

সত্য আর একবার বাবার অজ্ঞতায় কাতর হয়। তবে শুধু কাতর হয়ে চুপ করেও থাকে না। একটু তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে, তা যদি কেটে যেত, তা হলে তো মাটির প্রিথিবীটা সগগো হত বাবা! রুগীর চেহারা দেখে তুমি ওপর থেকে বলে দিতে পারো তার শরীরের মধ্যে কোথায় কি হচ্ছে, আর মানুষের মুখ দেখে বুঝতে পারো না তার প্রাণের ভেতরটায় কি হচ্ছে? নিজের চোক্ষে প্রেত্যক্ষ একবার দেখবে চল তা হলে!

সহসা কেন কে জানে রামকালীর গায়ে কি রকম কাটা দিয়ে উঠল। চুপ করে গেলেন তিনি। তার অনেকক্ষণ পর হাত নেড়ে মেয়েকে ইশারা করলেন চলে যেতে।

এর পর আর চলে না যাওয়া ছাড়া উপায় কি? সত্য মাথা হেঁট করে আস্তে আস্তে ঘর থেকে চলে যায়।

কিন্তু এবারের ডাকের পালা রামকালীরই, আচ্ছা শোনো।

সত্যবতী ঘাড় ফিরিয়ে তাকায়।

শোনো, বৌমাকে তোমার কিছু বলবার দরকার নেই, তুমি শুধু, মানে ইয়ে, তোমাকে খালি একটা কাজ দিচ্ছি

রামকালী ইতস্তত করছেন।

সত্যবতী অবাক হয়ে যায়।

নাঃ, আর যাই হোক বাবাকে কখনো এমন ইতস্তত করতে দেখে নি সত্য!

কিন্তু এ হেন পরিস্থিতিতেই বা কবে পড়েছেন রামকালী?

সত্যিই কি সত্যবতী তার চৈতন্য করিয়ে দিল নাকি? তাই রামকালী অমন বিব্রত বিচলিত?

বাবা কি করতে বলছিলেন?

ও হ্যাঁ, বলছিলাম যে তুমি তোমাদের বড়বৌ-এর একটু কাছে কাছে থাকো গে, যাতে তিনি ওই পুকুরের দিকেটিকে যেতে না পারেন।

সত্যবতী মুহূর্তকাল স্তব্ধ থাকে। বোধ করি বাপের আদেশের তাৎপর্যটা অনুধাবন করতে চেষ্টা করে। তার পর খুব সম্ভব অনুধাবন করেই নম্র গলায় বলে, বুঝেছি, বৌকে চোখে চোখে রেখে পাহারা দিতে বলছ।

পাহারা!

রামকালী যেন মরমে মরে যান।

তার আদেশের ব্যাখ্যা এই!

বিরক্তি দেখিয়ে বলেন রামকালী, পাহারা মানে কি? কাছে থাকবে, খেলাধুলো করবে, যাতে তার মনটা ভাল থাকে।

সত্যবতী সনিঃশ্বাসে বলে, ওই হল, একই কথা। কথায় বলে, যার নাম ভাজা চাল তার নাম মুড়ি, যার মাথায় পাকা চুল তারেই বলে বুড়ী। কিন্তু বাবা, পাহারা নয় দিলাম, ক’দিন ক’রাত দেব বলো? কেউ যদি আত্মঘাতী হব বলে প্রিতিজ্ঞে করে, কারুর সাধ্যি আছে আটকাতে? শুধুই তো চাটুয্যে-পুকুরের জল নয়, ধুতরো ফল আছে, কুঁচ ফল আছে, কলকে ফুলের বীচি আছে

চুপ চুপ!

রামকালী আতপ্ত নিঃশ্বাসে দাহ ছড়িয়ে বলে ওঠেন, চুপ করো। তোমার সেজ ঠাকুমা দেখছি ঠিকই বলেন। এত কথা শিখলে কোথা থেকে তুমি? যাও তোমাকে কিছু করতে হবে না, যাও!

 ১০. যাও বলে মানুষকে তাড়ানো যায়

যাও বলে মানুষকে তাড়ানো যায়, চিন্তাকে তাড়ানো যায় না। তাড়ানো যায় না মানসিক দ্বন্দ্বকে। সত্যবতীকে যাও’ বলে ঘর থেকে সরিয়ে দিলেন রামকালী, কিন্তু মন থেকে সরাতে পারছেন না সহসা উদ্বেলিত হয়ে-ওঠা এই চিন্তাটাকে, তাড়াতে পারছেন না এই দ্বন্দ্বটাকে।

তা হলে কি ঠিক করি নি?

তবে কি ভুল করলাম?

চিন্তার এই দ্বন্দ্ব রামকালীকেই তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে, ঘর থেকে চণ্ডীমণ্ডপে, চণ্ডীমণ্ডপ থেকে বারবাড়ির উঠোনে, সেখান থেকে বাগান বরাবর। কি জানি কেন, একেবারে চাটুয্যেপুকুরের ধারে ধারে পায়চারি করতে থাকেন রামকালী।

দীর্ঘায়ত শরীর সামনের দিকে ঈষৎ ঝোকা, দুই হাত পিঠের দিকে জোড় করা, চলনে মন্থরতা। রমিকালীর এ ভঙ্গীটা লোকের প্রায় অপরিচিত। দৈবাৎ কখনো কোনো জটিল রোগের রোগীর মরণ বাচন অবস্থায় চিন্তিত রামকালী এইভাবে পায়চারি করেন। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের পুঁথি নেড়ে ঔষধ নির্বাচন করেন না রামকালী, এইভাবে বেড়িয়ে বেড়িয়েই মনে করেন। হয়তো বা পুঁথির পৃষ্ঠাগুলো মুখস্থ বলেই সেগুলো আর না নাড়লেও চলে। শুধু ভেবে দেখলেই চলে।

কিন্তু সে তো দৈবাৎ।

ঔষধ নির্বাচনের জন্য চিন্তার বেশী সময় নিতে হয় না কবরেজ চাটুয্যেকে, রোগীর চেহারা দেখলেই মুহূর্তে রোগ এবং তার নিরাকরণ ব্যবস্থা দুইই তার অনুভূতির বাতায়নে এসে দাঁড়ায়। তাই চিন্তিত মূতিটা তার কদাচিৎ দেখতে পাওয়া যায়। ঋজু দীর্ঘ দেহ– শালগাছের মত সতেজ, দুই হাত বুকের উপর আড়াআড়ি করে রাখা, প্রশস্ত কপাল, খড়গনাসা, আর দৃঢ়নিবদ্ধ ওষ্ঠাধরের ঈষৎ বঙ্কিম রেখায় আত্মপ্রত্যয়ের সুস্পষ্ট ছাপ। এই চেহারাই রামকালীর পরিচিত চেহারা। কিন্তু আজ তার ব্যতিক্রম ঘটেছে, আজ রামকালীর মুখের রেখায় আত্মজিজ্ঞাসার তীক্ষ্ণতা।

তবে কি ভুল করলাম?

তবে কি ঠিক করি নি? তবে কি আরও বিবেচনা করা উচিত ছিল? কিন্তু সময় ছিল কোথা?

বার বার ভাবতে চেষ্টা করছেন রামকালী, তবে কি বুদ্ধিভ্রংশ হয়েছেন? তাই একটা অবোধ শিশুর এলোমেলো কথার উপর এতটা মূল্য আরোপ করে এতখানি বিচলিত হচ্ছেন? কি আছে এত বিচলিত হবার? সত্যিই তো, ত্রিভুবনে সতীন কি কারো হয় না? অসংখ্যই তো হচ্ছে। বরং নিঃসপত্নী স্বামীসুখ কটা মেয়ের ভাগ্যে জোটে, সেটাই আঙুল গুনে বলতে হয়। কিন্তু এ চিন্তা দাড়াছে না। চেষ্টা করে আনা যুক্তি ভেসে যাচ্ছে হৃদয়-তরঙ্গের ওঠাপড়ায়। কিছুতেই উড়িয়ে দিতে পারছেন না একফোঁটা একটা মেয়ের কথাগুলোকে।

বহুবিধ গুণের সমাবেশে উজ্জ্বল বর্ণাঢ্য চরিত্র রামকালীর, পুরুষের আদর্শস্থল, তবু সে চরিত্রের গাঁথনিতে একটু বুঝি খুঁত আছে। মানুষকে মানুষের মর্যাদা দেবার শিক্ষা আছে তার, শিক্ষা আছে বয়োজ্যেষ্ঠকে সম্মান সমীহ করবার, কিন্তু সমগ্র ‘মেয়েমানুষ’ জাতটার প্রতি নেই তেমন সমবোধ, নেই সম্যক মূল্যবোধ।

যে জাতটার ভূমিকা হচ্ছে শুধু ভাত-সেদ্ধ কর! ছেলে ঠেঙাবার, পাড়া বেড়াবার, পরচর্চা করবার, কোন্দল করে অকথ্য অশ্রাব্য গালিগালাজ করবার, দুঃখে কেঁদে মাটি ভেজাবার আর শোকে উন্মাদ হয়ে বুক চাপড়াবার, তাদের প্রতি প্রচ্ছন্ন এক অবজ্ঞা ছাড়া আর কিছু আসে না রামকালীর। অবশ্য আচার-আচরণে ধরা পড়ে না, ধরা পড়ে না হয়তো নিজের কাছে– তবু অবজ্ঞাটা মিথ্যা নয়। কিন্তু সম্প্রতি ক্ষুদে একটা মেয়ে যেন মাঝে মাঝে তাকে ভাবিয়ে তুলছে, চমকে দিচ্ছে, বিচলিত করছে, মেয়েমানুষ’ সম্পর্কে আর একটু বিবেচনাশীল হওয়া উচিত কিনা এ প্রশ্নের সৃষ্টি করছে।

আকাশে সন্ধ্যা নামে নি, কিন্তু তাল নারকেলের সারি-ঘেরা পুকুরের কোলে কোলে সন্ধ্যার ছায়া। এই প্রায়ান্ধকার পথটুকুতে পায়চারি করতে করতে সহসা রামকালীর চোখের দৃষ্টি ঈগলের মত তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে। কে? ঘাটের পৈঠের একেবারে শেষ ধাপে অমন করে বসে ও কে? কই এতক্ষণ তো ছিল না, কখন এল? কোন পথ দিয়েই বা এল? আর কেনই বা এল এমন ভরা-ভরা সন্ধ্যায় একা? এ সময় ঘাটের পথে এমন একা মেয়েরা কদাচিৎ আসে, অবশ্য মোক্ষদা বাদে। কিন্তু দূর থেকে কে তা ঠিক বুঝতে না পারলেও মোক্ষদা যে নয়, সেটা বুঝতে পারলেন রামকালী।

তবে কে?

অভূতপূর্ব একটা ভয়ের অনুভূতিতে বুকের ভেতরটা কেমন সিরসির করে উঠল। রামকালীর পক্ষে এ অনুভূতি নিতান্তই নতুন।

অন্ধকার দ্রুত গাঢ় হয়ে আসছে, দৃষ্টিকে তীক্ষ্ণতর করেও ফল হচ্ছে না, অথচ এর চেয়ে কাছাকাছি গিয়ে ভাল করে নিরীক্ষণ করবার মত অসঙ্গত কাজও রামকালীর পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু একেবারে অগ্রাহ্য করাই বা চলে কি করে? সন্দেহ যে ঘনীভূত হচ্ছে। এ আর কেউ নয়, নির্ঘাত রাসুর বৌ!

কিন্তু সত্য কি করল? সত্যবতী? পাহারা দেওয়ার নির্দেশটা পালন করল কই?

দিব্যি বড়সড় একটা কলসী ওর সঙ্গে রয়েছে মনে হচ্ছে।

যারা সাঁতার জানে, তাদের পক্ষে জলে ডুবে মরতে কলসীটা নাকি সহায়-সহায়ক। আর ছেলেমানুষ একটা মেয়ে যদি ওই কলসীটা গলায় বেঁধে

চিন্তাধারা ওই একটা দুশ্চিন্তার শিলা পাথরকে ঘিরেই পাক খেতে থাকে। কিছুতেই মনে আসে, অসময়ে জলের প্রয়োজনেও কলসী নিয়ে পুকুরে আসতে পারে লোক।

তবে এটা ঠিক, জল ভরবার তাগিদ কিছু দেখা যাচ্ছে না ও ভঙ্গীতে। কলসীর কানাটা ধরে চুপচাপ বসে থাকাকে কি তাগিদ বলে?

নাঃ, জলের জন্যে অন্য কেউ নয়, এ নির্ঘাত রাসুর বৌ। মরবার সংকল্প নিয়ে ভরসন্ধ্যায় একা পুকুরে এসেছে, তবু চট করে বুঝি সব শেষ করে দিতে পারছে না, শেষবারের মত পৃথিবীর রূপ রস শব্দ স্পর্শের দিকে তাকিয়ে নিতে চাইছে।

শুধুই কি তাই?

তাকিয়ে নিয়ে নিঃশ্বাস ফেলে ভাবছে না কি, কার জন্যে তাকে এই শোভা সম্পদ, এই সুখভোগ থেকে বঞ্চিত হতে হল?

হঠাৎ চোখ দুটো জ্বালা করে এল রামকালীর।

এই জ্বালা করাকে রামকালী চেনেন না। এ অনুভূতি সম্পূর্ণ নতুন, সম্পূর্ণ আকস্মিক।

কিন্তু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলে তো চলবে না, এখুনি একটা বিহিত করতে হবে। নিবৃত্ত করতে হবে মেয়েটাকে। অথচ উপায় বা কি? রামকালী তো আর মেয়ে-ঘাটে নেমে হাত ধরে তুলে আনতে পারেন না! পারেন না ওকে সদুপদেশ দিয়ে এই সর্বনাশা সংকল্প থেকে ফেরাতে! ডাকবেনই বা কি বলে? কোন্ নামে? রামকালী যে শ্বশুর।

অথচ এখান থেকে সরে গিয়ে কোনও মেয়েমানুষকে ডেকে নিয়ে আসবার চিন্তাটাও মনে সায় দিচ্ছে না। যদি ইত্যবসরে

আরে, আরে, স্থিরচিত্রটা চঞ্চল হয়ে উঠল যে!

কলসীটা জলে ডুবিয়ে জল কাটছে যে মেয়েটা! ঈগল-দৃষ্টি ছুরির ফলার মত তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে, নিজের অজ্ঞাতসারেই মেয়ে-ঘাটের দিকে এগিয়ে যান রামকালী, এমন সংকট মুহূর্তে ন্যায় অন্যায় উচিত অনুচিত নিয়ম অনিয়ম মানা চলে না। আর একটু ইতস্তত করলেই বুঝি ঘটে যাবে সেই সাংঘাতিক কাণ্ডটা!

দ্রুতপদে একেবারে ঘাটের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন রামকালী, প্রায় আর্তনাদের মত চিৎকার করে উঠলেন, কে ওখানে? সন্ধ্যেবেলা জলের ধারে কে?

রামকালী আতঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছিলেন, তাঁর চীৎকারের ফলটা কি দাঁড়াল! ওই যে সাদা কাপড়ের অংশটুকু দেখা যাচ্ছিল এতক্ষণ, সেটা কি এই আকস্মিক ডাকের আঘাতে সহসা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল? যেটুকু দ্বিধা ছিল সেটুকু আর রইল না? ওই তো বসে রয়েছে জলের মধ্যে পায়ের পাতা ডুবিয়ে, জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে ব্যবধান শুধু একটি লহমার, একটি ডুবের। তার পরই তো ওর সব দুঃখের অবসান, সব জ্বালার শান্তি। ওইখানেই তো ওর হাতে রয়েছে সব ভয় জয় করবার শক্তি, তবে আর রামকালীর শাসনকে ভয় করতে যাবে কোন্ দুঃখে?

সাদা কাপড়টা দেখা যাচ্ছে এখনও, একটু যেন নড়ছে। রুদ্ধশ্বাস-বক্ষে অপেক্ষা করতে থাকেন রামকালী। অথচ এই বিমূঢ়ের ভূমিকা অভিনয় করা ছাড়া ঠিক এই মুহূর্তে আর কি করার আছে রামকালীর? যতক্ষণ না সত্যি মরণের প্রশ্ন আসছে, ততক্ষণ বাঁচানোর ভূমিকা আসবে কি করে? জলে পড়ার আগে জল থেকে তুলতে যাওয়ার উপায় কোথা?

যতই ভয় পেয়ে থাকুন রামকালী, এমন কাণ্ডজ্ঞান হারান নি যে শুধু ঘাটের ধারে বসে থাকা মেয়েটাকে হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে আসবেন, মেয়েটা মরতে যাচ্ছে ভেবে।

কি করবেন তবে? সাদা রংটা এখনও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় নি, এখনও কিছু করা যাবে।

সহসা আত্মস্থ হয়ে উঠলেন রামকালী, সহসাই যেন ফিরে পেলেন নিজেকে। কী আশ্চর্য! কেন বৃথা আতঙ্কিত হচ্ছেন তিনি? এখুনি তেমন হাঁক পাড়লেই তো অঞ্চলের দশ-বিশটা লোক ছুটে আসবে। তখন আর চিন্তাটা কি? নিজের ওপর আস্থা হারাচ্ছিলেন কেন?

অতএব হাঁক পাড়লেন।

তেমনি ধারাই হক বটে। মৃত্যুপথবর্তিনীও যাতে ভয়ে গুরগুরিয়ে ওঠে। জলদগম্ভীর স্বরে অভ্যস্ত আদেশের ভঙ্গীতেই হাঁক পাড়লেন রামকালী, যে হও জল থেকে উঠে এসো। আমি বলছি উঠে এসো। ভরসন্ধ্যায় জলের ধারে থাকবার দরকার নেই। আমি’টার ওপর বিশেষ একটু জোর দিলেন।

না, হিসাবের ভুল হয়নি রামকালীর।

কাজ হল। এই ভরাট ভারী আদেশের সুরে কাজ হল। কলসীটা ভরে নিয়ে তাড়াতাড়ি উঠে এল মেয়েটা একগলা ঘোমটা টেনে। সাদা রংটার গতিবিধি লক্ষ্য করে বুঝতে পারলেন রামকালী, ঘাটের সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছে ও।

আর একবার চিন্তা করলেন রামকালী, পাশ কাটিয়ে চলে যাবেন? নাকি নির্বুদ্ধি মেয়েটাকে একটু সদুপদেশ দিয়ে দেবেন?

সাধারণত শ্বশুর-বৌ সম্পর্কে কথা কওয়ার কথা ভাবাই যায় না, কিন্তু চিকিৎসক হিসাবে রামকালীর কিছুটা ছাড়পত্র আছে। বাড়ির বৌ-ঝির অসুখ-বিসুখ করলে মোক্ষদা কি দীনতারিণী রামকালীকে খবর দিয়ে ডেকে নিয়ে যান এবং তাদের মাধ্যমে হলেও পরোক্ষে অনেক সময় রোণিীকে উদ্দেশ করে কথা বলতে হয় রামকালীকে। যথা ঠাণ্ডা না লাগানো বা কুপথ্য না করার নির্দেশ। তেমন বাড়াবাড়ি না হলে অবশ্য রোগী দেখার প্রশ্ন ওঠে না, লক্ষণ শুনেই ঔষধ নির্বাচন করে দেন। কিন্তু বাড়াবাড়ির ক্ষেত্রে বলতে হয় বৈকি। অবশ্য যথাসাধ্য দূরত্ব সম্ভ্রম বজায় রেখেই বলেন। পুত্রবধূ অথবা ভ্রাতৃবধূ সম্পর্কীয়দের আপনি ভিন্ন তুমি বলেন না কখনও রামকালী।

নিধি একেবারে লঙ্ঘন করলেন না রামকালী, তবু কিছুটা করলেন। পাশ কাটিয়ে চলে না গিয়ে একটা গলাখাকারি দিয়ে বলে উঠলেন, এ সময় এরকম একা ঘাটে কেন? আর এ রকম আসবেন না। আমি নিষেধ করছি। আর একবার ‘আমি’টার উপর জোর দিলেন রামকালী।

সমুখবর্তিনী অবশ্য কাষ্ঠপুত্তলিকাবৎ রামকালীর সামনে দিয়ে হেঁটে চলে যাবে, এমন ক্ষমতা অবশ্য থাকবার কথাও নয়।

রামকাণী কথা শেষ করলেন, বাড়িতে শুভ কাজ হচ্ছে, মন ভাল করতে হয়। এমন তো হয়েই থাকে।

দ্রুত পদক্ষেপে এবার চলে গেলেন রামকালী।

রামকালী চলে গেলেও কাঠের পুতুলখানা আরও কিছুক্ষণ কাঠপাথরের মত দাঁড়িয়ে থাকে, কী ঘটনা ঘটে গেল যেন বুঝতেই পারে না। কি হল? এটা কি করে সম্ভব হল?

এমন তো হয়েই থাকে, মানে কি?

উনি কি তা হলে সব জেনেছেন? জেনেও ক্ষমা করে গেলেন? মাথা ঠাণ্ডা রেখে সদুপদেশ দিয়ে গেলেন মন ভাল করতে? সত্যিই কি তবে উনি দেবতা? দেবতা ভেবেও বুকের কাপুনি আর কমতে চায় না শঙ্করীর।

হ্যাঁ, শঙ্করী!

রাসুর বৌ সারদা নয়, কাশীশ্বরীর বিধবা নাতবৌ শঙ্করী। চিরদিন পিত্রালয়বাসিনী কাশীশ্বরীর একটা মেয়েসন্তান, তাও মরেছিল অকালে। মা-মরা দৌত্তুরটাকে বুকে করে এক বছরেরটি থেকে আঠারো বছরের করে তুলে সাধ করে সুন্দরী মেয়ে দেখে বিয়ে দিয়েছিলেন কাশীশ্বরী, কিন্তু এমন রাক্ষসী বৌ যে বছর ঘুরল না, দ্বিরাগমন হল না। তা বাপের বাড়িতেই ছিল এ যাবৎ, কিন্তু এমনি মন্দকপাল শঙ্করীর যে, মা-বাপকেও খেয়ে বসল। ছিল কাকা, সে এই সেদিন ভাইঝিকে ঘাড়ে করে বয়ে দিয়ে গেছে চাটুয্যেদের এই সদাব্রতর সংসারে। না দিয়েই বা করবে কি? শুধুই তো ভাতকাপড় যোগানো নয়, নজর রাখে কে? শ্বশুরকুলে থাকলে তবু সহজেই দাবে থাকবে। আর কপাল যার মন্দ, তার পক্ষে শ্বশুরবাড়ির উঠোন ঝাট দিয়েও একবেলা একমুঠো ভাত খেয়ে পড়ে থাকা মান্যের। বাপ কাকার ভাত হল অপমান্যির ভাত।

এইসব বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কাকা সেই যে ছেড়ে দিয়ে গেছে, ব্যস! বছর কাবার হতে চলল, উদ্দিশ নেই। অথচ এখানে শঙ্করীর উঠতে বসতে খোঁচা খেতে হচ্ছে ‘চালচলনের’ অভব্যতায়। উনিশ বছরের আগুনের খাপরা এতখানি বয়স অবধি বাপের ঘরে কাটিয়েছে, তাকে বিশ্বাসই বা কি? বিধবার আচার-আচরণই তো শেখে নি ভাল করে। নইলে বামুনের বিধবা এটুকু জানে না যে রাতে চালভাজার সঙ্গে শশা খেতে হলে আলাদা পাত্রে নিতে হয়, এক পাত্রে রাখলে ফলার হয়! এমন কি কামড়ে কামড়েও তো খেতে নেই, আলগোছা টুকরো করে মুখের মধ্যে ছুঁড়ে দিয়ে তবে চালভাজার সঙ্গে খাওয়া চলে। তা নয়, সুন্দরী দিব্যি করে একদিন শশা কেটে চালভাজার পাশে নিয়ে খেতে বসেছেন। যা-ই ভাগ্যিস মোক্ষদার চোখে পড়ে গেল, তাই না জাত-ধর্ম রক্ষে।

কিন্তু সেই একটাই নয়, পদে পদে অনাচার ধরা পড়ে শঙ্করীর, আর প্রতিপদে উপর-মহলে সন্দেহ ঘনীভূত হয়– এ মেয়ের রীত-চরিত্তির ভাল কি না।

তা রামকালীর এত তথ্য জানবার কথা নয়। কবে কোন্ দিন কোন্ অনাথা অবীরা চাটুয্যেদের সংসারে ভর্তি হচ্ছে, সে কথা মনে রাখার অবকাশ কোথায় তাঁর? কাজে-কাজেই রাসুর বৌয়ের প্রশ্ন নিয়েই চিন্তাকে প্রবাহিত করেছেন। তাছাড়া পুকুরের উঁচু পাড় থেকে ঠিক ঠাহরও হয় নি, সাদা ওই বস্ত্রখণ্ডটুকুর কিনারায় একটু রঙের রেখা আছে কি নেই।

কিন্তু না, সারদা মরতে আসে নি। সত্যবতী পিতৃ-আদেশের সঙ্গে-সঙ্গেই তাকে কড়া পাহারায় রাখতে শুরু করেছে। আর পাহারা না দিলেও মরা এত সোজা নয়। মরব বলেছে বলেই যে সত্যিই সদ্য আগত সতীনের হাতে স্বামী-পুত্র দুই তুলে দিয়ে পুকুরের তলায় আশ্রয় খুঁজতে যাবে সে তা নয়। জ্বালা নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে তাকে অন্যকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাবার ব্রত নিয়ে।

মরতে এসেছিল শঙ্করী।

মরতে এসেছিল, তবু মরতে পারছিল না।

বসে বসে ভাবছিল মরণের দশা যখন ঘটেছে তার, তখন মৃত্যু ছাড়া পথ নেই। কিন্তু কোন্ মৃত্যুটা শ্রেয়? এই রূপ-রস-গন্ধ-শব্দ-সুধাময় পৃথিবী থেকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া, না সমাজ সংস্কার সম্ভ্রম সভ্যতা মানমর্যাদার রাজ্য থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া!

শেষের মৃত্যুটা যেন প্রতিনিয়ত কী এক দুর্নিবার আকর্ষণে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে শঙ্করীকে। কিন্তু শঙ্করী তো জানে সেখানে অনন্ত নরক। তাই না যে পৃথিবীর সকরুণ মিনতির দৃষ্টি তাকিয়ে আছে ভোরের সূর্য আর সন্ধ্যার মাধুরীর মধ্যে, তার কাছ থেকেই বিদায় নিতে এসেছিল শঙ্করী?

কিন্তু পারল কই?

শুধুই কি মামাঠাকুরের দুর্লজ্জ আদেশ! ঘাটের পৈঠাগুলোই কি তাকে দুর্লঙ্ঘ্য বাঁধনে বেঁধে রাখে নি?

তবে কি শঙ্করীর মৃত্যু বিধাতার অভিপ্রেত নয়? তাই দেবতার মূর্তিতে উনি এসে দাঁড়ালেন মৃত্যুর পথ রোধ করে?

হঠাৎ এমনও মনে হল শঙ্করীর, সত্যিই মামাঠাকুর তো? নাকি কোন দেবতার ছল? ঠাকুর দেবতারা মানুষের ছদ্মবেশে এসে মানুষকে ভুল-ঠিক বুঝিয়ে দিয়ে যান, অভয় দিয়ে যান, এমন তো কত শোনা যায়!

বাড়ি ফিরে শঙ্করী যদি কোনপ্রকারে টের পায় রামকালী এখন কোথায় রয়েছেন, তা হলেই সন্দেহ ভঞ্জন হয়। ভাবতে ভাবতে ক্রমশ শঙ্করীর এমন ধারণাই গড়ে উঠতে থাকে, নিশ্চয় খোঁজ নিলে দেখা যাবে মামাঠাকুর এখন এ গ্রামেই নেই, রোগী দেখতে দূরান্তরে গেছেন। নিশ্চয় এ কোন দেবতার ছল। নইলে সত্যিই তো মামাঠাকুর এমন ঘুলঘুলি সন্ধ্যেয় মেয়েঘাটের কিনারায় ঘুরবেনই বা কেন?

আর সেই হাঁকপাড়াটা?

সেটাই কি ঠিক মামাশ্বশুরের কণ্ঠস্বর? মাঝে মাঝে তো ভেতরবাড়িতে আসেন মামাঠাকুর, কথাবার্তাও কন মা’র সঙ্গে, খুড়ীর সঙ্গে, কই গলার শব্দে এতটা চড়া সুর শোনা যায় না তো? মৃদুগম্ভীর ভারী ভরাট গলা, আর কথাগুলি দৃঢ়গম্ভীর।

এ মামাঠাকুরকে দেখলে পুণ্যি হয়।

বড় মামাঠাকুরের মতন নন ইনি। বড় মামাঠাকুরকে দেখলে ভক্তি-ছো ছুটে পালায়। কিন্তু কথা হচ্ছে ছদ্মবেশ সম্বন্ধে একেবারে নিঃসংশয় হবার উপায়টা কি? কোথায় মেয়েমহল আর কোথায় পুরুষমহল! চাটুয্যেদের এই শতখানেক সদস্য সম্বলিত সংসারে স্ত্রীরাই সহজে স্বামীদের তত্ত্ব পান, তা আর কেউ! অবশ্যি পুরুষের তত্ত্ববার্তা নেবার প্রয়োজনটাই বা কি মেয়েদের? দুজনের জীবনযাত্রার ধারা তো বিপরীতমুখী। পুরুষের কর্মধারার চেহারা যেমন মেয়েদের অজানা, সেদিকে উঁকি মারবার সাহস মেয়েদের নেই, তেমনি পুরুষের নেই অবকাশ মেয়েদের কর্মকাণ্ডের দিকে অবহেলার দৃষ্টিটুকুও নিক্ষেপ করবার।

একই ভিটেয় বাস করলেও উভয়ে ভিন্ন আকাশের তারা।

তবু মনে হতে লাগল শঙ্করীর, কোন উপায়ে একবার খোঁজ করা যায় না! মামাঠাকুর বাড়িতে আছেন কিনা, থাকলে কি অবস্থায় আছেন? এইমাত্র ফিরলেন, না অনেকক্ষণ থেকে বসে আছেন?

আহা, মামাঠাকুরের সঙ্গে যদি কথা কইতে পারা যেত! তাহলে বোধ করি ভগবানকে দেখতে পাওয়ার আশাটা মিটত শঙ্করীর। তা ওঁকে ভগবানের সঙ্গে তুলনা করবে না তো করবে কি শঙ্করী? এত ক্ষমা আর কোন মানুষের মধ্যে সম্ভব? এত করুণা আর কার প্রাণে আছে? শঙ্করীর মর্মকথা জানতে পারলে ত্রিজগতের কেউ কি অমন দয়া অমন সহানুভূতি দিয়ে কথা বলতে পারত? নাঃ, তারা মাথা মুড়িয়ে ঘোল ঢেলে গাঁয়ের বার করে দিত শঙ্করীকে। আর পিছনে ঘৃণার হাততালি দিতে দিতে বলত, ছি ছি ছি, গলায় দড়ি! তুই না হিন্দুর মেয়ে! তুই না বামুনের ঘরের বিধবা!

আচ্ছা কিন্তু, হঠাৎ যেন সর্বশরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে শঙ্করীর, মামাঠাকুর টের পেলেন কি করে? কে বলবে, কে জানে? তাও যদি বা কোন প্রকারে সন্ধান পেয়ে থাকেন, যদি সেই পরম শত্রুটাই এসে কোন ছলে ভয়ে-ভয়ে ফাঁস করে দিয়ে গিয়ে থাকে– শঙ্করী যে আজ এই সন্ধ্যায় ডুবে মরবার সংকল্প নিয়ে ঘাটে এসেছিল, এ কথা জানতে পারলেন কি করে তিনি?

মাত্র আজই তো দণ্ডকয়েক আগে সংকল্পটা স্থির করেছে শঙ্করী, অনেক ভেবে, অনেক নিঃশ্বাস ফেলে, অনেক চোখের জলে মাটি ভিজিয়ে। বিয়েবাড়ি, শাশুড়ী দিদিশাশুড়ীর দল বাড়তি কাজে ব্যস্ত, কে কোথায় কি করছে না-করছে কেউ লক্ষ্য করবে না, আজই ঠিক উপযুক্ত সময়। তা ছাড়া আসছে কাল বাড়িতে যজ্ঞি, আত্মীয়-কুটুষের ভিড় লাগবে বাড়িতে। কে জানে কোন ছুতোয় কে শঙ্করীর রীতিনীতির ব্যাখ্যান করবে, শঙ্করীর চালচালনের নিন্দে করবে, চি-টি পড়ে যাবে বাড়িতে।

না না, মরতেই যদি হয়, আজকেই হচ্ছে তার শ্রেষ্ঠ সময়। এইসব সাত-সতেরো ভাবনার বোঝা মাথায় করে ঘাটে এসেছিল শঙ্করী, জীবনে সমস্ত বোঝা নামিয়ে দেবার জন্যে। কিন্তু, আবার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল শঙ্করীর, কিন্তু বিধাতা নিষেধ করলেন।

মরণের দরজা থেকে জীবনের রাজ্যে ফিরিয়ে আনলেন শঙ্করীকে।

তবে আর দ্বিধা কেন?

.

শঙ্করী বিধবা হলেও ওর আনা জল নিরামিষ ঘরে চলে না। ও ‘অনাচারে’, ওর অদীক্ষিত শরীর। জলের কলসীটাকেই তাই মাঝের দালানে এনে বসাল শঙ্করী, ছেলেপুলেদের খাওয়ার দরকারে লাগবে।

কলসী নামানোর শব্দে কোথা থেকে যেন এসে হাজির হল সত্যবতী। এসেই এদিক ওদিক তাকিয়ে আস্তে আস্তে বলল, সব্বনাশ করেচ কাটোয়ার বৌ, তোমার নামে টি-টিক্কার পড়ে গেছে! বাড়িতে অনেক বৌ, কাজেই আশপাশের বৌদের তাদের বাপের বাড়ির দেশের নাম ধরে অমুক বৌ, তমুক বৌ বলতে হয়। তা ছাড়া শঙ্করী নবাগতা, ওর আর পর্যায়ক্রমে মেজ-সেজ দিয়ে নামকরণ হয় নি।

বুকটা ধড়াস করে উঠল শঙ্করীর।

কিসের সব্বনাশ!

তবে কি সব ধরা পড়ে গেছে?

ঘরের কোণে রাখা মাটির প্রদীপের আলোয় মুখের রং-গড়ন দেখা গেল না, শুধু গলার স্বরটা শোনা গেল, কাঁপা কাঁপা ঝাঁপসা।

কিসের সব্বনাশ, রাঙা ঠাকুরঝি?

আজ না তোমার লক্ষ্মীর ঘরে সন্ধ্যে দেবার পালা ছিল? সত্যর কণ্ঠস্বরে বিস্ময় আর সহানুভূতি।

লক্ষ্মীর ঘরে সন্ধ্যে দেখানোর পালা।

ওঃ, শুধু এই!

বুকের পাথরটা নেমে গেল শঙ্করীর, হালকা হল বুক। হোক এটা ভয়ানক মারাত্মক একটা অপরাধ, আর তার জন্যে যত কঠিন শাস্তিই হোক মাথা পেতে নেবে শঙ্করী।

অবশ্য এই দরদের ধিক্কারে চখে জলে এসে গিয়েছিল তার।

সত্য গলাটা আর একটু খাটো করে বলে, আর তাও বলি কাটোয়ার বৌ, এই ভরসন্ধ্যে পর্যন্ত ঘাটে থাকার তোমার দরকারটাই বা কি ছিল? সাপখোপ আছে, আনাচেকানাচে কু-লোক আছে–

শঙ্করী সাহসে বুক বেঁধে বলে, দিদিমা খুব রাগ করছিলেন বুঝি?

রাগ? রাগ হলে তো কিছুই না। হচ্ছিল গিয়ে তোমার ব্যাখ্যানা!

সত্যবতী হাত-মুখ নেড়ে বলে, আর সত্যিও বলি কাটোয়ার বৌ, তোমারই বা এত বুকের পাটা কেন? ভর-সন্ধ্যেবেলা একা ঘাটে গিয়ে যুগযুগান্তর কাটিয়ে আসা কেন? আবার আজই সন্ধ্যে দেখানোর পালা। ঠাম্মারা তো তোমায় পাশ-পেড়ে কাটতে চাইছিল।

তাই কাটো না ভাই তোমরা আমায়– শঙ্করী ব্যগ্রকণ্ঠে বলে, তা হলে তোমরাও বাঁচো, আমার মনস্কামনা সিদ্ধি হয়।

সত্য ভ্রূভঙ্গী করে গালে হাত দিয়ে বলে, ওমা! তোমার আবার কিসের মনস্কামনা? তুমি আবার বড়বৌয়ের মত বোল ধরেছ কেন? বড়বৌও যে এতক্ষণ আমায় বলছিল, আমায় একটু বিষ এনে দাও ঠাকুরঝি, খাই। তোমার দাদার হাতের সুতো খোলার আগেই যেন আমার মরণ হয়, সে দৃশ্য দেখতে না হয়।

সত্যি বলতে কি, সারদার সঙ্গে শঙ্করীর এখনও তেমন ভাব হয় নি। প্রথম তো বয়সের ব্যবধান, তাছাড়া সারদা ছিল স্বামী-সোহাগিনী নবপুত্রবতী, আর শঙ্করী ছাইফেলার ভাঙাকুলো। আরও একটা কথা– দুজনের এলাকা আলাদা। শঙ্করীকে থাকতে হয় বিধবামহলে, তাদের হাতে হাতে মুখে মুখে ফাঁইফরমাশ খাটতে– সারদা সধবা মহলের জীব। খাওয়া শোওয়া বসা সব কিছুর মধ্যেই আকাশ-মাটির পার্থক্য।

কিন্তু আপাতত সারদা অনেকটা নেমে পড়েছে, এখন শঙ্করীও তাকে করুণা করতে পারে। তাই করে শঙ্করী। দরদের সুরে বলে, তা বলতে পারে বটে আবাগী।

বলি সে নয় বলতে পারল, তোমার কি হল? তোমার অকস্মাৎ কিসের জ্বালা উথলে উঠল?

আমার পোড়াকপালে তো সব্বদাই জ্বালা ঠাকুরঝি। শঙ্করী নিঃশ্বাস ফেলে।

সত্য হাত নেড়ে বলে,আহা, কপাল তো আর তোমার আজ পোড়ে নি গো! ঠামারা তো সেই কথাই বলছিল, সোয়ামীকে তো কোন্ জন্মে ভুলে মেরে দিয়েছ, তবে আবার তোমার সদাই মন উচাটন কিসের? কিসের চিন্তে কবরা রাতদিন?

মরণের! শঙ্করী দালানের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে পড়ে বলে, ও ছাড়া আমার আর চিন্তা নেই।

তা ভাল। সত্য আবার দুই হাত নেড়ে কথার সমাপ্তি টেনে মল বাজিয়ে চলে যায়, সব মেয়েমানুষের মুখে দেখি এক রা, মরব মরছি মরণ হয় তো বাঁচি! এ তো আচ্ছা ফ্যাসাদ!

শঙ্করী আর এ কথার উত্তর দেয় না, বসে বসে হাঁপাতে থাকে। আসুক ঝড়, আসুক বজ্রাঘাত, এখানে বসে বসেই মাথা পেতে নেবে সে, উঠে গিয়ে পায়ে হেঁটে ঝড়ের মুখে পড়বার শক্তি নেই।

তা একটু বসে থাকতে থাকতেই ঝড় এল।

কিংবা শুধু ঝড় নয়, বৃষ্টি-বজ্রাঘাতও তার সঙ্গী হয়েছে।

শঙ্করী ফিরেছে শুনে খোঁজ করতে এসেছেন কাশীশ্বরী আর মোক্ষদা।

পিছনে দর্শকের ভূমিকা নিয়ে ভুবনেশ্বরী, রামকালীর স্ত্রী।

১১. অপরাধটা হচ্ছে লক্ষ্মীর ঘরে

অপরাধটা হচ্ছে লক্ষ্মীর ঘরে যথাসময়ে প্রদীপ না দেওয়ার কিন্তু শাস্তির আশঙ্কায় সমস্ত শরীর কণ্টকিত হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শঙ্করীর মনের পটে যে ছবি ভেসে উঠল সেটা লক্ষ্মীর ঘট অথবা গৃহদেবতার পটগুলির নয়, নিজের যে অপরাধের শাস্তির আশঙ্কাটা সমস্ত দেহমন শিথিল করে ছিল শঙ্করীর, সে অপরাধের সঙ্গে এ বাড়ির, এমন কি এ গ্রামেরও কোন সম্পর্ক নেই।

অপরাধের জায়গাটা হচ্ছে শঙ্করীর বাপের বাড়ির আমবাগান। সময়টা গা ঝিমঝিমে ভরদুপুর।

নতুন ফাল্গুনের থেকে থেকে ঝিরঝিরি আর থেকে থেকে দমকা বাতাস বইছে আর নতুন “গুটি বাঁধা” আমগাছগুলো সে বাতাসে যেন মাতলামির খেলা জুড়েছে। কিছু কিছু গাছ কিন্তু খানিকটা পিছিয়ে আছে, তাদের এখনো বোল ঝরে আম ধরে নি। পাতার ফাঁকে ফাঁকে মঞ্জরীর সমারোহ।

নির্জন দুপুরে সেই বাগানে শঙ্করী আর নগেন।

নগেনের হাতের মধ্যে শঙ্করীর হাত।

আলগা করে এলিয়ে পড়ে থাকা নয়, হাতখানা বজ্রমুষ্টিতে ধরে রেখেছে নগেন, পাছে শঙ্করী পালিয়ে যায়! যতক্ষণ না নগেনের বক্তব্যটা সম্পূর্ণ শেষ হবে, ততক্ষণ শঙ্করীর ছাড়ান নেই।

অনেক দিন ধরে অনেক ছোটখাটো কথা, অনেক ইশারা-ইঙ্গিতের দূত মারফৎ নিজের বক্তব্য জানিয়েছে নগেন শঙ্করীকে, অনেক করুণ দৃষ্টি, অনেক চোরা হাসির সওগাতে। আজ বোধ করি একেবারে হেস্তনেস্ত করতে চায় সে।

কিন্তু নগেন কি শঙ্করীকে গায়ের জোরে এই নির্জন আমবাগানে টেনে এনেছিল? মুখে কাপড় বেঁধে, পাজাকোলা করে?

তা তো নয়।

সহায়সম্বলহীন ছেলেটার এত সাহস কোথা? মাসীর বাড়ির অন্ন খেয়ে খেয়ে তো মানুষ।

শঙ্করীর কাকীই নগেনের মাসী।

মা-মরা বোনপোকে কাছে এনে মানুষ করেছেন কাকী নিজের ছেলেদের সঙ্গে। সে সংসারে শঙ্করীও বেড়ে উঠেছে।

মাঝখানে শুধু একটা বিয়ের ব্যাপার।

কিন্তু সে আর ক’দিনের? অষ্টমঙ্গলাতেই তো তার সমাপ্তি।

একই বাড়িতে বাস করেছে দুজনে। ভাই-বোনের মত। অথচ আশ্চর্য, মনোভাবটা কিছুতেই কেন ভাই-বোনর মত তৈরী হল না!

কেন ছোট্টবেলা থেকে শঙ্করীর নিজের খুড়তুতো দাদারা শঙ্করীর চুলের মুঠি ধরেছে আর পান থেকে চুন খসলে খিঁচিয়েছে, আর নগেন কেনই বা বরাবর সেই দুঃখ-যন্ত্রণায় স্নেহের প্রলেপ লাগিয়েছে, অত্যাচারীদের প্রতি কটুক্তি করেছে!

পৃথিবীতে কি জন্যে কি হয় শঙ্করীর বোধের বাইরে। বোধের জগৎটা ওর নেহাই সীমাবদ্ধ। নইলে আঠারো বছরের বিধবা মেয়ের পক্ষে ভরা ভরদুপুরে আমবাগানে এসে একটা বেটাছেলের সঙ্গে কথা কওয়া যে কতদূর গর্হিত, সে বোধ থাকা উচিত ছিল বৈকি একটা আঠারো বছরের মেয়ের।

কিন্তু সত্যিই কি এটুকু বোধও ছিল না শঙ্করীর?

চব্বিশ ঘণ্টা কাকীর দাঁতের পিষুনিতে সে বোধ জন্মায় নি? বাগানে এসেছিল কি শঙ্করী নির্ভয় নিশ্চিন্তে?

না, অবোধ হলেও এতটা অবোধ নয় শঙ্করী। এসেছিল বুকের মধ্যে ভয়ের বাসা নিয়েই সকালে যখন নগেন এ আবেদন জানিয়েছে, তখন থেকেই বুকের মধ্যে ঢেঁকির পাড় পড়ছে তার। সকল কাজে ভুলচুক হয়েছে। তবু এসেছে।

তবু কি ভাগ্যিস আজ আর রান্নাঘরের ভারটা ঘাড়ে নেই। কাল শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে, বলতে গেলে জন্মের শোধই চলে যাবে, এই মমতায় গৃহকত্রী শঙ্করীকে হেঁসেলের দায়িত্ব থেকে ছুটি দিয়েছেন। আর যখন শঙ্করী নিতান্ত বিনীত মূর্তিতে, নিতান্ত কাচুমাচু মুখে আবেদন জানিয়েছে, বকুলফুলের বাড়ি একবার যাব কাকীমা? তখন না করতে পারেন নি তিনি।

বাগানে এসেই প্রথম এই ছলনার খবর শুনে হেসে উঠেছিল নগেন। বলেছিল, তা গুরুজনের সঙ্গে মিছে কথা কয়েছিস ভেবে অত মনমরা হচ্ছিস কেন? ধরে নে না আমিও তোর একটা বকুলফুল?

কিন্তু এখন আর নগেনের মুখে হাসি নেই, এখন নগেনের অন্য ভাব। এখন কেমন রুক্ষ হিংস্র উদভ্রান্ত মতন। এখন বজ্রমুষ্টিতে শঙ্করীর হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে চায় ভিন্ন এক জগতে।

পালিয়ে গিয়ে অন্য আরেক দূরের আর এক গাঁয়ে চলে যাই না? সেখানে কে চিনবে আমাদের? বলব আমরা স্বামী-স্ত্রী, আগুন লেগে ঘরবাড়ি ক্ষেতখামার সব পুড়ে গেছে, তাই মনের আক্ষেপে দেশ-ভুঁই ছেড়ে চলে এসেছি।

অমন পাপকথা বললে যে জিভ খসে যাবে নগেনদাদা। নরকেও ঠাই হবে না আমাদের। উচ্চারণ করে শঙ্করী, কিন্তু সে উচ্চারণে কোথাও কোন জোর প্রকাশ পায় না। পাপের আশঙ্কায় আগে থেকেই কি জিভ শিথিল হয়ে এল শঙ্করীর?

পাপ কিসের? তোর ওই বে-টা কি রে? স্বামীর ঘর করেছিস তুই? জন্ম-জন্মান্তর থেকে তুই আর আমি পতি-পত্নী, বুঝলি? তাই ওই একটা উটকো স্বামী সইল না তোর। নইলে এতদিন তুই কোথায় থাকতিস, আর আমি কোথায় থাকতাম। তুই মন ঠিক কর শঙ্করী, দোহাই তোর!

এ কথা কানে শুনলেও যে অনন্ত নরক নগেনদাদা।

তাই যদি হয়, নগেন উগ্রমূর্তিতে বলে ওঠে, নরকেই যদি যেতে হয়, তোকে তো একলা যেতে হবে না। আমাকেও যেতে হবে। তোর জন্যে সে ক্লেশও মেনে নিচ্ছি আমি। পৃথিবীর আর সব্বাই যাক তো স্বর্গে, তুই আর আমি নয় নরকেই থাকব। এ জন্মটা তো তবু ভাল যাবে।

এইটাই কি একটা নেয্য কথা হল? না নগেনদাদা, তোমার পায়ে ধরি, আমায় ছেড়ে দাও। কেউ যদি এ অবস্থায় দেখে ফেলে, তা হলে আর আমার ঘরে ঠাই হবে না।

ভালোই তো– নগেন হাতটা ছেড়ে দেওয়ার পরিবর্তে আরও জোরে চেপে ধরেছিল, বুঝিবা একটু কাছেও টেনেছিল, বলেছিল, ঘর থেকে দূর করে দিলে আমাদের সুরাহাই হবে। কলঙ্ক ছড়ালে শ্বশুরবাড়ি থেকেও নেবে না তোকে, তখন দুজনে চলে যাওয়া সোজা হবে। শাপে বর হবে আমাদের।

না না, নগেনদাদা, হাত ছাড়। তোমার মনে এত কু জানলে কখনো এখানে আসতাম না আমি। তুমি বললে একটা কথা আছে–

নগেন কখনো যা না করেছে তাই করল। অগ্নিমূর্তি হয়ে খিঁচিয়ে উঠল, ন্যাকামি করিস নে। জানলে আসতাম না! তোর সঙ্গে আমার কি ভাগবত-কথা থাকবে শুনি? আমি বলছি তুই আমার সঙ্গে পালিয়ে চল!

সজ্ঞানে নয়, অসতর্কে মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়ল, কোথায়?

নগেন মহোৎসাহে বলে ওঠে, যেখানে হোক। অনেক দূরের কোন গাঁয়ে। সেখানে শুধু তুই আর আমি সুখে সংসার করব। ছোট্ট একখানা মাটির কুঁড়ে, একটু শাকপাতার বাগান, একটা একছিট্টে পুকুর, এর বেশী আর কি চাই আমাদের ব! তা সেটুকু সংস্থান করতে পারব। পেটে তো একটু বিদ্যে করেছি, কিছু না পারি একখানা পাঠশালা খুলব। কারুর কোন ক্ষেতি নেই তাতে শঙ্করী।

বুকের মধ্যেকার সেই ঢেঁকির পাড় পড়াটা বন্ধ হয়ে কী এক কাঁপা কাঁপা সুখে মনটা দুলে উঠল শঙ্করীর? চোখ দুটো কি জলে ভরে এল না? নতুন ফাগুনের সেই থেকে থেকে ঝিরি ঝিরি, থেকে থেকে দমকা বাতাসে শরীরটা কেমন অবশ-অবশ হয়ে আসে নি কি? মনে কি হয় নি, সত্যিই তো- তাতে কার কি ক্ষতি? শ্বশুরবাড়ি সে চোখে দেখে নি, এক দিনও ঘর করে নি। চেনে না তাদের, জানে না শঙ্করীকে না পেলে কার কি সুখ-দুঃখ, কার কি লাভ-লোকসান! কাকারা যদি খবর দেয়, শঙ্করী বলে যে একটা মেয়ে ছিল তাদের ঘরে যে নাকি কবরেজ-বাড়ির ভাগ্নেবৌ ছিল– হঠাৎ ওলাওঠা হয়ে মরে গেছে সে, কত কাঁদবে কবরেজ-বাড়ির লোকেরা?

আর কাকা-খুড়ী?

মরে গেছে বলে রটিয়ে দিলে সমাজের কাছে পার পাবে না?

না, বেশীক্ষণ এ চিন্তা মনে স্থান পায় নি। বাতাসটা হঠাৎ বন্ধ হয়ে ভয়ানক যেন গুমোট হয়ে উঠল, চেতনা ফিরে পেল শঙ্করী। বলে উঠল, হিদুর ঘরের বিধবাকে বেরিয়ে যাবার কুমন্তরণা দিতে লজ্জা করে না তোমার? তুমি না আমার ভাইয়ের মতন?

না, কখনো না! গর্জে ওঠে নগেন, কখনো ভাইয়ের মতন নয়। সে কথা তুইও ভাল জানিস, আমিও ভাল জানি। চিরদিন মনে মনে আমি তোকে পরিবারের মতন দেখে এসেচি। জেনেশুনে কেন মিছে বাকচাতুরি করছিস! কথা দে, দুপুররাতে তুই খিড়কি দিয়ে বেরিয়ে এসে এখানে দাঁড়াবি, আমি আগে থেকে দাঁড়িয়ে থাকব। তার পর জোর পায়ে হেঁঠে গাঁ থেকে একবার বেরোতে পারলে কে ধরে? খুঁজতে তো আর পারবে না মাসী-মেসো? কিল খেয়ে কিল চুরি করে বসে থাকতে হবে!

ও নগেনদাদা, আমার বুকের ভেতরটা কেমন করছে, ছেড়ে দাও আমায়। আমি পারব না।

পারতেই হবে তোকে। নগেন ব্যাকুল স্বরে বলে, যতক্ষণ না তুই মত দিবি, ছাড়ব না হাত! দেখুক পাঁচজনে, সেই আমি চাই।

নগেনদাদা, আমি চেঁচিয়ে লোক জড়ো করব। আলগা আলগা দুর্বল স্বরে বলে শঙ্করী, বলব বাগানে একলা পেয়ে তুমি আমাকে

নগেন বেপরোয়া, বলে, চেঁচা। জড়ো কর লোক।

নগেনদাদা গো, আমাকে বরং মেরে ফেল।

আমি আর কি মারবো তোকে? মেরেই তো ফেলেছে সবাই মিলে। বাপের বাড়িতেই লাথি ঝটা না খেয়ে একমুঠো ভাত জুটছিল না, মরার ওপর খাঁড়ার ঘা, এর পর আবার শ্বশুরবাড়ি সারা জন্মটা শুধু লাথি-ঝাটা সার। আমিই বরং তোকে বাঁচাতে চাই। আদর করে যত্ন করে মাথার মণি করে রাখতে চাই।

আমি চাই না তোমার আদর-যত্ন। এবার একটু দৃঢ় শোনাল শঙ্করীর কণ্ঠস্বর, লাথি-ঝাঁটাই আমার ভাল।

বটে! লাথি-ঝাটাই তোর ভাল? নগেন সহসা মারমুখী হয়ে একটা কাজ করে বসল।

হ্যাঁ, আদর করে প্রেমালিঙ্গন নয়, মারমুখী হয়ে সহসা শঙ্করীকে সাপটে জড়িয়ে ধরল নগেন, ধরে বলে উঠল, বেশ, সেটাই যাতে আরও ভাল করে খাস তার ব্যবস্থা করছি। এই দিচ্ছি দেগে, তার পর তোর শ্বশুরবাড়ির গায়ে রটাব, ও আমার সঙ্গে মন্দ–

কী ভাবে যে নগেনের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়েছিল শঙ্করী, কী ভাবে যে একেবারে ঘাটে ডুব দিয়ে বাড়ি গিয়ে বলেছিল বকুলফুলের বাড়ি যাওয়া হল না, রাস্তায় একখানা ছুতোহাড়ি পায়ে ঠেকে গেল বলে একেবারে নেয়ে বাড়ি ফিরতে হল, আর কি করে যে অসময়ে নেয়ে মাথাটা ভার হয়েছে বলে দিনের বাকী সময়টা শুয়ে কাটাল, সে আর ভাল করে মনে পড়ে না শঙ্করীর।

শুধু মনে আছে তার প্রবল কান্নার ব্যাপার দেখে কাকাসুদ্ধু মমতা-মমতা গলায় সান্ত্বনা দিয়েছিল, কেন কাঁদছিস মা, মেয়েমানুষকে তো শ্বশুরঘর করতেই হয়। সেই হচ্ছে চিরকালের জায়গা। তা ছাড়া কবরেজ মশাই অতি সজ্জন ব্যক্তি, সংসারে খাওয়া-পরার কোন দুঃখু নেই, ভাল থাকবি, সুখে থাকবি।

তবু আরও আকুল হয়ে কেঁদেছিল শঙ্করী। অগত্যা খুড়ীকে পর্যন্ত বলতে হয়েছিল, আবার আসবি, পালাপার্বণে আসবি, আমরা কি তোকে পর করে দিচ্ছি?

.

বছর ঘুরে গেল, খুড়ীর প্রতিশ্রুতি খুড়ী রাখে নি। নিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা, একবার উদ্দিশ পর্যন্ত করে নি। সে গাঁয়ের এক কানাকড়া খবরও আর সেই অবধি পায় নি শঙ্করী। শুধু অবিরত কাটা হয়ে থেকেছে, ওই বুঝি কে বলে, নগেন বলে একটা ছেলে এসে গ্রামে কি রটিয়ে বেড়াচ্ছে শঙ্করীর নামে!

ঘাটেপথে বেরিয়ে গাছের পাতা নড়ার শব্দে শিউরে ওঠে শঙ্করী, বাঁশের সরসরানি শুনলে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে।

কিন্তু?

সে ভয় কি শুধুই ভয়? নিছক ভয়?

তার সঙ্গে ভয়ানক একটা আশাও জড়ানো নেই?

সর্বদা কি মনে হয় না, হঠাৎ কোন একটা বাঁশবাগানের ধারে, কি পুকুরঘাটের কাছে সেই সর্বনেশে লোকটাকে দেখতে পায় তো আর বাড়ি ফেরে না।…

কাল শুনেছে, বিয়ে উপলক্ষে কাকার বাড়ি থেকে নেমন্তনিতে আসবে। কাল থেকে তাই মরে আছে শঙ্করী।

কি জানি কি বলবে খুড়ো কি খুড়তুতো ভাইরা এসে!

নগেন কি সব বলে বেড়িয়েছে?

নগেন কি ওখানে আছে এখনও?

নগেন কি বেঁচে আছে?

হয়তো টের পেয়ে সবাই মেরে ফেলেছে।

সেদিন কেন আমবাগানে গিয়েছিল শঙ্করী? আর যে লোকটা তাকে মন্দ পথে টানবার চেষ্টা করছিল, কেন আজও শঙ্করীর মনকে লক্ষ দড়িদড়া দিয়ে টানছে সে?

মরতে গিয়েও কেন মরতে পারে না শঙ্করী!

পৃথিবীতে শঙ্করী বলে একটা মেয়েমানুষ যদি না থাকে কি এসে যাবে পৃথিবীর! কলঙ্কিত মন নিয়ে ঠাকুরঘরের কাজ করছে সে, তুলসীতলায় প্রদীপ দিচ্ছে, এ মহাপাপের ফল–

চিন্তায় বাধা পড়ল।

কাশীশ্বরী এসে দাঁড়িয়েছেন, তীব্রকণ্ঠে ডাকছেন, নাতবৌ!

১২. সত্যর মনের কাছে এত বড় ভয়ের পরিচয়

ভয়! ভয়!

সত্যর মনের কাছে এত বড় ভয়ের পরিচয় বোধ করি এই প্রথম।

কাটোয়ার বৌয়ের খুব যে একটা খোয়ার হবে এটা আশঙ্কা করছিল সত্য, কিন্তু এ কি! তিরস্কারের এ কোন ভাষা? জীবনে অনেক কথা শুনেছে সত্য, অনেক কথা শিখেছে, কিন্তু এসব শব্দ তো কখনো শোনে নি।

অসতী মানে কি? উপপতি কাকে বলে? কুল খাওয়া বলতেই বা কি বোঝায়?

যে কুলের আচার তৈরি হয়, আর তেলে-নুনে জরিয়ে অপূর্ব আস্বাদন পাওয়া যায়, এটা যে ঠিক সে জাতীয় নয়, এইটুকুই শুধু বুঝতে পারে সত্য। কিন্তু তার পরই কেমন দিশেহারা হয়ে যায়। দূর থেকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে শঙ্করী আর কাশীশ্বরীর দলের দিকে।

না, আর কেউ কিছু বলছে না, সবাই নিথর, এমন কি মোক্ষদা পর্যন্ত কেমন যেন স্তব্ধ, একা কাশীশ্বরীই পালা চালিয়ে যাচ্ছেন, চাপা তীক্ষ্ণ গলায়।

শঙ্করীকে ধরে চিবিয়ে খেলেও বুঝি রাগ মিটবে না, এমনি সব মুখভঙ্গী।

মোক্ষদা এক ধরনের, কাশীশ্বরী আর এক ধরনের। মোক্ষদার অটুট গতর, অসীম ক্ষমতা, অনর্গল বাকপটুত্ব। কিন্তু কাশীশ্বরীর তা নয়। কাশীশ্বরী শোকেতাপে কিছুটা অথর্ব, তাছাড়া চিরদিনই তিনি টেপামুখী। শুধু তেমন মোক্ষম অবস্থায় পড়লেই মুখ দিয়ে কথা বেরোয় তাঁর চাপা তীক্ষ্ণ।

কিন্তু আজকের মত এমন সব কথা কবে বেরিয়েছে কাশীশ্বরীর মুখ দিয়ে? এমন ঘৃণা-জর্জরিত মুখই বা কবে দেখা গেছে তাঁর?

কে গিয়েছিল কাটোয়ায়?

কে কি শুনেছে এসেছে সেখান থেকে? বার বার শঙ্করীর বাপেরবাড়ির কথাই বা উঠছে কেন? তারা নাকি কেউ ভোজবাড়িতে আসবে না, সম্পর্ক রাখতে চায় না শঙ্করীর সঙ্গে। নেহাৎ নাকি তারা শঙ্করীর মা-বাপ নয়, খুড়োখুড়ী, তাই অমন মেয়েকে টুকরো টুকরো করে কেটে কাটোয়ার গঙ্গায় ভাসিয়ে দেয় নি।

আরও কত কথা, তার সঙ্গে কত মুখভঙ্গী!

শঙ্করীকে গলায় দড়ি দিয়ে মরবার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে, দেওয়া হচ্ছে ঘাটে ডুবে মরবার নির্দেশ! পাপিষ্ঠা শঙ্করীর পাপস্পর্শেই যে কাশীশ্বরীর একমাত্তর নাতিটা বিয়ের বছর না ঘুরতেই মরেছে, সেকথাও প্রমাণিত হয়ে যাচ্ছে আজকের বিচারের রায়ে।

অনেক শুনতে শুনতে শেষ পর্যন্ত এইটুকু বুঝতে পারে সত্য, নাপিত-বৌ আর রাখু কাটোয়া গিয়েছিল যজ্ঞির জন্যে নেমন্তন্ন করতে। আর শঙ্করীর খুড়ী নাপিত-বৌয়ের কাছে শঙ্করীর নামে যাচ্ছেতাই করেছে।

সেখান থেকে খুব যে একটা গর্হিত কাজ করে চলে এসেছে শঙ্করী, সে বিষয়ে আর সন্দেহমাত্র নেই। লক্ষ্মীর ঘরে সন্ধ্যা দিতে দেরি হওয়া অথবা সাঁঝ-সন্ধ্যে পর্যন্ত ঘাটে বসে থাকার চাইতে যে অনেকে বেশী গর্হিত তা বুঝতে পারা যাচ্ছে।

কিন্তু শঙ্করীর অপরাধের সঙ্গে তার খুড়ীর বোনগোর যোগ কোথায়? সে কেন শঙ্করীর জন্যে বাড়ি ছেড়ে নিরুদ্দিশ হয়ে চলে গেছে?

এইখানেই সব গোলমাল লাগছে সত্যর।

সব যেন হেঁয়ালি।

এই অন্য জগতের অর্থবহ, জীবনে না-জানা শব্দগুলো সত্যর বুকটাকে কেমন হিম-হিম করে দিচ্ছে। ভয় করছে। যে অনুভূতি জীবনে জানে না সত্য, আজ সেই অনুভূতি তার সমস্ত সাহসকে যেন বোবা করে দিয়েছে।

গিন্নীরা কাউকে শাসন করছেন, অথচ সত্য তার মধ্যে ফোড়ন কাটছে না, এমন ঘটনা বোধ করি সত্যর জ্ঞানে এই প্রথম। অপরাধীর পক্ষ নেওয়াই সত্যর স্বভাব। তা সে অপরাধী যে শ্রেণীর হোক।

একবার বাসন-মাজুনী বাণী-বৌ সন্ধ্যে করে ঘাটে বাসন মাজতে গিয়ে পাজার বাসন থেকে একটা বাটি হারিয়ে ফেলেছিল। খুব সম্ভব বাটিটা জলেই ডুবে গিয়েছিল, কিন্তু বাণী-বৌকে ‘চোর’ অপবাদ দিয়ে ন ভূতো ন ভবিষ্যতি করেছিলেন শিবজায়া আর দীনতারিণী। এবং মোক্ষদা হুকুম দিয়েছিলেন, না যদি নিয়েছিস তো সমস্ত রাত ওই পুকুর হাতড়ে বাটি খুঁজে বার কর।

বান্দী-বৌ যত হাউমাউ কাঁদে, গৃহিণীকুল ততই চেপে ধরেন তাকে। চুরির উদ্দেশ্যেই যে সে বেলা গড়িয়ে বাসন মাজতে আসে এ মন্তব্যও করতে ছাড়েন না তারা। সেযাত্রা সত্যই তো রক্ষে করেছিল বান্দী-বৌকে।

বলেছিল, চল বান্দীবৌ, আমিও খুঁজিগে তোর সঙ্গে। আমি খুব সাঁতার জানি, সাঁতরে এপার ওপার করে বাটি হাতড়াব।

তুই খুঁজবি মানে?

ধমকে উঠেছিল সবাই। এবং সকলকে চমকে দিয়ে সত্য উদাসভাবে বলেছিল, তা খুঁজতে হবে বৈকি। তোমাদের পাপের প্রাচিত্তির আমাকেই করতে হবে, ভগবান যখন আমাকে তোমাদের ঘরের মেয়ে করে পাঠিয়েছে। বাড়িতে যাদের পাঁচসিন্দুক বাসন, তারা যদি তুচ্ছ একটা ডাল খাবার বাটির জন্যে একটা মানুষের প্রাণবধ করতে চায়, তবে একজনকে তো তার প্রিতিকার করতে হবে।

থ হয়ে গিয়েছিল সবাই, আর বোধ করি তুচ্ছ একটা বাটির জন্য নিজেদের তুচ্ছতার বহরটা সেই প্রথম নজরে পড়েছিল তাদের।

তবে আর কি, পাঁচসিন্দুক বাসন আছে তো হরির নুট দিগে যা বাসনের। অনেক পয়সা আছে তোর বাপের। বলে কেমন যেন শিথিলভাবে রণে ভঙ্গ দিয়েছিলেন তাঁরা।

বাদী-বৌ গলায় কাপড় দিয়ে সত্যকে প্রণাম করেছিল সেদিন।

তা এমন অনেককেই অনেক সময় বিপদ থেকে ত্রাণ করেছে সত্য। কিন্তু আজ আর সত্য গলা দিয়ে শব্দ বেরোচ্ছে না।

একটা অন্ধকার অরণ্যের গা-ছমছমে রহস্য মূক করে দিয়েছে সত্যকে।

কখন যে তিরস্কার-পর্ব শেষ হল, কখন যে গিন্নীরা আপন আপন কর্মে প্রস্থান করলেন, কাটোয়ার বৌ তারপর গেল কোথায়, এসবের কোন খবরই আর রাখতে পারে নি সত্য। কখন একসময় যেন আস্তে আস্তে চলে গিয়ে সারদার ঘরের মেজেয় পরনের চাঁদের আলো-রাঙা আটহাতি শাড়িখানির আঁচলটুকু বিছিয়ে শুয়ে পড়েছিল। যেখানে সারদাও শুয়ে আছে সেই একই পদ্ধতিতে, কোলের ছেলেটুকুকে কোলের কাছে নিয়ে।

সারদা বলেছিল, শুলে যে সত্য ঠাকুরঝি!

শুলাম বলে উত্তর এড়িয়েছিল সত্য।

সারদা আর একবার নিঃশ্বাস ফেলে বলেছিল– কাটোয়ার বৌ অত গাল খাচ্ছিল কেন ঠাকুরঝি?

সত্য বলেছিল, জানি না।

সত্যর পক্ষে এমন সংক্ষিপ্ত স্বল্প ভাষণ প্রায় অভূতপূর্ব, কিন্তু সারদারও নাকি মনে সুখের লেশ নেই– তাই আর বেশী কথা বাড়ায় নি। একসময় ছেলের সঙ্গে ঘুমিয়েও পড়েছিল।

কিন্তু সত্যর চোখে ঘুম আসতে চায় না।

ভয়ের সেই অনুভূতিটা ছাড়তে চায় না তাকে।

থেকে থেকে বুকটা কেমন ঠাণ্ডা আর ফাঁকা-ফাঁকা লাগে। অজানা ওই শব্দগুলো না হয় চুলোয় যাক, কিন্তু আর একটা নতুন ভয় যে মনের মধ্যে বাসা বাধল এসে।

সত্যিই যদি কাটোয়ার বৌ…

গলায় দড়ি দেওয়ার পদ্ধতিটা কি, আর তার পরিণামই বা কি ঠিক জানে না সত্য, কিন্তু অপরটার আশঙ্কায় বার বার গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল তার। যদি তাই হয়?

যদি কাল যজ্ঞি’র প্রয়োজনে পুকুরে জাল ফেলতে গিয়ে জেলেরা মাছের সঙ্গে আরও একটা জিনিস ছেঁকে তোলে।

ভারী রুই পড়েছে ভেবে আহ্লাদে হেঁই হেঁই করে জাল টেনে তুলে যদি দেখে মাছ নয়!

বুকের মধ্যে ঢেঁকির পাড় পড়ার মত শব্দ হতে থাকে সত্যর।

কজনকে পাহারা দেবে সে?

সারদার ব্যাপারেই তো ভয়ে আর বাপের হুকুমে তটস্থ হয়ে আছে, তার ওপর আবার কাটোয়ার বৌ চাপল মনের মধ্যে। কাকে রেখে কাকে দেখবে সত্য?

গালাগালির সময় মুখটা কি রকম দেখাচ্ছিল কাটোয়ার বৌয়ের?

সত্য কি তাকায় নি?

বোধ হয় তাকিয়েছিল, কিন্তু দালানের এক কোণায় মিটমিট করে একটা প্রদীপ জ্বলছিল, তার থেকে দাওয়ায় আর কত আলো এসে পড়বে?

তাও আবার চাঁদের এখন আঁধার কাল চলছে। শুক্কল চললে তবু উঠোনে বাগানে হেঁটে চলে সুখ, মনিয্যিকে দেখাও যায়। আঁধারে তো সন্ধ্যে হলেই হয়ে গেল।

মানুষের সঙ্গে কথা কওয়া ওই মুখ-চোখ না দেখেই।

না, শঙ্করীর মুখ দেখতে পায় নি সত্য। তাই বুঝতে পারছে না, ওই অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দগুলোর মানে শঙ্করী ধরতে পেরেছে কিনা।

আচ্ছা সারদাকে একবার চুপি চুপি জিজ্ঞেস করবে সত্য? যতই হোক সারদা সত্যর দুগুণ বয়সী, ছেলের মা, কতদিন আগে বিয়ে হয়েছে সারদার, হয়তো বিদঘুঁটে কথাগুলোর মানে জানা থাকলেও থাকতে পারে।

কিন্তু বার বার বলি বলি করেও বলতে পারল না শেষ অবধি। মুখের দরজায় কে যেন তালাচাবি দিয়েছে।

মানে বুঝতে না পারলেও কথাগুলো যে খারাপ কথা, সেটা বুঝতে পেরেছে সত্য।

.

কাটোয়ার বৌয়ের সঙ্গে খুব যে একটা যোগাযোগ ছিল সত্যর তা নয়। একে তো মাত্র বছরখানেক হল এসেছে সে, সবে আগন্তুক হয়ে, তাছাড়া সে তো নিরামিষ দিকের। একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া নেই। তবে নাকি নেহাৎ দেখা-সাক্ষাৎ-সূত্রে কথাবার্তা। তাও বিশেষ মিশুকে নয় শঙ্করী। সর্বদাই যেন আনমনা, কাজেই

সত্য আজও যখন সন্ধ্যা গড়িয়ে যাওয়ার অপরাধে চুপি চুপি অবহিত করতে এসেছিল শঙ্করীকে, তখন নেহাৎ একটা জীবের প্রতি যতটুকু মমতা থাকা উচিত তার বেশী ছিল না। কিন্তু এখন যেন মায়ায় মন ভরে যাচ্ছে সত্যর। মনে হচ্ছে কত না-জানি কাঁদছে বেচারা! জগতে এমন কেউ নেই ওর যে সে কান্নায় একটু সান্ত্বনা দেয়!

বিধবা হওয়ার কি কষ্ট!

সত্যরও তো বিয়ে হয়েছে। একটা বরের সঙ্গেই নাকি হয়েছে। সেই বরটা যদি হঠাৎ মরে যায়, সত্যও তাহলে তো বিধবা হবে?

তা যদি হয়, সত্যকেও সবাই অমনি করে খোয়ার করবে?

কিন্তু তাই বা কি করে বলা যায়?

পিসঠাকুমাও তো বিধবা।

বিবা আরও কতজনেই, তাদের ভয়েই তো সবাই তটস্থ হয়ে থাকে।

ওদের দেখে মনে হয়, ওরাই যেন পৃথিবীর দণ্ডমুণ্ডের কর্তা।

তবে? ওরা বড় বলে? কিন্তু তাই কি? এরা বড় হলে ওরকম হতে পারে?

না, এ সব ঠিক বুঝতে পারে না সত্য।

শুধু যে বয়েস দিয়েই সব বিচার হয় তা তো নয়। এই যে তার বাবাকে দেশসুদ্ধ লোক ভয় তে, জেঠামশাইকে কি কেউ করে? উল্টে জেঠামশাই পর্যন্ত তো বাবার ভয়ে কাঁটা। শুধু কি ওঠামশাই? সেজঠাকুদ্দা? ন’ঠাকুদ্দা? কে নয়? ওরা তো আর মেয়েমানুষ নয়?

বয়েসটা কিছু নয়। ছোট বড় বলেও কিছু নয়।

তাহলে ভয়ের বাসাটা কোথায়?

ভাবতে ভাবতে থই পায় না সত্য। তবু ভাবে। কে যে ওকে ভয়ের বাসা খোঁজার চাকরি দিয়েছে কে জানে!

অনেক রাত্রে ভুবনেশ্বরী আসে ডাকতে।

এই সত্য, না খেয়ে ঘুমিয়েছিস যে, ওঠ! সত্য পাশ ফিরে ঘুমের ভান করে জানায়, তার খিদের অভাব।

ভুবনেশ্বরী বকে ওঠে, খিদে নেই কেন? ও যা, রাত-উপুসী থাকতে নেই। কথায় বলে রাত উপুসে হাতী কাবু। বড় বৌমা, তুমিও ওঠো দিকি বাছা। সারাদিন উপুসে আছ, আর অমন করে পড়ে থেকো না। স্বামী-পুতুরের অকল্যেণ হয় ওতে।

ভুবনেশ্বরীর গলা পেয়েই ধড়মড়িয়ে উঠে বসেছিল সারদা। পৃথিবী থেকে বিদায় নেবার তীব্র ইচ্ছেয় ধরাশয্যা নিয়ে পড়ে থাকলেও খুড়শাশুড়ীকে দেখে সমীহ করবে না, এমন কথা ভাবা যায় না। তাই ধড়মড়িয়ে উঠেছিল। স্বামী-পুত্তুরের অকল্যেণ শুনে এবার মনে মনে ধড়ফড়িয়ে উঠল।

ভুবনেশ্বরী ফের বলে, আমি তোমার ছেলে দেখছি, যাও ওঠো। সত্যকে ডেকে নিয়ে খেতে যাওগে। তোমার শাশুড়ী হেঁসেল আগলে বসে আছে। এবেলায় জাল ফেলিয়ে মস্ত একটা মাছ ধরানো হয়েছিল, এসো-জন বসো-জন যদি আসে বলে। খামি খামি দাগার মাছ আর আমের বাখরা দিয়ে এমনি খাসা টক বেঁধেছে দিদি, দেখগে যাও খেয়ে।

ভুবনেশ্বরী অনেকগুলো কথা বলে গেলেও সত্যর কানে তার শেষ অবধি পৌঁছয় নি। পুকুরে এলি ফেলে বড় মাছ ধরা হয়েছে, শুনেই তার মনশ্চক্ষে ভেসে উঠেছে জালবদ্ধ আর একটা জীব। যাকে টেনে তুলে ধড়াস করে পুকুরপাড়ে ফেলা হয়েছে আর যে মুখ চন্দ্র-সূয্যিতে দেখতে পাবার কথা নয়, সেই মুখ সহস্র লোক দেখছে।

কিন্তু সেই মুখের উপর যে চোখ দুটো বসানো আছে, সে কি আর দেখছে? জীবনে কি আর দেখবে কোন কিছু?

উঠে বসে তাড়াতাড়ি বলে, মা, কাটোয়ার বৌ কোথায়?

কোথায় আবার, ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে ভুবনেশ্বরী, কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়েছে গিয়ে। তাকে তোর দরকার কি? খেতে যাচ্ছিস খেতে যা।

খাব না, খিদে নেই। ফের শুয়ে পড়ে সত্য।

কিন্তু ওদিকে দাগা দাগা রুই মাছ আর আমের বাখড়ার টক অন্যত্র কাজ করেছে। একে ষোল এই বয়সের দুরন্ত স্বাস্থ্য, তার উপর সারাদিন ছেলেটা বুকের দুধ টেনে খাচ্ছে।

সতীনকাটার যন্ত্রণাটাও যেন কাবু হয়ে এসেছে।

তবু একান্ত বাসনা সত্ত্বেও বাধা আসে মনে।

সারাদিন অভুক্ত পড়ে থেকেও সেই অভুক্ত চেহারাটায় স্বামীর সঙ্গে একবার দেখা হল না, কে জানে রাতে হতে পারে কিনা? আজ তো নতুন বৌয়েরই কালরাত্রি, কাজেই আজ পুরনো বৌ সামান্য পেলেও পেতে পারে। দিব্যি করে মাছের ঝাল দিয়ে একপাথর ভাত সেঁটে এসে অভিমান জানাবে কোন মুখে? সারদা তাই চি চি করে বলে, সবে পেটের ব্যথাটা একটু নরম পড়েছে।

তা হোক। ও খেলেই নরমে যাবে, নরম গলায় বলে ভুবনেশ্বরী, তুমি ডেকেডুকে নিয়ে গেলে তবে যদি সত্য দুটো খায়!

নিজের শাশুড়ীর সঙ্গে কথা বলে না। ঘোমটা দিতে হয় একগলা। কথা যা তা এই শাশুড়ীর সঙ্গেই। তা খুড়শাশুড়ীর কণ্ঠের নরম সুরটুকুই চোখে জল এনে দিল সারদার। অগত্যাই আর রাসুর সামনে অভুক্ত মুখ দেখাবার ইচ্ছেটাকে টেনে রেখে দেওয়া গেল না, সারদা সত্যকে নাড়া দিয়ে বললো, চল ঠাকুরঝি, যা পারবে খেয়ে নেবে।

সত্য উঠে বসল।

হাই তুলে বিরক্ত হয়ে উঠে বলল, বাবা, দু’দণ্ড যদি একটু নিরিবিলিতে পড়ে থাকার জো আছে! নাও চল।

.

সারদা চলে যেতেই ভুবনেশ্বরী একটা অসমসাহসিক কাজ করে বসল।

ঘুমন্ত ছেলেটাকে কাঁথা মুড়ে কোলে চেপে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে চুপি চুপি রাখুর মাকে গিয়ে বলল, রাখুর মা, বড় ছেলেকে একবার ডেকে দে তো। বলবি জরুরী দরকার।

বড় ছেলে অর্থে রাসু।

রাখুর মা এদিক ওদিক তাকিয়ে ফিসফিস করে বলে, দেখে এলাম চণ্ডীমণ্ডপে শুয়েছে।

তা হোক, তুই আমার নাম করে ডেকে নিয়ে আয়।

.

ঘরের কাছাকাছি গিয়ে মায়ের ডাকে থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে হল সত্যবতীকে, আর সারদার বুকটা কী এক আশঙ্কায় চমকে উঠে শীতকালের পানাপুকুরের জলের মত ঠাণ্ডা নিথর হয়ে গেল।

অভ্যস্ত উচ্চারণে মেয়ের নাম ধরে ডাক দেয় নি ভুবনেশ্বরী, ব্যস্ত অথচ চাপা গলায় বলে উঠেছে, এই, তুই এদিকে আয়। তুই অর্থেই সত্য।

আর বিশেষ করে সত্যকেই হঠাৎ চাপা গলায় ডাক দিয়ে সরিয়ে নেবার অর্থ কি? অর্থ আছে, এরকম ডাকের একটাই অর্থ হয়, আর যে অর্থ সত্যর কাছে ধরা না পড়লেও সারদার কাছে যেন ধরা পড়েছে। তাই না বুকটা হঠাৎ এমন হিম-হিম নিথর হয়ে গেল। তাই না আশঙ্কায় চমকে উঠল সে বুক।

সারদা জানে, সারদার মনে আছে।

ছেলেবেলায় সারদা যখন নিঃশঙ্কচিত্তে তার সদ্য-বিবাহিতা কাকীমার কাছে শোবার বায়না নিয়ে তোড়জোড় করত, তখন ঠিক এমনি চাপা গলায় তার মাও ডাক দিতেন, ইদিকে আয় বলছি। তবুও বায়না করত সারদা। এখন মনে পড়লে কী হাসিই পায়!

সত্যবতী থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, বড় বৌ কি একলা শোবে নাকি? তোমাদের আক্কেলটা তো ভাল!

ভুবনেশ্বরী হাসি চেপে ভর্ৎসনার সুরে বলে, থাম্‌, তোকে আর সক্কলের আক্কেল খুঁড়ে খুঁড়ে বেড়াতে হবে না। একলা কেন, অত বড় বেটা ঘরে রয়েছে বড় বৌমার, সে কি কম নাকি?

জানি না বাবা, তোমাদের একো সময় একো মতি! এইটুকুনখানি কচি ছেলে, যার গলা টিপলে দুধ বেরোয়, যে আগলাবে মাকে!

তুই আসবি?

যাচ্ছি বাবা যাচ্ছি। তর সয় না একটু, সবাই যেন ঘোড়ায় জিন দিয়ে আছে। নাও চল। একটা মনোকষ্টওলা মানুষ এই আঁধারপুরীতে একলা পড়ে থাকবে, এই যখন তোমাদের বিচের তো তাই হোক! কোন্ মুখেই যে তোমরা ধম্মকথা কও, তাও জানিনে বাবা!

আটহাত শাড়িখানার হাততিনেক অংশমাত্র কাজে লাগিয়ে, আর বাকী হাতপাঁচেক বিড়ে পাকিয়ে কুক্ষিগত করে নিয়ে মায়ের পিছু পিছু চলল সত্যবতী অনিচ্ছামন্থর গতিতে। সত্যিই তার আজ সারদার কাছে শুতে ইচ্ছে ছিল। প্রধানত সারদার প্রতি সহানুভূতি, দ্বিতীয়ত মনে আশা করছিল, যদি শুয়ে শুয়ে গল্প করতে করতে ভয়ঙ্কর শব্দগুলোর অর্থ উদ্ধার করে নিতে পারে!

শব্দগুলো যে ভাল নয়, বড়দের কাছে প্রশ্ন করলে যে সত্যি উত্তর পাওয়া যাবে না, ঠেলামারা একটা ভুলভাল উত্তরের সঙ্গে হয়তো বা খানিকটা ধমকই জুটবে– এ বিষয়ে যেন নিশ্চিত হয়ে রয়েছে সত্যবতী।

অথচ ভয়ঙ্কর অদম্য একটা কৌতূহল ভিতর থেকে চাড়া দিচ্ছে। শব্দগুলোর অর্থ সংগ্রহ করতে পারলেই যেন অনেক রহস্যের ঘরের চাবি খোলা যায়। অন্তত শঙ্করী কেন চব্বিশ ঘণ্টা ‘মরব’ ‘মরব’ করে, আর বাড়ির সকলে কেন তার প্রতি এককড়া সদ্ব্যবহার করে না, এটুকু যেন ওর থেকেই ধরা যাবে।

কিন্তু সকল গুড়ে বালি দিল মা।

তা নতুন কিছুও নয় অবিশ্যি! জন্মাবধি তো দেখে আসছে সত্যবতী, বড়দের কাজই হচ্ছে ছোটদের সকল ইচ্ছের গুড়ে বালি দেওয়া।

দীনতারিণীর ঘরে বাড়ির সব কটা সোমত্ত মেয়ের শোবার ব্যবস্থা। ঘরটা প্রকাণ্ড বড় বলেও বটে তাছাড়া বড় বড় মেয়েরা এখান ওখান ছড়িয়ে থাকে এটা বিধি নয়। এই বয়স্থা মেয়েদের মধ্যে ন বছরের সত্যবতী সব চেয়ে বড়, আর তার বিয়েও হয়ে গেছে, তাই সে হচ্ছে দলনেত্রী। পুণ্যি রাজু নেড়ী টেপি পুঁটি রাখালী সক্কলেই তাকে ওপরওলার সম্মানটা দেয়।

আজ ওরা সত্যর জন্যে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে ঘুমিয়ে পড়েছিল, সত্য এসে দেখল ঘুমন্ত পুরী। যে যেমন ইচ্ছে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়েছে, জায়গা বিশেষ নেই, ওর মধ্যেই ওদের হাত-পা ঠেলেঠুলে জায়গা করে নিতে হবে।

সত্য বিরক্তভাবে আর একবার বলে উঠল, একদিন অন্যত্তর শুলে যে কী মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত মা মঙ্গলচণ্ডীই জানে!… নে, সর দিকি, এই পুঁটি, ঠ্যাঙটা একটু গুটো।

বলা বাহুল্য পুঁটির সুপ্তির গভীরতায় এ স্বর পৌঁছল না। অগত্যাই সত্যবতী বাক্যবলের সাহায্য ছেড়ে বাহুবলের শরণ নিল। পুঁটির পা আর রাখালীর হাত সরিয়ে নিজের মতন একটু জায়গা করে শুয়ে পড়ল বিছানায়। দীনতারিণী এখনো আসেন নি, তাঁর শুতে আসতে দেরি হয়। বিধবাদের দিকের রাতের জলপান চালভাজা তিলের নাড়ুকে বড়ো দাঁতে জব্দ করতে সময় লাগে।

ঠাকুমার বিছানাটা ঠিক আছে কিনা একবার দেখে নিল সত্যবতী। আছে বটে একফালি ঠাই। অবিশ্যি বিছানা আর কি, ঘরজোড়া একখানা শতরঞ্জির উপর বড় বড় মোটা মোটা খানকয়েক কাঁথা পাতা, আর তারই মাথার দিকে দেয়ালজোড়া টানা লম্বা মাথার বালিশ।

একসঙ্গে যাতে সারি সারি অনেকগুলো মাথা ধরানো যায় তার জন্যেই এই অভিনব মাথার বালিশের আয়োজন। এক-একটা বালিশ বোধ হয় লম্বায় চার হাত আর ওজনে আধ মণ, যারা গোয় তারা নিজেরা তাকে এক ইঞ্চিও নড়াতে পারে না। নিজের বালিশকে নিজের ঘাড়ের তলায় ইচ্ছেমত ভঙ্গীতে রাখতে পারার সুখ ওরা জানে না।

বালিশগুলো যে শুধু মাপেই বড় বলে ভারী তাও তো নয়, তুলোগুলোও যে পুরনো। জিনিস যত সস্তাই হোক আর যত বেশীই প্রাচুর্য থাক–অপচয় করার কথা কউ কল্পনাও করতে পারে না। তাই কর্তাদের বড় বড় তাকিয়াগুলো ছিঁড়ে গেলে যখন তাদের জন্যে নতুন ‘খেরো’ দিয়ে নতুন তুলোর তাকিয়া বানানো হয়, তখন পুরনো তুলো আর ছেঁড়া খেরোগুলো কাজে লাগানো হয় বাড়ির নাবালকদের জন্যে।

সব বাড়িতেই একই অবস্থা। ছেলেপুলে কাচ্চা-বাচ্চা ছাড়া সংসারের যত ওঁচা মালের গতি হবে কাদের উপর দিয়ে? তবু তো কবরেজ-বাড়ির অবস্থা উত্তম। বাৎসরিক বৃত্তি দিয়ে সাজো-ধোবা ঠিক করা আছে, নিয়মিত সব ফর্সা করে দিয়ে যায় সে। মানে আর কি, কেচে শুকিয়ে পাট করে দিয়ে যায় কি আর? কাঁচার পুকুরে কেচে ভিজে কাপড়-চোপড়ের উঁই খিড়কির পুকুরের পৈঠেয় নামিয়ে রেখে যায়। তার পর তো আছেন মোক্ষদা। ভাল পুকুরের জল দিয়ে শুদ্ধ করে সেই ভিজের বস্তা রোদে মেলে দেওয়ার দায়িত্ব তার। তার পর আছে বৌ-ঝিরা। শিবজায়ার ছেলের বৌরা, কুঞ্জর বৌ, বনেশ্বরী–পরবর্তী ডিউটি এসে পড়ে এদের ওপর।

নিত্যি বিছানা কাথার ওয়াড় খোলা আর ওয়াড় পরানো কম ঝামেলার ব্যাপার নয়, কিন্তু–রামকালীর যে ধোবার উপর এবং সংসার–পরিচালিকাদের উপর কড়া হুকুম দেওয়া আছে, অনত্ত মাসে দুক্ষেপ সব সাফ করতে।

আজই বোধ হয় সব সদ্য কাচা। কলা-বাসনার ক্ষার আর সাজিমাটির গন্ধ ছাড়ছে। সত্যবতী নাকে কাপড় দিয়ে শুয়েছে, এই গন্ধটা তার ভারী বিশ্রী লাগে। ও শুয়ে শুয়ে ভাবে, এই বিচ্ছিরি গন্ধটা বাদ দিয়ে কাপড় কাচা যায় না? ওটা ভাবতে ভাবতে আরও অন্য ভাবনায় চলে গেল সত্যবতী।…

বড়বৌ তো একা শুলো, মাঝরাতে উঠে যদি জলে ডুবতে যায়? বৌটা তো যাবেই, বাবাকে কি জবাব দেবে সত্য? তারপর গিয়ে রাত পোহালেই বাড়ি কুটুমে ছেয়ে যাবে, তার মাঝখানে সেই বড়বৌয়ের ডুবে মরার র‍্যালা। আচ্ছা বিপদ হল বটে!

নাঃ, নিশ্চিন্দি থাকা চলে না, বেশী রাতে বাড়ি নিঃসাড় নিশ্চুপ হয়ে গেলে উঠে গিয়ে দেখে আসতে হবে বড়বৌকে। সব চেয়ে ভাল হয় ওর ঘরটায় বাইরে থেকে শেকল তুলে দিলে, নইলে কবার আর দেখতে যাওয়া যাবে? কোন ফাঁকে যদি উঠে গিয়ে সর্বনাশ ঘটিয়ে বসে থাকে বড়বৌ?

দরজার মাথায় শেকল, সত্যবতীর হাত পৌঁছয় না, কিসের ওপর উঠে শেকলে হাত পাওয়া যায় তাই ভাবতে থাকে সে।

ঢিপঢিপ-করা বুকটা নিয়ে সারদা ঘরে ঢোকে। সারদার আহারকালীন অবকাশে ছেলে কেঁদে ভুবনেশ্বরীকে জ্বালাতন করেছিল কিনা জিজ্ঞেস করতেও পারে না। ভুবনেশ্বরীই নিজ থেকে বলে, নিঃসাড়ে গিয়ে শুয়ে পড় তো বড় বৌমা, ছেলে সবে ঘুমিয়েছে, জেগে না যায়। শেওরে কাজললতা দিয়ে শুইয়ে রেখে এসেছি।

রাসুকে ডাকিয়ে এনে ঘরে পুরে দেওয়া পর্যন্ত স্বস্তি ছিল না ভুবনেশ্বরীর। কি জানি যদি অন্ধকারে ঠাহর করতে না পেরে কে কে করে চেঁচিয়ে ওঠে সারদা!

এদিকে আবার রাসুকে বলতে পারে না যে ঘরের পিদিম নিভিও না, কারণ ছেলেকে শোবার ঘরে পুরে দিয়ে আর তার সঙ্গে কথা কইতে মায়েরই লজ্জা লাগে। এ তো ভাসুরপো। আর সারদাকেই বা স্পষ্টাস্পষ্টি বলা যায় কি করে, ওগো তোমার জন্যে ঘরের মধ্যে মানিক আনিয়ে রেখেছি! বলা যায় না বলেই কচি ছেলের ছুতো।

তা ছাড়া আর একটু কারণও কি ছিল না? একটু কৌতুকের সাধ? হলেও শ্বাশুড়ী সম্পর্ক, তবু তো মেয়েমানুষ। আর বাবা রামকালীর ঘরণী হলেও ভুবনেশ্বরী যেন এখনও ভিতরে ভিতরে কোথায় একটু কাঁচা একটু সবুজ রয়ে গেছে।

মানিকের উপমাটা ভুবনেশ্বরীরই মনে এসেছে। নিত্যকার মানুষটাই যে আজ সারদার কাছে পরম মূল্যবান হয়ে উঠেছে, একথা বোঝবার ক্ষমতা ভুবনেশ্বরীর আছে। দেখা যাক বড়বৌমা কতটুকু করায়ত্ত রাখতে পারে স্বামীকে! অবিশ্যি ভরসা কিছু নেই, বেটাছেলের মন, নতুন বৌ ডাগরটি হয়ে উঠতে উঠতে সারদাও কোন্ না ততদিন তিন ছেলের মা হয়ে বসবে! তখন কি আর রাসু নতুন ফুলের মধু ফেলে–

ভাবতে গিয়ে চমকে গেল ভুবনেশ্বরী। মনে মনে নাক-কান মললো। রাসু না তার পুত্রস্থানীয়! তার সম্পর্কে এসব কথা কি বলে ভাবছে সে! সম্পর্কের মান-মর্যাদা আর থাকছে কি করে তা হলে।

ওদের সম্পর্কে সব ভাবনা জোর করে মুছে নিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল ভুবনেশ্বরী। এবার তাদের দলের খাবার পালা। তবে আজ আর খাবার পরে ঘুম নয়, রাত জেগে কালকের যজ্ঞির কুটনোবাটনা করতে হবে। বড়লোকের বাড়ির বৌ বলে তো আর আয়েস করবার হুকুম নেই। বৌ হচ্ছে বৌ। বরং রাসুর মা দুদণ্ড পা ছড়িয়ে বসলে, কি কাজে গাফিলি করলে কেউ কিছু বলবে না, কিন্তু বৌদের সেরকম আচরণ অমার্জনীয়!

তা খাটুনিতেও দুঃখ ছিল না, যদি শুধু নিজেরা জা-ননদের দল থাকতে পায় সে দলে। হাতের সঙ্গে গল্পগাছাও চলে তা হলে। কিন্তু তা তো হবার জো নেই, একজন গিন্নী পাহারাদার থাকেনই।

বৌরা ঘরভাঙানি মন্ত্রণা করছে কিনা সেটা তো দেখতে হবে তাঁদের। এই গুরু কর্তব্যের দায়ে বেচারা শিবজায়াকে যে মরতে মরতে রাত জেগে ছেলেবৌয়ের ঘরের পেছনের ঘুলঘুলির নিচে কান পেতে বসে থাকতে হয়।

.

সারদার ঘরে অবশ্য ঘুলঘুলি নেই। ভাল জানালা আছে। বাড়ির মধ্যে সেরা ঘরটাই সারদার। বর্ধমান থেকে মিস্ত্রী আনিয়ে রামকালী যখন অনেক খরচা করে দক্ষিণের উঠোনে এই ঘরদালান বানিয়েছিলেন, তখন সকলেই ভেবেছিল এটা রামকালীর নিজের জন্যই। মিস্ত্রীর কাজ শেষ হয়ে গেলে দীনতারিণীও তাই বলেছিলেন, একটা শুভ দিন দ্যাখ তা হলে রামকালী নতুন ঘরে ওঠবার।

রামকালী হেসে উঠে বলেছিলেন, তোমার যে দেখছি গাছে না উঠতেই এক কাঁদি গো মা। ঘরে যে উঠবে, সে আসুক আগে?

দীনতারিণী অবাক হয়ে বলেছিলেন, কে আসবে? কার কথা বলছিস?

ঘরের লক্ষ্মীর কথাই বলছি মা, রামকালী বোধ করি মায়ের হৃদগত ধারণা অনুমান করেছিলেন, তাই একবার মায়ের ধারণা-বৃক্ষের মূলে কুঠারাঘাত করে পরম শান্তভাবে কথা শেষ করেছিলেন, কেন, তুমি কি শোন নি রাসুর বিয়ের কথা চলছে?

রাসুর! রাসুর বৌ এসে ওই ঘরের দখলীদার হবে!

দীনতারিণীর সতীনপোর ছেলের বৌ! দীনতারিণী আর আত্মসংবরণ করতে পারেন নি, বিরক্তভাবে বলে উঠেছিলেন, অজ্ঞানের মতো কথা বলো না রামকালী। ওই সেরা ঘরখানা তুমি রাসুকে দেবে!

রামকালী আর হাসেন নি, গম্ভীরকণ্ঠে বলেছিলেন, দেওয়া-দিইর কথা কিছু নেই মা, যার যা ন্যায্য প্রাপ্য সে তা পাবে।

দীনতারিণী তথাপি ছেলের ক্রোধশঙ্কা তুচ্ছ করেও উষ্মা প্রকাশ না করে পারেন নি, বলে উঠেছিলেন, তুমি মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উপায় করছ, ‘হীরে হেন জিরে’ এনে নবাবীপছন্দের ঘর গড়লে, সে দ্রব্যি কুঞ্জর বেটা-বৌয়ের প্রাপ্য হল কোন্ সুবাদে রামকালী!

না, রামকালী প্রত্যক্ষে তিরস্কার করেন নি মাকে, বরং আরও শান্তকণ্ঠে বলেছিলেন, যে সুবাদে মানুষ বনের জন্তু-জানোয়ারদের মতন উদোম হয়ে না বেরিয়ে কোমরে কাপড় দিচ্ছে মা। যাকগে ও কথা থাক, ‘জ্যেষ্ঠের শ্রেষ্ঠ ভাগ’ এ বিধিটা তো তোমার অজানা নয় মা। রাসু এ বাড়ির জ্যেষ্ঠ ছেলে।

দীনতারিণীর চোখে জল এসে গিয়েছিল দুঃখে আর অপমান-বোধে, তাই শেষ-বেশ তর্কে বলে বসেছিলেন, মেজ বৌমার প্রাণটার দিকেও তো তাকাতে হয়। যতই হোক সে এখনও কাঁচা মেয়ে, এই ঘর আরম্ভ হয়ে ইস্তক তার একটা আশা ছিল তো।

রামকালী এবার আর একটু হেসেছিলেন, তোমার মেজ বৌমার যদি এমন ইলুতে আশা হয়েই থাকে তো সে আশায় ছাই পড়াই উচিত মা।

ছাই পড়াই উচিত?

আঁচল দিয়ে চোখ মুছেছিলেন দীনতারিণী। মেজ বৌমার আশাভঙ্গের কল্পনায় যত না হোক, নিজের আশাভঙ্গে। কুঞ্জ যে জন্মভোর গায়ে হাওয়া দিয়ে বেড়িয়ে সংসারের সব কিছুর সেরা ভাগটা ভাগ করে, এটা কি চিরকাল সহ্য হয়? দীনতারিণীর আশা ছিল, এই ঘরখানার ব্যাপারে অন্তত কুঞ্জ আর কুঞ্জের বৌয়ের মুখটা ছোট হবে। সেই আশায় ছাই পড়ল। তাই কেঁদে ফেলে বললেন, ছাই পড়াই উচিত?

উচিত বৈকি। ভবিষ্যতে তা হলে আর কখনও এমন বেয়াড়া আশা জন্মাতে পাবে না।

এর পর দীনতারিণী নীরবে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছিলেন চন্দননগর থেকে ছুতোর এসে ঢুকল সেই ঘরে। হ্যাঁ, জোড়াপালঙ্ক বানাতে হলে ঘরের মধ্যে বসেই বানাতে হয়, বাইরে থেকে গড়ে এনে লাগিয়ে দেওয়া রীতি তখনও হয় নি।

বহুবিধ কারুকার্য করা পালঙ্ক।

ওর জন্যে চন্দননগরের ছুতোরদের ভাত যোগাতে হয়েছিল মাস দেড়েক ধরে। খেয়ে, মজুরি নিয়ে আর নতুন কাপড়ের জোড়া বখশিশ আদায় করে ছুতোররা চলে গেল, তার পরই বিয়ে হল রাসুর। নতুন পালঙ্কে ফুলশয্যে হল।

সেই পালঙ্ক ছেড়ে সারাদিন আজ মাটিতে পড়েছিল সারদা। এখনও খুড়শাশুড়ীর নির্দেশমত নিঃসাড়ে ঘরে ঢুকে হুড়কোটা লাগিয়েই ছেলের তল্লাসমাত্র না করে ঝুপ করে শুয়ে পড়ল মাটিতেই।

ঘরে ঢুকে না তাকিয়েও টের পেয়েছিল সারদা, তার আশার আশঙ্কাটা মিথ্যে নয়। আঘ্রাণে, অনুমানে, হৃৎস্পন্দনে বুঝিয়ে দিয়েছিল সারদাকে ঘরে তোমার সাতরাজার ধন মানিক।

এ যেন আবার নতুন বিয়ের নতুন বর। দ্বিরাগমনে এসে প্রথম রাত্তিরে যখন পাঁচটা সমবয়সী মিলে সারদাকে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে দরজায় শিকল লাগিয়ে পালিয়েছিল, তখন এমনি বুক ধড়াস করেছিল সারদার। তবু তো তখন মাত্র বারো বছর বয়েস। আর এখন ষোলো। ষোড়শীর হৃদয় তো আলোড়নে আরোই উত্তাল হবে।

.

ঘরে যে অপরাধী আসামী অবস্থান করছিল তার অবস্থাও অবশ্য সারদার চাইতে কিছু উন্নত নয়। তার বুকের মধ্যে হাতুড়ি পিটছে। জীবনে আর কখনও সারদার মুখোমুখি দাঁড়াতে পারে, এ আশা বুঝি ছিল না রাসুর। সারাদিন শুধু ভেবেছে জীবনের সমস্ত আনন্দ-আহ্লাদের সমাধি হয়ে গেল তার।

মেজখুড়ী কেন অন্দরে ডেকে পাঠিয়েছিল, তাও ঠিক বুঝতে পারে নি। ভেবেছিল আবার কোন বিষম শাসনের পাকচক্রে পড়তে হবে এসে, কিন্তু এসে যা শুনল অভিনব।

সারদা নাকি রান্নাঘরে কাজে ব্যস্ত, আর ভুবনেশ্বরীরও কাজের তাড়া, ভাঁড়ারের দিকে না গেলেই নয়, তাই ঘুমন্ত খোকাকে একটু আগলাতে হবে রাসুকে।

কিছু নয়, শুধু ঘরে একটু থাকা।

বোকা রাসু তখনও কিছু সন্দেহ করে নি। শুধু একটু তাজ্জব বনে গিয়েছিল প্রস্তাবে। দেশসুদ্ধ লোক থাকতে কিনা ছেলে আগলাবার জন্যে রাসুকে ডাকিয়ে আনা হল বার-বাড়ি থেকে! আশ্চর্য নয় তা কি যে রাথুর মা ডাকতে গিয়েছিল, সে-ই তো পারত কাজটা। করেও তো বরাবর তাই। তবু কিছু বলতেও পারে নি। না প্রতিবাদ, না প্রশ্ন। নতুন বৌয়ের ব্যাপারে যতটা লজ্জা, ঠিক ততটাই লজ্জা এই নতুন ছেলের বিষয়েও।

সুড়সুড় করে তাই ঘরে ঢুকেছিল রাসু। আর ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই বুকের মধ্যে সন্দেহের হাতুড়ি পড়েছিল।

মেজখুড়ীর এই ডাকিয়ে আনাটা ছল নয় তো! মেজখুড়ীকে তো এমনিতেই খুব ভালবাসে রাসু, এবার যেন ইচ্ছে হল পুজো করে তাকে। ফস্ করে প্রদীপটা নিভিয়ে দিয়ে কাঠ হয়ে ভাবতে লাগল।

সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে খেয়াল করল ঘরে খিল পড়েছে, আর পরমূহুর্ত থেকেই অনুভব করল, বাতাসহীন ঘরের চাপা গুমোটটা যেন একটা কান্নার ধাক্কায় কেঁপে উঠছে।

টপ টপ্ করে দু’ফোঁটা জল পড়ল রাসুর চোখ থেকে। পুরুষ মানুষ! তা হোক, মানুষ তো বটে।

ধড়মড় করে উঠে বসল সারদা। একটা বলিষ্ঠ আবেষ্টন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করতে করতে রুদ্ধকণ্ঠে বলল, আর কেন, আর কেন?

আর কিছু বলতে পারল না। চোখ দুটো বিশ্বাসঘাতকতা করে বসেছে। সারাদিন ধরে প্রতিজ্ঞা করেছিল, যদি কখনও সেই নিষ্ঠুরটার সঙ্গে দেখা হয়, কাঁদবে না, মুখ মলিন করবে না। পরস্য পরের মত উদাসীন থাকবে। কিন্তু পরিস্থিতিটা সমস্তই গোলমাল করে দিল।

তাই কি দু-চার ফোঁটা?

একেবারে ধারার শ্রাবণ!

একে কি করে রোধ করবে সারদা? কোন্ বাঁধ দিয়ে ঠেকাবে?

বড়বৌ!

এতটুকু শব্দের মধ্যে কত মিনতি কত আবেদন!

কিন্তু এই করুণ মিনতিভরা ডাকেই বা সাড়া দিচ্ছে কে?

বড়বৌ, আমার কি দোষ? আমার ওপর বিরূপ হচ্ছ কেন? বুঝতে পারছ না আমার প্রাণটাও গুড়ো হয়ে যাচ্ছে!

ধারা শ্রাবণে বন্যা এল।

থাক থাক, আর মন-মজানে মিছে কথায় কাজ নেই। পুরুষের প্রাণে আবার দরদ!

বড়বৌ, এই আমার মাথা খাও, বিশ্বাস কর তোমার মতনই জ্বলে পুড়ে খাক হচ্ছি আমি। তুমি যে আমাকে বিশ্বাসঘাতক ভাবছ, এ কষ্ট আমি রাখব কোথায়?

রাখবার দরকার কি? সারদা কান্না সামলে কঠোর হবার চেষ্টা করে, কাল তোমার নতুন ফুলশয্যে, নতুন সুখ, আজ আবার এত দুঃখ কষ্টর পালা গাইবার কি আছে?

বড়বৌ, বল কি করলে তুমি আমায় বিশ্বাস করবে?

বলিষ্ঠ আবেষ্টনের চাপটা যেন পিষে ফেলতে চাইছে সারদাকে, কি করে আর কঠিন থাকবে সারদা? তবু শেষ চেষ্টা করে, আমার বিশ্বাস অবিশ্বাসে কি এসে যাচ্ছে তোমার? ছেলের মা বুড়ীকে ছেড়ে এখন কচি তালশাঁস—

বড়বৌ, তুমি এমন ব্যাভার করলে আমার আত্মঘাতী হওয়া ছাড়া আর উপায় থাকবে না তা বলে দিচ্ছি– রাসুও কঠিন হতে জানে, তাই বাধন আলগা দিয়ে বলে, এই চললাম মেজকাকার ওষুধের ঘরে। তাজা গোখরো সাপের বিষ সঞ্চয় আছে। কোথায় আছে তাও আমার জানা। এর পর কিন্তু বিধবা হলে দোষ দিও না আমায়!

বিধবা!

বুকটা থর থর করে ওঠে সারদার। বরং একশটা সতীন নিয়ে ঘর করবে সারদা, বিধবা হওয়ার মত অভিশাপ আর কি আছে? কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তে বলাই বা যায় কি?

তা হলে চললাম। এই জনের শেষ দেখা। বলে রাসু দরজার কাছে এগোয়, আশা এই যে এবার সারদা মাথা খাওয়ার অনুরোধ জানাবে, কিন্তু সারদা যেন অনড়।

ভেবেছিলাম ওকে চিরদিনের মত ত্যাগ দিয়েই রাখব, তুমি আমার যে প্রাণেশ্বরী সেই প্রাণেশ্বরীই থাকবে- স্বগত উচ্চারণে আক্ষেপ প্রকাশ করে দরজার হুড়কোয় হাত লাগায় রাসু, কিন্তু তুমি পতিহন্ত্রী হয়ে নিজের পায়ে কুড়ল মারলে বড়বৌ!

হুড়কোটা খুলে পাশে রাখল রাসু।

এবার সারদা কথা বলল, কিন্তু এ কী কথা! এই কি প্রেমে পাগলিনী অবলা বালার ভাষা?

রুদ্ধকণ্ঠে সারদা বলে উঠেছে, ঘরের পরিবারের সঙ্গে যাত্রা-গানের মতন কান্নার সুরে কথা কইছ কেন? হুড়কো খুলে বেরিয়ে গেলেই বুঝি খুব পৌরুষ হবে? তোমার গোখরো বিষ আছে, আর আমার দড়ি-কলসী নেই?

তোমার প্রাণটা পাথরে গড়া বড়বৌ! মেজকাকা যখন আমার গলায় গামছা মোড়া দিয়ে টানতে টানতে নিয়ে গেল, তখন তার সামনে গিয়ে বলতে পারলে না, আমারও দড়ি-কলসী আছে! ঠিক আছে, সবাইকে এবার দেখিয়ে দিচ্ছি–ভালমানুষ রাসু কি করতে পারে!

এই প্রকাণ্ড বীররসের ভূমিকাটি অভিনয় করে কপাটটা ধরে হ্যাঁচকা টান মারল রাসু, কিন্তু–টানার সঙ্গে সঙ্গেই পরিস্থিতিটা বুঝতে দেরি হল না, দরজার বাইরে শেকল এ কাজ কে করল?

মেজখুড়ী?

কিন্তু তাঁর পক্ষে কি এ ধরনের চপল রসিকতা সম্ভব? অথচ তা ছাড়া আর কে? রাসু যে বাড়ির মধ্যে এসেছে, তাই তো কেউ দেখে নি। মেজখুড়ী তো আজকের নাট্যকার।

বাইরে থেকে বন্ধ!

একটা বিপন্ন স্বর আস্তে ঘরে ছড়িয়ে পড়ল।

বন্ধ!

সারদারও এতক্ষণকার নীরবতা ভঙ্গ হল বিস্ময়ে ভয়ে।

তাই তো দেখছি রাসুর কণ্ঠে ব্যাকুলতা, এখন উপায়? যদি সকাল পর্যন্ত বন্ধ থাকে? বড়বৌ, কি হবে?

সহসা অদ্ভুত একটা কাণ্ড ঘটে।

একেবারে অভাবিত অপ্রত্যাশিত। হয়তো বা সারদা নিজেও এক মুহূর্ত আগে এটা কল্পনা করতে পারত না। ভাবতে পারত না তার কান্নায় বুজে আসা কণ্ঠ সহসা অমন কৌতুকের লীলায় হেসে উঠবে। সে হাসির শব্দ চাপা বটে তবু রহস্যে উচ্ছ্বসিত।

তা এই ধরনেরই স্বভাব বটে সারদার, নিতান্ত দুঃখের সময়ও হাসির কথা হলে হেসে ফেলা। কিন্তু আজকের কথা যে আলাদা। আজ সারদার মরণ-বাচনের সমস্যা। আজ কান্নায় গলা বুজে রয়েছিল সারদার। তবু রাসুর এই বিপন্ন বিপর্যস্ত কণ্ঠ থেকে তাকে কী যে কৌতুকের যোগান দিল, উচ্ছ্বসিত রহস্যে হেসে উঠল সে। হেসে উঠে বলল, কী আর হবে! দায়ে পড়ে মশাইকে এখন পরনারীর সঙ্গে রাত কাটাতে হবে!

রাসু চমকে গেছে, থমকে পড়েছে। তবে কি এতক্ষণ ছলনা করছিল সারদা? সতীন হওয়ায় তেমন কিছু লাগে নি তার? এ হাসি এ কথা তো রীতিমত প্রশ্রয়ের।

অতএব দরজা নিয়ে মাথা পরে ঘামালেও চলবে, এখন এদিকের ঘাঁটি সামলে নেওয়া যাক।

খোলা হুড়কো আবার দরজায় উঠল।

অনাদৃত পালঙ্কের বিছানা আবার স্পর্শের উষ্ণতা পেল।

না, একেবারে সহজে ধরা দেবে না সারদা। সে সত্যবদ্ধ করিয়ে নেবে স্বামীকে।

থাক, আমাকে স্পশ্য করতে হবে না, আগে মা সিংহবাহিনীর নামে দিব্যি কর, আমি বেঁচে থাকতে ছুটকিকে ছোঁবে না?

রাসুর বুকটা কেঁপে ওঠে।

শপথটা যে মারাত্মক। ভয়ে ভয়ে বলে, সিংহবাহিনীর নামে দিব্যি করা কি ভাল বড়বৌ?

মনে পাপ থাকলে ভাল নয়। একমন একপ্রাণ থাকলে ভয়ের কি আছে?

তবু, ঠাকুর-দেবতা বলে কথা!

বেশ তো, আমি তোমায় সাধি নি। নাই বা আর স্পশ্য করলে আমায়!

হায় মা সিংহবাহিনী, এমন ঘোরতর বিপদে তোমার গ্রামের আর কেউ কখনও পড়েছে?

একদিকে একখানি অপরাধবোধের ভারে পীড়িত আর নতুন আশায় উদ্বেল ব্যাকুল হৃদয়, আর অপরদিকে এক অনমনীয়া পাষাণী।

তবে কি হাসিটাই ছল?

তাই সম্ভব, নইলে দিব্যি গুছিয়ে ছেলের কাছ ঘেঁষে শোবার আয়োজন করছে কেন সারদা?

বড়বৌ!

আঃ, কেন জ্বালাতন করছ? সারদার বুকে পরম ভরসা দরজার বাইরে শেকল লাগানো, রাগ করে ছিটকে বেরিয়ে যাবার উপায় নেই রাসুর।

আঃ, কে সেই দেবী, যে রাসুকে এমন বন্দী করে ধরে দিয়েছে সারদার কাছে? স্বয়ং মা সিংহবাহিনী নয় তো?

তা হলে তোমার দয়া হবে না?

সোয়ামী, গুরুজন, তুমি আবার দয়ার কথা তুলছ কেন গো? পরিবারই হল গিয়ে কেনা দাসী।

আচ্ছা বেশ, করছি দিব্যি। হল তো?

কই করলে?

মনে মনে করেছি।

মনে মনে? হু! মনের কথা বনে যায়। মুখে বল।

বেশ বেশ, এই বলছি, তুমি ছাড়া আর কাউকে ছোঁব না, সিংহবাহিনী সাক্ষী।

আমি ছাড়া নয়, আমি বেঁচে থাকতে

এটুকু অনুগ্রহ করে সারদা।

ওই হল। কে আগে যায় কে পরে যায়, বলা যায় কি?

আমার কুষ্ঠিতে আছে সধবা মরব। সারদা আত্মপ্রসাদের হাসি হাসে, কিন্তু মনে থাকে যেন মা সিংহবাহিনী সাক্ষী!

থাকবে থাকবে।

কিন্তু সত্যিই কি মনে ছিল?

রাসু কি শেষ অবধি মা সিংহবাহিনীর মর্যাদা রাখতে পেরেছিল?

পুরুষমানুষ কি তাই পারে?

রাসুর মত মেরুদণ্ডহীন পুরুষ?

তবু এমনি মিথ্যে শপথের চোরাবালির উপরই তো ঘর বাঁধতে হয় মেয়েমানুষকে।

 ১৩. যজ্ঞির জন্যে ছানাবড়া ভাজা হচ্ছে

যজ্ঞির জন্যে ছানাবড়া ভাজা হচ্ছে। ভিয়েনের ‘চালা’য় বড় বড় কাঠের উনুন জ্বেলে কারিগররা লেগে গেছে ভোর থেকে। প্রথমে বোঁদে ভেজে স্তুপাকার করে রেখেছে কাঠের বারকোশে, এখন থেকে শুরু হয়েছে। ছানাবড়া। প্রচুর পরিমাণে না করলেও চলবে না, নিমন্ত্রিতদের পেট উপচে খাওয়ানোর পর আবার সরাভর্তি ছাঁদা দিতে হবে তো। তা ছাড়া যখন কুল্লে ওই দু-রকম মিষ্টি!

তাড়াহুড়োর যজ্ঞি, ওর বেশী আর সম্ভব হল না, অথবা সেটাও হয়তো ঠিক কথা নয়, মোটামুটি কথা মাত্র। রামকালী চাটুয্যে যদি দরকার বুঝতেন, তা হলে একদিনের মধ্যেই কাটোয়া কি গুপ্তিপাড়া থেকে ওস্তাদ ময়রা আনিয়ে পাঁচ-সাত রকম মিষ্টি বানিয়ে তোলাও অসম্ভব হত না তার পক্ষে। কিন্তু দরকার বোধ করেন নি তিনি।

রাসুর প্রথম বিয়েতে ঘটা হয়েছিল বিস্তর, গ্রামে এখনও তার গল্প ফুরোয় নি। মিষ্টির কারিগর এসেছিল নাটোর থেকে, কেষ্টনগর থেকে, মুড়োগাছা থেকে। কাঁচাগোল্লা ক্ষীরমোহন মতিচুর সরভাজা ছানার ছিলিপি খাজা অমূতি নিখুঁতি ইত্যাদি করে বারো-তেরো রকম মিষ্টি হয়েছিল। আর মাছের কথা তো বলেই শেষ হবে না। এক-একজনের পাতে বড় বড় এক-একটা মালসা ভর্তি মাছের তরকারি বসিয়ে দিয়ে আবার তিন-চারবার করে পরিবেশন। তা ভিন্ন রান্নার পদ তো বাহান্ন রকম, বাহান্ন ব্যঞ্জন নইলে আবার ঘটা কিসের?

কুমোরবাড়ি বরাত দিয়ে সাইজের হাঁড়ি গড়িয়ে আনা হয়েছিল ঝোড়া ঝোড়া, তাতেই গলা উপচে মিষ্টির ছাঁদা। যজ্ঞির জের চলেছিল দিন পনেরো ধরে।

সে কথা আলাদা। সে বিয়ের সঙ্গে এ বিয়ের তুলনা করার কোনও মানেই হয় না। অন্য বাড়ি হলে যজ্ঞিই করত না, নেহাৎ রামকালী চাটুয্যের বাড়ি বলেই এত আয়োজন। পরিমাণে প্রচুরই হচ্ছে, তবে ওই মাত্র দুরকম মিষ্টি, মোলো-কুড়ির মত রান্নার পদ। রান্না এখন চাপে নি, পাশের চালায় তার তোড়জোড় চলছে, হালুইকর ঠাকুর স্নান করতে গেছে।

এ গ্রামে হালুইকর ঠাকুর এনে রাধানোর প্রথা প্রবর্তন করেছেন রামকালীই। মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে দেখেছিলেন এ ব্যবস্থা। নইলে এ গ্রামে চিরদিন কাজেকর্মে গ্রামের ব্রাহ্মণ কন্যারাই বেঁধে থাকেন। সেটা রীতিমত একটা সম্মান-সম্ভ্রমের ব্যাপার। ডাকসাইটে রাঁধুনী বলে খ্যাতি আছে যাদের তাদেরই ডাকা হয় অনেক তোয়াজ করে। রান্নায় বসবার আগে পূর্ণপাত্র, নতুন কাপড়ের জোড়া, সধবা ব্রাহ্মণী হলে আলতা সিঁদুর–এই সব দিয়ে তবে পাকশালে ঢোকাতে হয় তাদের।

তথাপি এই রান্নার পর্ব থেকেই অনেক গদাপর্ব মুষলপর্ব বেধে যায়। গ্রামের যে একদল ছুতো খুঁজে বেড়ানো লোক আছে, তারাই যজ্ঞি দেখলে দক্ষযজ্ঞের আয়োজন করবার তালে ঘোরে। মন কষাকষি, কথান্তর, মান-অভিমান, এসব প্রায় যজ্ঞিরই অঙ্গ। রামকালী ওসব ঝামেলার মধ্যে নেই। পরমা দিয়ে লোক আনাবেন, কাজ করাবেন, চুকে গেল। রাধুনী বামুনের হাতে খেতে যাদের আপত্তি, তারা যাও বিধবার হেসেলে ভর্তি হও গে। মাছ জুটবে না।

তা সে দু-চারজন নিতান্ত নিষ্ঠাপরায়ণ গ্রামবৃদ্ধ ছাড়া না হু করে সকলেই বসে পড়ে রামকালীর বাড়ির ভোজে। ওস্তাদ কারিগরের রান্নার হাত, রামকালীর দরাজ হাত, আর রামকালীর প্রতি সমীহ (শোধ এই ত্রিশক্তির আকর্ষণে সকলেই প্রায় নরম হয়ে আসে। পয়সা যে এ অঞ্চলে কারুরই নেই তা তো নয়, কিন্তু এমন দরাজ হাত? এত বড় দিলদরিয়া মন?

খাঁটি গাওয়া ঘিয়ে সদ্য কাটানো টাটকা ছানার মিষ্টান্ন ভেজে তোলার সুগন্ধে শুধু আশপাশেরই নয়, সারা গ্রামখানারই বাতাস যেন ম ম করছে। বাড়ি বাড়ি ছোট ছেলেপুলেদের ঘরে আটকে রাখা দুঃসাধ্য হচ্ছে তাদের অভিভাবকদের।

পায়ে রূপোর বোল দেওয়া খড়ম, গায়ে বেনিয়ান, পরনে নেত্রকোণার থান। সবদিকে চৌকস হয়ে তদারকি করে বেড়াচ্ছেন রামকালী। শুধু মিষ্টির ভিয়েনে শেকড় গেড়ে বসে থাকবার ভারটা দিয়েছেন বড়দা কুঞ্জকে। ওর থেকে বেশী দায়িত্বর কাজ কুঞ্জকে দেওয়া চলে না।

.

গয়লারা দইয়ের ‘ভার’ এনে নামিয়েছে, ক’মণ দইয়ের যোগান দিতে পেরেছে তারা, দাঁড়িয়ে তারই হিসেব নিচ্ছিলেন রামকালী, হঠাৎ নেড়ু এসে কাছে দাঁড়াল। রামকালী গ্রাহ্য করতেন না, কিন্তু নেড়ু একেবারে গায়ের কাছে দাঁড়িয়েছে, ভাবটা যেন কিছু বক্তব্য আছে। গয়লাদের উপর চোখ রেখেই রামকালী মাথাটায় একবার হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, কি রে নেড়ু?

নেড়ু সভয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে আস্তে বলল, একবার অন্দর বাড়িতে যেতে বলছে।

অন্দরবাড়িতে যেতে বলছে? কাকে বলছে?

তোমাকে।

রামকালী ভুরু কুঁচকে বলেন, আমাকে এখন যেতে বলছে? পাগলটা কে হল? অগ্রাহ্যভরে আবার অদূরবর্তী গোয়ালাদের দিকেই মন দেন, বলিস কি রে তুই, ওই পাঁচ মণ বৈ দই দিয়ে ওঠতে পারছিস না! তা হলে আমার উপায়? তুই ভরসা দিলি

তুষ্টু মাথা চুলকে বলে, আজ্ঞে ভরসা তো দেছলাম, কিন্তু মা ভগবতীরা যে আমাকে নিভর্সা করে ছাড়লেন। কাল রেতে তো আর নিদ্রেই দিই নি, চৌদিকে সকল গোহালার ঘরে ঘরে বরাত দিয়ে দিয়ে বেড়ায়েছি, তা সবাইয়ের ঘরের দই যোগসাজস করে এই হল!

এই হল তা তো বুঝলাম, কিন্তু আমার কি হবে তাই বল? দাঁড়িয়ে অপমান হতে বলিস আমায়?

অপমান! তুষ্টু বীরবিক্রমে বলে ওঠে, বলি একটা ঘাড়ে বিশটা মাথা কার আছে কবরেজ ঠাকুর যে আপনাকে অপমান্যি করবে?

মাথা এ গাঁয়ের এক একজনের একশটা করে, বুঝলি রে তুই! বলে হাসলেন রামকালী, আর ঠিক সেই সময় নেড়ু আর একবার মিহিগলায় ডাক দিল, মেজখুড়ো!

আরে, এ ছোকরা তো ভাল বিপদ করল! কে তোকে পাঠিয়েছে শুনি?

পিসঠাকুমা।

রামকালী বিরক্তভাবে বললেন, তা আমি বুঝেছি, নইলে আর কার এত– বোধ করি কার

বে আক্কেল হবে বলতে যাচ্ছিলেন, সামলে নিলেন। ছোটদের সামনে গুরুজন সম্পর্কে তাচ্ছিল্যসূচক মন্তব্য করবার মত অসতর্কতা এসেছিল বলে রীতিমত বিরক্ত হলেন নিজের উপর। অথচ মোক্ষদার মত কাণ্ডজ্ঞানহীন গুরুজন সম্পর্কে সকলপ্রকার সমীহনীতি মেনে চলাও শক্ত।

অসতর্কতা সামলে নিয়ে বললেন, বল গে যাও আমার এখন বিস্তর কাজ, তার যা বলবার যখন ভেতরে যাব তখন যেন বলেন।

তুমি এ কথা বলবে পিসঠাকুমা জানে, তাই আমাকে বলে দিল– নেড়ু ঢোঁক গিলে বলে, বলে দিল বল গে যা বড় পিসঠাকুমার ভেদবমি হয়েছে, বাঁচে কি না, এক্ষুনি দরকার।

মুখটা আরো কুঁচকে উঠল রামকালীর। পিসীর ভেদবমির দুর্ভাবনায় নয়, মেয়েমানুষের বিবেচনাহীন আবদারের ধৃষ্টতা দেখে। রোগ যে কাশীশ্বরীর হয় নি সেটা নিশ্চিত, তবু অনর্থক হয়রানি করতে ডাকাডাকি। হয়তো বা অভ্যাগত কুটুম্বিনীদের নিয়ে কোনরূপ সমস্যার উদ্ভব হয়েছে, আর সালিশ মানতে ডাকা হয়েছে রামকালীকে। কিন্তু এই কি তার সময়?

সাতপাড়া লোক নেমন্তন্ন হয়েছে, একদিনের যোগাড়ে যজ্ঞি, মাথায় পর্বত বয়ে ঘুরছেন রামকালী, তখন কিনা এই সব মেয়েলিপনা!

তা ছাড়া আরও বিরক্তিকর, ছোট ছেলেটাকে মিথ্যে কথায় তালিম দিয়ে পাঠানো। কিন্তু যে রাগিণী মোক্ষদা, নেড়ুকে ফেরত দিলে নির্ঘাত নিজেই এখুনি রণরঙ্গিনী মূর্তিতে বার-উঠানেই হানা দেবেন এবং পাঁচজনের কান বাচাবার চেষ্টামাত্র না করে বকাবকি শুরু করবেন, পয়সার দেমাকে ধরাকে সরা দেখিস নে রামকালী, গুরুজন বলে একটু সমেহা করিস।–হ্যাঁ, এরকম কথা স্বচ্ছন্দে বলতে পারেন মোক্ষদা, দ্বিধামাত্র করেন না।

সংসারের এই একটা মানুষকে কিছুতেই এঁটে উঠতে পারলেন না রামকালী। পারতেন, অনায়াসেই পারতেন, যদি সত্যিই রামকালীর গুরুজনে সমীহবোধ না থাকত। গুরুজন হয়েই মোক্ষদা রামকালীকে জব্দে ফেলেছেন।

কিন্তু শুধুই কি গুরুজন বলে জব্দ?

আরও একজনের কাছেও কি মাঝে মাঝে জব্দ হয়ে পড়েন না রামকালী? যে মানুষটা নিতান্তই লঘুজন! হ্যাঁ, মনে মনে স্বীকার না করে পারেন না রামকালী, মাঝে মাঝে সত্যবতীর কাছে জব্দ হতে হয় তাঁকে, হার মানতে হয়। কিন্তু তাতে কি বিরক্তি আসে?

মেজখুড়ো! ছেলেটাও কম নয়। তাই রামকালীর কোঁচকানো ভুরু দেখেও ভয়ে পালিয়ে গেল, বলল, পিসঠাকুমা তোমায় চুপি চুপি ডেকে নিয়ে যেতে বলল, খুব বিপদ!

আঃ, এ তো আচ্ছা মুশকিলে ফেলল।

বিপদটা তো দেখছি আমারই! বলে রামকালী হাঁক দিলেন, তুষ্টু, দই সব ভেতর-দালানে তুলে দাও, আর খোঁজ করে দেখ আর কারও ঘরে আরও দু-দশ সের পাওয়া যাবে কিনা।

পাওয়া গেলে তো ঠাকুর মশাই, আমি নিজেই তুষ্টু মাথা চুলকে ধৃষ্টতা করে বসে, তা তোমার আজ্ঞে পাঁচ মণই কি কম? এ তো বড় খোকার পেরথম বিয়ে নয়

রামকালী ভুরুটা একবার কুঁচকেই মৃদু হাসলেন। বললেন, কথাটা গয়লার ছেলের মতই বলেছিস তুই, পেরথম বিয়ে নয় বলে কুটুম্বজনকে খাওয়াতে বসে অপরিতুষ্ট রাখব? আচ্ছা তুই ওগুলো তুলে দে গে, আসছি আমি।

.

নেড়ুর সঙ্গে সঙ্গে ভিতরবাড়িতে ঢুকলেন রামকালী, মাঝখানে প্রকাণ্ড উঠোনটা পার হয়ে। এই মাঝের উঠোনেই ধানের গোলা মরাই, সারা বছরের জ্বালানী কাঠের মাচা, চালার নিচে জালা জালা বীজধান।

নেড়ু দিগ্বিজয়ীর মত কাশীশ্বরীর ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল, কারণ রামকালীকে ডেকে আনার ভার আর কেউ নিতে চায় নি। সত্য পর্যন্ত ঝাড়া জবাব দিয়েছিল, এই দেখলাম বড় পিসঠাকমা চান করে এল, এক্ষুনি আবার কী ব্যায়োয় ধরল যে বাবাকে শত কষ্মের মধ্যে থেকে ডেকে আনতে যাব? মানুষটার কি এখন মাথার ঠিক আছে? ঘরে তো জোয়ানের বড়ি আছে, তাই খেয়ে নাও না।

তুই বেরো দজ্জাল হারামজাদী বলে মোক্ষদা নেড়ুকে ধরেছিলেন।

কিন্তু নেড়ুদের তো আর গিন্নীদের ঘরে ওঠবার হুকুম নেই, তাই এই যে ঠাকুমা– বলে দাঁড়িয়ে পড়ল। নিচু দরজা, রামকালী খড়ম খুলে মাথা নিচু করে ঢুকলেন। আর সমস্ত ভুলে মোক্ষদা তুই পালা লক্ষ্মীছাড়া ছেলে বলে নেড়ুকে তাড়া দিয়ে বিদেয় করলেন।

রামকালী দেখলেন কাশীশ্বরী মাটিতে শুয়ে আছেন থানের আঁচলটুকু মুখে চাপা দিয়ে। এটা আবার কি! নিশ্চয় কোন মান-অভিমানের ব্যাপার। বিরক্তি এল, তবু শান্তভাবেই বললেন, কি ব্যাপার!

ব্যাপার বেশ উত্তম- চাপা গলায় এটুকু জ্ঞান দান করে মোক্ষদা আরও ফিস ফিস করে বললেন, দুয়োরটা ভেজিয়ে দিয়ে তবে শুনতে হবে।

রামকালী একবার বাইরে তাকালেন। শুচিবাই মোক্ষদাদের এই দিকটা বাদে সারা বাড়ি লোকে লোকারণ্য, এর মধ্যে কপাট ভেজিয়ে গুপ্তমন্ত্রণা! তিনি তো পাগল হন নি! গম্ভীর গলায় বললেন, কপাট থাক, কি বলবার আছে বলো।

.

কিন্তু বলবার কিছু আর আছে নাকি?

আছে বলবার মত মুখ?

অথচ এত বড় ভয়ানক কথা রামকালীকে না জানিয়ে করবেন কি মুখ দুটো মেয়েমানুষ? হিতাহিত জ্ঞান কি আর কিছু আছে তাদের? মোক্ষদার আর কাশীশ্বরীর! শঙ্করী যে কাশীশ্বরীরই নাত-বৌ!

ভয়ঙ্কর খবরটা এখনও পাঁচকান হয় নি, এখনও সংসারে সবাই আপন আপন কাজে হাবুডুবু খাচ্ছে, কিন্তু কতক্ষণ আর অন্যমনস্ক থাকবে লোক? কতক্ষণ আর তাদের কান বাঁচিয়ে রাখা যাবে? তার পর? এক কান থেকে পাঁচ কান, তার পরই তো লহমায় পাঁচশ কান। খড়ো চালার পাড়ায় আগুন লাগাও যা, আর একটা বিধবার কলঙ্ক-কেলেঙ্কারী প্রকাশ হয়ে যাওয়াও। এ চাল থেকে ও চাল তো এ মুখ থেকে ও মুখ। হাড়হাবাতে লক্ষ্মীছাড়া মেয়েমানুষটা নিডুবি হবার আর দিন পেল না!

যদি জলে ডুবে নিডুবি হয়ে থাকে তো সেও বরং ভাল কথা, কিন্তু যদি ভরাডুবি করে বসে থাকে?

কাশীশ্বরীর ধারণা তাই। তাই তিনি মুখে আঁচল চাপা দিয়ে পড়ে আছেন। আর মর্মে মর্মে অনুভব করছেন, কেন সেই সর্বনাশীর খুড়োখুড়ী ও মেয়েকে ঘরে রাখে নি, উপযাচক হয়ে কাশীশ্বরীর গলায় গছিয়ে গেছে। হায় হায়, কালই তো টের পেয়েছিলেন কাশীশ্বরী, নাপিত-বৌয়ের কথার আঁচে, তবে কেন আবাগীর বেটিকে দুয়ারে তালা লাগিয়ে আটকে রাখেন নি! পাঁচটা কুটুমের কাছে সাফাই গাইতে বললেই হত, হঠাৎ মাথাটার কেমন দোষ হয়ে গেছে শঙ্করীর, তাই কাজের বাড়িতে ছেড়ে রাখতে সাহস করেন নি!

মোক্ষদা কিন্তু জলে ডোবার কথাই তোলেন। কোন্ রাত্তিরে কখন উঠে এ কাজ করেছে কিছু টের পাই নি রামকালী, সকালবেলাও বলি চানে গেছে না কোথায় গেছে। বেলা হতে মাথায় বজ্রাঘাত। আমার স্থির বিশ্বাস, বড় পুকুরে গিয়ে ডুবেছে কপালখাকী। এইবেলা জাল ফেলালে

না! রামকালী জলদগম্ভীর স্বরে বলেন, জাল ফেলা হবে না।

জাল ফেলা হবে না!

যন্ত্রচালিতের মত উচ্চারণ করেন মোক্ষদা।

না। এতগুলো লোকের খাওয়া পণ্ড হতে দেব না আমি।

মোক্ষদা প্রকৃতি-বিরুদ্ধ ভাবে বলেন, কিন্তু একটা জীবের জীবনের চাইতে যজ্ঞিটাই বড় হল তোমার বিচারে?

শুধু আমার বিচারে নয়, যে কোন বুদ্ধিমান লোকের বিচারেই। রামকালী ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে করতে বলেন, বলছ সকাল থেকে দেখতে পাও নি, ধরে নিতে হবে কাজটা হয়ে থাকে তো রাতেই হয়েছে। এখন জাল ফেললে জীবটা জীবন্ত উঠবে তোমাদের বিশ্বাস?

মোক্ষদা চুপ করে থাকেন উপযুক্ত উত্তরের অভাবে। আর কাশীশ্বরী চাপা গলায় হু-হুঁ করে দে ওঠেন।

থাম! লোকজন খাওয়ার আগে যেন টু শব্দটি না হয়। যদি ডুবে থাকে তো যতক্ষণ না ভেসে, ততক্ষণ তাকে জলের তলায় থাকতে দাও। ডুবলে ভেসে উঠতেই হবে, নদী নয় যে ভেসে চলে যাবে। কিন্তু– পায়চারি থামিয়ে রামকালী কাশীশ্বরীর খুব কাছে সরে আসেন, ঈষৎ নিচু হয়ে চাপা গম্ভীর সুরে বলেন, আর যদি ডুবে না থাকে, বৃথা জাল ফেলার পর সমাজে অবস্থাটা কি দেখাবে অনুমান করতে পারছ? ঘরের বৌ-ঝিকে আগলে আটকে রাখার ক্ষমতা যখন নেই, তখন নিজেদের জিভকেই আগলে আটকে রাখো!

কাশীশ্বরী সহসা কেঁদে ওঠেন, ও রামকালী, তুমি আমায় একটু বিষ দাও বাবা, আমি এই মুখ আর কাউকে দেখাতে পারব না।

ছেলেমানুষি করো না। মৃদুস্বরে ধমকে ওঠেন রামকালী, বিপদে মতি স্থির রাখ। আমাকে বিবেচনা করবার সময় দাও। কিন্তু এই ভেবে আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি আমি, বলছ তোমাদের কাছে শুতেন অথচ দু-দুটো মানুষ কিছু টের পেলে না তোমরা?

মরণের ঘুম এসেছিল বাবা আমাদের– কাশীশ্বরী আর একবার কেঁদে ওঠেন।

পিসীমা, হাতজোড় করছি তোমায়, হৈ-চৈ করো না। সবাইকে না হয় বলো খুড়োর অসুখের খবর পেয়ে হঠাৎ বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে তাকে।

মানুষ তো আর ঘাসের বিচি খায় না রামকালী, মোক্ষদা নিজস্ব ভঙ্গীতে ফিরে আসেন, কাল রাতদুপুর সবাইয়ের সঙ্গে কুটনো কুটেছে লক্ষ্মীছাড়ী

আশ্চর্য! আবার পায়চারি করতে করতে বলে ওঠেন রামকালী, এ রকমটা হল কেন কিছু অনুমান করতে পারছ তোমরা?

কাশীশ্বরী মুখের ঢাকাটা আরও শক্ত করে চাপা দিয়ে বলে ওঠেন, আমি পারছি রামকালী। মতিগতি তার ভাল ছিল না। ধিঙ্গী বয়েস অবধি খুড়োর ঘরে থেকেছে, মা-বাপ ছিল না যে সুশিক্ষে দেবে, উচ্ছন্নে যাওয়ার বুদ্ধির বৃদ্ধি করেছে বসে বসে! আমি বুঝছি জলে ডুবে মরে নি ও, আমাদের মুখে চুনকালিই দিয়েছে।

ঘরটা নিচু-নিচু অন্ধকার মত। জানলা আছে কি নেই, তবু রামকালীর টটকে ফরসা মুখটা আরও কত টকটকে হয়ে উঠেছে, টের পেলেন মোক্ষদা। চেয়ে চেয়ে মনে হল যেন ওই টকটকে মুখটা থেকে উত্তাপ বেরোচ্ছে। বেপরোয়া মোক্ষদাও ভয় খেলেন। কি বলতে গিয়ে থেমে গেলেন।

আর ঠিক এই সময় দরজার গোড়ায় কাসর বেজে উঠল।

মাজাঘষা চাচাছোলা কাসর। ওগো অ ঠাকমারা, কাটোয়ার বৌ গেল কোথায়? পান সাজবার জন্যে যে হাঁক-পাড়াপাড়ি হচ্ছে তাকে। তোমরাই বা দুই বুনে এই বেলা দুপুর অবধি শোবার ঘরে গুলতুমি করছ কেন? চান করে আবার শোবার ঘরে এসে সেঁধিয়েছ যে বড়? আর একবার চানের বাসনা আছে বুঝি? তা তোমাদের বাসনা মেটাও, বৌকে পাঠিয়ে দাও।

ঘরে ঢোকবার অধিকার নেই তাই বাইরে দাঁড়িয়েই বাক্যস্রোত বইয়ে দেয় সত্য। ধারণাও করতে পারে না ঘরের ভিতরে তার বাপের উপস্থিতি সম্ভব।

উঁচু ‘পোতা’র ঘর, দরজার বাইরে থেকে ছোটদের পক্ষে ভিতরটা স্পষ্ট দেখাও সম্ভব নয়।

মোক্ষদা বিনা বাক্যব্যয়ে কপাটের সামনে এসে দাঁড়ান, অতএব ঘরেই আছেন তিনি। সত্য বিরক্ত কণ্ঠে বলে, কি গো, মুখে বাক্যি-ওক্যি নেই কেন? কাঠোয়ার বৌ গেল কোথায় সেটা বলবে তো? ঘাট থেকে আরম্ভ করে সাত চৌহদ্দি ছিষ্টি খুঁজে এলাম

সহসা মোক্ষদা সরে দাঁড়ালেন, এবং সেই শূন্য স্থানে রামকালীর মূর্তিটা দেখা গেল।

বাবা!

সত্য বজ্রাহত!

এখানে বাবা! আর সত্য মুখের তোড় খুলে দিয়েছে! ছি ছি! কিন্তু বাবা এখানে কেন? তা হলে নির্ঘাত কাটোয়ার বৌয়ের হঠাৎ কোনও অসুখ করেছে, পিসঠাকুমারা তাই নিয়ে হিমসিম খাচ্ছে। ছি, ছি, এদিকে এই কাণ্ড, আর সত্য কিনা পান সাজার তাগাদা দিতে এসেছে! বাবা কি বলবেন! বাড়ির কোনও খবর রাখে না সত্য এইটাই প্রমাণ হবে!

মনে মনে জিভ কেটে চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বেচারা। আজ আর মানসিক চাঞ্চল্য নিবারণ করতে অভ্যাসগত শাড়ির আঁচলটা নিয়ে চিবোবার উপায় নেই, পরণে উৎসব উপলক্ষে নিজের বিবাহকাল লব্ধ একখানা ভারী বালুচরী চেলি।

রামকালী ঘাড় ফিরিয়ে মোক্ষদা ভগ্নীদ্বয়কে উদ্দেশ করে মৃদুস্বরে বললেন, স্বাভাবিক ভাবে যার যা কাজ করো গে যাও, বৃথা ঘরের মধ্যে বসে থাকবার দরকার নেই। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। এসে মেয়েকে একটা সহজ পরিহাসের কথা বলে উঠলেন, ইস! মেলাই সেজেছিস যে!

কথাটা মিথ্যা নয়, শুধু বালুচরী কেন, মেয়েকে আজ একগা গয়না পরিয়ে সাজিয়েছে ভুবনেশ্বরী। কমগুলি গয়না তো হয় নি সত্যর বিয়ের সময়, পরে কবে? বাপের কথায় লজ্জিত হাসি হেসে মাথা নিচু করল। এবার রামকালী পুরনো প্রসঙ্গে ফিরে গেলেন, ভাগ্নে-বৌমাকে কে ডাকছে?

ভাগ্নে-বৌমা অর্থে আপাতত শঙ্করীকেই বোঝাল। সত্য বাবার কথায় নয়, বাবার কণ্ঠস্বরে থতমত খেল, অসহায়-অসহায় চোখে বলল, ওই তো ওরা, যারা এক বরজ পান নিয়ে সাজতে বসেছে।

তাদের বলে দাও গে উনি আজ আর পান সাজতে পারবেন না। হঠাৎ যেন রামকালীও অসহায়তা বোধ করলেন, তাই তাড়াতাড়ি বললেন, আচ্ছা থাক, তোমার এখন আর ওদিকে যাবার দরকার নেই, যারা পান সাজছেন সাজুন।

কথায় কথায় পায়ে পায়ে এগিয়ে চলেছেন রামকালী, ঘরের পিছনে ঢেঁকি ঘরের দিকে ইচ্ছে করেই। সত্য সে খেয়াল করে না, ম্লানমুখে প্রশ্ন করে, কাটোয়ার বৌয়ের অসুখ কি বেশী বাবা?

অসুখ? কে বলবে? রামকালী চমকে উঠে সামলে নিয়ে গম্ভীর ভাবে বলেন, শোন, ওঁকে বৃথা ডাকাডাকি করো না। অসুখ করে নি, ওঁকে হঠাৎ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

.

আশ্চর্য! এ কথা কেন বললেন রামকালী!

একট আগেও কি সিদ্ধান্ত করেছিলেন তিনি এ সংবাদটা আর কারও কাছে প্রকাশ করবেন না? হয়তো আর কেউ হলেই করতেন না, হয়তো ভুবনেশ্বরী এসে প্রশ্ন করলেও তাকে এই ডাকাডাকি করো না বলেই থেমে যেতেন, কিন্তু সত্যর ওই উজ্জ্বল বিশ্বস্ত মস্ত বড় বড় চোখ দুটোর সামনে যেন সত্য গোপন করা কঠিন হল। আর রামকালীর চিন্তাক্লিষ্ট মুখের দিকে তাকিয়ে এমনও মনে হল, এই ন বছরের মেয়েটার কাছে বুঝি তিনি চিন্তার ভাগ নেবার আশ্রয় খুঁজছেন।

কিন্তু সত্যর তো ততক্ষণে হয়ে গেছে!

খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না?

আস্ত একটা মানুষকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না!

তাতে আবার মেয়েমানুষ! বেটাছেলে নয় যে পায়ে হেঁটে কোথাও চলে গেছে! মেয়েমানুষকে খুঁজে না পাওয়ার অর্থই নির্ঘাত বড়পুকুরের কাকচক্ষু জল। অবশ্য এ জ্ঞানটা সত্যর সম্প্রতিই হয়েছে সারদাকে উপলক্ষ্য করে। তাই চমকে উঠে বলে, খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না? হায় আমার কপাল, ওই ভয়ে বড়বৌকে সমস্ত রাত ঘরে ছেকল তুলে রেখে দিলাম, আর কাটোয়ার বৌ এই করল! হে ঠাকুর, আমি কেন দুটোকেই ছেকল দিলাম না?

বড় বৌমাকে ছেকল দিয়ে রেখেছিলে? চমৎকৃত রামকালী প্রশ্ন করেন।

না দিলে– সত্য উদ্দীপ্ত কণ্ঠে বলে, নিশ্চিন্দি হয়ে ঘুম আসে? জলচৌকির ওপর জলচৌকি বসিয়ে কত কাণ্ড করে ছেকলে হাত দিয়েছি! ভোরের বেলা মাকে বলেকয়ে খুলিয়ে দিই। হায় হায়, কাটোয়ার বৌকেও যদি বলেই সত্য সহসা সুর ফেরায়, করুণ রসের পরিবর্তে বীর রসের আমদানি করে, যাক, সে বেচারা মরেছে না জুড়িয়েছে। মানুষটা একদিন ঘাট থেকে আসতে একটু দেরি করেছে, লক্ষ্মীর ঘরে সন্ধ্যে দিতে পারে নি, তার তরে কী গঞ্জনা কী বাক্যিযন্ত্রণা! একটা মনিষ্যি, তাকে দশটা মানুষে তাড়না! বড় পিঠাটি কি সোজা নাকি? গাল দিয়ে দিয়ে আর আশ মেটে না। অত বাক্যযন্ত্রণায় পাষাণ পিরতিমে হলেও জলে গে ঝাঁপ দেয়।

রামকালী যেন ক্রমশ রহস্যের সূত্র পাচ্ছেন। বললেন, বকাবকিটা কখন হল?

এই তো কালই। অবশ্যি বৌয়েরও দোষ আছে, জল নিতে গেছ জল নিয়ে চলে এস, সন্ধ্যেভোর ঘাটে বসে থাকার দরকার কি? তবে হ্যাঁ, এনাদেরও লঘুপাপে গুরুদণ্ড! অবীরে বিধবা, মনেপ্রাণে কি সুখ আছে ওর? দু দণ্ড নয় ছিলই ঘাটে, তার জন্যে অত গালমন্দ! এই গ্রীষ্মকালে কুল কোথায় তার ঠিক নেই, সকল গাছই তো নেড়া, তবু বলে কি ঘাটে যাবার ছুতোয় কুল খাচ্ছিলি, আরও সব কত কথা– বলেই হতাশ নিঃশ্বাস ফেলা সত্য, আমি তার মানেই জানি না বাবা।

রহস্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কাল সন্ধ্যায় ঘাটে যে নারীমূর্তিটি দেখেছিলেন রামকালী, সে মূর্তি তা হলে সারদার নয়, কাশীশ্বরীর নাত-বৌয়ের! আত্মহত্যার চেষ্টাই ছিল তার তখন!

একবারের চেষ্টায় পারে নি, তাই দ্বিতীয়বার আবার! কিন্তু খটকা লাগছে একটা জায়গায়, বকাবকিটা তো তার পরবর্তী ঘটনা। তা ছাড়া সত্যবতী বর্ণিত কুল খাওয়া শব্দটা! যা শুনে এত চিন্তার মধ্যেও হাসি এসে গিয়েছিল তার।

কাশীশ্বরীও ওই সন্দেহ ব্যক্ত করেছেন।

রামকালী চাটুয্যের বাড়িতে এমন একটা ঘটনাও ঘটা সম্ভব!

ভয়ানক একটা যন্ত্রণা অনুভব করলেন রামকালী। না, শঙ্করীর অপঘাত মৃত্যু ভেবে নয়, চাটুয্যে বাড়ির সম্ভ্রম নষ্ট বলেও নয়, যন্ত্রণা বোধ করলেন নিজের ত্রুটির কথা ভেবে। আরও হুশিয়ার থাকা উচিত ছিল তার, আরও যথেষ্ট পরিমাণে সাবধান। একটা নিতান্ত তুচ্ছ মেয়েমানুষ যেন রামকালীর ক্ষমতার তুচ্ছতাকে ব্যঙ্গ করে গেল।

মেয়েটার এ ধৃষ্টতাকে ক্ষমা করা যাচ্ছে না।

হঠাৎ অনুভব করলেন সত্য পিছিয়ে পড়েছে। ঘাড় ফিরিয়ে দেখে থমকে গেলেন। সহসা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ে নিঃশব্দে কান্না শুরু করেছে সত্যবতী।

রামকালী পিছিয়ে এলেন। গম্ভীরভাবে বললেন, তোমার কাঁদবার দরকার নেই।

বাবা! এবার আর নিঃশব্দে নয়, ডুকরে ওঠে সত্য, সব দোষ আমার। কাটোয়ারা বৌ তো রাতদিন বলত, মরণ হলে বাঁচি, আমি যদি তখন তোমাকে বলি তো একটা প্রিতিকার হয়। মনে করতাম অলীক কথা, রাজ্যি সুদ্দু মেয়েমানুষই তো রাতদিন মরণ-মরণ করে–তেমনি। কাটোয়ার বৌ সত্যি ঘটিয়ে ছাড়ল! মা নেই বাপ নেই ভাই নেই, স্বামীপুতুর কেউ নেই মানুষটার, শুধু গালমন্দ খেয়ে খেয়ে বেঘোরে মরে গেল! তুমি আগে টের পেলে

কান্নাটা বড় বেশী উথলে উঠল সত্যর।

.

রামকালী কি হঠাৎ তড়িতাহত হয়ে স্তব্ধ হয়ে গেছেন? নইলে মুখের চেহারা তাঁর হঠাৎ অত অদ্ভুতভাবে বদলে গেল কি করে? যে ভ্রূকুটি নিয়ে একটা তুচ্ছ মেয়েমানুষের ধৃষ্টতার দিকে তাকিয়েছিলেন, সে কুভ্রূটি মিলিয়ে গেল কেন? হঠাৎ একটা ধাক্কা খেয়ে কি হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল তার এতক্ষণকার চিন্তাধারা?

কান্না থামাও! বলে আস্তে আস্তে চলে গেলেন তিনি বারবাড়ির দিকে। গিয়ে দাঁড়ালেন ভিয়েন-ঘরে যেখানে কুঞ্জ তখন জলচৌকিটা ঘুরিয়ে নিয়ে দেয়ালের দিকে মুখ করে বসে বসে একসরা গরম ছানাবড়া চাখছেন।

বললেন, বড়দা, আমাকে একবার বেরোতে হবে, তুমি দেখো অতিথিদের যেন কোন অমর্যাদা না হয়।

আ-আমি! মিষ্টি গলায় বেধে গেল কুঞ্জর।

হ্যাঁ, তুমি। নয় কেন? তুমি বড়!

হ্যাঁ, বেরোবেন রামকালী। জেলেদের ঘরে গিয়ে বলতে হবে, পুকুরে আর একবার জাল ফেলানো দরকার। বাড়িতে কাজ, সন্দেহ করার কিছু নেই। ভাববে মাছের কমতি পড়েছে।

তবে রামকালী যেন বুঝছেন, ওটা নিরর্থক। কাশীশ্বরীর নাতবৌ নিজে ডুবে মরে নি, সংসারটাকে ডুবিয়েছে।

রামকালী কি তবে এবার নির্দেশের আশ্রয় খুঁজবেন? নিজের ওপর কি আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন? নইলে যে প্রাণীটাকে শুধু প্রাণীমাত্র ভেবে তার ওপর বিরক্ত হচ্ছিলেন তার ধৃষ্টতার বহর দেখে তাকে অন্য দৃষ্টিতে দেখছেন কেন? কেন ভাবছেন তারও কোনো প্রাপ্য পাওনা ছিল সংসারে? তাই রামকালী উপদেষ্টার দরকার অনুভব করছেন!

 ১৪. পালকি থেকে মুখ বাড়িয়ে

ওরে বাবা-সকল, একটু চোটপায়ে চল, তাগাদা আছে।

পালকি থেকে মুখ বাড়িয়ে আর একবার তাগাদা দিলেন রামকালী। মধ্যাহ্নের মধ্যে গিয়ে পৌঁছাতে না পারলে বিদ্যারত্ন মশাইয়ের সঙ্গে দেখা হবে না। প্রাতঃসন্ধ্যা সেরে গঙ্গাস্নানে বেরিয়ে পড়েন বিদ্যারত্ন, যেটা বিদ্যারতের আবাসস্থান থেকে অন্তত তিন ক্রোশ দূরে। যাতায়াতের এই ছ ক্রোশ পাড়ি দিয়ে নিত্যাস্নানপর্ব সমাধা করে পুনরায় ঠাকুরঘরে ঢুকে পড়েন তিনি গৃহবিগ্রহের ভোগ দিতে। তৎপরে প্রসাদ গ্রহণ, তার পর আবার সামান্য সময় বিশ্রাম, এই মধ্যবর্তী সময়টা কারও সঙ্গে দেখা করেন না বিদ্যারত্ন। কাজেই তার কাছে যেতে হলে ওই গঙ্গাস্নান সেরে ফেলার মুহূর্তে, নয় অপরাহ্নে।

কিন্তু অপরাহ্ন পর্যন্ত সময় কোথা রামকালীর প্রয়োজন যে বড় জরুরী!

জীবনে যখনই কোন সমস্যা সমাধানের জরুরী প্রয়োজন পড়ে, তখন রামকালী বিদ্যারত্নের দরবারে এসে হাজির দেন।

অবশ্য সে রকম প্রয়োজন জীবনে দৈবাৎই এসেছে।

সেই একবার এসেছিল নিবারণ চৌধুরীর মায়ের গঙ্গাযাত্রার ব্যাপারে। তিরানব্বই বছরের বুড়ী সজ্ঞানে গঙ্গাযাত্রা করলেন, আর সে নির্দেশ রামকালীই দিয়েছিলেন। কিন্তু বুড়ী যেন রামকালীর বিদ্যা-বুদ্ধিকে পরিহাস করে পাঁচ দিন গঙ্গাতীরের হাওয়া খেয়ে বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠল। তারপর তার বায়না আমায় তোরা বাড়ি নে চল! শরীরে শক্তি আছে, বয়সে মন অবুঝ হয়ে গেছে। নিবারণ চৌধুরী রামকালীকে এসে ধরে পড়লেন, বলুন কি বিহিত?

সেই সময় চিন্তায় পড়েছিলেন রামকালী।

গঙ্গাযাত্রীর মড়া ফের ভিটেয় ফেরত নিয়ে গেলে সংসারের মহা অকল্যাণ, সদ্য ভিটেটায় তো তোলাই যাবে না তাকে। পেঁকিঘরে কি গোয়ালে বড় জোর রাখা যায়, কিন্তু নিবারণ চৌধুরীর মনোভাব দেখে মনে হয়েছিল, সেটুকুতেও তিনি নারাজ। ছেলেপুলে নিয়ে ঘর করেন তিনি সংসারে এত বড় অকল্যাণ ঘটাতে বুক কাঁপছে। বার বার তাই কবরেজ মশাইয়ের কাছে বিধিবিধান চেয়েছিলেন।

সেই সময় এসেছিলেন রামকালী বিদ্যারত্নের কাছে। এসে প্রশ্ন করেছিলেন, বিদ্যারত্ন মশাই, বলুন শাস্ত্র বড় না মাতৃমর্যাদা বড়?

আজ এসেছেন আর এক প্রশ্ন নিয়ে।

অবশ্য আপাতত প্রশ্ন তাড়াতাড়ি পৌঁছবার। একখানা গ্রাম পার হয়ে তবে দেবীপুর। বিদ্যারত্নের গ্রাম।

পালকি থেকে আর একবার মুখ বাড়িয়ে দেখে বেহারাদার তাগাদা দিতে গিয়ে থেমে গেলেন রামকালী, থাক, এত বিচলিত হবার দরকার নেই, পোঁছে ওরা দেবেই ঠিক।

বিচলিত হওয়াকে ঘৃণা করেন রামকালী। তবু মনে মনে অস্বীকার করে লাভ নেই, আজ একটু বিচলিত হয়েছেন। কোথায় যেন হেরে গেছেন রামকালী, তারই একটা সূক্ষ্ম অপমানের জ্বালা মনকে বিধছে।

কিন্তু রামকালীর মধ্যে এই পরাজয়ের গ্লানি কেন? সংসারের একটা বুদ্ধিহীন মেয়ে যদি একটা অঘটন ঘটিয়ে বসে থাকেই, তাতে রামকালীর পরাজয় কেন?

.

ঘোড়ায় এলে এতক্ষণে পৌঁছে যেতেন, কিন্তু কোন বয়োজ্যেষ্ঠ বা গুরুস্থানীয়ের সামনাসামনি সাধ্যপক্ষে ঘোড়ায় চড়েন না রামকালী। তাই পালকিতেই বেরিয়েছেন। বেরিয়ে এসেছেন একটু সঙ্গোপনেই। জেলেদের জাল ফেলার ব্যাপারটা সামান্য তদারক করেই। বাড়তি কিছু মাছ উঠলে উঠুক। খাদ্যবস্তু কখনো বাড়তি হয় না। ওরা এখন যেভাবে কাজ করছে করুক, রামকালীর অনুপস্থিতি টের না পেলেই মঙ্গল। টের পেলেই কাজে ঢিলে দেবে।

কারুর ওপর কি ভরসা করার জো আছে?

কাকা আছেন, সেজকাকা। কিন্তু তাকে কোন কাজকর্মের ভার দেওয়াও বিপদ। কারণ তাঁর মতে ডাকহক চেঁচামেচি এবং নির্বিচারে সকলকে ধমকাতে পারাই পুরুষের প্রধান গুণ। আর বয়েস হয়ে গেলে পৌরুষের পরিমাণটা যে তার একতিলও কমে নি, সর্বদা সেটা প্রমাণ করতেও রীতিমত তৎপর সেজকাকা। তাই তাকে ডেকেডুকে কর্তৃত্বের ভার দেওয়া মানে বিপদ বাধানো।

আর কুঞ্জ? কুঞ্জর কথা কি বলারই যোগ্য?

মিষ্টির ভিয়েনের কানাচে হাতে মুখে রসমাখা আর মুখভর্তি ছানাবড়া ঠাসা কুঞ্জর তৎকালীন চেহারাটা একবার চোখের সামনে ভেসে উঠল। তখন যখন দেখেছিলেন, মনটা বিরক্তিতে ভরে গিয়েছিল, এখন হঠাৎ একটা মমতা-মিশ্রিত অনুকম্পার ভাব মনে এল।

যে মানুষ লুকিয়ে-চুরিয়ে নিজের ছেলের বিয়ের ভোজের মিষ্টান্ন খেতে বসে, তার উপর অনুকম্পা ছাড়া হৃদয়ের আর কোন্ ভাববৃত্তি বিকশিত হবে?

এরা কি রাগেরই যোগ্য?

আশ্চর্য! রাসুটা হচ্ছে ঠিক বাপের মতই অপদার্থ। ভবিষ্যতের দিকে তাকালে খুব একটা আশার আলো চোখে পড়ে না। কিন্তু তার জন্য হতাশা আনেন না রামকালী–আপন শক্তিতে বিশ্বাসী, আপন কেন্দ্রে অটুট অবিচল তিনি।

ওদের কথাকে চিন্তার জগতে ঠাই দেন না রামকালী, কিন্তু সত্যটা মাঝে মাঝে তাঁকে ভাবিয়ে তোলে। শুধু সেই একটা ভয়ঙ্কর সরল মুখ থেকে উচ্চারিত ভয়ঙ্কর জটিল প্রশ্নগুলোই চিন্তিত করে তোলে রামকালীকে তা নয়, চিন্তিত করে তোলে সত্যর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে।

সংসার কি সত্যবতীকে বুঝবে?

পালকি থেকে নেমে পড়লেন রামকালী।

বিদ্যারত্নের মাটির কুটির থেকে একটু দূরে। সেটাই সভ্যতা, সেটাই গুরুজনের সম্ভ্রম রক্ষা। গুরুজনের চোখের সামনে গাড়ি পালকি থেকে নামা অবিনয়।

মাটির ঘর দালান দাওয়া, দাওয়ার নিচের উঠোনে আঁকা ছবির মত বেড়া ঘেরা ছোট্ট ফুলবাগানটি। বিদ্যারত্নের নিজের হাতের বাগান, নিজের হাতের দেওয়া বেড়া। টগর দোপাটি গাঁদা বেল মল্লিকা রক্তজবা করৰী সন্ধ্যামণি, নানান গাছে সারা বছরই ফুলের সমারোহ। এছাড়া বেড়ার ধারে আছে তুলসী কেয়ারি। গঙ্গাস্নানের পর পূজোর আগে একবার গাছগাছড়াগুলির তদারক করে যাওয়ার অভ্যাস বিদ্যারত্নের। পায়ে খড়ম, পরনে নিজের হাতে কাটা সুতোর ধুতি ও উত্তরীয়– পিতলের ঝারায় জল নিয়ে গাছের গোড়ায় গোড়ায় ঢালছিলেন বিদ্যারত্ন, রৌদ্রে, রামকালীর ছায়া পড়তেই মুখ তুলে তাকালেন।

হৈ হৈ করে সম্ভাষণ করে উঠলেন না বিদ্যারত্ন। হঠাৎ আবির্ভাবের জন্য বিস্ময় প্রকাশও করলেন, শুধু রামকালীর প্রণাম শেষ হলে তাঁর মাথায় হাত রেখে বললেন, এস, দীর্ঘায়ু হও।

শান্ত, সৌম্য মুখ, শ্যামবর্ণ ছোটখাটো চেহারা, মাথার চুলগুলি ধবধবে পাকা, কিন্তু দৃঢ়নিবদ্ধ মুখের চামড়ায় বলিরেখার আভাসমাত্র নেই। সহজে বিশ্বাস করা শক্তবিদ্যারত্ন মশাইয়ের বয়স আশী ছোঁয়-ছোঁয়। চকচকে সাজানো দাঁতের পাটির শুভ্র হাসিটুকুও বিশ্বাস করতে প্রতিবন্ধকতা করে।

দাওয়ার উপর খান দুই-তিন জলচৌকি, কাছের পৈঠেয় ঘটিতে জল। পা ধুয়ে দাওয়ায় উঠে জলচৌকিতে বসলেন রামকালী, বিনত হাস্যে বললেন, আপনার তো আহ্নিকের বেলা হল!

তা হল। বিদ্যারত্ন প্রশ্রয়ের হাসি হাসলেন, বলবে কিছু–যদি বলবার থাকে?

বলবার কিছু আছেই, নচেৎ এমন অসময়ে ব্যস্ত হয়ে আসার কারণ কি?

রামকালী আর গৌরচন্দ্রিকা করলেন না, মুখ তুলে পরিষ্কার কণ্ঠে বললেন, পণ্ডিতমশাই, আজ আবার এক প্রশ্ন নিয়ে আপনার দরবারে এসে দাঁড়িয়েছি। বলুন মানুষ বড়, না বংশমর্যাদার অহঙ্কার বড়?

.

ঠিক এই একই সময় একটা ছোট মেয়ে ওই একই ধরনের প্রশ্ন করছিল, অন্য কাউকে নয়, নিজের মনকেই। আচ্ছা এও বলব, মানুষ বড়, না তোমাদের রাগটাই বড়?

কী আশ্চয্যি, কী আশ্চয্যি! জলজ্যান্ত একটা মানুষ হারিয়ে গেল তবু গিন্নীরা কিনা সত্যর ওপর চোখ রাঙাচ্ছেন, খবরদার দুটি ঠোঁট ফাঁক করবি না, কারুর যদি কানে যায় তো তোদের সব কটার হাড়মাস দু ঠাই করব।

বেশ বাবা, তোমাদের জেদই থাক, রাগ নিয়ে ধুয়ে জল খাও তোমরা।

ওদিকে বিদ্যারত্ন রামকালীকে বলছিলেন, কালের সমুদ্রে একটা মানুষের জীবনমরণ সুখদুঃখ কিছুই নয় রামকালী, সমুদ্রে বুদ্বুদ মাত্র। কুলত্যাগিনী বধূকে সন্ধান করবার প্রয়োজন নেই।

কিন্তু সমাজকে তো একটা জবাব দিতে হবে?

যা সত্য তা বলবে সাহসের সঙ্গে। সত্যকে স্পষ্ট করে বলতে পারা চাই। সেটাই ধর্ম। সেই বিপদগামিনীকে তুমি তো আর ঘরে নিচ্ছ না? ভেবে নাও তার মৃত্যু হয়েছে।

কিন্তু পণ্ডিতমশাই, এ আমি ভাবতেই পারছি না। আমার ঘরের কথা নিয়ে অপরে আলোচনা করবে।

রামকালী, তোমার দেহে একট দুষ্টু রোগ হওয়া অসম্ভব নয়, তা যদি হয় কি করবে তুমি? বিধাতার বিধান মেনে নিতেই হবে। তা ছাড়া হয়তো এরকম একটা কিছু প্রয়োজনও ছিল। হয়তো তোমার ভিতর কোনখানে একটু অহমিকা এসেছিল।

অহমিকা! পণ্ডিতমশাই, আমি’র প্রতি মর্যাদাবোধ থাকাটা কি ভুল? অন্যায়?

এই একটা জায়গা বড় গোলমেলে রামকালী, আত্মমর্যাদাবোধ আর অহমিকা-বোধ, এ দুটোর চেহারা যমজ ভাইয়ের মত, প্রায় এক, সূক্ষ্ম আত্মবিচারের দ্বারা এদের তফাৎ বোঝা যায়। তা ছাড়া তুমি ব্রাহ্মণ! রজোগুণ তোমার জন্য নয়। কিন্তু আজ তোমার চিত্ত চঞ্চল, তুমি এখন বিশেষ ব্যস্তও, কাজেই আজ এস। আলোচনা থাক।

রামকালী কয়েক মুহূর্ত মাথা নিচু করে ভূমিসংলগ্ন দৃষ্টিতে কি যেন ভাবলেন, তারপর সহসা মাথা তুলে বলিষ্ঠ কণ্ঠে বললেন, আচ্ছা, আপনার নির্দেশ শিরোধার্য করলাম।

আর একবার বিদ্যারত্নের পদধূলি নিয়ে বেরিয়ে এসে পালকিতে চড়লেন রামকালী। ফেরার মুখে আর বেহারাদের তাড়া দেবার কথা মনে এল না। বিদ্যারত্নের একটা কথা তাকে বিশেষ ধাক্কা দিয়েছে। বিদ্যারত্ন বললেন, তুমি ব্রাহ্মণ, রজোগুণ তোমার জন্য নয়।

কিন্তু তাই কি সত্য? ব্রাহ্মণের মধ্যে তেজ থাকবে না? থাকবে কেবলমাত্র রজোগুণ-শূন্য স্তিমিত শান্তি?

.

ফিরে দেখলেন বাড়ি লোকে লোকারণ্য। নিমন্ত্রিতেরা প্রায় সকলেই এসে গেছে। রান্নাও প্রস্তুত। শুধু রামকালীর অনুপস্থিতিতে ভোজে বসিয়ে দেবার ব্যবস্থাটা ঠিকমত হচ্ছে না, সকলে মিলে শুধু গুলতানি চলছে।

এই চনচনে সময়ে দূর থেকে পরিচিত পালকি-বেহারাদের হুম হুম্ আওয়াজ কানে এল। আশায় অধীর হয়ে উঠল সবাই এসে গেছেন, এসে গেছেন রবে গম্ গম্ করে উঠল জনতা। সকলেই অবশ্য ধরে নিয়েছিল আচমকা কোন রোগীর মরণ-বাচন সংবাদ পেয়ে বাধ্য হয়ে বেরিয়ে যেতে হয়েছে রামকালীকে। কুঞ্জও সেই কথাই বলে রেখেছিলেন।

অন্দরমহলে মেয়েদের মধ্যে শঙ্করী সম্পর্কে কানাঘুষো শুরু হয়ে গিয়েছিল; কিন্তু বারমহল সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত।

রামকালী এসে দাঁড়াতেই বয়োজ্যেষ্ঠ অতিথি-অভ্যাসগতের দল হৈ হৈ করে এগিয়ে এলেন, ব্যারামটা কার রামকালী? কোন্ গায়ে? কে যেন দেবীপুরের দিকে পাকি যেতে দেখল, এইখানেই কারও—

না, কারও ব্যায়রাম শুনে আমি যাই নি– রামকালী একবার লোক-ভর্তি আটচালার সমস্তটায় চোখ বুলিয়ে নিলেন, তার পর একটু থেমে বললেন, আমি বেরিয়েছিলাম অন্য প্রয়োজনে, সে প্রয়োজেনের কথা আপনাদের সকলকেই জানাব। যদিও আপনারা এখনো অভুক্ত ও ক্ষুধার্ত, আমার কথা শুনে ঠিক কি মনোভাব আপনাদের হবে তাও সম্পূর্ণ বুঝতে পারছি না, তবু আহারাদির পূর্বেই কথাটা ব্যক্ত করা উচিত মনে করছি আমি। বলতে আপনারা সকলে অনুমতি করুন আমাকে।

নিঃশব্দ জনতার মাঝখানে রামকালীর ভরাট কণ্ঠস্বর গম্ গম্ করে উঠল, অনেকেরই বুক কেঁপে উঠল একটা অজানা আশঙ্কায়।

কুঞ্জ হঠাৎ পিছনদিকে হঠে গিয়ে ধুলোর উপর বসে পড়লেন, রাসু ভিড়ের একেবারে পিছনেই ছিল সে হাঁ করে তাকিয়ে রইল কাকার আরক্ত গৌরমুখের দিকে। সমাগতেরা অনুধাবন করতে পারছেন না ব্যাপারটা কি। আহার্য বস্তুতে কি কোনও অনাচার স্পর্শ ঘটেছে? কিন্তু তাই বা কি করে বলা যায়? রামকালীর আচমকা বেরিয়ে যাওয়ার প্রশ্নটাও যে রয়েছে।

তবে কি সহসা রামকালীর কোন জ্ঞাতির মৃত্যু ঘটেছে? এই বিরাট ভোজের রান্না সব অশৌচান। হয়ে গেছে? সেই সংবাদ পেয়েই রামকালী…। রামকালী কি এমন অর্বাচীন যে এই ভয়ঙ্কর মুহূর্তে সেই তথ্য এসে প্রকাশ করবেন? মৃত্যুসংবাদ কানে না শুনলে তো অশৌচ হয় না, উনি নিজে গা ঢাকা দিয়ে বেড়ালে তো আর এখানের অন্নগুলো অশৌচান্ন হয়ে যেত না? বলে এমন ক্ষেত্রে ঘরের মরা কাঁথা কাথা চাপা দিয়ে রেখে লোকে দিন উদ্ধার করে নেয়।

তবে?

রামকালী যে তার বক্তব্য জ্ঞাপন করতে অনুমতি চেয়েছিলেন, এ কথা কারও মনে ছিল না, ফের চেয়ে সে কথা মনে করিয়ে দিলেন রামকালী।

তা হলে আপনারা আমায় অনুমতি দিচ্ছেন?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, অবশ্য অবশ্য। তোর যা বলবার আছে বল।

তা হলে শুনুন, গতরাত্রে আমার পরিবারভুক্ত একটি বিধবা বধূ গৃহত্যাগ করেছে।

আঁ! অ্যাঁ! আঁ!

সহসা ভয়ঙ্কর একটা ঝড় উঠল। কালবৈশাখির দুমদাম এলোমেলো ঝড় নয়, যেন একটা বুনো অরণ্যের চাপাশ্বাস গোঁ গোঁ করে উঠল। সেই শ্বাস শুধু সমবেত কণ্ঠের ওই আহত বিস্ময়ের প্রচণ্ড ধ্বনি।

রামকালী কি এই বজ্রটাকেই প্রস্তুত করছিলেন এতক্ষণ ধরে তাঁর অভুক্ত ক্ষুধার্ত নিমন্ত্রিত অতিথিদের জন্যে?

তুমুল ঝড়ের ধ্বনিতে রামকালীর কথার শেষ অংশ চাপা পড়ে গিয়েছিল, আর একবার সে স্বর গমগম করে উঠল চাপা মেঘমন্দ্রের মত।

এখন আপনারা স্থির করুন, এই অপরাধে আমাকে ত্যাগ করবেন কিনা?

যেন বক্তৃতা-মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন রামকালী, এমন ধীর-স্থির সমুন্নত সেই মূর্তি!

একে ত্যাগ!

সম্ভব!

কিন্তু তাও হওয়া সম্ভব বৈকি। সমাজ বলে কথা!

নিবারণ চৌধুরীর মামা বেঁটেখাটো বিপিন লাহিড়ী একটা জলচৌকি টেনে এনে তার উপর দাঁড়িয়ে উঠে বিয়ে চিবিয়ে বললেন, ত্যাগ করাকরির কথা নয়, ভবিষ্যতে যা বিচার তা হবে। কিন্তু বর্তমানে আজ তো আর আমাদের এখানে খাওয়া হয় না রামকালী।

রামকালী দুই হাত জোড় করে শান্ত গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, আমি কাউকে অনুরোধের দ্বারা পীড়ন করতে চাই না, তবে এইটুকুই শুধু জানাচ্ছি, আমি সেই মতিভ্রষ্টা মেয়েকে মৃত বলেই গণ্য করব। মানুষের সমাজ থেকে তার মৃত্যু হয়েছে। আহারের পূর্বে এ কথাটি নিবেদন করতে যারপরনরাই দুঃখ বোধ করছি আমি, কিন্তু আমার বিবেকের কাছে এইটাই কর্তব্য বলে মনে হল আমার।

বিপিন লাহিড়ী মনে মনে খুব ভেঙচান, আগে বলাই কর্তব্য ভাবলাম! ওরে আমার যুধিষ্ঠির! এই যজ্ঞির খাওয়াটা পণ্ড করলি? ভাল হবে–তোর ভাল হবে?

চোখে জল এসে যাচ্ছিল বিপিন লাহিড়ীর। তবু কথা বলেন তিনি, আমার মনে হয়, খবরটা তোমার এখন গোপন রাখাই উচিত ছিল রামকালী।

সে আমি ভেবেছিলাম। রামকালী আবার একবার সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে বলেন, কিন্তু পরে মনকে ঠিক করে নিলাম। আমার এত বড় কলঙ্ক সত্ত্বেও যদি আপনারা আমাকে ত্যাগ না করেন, তাহলে পরম ভাগ্য বলে মানব। আর যদি তা করেন, সে শাস্তি মাথা পেতে নেব।

এবার আর ঝড় নয়, গুঞ্জনধ্বনি!

সে ধ্বনি ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠল। তা এতে তোমার আর কলঙ্ক কি?

আছে বৈকি! আমার অন্তঃপুর উচিত মত রক্ষা করবার অক্ষমতাই আমার কলঙ্ক, আমার অপরাধ। মার্জনা আমি চাইব না, এই অপরাধের মার্জনা নেই, শুধু আমার প্রতি আপনাদের স্নেহ ভালবাসার কাছে হাত জোড় করে প্রার্থনা করছি, আপনারা পরে আমার প্রতি যে শাস্তির আদেশ দেন মাথা পেতে নেব, শুধু আজ আপনারা দয়া করে আহার করুন।

আর একবার ঝড় উঠল।

অসন্তোষের? না উল্লাসের?

বোধ করি বা উল্লাসেরই, তবে জলচৌকির উপর দাঁড়িয়ে থাকা বেঁটে-খাটো বিপিন লাহিড়ীর গলাটায় শুধু শোনা গেল, আচ্ছা, আজকের মত তোমার অনুরোধ রক্ষা করাই আমরা স্থির করছি।

রামকালী ধীরে ধীরে সরে গেলেন। মাথা সোজা করেই।

১৫. সকালবেলা নেড়ুকে হাতের লেখা

সকালবেলা নেড়ুকে হাতের লেখা মক্‌শ করতে হয়। পুবের উঠোনের রোদ যতক্ষণ না পেয়ারাতলার ঠিক নিচেটায় এসে পড়বে ততক্ষণ পর্যন্ত নেড়ুকে সেই দুরূহ কর্তব্যটি করেই চলতে হবে, এই নির্দেশ আছে তার উপর। ঋতুভেদে সীমানার কিছু ভেদ হয়, আপাতত ওই পেয়ারাতলা।

অবশ্য তার প্রতি আরও নির্দেশ আছে।

সেটা হচ্ছে তালপাতার গোছাগুলি ও দোয়াত-কলম নিয়ে বসার সময় এবং মকশ’র পর সেগুলি তুলে রাখার সময় ভক্তিভরে মা সরস্বতীকে প্রণাম করা। প্রণাম-মন্ত্রের সঙ্গে প্রার্থনা-মন্ত্রও যুক্ত করা আছে।

দেবীর প্রসন্নতা লাভের উপায় স্বরূপ বিদ্যা অনুশীলনের চাইতে স্তবস্ততি প্রণাম প্রার্থনার উপরই নেড়ুর আস্থা বেশী। কাজেই শব্দবোধের পাতা যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি মুড়ে ফেলে, নিঃশব্দ স্তুতিতেই সময় বেশি যায় তার। চোখটা বুজে রেখেও তেরছা কটাক্ষের কৌশলে পেয়ারাতলার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে পরম ভক্তিভরে মন্ত্রোচ্চারণ করছিল সে পাততাড়িটি কপালে ঠেকিয়ে

ত্বং ত্বং দেবী শুভ্রবর্ণে,
রত্নশোভিত কুণ্ডলকর্ণে।
কণ্ঠে লম্বিত গজমোতিহারে,
দেবী সরস্বতী বর দাও আমারে।
লাগ লাগ বাণী কণ্ঠে লাগ–
যাবজ্জীবন তাবৎ থাক্।
দুষ্ট সরস্বতী দূরে যাক।
আমি থাকি গুরুর বশে,
ত্রিভুবন পূরিত আমার যশে।

দেবী-স্তবের কালে কিন্তু নেড়ু ভাবছিল দেবের কথা। সূর্যদেব।

আশ্চর্য! নিষ্ঠুর সূর্যদেবতাকে এত আন্তরিকভাবে মাতুল সম্বোধন করেও ভাগ্নের প্রতি তার মমতার কোনও প্রকাশ দেখতে পায় না নেড়ু। পেয়ারাতলার নিচেটায় আসার যেন কোনও গরজই নেই তার। অথচ তিনি সামান্য একটু কৃপা-দৃষ্টিপাত করলেই, করা মাত্রই, নেড়ুর আজকের মত যন্ত্রণা শেষ হয়। বার বার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে একই স্তবস্তুতি কতক্ষণ ধরেই বা করা যায়?

তবু কপাল থেকে কলম তালপাতা নড়ায় না নেড়ু, ঠেকিয়েই থাকে, এইমাত্র ঠেকানোর ভঙ্গীতে।

খুব যে বিদ্যে হচ্ছে! আহা মরে যাই, ছেলের কী ভক্তি রে!

সত্যবতীর শানানো গলা বেজে ওঠে।

বুকটা কেঁপে ওঠে নেড়ুর।

উঃ, যা মেয়ে ও! আর যা জেরা! তথাপি বাইরের প্রকাশে সত্যকে কোন স্বীকৃতি দেয় না নেড়ু,–একই ভাবে চোখ বুজে বিড়বিড় করতে থাকে।

সত্যবতী হি-হি করে হেসে ওকে একটা ঠেলা দিয়ে বলে, এখন যে বড় চোখ বোজা হচ্ছে? এতক্ষণ কি করছিলি? হুঁ বাবা, খালি চোখ পিটপিট আর পেয়ারাতলার দিকে তাকাসনি!

আঃ সত্য! নেড়ু এবার পাতা কলম কপাল থেকে নামিয়ে সযত্নে জলচৌকির উপর স্থাপিত করে বিরক্তি-ব্যঞ্জক গম্ভীর স্বরে বলে, নমস্কারের সময় গোলমাল করছিস কেন?

নমস্কার তো তুই সকাল থেকেই করছিস! এক পোর বেলা হয়ে গেল সেই এস্তক নমস্কারই হচ্ছে! দেখি নি যেন!

ইঃ, দেখেছিস তুই! নেড়ু উঠোনের দিকে তাকিয়ে দেখে। মনে হচ্ছে যেন মাতুল সূর্যদেব এতক্ষণে সদয় হয়েছেন, পেয়ারাতলার ঠিক নিচেটাতে কৃপাকটাক্ষ করছেন। অতএব বুকের বল বাড়ে তার। দৃপ্তকণ্ঠে বলে, কত মক্শ করলাম তখন থেকে!

কই দেখি কত! বলেই সত্য একটা কাজ করে বসে। হাতটা একবার মাথায় মুছে নিয়ে চট করে মা সরস্বতীর উদ্দেশে একটা প্রণাম নিবেদন করে নেড়ুর এইমাত্র রক্ষিত তালপাতার গোছায় এক টান মারে।

অ্যাই অ্যাই, ও কী হচ্ছে! শিহরিত নেড়ু ভয়ঙ্কর একটা ভয়ের সুরে বলে ওঠে, সত্য? তুই তালপাতায় হাত দিলি?

দিলাম তা কি! নির্ভীক স্বর সত্যর, আমি তো মা সরস্বতীকে পেন্নাম করে হাত দিয়েছি।

পেন্নাম করলেই সব হল? তুই না মেয়েমানুষ? মেয়েমানুষের তালপাতায় হাত ঠেকলে কি . জানিস না?

সত্য ইতিমধ্যে নেড়ুর সারা সকালের শ্রমফল নিরীক্ষণ শুরু করে দিয়েছে। বলা বাহুল্য খানি মাত্র পাতা কালি-কলঙ্কিত, বাকী সবগুলিই নিষ্কলুষ নিষ্কলঙ্ক। কাজেই আর একবার হি হি-র পালা।

খুব যে বলছিলি অনেক মকুশ করেছিস? কই কোথায়? দোয়াতে বুঝি কালির বদলি জল ভরেছিস? তাই চোখে ঠাহর হচ্ছে না?

সত্যর বিদ্রপের ভঙ্গী বড় তীক্ষ্ণ, কারণ উক্ত মন্তব্যের সঙ্গে সঙ্গে চোখের তারা পাতার যতটা সম্ভব কাছে নিয়ে এসেছে সে, মুখে কৌতুকের আলোর ঝলমলানি।

এটা সহ্য করা শক্ত।

নেড়ু এক হ্যাঁচকায় নিজ সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে ক্রুদ্ধকণ্ঠে বলে, বেশ থাক্। আমার বিদ্যে না হোক তোর কি? নিজের কি হয় দেখ। বলে দিচ্ছি গিয়ে সবাইকে, তালপাতে হাত দিয়েছিস তুই।

আর কেউ হলে সবাইকে বলে দেওয়ার ভীত-প্রদর্শনেই কাবু হয়ে পড়ে এবং আপসের সুরে আচ্ছা বেশ ভাই দেখলাম! ইত্যাদি অভিমানসূচক বাণী উচ্চারণ করে শত্রুপক্ষের মন নরম করে থাকে। কিন্তু সত্যর মনোভাব আপসহীন। তাই ভিতরে যাই হোক, বাইরে বিন্দুমাত্র বিচলিত ভাব দেখায় না সে, সমান জোরের সঙ্গেই বলে, বলে দিবি তো দিবি, সবাই আমার কি করবে শুনি? শূলে দেব?

দেয় কিনা দেখিস! চালাকি নয়!

কেন, মেয়েমানুষ তালপাতে হাত দিলে কি হয়? কলকেতায় তো কত মেয়েমানুষ লেখাপড়া করে।

তোকে বলেছে করে! পড়লে চোখ কানা হয়ে যায় তা জানিস?

কক্ষনো না, মিছে কথা! বড্ডই তুই জানিস! যারা পড়ছে তারা সব অমনি কানা হয়ে যাচ্ছে।

কলকেতা নামক অ-দৃষ্ট সেই দেশটায়, কদাচ কখনও যেখানের নাম কানে আসে, সেখানে সত্যিই কোনও মেয়েমানুষ লেখাপড়া করে কিনা এবং করলে তাদের চক্ষুযুগলকে দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন রাখতে পারে কিনা, এ সম্পর্কে নেড়ুর স্পষ্ট কিছু জানা নেই, তবু নিজের অভিমতকে প্রতিষ্ঠিত করতে প্রাণপণ চেষ্টা করে সে, এখন না যাক–আসছে জন্মে যাবে। অমনি না!

আসছে জন্মে। হি-হি-হি! তাদের আসছে জন্মটা তুই দেখে এসেছিস বুঝি? আমি এই তোকে বলে দিচ্ছি নেড়ু, ওসব কিছু হয় না। বিদ্যে তো ভাল কাজ, করলে কখনও পাপ হতে পারে?

লেখাপড়ার ব্যাপারে বুদ্ধি না খুললেও কূটতর্কের ব্যাপারে নেড়ু ওস্তাদ, তাই সে অকাট্য একটি যুক্তি প্রয়োগ করে, নারায়ন-পুজোও তো ভাল কাজ, করে মেয়েমানুষেরা? ছুঁতে তো পায় না। ভগবান বলে দিয়েছে ভালো কাজগুলো বেটাছেলেরা করবে, খারাপ কাজগুলো মেয়েমানুষরা করবে, বুঝলি?

হ্যাঁ, বলেছে ভগবান তোর কান ধরে! ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে সত্য, ভগবান কখনো অমন একচোখা নয়। ওসব বেটাছেলেরাই ছিষ্টি করেছে।

বচসার শব্দ খুব মৃদু হচ্ছিল না, শব্দে আকৃষ্ট হয়ে পুণ্যি এসে দাঁড়ায় এবং সকৌতূহলে প্রশ্ন করে, কি ছিষ্টি করেছে রে বেটাছেলেরা?

সত্য মুহূর্তে অনুত্তেজিত ভাব পরিগ্রহ করে বলে, কিছু না, শাস্তরের কথা হচ্ছে।

শাস্তর!

পুণ্যি হালে পানি পায় না।

সহসা এখানে শাস্ত্রালোচনা শুরু হল কী বাবদ, সেটা অনুধাবন করতে চেষ্টা করে। ইত্যবসরে নেড়ু সেই বলে দেওয়ার সুরে বলে ওঠে, সত্যর সাহসখানা শুনবি পুণ্যিপিসী? তালপাতে হাত দিয়েছে, আবার বলছে দিয়েছি তো হয়েছে কি!

তালপাতে হাত!

এটা আবার আর এক আকস্মিকতা। তালপাতাটা কি জাতীয় সহসা সেটা হৃদয়ঙ্গম করতে পারে পুণ্যবতী।

তালপাতা কি রে? প্রশ্ন করে সত্যর মুখের দিকে তাকিয়ে।

তাকে হাঁ করে দিয়ে সত্য হেসে উঠে দেওয়ালে পোঁতা পেরেক গোঁজা একখানা তালপাতার হাতপাখা পেড়ে নিয়ে বলে ওঠে, এই যে এই! দেখ, এখন হাতে পোকা পড়ল কিনা আমার!

সত্য! নেড়ু চোখ পাকিয়ে বলে, মা সরস্বতীকে নিয়ে তামাশা করছিস তুই?

প্রত্যেক সময় প্রত্যেক ব্যাপারেই সত্য জিতে যায়, নেড়ু হারে। নেড়ুর মজ্জায় অবস্থিত পৌরুষবোধ এতে যথেষ্টই আহত হয়, আজ সহসা সত্যকে শাসন করবার একটা ছুতো পেয়ে নেড়ুর আর উল্লাসের সীমা নেই। তাই সহসা করতলগত সেই শক্তিটাকে অবহেলায় বাজে খরচ করে ফেলতে পারছে না, রীতিমত করে ভাঙিয়ে খেতে চাইছে চেখে চেখে।

এবার আর হাসে না সত্য, বিরক্তি প্রকাশ করে, সেই ওর অভ্যস্ত ভঙ্গীতে জোড়াভুরু কুঁচকে, হাঁদার মতন কথা কস নে নেড়ু। তামাশা আমি মা সরস্বতীকে করছি না, করছি তোকে। তালপাতে একটু হাত দিয়েছি তো কী কাণ্ডই করছি। যেন সগৃগো মত্য রসাতলে গেছে! শুধু হাত দেওয়া কেন, আমি তো লিখতেও পারি।

লিখতেও পারিস!

যুগপৎ নারী-পুরুষ দুই কণ্ঠে উচ্চারিত হয় এই সর্পাহত-কণ্ঠবৎ শব্দ। আড়ষ্ট হয়ে গেছে পুণ্যি আর নেড়ু।

কিন্তু নিষ্ঠুর সত্য ওদের এই আঘাতপ্রাপ্ত চিত্তেই আরও আঘাত হেনে বসে, পারিই তো, এই দেখ।

ঝপ করে আলোচ্য তালপত্রখণ্ডের একখানা টেনে নিয়ে দোয়াতে কলম ডুবিয়ে পরিপাটি করে লিখে ফেলে সত্য, কর খল ঘট। লিখে অদৃশ্যের উদ্দেশ্যে আর একটা প্রণাম ঠুকে বলে, আরও কত লিখতে পারি?

বিস্ময়ের ঘোর কাটতে কিছুক্ষণ লাগে। পুণ্যির চাইতে নেড়ুই বেশী বিস্ময়াহত। যে দুরূহ কর্মের চেষ্টায় তার ঘাম ছুটে যায়, এত অনায়াসলীলায় সেটা করে ফেলে সত্য!

তাছাড়া কেমন করে?

মা সরস্বতী কি সহসা ওর উপর ভর করেছেন? যেমন নাকি শুনতে পাওয়া যায় কবি কালিদাসের উপর করেছিলেন?

লেখা শব্দ কটির উপর চোখ রেখে ঝিম হয়ে তাকিয়ে থাকে নেড়ু। আর পুণ্যি স্পর্শ বাচিয়ে তালপাতাখানার উপর ঝুঁকে পড়ে বিস্ফারিত নেত্রে বলে, কোথ থেকে শিখলি রে সত্য? কে শেখালে?

শেখাতে আবার কার দায় পড়েছে, আমি নিজে নিজেই শিখেছি! দেখে দেখে!

নিজে নিজেই শিখেছিস? দেখে দেখে?

না তো কি?

দো’ত কলম পেলি কোথা?

দো’ত কলম কে দিচ্ছে! সত্য ঝোঁকের মাথায় তার গোপন কথাটি প্রকাশ করে বসে, বটপাতার ঠুলি গড়ে, তার মধ্যে পুঁইমেটুলির রস গুলে কালির মতন করি।

তাজ্জব বনে যাওয়া দুটি প্রাণী ক্ষীণকণ্ঠে বলে, আর পাত কলম?

তোরা আর হাঁ-করা কথা কস নে বাপু। পৃথিবীর তালগাছ কি কেউ সিঁদুকে বন্ধ করে খেছে, না আকিঞ্চন করে খুঁজলে একটা শরকাঠি মেলে না?

গিন্নীর মতন মুখ করে ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে সত্য।

এতক্ষণে বুঝি হদিস পায় পুণ্যি। তা সেও গিন্নীদের মত গালে হাত দিয়ে বলে, তাহলে তুই শুকিয়ে মশ করিস? উঃ ধন্যি বাবা! কাউকে টেরই পেতে দিস না? কখন হাত পাকাস?

সত্য রহস্যের হাসিতে মুখ রঞ্জিত করে বলে, যখন তোরা থাকিস না।

কিন্তু সত্য! পুণ্যি চিন্তিত স্বরে বলে, খেয়াল করে তো করছিস, দেখে আহ্লাদও হচ্ছে, কিন্তু হাজার হোক মেয়েমানুষ, এতে তোর পাপ হবে না?

কেন, পাপ হবে কেন? সত্য সহসা উদ্দীপ্ত তেজের সঙ্গে বলে ওঠে, মেয়েমানুষরা যে রাতদিন ঝগড়া কেদল করছে, যাকে তাকে গালমন্দ শাপমন্যি করছে, তাতে পাপ হয় না, আর বিদ্যে শিখলে পাপ হবে? বলি স্বয়ং মা সরস্বতী নিজে মেয়েমানুষ নয়? সকল শাস্তরের সার শাস্তর চার বেদ মা সরস্বতীর হাতে থাকে না?

নেড়ুর আর বাক্যস্ফুর্তি নেই।

এত বড় অকাট্য যুক্তির সামনে পড়ে গিয়ে যেন বিরাট একটা দৃষ্টির দরজা খুলে যায় তার চোখের সামনে।

সত্যিই তো বটে, মা সরস্বতীটি স্বয়ং নিজেই তো মেয়েমানুষ।

এতবড় স্পষ্ট সত্য কি করে এত দিন তার দৃষ্টির বাইরে ছিল? আর এই সত্যবতীটাই বা কেমন করে উদঘাটন করে ফেলেছে সেই সবাইয়ের ভুলে থাকা, অথচ পরম স্পষ্ট কথাটাকে।

নে পুণ্যি, ঘাটে যাই চ।

আলোচনায় ইতি টেনে দিয়ে উঠে পড়ে সত্যবতী, আর দেরি করলে গিন্নীরা ভাত গেলবার জন্যে হাক পাড়বে, ভাল করে চানই হবে না।

কথাটা মিথ্যা নয়, জলে পড়লে সহজে আশ মিটতে চায় না এদের। সাঁতার দিতে দিতে হাঁপিয়ে না পড়া পর্যন্ত ভাল করে চান হয় না।

চ, বলে উঠে পড়ে পুণ্যি, কিন্তু নেড়ুর সঙ্গে চোখে চোখে একটা ইশারা হয়ে যায় তার।

কিন্তু না, অসদভিপ্রায় ছিল না তাদের, বলে দেওয়ার মনোভাবও ছিল না আর। সত্যর কিন্তু প্রকাশ করে সকলকে চমৎকৃত করে দেওয়াই উদ্দেশ্য ছিল।

সত্য যে তাদেরই একজন।

সত্যর মহিমায় তো তাদেরই মহিমা!

.

কিন্তু সদভিপায়ের ফল কি সব সময় সুস্বাদু হয়?

হয় না।

হয় না, সেটাই আর একবার প্রমাণিত হয়ে গেল নেড়ুর সত্যোদঘাটনে।

হুলুস্থুল পড়ে গেল অন্দর-বাড়িতে।

প্রচ্ছন্নে বইতে লাগল রামকালীর মেয়েকে আশকারা দেওয়ার সমালোচনা আর প্রত্যক্ষে ছিছিক্কার পড়তে লাগল সত্যর বুকের পাটার!

ও কি ভেবেছে শ্বশুরঘর করতে হবে না ওকে?

করতে হবেও না, শিবজায়া তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলেন, শ্বশুররা টের পেলে উদ্দিশে হাতজোড় করে ত্যাগ করবে ও বৌকে।

মোক্ষদা বলেন, হারামজাদী যখনই জটার নামে ছড়া বেঁধেছিল, তখনই সন্দ হয়েছিল আমার। এখন বুঝছি।

রাসুর মা কোনদিনই কোন কথায় বড় থাকে না, কাজের পাহাড় নিয়েই কাটায় সারা দিন, কিন্তু আজকের অপরাধের আবিষ্কর্তা নাকি স্বয়ং তারই পুত্ররত্ন, তাই বোধ করি কিছুটা দাবি অনুভব করে কথা বলার।

আস্তে আস্তে বলে, একে তো ঘরের একটা বৌ, যা নয় তাই কেলেঙ্কারি করে গালে-মুখে চুনকালি দিয়ে জন্মের শোধ লোকের কাছে হেয় করে রেখে গেল, আবার ঘরের মেয়েরাও যদি যা ইচ্ছে তাই করতে থাকে-

কথা শেষ করে না রাসুর মা, শুধু দুটো পাতকই যে একই গর্হিতের পর্যায়ে পড়ে সেইটুকুরই ইশারা দেয়।

কাঠ হয়ে তাকিয়ে থাকে ভবনেশ্বরী।

শুধু কাশীশ্বরীই নীরব। তাঁর আর মুখ নেই।

সমালোচনার উদ্দমতা কিছুটা স্তিমিত হলে দীনতারিণী প্রায় মিনতির ভঙ্গীতে বলেন, যাক গে বাবা, এই নিয়ে আর বেশী কথাকথিতে কাজ নেই সেজঠাকুরঝি। প্রবাদে বলে, কথা কানে হাঁটে। কোন্ সূত্রে কার দ্বারা চালিত হয়ে কুটুমবাড়ির কানে উঠবে, হয়ত সেই নিয়ে কি বিপত্তি বাধবে কে বলতে পারে! একে তো

দীনতারিণীও কথায় একটা অকল্পিত সম্ভাবনা উহ্য রেখে টেনে ছেড়ে দেন। কাশীশ্বরীর সামনে আর শঙ্করীর কথা স্পষ্ট করে তোলেন না।

তবু মোক্ষদা উচ্চ চীৎকারে ভবিষ্যদ্বাণী করতে ছাড়েন না, সে তুমি যতই সাবধান হও বড়বৌ, আমি এই আগবাড়িয়ে বলে দিচ্ছি, ও মেয়ের কপালে অশেষ দুঃখ আছে। আজ নয় তুমি আমি চেপে গেলাম, কিন্তু ওকে নিয়ে যারা ঘর করবে, তাদের কি আর গুণ বুঝতে বাকী থাকবে? হবে না তো কি, বাপে শাসন না করলে কি আর বেয়াড়া মেয়ে-ছেলে শায়েস্তা হয়?

দীনতারিণী অকূলের কূল হিসেবে মিয়মাণভাবে বলেন, তা তুমি না হয় রামকালীকে বুঝিয়ে বলো?

রক্ষে করো বড়বৌ। আমি আর হেয় হতে চাই না। আমি লাগাতে যাব, আর তিনি মেয়েকে শাসন তো দূরের কথা, উলটে আরও আশকারা দেবেন।

অগত্যাই দিশেহারা দীনতারিণী ভুবনেশ্বরীর প্রতিই দৃষ্টিক্ষেপণ করেন, তা তুমিও তো সময়ান্তরে যখন তার মনমেজাজ ঠাণ্ডা দেখবে, একটু বুঝিয়ে বলতে পার মেজবৌমা? সত্যি যে মেয়ে তোমার স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছে। পরের ঘরে পাঠাতে তো হবে?

ভুবনেশ্বরী অবশ্য এ কথার কোন উত্তর দেয় না। দেওয়া সম্ভব নয় তার পক্ষে। যদিও তার মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে, তবু গুরুজনের সমক্ষে স্বামী সম্পর্কে উল্লেখই যে যারপরনাই লজ্জাজনক। ভুবনেশ্বরী যে রামকালীর সঙ্গে কথা কয়, এত বড় লজ্জার কথাটা শাশুড়ী এই লোকসমাজে প্রকাশই বা করে বসলেন কেন? ছি ছি!

লজ্জা প্রতিকারের আর কিছু না দেখে মাথার ঘোমটাটাই আর খানিকটা বাড়িয়ে দিয়ে মাথা হেঁট করে ভুবনেশ্বরী।

তা মাথাটা আর ভুবনেশ্বরী উঁচু করতে পায় কখন?

স্বামীকেও যে তার বড় ভয়।

তবু বড়ই চিন্তাগ্রস্ত হচ্ছে সে মেয়ের ভবিষ্যৎ ভেবে। অহরহ সকলেই যে বলছে–ও মেয়ে শ্বশুরঘর করতে পারবে না।

.

আসামী এক, বিচারকও এক, শুধু কাঠগড়া আর অভিযোক্তা আলাদা।

তবে আসামীকে প্রথমেই হাজির করে না ভুবনেশ্বরী, তাকে শাসিয়ে রেখে এসে, অনেক কৌশলে ভয়ানক একটা দুঃসাহসিক চেষ্টায় দিনের বেলা একবার স্বামীর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ করে ফেলে সে। রামকালী যখন মধ্যাহ্ন-বিশ্রাম করছেন, সে সময় কাছে এসে ঘোমটা দিয়ে দাঁড়ায়।

রামকালী ঈষৎ আশ্চর্য হয়ে বলেন, কিছু বলবে?

স্বামীর স্নেহকোমল সুরে সহসা চোখে জল এসে যায় ভুবনেশ্বরীর, উত্তর দিতে পারে না, শুধু ঘোমটাটা একটু কমায়।

কি হল? রামকালী মৃদু কৌতুকে বলেন, বাপের বাড়ি যেতে ইচ্ছে হচ্ছে?

না। ভুবনেশ্বরী মাথা নেড়ে বাষ্পরুদ্ধ স্বরে বলে, বলছি সত্যর কথা।

সত্যর কথা! কেন? আর একটু হাসেন রামকালী, আবার কি মহা অপরাধ করে বসল সে?

করছে তো সব সময়। অভিমানের আবেগে কথায় জোর আসে ভুবনেশ্বরীর, তুমি তো সবই হেসে ওড়াও। কথা শুনতে হয় আমাকেই।

বাজে কথা গায়ে মাখতে নেই মেজবৌ।

বাজে? মেয়ে কি করেছে শুনলে আর

কি করেছে?

লিখেছে।

লিখেছে! লিখেছে কি?

তা জানি না। নেড়ুর তালপাতে কি সব বইয়ের কথা লিখেছে। আবার নাকি আস্পদ্দা করে বলেছে, আরও অনেক লিখতে পারে। বুকের পাটা কত, বাগান থেকে তালপাতা কুড়িয়ে শরকাঠি যোগাড় করে পুইমেটুলির রস দিয়ে লেখা শিখেছে!

এর পর রামকালী চমকৃত না হয়ে পারেন না। বলেন, তাই নাকি? গুরুমশাইটি কে? নেড়ুই নাকি?

নেড়ু? নেড়ু বলেছে সাতজন্ম চেষ্টা করলেও নাকি অমন হরফ সে লিখতে পারবে না!

বটে! কই তাকে একবার ডাক তো দেখি? আসামী পাশের ঘরেই অবস্থান করছে, ভুবনেশ্বরী তাকে চোখ রাঙিয়ে বসিয়ে রেখে এসেছে।

স্বামীকে যে খুব বেশী দুশ্চিন্তিত করতে পেরেছে ভুবনেশ্বরীর এমন ভরসা হয় না, শাস্তির মাত্রা কি আর তেমন গুরু হবে? অথচ লঘু শাস্তিতে কাজ হবে বলে মনে হয় না, কারণ সত্যর ভাব যথারীতি অনমনীয়। তাই স্বামীকে একটু তাতিয়ে তোলবার আশায় বলে, ডাকছি, বেশ ভাল করে শাসন করে দিও। শুধু যে আস্পদ্দার কাজ করেছ তাও তো নয়, আলাত পালাত কত সব তক্ক রেছে। কলকাতায় নাকি অনেক মেয়েমানুষ আজকাল লেখাপড়া শিখছে, তাদের তো কই চোখ না হচ্ছে না, বিদ্যের দেবী মা সরস্বতীই তো নিজে মেয়েমানুষ, এই সব বাচালতা। তুমি একটু উচিত শিক্ষা দিয়ে বকবে মেয়েকে, বুঝলে?

শেষাংশে মিনতি ঝরে পড়ে ভুবনেশ্বরীর কণ্ঠে।

সরে গিয়ে পাশের ঘর থেকে ইশারায় ডাকে মেয়েকে। স্বামীর সামনে তো আর গলা খুলতে পারে না।

.

সত্য এসে হেঁটমুণ্ডে দাঁড়ায়।

কাঠগড়ায় এসে দাঁড়াবার সময় এটাই পদ্ধতি সত্যর। উত্তরদানকালে মুখ তোলে।

রামকালী প্রথমটায় একটুও অন্তত ধমকে দেবেন এ আশা ছিল ভুবনেশ্বরীর, কিন্তু তিনি তাকে হতাশ করলেন। ভাবলেশশূন্য কণ্ঠে সহজভাবে বললেন, তুমি নাকি লিখতে শিখেছ?

মুখটা অবশ্য একটু পাংশু হল সত্যবতীর।

কই, কি লিখেছ দেখি?

অস্ফুটে যা উত্তর দেয় সত্য তার অর্থ এই–অপরাধের পর আর সেই অপরাধের চিহ্ন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়। নেড়ু জানে।

আচ্ছা ঠিক আছে। আবার লিখতে পার?

সত্যবতী মুখ তুলে তাকায়।

কই বাপের চোখে তো রুদ্ররোষের চিহ্ন নেই। তবে বোধ হয় তেমন রাগ করেন নি। তাই জবাবে সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ে সত্য।

আচ্ছা কই, লেখো দিকি।

হাত বাড়িয়ে চৌকির পাশে অবস্থিত জলচৌকিতে রক্ষিত দোয়াত কলম ও খসখসে একখানা বালির কাগজ টেনে নেন রামকালী, বলেন, লেখো–যা শিখেছ লেখো।

এ কী! এ যে হিতে বিপরীত!

ধমক চুলোয় যাক, মেয়ের হাতে আবার কাগজ কলম তুলে দিচ্ছেন রামকালী! নাটকের শেষ দৃশ্যের জন্যে?

অবশ্য এমনও হতে পারে, যাচাই করে দেখছেন নেড়ুর কথার সত্যতা।

সত্যি, আগাগোড়া ব্যাপারে নেড়ুর চালাকি হতে পারে।

কিন্তু তাই কি? হতচ্ছাড়া মেয়ে তো অস্বীকারও করছে না।

ততক্ষণে সত্য ঘাড় গুঁজে দু-তিনটি শব্দ লিখে ফেলেছে। অবশ্য তালপাতার নিয়মে অধিক জোর প্রয়োগে কাগজগাত্রে সামান্য সামান্য ক্ষতের সৃষ্ট হল, কিন্তু লেখা হল।

রামকালী সেটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারকয়েক দেখে কোনও মন্তব্য না করে শান্তভাবে বলেন, কলকাতায় অনেক মেয়ে লেখাপড়া করছে, এ কথা তোমায় কে বললে?

ছোটমামী।

তাই নাকি? তিনি কোথা থেকে–ও তিনি যে কলকাতারই মেয়ে! তাই না?

এ উদ্দেশটা ভুবনেশ্বরীকে। কিন্তু ভুবনেশ্বরী তো আর কত বড় মেয়ের সামনে গলা খুলে কথা বলতে পারে না, ঘাড় কাত করে সায় দেয়।

তা তিনি জানেন লেখাপড়া? তোমার মামী?

একটু একটু জানেন। বেশি করে কবে আর শিখতে পেল বেচারা? শুধু বলছিল, একজন মেম নাকি দেশী ইস্কুল খুলেছে, আর একজন সায়েব বিলিতী ইস্কুল খুলে দিয়েছে, কলকাতার মেয়েরা আর মুখ্যু থাকবে না।

মেয়েদের লেখাপড়া শিখে লাভ কি? তারা কি নায়েব গোমস্তা হবে? সকৌতুক হাস্যে মেয়েকে প্রশ্ন করেন রামকালী।

এবার সত্যবতীর তেজের পালা। সব সইতে পারে সে, সইতে পারে না ব্যঙ্গ।

নায়েব গোমস্তা হতে যাবে কেন? লেখাপড়া শিখে নিজে নিজে রামায়ণ মহাভারত পুরাণ বই টই পড়তে পারে তো? কবে কথকঠাকুর কোথায় পড়বেন বলে অপিক্ষে করে থাকতে হয় না।

মেয়ের এই ক্রুদ্ধমূর্তি আর সগর্ব উক্তি কি রামকালীর খুশির খোরাক হয়? তাই আরও একটু উত্তপ্ত করতে চান তাকে?

তা মেয়েমানুষের এত বেদপুরাণ জানবার দরকারই বা কি?

এবার সত্যবতী স্থান পাত্র বিস্মৃত হয়ে নিজ মূর্তি ধরে, এত যদি না দরকারের কথা তো মেয়েমানুষের জন্মাবারই বা দরকার কি, তাই বল তো বাবা শুনি একবার?

মেয়ের এই দুঃসাহসে ভুবনেশ্বরীর বুক থরথর করে, অত বড় মানুষটার মুখে মুখে এতখানি চোপা!

হবে না, হবে না–এ মেয়ের ককখনো শ্বশুরবাড়ি ঘর করা হবে না।

কিন্তু ভুবনেশ্বরীকে চমকে দিয়ে সহসা হেসে ওঠেন রামকালী, বেশ সশব্দেই।

তার পর মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলেন, তুমি লেখাপড়া শিখতে চাও?

চাই তো, পাচ্ছি কোথায়?

ধরো যদি পাও?

তা হলে রাতদিন লেখাপড়া করব।

অতটা করতে হবে না। নিয়ম করে কিছুক্ষণ পড়লেই হবে। কাল থেকে দুপুরবেলা এই সময় আমার কাছে পড়বে।

পড়বে!

ভুবনেশ্বরী আর কথা না বলে পারে না।

হ্যাঁ, পড়বে লিখবে! পুঁইমেটুলির কালি দিয়ে নয়, সত্যিকার দোয়াত কলমই দেব ওকে।

বাবা!

সত্যর মুখ দিয়ে মাত্র এই দুটি অক্ষর সম্বলিত শব্দটা বেরোয়। আর ভুবনেশ্বরীর দু চোখে শ্রাবণ নামে।

১৬. বসেছে কাব্যপাঠের আসর

বসেছে কাব্যপাঠের আসর।

ঋতুরঙ্গ কাব্য। বর্ষাখণ্ড শেষ করে প্রকৃতিদেবী সবেমাত্র শরৎখণ্ডের মলাটখানি খুলে ধরেছেন, এখনও তার ভিতরের শ্লোক পড়তে বাকী এখনও কাশের বনে বনে শুরু হয় নি শ্বেতচামরের ব্যজনারতি, শুধু ভোরের বাতাসে লেগেছে অকারণ পুলকের স্পন্দন। শুধু আকাশের নীলে দর্পনের স্বচ্ছতা, পাখীদের শিষে উল্লাসের তীক্ষ্ণতা। দেবী অনন্তকাল ধরে একই কাব্য আবৃত্তি করে চলেছেন, শেষ লাইনের পরই আবার গোড়ার লাইন, তবু সে কাব্য পুরনো হয়ে যায় নি, পুরনো হয়ে যায় না। অনন্তকালের মানুষের কাছে বয়ে নিয়ে আসে আশার বাণী, প্রত্যাশার স্বপ্ন, উৎসাহের সুর।

উৎসাহের জোয়ার লেগেছে বাংলার গ্রামে গ্রামে। প্রতীক্ষার উৎসাহ।

মা দুর্গা আসছেন!

আসছেন বাপের বাড়ি। কৈলাস থেকে মর্ত্যলোকে। এ কথা গল্পকথা নয়, বাংলার অন্তরের সত্য বিশ্বাসের কথা। বৎসরান্তে মা মাতৃরূপে আর কন্যারূপের সমন্বয় সাধন করে নেমে আসেন মাটি-মায়ের কোলে, এসে মায়ের কাছে সুখদুঃখের কথা কন, বিদায়কালে চোখের জল ফেলেন, এ কথা কি অবিশ্বাসের? দেবতার সঙ্গে আত্মীয়তার বন্ধন পাতিয়ে, দেবতাকে ঘরের লোক করে নিয়েই তো বাঙ্গালির ঘরকনা। তাই তারা শিবের বিয়ে দেয়, ইতু-মনসার ‘সাধ’ দেয়, ভাদুকে সোহাগ করে আর পার্বতাঁকে পতিগৃহে পাঠাতে চোখের জলে বুক ভাসায়। আর সবাই তবু দেবদেবী, উমা যে সেই ঘরের মেয়ে। মহিমায় তার সহস্র নাম থাক, আসল নাম যে সেই উমা নামটি। শরৎ পড়তেই ভিখারী বৈষ্ণবরা সেই কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে যায় খঞ্জনীর তালে তালে। আয় মা উমাশশী, নিরখি মুখশশী, দিবানিশি আছি আসার আশায়।

হয়তো একটি গ্রামে একটি মাত্র ভাগ্যবানের বাড়িতেই কন্যারূপিণী জগন্মাতার পদার্পণ ঘটবে, কিন্তু গ্রামের প্রতিটি ঘরের অন্তরবীণায় বাজছে আগমনীর সুর।

এবারে আশ্বিনের প্রথম দিকেই পূজো, তাই ভাদ্র পড়তে পড়তেই সাজ সাজ রব। সংসারের নিত্য রান্না খাওয়া বাদে অন্য সব কিছুতেই যে করা চাই মাসখানেকের মত আয়োজন। পূজোর মাসে তো আর কেউ মুড়ি ভাজবে না, চিড়ে কুটবে না, মুড়কি মাখবে না, পক্কান্ন রাঁধবে না, মেটে ঘরের দেয়াল নিকোবে না? এমন কি সলতে পাকানো, সুপুরি কাটা, নারকেলকাঠি চাছা, সবই সেরে রাখতে হবে দেবীপক্ষ পড়ার আগে। কোজাগরীর পর আবার এসব কাজে হাত, আবার কথায় ফোড় তোলা, আর তার সঙ্গে সদ্য-বিগত উৎসবের স্মৃতি রোমন্থন।

ভাদ্র মাসে শুধু যে আগমনীর প্রস্তুতি তাও তো নয়, বর্ষার পর যে অনেক কাজ এসে জোটে গেরস্তর মেয়েদের। স্যাঁৎসেঁতে বিছানা কথা, তোরঙ্গে তোলা কাপড় চাঁদর, ভাঁড়ারের সচ্ছরের মজুত বড়ি আচার, মশলাপাতি, ডাল কড়াই,–সব কিছুকে টেনে ভাদুরে রোদ খাওয়ানো তো কম কাজ নয়।

ভুবনেশ্বরীর মা নেই, ভাজেরাই সংসারের গিন্নী, কদিন থেকে দুপুরভোর এই কর্মকাণ্ড নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে তারা। আজ পড়েছে নাড় দিয়ে। হাঁড়িভর্তি মুগের নাড়ু, নারকেলের নাড় করে মাচায় তুলে রাখতে পারলে মাসখানেকের মত জলপানের দায়ে নিশ্চিন্দি। আর পূজোর মাসে ছেলেপুলের পাতে দুটো ভালমন্দ দিতেও হয়। ভুবনেশ্বরীর বড় ভাজ নিভাননী জোর হাতে নারকেল কুরছিল আর ছোট ভাজ সুকুমারী আঁতা ঘুরিয়ে মুগ ভাঙছিল, হঠাৎ উঠোনের দরজার শিকল নড়ে উঠল।

এই দেখ কাজের গুরু কামাই, নিভাননী নিচু গলায় বলে,কে আবার এখন বেড়াতে এল কাজ পণ্ড করতে! নে ছোট বৌ, ওঠ, দুয়োর খোল্।

সুকুমারীর অবশ্য মনোভাবটা ঠিক বড় জায়ের সমর্থক নয়, একঘেয়ে কাজ করতে করতে বাইরের হাওয়া একটু ভালই লাগে তার। নিভাননী যদি একটু গল্প-গাছা করতে জানে, মুখ বুজে খালি কাজ আর কাজ।

দরজা খুলেই সুকুমারী উল্লাসধ্বনি করে ওঠে, ওমা কি আশ্চর্য, পুবের সূয্যি কি পশ্চিমে উঠেছে আজ, না যার মুখ কখনও দেখি নি তার মুখ দেখে ঘুম থেকে উঠেছি?

এ হেন সংলাপে নিভাননীরও ব্যাজার মুখ কৌতূহলে সরস হয়, সে মুখ বাড়িয়ে বলে, কে এলো গো, কার সঙ্গে এত রসের কথা?

এই যে ডুমুরের ফুল, ঠাকুরঝি। বলে সুকুমারী তাড়াতাড়ি ননদের পা ধোবার জল আনতে ছোটে। ভুবনেশ্বরী মুখের ঘোমটা নামিয়ে দাওয়ায় বসে পড়ে ধুলো পা ঝুলিয়ে। ভাদ্দরের কড়া রোদে তার ফর্সা মুখটা লাল-টকটকে হয়ে উঠেছে, ঘোমটা দেওয়ার দরুন চুলের গোড়ায় আর গলার খাঁজে ঘাম গড়াচ্ছে।

এমন করে ভররোদে হেঁটে আসা ভুবনেশ্বরীর পক্ষে সত্যিই অভাবনীয় ঘটনা। একে তো আসাই তার কম, তাছাড়া যদি আসার বাসনা প্রকাশ করে, পাকি করে পাঠিয়ে দেন রামকালী। যদিও এর জন্যে বাড়ির আর পাঁচজন ঠেস্-টিটকারি দিতে ছাড়ে না, পাড়ার সমবয়সী বৌরা বলে ‘বাদশার বেগম’, তবু রামকালীর নির্দেশ মেনে চলতেই হয়।

কিন্তু আজ ব্যাপারটা কি?

পা ধোবার জল আর গামছা এগিয়ে দিয়ে একখানা ঝালর-বসানো হাতপাখা নিয়ে ননদকে বাতাস করতে থাকে সুকুমারী। একে তো গুরুজন, তায় আবার বড়লোকের ঘরনী।

কার সঙ্গে এলে? নিভাননী প্রশ্ন করে।

ভুবনেশ্বরী কিন্তু সে কথার উত্তরের আগেই বলে ওঠে, পাখায় ঝালর বসিয়েছে কে গো?

কে আবার, ছোটগিন্নি! নিভাননী অগ্রাহ্যে মুখ বাঁকিয়ে বলে, রাতদিন যিনি সংসারের সব্বতাতে বাহার কাটছেন!

সুকুমারীর মুখটা চুন হয়ে যায়, ভুবনেশ্বরী তাড়াতাড়ি বলে, তা বাহার কাটা তো ভালই, কেমন খাসা দেখাচ্ছে!

হোক গে, নিভাননী আর একবার মুখ বাঁকায়, এখন অবধি তো গাই দোয়াতে শিখল না, কুলো পাছড়াতে পারল না। পেঁকিশালে গিয়ে যা রঙ্গ, যদি দেখ তো বুঝবে। না পারে ‘পাড়’ দিতে, না পারে হাতে হাতে নেড়ে দিতে, পাড়াপড়শীকে তোয়াজ করে ডেকে এনে কাজ উদ্ধার করতে হয়। আসল কাজ চুলোয় দিয়ে ভাঁড়ারের হাঁড়ি-কলসীর গায়ে চিত্তির কেটে, শিকের দড়িতে কড়ির থোপনা গেঁথে, আর পাখার ঘাড়ে শালুর ঝালর ঝুলিয়ে গেরস্তর সগৃগের সিঁড়ি হবে!

ভুবনেশ্বরী দেখে হিতে বিপরীত, এই সূত্র ধরে নিভাননী আরও কোথায় গিয়ে পৌঁছবে কে জানে! তা হলে তো আসল কাজই মাটি। ছোট ভাজকেই যে আজ তার দরকার। তবু ভুবনেশ্বরী আবার একটা ভুল চালই করে বসে। বসে এইজন্যেই যে নিচুতলাদের নিন্দাবাদ করে ওপরওয়ালাদের প্রসন্ন রাখার যে চিরন্তন কৌশল, সে কৌশলটা তার ভাল আয়ত্তে নেই বলেই। নিজের বাড়িতে তো সেই ভয়ে সে কথাই কয় না সহজে। দেখে ঘোমটা আর নীরবতা অনেক বিপদের রক্ষক। কিন্তু এটা নাকি ভুবনেশ্বরীর বাপের বাড়ি, তাই সাহসে ভর করে বলে বসে, কেন বাপু, এই তো বেশ ডাল ভাজছে। মুড়ি ভাজতেও পারে। অত বড় একখানা শহরের মেয়ে, আর কত পারবে?

তা বটে! নিভাননী একটি উত্তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বলে, শহর কখনও চোখে দেখিনি, তার মম্মও জানি নে। ঘর-সংসারই বুঝি, আর বুঝি মেয়েমানুষের সেখানে হেরে গেলে লজ্জায় মাথা কাটা যায়… বসো একটু, গুড়ের পানা করে আনি, রোদে এসেছ।

রোদের সময় ঘরে কিছু না থাক, আখের গুড় জলে গুলে তাতে পাতিলেবুর রস মিশিয়ে খাওয়ার রেওয়াজ এদিকে আছে, নিভাননীর মগজে সেই সহজটাই আসে। কিন্তু সুকুমারীর ওই গুড়ের পানা জিনিসটায় বিষম বিতৃষ্ণা, তাই সে বড়জায়ের ওপর কথা-কওয়া-রূপ অসমসাহসিক কাজটাও করে বসে ননদের প্রতি সমীহে। সসংকোচে বলে ফেলে, কেন দিদি, মিছরি নারকেল গাছের ডাব তো পাড়ানো রয়েছে ঘরে!

রয়েছে সেটা নিভাননীর মনে ছিল না, কিন্তু মনে পড়িয়ে দেওয়ায় অপদস্থের একশেষ হয়ে যায় সে। কে জানে ননদ মনে করল কিনা, ইচ্ছে করেই ডাবের কথাটা বিস্মৃত হয়েছে সে। এই ছোট বৌটা দেখতে ভালমানুষ হলে কি হবে, টিপে ডান। কিন্তু এক্ষেত্রে নিভাননীকে মনের রাগ মনে চেপে হাসতেই হয়। হেসে বলতেই হয়, অই দেখ, ভাগ্যিস মনে করলি ছোটবৌ! আমার অমনিতর ভুলো মনই হয়েছে আজকাল, বুঝলে ঠাকুরঝি! ঠাকুর-জামাইয়ের কাছ থেকে এবার একটা সিঁতিশক্তির ওষুধ খেতে হবে। যা তবে ছোটবৌ, দুটো ডাব কেটে আন্ গে।

আহা, কেন ব্যস্ত হচ্ছ বড়বৌ? ভুবনেশ্বরী অকারণে গলা নামিয়ে বলে, আমি এসেছি বিশেষ একটা দরকারে পড়ে, এখুনি চলে যেতে হবে।

ওমা শোন কথা! এখুনি চলে যেতে হবে কি গো? কি এমন বিশেষ দরকার পড়ল? এলেই বা কার সঙ্গে, যাবেই বা কার সঙ্গে? একা নাকি?

একা? ভুবনেশ্বরী হেসে ওঠে, সে আর এ কাঠামোয় হবে না। এসেছি পিসশাশুড়ির সঙ্গে। দুয়োর থেকে আমাকে ছেড়ে দিয়ে গেলেন, আবার ফিরতি মুখে ডেকে নিয়ে যাবেন। চুপিসারে চলে এসেছি, ঘরে কেউ জানে না।

ঠাকুরজামাই? নিভাননী রহস্যের হাসি হাসে।

ভুবনেশ্বরী নিভাননীর ঠাকুরজামাইয়ের প্রসঙ্গেই মাথার কাপড়টা একটু টেনে বলে, তিনি তো ভিন গাঁয়ে গেছেন রুগী দেখতে, নইলে আর এত বুকের পাটা! নিতান্ত কারে পড়েই আসা। পিসশাশুড়ী সইয়ের বাড়ি আসছেন শুনে খুব কাকুতি করলাম, বলি, ওই পথ দিযেই তো যাবে পিসীমা! তা সেদিকে ভাল আছেন মানুষটা, কেউ শরণ নিলে তাকে বুক দিয়ে আগলান।

তা কাজটা কি?

এবার ভুবনেশ্বরী থতমত খায়, কাজটা কি সেটা নিভাননীর সামনে বলা সঙ্গত কিনা এতক্ষণে খেয়াল হয়। আসলে এসেছে সে সুকুমারীর কাছে একখণ্ড লেখা কাগজ নিয়ে, যে কাগজের হিজিবিজি রেখাগুলো এক দুর্বোধ্য কুটি হেনে তার দিকে ক্রমাগত তাকিয়ে আছে আজ কদিন থেকে।

সত্যবতীর লেখা একখণ্ড কাগজ।

জিনিসটা ভুবনেশ্বরীকে ভাবিয়ে তুলেছে। ঘরের কোণে ঘাড় গুঁজে লিখছিল সত্যবতী, হঠাৎ বুঝি দালানে কুমোর এল এই বার্তা পেয়ে ছুটে চলে গিয়েছিল নেড়ু পুণ্যি আরও কুচোকাঁচাঁদের সঙ্গে, কাগজখানা চৌকিতে পাতা শেতলপাটির তলায় খুঁজে রেখে। ভুবনেশ্বরী কৌতূহলপরবশ হয়ে পাটিটি ঈষৎ উঁচু করে তুলে দেখতে গিয়েছিল কেমন আখর সত্যর হাতের কিন্তু দেখতে গিয়েই স্তম্ভিত হয়ে গেল, গোটা গোটা আখরে ঠিক পদ্যর ছাঁদে এ কি লিখছিল সত্য?

নকল করছিল?

কিন্তু নকল করবে যদি তো সামনে বই খোলা কই? সর্বনেশে মেয়ে নিজেই পয়ার বাঁধছে নাকি? ভয়ে বুকের রক্ত হিম হয়ে গিয়েছিল ভুবনেশ্বরীর, কিন্তু কাকে দেখিয়ে রহস্যের মীমাংসা হবে?

রামকালীকে তার বড় ভয়।

রাসুকে বলতে গেলে পাঁচকান হবার সম্ভাবনা। তাছাড়া বাড়িতে আর যারা লিখন-পঠনক্ষম, সকলেই তো ভুবনেশ্বরীর শ্বশুর ভাসুর, ভেবে আর কুলকিনারা পাচ্ছিল না বেচারা। তারপর সহসাই মনে পড়ল সুকুমারীর কথা।

সুকুমারী পড়তে জানে।

বামালটা সরিয়ে ফেলে সুকুমারীর কাছে আসার তাল খুঁজছিল সে দু-তিন দিন থেকে। আড়চোখে দেখেছে, সত্য কখন একসময় শেতলপাটি উল্টে লণ্ডভণ্ড করে খোজাখুঁজি করেছে, আবার ‘ধুত্তোর’ বলে নতুন কাগজ নিয়ে বসেছে! সে কাগজে আর কোন্ রহস্যের রেখা এঁকেছে সত্য, সে কথা ভুবনেশ্বরীর অজ্ঞাত, জিজ্ঞেস করতে গেলে সত্য মারমুখী হয়। বাড়ির লোকের জ্বালায় যে একদণ্ড নিরিবিলিতে বসবার জো নেই তার, এ কথা স্পষ্ট গলায় ঘোষণা করতে বাধে না সত্যবতীর।

অতএব এই টুকরোটুকুই ভরসা।

ঘাড় গুঁজে গুঁজে কি এত লেখে সে জানবার জন্যে মায়ের মন নানা কারণেই ব্যাকুল হয়। ব্যাকুল হয় কৌতূহলে, ব্যাকুল হয় আশঙ্কায়।

সত্যকে যে শ্বশুরবাড়ি যেতে হবে!

হায়, সত্য যদি ভুবনেশ্বরীর মেয়ে না হয়ে ছেলে হত! বাপের উপযুক্তই হত। কিন্তু ভুবনেশ্বরীর কপালে এক তরকারি নুনে বিষ। একটা সন্তান, তা মেয়ে!

কি গো ঠাকুরঝি, বাক্যি-ওক্যি নেই কেন? নিভাননী অবাক হয়। এত কুণ্ঠা কিসের?

গরীব ননদ নয় যে আশঙ্কা করবে ধার চাইতে এসেছে ভাজের কাছে।

আর চেপে রাখা চলে না, ঢোক গিলে বলতেই হয় ভুবনেশ্বরীকে– এসেছিলাম ছোট বৌয়ের কাছে, একটা কাগজ পড়ানোর দরকার ছিল।

কাগজ! নিভাননী আকাশ থেকে পড়ে, কাগজ কিসের? কোন পাট্টা কোবালা নাকি?

না না,ওমা সে কি? সে সব আমি কোথায় পাব? এ ইয়ে–একটু চিঠির মতন।

চিঠির মতন! সেটা আবার কি বস্তু ঠাকুরঝি? আর সে পড়ানোর লোক তোমার বাড়ি হাঁটকে একটা পুরুষ বেটাছেলে কাউকে পেলে না, সাতপাড়া ডিঙিয়ে একটা মেয়েমাগীর কাছে পড়তে এলে? কিছু গোপন বুঝি?

সুকুমারী গিয়েছে ডাব কাটতে। ভুবনেশ্বরী অসহায় ভাবে একবার এদিক ওদিক তাকিয়ে সহসাই দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে বলে, কি যে বলো বড়বৌ, গোপন আবার কি? এই সত্যর একটু লেখা। বলি অষ্টপ্রহর কি এত লেখে বসে দেখি তো! বাড়িতে কাউকে দেখালে রসাতল করবে তো মেয়ে?

নিভাননীর কানে আসতে বাকী ছিল না–সত্য লেখাপড়া করছে, তবু অজ্ঞের ভানে বলে, বল কি ঠাকুরঝি, সত্যও কি তার ছোটমামীর মতন লেখাপড়া করছে? কালে কালে হল কি? বলি মেয়ে কি তোমার শামলা এঁটে কাছারী যাবে? সবাই তো তোমার ভাইদের মতন ভালমানুষ নয় যে, যা ইচ্ছে তাই চলে যাবে, শ্বশুররা এ খবর টের পেলে?

কি করব বড়বৌ, জানোই তো তোমাদের ননদাইকে কেমন একজেদা? মেয়ে বললে পড়ব তো পড়ুক। মেয়ে আকাশের চাঁদ চাইলে চাঁদ পেড়ে আনতে যাবেন এমন মানুষ। তাই তো ভাবলাম, কি লেখে বসে দেখি! ছেলেবুদ্ধি!

বড় একটা পাথরবাটিতে ডাবের জল নিয়ে এসে দাঁড়াল সুকুমারী।

ও বাবা কত! এত পারব না ছোটবৌ, তুমি একটু ঢেলে নাও। বলে ভুবনেশ্বরী।

খাও না, রোদে এসেছ।

তা হোক, অতটা নয় বাপু।

অগত্যাই খানিকটা ঢালাঢলি করতে হল সুকুমারীকে। ভুবনেশ্বরী ইত্যবসরে ব্যাপারটাকে লঘুর পর্যায়ে ফেলবার বুদ্ধিটা এঁচে নিয়েছে, তাই ডাবের জলে চুমুক দিতে দিতে ঝট করে বাঁ হাতের মুঠো থেকে কাগজের টুকরোটা এগিয়ে দিয়ে বলে, এই নাও বিদ্যেবতী বৌ, পড় দিকিন এটা! আমরা তো চোখ থাকতে অন্ধ!

জন্ম জন্ম যেন অন্ধই থাকি বাবা- নিভাননী বিষমুখে বলে, যে জাতের দশহাত কাপড়ে কাছা নেই, তাদের আবার এত চোখ-কান ফোঁটার দরকার কি? বলে, কিন্তু জিনিসটার ওপর এমন ভাবে হুমড়ে পড়ে, দেখে মনে হয় চোখ-কান থাকলে মুহূর্তে গ্রাস করে ফেলত। ভুবনেশ্বরী যাই বলুক, জিনিসটায় যেন রহস্যের গন্ধ।

সুকুমারী কাগজখানা উল্টে-পাল্টে বলে, কি এ?

কি তা আমি বলব কেন? তুমি বলো? কৌতুকের হাসি হাসে ভুবনেশ্বরী।

একটা তো ত্রিপদী ছন্দের দেবীবন্দনা দেখছি, কার লেখা? খুব ভাল হাতের লেখা তো?

ত্রিপদী ছন্দ শব্দটা বুদ্ধিগ্রাহ্য নয়, কিন্তু দেবীবন্দনা কথাটার অর্থ জানা, তাই ভুবনেশ্বরীর বুক থেকে যেন একটা পাহাড় নেমে যায়, তবে জিনিসটা দোষণীয় নয়।

পড় তো শুনি?

সুকুমারী একটু শঙ্কিত দৃষ্টিতে বড়জায়ের দিকে তাকায়। নিভাননীর সামনে পড়া? তিনি এটাকে কোন আলোয় নেবেন? গুরুজনের প্রতি অসম্মাননা? কিন্তু নিভাননীই অভয় দেয়, নাও, পড়ই শুনি। হাবা কালা কানা অন্ধদের জ্ঞান দাও।

অতএব সুকুমারী একটু কেশে একটু ইতস্তত করে পড়ে–

এসো মা জননী                  দুর্গে ত্রিনয়নী,
এসো এসো শিবজায়া,
সন্তানের ঘরে                     এসো দয়া করে,
মহেশ্বরী মহামায়া।
তোমারে হেরিতে                 আশাভরা চিতে
রয়েছি আকুল হয়ে,
আসিবে মা তুমি                  এই মর্ত্যভূমি,
পুত্র কন্যা সাথে লয়ে।
একটি বৎসর                     শূন্য আছে ঘর
দুঃখে আছি নিরবধি,
দিবস রজনী                      কাটে দিন গুনি,
কবে দিন দেবে—

ওমা এ কি, শেষ নেই যে? সুকুমারী অবাক হয়ে বলে, এ স্তোত্তর কোথায় পেলে ঠাকুরঝি?

আর বল কেন? ভুবনেশ্বরী কুণ্ঠা দমন করতে হাতপাখাখানা তুলে জোরে জোরে নাড়তে নাড়তে বলে, সত্যর কীত্তি। লিখছিল–কুমোর এসে কাঠামো বাধছে শুনে ফেলে দিয়ে ছুটে গেল। আমি কুড়িয়ে তুলে–

তা নকল করেছে কোথা থেকে?

সকৌতূহল প্রশ্ন করে সুকুমারী।

নকল করেছে তা মনে হল না ছোটবৌ, ভুবনেশ্বরী যাকে বলে, দোনামোনা সেই সুরে বলে, ও মুখপুড়ী নিয্যস নিজেই বেঁধেছে।

কি যে বল ঠাকুরঝি, সুকুমারীর কণ্ঠে অবিশ্বাস, নিজে বাঁধবে কি? অতটুকু মেয়ে এসব কথার মানে জানে?

জানে না কি করে বলি বৌ, মুখপুড়ী লুকিয়ে লুকিয়ে তোমার ননদাইয়ের কবরেজী শাস্তরের বইগুলো পর্যন্ত টেনে পড়তে বসে।

সে কথা আলাদা। পারুক না পারুক আম্বা করে বসে কিন্তু ছন্দ বেঁধে আখর মিলিয়ে এত বড় স্তোত্তর তৈরি কি সোজা নাকি?

ছোটবৌয়ের এই অবিশ্বাসের সুর ভুবনেশ্বরীকে ঈষৎ থতমত করছিল, কিন্তু মেঘ উড়িয়ে দিল নিভাননী, যে নিজে এতক্ষণ মুখে আষাঢ়ের মেঘ নামিয়ে ছোটজায়ের অবলীলাক্রমে’র দিকে তাকিয়ে দিল। সুকুমারীর কথা শেষ হতেই হাত নেড়ে বলে উঠল নিভাননী, তা এতে আশ্চয্যি হবার কি আছে ছোটবৌ? ঠাকুরঝি মনে বেদনা পাবে তাই রেখে-ঢেকে বলা, ঠাকুরঝির ওই মেয়েটিই কি সোজা? কতদিন আগে ভোদার নামে ছড়া বাঁধে নি ও? এ নয় মা-দুগগার নামে বেঁধেছে। তবে ভাবনার কথা বটে। ঠাকুর-জামাইয়ের দবদবায় আমরা দশজনা নয় মুখে চাবি দিয়ে আছি, কিন্তু কুটুম তো তা মানবে না? একবার টের পেলে–

কথা শেষ হল না, মোক্ষদার হন্তদন্ত মূর্তি দেখা গেল খোলা দরজার সামনে। চলে এস মেজবৌমা, ঝটপট চলে এস, ওদিকে এক কাণ্ড হয়েছে।

কাণ্ড হয়েছে!

কী সেই কাণ্ড!

ভুবনেশ্বরীর মুখে কথা যোগায় না, হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। সুকুমারী তো আগেই ঘোমটা টেনে বসেছে। তবে নিভাননীর কথা আলাদা, এ বাড়ির গিন্নীর পদটা তার, এগিয়ে গিয়ে বলে, কিসের কাণ্ড মাউইমা?

আর বলো না বাছা। সইয়ের বাড়িতে বসেছি কি না-বসেছি, রাখলা ছোঁড়া রণপা নিয়ে গিয়ে হাজির। কি সমাচার? না শীগগির চল, সত্যর শ্বশুরবাড়ি থেকে লোক এসেছে। ভাগ্যিস দিদিকে বলে এসেছিলাম সইয়ের বাড়ি যাচ্ছি।

নাঃ, মোক্ষদার কথা শেষ হতে পারে না, সহসা ভুবনেশ্বরী ডুকরে কেঁদে উঠেছে।

ওমা ও কি। কাঁদছ কেন মেজবৌমা? চল চল, অপিক্ষের সময় নেই। কিন্তু চলবে কে?

ভুবনেশ্বরীর শুধু পা দুখানাই নয়, সমস্ত লোমকূপগুলো পর্যন্ত যে অবশ হয়ে গেছে।

সত্যর শ্বশুরবাড়ি থেকে লোক!

অতএব আর সন্দেহ কি যে সমস্ত জানাজানি হয়ে গেছে। তা ছাড়া আর কি অর্থ থাকতে পারে এরকম বিনা নোটিসে হঠাৎ শ্বশুরবাড়ির লোক আসার? কোথায় কে ঘরশত্রু বিভীষণ আছে সে গিয়ে পলাগিয়ে দিয়েছে সত্যর এই মারাত্মক অপরাধের আর সত্যর বাপের ওই ভয়ানক দুঃসাহসের খবর। এর পর? এর পর আর কি ভুবনেশ্বরী ভাবতে পারে না, শুধু ডুকরোনোর মাত্রাটা বাড়িয়ে বলে ওঠে, ওগো পিসীমা গো, তুমি আমাকে এখানে মেরে ফেলে রেখে যাও, বাড়ি অবধি যেতে পারবো না আমি।

আহা অধোয্য হচ্ছ কেন মেজবৌমা? মোক্ষদা দেহটাকে প্রায় উলটোমুখো ঘুরিয়ে ব্যস্ত কণ্ঠে বললেন, এখনকি অধোয্যের সময়? এক্ষুনি না যেতে পারো একটু সামলে নিয়ে ভেজের সঙ্গে যেও, আমি চললাম। পা তো আমারও কাঁপছে, কে জানে কী বার্তা নিজে এসেছে! তা বলে কোত্তব্য ত্যাগ করা চলে না। আচ্ছা, আমি এগোলাম।

‘রণপা’ ব্যতীতই রণপায়ের বেগে অদৃশ্য হয়ে যান মোক্ষদা।

.

ভুবনেশ্বরী যখন নিভাননীর সঙ্গে সন্তর্পণে খিড়কি দরজা দিয়ে ঢুকল, তখন বাড়ির চেহারা নিস্পন্দ।

যেন এইমাত্র কেউ একটা শোকসংবাদ পাঠিয়েছে।

তা হলে?

নিভাননী ফিসফিস করে বলে, বাড়ি এমন থমথমে কেন বল তো ঠাকুরঝি? মন তো ভাল নিচ্ছে না। আর পোড়া মনের স্বধৰ্ম্মই তো কু-কথা গাওয়া। জামাইয়ের কিছু দুঃসংবাদ নেই তো?

আধমরা মানুষটাকে চৌদ্দ আনা মেরে নিভাননী হৃষ্টচিত্তে উঠোনে পা দিয়ে এদিক ওদিক তাকায়।

দালানে কারা যেন নিঃশব্দে জটলা করে বসে রয়েছে, ঘোমটা দিয়ে বোধ করি সারদা ঘোরাঘুরি করছে, ছোট ছেলেমেয়েগুলোর পাত্তা নেই।

এসো ঠাকুরঝি উঠে এসো, নিয়তি যা করবে তা সইতেই হবে, এখন দেখি গে চল কার কি হল।

নিভাননী নিজে বুঝতে পারুক না-পারুক, তার অবচেতন মনের একটা ফটোগ্রাফ নিতে পারলে সেখানে একটা প্রত্যাশার ছবি দেখতে পাওয়া যেত। জামাইটির কিছু হলেই যেন প্রত্যাশাটি পূর্ণ হয়। নন্দাইয়ের দবদবা সেই গহন গভীরে যে একটি অনির্বাণ দাহ সৃষ্টি করে রেখেছে, সেটাও বুঝি কিঞ্চিৎ শীতল হয় এমন একটা কিছু হলে।

ভুবনেশ্বরী কিন্তু দাওয়ায় উঠে দালানের চৌকাঠ পার হবার সাহস সঞ্চয় করতে পারে না, উঠোনের পৈঠেতেই বসে পড়ে বলে, আমার হাত পা উঠছে না বড়বৌ, তুমি দেখ গে।

শোন কথা! তুমি এখেনে এমন করে বসে থাকলে চলবে কেন? ভীমের গদা বুকে পড়লেও তো বুক পেতে নিতে হবে ঠাকুরঝি! কণ্ঠস্বর সহানুভূতিতে কোমল হয়ে আসে নিভাননীর, চল, আমি তোমায় আগলে দাঁড়াই গে।

ভয় যতই তীব্র হোক, ভয়ের আকর্ষণটাও যে ততোধিক তীব্র। কাজে কাজেই উঠে পড়ে ভুবনেশ্বরী। আস্তে আস্তে দাওয়ায় উঠে দালানের কোণের দিকের একটা জানলায় উঁকি মারে। নিভাননী অবশ্য দরজায় পৌঁচেছে।

কিন্তু ব্যাপারটা কি হল?

ভালমন্দের মত তো কিছু দেখাচ্ছে না। অন্তত সত্যর শ্বশুরবাড়ি থেকে আগতা হৃষ্টপুষ্টাঙ্গী রমণীটির হিসেবে তো মনে হচ্ছে পুরোপুরি ভালই।

হয় কোনও দাসী, নচেৎ নাপিতমেয়ে, এ ছাড়া আর কে-ই বা আসবে? যেই হোক, আপাতত তার আদরটা প্রায় মহারাণীর মত। জল খাওয়াতে বসানো হয়েছে তাকে, চারিদিকে ঘিরে বসে আছেন দীনতারিণী, কাশীশ্বরী, মোক্ষদা, শিবজায়া, ছোটজেঠী, তা ছাড়া আশ্রিতা প্রতিপালিতার ঝাঁক।

সকলের মুখের চেহারাতেই একটি ভক্তি-বিনম্র সমীহ ভাব।

আর মধ্যমণিটির মুখচ্ছবিতে অহংবোধের দৃপ্ত মহিমা। তার সামনে কানাউঁচু বড়সড় পাথরের খোরা, তার মধ্যস্থলে মন্দিরাকৃতি শুকনো চিড়ের স্থূপ, পাশে একটি উঁচু কালো পাথরবাটি ভর্তি দই এবং সন্নিকটে একখানি অঙট কলার পাতে স্থাপিত ছড়াখানেক চাটিম কলা, গণ্ডাচারেক দেদো মণ্ডা, একরাশ ফেনী বাতাসা এবং ক্ষীরের ছাঁচ, চন্দ্রপুলি, নারকেলনাড়, বেসননাড়ু ইত্যাদি বেশ একটি বড়গোছের সম্ভার।

অর্থাৎ ঘরে সংসারে যত প্রকারের মিষ্ট বস্তু ছিল, সব কিছু দিয়ে তুষ্ট করার চেষ্টা চলছে কুটুমবাড়ির নাপতিনীকে।

হ্যাঁ, নাপতিনীই।

মালুম হয় দীনতারিণীর কথাতেই। নিতান্ত কাকুতিভরা কণ্ঠে বলছেন তিনি, আর দুটোখানি চিড়ে দিই নাও নাপিত বেয়ান, আর বেয়ানই বা কেন, হিসেবে তো মেয়ে সুবাদ হচ্ছ, মেয়ে বলি। আর দুটো চিড়ে একেবারে মেখে জব্দ করে নাও মেয়ে, দইয়ে ভিজলে ও আর কটা? সেই কোন ভোরে বেরিয়েছে। রোদে একেবারে মুখচোখ সিটিয়ে গেছে।

ভুবনেশ্বরী বোধ করি বিহ্বলতার বশেই জানলা ছাড়তে ভুলে গিয়েছিল, নিষ্পলক নেত্রে ঠায় তাকিয়েছিল সেই দেবমূর্তি আর তার নৈবেদ্যের দিকে, হঠাৎ একসময় পিছনে একটা মৃদুকণ্ঠের আভাসে চমকে ফিরে তাকাল, পিছনে সারদা।

এখানে দাঁড়িয়ে কেন মেজখুড়িমা?

দাঁড়িয়ে কেন? এমনি। ঘরে ঢুকতে পা উঠছে না। ও কেন এসেছে বড়বৌমা?

কেন আর? সারদা অস্ফুট ম্রিয়মাণ গলায় বলে, এসেছে মস্ত উদ্দেশ্য নিয়ে। বৌ নিয়ে যাবার বার্তা পাঠিয়েছেন তাঁরা। আশ্বিন পড়তেই নিয়ে যাবেন বলছে।

আশ্বিন পড়তেই! বলো কি বড়বৌমা! এই কদিন বাদ?

তাই তো বলছে। একেবারে নাকি পুরুত দিয়ে দিন দেখিয়ে পাঠিয়েছেন তাঁরা।

কিছুক্ষণ স্তব্ধ থেকে ভুবনেশ্বরীর বুক ছিঁড়ে একটা প্রশ্ন ওঠে, সত্য টের পেয়েছে?

তা আর পায় নি?

কি করছে?

তা তো জানি না খুড়িমা। ভয়ে ভয়ে ঘরে গিয়ে সেঁধিয়েছে বোধ হয়!

আমি যে বাড়ি ছিলাম না–এটা কেউ টের পেয়েছে?

এবার সারদা একটু সত্য গোপন করে, বলতে পারছি না মেজখুড়িমা, বোধ হয় পান নি কেউ। গোলেমালে ব্যস্ত আছেন সবাই।

সত্য কথা বলা চলে না।

কারণ অনুপস্থিত ব্যক্তি সম্পর্কে যে ধরনের আলোচনা হয়, সেটা যথাযথ প্রকাশ করলে লাগিয়ে দেওয়া ভাঙিয়ে দেওয়ার পর্যায়ে পড়ে।

ব্যস্ত থাকলেই বাঁচন ভুবনেশ্বরী আর একটা দীর্ঘশ্বাস-বাক্যে উচ্চারণ করে। কিন্তু এখন হঠাৎ এ কি বিপদ বড়বৌমা!

বড়বৌমা কিছু বলার আগেই নাপিত-মেয়ের মাজা-ঘষা চাচা গলাটি ধ্বনিত হয়, বাপ বাড়ি নেই বলে মত দিতে ছুতো করছ কেন মাউইমা? আমি তো আর আজই নে যাচ্ছি না। আমাকে এ মাসের কটা দিন এখেনে থেকে একেবারে আশ্বিনের তেসরা তারিখে নিয়ে যেতে বলেছে।

১৭. জগতের সমস্ত বিস্ময়

জগতের সমস্ত বিস্ময়কে কি একটিমাত্র প্রশ্নের মধ্যে প্রকাশ করা যায়? সেই একটি প্রশ্নের মধ্যেই ধিক্কার দেওয়া যায় জগতের সর্বাপেক্ষা অসহনীয় ধৃষ্টতাকে?

আরো কারও পক্ষে দেওয়া সম্ভব কিনা জানি না, কিন্তু দেখা গেল অন্তত একজনের পক্ষে তা সম্ভব হয়েছে!

বারুইপুরে বায্যে-গিন্নীর একটিমাত্র ছোট্ট প্রশ্নে ধ্বনিত হল বিশ্বের সমস্ত বিস্ময় আর সমস্ত ধিক্কার-বাণী।

পাঠাল না!

না।

পথশ্রান্ত নাপিত-বৌ শুধু এই একটি শব্দ উচ্চারণ করে পা ছড়িয়ে বসল।

প্রথম বড় ঢেউয়ের পরবর্তী আর একটি ছোট ঢেউ।

তুই হার মেনে ফিরে এলি?

এবার বিস্ময় আর ধিক্কারের পালা নাপিত-বৌয়ের, শোনো কথা! তাদের মেয়ে, তারা পাঠালে না, আমি কি তাদের ঘর থেকে মেয়ে কেড়ে নিয়ে আসব?

এবার বাড়ূয্যে-গিন্নী নিজেই পা ছড়িয়ে বসলেন, দুই ভ্রূ এক জায়গায় এনে জড়ো করার চেষ্টা করতে করতে বললেন, ছুতোটা কী দেখাল?

শোনো কথা! ছুতো আবার কিসের, সোজাসুজি মুখের ওপর ঝাড়া জবাব, এখন পাঠাব না।

নাপিত-বৌ আঁচল খুলে পানের কৌটো বার করে।

এক্ষুনি মুখে পান ভরিস নে নাপিত-বৌ, চোদ্দবার উঠবি পিক ফেলতে। আমার কথাগুলোর আগে উত্তর দে। বলি ছুতো যুক্তি কিছু না–শুধু পাঠাব না?

এখন পাঠাব না।

তা কখন পাঠাবেন? আমার ছেরাদ্দর সময়? আমি যে ভেবে থই পাচ্ছি না রে নাপিত-বৌ, মেয়ের বাপের এত বড় বুকের পাটা! পৃথিবীতে এখনও চন্দ্র-সূর্য্যি উঠছে, না থেমে গেছে? এ কথা ভেবে বুক কাপল না যে, তোর মেয়েকে যদি ত্যাগ দিই!

নাপিত-বৌ নিষেধ অগ্রাহ্য করে মুখে পান-দোক্তা পুরে বলে, বুক কাঁপবে! হুঁ! একটা কেন একশটা মেয়েকে ঘরে ঠাই দেবার, ভাত কাপড় দে’ পোষবার ক্ষমতা তাদের আছে। লক্ষ্মীমন্তর ঘর বটে।

খুব বুঝি গিলিয়েছে! বড়য্যে-গিন্নী দুরন্ত ক্রোধকে পরিহাসের ছদ্মবেশ পরিয়ে আসরে নামান, তাই বেয়াইবাড়ির লক্ষ্মীর ঘটায় চোখ ঝলসেছে! বলি ঘরে ভাত থাকলেই মেয়ের শ্বশুরবাড়ির আশ্রয় ঘোচাতে হবে? এত বড় আস্পদ্দার পর আর ওদের মেয়ে আনব আমি?

খাওয়ার কথা তুলে খোটা দিও না বামুন-বৌদি, তোমাদের আশীর্বাদে নাপিত-বৌয়ের অমন খাওয়া ঢের জোটে। তবে হ্যাঁ, নজর আছে বটে। শুধু পয়সা থাকলেই হয় না, নজর থাকা চাই।

কথাটা অর্থবহ এবং সে অর্থ বড়য্যে-গিন্নির অন্তরে ছুঁচের মত গিয়ে বেঁধে, তবু তিনি নিজেকে সংযত করে বলেন, তা নজরের পরিচয় কি দেখাল? বিশ ভরির চন্দরহার গড়িয়ে দিয়েছে তোকে, নাকি পঁচিশ ভরির গোট?

উপহাস্যির কিছু নেই, যা অনেয্য তা বললে চলবে কেন? একজোড়া ফরাসড্যাঙার থান, একখানা কেটে ধুতি আর নগদ পাঁচ টাকা কে দেয় গা কুটুমবাড়ির লোককে?

দেবে না কেন, যারা মেয়ে ঘরে আটকে রেখে দিতে চায়, তারা ঘুষ দিয়ে মুখ বন্ধ করে কুটুমের লোকের। নইলে তুই তাদের যাচ্ছেতাই শুনিয়ে দিয়ে না এসে সুখ্যেত করছিস বসে বসে! তোর ওপর আমার ভরসা ছিল, এ তল্লাটে তোর মতন মুখ তো কারুর দেখি না, আর তুই-ই ডোবালি? বাঘিনী হয়ে মেড়া বনে এলি?

কী যে তকরার করো বামুন-বৌদি, মেয়ের বাপ নিজে তফাতে দাঁড়িয়ে গিন্নীকে বলে দিল, মা, কুটুমবাড়ির মেয়েকে বলে দাও, বিয়ের সময় কথা হয়েছিল মেয়ের কুমারীকাল পুন্ন না হলে শ্বশুরবাড়ি পাঠানো হবে না, সে কথা তারা হয়ত বিস্মরণ হয়ে গেছেন, আমি তো হই নি। সময় হলে যাবে বৈকি!

বড়য্যে-গিন্নী বিবাহকালের শর্ত উল্লেখে ধেই ধেই করে ওঠেন, কী বললি নাপিত-বৌ, বিয়ের কালের শত্ত-সাবুদের কথা তুলেছে? কথা অমন কত হয়–বলে লাখ কথা নইলে বিয়ে হয় না–বলি তাদের চরণে খত লিখে দিয়েছিল কেউ? আমার ঘরের বৌ আমার যদি আনতে ইচ্ছে হয়! আচ্ছা আমিও দেখছি কত তাদের আস্পদ্দা, কত তাদের তেজ! মেয়েকে শুধু ভাত-কাপড় দিলেই যদি সব মিটে যেত, তা হলে আর কেউ তাকে বিয়ে দিয়ে পরগোত্তর করে দিত না, বুঝলি নাপিত-বৌ? আসছে মাসেই বেটার আবার বিয়ে দেব আমি, এই তোকে বলে রাখলাম।

নাপিত-বৌ নিমকহারাম নয়। অনেক খেয়ে অনেক পেয়ে এসেছে, তাই বেজার মুখে বলে, সে তোমাদের কথা তোমরা বুঝবে, বেয়াই তো পত্তর লিখে দিয়েছে বামুনদাদার নামে, ন্যাও রাখো।

তুই যে তাজ্জব করলি নাপিত-বৌ, এই কদিনে তোকে তুক করল না গুণ করল লো! তাই ঘরশত্তুর বিভীষণ হলি! কেবল ওদের কোলে ঝোল টেনে কথা বলছিস! কই, পত্তর কোথা?

এই যে। নাপিত-বৌ নিজের গামছাটার পুঁটলির গিট খোলে।

বড়য্যে-গিন্নীর অবশ্য তৎপরতার অভাব নেই, তিনিও সঙ্গে সঙ্গে পুঁটলির মধ্যে শ্যেনদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন, কই, বড়মানুষ কুটুম কী দিয়েছে দেখি!

একটি ছেঁড়া ন্যাকড়ার পুঁটলি খুলে একখানি দোমড়ানো মোচড়ানো চিঠি বার করে মাটিতে নামিয়ে দিয়ে নাপিত-বৌ প্রাপ্ত সম্পদ দেখায়, এই কেটে, এই কাপড়ের জোড়া, এই গামছা, আর-

ও বাবা, আবার নতুন ঘটি কাঁসি দিয়েছে যে দেখছি! বড়য্যে-গিন্নী বলেন, সাধে কি আর বলছি ঘুষ দিয়েছে! তা নাকুর বদলে নরুণ নিয়ে ফিরলি তুই! কাসিখানা তো দেখছি ভারী পাথরকুচি!

তা ভারী আছে। আর কথাবার্তাও ভাল। বাড়িসুদ্ধ গিন্নীরা যেন আমায় হাতে রাখে কি মাথায় রাখে! সে তুমি যাই বলো বামুন-বৌদি, কুটুম তোমার খুব ভাল হয়েছে। অমন কুটুমের সঙ্গে অসসরস করলে তুমিই ঠকবে। তবে গিয়ে বৌ তোমার মিছে বলব না, একটু বাচাল।

বাচাল!

সহসা যেন পাথরে পরিণত হলেন বাঁড়ুয্যে-গিন্নী।

বাচাল! আর সে কথা এতক্ষণ বলছিস না তুই? হবেই তো, বাচাল হবে না? বাপের চালচলন তো বুঝতেই পারছি, পয়সার গরমে ধরাকে সরা দেখেন, মেয়েকে আসকারা দিয়ে ধিঙ্গী অবতার করে তুলেছেন আর কি! আমিও এলোকেশী বামনী, বাচাল বৌকে কেমন করে ঢিট করতে হয় তা আমার জানা আছে!

তা আর জানা থাকবে না? ঠোঁটকাটা নাপিত-বৌ বলে বসে, আরও একটা মানুষের মেয়েকে ঘরে পুরে কী হালে রেখেছ তা তো আর কারু অজানা নেই। তা এই বৌকে আর তুমি ঢিট করছ কখন, বেটার তো আবার বে দিচ্ছ!

নাপিত-বৌয়ের কথায় এবার একটু ভয় খান বাঁড়ুয্যে-গিন্নী এলোকেশী। ও যা মুখফোড়, পাড়ায় পাড়ায় সমস্ত রটিয়ে বেড়াবে, হাটে হাঁড়ি ভাঙবে। বড়য্যের বৌ আনতে পাঠিয়েছিল, বড়মানুষ বেহাই মেয়ে পাঠায় নি, এ খবর রাষ্ট্র হলে কি আর মাথা হেঁট হবার কিছু বাকী থাকবে? নাপিতবৌকে চটানেটো ঠিক হয়নি চটায় না ওকে কেউ, চটাতে সাহসই করে না। সকলের হাড়ির খবর রাখে, সকল ঘরে যাতায়াত করে, আর সময়-অসময়ে নাপিত-বৌয়ের শরণ না নিলে কারুর চলে না। যেমন তেজী তেমনি বিশ্বাসী, আর তেমনি জোরমন্ত ডাকাবুকো। একটা মদ্দজোয়ানের ধাকা ধরে নাপিত-বৌ। বৌ মেয়ের শ্বশুরবাড়ি বাপেরবাড়ি করতে নাপিত-বৌ এ গ্রামের ভরসাস্থল। চৈতন্য হয় সেটা এবার, তাই আর একবার সেঁতো হাসি হাসেন বাঁড়ুয্যে গিন্নী, তবে আর কি, যা দেশ-রাজ্যে রাষ্ট্র করে আয়, আমি আবার বিয়ে দিচ্ছি বেটার! মরণ আর কি, গা জ্বলে যায়! কিন্তু তুই-ই বল, রাগে মাথায় রক্ত চড়ে ওঠে কিনা। যাক বিশদ বৃত্তান্ত বল্ দিকি, তুই কি বললি, তারা বলল, মেয়েই বা–

সাতকাণ্ড রামায়ণ গাইবার সময় এখন আমার নেই বামুন-বৌদি, দু দিন দু রাত পায়ের ওপর, সব্বাঙ্গ যেন ভেঙে আসছে। ঘরে যাই এখন।

ঘরে আর যাবি কেন, বাঁড়ুয্যে-গিনী নিষ্প্রভ ভাবে বলেন, এখানেই নয় দুটো।

না বাবা, ওতে আর দরকার নেই। কথায় বলে ভাইয়ের ভাত ভেজের হাত। ঘরে গে দু-দুও জিরোই, তারপর বোঝা যাবে।

আরো নরম হতে হয়, আরো তোয়াজ করতে হয়। শক্তের ভক্ত পৃথিবী।

হ্যাঁলা, তা মাথায় বিষবাণ বিধে রেখে দিলি, উদ্ধার কর! মেয়ে কি বলল তাই বল্? তুই কুটুমের বাড়ি থেকে গিয়েছিস, তোর সামনে কি বাচালতা করল?

করল কি আর গাছে চড়ল? তা নয়। তবে ঠাকুরমাদের সঙ্গে খুব হাত মুখ নেড়ে বক্তিমে করছিল দেখছিলাম। গিন্নীরা বলছিল, কুটুম চটানো ঠিক নয়, তোমার বেয়াইয়ের দুর্বুদ্ধির নিন্দে করছিল, তা দেখি ঘরের মধ্যে ঝাঁজ দেখাচ্ছে, বাবার কথার ওপর কথা! বাবার চাইতে তোমাদের বুদ্ধি বেশী! বে’র সময় যদি কথা হয়ে গেছল বারো বছর বয়েস না হলে তারা বৌ নিয়ে যাবে না তো নিতে পাঠায় কোন্ আইনে, এই সব!

কিন্তু বাঁড়ুয্যে-গিন্নীর তখন আর বাকস্ফূর্তির ক্ষমতা নেই। পুত্রবধূর বাকবিন্যাস-প্রণালীর সংবাদে সে ক্ষমতা লোপ পেয়েছে তার।

কিছুক্ষণ গালে হাত দিয়ে স্তব্ধ হয়ে থেকে সনিঃশ্বাসে বলেন, হ্যাঁলা বৌ, তুই তো আমাকে খুব উপহাস্যি করলি বেটার আবার বে দেব বলেছি বলে, তা তুই-ই নিজে মুখে স্বীকার কর, এ বৌ নিয়ে ঘর করা যাবে? বাবার জন্মে তো এমন কথা শুনি নি নাপিত-বৌ যে শ্বশুরঘরে যাওয়ার কথা নিয়ে ঘরবসতের বৌ কথা কয়, চিপটেন কাটে!

বাপের একটা তো, একটু বাপসোহাগী আছে। তা ও দোষ কি আর থাকবে? আপনিই যাবে। কথাতেই তো আছে গো–হলুদ জব্দ শিলে, চোর জব্দ কিলে, আর দুষ্ট মেয়ে জব্দ হয় শ্বশুরবাড়ি গেলে!

জানি নে মা, আমার তো ভয়ে পেটের মধ্যে হাত-পা সেঁদিয়ে যাচ্ছে। বুড়ো বয়সে বেটার বৌয়ের হাতে কি খোয়ার আছে তা জানি না। আবার বে দেব আর কোথা থেকে! তোর বামুনদাদা যে বেয়াইয়ের বিষয়-সম্পত্তির ওপর ট্র্যাক করে বসে আছে। বলে বাপের একটা মেয়ে, বাপ চোখ বুজলে সব মেয়ে-জামাইয়ের।

শোন কথা! এবার গালে হাতের পালা নাপিত-বৌয়ের, ওই বিরিঙ্গির গুষ্টি, অমন সব সোনারচাঁদ ভাইপো রয়েছে, তারা পাবে না? তা ছাড়া ভাগভেন্ন তো নয়!

তা জানি নে বাপু, কত্তা বলে তাই শুনি। বলে বাপটা একবার চোখ বুজলে হয়!

কার চোখ আগে বোজে, কে কার বিষয় খায়, কে বলতে পারে বামুন-বৌদি! বেয়াইয়ের তো তোমার সোনার গৌরাঙ্গর মতন চেহারা, এখনো বে দিলে বে দেওয়া যায়! যাক গে বাবা, তোমাদের কথা তোমরা বোঝ, যাই, উঠি। বামুনদাদাকে পত্তরখানা দিও।

নাপিত বৌ উঠতে যায়, আর সেই মুহূর্তেই বামুনদাদার আগমনবার্তা ঘোষণা করে খড়মের খট খট।

এ কী, নাপিত-বৌ ফিরে এলি যে!

প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে বাইরের উঠোন থেকে ভিতর-উঠোনে পা ফেলেন বাড়ূয্যে।

ফিরে না এসে অকারণ আর কতদিন কুটুমের অন্ন ধ্বংসাব! অবিশ্যি তারা অনেক বলেছিল আর দশদিন থেকে

তা তুই গিয়েছিলি কি করতে? বৌ কই?

পাঠাল না।

বজ্রনির্ঘোষ ধ্বনিত হয় গৃহিণীর কণ্ঠ হতে।

পাঠাল না।

আর একবার প্রমাণিত হল, একটি প্রশ্নের মধ্যেই জগতের সমস্ত বিস্ময় প্রকাশ করা সম্ভব হল।

ছেলেকে খেতে বসিয়ে কথাটা পাড়লেন এলোকেশী। নাপিত-বৌ-নিষিক্ত অগ্নিধারা শরীরের মধ্যে পরিপাক করতে করতে বেগুনেরঙা হয়ে উঠেছিলেন তিনি, তাই ভাতের থালাটা ছেলের পাতের গোড়ায় ধরে দিয়ে যখন পিদ্দিমের সলতেটা একটু বাড়িয়ে পা ছড়িয়ে বসলেন, মায়ের ভীষণাকৃতি মুখ দেখে বুকটা কেঁপে উঠল নবকুমারের।

নবকুমারের বয়স আঠারো-উনিশ হলেও মায়ের কাছে সে দুগ্ধপোষ্যের সমগোত্র। আর মা এবং যম তার মনের জগতে সমতুল্য। মা যখন মুখ ছোটায়, তখন ভয়ে নবকুমারের হাত-পা পেটের মধ্যে সেঁদিয়ে যায়। যার উদ্দেশেই সেই বহ্নিস্রোত প্রবাহিত হোক, নবকুমার ভয়ে কাঁপে।

আজকের গালিগালাজের স্রোতটা আবার নবকুমারেরই শ্বশুরবাড়িকে কেন্দ্র করে, কাজেই খাওয়া আর হয় না বেচারার। ভয়ে লজ্জায় ঘাড়টা নিচু হতে হতে প্রায় থালার সঙ্গে ঠেকে আসে।

নাপিত-বৌ কুটুমবাড়ি যাওয়া পর্যন্ত মনের মধ্যে একটি পুলকের গুঞ্জরণ বইছিল নবকুমারের, ছড়ানো ছিটানো কথায় শুনতে পাচ্ছিল এলোকেশী নাকি বৌকে আনতে পাঠিয়েছেন।

কেমন সেই বৌ, কি তার নাম, কি রকম দেখতে, এসব লজ্জাকর চিন্তাকে কিছুতেই মন থেকে তাড়াতে পারছিল না নবকুমার। শয়নে স্বপনে একটি মুখচ্ছবি আবছা আবছা ছায়া ফেলে বাড়ির এখানে সেখানে এলোকেশীর কাছে কাছে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, ঘোমটা টেনে টেনে।

শোবার ঘরে? অনবগুণ্ঠনে?

ওরে বাবা, অত দুঃসাহসী কল্পনার সাহস নবকুমারের নেই। সে ভাবনার ধারে-কাছে গেলেই বুক গুরগুর করে ওঠে তার। মার সামনে দাঁড়ালে তো কথাই নেই, আশঙ্কা হয় ছেলের মনের ভিতরটা কাঁচদীঘির জলের ভিতরটার মতই দেখতে পাচ্ছেন এলোকেশী।

না, শোবার ঘরের এলাকায় কি নিজের ধারে-কাছে বৌয়ের উপস্থিতির অবস্থা চিন্তা করে না নবকুমার, করে শুধুই মায়ের ধারে-কাছেই।

নাপিত-বৌয়ের অভিযান কার্যকরী হবে না, এরকম অবিশ্বাস্য দুর্ঘটনার কথা তার স্বপ্নেও মনে আসে নি, তাই এই কদিন প্রতিদিন সন্ধ্যার পর ভবতোষ মাস্টারের কাছে ইংরেজি পড়া পড়ে বাড়ি ফিরে উৎকর্ণ হয়ে থাকে একটি মৃদু ঝুনঝুন মলের শব্দের আশায়।

কিন্তু কই?

ক’দিনের কড়ারে গেছে নাপিত-বৌ, সে খবর নবকুমারের জানবার কথা নয়, তবু আশা করছিল পূজোর আগে অবশ্যই। আর পূজোর উৎসবের সঙ্গে হৃদয়ের আর এক উৎসবকে যুক্ত করে নিয়ে অবিরত বিহ্বল হচ্ছিল সে।

পূজো আসছে!

বৌ আসছে!

পূজোটা জানা, কিন্তু না-জানি কেমন সে বৌ।

বিয়ে হয়েছিল পনেরো পার হয়ে, এমন কিছু অজ্ঞানের বয়সে নয়, তবু লাজুক-প্রকৃতি নবকুমার বিয়ের কোন অনুষ্ঠানের সময়ই একটু চকিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করেও কনে বৌকে দেখে নেবার চেষ্টা করে নি। এখন যদি কেউ বদলে অন্য মেয়ে গছিয়ে দেয়, ধরার সাধ্য হবে না নবকুমারের।

এমন কি এই কদিন ধরে শত চেষ্টাতেও বৌয়ের নামটা মনে আনতে পারছে না সে। এতদিন অবশ্য মনে আনবার খেয়ালও হয় নি, নাপিত-বৌয়ের অভিযানই সহসা নবকুমারকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছে কৈশোর থেকে যৌবনের ধাপে।

বিয়ের সময় সম্প্রদানকালে নামটা তো দু-একবার উচ্চারিত হয়েছিল মনে হচ্ছে, কিন্তু কে তখন ভেবেছে এই নামটা মনে রাখবার দায়িত্ব তার! নবকুমার তো তখন অবিরাম ঘামছে!

ওই ঘামটাই মনে আছে, নাম-টাম নয়।

একে তো বিয়ের বর, তা ছাড়া শ্বশুরের সেই দৃপ্ত উন্নত চেহারা, গম্ভীর স্বর আর রাশভারী ভাব। সেটাও সেই ভয়কে বাড়িয়ে দেওয়ার সহায়তা করেছিল।

তা ছাড়া বাসরঘরে আরও কত রকম ভয়।

সে ভয় এখনও বুঝি একটু একটু আছে। কিন্তু বৌ শব্দটি মিষ্টি। ভয়ের মধ্যেও রোমাঞ্চ।

কও না কথা মুখ তুলে বৌ,
দেখ না চেয়ে চোখ খুলে!

মনের মধ্যে বাজছে সুর আর শব্দ। বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে বৌয়ের আসন্ন আবির্ভাব নিয়ে আলোচ• করবার ক্ষমতাও নেই নবকুমারের। পাড়ার বন্ধু যারা খবরটা শুনেছিল তারা যদি একটু-আধটু ঠাট্টা করছে, “ধেৎ, ধেৎ” ছাড়া আর কোনও উত্তর দিতে পারছে না সে।

অথচ যখন ভবতোষ মাস্টারের কাছ থেকে পড়া সেরে সন্ধ্যায় কাঁচদীঘির নির্জন পাড় দিয়ে বাড়ি ফিরেছে তখন অনুচ্চারিত শব্দে বার বার ফিরিয়ে ফিরিয়ে গেয়েছে–

এনেছি বকুলমালা, করবে আলা
তেল-চোয়ানো তোর চুল!
…      …
মিশি দাঁতের হাসিটি বেশ,
মুখখানি বেশ ঢলঢলে!

তারপর কি? তাই তো! মুখখানি বেশ ঢলঢলে, মুখখানি বেশ-পরের লাইনটা কিছুতেই মনে পড়ে না, কোথা থেকে যে শিখেছিল তাও মনে পড়ে না। তবু ওই অসমাপ্ত গানটাই অপূর্ব সুরে গুঞ্জরিত হতে থাকে সমস্ত রাস্তাটা।

ক’দিনের প্রত্যাশার পর আজ বাড়ি ফিরে এলোকেশীর প্রদত্ত সমাচারে বুকটা ছলাৎ করে উঠল। আর সেই বিয়ের দিনের মত ঘাম ছুটে গেল মুহূর্তের মধ্যে।

নাপিত-বৌ এসেছে শুনেছিস? বলে উঠলেন এলোকেশী।

বাঘিনীর মত বসেছিলেন দাওয়ার ধারে। ছেলে এসে পা-টা হাতটা ধোবে, এটুকু সময়ও দেরি সইল না তার। দিয়ে বসলেন সংবাদ। অন্ধকারেই বলে বসলেন, আলোটাও আনলেন না ছেলের সামনে।

নবকুমারের কাছে অবশ্য এ সংবাদ অন্য অর্থ বহন করে এনেছে, তাই তার চিত্তে বিহ্বলতা তাই মার বর্তমান অবস্থা ধরতে পারল না সে। ধরতে পারল না কণ্ঠস্বরের ভীষণতাও। তাই না-জানা একটা সুখে শিউরে উঠল।

কিন্তু কতক্ষণের জন্যেই বা!

ক্ষণকালের মধ্যেই নিষ্ঠুর সত্য প্রকাশিত হল।

মান্যগণ্য বেহাইয়ের উদ্দেশে ‘ছোটলোক’, ‘চামার’, আসপদ্দাবাজ’ ইত্যাদি শোভন-সুন্দর বিশেষণমালা প্রয়োগ করে এলোকেশী জানালেন, “মেয়ে পাঠাল না।”

মেয়ে পাঠাল না!

এ কি অদ্ভুত বাণী!

মেয়ে না পাঠানো যে সম্ভব, সে কথা তো একবার মনের কোণেও আসে নি নবকুমারের!

কিন্তু এ কথায় আর কি কথা কইবে নবকুমার! আর উত্তরের প্রত্যাশা করেও কথা বলেন নি এলোকেশী।

আরও খানিকক্ষণ ধরে বেয়াইয়ের পয়সার গরম তুলে, নাপিত-বৌকে ঘুষ দিয়ে হাত করার বার্তা জানিয়ে, অবশেষে হঠাৎ আবিষ্কার করলেন এলোকেশী, ছেলেটা সেই অবধি উঠোনেই দাঁড়িয়ে আছে কাঠ হয়ে।

মাতৃস্নেহ জেগে উঠল।

আর দাঁড়িয়ে থেকে কি করবি, হাত-মুখ ধো! বলে এলোকেশী উচ্চগ্রামে চিৎকার করলেন, ভাত নেমেছে সদু?

রান্নাঘর থেকে সাড়া এল, নেমেছে মামীমা।

আয় মুখ ধুয়ে, ভাত দিই। বলে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন এলোকেশী। আর নবকুমার আস্তে আস্তে গায়ের কোটটা খুলে দেয়ালে লাগানো একটা গজালে টাঙিয়ে রেখে চলে গেল খিড়কির পুকুরের দিকে।

হঠাৎ মনটা কেমন শিথিল আর ফাঁকা-ফাঁকা লাগছে। যা ছিল না, কোন দিনই যার স্বাদ জোটে নি, তেমন জিনিস হারালেও এমন শূন্যতা বোধ আসে? সব ফাঁকা-ফাঁকা ঠেকে?

কিন্তু তখনই বা হয়েছে কি!

আসল কথা পাড়লেন এলোকেশী ছেলেকে খেতে দিয়ে, পিদ্দিমের সলতে উসকে পা ছড়িয়ে বসে।

সে মুখ দেখে বুক কেঁপে উঠল নবকুমারের।

আমি এই তোকে বলে রাখছি নবা, শেষবেশ একটা চিঠি চামারটাকে দেওয়াব কর্তাকে দিয়ে, তাতেও যদি মেয়ে না পাঠায়, এই সামনের অঘ্রাণেই তোর আবার বিয়ে দেব।

আবার বিয়ে!

মা কি আজকে বুক ধড়াস ধড়াস করিয়েই মারবে নবকুমারকে?

আবার বিয়ে!

তার মানে আবার আর একবার নবকুমারকে নিয়ে সেই নকড়া-ছকড়া খেলা, আবার আর একটা বাড়িতে গিয়ে সেই সম্প্রদান, সেই বাসর, সেই কানমলা, সেই ঘাম।

ঘাড়টা প্রায় পাঁতের সঙ্গে ঠেকে যায় নবকুমারের। মুখ দিয়ে কথাও বেরোয় না, মুখের মধ্যে ভাতের গ্রাস ঢোকে না।

হঠাৎ একসময় কটুক্তি থামিয়ে এলোকেশী বলেন, খাচ্ছিস কই?

খাচ্ছি তো! এতক্ষণে অস্ফুটে একটা কথা বলে নবকুমার এবং বাক্যের সত্যতা রক্ষার্থে এক গ্রাস ভাত ঠেলেঠুসে মুখের মধ্যে চালান দেয়।

এবার সদু বা সৌদামিনীর রঙ্গমঞ্চে আবির্ভাব। মাটির সরায় একসরা ধোয়াওঠা গরম ভাত নিয়ে এসে অবাক গলায় বলে উঠে সে, ওমা, ই কি! যেখানকার ভাত সেখানে পড়ে! এতক্ষণ কি করলি রে নবু?

খাচ্ছি তো! আরও একবার পূর্ব-কথা এবং পূর্বোক্ত কাজের পুনরাবৃত্তি করে নবকুমার।

দিয়ে যাই আর দুটো?

না না, আর নয়। ভরা মুখে হাত মুখ মাথা সব নেড়ে প্রতিবাদ জ্ঞাপন করে নবকুমার।

খিদে নেই?

নবকুমার আর একবার বলে, খাচ্ছি তো।

এদিকে ঠেলে-ওঠা চোখে জল আসতে চায়।

খিদে আর থাকবে কোথা থেকে? এলোকেশী বলে ওঠেন, শ্বশুরের নিন্দে, করেছি যে! একালের ছেলে তো! কিন্তু তোকে আবারও এই বলে রাখছি নবা, তোর দেমাকে-শ্বশুরের ওই খাড়া নাক যদি না খুঁয়ে ঘষটে দিই তো আমি কি বলেছি বাপ বাপ বলে ওই মেয়ে ঘাড়ে করে নাকে খত্ দিতে দিতে আসে তো ভাল, নচেৎ আবার ছাদনাতলায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে তোকে। এবার আর নবাবের বেটী আনব না, গরীব-গুরবো ঘরের মেয়ে নে আসব।

ওই শোন’ সদু হেসে ওঠে, আর মুখ গোঁজ করে থাকবার কিছু নেই রে নবু, আশ্বাস-বাকি পেয়ে গেলি। এখন বড় বড় থাবায় খেয়ে নে। …বৌ এল না বলে মনের দুঃখে নবু অমন সরলপুঁটির টকটাই ভাল করে খেল না, দেখছ মামী?

সব সময় ন্যাকরা করিস নে সদু, এলোকেশী বেজার মুখে বলে, চব্বিশ ঘণ্টা হাসি-মসকরা কার ভালও বা লাগে! প্রাণে কিসের যে এত উল্লাস তাও তো বুঝি না।

.

কথাটা সত্যি।

উল্লাস আসবার কথা সদুর নয়।

তবু আসে।

তবু রং-তামাশা করে সদু, হি-হি করে হাসে। কিন্তু হাসি আসে কি করে সদু নিজেই কি জানে ছাই!

হয়তো এ জগতে একমাত্র ওইটুকুই ওর নিজের এক্তারে আছে বরে আনায়। দুর্ভাগ্যকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে হি-হি করে হেসে বেড়ায় সে বুকের পাথরখানা ঠেলে ফেলে দিতে।

অবিরত ওই পাথরখানা বুকে বইতে হলে কি ঘুরেফিরে আর অসুরের মত খেটে বেড়াতে পারত?

গাঁ-সুদ্ধ সবাই তো ধিক্কার দেয় সদুর ভাগ্যকে, সবাই তো জানে সদুকে বরে নেয় না। অকারণ, শুধু খেয়ালের বশে সদুকে সদুর বর ত্যাগ করেছে। স্বভাবচরিত্র খারাপ তো অনেকেরই থাকে, পরিবারকে ত্যাগ আর কজন করে!

সদুর মা নেই, বাপ নেই, আজন্ম মামার বাড়ি মানুষ। মামা দু-তিনবার চেষ্টা করে করে শ্বশুরবাড়ি রেখে এসেছিল তাকে, কিন্তু কিছুতেই নিজের আসন দখল করতে পেরে উঠল না হতভাগা মেয়েটা। দুর্ব্যবহারের চোটে পালিয়ে আসতে পথ পায় নি।

তদবধি আবার এই মামার বাড়িতেই স্থিতি।

তা ছাড়া উপায় কি?

মামার বাড়িতে আছে, দুবেলা হেঁসেল ঠেলছে, জুতো-চণ্ডী সব নাড়ছে আর মামীর মুখ। খাচ্ছে।

তবু সে হাসে।

বলিহারি!

বলিহারি যাই বাবা!– মামী বলে, পাড়াসুদ্ধ সবাই শুনে শুনে নবকুমারের এখন ধারণা হয়ে গেছে, হাসিটা সদুদির পক্ষে গর্হিত, তাই সে হাসিঠাট্টায় কোনও দিনই তেমন করে যোগ দিতে পারে না। আর আজকের কথা তো স্বতন্ত্রই। আজকের হাসি-ঠাট্টার বিষয়বস্তু তো নবকুমার নিজেই।

দুধটা আনবি, না দাঁড়িয়ে রঙ্গ করবি?

ধমকে ওঠেন এলোকেশী।

ছেলের কোলের গোড়ায় ভাতের থালাটি বসিয়ে দেওয়া ছাড়া আর বেশী নড়াচড়া করেন না এলোকেশী। দ্বিতীয়বার যা কিছু লাগে ‘সদু সদু’ হাঁক। মস্ত সুবিধে, সধু বিধবা পুষ্যি নয়। বিধবা হলে তো এক মহা ঝঞ্ঝাট-রাত্তিরে আঁশ হেঁসেলের ভার দেওয়া যায় না। এক্ষেত্রে আর কোন দ্বিধা দায় নেই। বড় বড় সরলপুঁটির টক সদু তো নিজেও একটু খাবে, অতএব কুটুক বাছুক রাঁধুক।

কর্তা নীলাম্বর বড়য্যের বয়স যাই হোক, রাতে ভাত খাওয়া ছেড়েছেন তিনি অনেক দিন। ঘরের গরুর খাঁটি দুধ দেড়সেরখানেককে মেরে আধসের করে সর পড়িয়ে রাখা হয়, তাতেই বাড়িতে ভাজা টাটকা খই ফেলে গোটা আষ্টেক মনোহরা মেখে আহার সারেন নীলাম্বর।

সে সারা তার সন্ধ্যাহ্নিক সেরে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই হয়। নবু মাস্টারের কাছে পড়ে ফেরার আগেই। আবার তিনি যখন বেড়িয়ে ফেরেন, নবুর তখন অর্ধেক রাত্তির, কাজেই এ বেলায় বাপে ছেলেতে দেখা হয় না। ছেলের যে এই এক বেয়াড়া খেয়াল হয়েছে, ইংরিজি শিখবে! ওই ম্লেচ্ছের ভাষা শিখে কি চতুর্বর্গ লাভ হবে কে জানে, তবু খুব একটা বাধাও দেন নি নবকুমারের স্নেহশীল পিতা। বলেছেন, ইচ্ছে হয়েছে পড়ুক!

আসল নষ্টের গোড়া তো ওই ভবতোষ বিশ্বাসটা। কলকেতা থেকে ইংরিজি শিখে এসে গাঁয়ে এখন ইস্কুল খোলা হয়েছে বাবুর। সকাল-বিকেল দুবেলা ইস্কুল বসায়। গাঁয়ের ছোঁড়াগুলোকে ক্ষ্যাপানোর গুরু। কানে মন্তর দিচ্ছে, ইংরিজি না শিখলে নাকি উন্নতি নেই, শিখে কলকাতায় গিয়ে হাজির হতে পারলে সাহেবের অফিসে মোটা মাইনের চাকরি অবধারিত। ছুটছে সবাই ওর ইস্কুলে চালাকের রাজা ভবতোষ ফাসটু বুক, সেকেন বুক, কত সব শক্ত বই কিনে এনেছে কলকাতা থেকে, তাই থেকে পড়িয়ে পড়িয়ে বিদ্যে-দিগগজ করছে সবাইকে।

বামুনের ঘরের ছেলেগুলো যাচ্ছে শুদুরের কাছে বিদ্যে নিতে! কলি পূর্ণ হতে আর কতই বা বাকি!

তবু ছেলেকে বাধা দেন নি নীলাম্বর, কলির তালেই চলেছেন। শুধু ওই ম্লেচ্ছ-ভাষা-শিখে-আসা জামা-কাপড়গুলো ঘরে তোলে না, পরে কিছু ছোয় না, ছেড়ে হাত-পা ধুয়ে গঙ্গাজল স্পর্শ করে, এই পর্যন্ত।

নবকুমারকে খাইয়ে মামী-ভাগ্নী দুজনে রান্নাঘরে বসে পড়ে খেতে। ওরা তো আর ভাত বেড়ে পিড়ি পেতে খাবে না, কাসি গামলা যাতে তাতে খেয়ে নেবে মাটিতে থেবড়ে বসে। তা এ সময় গল্পটা চলে ভাল। ফি হাত ধমক দিলেও ভাগ্নীকে নইলে চলেও না এলোকেশীর। কথা কইবার সঙ্গী বলতে দ্বিতীয় আর কে?

খাওয়ার পর রান্নাঘর ধোয়ার ভার সৌদামিনীর।

ঘর ধুয়ে পরদিনের জন্যে রান্নার কাঠ গুছিয়ে চকমকি ঠিক করে রেখে কাজ-করা কাপড় কেটে ৩বে শুতে যায় সদু। শোবার জন্যে তার নামে একটা ঘর আছে বটে, বিছানাও আছে বটে, কিন্তু সে ঘরে সে বিছানায় কতটুকুই বা শুতে পায় সে? নীলাম্বর যতক্ষণ না আসেন এলোকেশীকে আগলাতে হয়, কারণ এলোকেশীর বড় ভূতের ভয়।

নীলাম্বর আসার পর তার জল চাই কিনা, তামাক চাই কিনা খোঁজখবর করে তবে সদুর ছুটি। তা সে ছুটিটা প্রায় রাতের আধখানা গড়িয়ে গিয়ে হয়।

অবিশ্যি তার পর বাকী রাতটা সদুকে কে আগলাবে, এ প্রশ্ন ওঠে না। সদু তো সদু! ওকে যদি তা নিয়ে আক্ষেপ প্রশ্ন করো, নিশ্চয় হেসে উঠে বলবে, ভূতই আমায় আগলায়। জানো না– আমি যে শাকচুন্নী!

তবু সদু মামীকে ভালোবেসে মামাকে ভক্তিসমীহ করে, নবকুমারকে প্রাণতুল্য দেখে।

তার এই বত্রিশ বছরের জীবনে ভালবাসার, ভক্তি করবার, স্নেহ করবার জন্যে পেলই বা আর কাকে?

.

ভোরবেলাই ঘুমটা ভেঙে গেল।

কারণ কিছু মনে নেই, তবু যেন মনে হল নবকুমারের, বুকটায় কী একটা পাষাণভার চেপে রয়েছে। যেন আস্ত একটা পাহাড়ই কেউ বুকের ওপর বসিয়ে দিয়েছে কোন্ ফাঁকে! রাত্রে ঘুমের মধ্যেও ছিল যেন কি এক আতঙ্কের স্বপ্ন।

একটুক্ষণ খোলা জানলার দিকে চেয়ে বসে থাকতে সব মনে পড়ল। মনে পড়ল মায়ের শপথবাণী। মনে পড়ে হাত-পা ছেড়ে এল।

ধীরে ধীরে উঠে পড়ল, বেরিয়ে এল ঘর থেকে কেঁচার খুঁটটা গায়ে দিয়ে। ভোরের দিকে বেশ শীত-শীত পড়ে গেছে। আর শরৎকালের সকালের এই গা-সিরসিরে হাওয়াটাই তো কোন উধাও পাথারে মনটাকে ছুটিয়ে নিয়ে যায়।

বাইরে এসে দেখল সৌদামিনী উঠোনে ছড়াঝাট দিচ্ছে। কাছে গিয়ে বলল মা ওঠে নি সদুদি?

মামী। সকালবেলাই হেসে গড়িয়ে পড়ে সৌদামিনী। মামি আবার এমন সময়ে কবে ওঠে রে নবু? ভোর ঠাকুরের সঙ্গে যে মামীর বিরোধী।

খচখচ ঝাঁটা চালাতে চালাতে বলে সদু, সরে দাঁড়া নবু, ধুলো লাগবে।

লাগুক গে। বলে বরং কাছেই সরে এল নবকুমার, কাছে এসে হঠাৎ শীতকালে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ার ভঙ্গীতে বলে উঠল, সদুদি, তুমি মাকে বলে দিও, ওসব পারব-টারব না।

ঝাঁটা বন্ধ হল সৌদামিনীর!

চোখ গোল গোল করে বলল, কি বলে দেব মামীকে? কী পারবি না?

ওই সব! নবকুমার বলে ওঠে, শুনলে তো কাল নিজের কানে, আবার শুধোচ্ছ কেন?

নাঃ, তুই আমায় অথই জলে ফেললি নবু! কালকের দিনভোর কত কথাই তো শুনেছি, কোনটা তোর মনে গিথে আছে, তা কেমন করে বুঝব?

আঃ, আচ্ছা জ্বালায় ফেললে তো! নাপিত পিসির ব্যাপারে রেগে গিয়ে মা যা বলল মনে নেই তোমার?

ও হরি, তাই বল! তোর আবার বিয়ে দেবে, এই কথা তো? ফের সদুর সেই হি-হি হাসি, সেই চিন্তেয় রাতভোর ঘুমুস নি বুঝি? নাকি সেই ঠাকুরঘরে কে, না আমি তো কলা খাই নি তাই? মামী পাছে প্রিতিজ্ঞে বিস্মরণ হয়ে যায় তাই আমি পারব না আমি করব না বলে স্মরণ করিয়ে দিতে এসেছিস?

আঃ সদুদি, ভাল হবে না বলছি। আমি এই তোমায় বলে রাখছি ওসব পারব না। আবার ওই কানমলা-টানমলা–ওরে বাবা!

সদু ফের হাতের কাজে মনোনিবেশ করে বলে, তা আমায় বলে কি হবে? মামীকে বল!

আমি বলব? আমি বলব মাকে?

সদু হাসতে হাসতে বলে, বলবি না কেন? ডাগর হয়েছিস, সাহস হচ্ছে না?

মার কাছে সাহস! হুঁ! এই তোমায় বলছি সদুদি, আমি তোমার কাছে বলে খালাস, যা বিহিত করার তুমি করবে।

সৌদামিনী ফের হাত থামিয়ে বলে, বেশ বলব মামীকে, নবুর আমাদের প্রেথম পক্ষের ওপর বড় আঁতের টান, ওকে ত্যাগ দিয়ে অন্যত্তর বিয়ে করবে না!

সদুদি ভাল হবে না বলছি! বলি, আবার এই সব ভুতুড়ে কাণ্ডর দরকার কি? নাই বা পাঠাল কেউ মেয়ে, পরে ঘরের মেয়ে নইলে বুঝি সংসার চলে না?

কই আর চলে? সদু হাত মুখ নেড়ে বলে, চলে আর এই আদি-অন্তকাল ধরে মানুষে ওই সব ভূতুড়ে কাণ্ড করত না, বুঝলি রে নবু! এর পর ওই পরের মেয়েই জগতের সেরা আপন হবে।

ছাই হবে! ঝোঁকের মাথায় বলে ফেলে নবকুমার, কই, জামাইবাবুর তো হল না।

সদুর উচ্ছাস কমে, একটু গম্ভীর হয়ে গিয়ে বলে, ও-কথা বাদ দে। আমার মতন ছাই-পোরা কপাল যেন অতি বড় শত্রুরও না হয়!

নবকুমার সদুর ভাবান্তরে ঈষৎ থতমত খেয়ে বলে, আমি কিছু ভেবে বলি নি সদুদি। কিন্তু যা বললাম, তোমাকে আমার রক্ষেকত্তা হতে হবে!

বেশ বলব মামীকে, যা দেখেছি দু-ঘা ঝাটা আছে ললাটে।

.

তা সদুর কথা মিথ্যা নয়। এলোকেশী সেই ব্যবস্থাই করেন।

তবে ললাটের-ঝাঁটাটা দৃশ্যমান নয় এই যা। শব্দ অদৃশ্য। তবু এলোকেশী যখন কথার তুবড়ি ছোটান, মনে হয় তার মুখ থেকে আগুনের হলকার মত দৃশ্যমানই কিছু বার হচ্ছে বুঝি!

শাক বাছতে বাছতে কথাটা পেড়েছিল সৌদামিনী, ওগো মামী, তুমি তো বলছ ওরা পশুপাঠ মাত্তর মেয়ে না পাঠালে তুমি ছেলের আবার বিয়ে দেবে, এদিকে ছেলে তো বেঁকে বসে আছে!

কী! কী বললি?

মুহূর্তে অগ্নিকাণ্ড ঘটে গেল।

সদু কেন ভুতো ন ভবিষ্যতি করে গাল দিয়ে ঘোষণা করলেন এলোকেশী, যে আমার খেয়ে আমার পরে আমার সংসার ভাঙবার তাল খুঁজবে, তাকে ঝেটিয়ে দূর করে দেব তা এই বলে রাখছি সদু। আমার ছেলেকে কানে বিষ-মন্তর দিয়ে পর করে নিতে চাস লক্ষ্মীছাড়ি! উঠুক তোর মামা আহ্নিক করে, দেখাচ্ছি মজা!

সদু প্রতিবাদও করে না, নিজের সাফাইও গায় না এবং এ প্রশ্নই তোলে না, তার অপরাধ কোথায়? এমন কি তার মুখ দেখে এই মনে হয়, এই বাক্যবাণের লক্ষ্য বুঝি তার অপরিচিত কেউ!

নীলাম্বর আহ্নিক সেরে উঠে বাইরে তামার কুশিতে সূর্যার্ঘ্য নিবেদন করে কুশিটা মাটিতে উপুড় করে, আর এক দফা সূর্যপ্রণাম সেরে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়াতেই এলোকেশী দুধকলা দিয়ে কালসাপ পোষার নজীর তুলে স্বামীকে অবহিত করিয়ে দিয়ে বলেন, তুমি যদি এই দণ্ডে চিঠি লিখে রওনা করে না দেবে তো আমার মাথা খাবে।

নীলাম্বর আহাহা করে উঠে বলেন, দিব্যি গালাগালির কি আছে। পত্র লিখছি, কিন্তু পাঠাবার কি হবে তাই ভাবছি। নাপতে-বৌ-তো–

কেন গাঁয়ে কি ও ভিন্ন আর মানুষ নেই? রাখাল তো গেছল সেবার?

রাখাল যাবে? কিন্তু অতখানি পথ একেবারে একলা! তাই ভাবছি।

তা হলে গোবিন্দ আচায্যির ছেলে গোপনাকে পাঠাও। গাঁজার পয়সা দিলে রাজী হয়ে যাবে।

গোপনাকে কুটুমবাড়ি পাঠাব! কি বলতে কি বলে আসবে!

আসুক না। এলোকেশী বীরদর্পে বলেন, ওই গেজেলের কটুবাক্যিতে যদি মিনসের চৈতন্য হয়! তার পর দেখি কেমন সোহাগিনী মেয়ে নিয়ে ঘরে বসে থাকতে পারে! গোপনাকে এও বলে দেবে, ওখানে আশেপাশে কুলীনের মেয়ের সন্ধান পায় কিনা দেখে আসতে। নাকের সামনে হলেই ভাল হয়।

নীলাম্বর আর কথা বাড়ান না, কাগজ কলম নিয়ে বসেন। এবং অনেক মুসাবিদান্তে একখানি চিঠির খসড়া করেও ফেলেন।

তাতে এই কথাই বিশদ বোঝানো থাকে, রামকালী যদি পূর্ব জিদ বজায় রাখতে চান, তাঁর কপালে অশেষ দুঃখ আছে। ছেলের তো আবার বিয়ে দেবেনই এঁরা, তা ছাড়া আরও যা করবেন ক্রমশ প্রকাশ্য। রীতিমত ভয় দেখানো চিঠি।

পত্রের ভাব ও ভাষায় এলোকেশী প্রীতিপ্রকাশ করেন। অতএব নীলাম্বর তৎপর হন পাঠাবার চেষ্টায়। কিন্তু মনে তার দুশ্চিন্তা, রামকালীর একমাত্তর মেয়ে সত্যবতী! বেশী টান কষলে দড়ি না ছিঁড়ে যায়।

এত কথার কিছুই নবকুমার জানে না। সে স্কুলে।

বেলায় যখন ফিরল, সদুর কাছে গিয়েই আগে দাঁড়াল। সদুদি, তেল!

সদু পলায় করে তেল এনে ওর হাতে দিয়ে বলে, দেখলি তো, বললাম কাজ কিছু হবে না, শুধু আমার কপালে ঝাটা, তাই হল। তোর শ্বশুরের মৃত্যুবাণ তৈরি, এতক্ষণে বোধ হয় পাঠানোও হয়ে গেল। যদি বা দুদিন দেরি হত, তোর অমত শুনে মামী একেবারে ধেই ধেই।

হাতের তেল আঙুলের ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে পড়ে, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে বেচারা নবকুমার।

সদু বোধ করি ওর মুখভঙ্গী দেখেই করুণাপরবশ হয়ে বলে, যাক গে, তুই আর ও নিয়ে মন উচাটন করিস নে, দিতে হয় আর একবার টোপর মাথায় দিবি। কত আর কষ্ট! তোর একটা বৌ পেলেই হল। তবে মনে নিচ্ছে এবার তালুইমশাই নরম হবে, যতই হোক মেয়ের বাপ!

হঠাৎ নবকুমার একটা বেখাপপা এবং অবান্তর কথা বলে বসে, সায়েবরা শুধু একটা বিয়ে করে, কখনো অনেক বিয়ে করে না।

ব্যস, আর যায় কোথা!

সদুর হাসির ধুম পড়ে যায়। ওমা, তাই নাকি? ও বুঝেছি, ওই সায়েবদের বই পড়ে তোরও সেই বুদ্ধি মাথায় ঢুকেছে! তা হারে নবু, সায়েবরা যদি একটা বৈ বিয়ে করে না তো বাকী মেমগুলোর কী দশা হয়? বিধাতা পুরুষ যখন পৃথিবী ছিষ্টি করেছিল, তখন একটা করে বেটাছেলে আর দেড়কুড়ি করে মেয়েমানুষ গড়েছিল, এ তো জানিস? তা হলেই বল, বাকীগুলোর গতি কে করবে, যদি একটা বৈ বিয়ে না করে?

যত সব আজগুবী! যদিও নবকুমার মার আড়ালে বেশ সশব্দেই কথা বলে, পৃথিবী সুদ্ধ বেটাছেলে বুঝি দেড়কুড়ি করে–

মুখের কথা মুখেই থাকে, রঙ্গস্থলে এলোকেশী দেখা দেন, বলি নবা, চান করতে যেতে হবে কিনা? যখন দুটোয় এক হবে, অমনি হাসি-মস্করা। হ্যাঁলা সদি, তোকেও বলি, ও কি তোর সমবয়সী? তা তো না, রাতদিন কেবল কানে কুমন্তর দেওয়া! রোস, বৌ একটা আসুক না ঘরে, হাঁড়ি গলায় গেঁথে দেবার লোক হোক, তোকে একবারে ঝেটিয়ে বিদেয় করি।

মাতৃ সন্নিধানে নবকুমারের সর্বদাই চোরের ভূমিকা। তাই সদুদির এই অপমানে তার প্রাণটা ছটফটিয়ে উঠলেও মুখ দিয়ে রা ফোটে না। কিন্তু আশ্চর্যের কথা এই, সদুর মুখের রেখায় কোনভাব বৈলক্ষণ্য ফোটে না। সে যথাপূর্বং হাস্যবদনে নবুকে চোখ টিপে ইশারা করে, যার এই অর্থ হয় যা নাইতে যা, মামী ক্ষেপেছে!

হাতের তেল তেলো থেকে সবটাই গড়িয়ে গেছে, তেলালো হাতটাই শুধু মাথায় ঘষতে ঘষতে সোজা কাঁচদীঘিতে চলে যায় নবু। আজ আর যেন খিড়কি পুকুরে মন ওঠে না।

যেতে যেতে হঠাৎ সেই একদিন দেখা শ্বশুরের ওপর ভারী রাগ এসে যায় নবকুমারের। এত ঝামেলার কিছুই তো হত না, যদি সেই মেয়ে না কি পাঠাতেন তিনি!

বুকটায় শুধু পাষাণভারই নয়, যেন কাঁটাও বিধেছে। দূর ছাই!

১৮. সপরিবার তুষ্টু গয়লা

সপরিবার তুষ্টু গয়লা মাঠে এসে বুক চাপড়াচ্ছে আর পরিত্রাহি চেঁচাচ্ছে। তুষ্টুর পরিবার জলে পড়ে কি আগুনে পড়ে এইভাবে লুটোপুটি খাচ্ছে এখান থেকে ওখান।

একরাশ লোক চারিদিকে ভিড় করে হা-হুতাশ করছে, আর কে কবে কোথায় ঠিক এই রকম অথবা এই ধরনের ব্যাপার দেখেছে তারই আলোচনায় বাতাস মুখর করে তুলেছে।

আশ্বিনের রোদে সর্দি-গর্মি হবার কথা নয়, কিন্তু সময়টা বড্ড কড়া। একেবারে ভরদুপুর বেলা। আর ভিজে পান্ত কটা পেটে ঢেলেই মাঠে-জঙ্গলে ঘোরা। মায়েরা তো এটে উঠতে পারে না ছেলেগুলোকে।

ছেলেটা তুষ্টু গয়লার নাতি রঘু। সমবয়সের দাবিতে নেড়ু কোম্পানির দলের একজন। আশ্বিনে আখের ক্ষেত রসে ভরভর, ছেলেগুলোর তাই দ্বিপ্রহরিক খেলা আখ চুরি। উপকরণের মধ্যে একটুকরো ধারালো লোহার পাত। তার পর ক্ষেত থেকে আনার পর তো দাঁতই আছে।

দাঁত দিয়ে ভোলা ছাড়িয়ে মাথাপ্রমাণ লম্বা লাঠিগুলো চিবিয়ে চিবিয়ে রসগ্রহণ করেছে সকলেই, হঠাৎ রঘুর যে কি হল! বুড়ো বটগাছটার তলায় যেখানে বসেছিল সবাই, সেখানেই ধুলো-জঞ্জালের ওপর শুয়ে পড়ল রঘু, যেন নেশাচ্ছন্নের মত।

ছেলেরা প্রথমটা খেয়াল করে নি, আগামী কাল আবার কখন অভিযান চালানো হবে সেই আলোচনাতেই তৎপর হয়ে উঠেছিল, চোখ পড়ল উঠে পড়বার সময়।

কী রে রঘু, তুই যে দিব্যি ঘুম মারছিস? বলল একজন হি-হি হাসির সঙ্গে ঠেলা মেরে। কিন্তু পরক্ষণেই হাসিমুখটা কেমন শুকিয়ে উঠল তার। রঘুর দেহটা যেন শক্ত কাঠমত, রঘুর ঠোঁটের কোণে ফেনা।

এই, রঘুটার কি হয়েছে দেখ তো!

কি আবার হল? বেপরোয়া ছেলেগুলো রঘুর গায়ে হাত দিয়ে প্রথমটা হাসির ফোয়ারা ছোটাল, দেখছিস চালাকি, কি রকম মটকা মেরে পড়ে আছে! এই রঘু, গায়ে কাঠপিঁপড়ে ছেড়ে দেব, ওঠ বলছি!

শুধু গায়ে কাঠপিঁপড়ে নয়, কানে জল, পায়ে চিমটি ইত্যাদি করে ঘুম ভাঙ্গাবার সমস্ত প্রক্রিয়া শেষ করার পর বেদম ভয় ঢুকল ওদের। নিশ্চিত হল, এ ঘুম আর ভাঙবে না রঘুর, এ একেবারে ‘মরণ-ঘুম’। নইলে অমন হলদে রংটা ওর এমন বেগুনে হয়ে উঠবে কেন?

চল পালাই। বলল একজন।

পালাব? নেড়ু রুখে দাঁড়ায়।

পালাব না তো নিজেরাও রঘুর সঙ্গে যমের দক্ষিণ দোরে যাব নাকি? কর্তারা কেউ দেখ আস্ত রাখবে আমাদের?

যা বলেছিস। তুষ্ট ঠাকুর্দা ওই দুই দুধের বাঁক দিয়ে মাথা ফাটিয়ে দেবে।

বাঃ, আমাদের কি দোষ? আমরা কি মেরে ফেলেছি?

তা কে মানবে? বলবে তোদের সঙ্গে খেলছিল, তোরাই কিছু করেছিস। চল্ চল্, কে কমনে দেখে ফেলবে!

নেড়ু ক্রুদ্ধকণ্ঠে বলে, খুব ভাল কথা বলেছিস! বলি রঘু আমাদের বন্ধু না? ওকে শ্যাল-কুকুরে খাবে, আর আমরা পালিয়ে প্রাণ বাঁচাব?

রঘু বন্ধু, এ কথা সকলের মনেই কাজ করছিল, কিন্তু ভয় কাজ করছিল তার চাইতে অনেক বেশী। কাজেই আর একজন বাস্তববাদী এবং ঈশ্বরবাদী বালক উদাসমুখে বলে, ভগবান ওর কপালে যা লিখেছে তাই হবে। আমাদের কি সাধ্যি যে খণ্ডাই!

আর রঘুর মা যখন বলবে, তোদের সঙ্গে খেলতে গেছল রঘু, সে তো বাড়ি ফিরল না। কোথায় সে গেল বাবা? তখন কি বলবি?

বলব আজ রঘু আমাদের সঙ্গে খেলতে যায় নি।

মিছে কথা বলবি?

তা কি করব? বিপাকে পড়লে স্বয়ং নারায়ণও মিছে কথা বলে।

বলে! তোকে বলেছে! নেড়ু তীব্রকণ্ঠে বলে ওঠে, পাহারা দে তোরা ওকে, আমি দেখি গিয়ে মেজকাকা আছেন নাকি!

আর মেজকাকা! যমে ওকে গ্রাস করেছে রে নেড়ু!

তাতে মেজকাকা ডরায় না। জটাদার বৌ তো মরে গেছল বাঁচান নি? কত লোককেই তো বাঁচান। আমি যাব আর আসব। তবে কপালক্রমে যদি দেখা না পাই, তাহলেই রঘুর আশায় জলাঞ্জলি।

অগত্যা রঘুর বাস্তববাদী বন্ধুরা ‘য পলায়তি’ নীতি ত্যাগ করে রঘুর মৃতদেহ পাহারা দিতে সম্মত হল। মায়া কি তাদেরই করছিল না? কিন্তু কি করবে?

.

তারপর এই জলন্ত আগুনের মত সংবাদটাই আগুনের মতই এখান থেকে ওখানে, এঘর থেকে ওঘর, দাউ দাউ করে জ্বালিয়ে দিয়ে গ্রামসুদ্ধ সবাইকে টেনে এনেছে এই বুড়ো বটতলায়।

তারপর চলছে জল্পনা-কল্পনা।

সর্দি-গর্মি?

শরৎকালে?

তা হবে না কেন? শরতের রোদই তো বিষতুল্য। গণেশ তেলির শালীর ছেলেটা সেবার ঠিক এই রকম করে

আর জীবন স্যাকরার ভাইপোটা?

নেপালের ভাগ্নীটাও তো।

আরে বাবা, সে এ নয়, সে অন্য ঘটনা!

আমার পিসশ্বশুরের দেশেও একবার কাঁদের নাকি বুড়ো বাপ ঘাট থেকে আসতে গিয়ে-

সহসা সমুদ্র কল্লোলে স্তব্ধ হয়ে গেল।

কবরেজ মশাই আসছেন!

বাড়ি ছিলেন না, কোথা থেকে যেন ফিরেই শুনে পালকি করেই বুড়ো বটতলায় এসে হাতি হয়েছেন।

শায়িত বালকের দিকে তাকিয়েই চমকে উঠলেন রামকালী, চমকে বললেন, কখন হয়েছে এ রকম?

নেড়ুর দিকে তাকিয়েই বললেন।

নেড়ু সভয়ে ঘটনাটা বিবৃত করল। রামকালী নিচু হয়ে ঝুঁকে ছেলেটার হাতটা তুলে ধরে নাড়ী পরীক্ষা করে নিঃশ্বাস ফেললেন, তারপর আস্তে মুখ তুলে বললেন, কাদের ক্ষেতের আঁখ খেয়েছিলি?

অন্য সব বালকরাই নাগালের বাইরে, নেড়ুই রাজসাক্ষী, তাই নিরুপায় স্বরে গুপ্তকথা প্রকাশ করে, ইয়ে–বসাকদের।

কিছু কামড়েছে বলে চেঁচিয়ে ওঠে নি একবারও?

না তো! নেড়ু অবাক হয়। সমগ্র জনসভা একটি মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে চিত্রাপিত পুত্তলিকাবৎ দণ্ডায়মান। এমন কি তুষ্টরা পর্যন্ত স্তব্ধ হয়ে গেছে, হাঁ করে তাকিয়ে আছে, বোধ করি কোনও একটু ক্ষীণ আশায় বুক বেঁধে।

সর্দি-গর্মি নয়। নিষ্ঠুর নিয়তির মত উচ্চারণ করেন রামকালী, সাপের বিষ!

সাপের বিষ!

একটা সমস্বরে চিৎকার উঠল, কোথায় কোথায় কেটেছে?

কাটে নি কোথাও, সে তো ওর সঙ্গীরাই বলছে। রামকালী নিঃশ্বাস ফেলেন, খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেহে বিষ প্রবেশ করেছে। একটু আগে যদি হাতে পেতাম, চেষ্টা দেখতাম, এখন আর কিছু করবার নেই।

কবরেজ মশাই! হাহাকার করে পায়ে আছড়ে পড়ল তুষ্টু, জগতের সবাইকে জীবন দিচ্ছেন কবরেজ-ঠাকুর, আর আমার নাতিটাকে কিছু করবার নেই বলে ত্যাগ দিচ্ছেন!

রামকালী ডান হাতটা তুলে একবার আপন কপাল স্পর্শ করে বলেন, আমার ভাগ্য।

আপনার পায়ে ধরি ঠাকুরমশাই, ওষুধ একটু দ্যান।

এবার আছড়ে এসে পড়েছে বুড়ী। তুষ্টুর বৌ।

রামকালী কোন উত্তর দেন না, লক্ষ্যহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন জনতার দিকে।

.

কিন্তু সাপের বিষ মানে কি?

আহারের সঙ্গে সাপের বিষ আসবে কোথা থেকে?

সহসা এ কি আকাশ থেকে পড়া বিপর্যয়ের কথা বলছেন কবরেজ মশাই!

তুষ্টুর মত নির্বিরোধী নিরীহ মানুষটার এত বড় মহাশত্রু কে আছে যে, তার বংশে বাতি দেবার সলতেটুকু উৎপাটিত করবে, জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে খাক করবে!

গুঞ্জন উঠছে জনতা থেকে।

কবরেজ মশাই, সাপের বিষের কথা বলছেন? এত বড় শত্রু কে আছে তুষ্টুর?

কেন, ভগবান! তীক্ষ্ণ একটা ব্যঙ্গ-তিক্ত হাসির সঙ্গে কথাটা শেষ করেন রামকালী, ভগবানের বাড়া পরম শত্রু আর মানুষের কে আছে তুষ্ট?

কিন্তু এত সংক্ষিপ্ত ভাষণ বোঝে কে?

বিশদ না শুনতে পেলে ছাড়বেই বা কেন তোক? শুধু সাপের বিষ ফতোয়া জারি করে নিষ্ঠুরের মত নীরব হয়ে থাকলে প্রশ্ন-বিষের দাহে যে ছটফট করবে লোক!

বলতেই হবে রামকালীকে, সাপে কাটল না, তবু তার বিষ এল কোথা থেকে?

কিন্তু উত্তর দিয়ে যে রামকালী বাকশক্তিরহিত করে দিলেন সবাইকে! এ কী তাজ্জব কথা!

আখের ক্ষেতে সাপের গর্ত ছিল, থাকেই এমন।

ঠিক যে আখ গাছটার গোড়ায় সে বিষের থলি, সেই আখটাই তুলে খেয়েছে হতভাগ্য ছেলেটা।

এ কি বলছেন কবিরাজ মশাই!

যা সত্য তাই বলছি। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে কপালের ঘাম মোছেন রামকালী, গম্ভীর কণ্ঠে উচ্চারিত হয়, নিয়তির উপর হাত নেই, আয়ু কেউ দিতে পারে না। তবু তক্ষুনি টের পেলে বিষ তোলার চেষ্টাটা অন্তত করতাম। কিন্তু তা হবার নয়, অদৃশ্য নিয়তি অমোঘ নিষ্ঠুর।

অমোঘ নিয়তি!

তবু উৎসাহী কোন এক ব্যক্তি সাপের বিষ শোনা মাত্রই হাড়িপাড়ায় ছুটে গিয়ে ডেকে এনেছে বিন্দে ওঝাকে।

বিন্দে এসেও ধীরে ধীরে মাথা নাড়ে।

অর্থাৎ সেই এক কথা–আর কিছু করবার নেই!

কিন্তু মরাকে বাচাতে না পারুক, জ্যান্তটাকে তো মারতে পারে বিন্দে। সেই মূল যমটাকে মন্ত্রের জোরে শেষ করে দিক সে। জনমত প্রবল হয়ে ওঠে।

হয়তো এই তীব্র বাসনার মধ্যে অন্য একটা প্রচ্ছন্ন বাসনাও সুপ্ত হয়ে রয়েছে। সন্দে নেই রামকালী কবিরাজ দেবতা, তার বিচার নির্ভুল, কিন্তু এ হেন কৌতূহলোদ্দীপক কথাটার একটা ফয়সালা হওয়া তো দরকার।

বিন্দেকে ঝুলোঝুলি করতে থাকে সবাই।

রামকালী সামান্য বিষণ্ণ হাসি হেসে বলেন, যাচাই করতে চাও?

হায় হায়, আজ্ঞে এ কী কথা! কী বলছেন ঠাকুরমশাই!

যা বলছি তাতে ভুল নেই বাবা সকল। যা হোক, একটা কথা কেউ বললেই সেটা বিশ্বাস করে নিতে হবে, তার কোন হেতু নেই। কিন্তু হতভাগার দেহটার যথাযথ একটা ব্যবস্থা আগে না করে—

বিন্দে মাথা নেড়ে বলে, আজ্ঞে বিষহরির পো যখন কাটেন নি, তখন ওতে আমার কিছু করার নেই। ও আপনার সহজ মিত্যুর হিসেবেই যা করবার করতে হবে।

কিন্তু দেখছ তো বিষে একেবারে নীল হয়ে গেছে!

তা অবিশ্যি দেখছি আজ্ঞে। একেবারে কালকেউটে দংশনের চেহারা। তবু যা কানুন!

বাবা সকল, তোমরা তবে আর বৃথা ভিড় না করে কাজে লাগো। শিথিল স্বরে বলেন রামকালী। রঘুর দিকে আর যেন তাকাতে পারছেন না তিনি। কিন্তু কে এখন কাজে লাগতে যাবে?

এত বড় একটা উত্তেজনা তাদের অধীর করে তুলেছে। সকলে বিন্দেকে ঘিরে ধরে চেঁচাচ্ছে, কড়ি চাল তুই, কড়ি চা! হারামজাদা বেটা সুড়সুড় করে এসে তোর ঝাপিতে ঢুকুক। তারপর তুই আছিস আর তোর বিষপাথর আছে। আছড়ে মেরে ফেল।

তোমরা এত ছেলেমানুষি করছ কেন? সাপটাকে ঠিক পাওয়াই যাবে তার নিশ্চয়তা কি?

পাওয়া যাবে না মানে? আপনি যখন বলছেন–

বিষ তো ঠিক, কিন্তু আখের ক্ষেতটা আমার অনুমান মাত্র, তার আগে জলটল কিছুই যখন খায় নি বলছে–তাই। কিন্তু এখন বিন্দের কীর্তি নিয়ে পড়লে তোমরা তো।

কিন্তু যে যতই ভয়-ভঙ্কিত করুক রামকালীকে, আজকের উত্তেজনা তাকে ছাপিয়ে উঠেছে। যদি আখের গাছের গোড়ায় সাপের বাসা থাকে, সেই খেয়ে জলজ্যান্ত একটা ‘সাদস্যি’ গোয়ালার ছেলে এক দণ্ডে মরে যাবে? তা যদি হয়, সেটা চোখের সামনে যাচাই হোক!

সাপের গর্ত আবিষ্কৃত না হওয়া পর্যন্ত কেউ নড়বে না।

অতএব সমস্ত দৃশ্য যথাযথ রয়ে গেল, রঘুর ব্যবস্থায় কেউ গাও দিল না, বিন্দে ওঝা মহাকলরবে সাপ চেলে আনার মন্ত্র আওড়াতে শুরু করে দিল।

রামকালী চুপ করে দাঁড়িয়েছিলেন, হয়তো বা শেষ অবধি দাঁড়িয়েই থাকতেন, হয়তো বা একসময় চলেই যেতেন, কিন্তু সহসা সেজখুড়ো এসে হাজির হয়ে চাপা গলায় ডাক দিলেন, রামকালী!

খানিক আগে গ্রামের আরও অনেক কাজের লোকের মত সেজকর্তাও একবার এখানে এসে ঘুরেফিরে নানা মন্তব্য করে চলে গেছেন। আবার ফিরে এলেন কোন বার্তা নিয়ে?

না, বার্তাটা বলতে রাজী নন সেজকর্তা।

তবে জরুরী দরকার।

বাড়ি যেতে হবে রামকালীকে।

দ্বিতীয় প্রশ্ন আর করলেন না রামকালী, ধীরে ধীরে সরে এলেন বুড়ো বটতলা থেকে। অকর্মা একদল লোক তখন বিন্দেকে ঘিরে উন্মত্ত হট্টগোল করছে।

ভাবলেন মৃত্যুর কারণ না বললেই হত। মৃত্যু মৃত্যুই। মৃত্যুর কারণ নির্ণয় করতে পারলেই কি তুই নাতিকে ফিরে পাবে? নাকি আততায়ীকে শেষ করে ফেললেই পাবে?

তা পায় না।

তবু মৃত্যুর পর মৃত্যুর কারণ নিয়ে মাথা ঘামায় লোকে। আর খুন হলে নিহত ব্যক্তির হত্যাকারীর ফাঁসি ঘটাবার জন্যে মরণ-বাচন পণ করে লড়ে।

.

আকাশ আর পাতাল, পাহাড় আর সমুদ্র।

কোন পরিবেশ থেকে কোন পরিবেশ।

কিন্তু ঘটনা যাই হোক, রামকালীর অন্তঃপুরেও প্রায় শোকেরই দৃশ্য। দীনতারিণী চোখ মুছছেন, চোখ মুছছেন কাশীশ্বরী, ভুবনেশ্বরী মূৰ্ছাতুরার মত পড়ে আছে একপাশে, মোক্ষদা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন এবং সেজখুড়ী, কুঞ্জর বৌ, আশ্রিতা অনুগতা প্রভৃতি অন্যান্য নারীকুল নিম্নস্বরে রামকালীর জেদ তেজ ও অদূরদর্শিতার নিন্দাবাদ করছেন।

শুধু সারদা সেখানে নেই, সে তদব্যস্তে কুটুমবাড়ির লোকের আহার-আয়োজনে ব্যাপৃত আছে।

তুষ্টু গয়লার নাতির ব্যাপার নিয়ে সারা গ্রাম আজ তোলপাড়, তবে বাইরের কোনো হুজুগে এ বাড়ির অন্তঃপুরিকাঁদের উঁকি দেবার অধিকার নেই, বাদে মোক্ষদা।

মোক্ষদা একবার দেখে এসে স্নান করেছেন, আর যাবেন না। গিয়ে করবেনই বা কি?

সত্যর শ্বশুরের প্রেরিত চিঠি কুঞ্জবিহারী পড়ে দিয়েছেন, আর তার পর থেকেই বাড়িতে এই শোকের ঝড় বইছে।

জামাইয়ের মা-বাপ যদি ছেলের আবার বিয়ে দেয়, মেয়ের মৃত্যুর চাইতে সেটা আর কম কি! পরের মেয়ে-বৌকে উদারতার উপদেশ দেওয়া যায়, তার মধ্যে সতীনের হিংসের পরিচয় পেলে নিন্দে করা যায়, কিন্তু ঘরের মেয়ের কথা আলাদা।

সারাদিনের ক্লান্ত পরিশ্রান্ত দেহ আর তুষ্ট্রর নাতির ওই শোচনীয় পরিণামে ক্লিষ্ট মন নিয়ে বাড়ি ঢুকেই ঘটনাটা শুনলেন রামকালী।

তীক্ষ্ণ তীব্র দুই চোখের মণিতে জ্বলে উঠল দু-ডেলা আগুন। মনে হল ফেটে পড়বেন এখুনি, ধৈর্যচ্যুত হয়ে চিৎকার করে উঠবেন, কিন্তু তা তিনি করলেন না, শুধু ভয়াবহ ভারী গলায় প্রশ্ন করলেন, কে এসেছে চিঠি নিয়ে?

এ সময় মোক্ষদা ভিন্ন আর কার সাধ্য আছে সামনে এগিয়ে যাবার? তিনিই গেলেন। বললেন, এনেছে ওদের ওখানে এক আচায্যিদের ছেলে। গোপেন আচায্যি না কি বলল।

কোথায় সে? চণ্ডীমণ্ডপে?

.

না, খেতে বসেছে।

ঠিক আছে খাওয়া হলে আমার সঙ্গে দেখা করতে পাঠিয়ে দিও। চণ্ডীমণ্ডপে আছি আমি।

মোক্ষদা প্রমাদ গুনে বলেন, তা তুমিও তো আজ সারাদিন নাওয়া-খাওয়া কর নি!

যাক বেলা পড়ে এসেছে, একেবারে সন্ধ্যাহ্নিক সেরে যা হয় হবে।

লোকটা একটু রগচটা আছে, একটু বুঝেসুঝে কথা কয়য়া তার সঙ্গে।

রামকালী ভুরু কুঁচকে বললেন, লোকটা একটু কি আছে?

বলছিলাম রগচটা আছে।

মোক্ষদাকে অবাক করে দিয়ে সহসা হেসে ওঠেন রামকালী, তাতে কি? আমি তো আর রগচটা নই!

.

তা বলেছিলেন রামকালী ঠিকই।

রগ মাথা সবই তিনি খুব ঠাণ্ডা রেখেছিলেন; বুঝিবা অতি মাত্রাতেই রেখেছিলেন; গোপেন আচায্যিকে ডেকে বেয়াইবাড়ির কুশলবার্তা নিয়ে হাস্যবদনে বলেছিলেন, শুনলাম নাকি বেয়াই মশাইয়ের ছেলের বিয়ে! বলো শুনে খুব আনন্দিত হয়েছি। নেমন্তন্ন পেলে উচিতমত লৌকিকতা পাঠিয়ে দেব।

গেজেল গোপেন আচায্যি কটুকাটব্য দূরের কথা, কথা কইতেই ভুলে গেল, হাঁ করে চেয়ে রইল।

খাওয়া-দাওয়া হয়েছে তোমার?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

আজ রাতে তো আর ফিরছ না?

আজ্ঞে না।

বেশ। সকালে জলটল খেয়ে যাত্রা করো।

আজ্ঞে মেয়ে তা হলে পাঠাবেন না?

মেয়ে? কার মেয়ে? কোথায় পাঠাবার কথা বলছ হে?

গোপেন এবার সাহসে ভর করে বলে ওঠে, আজ্ঞে, আজ্ঞে আপনার মেয়ের কথা ছাড়া আপনাকে আর কার কথা বলতে আসব? মেয়ে তাহলে পাঠাবেন না?

আরে বাপু, কোথায় পাঠাব তাই বলো? ভদ্রলোকের মেয়ে ভদ্রলোকের ঘরেই যেতে পারে, যেখানে সেখানে তো যেতে পারে না?

গোপেনের শীর্ণ মুখটা বিকৃত হয়ে ওঠে, বেশ, তবে পত্রে তাই লিখে দিন।

আবার পত্র লিখতে হবে? এই তুচ্ছ কথাটুকু তুমি বলতে পারবে না?

আজ্ঞে না। আমি গেঁজেল-নেশেল মানুষ, আমার কথায় বিশ্বাস করে না করে! এসেছি যখন পাকা দলিলই নিয়ে যাবো/

হুঁ। বলে মিনিটখানেক ভুরু কুঁচকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকেন রামকালী, তার পর বলেন, আচ্ছা তাই হবে। পত্র লিখে রাখব, কাল সকালে রওনা দেবার আগে নিও।

সন্ধ্যা হয়ে গেছে। তবু ধীরে ধীরে বেরিয়ে পড়লেন রামকালী।

না, সন্ধ্যাহ্নিকের পূর্বে হাতমুখ ধুতে ঘাটে গেলেন না, গেলেন বুড়ো বটগাছতলার দিকে। কি করল ওরা দেখা যাক। এতক্ষণ পরে আবার রঘুর চেহারাটা চোখে ভেসে উঠল।

উঃ, নিয়তি কী অকরুণ।

.

বাড়ি থেকে একটু এগিয়ে থমকে দাঁড়ালেন রামকালী।

চলচলিয়ে চোটপায়ে আসছে কে অন্ধকারে? সত্যবতী না?

তুই এখানে একলা যে?

একলা নয় বাবা, নেড়ু এসেছিল, তা ও এখন ফিরল না।

এসেছিলি কেন?

কেন, সেকথা আর শুধোচ্ছ কেন বাবা? সত্য বিষণ্ণ হতাশ কণ্ঠে বলে, রঘুটাকে একবার শেষ দেখা দেখতে।

এভাবে এসে ভাল কর নি। সেজঠাকুমার সঙ্গে এলে পারতে।

সেজঠাকুমার তো আটবার ডুব দেওয়া হয়ে গেছে, আর আসত?

আচ্ছা বাড়ি যাও।

যাচ্ছি।…বাবা—

কি হল? কিছু বলবে?

বলছি—

কি? কি বলতে চাও বলো?

বলছি কোথা থেকে যেন একটা লোক এসেছে না পত্তর নিয়ে?

রামকালী মেয়ের মুখে এ প্রসঙ্গে শুনে অবাক হন। তার পর ভাবেন, মেয়েটা তো চিরকেলে বেপরোয়া। শ্বশুরবাড়ি যাবার ভয়ে বাপের কাছে আর্জি করতে এসেছে। তাই সস্নেহে বলেন, হ্যাঁ,এসেছে তো। তোর শ্বশুরবাড়ি থেকে। তার কি?

বলছিলাম কি– সত্যবতীর কথা বলার আগে চিন্তা আশ্চর্য বটে!

রামকালী মনে মনে হাসেন, শ্বশুরবাড়ি শব্দটাই মেয়েদের এমন!

বলো কি বলছ?

আচ্ছা এখন থাক। তুমি ঘুরে এসো। গুছিয়ে বলবার কথা। রঘুটার মিতদেহ দেখে অবধি মনটা বড় ডুকরোচ্ছে। বাড়ি ফিরে একটু জিরোই।

আচ্ছা। বলে চলে যান রামকালী।

এই অবোধ মেয়ে–একে এক্ষুনি শ্বশুরবাড়ি পাঠানো চলে? অসম্ভব!

.

পাওয়া গেছে পাওয়া গেছে!

বহু কণ্ঠের একটা উন্মত্ত উল্লাসধ্বনি ভেসে আসে কবরেজবাড়ির দিকে, কবরেজ মশাই, পাওয়া গেছে!

কী পেল ওরা? কিসের এত উল্লাস? কোন পরম প্রাপ্তিতে মানুষ এমন উন্মত্ত হয়ে উঠতে পারে? চণ্ডীমণ্ডপের দাওয়া থেকে নেমে এলেন রামকালী। তবে কি হতভাগ্য রঘুর প্রাণটাই ফিনে পাওয়া গেল তুষ্টুর পূর্বজন্মের পুণ্যে? কলিযুগেও ভগবান কানে শুনতে পান?

রঘু কি শুধু অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল?

মৃত্যুর কাছাকাছি অচৈতন্যতার যে গভীর স্তর, সেখানে ডুবেছিল? জটার বৌয়ের মত? রামকালীর নির্ণয় ভুল? তাই হোক, তাই হোক। হে ঈশ্বর, একেবারের জন্য অন্তত তুমি রামকালীর গর্ব খর্ব করো, একবারের মত প্রমাণ করো রামকালীর নির্ণয় ভুল!

.

নাঃ, কলিযুগে ভগবান হাবা কালা ঠুঁটো। রামকালীর গর্ব খর্ব করবারও গরজ নেই তার। রঘুর প্রাণটা ওরা ফিরে পায় নি, পেয়েছে তার প্রাণঘাতককে! ওঝার মন্ত্রচালনার গুণে সাপটা এসে লুটিয়ে পড়েছে মুখে ফেনা ভেঙে। আশ্চর্য! এ এক পরম আশ্চর্য!

সাপটাকে নাকি নিতে চেয়েছিল ওঝা, কাকুতি-মিনতি করে বলেছিল, এমন জাতপাত দৈবাৎ মেলে! কিন্তু জনতার আক্রোশ থেকে রক্ষা করতে পারে নি তার জাতসাপকে। লাঠি দিয়ে আর বাঁশ দিয়ে পিটিয়ে তার গোল চকচকে দেহটাকে ছেচে কুটে চ্যাপটা করে দিয়েছে সবাই।

অপরাধ নিও না মা জগদগৌরী! বলেছে আর পিটিয়েছে।

এখন লম্বা একটা বাঁশের আগায় সেই মরা সাপটাকে ঝুলিয়ে নিয়ে ওরা এসেছে রামকালীর জয়গান করতে। ওঝা বুড়োও তার নিকষ-কালো গুলি পাকানো বেঁটে শরীরটাকে নিয়ে আসছে ছুটে ছুটে বকশিশের আশায়। মোটা বকশিশ কি আর না দেবেন রামকালী? ওঝার সাফল্য যে রামকালীরও সাফল্য!

উল্লাস-চীৎকার-রত এই লোকগুলো যেন একটা অখণ্ড বর্বরতার প্রতীক। ঘৃণায় ধিক্কারে মনটা বিষিয়ে গেল রামকালীর, হাত তুলে ওদের থামতে নির্দেশ দিয়ে ভ্রুকুটি করে বললেন, কী হয়েছে কী? এত স্ফূর্তি কিসের তোমাদের? রঘু বেঁচে উঠেছে?

বেঁচে উঠবে! একজন মহোৎসাহে বলে ওঠে, ভগবানের সাধ্যি কি ওকে বাঁচায়! একেবারে কালনাগিনীর বিষ! কিন্তু ধন্যি বলি কবরেজ মশাই আপনার শিক্ষা! কামড়ায় নি, শুধু

থামো! ধমকে ওঠেন রামকালী, তা ওই নিয়ে এত হৈ-চৈ করছ কি জন্যে? একটা বালক এখনো মরে পড়ে রয়েছে!

সহসা একটা প্রবল আবেগে কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে রামকালী চাটুয্যের, যেমনটা তার বড় হয়। রঘুর এই শোচনীয় মৃত্যুটা বড় লেগেছে রামকালীর। বার বার মনে হচ্ছে, হয়তো সময় থাকতে রামকালীর হাতে পড়লে বেঁচে যেত ছেলেটা।

ভাবতে চেষ্টা করছেন, নিয়তি অমোঘ আয়ু নির্দিষ্ট, এ চিন্তা মূঢ়তা, তবু সে চিন্তাকে রোধ করতে পারছেন না। বিষ-নিবারক ওষুধগুলো তাদের নাম আর চেহারা নিয়ে অনবরত মনে ধাক্কা দিচ্ছে।

আজ্ঞে কর্তা, মা বিষহরি নিলে কে কি করতে পারে? তবে কীর্তি একটা দেখালেন বটে! বলে ওঠে ওঝা বুড়ো, তবে আমাকেও মুখে রক্ত তুলে খাটতে হয়েছে কত্তা! বেটী কি আসতে চায়? একেবারে মোক্ষম মন্তর ঝেড়ে তবে–।

বেশ, শুনে সুখী হলাম। যাও, তোমরা এখন ওটার একটা সঙ্গতি করো গে। সাপ মারলে তাকে শাস্ত্রীয় আচারে দাহ করা নিয়ম, সেই কথাই উল্লেখ করে কথাটা বলেন, তার পর ঈষৎ গাঢ়স্বরে বলেন, আর সেই হতভাগাটারও একটা গতির ব্যবস্থা করোগে। তুষ্টুর একার ঘাড়ে সব দায়টা চাপিয়ে নিশ্চিন্ত থেকো না।

জনতার উল্লাসটা একটু ব্যাহত হয়। এটা কী হল! এমনটা তো তারা আশা করে আসে নি। ভেবেছিল, সাপটা আবিষ্কৃত হয়েছে দেখে নিঃসন্দেহে উফুল্ল হবেন রামকালী, কারণ এটা তার জয়পতাকা বলা চলে। অনেকের মধ্যেই তো একটা অবিশ্বাস উঁকি দিয়েছিল, কবরেজ মশাইয়ের প্রতি অপরিসীম বিশ্বাস সত্ত্বেও।

একেবারে একটা অসম্ভব কথাই যে বলেছিলেন রামকালী। অসম্ভবও যে সম্ভব হয়, এ কথা প্রমাণ করত কে এই সাপটা ছাড়া? অথচ রামকালী যেন নির্বিকার।

ক্ষুব্ধ হল, আহত হল ওরা।

সে ব্যবস্থা কি আর না হচ্ছে কবরেজ মশাই, ওরা বলে, এতক্ষণে বাঁশ কাটা হয়ে গেল বোধ হয়। তবে কথা হচ্ছে সাপের মড়া, ওকে তো ভাসাতে হবে!

না। ভারী গলায় বলেন রামকালী, সাপে কাটে নি। যথারীতি দাহর ব্যবস্থাই করো গে। কতগুলো হৈ-চৈ করো না।

বাঁশ ঘাড়ে করে চলে গেল ওরা, তার পিছনে গ্রাম-বেঁটানো ছেলেমেয়ে ইতরভদ্র। ওদের গমনপথের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ মনে হল রামকালীর, এরা আমাদের আত্মীয়। এই আমাদের প্রতিবেশী! বুনো জঙ্গলে কোন সাঁওতালদের থেকে এমন কি উন্নত এরা? বর্বরতার সুযোগ পেলেই তো মেতে উঠতে চায় সেই বন্য বর্বরতায়! মৃত্যুকে যে একটু শ্রদ্ধা করতে হয়, শ্রদ্ধার লক্ষণ যে নীরবতা, এ বোধের কণামাত্র ও তো নেই এদের মধ্যে।

কর্তা আমার বকশিশটা?

নিকটে সরে এসে হাত কচলায় বিলে বুড়ো।

বকশিশ? রামকালী ভুরুর তীক্ষ্ণতায় কপালে রেখা এঁকে বলেন, বকশিশ কিসের?

আজ্ঞে কত্তা-!

বলছি বকশিশ কিসের? ছেলেটাকে বাঁচিয়েছ?

সে আজ্ঞে মৃত্যুর পর আর বাঁচাবে কে?

হ্যাঁ, আমি তা জানি। শুধু এটাই বুঝতে পারছি না, বকশিশ পাবার দাবিটা কখন হল তোমার?

বেশ, বকশিশ না দ্যান, মজুরিটা তো দেবেন আজ্ঞে! ওঝা এবার রুখে ওঠে।

সেটা দেবে যারা ডেকে এনেছে– শান্ত গম্ভীর কণ্ঠে বলেন রামকালী, আমি তোমায় ডেকে আনি নি।

দশজনের মধ্যে কাকে ধরতে যাব কত্তা, বিন্দে বেজার মুখে বলে, না দ্যান তো চলে যাব। গরীব মানুষ

দাঁড়াও। রামকালী বেনিয়ানের পকেট থেকে নগদ দুটি টাকা বার করে ওর হাতে দিয়ে আরও গম্ভীর গলায় বলেন, শুধু তোমার মজুরি নয়, একটা সাপেরও দাম। দামী সাপটা গেল তোমার!

বুড়ো বিহ্বল দৃষ্টি মেলে অভিভূত কণ্ঠে বলে, আজ্ঞে কী বলছ কত্তা?

যা বলছি ঠিকই বুঝেছ। যাও

কত্তা!

কটা সাপ তোমার ঝাপিতে ছিল বুড়ো? নির্নিমেষ দৃষ্টিতে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রামকালী আস্তে উচ্চারণ করেন কথাটা।

সে দৃষ্টির সামনে কেঁপে ওঠে লোকটা, কাঁদো কাদো গলায় বলে, কত্তা, তুমি অন্তরযামী

বিশ্বাস করছ সে-কথা? আচ্ছা যাও, ভয় নেই।

টাকা অভয় দুটো জিনিস পেয়ে গেছে লোকটা, অতএব আর দাঁড়ায় না। কি জানি ‘অগ্নিমুখ দেবতা’ এক্ষুনি যদি মত পাল্টায়!

রামকালী অদ্ভুত একটা ক্ষোভের দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকেন। এদের তো নিজেদের অজ্ঞতার শেষ নেই, বুদ্ধিহীনতার চরম প্রতীক, তবু অপরের অজ্ঞতা আর মূঢ়তাকে উপজীবিকা করে চালিয়েও চলেছে দিব্যি!

সাপটা সম্বন্ধে সন্দেহ হয়েছিল, কিন্তু ধারণা করেন নি লোকটা এত সহজে স্বীকার পাবে, এক কথায় এমন গুটিয়ে কেঁচো হয়ে যাবে!

মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে একটা বিষণ্ণ বেদনায়। দেহের রোগ সারাবার ভার চিকিৎসকের হাতে, কিন্তু মনের রোগ কে সারাবে? কুসংস্কার, অজ্ঞতা, বোকামি–অথচ তার সঙ্গে সোল আনা কুটিল বুদ্ধি। আশ্চর্য!

.

অন্ধকার হয়ে গেছে। আহ্নিকের সময় উত্তীর্ণ প্রায়, তবু সেই দাওয়ার ধারেই জলচৌকিটার ওপর বসে আছেন রামকালী। খড়মটা পায়ে পরা নেই, পা দুটো আলগা তার ওপর চাপানো। অন্ধকারে খড়মের রূপোর ‘বৌল’ দুটো ঈষৎ চকচক করছে।

বাবা!

চমকে উঠলেন এই অপ্রত্যাশিত ডাকে।

সত্য! তুমি এখানে? ও, আহ্নিকের সময় উত্তীর্ণ হয়ে যাচ্ছে তাই বলতে এসেছ? যাও মা, তুমি ভেতরে যাও।

আমি সে কথা বলতে আসি নি বাবা!

সে কথা বলতে আস নি! তা হলে?

বলছিলাম প্রায় মরীয়ার মতন বলে ফেলে সত্য, বারুইপুরের লোককে, হ্যাঁ করেই দাও না বাবা।

বারুইপুরের!

রামকালী অবাক হয়ে বলেন, হ্যাঁ করে দেব? কি হ্যাঁ করে দেব?

তুমি তো বুঝতেই পারছ বাবা–সত্য কাতর সুরে বলে, আমি আর নিলুজ্জর মত মুখ ফুটে কি বলব!

রামকালী মেয়ের মুখটা দেখতে পান না অন্ধকারে, কিন্তু স্বরটা ধরতে পারেন, তবু বুঝতে সত্যিই পারেন না, সত্য কি বলতে চায়? বারুইপুরের লোকটার চলে যাওয়ার ব্যাপারে হ্যাঁ করতে বলতে চাইছে নাকি? রামকালী তো সে রায় দিয়েছেন। তবে? বাড়ির মেয়েরা বোধ হয় এখনো জেব টানছেন!

সান্ত্বনার গলায় বলেন, ভয় পেও না, শ্বশুরবাড়ি তোমায় যেতে হবে না এখন।

সত্য বোঝে বাবা তার আবেদন ধরতে পারেননি, আর পারার কথাও নয়। সত্যর মতন কোন মেয়েটা আর নিজের গলা নিজে কাটতে চায়? কিন্তু সত্য যে সাতপাঁচ ভেবে তাই চাইছে। হাড়িকাঠের নিচে গলাটা বাড়িয়েই দিচ্ছে। পিসঠাকুমার দল সশব্দে ঘোষণা করেছেন, অহঙ্কারে ধরাকে সরা দেখে রামকালী মেয়ের আখের ঘোচালেন! কুটুমরা রক্তমাংসের মানুষ বৈ তো কাঠ পাথরের নয় যে এত অপমান সহ্য করে বসে থাকবে! ছেলের আবার বিয়ে দেবেই নির্ঘাত, আর রামকালী চিরকাল মেয়ে গলায় করে বসে থাকবেন! গলায় পড়া মেয়ে মানেই হাতেপায়ে বেড়ি!

সত্য ভেবে ঠিক করেছে, বাপ-মায়ের হাতে-পায়ে বেড়ি হয়ে থাকাটা কোন কাজের কথা নয়। তার চাইতে বাপের সুমতি করানোই ভাল।

কিন্তু বাবা তার বক্তব্যই ধরতে পারছেন না।

অতএব আর লজ্জার আবরণ রাখা চলল না। সত্য সকালবেলার চিরেতার জল খাওয়ার মতই চোখ-কান বুজে বলে ফেলল, সে ভয়কে আমি মনে ধরাচ্ছি না বাবা, বরং উল্টো কথাই বলছি। ও তুমি পাঠাবার মন করেই দাও, আমার কপালে মরণ-বাচন যা আছে হবে।

রামকালী স্তম্ভিত হলেন।

এযাবৎ মেয়ের বহু দুঃসাহসের পরিচয় তিনি পেয়েছেন, সে দুঃসাহস পরিপাকও করেছেন। কারণ তার অর্থ হৃদয়ঙ্গম করেছেন, কিন্তু এটা কি? নিজে সেধে শ্বশুরবাড়ি যেতে চাইছে সে?

বয়স্থা মেয়ে নয় যে এ চাওয়ার অন্য অর্থ করবেন, তবে?

কণ্ঠস্বর গম্ভীর হল, হয়তো বা একটু রূঢ়ও, তুমি ইচ্ছে করে শ্বশুরবাড়ি যেতে চাইছ?

যেতে চাইছি কি আর সাধে! বাবার কণ্ঠস্বরে দৃঢ়তার আভাস সত্যর চোখে প্রায় জল এনে ফেলেছে, চাইছি অনেক ভেবেচিন্তে। কুটুমকে চটিয়ে শুধু গেরো ডেকে আনা বৈ তো নয়!

রামকালী বুঝলেন, বাড়িতে এই ধরনের কথার চাষ চলেছে। অবোধ শিশু শিখবেই তো। কিন্তু তাই বলে এতই কি অবোধ যে, বাপের সামনে কোন্ কথা বলতে হয় তা বোঝে না?

কঠিন স্বরে বললেন, আমার গেরোর কথা আমিই বুঝব সত্য, তুমি ছেলেমানুষ, এ নিয়ে ভাববার বা এসব কথায় থাকবার দরকার নেই। এটা বাচালতা।

কিন্তু সত্য তো দমবে না!

হাত ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া সত্যর কোষ্ঠীতে লেখে নি। তাই ম্লান হলেও জোরালো স্বরে বলে, সে তো বুঝছিই বাবা, বাচালতা নির্লজ্জতা, কিন্তু উপায় কি? সমিস্যে যে প্রবল। এর পর যখন তোমাকে আমায় নিয়ে ভুগতে হবে, তখন যে মরেও শান্তি পাবে না। ওরা ছেলের আবার বিয়ে নাকি দেবে বলেছে! সেটা তো অপমান্যি! তুশ্চু একটা মেয়েসন্তানের জন্যে কেন তোমার উঁচু মাথাটা হেট হবে বাবা!

রামকালীর মনে হল প্রচণ্ড একটা ধমকে মেয়েটার বাচালতা ঠাণ্ডা করে দেন, কিন্তু পরক্ষণেই একটা বিপরীত ভাবের ধাক্কা এল! মেয়েটার মনের মধ্যে আছে কি? এতটুকু মেয়ে এত কথা ভাবেই বা কেন? আর এতখানি দুর্জয় সাহসই বা সংগ্রহ করল কোথা থেকে?

বাপের সঙ্গে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার আলোচনা ভূ-ভারতে আর কোনো মেয়ে করেছে কখনো? তাও রামকালীর মত রাশভারী বাপ! মা দীনতারিণী পর্যন্ত যার সঙ্গে সমীহ করে কথা বলেন! তা ছাড়া শ্বশুরবাড়ি শব্দটাই তো মেয়েদের কাছে সাপখোপ বাঘ ভাল্লুক ভূত চোর সব কিছুর চাইতেও ভয়ের। সে ভয়কে জয় করেছে সত্য কোন নির্ভয় মন্ত্রের জোরে?

ঠিক করলেন ধমকে ঠাণ্ডা করবেন না, শেষ অবধি ধৈর্য ধরে শুনবেন ওর কথা। দেখবেন ওর মনের গতির বৈচিত্র্য। রাগের বদলে একটা বিস্মিত কৌতূহল জাগছে।

শান্তগলায় বললেন, মেয়েসন্তান যে তুশ্চ এটা তো তুমি কখনো বলো না?

বলি না, অবস্থাই বলাচ্ছে বাবা। তুশ্চ না হলে আর তাকে সাত-তাড়াতাড়ি পরগোত্তর করে দিতে হয়? একটা সন্তান বলে কথা, তাও তো ঘরে রাখতে পার নি, তবে আর মিথ্যে মায়ায় জড়িয়ে কি হবে বাবা? সেই পরগোত্তরই যখন করে দিয়েছ, তখন আর কি? আজ না হয় কাল  পাঠাতে তো হবেই, বলতে তো পারবে না দেবনা আমার মেয়ে, তবে?

পাঠাবার একটা সময় আছে, নিয়ম আছে, সে তুমি এখন বুঝবে না। ও নিয়ে মিছে মাথা খারাপ করো না। যাও ভেতরে যাও।

ভেতরে নয় যাচ্ছি, কিন্তু মনের ভেতরে তোলপাড় হচ্ছে বাবা। রঘুর মৃত্যু আজ আমার দৃষ্টি খুলে দিয়েছে। ভগবানের রাজ্যেই যখন সময় বাঁধা নেই, নিয়ম নেই, তখন মানুষের থাকবে কি? এই আজ আমাকে পরের ঘরে পাঠাতে বুক ফাটছে তোমার, এক্ষুনি যদি মৃত্যু এসে দাঁড়ায় দিতেই তো হবে তার হাতে তুলে? সহসা আঁচলের কোণ তুলে চোখটা মুছে নেয় সত্য, তার পর ভারী গলায় বলে, তখন তো বলতে পারবে না এখনও সময় আসে নি, নিয়ম নেই? ও শ্বশুরবাড়ি আর যমের বাড়ি দুই যখন সমতুল্যি, তখন আর মনে খেদ রেখো না। পাঠিয়ে দিয়ে মনে করো সত্য মরে গেছে।

আর বোধ করি শক্ত থাকতে পারে না সত্য, নিজের সেই কাল্পনিক মৃত্যুর শোকেই ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।

স্তব্ধ রামকালী সেই ক্রন্দনবতীর দিকে তাকিয়ে থাকেন। মেয়েটা কি শুধুই শেখা বুলি কপচে যায় না সত্যিই এমনি করে ভাবে?

খানিকক্ষণ পরে স্তব্ধতা ভেঙে বলেন, মন-কেমনের কথা আমি ভাবি না সত্য, তুমি বড়দের মত কথা বলতে শিখেছ তাই বলছি, তোমায় পাঠালে আমার মান থাকবে না।

সত্য গভীর দুঃখে হতাশ স্বরে বলে, বুঝি বাবা, বুঝি না কি? কিন্তু এ তো তবু শুধু ওদের কাছে মান থাকা মান যাওয়া! গলবস্তর হয়ে যেদিন ওদের ঘরে মেয়ে দিয়েছ, মান তো সেদিনই গেছে। কিন্তু ওরা যদি তোমার মেয়েকে ত্যাগ দেয়, তা হলে যে দেশসুদ্ধ লোকের কাছে হতমানি। দু’ দিক বিবেচনা করো বাবা।

রামকালীর গলা দিয়ে বুঝি আর শব্দ বেরোয় না, ভাষা স্তব্ধ হয়ে গেছে তার। মেয়েটা কি সত্যি বালিকা মাত্র নয়, ওর মধ্যে কি কোন শক্তির “ভর” হয়? বুদ্ধির শক্তি, বাক্যের শক্তি?

আচ্ছা তুমি যাও, আমি ভেবে দেখছি।

ভাবো। যা পারো আজ রাত্তিরের মধ্যে ভেবে নাও। ওই হতচ্ছাড়াটা তো রাত পোহাতেই বিদেয় হবে।

ছি মা, শ্বশুরবাড়ির লোকের সম্পর্কে কি এভাবে বলতে আছে?

নেই তো জানি বাবা, কিন্তু দেখে যে অপিরবিত্তি আসছে। কুটুমবাড়িতে পাঠাবার যুগ্যি একটা লোকও জোটে নি!

রামকালী ঈষৎ তরল কণ্ঠে বলে উঠেন, তুই তো আমার মুখ হেঁট হবার ভয়ে সারা, কিন্তু শ্বশুররা ত্যাগ না দিয়ে কি ছাড়বে তোকে? দুদিন ঘর করেই তো ফেরত দেবে। তোকে নিয়ে কে ঘর করবে সত্য? এত বাক্যি কে সইতে পারবে?

সত্য সগৌরবে মাথা তুলে বলে, সে তুমি নিশ্চিন্দি থেকো বাবা, সত্যকে দিয়ে তোমার মুখ কখনো হেট হবে না।

রামকালী গভীর স্নেহে মেয়ের পিঠে একটু হাত রাখেন।

মেয়েটা যে কি, তিনি বুঝে উঠতে পারেন না। থেকে থেকে সে যে তীক্ষ্ণ একটা প্রশ্নের মত তার সামনে এসে দাঁড়ায়। যে কথাগুলো বলে, সব সময় সেগুলো মেয়ের শেখা কথা বলে উড়িয়ে দেওয়াও শক্ত। সে সব কথা চিন্তিত করে, বুঝিবা ভীতও করে। তবু রামকালী ওকে বুঝছেন, কিন্তু পৃথিবী কি ওকে বুঝবে?

ও কেন সাধারণ হল না?

পুণ্যির মত, বাড়ির আর পাঁচটা মেয়ের মত? রামকালী তাহলে ওর সম্পর্কে নিশ্চিন্ত থাকতেন। সুখী হতেন।

কিন্তু?

সত্যিই কি সুখী হতেন? সত্য সাধারণ হলে, বোকা হলে, ভোতা হলে? সত্যকে যে তার একটা দামী জিনিস বলে মনে হয়, সেটা কি হত তাহলে? (কবলমাত্র স্নেহের ওজন চাপিয়ে পাল্লাট। এত ভারী করে তুলতে পারতেন?

যাও মা ভেতরে যাও, আহ্নিক করব এবার।

যাচ্ছি– উঠে দাঁড়িয়েই রামকালীর অসাধারণ মেয়ে সহসাই একটা হাস্যকর সাধারণ কথা বলে বসে, ভেতর-দালান পর্যন্ত একটু এগিয়ে দেবে বাবা?

এগিয়ে দেব? কেন রে?

রঘুর দিশ্যটা দেখে অবধি গা-টা কেমন ছমছম করছে বাবা। মেলাই অন্ধকার ওখানটায়।

হ্যাঁ হ্যাঁ চল, যাচ্ছি আমি। কেন যে তুমি গেলে সেখানে! ভাল করো নি। রামকালী কি একটু আশ্বস্ত হলেন? তাঁর নির্ভীক মেয়ের এই ভয়টুকু দেখে?

.

মেলাই অন্ধকারটা পার হয়ে এসে সত্য একবার থমকে দাঁড়াল, তার পর ঝপ করে বলে উঠল, ভাবতে ভুলে যেও না বাবা!

ভাবতে? কি ভাবতে? ও! অন্যমনস্কতা থেকে সচেতনতায় ফিরে আসেন রামকালী, ভেবেছি। পাঠিয়েই দেব তোমায়।

সহসা কান্নায় উথলে উঠল সত্য, আমার উপর রাগ করলে বাবা?

না, রাগ করি নি।

আবার আনবে তো? কান্না অদম্য হয়ে ওঠে।

ওরা যদি পাঠায়। নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলেন রামকালী।

পাঠাবে না বৈকি, ইস্! মুহূর্তে কান্না থামিয়ে উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে সত্য, তুমি ওদের মান রাখছ, আর ওরা তোমার মান রাখবে না? পাছে কুটুম্বর সঙ্গে ‘অসরস’ হয়, আসা-যাওয়া বন্ধ হয়, এই ভয়ে বুক ফেটে যাচ্ছে তবু যেতে চাইছি আমি, বুঝবে না তারা সে কথা?

রামকালী আর একবার চমৎকৃত হলেন।

অতটুকু মগজে এত তলিয়ে ও ভাবে কি করে? তারপর হতাশ নিঃশ্বাস ফেললেন, বোঝবার কথা যদি সবাই বুঝত?

মেয়ের বিয়ে দেবার সময় জামাইয়ের রূপ দেখে নেওয়া যায়, কুল দেখে নেওয়া যায়, অবস্থা দেখে নেওয়া যায়, কিন্তু তার সংসারসুদ্ধ পরিজনের প্রকৃতি তো আর দেখে নেওয়া যায় না!

.

মেয়েকে রামকালী গৌরীদান করেছেন।

পাত্র খোঁজার সময় দীনতারিণী বলেছিলেন, তোমার মোটে একটা মেয়ে, পরের ঘরে কেন দেবে? একটি সোন্দর দেখে কুলীনের ছেলে নিয়ে এসে ঘরজামাই রাখো।

ভুবনেশ্বরীও স্পন্দিতচিত্তে শাশুড়ীর অন্তরালে বসে রায় শোনবার জন্যে হাঁ করে ছিল, কিন্তু রামকালী তাদের আশায় জল ঢাললেন। বললেন, ঘরজামাই? ছি ছি ছি!

কেন? দীনতারিণী বুকের ভয় চেপে জেদের সুরে বলেছিলেন, লোকে কি এমন করে না? লোকে তো কত কি করে মা!

তা বৌমার যে আর ছেলেপুলে হবে এ আশা দেখি না, কুষ্টিতেও নাকি আছে এক সন্তান। তালে তোমার বিষয়-আশয় তো জামাই-ই পাবে, ছোট থেকে গড়েপিটে তৈরি না করলে

রামকালী তীব্র প্রতিবাদে মাকে নির্বাক করে দিয়েছিলেন, রাসু থাকতে, তার ভাইয়েরা থাকতে জামাই বিষয় পাবে এ কথা তুমি মুখে আনলে কি করে মা? ছি ছি।

সত্য কেন বাপের ভাত খেতে যাবে? এমন পাত্রে দেব, যাতে জামাইকে শ্বশুরের বিষয়ে লোভ করতে না হয়।

তা সে কথা রামকালী রেখেছিলেন।

মেয়ের যা বিয়ে দিয়েছিলেন, শ্বশুরের সম্পত্তিতে লোভ করার দরকার তাদের নেই।

বিষয়–আশয় ঢের, সে-ও বাপের এক ছেলে।

শুনেছেন বাপ একটু কৃপণ, তা সে আর কি করা যাবে? সব নিখুঁত কি হয়?

তেমনি যে চাঁদের মত জামাই!

তা ছাড়া পরম কুলীন।

এর বেশী আর কি দেখা যায়?

কিন্তু লোভ কি মানুষ দরকার বুঝে করে? রামকালী কি স্বপ্নেও ভেবেছেন তাঁর পরম কুলীন বেহাই শ্যেনদৃষ্টি মেলে বসে আছেন তার বিষয়ের দিকে? এমন তীব্র লোভ যে রামকালীর অবর্তমান অবস্থাটাই তার একান্ত চিন্তনীয় বিষয়?

রামকালীর চাইতে বছর দশেকের বড় হয়েও, নিজে তিনি চিরবর্তমান থাকবেন এমনই আশা।

এসব জানেন না রামকালী।

শুধু জামাই পাঠচর্চা করছে এটা জেনেছেন, জেনে সন্তুষ্ট হয়েছেন।

ম্লেচ্ছ বিদ্যা বলে হেয় করবেন, এমন সংস্কারাচ্ছন্ন রামকালী নন। শিখুক, ভালই। ম্লেচ্ছদেরই তো রাজত্ব চলছে এখন।

 ১৯. লক্ষ্মীকান্ত বাড়ুয্যে মারা গেলেন

লক্ষ্মীকান্ত বাড়ুয্যে মারা গেলেন।

পুণ্যবান মানুষ, নিয়মের শরীর, ভুগলেন না ভোগালেন না, চলে গেলেন সজ্ঞানে। সকালেও যথারীতি স্নান করেছেন, ফুল তুলেছেন, পূজো করেছেন। পূজো করে উঠে বড় ছেলেকে ডেকে বললেন, তোমরা আজ একটু সকাল সকাল আহারাদি সেরে নাও, আমার শরীরটা ভাল বুঝছি না, মনে হচ্ছে ডাক এসেছে।

বড় ছেলে হতচকিত হয়ে তাকিয়ে থাকে, বোধ করি ধারণাও করতে পারে না, লক্ষ্মীকান্তর শরীর খারাপের সঙ্গে তাদের আহারাদি সেরে নেওয়ার সম্পর্ক কোথায়? আর ‘ডাক’ কথাটারই বা অর্থ কি?

লক্ষ্মীকান্ত ছেলের ওই বিহ্বলতায় হাসলেন। হেসে বললেন, আহারাদি সেরে দুই ভাই আমার কাছে এসে বসবে, কিছু উপদেশ দিয়ে যাব। অবশ্য উপদেশ দেবার অধিকার আর কিছুই নয়, কতটুকুই বা জানি, জগৎকে কতটুকুই বা দেখেছি, তবু বয়সের অভিজ্ঞতা। বধূমাতাদের জানিয়ে দাও গে, রান্না কতকগুলি পদ বাড়িয়ে যেন বিলম্ব না করেন।

বাপ কেবল তাদের খাওয়ার কথাই বলছেন। কিন্তু তাঁর নিজের?

বড় ছেলে রুদ্ধ কণ্ঠে বলে, আপনার অন্নপাক কখন হবে?

এই দেখ বোকা ছেলে, বিচলিত হচ্ছ কেন? আমার আজ পূর্ণিমা, অন্ন নেই। ফলাহার একটু করে নেব, নারায়ণের প্রসাদ। প্রসাদে চিত্তশুদ্ধি, দেহশুদ্ধি।

ছেলে গিয়ে ছোট ভাইয়ের কাছে ভেঙে পড়ল। তার পর অন্তঃপুরিকারা টের পেলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই সমস্ত সংসারে শোকের ছায়া নেমে এল। কেউ অবিশ্বাস করল না, কেউ হাস্যকর বলে উড়িয়ে দিল না, অমোঘ নিশ্চিত বলে ধ্বসে পড়ল।

বাড়ূয্যের সংসার থেকে এ সংবাদ সঙ্গে সঙ্গেই বাইরেও ছড়িয়ে পড়ল, কারণ আগুন কখনো এক জায়গায় আবদ্ধ থাকে না।

মুহূর্তে চারিদিকে প্রচার হয়ে গেল, বাড়ুয্যে যে চললেন!

যেন বাঁড়ুয্যে কোন বিদেশভ্রমণে যাচ্ছেন, নৌকো ভাড়া হয়ে গেছে, সঙ্গীরা প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কোথাও।

.

উঠোনে তুলসীমঞ্চের নীচে লক্ষ্মীকান্তের শেষ শয্যা বিছানো হয়েছে, বালিশে মাথা রেখে দুই হাত বুকে জড়ো করে টানটান হয়ে শুয়ে আছেন তিনি সোজা।

কপালে চন্দনলেখায় হরিনাম, দুই চোখের উপর-পাতায় আর দুই কানে চন্দন মাখানো তুলসীপাতা। বুকের উপর ছোট্ট একটি হাতে-লেখা পুঁথি। লক্ষ্মীকান্তর নিজেরই হাতের লেখা, গীতার কয়েকটি শ্লোক। নিত্য পাঠ করতেন, সেটি সঙ্গে দেওয়া হচ্ছে।

যাত্রাকালে কেউ স্পর্শ করবে না, যাত্রীর নিষেধ। বিছানাটি ছেড়ে আশেপাশে মাথা হেঁট করে বসে আছে ছেলেরা, পাড়ার কর্তাব্যক্তিরা। অন্তঃপুরিকারা আলম্ব ঘোমটায় আবৃত হয়ে বসে নীরবে অশ্রু বিসর্জন করছেন।

মৃত্যুর দণ্ডকাল অতীত না হওয়া পর্যন্ত ডাক ছেড়ে কাঁদা চলবে না, সেটাও নিষেধ। ক্রন্দনধ্বনি আত্মার ঊর্ধ্বগতির পথে বিঘ্ন ঘটায়।

বাঁড়ুয্যে-গিন্নীও সেই নিষেধাজ্ঞা শিরোধার্য করে নিঃশব্দে ডুকরোচ্ছেন।

ঘোষাল এসে দাঁড়ালেন।

কাঁপা গলায় বলে উঠলেন, জনকরাজার মত চললে বাঁড়ুয্যে?

লক্ষ্মীকান্ত মৃদু হেসে মৃদুস্বরে বললেন, বিদেশ থেকে স্বদেশে। বিমাতার কাছ থেকে মাতার কাছে।

তারপর ছেলেদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তারক ব্রহ্ম।”

অর্থাৎ বৃথা কথায় কালক্ষেপ নয়।

নমো নারায়ণায় নমো নারায়ণায়, হরের্নামৈব কেবলম্।

আস্তে আস্তে চোখের পাতা দুটি বুজলেন লক্ষ্মীকান্ত। তুলসীপাতা দুটি ঢেকে দিল দুটি চোখের

নিঃশ্বাসের উত্থান-পতনের সঙ্গে সঙ্গে নামজপ হতে থাকল ভিতরে, যতক্ষণ চলল শ্বাসের ওঠাপড়া।

একসময় থামল।

যাক, বয়স হয়েছিল লক্ষ্মীকান্তর, ভুগলেন না ভোগালেন না, চলে গেলেন, এতে দুঃখের কিছু নেই। অন্তত দুঃখ করা উচিত নয়। মানুষ তো মরবার জন্যেই এসেছে পৃথিবীতে, সেই তার সর্বশেষ, আর সর্বশ্রেষ্ঠ কর্মটি যদি নিপুণভাবে নিখুঁতভাবে করে যেতে পারে, তার চাইতে আনন্দের আর কি আছে?

না, লক্ষ্মীকান্তর মৃত্যুতে দুঃখের কিছু নেই।

তবু নিকট-আত্মীয়রা দুঃখ পায়।

মায়াবদ্ধ জীব দুঃখ না পেয়ে যাবে কোথায়?

কিন্তু নিকট-আত্মীয় না হয়েও একজন এ মৃত্যুতে দুঃখের সাগরে ভাসে, সে হচ্ছে সারদা।

শ্রাদ্ধ উপলক্ষে নতুন কুটুম্বকে নিমন্ত্রণ জানিয়েছে বাঁড়ুয্যের ছেলেরা আর নিয়মভঙ্গ অবধি থাকার আবেদন জানিয়ে রাসুকে নিতে লোক পাঠিয়েছে।

তুলনা হিসেবে বলতে গেলে সারদার মাথায় একখানা ইট বসিয়েছে।

নিয়ে যাবে পরদিন। কথা চলছে সারাদিন।

এ বাড়ি থেকে রামকালী খবর শোনামাত্র একবার দেখা করে এসেছেন, এবং যথারীতি হবিষ্যান্নের যোগাড় পাঠিয়েছেন লৌকিকতা হিসাবে। প্রচুরই পাঠিয়েছেন।

এখন আবার রাসুর সঙ্গে লোক যাবে, শ্রাদ্ধের ‘সভাপ্রণামী’ আর সমগ্র সংসারের ঘাটে ওঠার কাপড়চোপড় নিয়ে। নিয়মভঙ্গের দিন দুপুরে জাল ফেলানো হবে, মাছ যাবে, রাসুর শাশুড়ীদের জন্য সিঁদুর আলতা পান সুপারি যাবে।

এই সব আলোচনাই চলছে সারাদিন।

সারদার মনে হচ্ছে, সবই যেন বড্ড বেশী বাড়াবাড়ি হচ্ছে।

এই যে তার বাবার খুড়ী মারা গেলেন সেবার, কই এত সব তো হয় নি!

যাক, সে কথা যাক।

পয়সা আছে বিলোবে।

কিন্তু সারদার খাস তালুকটুকু না এই উপলক্ষে বিকিয়ে যায়!

রাতে ছাড়া কথা কওয়ার উপায় নেই, স্পন্দিতচিত্তে সংসারের কাজ সারে সারদা, আর প্রহর গোনে।

তবু কুটুমদের একটু আক্কেল আছে, দিনে দিনেই নিয়ে চলে যায় নি, একটা রাত হাতে রেখেছে।

এ বাড়ির খাওয়া-দাওয়া মিটতে রাতদুপুর হয়ে যায়।

তবু একসময় আসে সেই আকাক্ষিত সময়।

দরজায় হুড়কো লাগিয়ে দেওয়া যায় এবার, সমস্ত সংসার থেকে পৃথক হয়ে এসে বসা যায় দুটো মানুষ।

চট করে কথা বলা সারদার স্বভাব নয়

প্রথমটা যথারীতি প্রদীপ উসকোয়, এলাপের শিখার ওপর বাটি ধরে ছেলের দুধ গরম করে, ছেলে হলে দুধ খাওয়ায়, তার পর তাকে শুইয়ে চাপড়ে তার ঘুম সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে এদিকে এসে পা ঝুলিয়ে বসে।

শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলে।

তারপর?

রাসু অবশ্য এ প্রশ্নের জন্য প্রস্তুতই ছিল, তাই নির্লিপ্ত স্বরে বলে, যাওয়া ছাড়া যে উপায় দেখছি না।

উপায় খুঁজে বেড়াচ্ছিলে বুঝি? ব্যঙ্গ-তীক্ষ্ণ সুর।

খুঁজে আর কি বেড়াব? জানি তো ছাড়ান-ছিড়েন নেই!

চেষ্টা থাকলে ছাড়ান। আরও তীক্ষ্ণ হুল ফোঁটায় সারদা।

কি করে শুনি? ঈষৎ উষ্মা প্রকাশ করে রাসু।

শরীর খারাপের ছুতো দেখাতে পারলে কেউ টেনে নিয়ে যেতে পারে না।

রাসু বিরক্তভাবে বলে, সে ছুতোটা দেখাব কি করে শুনি, এই আঁকাড়া দেহখানা নিয়ে?

সারদা এ বিরক্তিতে ভয় পায় না, দমে না। অম্লান বদনে বলে, চেষ্টা থাকলে কি না হয়। বলকা দুধ তোমার ধাতে অসৈরণ, লুকিয়ে সের দু-তিন কাঁচা দুধ চুমুক দিয়ে খেয়ে ফেললেই এখুনি এককুড়ি বার মাঠে ছুটতে হত। অসুখ বলে টের পেত সবাই। গুরুজনের সঙ্গে মিছে কথাও বলা হত না।

তা এটা আর মিছে ছাড়া কি? মিছে কথা না হয়ে, হয় মিথ্যে আচরণ!

নীতিবাগীশ রাসু জোর দিয়ে বলে।

থামো থামো, সারদা তীব্র প্রতিবাদ করে ওঠে, এটুক তো আর কখনো করো না গোসাইঠাকুর! ফটা বটঠাকুরদের বাড়ি থেকে পাশা খেলে দেরি করে ফিরে সদর দিয়ে না ঢুকে খিড়কি দিয়ে ঢোকা হয় কেন শুনি? মেজকাকা মশাই যে সমস্কৃত পড়ার টোল ঠিক করে দিয়েছেন, সেখানে তো মাসের মধ্যে দশ দিন কামাই দাও, সে কথা জানাও ওনাকে? নিত্যিনিয়মে বেরিয়ে এখান-ওখান করে বেড়াও না? আমাকে আর তুমি ধম্ম দেখাতে এস না!

আমি কাউকে কিছু দেখাতে চাই না, বীরপুরুষ রাসু বলে, গুরুজন যা নির্দেশ দেবে মানব, ব্যস।

তা তো মানবেই। সেখানে যে মধু আছে। নতুন বাগানের নতুন ফুল। পাটমহলের পাটরাণী।

বাজে কথা বলো না।

বাজে কথা বটে!

সারদা আর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে, আমার গা ছুঁয়ে প্রিতিজ্ঞে করেছিলে, সে কথা মনে পড়ছে?

পড়বে না কেন? তা আমি তো আর জামাইষষ্ঠীর নেমন্তন্ন খেতে যাচ্ছি না। যাচ্ছি একটা মান্যমান লোকের শ্রাদ্ধয়।

তার সঙ্গে আমারও শ্রাদ্ধ-পিণ্ডির ব্যবস্থা হচ্ছে, অন্তরেই জানছি। এবার নিঘঘাত তারা মেয়ে পাঠাবার কথা কইবে।

রাসু তেড়ে ওঠার ভান করে বলে, তোমার যেমন কথা! নিজে থেকে কেউ মেয়ে পাঠাবার কথা বলে?

বলে বৈকি। ক্ষেত্তর বিশেষে বলে। সতীনের ওপরে পড়া মেয়ের কথায় বলে।

বলি তার ঘরবসতের বয়েসটা হবে, তবে তো? তুমি যেন রাতদিন দড়ি দেখে ‘সাপ’ বলে আঁতকাচ্ছ।

বয়েস! সারদা তীব্র ঝঙ্কারে বলে ওঠে, মেয়েমানুষের বয়েস হতে আবার কদিন লাগে? দশ পেরোলেই বয়স। আর মেজকাকা মশাইয়ের কড়াকড়ির জারিজুরি তো ভেঙে গেল। নিজের মেয়েকেই যখন বয়েস না হতেই পাঠালেন!

গুরুজনের কাজের ব্যাখ্যান করো না। কারণ ছিল তাই এ কাজ করেছেন

সারদা দুর্বার, সারদা অদম্য।

সেও সমানে সমানে জবাব দেয়, তা তোমার দ্বিতীয় পক্ষকে শ্বশুরঘর করতে নিয়ে আসারও একটা কারণ আবিষ্কার হবে। তবে এই জেনে রাখো, নতুন বৌ যদি আসে, সেও এক দোর দিয়ে ঢুকবে, আমিও আর এক দোর দিয়ে দড়ি-কলসী নিয়ে বেরিয়ে যাব।

অস্ত্রটা মোক্ষম।

রাসু এবার কাবু হয়।

আপসের সুরে বলে, আচ্ছা অত পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে দুঃখু ডেকে আনবার কি দরকার তোমার বলো তো? যাচ্ছি দাদাশ্বশুরের শ্রাদ্ধয়, খাব মাখব চলে আসব, ব্যস! আমি কি কাউকে আনতে যাচ্ছি?

তা সে। মনে রাখলেই হল।

সারদা সহসা রাসুর একটা হাত টেনে নিয়ে ঘুমন্ত ছেলের মাথায় ঠেকিয়ে দিয়ে বলে, তবে সত্যি করে যাও সেকথা!

আ ছি ছি! কি মতিবুদ্ধি তোমার! ছেলের মাথায় হাত দিয়ে

সারদা অকুতোভয়ে বলে, তাতে ভয়টা কি? আমায় বলো না খোকার মাথায় হাত দিয়ে দিব্যি করতে– জীবনে কক্ষনো পরপুরুষের দিকে চোখ তুলে চাইব না, একশ বার সে দিব্যি করব।

চমৎকার বুদ্ধি! সেটা আর এটা এক হল?

কেন হবে না? আমি ছাড়া জগতের আর সকল মেয়েমানুষকে পরস্ত্রী ভাবলে কোন কষ্ট নেই!

বাঃ, যাকে অগ্নিনারায়ণ সাক্ষী করে গ্রহণ করলাম-

ও! সারদা ঝট করে উঠে দাঁড়ায়। দরজার খিলটা খুলে ফেলে, কপাট ধরে দাঁড়িয়ে চাপা অথচ ভয়ঙ্কর একটা শব্দে বলে ওঠে, ও বটে! এতক্ষণে প্রকাশ পেল মনের কথা! তা এতক্ষণ না ভুগিয়ে সেটা বললেই হত! আচ্ছা–

রাসুও অবশ্য এবার ভয় পেয়েছে, সেও নেমে এসে বলে, আহা, তো কপাট খুলছ কেন? যাচ্ছ কোথায়?

যাচ্ছি সেইখানে, যেখানে খলকাপট্য নেই, আগুনের জ্বালা নেই। বলে ঝট করে বেরিয়ে পড়ে অন্ধকারে মিশিয়ে যায় সারদা।

নাঃ, আর কিছু করবার নেই!

নিরূপায় ক্ষোভে কিছুক্ষণ উঠেনের সেই গভীর রাত্রির নিকষ অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থেকে নিঃশব্দে কপাটটা ভেজিয়ে দিয়ে খাটের ওপর বসে পড়ে রাসু।

ঘাম গড়াচ্ছে সর্বাঙ্গ দিয়ে।

গরমে নয়, আতঙ্কে।

কিন্তু করবার কি আছে এখন? ঘর থেকে বেরিয়ে তো আর বৌ খুঁজে বেড়াতে পারবে না রাসু, মা-খুড়ীর ঘুম ভাঙিয়ে দুসংবাদটা জানাতেও পারবে না!

নিজের হাতে যদি করণীয় কিছু থাকে তো সে হচ্ছে নিজের হাতটা মুঠো পাকিয়ে নিজের মাথায় কিল মারা।

২০. এলোকেশী দাওয়ায় পাটি পেতে

এলোকেশী দাওয়ায় পাটি পেতে বসে বৌয়ের চুল বেঁধে দিচ্ছেন। দিচ্ছেন অনেকক্ষণ থেকেই। সেই দুপুরবেলা বসেছিলেন– এখন বেলা প্রায় গড়িয়ে এল।

এলোকেশী যেন পণ করেছেন আজ তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ শিল্পকীর্তি দেখিয়ে ছাড়বেন। বৌকে সামনে রেখে তার পিছনে হাঁটু গেড়ে উঁচু হয়ে বসেছেন তিনি, মুখের ভাব কঠিন কঠোর।

ওদিকে টানের চোটে সত্যবতীর রগের শির ফুলে উঠেছে, চুলের গোড়াগুলো মাথার চামড়া থেকে উঠে আসতে চাইছে, ঘাড় অনেকক্ষণ আগে থেকেই টনটন করতে শুরু করেছে, এখন মেরুদণ্ডের মধ্যেও একটা অস্বস্তি শুরু হচ্ছে।

অথচ তার কেশকলাপ নিয়ে যে অপূর্ব শিল্প-রচনার চেষ্টা চলেছে, আশা হচ্ছে না সহজে তার সমাপ্তি ঘটবে।

কিন্তু কেবলমাত্র এলোকেশীর অক্ষমতাকেই দায়ী করলে অবিবেচনার কাজ হবে, দায়ী অপরপক্ষ। সত্যবতীর চুলগুলো যেন বেয়াড়া ঘোড়া, কোনমতেই তাকে বাগ মানিয়ে বশে আনা যাচ্ছে না।

ঝুলে খাটো আর আড়ে ভারী চাপ চাপ কোঁকড়া কোঁকড়া চুলগুলো খোলা থাকলে যতই সুন্দর দেখাক, তাকে বেণীর বন্ধনে বেঁধে কবরীর আকৃতি দিতে গেলেই মুশকিলের একশেষ। গোড়া বাধতে গেলে ফসফস করে এলিয়ে খুলে পড়ে, কোনরকমে যদিবা তিনগুছির ফেরে ফেলা যায়, পাঁচগুছি নগুছির দিকেও যাওয়া চলে না।

কিন্তু এলোকেশী আজ বদ্ধপরিকর, সাতগুছির বাঁধনে বেঁধে ‘কল্কা খোঁপা’ করে দেবেন, তাই বারতিনেক অসাফল্যের পর একগোছা মোটা মোটা কালো ঘুনসি দিয়ে চুলের গোরা নিয়ে টেনে ব্রহ্মতালুতে জড় করে এনে প্রাণপণ বিটকেলে বেঁধে ফেলেছেন, এবং সাতগুছির সাত ভাগকে করতে চেষ্টা করছেন।

দীর্ঘস্থায়ী এই চেষ্টায় সত্যবতীর অবস্থা উপরোক্ত। অনেকক্ষণ বাবু হয়ে বসে থাকার পর এবার হাঁটু দুটো মুড়ে বুকের কাছে জড়ো করে বসেছে সত্যবতী, কারণ পায়ে ঝিঝি ধরেছিল। মুখটা সত্যবতীর আকাশমুখো আর সেই মুখের ওপর পরনের নীলাম্বর শাড়িখানার আঁচলটুকু চাপা দেওয়া।

মুখে আঁচল চাপা না দিয়ে উপায় নেই, কারণ চুল বাঁধবার সময় ঘোমটা দেওয়া চলে না। অথচ জলজ্যান্ত আস্ত মুখোনা খুলে বসে থাকলেও তো চলে না। না-ই বা ধারেকাছে কেউ থাকল আর হলই বা শাশুড়ী পিছনে বসে, তবু নতুন বৌ বলে কথা। তাই আঁচলটা তুলে মুখে চাপা দিয়েছে সত্যবতী। মানে দিতে বাধ্য হয়েছে। ঘোমটা খসবার আগেই এলোকেশী নির্দেশ দিয়েছেন, আঁচলটা মুখে ঢাকা দাও দিকি বাছা! তোমার তো আর বোধ-বুদ্ধির বালাই নেই, অগত্যে সবই স্পষ্ট করে বলে দিতে হবে আমায়।

.

দিনটা কি তবে সত্যবতীর শ্বশুরবাড়ি বাসের প্রথম দিন?

না তা নয়, এসেছে সত্যবতী প্রায় মাসখানেক হয়ে গেল, কিন্তু মাথাটা ওর এ পর্যন্ত শাশুড়ীর হাতে পড়ে নি। সৌদামিনীই চুল বেঁধে সরময়দা মাখিয়ে আলতা পরিয়ে নতুন বৌয়ের প্রসাধন আর যত্নসাধন করছিল কদিন! হঠাৎ আজ এলোকেশীর নজরে পড়ল বৌয়ের চুল বেড়াবিনুনি করে বাঁধা।

দেখে রাগে জ্বলে উঠলেন এলোকেশী। তবু নিশ্চিন্ত হবার জন্যে ভুরু কুচকে ডাক দিলেন, এদিকে এস দিকি বৌমা!

শাশুড়ীর সামনে কথা বলাও নিষেধ, মুখ খোলাও নিষেধ, সত্যবতী নীরবে কাছে এসে দাঁড়াল।

ঘোমটা অবশ্য বজায় থাকলই, এলোকেশী হ্যাঁচকা একটা টানে পুত্রবধূর পিঠের কাপড়টা তুলে খোঁপাটা দেখে নিলেন। ঠিক বটে, বেড়াবিনুনিই বটে।

তেলে-বেগুনে জ্বলে ডাক দিলেন, সদু! সদি!

যাকে বলে ত্রস্তেব্যস্তে সেইভাবে ছুটে এল সৌদামিনী। দেখল নতুন বৌ বুকে মাথায় এক হয়ে ঘাড় হেঁট করে দাঁড়িয়ে, আর মামী তার পিঠের কাপড় উঁচু করে তুলে ধরে দণ্ডায়মান। মামীর নয়নে অগ্নিশিখা; কপালে কুটিলরেখা।

কি বলছ এ প্রশ্ন উচ্চারণ করল না সৌদামিনী, শুধু শঙ্কিত দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে রইল।

কি হল বৌয়ের পিঠে?

কোন জড়ল চিহ্ন, না কোন চর্মরোগের আভাস, নাকি বা কোন পুরনো ক্ষতের দাগ! অর্থাৎ নতুন বৌ কি ‘দাগী’! আর মামীর শ্যেনদৃষ্টির সামনে ধরা পড়ে গেছে সেটা!

অবশ্য ভুল ধারণা নিয়ে বেশীক্ষণ থাকতে হল না সৌদামিনীকে, এলোকেশী প্রবল স্বরে বলে উঠলেন, বলি সদি, এমন ব্যাপার ঠেলার কাজ কি না করলেই নয়?

বুক থেকে পাথর নামে সৌদামিনীর।

যাক বাচা গেল।

নতুন কিছু নয়। সেই আদি ও অকৃত্রিম লক্ষ্য।

অতএব সাহসে ভর করে বলল, কি হল?

কি হল! বলি শুধোতে লজ্জা করল না? ধম্মের ষাঁড়ের মতন আঁকাড়া গতর নিয়ে দুবেলা ভাতের পাথর মারছিস, আর গতরে হাওয়া দিয়ে বেড়াচ্ছিস, একটু হায়া আসে না প্রাণে? দশটা নয় বিশটা নয় একটা ভাই-বৌ, তার চুলটা বেঁধে দিয়েছিস এত অচ্ছেদ্দা করে! বলি কেন? কেন? এত

হলটা কি তা বলবে তো?

সহজ গলায় বলে সৌদামিনী। আর সত্যবতী ঘোমটার মধ্যে থেকে অবাক হয়ে প্রায় থরথর করে কাঁপতে থাকে। না, এলোকেশীর কটু-ভাষণে নয়, গিন্নীদের মুখে এরকম বিচ্ছিরি বিচ্ছিরি কথা শোনার অভ্যাস পাড়াবেড়ানি সত্যর আছে। রামকালী চাটুয্যের বাড়ির কথাবার্তাগুলো কথঞ্চিত সত্য, নইলে তারই সেজপিসি সাবিপিসির বাড়ি সর্বদা এই ধরনের কথার চাষ। সেজন্যে না। এলোকেশীর কটুভাষণে না অবাক হয় সৌদামিনীর সহ্যশক্তি দেখে। এত অপমানের পর ওই রকম সহজভাবে কথা বলল ঠাকুরঝি!

এটা সত্যবতীর অদেখা।

কটু কথার পরিবর্তে হয় কটু কথা, নয় ক্রন্দন, এই দেখতেই অভ্যস্ত সে! আর ঠাকুরঝি কিনা! বলছে হলটা কি তা বলবে তো?

এলোকেশী অবশ্য অবাক হন না, কারণ সৌদামিনীর এই সহ্যশক্তি তার পরিচিত। তবে তিনি তো আর প্রশংসায় উদ্বেল হন না, বরং এটা তার মামীর প্রতি অগ্রাহ্য ভাব বলেই রেগে জ্বলে যান।

এখনো তাই বললেন, হলটা কি তা বলে তবে বোঝাতে হবে? মনে মনে জানছ না? চোখে দেখতে পাচ্ছ না? এ কী ছিরির চুল বাধা হয়েছে? বৌয়ের মাথায় বেড়া-বিনুনি! ছি ছি, এতখানি বয়েস হল, কখনো শ্বশুরবাড়ির বৌয়ের মাথায় বেড়া-বিনুনি দেখি নি! গলায় দড়ি তোর সদু, গলায় দড়ি যে একটা মাত্তর মাথা, তাও একখানা বাহারি খোঁপা বেঁধে দিতে পারিস না!

সদু হেসে ওঠে, বৌয়ের চুল যা বাহারি, ওতে আর বাহারি খোঁপা হয় না। বাগ মানানোই যায়।

বাগ মানানো যায় না! এলোকেশী ঝঙ্কার দিয়ে ওঠেন, আচ্ছা, দেখব কেমন না যায়। এই বড়য্যে-গিন্নীর কাছে জব্দ হয় না এমন কোন বস্তু জগতে আছে দেখি! ত্রিজগতের মধ্যে বাগ মানাতে পারলাম না শুধু এই তোমাকে।

বেশ তো মামী, তুমি নিজে হাতেই বৌকে সাজিও না, তোমার একটা মাত্তর বেটার বৌ! বলে সৌদামিনী।

আর এলোকেশী আরও ধেই ধেই করে ওঠেন, কি বললি সদি? এ্যা! এত আসপদ্দা! মুখে মুখে জবাব! এত অহঙ্কার তোর কবে চূর্ণ হবে, কবে তোর দুঃখে শ্যালকুকুর কাঁদবে, সেই আশায় আছি আমি। এই তোকে দিব্যি দিলাম সদি, যদি আর কোনদিন তুই আমার বো’র চুলে হাত দিবি!

গুরুজনের দিব্যি গায়ে লাগে না– এ মানলে কি চলে গা? সদু অম্লানবদনে বলে, তোমার হল গে মন-মর্জি, কোনদিন দেবে, কোনদিন বা ভুলে যাবে–

কী বললি! কী বললি লক্ষ্মীছাড়ি! আমার একটা বেটার বৌয়ের কথা আমি ভুলে যাব?

তা তাতে আর আশ্চয্যি কি মামী! সদু নিতান্ত অমায়িক মুখে বলে, তোমার সে গুণে কি ঘাট আছে? আপনার খিদের খাওয়া, তাই তো অর্ধেক দিন ভুলে যাও, ডেকে খাওয়াতে হয়।

এলোকেশী সহসা থতমত খান এটা ঠিক কোন ধরনের কথা ধরতে পারেন না অভিযোগ না প্রশস্তি?

তাই ভারীমুখে বলেন, হ্যাঁ, আমি ভুলে থাকছি আর রোজ তুমি আমায় ডেকে তুলে ঝিনুকে করে গিলিয়ে দিচ্ছ।

আহা তা না দিই, তোমার কি খেয়াল থাকে?

না থাকে না থাক। বৌয়ের চুল আজ থেকে আমি বাঁধব এই বলে রাখছি। ওর চুলের দড়ি কাটা সব আমার ঘরে রেখে যাবি। পাখী-কাঁটাগুলো দিতে ভুলবি না।

দেব, দিয়ে যাব। তা বৌয়ের বাবা যে সোনার চিরুনি, সাপকাটা, বাগান ফুল ইত্যাদি করে একরাশ মাথার গহনা দিয়েছেন, সেগুলোই বা বাক্সয় পুরে রাখছ কেন? সব বার করে বাহার করে দিও!

সে আমি কি করব না করব তোমার কাছে পরামর্শ নিতে আসব না! অনবরত খালি চ্যাটাং চ্যাটাং কথা! ভগবান যে কেন কঠিন রোগ দিয়ে তোর বাকশক্তি হরণ করে নেন না তাই বি। তুই জনোর শোধ বোবা হয়ে বসে থাক, আমি নিসিংহতলা’য় ভোগ চড়াই।

দোহাই মামী, ওসব মানত-টানত করতে যেও না। দেব-দেবীরা এক শুনতে আর এক শুনে বসে থাকে, হয়ত বোবার বদলে ঠুটো করে দেবে, তখন মরবে তুমি লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে।

কী বললি! তুই ঠুটো হয়ে বসে থাকলে আমার সংসার অচল হয়ে যাবে? সাধে বলি অহঙ্কারে পাঁচ-পা তোর। আমার সংসার আমি চালাতে পারি নে ভেবেছিস? বা হাতের কড়ে আঙুলে পারি। কিন্তু সে আঙুলই বা আমি নাড়ব কেন? ভাতকাপড় দিয়ে তোকে পুষছি যখন!

আহা, আমিও তো তাই বলছি গো। ঠুটো হলেও তো ভাত-কাপড়টা দিতেই হবে।

হবে! দায় পড়েছে। ঠ্যাং ধরে টেনে পগারে ফেলে দেব।

সর্বনাশ মামী, ও বুদ্ধি করতে যেও না, পাড়াপড়শী তাই সেই পণে শাক তুলে এনে তোমাদের গালে মুখে মাখাবে। বলে হাসতে হাসতে চলে যায় সৌদামিনী সত্যবতীকে স্তম্ভিত করে রেখে।

বড় সংসারের মেয়ে সত্যবতী, তার এতটুকু জীবনে অনেক চরিত্র দেখেছে, এরকম আর দেখেনি।

.

যাক, সকালের সেই ঘটনার পরিণামে আজ দুপুরের এই মল্লযুদ্ধ।

সত্যিই বড় ভারী চুলের গোড়া সত্যর, অথচ এদিকে ঝুলে খাটো! এক গোছা কালো ঘুসি দিয়ে কষে বেঁধে আর গোছা গোছা ঘুনসির ভেজাল মিশিয়ে বেণী দুটো যদিবা লম্বা করলেন এলোকেশী, তাদের প্রজাপতি ছাদে পাক খাওয়াতে গিয়েই গোড়াসুদ্ধ ঢিলে হয়ে নেমে এল। সত্যবতীর কপালের ফের, ঠিক সেই মুহূর্তেই সত্যবতী বোধ করি পিঠের খিল আর পায়ের ঝিঝি ধরা কমাতে একটু নড়েচড়ে বসল।

ব্যাপারটা হল পাত্ৰাধার তৈল কি তৈলাধার পাত্রের মতই। বন্ধনটা ঢিলে হয়ে পড়ার জন্যেই মুক্তির সুখে নড়েচড়ে বসল সত্যবতী, না নড়েচড়ে বসার জন্যেই বেণী বন্ধনমুক্ত হয়ে গেল সেটা বোঝা গেল না। এলোকেশী দেখলেন বৌ নড়ল, চুল খুলল।

এলোকেশী পাথরের দেবী নন, রক্তমাংসের মানুষ, এরপরও যদি তাকে ঠাণ্ডা মাথায় সহজভাবে বসে থাকতে দেখবার আশা করা যায়, সে আশাটা পাগলের আশা। পাগলের আশা পূরণ হয় না, হবার নয়।

এতক্ষণের পরিশ্রম পণ্ড হওয়ার রাগে, আর সৌদামিনীকে নিজের শিল্পপ্রতিভা দেখিয়ে দেবার আশাভঙ্গে, দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য এলোকেশী সহসা একটা অভাবিত কাজ করে বসলেন। বৌয়ের। সেই খিল-ছড়ানো সিদে পিঠটার ওপর গুম করে একটা গোলগাল কিল বসিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন, হল তো! গেল তো গোল্লায়! এক দণ্ড যদি সুস্থির

কিন্তু কথা এলোকেশীকে শেষ করতে হল না, মুহূর্তের মধ্যে আর এক প্রলয় ঘটে গেল। শাশুড়ীর হাত থেকে চুলের ভার এক হ্যাঁচকায় টেনে নিয়ে সত্যবতী ছিটকে দাঁড়িয়ে উঠল, আর শাশুড়ীর সঙ্গে যে কথা কওয়া নিষেধ সে কথা সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়ে দৃপ্তস্বরে বলে উঠল, তুমি আমায় মারলে যে!

কিলটা বসিয়ে চকিতে হয়তো একটু অনুতপ্ত হয়েছিলেন এলোকেশী, কিন্তু সে অনুতাপের অনুভূতি দানা বাঁধবার আগেই এই আকস্মিক বিদ্যুতাঘাতে এলোকেশী প্রথমটা যেন পাথর হয়ে গেলেন। বৌয়ের কণ্ঠস্বর কেমন সেটা জানবার সুযোগ এ পর্যন্ত হয় নি এলোকেশীর, কেননা তার সঙ্গে তো বটেই, তাঁর সামনেও কোনদিন বৌ কথা কয় নি। কইবার রেওয়াজও নেই। কোনও প্রশ্ন করলে শুধু ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ-না জানিয়েছে। কথা যা সে সদুর সঙ্গে। কিন্তু সেও তো নিভৃতে। রাত্রে সৌদামিনীর কাছেই শোয় বৌ, কারণ ডাগরটি না হলে তার ঘর-বরের প্রশ্ন ওঠে না।

না, কোন ছলেই সত্যর কণ্ঠস্বর এলোকেশীর কানে আসে নি, সহসা আজ সেই স্বর বাজের মত এসে কানে বাজল।

এ কী জোরালো গলা বৌ-মানুষের!

এতটুকু একটা মানুষের।

অনুতাপের বাষ্প ধুলো হয়ে উড়ে গেল।

এলোকেশীও দাঁড়িয়ে উঠলেন। চেঁচিয়ে তেড়ে উঠলেন, মেরেছি বেশ করেছি। করবি কি শুনি? তুইও উল্টে মারবি নাকি?

সত্য তখন এলোকেশীর অনেক পরিশ্রমে গড়া সাতগুছির বেণী দুটোর মধ্যে আঙুল চালিয়ে চালিয়ে জোরে জোরে খুলে ফেলতে শুরু করেছে। মাথায় কাপড় নেই, মুখের আঁচল খসেছে, সেই মুখে আগুনের আভা।

এলোকেশীর কথায় একবার সেই আগুনভরা মুখটা ফিরিয়ে অবজ্ঞাভরে উচ্চারণ করল সত্য, আমি অমন ছোটলোক নই। তবে মনে রেখো আর কোনদিন যেন–

কী বললি? আর কোনদিন যেন? গলা টিপলে দুধ বেরোয় এক ফোঁটা মেয়ে, তার এত বড় কথা! মেরে তোকে তুলো ধুনতে পারি তা জানিস?… সদি লক্ষ্মীছাড়ি, আন দিকি একখানা চ্যালাকাঠ, কেমন করে বৌ ঢিট করতে হয় দেখাই ত্রিজগৎকে। চ্যালাকাঠ পিঠে পড়লেই তেজ বেরিয়ে যাবে।

মারো না দেখি, তোমার কত চ্যালাকাঠ আছে!

বলে দৃপ্তভঙ্গিতে সোজা শাশুড়ীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকে সত্যবতী নির্ভীক দুই চোখ মেলে।

জীবনে অনেকবার রেগে জ্ঞানহারা হয়েছেন এলোকেশী, অনেকবার বুক চাপড়েছেন শাপমন্যি দিয়েছেন দাপাদাপি করেছেন, কিন্তু আজকের মত অবস্থা বোধ হয় তার জীবনে আসে নি।

এ অবস্থা যে তার কল্পনার বাইরে, স্বপ্নের বাইরে। তাই সহসা যেন নিথর হয়ে গেলেন তিনি, সাপের মত ঠাণ্ডা চোখে শুধু তাকিয়ে রইলেন সেই দুঃসাহসের প্রতিমূর্তির দিকে।

ঠিক এই অবস্থায় থাকলে কতক্ষণে কি হত বলা শক্ত, কিন্তু ভাগ্যের কৌতুকে আর এক অঘটন ঘটে গেল।

এই নাটকীয় মুহূর্তে উঠোনের বেড়ার দরজা ঠেলে বাড়িতে এসে ঢুকল নবকুমার। ঢুকেই যেন বজ্রাহত হয়ে গেল।

এ কী পরিস্থিতি।

সহস্র সাপের ফণার মত একরাশ চুলের ফণায় ঘেরা সম্পূর্ণ খোলামুখে এলোকেশীর মুখোমুখি অগ্নিবর্ষী দুই চোখে সোজা তাকিয়ে যে মেয়েটা দাঁড়িয়ে রয়েছে, কে ও?

নবকুমারের বৌ নাকি?

কিন্তু তাই কি সম্ভব?

আকাশ থেকে বাজ পড়ছে না, পৃথিবীর মাটি ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে না, এমন কি প্রলয়ঙ্কর একটা ঝড়ও উঠছে না, অথচ নবকুমারের বৌ নবকুমারের মার সামনে অমনি করে দাঁড়িয়ে আছে?

আর নবকুমার ঢুকে হাঁ করে দাঁড়িয়ে পড়া সত্ত্বেও দৃকপাতমাত্র করছে না?

অসম্ভব! অসম্ভব!

এ অন্য আর কেউ!

নবকুমারের অজানিত পড়শীবাড়ির মেয়ে। হয়তো ভয়ঙ্কর কোন একটা কিছু ঘটেছে ওদের সঙ্গে।

নবকুমার গলাখাকারি দিতে ভুলে যায়, সরে যেতে ভুলে যায়, স্তম্ভিত বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। বিপদ যে ঘোরতর! অসম্ভব বলে একেবারে নিশ্চিন্ত হতেই বা পারছে কই?

বৌয়ের মুখটা দেখবার সৌভাগ্য কোনদিন না হলেও এই মাসখানেকের মধ্যে কোন না বিশ পঁচিশবার আভাসে ছায়ায় বৌকে দেখতে পেয়েছে সে। যদিও পাছে কেউ দেখে ফেলে বৌয়ের দিকে তাকিয়ে আছে নবকুমার, তাই সেই তাকানোটা পলকস্থায়ী হয়েছে মাত্র।

তবুও ক্যামেরার লেনস্ পলকের মধ্যেই চিরকালের মত ছবি ধরে রাখে।

মুখ না দেখুক, সর্ব অবয়বের একটা ভঙ্গি তো দেখেছে।

আর দেখেছে ওই নীলাম্বরীর আঁচলখানা।

অতএব মনকে চোখ ঠেরে লাভ নেই। চোখ বুজে সূর্যকে অস্বীকার করতে যাওয়া হাস্যকর।

পড়শীবাড়ির কেউ নয়, ওই দৃপ্ত মূর্তি নবকুমারের বৌয়েরই।

যে বৌয়ের উদ্দেশে নবকুমার স্বপ্নে জাগরণে নিঃশব্দ উচ্চারণে ক্রমাগত গেয়েছে, গাইছে, কও কথা মুখে তুলে বৌ, দেখ না চেয়ে চোখ খুলে।

কিন্তু সে কী এই চোখ!

নবকুমার যেমন নিঃশব্দে এসেছিল, যদি পরিস্থিতি দেখে তেমনি নিঃশব্দে সরে পড়ত, তাহলে হয়তো নাটকের এই নাট্য-মুহূর্তটা এমন চূড়ান্তে উঠত না, হয়তো সত্যবতী নির্ভীকভাবে সেখান থেকে সরে যেত, আর এলোকেশী জীবনে যত গালি-গালাজ শিখেছেন, সবগুলো উচ্চারণ করতেন বসে বসে। আর স্বামী-পুত্র বাড়ি ফিরলে বৌয়ের এই মারাত্মক দুঃসাহস আর ভয়ঙ্কর দুর্বিনয়ের কাহিনী বিস্তারিত বর্ণনায় পেশ করতেন। তারপর গড়িয়ে যেত ব্যাপারটা।

কিন্তু নির্বোধ নবকুমার সেইখানেই দাঁড়িয়ে রইল হাঁ করে।

আর এক সময়ে এলোকেশীর চোখ গিয়ে পড়ল তার ওপর। দাওয়ার উপর তিনি, নিচে উঠোনে ছেলে।

নবকুমারকে এভাবে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এলোকেশীও একবার হাঁ হয়ে গেলেন, তারপর সহসা সেই এতক্ষণের স্তব্ধ হয়ে থাকা হাঁ থেকে ভয়ঙ্কর একটা চিৎকার উঠল, ওরে লক্ষ্মীছাড়া হতভাগা মেনিমুখো ছোঁড়া, পায়ে কি তোর জুতো নেই? জুতিয়ে জুতিয়ে ওর মুখটা যদি জন্মের শোধ ছেঁচে শেষ করে দিতে পারিস, তবে বলি বাপের বেটা বাহাদুর!

কিন্তু নবকুমার নিশ্চল।

পরক্ষণেই সুরফেৰ্তা ধরলেন এলোকেশী, ওগো মাগো, কোথায় আছি দেখ গো, বেতা বেটা-বৌ দুজনে মিলে কী অপমান্যিটা করছে আমায়! ওরে নবা, বামুনের গরু, ছোটলোকের মেয়ে বিয়ে করে তুইও কি ছোটলোক হয়ে গেলি? দু পায়ে খাড়া দাঁড়িয়ে মায়ের অপমানটা দেখছিস? তবে মার মার, ঝাটা আমাকেই মার। ঝাটা খাওয়াই উপযুক্ত শাস্তি আমার। নইলে এখনো ওই বৌকে ভিটের বুকে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দিই? মাথা মুড়িয়ে ঘোল ঢেলে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিই না? ওগো মাগো, বৌ আমায় ধরে মারে আর তাই আমার ছেলে দাঁড়িয়ে দেখে!

এতক্ষণে নবকুমার বোধ করি চেতনা ফিরে পায়, আর ফিরে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চোঁ চোঁ দেড় মারে সেই খোলা দরজাটা দিয়ে।

.

খিড়কির ঘাটে বাসন মাজছিল সদু, ঘাটের পাশ দিয়ে নবকুমারকে উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়োতে দেখে দাঁড়িয়ে উঠে ছাইমাখা হাতটাই নেড়ে ডাক দেয়, নবু, কি হল রে? অ নবু, অমন করে ছুটছিস কেন?

নবকুমার প্রথমটা ভাবল পিছুডাকে সাড়া দেবে না, ছুটে একেবারেই নিতাইয়ের বাড়ি গিয়ে পড়বে, তারপর বলবে, জল দে এক ঘটি।

কারণ নিতাই হচ্ছে তার সবচেয়ে অন্তরঙ্গ বন্ধু। বিচলিত অবস্থায় তার কাছেই যাওয়া চলে।

কিন্তু সৌদামিনীর উত্তরোত্তর ডাকে কি ভেবে থমকে দাঁড়াল, ফিরল, তারপর গুটি গুটি এসে ঘাটের পাশে একটা ঝড়ে-পড়া তালগাছের গুঁড়ির ওপর বসে পড়ে রুদ্ধকণ্ঠে বলল, আমি আর বাড়ি ফিরব না সদুদি।

কথার ছিরি শোন ছেলের! হল কি তাই বল?

সর্বনাশ হয়েছে সদুদি!

আরে গেল যা! সর্বনাশের কথা বলতে আছে নাকি?

হলে বলতে আছে বৈকি।

সদু নবকুমারের প্রকৃতির সঙ্গে পরিচিত, তাই বেশি ভয় না পেয়ে বলে, কেন, তোর মা হঠাৎ চড়ি ওল্টালো নাকি?

মা নয় সদুদি, মা নয় আমিই। জানি না, ঠিক বলতে পারছি না, আমি সত্যি বেঁচে আছি কিনা!

গায়ে চিমটি কেটে দেখ। বলে পুকুরের জলে হাত ডুবিয়ে ডুবিয়ে ছাই মাটি ধুতে ধুতে বলে সদু, মামী বুঝি রণচণ্ডী হয়ে তেড়ে এসেছিল?

জানি না।

জানিস না? ন্যাকামি রাখ দিকি নবু, হয় কি হয়েছে তাই বল, নয় যে দিকে যাচ্ছিলি সেই দিকে যা। বেটাছেলে না মেয়েমানুষ তুই?

সদুদি, যে দৃশ্য দেখে এসেছি, তা দেখলে অতি বড় বীর বেটাছেলেরও পেটের ভেতরে হাত পা সেঁধিয়ে যায়।

নাঃ, তোর দেখছি আর গৌরচন্দ্রিকে শেষ হয় না। বলবি তো বল, না বলবি তো যা। ভূত দেখেছিস, না ডাকাত পড়া দেখেছিস তাও তো জানি না।

নবকুমার বুকে বল করে কণ্ঠে শব্দ আনে, ঝপ করে বলে ওঠে, মাতে আর তোমাদের বৌতে মারামারি করছে!

কি করছে মাতে আর বৌতে? চমকে উঠে বলে সৌদামিনী।

বললাম তো, মারামারি করছে!

সৌদামিনী এক মুহূর্ত স্তব্ধ থেকে তারপর বলে, মারামারি কথাটা বলছিস কেন, মামী বৌকে ধরে ঠেঙাচ্ছে, তাই বল! আর সেই দৃশ্য দেখে তুই মদ্দ পুরুষ কাছা-কোঁচা খুলে ছুট মারছিস! কেন তুই মেয়েমানুষ হয়ে জন্মাস নি নবু তাই ভাবি। যাই দেখি ইতিমধ্যে কি এমন ঘটল। এই তো খানিক আগে বাসনের পাঁজা নিয়ে বেরিয়ে এলাম দেখলাম মামী বেটার বৌয়ের চুল বাঁধছে, ইতিমধ্যে হলটা কি?

আমি তো এই ঢুকলাম বাড়িতে। তুমি শীগগির যাও সদুদি।

যাই। বাবা পলকে প্রলয়, তিল থেকে তিলভাণ্ডেশ্বর! কি হল এক্ষুনি?

সৌদামিনী তাড়াতাড়ি বাসনগুলো ধুয়ে নিতে থাকে।

আমি আজ নিতাইদের বাড়িতেই থাকব সদুদি। এই চললাম।

সৌদামিনী ভুরু কুঁচকে বলে, কদিন পরের বাড়িতে থাকবি?

যতদিন চলে।

তার মানে নিজে গা বাঁচিয়ে কেটে পড়বি, আর পরের মেয়েটা, দুধের মেয়েটা তোর মার হাতে পড়ে মার খাবে!

পরের মেয়ে এবং দুধের মেয়ে শব্দটায় নবকুমারের বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে, চোখে জল এসে যায়। কষ্ট গোপন করে বলে, তা আমি আর কি করব!

সৌদামিনী আড়চোখে একবার ওর মুখচ্ছবি দেখে নিয়ে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলেন, দৃশ্য দেখে চলে এলে পারতিস, তুই দেখছিস জানলে যতই হোক নিজেকে একটু সামলে নিত মামী, একেবারে শেষ করে ফেলত না। যাই দেখি ছুঁড়ি বাঁচল কি মরল!

নবকুমার লজ্জা ত্যাগ করে সহসা বলে ওঠে, যাই বল সদুদি, যা দেখলাম ও তোমাদের বৌটি পড়ে মার খাবার মেয়ে নয়।

আমারও তাই মনে হয়, বলে সদু সকৌতুকে একটু হেসে বলে, মারামারি না করুক, পড়ে মার খাবে না। তাই তুই তো বলতেই পারলি না হয়েছেটা কি?

গোড়া থেকে কি কিছু জানি ছাই। বাড়ি ঢুকেই দেখি দাওয়ায় দু প্রাণী সুমুখোমুখি দাঁড়িয়ে। একজন সাপিনীর মত ফুঁসছে, আর একজন বাঘিনীর মতন গজরাচ্ছে।

সৌদামিনী হেসে উঠে বলে, বা রে, তুই তো অনেক নাটুকে কথা শিখেছিস দেখছি! যাক কালে-ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। তোর বৌও খুব পণ্ডিত।

বৌয়ের গল্প কান ভরে শুনতে ইচ্ছে করে নবকুমারের, ভুলে যায় এইমাত্র তাকে বাঘিনীর সঙ্গে তুলনা করেছে সে নিজেই। কিন্তু গল্প বাড়বে কি উপায়ে? নবকুমার তো আর কথা ফেলে বাড়াতে পারে না?

শুধু ভাবে, কালে-ভবিষ্যতে!

সে কত কাল?

কোন ভবিষ্যৎ?

বাঘিনীর মুখটা বার বার মনে ধাক্কা দিচ্ছে। ভয়ঙ্কর, কিন্তু সুন্দর! কী বড় বড় চোখ, কী চমৎকার জোড়া ভুরু!

কিন্তু বৌও মায়ের মত রাগী হবে হয়তো। লজ্জায় কুণ্ঠায় বিগলিত বৌটি মাত্র থাকবে না। নবকুমারের কল্পনার সঙ্গে ঠিক খাপ খাচ্ছে কি?

ঠিক যেন কি একটা লোকসানের দুঃখে বুকটা টনটন করে ওঠে নবকুমারের।

কাদার পুতুলের মত একটি নিরীহ ভালমানুষ বৌ নবকুমারের ভাগ্যে জুটলে কি এসে যেত ভগবানের! কত লোকেরই তো তেমন বৌ হয়!

কিন্তু সাপের ফণার মত চুলের ফণায় ঘেরা ওই মুখখানি।

ওতে যেন আগুনের আকর্ষণ।

নবকুমার পতঙ্গ মাত্র।

সৌদামিনী বলে, বিবাগী হয়ে যাচ্ছিলি তো যা, মেলা রাত করিস নে হাঁড়ি আগলে বসে থাকতে পারব না।

হাঁড়ি!

রান্না!

ভাত!

এসব শব্দগুলো কাজে লাগবে আজ! নবকুমারের যেন বিশ্বাস হয় না। ভয়ে ভয়ে বলে, আছি এখানটায় আমি– তুমি, তুমি একবার দেখে এসে খবরটা আমায় দিতে পার না সদুদি? নিশ্চিন্দি হয়ে তা হলে আমাদের তাসের আড্ডায় যেতে পারি।

ওরে আমার কে রে, উনি বাবু বসে থাকবেন, আর আমি ওঁর জন্যে খবরের থালা বয়ে আনব!

বলে থালা-বাসনের গোছাটা বাগিয়ে কাঁধের ওপর তুলে নেয় সদু। হাতে গামছার পুঁটুলিতে ঘটিবাটি। চলে যেতে যেতে ছোট ভাইকে আর একবার অভয় দেয় সে, বৌয়ের চিন্তে করে মনখারাপ করিস নে, নেহাৎ যদি মামী খুন করে ফাঁসির দায়ে না পড়ে তো ওই বৌয়ের দ্বারাই শায়েস্তা হবে। বৌ তোর যেমন তেমন মেয়ে নয়।

যদি খুন না করে!

যদিটা নবকুমারের বুকের মধ্যে কাঁটার মত খচখচিয়ে ওঠে, কিন্তু প্রশ্ন তুলতে পারে না, শুধু ম্রিয়মাণ হয়ে বসে থাকে।

সন্ধ্যে হয়ে আসছে, এখেনে আর বসে থাকতে হবে না, যা কোথায় যাচ্ছিলি ঘুরে আয়।

সদু লম্বা লম্বা পা পেলে বাঁশবাগানের খানিকটা অতিক্রম করে। কিন্তু নবকুমার আবার পিছু নিয়েছে। উদ্ভ্রান্ত মুখ, ছলছল চোখ।

সদুদি, তোমার সঙ্গে আমি যাব?

সদু মৃদু হেসে পা চালাতে চালাতেই বলে, কেন, এই যে বললি আর কখনো বাড়ি ফিরবি না?

মনটা কি রকম যেন করছে সদুদি! বলে সঙ্গে সঙ্গে এগোতে এগোতে নবকুমার হঠাৎ সুর বদলায়, বৌ যদি মাকে অপমান করে থাকে, তারও শাস্তি করা দরকার।

গায়ে পড়ে কাউকে অপমান করবার মেয়ে সে নয় নবু, সেদিকে তুই নিশ্চিন্দি থাক। তবে কেউ যদি গা পেতে অপমান নিতে যায় সে আলাদা কথা। আসল কথা কি জানিস, বৌ হল উঁচু ঘরের মেয়ে, শিক্ষাদীক্ষা উঁচু, লেখাপড়া জানে, বড় বড় বই পড়ে ফেলে, নিজে পয়ার বাঁধে।

অ্যাঁ!

স্থানকাল ভুলে নবকুমার প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে, মস্করা করছ আমার সঙ্গে?

কি দরকার আমার? আকাশ থেকে কথা পেড়ে বলতেই বা যাব কি করে? আর ওসব আমি বুঝিই বা কি? বৌ আমার কাছে মনটা খোলে তাই টের পেয়েছি।

সদুর কাছে মনটা খোলে!

হায়, কবে সেই আকাক্সিক্ষত স্বর্গসুখ আসছে নবকুমারের ভাগ্যে, যেদিন নবকুমারের সামনে বৌ মন খুলবে!

সদু আবার মুখ চালায়, তোদের এ বাড়িতে বিয়ে হওয়া ওর উচিত হয় নি, এই বলে দিলাম স্পষ্ট কথা! তুই রাগ করিস আর যাই করিস, এ বাড়ি ওর যুগ্যি নয়! মামীর পয়সাই আছে, নজর বলতে আছে কিছু? আর বৌয়ের ছোট নজর দেখার অভ্যেসই নেই। এই তো সেদিন মামী পাড়ার লোকের গয়না বাধা রেখে টাকা ধার দিয়ে সূদ নেয় শুনে যেন হিমাঙ্গ হয়ে গেল বৌ!

নবকুমার বিরক্ত স্বরে বলে, তা ওসব কথা বলতে যাবারই বা দরকার কি?

বলতে আমি যাই নি রে বাপু তোর বৌয়ের কান ধরে। ওর সামনেই ঘোষগিন্নী একজোড়া বাজু বন্দুক নিয়ে দৈ-দস্তুর করতে লাগল। সে বলে টাকায় এক পয়সা, মামী বলে টাকায় দেড় পয়সা, এই আধপয়সা নিয়ে ধস্তাধস্তি। শেষ অবধি

শেষ অবধি কি হল তা আর শোনা হল না নবকুমারের, সহসা বাড়ির মধ্যে থেকে ভয়ঙ্কর একটা চিৎকার-রোল ভেসে এল।

সর্বনাশ করেছে

সদুর নিষেধবাণী ভুলে নবকুমার সর্বনাশ শব্দটাই আবারও ব্যবহার করল, নিশ্চয় হয়ে গেল একটা কিছু!

সদু ততক্ষণে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়েছে।

আর নবকুমার?

সে চলৎশক্তি হারিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে নিজেদেরই বাড়িখানার দিকে তাকিয়ে।

তীক্ষ্ণ তীব্র সানুনাসিক এই স্বরটা কার?

এ তো এলোকেশীর!

তবে হলটা কি?

কিন্তু যাই ঘটুক, সব কিছু ছাপিয়ে নবকুমারের প্রাণটা হাহাকারে ভরে উঠল এই ভেবে– এই অ-সাধারণ বৌ নিয়ে ঘর করা হল না নবকুমারের অদৃষ্টে!

মা হয় বৌকে মড়িপোড়ার ঘাটে পাঠাবে, নয় জন্মের শোধ বাপের বাড়ি বিদেয় করে দেবে।

মার চিৎকার উত্তরোত্তর আকাশে উঠছে।

আর দলে দলে পড়শীরা নবকুমারের বাড়ির দিকে দৌড়চ্ছে।

নবকুমার যাত্রাগানের দর্শকের মত পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে সেই দৃশ্য!

২১. ত্রিবেণীর ঘাটে এসেছিলেন রামকালী

ত্রিবেণীর ঘাটে এসেছিলেন রামকালী। রোগী দেখতে নয়, যোগে গঙ্গাস্নান করতে। একাই আস্ত একটা পারানী নৌকা ভাড়া করেছিলেন স্নানের জন্যে। পাঁচজনের সঙ্গে ঠেলাঠেলি করে নৌকা বোঝাই হয়ে। যেতে রামকালী ভালবাসেন না। দরকার হলে একাই ভাড়া করেন।

আগে অবশ্য এমন নৌকাভ্রমণ সহজ হত না। কারণ রামকালী যোগের স্নান করতে ত্রিবেণী যাচ্ছেন, কি কাটোয়া যাচ্ছেন, কি নবদ্বীপ যাচ্ছেন টের পেলে সত্যবতী একেবারে নাছোড়বান্দা হয়ে পেয়ে বসত। পায়ে পায়ে ঘুরে কাকুতি-মিনতি-করা মেয়েকে রামকালী এড়াতে পারতেন না, সঙ্গে নিতেন। অগত্যাই নেড়ু আর পুণ্যি। ওদের ফেলে রেখে শুধু নিজের মেয়েকে নিয়ে কোথাও যাবেন, এমন দৃষ্টিকটু কাজ রামকালীর পক্ষে সম্ভব নয়।

ওরা যেত।

রামকালী জলে সাবধান করতেন। আর স্নানের শেষে ঠাকুর-দেবতা দেখিয়ে নিয়ে ফিরতেন। ঘাট আর পথ, নৌকা আর মন্দির-প্রাঙ্গণ মুখর হয়ে উঠত ছোট্ট একটা বাক্যবাগীশ মেয়ের বাক্যস্রোতে।

আজকে শুধু জলের উপর দাঁড়টানার ছপাৎ ছপাৎ শব্দ। উন্মুক্ত গঙ্গাবক্ষের দিকে তাকিয়ে ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেললেন রামকালী।

আকাশের পাখিটা খাঁচায় বন্দী হয়ে কেমন আছে কে জানে!

পুণ্যিটার বিয়ের ঠিক হয়ে আছে।

গত ক-মাস অকাল ছিল বলে বিয়ে হয়নি। কিন্তু পুণ্যি অন্য ধরনের মেয়ে। নেহাৎ সত্যর “প্রজা” হিসেবে দস্যিচাল্লি করে বেড়িয়েছে, নচেৎ একান্তই ঘরসংসারী মেয়ে সে। খাঁচার পাখি হয়েই জন্মেছে পুণ্যি আর পুণ্যির মত মেয়েরা।

কিন্তু সত্যর মত দ্বিতীয় আর একটা মেয়ে আর দেখলেন কই রামকালী? যে মেয়ে প্রতি পদে প্রশ্ন তুলে জানতে চায় “কী” আর “কেন”!

খোলা গঙ্গার দিকে তাকিয়ে আর একবার মনে হল রামকালীর, কতদিন যোগে স্নান করি নি। মনে হচ্ছে যেন দীর্ঘকাল। আর একটা নিঃশ্বাস পড়ল।

মাঝিটা একবার কথা কয়ে উঠল, খুকী শ্বশুরঘরে কত্তাবাবু?

রামকালী বললেন, হুঁ।

আর বার দুই ছপাৎ ছপাৎ করে ফের মাঝিটা বলে উঠল, থাকবে এখন?

সংক্ষেপে “দেখি” বলে আলোচনায় ইতির সুর টানলেন রামকালী। পুণ্যির বিয়ে আসছে, এই যা একটু আশার আলো দেখা যাচ্ছে, নইলে থাকবে ছাড়া আর কি। চিরকালই থাকবে সেখানে। আর সেইটাই তো কাম্য। মোক্ষদার মত অনবদ্য রূপ আর অশেষ তীক্ষ্ণতা নিয়ে আজীবন বাপের ঘরে বসে জ্বলতে থাকবে, এমন ভাগ্য কেউ মেয়ের প্রার্থনা করে না। ঘরে থাকা মেয়ে মানেই দুর্ভাগা মেয়ে। অথচ মাঝে মাঝে পালেপার্বণে কি ভাত-পৈতে-বিয়েয় কুটুম্বের মত যে আসা, সে আসায় মায়ের প্রাণ ভরতে পারে, বাপের ভরে না। অতএব তাতে ইতি হয়ে গেছে।

কিন্তু শুধু মেয়ে-সন্তান কেন, পুত্র-সন্তান হলেই বা কতটুকু তফাৎ? ছেলে ঘরে থাকে, ছেলের ওপর জোর খাটে, এই পর্যন্ত। ছেলে বড় হয়ে গেলে আর কি তাকে নিয়ে মন ভরে? তাই হয়তো মানুষ জীবনের মধ্যে বারে বারে নতুন শিশুকে ডেকে আনে জীবনকে সরস রাখতে, ভরাট রাখতে। আবার তার পরেও আশ্রয় খোঁজে টাকার সুদের মধ্যে।

.

নিত্যানন্দপুর ঘাট থেকে ত্রিবেণী ঘাট সামান্য পথ।

মাঝি নৌকা বাধল।

আর ঘাটে নেমেই প্রথম যার সঙ্গে চোখাচোখি হল রামকালীর, সে হচ্ছে “রানার” গোকুল দাস। দূর থেকে রামকালীকে নামতে দেখে ছুটে ছুটে আসছে সে।

কাদার উপরই আভূমি এক প্রণাম করে কৃতার্থম্মন্য গোকুল সবিনয় হাস্যে বলে, আজ আমার কী ভাগ্যি কত্তাবাবু, কী ভাগ্যি!

রামকালী মৃদু হেসে বলেন, সক্কাল বেলা হঠাৎ ভাগ্যের এত জয়-জয়কার যে গোকুল!

গোকুল বলে, তা জোকার দেব না আজ্ঞে? এই আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল, নইলে তো যেতে হত সেই নিত্যেনন্দপুরে। এই নিন, পত্তর আছে আপনার।

পত্র!

কলকাতা থেকে আসছে! অভাবনীয়!

বিস্মিত হলেন রামকালী, কিন্তু বিস্ময় প্রকাশ করলেন না। খামে আঁটা চিঠিটা নিজের পরিত্যক্ত গাত্রবস্ত্রের উপর রেখে দিয়ে বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে। ভাল তো সব?

আপনাদের আশীৰ্বাদে আজ্ঞে। বলে ঈষৎ উসখুস করে গোকুল বলে ফেলে, কলকাতার চিঠি আজ্ঞে?

তাই তো দেখছি, বলে রামকালী গামছা কাঁধে ফেলে জলে নামেন। প্রথম সূর্যের কাঁচা রোদ ঝলসে ওঠে কাঁচা সোনার রঙের দীর্ঘ দেহখানির উপর। গোকুল হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। থাকতে থাকতে মনে মনে ভাবে–ইস, যেন আকাশের দেবতা! কী দিব্য অঙ্গ!

পত্রের কথা মন থেকে সরিয়ে ফেলে, যথাকৃত্য সব সেরে উত্তরীয়ের কোণে পত্ৰখানা বেঁধে মন্দির-দর্শনে অগ্রসর হলেন রামকালী। অগত্যাই গোকুল আর একটা সাষ্টাঙ্গ প্রণাম সেরে বিদায় নিল। কলকেতা থেকে কার পত্র এল সে কৌতূহল আর মিটল না তার।

.

নৌকোয় বসে চিঠি খুললেন রামকালী। আর পড়ে স্তব্ধ হয়ে গেলেন।

এই সকলের আলো তার সমস্ত উজ্জ্বলতা হারিয়ে যেন আসন্ন সন্ধ্যার মত মলিন হয়ে গেল। সদ্য গঙ্গাস্নানে নির্মল রামকালী যেন একটা অপবিত্র দ্রব্যের সংস্পর্শে এসে নিজেকে অশুচি বোধ করলেন।

চিঠি কোন পরিচিতের নয়। অজ্ঞাত ব্যক্তির। তাছাড়া নিচে কোন নাম-দস্তখতও নেই।

বেনামী এই চিঠিতে শুধু সম্বোধনের বাগাড়ম্বর অনেক। কিন্তু সেটাই তো কথা নয়। চিঠির বক্তব্য এ কী ভয়ঙ্কর।

বার বার পড়ার পর আরও একবার চিঠিখানা সামনে মেলে ধরলেন রামকালী।

হস্তাক্ষর সুঁছাদের, লাইনগুলি পরিপাটি, বানান বিশুদ্ধ। কোন “লিখিত পড়িত” লোকের দ্বারা লেখা, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই; উপরে শ্রীশ্রীবাগদেবী শরণং দিয়ে শুরু

মহামহিমার্ণব শ্রীল শ্রীযুক্ত রামকালী চট্টোপাধ্যায় বরাবরেষু– যথাযোগ্য-সম্মান-পুরঃসর নিবেদনমেতৎ, অত্রপত্রে এই জ্ঞাত করাই যে, মহাশয়ের কন্যার অতীব বিপদ! তিনি তাহার শ্বশ্রূগৃহে যারপরনাই লাঞ্ছিতা উৎপীড়িতা ও অপমানিতা রূপে কালযাপন করিতেছেন। বলিতে মন শিহরিত ও কলেবর কম্পান্বিত হইলেও জ্ঞাতার্থে লিখিতেছি, আপনার কন্যা তাঁর পূজনীয়া শ্বশ্রূমাতা কর্তৃক প্রহারিতাও হইতেছেন। সেই অবলা বালিকাকে রক্ষা করে নিষ্ঠুর পাষাণপুরীতে এমন কেহই নাই। আপনার জামাতা ধর্মপত্নীর এবম্বিধ নির্যাতনে অবিরত অশ্রু বিসর্জন সার করিয়াছে। গুরুজনদিগের উপর তাহার আর কি বলিবার সাধ্য আছে? এবম্প্রকার অবস্থায় মহাশয় যদি সত্বর কন্যাকে নিজগৃহে লইয়া যান তবেই মঙ্গল নচেৎ কি যে হইতে পারে চিন্তা করিতে মস্তক ঘূর্ণিত হইতেছে। মনুষ্যজনোচিত কর্তব্য বোধে ইহা আপনার গোচরে আনিলাম। নিজ গুণে ধৃষ্টতা মার্জনা করিয়া কৃতার্থ করিবেন। অলমতিবিস্তরেণ। ইতি–

না, নাম-স্বাক্ষর নেই।

পত্র-লেখকের বাচালতা বা বাগাড়ম্বরে কৌতুক বোধ করবেন, এমন মানসিক অবস্থা থাকে না রামকালীর। চিঠিটা আস্তে আস্তে মুড়ে মেরজাইয়ের পকেটে রেখে দিয়ে এই রৌদ্রকরোজ্জ্বল পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে থাকেন তিনি।

এত আলো পৃথিবীতে, তবু পৃথিবীর মানুষগুলো এত অন্ধকারে কেন?

কিন্তু কে এই পত্র-লেখক?

সত্য শ্বশুরবাড়ির কোন শত্রু? এভাবে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে পত্র লিখে তাঁদের অনিষ্টসাধন করতে চায়? কিন্তু তাহলে চিঠিতে কলকাতার ছাপ কেন? কলকাতা থেকে এ চিঠি আসে কি করে?

ভেবে ভেবে অবশ্য একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন রামকালী। পত্র-লেখকের অবশ্যই কলকাতায় যাতায়াত আছে, এবং নিজেকে গোপন রাখতে কলকাতায় অবস্থানকালে পত্র প্রেরণ করেছে।

তবু একটা সমস্যা থেকেই যায়। পত্রের মধ্যস্থিত ওই বীভৎস সংবাদটা সত্যি, না শত্রুপক্ষের মিথ্যা রটনা?

রামকালী কি একেবারে নিজে গিয়েই তদন্ত করবেন, না লোক পাঠাবেন? বাইরের লোক গিয়ে কি ভিতরকার প্রকৃত তথ্য আবিষ্কার করতে পারবে? এক যদি কোন স্ত্রীলোককে পাঠানো যায়!

যারা বারো মাস রামকালীর সংসারে খেটে খায়, চিড়ে-কোটানি মুড়ি-ভাজুনি ইত্যাদি, তাদেরই কারো একজনকে একটা সঙ্গী ও রাহাখরচ দিলে খবর এনে দিতে পারে। পল্লীগ্রামে সচরাচর এরাই কাজ করে। কিন্তু রামকালীর ওদের কথা ভেবে চিত্ত বিমুখ হল। কোন খবর ওরা জানা মানেই সাতখানা গ্রামের লোকের জানা। ঈশ্বর জানেন কী খবর আনবে, আর সেই নিয়ে সারা গ্রামে আলোচনা চলবে।

মনে হল সত্য যদি নিজে চিঠি লিখত!

চিঠি লেখবার মত বিদ্যে সত্য অর্জন করেছে। কিন্তু করে আর লাভ কি? পিত্রালয়ে নিজের খবর জানিয়ে চিঠি দেবে এমন সাধ্য বা সাহস তো হবে না। তবে আর মেয়েদের লেখাপড়া শিখে লাভ কি?

বুকের মধ্যেটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠল স্থিতপ্রজ্ঞ রামকালী কবরেজের। চোখের সামনে ভেসে উঠল সত্যর সেই দৃপ্ত মুখচ্ছবি। সেই সত্য পড়ে মার খাচ্ছে! এ যে বিশ্বাস করা একেবারে অসম্ভব!

না না, এ মিথ্যা চিঠি।

শত্রুপক্ষের কাজ।

নইলে কেনই বা? ভাবলেন রামকালী, সত্যর ওপর নির্যাতন চালাবে কেনই বা? অকারণ এত হিংস্র কখনো হতে পারে মানুষ? তাছাড়া শুধু তো শাশুড়ী নয়, তার শ্বশুর রয়েছেন। হাজার হোক একটা ভদ্ৰব্যক্তি, তাঁর জ্ঞাতসারে এ রকমটা হওয়া কখনই সম্ভব নয়। আর বাড়ির লোকেরও অজ্ঞাতসারে যদি কোন পীড়ন চলে, পাড়ার লোকে টের পাবে কি করে?

আবার ভাবলেন রামকালী, সত্যবতী তাদের একমাত্র পুত্রবধূ। বিনা প্রতিবাদে রামকালী তাকে শ্বশুরঘর করতে পাঠিয়ে দিয়েছেন, তার সঙ্গে ঘরবসত হিসাবে প্রচুর সামগ্রী পাঠিয়েছেন, যাতে অন্তত শাশুড়ীর মন ভোলে। তবু তারা সত্যকে নির্যাতন করবে?

তাই কখনও সম্ভব?

বললে দোষ, ভাবতে বাধা নেই, মেয়ের বিয়ের সময় ঘটক আনীত নানা পাত্রের মধ্যে এই পাত্রটিকেই পছন্দ করেছিলেন রামকালী, কেবলমাত্র তাদের পরিবারের লোকসংখ্যা কম বলে। সেই শৈশব থেকেই লক্ষ্য করেছেন, তাঁর মেয়ে জেদী তেজী অনমনীয়। বৃহৎ গোষ্ঠীর অনেকের মন যুগিয়ে চলা হয়তো তার পক্ষে সহজ হবে না, সে বোধ রামকালীর ছিল, তাই ভেবেছিলেন এখানেই ভালো। বাপের একমাত্র ছেলে? দোষ কী? সত্যও তো তার বাপের একমাত্র মেয়ে!

ঘরজামাইয়ের সাধ একেবারেই ছিল না রামকালীর। শুধু এইটুকু মনে মনে ভেবেছিলেন, ছেলেটা যেন নেহাত রাঙামূলো না হয়। লেখাপড়ার একটু ধার যেন ধারে। তা সে সাধটুকু মিটেছিল রামকালীর, মিটছিলও। জামাই তখনই ছাত্রবৃত্তি পাস, টোলে সংস্কৃত শিখছে।

তারপর লোক-পরম্পরায় শুনেছিলেন, জামাই নাকি ইংরেজি ভাষা শিখতে উদ্যোগী হয়েছে। শুনে সন্তুষ্ট হয়েছিলেন রামকালী। নিজে সামনে উপস্থিত না হলেও জামাইয়ের খবর তিনি লোক মারফৎ নিতেন, এবং এটুকু জেনে নিশ্চিন্ত ছিলেন, ছেলেটা কুসঙ্গে মেশে না, বদ খেয়ালের দিকে যায় না।

সবই তো একরকম ছিল, হঠাৎ এ কী বিনামেঘে বজ্রপাত। অ

বশেষে আবার ভাবলেন, এ শত্রুপক্ষের কাজ।

কিন্তু মনের মধ্যে যে আলোড়ন উঠেছিল, সেটাকে একেবারে চেপে ফেলে নিশ্চিন্ত হয়ে থাকতে পারলেন না রামকালী, স্থির করলেন তিনি একবার নিজেই যাবেন বেহাইবাড়ি।

মান খাটো হবে?

তা যেদিন জামাইয়ের হাঁটু ধরে কন্যা-সম্প্রদান করেছেন, সেইদিনই তো মান গেছে। সেকালের মত তো রামকালী মেয়েকে স্বয়ম্বরা করতে পারেন নি।

তাছাড়া একেবারে অকারণ জামাইবাড়ি যাওয়ার অগৌরবটা পোহাতে হবে না। পুণ্যির বিয়েকে উপলক্ষ করে মেয়ে নিয়ে আসতে চাইবেন। সেই সঙ্গে জামাই-বেহাইকেও নিমন্ত্রণ করে আসা হবে। রামকালী নিজে গিয়ে নিমন্ত্রণ করছেন, এর চেয়ে সৌজন্য আর কি হতে পারে?

ত্রিবেণী থেকে ফিরে রামকালী দীনতারিণীর কাছে সংকল্প ঘোষণা করলেন, মনে করছি একবার বারুইপুর যাব।

বারুইপুর! সত্যর শ্বশুরবাড়ি? দীনতারিণী চমকে উঠে বললেন, কেন, হঠাৎ? সত্যর কোন রোগ-ব্যামো হয় নি তো?

কী আশ্চর্য! রোগ-ব্যামো হবে কেন? রামকালী শান্তভাবে বললেন, ভাবছি পুণ্যিটার বিয়ে হয়ে যাবে, তারপর দুজনে কবে দেখাসাক্ষাৎ হয় না হয়, গলাগলি বন্ধু দুটোতে। বিয়ের আগে কিছুদিন একসঙ্গে থাক।

দীনতারিণী ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। এত সহজ ভাষা, এত সহজ কথা! রামকালীর মুখে!

ছেলেকে তো তিনি “পাথরের ঠাকুর” আখ্যা দেন।

.

সহজ কথা। তবু রামকালীর মুখ থেকে উচ্চারিত হয় বলে কেউ সহজভাবে নিতে পারে না।

মোক্ষদা খরখরিয়ে বলেন, এ আর অমনি নয়, লিখিপড়ি-উলি বিদ্যেবতী মেয়ে, নিঘঘাত লুকিয়ে বাপকে চিঠি লিখেছে, বাবা আমায় নিয়ে যাও, আর ঘোমটা দিয়ে থাকতে পারছি নে!

শিবজায়া আনতমুখী ভুবনেশ্বরীর দিকে কটাক্ষপাত করে কাতর-কাতর মুখে বলেন, আমার কিন্তু তা মন নিচ্ছে না ছোটঠাকুরঝি। মনে হচ্ছে কোন কু-খবর আছে, রামকালী চাপছেন।

বলা বাহুল্য এর পর আর ভুবনেশ্বরীর ডুকরে কেঁদে ওঠা ছাড়া গতি থাকে না।

ভুবনেশ্বরীর একমাত্র অন্তরের সুহৃদ অসমবয়সী এবং অসমসম্পর্ক হলেও ভাসুরপো- বৌ সারদা। কিন্তু এমনি কপালের দুর্দৈব ভুবনেশ্বরীর যে, সারদা আজ চার মাস কাল বাপের বাড়ি।

দ্বিতীয় সন্তানের আবির্ভাব ঘোষণাতেই তার এই পিতৃগৃহে স্থিতি।

না, সেই এক অন্ধকার রাত্রে রাসুর সঙ্গে কলহ করে ডোবার জলে ডুবে মরেনি সারদা। শুধু অন্য ঘরে ননদের কাছে গিয়ে শুয়েছিল। সে শুধু একটাই রাত। রাতের পর রাত পারবে কেন?

শ্বশুরবাড়ি বৌয়ের রাতটুকুই তো মরুভূমিতে সরোবর। মৃত্যুপুরীর মধ্যে জীবন। যত বড় দুর্জয় মানই হোক, সে মান খাটো না করে উপায় থাকে না তাদের।

সকলেরই তাই। রাত্রে ভুবনেশ্বরীরও কান্নার বেগ অসম্বরণীয় হয়ে ওঠে। রামকালী অপর চৌকি থেকেও সেটা টের পান। কিছুক্ষণ ঘুমের ভান করে চুপচাপ থাকলেও শেষ পর্যন্ত আর চুপ করে থাকা সম্ভব হয় না। মৃদুস্বরে বলেন, অকারণ কাঁদছ কেন?

বলা বাহুল্য, এ প্রশ্নে যা হয় তাই হল।

কান্নার আবেগ আরও প্রবল হল।

রামকালী বলেন, ছেলেমানুষি করো না। এস কাছে এস, কান্নার কারণটা শুনি।

ভুবনেশ্বরী চোখ মুছতে মুছতে উঠেই এল। এসে স্বামীর বিছানার এক প্রান্তে বসে চোখে আঁচল ঘষতে লাগল।

রামকালী ক্ষুব্ধস্বরে বললেন, তুমিও যদি এই সব গিন্নীদের মত হও, তাহলে তো নাচার। অপরাধের মধ্যে বলেছি পুণ্যির বিয়ে উপলক্ষে সত্যকে কিছুদিন আগেই আনব। নিজে গেলে আর ওরা অমত করতে পারবে না। কিন্তু এই সহজ কথাটা না বুঝে সবাই মিলে এমন কাণ্ড করছ যে, মনে হচ্ছে বুঝি কি একটা অমঙ্গলই ঘটে গেছে। আশ্চর্য!

তা কিছু নয়। ভূবনেশ্বরী কষ্টে বলে, মেয়েটার জন্যে প্রাণটা উতলা হচ্ছে তাই–

হচ্ছে ঠিকই। হওয়া স্বাভাবিক। রামকালী স্নেহ-গম্ভীর স্বরে বলেন, তোমার একমাত্র সন্তান। কিন্তু কান্নাকাটি করলেই তো আর কিছু সুরাহা হয় না। মায়ের প্রাণ উতলা হয়, বাপের প্রাণেই কি একেবারে কিছু হয় না? আর একটু ক্ষুব্ধ হাসি হাসলেন রামকালী।

ভুবনেশ্বরীর পক্ষে এ কথার জবাব দেওয়া সম্ভব নয়।

অপ্রতিভ হয়ে বসে থাকে বেচারা।

একটু পরে রামকালী বলেন, যাও, ভগবানের নাম স্মরণ করে শুয়ে পড় গে। দেখি যদি নিয়ে আসতে পারি।

ভুবনেশ্বরী সহসা আবার কেঁদে ভেঙে পড়ে বলে, আমার মন বলছে ওরা পাঠাবে না।

রামকালী আর কিছু বলেন না, দুর্গা দুর্গা বলে পাশ ফিরে শুয়ে পড়েন। ভুবনেশ্বরী অনেকক্ষণ কেঁদে অবশেষে এসে শোয়।

পরদিন মেয়ের বাড়ি যাত্রার আয়োজন করেন রামকালী।

.

ইংরিজি পড়া আপাতত বন্ধ আছে, কারণ ভবতোষ মাস্টার গ্রামে নেই। ছাত্রদের জন্য সেকেণ্ড বুক সংগ্রহ করতে কলকাতায় গেছে। নবকুমারের তাই এখন অবসর। কিন্তু হায়, অবসরকে কুসুমমণ্ডিত করে তুলবে, এ ভাগ্য নবকুমারের কই? বাড়িতে যে দু-দণ্ড বিশ্রামসুখ উপভোগ করবে, খাবে মাখবে থাকবে, তারও জো নেই। সেখানে জাগন্ত অবস্থায় যতক্ষণ থাকে ততক্ষণই হৎকম্প হতে থাকে তার।

কিন্তু ঘুমন্তই বা থাকে কতক্ষণ?

রাত্রে এখন আর সেই মহিষ-বিনিন্দিত ঘুম নেই নবকুমারের। বিছানায় শুয়ে ঘুম আসে না, ওঠে, বসে, পায়চারি করে, জল খায়, আবার শোয়, এইভাবে অনেকটা সময় কাটে। দিনের বেলা কর্মহীনের কর্ম, নিষ্কর্মার গতি পুকুরে ছিপ ফেলা।

বন্ধু নিতাই আর সে দুজনে সারা দুপুর সেই কাজটা করে। আজও করছিল। ফাত্মা থেকে চোখ তুলতে হঠাৎ চোখে পড়ল নিতাইয়েরই।

বলল, অমন বাহারে পালকি চড়ে কে আসছে বল্ দিকি?

নবকুমার তাকিয়ে বলল, তাই তো! দিব্যি পালকিখানা! তবে আসছে না বোধ হয়, গাঁ পার হচ্ছে।

বলল কিন্তু দুজনের একজনও চোখ ফেরাতে পারল না।

আর কম্পিত চিত্তে ভীত পুলকে দেখল পালকি তাদের দিকেই আসছে।

নবকুমার বলল, ছিপ ফেলে রেখে চো চো দৌড় দিই আয়।

নিতাই সবিস্ময়ে বলে, কেন, পালাব কেন?

আমার মন বলছে এ পালকি নিত্যেনন্দপুরের।

আঁ! চিনিস বুঝি?

চিনব কেন, অনুমান। মেয়ে নিতে পাঠিয়েছে নিয্যস। নিতাই, আমি পালাই।

নিতাই ওর কোঁচার খুঁট চেপে ধরে বলে, পালাবি মানে? হেস্তনেস্ত দেখবি না?

আর একটু তর্কাতর্কি হয় দুই বন্ধুতে এবং সত্যি বলতে, নবকুমার যতই পালাবার চিন্তা করুক, নড়তেও পারে না। টিকটিকির শিকারী দৃষ্টির সম্মোহনী শক্তিকে আকর্ষিত কীটের মত নির্জীব হয়ে বসে থাকে।

পালকি এই দিকেই আসে, আরোহীর নির্দেশে বেহারারা এখানেই নামায়, এবং আরোহী না নেমেই হাতছানি দিয়ে ডাকেন ওদের। ঘাটের ধার থেকে দুজনেই উঠে আসে কেঁচার খুঁটটা টেনে গায়ে দিতে দিতে।

তোমরা এ গ্রামের?

ভরাট গম্ভীর এই কণ্ঠস্বরে বুক কেঁপে ওঠে দুজনেরই। এবং যদিও নবকুমার শ্বশুরকে চেনে না, বিয়ের সময় তাকিয়ে দেখেও নি, দু-দুবার ষষ্টিবাটায় নেমন্তন্ন করেছিল, অসুখের ছুতো করে যায় নি। ভয়েই যায় নি। তবু তার মন বলতে থাকে, এ সেই! এ সেই!

হ্যাঁ, রামকালীই। তিনি ওদের ঘাড়নাড়া উত্তরের পর আবার বলেন, এ গ্রামের ছেলে, না ভাগিনেয়?

নিতাই এগিয়ে এসে বলে, আজ্ঞে আমি ভাগিনেয়, শ্ৰীযুক্ত কৃষ্ণধন দত্ত আমার মাতুল। আমার নাম নিতাইচন্দ্র ঘোষ। আর এই বাঁড়ুয্যে বাড়ির ছেলে নবকুমার বাঁড়ুয্যে। আমার বন্ধু।

নবকুমার বাঁড়ুয্যে!

রামকালীর দুই চোখে একটা বিদ্যুতের আভা খেলে যায়, নিশ্চিন্ত হন অনুমান ঠিক। আর একবার ভাল করে আপাদমস্তক দেখে নেন ছেলেটার। দেখে নেন ওর মেয়েলী মেয়েলী দুধেআলতা গোলা রং, আলতা-গোলা ঠোঁট, আর রোদে ঝলসানো টুকটুকে লালরঙা মুখ। তার পর নেমে আসেন পালকি থেকে।

গম্ভীরতর স্বরে বলেন, আমি রামকালী চাটুয্যে!

বসে পড়বার একটা সুযোগ পেয়েই বোধ হয় বেঁচে যায় ছেলে দুটো, তাড়াতাড়ি বসে পড়েই রামকালীর চরণ-বন্দনা করে।

থাক থাক বলে উভয়ের মাথাতেই একটু হাতের স্পর্শ দিয়ে রামকালী একবার নিতাইয়ের দিকে দৃষ্টিক্ষেপ করে নবকুমারকে উদ্দেশ করে বলেন, এ যখন তোমার বন্ধু, তখন এর সামনে কথা বলতে বাধা নেই, জিজ্ঞেস করছি, এইভাবে মাছ ধরেই দিন কাটাও নাকি?

নবকুমারের থুতনি বুকে ঠেকে। কিন্তু কায়স্থ বংশধর নিতাই, ওর থেকে অনেক চটপটে চৌকস। আর নিভীকও বটে।

সে তাড়াতাড়ি বলে, না আজ্ঞে, অন্যদিন দুপুরবেলা আমরা মাস্টারের বাড়ি পড়তে যাই। আজ তিনি–

কি পড়তে যাও?

নবকুমার পিছন থেকে প্রবল চিমটি কেটে বন্ধুকে নিষেধ করে যাতে ইংরিজি পড়াটার কথা না বলে ফেলে। বলা যায় না, ম্লেচ্ছ ভাষা অধ্যয়নের সংবাদে ক্ষেপে ওঠেন কিনা এই ভয়ঙ্কর লোকটা!

ভয়ঙ্কর?

অন্তত নবকুমারের তাই লাগছে।

কিন্তু নিতাই নিষেধের মান্য রাখে না। বরং একটু বিনয়-আচ্ছাদিত গর্বিত ভঙ্গীতেই বলে, আজ্ঞে ইংরিজি।

ইংরিজি! তা বেশ। কতদূর পড়েছ?

ফার্স্ট বুক সেকেণ্ড বুক সারা হয়ে গেছে আজ্ঞে। এখন

ভাল, শুনে সুখী হলাম। তা আজ পড়তে যাও নি যে?

প্রশ্নটা নবকুমারকে, তবু উত্তরটা দেয় নিতাই-ই, মাস্টার মশাই বই আনতে কলকাতায় গেছেন।

কলকাতায়! ওঃ! হুঁ। যাক বাবাজী, তোমার সঙ্গে একটা কথা আছে। জানতে চাইছি, গ্রামে তোমাদের কোন শত্রু আছে?

শত্রু!

নবকুমার বিহ্বলভবে তাকিয়ে থাকে।

কোনও শত্রু! এলোকেশীর মতে তো গ্রামসুদ্ধ সকলেই তাদের শত্রু।

হ্যাঁ, শত্রু। মানে যে তোমাদের অনিষ্টকামী। মিথ্যা অপবাদ রটিয়ে তোমাদের ক্ষতি করতে চায়। এমন কোনও লোক আছে মনে হয়?

নবকুমার আস্তে আস্তে নেতিবাচক মাথা নাড়ে, কিন্তু ততক্ষণে নিতাই অন্য উত্তর দিয়ে বসেছে, আজ্ঞে গায়ে তো সবাই সবাইয়ের শত্রু। ওই ওপরেই দেখন-হাসি। আর নবুর মার মেজাজের জন্যে তো

থাক ও কথা–, মৃদু ধমক দিয়ে ওঠেন রামকালী, মেঘমন্দ্র স্বরে বলেন, গ্রামের সকলের হাতের লেখা চেন? বলতে পার এ লেখা কার?

মেরজাইয়ের পকেট থেকে চিঠিখানা বার করে সামান্য একটু মেলে ধরেন রামকালী।

কিন্তু মেলে ধরবার দরকারই বা কি, ওরা তো জানে এ লেখা কার! ভবতোষ মাস্টারের। আর লেখার প্রেরণা নিতাই নিজে। মাস্টারের কাছে হতভাগ্য নবকুমারের ধর্মপত্নীর যন্ত্রণাময় জীবনের কাহিনী দিব্য বিশদ করেই বলেছিল সে, এবং সহসা ভবতোষ মাস্টার ঘোষণা করেছিল, আচ্ছা, আমি এর প্রতিকার সাধনে যত্নবান হব। সাহেবদের দেশে কদাপি কেউ স্ত্রীজাতির প্রতি নির্যাতন সহ্য করে না।

কি, চিনতে পারলে বলে মনে হয়?

দুজনেই প্রবল বেগে মাথা নাড়ে। বলা বাহুল্য নেতিবাচক। হ্যাঁ বলে কে সিংহের মুখবিবরে মাথা গলাতে যাবে?

ঠিক আছে। আমি তোমাদের ওখানেই যাচ্ছি। তোমার বাবা বাড়ি আছেন অবশ্যই!

আছে। অস্ফুট এই শব্দটি এতক্ষণে রামকালীকে নিশ্চিন্ত করে, তাঁর জামাতা বাবাজী বোবা নয়।

পালকি-বেহারাদের ডেকে জনান্তিকে কি যেন নির্দেশ দিয়ে রামকালী বলেন, চল, এটুকু তোমাদের সঙ্গে হেঁটেই যাই।

আমি আজ্ঞে একটু দৌড়ে গিয়ে খবরটা দিয়ে আসি, বলেই বন্ধু নিতাই বিশ্বাসঘাতকের মত নবকুমারকে অথই জলে ফেলে রেখে দৌড় মারে।

রামকালী কয়েক পা অগ্রসর হয়ে সহসা স্বভাব-বহির্ভূত স্বরে একটা প্রশ্ন করে বসেন, আমার মেয়ে কি তোমাদের গৃহে কোন উৎপাত ঘটাচ্ছে?

আঁ–আজ্ঞে, সে–এ কী!

তোতলা হয়ে ওঠে নবকুমার।

না, তাই প্রশ্ন করছি। সে বালিকা মাত্র, অবুঝ হওয়া অসম্ভব নয়।

আঁ–অজ্ঞে! না-না।

কালঘাম ছুটে যায় নবকুমারের। সে গায়ের একমাত্র আচ্ছাদন কোঁচার খুঁটটুকু টেনে কপালের ঘাম মুছতে থাকে।

রামকালী মৃদু হাস্যে বলেন, অধীর হবার কিছু নেই, আমি কৌতূহলপরবশ হয়ে প্রশ্ন করেছিলাম মাত্র। যাক, আমি যার জন্য এসেছি তোমাকে জানাই, কারণ তুমি আমার জামাতা। বাড়িতে একটি শুভ কাজ আসন্ন, সে কারণ আমার নাকে আমি নিয়ে যেতে মনস্থ করেছি। বিবাহের সময় অবশ্য যথারীতি নিমন্ত্রণ আসবে, তুমি এবং তোমার পিতা যাবে। তোমাকে কয়েকদিন থাকবার জন্য মেয়েরা অনুরোধ করতে পারেন, সে সম্পর্কে আমি তোমার পিতা-মাতাকে জানিয়ে যাব। থাকবার জন্যে প্রস্তুত থেকো।

এ সবের আর কি উত্তর দেবে নবকুমার?

ভয়ে আর আনন্দে, আশায় আর উৎকণ্ঠায় তার তো মুহুর্মুহু স্বেদ-কম্পপুলক দেখা দিচ্ছে।

বাড়ির দরজার কাছাকাছি আসতেই নবকুমার সহসা কাতরকণ্ঠে বলে ওঠে, আমি যাই।

কি আশ্চর্য, যাবে কেন?

হ্যাঁ, আমি যাই। নিতাই আছে– বলে এদিক ওদিক তাকিয়ে শ্বশুরের পায়ের কাছে মাটিতে একটা খাবল দিয়ে ছুট মারে নবকুমার।

রামকালী সেদিকে চেয়ে একটা নিঃশ্বাস ফেলেন।

লেখাপড়া শিখছে?

কিন্তু মানুষ হচ্ছে কি?

ঠিক এই সময় নিতাই নবকুমারদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে, আর নীলাম্বর বাঁড়ুয্যে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে একটি সুনিপুণ হাস্য সহযোগে বলেন, বেহাই মশাই যে? কী মনে করে?